বাবাঠাকুরতলায় ভোরবেলায় ঝুঁজকি থাকতে অর্থাৎ অন্ধকার থাকতেই ঢাকী ভোরের বাজনা ধুমুল বাজাতে শুরু করলে। রবিবার অমাবস্যা ক্ষণ মিলেছে ভাল, বাবাঠাকুরের পুজো হবে। ফুলে বেলপাতায়, তেলে সিঁদুরে, ধূপে প্রদীপে, আতপে চিনিতে, দুধে রম্ভায়, মদে মাংসে, কাপড়ে দক্ষিণায়সমারোহ করে পুজো।
ঢাক বাজবার আগেই ওঠে কাহারপাড়া—মেয়ে পুরুষে। ঘুমিয়ে থাকে শুধু ছেলেরা। তারাও আজ উঠে পড়ল। কলরব করে তারা যেতে চায় বাবাঠাকুরের থানে। সুচাঁদ চোখ বড়। বড় করে বললে—খবরদার, এ তো বছরশালি পুজো নয়,-আমোদ নেই এতে। অপরাধের। পুজো, একেই বাবা মুখ ভার করে আছেন, তারপর ছেলেরা যাবে, চেঁচামেচি করবে, ল্যাই কলহ। করবে, ধুলো ছিটোবে, অবলার জাত—নোংরা ময়লা করবে অপরাধের ওপর অপ্রাধ হবে। খবরদার! আগে পাঁঠা দুটি নিব্বঘ্নে কাটা হোক, বাবাঠাকুর পুজো লেন হাসিমুখে; তারপর নাচন-কোদন, গান-বাজনা, মাল-মাতালি—সব হবে।
বনওয়ারী পাড়ায় পাড়ায় বলে এলসবোধান, সব সাবোধান! করালীর অপরাধের সাজা গোটা পাড়াকে ভুগতে হচ্ছে বাবা সকল; আর অপরাধ বাড়িয়ো না। অনেক মাসুল লাগল। আর না।
প্ৰহ্লাদ বললে—সোজা খরচ!
বনওয়ারী খরচ করছে, পানু মনে করে হিসেব রাখছে। এসবে নিমতেলে ছোকরা খুব লায়েক। দেহখানিওরা বলে, সরিঙ্গী অর্থাৎ কাঠির মত; কিন্তু মাথা নাকি খুব। মনে রাখতে পারে খুব। পানু মুখে মুখে হিসেব দিলে—খরচ তোমার অনেক। লগদ তিন টাকা বার আনার ওপর দু পয়সা।
এর উপরে আরও খরচ আছে, ঘর থেকে দ্রব্যসামগ্রী দেওয়া হয়েছে, তার দামই বেশি। দুটো পঁঠা, একটা ভেড়া, বারটা হাঁস, দশবার সের চালও দিতে হয়েছে—বায়েন কর্মপ্রকার পুরোহিত মহাশয়দের সিধার জন্য। এ সবের দাম অনেক। সকালবেলা থেকে তিন প্রহর বেলা পর্যন্ত মজুরি খেটে যারা পাঁচ আনা রোজ পায় অর্থাৎ মাসিক ন টাকা ছ আনা মাত্র যাদের আয়, তাদের কাছে অনেক বৈকি! সুতরাং কাহারদের জীবনে এ একটা সমারোহ এবং রোমাঞ্চকরও বটে।
রোমাঞ্চটা আরও প্রবল হয়ে উঠল বাবাঠাকুরের থান পরিষ্কারের সময়। সেয়াকুলের ঝোপ কাটবার সময়, ওই ঝোপগুলির ভিতরের উইঢিপি থেকে বেরিয়ে পড়ল তিন-তিনটে আলকেউটে। কেউটেকে ওরা খুব ভয় করে না। কোপাইয়ের তীরে, জাঙলের মাঠে আল-কেউটের বাস চিরকাল। ওদের সঙ্গেই একরকম বাসই করে কাহারেরা। কেউটেরাও ওদের মধ্যে মধ্যে তাড়া করে, ওরাও কেউটেদের তাড়া করে পাঁচন-লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলে। তবে জাতসাপ নাকি ব্রাহ্মণ, ওদের মেরে তাই সম্মান করে আগুনে ডাহ অর্থাৎ দাহ করে। বাবাঠাকুরের থানে কেউটের কিন্তু অন্য অর্থ হল। বিশেষ করে এই অজগরতুল্য চন্দ্রবোড়াটিকে বাবার বিচিত্রবর্ণ বাহন বলে জানার পর, এই কেউটেগুলিকে তার সঙ্গী-সাথী না ভেবে পারলে না বনওয়ারী। সে বললে-খবরদার! হাত দিয়ো না গায়ে।-বলে নিজেই সে হাত জোড় করে। প্ৰণাম করলে। সাপ তখন মাথা তুলে দাঁড়িয়ে ফোঁসাচ্ছে। মধ্যে মধ্যে মাটিতে ছোবল মারছে। কিন্তু এগিয়ে আসতে তাদেরও সাহস নাই। বেদে জাতের গায়ের গন্ধে সাপ তাদের বেদে বলে। জানতে পারে, ভয় পেয়ে ছুটে পালায়; কাহারদের গায়ের গন্ধে ওরা তেমনিই বোধহয় ভয় পায়, এগিয়ে আসতে চায় না সহজে।
বনওয়ারী সাপদের বললে—যা যা, যা বাবারা, চলে যা। খানিকটা সরে যা। লরে-লাগে অর্থাৎ নরে-নাগে বাস করতে নাই, এখন তোরা সরে যা। তোমাদের প্রভু, আমাদের বাবাঠাকুর, তার পুজোটি সেরে লি, তাপরেতে তোমরা আবার স্বস্থানে পরমেশ্বরী হয়ো না কেনে!
সাপগুলো সরেই গেছে। কাহারেরাও সাবধান হয়ে রইল। কি জানি, হোক না কেন বাবাঠাকুরের বাহনের সঙ্গী-সাথী, তবু ও জাতকে বিশ্বাস নাই।
তবে ওই যে ঢাকের শব্দড্যাডাং-ড্যাডাং, ওতেই ওরা সরে যাবে অনেক দূর। তার উপর ধূপ-ধুনো, অনেক মানুষের আনাগোনা।
নগদ খরচের মধ্যে পুরুত মহাশয় নিলেন আট আনা; কাপড় একখানা সাত হাত-দাম পাঁচ। সিকে জোড়া হিসেবে দশ আনা; পাকী কারণ সওয়া পাঁচ আনা; বাতাসা কদমা মণ্ডা ও অন্যান্য জিনিস,বনওয়ারীরা এক্ষেত্রে জিনিসকে বলে দব্যতার দাম সওয়া পাঁচ আনা; বলিদানের ছেত্তাদার ছ আনা; দেড় গোলা মদ আঠার আনা, এবং ঢাকী নিয়েছে চার আনা, বাকি চার আনায় তেল সিঁদুর ধূপ ধুনো ধুনুচি প্রদীপ ইত্যাদি। ছাগলের দুটো মুড়ির একটা নিয়েছে পুরুত, একটা ছেত্তাদার, ঢাকী নিয়েছে ভেড়ার মাথাটা। কাপড়খানা পুরুত নিয়েছে। সকলেই খুশি হয়ে গিয়েছে, বলে গিয়েছে পুজো নিখুঁত হল মুরুদ্ধি। শুধু একদিন দেরি হয়ে গেল এই যা! শনিবারটা পাওয়া গেল না। তা হোক। পুরুত বললেন—রবিবার অমাবস্যে—খুব ভাল। অমাবস্যে রবিবার, মৎস্য খাবে তিনবার। কত্তা খুশি হয়ে মদ-মাংস খাবেন।
তা বাবাঠাকুর খুশি হয়ে পেসন্ন মনে দু হাত ভরে মদ-মাংসের পুজো নিলেন। বলিদানে একটু খুঁত হল না। তিন প্রহরের সময় বলিদানের ঢাক বাজল–ড্যাং-ডাং-ডাং-ডেনাক–ড্যাডাং-লাগ-ডাং-ড্যাং-ড্যানা–
কাহারদের মাতব্বরেরা তখন বাবার পেসাদী কারণের প্রসাদ নিয়ে ছ—উপোসকরা পেটে অল্প কারণেই বেশ জমিয়ে তুলেছে; মাথা ঝিমঝিম করছে। তারা সব জোড়হাত করে দাঁড়াল। সুচাঁদ রাঙা আঁটির মত চোখ বিস্ফারিত করে চেয়ে চেঁচাতে লাগল,—হে মাহে মা হে মা!
ছেলেরা মুখে বাজনার বোল বলতে লাগল-খা-জিংজিং জিনাক জিজিং লাগ জিং জিং জিনা
বলির সঙ্গেই পূজা শেষ। দেখতে দেখতে বলি হয়ে গেল নিখুঁত বলি। হাঁসগুলোকে কেটে উড়িয়ে দিলে। হাঁসগুলোকে কেটে ধড়টাকে ছুঁড়ে দিলে। তারা খানিকটা উড়ে গিয়ে পড়ল।
পানুর পাঁঠা তো ছিলই, বনওয়ারী নিজে একটা পাঁঠা দিয়েছে। রতন দিয়েছে ভেড়াটা। বনওয়ারী দিলে ওই সাপটিকে মারার অপরাধের জরিমানা করালী করলে পাপ, সে করলে প্ৰায়শ্চিত্ত। না করলে কে করবে? করালীর যা হবে হোক, কিন্তু পাড়ার মঙ্গল, গায়ের মঙ্গল তাকেই দেখতে হবে যে। সমস্ত পাড়ার লোক বনওয়ারীকে এর জন্য প্রাণ খুলে ধন্যবাদ দিয়েছে। রতন ভেড়াটি দিয়েছে নিজের অবাধ্য সন্তানের জন্য লটা করালীর সঙ্গী, সেই হতভাগাই বাশে ঝুলিয়ে ওই অলৌকিক সাপটিকে বয়ে নিয়ে গিয়েছে। সুচাঁদ দিয়েছে একটি হাঁস। নিছক ভক্তির বশবর্তী হয়েই সে দিয়েছে। বসন্তও দুটি হাঁস দিয়েছে, ডাইনে বায়ে বলি দেবার মত দু পাশে দুটো হাড়কাঠ ছিল না—তবু ওই মানসেই সে দুটি হস দিয়েছে। পাখী করালীকে সমর্থন করে। বসন্তের গোপন মানত ছিল একটি হাঁস পাখীর জন্য, অন্যটি করালীর জন্য। একটি পাঠিয়েছে কালোশশী—গোপনে পাঠিয়েছে। এ পুজোয় আটপৌরে-পাড়ার সকলে যোগ দিলেও পরম মাতে নাই এতে। বনওয়ারীর সঙ্গে তার সৌহার্দ্য নাই। বনওয়ারী মাতব্বর হয়ে যা করে, তাতে পরম যোগ দিতে দেয় না আটপৌরেদের। এক্ষেত্রে আটপৌরেরা পরমের কথা মানে নাই। কিন্তু পরম যোগ দেয় নাই। তবে নিজের পাড়ার লোকেরা যখন তার কথা না শুনেও যোগ দিলে, তখন নেহাত পাড়ার মাতব্বরি করতে উপস্থিত হয়েছিল মাত্র। বাকি আটটা হাঁস আর আট ঘর থেকে এসেছে। যার হাঁস ছিল, সে না-দেওয়া হয় নাই। যার নাই, সে কি করবে? কত্তাকে পুজো দিতে সাধ কার না হয়, প্রসাদ পাওয়ার ভাগ্য কে চায় না? সকল বাড়ি থেকেই মণ্ডা বাতাসা পাঁচ পয়সা হিসেবে দিয়েছে। এ ছাড়া মদ। ঘোষ মহাশয় তিন গোলার দাম দিয়েছিলেন, কিন্তু বনওয়ারী দেড় গোলার বেশি কেনে নাই। দেড় গোলা কিনে তারই আবরণে ভেণ্ডরকে ফাঁকি দিয়ে গ্রামেই তারা আরও তিন গোলা মদ নিজেরাই করে নিয়েছে। পুজো হয়ে গেল। এইবার নিশ্চিন্ত। চল সব, চল, বাবাঠাকুরের বাতাসা পেসাদ লাও, জল খাও, রান্নাবান্না কর। জয় বাবাঠাকুর! হে ভগবান, মঙ্গল কর তুমি।
হঠাৎ ভিড় ঠেলে এসে দাঁড়ালে করালী। তার হাতে তিনটে হাঁস। পিছনে নসুবালা আর পাখী।
–মাতব্বর, আমি তিনটে হাঁস বলিদান দোব।
বনওয়ারী দুঃসহ ক্রোধে স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে চেয়ে রইল। এ কি উৎপাত—এ কি বিঘ্ন রাগে তার মুখে কথা ফুটল না, গোটা কাহারপাড়াই স্তব্ধ হয়ে রইল। এগিয়ে এল পানু। সে তার শীর্ণ লম্বা হাতখানা লম্বা করে বাড়িয়ে রাস্তা দেখিয়ে বললে—ভাগো।
—ভাগো?—করালী প্রশ্ন করলে।
–হ্যাঁ। লিয়ে যাও তোমার হাস। তোমার বলি লেয়া হবে না।
–লেয়া হবে না?
–না।
করালী চিৎকার করে উঠল—মাতব্বর!
বনওয়ারী এগিয়ে এল এবার। বললে—চিকার কিসের? চিচ্কার কিসের?
—পানার মুখ ভেঙে দেব আমি। কি বলছে শুনছ?
–কি বলছে?
—আমার হাঁস লেবে না। বলি দিতে দেবে না।
–হ্যাঁ, লেবে না—আমার হুকুম।
—কেনে? লেবে না কেনে?
—না, না। লেবে না। তোমাকে নাকে খত দিতে হবে—
বাধা দিয়ে বলল করালী—নাকে খত দিতে হবে?
–হ্যাঁ। জরিমানা দিতে হবে। সকলের ছামুনে–
—থাক্, থাক্। এই করলে তবে লেবে আমার হাঁস?
–হ্যাঁ।
—নইলে লেবে না?
—না।
করালী আর কোনো কথা না বলে পট-পট করে হাঁস তিনটের মুণ্ড দু হাতে টেনে ছিঁড়ে ফেলে দিয়ে বললে-কত্তা, খাবে তো খাও, না খাবে তো খেয়ো না, যা মন তাই কর। আমাদের হাঁস খাওয়া নিয়ে কথা, আমাদের বলিদান হয়ে গেল।-বলে মুখে বলিদানের বাজনার বোল। আওড়াতে আওড়াতে চলে গেল—খা—জিং জিং-জেনাক পুজো
মুণ্ডগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে হাঁসগুলোকে নিয়ে সে চলে গেল। গোটা পাড়াটা স্তম্ভিত হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
শুধু বনওয়ারী হেঁকে উঠল—যাক, যেতে দাও ওকে। চল সব, বাড়ি চল, জল খাও। একবার বাবাকে ডাক। বলেই সে ডেকে উঠল, বলো, শি-বো–ধর্ম রঞ্জো।
সবাই সমবেত কণ্ঠে হেঁকে উঠল।
ঢাক বাজতে লাগল পুজো শেষের–ড্যাং-ডাং-ডাং-ডাং-ডাং-ডাং-ডাং-ড্যাং ড্যাং—লম্বা করে বাজনা। শেষ হল। পুজো শেষ।
অশুভক্ষুণে করালী, অশুভক্ষণে ওর জন্ম; এমন পুজোটিতে কেমন অস্বস্তি এনে দিলে। দিক। সে ভাববার অবকাশ নাই বনওয়ারীর। পুজো শেষ হলেই কাজ শেষ হল না। অনেক কাজ। মাতব্বরি সহজ নয়। অনেক বিবেচনা করতে হয়। অনেক ভাবতে হয়। প্রসাদ বিলি করতে হবে। মিষ্টির প্রসাদ, বলিদানের প্রসাদ, কারণের প্রসাদ। যেসব লোকের বাড়ি থেকে। হাঁস অথবা অন্য বলি যায় না, তাদের বাড়িতে দেবার জন্য প্রত্যেক বলি থেকে দুটি করে পা। কেটে নিয়ে একত্র করে কুটে তাই ভাগ করে পাঠিয়ে দাও তাদের বাড়ি বাড়ি। নিজের বলিটির আর দুটি পা ছাড়িয়ে ঘোষ মহাশয়ের বাড়ি পাঠাতে হবে। নিজেই সে চলল সে-দুটি নিয়ে। তার আগে নিজের পোশাক-পরিচ্ছদটি সে ভাল করে দেখে নিলে। বাঃ, বেশ হয়েছে। ঠিক আছে। পরনে আজ তার পরিষ্কার একখানি হাঁটু-বহরের কাপড়, তার কেঁচাটি উল্টে নিয়ে কোমরে খুঁজেছে, কাঁধে পরিষ্কার করা গামছাখানি পাট করে ঝুলিয়েছে, কপালে পরেছে সিঁদুরের। ফোঁটা। মাংস পেয়ে ঘোষ খুশি হলেন খুব, একটা সিগারেট দিলেন বনওয়ারীকে। বললেন হ্যাঁ, আজ একটা মণ্ডল মাতব্বর বলে মানাচ্ছে বটে। তা এর সঙ্গে একটা সিগারেট না হলে চলবে কেন?
বনওয়ারী সেটিকে কানে খুঁজে ভক্তিসহকারে প্রণাম করে বাড়ি ফিরল। দু বাটি মদ সে এর আগেই খেয়েছিল। একটু বেশ নির্ভয়-নির্ভয় ঠেকছিল দিন-দুনিয়া; সে বললে—আশীব্বাদ সব আপনকারদের আশীৰ্ব্বাদ। ঘোষ-বাড়ির নক্ষ্মীর এঁটোকাটায় বনওয়ারীর পিতিপুরুষের জেবন। আবেগে কেঁদে ফেললে বনওয়ারী।
সান্ত্বনা দিতে গেলে ফ্যাসাদ বাড়বে—ও অভিজ্ঞতা মেজ ঘোষের স্বােপার্জিত; ধমক দিলেও ওদের মনে বড়ই লাগে তাও অজানা নয়। সুতরাং তিনি সংক্ষেপে বললেন—সে হবে বনওয়ারী, কাল হবে সেসব কথা। ওদিকে তোমার পাড়ায় আজ অনেক কাজ। দেখো, যেন কোনো অঙ্গহীন না হয়।
বনওয়ারীকে এখন বিয়ে করতে পারলেই বাচেন ঘোষ। একে কাহার, তাতে মাতাল হয়েছে, গায়ে দুৰ্গন্ধ উঠছে। কিন্তু মাতাল বনওয়ারীর কথা সহজে শেষ হবে কেন, সে বললে–আজ্ঞে হ্যাঁ। একশো বার। জ্ঞানবানের কথা। তবে বনওয়ারীর জেবন থাকতে সেটি হবেন না। খুন-খারাপি হয়ে যাবে। ওই করালীওই যে হারামজাদা বদমাশ-অক্তের ত্যাজে মেরে ফেলালে দেবতুল্য সপ্যটিকে, ওর আমি কি করি দেখেন। তাড়াবওকে আমি এখান থেকে তাড়াব।
বড় ঘোষ-বউ বললেন—বেশ বেশ, এখন বাড়ি যাও। সন্ধে হয়ে গেল, আজ পুজো দিয়েছ, কত্তার ওখানে আজ একটা পিদিম দিয়ে, ঢাকীটাকে একবার ধুমুল দিতে বোলো যেন। যাও। এখন ব্যবস্থা কর গিয়ে।
বনওয়ারী এবার তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়াল। একটি ব্যবস্থা তার ভুল হয়ে গিয়েছে। ঠিক কথা, ওরা জ্ঞানবান লোক, অনেক বিদ্যা ওঁদের ওদরের মধ্যে আছে, এমন প্রয়োজনীয় কথা। ঠিক ওঁদের মনে পড়বেই তো! সে হাত জোড় করে বললে—আজ্ঞে আমি আজ যাই।
–হ্যাঁ, এসো—এমন ক্ষেত্রে গম্ভীর ভাব রক্ষা করতে মেজ ঘোষ অদ্বিতীয়। অন্য সকলেই অল্প অল্প হাসছিল, কিন্তু ঘোষ একেবারে গম্ভীর, যেন কোনো সম্পত্তি নিলামে ওঠার সম্পর্কে চিন্তান্বিত মুখে আলোচনা করছেন তার ভারপ্রাপ্ত কর্মচারীর সঙ্গে।
বনওয়ারী চলে গেল, খুব দ্রুতপদে হনহন করে চলল। প্রদীপ দিতে হবে, ঢাকীকে বলতে হবে বাবার স্থানে ধুমুল দেওয়ার জন্যে। তার হয়েছে এক মরণ। এই যে মাতব্বরি, এর চেয়ে ঝকমারির কাজ আজ আর কিছু নাই। রাজার দোষে রাজ্য নাশ, মণ্ডলের দোষে গ্রাম নাশ; প্রজার পাপে রাজ্য নষ্ট, গ্রামের পাপে মণ্ডলের মাথায় বজ্ৰপাত। হে ভগবান!
পাড়ায় এসেই হাঁকডাক শুরু করে দিলে, পিদিম—পিদিম চাই একটা। কাঁচা কাপড়ের সলতে দে। ভঁড় ঘেঁকে ত্যাল দে, অনুশালের ত্যাল দিস না যেন।
পানুকে সে পাঠালে বায়েনপাড়া। ধুমুল দিতে হবে।
প্রদীপটি নিয়ে সে দু পা এগিয়ে থমকে দাঁড়াল। বাতাস দিচ্ছে। তার স্ত্রী গোপালীবালা এগিয়ে এসে একটি টোকা অর্থাৎ চুপড়ি হাতে দিলে।
বনওয়ারী বললে—বাঃ! হ্যাঁ, এসব কাজে মেয়েদের বুদ্ধিই খেলে ভাল। ঠিক হয়েছে। প্রদীপটিকে টোকার আড়াল দিয়ে সে চলল। কত্তার থানে যেতে হলে পথে আটপৌরে-পাড়ার উত্তর প্রান্তের কঁকড়া বটগাছতলাটা পার হতে হয়। বড়ই অন্ধকার স্থান। টোকার আড়ালে প্রদীপের আলো ঢেকে গেছে। গাছতলাটা থমথম করছে। হঠাৎ একটা শব্দ শুনে বনওয়ারী থমকে দাঁড়াল। কে ফেসফেঁস করে কাঁদছে যেন?—কে?—কে গা?
গাছতলায় একটা সাদা মূর্তি বসে রয়েছে। এগিয়ে গেল বনওয়ারী।
–কে? প্রদীপটার উপর থেকে টোকাটা সরিয়ে নিয়েই সে চমকে উঠল।কালোবউ? কালোশশী? এ কি? এ কি? হা, সে কালোশশীই বটে! বুকের ভিতর যেন ঢাক বেজে উঠল। অন্ধকারে এই গাছতলায় একা কালোশশী!
মনের দুঃখে ঘর ছেড়ে এসে কালোশশী কাঁদছিল। পরম তাকে বেশ ঘা কতক দিয়েছে। গোপনে সে যে হাঁসবলি পাঠিয়েছিল বনওয়ারীর কাছে, সে কথাটা পরমের কাছে গোপন থাকে নাই। কেউ বলে দেয় নাই, কিন্তু পরম নিজেই ধরে ফেলেছে। কত্তার ওখানে পরম একবার গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, পুজো না দিলেও প্রণাম জানাবার জন্য গিয়েছিল; সেই সময় বলি দেবার জন্য যখন হাঁসটার মাথায় সিঁদুর দিচ্ছিল পুরুত, তখনই তার সন্দেহ হয় হসটা তার বাড়ির হাঁস বলে। কিন্তু সেখানে কোনো গোল করে নাই। বাড়ি এসে হাঁসের হিসেব করে দেখেছে একটি হাঁস কম। অমনি বাক্যব্যয় না করে কালোশশীকে ঘরে পুরে নিষ্ঠুরভাবে প্রহার করেছে এবং এই গোপনে পুজো দেওয়া যে কালোশশীর কর্তার প্রতি ভক্তির জন্য নয়, পুজোর উদ্যোক্তা বনওয়ারীর প্রতি প্রীতির আতিশয্যের নিদর্শন, সেই কথাটা অত্যন্ত কুৎসিত ভঙ্গি করে পরম তাকে বারবার করে বলেছে—আমি কবে মরব তাই জানি না, লইলে সব জানি, সব বুঝি, বুয়েছিস? পরিশেষে কয়েকটা কুৎসিত অশ্লীল সম্বোধনে সম্বোধিতও করেছিল কালোশশীকে। প্রহারের বেদনার জন্যই সে রাগ করেছে, এবং সেই ক্ষোভের মধ্যেই সুযোগ পেয়ে তার অভিমান জেগে। উঠেছে তার অদৃষ্ট এবং বিধাতার উপর। তাই ঘর ছেড়ে গ্রামের বাইরে গাছতলায় বসে সে কাঁদতে এসেছে।
বনওয়ারীর সঙ্গে সে কিন্তু ছলনা করলে। আসল কথা গোপন করলে, বললে—এসেছিলাম কত্তাকে পেনাম করতে। মানত করলাম একটা।
বনওয়ারী বললে—তা কাঁদছিলা কেনে ভাই?
–কাঁদছিলাম মনের বেথায়।
—মনের বেথায়? কেঁদে ফেললে বনওয়ারী। কালোশশীর মনের ব্যথা! সে ব্যথা সঙ্গে সঙ্গে বনওয়ারীর মদ্যসিক্ত নরম মনকে ব্যাকুল করে তুললে।—কি তোমার মনের বেথা ভাই?
—আমার বেথা আমার কাছে ভাই; যাকে বলবার, যার বুঝবার, সেই বুঝবে। বললাম আমার যেন মিত্যু হয়।
কেনভাই? এমন মান কেনে করলে ভাই? কি তোমার বেথা, কি তোমার অভাব আমাকে বলবে না?
—কি হবে বেঁচে? ছেলে নাই, পুলে নাই! সোয়ামি, না, কসাই—
বনওয়ারী তার মাথায় হাত দিয়ে বললে হবে হবে। আমি বলছি, তোমার সন্তান হবে। দেখো তুমি।
হঠাৎ প্রদীপের আলোটা নিবে গেল। চুপড়ির আড়ালের মধ্যে থেকে প্রদীপটার বাইরের বাতাসে নেববার কথা নয়। বাতাস নয়, ফুঁ দিয়ে প্রদীপটা নিবিয়ে দিলে কালেশশী। ব্যাকুলভাবে সে বনওয়ারীর খালি হাতখানি জড়িয়ে ধরলে। কালোশশীর মুখেও মদের বাস উঠছে।
হাঁসুলী বাঁকে বাঁশবনের তলায় পৃথিবীর আদিম কালের অন্ধকার বাসা বেঁধে থাকে। সুযোগ পেলেই দ্রুতগতিতে ধেয়ে ঘনিয়ে আসে সে, অন্ধকার বাঁশবন থেকে বসতির মধ্যে। প্রদীপটা নিবে যেতেই সে অন্ধকার ছুটে এল যেন কোপাইয়ের বুক থেকে হড়পা বানের মত। সেই তমসার মধ্যে মদের নেশায় উত্তেজিত বনওয়ারী এবং কালোশশী বিলুপ্ত হয়ে গেল। এতক্ষণে কালোশশী সব কথা বললে বনওয়ারীকে। বনওয়ার অনেক কাঁদল। তার ব্যথার কথাও সে বললে। তার সন্তান নাই। সে জানে সন্তানহীনতার দুঃখ। এত বড় মাতব্বর সে, দু-দুবিঘে জমি, খানিকটা ঘাসবেড়, এতগুলি গরু, হাল, বলদ, এসব কি হবে? কি দাম এ সবের? কিন্তু আজ আর তার কোনো উপায় নাই। তা ছাড়া আজ এই এমন মুহূর্তে কালোশশীর কাছে সত্য গোপন করবে না; তার স্ত্রীকে সে কখনই কালোশশীর মত ভালবাসে না। কিন্তু কি করবে সে? তাদের মধ্যে সাঙার রেওয়াজ আছে, কিন্তু ওর পক্ষে ঘাড় নাড়লে বনওয়ারী। অন্য কেউ হলে তার পক্ষে সম্ভব ছিল এমন কাজ। সে বনওয়ারী–পাড়ার মাতব্বর।
কালোশশী বললে—আমারই কি আর তাই সাজে ভাই! সেকথা আমি বলি নাই। হঠাৎ কালোশশী চমকে উঠল। বললে—কে যেন গেল! আমি বাড়ি যাই। তুমি যাও, ঠাকুরতলায় পিদিম দিয়ে পাড়ায় যাও।
—দাঁড়াও, পিদিম আবার জ্বেলে আনি।
এইবার কালোশশীই বললে—পিদিম নিয়েছ, ধূপ কই? শুধু পিদিমে সনজে দেওয়া হয় নাকি?
ঠিক কথা। ঠিক বলেছে কালোশশী। কালোশশী যে চন্নপুর ফেরতা মেয়ে, এ কথা কালোশশী ছাড়া আর কে বলতে পারবে?
চন্ননপুরে বাবুদের বাড়িতে কালোশশী অনেকদিন ছোটলোক ঝিয়ের কাজ করেছে। বাবুরা বলে-ছোটলোক ঝি। এদের মেয়েরা এঁটোকাটা আঁস্তাকুড় যোয়, বাসন মাজে, ছেলেপিলের ময়লা কাপড় সাফ করে, দুবেলা খেতে পায়, বছরে দুখানা কাপড়ও মেলে, মাইনে চার আনা থেকে এক টাকা পর্যন্ত যার যেমন বাড়ি, যেমন কাজ। কাহারপাড়ার মেয়েরা জাঙলে সদূগোপদের বাড়িতে ভোরবেলায় গিয়ে কাজ করে বাড়ি ফেরে। চন্ননপুর এখান থেকে অনেকটা দূর, সেখানে যাওয়া চলে না এবং সেখানেও অনেক ছোটজাত আছে, তারাই করে সেখানকার কাজ। কেবল কালোশশীই চন্ননপুরে বড়বাবুদের বাড়ি কাজ করেছে বছর দুয়েক। সেবার একটা ডাকাতির মকদ্দমায় পরমের আড়াই বছর জেল হয়েছিল। সেই সময় কালোশশীকে চন্ননপুরে বড়বাবুদের বাড়িতে কাজ ঠিক করে দিয়েছিল বড়বাবুদের হিন্দুস্থানি বরকন্দাজ ভূপসিং মহাশয়। সেইখানেই থাকত তখন কালোশশী। ভূপসিং মহাশয় তখন কালোশশীর মালিক হয়েছিলেন। ব্যাপারটায় নিন্দা অবশ্যই আছে, নিন্দাও হয়েছিল; কিন্তু নিন্দনীয় কর্মমাত্রই অমার্জনীয় অপরাধ। নয় সমাজে। ওদের সমাজে এটা এমন নিন্দনীয় কর্ম নয়, যার মার্জনা নাই। কারণ ভূপসিং মহাশয় জাতিতে উচ্চবৰ্ণ, ছত্রী, গলায় পৈতে আছে, তা ছাড়া তিনি বাবুদের বরন্দাজ। যাক সে কথা। পরম ফিরে এসে কালোশশীকে ঘরে এনেছে। এসব রীতিনীতি কালোশশী সেখানেই শিখে এসেছে।
বনওয়ারী আবার পাড়ায় ফিরে ধূপ প্রদীপ নিয়ে গেল।
প্রদীপটা কয়েক মুহূর্ত জ্বলেই নিবে গেল বাতাসে।
ধূপটা পুড়তে লাগল, কৰ্তাতলার সরীসৃপসঙ্কুল প্রান্তরের মধ্যে বাতাসের সঙ্গে ঘুরতে লাগল। ওদিকে গ্রামের মধ্যে তখন মাতন লেগেছে, ঢোলক বাজছে, গান চলছে সমবেত কণ্ঠে। আঃ, তবু আজ পাগল কাহার নাই! পাগল কাহার বাঁশবাঁদির গায়েনদার, গান বাধে, গান গায়, সে থাকলে আরও জমত। এত বেশ জমেছে। বয়স্কদের মোটা গলার সঙ্গে ছেলেদের মিহি জোরালো মিঠে গলার সুর; শিঙের সঙ্গে সানাইয়ের মত মিহি মোটা সুরের শিল্পময় বুনন বুনছে। মেয়েরাও মদ খেয়েছে। তাদেরও বসেছে স্বতন্ত্র আসর। সে আসরের মূল গায়েন সুচাঁদ; সে আজ খুব খুশি। কত্তার পুজো হয়ে গিয়েছে, পুজোর মত পুজো, বলিদান, ঢাক, মদ-কোনো খুঁত নেই। পাকী আধ সের দুধ ধরে, এমন বাটির তিন বাটি মদ খেয়েছে সে। সুচাঁদ নাচছে। কখনও, গান গাইছে কখনও কখনও বলছে সেকালের রোমাঞ্চকর গল্প। তাদের আমলের মনে মনে রঙ-ধরাধরির কথা, কে ছিল কার ভালবাসার মানুষউচ্চ হাসি হেসে সেইসব কথা বলে যাচ্ছে। কখনও বলছে, নীলকুঠির আমলের সাহেবদের গল্প, কুঠি উঠে গেলে কাহারদের কষ্টের কথা।
–কাহারপাড়ার সে এক মনন্তরা। আমার মা বলত, বাবার মা বলত, সে এক ভেষণ অবস্থা। হাড়ির ললাট-ডোমের দুৰ্গতি। বান এল, সেই বানে কুঠি ভাসল—তা কাহারপাড়া! কাহারপাড়ায় সাগর জল। সে জলের সোরোত কি! ঘর-দুয়োর পড়ে গেল। গরু-বাছুরছাগল মরে ঢোল হয়ে ফুলে বাঁশবনে আটকে থাকল কতক, কতক ভেসে গেল। লোকেরা গাছে উঠে বসে থাকল চি-পুত্তমা-বুন নিয়ে। মায়ের কোল থেকে কচি ছেলে ঘুমের ঘোরে হাত থেকে খসে টুপুল করে পড়ে গেল বানের জলে। আমাদের বনওয়ারীর এক জেঠা ছিল—বাবার বড় ভাই, সে তখন দু বছরের ছেলেসে পড়ে যেয়েছিল। আরও যেন কার কার ছেলে যেয়েছিল পড়ে। গাছের ডালেই তুকুস করে ঘাড় লটকে মরে গেল পেহ্লাদের কত্তাবাবা! ওই হারামজাদা করালীর কত্তাবাবা ছিল তখন মায়ের প্যাটে। ভর্তি-ভর্তি দশ মাস। গাছের ডালেই পেসব হল ছেলে। তাতেই নাম হল—ষষ্ঠীদাস। গাছটি ছিল ষষ্ঠীগাছ। ডাকত নোকে গেছোষষ্ঠী বলে। ওই হারামজাদা করালী এমন ডাকাবুকো কেন? গেছোষষ্ঠীর ঝড় বলে।
তারপর সে হা-হা করে হাসতে লাগল।
বসন বললে—মরণ, এর আবার হাসি কিসের?
পাখী নেশায়-রঙিন চোখ বিস্ফারিত করে পলকহীন দৃষ্টিতে চেয়ে রয়েছে, বাইরে সে। মজলিসটিকে লক্ষ্য করছে, মনে মনে স্বপ্ন রচনা করছে। ওর কান রয়েছে করালীর বাড়ির আসরের ধ্বনির দিকে। করালীর বাড়িতে করালী আলাদা আসর বসিয়েছে। করালী কাউকে ভয়। করে না, সে কারও কাছে হার মানে না, ঘোষকেই সে আজ প্রণাম করে নাই তো বনওয়ারী: সেই মুণ্ডঘেঁড়া হাঁস তিনটে রান্না হয়েছে। চন্ননপুর থেকে বোতলবন্দি পাকী মদ এসেছে। নসুবালা নাচছে। জমে উঠেছে তাদের আসর। পাখীর মন নাচছে। আষাঢ় মাসে ঘনঘটা করে মেঘ এলে তালচড়ুই যেমন নেচে নেচে ওড়ে, তেমনিভাবে উড়ে যেতে ইচ্ছে করছে। তার মনে রঙের সঙ্গে মদের নেশায় উত্তেজনা যোগ দিয়েছে। সে যাবেই করালীর বাড়ি। এদের মজলিসটা ভাঙলে হয়, কি নেশাটা আরও খানিক জমে উঠলে হয়। ওদিকে সেই ডাকাবুকোর অর্থাৎ করালীর মজলিস ভাঙলে হয়! তার সঙ্কল্প আজ দৃঢ়।
সুচাঁদ গাল দেবেদিক। বনওয়ারী শাসিয়েছে—শাসক। সে মানবে না কারও শাসন। সে ছুটে গিয়ে ঝাপিয়ে পড়বে তার বুকে।
বনওয়ারী আজ পাড়ার মজলিসে বলে দিয়েছে—যদি আপন আপন থাকতে চাও তো সে ভাল কথা; যার যা খুশি কর; কারুর দায় হায় কারুর নাই, কে মরল, কে থাকল দেখাদেখি নাই; বাস্ ভাল কথা; আমি বাঁচি, মাতব্বরি আমি চাই না, করব না। আর তা যদি না হয়, দায়। যদি পুরতে হয় আমাকে, তা হলে আমার কথা মেনে চলতে হবে। ওই করালীর মতন চালচলন-এ চলবে না। কথাটা সে বলবার সময় দু-তিনবার পাখীর দিকে চেয়ে কথা বলেছে। বলুক।
নিমতেলে পানু ওই লিকলিকে চেহারা, ধূর্ত চাউনি-ভরা চোখ ওই দুষ্টটাই সর্বাগ্রে সমর্থন করেছে বনওয়ারীকে। যত নষ্টের মূলে হল ওই। করালীর নামে ওই সাতখানা করে লাগিয়েছে। সেদিন চন্ননপুরে সাপটা নিয়ে যাবার সময় কি সব করালী বলেছিল, তা-ই একটাকে সাতখান করে লাগিয়েছে। ওই নষ্টই তুলেছিল পাখীর কথা।
ফুট কেটে বলেছে—বসন আর পাখীকে শুধাও কথা। তারা তোমার কথা মানবে তো? করালীর উঠানে পাখীর যে ফাদ পাতা আছে। হি-হি কুরে সে হেসেছে।
পাখী পাখা ঝাপটে নখ ঠোঁট মেলে আক্রমণ করত পানুকে, কিন্তু তার আগেই বসন্ত তাকে। থামিয়ে দিয়েছে। পাখীর ওই একটা দুর্বলতা। মাকে সে দুঃখ দিতে পারে না। কি করে দেবে? মা তো তার শুধু মা নয় তার পরানের সখী। এমন মা কারও নাই। পাখী অকপটে বলে সকল কথা তার মাকে। বসন কখনও মেয়েকে তিরস্কার করে না। সে তার চুল বেঁধে মুখ মুছিয়ে দেয়। ঠাট্টা করে বলে ভাল হয়েছে কি না করালীকে শুধাস। এই মায়ের অপমান সে করতে পারে, না তাকে দুঃখ দিতে পারে?
সে জানে, করালীর ঘরে সে গেলে কেউ তাদের কিছু করতে পারবে না। কিন্তু তার মা বসনকে সবাই বিধে মারবে। সেই ভয়েই এতদিন সে কিছু করে নাই। তবে আজ আর নয়। আজই সে যাবে, আজ যেন মন বলছে, যেতেই হবে।
ওঃ! কি আষাঢ়ে এক গল্প ফেঁদেছে দিদি-বুড়ি ওর্থাৎ সুচাঁদ, তার আর শেষ নাই। টুকরো টুকরো করে এই গল্প—এই আঠার বছর বয়সের গোটা জীবনটাই শুনে আসছে পাখী। অরুচি ধরেছে তার ওই গল্পে, বিশেষ করে আজ এই মুহূর্তে।
হা-হা করে হাসছে সুচাঁদসে হাসি আজ রাত্রে আর থামবেই না বোধহয়। করালীর বাবার বাবা বন্যার সময় গাছের উপর জন্মেছিল, সেই নিয়ে বুড়ি হাসছে। তা নিয়ে এত হাসি কিসের? বুড়ি ডাইনি ডাকিনী, করালীকে দুচক্ষে দেখতে পারে না।
সেজন্য কিন্তু হাসে নাই সুচাঁদ। বন্যার দুর্যোগে গাছের ডালে জীবন বাঁচাতে মানুষ যখন বিব্রত, তখনও কিনা কাহার-কাহারনীর মন মাতানো রঙের খেলা! সেই কথা বলতে গিয়ে সুচাঁদ না হেসে পারে! হায় হায় রে! কাহার-কুলের মনে রঙের খলার বিরাম নাই। কি মনই তাদের দিয়েছিল বাবাঠাকুর! বলতে বলতে হাত জোড় করে প্রণাম করে সুচাঁদ। গাছের ডালে বসে মানুষ অনাহারে রয়েছে, শীতে কাঁপছে, হু-হু করে বাদলের বাতাস বইছে, নিচে পাথার বান, কোপাইয়ের বুকে গো-গোঁ করে ডাক উঠেছে, সেই সময়ে কিনা ওই নিমতেলে পানুর ঠাকুরদাদার বাবার তৃতীয় পক্ষের পরিবার রঙ লাগালে আটপৌরেদের পরমের কত্তাবাবার সঙ্গে? ওরা ছিল এক গাছে, এরা ছিল এক গাছে। চোখে চোখে কি খেল হল, কখন হল দুজনার, কে জানে! সেই দুর্যোগে—কেইবা উদিকে মন দেয়। পরমের কত্তাবাবার তখন ছোকরা বয়েস; তার উপর কুটির সাহেবদের আটপৌরে; খাতির যত, হাঁকডাক তত। আর ছুঁড়ীরও তখন অল্প বয়েস, বুড়ো স্বামী ইংলি-বিংলি সতীনপোর কঁক, সে থাকবে কেনে তার ঘরে? এমনিতেই থাকত না। আশ্চর্যের কথা মা, তা দুদিন তর সইল না, ওই গাছের উপর বসেই চোখে চোখে অঙ খেললে! ভোরবেলা সবাই ঢুলছে; শব্দ উঠল—ঝপ। বাস্। কেবল বনওয়ারীর কত্তামাছেলের শোগে ঘুমোয় নাই, সে চেঁচিয়ে উঠল। সবাই জাগল। দেখু দেখৃ কে পড়ল। নিমতেলে বুড়ো কেঁদে উঠলও মাতব্বর, আমার বউ পড়েছে। পড়েছে তো পড়েছে, যে গেল সে যাক। কি করবি বল? আর করবেই বা কি? বুড়ো কাদতে লাগল। ওমা! সকাল হলে লোকে দেখলে, আটপৌরেদের গাছে পরমের কত্তাবাবার ডালে বসে আছে সে মেয়ে।
আবার হাসতে লাগল সুচাঁদ।
রতনের স্ত্রী বললে—তা হলে মজার মনন্তরা বল?
সুচাঁদ এক মুহূর্তে হাসি থামিয়ে মদের নেশায় লাল চোখ বিস্ফারিত করে মুখ তুলে চাইলে, মাঝ উঠানে জ্বলছিল যে কাঠের পাতার ধুনিটা তার ছটা পড়ল মুখে; হাঁড়ির মত বুড়ির মুখখানা কেমন হয়ে উঠেছে যেন। সে বললে—মজা! হা, সে মজা যেন আর কখনও না হয়। মজা হল তাপরেতে। বান নেমে গেল। ভিজে দেয়াল ও আর বাতাস পেয়ে দুড়দাড় করে ধসতে লাগল। গায়ের মাটি ভিজে সপসপ করছে, চার আঙ্গুল করে পলি পড়েছে, দড়াবার থান নাই। গরু মরেছে, বাছুর মরেছে, ছাগল মরেছে, শুয়োর মরেছে, মানুষ মরেছে; চারিদিকে পচা দুগগন্ধ; ধান চাল ভেসে গিয়েছে, কথা-কানি ভিজে ডবডব করছে। কুঠির সায়েবের চাকর বেয়ারারা ছিল, সাহেব মেম মরেছে, কুঠি ভেসে গিয়েছে। কে গুরু, কে গোঁসাই তার ঠিকানা নাই। মুনিব নাই। মুনিব নাই, অক্ষে করবে কে? আগের কালে বান আসত, কাহারপাড়া ড়ুবত, সায়েবরা ছিল—তারা বড় বড় তক্তা বেঁধে ভেলা করে কাহারদের নিয়ে যেত কুঠিবাড়িতে। চাল দিত, ডাল দিত, হুকুম দিত—খিচুড়ি রাধ, খাও। ঘর ভাঙলে ঘরের খরচ দিত, খোরাক দিত। কাহারেরা ছিল পাহাড়ের আড়ালে। ঝড় আসুক, ঝাপটা আসুক, বান। আসুক, কাহারদের ভাবনা ছিল না। আর এবার কাহারদের পিথিমী অন্ধকার হয়ে গেল। সাহেব মল, মেম মল, কুঠি বিকিয়ে গেল। তার ওপর সেবার সে কি ওগ! সে এক মহামারণ। জ্বরজ্বালা, প্যাটের ব্যানো; কে কার মুখে জল দেয়—এমনি হাল। দু-তিন ঘর নিবনেদ হয়ে গেল। তখন সব যে যার পরান নিয়ে পালাতে আরম্ভ করলে। কেউ গেল কুটুমবাড়ি, কেউ গেল ভিখ করতে হেথা-হোথা। বিদেশ-বির্ভুয়ে কতজনা যে মল তার ঠিকানা নাই। তাপর দেশঘাট শুকুল, মা দশভুজার পুজোর সময় যারা বেঁচে ছিল একে একে ফিরল গায়ে। ফিরল যদি তো সে আর এক বেপদ। সে বেপদের কাছে বানের বেপদ কোথা লাগে! সায়েবদের কুঠি উঠে যেয়েছে, বেবাক জমিদারি হকহুকুক কিনেছে চৌধুরী। সেই যে যখের ধন দিয়েছিলেন কত্তা, সেই টাকায় সায়েবদের সবকিছু কিনেছে তখন চৌধুরী। ঘর নাই, দুয়োর নাই, আশ্চয় নাই, চাকরি নাই, কাহারেরা এসে অতান্তরে পড়ল, চোখে পিথিমী অন্ধকার হয়ে গেল। কি হবে? কোথা যাবে? কে চাকরি দেবে?
সায়েবদের আমলে দুখানা পালকি, কুঠিতে চব্বিশ ঘণ্টা হাজির থাকতে হত, ষোলজন বেহারা মোতায়েন থাকত। সায়েবরা ফি বেহারাকে জমি দিয়েছিল দশ বিঘে করে আর বাস্তুভিটে। জমি চাষ কর, খাও দাও, আর সায়েব-মেমকে নিয়ে সাওয়ারী কাঁধে বেড়াও। তার ওপর বশকিশ ছিল, হেথা-হোথা বিয়েশাদির বায়না ছিল। আরও ছিল তোমার নীলের চাষ। তাও সবাই খানিক আধেক দু বিঘে পাঁচ বিঘে করত। তাপরে তোমার সায়েবদের যখন দাঙ্গা হত—এই ধর কোনো ভদ্দশুদুদের জমির ধান ভেঙ্গে নীল বুনতে হত, কি পাকা ধান কেটে নিতে হত তখন কাহারেরা ছিল সায়েব মোয়দের ডান হাত। সায়েবদের লেঠেল যেত। ওই আটপৌরেরাও লেঠেলদের সঙ্গে লাঠি নিয়ে যেত। তারা পাহারা দিত, আর বেহারা-কাহারেরা হাল গরু নিয়ে দিত পোতা জমি ভেঙে, চযেমষে তছনছ করে নীল বুনে দিত, পাকা ধান হলে কেটে-মেটে ছিঁড়ে-খুঁড়ে তুলে নিয়ে চলে আসত বাড়ি। ধান যে যা আনত সে তো পেতই, তার ওপর ছিল লগদ গদ বশকিশ। সে ছিল কাহারদের সোনার আমল। সায়েবরা গেল, কাহারদের কপাল ভাঙল। চোখে অন্ধকার দেখবে না কাহারেরা? আমলই পালটিয়ে গেল। চৌধুরী বেবাক চাকরান জমি খাস করে নিয়েছে এখন। বললে—আমার তো পালকি বইতে হবে না বার মাস, বেহারাদের চব্বিশ ঘণ্টা হাজির থাকতেও হবে না-চাকরান জমি আমি দোব কেনে? কেড়ে নিলে মা জমি। জমি বাড়ি ঘর সব গেল। অন্ধকার, তিভুবন অন্ধকার মা। বুক চাপড়িয়ে কেঁদেছিল কাহারেরা। আমার মা বলত, তখন আমার মা ভরাভরতি সোমত্ত মেয়ে; তার এক বছর পরে আমি প্যাটে হই। মা বলত-কাহারেরা বুক চাপড়িয়ে কেঁদেছিল, সে কান্নায় পুজো-বাড়ির ঢাকের বাদ্যি ঢাকা পড়ে যেয়েছিল। যে প্যাটের জ্বালায় গা ছেড়ে দিয়ে ভিখ মাগতে গিয়েছিল কাহাররা, কুটুমবাড়িতে নেনো হয়েছিল এতদিন মা, সেই প্যাটের জ্বালা পারণ হয়ে গেল। হাঁড়ি চড়ালে না; আন্নাবান্না দূরে থাক, পুজো-বাড়ির পেসাদ–সেও কেউ মাগতে গেল না। তাপরে হল কি মা, শেষকালে নউমী পুজোর দিনে সে এক অবাক কাণ্ড! হঠাৎ চৌধুরী বললে—যা ভিটেগুলো তাদের ছেড়ে দিলাম, ভিটে থেকে তাদের বাস তুলে দোব না, সে বজায় রাখলাম। ওই চাকরানটুকু রইল, কালেকস্মিনে পালকির দরকার হলে বইতে হবে। তবে জমি পাবি না। হ্যাঁ, কৃষাণি মান্দেরী করথা। কাহাররা তবে হপ ছেড়ে বাঁচল। পিতিপুরুষদের ভিটে থাকল মনন্তরায়, এই ভাগ্যি। চৌধুরীকে দু হাত তুলে আশীর্বাদ করে বিজয়া দশমী থেকে ঘর তুলতে লাগল সব পড়ো ভিটেয়। সেও তোমার ওই কত্তামশায়ের দয়া। চৌধুরীকে তিনি স্বপন দিয়ে দিয়েছিলেন অষ্টমীর আতে মানুষকে ভিটেছাড়া করতে নাই। কাহারদিগে তুলে দিলে আমার ওষ হবে তোর ওপর। তাতেই নউমীর দিন সকালে উঠে চৌধুরী ভিটে ছেড়ে দিলে।
থামল সুচাঁদ। সমস্ত মজলিসটা হাঁসুলী বাঁকের উপকথা শুনে অবাক বিস্ময়ে স্তম্ভিতের মত বসে আছে, মদের নেশায় আবেগপ্রবণ মস্তিষ্কে সেকাল ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাথার মধ্যে নেশার স্রোত ছুটছে কোপাইয়ের হরপা বানের মত। সেই বানের উপর কল্পনায় সেকালের নৌকো। ভেসে বেড়াচ্ছে! ভেসে বেড়াচ্ছে চৌধুরী-বাড়িতে ভেসে আসা সেই যক্ষের নৌকোর মত। পঞ্চ-শব্দের বাজনা বাজিয়ে আলো ঝলমল হয়ে যেন ঢেউয়ে ঢেউয়ে নড়ছে। সব ভাম হয়ে বসে আছে। কেউ কেউ ঢুলছে, কার যেন নাক ডাকছে। শব্দ উঠেছে নানা রকমের, হাসি আসে। শুনে।
বসন বড় ঠাণ্ডা প্রকৃতির মেয়ে, সে মদও কম খেয়েছে—মৃদু হেসে রতনের স্ত্রী কুসুমকে বললে—মরণ, নাক ডাকছে কার লো?
কুসুমও চারিদিকে চেয়ে প্রশ্ন করলে—কে লো, কার নাকে শুয়োর ঢুকল বটে? ঘোৰ্ঘোত করছে কে লো?
সুচাঁদ ওদের মুখ নড়া দেখতে পেয়ে মুখটা এগিয়ে এনে প্রশ্ন করলে—অ্যাঁ?
পাখী এবারে উঠে পড়ল বিরক্ত হয়ে। নাঃ, এরা আর ঘুমোবে না। ওদিকে করালীর ঘরেও মজলিসে তেহাই পড়বে না! সে উঠে মাকে বললে আমি শুতে চললাম মা।
–খেয়ে শুবি। আর খানিক বস।
–না।
কুসুম চিমটি কাটলে বসনের পায়ে। কুসুম বসন্তের সখী, সে সবই জানে ভিতরের কথা। বসন্ত একটু হেসে বললে—যা তাই। ঘুমোস না যেন।
সুচাঁদ একটু বিরক্ত হয়ে বললে—কি বলছিস লো? আঁ?
চিৎকার করে বসন্ত বললে—পাখী শুতে চলল। তাই বলি ঘুমোস না যেন।
সুচাঁদ সর্বাঙ্গ দুলিয়ে দু হাত নেড়ে একটা ছড়া কেটে কিছু বলতে যাচ্ছিল, কিন্তু সেই মুহূর্তেই একটা জোর হক জেগে উঠল কোথা থেকে। হাঁসুলী বাঁকের অন্ধকার চমকে উঠে সতর্ক হল; ওঃ, চৌকিদার হাক দিচ্ছে। সুচাঁদও চমকে উঠেছিল—পাখীকে কথাটা তার বলা হল না, তার বদলে বিস্মিত হয়ে বললেও মা গো! থানাদার হাক দিচ্ছে? ইয়ের মধ্যে? বলি হা বসন, ট্যান পল পেরিয়ে গেল কখন? কই বাদ্যির মত শব্দ তো ওঠে নাই?
সত্যই ট্রেন যাওয়ার শব্দ এখনও ওঠে নাই।
পাখী যেতে যেতে থমকে দাঁড়িয়ে বলে গেল মদ খেয়ে মেতে আনন্দের আর সীমে নাই। আজ অবিবার মনে আছে? আজ সেই ভোরবেলাতে গাড়ি।
তাই বটে, সে কথা কারও খেয়াল নাই। রবিবার সন্ধ্যায় ট্রেন যায় না, যায় ভোররাত্রে।
–কি?
–আজ অবিবার।
হ্যাঁ, মনে পড়ল সুচাঁদের। পরক্ষণেই ভুরু কুঁচকে বললে—তা শ্যাল ডেকেছে পহরের? শুনেছিল?
–কই, না। যে গল্প তুমি বলছিলে!
ঠিক এই সময়েই খানিকটা দূরে শোনা গেল কার খুব গম্ভীর গলার আওয়াজ-পরম! পরম! পরম আটপৌরে! সঙ্গে সঙ্গে একটা জোরালো টর্চের আলো লম্বা ফালিতে আটপৌরে-পাড়ার অন্ধকার চিরে ফেললে। সকলে আশ্বস্ত হল। না, রাত্রি বেশি হয় নাই। থানার বাবুরা কেউ এসেছে। দাগ দেখতে। মধ্যে মধ্যে সপ্তাহে এক দিন করে আসে থানার বাবুরা। এরা ওই সকালে সকালেই আসে। পরম আটপৌরে দাগী। এই জাঙলে সদৃপোপ-বাড়িতে ডাকাতি হয়েছিল কয়েক বছর আগে। পরম ডাকাতির দলে অবশ্য ছিল না, কিন্তু শুলুক-সন্ধান সে-ই দিয়েছিল। মালও বেরিয়েছিল তার ঘরে। জেল হয়েছিল পরমের। পরম দাগী আসামি।
সকলেই ভাল হয়ে বসল। পুরুষদের মজলিসে গান বাজনা গোলমাল সংযত হল। করালীর বাড়ির মজলিসের বাজনা একেবারে থেমে গেল। থানার বাবু, এ পাড়া পানেও আসবে একবার। আটপৌরে-পাড়ায় এলে এ পাড়াও ঘুরে যায়। এ পাড়ায় দাগী এখন কেউ নাই, কিন্তু এককালে ছিল। এককালে কাহারপাড়ার সকলেই দাগী ছিল বললেই সত্য কথা বলা হবে। সে কারণেও বটে, তা ছাড়া—অজ্ঞান জাত, কার কখন মতিভ্ৰম হয় কে বলতে পারে? তাই বোধহয় বাবুরা দেখে যান। বনওয়ারী বলে—এঁরা যে আসেন, তাতে আমি খুশি। নিজের চোখে দেখে যান। আমাদের রীতকরণ, আর আমাদের মধ্যে যারা মনে মনেও চুলবুল করে তারাও জ্ঞান পাক, সতর হোক, মনকে সামাল দিক।
এই যে করালীর মত বেহেট-বেতরিবৎ ছোকরা, এদের শাসন কি শুধু মাতব্বর থেকে হয়? বনওয়ারী ঠিক করে রেখেছে আজ বলবে—দারোগা হোক, ছোট দারোগা হোক, যে আসবে তাকেই বলবে করালীর কথা। রতনকে সে বললে—তোর সেই বড় কুকুড়েটা ঠ্যাঙে বেঁধে নিয়ে আয় দি-নি।
বাবুরা যেদিন আসেন, সেইদিন কুকুড়ে অর্থাৎ মুরগি আর হসকিছু না হলে কয়েকটা ডিম কাহারেরা ভেট দিয়ে থাকে। আজ বড় মুরগি একটা দিতে হবে ঠিক করলে বনওয়ারী। রতন একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে উঠে গেল। উপায় নাই, মাতব্বরের কথা, তা ছাড়া তার ছেলে লটা লচ্ছার করালীর দলে জুটেছে। লটা শাসনের বাইরে; বাপের সঙ্গে ভিন্নই হয়েছে তো শাসন! কিন্তু তবু তো তার বাপের পরান? কি জানি, কখন কুদৃষ্টিতে পড়বে বাবুদের! আগে থেকে একটু বলে রাখা ভাল।
বনওয়ারী হাঁকলে—শিগগির কর। বাবু আসছে।
নীলের বাঁধের উত্তর-পশ্চিম কোণ বরাবর আলোর ছটা উঠে হেঁড়ে তালগাছটার মাথায় গিয়ে পড়েছে। দুটো পাঁচা ছটা পেয়ে কাঁচ কাঁচ শব্দ করে উড়ে গেল। বাবু মাঠ থেকে পাড়ের উপর উঠছেন। জুতোর শব্দ বাজছে পাষাণের মত কঠিন মাটিতে। এইবার সামনাসামনি আসছে টর্চের আলো। বাবু এসে পড়েছেন।
বাবু এসে দাঁড়ালেন। প্রণাম করলে সব। নিমতেলে পানু ছুটে গিয়ে একটা মোড়া নিয়ে এল। বাবু বসেন না ওটাতে, পা দিয়ে দাঁড়ান। বাবু হেসে বললেন—কি রে, আজ যে খুব ধুম দেখি!
নতির স্বীকৃতি জানিয়ে বনওয়ারী একটু কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে মুখের সামনে বা হাতের আড়াল দিয়ে জবাব দিলে—পাছে মুখের আব অথবা গন্ধ গিয়ে লাগে তাই সতর্কতা; বললে–আজ্ঞেন হুজুর, আজ কত্তার থানে পুজো দিলাম কিনা।
বাবু বললেন-আচ্ছা ভাল।
রতন বড় মুরগিটা এনে নামিয়ে দিলে সামনে। টর্চের আলোটা সেটার উপর ফেলে বাবু খুশি হয়ে বললেন—বেশ বড় জাতের যে রে, আঁ?
–আজ্ঞেন হা। আজ কত্তার পুজো দিলাম; আপনাকে কি আর যা-তা দব্য দিতে পারি?
—বেশ, বেশ। তা তোদের মধ্যে করালী কার নাম?
মনে মনে বিস্মিত হল সকলে। বনওয়ারী চকিতে অনুভব করলে বাবাঠাকুরের অদ্ভুত মাহাত্ম্য। ওঃ! এরই মধ্যে করালীর বীতি-চরিত্রের কথা দারোগাকে তিনি জানিয়েছেন। মনে মনে বাবাকে প্রণাম করে বনওয়ারী বললে আজ্ঞে হা, ছেড়াটা বড়ই আজ্ঞেনবেজায় আজ্ঞেন—
করালীকে অভিযুক্ত করার মত বিশেষণ খুঁজে পেলে না বনওয়ারী।
কিন্তু দারোগা বললেন উল্টো কথা—হা, বাহাদুর ছোকরা। ছোকরাকে পাঠিয়ে দিবি থানায়। বকশিশ পাবে কিছু। গোটা পাঁচেক টাকা পাবে।
–বকশিশ পাবে?
–হ্যাঁ। আমরা শিসের কথা ডায়েরি করেছিলাম, ওপরেও গিয়েছিল খবর। এখন যখন। সাপটাই শিস দিচ্ছিল, আর সেই সাপ ওই ছোকরা মেরেছে—সে খবরও পাঠিয়েছি। পাঁচ টাকা। বকশিশ ও পাবে।
বাবু চলে গেলেন। মুরগিটা নিয়ে গেল চৌকিদার।
কাহারপাড়াটা বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেল। তাদের বিস্মিত মনের দৃষ্টির সামনে করালী যেন নতুন মূর্তিতে দাঁড়িয়ে আসছে। গোলালো বুক ফুলে উঠেছে, গালে টোল খেয়েছে, সুন্দর মিষ্টি হাসিতে সুন্দর সাদা দাঁতগুলি ঝিকমিক করছে।
মেয়েদের মজলিসে হঠাৎ গোল উঠল।
করালীর বকশিশের ব্যাপার নিয়ে কথা হচ্ছিল, হঠাৎ তাদের সুমুখ দিয়ে কে ছুটে পালিয়ে গেল।
হাতের চুড়ি বিনরিন শব্দে বেজে উঠল।
—কে? কে?
–পাখী! পাখী! একজন জবাব দিলে—পাখী ছুটে চলে গেল।
–পাখী! পাখী! ও পাখী!—বসন্ত ডাকলে তারস্বরে।
পাখী শুতে যাবার জন্য উঠছিল, এই সময়েই এলেন ছোট দারোগা। সে দরজার মুখে ঢুকছিল, ছোট দারোগা করালীর নাম করতেই থমকে দাঁড়াল। ব্যাপারটা শুনে সেও অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ, তারপর হঠাৎ দাওয়া থেকে লাফিয়ে নেমে মজলিসকে পাশ কাটিয়ে অন্ধকারের মধ্য দিয়ে সাদা কাপড়ের দোলায় বাতাসে খানিকটা ঝলক তুলে ছুটে বেরিয়ে গেল।
বসন্ত ডাকতে ডাকতে বেরিয়ে এল-পাখী শোন! পাখী!
দূর অন্ধকারের ভিতর থেকে জবাব এল-না। আমি চললাম।
পাখী বললে—যার ওপর আমার মন পড়েছে, আমি তারই ঘরে চললাম।
হাঁসুলী বাঁকের উপকথায় তুফান বানে ঝাপ খেয়ে যুবতী বউ পালায় যার উপরে মন পড়ে তার কাছে, তার গাছের উপরে তার পাতা সংসারেই গিয়ে উঠে বসে। পাখীর মা বসন্ত যৌবনে নিত্য রাত্রে বেশভূষা করে একাই চলে যেত চৌধুরীবাবুদের গায়ের ধারের বাগানে, কোনোদিন ফিরত গভীর রাত্রে, কোনোদিন ভোরবেলা। পাখীও আজ চলে গেল ছুটে করালীর বাড়ি।
এরপর আসছে একটা কুৎসিত ঝগড়ার পালা। তারপর হয়ত লাঠি-মারপিট মাথা ফাটাফাটি! করালী তো হটবার পাত্র নয়!
ঝগড়ার পালাটা জমিয়ে তুললে সুচাঁদ। কর্কশ কণ্ঠে উচ্চকণ্ঠে সে গালিগালাজ আরম্ভ করলে। করালীর নিজের মা বোন কি কোনো স্ত্রীলোক আত্মীয়া নাই। কিন্তু নদিদি আছে। নসুদিদি এতক্ষণ নাচছিল, পায়ে নূপুর বেঁধেই সে বেরিয়ে এল ঝগড়া করতে। মেয়েদের মত কোমরে কাপড় জড়িয়ে দুই হাতের বুড়ো আঙুল নেড়ে অঙ্গ দুলিয়ে সুচাঁদের সঙ্গে সমান। জোরালো ভাষায় ঝগড়া জুড়ে দিলে।
সকলেই উত্তেজিত হয়ে উঠেছিল। বিশেষ করে নিমতেলে পানু। হঠাৎ সকলে চমকে উঠল। একটা কঙ্কালসার মানুষ টলতে টলতে এসে দাঁড়িয়েছে মজলিসের সামনে। এখনও টলছে। কে? কে?—ও, নয়ান এসেছে। হেঁপো রোগী নয়ান। ওই নয়ানের সঙ্গেই ছেলেবেলায় পাখীর বিয়ে হয়েছিল। তখন অবশ্য নয়ান হাঁপানির রোগী ছিল না, এবং নয়ান তখন ছিল পাড়ার মধ্যে সবচেয়ে ভাল পাত্ৰ। নয়ানের ঠাকুরদাদা ছিল সে আমলে কাহারপাড়ার মাতব্বর। সেই আমল থেকেই চৌধুরী-বাড়ির ভাগজোতদার নয়ানেরা। দু বিঘা নিজের জমিও আছে নয়ানের। সেইসব দেখেই বিয়ে দিয়েছিল সুচাঁদ। হঠাৎ নিউমোনিয়া হয়ে নয়ান ঘায়েল হয়ে গেল প্রথম যৌবনেই। সারল, কিন্তু পানি ধরে গেল। পাখী বলে—যে গন্ধ ওর নিশেষে আর যে বুকের ডাক! সে সহ্য করতে পারে না, তার ভয় লাগে। সে কিছুতেই যাবে না ওর বাড়ি। আজ দু বৎসর ধরেই এই বিরহের পালা চলছে, কিন্তু আজও পর্যন্ত পূর্ণ বিচ্ছেদ হয় নাই। আজ হয়ে গেল। মৃতপ্রায় নয়ান এমন ক্ষেত্রে না বেরিয়ে পারলে না। টলতে টলতে এসে বসে পড়ল, তারপর হাঁপাতে হাঁপাতে মাটিতে চাপড় মেরে বনওয়ারীকে বললে—তুমি এর বিচার কর। বিচার কর তুমি।
কিন্তু বনওয়ারী বসে রইল মাটির পুতুলের মত। সে যেন কেমন হয়ে গিয়েছে। করালী এবং পাখীর ঘটনায় তার বার বার মনে পড়ছে সন্ধ্যার কথা; মনে পড়ছে কালোশশীকে। সে উৎসাহ পাচ্ছে না। সে যেন মাথা তুলতে পারছে না।
নয়ান কান্নায় চিৎকার করে উঠল—মাতব্বর।
বনওয়ারী হতভষের মত বললে—কি বলব?
রতন বললে–না না। এ ভারি অল্যায়। তুমি চুপ করে থাকলে হবে না বনওয়ারী। গাঁ-সুদ্ধ ছেলে মাটি হল ওই হারামজাদার সঙ্গে জুটে।
বনওয়ারী তবু স্তব্ধ।
ওদিকে হঠাৎ মেয়েদের ঝগড়ার আসরের সুর পালটে গেল। অকস্মাৎ সুচাঁদ আৰ্তনাদ করে উঠল—মর্মান্তিক আর্তনাদ। কি হল? নসু মারলে নাকি ধরে? প্রহ্লাদ, রতন, নিমতেলে পানু ছুটে গেল। কি হল?
সুচাঁদ আৰ্তনাদ করে লাফাচ্ছে। মুখে একটা ভয়ার্ত শব্দ শুধু। চোখের দৃষ্টিতে বিভীষিকার ছায়া। সে যেন মৃত্যুকে দেখছে চোখের সম্মুখে।
বুঝতে বাকি রইল না কারও কিছু।
ব্যাঙ দেখেছে সুচাঁদ। ব্যাঙকে সুচাঁদ মৃত্যুদূতের মত ভয় করে। ব্যাপারটা ঘটেছে এই–
সুচাঁদ প্রচণ্ড চিৎকারে গালিগালাজ করছিল। করালী হঠাৎ এসে শাসিয়ে তাকে বলে—চুপ কর, নইলে দেব ছেড়ে।
অর্থাৎ ব্যাঙ ছেড়ে দেবে।
সুচাঁদ মানে নাই সে কথা। ব্যাঙ যে কেউ তার গায়ে ছেড়ে দিতে পারে—এ তার ধারণার অতীত ছিল। চন্ননপুরে বাবুদের ছেলেরা কখনও কখনও এমন ঠাট্টা করে। কিন্তু এ গায়ে এমন সাহসই বা কার, এমন হৃদয়হীনই বা কে? কেরালীর যে সেই সাহস সেই হৃদয়হীনতা আছে, তা সে জানত না। কিন্তু করালী সত্যিই একটা ব্যাঙ ধরে এনেছিল। সুচাঁদ ক্ষান্ত হল না দেখে, সেটাকে সে তার উপর ছুঁড়ে দিয়ে নসকে টেনে নিয়ে বাড়ি চলে গিয়েছে।
পাখী খিলখিল করে হাসছে করালীর বাড়িতে।
এদিকে বসন্ত দুই হাতে জাপটে ধরেছে মাকে। সুচাঁদ তবু লাফাচ্ছে। মেয়েরা সব মুখে কাপড় দিয়ে হাসছে। প্রহ্লাদ ব্যাঙটা ফেলে দিয়ে এক বাটি মদ এনে সুচাঁদের মুখের কাছে ধরলেখাও পিসি। চোখ বন্ধ করে তৃষ্ণার্তের মত পান করে নিলে সুচাঁদ, তারপর বুকে হাত দিয়ে প্রহ্লাদের কোলের মধ্যেই নিজেকে এলিয়ে দিল।—আঃ আঃ! তারপর হাউহাউ করে কেঁদে উঠল।
প্ৰহ্লাদ বললে—ভয় নাই, ফেলে দিয়েছি, ফেলে দিয়েছি ব্যাঙ।
ওদিকে করালী পাখীকে নিয়ে তখন বেরিয়ে পড়েছে বাঁশবাঁদি থেকে। এই রাত্রির অন্ধকারেই তারা যাবে চন্ননপুরে। নদিদিও চলল। বনওয়ারীর সঙ্গে বিবাদ করে কাহারপাড়ার সকলকে বিরোধী করে থাকতে তার সাহস হল না।
দূরে রেললাইনের উপর সিগ্নালের লাল আলো জ্বলছে। ওই চন্ননপুর। করালীর দুর্গ ওইখানে। ওখানে যেতে কাহারদের সাহস নাই। নসুবালা হঠাৎ গান ধরলে। করালী ধমক দিয়ে বললে—চুপ কর। সে ভাবতে ভাবতে চলছে, কেমন করে এর শোধ তুলবে সে। শোধ তাকে তুলতেই হবে।
ওদিকে বনওয়ারী ভয়ঙ্কর মূর্তিতে করালীর বাড়িতে এসে দেখলে, করালী নেই—বাড়ি খাঁ খাঁ করছে।