২.৬ হাঁসুলী বাঁকের কাহারপাড়া

 হাঁসুলী বাঁকের কাহারপাড়ায় সনসনে রাত্রিতে গোলমাল চিরকাল ওঠে। এই সময়ে পুরনো ঝগড়া নতুন করে বাধে। সকলে ঘুমোয়, সেই সময়ে কেউ ঘুম ভেঙে বাইরে এসে নিস্তব্ধ অন্ধকারের মধ্যে সাধ মিটিয়ে গাল দিতে আরম্ভ করে। যদি প্রতিপক্ষটিও সেই সময় জেগে ওঠে দৈবক্রমে, তবে লেগে যায় চুলোচুলি। তা ছাড়া হঠাৎ লোকের সাড়ায় গোলমাল ওঠে কাহারপাড়ায়। জাঙলের চন্দনপুরের ছোকরারা সেই সময় শিস দেয়, সিটি দেয়, উঠানে টুপটাপ করে ঢেলা ছুঁড়ে ইশারা জানায় কাহার-বাউরি আলাপী মেয়েদের মায়েরা পিসিরা মাসিরা শাশুড়িরা শুনতে পেলে গোল হয় না, বাপেরাও বড় কিছু বলে না, কিন্তু ননদ কি স্বামী কি ভাই শুনলে গোলযোগ বাঁধবেই। চোর কাহারপাড়াতে আসে না; এসে নেবে কি? তা ছাড়া কাকের মাংস কাকে খায় না, কাহারেরা একদিন নিজেরাই চোর ছিল; আজ চুরি ছাড়লেও চোর নাম আছে, চুরির হদিসও ভুলে যায় নাই। বনওয়ারী কান-পেতে শুনতে চেষ্টা করতে গোলমালের মধ্যে কার কার গলার ‘রজ’ অর্থাৎ আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। হাঁসুলী বাঁকের এই একটি মজা আছে। কোপাইয়ের ধারের বাঁশবনে ধাক্কা খেয়ে বাঁশবাঁদির কাহারপাড়ার চেঁচামেচি স্পষ্ট হয়ে ফিরে আসে।

গলা শোনা যাচ্ছে নসুবালার। ওঃ, পুরুষের মেয়েলি ঢঙ হলে সে পুরুষ ঝগড়ায় মেয়ের বাড়া হয়ে ওঠে। নসুকে নিয়ে আর পারা গেল না। হুঙ্কার দিচ্ছে করালী। তারস্বরে মেয়ের গলায় চিৎকার করছে কে?-ওগো, ‘অক্ষে কর গো, বাচাও গো!

নিশ্চয় মারপিট করছে করালী। কাকে? সুচাঁদ পিসিকে? পাখীর সঙ্গে বিয়ে হওয়া সত্ত্বেও সুচাঁদ করালীকে ভাল চোখে দেখে না। কিন্তু সুচাঁদের গলা হেঁড়ে গলা; হাড়ির ভেতর মুখ ভরে মেয়েতে কথা বললে যেমন আওয়াজ বের হয় তেমনই,এ তো সে গলা নয়। তবে পাখীকে ঠ্যাঙাচ্ছে নাকি? কিছু বিশ্বাস নেই করালীকে।

আর্তনাদ কিন্তু ক্রমশই বাড়ছে।

হাঁসুলী বাঁকের চারিদিকে বাঁশবন—‘অরুণ্যের’ অর্থাৎ অরণ্যের মত, সেখানে ডাল পড়লে ভেঁকি না হোক, পাতা পড়লে কুলো না হোক, লড়াই লাগলে টুটি-ঘেঁড়াৰ্ছেড়ি হয়। ‘অরুণ্যে’ বাঘ-ভালুকে আপন এলাকা থেকে চেঁচায়, কাহারপাড়ায় আপন আপন অঙ্গন থেকে গাল পাড়ে। তারপর এক সময় লাগে হাতাহাতি। তখন এ ওর টুটি টিপে ধরে, ও এর টুটি ধরতে চেষ্টা করে। এদের যে মাতব্বর, মরণ তারই। মরণ বনওয়ারীর। ছুটল বনওয়ারী।

করালীই বটে! করালী নির্মমভাবে প্রহার করছে রুণ নয়নকে। চারিপাশে মেয়েরা দাঁড়িয়ে গিয়েছে। নসুবালা হাতে তালি দিয়ে বলছে—লাক ছিঁড়ে দে, লাক ছিঁড়ে দে ছুঁচো কুকুরের।

 

সুচাঁদের দৃষ্টি বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে। এই দৃষ্টিতেই কাহারদের মেয়েরা পুরুষদের লড়াই দেখে চিরকাল। সুচাঁদের দৃষ্টির মধ্যে খানিকটা ভয়ের আভাস দেখা দিয়েছে।

সুচাঁদ এ গল্প চিরদিন করবে। ঠিক এমনই দৃষ্টি তখন ফুটে উঠবে চোখে। বললে—বাবা রে, সে কি ‘লড়ন’। সে যেন মহামারণ! করালীর সে কি ‘মুত্তি’! সম্ভবত মনে মনে সে ভয় পায়, করালী যদি তাকে এমনি করে মারে!

বসন চেষ্টা করছে করালীকে ছাড়াতে।উঠে এস করালী; ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও। ওগা মানুষ নয়ান। করালী করালী।

পাখী ফোঁসফোঁস করে কাঁদছে।

আর্ত চিৎকার করছে নয়ানের মা। সে পড়ে আছে উঠানের ওপর। মাথার চুল খুলে, ‘রঙ্গের কাপড় খসে গিয়েছে; বুকে পিঠে ধুলোর চিহ্ন; কেরোসিনের ডিবের লালচে আলোয় তাকে মনে হচ্ছে রাস্তার পাগলিনীর মত। হারামজাদা নিশ্চয় তাকেও মেরেছে; ঠেলে মাটিতে ফেলে দিয়েছে, এতে আর সন্দেহ নাই। কি নিষ্ঠুর, কি দুৰ্দান্ত!

বনওয়ারী গিয়ে করালীর ঘাড়ে হাত দিয়ে ধরে পাঁতে পাঁত টিপে বললে—ছেড়ে দে।

বনওয়ারীর গলার আওয়াজের মধ্যেও বনওয়ারী আছে। চমকে মুখ তুলে তাকালে করালী।

—ছেড়ে দে।

ছেড়ে দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েও করালী বললে—ছেড়ে দেব? ওকে আমি মেরে ফেলাব।

—মেরে ফেলাবি?

নসু হাত-পা নেড়ে অঙ্গ দুলিয়ে বলে উঠল—ফেলাবে না? মেরে ফেলাবে না কেনে, শুনি? তোমার পরিজনের লোক যদি কামুড়ে ধরে লাক কেটে দিতে যায়, তবে তুমি তাকে মেরে ফেলাবে না? ছেড়ে দেবা? গায়ে পিঠে হাত বুলিয়ে সন্দেশ খেতে দেবা?

নয়ানের মা ছেলের কাছে এসে ছেলেকে তুলতে চেষ্টা করছিল, সে বলে উঠল—কার পরিবার? লয়ানের বিয়েলো বউ লয় উঃ যে পরিবার স্বামীর ওগ দেখে ফেলে চলে যায়, সাঙা করে, তার লাক কেটে দেবে না?

 

বনওয়ারী বুঝে নিলে ব্যাপারটা। পাখী এসে সামনে দাঁড়িয়ে আরও পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিলে ব্যাপারটা। সে নিজের নাকটা দেখিয়ে বললে—দেখ।

নসুবালা একজনের হাত থেকে কেরোসিনের ডিবেটা প্রায় কেড়ে নিয়ে পাখীর নাকের সামনে ধরে বললেবল, চোখ তো আছে, মাতব্বর মানুষ, বিচেরও আছে, বলি একবার দেখ। লাকে কামুড়ে কি করেছে দেখ। ‘সব পুত থাকতে লাতির মাথায় হাত!’ হাত গেল, আঙুল গেল, পিঠ গেল, কাঁধ গেল, গিয়ে লাকে কামড়?

সত্যই নাকে দাঁতের দাগের ঘের জুড়ে লালচে রক্তাভ দাগ হয়ে গিয়েছে। নয়ানের দিকে। তাকালে বনওয়ারী। হাঁপানির রোগী বেচারা, নিৰ্জীবের মত পড়ে আছে, যে শাসন তার হয়েছে তার উপর শাসনের আর উপায় নাই। তা ছাড়া নয়ানের উপর যে আঘাত দিয়েছে, তার জন্য বনওয়ারীর মনে যে অন্যায় বোধটুকু খচখচ করছিল, সেটাও এই সুযোগে বড় হয়ে উঠল। সে কিছুতেই মানতে পারলে না, শাসনটা ন্যায্য শাসন হয়েছে। বনওয়ারী বললে—বোঝলাম, সব। বোঝলাম। কিন্তু তবু অল্যায় হয়েছে। নিশ্চয় অন্যায় হয়েছে। ওগা মানুষটা যদি মরে যেত? মুখ এখে বাকি আর ঠাঁই একে মারপিতিপুরুষে বলে যেয়েছেন ই কথা।

করালী বলে উঠল—কোম্পানির আইনে মেয়েমানুষকে এমন করে কামুড়ে দেওয়ার জন্যে জ্যাল হয়।

বনওয়ারী গর্জে উঠল—করালী।

—কি! আমি অল্যায় কি বললাম!

—এই দেখু! চন্ননপুরে পালাতে হয়েছিল তোকে গা ছেড়ে। আমি তোকে সব ক্ষমা-ঘেন্না করে আবার এনেছি গেরামে। যখন আনি, তখন কি কি বলেছিলাম মনে কর। আমার কথা শুনে চলতে হবে, পবীণদের অমান্য করবি না, অধৰ্ম্ম অনাচার করব না। তু স্বীকার করেছিলি কি না?

করালী জবাব দিলে না কথার। পাখীকে টেনে বললে—চলে আয়।

চলে গেল তারা। নসুবালা কোমর ঘুরিয়ে হঠাৎ বলে উঠল—আঃ মরে যাই! চল্ গো চ। ঘর চল্ সব। সেই যে বলে

“চোখের জলে লরম হল মাটি–
সেই মাটিতে কুড়িয়ে পেলাম হারানো পিরিত!”

বলেই সে ঠোঁটে পিচ কেটে সঙ্গে সঙ্গে চলে গেল।

হয়ত সেই মুহূর্তে বনওয়ারী একটা কাণ্ড করে বসত। কিন্তু তখন নয়ানের মা তার পায়ের কাছে মাথা রেখে পায়ে হাত দিয়ে কেঁদে বলছিল—বিচার কর, তুমি বিচার কর, মাতব্বর তুমি, বিচার কর।

বনওয়ারী মাথা হেঁট করলে, অবিচার সে করেছে। পরক্ষণেই সে নয়ানকে দুই হাতে তুলে নিয়ে দাওয়ার উপর এনে সেখানে পাতা তালপাতার চ্যাটাইয়ের উপর শুইয়ে দিয়ে বললে—জল। আন দেখি। মুখে কপালে জল দাও। ছেলেকে সোস্থ কর আগে।

 

সকলেই প্ৰায় চলে গিয়েছিল। নয়ানের মা এককালে ছিল মাতব্বরের পরিবার, ঘরভাঙাদের ঘরের গিনি, তার অহঙ্কার ছিল বেশি, সে অহঙ্কার তার ভেঙে গেল যখন থেকে, তখন থেকে সে অত্যন্ত কটুভাষিণী। তাই তার প্রতি কারু সহানুভূতি নাই। কাহারপাড়ার লোকে শুধু ঠোঁটে হাসতে জানে না; ওদের সহজ কথা; ওরা বলে—আকাশের তারা জলে ফোটে। আকাশে ম্যাঘ। থাকলে কি পুকুরে পানা থাকলে সে হবার যো নাই। ‘লতার সঙ্গে ভাব নাই তো হাসলে হবে কি?’

বসে ছিল কেবল সুচাঁদ।

সে আক্ষেপ করছিল—আঃ, ‘মানুষের দশ দশা, কখনও হাতি, কখনও মশা, সেই ঘরভাঙাদের আজ এই অবস্থা।

সে বসে বসে  হাঁসুলী বাঁকের উপকথা বলে যায় অভ্যাসমত। ‘ঘরভাঙাদের পবল পেতাপ’, জাঙলের চৌধুরীরা বাবাঠাকুরের ‘কিপায়’ যখের ডিঙির ধনে বড়লোক, সায়েবডাঙার নীলকুঠির সায়েবদের বাগ-বাগিচা ক্ষেত-খামার জমিদারির মালিক। সেই চৌধুরীদের জোতদার ‘পেধান’ জোতদার ঘরভাঙারা। নয়ানের কত্তাবাবার গলার হকার কি! ‘মোচের’ ‘বেক্কম’ কি! আঙা চোখের তারার ঘুরন কি! বাবা, আজ নয়ানের বউকে কেড়ে নিয়ে তোমরা দিলে করালীকে। সেকালে চৌধুরীবাবুর ছেলের কামরায় নয়ানের বাবা দিয়ে আসত কাহারপাড়ার বউ বিটী। বসনকে আমার সেই তো ধরেছিল বাবুর লজরে? নয়ানের বাপ বাবুর মদের পেসাদ পেত, মাসের পেসাদ পেত, সকল ভোগের পেসাদ পেত।

নয়ান এতক্ষণে সুস্থ হয়েছে। চোখ মেলে চাইলে সে। বনওয়ারীকে দেখে তার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ল। বনওয়ারী তার কপালে হাত বুলিয়ে বললে ঘুমো। তু টুকচে সেরে ওঠ, তোরও সাঙা দিয়ে দেব আমি। করালী তোর বউকে সাঙা করেছে, বলিস তো–করালী যে বউকে ছেড়েছে সেই বউকে সাঙা দিয়ে দেব তোর।

 

সুচাঁদ বললে—কি বলছিস ব্যানো? আঁ! কি অন্যায় আমি করলাম রে? আজ মাতব্বর হয়েছিস। তোর গায়ে লাগছে ঘরভাঙাদের মাতব্বরির কাহিনী, সে আমি জানি। কিন্তুক লয়ানের বাবার পাশে পাশে তোর ঘোরা তো আমার মনে আছে। লয়ানের বাপ চৌধুরীবাবুর কামরাতে থাকত, আমোদ করত। তু ঘরভাঙাদের পাদাড়ে পাদাড়ে ঘুরঘুর করে বেড়াতিস, সে কথা তু ভুলতে পারিস, আমি তো ভুলতে পারি না। তু আজ হারামজাদা করালীর পক্ষ নিয়েছি! লয়ানের মা আজ না হয়

বনওয়ারী বেশ উঁচু গলায় ধমক দিয়ে উঠল—পিসি!

সুচাঁদ শুনতে পেলে এবং তিরস্কারের সুর বুঝতেও পারলে। সেও চিৎকার করে উঠল— কেন রে? তোকে ভয় করে বলতে হবে নাকি কথা? লয়ানের মায়ের সঙ্গে তোর গুজু-গুজু আর কেউ না জানুক আমি জানি। দীর ধারে একদিন উয়োর পায়ে ধরেছিলি, আমি দেখেছিলাম।

বনওয়ারী এসে দাঁড়াল সুচাঁদের সামনে।

সুচাঁদও উঠে দাঁড়াল। সে ভয় পেয়েছে। কাহারদের মাতব্বর বড় ভয়ঙ্কর। সে সঙ্গে সঙ্গে বনওয়ারীর কথা ছেড়ে করালীকে গাল পাড়তে লাগল।—করালীকে গায়ে আনলি, ও থেকে গাঁয়ের সব্বনাশ হবে। বাবার বাহন মেরেছে ও। চন্ননপুরে মেলেচ্ছ কারখানায় কাজ করে মেলেচ্ছ হয়েছে ও। আমার গায়ে ব্যাঙ দিয়ে দেয়। ওর সঙ্গে পাখীর বিয়ে?

বলতে বলতেই সুচাঁদ চলে গেল।

বনওয়ারী উঠানে কয়েক মুহূর্ত পঁড়িয়ে থেকে চলে যাচ্ছিল শালের দিকে। মৃদু কণ্ঠে কে ডাকলে—শোন।

নয়ানের মা দাঁড়িয়েছে এক দাওয়ার ধারে খুঁটিটি ধরে।

বনওয়ারী একটু বিব্রত হল।

নসুবালার ছড়ার ইঙ্গিত সত্য, সুচাঁদের কাহিনীও সত্য। নয়ানের মায়ের কাছে আজ মুখ দেখাতে লজ্জা হচ্ছে। অন্যায়-অনেক অন্যায় হয়ে গিয়েছে। বনওয়ারীর এ অন্যায় ইচ্ছাকৃত অন্যায়। সে আমলের কথা সে সব। নয়ানের বাপ তাল কুঞ্জ তখন মাতব্বর, বনওয়ারী ছিল কুঞ্জর বন্ধু, কিন্তু তাকে ঈর্ষা না করে পারত না। মাতব্বরির উপর দৃষ্টি পড়েছিল। বনওয়ারীর বাপ তখনও বেঁচে। কুঞ্জ তখন চৌধুরীবাবুর ছেলের সঙ্গে ঘোরে। সেই সময় বনওয়ারী প্রতারণা করেছিল নয়ানের মার সঙ্গে।

নয়ানের মা কাছে এসে দাঁড়াল। বনওয়ারী বললে—লয়ানের আমি সাঙা দিয়ে দোব বাসিনীবউ, পিতিজ্ঞে করেছি আমি।

নয়ানের মা কাঁদছিল।

বনওয়ারী বললে—লয়ান সেরে উঠুক, আনন্দে ঘর সংসার কর। আর–আর যদি লয়ান ভাল করে না সারে, তবে কাউকে নিয়ে খেটে-খুটে খাবে। আর সে চুপ করে গেল, কথাটা উচ্চারণ করতে পারলে না। মাতর হয়ে কথাটা উচ্চারণ করা উচিত নয়।

বউয়ের রোজকার, বিটীর রোজকার কাহারপাড়ায় ‘শাক-ঢাকা মাছ’। জানে সবাই। বনওয়ারী বলতে চেয়েছিল সেই কথা।

বনওয়ারী বললে আমি তবে যাই। শালে গুড় ফুটবে।

পিছন থেকে টান পড়ল তার কাপড়ে। চকিত হয়ে বনওয়ারী ফিরল। অন্ধকারের মধ্যেও কাহারদের দৃষ্টি প্রখর। তা ছাড়া কাহারদের বুকের কথাও জানে কাহার মাতব্বর। কোপাই নদীর পাগলামির হেঁয়াচ কাহার মেয়েদের জীবনে ঘোচে না।

বিশ বছরের সন্তানের জননী নয়ানের মা। তার চোখের দিকে বনওয়ার চেয়ে দেখে চঞ্চল হয়ে উঠল। নয়ানের মা বললে—মনে আছে? পায়ে ধরেছিলে লদীর ধারে সুচাঁদ পিসি বলে গেল।

—লয়ান রয়েছে ঘরে, বাসিনীবউ।

—সে ঘুমিয়েছে। জান, তখনও মাতব্বরি ঘরভাঙাদের। আমি তখন ঘরভাঙাদের বউ।

–বাসিনীবউ, আমি তো তোমার অসম্মান করি নাই ভাই।

বাসিনীবউ তার হাত চেপে ধরেছে। চোখ জ্বলছে। ভয় পেলে বনওয়ারী। বানিসীবউ ভয়ঙ্করী হয়ে উঠেছে।

বনওয়ারী মনে মনে বাবাঠাকুরকে স্মরণ করলে। সে দাঁড়াল বাবার থানের দিকে মুখ করে। বাঁশবনে অন্ধকারে ভয়-ডর লাগলে বাবার থানের দিকে তাকালে সে ভয় কেটে যায়। বাবার থানে গভীর রাত্রে আলো জ্বলে।

 

সুচাঁদ পিসি বলে—আমার বাবার বাবা দেখেছেন, ঘরভাঙাদের কত্তা দেখেন, অমাবস্যার ‘এতে’ বাবার থানে আলোয় আলোয় ‘আলোকীন্নি’। সেই জন্যই কাহারপাড়ার প্রতি ঘর ওই বাবার থানে প্রতি অমাবস্যায় একটি করে প্রদীপ জ্বেলে দিয়ে আসে।

বাবার থানে অমাবস্যায় পিদিম দিলে, বাবা তার মঙ্গল করেন; তার ঘরে নিত্যি ‘সনজেতে আলো জ্বলবে, গভীর ‘অরুণ্যে’ তেপান্তরে পথ হারালে পথ খুঁজে পাবেওই আলো কাহারদের চোখে ফুটে উঠবে। যমপুরীতে ‘অন্ধকারে থাকতে হবে না, বাবার থানে যতগুলি পিদিম দেবে, সেখানে ততগুলি পাবে। তবে ‘এড়া’ কাপড়ে, পাপের কথা মনে ভাবতে ভাবতে পিদিম দিলে তার ফল—‘আগড়া ধানের মত’, খোসার মধ্যে শ‍স থাকে না, তুষের মধ্যে চাল থাকে না, তেলকালির দাগ-ধরা মাটির ‘ডেলুই’ অর্থাৎ প্রদীপ শুকনো আধ-পোড়া সলতে নিয়ে পড়ে থাকে, পিদিমে শীষ জ্বলে না।

বনওয়ারী এই একটু আগে বাবার থানে গড়াগড়ি দিয়ে এসেছে। মানত করে এসেছে। বলে এসেছে, যে পাপ সে করেছে তার প্রায়শ্চিত্ত করবে। সে মাতব্বর;-রাজার পাপে রাজ্য নাশ, মণ্ডলের পাপে ‘গেরাম’ নাশ, কত্তার পাপে গেরস্ত ছারখার, ‘পিতের’ অর্থাৎ পিতার পাপে ‘পুত্তের দণ্ড। সে মাতর হয়ে গেরামের সব্বনাশ ডেকে আনবে না। বাবার কাছে তবু সে বলেছে। কালোশশীর কথা, আর তার সঙ্গে রঙের খেলার ‘রনুমতি’ অর্থাৎ অনুমতি চেয়েছে। কিন্তু আর না। তা ছাড়া ‘নোকসমাজে নিন্দে হয়, ‘চিলোকে’ অর্থাৎ স্ত্রীলোকেরা করে হাসাহাসি, পুরুষে করে কানাকানি, উঁচু মাথা হেঁট হয়, মাতব্বরির আসন করে টলমল, শেষ পর্যন্ত মা-বসুন্ধরা ফেটে গিয়ে সে আসন ‘গেরাস করেন। সে বাবার থানের দিকে চেয়ে বাবাকে মনে মনে। ডাকলে।

সত্যিই আলো চমকে উঠল। বাবার থানে নয়, আকাশে। চমকে উঠল দুজনেই। কখন আকাশ ঘিরে মেঘ জমে উঠেছে। বিদ্যুৎ দিলে এই প্রথম। মেঘ ডেকে উঠল গুর-গুর করে।

বনওয়ারী এবার ভয়ে চমকে উঠল।

বাবার খানের আলো আকাশে বিদ্যুৎ হয়ে ‘ললপাচ্ছে’ অর্থাৎ চমকাচ্ছে। বাবার হক আকাশে আকাশে বেজে উঠেছে। কিন্তু পরমুহূর্তে সামলে নিলে নিজেকে। ওদিক থেকে কে হকছে—মুরুন্ডি, মুরুদ্ধি! সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, শালে কড়াইয়ে গুড় ফুটছে। জল পড়লে সব। খারাপ হবে। সে ছুটল। নয়ানের মা সেই দুর্যোগভরা আকাশের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে চিৎকার করে উঠল হঠাৎ-বাহনের মাথায় চেপে নাচ বাবা। নকনক করুক তোমার বাহনের জিভ। হে বাবা! হে বাবা!

বনওয়ারীও মনে মনে বলছিল, হে বাবা, হে দয়াময়, খুব রক্ষে করেছ বাবা। খুব রক্ষে করেছ।

 

শালে তখন হুড়োহুড়ি পড়ে গিয়েছে। উপরের ছাউনিতে খড় দিতে হবে। হেদো মণ্ডল খুব হাঁকডাক করছেন। অতনার বেটা লটবর উঠেছে ছাউনির উপর। মধ্যে-মাঝে বাবা কালারুদ্রের নাম নিচ্ছে।

—শিবো হে! জয় বাবা কালারুদ্দু! ত্রিশূলের খোঁচায় ‘ম্যাঘ’ উড়িয়ে দাও বাবা। জল হলে গুড় মাটি হবে বাবা। আমের মুকুল যাবে বাবা। ‘ফাগুনের জল আগুন’। ম্যাঘ উড়িয়ে দাও, এবার গাজনে আধ মন গুড়ের শরবত মানত রইল। জয় বাবা কালারুদ্দু, গাজনে এবার পাচ। পো তিলত্যালের পিদিম দোব বাবা। শিবো হে, খাস আমের গুটি তোমার ভোগে দোব বাবা।

বনওয়ারী আকাশের দিকে চেয়ে দেখছিল স্থির দৃষ্টিতে।

বিদ্যুতের আলোয় সে দেখছিল, মেঘ যেন কড়াইয়ের ফুটন্ত গুড়ের মতই উথলাচ্ছে। সাদায় কালোয় ফুলে ফেঁপে ছড়িয়ে পড়ছে ক্রমশ দিকে দিকে। জল ‘অনিবার্য’। সকালের মেঘ ডাকলে নামে না, কিন্তু অকালের মেঘ নামবেই। বর্ষণের কাল আষাঢ় শাওন ভাদ্দ আশ্বিন। বাকি সকল মাস অকাল। বর্ষার সময় মেঘ ডাকলেও অনেক সময় বৃষ্টি নামে না। এ মেঘ অকাল মেঘ, বিশেষ মাঘ-ফাল্গুনের মেঘ, সাড়া দিলে অঙ্গ নাড়া দিয়ে ঝরবেই। ফাগুনের জল আগুন, আমের পক্ষে তো নিৰ্ঘাত আগুন। সমস্ত মুকুলে ঝই লেগে যাবে। আম হবে না। আঃ—’আমে দেখে ধান’। আম না হলে ধান হবে না। তবে বৃষ্টি হলে সায়েবডাঙায় কাজ লাগবে। কাকর মাটি ভিজে নরম হবে। জমি তৈরির একটা ‘বাত’ অর্থাৎ সময় পাবে। সায়েবডাঙায় জমি অনেকটা পেয়েছে বনওয়ারী।

নামল বৃষ্টি ঝমঝম করে। বাবা কালারুদ্দু কান দিলেন না ওদের প্রার্থনায়। রতন তার মুনিব হেদো মণ্ডল মহাশয়কে বললে—মুনিব মশায়, আধ মন গুড়ের মানতে বাবার মন উঠল না। এক মন মানত করেন।

 

হেদো মণ্ডল পুরনো কালের লোেক, কিন্তু তিনি কাহার নন। জলের ছিটে থেকে বাঁচবার। জন্য বুড়ো বটগাছটার কাণ্ডের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে হুঁকো টানতে টানতে বললেন—ভাগ বেটা কাহার কোথাকার, মানত করলে জল থামে।

তবে গুড়টা মাটি হবেন মাশায়!

গাছের কাণ্ড বেয়ে কয়েকটা মোটা ফেঁটার জল মণ্ডল মহাশয়ের কঙ্কের উপর পড়ে ফাঁস শব্দ করে কল্কেটা নিবিয়ে দিলে, মণ্ডল মশায় ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে উপরের দিকে তাকালেন, বললেন অ-হ-হ!

রতন বললে—মুনিব মাশায়!

–নিকুচি করেছে বেটা কাহারের মুনিব মাশায়, মুনিব মাশায়! হুঁকোটা ফেলে দিয়ে হেদো মণ্ডল খপ করে ধরলেন রতনের মাথার চুল, দমাদম কশিয়ে দিলেন কয়েকটা কিল। ছাড়া পেয়েই রতন বললে—দ্যান, কন্ধেটা খসিয়ে দ্যান, আগুন করে দিই।

 

ওদিকে শালের কড়াইয়ের পাশে বনওয়ারী অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে আছে। কড়াইয়ের ফুটন্ত রসে খড় ও তালপাতার ছাউনি ভেদ করে জল পড়ছে। আঃ, এমন যত্ন করে গুড় তুলেছিল সে, সব মাটি হয়ে গেল। গন্ধ হবে, স্বাদ নষ্ট হবে। হায়! হায়! হয়!

পানু দূরে গাছের তলায় জল বঁচিয়ে বসে কয়েকজন অন্তরঙ্গের সঙ্গে এরই মধ্যে সরস রসিকতায় মজলিস জমিয়ে তুলেছে। রসটা জমিয়ে তুলেছে সে হেদো মণ্ডলের গুড় নষ্ট হওয়ায় আনন্দ অনুভব করে।বেশ হচ্ছে, আচ্ছা হচ্ছে, লাগাও বাবা লাগ ঝমাঝম! কি বেটার গুড় খারাপ হয়ে। ভারি বজ্জাত বেটা। মা-দুগগার অসুর।

 

হঠাৎ সেখানে এসে বসল মাথলা। তার সঙ্গে এল প্রহ্লাদ। জলে তাদের সর্বাঙ্গ ভিজে গিয়েছে। প্রহ্লাদ বসেই বিনা ভূমিকায় বললে, পান, তু কিন্তুক সাবধান!

—কেনে?

—কেনে? বনওয়ারী এতক্ষণ কোথা যেয়েছিল জানিস?

–কোথা?

—আটপৌরে-পাড়ায় ঘেঁটুর গান শুনতে।

মুখ শুকিয়ে গেল প্ৰাণকৃষ্ণের। বনওয়ারীর প্রতিহিংসা বড় ভীষণ। মাতব্বর রাগে না তো রাগে না, রাগলে কিন্তু রক্ষা নাই।

প্রহ্লাদ বললেওদের ঘেটুগান এবার টু করেছিলি আমি জানি।

পানু এতক্ষণে নিজেকে সামলে নিয়েছিল, এবার সে তার স্বভাবগত চাতুর্যের সঙ্গে বলে উঠল—মাইরি না; মাইরি বলছি, ছেলের দিব্যি করে বলতে পারি, কিছুই জানি না আমি। তারপর সে বিপুল বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন করলে আটপৌরেওলারা এবার লতুন গান বেঁধেছে নাকি ঘেঁটুতে? কি গান? মজার গান নাকি? বলে সে অকারণে হি-হি করে হাসতে লাগল।

প্রহ্লাদ বললে—বুঝবি মজা, এইবার বুঝবি। মুরুদ্ধির সঙ্গে কালোশশীকে জড়িয়ে গান! ঠেলা বুঝবি এইবার!

পানু বললে— মুরুক্মির সঙ্গে কালোশশীকে জড়িয়ে? তা হলে নিশ্চয় ওই করালীদের কাণ্ড। ওই সুবালা-হারামজাদী

—কে রে? কে? কি কাণ্ড করালীর?—বলতে বলতে পিছন থেকে এসে দাঁড়াল কে একজন। লোকটার গায়ে একটা আলখাল্লা, মাথায় প্রকাণ্ড একটা বোঝা। মুখটাও দেখা যাচ্ছে না। শুধু গলার আওয়াজে বোঝা গেল, সে করালী। মাথায় ওটা কি?

প্ৰহ্লাদ প্রশ্ন করলে—করালী মাথায় কি রে?

—তেরপল গো কাকা।

—তেরপল?

–হ্যাঁ। ইস্টিশান থেকে এনেছিলাম একটা। তা জল দেখে মনে হল, তোমাদের গুড় লষ্ট হবে। তাই নিয়ে এলাম, দাও চাপিয়ে চালের ওপর। এক ফোঁটা জল পড়বে না; একটা তেরপলের জামা গায়ে দিয়ে সে তেরপলটা মাথায় বয়ে এনেছে। অদ্ভূত লাগছে ওকে। ঠিক সাহেবের মত। প্রহ্লাদ লাফিয়ে উঠল।—বনওয়ারী! ব্যানো!

করালীকে প্রায় টানতে টানতে সে নিয়ে গেল শালের উনোনের কাছে। হতাশভাবে সকলে উপরের চালের দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। জনদুয়েক ছোকরা মুনিষ কোদাল ধরেছে, উনোনের মুখটার চারিদিক ঘিরে বাঁধ তৈরি করছে, জল যেন গড়িয়ে এসে উনোনের ভিতরে না। ঢোকে, উনোন যেন নিবে না যায়। হেদো মণ্ডল হাউহাউ করে চিৎকার করছেন ছাতা নিয়ে আয়, ছাতা এনে কড়াইয়ের ওপরে ধ। মণ্ডল মশায়ের বুদ্ধি হরে’ যেয়েছে, অর্থাৎ বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। এ জলে ছাতা ধরে মাথাই বাঁচে না, তা শালের কড়াই?

প্ৰহ্লাদ কলরব করে বলে উঠল—হইছে বনওয়ারী, হইছে। করালী রুপায় করেছে, তারপল নিয়ে আইচে। দাও চাপিয়ে চালে।

তেরপল! রেল-ইস্টিশানের তেরপল! চাল-ধানের বস্তার উপর বর্ষার সময় চাপিয়ে দেয়, একটি ফেঁটা জল পড়ে না—সেই তেরপল?

হেদো মণ্ডল হাফ ছেড়ে চলেন। তাঁর আর তর সইছে না।

—দে দে, চাপিয়ে দে। ওঠ। উঠে পড়।

বনওয়ারী একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেললে তা ভালই হইছে-হঁ, ভালই হইছে। দে, তা চাপিয়ে দে।

করালী বলে—তোমার জিম্বা রইল কিন্তু মুরুক্মি। তুমি অইচ বলেই আনলাম আমি, নইলে লাখ টাকা দিলে দিতাম না আমিতা সে আজাই হোক আর রুজীই হোক, হা।

হেদো মণ্ডল কথাটা শুনে একটু হেসে তার দিকে তাকিয়ে বললে—বলিহারি রে বলিহারি! খুব বলছিস যে! আঁ? আবার একটু হেসে বনওয়ারীর দিকে তাকিয়ে মণ্ডল বললেন—তা বাহাদুর বলতে হবে বেটাকে-হাঁ, বেটা খুব বাহাদুর।

করালীর ভুরু দুটো কুঁচকে উঠল। ঘোষ মশায় হলে হয়ত ভুরু কুঁচকেই মাথা হেঁট করে চলে যেত, কিন্তু হেদো মণ্ডল মাইতো ঘোষ নয়। সে মুহূর্তে জবাব দিয়ে উঠল, কি? বেটাবেটা বলছেন কেনে? ভদ্দনোকের উ কি কথা!

এক মুহূর্তে শালের সমস্ত কাহারেরা হতভম্ব হয়ে গেল। বনওয়ারী শঙ্কিত হয়ে উঠল। হেদো মণ্ডল সাক্ষাৎ দুর্গা মায়ের অসুর, এইবার হুঙ্কার ছেড়ে লাফিয়ে পড়বেন করালীর উপর। কিন্তু আশ্চর্য, হেদো মণ্ডল কেমন যেন হয়ে গিয়েছিলেন, চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন তেরপলের জামা-পরা করালীর দিকে চেয়ে। কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে হেদো মণ্ডল শুধু বললেনক্যানে, অন্যায় কি বললাম আমি? কি রে বনওয়ারী, কি অন্যায়টা বলেছি, তুই বল দেখি?

বনওয়ারী উত্তর দেবার পূর্বেই করালী বললে—মুরুব্বির কাছে উ সব তো অন্যায় লাগবে। না, উ সব ওদের গাওয়া হয়ে যেয়েছে। বলি বেটা কিসের মশায়, বেটা? বলেই সে হনহন করে চলে গেল। বলতে বলতে গেল—বেটা শালা হারামজাদা গুখোরবেটা লেগেই আছে— ভদ্দনোকের মুখে লেগেই আছে। ভদ্দনোক! মাথা কিনেছে! অঃ

সে এসে দাঁড়াল সেই গাছতলায়। কই, পানা কই? সে ‘যেল’ অর্থাৎ গেল কোথায়?

যারা বসে ছিল তারা হতভম্ব হয়ে গিয়েছে করালীর কাণ্ড দেখে। ভাবছে, করালী করলে কি? এও কি সম্ভব হয়? অবাক করে দিয়েছে করালী। ছোকরার বুকের পাটা বটে! সঙ্গে সঙ্গে এও তাদের মনে হচ্ছে যে, করালী কথাটা কিন্তু ঠিক বলেছে। ওই বাক্যগুলি মণ্ডল মশায় বাবু মোয়দের মুখে লেগেই আছে। রাগ হলে কথাই নাই, আদর করবেন, তাও বলবেন—বলিহারি রে শালা! আদর করে ‘কেমন আছিস’ শুধাবেন, তা বলবেন কিরে হারামজাদা, রইছিস কেমন? কথাটি করালী বলেছে ঠিক। তবে তবে এমন চড়ে উঠে না বললেই হত। লঘুগুরু তো মানতে হয়। ভগবান, বাবা কালারুদ্দের বিধানে তো এ সব লেখাই আছে, পায়ে মাথায় সমান নয়।

করালী আবার প্রশ্ন করলে—বলি, সে শালো গেল কোথা রে? আ কাড়িস না যে? আঁ!

মাথলা বললে–সে পলালছে কোথা।

—পালালছে! শালে খ্যাঁকশ্যাল। পেলে হয় শালোকে।–করালী আর দাঁড়াল না। তেরপলের জমাটা পরে লম্বা লম্বা পা ফেলে চলে গেল, যেন সাপের পাঁচ-পা দেখেছে!

তেরপলের তলায় একটি ফেঁটা জল পড়ে না। নির্বিঘ্নে চলছে গুড় তৈরির কাজ। উনোনের পাশে লম্বা বাখারিতে নারকেলের মালা-গাথা হাতা নিয়ে গাদ অর্থাৎ ময়লা তুলতে তুলতে বনওয়ারী ভাবছিল ওই করালীর কথা। ছোকরা অসম্ভব কাণ্ড করে তুলেছে। যা-খুশি তাই করছে। কোনো বিধিবিধান মানছে না, শাসনের বাইরে গিয়েছে, কথায় কথায় ঝগড়া, পদে পদে বিপদ বাধিয়ে তুলছে।

আজই যদি তেরপলটার নেহাত দরকার না থাকত, তবে হেদো মণ্ডল ছাড়তেন না। কাণ্ড একটা ঘটে যেতই। নাঃ, বনওয়ারীর এ বড় খারাপ লাগছে। কাটাগাছ করালী সেই কাঁটাগাছের চারা, তুমি আদর করে কোল দিতে যাও, বুকে তোমার বিধে ক্ষতবিক্ষত করে দেবে। তবে বেটা-ফেটা কথাগুলি খারাপ বটে।

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলল বনওয়ারী। আঃ, ছোকরাটি যদি ভাল হয়ে চলত, ‘সলা-সুলুক’ নিত মানত। ওই চন্ননপুরের কারখানাতেই ওর মাথা খারাপ করে দিলে।

বৃষ্টি আরও জোরে এল। সঙ্গে সঙ্গে দমকা বাতাস। বৃষ্টির জলের ঢল নামছে, গ্রাম থেকে বেরিয়ে মাঠের দিকে চলেছে। ওঃ, তেরপলটা না হলে আজ সব মাটি হত। সব বরবাদ যেত। ওঃ, ঝম-ঝম করে জল! কাহারপাড়ায় মেয়েছেলেগুলো কলকল করছে। ফাগুন মাস, চালে এখনও নতুন খড় পড়ে নাই, পুরনো খড় পচেছে, উড়ে গিয়েছে, দেবতার জল সবটুকুই ঘরে পড়ছে আজ। আহা-হা, সমস্ত রাত্রি ঘুমুতে পারে না।

ছেড়ে দাও বাবা, দেবতা হে কালারুদ্দ, ক্ষান্ত দাও বাবা। কাহারদিগে আর মেরো না। মাইতো ঘোষ বলেন—এল ডাউরী ম’ল বাউরি। বাদলা বর্ষা হলে কাহারদেরই মরণ।

বাতাসে গাছপালার মাথা দুলছে। বাঁশবাঁদির বাঁশবনে মাতন লেগেছে। ঝরঝর শব্দে বৃষ্টি পড়ছে বাঁশের পাতায়, কা-কটকট-কট শব্দ উঠেছে দোলনলাগা বাশে বাশে ঘষা খেয়ে। মাঠ থেকে ভিজে মাটির গন্ধ ভেসে আসছে।

হঠাৎ প্রহ্লাদ কোদালখানা হাতে নিয়ে উঠল।

—কোথা যাবি?

ওই দেখ। প্রহ্লাদ দেখাল, গ্রাম-গড়ানি জলের ধারার মধ্যে একপাশে কষের কালির মত। একটা জলের স্রোত বয়ে যাচ্ছে। কার সার-ডোবা ভেসেছে। সার-ধোঁয়া জলের ওই রঙ, ওই ধারা। কিছুতেই জলের সঙ্গে গুলে এক হয়ে যাবে না, একপাশ ধরে চলবে। আর ওতে পা দাও, দেখবে ফুটন্ত জলের মত গরম। পাশে মাটি রঙের জলে পা দাও, দেখবে ঠাণ্ডা।

প্ৰহ্লাদ বললে—আমার আউশের উঁইখানা ছামনেই, দিই কেটে ঢুকিয়ে, ই একবারে জমির সালসা।

—দে, ঘুরিয়ে দে। বনওয়ারীর জমি দূরে। আর সায়েবডাঙায় কোদাল চলবে এইবার।

ওঃ, বুনো শুয়োরগুলো চিৎকার করছে সায়েবডাঙায়। বেটারা ভিজে মাটি খুঁড়ে কল খেতে বেরিয়েছে। সায়েবডাঙার মাটি নরম হয়েছে।


© 2024 পুরনো বই