২.৯ বনওয়ারীর মাতব্বরি

না না না। সে হতে দিতে পারবে না বনওয়ারী। সে যতকাল বেঁচে আছে, তার মাতব্বরির আমলে কাহারপাড়ার কারও ‘বঙ্গে’ অর্থাৎ অঙ্গে ওই দাগ লাগতে সে দেবে না। যত ঘেন্নার দাগ, যত দুঃখের কষ্টের দাগ। চোরকে সাধে বলে দাগী! ভাবলেও শিউরে ওঠে বনওয়ারী। একা বনওয়ারী নয়। এ পাড়ার প্রবীণেরা সকলেই শিউরে উঠবে।

কাহারপাড়ার উপকথায় ওই দাগের কথা মনে হলেই শিউরে ওঠে বনওয়ারী। স্মরণ হয় বর্ষার উপকথায় কালো অবস্যের ‘আত্তিকাল’, ঝুমঝমিয়ে আকাশ ভেঙে মাটিতে নামছে, কোপাইয়ের হাঁসুলী বাঁকে বাঁকে জল ছুটছে, তাতে ‘অঙ’ ধরেছে লালচে; কাহারদের চোখে তার ছটা জাগত সেকালে। দূর মাঠ থেকে একটি শেয়াল ডাকত। সুটট করে বেরিয়ে পড়ত কাহারেরা। মাথায় ফেটা বেঁধে মুখে চুন-কালি মেখে, হাতে লাঠি নিয়ে বেরিয়ে পড়ত।

হে বাবাঠাকুর, তুমি ‘অক্ষে’ কর।

বনওয়ারী প্রহ্লাদ রতন গুপী—এরা সকলেই ছেলেবেলায় সেসব কিছু কিছু দেখেছে। সুচাঁদ চোখে দেখেছে, সে আজও সেই গল্প করে, চোখ বড় হয়ে ওঠে, ভারী গলায় বলে– “কোপাইয়ের সে ‘মনন্তরার’ বানে ড়ুবে দেশ ‘শোশান’ হয়ে গেল! কুঠি উঠে গেল! সায়েব মশাইরা গেলেন। কাহারপাড়া অনাথা হল। মুনিব গেল, না বাপ গেল। পেটের তরে ভাবতে হত না; সকালবেলাতেই ষোলজনা কাহার কুঠির কাছারিতে গিয়ে হাজির হলেই খালাস। পালাপালি করে ষোলজনা করে যেত কাহারেরা। কাহারপাড়ায় তখন দু কুড়ি আড়াই কুড়ি মুনিষ। মোষের কাঁধের মত ইয়াইয়া কাঁধ। কুঠি উঠে গেল, বানে ঘরবাড়ি ভেঙে গেল, মড়ক লাগল, তখন যে ‘যেমনে’ পেলে—এ-গাঁ সেগা পালাল। কেউ গেরামে মরল, কেউ ভিন গেরামে মরল, কেউ পথে মরল, পচে ফুলে ঢোল হয়ে গলে গেল–গতি পর্যন্ত হল না। তা’পর আবার সব গেরামে ফিরল। ফিরল তো দেখলে, পথের ফকির। চৌধুরীরা চাকরান জমি কেড়ে নিলে। দয়া করে দিলে শুধু ভিটেটুকুন। কাহারেরা সকালে উঠে চৌধুরী-বাড়ির মা-দুগ্গাকে আর ওই কত্তাকে ‘পেনাম’ করত। ‘তেনারা’ স্বপন না দিলে ওটুকুও দিত না চৌধুরী মাশায়। তখন ভাবনা হল ‘প্যাটের’। চৌধুরী মাশায় বললে, চাষে বাসে খাটতে, কৃষেণ মান্দেরী করতে। তা সদূগোপ মাশায়রা কেউ রাখবে না কাহারদিগে। কাহারেরা সাহেব মাশায়দের আমলে সদ্‌গোপ মাশারদের জমিতে জোর করে ‘লীল’ অর্থাৎ নীল বুনেছে, ধান কেটে নিয়ে গিয়েছে, ধরে নিয়ে গিয়েছে। তা ছাড়া কাহারেরা চাষেরই-বা জানে কি? সত্যিই কাহারেরা ‘চাষকৰ্ম’ ভাল করে জানত না। তবু চৌধুরী মাশায়ের কথায় ছেলে ছোকরাকে ‘বাগাল মান্দের’ অর্থাৎ রাখাল মাহিন্দার রাখলে। বড় বড় জোয়ানেরা মাথায় হাত দিয়ে বসল। তখন আটপৌরে-পাড়ায় হল চোরের দল। ‘এতে ‘দুপুরের শ্যাল’ ডাকলে সুটসাট করে বেরিয়ে ই-গা সিগা থেকে। চুরিচামারি করে আনত। ক্রমে পেটের দায়েও বটে, মতিভ্রমের কারণেও বটে-কাহারেরা ধরলে ওই পথ।

রাতের অন্ধকারে কালো কাহারদের দেখতে হত আর কালো, গলার ‘রজ’ হত জন্তুজানোয়ারের মত, চোখ দুটো জ্বলত আঙরার মত! তারা চুপি চুপি গিয়ে গেরস্থ-বাড়িতে সিদ দিত, দরজার কুলুপ ভাঙত; সোনাদানা, চালধান, বাসনকোসন, কাপড়চোপড় যা পেত নিয়ে আসত। সকালে উঠে বুক ধড়ফড় করত, ওপারে যমরাজার ধর্মের খাতায় নাম লেখা যেত। এপারে পুলিশ এসে ঘর খানাতল্লাশ করত। মেয়েদের পর্যন্ত কাপড় ঝড়া নিত। পুরুষদের মাবোন তুলে গাল দিত, থানার হাজতে পুরে চালাত কিল চড় লাথি।”

আজও আটপৌরে-পাড়ায় সেই বৃত্তান্ত চলছে। তবু ওদের হায়া নাই। বেহায়ার দল ওই আটপৌরেরা! অনেক কষ্টে কাহারেরা নিষ্কৃতি পেয়েছে। সুচাঁদ বলে—

এক পুরুষ গেল, দু পুরুষে সবাই দাগী হল। কাহারেরা তখন চাষেবাসে মন দিলে; চুরিচামারিও করত, কিন্তুক আগের মতন লয়। তবু দাগীর বিপদ যাবে কোথায়? চুরি হলে কাহারপাড়ায় পুলিশ আসত, ধরে বেঁধে নিয়ে যেতদোষেও নিয়ে যেত, বিনি-দোষেও নিয়ে যেত। মধ্যে মধ্যে বদমাইশি মকদ্দমায় গুষ্টিসমেত নিয়ে টানাটানি। এই তখন আমার দাদা ওই বনওয়ারীর বাপ—গেরামের মধ্যে পবীণ সৎলোক ঘোষ-বাড়ির আশ্চয় পেয়েছেঘোষ মাশায়রা অনেক তদ্বির করে থানার খাতা থেকে নাম কাটিয়ে দিলেন। দাদাই তখন বললে— পিতিজ্ঞে কর সব, চুরি কেউ করবে না। নয়ানের বাবাছোকরা বয়স, চৌধুরী মাশায়দের বাড়ির লোক সে, সে তো গেরাহ্যিই করলে না। চৌধুরী মহাশয়দের দয়াতে ঘরভাঙারা পুলিশের হাত থেকে অক্ষে পেলে। তখন গেরামের দুটো দল হয়ে গেল। একদল দাদার কথা শুনলে। একদল হেসেই উড়িয়ে দিলে। তা’পরেতে নয়ানের বাবা কাঁচা বয়সে মরলে পর দাদা হল মাতব্বর। দাদা অ্যানেক কষ্টে কাহারপাড়ার চোর নাম ঘুচালে। তাও দু-একজন মানত না, শুনত না; এই গুপের দাদা কেলো ছেরোটা’ কাল চুরি করে এল। গায়ে দল নাই তো ডোমেদের সাথে চুরি করত। বনওয়ারী কত মারধর করত, কালাচাঁদ তাও শুনত না। পুলিশে ধরে নিয়ে যেত। হাসতে হাসতে যেত, বলত-শরীল সেরে আসিগা দিনকতক। তা জাল থেকে ফিরত এই ‘ভাকুম-কুমো’ অর্থাৎ মোটাসোটা হয়ে শেষ কথাটি বলে হাসে সুচাঁদ।

মধ্যে মধ্যে আফসোসও করে সুচাঁদ। আঁচলের খুঁটে চোখ মোছে আর বলে-আঃ, কি সব কাল ছিল, আর কি হল! সেসব ছিল মরদ। এই বুকের ছাতি, এই সাহস–মেয়েকে সোনার গয়না পরিয়েছে, আতে এই ঝকঝকে কাপড় পরিয়েছে। হোক কেনে আতের আঁধারে, পরিয়েছে তো। এখনকার মরদ, না, শ্যাল কুকুর।

বলুক, সুচাঁদ যা বলে বলুক। আড়ালে আবডালে কাহারদের যারা মতিভ্ৰষ্ট তারা যা বলে বলুক। বনওয়ারী আর সে পাপ পাড়ায় ঢুকতে দেবে না। আজ করালীকে নিয়ে সে ভয় দেখা দিয়েছে। করালী ছোকরাটির গায়ে ‘তাগদ’ আছে, ছাতিতে সাহস আছে, মাথাও খেলে বেশ। ভয় যে সেইখানে। কঁচা বয়সের দশজনা মদ-মাতালি করতে গিয়ে শেষে একটা কুকর্ম না করে বসে! ‘ধৰ্মপথে অধিক রাতে ভাত। যে ধর্মপথে থাকে তার যদি উপবাসেই দিন যায় তবে ধর্ম নিজে অর্ধেক রাত্রে তাকে অন্ন যুগিয়ে দেন। বনওয়ারী করালীকে বলবে, সৎ পরামর্শ দেবে।

বাড়িতে ফিরেই মেজাজ তার আরও বিষিয়ে উঠল। হি-হি-হি-হি করে পাখী হেসে প্রায় গড়িয়ে পড়ছে। এ কি হাসি? এত হাসি কি মেয়েছেলের ভাল? বনওয়ারীকে দেখেও পাখীর হাসি কম হল না। অন্য কেউ হলে কাপড়ের আঁচল দিয়ে অন্তত মুখটা ঢাকত। পুরুষমানুষকে কি দাঁত দেখিয়ে হাসে মেয়েছেলেতে? পুরুষ বলে পুরুষ নয়—বনওয়ারীর মত পুরুষ, সম্মানের মানুষ। পাখী বলেই পেরেছে এটা। করালীবাবুর ‘অঙ’ করে বিয়ে করা বউ যে! করালীর দেমাকে পাখীর মোক বেড়েছে। কাহারপাড়ার কন্যেরা বউয়েরা ক্ষেপলে অবশ্য বানভাসা কোপাই, কিন্তু সহজে তারা নীলবাঁধের জল, শান্ত স্থির।

গম্ভীরভাবে বনওয়ারী বললেকি? বেপার কি? এত গো-গোল-করা হাসিটা কিসের?

গোপালীবালা ঘোমটাকে কপাল পর্যন্ত তুলে দিয়ে অল্প হেসে বললে পাখী যা ‘ভিকনেস করতে পারে।

‘ভিকনেস’ অর্থাৎ ব্যঙ্গভরে মানুষকে নকল করা; পাখী ভিকনেস করছিল রেল কোম্পানির সাহেবের মেমের। সরু গলা করে ইংরিজি বাক্য নাকি সে অবিকল তুলে নিয়েছে-গুড়-মুনিংবুডটিংটং অনুস্বার লাগিয়ে অনর্গল ব্যঞ্জনবর্ণগুলি উচ্চারণ করে যাচ্ছে সে। ইস্টিশান মাস্টারের ভঁড়ি দুলিয়ে চলা নকল করে দেখিয়েছে। এবং গোপালীবালার চেয়ে নিজেই হেসেছে বেশি। কঠিন বাক্য উচ্চারণ করতে গেল বনওয়ারী, হঠাৎ তার নজরে পড়ল—তার দাওয়ার উপর চারখানা নতুন গাঁইতি, টকটকে লাল রঙ মাখানো, যেন “ত্যাল’-সিঁদুর দিয়েছে যন্ত্রটায়। এ গাঁইতি রেল কোম্পানির এবং আনকোরা নতুন। এত গাঁইতি করালী এনেছে জংশন থেকে, এবং পাখী যখন এমন অসময়ে এসে হাসছে তখন পাখীই নিয়ে এসেছে করালীর বাড়ি থেকে তার বাড়ি। রূঢ় শাসনবাক্য বনওয়ারীর গলায় এসে আটকে রইল। সে নীরবে এসে দাওয়ায় উঠে গাঁইতিগুলি নেড়ে দেখলে। খাসা জিনিস। সাহেব কোম্পানির যন্ত্র। সায়েবেরা তো যে-সে নন, সাদা রঙ, কটা চোখ, ওঁরা না পারেন কি? কল চলে গড়গড়িয়ে লাইনের উপর। আকাশ কেঁড়ে ভরভরিয়ে চলে উড়োজাহাজ। যুদ্ধ লেগেছে। অনেক উড়োজাহাজ এ দেশ পর্যন্ত এসেছে। বনওয়ারী তিনখানা উড়োজাহাজ দেখেছে।

পাখী বললে—কার কাছে শুনেছে, তোমার গাঁইতি চাই। তা আমাকে বললে, যা, এখুনি দিয়ে আয়। তাই নিয়ে এলাম।

বনওয়ারীর মুখ দিয়ে আপনি বেরিয়ে এল আশীৰ্বাদ।বেঁচে থাক মা, বেঁচে থাক। আঃ, কি ‘রোপকার’ যে হল! সে একখানা গাঁইতি তুলে নেড়ে পরীক্ষা করে দেখলে। তারপর বললে—তা করালী দেখালে অ্যানেক রকম। বাহাদুর বটে!

–আজ্যের জিনিস মামা-আজ্যের জিনিস! আখবার ঠাঁই নাই—ওই ডাঁই করে এখেছে। বারণ করলে শোনে না।

–পরমকে গাঁইতি দিয়েছে নাকি?

—কাকে? পরম মামাকে? না। ওকে আমি দুচক্ষে দেখতে নারি। দেখ কেনে, এসে অবেলায় ধরে নিয়ে গেল লাঠি খেলবি! নাচতে নাচতে ধেই ধেই করে চলে গেল। বলে–চল। আমি থাকতে কাহারপাড়ার মান যেতে দোব না আটপৌরেদের কাছে।

বনওয়ারী খুশি হল একটু, এ কথা যে বলেছে করালী–একটা কথার মত কথা বলেছে বটে। কিন্তু ছেলেমানুষ, ঘোরফেরটা বুঝতে পারে নাই। ওরে বাবা, খাবার দিয়ে ফাঁদ পাতাই হল সংসারের নিয়ম। সাবধান করতে হবে করালীকে। বললে—তা বেশ। তা আজ যেয়েছে বেশ করেছে—আর যেতে দিস না। হাজার হলেও পরম দাগী। ওর সাথে লাঠি খেলা ভাল লয় বাছা। বুঝলি?

চোখ বড় করে পাখী বললে—তা তো ভাবি নাই মামা। ঠিক বলেছ তো তুমি। যাব, আমি আখুনি যাব।

—না। আসবে, আখুনি আসবে খানিক বাদে, তখন বারণ করিস। আর একটু থেমে গম্ভীরভাবে বললে—সনজেতে পাঠিয়ে দিস মসলিসে। সমঝিয়ে দেব আমি।

হঠাৎ মনে পড়ে গেল জংশনে দাঙ্গার কথা। বনওয়ারী ঘুরে বেশ আগ্রহ প্রকাশ করে বললে—করালী নাকি জংশনে দাঙ্গা-টাঙ্গা কি করেছে পাখী?

—ও বাবা! তা জান না? হিন্দু খালাসীরা এক দিক, মোছলমানেরা এক দিক। একজন মোছলমান খালাসী হিন্দু কামিনের হাত ধরে টেনেছিল। তাই নিয়ে ঝগড়া। তা’পরেতে লাঠালাঠি। বানের এগুতে হাদি—চলে গেল এক লাঠি নিয়ে। খুব ঠুঁকে দিয়ে আইছে।

বিস্মিত নয়, স্তম্ভিত হয়ে গেল বনওয়ারী! কাহারেরা মুসলমানদের চেয়ে কম শক্তিমান নয়, কিন্তু এ পর্যন্ত মুসলমানদের সম্মানই করে এসেছে ওরা। মুসলমানেরা কাহার-মেয়েদের দু-চার জনকে নিয়েও গিয়েছে, কিন্তু তাদের সঙ্গে কলহ কেউ করতে সাহস করে নাই। ওরা ‘শ্যাখ’, ‘পাঠান’। ছোকরাটা যদি বনওয়ারীর ‘পুতু’ হত! একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে বনওয়ারী।

সন্ধ্যাবেলার মজলিসে করালী এল।

বনওয়ারী তাকে বুঝিয়ে বললে। ছেলে-ছোকরারা সকলেই হাজির ছিল আজ, করালী যখন এসেছে তারা থাকবে কোথায়? সকলে চুপচাপ বসে শুনলে বনওয়ারীর কথা।

 হাঁসুলী বাঁকের সাধারণ মন্থর জীবনের ঠাণ্ডা মজলিস। মদ সকলেই খেয়েছে, কিন্তু সে পরিমিত পরিমাণে। সারা দিনের খাটুনির পর যেটুকু খেলে রাত্রে সুনিদ্রা হবে, সকালে গা গতরে ব্যথা থাকবে না—সেইটুকু। মজলিস বসে নীল বধের ঘাটের উপরে যে ষষ্ঠীতলার বটগাছটি আছে তারই তলায়। সাধারণের জায়গা এটি। সেই প্রথম আমল থেকে এখানে মজলিস বসে আসছে। নীলকুঠি ভাঙতে থাকে, তখন নীলকুঠির ভাঙা গাঁথনির চাঙড় কতকগুলি এনেছিল কাহারেরা, সেইগুলি সুদীর্ঘকাল ধরে আসনের কাজ করে আসছে। প্রবীণেরা সেইসব চাঙড়ের উপর বসে। গাছের তলায় ঠিক মাঝখানটিতে যে চাঙড়টি সেইটিতে বসে মাতব্বর। বনওয়ারী সেই চাঙড়টির উপর বসে হাত নেড়ে বেশ বুঝিয়ে বলার ভঙ্গিতে আস্তে আস্তে বলে বাপধন, করালীচরণ, বুয়েছ কিনা তোমাকে বলছি আমি।

—আমাকে? করালী বিস্মিত হল। সে তো আজকাল বনওয়ারীকে মান্য করেই চলেছে। তার সঙ্গে একটা সদ্ভাব স্থাপন করতে অন্তরে অন্তরে ব্যর্থ হয়েই উঠেছে। বনওয়ারী তাকে স্বীকার করেছে, তাকে খানিকটা খাতির করেছে—এটা সে বুঝতে পারে। পানাই হোক, পেহলাদই হোক, আর রতনই হোক, সকলের চেয়ে তার খাতির বেশি—এটা বনওয়ারীর ব্যবহারে প্রকাশ পেয়েছে। সেও বনওয়ারীকে মনে মনে খানিকটা যেন বাপখুড়োর মত ভালবেসেছে। সেই কারণেই সে সেদিন ওই তেরপলটি ঘাড়ে বয়ে নিজে থেকে দিয়ে এসেছে গুড়ের শালে। আজ খবর পাবামাত্র সে চারখানা গাঁইতি পাখীর ঘাড়ে চাপিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে। এত করার পরেও তাকেই বলবে কথা! সে ভুরু কুঁচকে বললেবল। সে সামনে চেপে বসল। মনে মনে সংকল্প করলে—বনওয়ারী অন্যায় কথা বললেই কড়া জবাব দিয়ে দেবে।

বনওয়ারী ও-বেলার মনে-করা কথাগুলি বললে। বললে—বাবাধন, ধরমের পথে থাকলে বাবাঠাকুর আদেক এতেমানে ধরা যেয়ে-দোপর তিনপোর এতে নিজে ভাত এনে ছামনে ধরে আমাকে বলবেন—লে বেটা, ধরমের পথে থেকে আজ ভাত জোটে নাই, লে, খা!

কথাগুলি ভাল। গোটা কাহারপাড়ার প্রবীণদেরই আধ্যাত্মিক মনোভাব গদগদ হয়ে উঠল; কেউ বললে হরি বল মন, হরি বল। কেউ বললে—শিবো হে। কেউ বললে—এ সংসারে মরণই সত্যি। কপালে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করলে তারা দেবতাকে। করালীর কিন্তু হাসি পেল। কথাগুলির বিপরীত কোনো সত্যে সে বিশ্বাসী বলে নয়, ওই কথা বলার ভঙ্গি দেখে তার হাসি পায়। চন্ননপুরে মিটিং শুনেছে সে। কি করে যে বাবুরা বক্তৃতা করে! ওঃ, সে শুনে চনচন করে ওঠে ‘শরীল’। তবু হাসি গোপন করলে, শুধু একটু হাসিমুখেই বললে—তা বলছ ভালই, কথাও ভাল।

বনওয়ারী প্রবীণদের দিকে চেয়ে বললে—কি হে মাতব্বরেরা, ন্যায় বললাম, কি অল্যায় বললাম? বল কেনে হে? ছোকরাদের এমন আলাদা আড্ডা ভাল লয়।

রতনের ছেলে মাথলা করালীর ঘনিষ্ঠ অন্তরঙ্গ, রতনের কথা শোনে না, কিন্তু রতন তার সম্বন্ধে দুশ্চিন্তা ছাড়তে পারে না, রতন সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, এর আর কথা আছে বনওয়ারী? আর তুমি কি অল্যায্য বলবার লোক?

তামাক খাচ্ছিল প্রহ্লাদ, সে অনেকটা নিরাসক্তভাবেই বললেলাও, খাও। হুঁকোটি বনওয়ারীর হাতে দিয়ে সে মূল প্রশ্নের উত্তর দিলে–হ্যাঁ, কথা তুমি ঠিক বলেহ। বলুক কেনে ছোকরারা কি বলছে।

—কি হে সব, তোমরা কি বলছ? ওসব ছাড়। একত্ত হয়ে আচ্ছা কর। নাকি?

অপর সকল প্রবীণও ওই প্রহ্লাদের দলে। এতখানি উৎকণ্ঠার প্রয়োজন তারা বুঝতেই পারছে। না। ছোকরাদের দল যদি আলাদা আসর করে গানবাজনা করে ‘অঙচঙের কথাই কয়, একটু আধটু মদই খায়—তাতে এত সব কথা কেন? তিলকে তাল করে তুলেছে বনওয়ারী। তবুও তারা বললে—কথা তো ভালই। অল্যায্য আর কে বলবে?

বনওয়ারী এইবার উঠে বললে—তুমি তা হলে শোন দিকিনি করালী। গোপনে একটি বাক্যি বলব তোমাকে।

গোপনে? বেশ, চল। শুনি।

একটু সরে এসে বনওয়ারী বললে—আটপৌরে-পাড়ায় পরমের আখড়ায় লাঠি খেলতে। যাওয়া তো ভাল কথা লয় বাবা।

—কেনে?

—সে দাগী ডাকাত বাবা। সাধুজনের সঙ্গে সাধু থাকে, চোরের সঙ্গে চোর, জেনালের সঙ্গে ছেনাল। কাহারপাড়ার সঙ্গে ওই কারণে আটপৌরেদের মিল হল না। বুয়েচ?

করালী বললে পরম যি ঠাট্টা করলে। তাতেই তো যেলাম—বলি কাহারপাড়ার মরদ দেখ একবার।

বনওয়ারী বললেওই বাবা, ওই অকম করেই বুড়ো-ডাকাত ছেলে-ছোকরাকে দলে টানে। বুয়েচ? পেথম পেথম লাঠি খেলা, হাসিঠাট্টা, মদ-মাংস খাওয়া, তা’পরেতে কানে মন্তর। একবার সঙ্গে যেয়েছ তো আর ছাড়ান নাই। ধম্মের পাক সাতটা, পাপের পাক সাতানুটা। বুয়েচ? আর খোলা যায় না, ঘেঁড়া যায় না। দলে যাব না বললেই তখন ধরিয়ে দেবে।

করালী বিস্ফারিত নেত্রে তার দিকে চেয়ে রইল। সত্যই সে এ কথাটা ভাবে নাই। তবে কথা বনওয়ারীমামা ঠিকঠাক বলেছে। কয়েক মুহূর্ত পরে সে অকুণ্ঠিতভাবে বলেও ফেললেই সব কথা আমি ভাবি নাই মামা।

—অ্যাই! ভাব নাই তো! এস, আর যেয়ো না। হেঁয়া মাড়িয়ো না। করালীর হাত ধরেই সে মজলিসে ফিরে এল।

মজলিসে তখন নসুবালা হাত-পা নেড়ে, অঙ্গ দুলিয়ে সে এক কাণ্ড ‘সেজ্জন’ অর্থাৎ সৃজন করে তুলেছে। ব্যাপারটার মূল হল নিমতেলে প্যাকাটি প্ৰাণকৃষ্ণ। বনওয়ারী করালীকে নিয়ে উঠে যেতেই অভ্যাসমত সে বনওয়ারীর ভূমিকায় মাতব্বরি শুরু করে দিয়েছিল। বেশ মুরব্বিয়ানার সুরে ভঙ্গিতে বলেছিল—বনওয়ারীকাকা যা বলেছে তার চেয়ে ভাল কথা আর হয় না। ছেলে-মিেকরার এসব মতিগতি ভাল নয়। ধর যেয়ে, কেউ ছাড়ছে কুলকর্ম, অক্তের ত্যাজে ধরাকে সরাখানটা দেখছে। না, কি গো?

প্রতিটি কথা তার করালীর দিকে নিক্ষিপ্ত গুপ্তবাণ। বুঝতে বাকি কারও রইল না।

নসুবালা বসে ছিল পুরুষদের হেঁয়াচ বাঁচিয়ে! সে এবার উঠে এসে পানুর মুখের সামনে হাত নেড়ে শরীর দুলিয়ে বলে উঠেছিল—আ মরে যাই, গুড় দিয়ে তোমার গাল চেটে খাই! ‘কিরে আদ্যিকালের বদ্যিবুড়ো আমার! উনি বলছেন—আমরা ছেলে-ছোকরা। বলি তোর। মতিগতি তো ভাল! বলিহা রে মুখপোড়া চিমড়ে শকুনি, কি করেছি আমরা। বল শুনি? মাতব্বরের দোসর আমার! বাঘের পেছুতে ফেউ সানাইয়ের পোঁ!

করালী এসেই নসুর হাত ধরে টেনে সরিয়ে এনে বললে—চুপ কর তু। বস। তারপর সে এগিয়ে এসে ওই মজলিসের মধ্যে সর্বসমক্ষে বনওয়ারীর পায়ে হাত দিয়ে বলল—এই তোমার পায়ে হাত দিয়ে বলছি, এমন কাজ কখনও করব না।

বনওয়ারী এতটা কল্পনাও করে নাই, এবং এর পরের কি উত্তর তাও সে ভেবে পেলে না। করালীর উপর স্নেহে সে আর্দ্র হয়ে উঠল।

পাঁচজনে তারিফ করে উঠল করালীর–বা-বা-বা!

—হ্যাঁ রে বাবা। পথ চলবি, আপথ কুপথ খাল বিল বাঁচিয়ে চলিস!

পানু কিন্তু উঠে দাঁড়াল, বললে-পা ছুঁয়ে তো বললে! কিন্তু চোলাই মদের কথাটা? সেটা অল্যায় লয়?

এবার করালী ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিলে তার গালে। দুর্বল চেহারার লোক সে, করালীর হাতের চড় খেয়ে সে ‘বাপ’ বলে বসে পড়ল। করালী বললে—দেখাতে পার তুমি শালো? পেমাণ করতে পার?

বনওয়ারী খুশি হল। খুব খুশি হল। কিন্তু পরমুহূর্তেই হেঁকে উঠল—করালী, অন্যায় করলে তুমি।

–আমি?

–হ্যাঁ। বস তুমি।

—তা বসছি আমি। হোক, এর বিচার হোক! তুমি আমার ঘর পেতে দিয়েছ, তোমাকে আমি মানি। একশো বার হাজার বার আমি মানি। ধাৰ্ম্মিক লোক তুমি, মাতব্বর তুমি, তোমার কথা শুনতে পারি। তা বলে ওই লিকলিকে সড়িঙ্গের কথা শুনব আমি!

—বস বস।

সকলেই বসল। কেবল প্রাণকেষ্ট বসল না। সে পটগট করে মজলিস থেকে বেরিয়ে গেল। বনওয়ারী করালীকে শাসন করলেও সে বেশ অনুভব করতে পারছে—করালীর প্রতি তার স্নেহাধিক্যের পরিমাণ। শুধু তাই নয়, সে বেশ বুঝতে পারছে বনওয়ারী এইবার তাকে নিয়ে পড়বে। কয়েকবারই সে লক্ষ্য করেছে তার প্রতি বনওয়ারীর বক্র ক্রুর দৃষ্টি। বুঝতে ঠিক পারছে না, কিন্তু তার উপর তার অভিমানও হল। সে বেরিয়ে চলে গেল।

–চলে যেছিস যে পানা?—জিজ্ঞাসা করলে মাথলা।

উত্তর দিলে না পানা।

—কি রে আ কাডিস না যে?

পানা এবার বললে ছুঁচোর করেদ চামচিকের কথার জবাব পানকেষ্ট দেয় না।

করালীর লাফিয়ে ওঠার কথা, উঠতও সে লাফিয়ে এবং কাণ্ডও একটা ঘটে যেত, কিন্তু তার আগেই বনওয়ারী ডাকলে-পানকেষ্ট! গম্ভীর কণ্ঠে ডাকলে।

প্ৰাণকৃষ্ণের গলার সাড়া পাওয়া গেল তার নিজের উঠানের নিমতলা থেকে। চিৎকার করে সে বললে—সাধু নোক, আটপৌরে-পাড়ার বটতলাতে সনজেবেলা সাধনভজন করেন। মনে করলাম—থা, বলব না, মানী নোক। কিন্তু সে কথা সে শেষ করতে পারলে না, আতঙ্কে সে চমকে উঠল, বনওয়ারী এসে তার হাতখানা সজোরে চেপে ধরেছে।

পানু শুয়ে পড়ল মাটিতে। যাব না আমি। জাতজ্ঞাত কেউ আপনার লয় আমার। লরমকে ধরম দেখায়। আমি মানি না কারুকে।

বনওয়ারী তার ঘাড়ে ধরে খাড়া করে তুলে দিলে। তারপর ধাক্কা দিয়ে নিয়ে এল মজলিসে। পানু আর উপুড় হয়ে পড়বার অবকাশ পেলে না। পানুকে ঠেলে মজলিসের মাঝখানে ফেলে দিয়ে বললে—লয়ানের বাঁশঝাড় নিজের বলে পাকু মোড়লকে বেচে দিয়েছিস কেনে?

পানুর চিৎকার ঝংকার এক মুহূর্তে বন্ধ হয়ে গেল।

—বল্‌। মজলিসে বল্।

এবার পানু ফ্যালফ্যাল করে বনওয়ারীর দিকে চেয়ে বললে—ক্যা বললে? অর্থাৎ কে বললে।

—তোর মুনিব খোদ পাকু মোড়ল আমাকে বলেছে। চৌহদ্দি পড়ে শুনিয়েছে—অতনের দরুন কেনা, হেদো মণ্ডলের বাঁশঝাড়ের পুত্ব, বনওয়ারীর মানে আমার বাঁশঝাড়ের দক্ষিণ, কোপাইয়ের বাঁধের উত্তর, গুপীর দরুন কেনা ঘোষ মাশায়দের বাঁশঝাড় আর শিরীষগাছের পচ্চিম। এর মধ্যে আমি—নিমতেলে পানকেষ্ট কাহার নিজ হাতে লাগানো বড় বাঁশঝাড় একটি বাঁশ সাড়ে আট গণ্ডা-আট টাকায় বিল্কয় করিলাম।

পানু উঠে বসে বললো, তা বিক্কয় করেছি আমি। সে তো আমার নিজের বাঁশঝাড়। আমি নিজের হাতে লাগালছি।

—হ্যাঁ হ্যাঁ–লাগালছ! ‘না’ বলি নাই আমি। আমার বাঁশঝাড়ের পুবেলয়ানের বাবার। লাগানো বশঝাড়, তার পুবে ঘোষ মাশায়দের বাঁশঝাড়ের মধ্যিখানে খালি জায়গায় তুমি লাগালছ একঝাড় বাঁশ ও-বছর আগে, তাতে দু গণ্ডা বাঁশও জমে নাই এখনও। লয়ানের ঝাড়ের সাথে লাগালাগি হয়ে হয়েছে, এই সুবিধাতে তুমি গোটা সাড়ে আট গণ্ডা বা-সমেত বাঁশঝাড় মুনিবকে বেচে দিয়ে এসেছ। বল, কেনে বিক্কি করেছ পরের ধন নিজের বলে?

মজলিসে কলরব উঠে গেল।

–অল্যায়, মহা অল্যায়, হে ভগবান। সমস্বরে সকলে চিৎকার করে উঠল।

নসুবালা গালে হাত দিয়ে বলে উঠল—হেই মারে! বলে কিছুক্ষণ স্থির বিস্ময়বিস্তারিত দৃষ্টিতে চেয়ে রইল, তারপর ঘাড় নেড়ে বললে—ঘোর কলি মা। আমের ধন শ্যামে বিয় করছে।

পানু কাতরভাবে বললে আমি কি করব? মুনিবই আমাকে নিকে দিতে বললে।

–বললে? করালী বলে উঠল—চন্ননপুরের বাবুদের পাকা বাড়িটা নিকে দিতে বললে দিবি?

বনওয়ারী বললে—করালী, চুপ কর তুমি।

পানু কাঁদতে লাগল। বনওয়ারী করালীকে চুপ করতে বলতেই সে কেঁদে ফেললে।

বনওয়ারী বললে—ফোঁপাস না, বুল্লি, ফোঁপাস না। ওতে কেউ ভুলবে না।

পানু বললে—আমার বেবরণটা পঞ্চজনে দয়া করে শোনেন, নাকি আমি বানের জলে ভেসে আইছি? অপরাধ তো হয়েছে আমার, সাজা নিতে তো আমি পস্তুত।

বনওয়ারী নিজের পাথরটায় বসে বললেবল, কি বলছিল?

পানুর বিবরণ অন্য কিছু নয়, নিজের অন্যায়ের স্বপক্ষে বিপক্ষে কোনো যুক্তিতর্ক নয়, নিতান্তই নিজের মন্দভাগ্য এবং মনিবের কঠিন আচরণের করুণরসসিক্ত ইতিবৃত্ত। এইটুকু পানুর কাপুরুষ এবং কুটিল মনের উপস্থিতবুদ্ধি। পানু বললে—মুনিবে যে মেরে ফেলাইছে তার পিতিবিধেন কর পাঁচজনায়। ‘ধরে মারে সয় বড়। আমাকে মুনিব ধরে নিকে লিলে—আমি কি করব? মাশায়, তিন বছর হিসেব করলে না, ই বছর হিসেব করে বললে—সঁচিশ টাকা পাওনা তোর কাছে। দে, ফ্যা। তা বললাম—বছর বছর হিসেব করলেন নানা করে একবারে এমনি মোটা পাওনা কি করে দেব আমি? তা বললে—তা, আমি কি জানি? তু শালোদের ওজগারই কি কম? তুমি শালোরা মাঠ থেকে ধান সচ্ছ। ঘর থেকে এনে শোধ দাও। কি করব মাশায়, বললাম—আপনকার জমির পাশে সরকারি গোপথ ভেঙে যে জমিটুকুন বেড়েছে, সেইটুকুন তো আপনকারই হয়েছে—তারই দরুন বলেছিলেন দশ টাকা দেবেন, সেই ল্যান আর বাঁশঝাড় একটা আছে ল্যান, লিয়ে আমাকে রেহাই দ্যান। তা সে কি গালাগাল করলে!—ফোঁস ফোঁস। করে কাদতে লাগলে পানু।

পানু চতুর, নিঃসংশয়ে বুদ্ধিমান। মুহূর্তে ঘুরে গেল মজলিসের মনোভাবের মোড়। পানু যে কথাটা বলেছে, সেটার সঙ্গে সকলেরই অন্তরের কথার অল্পবিস্তর মিল আছে। বনওয়ারীর মত মাতব্বর, সচ্ছল ব্যক্তির পর্যন্ত মিল আছে। সদ্‌গোপ মহাশয়দের সঙ্গে নিয়মিত হিসাব হয় না। ঘোষ-বাড়িতে বনওয়ারীও এবার হিসাব করিয়ে উঠতে পারে নাই। দু বছর তিন বছর পর হিসাব হয়; অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কৃষাণদের ঋণ দাঁড়িয়ে যায়। অবশ্য মনিব অন্যায় হিসেব করেন। না। সে অন্যায় কথা বলা চলে না, বললে পাপ হবে। ঋণ দাঁড়াবারই কথা, সম্বৎসরের ছ মাস বৈশাখ থেকে আশ্বিন পর্যন্ত মনিবের কাছে ধার করে খাওয়া হয়, বাকি ছ মাস তাও একরকম মনিবের কাছ থেকেই নেওয়া। মনিবের পাওনা শোধ না করে ফসলের কৃষাণ পাওনা তিন ভাগের এক ভাগ থেকে কিছু কিছু নিয়েই চলে, এটার সুদ লাগে না—সেও মালিক দয়া করেই নেন না বলতে হবে। তারপর গম, ছোলা, গুড়, আলু, সরষে, তিসি-এ সবের ভাগ মনিব কাটেন না। সুতরাং ঋণ যে শোধ হয় না, তাতে কোনো সংশয় নাই। তবে বছর বছর হিসেব করলে, এগুলো শোধ করা সহজ হয়। দু বছর তিন বছর অন্তর মনিব হিসেব নিয়ে বসলে ভয়ে বুক শুকিয়ে যায়। ভরসার মধ্যে মা-কোপাইয়ের চরে অনেক পতিত আর বাঁশবাঁদিতে বাঁশের ‘মুড়ো’র অর্থাৎ শিকড়সুদ্ধ বাঁশের অভাব নাই, প্রতি বৎসর কাহারেরা দুটো চারটে বাঁশঝাড় লাগায়, দু-চারটে বট-পাকুড়ের চারা বা ডাল পোতে। সেই বাঁশঝাড় আর গাছগুলি মনিবেরা নিয়ে রেহাই দেন। প্রতিজনেই মনিবের জমির পাশে যেখানে যতটুকু সরকারি পতিত জমি থাক্—সে পতিত ডাঙাই হোক বা জলাই হোক বা জলনিকাশী নালাই হোক কিংবা গোপথ হোক—সেইটুকুকে কেটেকুটে বা ভরাট করে আলবন্ধন দিয়ে মনিবের জমির সঙ্গে চাষ করে। সেগুলি নিয়েও রেহাই দেন মনিবেরা।

পানুর কথার উত্তর খুঁজে না পেয়ে সকলে চুপ করেই রইল। কেউ কেউ দীর্ঘনিশ্বাসও ফেললে। বনওয়ারীও ফেললে দীর্ঘনিশ্বাস। বনওয়ারীও এমনি খানিকটা নালা ভেঙে জমি করেছে। ঘোষেরাও বছর কয়েক হিসেব করেন নাই তার সঙ্গে।

শুধু করালী বসে পা নাচাতে লাগল। সে এ বিষয়ে নিশ্চিন্ত মানুষ, চন্দনপুরে খাটে, নগদানগদ মাইনে; সে বলেও ফেললে মারো ঝাড়, চাষের মুখে।

বনওয়ারী বললে—আই করালী!

করালী বললে—তবে পিতিবিধেন কর। পানা যা বলছে, তা তো মিথ্যে লয়।

–বল ভাই করালী, বল।

কাউকে কিছু বলতে হল না। ওদিকে তখন মেয়েরা কথা বলতে শুরু করেছে। মজলিসের ঢেউ ঘরে গিয়ে আছাড় খেয়ে পড়েছে। একেবারে আধুনিক রাষ্ট্রনীতি ফুটে উঠেছে ঝগড়াটার মধ্যে।

পরস্পরের শত্রু নয়ানের মা এবং করালীর নদিদি একত্রিত হয়ে প্রাণকের বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া শুরু করেছে। নয়ানের মা অগ্নি-বৰ্ষণ করছে।

পানুর বউ দুলে দুলে নসুকে গাল দিয়ে চলেছেওলো বেটাখাকী লো, ওলো ভাতারখাকী লো, নিব্বংশের বেটী লো—তোর মুখে আগুন দি লো–

ভুলেই গিয়েছে যে নসুবালা কারও কন্যা নয়, সে পুরুষ, তার স্বামীও নাই, পুত্ৰও নাই।

নসুবালা আবার নেচে নেচে গালাগাল দিচ্ছেনোকের জোড়া বেটাকে আমি এমনি করে নেচে নেচে খালে পুঁতব। নোকের ভাতার মরবে—ওগ নাই, বালাই নাই, ধরফড়িয়ে মরবে, আমি ধেই ধেই করে নাচব।

বনওয়ারী বিরক্ত হয়ে প্রহ্লাদ এবং রতনকে বললে—যা তো রে বাপু একজনা, মেয়েগুলোকে গলায় ধরে আপন আপন ঘরে দিয়ে আয়।

মেয়েদের ঝগড়া অসহ্য হলে কাহারদের ঝগড়া বন্ধ করার এই ব্যবস্থা। এতেও না মানলে তখন প্রহার।

পানু গোটা মজলিসের মন আরও বেশি করে পাবার জন্য বললে ঘা কতক গুমাগুম দিয়ো, বুল্লে পেহ্লাদকাকা, আমি বলছি—আমার ওই পরিবারটাকেও দিয়ো ঘা কতক।

সঙ্গে সঙ্গে করালী উঠে গেল, নসুবালাকে সে হেঁচড়ে টেনে নিয়ে গিয়ে ঘরে বন্ধ করে দেবে।

 

মেয়েদের ঝগড়া বন্ধ হল। সকলে মজলিসে ফিরে এসে আবার বসল। বনওয়ারী স্থির দৃষ্টিতে পানার দিকে তাকিয়ে আছে। পানা দৃষ্টি তুলছে আর নামাচ্ছে। একবারও সে দেখলে না যে বনওয়ারীর দৃষ্টি তার দিক থেকে ফিরেছে। সে চতুর, বুঝছে সব। মধ্যে মধ্যে কান মলে বলছে—এই—এই, আর যদি করি। তারপরই ফেলছে কয়েক ফেঁটা চোখের জল। বনওয়ারীর ঠোঁটের কোণে মধ্যে মধ্যে হাসিও খেলে যাচ্ছে।

–মাতব্বর! হাত জোড় করে আবেদন করলে পানা।

—আর করবি এমন কাজ? বনওয়ারী জানে পানু বুঝতে পারছে কাজের সত্যকার অর্থ।

—কান মলেছি দশবার। আবার মলছি।

আচ্ছা যা। ব্যবস্থা করছি আমি। ধরব গিয়ে মণ্ডলকে। বলব, ভুল হয়ে যেয়েছে—আর তা আপুনি জেনেশুনেই পানাকে দিয়ে করিয়েছেন। না হয়, লয়ানকে দিয়ে আমার মুনিবের নামে। লিখিয়ে দোব লয়ানের ঝাড়। লেগে যাবে ড়ে বঁড়ে লড়াই।

প্ৰহ্লাদ বললে—এটা আচ্চা হবে, বুল্লে কিনা ব্যানো ভাই, আচ্চা! পাকু মণ্ডলের পাক টান। মেরে ছিঁড়ে দেবে ঘোষ। হু হুঁ বাবা, ঘোষ হল ভাগলপুরের ষাঁড়।

খুব হেসে উঠল সকলে।

–কিন্তুক হিসাবের কথা? জিজ্ঞাসা করলে রতন। সে হেদো মণ্ডলের কাছে এমনি একটি বকেয়া হিসাবের বন্ধনে পড়েছে। হেদো শুধু কথা বলে ক্ষান্ত হন না, গদাগ কিল মারেন।

–হবে, হিসেবও হবে। চল, সবাই মিলে যাই একদিন।

—কালই চল সকলে। রতন বললে।

—কাল হবে না ভাই। কাল গাজনের উতুরী পিরবার দিন।

—সি তো যে গাজনের পাটায় চাপবে।

–এবার আমি চাপব। বনওয়ারী বললে।

—তুমি?

–হ্যাঁ।

—না, না। কাজ নাই বনওয়ারী। কিসে খ্যাত হয়। কাজ নাই।

–উঁহুঁ। বাবাঠাকুর পেত্যাদেশ করেছেন, রুপায় নাই।

–বাবাঠাকুর। মজলিস স্তব্ধ হয়ে শিউরে উঠল।

বনওয়ারী বললে—কাল এলে অ্যাই ভোরবেলাতে, ঠিক স্বপনটিও ভাঙল, কাককোকিলও কলকল করে উঠল।

ভোরের স্বপ্ন একেবারে প্রত্যক্ষ অব্যৰ্থ। সকলে হাতজোড় করে প্রণাম করলে দেবতাকে।

—তা ছাড়া–বনওয়ারী বললে—বাবাঠাকুরের রজগরটি আমাদেরই ভুলচুকে পুড়ে মরেছে। তো! পাপটা খালন করতে হবে, চড়কে চাপার মানত খুনি করেছিলাম আমি। হঠাৎ হেসে বললে—বয়েসও তো হল। না হয় ফেটেই মরব।

 

ভোরবেলায় বনওয়ারী কোপাইয়ের জলে গিয়ে নামল। গঙ্গা-গঙ্গা-গঙ্গা। কালই সে কাটোয়ায় যাবে গঙ্গাস্নান করতে, গঙ্গাস্নান করে কালরুদ্রের মাথায় ঢালবার জন্যে ভার বয়ে। নিয়ে আসবে গঙ্গাজল। যাবার সময়টা ট্রেনেই যাবে। আসবার সময় কাধে ভার নিয়ে দুলতে দুলতে দশ কোশ রাস্তা চলে আসবে মনের আনন্দে ‘শিববা হে, শিবো হে’ আঁকতে হকতে। কোশকেঁধে বনওয়ারীর কাছে দশ কোশ কতটুকু!

কালারুদ্দুতলায় ঢাক বাজছে, আজ থেকে সকাল-সন্ধে ধুমুল শুরু হল!

ড্যাডাং ড্যাডাং—ড্যাং–ড্যারা ড্যাং–ড্যাডাং
এ-র্‌–র্‌ র্‌ -র্ র্‌–ড্যাডাং।

লোহার কাঁটা-ভরা চড়কের পাটার উপর শুয়ে বনওয়ারী ঘুরবে। আকাশের দিকে চেয়ে ডাকবে_শিবো হে, শিবো হে, শিবো হে।

তাতে মরতে হয় মরবে, খেদ নাই।

গোটা কাহারপাড়ায় আজ সে দেবতা হয়ে উঠেছে। সকলে তার পথে গোবরজল ছিটিয়ে পবিত্র করে দিচ্ছে।

পাখী এসে বললে–গঙ্গাজল চাই তো? শুধিয়ে গিয়েছে।

–কে? করালী?

পাখী হাসলে।

–আমি নিজেই যাব কাটোয়া। যাবার সময় ট্যানে যাব। আসবার সময় হাঁটব।

–ট্যানে কিন্তুক টিকিট কেটো না। সে ঠিক করে দেবে।


© 2024 পুরনো বই