ওদিকে কোপাইয়ের ধারে খুব গোলমাল।
সুচাঁদ বাড়িতে বসে কাঁদছে—ওরে বাবা রে—কোথা গেলে রে—দেখে যাও করালী মরল রে!
থরথর করে কেঁপে উঠল বসন!—কি হল? ওটে; সোরমার করে ফেঁচাস না, আগে বল কি হল?
–ওরে আমার মাথা হল রে! করালী মরল রে!
—তোর পায়ে পড়ি, বল্ কি হল?
—অ্যাই আগাসায়েব লো বসন, অ্যাই লাঠি-বলেই কপালে চাপড় মেরে সে আবার চেঁচাতে শুরু করে দিলে।
পাড়ায় একটি লোক নাই যে সে জিজ্ঞাসা করে। সবাই ছুটে গিয়েছে ওইখানে। ওখানে যেতে তার পা উঠছে না। পাড়ায় রয়েছে শুধু নয়ান। বসে হপাচ্ছে, সাদা চোখগুলো যেন জ্বলছে। তাকে কোনো কথা জিজ্ঞাসা করতে বসনের জিব যেন আটকে যাচ্ছে।
সে নিজেই ছুটে গেল। কোপাইয়ের ঘাটে গোটা কাহারপাড়া জমে গিয়েছে। ভিড়ের মধ্যে করালীকে দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু আগাসায়েবের পাগড়ি দেখতে পেলে বসন। আগাসায়েব, মানে কাবুলীওয়ালা। ভিড় ঠেলে ঢুকে বসন অবাক হয়ে গেল। করালী মরে নাই। আগাসায়েবের হাত ধরে বীরবিক্রমে তাকে শাসাচ্ছে- উ সমস্ত চলে গা নাই আর। হাঁ। ঠেঙিয়ে দোরস্ত করে দেগা। মেরে ফেলে দেগা দহমেন্দ্রকুমিরে খেয়ে লেগা। সে আমল আর নেহি হ্যায়।
আগাসায়েব সবিস্ময়ে বললে—আরে, তুম চন্ননপুরসে হিয়া আয় হ্যায়?
–হাঁ। হিঁয়া হামারা ঘর হ্যায়, বাড়ি হ্যায়। মনে পড়তা হ্যায় চন্ননপুরকে ঠেঙানি? হিঁয়া ওই হোগা।
আগা বললেহামারা রুপেয়া তো দে দেও ভাই।
–কাহে? কাহে তুম হাত ধরা হ্যায়? কাহে? কাহে তুম মেয়েলোককে খারাপ বাত বোলা হ্যায়? কাহেঃ হামলোক সবাই মিলকে তুমকে মারকে ছাতু বানায় দেগা তো কেয়া করেগা তুম?
ব্যাপারটা ঘটেছে পাগলকে নিয়ে। দু বছর আগে পাগল একখানা র্যাপার কিনেছিল আগাসায়েবের কাছে। টাকা দেবার কথা পরের বছর। কিন্তু পাগল দেশ ছেড়েছে। টাকা আদায়ের সময় আগা এসে ওকে পায় নাই। ফিরে গিয়েছিল। এবার হঠাৎ নদীর ওপারে আজ আগার সঙ্গে পাগলের দেখা হয়ে গিয়েছে। পাগলের টাকা দেবার ইচ্ছা নাই এমন নয়, কিন্তু গতবারে যথাসময়ে দেওয়া হয় নাই বলেই ভয়ে সে ছুটে নদী পার হয়ে পালিয়ে আসতে চেষ্টা করেছে, আগাও ছুটেছে—এসে তাকে ধরেছে। রুপিয়া ফেকো! দু-চার ঘা দিয়েছে। পাগল চিৎকার করেছে। ঠিক সেই সময়েই কাজ সেরে চন্ননপুর থেকে করালী ফিরছিল। চিৎকার শুনে দল নিয়ে করালী ছুটে গিয়েছে এবং আগার সামনে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়েছে।—খবরদার! মারে গা তো মাথা ভাঙ দেগা তুমারা।
আশ্চর্যের কথা, আগা থমকে গিয়েছে।
আগাসায়েব ভীষণ লোক, ভয়ঙ্কর লোক। আগারা এ দেশে ব্যবসা করেছে এতদিন লাঠির জোরে। এই জোয়ান, এই লাঠি। একজন আগা গায়ে ঢুকলে গোটা গ্রাম ত্ৰস্ত হয়েছে। আগারা টাকার জন্য গালাগাল দিয়েছে, মেরেছে, এমনকি পুরুষদের না দেখে মেয়েদের অপমান করেছে। সেই আগার সামনে—হেই মা!
পাগল বললেকটুলী, টাকা আমি দিচ্ছি ভাই, ছাড়ান দে।
—দাঁড়াও না কেনে। ছাড়ান দোব। ওর ভিরকুটি ভাঙব আমি। বলেই সে বললে—যাও, ভাগো। টাকা কাল দেগা–কাল, যাও যাও—
আশ্চর্য, আগা আস্তে আস্তে চলে গেল—জরুর দেও, কাল রুপিয়া জরুর দেও। আচ্ছা।
–আচ্ছা, আচ্ছা। গোঁড়া হিং নিয়ে এসো। আর এইসা জবরদস্তি মৎ করো। নেহি তো হামলোক মারে গা, হাঁ।
আগা সত্যিই চলে গেল। সুড়সুড় করে চলে গেল।
কাহারপাড়ায় করালী যেন ভিনদেশী মানুষ। জাত এক হলে কি হয়, রীতকরণ আলাদা বাক্যি, যে বাক্যি শিখেছে সে হাঁসুলী বাঁকের কাহারপাড়ায়, সেই মুখের বাক্যি পর্যন্ত আলাদা। হয়ে গিয়েছে।
নিজ চন্ননপুরের মুখুজ্জেবাবুদের এক ছেলে বিলাত থেকে সায়েব হয়ে এসেছেন। চন্ননপুরের মানুষদের মধ্যে তিনি আলাদা। চন্ননপুরের কারখানা কাহারপাড়ার কাছে বিলাত; সেখান থেকে করালীও হয়েছে কাহারপাড়ার বিলাত-ফেরত। এবার আবার গিয়েছিল কাটোয়া, সেখান থেকে ফিরেছে করালী আর-এক মূর্তি নিয়ে।
করালী বাড়ি ফিরল পাগলকে নিয়ে। পাগল বললে—তোর এত সাহস ভাল নয় করালী। ওরা খুনের জাত।
—আমরাও খুন করে খুনের জাত হব। সেদিন চন্ননপুরে ওকে ঠেলা বুঝিয়ে দিয়েছি। এ তো একা ছিল। সেথা ছিল তিন জনা, জন দশেকে মিলে এসা মার দিয়েছিলাঠি-ফাঠি ফেলে দে দৌড়। শেষে এসে লাইনমিস্ত্রিকে ধরে মিটমাট করে। পঁয়ত্রিশ টাকা পেত, পঁচিশ নিয়ে ফারখৎ। ও আমাকে চেনে। বুয়েচ?
পাগল বললে–না ভাই, ন্যায্য টাকা আমি দিয়ে দোব। পরকালে গিয়ে যে—না ভাই সে হবে না।
করালী অসহিষ্ণুভাবে ঘাড় নাড়লে—সে তুমি দাও গা। কিন্তু ও এসে খপ করে হাত ধরে অপমান করবে, আমি থাকতে তা হবে না। টাকা তুমি দাও, আমি ঠিক কাটব পাঁচ টাকা–দেখো তুমি। ও তোমার পরিবার তুলে গাল দিয়েছে কেন?
–আমার তো পরিবার নাই, তা নিয়ে হাঙ্গামা কেনে?
—আজ নাই, একদিন তো ছিল। ও তুমি যাই বল, আমি শুনব না। বলেই সে একটা। গাছের গুঁড়িতে বসে পড়ল। পকেট থেকে সিগারেটের বাক্স বার করে একটা দিলে পাগলকে, একটা নিলে নিজে, অন্য সকলকে দিলে বিড়ি। তারপর মজুরদের বললে—জোরসে ভাই কাম চালাও।
করালীর ঘর তৈরি হচ্ছে। আজ মাটি তৈরির দিন। কাল দেওয়ালে নতুন পাট চড়বে। প্রায় দু হাত উঁচু দেওয়াল উঠে পড়েছে।
গোটা পাড়াটা তার চারিপাশে ঘিরে দাঁড়িয়েছে। একটা ক্ষুব্ধ হিংস্র দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রয়েছে। এতখানি দম্ভ, এতখানি আস্ফালন তারা সহ্য করতে পারছে না। পানা আসেই নাই। সে আপন ঘরে বসে বিস্ফারিত শূন্যদৃষ্টিতে তারিয়ে নীরব হয়ে বসে আছে। নয়ান হাঁপাচ্ছে, আর নখ দিয়ে মাটিতে দাগ কাটছে। নয়ানের মা আপন মনেই গালাগাল দিচ্ছে : গালাগাল দিচ্ছে পানার উঠানের নিমগাছটাকে।–গাছটা অত্যন্ত উঁচু এবং বিস্তৃতপল্লব হয়েছে, কাক বসছে, হাড় ফেলছে, ময়লা ফেলছে, হনুমানের বসত হয়েছে; গোদা হনুমানটা ওই গাছের মাথাতে এসে বসে খ্যাঁকার-খ্যাঁক্ খ্যাঁকের-খ্যাঁক শব্দে শাসায় কোপাইয়ের জঙ্গলবাসী সন্ন্যাসীর দলকে এবং মধ্যে মধ্যে কাহারপাড়ার ঘরগুলিতে নজর চালিয়ে দেখে-কার উঠানে, কার চালে, কোন গাছে ধরেছে বেগুন কি কলা কি কুমড়ো বা লাউ বা ঝিঙে। দেখতে পেলেই উপ শব্দে লাফ মেরে নয়ানের মায়ের চালে পড়ে। সেখান থেকে দেবে লাফতারপর চলে গিয়ে সেটাকে ছিঁড়ে নিয়ে আবার লাফ মেরে এসে বসবে এই গাছে। নয়ানের মা তাই গাছটাকে অভিশাপ দিচ্ছে।
***
কালোবউ–বনওয়ারী বুঝেছে—কালোবউ ইশারা দিয়ে গেল—ওই গাছে সে বাসা বেঁধেছে। হয়ত নিমন্ত্রণ জানিয়ে গেল।
খেয়েদেয়ে সুস্থ হয়েও বনওয়ারী নিস্তব্ধ হয়ে শুয়ে রইল। আশ্চর্যের কথা। কোশকেঁধে বনওয়ারী জ্বর ছাড়লে কখনও শুয়ে থাকে না। কাল জ্বর ছেড়েছে, কালই উঠে বসেছে, আজ সকালে কত্তার থান ঘুরে এসেছে। সেই মানুষ অন্নপথ্য করেও শুয়ে রইল।
কালোবউয়ের কথা সে ভাবছে। আটপৌরে-পাড়ার বটগাছটার তলায় সে দাঁড়িয়ে আছে। ডালে দোল দিচ্ছে, হয়ত দোল খাচ্ছে। গভীর রাত্রে জ্যোক্সর মধ্যে সে নিশ্চয় এগিয়ে আসবে–বনওয়ারীর ঘরের দিকে। বাঁশবাঁদির বাঁশবন এবং গাছপালার ছায়ায় অন্ধকারের মধ্যে। জ্যোত্মার সাদা গুলছাপ গায়ে মেখে ঝরাপাতার উপর পা ফেলে শব্দ তুলে এসে দাঁড়াবে তার ঘরের পিছনে। টুপটাপ করে ঢেলা ফেলে দেবে ইশারা। আরও গভীর রাত্রে বনওয়ারী উঠছে না দেখে গুনগুন করে গান গাইবে, তারপর ভোরের আকাশে শুকতারা উঠলে সে ফিরে যাবে বাঁশবনের ভিতর দিয়ে, কোপাইয়ের ধারে ধারে কত্তার দহে গিয়ে নামবে; সেখান থেকে উঠে আবার আসবে বটতলায়। বটতলা দিয়ে বনওয়ারী গেলে বটফল ছুঁড়ে মারবে কৌতুকরে, কোপাইয়ের ধারে গেলে নদীর জল অথবা বালি ছিটিয়ে দেবে গায়ে। কোনোদিন হয়ত দেখা দেবে মনোহারিণী সাজে সেজে, কোপাইয়ের ধারের শিরীষ কাঞ্চন তুলে খোপায় পরে, অথবা দহের জলে ভেজা চিকন চুলগুলি এলিয়ে, তাতে অজস্ৰ জোনাকি পোকা পরে, কালো মুখে সাদা দাঁতগুলি ঝিকমিকিয়ে হাসবে। কোনোদিন হয়ত-বা দেখা দেবে ভয়ঙ্করীরূপে, মাথা ঠেকবে শিমুলগাছের মাথায়, চোখ দুটো জ্বলবে আগুনের আঙারের মত, লম্বা হাতখানা বাড়িয়ে দেবে হিমের মত ঠাণ্ডা হাত, বনওয়ারীর ঘরের দিকে। রুদ্ধ রোষে বাঁশবাঁদির অন্ধকার-চেরা চিৎকার করবে অথবা অতৃপ্ত বাসনায় কাঁদবে, অন্ধকার উঠবে গুমরে।
শিউরে উঠল বনওয়ারী। কোশকেঁধে বনওয়ারী, দুপুর রাত্রে চন্ননপুর যায় ঘোষেদের জন্য। ডাক্তার ডাকতে। অনাবৃষ্টির বৎসরে কোপাই নদী পেরিয়ে ঘোষপাড়ার বিলের ধারে ধারে। নিঃশব্দে নিৰ্ভয়ে হঁটে বনওয়ারী—কোপাইয়ের জল কোথায় কারা বাঁধ দিয়ে আটকেছে তাই দেখতে। জাঙলে কোনো গোলমাল হলে বনওয়ারীই ছোটে সর্বাগ্রে লাঠি নিয়ে, তা সে যত রাত্রিই হোক। জাঙলে একবার ডাকাত পড়েছিল, বনওয়ারী গিয়েছিল পাড়ার লোক নিয়ে ছুটে, সে-ই দাঁড়িয়েছিল সকলের আগে ডাকাতদের মহড়া নিয়ে। সেই বনওয়ারী আজ এইভাবে শুয়ে আছে? কোনো কিছুতে তার রাগ করবার মত মনের অবস্থা কোথায়? করালীর কোঠাঘর নিয়েইবা সে মাথা ঘামাবে কি করে?
হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় কালোবউয়ের প্রেতযোনি তো অলীক নয়। পিতিপুরুষের কথার মধ্যে ওরা আছে, তারা চোখে দেখছে। ঘরের কোণে, বাঁশবনের তলায়, হাঁসুলী বাঁকের মাঠে, জলার পাশে কেউ নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে থাকে, কেউ কদে, কেউ গান করে, কেউ ঘরের চালে বসে পা ঝুলিয়ে দেয়, কেউ মাঠে মাঠে আগুন লুফে খেলা করে ছুটে বেড়ায়, কেউ জলে জলে পদক্ষেপের শব্দ তুলে ঘুরে বেড়ায়। এ ছাড়া আছে ‘ভুলো’, সে দিক ভুলিয়ে নিয়ে যায় বিপথে অপমৃত্যুর সম্ভাবনার দিকে। আরও আছে ‘নিশি রাত্রে কেউ কাউকে ডাকবার কথা থাকলে নিশি এসে তার রূপ ধরে অবিকল তারই কণ্ঠস্বরে ডাকে। সেও নিয়ে যায় ওই অপঘাত মৃত্যুর পথে। এক এক পুরুষ শেষ হলে তবে তাদের সঙ্গে মায়ায় অথবা হিংসার বাঁধা প্রেতাত্মাগুলি মুক্তি পায়; আবার নতুন পুরুষে নতুন মৃতদের আত্মা মায়া বা হিংসা যে কোনো কিছুর বশে ঘুরে বেড়ায় বাঁশবাঁদির ছায়ায় ছায়ায়—কোপাইয়ের কূলে কূলে, ঘনপল্লব গাছের আড়ালে আড়ালে, হাঁসুলী বাঁকের মাঠে মাঠে। হাঁসুলী বাঁকের অলৌকিক জগতের পরিধি বহুবিস্তৃত আকাশ থেকে মাটি পর্যন্ত, প্রেতলোক থেকে নরলোক পর্যন্ত।
সুচাঁদ আজও বলে—ঘরভাঙাদের পূব্বপুরুষ নয়ানের বাবার বাবার বাবা মরেছিল চুরি করতে গিয়ে গেরস্তের ছুঁড়ে-দেওয়া থালা কপালে গেঁথে। গেরস্তরা থালা ভেঙে শই শই করে ছেড়ে—কানাভাঙা থালা; সে থালা ঘুরতে ঘুরতে আসে সুদৰ্শনচকের মত। নাগলে আর অক্ষে থাকে না। তাই নেগেছেল কপালে। তাইতে মরল বাড়ি এসে। তা’পরেতে তিনি তাই হলেন। মা, দিন-আত ঘরের সাঙায়, না হয়ত বাড়ির পাদাড়ে, গাছের ডালে পা ঝুলিয়ে বসে থাকতেন। লোকে ভয়ে টটরস্ত! ভয় করত না কেবল তার পরিবার—নয়ানের কত্তাবাবার মা। ঘরে ছেলে শুয়ে থাকত-নয়ানের কত্তাবাবা। কচি ছেলে তখন। কাদত তো পরিবার বলত পোড়ামুখো মানুষ, মরেও সুখ দিলি না, জ্বালাতে এলি? শুধু সাঙায় পা ঝুলিয়ে বসে থাকলে হবে না, ছেলে কাঁদছে—চুপ করা। আশ্চয্যি মা, ছেলে উঠে যেত সাঙার ওপরে। দিব্যি ছেলে দোল খেত বাতাসে। তারপর চুপিচুপি বলে—একটি ছেলে নিয়ে মেয়েটি বিধবা হল—বয়স কম, তা বলে সাঙা করিস না, তা হলে ঘাড় দুমড়ে দোব। তবে ভদ্রনোকের আশ্চয়ে থাক, কিছু বলব। না। তা তাই সে ছিল। এ অঞ্চলে একজন পশ্চিমে সাউ তামুকের কারবার করত। তার নজরে পড়ে তার আশ্চয়ে ছিল। সে আসত, যেত। তাতে কিছু বলত না। একদিন ঘরে জল নাই, এতে তেষ্টা পেয়েছে। বললে—এত এতে আমি জল আনব কি করে? বলতে বলতে মা, এক কলসি। জল—কোপাইয়ের বালি-খোড়া জল এনে নামিয়ে দিলে। একবার হয়েছিল কি—সুচাঁদ মুখখানা গম্ভীর করে বলে—তখন কাৰ্ত্তিক মাস, ঠাকুরের আসপুণিমে, কাদির আজবাড়িতে খুব ধুম; ছেলেমেয়েদের সাধ হল কাদির সন্দেশ খেতে, তারা বললে—ভাই, কাদির আজবাড়িতে ভোজের মেঠাই-মণ্ডা খেতে সাধ হচ্ছে। সেই নয়ানের বাবার বাবার বাবা তার নাম ছিল অমাই, তার নাম করে বললে—তা অমাই যদি খাওয়াতে পারে, তবেই বুঝি অমাইয়ের ক্ষ্যামতা! খোনা খোনা গলায় বাঁশ-আদাড় থেকে তখুনি অমাই বললে—কাল সঁকালে আঁসিস। বললে না পেত্তয় যাবে মাসকালে নোকে গিয়ে দেখে বাঁশ-আদাড়ের মধ্যে অ্যাই এক চ্যাঙাড়ি অয়েছে, তাতে লুচি-পুরি মিষ্টি-মণ্ডা-মেঠাই—নানান দব্য। নয়ানের কত্তাবাবার গলার রজ পর্যন্ত খোনা হয়েছিল সেই তার ছোঁয়া লেগে। তার লেগে লোকের কাছে নাম হয়—খোনা কাহার। ভূত বশে থাকার তরেই তো চৌধুরীরা কাজে নিলে ওকে।
এই হল হাঁসুলী বাঁকের সেকালের ভৌতিক লোকের ইতিকথা। তবে মানুষের আধ্যাত্মিক জীবনের মত এতেও যেন পরিবর্তন ঘটেছে। ওই সুচাঁদই বলে সে কথা। দেবভক্তি কমে যাওয়ার জন্য আক্ষেপ করে বলে–এখন ভূত হলে চন্ননপুরের ছোকরাবাবুরা বন্দুক নিয়ে পাহারা। দিয়ে পরীক্ষ করে দেখতে আসবে। জাঙলে মোড়ল মহাশয়দের ছোকরারা ঠেঙা লাঠি নিয়ে আসবে। তাদের কি গরজ? কেনে তারা এইসব ঝামেলায় থাকবেন? তার চেয়ে দূরে দূরান্তরে নদীর ধারে হাঁসুলীর মাঠে দিব্যি থাকেন, শোশানের হাড়গোড় নিয়ে বাদ্যি বাজান, সাধ গেলে নদীতে বিলে মাছ ধরেন, চিতের আগুন লুফে খেলা করেন, ই গাছের মাথা থেকে হুপ করে। ভেসে চলে যান উ গাছে।
ভয়ার্ত বনওয়ারী ঘরের দরজা, এমনকি দেওয়ালের মাথার দিকে যে দুটো ছোট গোল ঘুলঘুলি ছিল সে দুটোও বন্ধ করে শুয়ে থাকল।
বউ বললেজষ্টি মাসের গরম, ভেপে যাবা যি!
বনওয়ারী চিৎকার করে ওঠে—ঠাণ্ডা লাগবে ঠাণ্ডা লাগবে।
বউ বললে—তবে তুমি ঘরে শোও, আমি বাইরে শোব।
–না।
গভীর রাত্রে সে উঠে স্ত্রীর কাপড়ের সঙ্গে নিজের কাপড় বেঁধে তবে নিশ্চিন্ত হল। ঘুম খানিকটা এল শেষরাত্রে। একটু ঘুমের পরই সে ভয় দেখে বু-বু শব্দ করে উঠল। স্বপ্নে দেখলে—কালোবউ গাছতলায় দাঁড়িয়ে কাতরাচ্ছে। তার সর্বাঙ্গে জড়িয়ে ধরেছে বাবার সেই বাহন, করালীর ঘর উড়িয়েছেন বাবার যে বাহন, বনওয়ারীর কালোবউকে ড়ুবিয়ে মারলেন যিনি–তিনি।
দিনের আলো ফুটল। বনওয়ারী আশ্বস্ত হল। শুধু আশ্বস্ত নয়—একটা রাত্রি অতীত হতেই সে খানিকটা সুস্থও হল। রাত্রেই সে ভেবেচিন্তে ঠিক করেছে—বাকুলের জাগ্রত মা-শ্মশানকালীর রক্ষাকবচ ধারণ করবে, কত্তাবাবার পুষ্পও মাদুলিতে পুরে ধারণ করবে। তা হলেই নিশ্চিন্ত। ভূত প্ৰেত যত নিষ্ঠুর-দেবতা তত দয়াল। এই সামঞ্জস্যের মধ্য দিয়েই চলে হাঁসুলী বাঁকের দিনরাত্রি। নিজেই যাবে সে। এ কথা তার প্রকাশের উপায় নাই। প্রকাশ হলে হয়ত ডাক আসবে থানা থেকে। আর পাড়াময় গ্রামময় চাকলাময় কেলেঙ্কারির একশেষ। মাতব্বর সে। লোকে তাকে দেখে হাসবে। আড়ালে নানান কথা বলবে। হয়ত লোকে আর তেমন মান্য করবে না; সে এক কাল গিয়েছে, যে কালে মাতব্বর যা করেছে তাই সেজেছে। এবার সেকাল নয়।
বউ এনে নামিয়ে দিলে মুড়ি।
বনওয়ারী বললে না। মা-কালীর থানে যাব।
উঠে পড়ল সে। পথে যেতে যেতে থমকে দাঁড়াল করালীর নতুন ঘরের কাছে। কালী নাই, দেওয়াল দিচ্ছে চন্ননপুরের পাকা ‘দেওয়াল-বারুইয়ে’, অর্থাৎ মাটির দেওয়ালের কারিগর মাটি কাটছে এখানকার কয়েকজন ছোকরা। তারাও মজুর খাটছে।
বনওয়ারীর কপালে সারি সারি কুঞ্চনরেখা দেখা দিল। মনে পড়ে গেল, অসুখের মধ্যেই সে শুনেছে করালীর কোঠাঘরের কথা; হারামজাদা শয়তান অশুভক্ষুণে করালী! গায়ে জোর হয়েছে, রেলের জাতনাশা কারখানায় যুদ্ধের চাকরিতে টাকা হয়েছে, তাই ধকে সে সরা দেখছে। বাবার বাহনকে পুড়িয়ে মেরেছে। বাবার শিমুলবৃক্ষে চেপেছে। তাঁর কোপে নতুন চাল উড়ে গেল, তবু উঁশ নাই। অতি বাড় বেড়ো না ঝড়ে ভেঙে যাবে-পিতিপুরুষের কথা। যে গাছ। অতি বাড়ে ঝড়ে ভেঙেও সে গাছের উঁশ হয় না। পিতিপুরুষের নিয়ম লঙান করে কোঠাঘর করবে। ঘরকে আরও উঁচু করবে! কাহারপাড়ার সকলকে ছাড়িয়ে উঠবার বাসনা! কাল আগাসাহেবের বৃত্তান্তও শুনেছে। খুব বড় বেড়েছে। রাগে দুর্বল শরীর মস্তিষ্ক অধীর হয়ে উঠল। কোঠাঘরে পরিবার নিয়ে শয়ন করবে। ‘হ’ অর্থাৎ হাওয়া খাবে! বড়লোকপনা দেখাবে! লোকে পথ দিয়ে যাবে, করালী কোঠার ‘বারজালা’ অর্থাৎ জানালা থেকে হেসে বলবে—কোথা যাবে গো বনওয়ারীকাকা?
বনওয়ারীকে দেখে দেওয়াল-বারুই’ মজুর সকলেই কাজ বন্ধ করে তার দিকে তাকিয়েছিল। বনওয়ারী খাতিরের পাত্র। সে যখন দাঁড়িয়ে দেখছে মন দিয়ে, তখন মন্তব্য করবেই; লোকও সে পাকা, তার মন্তব্য শুনবার জন্যই তারা কাজ বন্ধ করে অপেক্ষা করছিল। বারুই অর্থাৎ কারিগর একটু অপেক্ষা করে প্রশ্ন করলে—দেওয়ালের ধরন কেমন হয়েছে। মাতব্বর? মাপ করে করেছি তবু তোমার চোখে দেখ দি-নি—এঁকাবেঁকা ছোটবড় হয়েছে কি না?
তার উত্তরে বনওয়ার প্রশ্ন করলে—করালীবাবু মহাশয় কই?
সকলে চমকে উঠল।
বনওয়ারী নিজেই নিজের প্রশ্নের জবাব দিলে—চন্ননপুরে বুঝি?
তারপর গম্ভীরভাবে বললে—কাজ বন্ধ রাখ। তোমরা ঘর যাও।
সকলের হাত মুহূর্তে বন্ধ হয়ে গেল।
বনওয়ারী বললে—করালী ফিরে আসুক, কথাবার্তা আছে। কোঠাঘর করা হবে না। সে ধমক দিয়ে উঠল গায়ের যারা মজুর খাটছিল তাদের অ্যাই, কথা কানে যায় না, নাকি? যা, উঠে যা। ফেল্ কোদাল। নামা জলের টিন। যা—যা—
কোঠাঘর, কোঠাঘর! গায়ে টেক্কা দেবে ছোকরা! আরে টেক্কা দেওয়া কি সোজা কথা? ‘অঙের’ খেলায় টেক্কার চেয়ে গোলাম বড়, নহলা বড়। কাহারপাড়ার মাতব্বর-অঙের খেলা। নয়—এখানে টেক্কা বড়। তার পরে সায়েব। টেক্কা হলেন বাবাঠাকুর, সায়েব হল মাতব্বর। এখানে গোলাম করালীর খেলা চলবে না। এই হল বিধাতার নিয়ম; বনওয়ারীকে মাতব্বর করেছে। বাবাঠাকুরের দয়া। আরে বাবা, বনওয়ারীর ঘরের দিকে চেয়ে দেখ। সে কি করতে পারত না। একখানা কোঠা? পিপড়ের পালক উঠেছে। পিপীলিকার পালক ওঠে মরিবার তরে। মঙ্গল অমঙ্গল। বুঝতে পারে না, ঝকমকে কিছু দেখলেই ফরফর করে উড়ে যায়; পুড়ে মরে, ধাক্কা খেয়ে মরে, দিশেহারা দেশহারা হয়ে মরে। হাঁসুলীর বাঁকের সোনার মাঠ। এ মাঠ গ্রীষ্মে যত কঠিন, বর্ষায় চাষ খোড়ের পর তত নরম, তত মোলাম। এই মাঠের ধানে পানে, কলাইয়ে পাকড়ে, তরিতে। তরকারিতে যার পেট ভরল না তার পেট দুনিয়ার কোথায় ভরবে? এ মাটি চষে খুঁড়ে যার পেট ভরে না, বুঝতে হবে তার অদৃষ্টের দোষ, পূর্বজন্মের কর্মফল, এ জন্মের কুটিল মনের কুঁড়ে গতরের সাজা। এককাল গিয়েছে, সেকালে কাধে ঘটা ফেলে বেহারাগিরি করে বাচত কাহারেরা, তারপর কত্তাঠাকুরের দয়া হল, তিনি মন্বন্তরের মাঝে কাহারদের দিকে ফিরে তাকালেন। চৌধুরী মহাশয়কে স্বপন দিয়ে ভিটে দেওয়ালেন, ভাগে কৃষণিতে কাহারদের জমি দিতে বললেন। চৌধুরী মহাশয় মারফতে কর্তার সে আদেশ কাহারদের উপরে। তাঁর দয়াতেই তো গোটা হাঁসুলী মাঠের অর্ধেকের উপর তাদের করতলগত। জাঙলে ঘরকয়েক হাড়ি ডোম আছে, মুচি আছে, আগে তারাই করত জাঙলের সদূগোপ মহাশয়দের জমি। আজ তারা হটে গিয়েছে। এককালে যে কাহারেরা চাষকৰ্ম জানত না, আজ তাদের চেয়ে ভাল চাষী ‘মুনিষ’ এ চাকলায় নাই।
করালী হতভাগা-করালী বদমাশ। শুধু তাইবা কেন? করালী অশুভকক্ষুণ; অশুভক্ষণটিতে ওর জন্ম। ওই চন্ননপুর রেললাইনে ওর মায়ের কেলেঙ্কারি টেলিগেরাপের খুঁটিতে খুঁটিতে কান পাতলে আজও শুনতে পাওয়া যায়। গাড়ি চলে যায় লাইনের উপর দিয়ে, তারে যে শব্দ হয় তাতে শুনতে পাওয়া যায়। এখন ছেলেরা মেয়েরা বলেগাড়িটা বলছে, কাচা তেঁতুলপাকা তেঁতুলকঁচা তেঁতুল পাকা তেঁতুল। আগে লোকে বলত—সিদু-জগাপেবাতী, গেল কুল গেল জাতি—সিদু-জগাপেবাতী। প্রভাতী ছিল করালীর মায়ের নাম। হতভাগা শুনতে পায় না সে ছড়া ওই শব্দের মধ্যে? সেই চন্ননপুরের রেললাইনে চাকরি করে বুক ফুলিয়ে বেড়ায়? ‘নিলেজো’ অর্থাৎ নির্লজ্জ হতভাগা। আবার যুদ্ধ দেখায় সকলকে, যুদ্ধের পোশাক পরে যুদ্ধের কাজের লোভ দেখায় কাহারপাড়াকে!
যুদ্ধ। যুদ্ধযুদ্ধ তো হাঁসুলী বাঁকের কি? যুদ্ধ কি বনওয়ারী জানে না? না, শোনে নাই? কটা যুদ্ধের কথা তুই জানিস? রাম-রাবণের যুদ্ধ গিয়েছে, কুরুক্ষেত্র গিয়েছে, বাণরাজার সঙ্গে ভগবান হরির যুদ্ধ গিয়েছে, রাবণ নির্বংশ হয়েছে, ধর্মপুত্ৰু রাজা হয়েছেন, রাজা দুৰ্য্যোধন মরেছে, বাণ-রাজার বেটীর সঙ্গে হরির লাতির বিয়ে হয়েছে। কাহারদের কি হয়েছে? কাহারেরা বাবা কালারুদ্র আর বাবাঠাকুরকে ভজে বেঁচে আছে। বৰ্গী হাঙ্গামা গিয়েছে, সাঁওতালরা ক্ষেপেছিল যুদ্ধ হয়েছিল, জনিস তুই? এই তো বিশ বছর আগেও আর একবার যুদ্ধ হয়ে গিয়েছে। তাতে হাঁসুলী বাঁকের কি হয়েছে? ভাল হয় নাই। মন্দ হয়েছে। মন্দ হয়েছে অভাব এসেছে, রোগ এসেছে, দুঃখ এসেছে, সুখের কাল ঘুচিয়ে দিয়েছে। আবার লেগেছে যুদ্ধ, লাগুক। আরও খানিকটা মন্দ হবে। তার বেশি কিছু হবে না। হাঁসুলী বাঁকের মাথার উপর উড়োজাহাজ উড়ছে, উড়ুক। কিন্তু যুদ্ধের ঢেউ বাঁশবাঁদির বুকে আছাড় খাবে না। বাবাঠাকুর আছেন। পৃথিবীর ভালমন্দতে হাঁসুলী বাঁকের কি যায় আসে?
ঘর বন্ধ করে দিয়ে সে কালীর থানে রওনা হল।
***
কালীর থান থেকে মাদুলি নিয়ে সে ফিরল।
মা-কালী ও কত্তাঠাকুরের পুষ্প নিয়ে স্যাকরা-বাড়ি থেকে কিনে আনা দুটি রুপোর মাদুলীতে পুরে স্নান করে শুদ্ধ কাচা কাপড় পরে লাল সুতোয় বেঁধে ধারণ করে সে নিৰ্ভয় হল। তারপর খাওয়াদাওয়া সেরে মনে এবং দেহে বেশ সুস্থ হয়ে করালী সম্পর্কে সংকল্প স্থির করলে সে। মনটা এখন শান্ত হয়েছে, মনে হল ভাগ্য ভাল যে তখন রাগের মাথায় কিছু করে বসে নাই। করালীকে সামনে পেলে তখন হয়ত তাই হত। সে হলে বড়ই লজ্জার কথা বড়ই কেলেঙ্কারির ঘটনা হত সেটা। কত্তা রক্ষা করেছেন তাকে, পিতিপুরুষের আশীর্বাদে রক্ষা পেয়েছে বনওয়ারী। সে প্রবীণ মাতব্বর লোক, তার পক্ষে এমন রাগ বিশেষ করে ওই ছেলেছোকরার উপর রাগ কি শোভা পায়। না, উচিত হয় সেটা? পাড়ার মঙ্গল, প্রতিটি লোকের মঙ্গল তাকে দেখতে হবে প্রতিটি লোককে ‘পেঁহ’ অর্থাৎ স্নেহ করে ‘কোলগত’ করে রাখতে হবে নইলে কিসের মাতব্বর। তা ছাড়া ছোকরার ‘এলেম’ অর্থাৎ কৃতিত্ব আছে। কাল আগাসায়েবকে শিক্ষা দিয়েছে, এটাকে সে ভালই বলবে। গায়ে ক্ষমতা ধরে, বুকের পাটা আছে। ভবিষ্যতে মরদের মত মরদ হবে! বনওয়ারীর ছেলেপুলে নাই, করালী যদি অনুগত হয়ে থাকে তবে তাকেই শেষ পর্যন্ত সে মাতব্বর করে যাবে পাড়ার। তার জন্য ছোকরার মাথায় ‘হিতবুদ্ধি দিতে হবে। একদিন গোপনে ডেকে বলতে হবে ছোকরাকে খুলে, ‘হিয়া-খানিকে খোলসা করে বলতে হবে।
আরাম করে তামাক খেয়ে সে বাইরের দাওয়ায় গড়াল একটু। আটপৌরে-পাড়ার বটগাছের মাথাটা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। দুলছে মাথাটা। যতই দুলিয়ে ইশারা দাও সখি, বনওয়ারী আর ভুলছে না, তোমার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে এখন বনওয়ারী। মা-কালীর কবচ, বাবা কত্তাঠাকুরের কবচ বনওয়ারীর হাতে। তবে দুঃখ তোমার জন্যে হয়। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে বনওয়ারী। কিছুক্ষণ পরে সে উঠে গেল সায়েবডাঙায়। দিন যাচ্ছে, না জল যাচ্ছে। যে জল। কোপাইয়ে বয়ে চলে যায়—সে জল আর ফেরে না। যে দিনটি গেল, সেটি আর ফিরবে না। সায়েবডাঙার জমিটা এবার আর তার হাসিল হল না। তবু মনের টানে সে সায়েবডাঙায় গিয়ে উঠল।
সায়েবডাঙা থেকে বনওয়ারী গেল জাঙল গাঁয়ে। মনিব-বাড়িতে আজ পনেরবিশ দিন যাওয়া হয় নাই। মনিববাড়ি থেকে লোক এসে খোঁজ করে গিয়েছে। বলে গিয়েছে, ঘোষ। বাড়িতে কাজ আসছে। মাইতো ঘোষ আজ রাত্রে আসবেন, মাইতো ঘোষের ছেলের অন্নপ্রাশন হবে। ঘোষ-বাড়ির কাজে বনওয়ারীর কর্তব্য অনেক। কাঠ কাটা, বাড়ি পরিষ্কার করা, উনোন পাতা, হাট, তরিতরকারি আনা-নেওয়া অর্থাৎ মজুরদের কাজের সব ভারই বনওয়ারীকে নিতে। হবে। পাড়তে আবার সে কথাটাও বলতে হবে। মজুরি পাবে—সে কাজ বাইরের লোক পায়। কেন? তা ছাড়া পাত পেড়ে প্রসাদের সঙ্গে বালতিভরতি বাড়তি ভাত তরকারি ডাল ছাঁদা সেও মিলবে। এটোপাতা পরিষ্কার করবে, সড়কি বাসনগুলো মাজবে মেয়েরা তার জন্য জানাহি এক পাই অর্থাৎ আধ সের চাল, আর আঁচলে মুড়ি পাবে। অবিশ্যি কাজের এখনও দেরি আছে, মাস তিনেক। তবু করতে হবে তো। হঠাৎ সে চঞ্চল হয়ে উঠল। মনে পড়ে গেল করালীর কথা। করালী বলেছে—জাত যায় এঁটো খেলে। কাহারেরা সদ্গোপদের এঁটো খায়।
ঘোষ-বাড়ি ঢুকতেই বড় ঘোষ বললেন—কি রে! শরীর আবার অসুখ করছে নাকি?
বনওয়ারী মাথা ঝুঁকি দিয়ে বললে মাথার ভেতর দপদপ করছে। তা সেরে যাবে।
মাইতো-বউ বললেন—কি গো কাহার দেওর, এই সময় অসুখ করলে? ঘরে কাজ!
বনওয়ারী বড় ঘোষের চেয়ে অনেক বড়, তবু ‘জাতে ছোট’ বলে বউয়েরা ওকে ‘কাহারদেওর’ বলে। বনওয়ারী হেসে বললে—সেরে উঠেছি বউঠাকরুণ, আর ভাবনা কি? আর দু-চার দিনে যেকে সেই হয়ে যাব। হুকুম করেন কি করতে হবে।
বড় বউ বললেন—তোমাকে আজ কিছু করতে হবে না। তুমি মান্দের ছোঁড়াকে বলে যাও, কাটা কাঠের উপর যেন তালপাতা ঢেকে দেয়। মেঘ চমকাচ্ছে, আকাশে ছটাও বাজছে। জল হলে শুকনো কাঠ ভিজবে।
বড়গিনি খুব খুঁশিয়ার গিন্নি। বটে, আকাশ থেকে থেকে যেন চমকে উঠছে। সূর্য ঢাকা পড়ছে পশ্চিমে। বনওয়ারী দাঁড়িয়ে থেকে কাঠ ঢাকা দেওয়ালে। শেষে নিজেও এক-আধবার হাত লাগালে।
ফেরবার সময়ে আঁচলে মুড়ি নাড় নিয়ে ফিরল সে। আরও কয়েকটি জিনিস সংগ্রহ করেছে। সেখাটের এক টুকরো ছত্রির ভাঙা ডাণ্ডা, চমক্কার টামনার বট হবে। আর পেয়েছে একটা হাত-পা ভাঙা কাচের পুতুল-মাটির মধ্যে চাপা পড়ে ছিল সেটা। ঘরের তাকে দিব্যি সাজানো থাকবে। আরও পেয়েছে খানিকটা সুতো আর একফালি প্যাকিং পেপার। সুতোটায় কাজ হবে, কিন্তু কাগজটায় কি হবে তার কিছু ঠিক নাই। দুটি ঝকমকে ধাতুর বোতামও পেয়েছিল, সে দুটি বউঠাকরুণকে দিয়ে এসেছে; কে জানে সোনাদানা কি বটে।
ফেরবার পথে কালারুদ্রতলায় ‘কর্তার থানে’ সে আবার প্রণাম করলে। বিপদে রক্ষা কোরো প্রভু, মাঠে ফসল দিয়ে, আর যেন কুমতি না ঘটে, কাহারপাড়ার মঙ্গল কোরো। কর্তার থানে প্রণাম করতে গিয়ে হঠাৎ তার একটা কথা মনে হল। মনে পড়ল, আটপৌরে-পাড়ার ‘অমনের কথাগুলি। সে মানত করলে কর্তার কাছে—যদি আটপৌরে-পাড়ায় কাজটি হয়, কাহারেরা যদি আটপৌরেদের সঙ্গে এক ‘থাকে’ অর্থাৎ স্তরে ওঠে, তা হলে সে বাবার ‘বেলবিক্ষ’তলাটি বাঁধিয়ে দেবে, যেমন ঘোষেরা দিয়েছে ষষ্ঠীতলা বাধিয়ে। কালারুদ্রতলা এখন ফেটেছে, এককালে চৌধুরীরা ওই কালারুদ্রতলা বাঁধিয়েছিল।
প্রণাম সেরে উঠেই বনওয়ারী অবাক হয়ে গেল। একটি সুন্দরী যুবতী মেয়ে তার দিকে চেয়ে দেখতে দেখতে চলে যাচ্ছে—মেয়েটি চলছে যেন হেলেদুলে।
বনওয়ারী অবাক হয়ে গেল—কে মেয়েটি? মেয়েটির মধ্যে যেন কালোশশীর ঢঙ আছে। অবিকল কালোশশীর মতই দেখতে।
মেয়েটি গিয়ে দাঁড়াল সেই বটগাছতলায়। বনওয়ারী একদৃষ্টে চেয়ে রইল তার দিকে। তার বুকের ভিতরটায় যেন চেঁকির পাড় পড়ছে। কালোবউ কি মোহিনী রূপ ধরে তাকে ভুলিয়ে নিয়ে যেতে এসেছে? সে মাদুলিটি ঠেকালে কপালে।
–কে? বনওয়ারী?
—কে? বনওয়ারী চমকে ফিরে তাকালে। বুড়ো রমণ আটপৌরে আসছে জাঙল থেকে। রমণ বললে—কথাটা ভেবে দেখেছ? আজ যাব ‘এতে’ তোমার পাড়ায়।
—বেশ। এসো। বনওয়ারী অন্যমনস্কভাবেই বললে—সে আবার তাকিয়ে দেখলে গাছতলার দিকে না, কালোবউ মোহিনী সেজে আসে নাই। তা হলে রমণকে দেখে সে নিশ্চয় অদৃশ্য হয়ে যেত। তবে ও কে?
মেয়েটি এবার কথা কইলে। চেঁচিয়ে ডাকলে—এস কেনে গো মেসো। দাঁড়িয়ে থাকব কত?
ও রমণকে ‘মেসো’ বলছে। তবে কালোবউয়ের বোনঝি। তাই তার মত দেখতে। সে নিশ্চিন্ত হয়ে আবার প্রণাম করলে বাবাঠাকুরকে।
সবে প্রণামটি সেরে উঠেছে বনওয়ারী, অমনি কোথায় একটা গোল উঠল। দিক নির্ণয়ের জন্য অন্য কোনো দিকে তাকালে না, তাকালে কাহারপাড়ার দিকে।
করালী—করালী–করালী। আর কে? একা করালীই কাহারপাড়ার হাজার গোলমাল তৈরি করছে। বনওয়ারী এসে দাঁড়াল করালীর উঠানে। চারিদিকে লোক জমে রয়েছে, মাঝখানে। করালী অন্য একজনের হাত চেপে ধরে ছাতি ফুলিয়ে বুনো জানোয়ারের মত চিৎকার করছে, ফুলছে। লোকটা কে? চৌধুরী-বাড়ির মাহিন্দার, আটপৌরে-পাড়ার নবীন। ব্যাপার কি? হল কি? কেউ বলে না। লোকের দুঃখে যেন বারোধ হয়ে গিয়েছে। বসন্ত বিবৰ্ণমুখে দাঁড়িয়ে আছে। করালী চিৎকার করছে—মানি না আমি। কারু হুকুমে যাই না আমি। আইন আছে, আদালত আছে, পারে তো আমাকে উঠিয়ে দিতে বলিস। জোর করতে এলে আমারও জোর আছে।
সুচাঁদ তারস্বরে কাঁদছে।
কিন্তু হল কি? নীলের বাঁধ সম্পর্কে কাহারেরা চৌধুরী-বাড়ির বাঁধের পাড়ের চাকরান প্রজা। বরাবর নিয়ম, ঘর ভেঙে ঘর করতে হলে চৌধুরীদের হুকুম নিতে হয়। মুখে বললেই হুকুম হয়ে যায়—এক টাকা নজর দিতে হয়। নজর এক টাকা পাঠিয়ে দিয়েছে করালী বসন্তকে দিয়ে। কিন্তু আজ চৌধুরী-বাড়ির লোক এসেছে করালীকে নিয়ে যাবার জন্য এক টাকা নজর দিয়ে কোঠাঘর করার কথা নয়। আর কোঠাঘরের শর্তও নাই কাহারদের সঙ্গে। আগেকার বিক্রম থাকলে চৌধুরীদের পাইক এসে গলায় গামছা দিয়ে টেনে নিয়ে যেত। একালে সর্বস্ব গিয়ে চৌধুরীরা বিষহীন সাপ, তারা পাইকের বদলে আটপৌরে-পাড়ার নবীন মাহিন্দারকে পাঠিয়েছে করালীকে সঙ্গে নিয়ে যাবার জন্য। নবীন করালীকে ঠিক ওজন করতে পারে নাই। চৌধুরী-বাড়ির ভাঙা দালানের নোনা-ধরা ইটের দাওয়া থেকে হুকুম নিয়ে আটপৌরে পূর্বপুরুষদের ঘুণ-ধরা-বাঁশের লাঠি হাতে এসে করালীর হাতখানা খপ করে ধরে বলেছিল–এই চল্ হুকুম আছে ধরে নিয়ে যেতে।
–হুকুম? কার হুকুম?
–চৌধুরী মাশায়ের।
করালীর মেজাজ খারাপ হয়েই ছিল। লাইনের কাজ থেকে ফিরেই সে বনওয়ারীর দেওয়াল বন্ধ করার খবর শুনেছিল। এক কথাতেই মাথা গরম হয়ে গেল তার। আটপৌরে ছোঁড়ার লাঠিটা কেড়ে নিয়ে ফেলে দিলে, এবং নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ঘোড়াটার হাতটা খপ করে চেপে ধরল। রীতিমত হাতখানা মুচড়ে ধরে চিৎকার করতে লাগল। অসংবদ্ধ প্রলাপ নয়-রীতিমত আইনের কথা। শিখেছে ওই চন্ননপুরের ইস্টিশানে। সেটেলমেন্ট হয়ে গিয়েছে—পরচা আছে। তার। তাতে লেখা আছে, বাস্তুভিটা তার। সেখানে যে যেমন ইচ্ছা ঘর করতে পারে; এমনকি, যে এক টাকা ভালমানুষের মত দিয়েছে তা দেওয়ারও কোনো প্রয়োজন ছিল না, খাজনার দরুন একটি বেগার তাকে দিতে হবে—সেও সে ইচ্ছে করলে গতরে খেটে দিতে পারে, ইচ্ছে করলে একজন মজুরের মাইনে ঝনাৎ করে ফেলে দিয়েই খালাস।
চৌধুরীরা সেটেলমেন্টের সময় পালকি-বহনের দাবির বদলে মজুর বেগারই চেয়েছিলেন। বারান্দার ছাদ ধসে পড়ে পালকি তাদের ভেঙে গিয়েছে। বেহারার চেয়ে বেগারই তাদের বেশি। উপকারে লাগবে—এই হিসাবই তারা করেছিলেন। সে কথা যাক, পাড়ার লোকেরা–করালীর ঔদ্ধত্য দেখে নয়, তার এই আইনের ব্যাখ্যার অভিনবত্ব এবং দখলের জোর দেখে স্তম্ভিত হতবাক হয়ে গেল।
বনওয়ারী এগিয়ে এসে নবীন এবং করালীর মাঝখানে পড়ে বললে–ছাড়।
করালী তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললে—এই যে! তাই বলি, মাতব্বর কই? তোমার সাথেও আছে যে একচোট! বলি তুমিইবা আমার ঘর বন্ধ করেছ কেনে?
বনওয়ারীর মাথায় আগুন জ্বলে গেল। সে থরথর করে কাঁপতে লাগল। সে অকস্মাৎ একটা হুঙ্কার দিয়ে উঠল—বাজ ডেকে উঠল যেন!
তারপর যে কাণ্ড ঘটল, সে কাও উপকথায় খাপ খায়, একালের কথায় শোভন হয় না। কিন্তু তবু হাঁসুলীর বাঁকে ঘটে।
করালীও সেটা কল্পনা করতে পারে নাই। প্রহ্লাদ রতন গুপী পানা প্রভৃতি প্রবীণেরা এল কোদাল নিয়ে। জন কয়েক চেপে ধরলে করালীকে। বাকি কয়জন চালাতে লাগল কোদাল। তার কোঠাঘরের বনিয়াদ তছনছ করে দিলে। বনওয়ারী পঁড়িয়ে রইল স্থিরভাবে। মধ্যে মধ্যে আঙুল দেখিয়ে হুকুম দিলে—এইখানটা ‘অইল’, ফেল কেটে।
হেঁইয়া, হেঁই-হো; হুম-হুহ; হাঃ-হাঁ–বিভিন্ন মুনিষে বিভিন্ন শব্দ করে কোদালে কোপ মারছে। পানার উৎসাহ সকলের চেয়ে বেশি। সে কাটছে—হেঁই-হেঁই। হঠাৎ কে চিৎকার করে উঠল তীক্ষ্ণ গলায় সরে যাও, সরে যাও। অবাক হয়ে গেল সকলে। টলতে টলতে আসছে একটা কঙ্কালসার মানুষ। তারও হাতে কোদাল। সে হেঁপো-রোগী নয়ান।
—সরে যাও, সরে যাও। আমি কাটব। তার পাজরার নিচে হৃৎপিণ্ড লাফাচ্ছে—দেখতে পাওয়া যাচ্ছে, চোখ দুটো বড় বড় হয়ে উঠেছে, যেন জ্বলছে।
করালী আর চঞ্চল নয়, তার সর্বাঙ্গে ধুলো, সেও অদূরে দাঁড়িয়ে স্থির হয়ে দেখছে। পাখীও স্থির হয়ে দেখছে, তার দৃষ্টি একটি লোকের উপর নিবন্ধসে ওই হেঁপো-রোগী নয়ান। সে দৃষ্টি যেন বিষদৃষ্টি।
করালী হঠাৎ পাখীর হাত ধরে বললে—আয়, চলে আয় চন্ননপুর।
গটগট করে সে চলে গেল। নয়ানের তাতেও আনন্দ।
তারপর বসল মজলিস।
বনওয়ারী বসল থমথমে মুখ নিয়ে। বনওয়ারীর এমন চেহারা অনেকদিন কেউ দেখে নাই। বনওয়ার কথা বলতে লাগল আস্তে আস্তে। বনওয়ারীর এমন কণ্ঠস্বরও অনেকদিন কেউ শোনে নাই। শুধু তাই নয়, গোটা পাড়াটার ভাবভঙ্গি যেন আর একরকম হয়ে গিয়েছে। এমন থমথমে অন্ধকারও যেন অনেকদিন নামে নাই। সেই সেকালের হাঁসুলী বাঁকের রাত্রি যেন ফিরে এল।
বনওয়ারী বললেচন্ননপুরের লাইনে যে খাটতে যাবে, তার ঠাঁই কাহারপাড়ায় হবে না। পিতিপুরুষে যা করে নাই, তা করতে নাই। ছত্তিশ জাতের কাণ্ড। পয়সা বেশির দিকে তাকালে হবে না। সে পয়সা থাকবে না। স্বভাব মন্দ হবে। এতবড় হাঁসুলীর মাঠে যার পেট ভরবে না, তার পেট অভর। পিথিমীর কোথাও সে পেট ভরবে না। এই মাঠে বুক দিয়ে খাট-দু হাতে খাও। মনে কর—ভগবান এই কৰ্ম্ম করতেই হাঁসুলীর বাঁকে জন্ম দিয়েছেন। ওই অ্যাললাইনের ধারে তো কেউ জন্মায় নাই। যে যাবে তার সব্বনাশ হবে। এ আমার কথা নয়। কত্তাঠাকুরের কথা। আজই সন্জেতে এই করালীর ঘরে গোল ওঠবার আগে—আমি পেনাম করছি, কথাটি আমার মনে হল। কত্তা আমায় মনে পড়িয়ে দিলেন।
ঠিক এই সময় আটপৌরে-পাড়ার রমণ এসে দাঁড়াল। সঙ্গে আটপৌরেরা।
–বনওয়ারী।
–কে?
–আমি অমন, সেই কথাটার তরে এলাম।
—এস, এস, এস। বস, সব বস।
মজলিসে কথা পাড়লে।
এক অদ্ভুত রাত্রি! কাহারপাড়ার সায়েব মোয়দের আমলে দু-ভাগ হয়েছিল তারা। পরমেরা লাঠি নিয়ে আটপৌরে হয়েছিল, বনওয়ারীরা পালকি কাধে নিয়ে কাহার হয়েছিল। অনেকদিন দু পাড়ারই সে আমল ঘুচে গিয়েছে; চাষই করে আসছে দু দলে, কালেকস্মিনে এরা পালকি বয়, ওরা রায়বেশে নাচে। তবু এতদিন ওরা সেই ভিন্নই ছিল। আজ সেই ভেদ ঘুচল। পরমের জমিটা বলে কয়ে আটপৌরেদের করে দেবে বনওয়ারী। আর যাবে থানায়, বলবেহলফ করে বলবে—আটপৌরেরা আর চুরিতে নাই, ডাকাতিতে নাই, পাপের ছায়া মাড়ায় না। তা ছাড়া পরম বিদেয়া হয়েছে, পাপের জড় মরেছে। খালাস দেন হুজুর। তাতে হুজুরদের সম্মান আটপৌরেরা করবে। মুরগি, খাসি, দুধ তা ছাড়া পান খেতে কিছু, তাও দেবে। অবিশ্যি। একদিনে এ কাজ হয় না, এক বছর দু বছর লাগবে। লাক। বনওয়ারী নিজে জামিন থাকবে। তবে আটপৌরে-পাড়াকে তার ‘রুপদেশ’ মেনে চলতে হবে।
বনওয়ারী বললে–আজি থাক তো দেখ।
রাজি না হয়ে আটপৌরেদের আর উপায় নাই। আটপৌরেদের অবস্থা যে মারাত্মক রকম খারাপ হয়ে পড়েছে। সংখ্যায় তারা চিরদিনই কাহারদের চেয়ে কম, তার উপর লাঠি ধরার কাজ করে কুলীন হওয়ার অহঙ্কারে আজও পর্যন্ত তারা গোফে তা দিয়ে আর মুখে হুঙ্কার দিয়ে কাল কাটিয়ে এসেছে। চাষ করলেও আটপৌরেরা কোনো কালেই চাষের কাজ ভাল করে না। এতে তাদের মনই নাই। চুরি-ডাকাতিতে তাদের নাম আগে হয়। আগে এ নাম ছিল গৌরবের, এখনও অবশ্য তারা খুব অগৌরবের মনে করে না, কিন্তু এখন ও নামটা আতঙ্কজনক হয়ে উঠেছে। পুলিশের চাপে, পৃষ্ঠপোষকের অভাবে, মার খেয়ে সহ্য করার ক্ষমতা কমে যাওয়ায়। সে রামও নাই সে অযোধ্যা নাই। সেকালে ডাকাতদের রক্ষাকর্তা মাল-সামালদার বড় বড় বাড়ির মোটা মোটা কর্তারা যে আজ আর নাই; মাতব্বর পর্যন্ত নাই। নামে মাতব্বর পরম, সেও পালিয়েছে, কোনো সন্ধান নাই তার। সন্ধান পেলেও তার রক্ষা নাই, এবার পুলিশ তাকে কালোবউকে খুন করার অপরাধে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে দেবে। এদিকে দিন দিন অবস্থা সাংঘাতিক হয়ে উঠছে। বিলাতে যুদ্ধ লেগেছে। ধান-চালের দর বাড়ছে, নুন তেল কাপড়ের দরে আগুন লেগেছে। অনেক দ্রব্য বাজারেই নাই। আটপৌরেদের বাঁচতে হবে। এ কাজ বনওয়ারী পারে—এ ভরসা। তাদের আছে। সে জামিন হলে আটপৌরেরা জাঙলে সদ্গোপ মহাশয়দের বাড়িতে কৃষণি পাবে। বনওয়ারী থানায় গেলে দারোগা তার কথা বিশ্বাস করুক আর না কক, অন্তত কানে শুনবে। কানে দু-দশ বার যেতে যেতেই বিশ্বাস জন্মাবে। হরি বলতে বলতে চোর সাধু হয়, সাধুকে দশে চোর বললে সে চোরই হয় দশের কাছে। তা ছাড়া একটা সদ্য প্রলোভনের সামগ্রী ওই সায়েবডাঙার জমি। পরম যে জমিটা নিয়েছিল সেই জমিতা। পরম ফেরার, কালোবউ। মরেছে, ওয়ারিশ কেউ নাই। এখন ওই জমিটার উপর দৃষ্টি পড়েছে আটপৌরেদের। মালিক চন্ননপুরের বড়বাবু। তার হুকুম চাই। আটপৌরেদের চাষী হিসেবে সুনাম নাই আর বড়বাবুর ‘ছামুতে’ গিয়ে দাঁড়াতে তাদের সাহসও নাই। সাহস করে দাঁড়াতে পারত পরম, আর পারে। বনওয়ারী। আজ সেই কারণে বনওয়ারীকে তাদের মাথায় নিতেই হবে।
আটপৌরে-পাড়ার সকলেই বললে—‘আজি’। হ্যাঁ, আজি।
রমণ জোর গলায় সায় দিলে–নিশ্চয় আজি।
নিমতেলে পানা শয়তানের বুদ্ধি মন্দ, কিন্তু ভারি হিসেব তার। পানা বললে—আপনার। গরজে ধান ভানে মরদে। বনওয়ারীকাকাকে মাতব্বর তো করলে, কিন্তু আমাদের সঙ্গে চলবে তো? আর ঘোড়াগোত্ত বলে পেথক হয়ে থাকবে না তো? তা বল। লইলে বনওয়ারীকাকার মাতব্বরির লোভ থাকলেও আমরা হতে দোব না। হুঁ-হুঁ।
কথাটায় আটপৌরেরা চুপ করে গেল। এদিকে কাহারদের সকলে ঘাড় নেড়ে যায় দিয়ে উঠল—ঠিক বলেছে, পানা ঠিক বলেছে। কিসের দায় আমাদের?
পানা বললে—ব্যানোকাকা নিজেই লিতে পারে পরমের জমি। আমাদিগে করে দিতে পারে।
রমণ তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললে—‘পেটে ভাত নাই ধরমের উপোস’। জাত বেজাতের কৰ্ম্ম করে যাওয়ার চেয়ে কাহারদের সঙ্গে চলা ঢের ভাল। আটপৌরেরা কাহারেরা—এক হাতের দুটো আঙুল, এক বংশের দুই গোত্ত। তোমরাও যা, আমরাও তাই। খেতে-দেতে মানা নাই। করণ-কারণ বিয়েশাদিটাই হয় না। তা তোমরাও পালকি বহনটি ছাড়, আমরাও তোমাদের সঙ্গে এক হয়ে যাই। কি বল সব?
আটপৌরেরা সায় দিলে এবার। ছাড়, পালকি বহন ছাড়।
বনওয়ারী ঘাড় নাড়লে—উহু। সে হয় না। বেবাহ আর জ্ঞানগঙ্গা এ দুটিতে ডাকলে যেতেই হবে। লক্ষ্মী আর লারায়ণের দুই হাত এক হয়, তাদের বহন করতেই হবে। জ্ঞানগঙ্গা যায় পুণ্যাত্মা-লক্ষ্মীমান। পুণ্যবলে সশরীরে স্বগ্গো যাত্তা। তাকে কাঁধে বহন করলে পরলোক গতি হয়। ও দুটিতে ডাকলে যেতেই হবে। সে ‘না’ বলতে পারব না। তাতে তোমরা আলাদা থাকতে চাও, থাক। খুশি তোমাদের।
রমণ একটু ভেবে বললে—তাই–তাই।
পানা বললেহরি হরি বল ভাই! বল—জয় বাবা কত্তাঠাকুর!
সমস্বরে ধ্বনি দিয়ে উঠল কাহার এবং আটপৌরেদের দুই দলেই।
ধ্বনি থামতে পানা বললে—বেশ, তবে আজই মজলিসে একটা করণের কথা কয়ে ফেল। হয়ে যা—সব কথার শ্যাষ ব্যাশ।
—করণ? ঢোক গিলতে হল আটপৌরেদের।
পানু বললো, করণ। আমি বলছি। এগিয়ে এসে মজলিসের মাঝখানে সে চেপে বসল। পানু আজ ভারি খুশি করালী দূর হয়েছে গ্রাম থেকে। সে আবার বনওয়ারীর কাছ ঘেঁষে বসবার সুবিধে পেয়েছে। সে বললে—তোমার যে শালীর বিধবা কন্যেটি এসেছে অমনকাকা, তার সঙ্গে বনওয়ারীকাকার সাঙা হোক। কাকার ছেলেপিলি হল না, পাড়ার মাতব্বর বংশ লোপ পাবে তা হবে না। কি বল গো সব? পানা চতুর, সে ঠিক লক্ষ্য করেছে যে মেয়েটির মধ্যে কালোশশীর ঢঙ রয়েছে। বনওয়ারী আজ করালীকে তাড়িয়েছে, সে বনওয়ারীকে আজ খুশি করতে চায়।
রমণের স্ত্রীর বোনঝি—কালোবউয়ের বোনঝি—বনওয়ারী তাকে আজই দেখেছে বিকালবেলায়। কালোবউয়ের ঢঙ তার সর্বাঙ্গে। মেয়েটি যুবতী। কালোশশীর রঙ ছিল কালো এ মেয়েটির রঙ মাজা। মেয়েটি বিধবা হয়েছিল একটি সন্তান নিয়ে। সন্তানটিও মারা গিয়েছে। মায়ের কাছে আশ্রয় নিয়েছিল। মায়ের ইচ্ছা ছিল, সাঙা দেবে। কিন্তু তার আগেই মা গেল মরে। মেয়েটি এসে রমণের ঘাড়ে পড়েছে।
রমণ ভাবছিল। জালের বন্ধনে তাকেই প্রথম পড়তে হবে—এ কথা সে ভাবে নাই। তবে ভরসার মধ্যে, সুবাসী তার শালীর কন্যে, নিজের বোনও নয়, বেটীও নয়, ভাইঝিও না, বোনঝিও না, ওর দায়ে তার জাত যাবে না।
বনওয়ারী চুপ করে বসে ছিল। সে ভাবছিল কালোবউয়ের কথা। ভাবছিল, মেয়েটিতে তার কালোশশীর অভাব মিটবে। ভাবছিল, এমনভাবে যেচে উঁচু কুলের মেয়ে যখন আসছে, তখন। তাকে ঠেলা আর উচিত নয়। আর এমন ক্ষেত্রে আটপৌরে-ঘরের মেয়ে সর্বপ্রথম তারই ঘরে আসা উচিত। তা ছাড়া পানা এ কথাও খুব ঠিক বলেছে—তার মত মাতব্বরের বংশটা লোপ পেতে দেওয়া কখনও ঠিক নয়। বাবা সদয় তার উপর। আজ দুঃখের মধ্য দিয়ে সুখ দিলেন তিনি, গোটা আটপৌরে-পাড়াকে এনে দিলেন তার অধীনে। যা আজ এতদিন ধরে হয় নাই, তাই হল বনওয়ারীর ভাগ্যে। জয় কর্তাঠাকুর! জয় দণ্ডমুণ্ডের কর্তা! সূক্ষ্ম বিচার তোমার! ওই। করালী তোমার বাহনকে মেরেছিল, তাকে সে সাজা দেয় নাই, তাই তুমি বনওয়ারীকে সাজা দিয়েছিলে, কালোশশীকে কেড়ে নিয়েছিলে। আজ করালীকে সে সাজা দিয়েছে, তুমি খুশি হয়েছ-বনওয়ারীকে পুরস্কার দিলে আটপৌরে-পাড়ার মাতব্বরি; ফিরে দিলে তার কালোশশীকে—তোমার আদ্যিকালের বেলগাছটাকে যেমন বোশেখ মাসে নতুন পাতায় সাজিয়ে নতুন করে তোেল, তেমনি মোহিনী যুবতী করে কালোশশীকে ফিরে দিলে। কত্তাঠাকুরের কোপদৃষ্টিতে কাচা জীবন পুড়ে ছাই হয়ে যায়, মুখের গ্রাস যায় উড়ে, ভরা নৌকা যায় ড়ুবে; আবার কাঠাকুর তুষ্ট হয়ে মিষ্টি হাসি হেসে ‘পেসন্ন দৃষ্টিতে চাইলে—মরলে ‘জীয়েয়’, হারালে পায়, নিরুদ্দেশ ঘরে ফেরে, একগুণ হয়ে দশগুণ। উপকথায় বনওয়ারী যা শুনেছিল, তাই আজ অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেল।
রমণ রাজি হল। পানা তাকে বুঝিয়ে দিলে গোপনে ডেকেকরণও হবে, তোমারও কুলভাঙার পাপ অৰ্ণাবে না! শালীর কন্যে আর পালতে-দেওয়া গাইয়ের বাছুর-ও দুই-ই সমান। ভদ্রলোকে গাই-গরু কিনে কাহারদের পালন করতে দেয়, কাহারেরা গাইটিকে খাইয়ে-দাইয়ে বড় করে, গাই বাচ্চা প্রসব করে, কাহারেরা দুধ পায় আর পায় ওই বাছুরটির অর্ধেক স্বত্ব। ভদ্রলোকে দু টাকা চার টাকা কাহারদের দিয়ে বাছুরটাকে কিনে নেয়। না নিলে পাইকার ডেকে বাছুরটিকে বেচে টাকাটা ভাগ করে নেয় ভদ্রলোকের সঙ্গে। স্ত্রীর বোনের কন্যে ঘাড়ে এসে পড়েছে, বনওয়ারীর হাতে দিয়ে দাও, ঘাড় থেকে বোঝাও নামবে, আটপৌরেকাহারদের মিলনে করণও হবে। পরমের জমিটা যখন বনওয়ারী বাবুর হুকুম নিয়ে আটপৌরেদের মধ্যে বেটে দেবে, তখন কি আর ভাগের বাছুরের আধা দামের পাওনার মত কিছু বেশি পাবে না তুমি? ছোকরা পানু কথাটা বলে একেবারে ইয়ার বন্ধুর মত রমণকে কাতুকুতু দিয়ে দিলে। রমণও হাসলে এবং সানন্দেই রাজি হয়ে গেল।
কথাটা স্থির হয়ে গেল।
রতন, গুপী সবাই খুব খুশি হল বলেই মনে হল। সবাই বললে—খুশি। আমরা খুব খুশি।
অল্পবয়সী মেয়েরা মুখ টিপে হাসতে লাগল। সুচাঁদের ইচ্ছা হচ্ছিল, ছুটে এসে বলে খুব ভাল হল বাবা, খুব ভাল হল। কিন্তু আজই বনওয়ারী করালী এবং পাখীর ঘর ভেঙে দিয়েছে, তাদের কাহারপাড়া থেকে দূর করে দিয়েছে। কোন মনে যাবে সে? কেমন করে বলবে ভাল কথা?
পাগল এই সময়টিতে মজলিসে এসে হাজির হল। কোথায় গিয়েছিল সে আজ সারাদিন, সে-ই জানে। এসে বসে বললে—কি বেপার?
পানা মদ ঢেলে পাগলকে দিয়ে বললে—খাও। জমিয়ে বস, শোন।
শুনতে শুনতে পাগল গুনগুন করে গান ভঁজতে লাগল। সুচাঁদ বলে হাঁসুলী বাঁকের উপকথা, পাগল বধে হাঁসুলী বাঁকের ছড়া পাচালি।
হাঁসুলী বাঁকের বনওয়ারী—যাই বলিহারি,
বাধিল নতুন ঘর দখিনদুয়ারী।
সুবাসী বাতাসে ঘর উঠিল ভরি, মরি রে মরি!
বনওয়ারী হেসে ধমক দিয়ে বললে—থাম্ বলছি।
পাগল ঘাড় নেড়ে গানের নতুন কলি গাইবার উদ্যোগ করছিল, এমন সময় বুক চাপড়ে কেঁদে ছুটে এল নয়ানের মা।
–ওগো, আমার নয়ান কি করছে—দেখে যাও গো! ওগো! ওগো! ওগো!
সে কি? এই যে সন্ধ্যার মুখে কঙ্কালসার দেহে হাতির বলের মান নিয়ে করালীর ঘর ভেঙে এল নয়ান!
অন্ধকার দাওয়ায় পড়ে ছিল নয়ান। সর্বাঙ্গে ঘাম। হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। পাগল হাত। দেখতে বসল। সে নাড়ি দেখতে জানে। বনওয়ারী চেহারা দেখে বুঝতে পারে অনেকটা। সে চেঁচিয়ে বললে—আলো কই? আলো?
আলো নাই। কেরোসিন তেল পাওয়া যায় না। যুদ্ধের বাজার। পানা তার বাড়ি থেকে নিয়ে এল নিজের ডিবেটা। সেটা সে নিবিয়েই রাখে। একটু তেল এখনও আছে তার মধ্যে। বনওয়ারী দেখলে। হরি—হরি–হরি!
নয়ান সেজেছে। ওই কোদাল চালিয়ে এসে শুয়েছিল, তারপর ক্রমশ এই অবস্থা। নয়ান কিন্তু এর মধ্যেও হাঁপাতে হাঁপাতে বলেছে—শালোর ঘর ভেঙে মরছি, এতেও আমার সুখ। সেই সুখ নিয়ে সে চলবার পথে সেজেছে।
কাহারপাড়া নয়ানকে ঘিরে বসে রইল। এই নিয়ম। বনওয়ারী দূরে দাঁড়িয়ে ব্যবস্থা করলে কাঠের বাঁশের। নয়ানের মা কাঁদলে, নয়ানের আপনার জনেরা কদলে। সকলের শেষে এল সুচাঁদ এবং বসন্ত। তারাও কাঁদতে বসল। অল্পবয়সী মেয়েরা নীরবে চোখের জল মার্জনা। করছে; করালীর বাড়ি থেকে এল কেবল নসুবালা। করালী-পাখী নাই, তারা চন্ননপুরে। নসুবালাও কাঁদলে। তার আক্ষেপের কথাগুলির মধ্যে অকৃত্রিম আক্ষেপ কত কথা সে বলছে! নয়ানের বাল্য কৈশোর যৌবনের কথা; তারই সমবয়সী ছিল, একসঙ্গে খেলেছে, একসঙ্গে বড় হয়েছে, তারই স্মৃতির কথা; তার মধ্যে নয়ানের দোষের কথা একটিও নাই, সব গুণের কথা।
হঠাৎ আলোটা নিবে গেল। তেল নাই আর। অন্ধকারের মধ্যেই সকলে বসে রইল। নয়ানের বুকে হাত দিয়ে তার মা বসে কাঁদছে। তাতেই বুঝতে পারবে। বুক থামলেই জানাবে চিৎকার করে। আলো হয়ত পাওয়া যায়, কিন্তু আর সে কথা মনে হচ্ছে না তাদের। আলোর প্রাচুর্য কাহারদের চিরদিনই কম। অন্ধকারে জন্মায়, অন্ধকারে থাকে, অন্ধকারেই মরণ হয়। পাগল ছড়া কেটে বলে—কি হবে আলো?
অন্ধকারের ভাবনা কেনে হয় বে!
অন্ধকারেই পরানপাখি সেই দ্যাশেতে যায় রে!
চন্দ্ৰ সূৰ্য্য লম্ফ পিদিম তাই রে নাইরে নাই রে
না থাক, আছে একজনা ভাই,
এগিয়ে এসে হাতটি বাড়ায়
দুই চোখে তার দুইটি পিদিম আঁধারে রোশনাই রে
আলোর তরে ভাবনা কেনে হয় রে!
বনওয়ারী সকারের লোক ঠিক করেছিল। লোকের আজ অভাব নাই। আজ আটপৌরেরাও যাবে।
হাঁসুলী বাঁকে এমন রাত্রে কেউ একা নয়। আটপৌরে-পাড়াতেও এমন ক্ষেত্রে কাহারপাড়ার সকলে যায়। কাহারপাড়ায় আসে আটপৌরেরা। আজ আবার তার উপর নতুন বাঁধন পড়েছে। দুই পাড়ায়। আজ আটপৌরেরা শ্মশানেও যাবে। বনওয়ারীর মাতব্বরির আমলে দুই পাড়ায় চলনের ক্ষণে নয়ান প্রথম যাত্রী। সে-ই প্রথম যাবে দুই পাড়ার কাধে চেপে। আজ পুরনো মাতব্বর বংশ নির্বংশ হল।
কত মাতব্বর কাহারদের নির্বংশ হয়েছে কে জানে তা, কে তার হিসেব রাখে? কাহারপাড়ার উপকথার কি আদি আছে, না অন্ত আছে? পিথিমী ‘ছিষ্টি হল, কাহার ছিষ্টি করলেন বিধেতা, কাহারদের মাতব্বরও ছিষ্টি হয়েছে সেই সঙ্গে। বাবা কালারুদ্দের গাজনের পাটা ঘুরছে বনবন শব্দে, সেই পাটায় ঘুরে দিন রাত্রি মাস বছর এক এক করে চলে যাচ্ছে। বছর যাচ্ছে, যুগ যাচ্ছে। তার সঙ্গে কত যাচ্ছে-মাতব্বর যাচ্ছে, মাতত্ত্বরের ঘর যাচ্ছে, ঘরভাঙাদেরও ঘরের শেষ হল। এতদিনে নয়ানের সঙ্গে। বাবার পাটা ঘুরছে, সেই পাটায় বছর ঘুরছে। সেই ঘুরণের পাকে এবার প্রথম গেল নয়ান। আর কে যাবে কে জানে? নতুন বছরের কাছে কালোশশীও মরেছে, কিন্তু সে আটপৌরে-পাড়ার। তখনও দুই পাড়া এক হয় নাই।
কথাগুলি শুশ্মশান্যত্রীদের মধ্যেই আলোচনা হচ্ছিল। বনওয়ারীও চলেছে সঙ্গে। হাজার হোক পুরনো মাতব্বর বংশ। তার খাতির করতে হবে বৈকি! আর নয়ান বলতে গেলে নিঃস্ব। তার সব খরচও দেবে বনওয়ারী। নিয়ম। পাগল ধরে নিয়ে গেল নয়নের মাকে। নয়ানের মায়ের সব অভিসম্পাত আজ নীরব হয়ে গিয়েছে। নিবে গিয়েছে তার সব তেজের আগুন।
বনওয়ারী অন্ধকারের মধ্যে ভারী পা ফেলে চলছে আর ভাবছে—বছরটি ভালয় ভালয় গেলে হয়। বাবাঠাকুরের রোষ যে ভয়ানক। ভাবতেও শিউরে ওঠে বনওয়ারী। আঃ, কবে বাজবে। আবার গাজনের ঢাক, কালারুদ্দের চড়ক চক্রপাক খেয়ে এক পলক থামবে। বলবেচন্দ্র থাম, সূর্য থাম, এক লহমার জন্যে আমার সঙ্গে থাম। বছর শেষ হোক। কতজনে সেদিন কাদবে। হারানো পরানধনের জন্যে কে জানে। বাবাঠাকুরের কাছে অপরাধ হয়েছে—এ বছরটা গোটা বনওয়ারীর ভাবতে ভাবতেই যাবে। সৌভাগ্য সত্ত্বেও ভাবনা তার যাচ্ছে না।