২৮. রাখাল সিং

রাখাল সিং, কেষ্ট সিং ফিরিল প্রায় অপরাহ্রে। তাহারা দুই জনেই শুধু ফিরিয়া আসিল, সঙ্গে প্রজাদের কেহ ছিল না। শিবনাথ বুঝিল, প্রজারা আসে নাই। সম্পত্তি রক্ষার জন্য কাঁদিয়া অনুরোধ জানাইতে যাহারা আসিয়াছিল, টাকা দিবার সময় তারা পর্যন্ত আসে নাই। কী করিবে। তাহারা, পাইবে কোথায়? কী হইল, এ সংবাদ জিজ্ঞাসা করিতে শিবনাথের সাহস হইল না; সংবাদ জানাই আছে, তবু প্রত্যক্ষভাবে সে সংবাদ শুনিতে যেন তাহার ভয় হইতেছিল। সে অন্য দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া নীরবে বসিয়া রহিল।

রাখাল সিং একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, প্রজাদের কাছে কোনে আশাই নেই বাবু, মানে—দেখাই করলে না কেউ।

কেষ্ট সিং বলিল, দেখা যে এক বেটারও পেলাম না নায়েবলবু, নইলে দেখতাম সব কেমন হাজির না হয়।

রাখাল সিং বলিলেন, তাদেরও তো ইজ্জতের ভয় আছে কেষ্ট। মানে—ভয়ে তারা দেখা করলে না।

শিবনাথ এতক্ষণে বলিল, প্রজাদের তা হলে দেখাই পান নি?

না, খবর পেতেই সব লুকিয়ে পড়ল। সামান্যক্ষণ নীরব থাকিয়া রাখাল সিং আবার বলিলেন, অবিশ্যি লুকিয়ে পড়া ভুল, মানে—এর পরে তো আছে। তবে আজ এক হিসেবে তারা। ভালই করেছে, মানেদেখা হলেই ধরুন, দুটো কড়া কথা শুনত; কেউ জবাবই যদি করত, তা হলে আবার আমাদের জেদও চাপত।

শিবনাথ বলিল, তা হলে তো দেখছি নিরুপায়। একটা গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া সে নীরব হইল। তাহার দীর্ঘনিশ্বাসটা প্রচণ্ডভাবে আঘাত করিল রাখাল সিংকে। তিনি মাথা হেঁট করিয়া মাটির দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিলেন, চোখ হইতে ফোঁটা ফোঁটা জল টপ টপ করিয়া মাটিতে ঝরিয়া পড়িতে আরম্ভ করিল। কেষ্ট একলা থামের গায়ে মুখ লুকাইয়া দাঁড়াইয়া ছিল, তাহার দীর্ঘ দেহখানা লইয়া সে যেন ওই থামের সঙ্গে মিশিয়া যাইতে চায়। এই সময়ে অন্য একটি গ্রাম হইতে গোমস্তা কুড়ারাম, চাকর সতীশ ও মাহিন্দার দুই জন ফিরিয়া আসিল। কুড়ারাম বলিল, নাঃ, একটি পয়সার ভরসা নেই বাবু।

এ কথায় কেহ কোনো জবাব দিল না, ওই একটি কথার পর পূর্বের মতই সকলে নিরুত্তর হইয়া বসিয়া রহিল। সে স্তব্ধতা ভঙ্গ করিল নিত্য-ঝি; সে বলিল, এই যে নায়েববাবু, মিশ্রি মাশায়, সতীশ, সবাই এসে বসে আছেন। বেশ মানুষ মাশায় আপনারা, বলি, আর খাবেন কখন গো?

অন্য কেহ এ কথার জবাব দিল না, জবাব দিল সতীশ, সে বলিল, হুঁ, তা খেতে হবে বৈকি, তা নায়েববাবু, গোমস্তা মাশায় এরা না গেলে আমরা যাই কী করে?

রাখাল সিং বলিলেন, এ অবেলায় আমি আর খাব না নিত্য, একেবারে—

বাধা দিয়া নিত্য বলিল, অবেলা তো বটে, কিন্তু বউদিদি যে এখনও খান নি গো!

কেন?

কেনে আবার কী গো! ছেলেমানুষ হলেও তিনি তো বাড়ির গিনি; বললেন এতগুনো নোক খায় নি, আমি কী করে খাব? রতন-দিদিও খান নি, আমিও না। কেবল দাদাবাবু, তাও সে নামমাত্র খেতে বসা।

কেষ্ট সিং তাড়াতাড়ি আপনার জামা পাগড়ি খুলিয়া ফেলিয়া বলিল, দেখ দেখি বউদিদির কাণ্ড! এ কষ্ট করবার তার কী দরকার? হুঁ!

নিত্য বলিল, আর বোলো না বাপু, কচি বউ, তার সাধ্যি এই সংসার চালানো? সারা হয়ে গেল বেচারি; কাল একবার বমি করেছেন, আজ একবার করেছেন।

শিবনাথ বিস্মিত হইয়া প্রশ্ন করিল, কই, আমি তো কিছু শুনি নি?

নিত্য বলিল, আপনি পাগলের মত ঘুরছেন, এর মধ্যে আর আপনাকে সে কথা বলে কী করব? নিত্য এ বাড়িতে উপোস, আজ এ পালন, কাল ও পর্ব; পিত্তি পড়ছে, অম্বল হচ্ছে, তার আর বলব কী বলুন?

নিত্যর কথা শেষ হইতেই সতীশ বলিল, তা হলে উঠুন নায়েববাবু, তেলটেল দেন গায়ে। বউদিদি বসে আছেন, খান নি এখনও।

নায়েব বলিলেন, চল নিত্য, আমরা এই গেলাম বলে।

নিত্য চলিয়া গেল। রাখাল সিং অত্যন্ত সঙ্কোচভরে বলিলেন, একটা কথা বলব বাবু, মনে কিছু করবেন না। মানে-সম্পত্তি আপনার মানেই বউমায়ের, আবার বউমায়ের টাকা সেও

আপনারই–

বাধা দিয়া শিবনাথ বলিল, মানে সংসারে অনেক রকমই হয় সিংমশায়, কিন্তু সব মানে সব ক্ষেত্রে খাটে না। সে হয় না, সে হবে না। আর সে যে একটা দারুণ লজ্জার কথা, ছিঃ, ও কথা ছেড়ে দিন।

রাখাল সিং একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া তেল মাখিতে বসিলেন। কুড়ারাম মিশ্ৰ এবার সঙ্কোচভরে বলিল, কিন্তু একটা উপায়ও তো করতে হবে। সম্পত্তি তো এভাবে ছেড়ে দেওয়া যায় না।

শিবনাথ অনেকক্ষণ চিন্তা করিয়া বলিল, আপনারা স্নান করে খেয়ে নিন, সন্ধ্যার পর আমি নিজে একবার প্রজাদের কাছে যাব। দেখি, কিছু হয় কি না।

রাখাল সিং বলিলেন, কিছু টাকা হলেও আপনাকে নিয়ে কালেক্টর সাহেবের কাছে দাঁড়িয়ে নাবালক বলে সময় করে নেব আমি।

শিবনাথ বলিল, চলুন, একবার নিজে গিয়ে দেখব, প্রজারা কী বলে।

কেষ্ট সিং দুই হাতে আপনার মাথা সজোরে চাপিয়া ধরিয়া বলিয়া উঠিল, না না না। সে হবে না দাদাবাবু।

শিবনাথ তাহার দিকে চাহিয়া দেখিল, সে কাঁদিতেছে। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া ম্লান হাসি হাসিয়া শিবনাথ বলিল, কাঁদছ কেন কেষ্ট সিংহ সময়ে মানুষকে সবই করতে হয়।

কেষ্ট সিং এবার হাউমাউ করিয়া কাঁদিয়া উঠিল, আপনি যাবেন বাবু প্রজাদের কাছে ভিক্ষে চাইতে?

শিবনাথ বলিল, জোর-জুলুম করে টাকা আদায় করার চেয়ে মিষ্টি কথায় নিজে হাত পেতে টাকা আদায় অনেক ভাল কে সিং। ওকে ভিক্ষে করা বলে না।

 

সন্ধ্যা হইতে আর বিশেষ বিলম্ব ছিল না।

শিবনাথ একটা অপেক্ষাকৃত নিৰ্জন রাস্তা ধরিয়া গ্রাম হইতে বাহির হইয়া মাঠে আসিয়া পড়িল। সদর রাস্তা দিয়া কিছুতেই তাহাকে আসিতে দেওয়া হয় নাই, রাখাল সিং ও কেষ্ট সিং ঘোর আপত্তি তুলিয়াছিল।

তৃণচিহ্নহীন ধূলিধূসর মাঠ, যতদূর দৃষ্টি যায় ধু-ধু করিতেছে। শিবনাথের পিছনে রাখাল সিং ও কেষ্ট সিং মাথা হেঁট করিয়া চলিতেছিল; শিবনাথের এই যাওয়াটাকে কিছুতেই তাহারা সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে নাই। লজ্জায় যেন তাহাদের মাথা কাটা যাইতেছে। রাখাল সিং সবই বোঝেন, কিন্তু সমস্ত বুঝিয়াও তিনি স্বচ্ছন্দে মাথা তুলিতে পারিতেছেন না। প্রজারা চারি আনা করিয়া দিলেও তো দুই শত আড়াই শত টাকা হইবে। কিছুদূর আসিয়া শিবনাথ দেখিল, মাঠের মধ্যে এক পুকুরের পাশে একটা জনতা জমিয়া আছে। কেষ্ট সিং থমকিয়া দাঁড়াইয়া বলিল, একটু ঘুরে চলুন বাবু।

শিবনাথ ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া প্রশ্ন করিল, কেন?

অনেক লোক রয়েছে, ওই দেখুন।

কেন, কী হয়েছে ওখানে?

বাবুরা পুকুর কাটাচ্ছেন।

বাঃ, একটা ভাল কাজ হচ্ছে।

আজ্ঞে হ্যাঁ; একটু ঘুরে চলুন।

কেন, ঘুরে যাবার দরকার কী?

আজ্ঞে, ওরা দেখবে, কথাটা জানাজানি হবে বাবু।

হাসিয়া শিবনাথ বলিল, হোক। এগুলো মিথ্যে লজ্জা কেষ্ট সিং।

রাখাল সিং মৃদুস্বরে বলিলেন, মানে—একটু ঘুরে গেলেই বা ক্ষতি কী বাবু?

শিবনাথ দৃঢ়স্বরে বলিল, প্রয়োজন নেই সিংমশায়; আসুন, এতে কোনো লজ্জা আমি দেখছি। না। গ্রামে গ্রামে তো আমি অনেক ঘুরে বেড়িয়েছি।

আজ্ঞে বাবু, সে এক আর এ এক। সে যেতেন আপনি তাদের বাঁচাতে, আর রাখাল সিং কথাটা শেষ করিতে পারিলেন না, তাহার মুখে যেন বাঁধিয়া গেল। কয়জন মজুর এই দিকেই আসিতেছিল, তাহারা শিবনাথকে দেখিয়া লজ্জায় মাথা হেঁট করিয়া দ্রুতপদে স্থানটা অতিক্রম করিয়া চলিয়া গেল। শিবনাথ তবুও তাহাদের চিনিতে পারি, ইহারা এই গ্রামেরই চাষী-গৃহস্থ। মধ্যে মধ্যে নিজেদের শক্তিতে না কুলাইলে ইহারা মজুর খাটাইয়া আসিয়াছে। নিজেরা কখনও জনমজুর খাটে নাই। শিবনাথ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। আর একদল মজুর তাহাদের পিছনে আসিয়া পড়িয়াছিল; তাহাদের কয়টা কথা কানে আসিয়া পৌঁছিল। একজন বলিতেছিল, সারাদিন খেটে মোটে ছয়টা পয়সা, এক সের চাল হবে না, কী যে করব!

আর একজন বলিল, মজাতে আছে বাবুরা, খেছে-দেছে, জামা ফট-ফুটিয়ে বেড়াইছে। গাঁ ড়ুবলে একটু জল—আমরা বানে ড়ুবে মলাম, ওরা ডাঙায় দাঁড়িয়ে বান দেখছে।

কেষ্ট সিং ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিল, সে ফিরিয়া দাঁড়াইল। শিবনাথ কঠিন দৃষ্টিতে তাহাকে তিরস্কার করিয়া নিরস্ত করিল, বলিল, চুপ করে থাক। ওসব শোনে না, শুনতে নেই।

কিছুদূর আসিয়া দেখিল, একটা বটগাছের তলায় কয়েকটি সাঁওতালদের উলঙ্গ ছেলে কী কুড়াইয়া কুড়াইয়া খাইতেছে। শিবনাথ লক্ষ্য করিল, খাইতেছে তাহারা বটের ফল। উপরের দিকে চাহিয়া দেখিল, গুটি-দুয়েক সাঁওতালের মেয়ে গাছে চড়িয়া বটফল সংগ্রহ করিতেছে।

কেষ্ট বলিল, আজকাল সাঁওতালেরা বট-বিচি খেতে আরম্ভ করেছে। পাকুড়-বিচি মায় পাকুড়-পাতা খেয়ে সব শেষ হয়ে গেল। ওই দেখুন কেনে! অদূরেই একটা প্ৰকাণ্ড গাছ পত্ৰহীন শাখাপ্রশাখা মেলিয়া কঙ্কালের মত দাঁড়াইয়া ছিল, কেষ্ট আঙুল দেখাইয়া সেই দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করিল।

শিবনাথ থমকিয়া দাঁড়াইল। সত্যই প্রায় নিঃশেষ করিয়া অশ্বথগাছটার পাতাগুলা খাইয়া ফেলিয়াছে, একেবারে মাথার উপরে কয়েকটি হালকা সরু ডালের মাথায় দুই-চারিটা পাতা গরম বাতাসে থরথর করিয়া কাঁপিতেছে। মানুষের ওখানে ওঠা চলে না।

রাখাল সিং বলিলেন, একটু বসবেন? অনেকটা পথ–

শিবনাথ বলিল, না, চলুন। চলিতে চলিতেই সে দেখিতেছিল, মাঠের মধ্যে গত বৎসরের ধানের গোড়ার চিহ্ন পর্যন্ত নাই, ঘাস নাই, জল নাই। যতদূর দৃষ্টি চলে মাঠ যেন ধু-ধু করিতেছে, মাটির বুক ফাটলে ভরিয়া উঠিয়াছে, অসংখ্য ফাটল। ফাটলে ফাটলে পৃথিবীর বুকের চেহারা হইয়াছে ঠিক সবুজ-সারাংশ নিঃশেষিত জীর্ণ তনুসার পাতার মত। সম্মুখেই একটা প্রশস্ত দীর্ঘ ফাটল, সেটা পার হইতে শিবনাথ অনুভব করিল, ফাটলের ভিতরটা গরম বাষ্পের মত উত্তপ্ত বাতাসে ভরিয়া উঠিয়াছে; ধীরে ধীরে সে উত্তপ্ত বাতাস বিকিরিত হইতেছে জ্বরোত্তপ্তের উষ্ণ নিশ্বাসের মত।

 

গন্তব্য গ্রামখানি বেশি দূর নয়; দূরত্ব দুই মাইপের কমই, বেশি হইবে না। সন্ধ্যার মুখেই তাহারা গ্রামের প্রান্তে আসিয়া পৌঁছিল। অদূরেই গ্রাম, তবুও কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না, অস্বাভাবিক একটা স্তব্ধতায় সমস্ত যেন মুহ্যমান হইয়া রহিয়াছে। কিছুদূর আসিয়া একটা অন্ধকার নিস্তব্ধ পল্লীর মধ্যে প্রবেশ করিয়া শিবনাথ বলিল, লোকজনের তো কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না।

কেষ্ট সিং বলিল, আজ্ঞে এটা বাউরিপাড়া।

সে জানি। কিন্তু বাউরিরা সব গেল কোথায়?

পেটের জ্বালায় সব পালিয়েছে বাবু। কোথাকার কলে সব খাটতে গিয়েছে।

শিবনাথ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া অগ্রসর হইল। বাউরিপাড়ার পর খানিকটা পতিত জায়গার ব্যবধান পার হইয়া সদূগোপপল্লীতে আসিয়া তাহারা প্রবেশ করিল।

আকাশে চাঁদ উঠিয়াছে, কিন্তু গাছের ছায়ায় পল্লীপথের উপর জ্যোৎস্না ফুটিতে পায় নাই; অন্ধকার পল্লীপথ জনহীন, নিস্তব্ধ। পথের দুই পাশে চাষী-গৃহস্থের বাড়ি, কিন্তু বাড়িগুলিও প্রায় অন্ধকার, কোথাও কোথাও এক-আধটা কেরোসিনের ডিবার আলোর ক্ষীণ শিখার আভাস পাওয়া যায় মাত্র; দুই-একটা বাড়িতে দুই-চারিটা কথা বা ছেলের কান্না জল-বুদুদের মত অকস্মাৎ পরপর কতকগুলি উঠিয়া আবার স্তব্ধ হইয়া যাইতেছে। মধ্যে মধ্যে দুই-একটা কুকুর একআধবার চিৎকার করিয়া ভয়ে আশপাশের গলির মধ্যে ছুটিয়া পলাইতেছিল। একখানি বাড়ির সম্মুখে আসিয়া কেষ্ট সিং হাক দিল, মোড়ল, বড় মোড়ল!

উত্তর আসিল, কে?

আমি কেষ্ট সিং; জলদি একবার বেরিয়ে এস দেখি-জলদি! দেরি কোরো না।

বড় মোড়লের নাম পঞ্চানন মণ্ডল, সে এ গ্রামের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি, জমিদারের পুণ্যাহ-পাত্র, সম্পত্তিবান গৃহস্থ, সম্মানিত ব্যক্তি। প্রৌঢ় পঞ্চানন বাহিরে আসিয়া শিবনাথকে সম্মুখে দেখিয়া স্তম্ভিত হইয়া গেল। সসম্ভ্ৰমে প্ৰণাম করিয়া সে সবিস্ময়ে সশঙ্ক ভঙ্গিতে বলিল, বাবু, হুজুর, আপনি—এমন পায়ে হেঁটে—এই সন্ধ্যাবেলা! সে যেন মনের শত প্রশ্নকে ভাষায় প্রকাশ করিতে পারিতেছিল না।

শিবনাথও একটু বিচলিত হইয়া পড়িল, যে উদ্দেশ্য লইয়া সে এমনভাবে এতদূর আসিয়াছে, সেকথা প্রকাশ করিবার সময় লজ্জায় কণ্ঠস্বর যেন রুদ্ধ হইয়া গেল। কঠিন চেষ্টায় আত্মসংবরণ করিয়া কিছুক্ষণ পরে সে বলিল, তোমাদের কাছেই এসেছি পঞ্চানন। তোমরা আমার কাছে গিয়েছিলে, আমার জমিদারি বজায় রাখবার জন্য তোমরা বলে এসেছ। আমি বলতে এলাম, তোমাদের সেকথা রাখবার ক্ষমতা আমার হচ্ছে না। তোমরাও যদি কিছু কিছু সাহায্য কর, তবেই তোমাদের জমিদারবাড়ি থাকবে, নইলে এই শেষ।

প্রৌঢ় পঞ্চানন কাঁদিয়া ফেলিল। চোখ মুছিয়া শিবনাথকে বসিবার আসন দিয়া সে নীরবে নতশিরে বসিয়া রহিল। শিবনাথও নীরব। রাখাল সিং কে সিংও নীরব। সে নীরবতার মধ্যে একটা লজ্জার পীড়ন প্রত্যেকেই অনুভব করিতেছিল। কেষ্ট সিং হাঁপাইয়া উঠিল, সে-ই প্রথম এ নীরবতা ভঙ্গ করিয়া বলিল, মোড়ল!

পঞ্চানন নীরবেই বসিয়া রহিল, উত্তর সে খুঁজিয়া পাইল না। কেষ্ট সিংয়ের অনুসরণ করিয়া এবার নায়েব বলিলেন, পঞ্চানন।

পঞ্চানন এবার যেন একটা সঙ্কল্প লইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল, কাহাকেও কোনো কিছু না বলিয়া সে বাড়ির ভিতর চলিয়া গেল। কেষ্ট সিং এবার হাসিয়া বলিল, মি লইলে কি মাড়ন হয়। নায়েববাবু? এইবার দেখুন, বেরোয় কি না!

শিবনাথ নীরব হইয়া বসিয়া রহিল। তাহার মনের মধ্যে একটা কঠিন দ্বন্দ্ব জাগিয়া উঠিয়াছিল, এখানে এমন সঙ্কল্প লইয়া আসার জন্য বারবার সে আপনাকে তিরস্কার করিতেছিল, ইহার মধ্যে নির্জলা স্বার্থপরতা ভিন্ন আর কিছু সে দেখিতে পায় না। মনে হইল, ওই বৃদ্ধ চাষীর এই দীর্ঘ জীবনে তাহাকে এমন কঠিনভাবে পীড়ন কেহ কখনও করে নাই। এই সমস্তের জন্য যে দায়ী একমাত্র গৌরীই। গৌরী যদি তাহার জীবনের অংশভাগিনী না হই তবে নিঃসঙ্কোচে এই সম্পত্তি সম্পদ আজ সে ছাড়িয়া দিত; গৌরী যদি হাসিমুখে দারিদ্র্যের ভাগ লইতে চাহিত, তবে সে এই সম্পত্তি পাপ বলিয়া পরিত্যাগ করিত।

পঞ্চানন ফিরিয়া আসিল। শিবনাথের সম্মুখে সে কয়েকখানি সোনার গহনা নামাইয়া দিয়া নায়েবকে সম্বোধন করিয়া বলিল, এই নিয়ে যান, এ ছাড়া আমার আর কিছু নাই।

শিবনাথ সবিস্ময়ে বলিল, এ যে গয়না পঞ্চানন।

আজ্ঞে হ্যাঁ। আর কোনো উপায় আমার নাই। এই বছরই বউমাকে নতুন নিয়ে এসেছি ঘরে। তাই এ কখানা আর নিতে পারি নাই লজ্জায়। অন্য সকলের যা কিছু সবই পেটে ভরেছি। হুজুর।

ফোঁটা দুয়েক জল শিবনাথের চোখ হইতে ঝরিয়া পড়িল। সে বলিল, না পঞ্চানন, ও তুমি নিয়ে যাও।

হাতজোড় করিয়া পঞ্চানন বলিল, হুজুর, ভগবান মুখ তুলে চাইলে আপনার আশীর্বাদে আবার হবে আমার বউমার গয়না। আমার কাছে যা পাওনা আপনার, তা এতেও শোধ হবে না। হুজুর। পঞ্চানন বিনয় করিল না, সত্য সত্যই গহনা করখানি নামে গহনা হইলেও মূল্য তাহার পঞ্চাশ ষাট টাকার বেশি হইবে না।

শিবনাথ উঠিয়া দাঁড়াইল, দৃঢ়স্বরে বলিল, সে হোক পঞ্চানন, ও আমি নিতে পারব না। বউমাকে গয়না তুমি ফিরিয়ে দিও। চলুন সিংমশায়, চল কে সিং। সে পঞ্চাননের ঘরের দাওয়া হইতে পথের উপর নামিয়া পড়িল। রাখাল সিং, কেষ্ট সিং শত ইচ্ছা সত্ত্বেও প্রভুর এ দৃঢ়তার সম্মুখে ক্ষীণ প্রতিবাদ করিতেও সাহস করিল না। পঞ্চানন স্তব্ধ হইয়া গহনা কয়খানির সম্মুখে। পশুর মত বসিয়া রহিল।

গ্রাম ত্যাগ করিয়া আবার নির্জন প্রান্তরের উপর দিয়া তিন জনে ফিরিতেছিল। চিন্তায় নতশির নিস্তব্ধ তিনটি মূর্তি, চন্দ্রালোকে প্রতিফলিত তিনটি ছায়া তির্যকভাবে মাটির উপর সঙ্গে সঙ্গে চলিয়াছে। প্রাণস্পন্দন ভিন্ন ছায়ায় ও কায়ায় কোনো প্ৰভেদ নাই। সহসা মনে হইল, পিছন হইতে কে যেন কাহাকে ডাকিতেছে।

কেষ্ট সিং স্থির হইয়া পঁড়াইয়া বলিল, পেছুতে কে হাঁকছে মনে হচ্ছে। তিন জনেই স্থির হইয়া পাঁড়াইল। হ্যাঁ, সত্যই কে কাহাকে ডাকিতেছে। কেষ্ট সিং উচ্চকণ্ঠে হাঁকিয়া প্রশ্ন করিল, কে?

অস্পষ্ট সাড়ায় যেন ভাসিয়া আসিল, আমি পঞ্চানন।

কেষ্ট আবার হাঁকিয়া, কে?

এবার পিছনের কণ্ঠস্বর স্পষ্ট হইয়া উঠিল, এবার স্পষ্ট সাড়া আসিল, আমি পঞ্চানন। অল্পক্ষণ পরেই পঞ্চানন হাঁপাইতে হাঁপাইতে আসিয়া উপস্থিত হইল। শিবনাথ সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিল, কী পঞ্চানন?

পঞ্চানন মাথা তুলিল না, বরং আরও একটু ঘেঁট করিয়া একখানি মুষ্টিবদ্ধ হাত প্রসারিত করিয়া বলিল, হুজুর, আপনি পায়ের ধুলো দিলেন, আর শুধু শুধু; দয়া করে এই সামান্য পাঁচ টাকাও ভরাতে পারলাম না হুজুর, সমস্ত গা ঝেটিয়ে দু পয়সা চার পয়সা করে আপনার নজর–

অসম্বন্ধ অসমাপ্ত কথা, কিন্তু শিবনাথ বুঝিল অনেক। সে আর দ্বিধা করিল না, পঞ্চাননের হাত হইতে পয়সা, আনি, দুয়ানির মুঠি আপন হাতে তুলিয়া লইল।

 

এই যাওয়ার কথাটা শিবনাথ বাড়িতে বলিয়া না গেলেও কথাটা গোপন ছিল না। শুনিয়া গৌরীর সর্বাঙ্গ যেত শাণিত দীপ্তিতে ঝলকাইয়া উঠিল। নগণ্য চাষী-প্রজার কাছে স্বয়ং গিয়া খাজনা দিতে বলাটা তার কাছে ভিক্ষা করা ছাড়া আর কিছু মনে হইল না। সে মনে মনে ছি। ছি করিয়া সারা হইল, শিবনাথের এই উদ্ভু-প্রবৃত্তিতে তাহার প্রতি ঘৃণায় তাহার অন্তরটা ভরিয়া উঠিল। সঙ্গে সঙ্গে রাগেও সে হইয়া উঠিল প্রখর। ওই নগণ্য তুচ্ছ চাষী-প্রজার চেয়েও সে হেয়, তাহাদের চেয়েও সে শিবনাথের পর? কই, একবারও তো মিষ্ট কথায় অনুনয় করিয়া সে তাহাকে বলিল না, গৌরী, এ বিপদে তুমি মুখ তুলিয়া না চাহিলে যে আর উপায় নাই। ঘূণায় ক্রোধে জর্জর হইয়া গৌরী নীরবে শিবনাথের প্রতীক্ষায় বসিয়া ছিল। শিবনাথ ফিরিতেই সে বলিল, হাগা, তুমি নাকি প্রজাদের কাছে ভিক্ষে চাইতে গিয়েছিলে?

মুহূর্তে শিবনাথের মস্তিষ্ক উত্তপ্ত হইয়া উঠিল, সে কঠিনভাবেই জবাব দিল, হ্যাঁ।

বাঁকানো ছুরির মত ঠোঁট বাঁকাইয়া হাসিয়া গৌরী বলিল, কত টাকা নিয়ে এলে, দাও, আমি আঁচল পেতে বসে আছি।

শিবনাথ রূঢ় দৃষ্টিতে গৌরীর দিকে চাহিয়া রহিল, এ কথার কোনো জবাব ছিল না।

উত্তর না পাইয়া গৌরী আবার বলিল, কী ভাবছ? হাজার দরুনে টাকা এ শাড়ির অ্যাঁচলে মানাবে না, নাকি? বল তো বেনারসী শাড়িখানাই না হয় পরি।

শিবনাথ এবার বলিল, শাড়ির কথা ভাবছি না গৌরী, ভাবছি তোমার পুণ্যের কথা। যে ধন আমি এনেছি, সে ধন গ্রহণ করবার মত পুণ্যবল তোমার এখনও হয় নি। হলে দিতাম।

গৌরী বলিল, কেন, তোমার পুণ্যের অদ্ধেক তো আমার পাবার কথা গো; তবে কুলুবে না। কেন শুনি?

পাবার কথাও বটে, আমি দিতে চেয়েছি, কিন্তু তুমি নিতে পারলে কই গৌরী? সে হলে তোমায় বলতে হত না, আমি এসেই তোমাকে সব ঢেলে দিতাম।

গৌরী এবার জ্বলিয়া উঠিল, অন্তরের জ্বালায় উপরের ভদ্রতার আবরণটুকুও খসাইয়া দিয়া সে নির্মমভাবে বলিয়া উঠিল, ছি ছি, তুমি এত হীন হয়েছে, ছি! আমি যে ছি ছি করে মরে। গেলাম!

শিবনাথ আর সহ্য করতে পারিতেছিল না, সেও এ কথার উত্তরে নির্মমভাবেই গৌরীকে আঘাত করিত, কিন্তু নায়েব রাখাল সিংয়ের আকস্মিক আবির্ভাবে সেটুকু আর ঘটিতে পারিল না। রাখাল সিং ব্যস্ত হইয়া আসিয়া বলিলেন, সদর থেকে সায়েব-সুবো, উকিল-মোক্তার সব দুর্ভিক্ষের জন্যে ভিক্ষে করতে এসেছেন। আমাদের কাছারির দোরে এসে দাঁড়িয়েছেন, শিগগির আসুন।

অন্দর হইতে কাছারি-বাড়ি যাইবার অর্ধপথে আসিয়াই শিবনাথ অনুভব কলিল, মূল্যবান। সিগারেটের ধোঁয়ার গন্ধে বায়ুস্তর যেন মোহময় হইয়া উঠিয়াছে। কাছারিতে আসিয়া দেখিল, গোটা বাড়িটাই উজ্জ্বল আলোয় আলোময় হইয়া গিয়াছে। একটা লোকের মাথায় একটা পেট্রোম্যাক্স আলো জ্বলিতেছে, তাহার পিছনে ভিক্ষার্থী বিশিষ্ট ব্যক্তির দল। ভিক্ষার কাপড়টার এক প্রান্ত ধরিয়াছেন জেলার উচ্চপদস্থ এক রাজকর্মচারী, অন্য প্রান্ত ধরিয়াছেন জেলার এক লক্ষপতি ধনী; তাঁহাদের পশ্চাতে উকিল মোক্তার ও অন্যান্য সরকারি কর্মচারীর দল। হাতে হাতে প্রায় দশ-বারটা সিগারেট হইতে ধোঁয়ার কুণ্ডলী পাক খাইয়া খাইয়া বাতাসে মিশিয়া যাইতেছে।

পঞ্চাননকে মনে মনে শত শত ধন্যবাদ দিয়া শিবনাথ সেই পয়সা, আনি, দুয়ানির মুষ্টি ভিক্ষাপাত্রে ঢালিয়া দিয়া বাড়ি ফিরিল। গভীর চিন্তায় আচ্ছনের মত সে বাড়িতে প্রবেশ করিল। কিন্তু গৌরীর তীক্ষ্ণ কঠোর কণ্ঠস্বরে তাহার সে চিন্তার একাগ্ৰতা ভাঙিয়া গেল। গৌরী নিত্যকে বলিতেছিল, খবরদার, ওকে আর বাড়ি ঢুকতে দিবি না। বলছি, বসে খা, তা না, অ্যাঁচলে বেঁধে নিয়ে যাবে, যুগিয়ে রাখবে। নিত্যি দুবেলা ওকে আচার দিতে হবে।

শিবনাথ দেখিল, ওদিকের দুয়ারে দাঁড়াইয়া সেই খোনা মেয়েটা। মেয়েটা আবার মুড়ি ও আচার চাহিতে আসিয়াছে! ধমক খাইয়াও মেয়েটা কিন্তু নড়িল না, তেমনিভাবেই দাঁড়াইয়া রহিল, না লইয়া সে এক পা নড়িবে না। মধ্যে মধ্যে আপনার দাবিটা সে মনে পড়াইয়া দিতেছিল, এঁই এঁতটুকুন আঁঙুলের উঁগায় কঁরে দাঁও ঠাঁকরুন। এঁকটুঁকুন।

শিবনাথ উপরে উঠিয়া গেল। কোনো উপায় আর নাই। পৈতৃক সম্পত্তি চলিয়াই যাইবে।


© 2024 পুরনো বই