১৭. মাসখানেক পর

মাসখানেক পর। জ্যৈষ্ঠের প্রথম সপ্তাহ পার হইয়া যায়, প্রকৃতি সুস্থির হইয়াছে।

কালবৈশাখীর ঝড়ের মত যে বিপর্যয়টা গ্রামখানির উপর আসিয়া পড়িয়ছিল, সে বিপর্যয় শান্ত হইয়াছে। মহামারী থামিয়াছে। তাহার ওপর উপর্যুপরি কয়েকদিন ঝড়-বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে, বর্ষণস্নিগ্ধ প্রকৃতির রূপেও পরিবর্তন হইয়াছে, রৌদ্রের উত্তাপে আর সে আগুনের জ্বালার মত জ্বালা নাই, দাহ নাই, প্রান্তরে প্রান্তরে পথে পথ আর সে ধুলার ঘূর্ণি ওঠে না, ধূসর মরুভূমির মত ধরিত্রীবক্ষে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তৃণাঙ্কুর দেখা দিয়াছে, দূর হইতে সমস্ত মাঠটা এখন সবুজ বলিয়া মনে হয়, কাছে গেলে সে রঙ মায়ার মত মিলাইয়া যায়, শুধু সদ্যোপাত তৃণাঙ্কুরগুলি বিচ্ছিন্নভাবে ঝিকমিক করে। হাল-বলদ লইয়া চাষীরা মাঠে পড়িয়াছে, আউশ ধানের বীজ ফেলার সময়, আর যে নিশ্বাস ফেলিবার সময় নাই।

রাখাল সিং বীজধানের হিসাব করিতেছিলেন। কেষ্ট সিং বাড়ির কৃষাণদের শাসন আরম্ভ। করিয়াছে, বলি, জমি ক কাঠা চরেছ, সারই বা ক গাড়ি ফেলেছ যে, একেবারে এসে খাবার। ধানের জন্যে রাঘব বোয়ালের মত হাঁ করে দাঁড়ালে?

কৃষাণদের মুখপাত্র বাহারুদ্দিন শেখ বলিল, তা বলতে পার সিংজী, ই কথা তুমি বলতে পার। তবে ইটাও তো ভালা সমঝ করতে হবে যে, দ্যাশের হালটা কী গেল! ইয়ার মধ্যে কামকাজ কি করা যায়, সিটা তুমিই ভাল বল।

অন্য একজন বলিল, আর বাপু, আজ সব মুখে হাসি দেখা দিয়েছে, কথা ফুটেছে; এতদিন বলে হাত-পা সব প্যাটের ভিতর সেঁদালছিল। ছেলেন আমাদের বাবু, আহা-হ্যাঁ, আল্লার দোয়ায় বাবু আমার আমির-বাদশা হবেন, বাবু ছেলেন তাই বাঁচলাম, চাষ-আবাদ করবার লাগি আবার এসে দাঁড়ালাম। তুমি বল কী সিংজী, তার ঠিকেনা নাই!

রাখাল সিং বলিলেন, তা হলে তিরিশ বিঘে জমির আউশের বীজ তোমার এক বিশই বার করে দাও। আর তোমরা শোন বাপু, এখন জানাচ্ছি, পাঁচ টিনের বেশি খোরাকি ধান দিতে পারব না। হুকুম নেই, যেতে হয় যাও পিসিমার কাছে।

শিবনাথ নিতান্ত অন্যমনস্কভাবে শ্ৰান্ত অলস পদক্ষেপে কাছারিতে প্রবেশ করিল। সুশীল ও পূর্ণ চলিয়া গিয়াছে। শিবনাথ এখন একা পড়িয়াছে। এই কঠিন এবং অবিশ্রাম পরিশ্রমের ফলে তাহার শরীর অল্প শীর্ণ হইয়া গিয়াছে, অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ বলিয়া ভ্ৰম হয়; মাথার চুলগুলিও কাটিবার অবসর হয় নাই, পারিপাট্য ও প্রসাধন-যত্নের অভাবে চুলগুলি অবিন্যস্ত রুক্ষ, মৃদু বাতাসে সেগুলি অল্প অল্প কাঁপিতেছিল, চোখের দৃষ্টি চিন্তাপ্রবণ।

শিবনাথকে দেখিয়াই বাহারুদ্দিন ও অপর কৃষাণগণ সসম্ভ্ৰমে উঠিয়া সেলাম করিল। বাহারুদ্দিন বলিল, হুজুর রইছেন, আমাদের হুজুরের কাছে আমরা দরবার করছি। আমরা কি বাল-বাচ্চা নিয়ে না খেয়ে মরব নাকি? হুকুম দিয়ে দ্যান হুজুর, না হলে আমরা যাব কোথা?

শিবনাথের চিন্তায় বাধা পড়িল, সে ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া জিজ্ঞাসুনেত্ৰে বোধ করি সকলের দিকেই চাহিল। বাহারুদ্দিন আড়ম্বর করিয়া আর একটা বক্তৃতা ভজিবার উপক্রম করিতেছিল, কিন্তু রাখাল সিং বলিলেন, থাম হে বাপু তুমি। ওসব হুজুর, দয়াল, মা-বাপ বলে আমড়াগাছি করতে হবে না তোমাকে।

শিবনাথের বিরক্তিব্যঞ্জক ভ্রূকুটি কৌতুকে প্ৰসন্ন হইয়া উঠিল, সে হাসিয়া বলিল, হুজুর, দয়াল, তারপর দরবার, এগুলো তো বাহারুদ্দিন ভাল কথাই বলেছে সিংমশায়, যাকে আপনাদের এস্টেটে বলে—আদব-কায়দাদোরস্ত কথা। কিন্তু ব্যাপারটা কী?

রাখাল সিং বলিলেন, কথাটা ভালই বটে, কিন্তু মতলবটি যে খারাপ। আপিন কাজ হাসিলের জন্যে, স্বার্থের জন্যে ওসব হুজুর, দয়াল, দরবার, এ তো ভাল নয়।

কিন্তু সংসারে বড়লোকমাত্রেই তো গরিবলোকের কাজ হাসিল আর স্বার্থের জন্যেই কেবল হুজুর আর দয়াল সেজে বসে আছে। কাজের দায় না থাকলে আর কে কাকে হুজুর বলে, বলুন? তারপর হল কী আপনাদের?

রাখাল সিং এ মন্তব্যে মনে মনে বিরক্ত হইয়া উঠিলেন ও আলোচনাটা হন্ধ করিয়া দিয়াই কাজের কথা উপস্থাপিত করিলেন। এখনও এবার মাঠে চাষের কাজকর্ম একেবারে কিছু হয় নাই। বলিলেই চলে, মাঠে এক গাড়ি সার পর্যন্ত ফেলা হয় নাই; বৃষ্টির পর এই সবে কাজকর্মের প্রারম্ভ, এখন হইতেই কৃষাণের দল অত্যন্ত বেশি পরিমাণে ধান ধার চাহিতেছে। সম্মুখে এখন সমগ্র বর্ষাটাই পড়িয়া আছে, সমস্ত বর্ষাভোর তাহাদের খাদ্যের ধান ধার দিতে হইবে, কৃষাণ ছাড়া ভাগজোতদার আছে, অভাবী প্রজা আছে, সকলকেই রক্ষা করিতে হইবে। সুতরাং কৃষাণদের দাবির পরিমাণ ধান তো দেওয়া হইতেই পারে না, এমনকি তাঁহাদের মতে এখন ধান দেওয়াই উচিত নয়। কৃষাণেরা চাষের কাজ আরম্ভ করুক, কাজ দেখিয়া পরে ধান দেওয়া যাইবে। শেষে রাখাল সিং বলিলেন, তবে যদি দানছত্র খুলে দেন, সে আলাদা কথা।

বাহারুদ্দিন সঙ্গে সঙ্গে এক সেলাম করিয়া বলিল, হুজুরের আমার অভাব কী? দানছত্রই কি খুলতে হুজুর আমার পারেন না? এই যে হুজুর দিলেন খেতে এই সব বাউরি-ডোম-মুচিদের, আল্লার দরবার তাকাত চলে গেল খবর, লেখা হল সিখানেএই বছরই দেখবেন, আল্লা ক্ষ্যাতে কী ফসলটা ফলিয়ে দ্যান।

শিবনাথ বলিল, না না বাহারুদ্দিন, খেতে একা আমি দিয়েছি—এ কথা তোমাকে কে বললে? গ্রামের সকলেই দিয়েছেন আপন আপন সাধ্যমত। এ কথা তোমরা যেন আর বোলো না। তোমরা আমাদের বাড়ির লোক, তোমাদের মুখে এ কথা শুনলে লোকে দোষ দেবে আমাকেই।

আজ্ঞে না হুজুর, এমন অন্যায় কথা বলব কেনে, বলুন? দিয়েছেন বৈকি যার যার যেমন সাধ্যি, তবে হুজুর, মি লইলে তো মাড়ন হয় না, মাথা লইলে কাজ হয় না, আপনি হলেন সেই মাথা, সেই মি।

যাকগে। এখন তোমরা ধান চাচ্ছ, তা একটু কমসম করেই নাও না। পরে আবার নেবে। যখন তোমাদের দরকার হবে, পাবে। এ তো তোমরা ভিক্ষে নিচ্ছ না, ধার নিচ্ছ; ফসল হলে আবার শোধ দেবে।

আগাম হুজুর, আগাম আপনকার ধানটি শোধ করব, তবে আমরা ঘরে লিয়ে যাব। শোধ। দিয়ে ফেরত না পাই, হাত-পা ধুয়ে ঘর যাব হুজুর।

তা হলে তাই দিন নায়েববাবু, যা দিতে চাচ্ছেন আর কিছু বেশি দিন, একটা মাঝামাঝি করে দিন, ওরাও তো আমাদেরই মুখ চেয়ে আছে, অভাব হলে ওরা আর যাবে কোথায় বলুন?

অ্যাই! হুজুরের চাষ-কাম করছি, দোসরা কার দুয়ারে আমরা হাত পাততে যাব, বলেন?

শিবনাথ আর কথা না বাড়াইয়া শ্রীপুরের ঘাটের দিকের বারান্দায় আসিয়া একখানা ডেকচেয়ার টানিয়া লইয়া বসিল। এদিকটা অপেক্ষাকৃত নির্জন, সম্মুখেই কাজল-কালো জলভরা পুকুরটির ধারে ধারে শালুক ও রক্তকমলের জলজ-লতা, ফুল ফুটিয়াছে, পানাড়ির পাতলা পাতার ঘন দলের মধ্যে অসংখ্য ছোট ছোট সাদা ফুল আকাশভরা তারার মত ফুটিয়া আছে, মাঝে মাঝে কলমিলতার বেগুনি রঙের ফুল দুই-চারিটাও দেখা যায়। জলের ধারে বাতাসও অপেক্ষাকৃত স্নিগ্ধ।

তাহার জীবনে যেন অবসাদ আসিয়াছে, এই মাসখানেকের প্রবল উত্তেজনাময় কর্মসমারোহের পর কেমন যেন নীরব শান্ত হইয়া গিয়াছে শিবনাথ। সুশীল ও পূর্ণ চলিয়া গিয়াছে, কিন্তু সাহচর্যের এমন একটা আস্বাদ তাহারা দিয়া গিয়াছে যে, আর তাহার এখানকার বন্ধুদের সাহচর্য তেমন মধুর এবং রুচিকর মনে হয় না। সে বসিয়া বসিয়া কৰ্মমুখর দিন কয়টির কথা ভাবে; ভাবিতে ভাল লাগে, মন গৌরবে আনন্দে ভরিয়া ওঠে। একটা গৌরবময় ভবিষ্যৎ কল্পনা করিতে মন অধীর হইয়া পড়ে। প্রাসাদ নয়, ধন-সম্পদ নয়, গাড়ি নয়, ঘোড়া নয়, বিশাল জমিদারি নয়, কৃচ্ছ্বসাধনধন্য ত্যাগের দীপ্তিতে উজ্জ্বল ভাস্বর জীবন। সে কল্পনার মধ্যে তাহার পিসিমা তাহার জন্য কাঁদিয়া সারা হন, মা ম্লানমুখে অশ্রুসজলনেত্ৰে তাহার যাত্রাপথের দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে চাহিয়া থাকেন, নিরুদ্ধ অশ্ৰুসাগর বুকে করিয়া গৌরী উদাসিনীর মত পিছনে পড়িয়া থাকে, আর সে চলে সম্মুখের আহ্বানে; দুর্গম পথ, আকাশে দুর্যোগ, আলোক নিবিয়া আসিতেছে, অন্ধকার প্রগাঢ় অন্ধকার; দুই পাশে ঘন বন, বনপথের অন্ধকার অতলস্পর্শী সূচীভেদ্য, সে অন্ধকারের মধ্যে আপনাকেও অনুভব করা যায় না, অগ্ৰ নাই পশ্চাৎ নাই, তবু সে চলে। সে অন্ধকারের ওপারের আলোকিত শ্মশানে শ্মশানকালী—মা মা হইয়াছেন।

কল্পনার সঙ্গে অদ্ভুতভাবে সেদিনের বাস্তব স্মৃতি মিশিয়া এক হইয়া যায়।

তাহার মনে পড়িল, সেই রাত্রেই ওই মা যা হইয়াছেন আলোচনা প্রসঙ্গে আনন্দমঠের কথা উঠিয়াছিল—

সেই অন্তশূন্য অরণ্যমধ্যে, সেই সূচীভেদ্য অন্ধকারময় নিশীথে, সেই অননুভবনীয় নিস্তব্ধ-মধ্যে শব্দ হইল, আমার মনস্কাম কি সিদ্ধ হইবে না? উত্তরে অন্ধকার অরণ্যের মধ্য হইতে অশরীরী বাণীর প্রশ্ন ধ্বনিত হইল, তোমার পণ কী? পণ আমার জীবনসর্বস্ব। জীবন তুচ্ছ; সকলেই ত্যাগ করিতে পারে। আর কী আছে? আর কী দিব? তখন আবার উত্তর হইয়াছিল, ভক্তি। সুশীল বলিয়াছিল, দেশ কি বাইরে শিবনাথবাবু? দেশের বসতি মানুষের মনে, মাটি মা হয়ে ওঠেন ওই ভক্তির স্পর্শে, মৃন্ময়ী চৈতন্যরূপিণী চিন্ময়ী হয়ে ওঠেন ওই সাধনায়।

তাহার তরুণ বখানি ভাবাবেগে ফুলিয়া ফুলিয়া উঠিতেছিল।

বাবু! জামাইবাবু!

কণ্ঠস্বরে চকিত হইয়া মুখ ফিরাইয়া দেখিল, অর্ধ-অবগুণ্ঠনবতী একটি মেয়ে তাহাকে ডাকিতেছে। সেই ডোমেদের বধূটি। মেয়েটির মুখে একটি শীর্ণতার ছায়া এখনও বিদ্যমান; তবুও সে অনেকটা সারিয়া উঠিয়াছে। বধূটি রূপবতী নয়, শ্রীমতী; তার ঈষৎ দীর্ঘ দেহখানি পাথরে খোদা মূর্তির মত সুগঠিত, রোগের শীর্ণতার মধ্যেও নিটোল লাবণ্য একেবারে মুছিয়া যায় নাই। এখন আবার সে লাবণ্য স্বাস্থ্যের স্পর্শে সজীব সতেজ হইয়া উঠিতেছে। শিবনাথ তাহার দিকে ফিরিয়া চাহিতেই সে ম্লান হাসি হাসিয়া বলিল, আপনার কাছে আবার এলাম বাবু বেপদে পড়ে, আর কার কাছে যাব বলেন?

বিপদ! আবার কী বিপদ হল তোমার?

মেয়েটি মুখ নিচু করিয়া বলিল, আমাকে একটি কাজ দেখে দ্যান বাবু, উ বাড়িতে আর আমি থাকতে লারছি।

শিবুর মনে পড়িয়া গেল মেয়েটির ভূতের ভয়ের কথা। সে হাসিয়া বলিল, ভূতটুত সংসারে নেই বাবু, ওসব মিথ্যে কথা। ওই তো এতদিন এ বাড়িতেই–

বাধা দিয়া মেয়েটি বলিল, আজ্ঞে না বাবু, ভূত লয়, শাশুড়ি ভাসুর দেওর এরা আমাকে। বড় জ্বালাইতেছে মাশায়; রেতে নিশ্চিন্দি ঘুমোবার যো নাই।

কেন?—শিবুর মন উত্তপ্ত হইয়া উঠিল।

মেয়েটির ঠোঁট দুইটি এবার থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল, সে এ প্রশ্নের উত্তর দিতে পারিল না। কিছুক্ষণ পরে মৃদুস্বরে ধীরে ধীরে বলিল, আমাকে বলে বাবু, এই ভাসুরকে সেঙা করতে।

শিবনাথ আশ্চর্য হইয়া গেল, কেবল আশ্চর্য নয়, পুনর্বিবাহে মেয়েটির অসম্মতি দেখিয়া তাহার স্নেহ যেন খানিকটা বাড়িয়া গেল। সে বলিল, তুমি কি আর বিয়ে করবে না?

নতমুখেই মেয়েটি বলিল, না। আপুনি একটি কাজ দেখে দ্যান, সেখানেই কাজ করব, পড়ে থাকব আমি।

কোথায় কাহার বাড়িতে কাজ খুঁজিতে যাইবে সে? চিন্তিতমুখেই শিবনাথ বলিল, আচ্ছা, দেখি।

এবার চোখের জল মুছিয়া বধূটি অল্প একটু হাসিয়া বলিল, এমন করে কী ভাবছিলা জামাইবাবু?

কখন?

এই আমি এলাম, চার-পাঁচ বার ডাকলাম, শুনতেই পেলে না মাশায়। হুই ঘুড়ির মতন। মনটি যেন আকাশে উড়ে বেড়াইছে।

শিবনাথ একটু হাসিল, কী উত্তর সে তাহাকে দিবে? কী বুঝিবে সে?

মেয়েটি এবার ফিক করিয়া হাসিয়া বলিল, নান্তিদিদির কথা ভাবছিলা বুঝি?

শিবনাথের দৃষ্টি রূঢ় হইয়া উঠিল, একটা ইতরশ্রেণীর নারীর রহস্যালাপে তাহার। আত্মমর্যাদায় আঘাত লাগিল; আর একদিন মেয়েটা এইভাবে রহস্যালাপের চেষ্টা করিয়াছিল। মেয়েটি সে দৃষ্টির আঘাতে সঙ্কুচিত হইয়া গেল, বিনয় করিয়া নিবেদনের ভঙ্গিতে বলিল, রাগ করলেন জামাইবাবু? আপুনি আমাদের জামাইবাবু কিনা, তাতেই বললাম মাশায়।

আত্মসংবরণ করিয়াও শিবনাথ ঈষৎ রূঢ়স্বরেই বলিল, আচ্ছা, যা তুই এখন।

আমার লেগে একটি কাজ দেখে দিয়েন মাশায়; ডোমের মেয়ে, ময়লা মাটি নর্দমা পরিষ্কার যা বলবেন তাই করব আমি।

হুঁ।–শিবনাথ কথা বন্ধ করিবার অভিপ্ৰায়েই সংক্ষেপে কহিল, হঁ। আবার সে মুখ ফিরাইয়া আকাশের দিকে চাহিয়া ছিন্ন চিন্তাসূত্রের প্রান্তের সন্ধান করিতে বসিল। মেয়েটা কিছুক্ষণ নীরবে কাপড়ের অ্যাঁচলে পাক দিয়া ধীরে ধীরে, যেমন অজ্ঞাতসারে আসিয়াছিল, তেমন অজ্ঞাতসারেই চলিয়া গেল। শিবনাথ মুখ ফিরাইয়া দেখিল, মেয়েটি চলিয়া গিয়াছে। তাহার মন চঞ্চল হইয়া উঠিল, না, এমন রূঢ় হওয়া ভাল হয় নাই।

মেয়েটির আত্মীয়তার সুরটি বড় মিষ্ট। সে একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। মনটা এই এতটুকু হেতুকে অবলম্বন করিয়াই কেমন বিমর্ষ হইয়া গেল। ছিন্ন চিন্তার সূত্র কোথায় হারাইয়া গিয়াছে, শিবনাথ সে সূত্রের সন্ধান আর পাইল না। আবার একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া সে চোখ বুজিল। গৌরীর প্রতি অবিচারের অপরাধ আর সে বাড়ায় নাই। গৌরীকে পত্ৰ দিয়াছে। এইবার গৌরীর পত্ৰ আসিবে। পত্র আসিবার সময় হইয়াছে, চিঠি বিলি হইবারও তো সময় হইয়া আসিল। শিবনাথ একটু চঞ্চল হইয়া উঠিল, ডাকিল, কেষ্ট সিং!

পত্র-রচনায় নিবিষ্টচিত্ত কিশোরী গৌরীর মূর্তি তাহার মনের মধ্যে বিনা ধ্যানেই জাগিয়া। উঠিল। কিশোরী গৌরী, পরনে তাহার নীলাম্বরী, অধরকোণে মৃদু হাসি, চিঠি লিখিতে লিখিতে আপনি তাহার মুখে হাসি ফুটিয়া উঠিয়াছে।

কেষ্ট আসিয়া দাঁড়াইতেই শিবনাথ বলিল, পথের ওপর একটু নজর রেখো তো, পিয়ন এলে চিঠি থাকলে নিয়ে আসবে আমার কাছে।

চিঠি লইয়া স্বয়ং শৈলজা-ঠাকুরানী আসিয়া সঁড়াইলেন, তোর চিঠি শিবনাথ।

সুন্দর একখানি খামের চিঠি, ইংরাজিতে ঠিকানা লেখা। শিবনাথের বুকটা ধড়াস করিয়া উঠিল। সে কম্পিত হাত বাড়াইয়া দিয়া চিঠিখানা গ্রহণ করিল।

শৈলজি-ঠাকুরানী প্ৰশ্ন করিলেন, কোথাকার চিঠি রে? বউমা চিঠি দিয়েছেন বুঝি?

পোস্ট-অফিসের ছাপই শিবনাথ দেখিতেছিল, ম্লান হাসি হাসিয়া সে বলিল, না, কলকাতা থেকে আসছে। বোধহয়–

চিঠিখানা বাহির করিয়া দেখিয়া বলিল, হ্যাঁ, সুশীলবাবুই লিখেছেন।

সুশীল?

হ্যাঁ।

ক্ষণকাল নীরব থাকিয়া পিসিমা বলিলেন, বউমা চিঠিপত্র তো লেখেন না?

না।

তুই তো দিলে পারিস।

শিবনাথ এ কথার উত্তর দিল না; সত্য বলিতেও শঙ্কা হইতেছিল, মিথ্যা বলিতেও মন চাহিতেছিল না। আবার শৈলজা-ঠাকুরানী বলিলেন, তুই চিঠি না দিলে সে কি নিজে থেকে প্রথমে পত্র দিতে পারে?

শিবনাথের মুখচোখ রাঙা হইয়া উঠিল, সে এবার অকুণ্ঠিত দৃষ্টিতে পিসিমার মুখের দিকে চাহিয়া অকারণে দৃঢ়স্বরে উত্তর দিল, আমি চিঠি দিয়েছি।

পিসিমা স্তম্ভিতভাবে শিবনাথের মুখের দিকে চাহিয়া আহতকণ্ঠে বলিলেন, সে কথা তুই এমনভাবে বলছিস কেন শিবনাথ? আমি দূষ্যভাবে কিছু বলি নি।

ইহার পর শিবনাথ আর উত্তর দিতে পারি না, সে গভীর মনোযোগের সহিত সুশীলের চিঠিখানার উপর ঝুঁকিয়া পড়িল। দীর্ঘ পত্র-কলিকাতায় কখন কোন ট্রেনে শিবনাথ যাইবে জানাইবার জন্য বার বার লিখিয়াছে। সে স্টেশনে থাকিবে, তাহাদের বাড়িতেই তাহাকে প্রথম উঠিতে হইবে। দীপা তো অসীম আগ্রহ আর কৌতূহল লইয়া আপনার অপেক্ষা করিয়া আছে। আপনার অভ্যর্থনার জন্য সে একখানা নূতন শাড়িই কিনিয়া ফেলিয়াছে। তাহার ধারণা, আট বছর বয়সেই সে অনেক বড় হইয়া উঠিয়াছে, আর কি ভদ্রলোকের সম্মুখে ফ্ৰক পরা যায়!।

শিবনাথের মুখে হাসি দেখা দিল। শৈলজা-ঠাকুরানী এই অবসরে কখন সেখান হইতে চলিয়া গিয়াছেন।

 

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বঞ্চনা অথবা বঞ্চনার সম্ভাবনায় মানুষ প্রাণপণ শক্তি লইয়া তাহার প্রতিকারের জন্য যুদ্ধ ঘোষণা করিয়া দাঁড়ায়, উচ্চকণ্ঠে সে আপনার দাবি লইয়া কলহ করে; কিন্তু যেদিন অকস্মাৎ আসে চরম বঞ্চনা, আপনার সর্বস্ব এক মুহূর্তে আপনার অজ্ঞাতে পরহস্তগত হইয়া যায়। বা হারাইয়া যায়, সেদিন একান্ত শক্তিহীন হতভাগ্যের মত নীরবে তাহ্যাঁ মাথা পাতিয়া লওয়া ছাড়া আর গত্যন্তর থাকে না। শিবুর রক্তাভ মুখের উত্তাপ আর ওই কয়টি দৃপ্ত কথার সুরের মধ্যে যেন লুকাইয়া ছিল কালবৈশাখীর মেঘের বিদ্যুৎ আর বজ্ৰধ্বনি; শৈলজা-ঠাকুরানীর জীবনের প্রাসাদনিকে যেন একেবারে চৌচির করিয়া দিল। বঞ্চনার বেদনায় তিনি ক্ষীণ আর্তনাদ পর্যন্ত করিলেন না, নীরবে নতশিরে আসিয়া পূজার ঘরে প্রবেশ করিলেন।

অস্বাভাবিক বিলম্বে জ্যোতির্ময়ী দুইবার আসিয়া ননদকে পূজায় নিযুক্ত দেখিয়া ফিরিয়া গেলেন, তৃতীয় বারে আসিয়া কথা কহিবার প্রতীক্ষায় পাঁড়াইয়া রহিলেন।

অত্যন্ত শান্তকণ্ঠে শৈলজা-ঠাকুরানী বলিলেন, আমার জন্যে দাঁড়িয়ে আছ?

জ্যোতির্ময়ী বলিলেন, বেলা যে অনেক হল ঠাকুরঝি।

একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া তিনি বলিলেন, যাই।

ধীরে ধীরে প্রণাম সারিয়া পূজার সরঞ্জামগুলি নিজেই পরিষ্কার ও গোছগাছ করিতে করিতে বলিলেন, উপর আর নিচে দুদিকে একসঙ্গে চোখ রাখা যায় না বউ।

জ্যোতির্ময়ী তাহার হাত হইতে বাসনগুলি টানিয়া লইয়া বলিলেন, চল না ভাই, একবার তীর্থ করে আসি।

শৈলজা-ঠাকুরানী বলিলেন, যাব। শিবুর ঘর পেতে দিয়ে একেবারে যাব ভাই।

জ্যোতির্ময়ী কথাটা সহজভাবেই গ্রহণ করিলেন, হাসিয়া বলিলেন, শিবুর ঘর গোছগাছ করে কি শেষ করতে পারবে তুমি? তোমার সাজানোই শেষ হবে না।

শৈলজা-ঠাকুরানী হাসিলেন, বলিলেন, বউমাকে আনবার জন্যে আজই চিঠি দেব আমি। নিজের বউকে অন্যের ওপর রাগ করে বাইরে ফেলে রাখা আমাদের ভুল হচ্ছে ভাই। শিবুর দুঃখ হয়, রাগও হয়।

জ্যোতির্ময়ী ঘাড় নাড়িয়া বলিলেন, না। তারা নিয়ে গেছেন, তারাই পাঠিয়ে দিন। আমরা আনতে পাঠাব কেন?

না, পাঠাতে হবে। চিরকাল তুমি আমার কথা মেনে এসেছ বউ, এ কথাটাও তোমাকে মানতে হবে। তুমি না বলতে পাবে না।

ননদের মুখের দিকে সবিস্ময়ে চোখ ফিরাইয়া জ্যোতির্ময়ী বলিলেন, তোমায় কি কেউ কিছু বলেছে ঠাকুরঝি?

বারবার ঘাড় নাড়িয়া অস্বীকার করিয়া শৈলজা বলিলেন, না না না। কার ক্ষমতা আমাকে কিছু বলে, আমি বড় বাপের মেয়ে, আমি বড় ভাইয়ের বোন, আমি শিবুর পিসিমা।

তুমি আমায় লুকোচ্ছ ঠাকুরঝি।

না না ভাই। আজ পুজোয় বসে ইষ্টদেবতার মূর্তি মনে আনতে পারলাম না বউ, বারবার বউমাকেই আমার মনে পড়ল। তুমি না বোলো না, বউমাকে আমি আনব। সে আমার ঘরের লক্ষ্মী, আর শিবুও আমার বড় হয়েছে।

জ্যোতির্ময়ীর চোখও ধীরে ধীরে জলে ভরিয়া উঠিল। বধূকে লইয়া তাহার মনের মধ্যে একটা গ্লানি অহরহ জমিয়া থাকিত। সে গ্লানি আজ যেন নিঃশেষে ধুইয়া মুছিয়া গেল।


© 2024 পুরনো বই