পঞ্চম পর্ব
ড্যাড্যাং—ড্যাড্যাং—ড্যারাডাং—ড্যাড্যাং–
আবার বাজল গাজনের ঢাক। চড়কের পাটায় শুয়ে আকাশপানে চেয়ে বনওয়ারী কালারুদ্দকে প্রণাম করলে। যাক। বছর শেষ, বছর শেষ, পরমদয়াল ক্ষ্যাপা বাবার দৌলতে ভাল ভালয় কেটে গিয়েছে কাহারদের বছর। বনওয়ারী যা আশঙ্কা করেছিল, তা ঘটে নাই। কাহারপাড়ায় যুবা প্রবীণ মাতব্বরেরা সকলেই বেঁচে রয়েছে। ‘মিত্যু’ অর্থাৎ মৃত্যু আর হয় নাই। হয়েছে, যেমন হয় যেমন নিয়ম, তেমনি হয়েছে, তার বেশি কিছু নয়। অঘটন ঘটেছে একটি, তাও আটপৌরে-পাড়ায়ওই কালোবউ মরেছে। আর নয়ানও মরেছে হঠাৎ। তা ছাড়া, দুচারটে ছেলে মরেছে ‘ম্যালিরিয়া’ জ্বরে, বুড়ো-বুড়ি মরেছে চার জন—গুপীর মাসি, রতনের মা, প্রাণকেষ্টর কাকা গোবর্ধন—সে লোকটাই ছিল হাবা, আর মরেছে গোপালের পিসে। গোপালের পিসে বাইরের গেরামের লোক, এসে গোপালের ঘাড়ে ভর করেছিল, তাকে ঠিক ধরা যায় না। হিসেবের মধ্যে। ‘কচিকাঁচা’ অর্থাৎ আঁতুড়ের ছেলের মরার হিসেব কেউ কখনও কোনোকালে করে না, শুধু চৌকিদারে জন্মমৃত্যুর খাতায় লিখে নিয়ে যায়, থানায় দাখিল করে, থানায় তার হিসেব থাকে। সে হিসেবও বাজে হিসেব কাহারপাড়ায় চৌকিদার কালে-কস্মিনে আসে, তাও দিনের বেলা, ওই হিসেবের জন্যই আসে। ছেলে মরার হিসেব কেউ মনেও রাখে না, বলতেও ভুল করে। চৌকিদারও সেই ভুল হিসেব মনে মনে আওড়াতে আওড়াতে জাঙলে গিয়ে সদ্গোপ মহাশয়দের কোনো ছেলেকে ধরে লিখিয়ে থানায় ইউনিয়ন-বোর্ডে দাখিল করে।
এবার গাজনে পাগল হাজির আছে। সে ভাল সঙ দিয়েছে। নিজে সেজেছে মহাদেব, দু-পাশে দুটো ছেলেকে সাজিয়েছে দুর্গা আর গঙ্গা। একজন বয়সালা মেয়ে আর একজন যোবতী। বড়কী আর ছুটকী। বনওয়ারীকে ঠাট্টা করেছে। তা কর ভাই পাগল, তা কর। বনওয়ারীরও বেশ ভালই লাগছে।
বনওয়ারী সেদিনের সেই মজলিসের কথামত কালোশশীর বোনঝিকে সাঙা করেছে। তার ঘরেও এখন দু বউ। বড়কী আর ছুটকী—গোপালীবালা আর সুবাসী। বছর ফিরে গেল, বিয়ের বছর পুরতেও দেরি নাই, তবুও মনে হচ্ছে, এই তো সেদিনের কথা, পাগল মিতের গান যেন কানে বাজছে। মনে হচ্ছে, এই তো করলে গান! আঃ, পাগল মিতে ‘উদোমাদা’ মানুষ, গুণী লোক, যেমন গলা তেমন গান! হাঁসুলী বাঁকের উপকথা বলে সুচাঁদ পিসি। হাঁসুলী বাঁকের কথা নিয়ে পাঁচালি তৈরি করে পাগল মিতে। বিয়েতে শাদিতে গান বাধে, ভজোতে গান বাধে, ঘেঁটুতে গান বাধে, গাজনে গান গেয়ে সঙ সেজে নাচে। এবারে দুর্গা আর গঙ্গায় কোন্দল অর্থাৎ সুবাসী আর গোপালীবালার ঝগড়া, মাঝখানে বুড়োশিব অর্থাৎ বনওয়ারী-খায় এর হাতে ঠোনা, ওর হাতে ঝাটা।
***
হাঁসুলী বাঁকের পাঁচালিকার পাগল কাহার মজার মানুষ। মনখানি তার নীলের বাঁধের জলের মত। আকাশের রঙেই তার রঙ। আকাশে সুয্যি উঠলে কালো জল ঝকমক করে, তার সঙ্গে বাতাস উঠলে ঢেউয়ে ঢেউয়ে গলানো রুপোর মত ‘টলমলিয়ে’ ওঠে, রাত্রে চাদ থাকলে নীলের বাঁধের ছায়ামাখানো কালো জলে চাদ ওঠে, চাদের সঙ্গে তারাও ফুটে ওঠে, আকাশে মেঘ নামলে নীলের বধের জল হয় ‘গহিন’ কালো, মনে হয় আকাশ কাঁদছে, তারই দুঃখে নীলের বাঁধের জলও কাঁদছে। তা হবে না কেন? আকাশ থেকেই ঝরে পড়ছে নীলের বাঁধের জলও তো ওরই এক কন্যে। পাগল কাহারই বলে কথাটা। নইলে এমন সাজিয়ে কে বলতে পারে ‘অমৃতির মত বাক্যি! বনওয়ারী হেসে বলে পাগল মিতের মনটিও নীলের বাঁধের জলের মত। কাহারপাড়া তার কাছে আকাশ। কাহারপাড়া হাসলে সে হাসে, কাদলে সে কাঁদে। হাসিও না, কান্নাও না এমন অবস্থায় কাহারপাড়া ঝিমিয়ে থাকলে, অগ্রহায়ণ থেকে ফারুন মাসের কুয়াশায় ঢাকা নীল বাঁধের জলের মত চেহারা নেয়, পাগলের মনের চেহারাও ঠিক তাই হয়; সে উদাস হয়ে থাকে।
নয়ানের ‘মরণশয্যের’ পাশে বসে পাগল ছড়া কেটেছিল—
ভাই রে! অন্ধকারের ভাবনা কেনে হয় রে!
অন্ধকারেই পরানপাখি সেই দ্যাশেতে যায় রে!
তার মাসখানেক পরে বনওয়ারীর সাঙা হল আটপৌরে-কন্যে সুবাসীর সঙ্গে। পাগল তখন রসের গানে ছড়ায় পাচালিতে মাতিয়ে তুললে কাহারপাড়া। তার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারত এক নসুবালা; কিন্তু নসুবালা বললে শরীর খারাপ। শরীর খারাপ নয়, আসল কথা সবাই বুঝেছে। যে বনওয়ারী তার করালী-দাদা পাখী-বউকে গা-ছাড়া করেছে, তার বিয়েতে নাচতে গাইতে মন তার উঠবে না। নসু বলে—কাহারকুলে জন্মেছি, কাহারপাড়ায় বাস করি, বনওয়ারী কাহারপাড়ার মাতব্বর, দণ্ডমুণ্ডের মালিক, তার হুকুম যেন মানতে হবে বাইরে; কিন্তু মন তো কারুর দাসীর্বাদী নয়, সে কাহারও নয়, আটপৌরেও নয়, সে-ই হল শুধু মানুষসে রাজারও প্রজা নয়, মহাজনেরও খাতক নয়, সে মানবে কেনে বুন? তা না নাচুক নসুবালা, পাগল একাই এক শো। সে যত্ন করে মদ তৈরি করলে। সে মদের ‘তার’ কি! তার ‘ঘোর’ অর্থাৎ নেশা কত! নামকরা মদ-খাইয়েরা টলতে লাগল। পাগল কিন্তু ঠিক রইল। সেই করলে রান্না। ঘুরলে ফিরলে ‘ঢুকঢাক মদ ঢেলে খেলে, হাড়ি নামালে, কড়ায় হাত দিলে, উনোনে কাঠ দিলে আর সারাক্ষণ গাইলে গান–
হাঁসুলী বাঁকের বনওয়ারী, যাই বলিহারি–
বধিল নতুন ঘর দক্ষিণ-দুয়ারী।
সে ঘর বাধিতে এল (যত সব) অষ্টপহরী।
অষ্টপহরী পাড়ার সুবাসী-লতা
কাহারপাড়ায় আজ হল পোঁতা।
বুড়া মালী বনওয়ারী (যতনে) সাজায় কেয়ারী।
প্ৰহাদ রতন গুপী এরা খুব বাহবা দিলে। এ বিয়েতে বুড়োদেরই হয়েছিল বেশি মাতন। পাগল গেয়েই চলেছিল–
সুবাসী লতার ফুল পরিবে কানে
সুবাস জাগিবে রস বুড়ানো প্ৰাণে
ও পথে যাস না তোরা বারণ করি–
(বুড়া আসবে তেড়ে,
খেটে হাতে বুড়া আসবে তেড়ে)
এই সময় বনওয়ারী তার পাশে দাঁড়িয়ে বলেছিল—শোন পাগল।
—কি? মুখ এমন কেনে?
–বলব বলেই ডাকছি! পেল্লাদ অতন গুপীকে ডাক।
বনওয়ারীর প্রথম স্ত্রী গোপালীবালা কেঁদেছিল। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কেঁদেছিল। বনওয়ারী তাই এসেছিল—কি করি এখন বল দি-নি?
গোপালীবালা কাঁদছে। চমকে উঠেছিল পাগল। এ কথাটা তো সে ভাবে নাই! কাহারপাড়ায় এ কথা কেউ কোনো কালে ভাবে না। কাহারপাড়ার স্বামী যদি স্ত্রী থাকতে বিয়ে করে, তবে স্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে শাখা আর নোয়া খুলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে স্বামীকে গাল দিতে দিতে চলে যায় অন্য কোনো কাহার-মরদের ঘরে গিয়ে ওঠে। সতীনের সঙ্গে ঘর কাহার-মেয়েরা করে না। স্বামী যদি তেমন পয়সাওয়ালা হয়, তেমন ‘বেক্কমশালী’ অর্থাৎ বিক্রমশীল মোড়ল মাতব্বর হয়, সে যদি কোনো মেয়েলোককে ঘরে আনে, বিয়ে না করে এমনি রাখে তাতে বরং কাহার-মেয়েরা আপত্তি করে না; কিন্তু বিয়ে করলে সহ্য করে না। কাহারপাড়ার মেয়েরা ফেলনা নয়, স্বামীকে তাদের ভাত দিতে হয় না, নিজেরাই তারা খেটে খায়, রূপযৌবন ছাড়া ‘গতরের’ অর্থাৎ পরিশ্রমের ক্ষমতার একটা কদর আছে; সেই দরে কানা খোড়া বুড়ো কতজনের ঘরে ষোল আনা গিন্নির ‘পিঁড়ি’ তাদের আদর করে ডাকে, তারাও গিয়ে সে পিড়ি দখল করে বসে। ঘরের পাটকাম করে, অক্ষম পুরুষকে রাধা ভাত দেয়, খেটেখুটে রোজকারও করে। গোপালীবালা যদি চলে যায়, তবে সে হবে তার অপমান। তা ছাড়া গোপালীবালা বড় ভাল। গোপালীবালার মধ্যে কোপাইয়ের ঢেউ নাই, মনে সে দোলা লাগাতে পারে না, সে হল নীলের বধের জলনা আছে। সাড়া, না আছে ধারা, চুপচাপ ঠাণ্ডা ‘শেতল’; বুক ড়ুবিয়ে বসে থাকলে নড়বে না, জড়িয়ে ঘিরে নিথর হয়ে থাকবে তোমার চারিপাশে। নীলের বাঁধের মতই বনওয়ারী ওকে ভালবাসে; কিন্তু কোপাইয়ের মতন মাতন নাই বলে ওর ওপর নেশা কোনো কালে জমে নাই। সেই জন্যই বিবেচনা করেও বনওয়ারী নিজের মনকে মানাতে পারে নাই। কোপাইয়ের মত ছিল কালোবউ, সুবাসী ঠিক কালোবউয়ের মতই। সে যেন কোপাইয়ের বুকে নতুন বছরের বান হয়ে ফিরে এসেছে। তা ছাড়া সুবাসী হল আটপৌরে-ঘরের মেয়ে। আটপৌরেরা কাহারদের সঙ্গে চলতে রাজি হয়েছে বনওয়ারীর মাতব্বরির গুণে, সেই চলনের প্রথম করণ আটপৌরের কন্যে ঘরে আনবার গৈরব’ সে আর কাউকে দিতে পারবে না। তাই সে গোপালীবালার কথা ভেবেও সাঙা করতে সম্মত হয়েছে। গোপালীবালাকে একদিন সে বুঝিয়ে বলেছিল, প্রহাদ রতন এরাও বলেছিল, তখন গোপালীবালা নিজেই বলেছিল—তা কর, সাঙা কর, আমি যাব না। তবে তুমি তাড়িয়ে দিয়ো না। তোমার বেটা-ছেলে হোক, আমি মানুষ করব। তোমরা দুজনায় ‘রামোদ-রাল্লাদ করবা। আমি দেখব, হাসব। বিয়ের দিন কিন্তু গোপালীবালা কাঁদতে লেগেছে।
পাগল বনওয়ারীর মুখের দিকে হাঁ করে চেয়ে অবাক হয়ে গিয়েছিল।
বনওয়ারী বলেছিল—কি করি বল এখন?
অনেকক্ষণ ভেবে পাগল উত্তর দিয়েছিল—গোপালী যদি আজি থাকে, তবে আমিও ওকে মাথায় করে আখব। বুল্লি–বলগা তাকে।
বনওয়ারীর মুখটা থমথমে হয়ে উঠেছিল।
পাগল বুঝে বলেছিল—আগ করি না। নতুন করণ আটপৌরেদের সাথে সেটাও হবে তোরও ছেলেপুলে ঘর-সংসার হবে, সাধ মিটবে, গোপালী-বউকেও সতীন নিয়ে ঘর করতে হবে না।
গোপালী-বউ কিন্তু আশ্চর্য। সে তাতেও বলেছিল–না।
প্রাণকেষ্ট উপকার করেছিল, সে বনওয়ারীকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে হদিস বাতলে দিয়েছিল—এক কাজ কর কাকা। দশটা টাকা কাকির হাতে দাও। বলঘর কর, সংসার কর, পাড়ায় ধার দাও, মহাজনী কর; তুমিই ঘরের আসল গিনি, যেমন ছিলে তেমনি রইলে, আটপৌরের মেয়ে ঘরে আসছে, ছেলেপুলে হবে, খাটবে-খুটবে খাবে। বুঝলে?
বনওয়ারীর কথাটা মনে ধরে। পানার বুদ্ধির সে তারিফ না করে পারে নাই। টাকা তার আছে, কিন্তু কথাটা তার মনে হয় নাই। টাকাতে মন ভোলে বৈকি! কতজন কাহার মরদ পরিবারের দাবি ছাড়তে দাঙ্গা করে, হাঙ্গামা করে, শেষে টাকাতে রক্ষা হয়। টাকাতে আরও কত হয়, সে বনওয়ারীর অজানা নয়। ছেলের হাতে ‘অঙচঙে’ খেলনা, মিষ্টি নাড়ু দিলে তার কান্না থামে; বড় মানুষের হাতে টাকা দাও আঁজলা ভরে, বড় মানুষ ভুলে যাবে সব দুঃখ।
পানা বলেছিল-টাকাতে বলে পুতুশোক ভেলে, তা এ তো বলে সে একটা পিচ কেটেছিল।
বনওয়ারী দশটার বদলে এক কুড়ি টাকা নিয়ে গোপালীবালার দুই হাতের আঁজলা টেনে তার উপর ভরে ঢেলে দিয়েছিল।
গোপালীবালা চমকে উঠে স্বামীর দিকে তাকিয়েছিল। সে দৃষ্টি বনওয়ারী গাজনের পাটায় শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়েও যেন দেখতে পাচ্ছে।
বনওয়ারী হেসে বলেছিল—সব তোমাকে দিলাম। গয়না গড়িয়ো তুমি। না হয় যা খুশি কোরো।
গোপালীবালার মন ভুলেছিল। আঁজলা-ভরা ঝকঝকে টাকা! স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে সে হেসে বলেছিল—আর দুটি সোনার কানফুল গড়িয়ে দিতে হবে কিন্তু।
বনওয়ারী বলেছিল—দোব, নিশ্চয় দোব। সোনা একটুকু সস্তা থোক, যুদ্ভুতে দর চড়েছে। বিষম, একটুকুন নামুক দর, দোব।
পানা বলেছিল—একটি ঢোক মাল খাও খুড়ী এইবার। নাচতে হবে তোমাকে।
সত্যিই পানা গোপালীবালাকে মদ খাইয়েছিল। পানার উপর এরপর বনওয়ারী খুশি না হয়ে পারে নাই।
–চল, এইবার আটপৌরে-পাড়ায় যাবার আয়োজন কর।
কাহারদের আজ আটপৌরে-পাড়ায় যাওয়া যেমন-তেমন যাওয়া নয়, এমন যাওয়া কখনও যায় নাই আজ পর্যন্ত। প্রহাদ রতন গুপী পানু সকল কাহার মাথায় বেঁধেছিল ক্ষারে কাচা গামছা, গায়ে দিয়েছিল বহুকালের সযত্ন-রক্ষিত ফতুয়া, হাতে নিয়েছিল লাঠি; গোঁফে চাড়া দিয়ে মশাল জ্বালিয়ে সকলে গিয়েছিল। ঢোল বেজেছিল, সানাই বেজেছিল, কাঁসি বেজেছিল। বনওয়ারী গায়ে দিয়েছিল একখানা নতুন চাদর। যুদ্ধের বাজারে অগ্নিমূল্য দিতে হয়েছিল। সেই চাদরখানি গায়ে দিয়ে সে খুঁজেছিল পাগলকে।
–পাগল! পাগল!
সকলকে সামলে নিয়ে যেতে হবে। শুভকর্মে ব্যাঘাত না ঘটে। কাহারেরা মদ খেয়েছে, আটপৌরে-পাড়ায় মেয়ে আনতে চলেছে—সেই গরম নেশার সঙ্গে মাথার মধ্যে পাক খেয়ে ঘুরছে। হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় যা কখনও ঘটে নাই, আজ রাত্রে তাই ঘটবে। তার মধ্যে অঘটন ঘটিয়ে না বসে কাহারেরা। পাগল হুঁশিয়ার মানুষ। তাকে ভার দিতে হবে।
–পাগল! পাগল!
পাগলকে পাওয়া যায় নাই। গোটা গায়ের মধ্যে না।
পানা হাসতে হাসতে বলেছিল, আঁ, কত সাধ করে কথাটা বললে—শেষে লাজে হয়ত পালালছে।
ঠিক এই সময় বিদ্যুৎ চমকে উঠেছিল।
কে যেন বলেছিল—মেঘ চিকুরছে, চল চল।
ওঃ সে কি মেঘ। বর্ষার মেঘ। বিয়ের রাত্রে নেমেছিল বর্ষা, কাড়ান। কাড়ানের মেঘ ঘন। কালো। বিদ্যুৎ চমকে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে মেঘের গুরু গুরু ডাকে হাঁসুলী বাঁকের বাঁকে বাঁকে, বাঁশবাঁদির বাঁশের বনে যেন ডঙ্কা বাজিয়ে দেয়। ঝিরঝির করে মৃদুমন্দ বাতাস বয়। নীলের বঁধের স্থির জলে কাপন লাগে। বাঁশবনের কোনো পাতা ঢাকা গর্ত থেকে মোটা গম্ভীর গলায় ‘গ্যাঙোর গ্যাঙ, গ্যাঙোর গ্যাঙ, গ্যাও-গ্যাও’ শব্দ করে ওঠে হেঁড়েব্যাঙ মহাশয়। ছোটখাটো হাঁড়ির মত চেহারা—এমনি বড় আকারের ব্যাঙ, তাই এদের নাম হেঁড়েব্যাঙ। গাছের ডাল থেকে অপেক্ষাকৃত মিহি গলায় সাড়া দেয় গেছোব্যাঙ—অ্যাও! অ্যাও! পুকুর ডোবার কোণ থেকে সোনাব্যাঙগুলো কলরব জুড়ে দেয়। করবৃকর—কর শব্দে হাঁসুলী বাঁকে যেন হাজার ব্যাঙ-টুনটুনির বাজনা বেজে ওঠে। মাথার উপরে কিচির-কি-কিচির শব্দ ওঠে। ফটিকজল পাখিগুলো রাত্রেও ডাকতে শুরু করে মেঘরাজার হাক শুনে। তেমনি মেঘ উঠেছিল সেদিন।
বরযাত্রী কাহারেরাও হাক দিয়ে উঠেছিল সে মেঘের ডাক শুনে। এ কি ডাক! অঁ! জয় জয় বাবাঠাকুর! আষাঢ়ের প্রথম অম্বুবাচীর দুদিন বাকি, এরই মধ্যে মেঘের হাকে বর্ষার থমথমে আওয়াজ বেজে উঠল যে! হাঁসুলী বাঁকের চষা-খোড়া মাটি ‘শিরশির করছে অর্থাৎ শিউরে উঠছে বোধহয়।
পানু বলেছিল—বনওয়ারীকাকার নতুন বউয়ের পয়।
–নিচ্চয়। মঙ্গল হবে, মঙ্গল হবে, আটপৌরের সাথে কাহারদের চলনে দু পাড়ারই মঙ্গল হবে। ‘আষিঢ়ে কাড়ান’ পায় কে? অর্থাৎ আষাঢ় মাষে চাষের উপযুক্ত পর্যাপ্ত বর্ষণ পায় কে?
বনওয়ারী প্রথমটা ভয় পেয়েছিল; আকাশের দিকে চেয়ে বলেছিল—হে বাবা, তোমার বাহন যেন সেদিনের মত কোড়ল পাকিয়ে লকলকিয়ে জিভ মেলে ফুসিয়ে না ওঠে! বনওয়ারীর মন আশ্বস্ত হয়েও হচ্ছিল না। জষ্ঠি মাসের শেষে তো বর্ষা দেখা দেয় না, আষাঢ় মাসেই বৰ্ষা দুর্লভ। তবে? এই অকালে ঠিক তার বিয়ের লগ্নে মাথার উপরে অকাল বর্ষা হক মেরে উঠল কেনে? বাবার বাহন সেদিন কালবৈশাখীর মেঘের মধ্যে ফুসিয়ে উঠেছিল। সেই বিচিত্র বরন ফুটে উঠেছিল সাদা-কালো মেঘে মেঘে। আজও আবার–?
বনওয়ারী! ব্যানো! ব্যানো!
বনওয়ারী সংবিৎ ফিরে পেয়েছিল রতনের ডাকে। আর আশ্বাস পেয়েছিল মেঘ দেখে, বাবার বাহনকে সে মেঘের মধ্যে দেখতে পায় নি। একটানা ঘনশ্যাম মেঘ উঠছে আকাশ ভরে। ইনি বর্ষার মেঘ। বনওয়ারী বলেছিল-চল।
***
হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় ওই রাত্রি থেকেই বেজে উঠেছিল চাষের বাজনা; এবারের বর্ষা ভাগ্যের বর্ষা গিয়েছে। আষাঢ়ের বর্ষা। “আষাঢ়ে কাড়ান পায় কে? শাঙনে কাড়ান ধানকে। ভাদুরে কাড়ান শিষকে। আশ্বিনে কাড়ান কিসকে?” আষাঢ় মাসে চাষের উপযুক্ত ভাসান জল কোন ভাগ্যবান পায়? কালেকস্মিনে কখন-সখনও হয়। এবার পেয়েছে কাহারেরা।
গুরু গুরু শব্দে গম্ভীর গলায় মেঘের সে ধ্বনি কি! কোপাইয়ের জল হয় ঘোলা; তার কূলে কূলে মেঘের ডাক যেন ডঙ্কার মত শোনায়। বাঁশবনের নতুন বাঁশগুলির ‘খুঙি’ অর্থাৎ আবরণ খসে পড়ে, ফিকে সবুজ রঙের পাতা দেখা দেয়, পুরনো বাঁশের পাতার সবুজে কালচে আমেজ ধরে। শিমুল-শিরীষ-বট-অশ্বথ –পাতাগুলিতেও কালো রঙের ঘোর ধরে, পাতাগুলি পুরু হয়। বাঁশবনের তলায় ভিজে পাতা চাপ বেঁধে সপসপ করছে, পা দিলে “বুড়াবুড়ি’ কেটে লালচে রঙের জল ওঠে। কত নতুন নতুন চারা গজায়। কোপাইয়ের কূলে শরবন, কাশবন, বেনাবনে লম্বা কচি পাতা গজিয়ে উঠে ঝাড়বন্দি হয়ে বাতাসে ঢেউ খেলিয়ে নাচতে থাকে। সবচেয়ে বাহার। হয় কোপাইয়ের ঘাটের উপরের ছাতিমগাছটির। চোখ জুড়ানো সবুজ বরন টোপরটির মত চেহারা হয়। গাছের মধ্যেও হয় নটবর। ঘাসে ঘাসে ভরে যায় চারিদিক। কাহারপাড়ার উঠানগুলির চারিপাশে, ঘরগুলির ‘পোতায়’ অর্থাৎ ভিত পর্যন্ত কেউ যেন সবুজ রঙের পাড় বুনে দেয়। মাঠ জলে থইথই করে, আলে আলে ঘাস। কাহারেরা তারই মধ্যে কাজ করতে কাঁপিয়ে পড়ে—কেউ চালায় হাল, মাটির উপর হালের মুঠো ধরে চলে পিঠ বেঁকিয়ে ঘাড় নামিয়ে অসুরের মত। কেউ জমির কাদায় জলে হাঁটু গেঁড়ে বীজচারা তোলে, কাদানো জমিতে ঘাস আগাছা তুলে দুমড়ে মাটির মধ্যে পুঁতে দেয়। রাত্রি এক প্রহর থাকতে মাঠে ছোটে, বাড়ি ফেরে রাত্রি এক প্রহর পার হলে তবে।
বনওয়ারী এবার অনেক ধান পেয়েছে। ভাগের চাষে বেশি ফলেছে, তাতে আর কত বেশি পেয়েছে। এবার সায়েবডাঙার জমির ধান যে তার ঘরে উঠেছে। পাঁচ বিঘে ডাঙার কাটানো হয়েছে দু বিঘে, তার থেকে ধান পেয়েছে চার বিশ দু আড়ি অর্থাৎ সাড়ে দশ মন, কাউকে ভাগ দিতে হয় নাই, খাজনা লাগে নাই। এই সাড়ে দশ মন তার কাছে হাজার মনের সমান। আজ বিক্রি করলেই পঞ্চাশ টাকার করকরে নতুন ‘লোট গুনে দেবে মহাজনেরা। দেশে টাকা নাই, সব ‘লোট’ সব ‘লোট’; নইলে কিছুখানি বিক্রি করত বনওয়ারী, কিন্তু লোট তো মাটিতে পুঁতে রাখা যায় না! আরও একটা কথা আছে, ছুটকী অর্থাৎ নতুন বউ সুবাসীর মতিগতি না বুঝে টাকাকড়ি পুঁতে রাখা ঠিক নয়।
বাবু মহাশয়দের সায়েবডাঙার জমিতেও প্রচুর ধান হয়েছে। ওঁরা জমি কাটিয়ে জমিতে পুকুরের পাক দিয়েছিলেন, সার দিয়েছিলেন, বনওয়ারী তো তা পারে নাই। তবে সে এবং গোপালীবালা পথেঘাটে যেখানে যত গোবর দেখেছে, কুড়িয়ে নিয়ে গিয়ে জমির মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছে। গোপালী আর এক কাজ করেছে, সে কথা বনওয়ারী ছাড়া কেউ জানে না; মাঠে লোকজন না থাকলে, সে বাবুদের জমিতে নেমে পকের ঢেলা তুলে ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলেছে। বনওয়ারীর জমিতে। গোপালীবালা তার সাক্ষাৎ লক্ষ্মী। সুবাসীর রূপ যৌবন বনওয়ারীকে নেশায় আচ্ছন্ন করে রেখেছে বটে, কিন্তু সে এই নেশার মধ্যেও বুঝতে পারে, এ নেশায় সংসারের কল্যাণ নাই। মেয়েটা অবিকল কালোশশী—তেমনি বিলাসিনী, তেমনি ঢঙ, তেমনি হাসি, তেমনি ঢলে পড়া, মধ্যে মধ্যে বনওয়ারীর মন খাপ্পা হয়ে ওঠে।
আবার নবান্নর সময় একটা কাণ্ড ঘটেছিল। সেই কাণ্ডেই বুঝতে পেরেছে এ মেয়ের হাতে লক্ষ্মী নেই। নবানে এবার হাঁসুলী বাঁকের বাঁশবাঁদিতে খুব ধুম গিয়েছে। নবানে তাদের ধুম চিরকালের। সজ্জাতের অনেক ধুমধাম, এক পুজোর পর আর এক পুজো, তাতে কাহারেরা আনন্দ করে, পূজাস্থানে গিয়ে দাঁড়ায়, কিন্তু তাদের নিজের ঘরে সে ধুমে দেবতার চরণের ছাপ। পড়ে না। ওদের ধুম গাজন, ধরম পুজো, আমূতি অর্থাৎ অম্বুবাচী, মা বিষহরির পুজো, ভাদ্র মাসে ভজো পরব, অগ্রহায়ণে নবান্ন, পৌষে লক্ষ্মী। মোটামুটি সাতটা পরব। এ ছাড়া ষষ্ঠী আছে, মঙ্গলচণ্ডী আছে, সে শুধু মেয়েদের ‘বেরতো, তাও তাদের করতে হয়, ওই সজাতদের মালক্ষ্মীদের বেরতো-স্থানের ‘পাট আঙনে’ অর্থাৎ পাট-অঙ্গনের এক প্রান্তে বসে। নবান্নই ওদের বড় পরব। নতুন ধান কেটে লক্ষ্মী অন্নপূর্ণার পূজা করে, কালারুদ্দু বাবাঠাকুরের ভোগ দিয়ে। নতুন অন্নের ‘পাঁচ দব্য পস্তুত করে আনন্দ করে খাওয়ায়। আর কালারুদ্দুর কাছে বলা বাবা!
‘ল’ লড়লাম—‘ল’ চাড়লাম
‘ল পুরনোয় ঘর বাঁধলাম।
লতুনে বাখার বাধি পুরনো খাই–
এই খেতে যেন জনম যায়–
লতুন বস্তু পুরনো অন্ন–
তোমার কৃপাতে জীবন ধন্য।
‘ল’ অর্থাৎ ‘ন’; ‘ন’-কে ওরা ‘ল’ হিসাবে উচ্চারণ করে, ‘ন’ অর্থাৎ নতুন। খাওয়াদাওয়ার খুব ধুম। সবার বাড়িতে সবার নিমন্ত্রণ। খেয়েদেয়ে বিকেলবেলা হয় ড্যাং-গুলি অর্থাৎ ডাণ্ডাগুলির পাল্লা। জোয়ান ছেলেরা সায়েবডাঙায় গিয়ে দেড় হাত লম্বা ড্যাং এবং বিঘৎ প্রমাণ মোটা গুলি নিয়ে খেলতে আরম্ভ করে, সন্ধে পর্যন্ত খেলে খাদ্য হজম করে বাড়ি ফেরে। এক এক ডাণ্ডা। মেরে গুলিকে পাঠিয়ে দেয় হুই-লম্বাপির, দেখিয়ে দেয় সাত ভুবন। বারি দুরি তেরি চাল চম্পা ডেক লঙ্কা মাপতে মাপতে সাত মাপে গজ দিয়ে পিটিয়ে দেয় ‘গজা’ অর্থাৎ এক দানের হার। আবার যারা খাটুনি দেয়, তারাও কম যায় না, ওই বো-বো শব্দে ছুটন্ত গুলি দুই হাতে খপ করে লুফে নিয়ে মুখে ঠেকিয়ে বলে—খেয়ে নিয়েছি অর্থাৎ গেল খেলদারের হাত। সে এক মাতন। বুড়োরাও মধ্যে মধ্যে লোভ সামলাতে পারে না, তারাও দু-এক দান খেলে নেয়। ছেলেরা বার হয় তীর ধনুক নিয়ে—বাখারির ধনুক, নতুন শরকাঠির তীর তৈরি করে তারা হইহই করে বেড়ায় মাঠময়, তাড়িয়ে বেড়ায় ধান খেতে নামে যেসব পাখির কঁককাক, শালিক, চড়াই, টিয়া তাদের।
সন্ধেবেলা মদের পর্ব। ঢোলক, বাদ্যি, গান, নাচ। এবার বনওয়ারী গোটা আটপৌরেপাড়াকে নিমন্ত্রণ করেছিল। নতুন মিলন হয়েছে ওদের সঙ্গে, কুটুম্বিতাও হয়েছে। বনওয়ারীরও এবার বাড়বাড়ন্তের বছর, এ তার কর্তব্য। দিনের বেলা চুকে গেল সব, সন্ধেতে মদের আসর বসলজমলও খুব, পাগল বাহারের গান ধরলে–
ও লবানের নতুন ধানের পিঠে
আজ কাজ কি মাছের ঝোলে!
অমনি নৃত্য আরম্ভ হয়ে গেল। পাগলের গান চলল—
লতুন কাপড় খসখসিয়ে বউরা এসেছে—
আঙা নতুন ছাওয়াল লিয়ে কোলে।
সঙ্গে সঙ্গে সকলে হইহই করে উঠল। হিসেব কর, কার কার ছাওয়াল হবে। নতুন ছাওয়াল কোলে কে কে লবান্ন করলে। ৰনওয়ারী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলেছিল। বাবাঠাকুর কবে তাকে বংশ দেবেন। তিনিই জানেন। ভাবতে ভাবতে হঠাৎ নজরে পড়ল, সুবাসী যেন নাই মনে হচ্ছে। ভাল করে দেখতে দেখলে, হাঁ বটে। সে নাই, কোথায় গেল? অজুহাত তুলে বাড়ি এসে সেখানেও পেল না তাকে। কোথায় গেল? বেরিয়ে পড়ল মাঠে। চারিদিক খুঁজতে লাগল; করালীকে মনে পড়ে গেল হঠাৎ। কারণ মনে হল, যেন সে বাতাসে সিগারেটের ক্ষীণ গন্ধ পাচ্ছে। সে পাগল হয়ে খুঁজতে লাগল। হঠাৎ মনে। হল, কে যাচ্ছে দূরে দূরে আটপৌরে-পাড়ার কোলটাতে। সে চিৎকার করে উঠল—কে? ছুটে গেল সঙ্গে সঙ্গে। কিন্তু কেউ মানুষ নয়, একটা মরা শেওড়াগাছের বাকল উঠে যাওয়া পুঁড়ি, একটা ঝোপের সামনে খাড়া হয়ে রয়েছে, সেটাকে ঠিক মনে হচ্ছে মানুষ। সেখান থেকে ফিরবার পথে হঠাৎ সে আতঙ্কে অভিভূত হয়ে দাঁড়াল। কালোশশীর ভাঙা ঘরের উঠানে এসে পড়েছে সে, এবং ভাঙা দাওয়ায় দাঁড়িয়ে কার সাদা মূর্তি! বাক্যহারা হয়ে সে দাঁড়িয়ে রইল। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল তার মনে নাই। চেতনা হল তার সাদা মূর্তিটির কথা শুনে। অতি মৃদু ভোনা সুরে বললে-পাঁলাও—তুমি পাঁলাও—
আমার লোঁভ লাঁগছে তোমার ওঁপর
মুহূর্তে বনওয়ারীর ভয় ভেঙে গেল। চেতনা ফিরে এল। লাফ দিয়ে সে ধরলে তাকে। সে সুবাসী।
–হারামজাদী–
আশ্চর্য সুবাসী, সে খিলখিল করে হেসে উঠল। উন্মত্ত ক্ৰোধে বনওয়ারী তার গলা টিপে ধরে বললে—ব কি করছিলি এখানে? বল, আর কে ছিল?
সুবাসী বহু কষ্টেই বললে—সন্দেশ।
–সন্দেশ?
–সন্দেশ খেছিলাম লুকিয়ে। এই দেখ। সে কাপড়ের ভিতর থেকে বার করলে সন্দেশের বাটি।
গলা ছেড়ে দিলে বনওয়ারী। সন্দেশ খেছিলি লুকিয়ে?
–হ্যাঁ। নতমুখে সে বললে—দিদি মোটে দুটি দিয়েছিল, তাই–
এবার হেসে ফেললে বনওয়ারী। তাই লুকিয়ে এখানে খেতে আইছিলি! তা ঘরে খেলেই তো পারতিস?
—কেউ যদি দেখে ফেলত।
—তাই বলে এই ভাঙা ঘরে-সাপ, না খোপ
–ভালই হত মরতাম। তুমি আজলক্ষ্মী গোপালী বুড়িকে নিয়ে ঘর করতা।
হাসলে বনওয়ারী। বললে—চল, কত সন্দেশ তু খেতে পারিস দেখব? এখুনি সন্দেশ আনাব।
–না। এবার কাঁদতে লাগল সুবাসী।
—কাঁদিস না চল্।
অনেক কষ্টেই সুবাসীর মান ভাঙিয়েছিল সে। কিন্তু এমন যে মেয়ে—যে লোভের বশে দেবতার কথা না ভেবে স্বামীকে বঞ্চিত করে চুরি করে ভুতুড়ে ঘরে বসে পেট পূরণ করে, সে তো ভাল মেয়ে নয়। ওই মিষ্টি পরের দিন দেবতাকে দেওয়ার কথা ছিল। বনওয়ারী মুখে তোলে নাই তখনও পর্যন্ত।
দ্বিতীয় বছর চড়কের পাটায় শুয়ে বনওয়ারী ওইসব কথাই ভাবছিল। গত বছরের কথা। ও বছরের কথা বছর পার হয়ে এ বছরে কাহিনী হয়ে গেল। বাজনা থামল, পাটা নামছে, উপরে শিমুলবৃক্ষের ডগার ডালটি দুলছে; বাবাঠাকুরের দহের ধারে পাটা নামছে। বাবা জলশয়ানে যাবেন বছরের মত। এক বছর গেল, নতুন বছর শুরু হল।
পাটা নামতেই বনওয়ারী অবাক হয়ে গেল।
এক লালমুখ সায়েব আর তার পাশে কালী। দুজন সিগারেট খাচ্ছে। জাঙলের সদ্গোপ মহাশয়েরা মায় মাইতো ঘোষ পর্যন্ত দাঁড়িয়ে। করালীর ভ্রুক্ষেপ নাই। সায়েবটা কড়োমড়ো করে কি বলছে। মাইতো ঘোষ ইংরেজিতে জবাব দিচ্ছেন। বনওয়ারীর ইচ্ছে হল, লাফিয়ে উঠে ছোঁড়ার বুকে প্রচণ্ড এক কিল মারে। ভেঙে দেয় ওর বুকের পাটা, চুরমার করে দেয়। কিন্তু সে শুয়ে আছে চড়কপাটায়, এবং সায়েবটা রয়েছে করালীর পাশে।
অবাক! করালী বলছে—হ্যালো ম্যান? বলেই ঘাড়টা উল্টে দিল। এ ইশারার মানে—চল। তাই বটে। সায়েবটা চলে গেল করালীর সঙ্গে।
***
করালী পাপ, করালী সাক্ষাৎ ‘দানো’ অর্থাৎ দানব। কাহারকুলের অনেক পাপে হাঁসুলী বাঁকে ওর আবির্ভাব হয়েছে। বনওয়ারীর বয়স প্রায় তিন কুড়ি হল, সুচাঁদ পিসির চার কুড়ি হবে, চোখে তো দুজনের একজনও দেখে নাই এমন ‘দানোর আবির্ভাব।
সুচাঁদ পিসির জানা হাঁসুলী বাঁকের যে উপকথা, সে উপকথার মধ্যেও নাই। বজ্জাত দুষ্টু চিরকাল আছে, থাকবেও চিরকাল, হাতের পাঁচটা আঙুল সমান নয়, কিন্তু এ যে সাক্ষাৎ দানো। আদ্যিকালের কথায় দত্যিদানের কথা শোনা যায়, পৃথিবীতে তারা জন্ম নিত মনুষ্য হয়ে, পাড়াগেরাম-দেশ লণ্ড ভণ্ড করে দিত, নিজে পাপ করত, পরকে দিত পাপমতি, মানুষ পরিত্ৰাহি ডাক ছাড়ত মনে মনে। মা ধরণীর বুক উঠত টাটিয়ে, তিনিও কাঁদতেন। তখন দেবতা আসতেন, এসে বধ করতেন মানুষ্যবেশী দানোকে। মানুষের সাধ্য নাই দানোকে বধ করতে। বনওয়ারী অত্যন্ত সাবধান হয়েছে। মনে মনে বেশ বুঝেছে। একটি ব্যাপারেই চোখ খুলে গিয়েছে।
আজ কাহারপাড়ার মাথার দিকে তাকিয়ে দেখ, করালীর কোঠাঘর মাথা উচু করে দাঁড়িয়ে। আছে। কোঠাখানা কাহারপাড়ায় জোর করে পেতা। করালীর জিদের ধ্বজার মত উঠে রয়েছে-সন্ধ্যাবেলা এসে ওরা আলো জ্বলে ঢোল বাজিয়ে ‘জানান’ দিয়ে যায়। জিদের ধ্বজাই নয় শুধু, অধর্মেরকলিকালের ধ্বজা। হতভাগা জানে না, উঁচু মাথায় বিপদ কত! তালগাছে বজ্ৰাঘাত হয়, লাঠি পড়লে উঁচু মাথাতেই পড়ে, ঝড়ে উঁচু ঘর ওড়ে, উঁচু ঘরে আগুন লাগলে সে আর নিবানো যায় না। চোর-ডাকাতের নজর উঁচু ঘরের মাথা দেখে ফেরে, হিংসুটে লোক উঁচু ঘর দেখেই বিষমন্তর আওড়ায়। ভূত বল, প্রেত বল—আকাশে আকাশে যারা ফেরেন, তাদের পথে যে ঘরের মাথা উঁচু সেই ঘরের মাথাতেই তারা বসে পড়েন, বাধা পড়লে সে ঘরে মন্দ দৃষ্টি দিয়ে যান। পিতৃপুরুষে যা করে নাই, তাই করলে অশুভক্ষুণে, তার ফল ওকে পেতেই হবে।
চড়কপাটায় শুয়ে বনওয়ারী স্মরণ করলে ওই ঘর করার বৃত্তান্ত। যেদিন করালীর ঘরের তৈরী বনিয়াদ কাহারপাড়ার সবাই জুটে হইহই করে কেটে সমান করে দিলে মাটির সঙ্গে, সেই দিনই সন্ধ্যাবেলায় করালী চলে গেল পাখীকে নিয়ে চন্ননপুর। রাত্রে নয়ান মারা গেল, ভোরে শ্মশান থেকে বনওয়ারীরা ফিরতেই গোপালী বললে—বেপদ হইছে। করালী পুলিশ নিয়ে আইছিল। জমাদার বলে যেয়েছে—তোমাকে থানাতে যেতে।
—থানায় যেতে! বুকটা গুর গুর করে উঠল বনওয়ারীর।
অনেক ভেবে সে সাহস সঞ্চয় করলে। চুরিও করে নাই সে, ডাকাতিও না, খুনও না, কিসের ভয় তবে? সরকারের একটা আইন আছে, পাড়াঘরে জাতধর্মের একটা নিয়ম আছে। সে মাতর হয়ে অনিয়ম করতে দেবে কি করে থানাওয়ালা আইন দিয়ে তাই হিসাব করুক, বিচার হোক। সে সঙ্গে নিলে প্ৰহ্লাদ এবং রতনকে, আরও নিলে চৌধুরী মহাশয়ের পাইক নবীনকে। জমিটা চৌধুরী মহাশয়ের। ঘর করে আছে বলে জায়গা করালীর বাপের নয়। সুতরাং তাদের বিনা হুকুমে করালী ঘর করে কি করে? আর নবীনকে করালী গাল দিয়েছে, মেরেছে। এ বুদ্ধিটা দিলেন ঘোষেরা। মাইতো ঘোষ বলে দিলেন-বলবি, চৌধুরী মহাশয়ের হুকুমে কেটে দিয়েছি বনে।
কিন্তু দারোগাবাবু বললেন–উঁহু, ওসব কথা চলবে না। বুঝলে! ঘর ওর ছিল ওখানে, সেই ঘর ভেঙে নতুন করছে, জমি চৌধুরীদের হোক আর যারই হোক, তারা খাজনার মালিক, খাজনা পাবে; ঘর করতে বাধা দিতে কেউ পারবে না। আর পাড়া-নিয়মের কথাও চলবে না। কোঠাই করুক আর গম্বুজই করুক, ওকে করতে দিতে হবে।
বনওয়ারী হাত জোড় করে শেষ চেষ্টা করে বলেছিল—আজ্ঞে, খ্যানত হয়, কিছু হয়—
করালীই ওপাশ থেকে জবাব দিয়েছিল–হয়, আমার হবে।
দারোগা হেসেছিলেন। বনওয়ারী ক্রুদ্ধ বিস্ময়ে করালীর দিকে তাকিয়েছিল, কথা বলতে পারে নাই। অবশেষে তাই স্বীকার করে ফিরে এসেছিল। দারোগাবাবুকে একটা খাসিও দিতে হয়েছে। অন্যথায় করালীকে ক্ষতিপূরণ দেবার হুকুম দিতেন দারোগাবাবু। করালী উঠে গেলে জমাদার বনওয়ারীকে ডেকে বলেছিলেন ক্ষতিপূরণের কি করবি?
ক্ষতিপূরণ! লজ্জায় ক্ষোভে বনওয়ারীর চোখে জল এসেছিল। করালীকে ক্ষতিপূরণ দিতে হলে তার মাথাটা যে কাটা যাবে! তার চেয়ে তার ‘মিত্যু’ ভাল।
শেষ জমাদারবাবুই মান রক্ষে করেছিলেন, বলেছিলেন যাক, সে অপমান তোর হতে দোব না। আমি তো লোকে জানি। দারোগাবাবু না হয় নতুন লোক। বলে দোব ওঁকে আমি। তা নতুন বাবুকে একটা খাসি দিস। উনিও খাবেন, আমরাও খাব।
সেইদিনই বিকেলবেলা করালী এসে করেছিল ওর ঘরের পত্তন। সেই মরা গাছের গুঁড়িটায় ঠেস দিয়ে বসে সিগারেট ধরিয়ে হুকুম দিয়েছিল—লাগাও।
সঙ্গে সঙ্গে হো-হো করে হাসি।
লোকজন সব এনেছিল চন্ননপুর থেকে। তারা কাজ আরম্ভ করে দিলে। কাহারপাড়ার লোক দূরে দাঁড়িয়ে নির্বাক হয়ে দেখলে। সুচাঁদ যে সুচাঁদ, সেও নির্বাক হয়ে রইল। তার বাবাকে স্মরণ করে আনন্দেও কাঁদতে পারলে না, ভবিষ্যতের অমঙ্গল কল্পনা করে আশঙ্কাতেও কাঁদতে পারলে না দারোগার ভয়ে।
শুধু মাথলা নটবর এরা এসেছিল। ওরা দু-তিন জন প্রকাশ্যেই করালীর দলে গিয়ে যোগ দিয়েছে। খাসির কথা ওরাই বললে করালীকে। খুব কৌতুকের সঙ্গেই বললে। বললে—আচ্ছা সঁড় হইছে! খুব হাসলে।
করালী কিন্তু আশ্চর্য হয়ে গেল। বললে—দিলে কেনে?
–না দিলে?
—না দিলে কি?
—তোকে ক্ষতিপূরণ দিতে হত। তাতে যে অপমান হত।
–আমি তো ক্ষতিপূরণ চাই নাই।
—তু না চাইলে কি হবে? আইন–
করালী মুখ ভেঙিয়ে বলে উঠল—আইন! ভাগ শালো বেকুব কোথাকার! ঠকিয়ে নিয়েছে। মাতব্বরকে ঠকিয়ে নিয়েছে। বলিসরাজি থাকে তো আমি নিয়ে যাব স্বদেশীবাবুদের কাছে। খাসি পেট থেকে বার করব দারোগার।
কথাটা বনওয়ারী শুনেছিল। কিন্তু সে করালীকেও বলে নাই, কারও কাছেই যায় নাই। ছি! শুধু তাই নয়, করালীর ঘরের দিকেই আর সে তাকায় না। ওদিক দিয়ে সাধ্যমত ঘঁটে না, ওদিকে যেতে হলে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে চলে যায়। ঘর যখন পাড়া ছাড়িয়ে মাথা তুলে উঠেছে। তখন অবশ্য না দেখে উপায় নাই, তবে সাধ্যমত তাকায় না। কিন্তু করালী আশ্চর্য—ঘর তৈরি করে ঘরখানার ভিতর মেরামত আর করলে না। করবে কেন? ঘর করাটা তো তার জেদ। কাহারপাড়ায় কোঠাঘর তোলা হল। চিরকালের নিয়ম-আচারে লাথি মারা হল, হয়ে গেল কাজ। সে বাস করছে চন্ননপুরের সেই পাকা খুপরি কোয়ার্টারে। যুদ্ধের কাজ, তাকে থাকতেই হবে। আরও একটা কারণ আছে। সেটা বনওয়ারী বুঝতে পারে। তারও বয়স অনেক হল। করালী এখানে বাস করতে ভয় করে। করালীর ঘরে এখন বাস করছে নসু। সে থাকে, সঁজ পিদিম জল মাজুলী দেয়, সকালবেলায় চলে যায় চন্ননপুর, ফেরে সন্ধ্যায়। বিকেলে যেদিন ফেরে, সেদিন করালী পাখীও আসে। সন্ধের আগেই আবার চলে যায়।
ড্যারাডাং-ড্যা–ড্যারাডাং-ড্যাং।
***
ড্যাং-ড্যাং–ড্যাডাং।
কালারুদ্দের শিলারূপ জলশয়ানে গেলেন। গত বছরের কথাগুলি স্মরণ করা বন্ধ করে বনওয়ারী চড়কচক্রের পাটা থেকে নামল। ভয়ের বছর শেষ হল। নিৰ্ভয়ে কেটে গেল। জয় বাবা কালারুদ্র! আটচল্লিশ সাল শেষ হলেন, ঊনপঞ্চাশ সাল এলেন। সুচাঁদ বলে—ক’কুড়ি ক’বছর। তাই বল। তারপর ঘস ঘর করে মাথা চুলকে বা হাতের আঙুলে টিপে উকুন বার করবার চেষ্টা। করতে করতে আবার বলে—বিধেতার তো চুলও পাকে না, দাঁতও ভাঙে না। তার কি? বছর। পার করলেই খালাস। সেই আদ্যিকাল থেকে বলে সে পিছনের দিকে ডান হাতের তর্জনীটি বাড়িয়ে দেয়, চোখে ফুটে ওঠে এক বিচিত্র বিস্ময় বিস্ফারিত দৃষ্টি; কয়েক মুহুর্ত সে চুপ করে। থাকে, গোটা কাহারপাড়াও তার মুখের দিকে চেয়ে চুপ করে থাকে। সুচাঁদ আবার বলে—কত বছর হল কে জানে! মাথার চুলের সংখ্যে হয় তার আর সংখ্যে নাই। বলে সে ঘাড় নাড়তে থাকে।