পরদিন প্রাতঃকালে রামকিঙ্করবাবু শিবনাথের বাড়ির ভিতর প্রবেশ করিতে করিতেই শুনিতে পাইলেন, শৈলজা-ঠাকুরানী বলিতেছেন, গাছ একটা সামান্য জিনিসই বটে বউ, কিন্তু এ মানঅপমানের কথা, ইজ্জতের কথা, এখানে তুমি কথা কয়ো না।
কণ্ঠস্বরে সুকঠোর দৃঢ়তা প্ৰকাশ পাইতেছিল। কয়েক মুহূর্ত নীরব থাকিয়া আবার তিনি বলিলেন, এ আমার বাপের বংশের অপমান। দাদা আমাকে বলতেন, শৈল, না খাব উচ্ছিষ্ট ভাত, না দিব চরণে হাত। এ আমাদের পিতৃপুরুষের শিক্ষা। মাথা নিচু করে জবরদস্তি তো কারও সইতে পারব না।
রামকিঙ্করবাবু ডাকিলেন, ঠাকরুন-দিদি রয়েছেন নাকি?
ভিতর হইতে আহ্বান আসিল, এস ভাই, এস।
নায়েব সিংহ মহাশয় বহির্দ্বার পর্যন্ত আগাইয়া আসিয়াছিলেন। রামবাবু ভিতরে গিয়া। দেখিলেন, চাপরাসী কেষ্ট সিং এবং আরও কয়েকজন পাইক কোন কাজের জন্য যেন প্রস্তুত হইয়া। দাঁড়াইয়া আছে।
পিসিমা একখানা গালিচার আসনের উপর বসিয়া ছিলেন; আর একখানা বিস্তৃত আসন দেখাইয়া দিয়া তিনি রামবাবুকে বলিলেন, এস ভাই।
তারপর বলিলেন, কেষ্ট সিং গাছ আটক করতে পারবে তোমরা?
কেষ্ট সিং বলিল, না জখম হলে তো ফিরব না মা। রামবাবু বলিলেন, কী হল ঠাকরুন-দিদি?
পিসিমা বলিলেন, ও-পাড়ার শশী রায় কালকের সে অপমান ভুলতে পারে নি ভাই। আজ ওদের পুকুরপাড়ে আমাদের বহুকালের দখলী একটা গাছ আছে সেটা কাটতে লাগিয়েছে।
রামবাবু বলিলেন, মকদ্দমা হলে যে আপনারা ঠকবেন, যার জায়গা গাছ তারই হয়। পিসিমা বলিলেন, গাছ যখন আমার দখলে আছে, তখন তার তলার মাটিও তা হলেআমার। সবই তো দখলের প্রমাণের ওপর ভাই। কিন্তু সে তো পরের কথা। আজ যে শিবনাথের মাথা হেঁট হবে, তার কী? বিষয় বাপের নয়, বিষয় দাপের।
রামবাবু বলিলেন, চাপরাসী দরকার হয় তো আমার চাপরাসী–
বাধা দিয়া পিসিমা বলিলেন, থাক ভাই, এখন নয়। শিবুর বিয়ে যদি ভগবান তোমার ঘরেই লিখে থাকেন, তখন যত পারবে করবে।
তারপর আবার হাসিয়া বলিলেন, তখন দরকার হলে বেয়াইকেও বলব, তোমাকেও লাঠি ধরতে হবে বেয়াই।
নায়েব বলিলেন, তা হলে ওরা চলে যাক?
একটু চিন্তা করিয়া পিসিমা বলিলেন, না, জখম হয়ে ফিরে এলে তো আমার মান রক্ষা হবে না। তার চেয়ে কাটুক ওরা গাছ। আপনি আমার এখানকার মহলের সমস্ত পাইক আর লাঠিয়ালকে ডাক দিন। পঞ্চাশখানা গাড়ি যোগাড় করে রাখুন। কাটা গাছ ঘরে তুলে আনুক, একটি পাতাও যেন ওরা না নিয়ে যেতে পারে। ওই গাছের কাঠেই আমার রান্না হবে।
কেষ্ট সিং ও পাইকরা চলিয়া গেল।
পিসিমা নায়েবকে বলিলেন, একবার মুখুজ্জের ভাগ্নেদের ওখানে যান দেখি, খাজনা ওরা আপোসে দেবে কি না জিজ্ঞাসা করে আসুন। আর গণকের যদি পূজা শেষ না হয়ে থাকে, তবে ধীরে-সুস্থেই করতে বলুন, তাড়াতাড়ি নেই।
নায়েব চলিয়া গেলেন।
রামবাবু হাসিয়া বলিলেন, নান্তি কাল কী বলছে জানেন? বড় পান খায় নান্তি, তাই মা বললেন, জানিস, শিবনাথের সঙ্গে তোর বিয়ে হবে, তার পিসিমাকে তো জানিস, দেশের লোক ভয় করে, সে তোকে পান খাওয়াবে এমনই করে? নান্তি বেটি ভারি দুষ্ট তো, সে বললে, না, দেবে না! না দিলেই হল আর কি!
ঘরের মধ্য হইতে শিবনাথের মা মৃদুস্বরে বলিলেন, আমার কিন্তু একটি শর্ত আছে। ঠাকুরঝি। বিয়ের পর বউ কিন্তু আমার এখানে থাকবে।
বাহির হইয়া আসিয়া তিনি জলখাবার লইয়া রামকিঙ্করবাবুর সম্মুখে নামাইয়া দিলেন।
রামকিঙ্করবাবু বলিলেন, নান্তির মা নেই। আপনাদের শুধু শাশুড়ি হিসাবেই পাবে না, মাও হবেন আপনারা। আপনাদের কাছে থাকবে সে।
জল খাওয়া শেষ করিয়া রামবাবু বলিলেন, তা হলে গণককে একবার—
পিসিমা বলিলেন, তুমি কুষ্টিটা রেখে যাও ভাই, আমি দেখিয়ে রাখব।
রামবাবু হাসিয়া কোষ্ঠীটা রাখিয়া দিয়া বলিলেন, আগে থেকেই যদি গণককে টাকা খাইয়ে থাকি ঠাকরুন-দিদি?
পিসিমা বলিলেন, তবে সে ভবিতব্য, আর এই দুই বিধবার মন্দ অদৃষ্টের ফল, তা ছাড়া আর কী বলব।
রামবাবু চলিয়া গেলেন।
পিসিমা নিত্যকালী-ঝিকে ডাকিয়া বাসনের হিসাব লইতে বসিলেন। নিত্য বলিল, খাগড়াই বাটিটা শুধু পাওয়া যায় নি, সেটা সকালবেলাই দাদাবাবু নিয়ে গিয়েছেন সেই হেঁড়োলর বাচ্চাকে দুধ খাওয়াতে।
পিসিমা বলিলেন, বউ, শিবু তো জল খেতে এল না! নিত্য, দেখে আয় তো শিবুকে। মতির মা কোথায় গেল? আমার তেল-গামছা নিয়ে আয়।
নিত্য বাটিটা হাতে করিয়া ফিরিয়া আসিয়া বলিল, পড়া সেরে দাদাবাবু সেই হেঁড়োলের বাচ্চা ফিরিয়ে দিতে গিয়েছেন।
পিসিমা চমকিয়া বলিয়া উঠিলেন, একা?
না, শম্ভুও সঙ্গে গিয়েছে। নায়েববাবু বারণ করেছিলেন, তা শোনেন নি; বলেছেন, মায়ের হুকুম, এটাকে নিজে ছেড়ে দিয়ে এসে তবে জল খাব। নায়েব পাইক দিতে চেয়েছিলেন তাকে ঢিল মেরে তাড়িয়ে দিয়েছেন।
পিসিমা ভ্ৰাতৃজায়াকে বলিলেন, কী যে তোমার শিক্ষার ধারা বউ, তুমিই বোঝ ভাই।
শিবনাথের মা হাসিয়া বলিলেন, দিনের বেলা, শম্ভু সঙ্গে আছে, ভয় কী?
পিসিমা বলিলেন, বাঘ-ভালুকের ভয়ের কথা বলছি না ভাই, শাক্ত জমিদারের ঘরের ছেলেকে তুমি মালা জপাতে চাও নাকি? থাকতই বা ঘেঁড়োলের বাচ্চাটা। দাদার আমার জানোয়ার ছিল কত!
অপরাহ্রে বাড়ির সমস্ত দরজা বন্ধ করিয়া গণক বসিয়া কোষ্ঠী বিচার করিল। হৃদয়বাবু পুলিশ সাহেবের নাতনীর কোষ্ঠীও ভাল, কিন্তু অবশেষে জয় হল ওই নান্তির। নান্তির অবৈধব্য যোগ আছে। আঠার হইতে বিশ বৎসরের মধ্যে শিবনাথের মৃত্যুতুল্য ফাড়া। নান্তির সহিতই বিবাহ স্থির হইয়া গেল।
আপত্তি তুলিলেন শিবুর গৃহশিক্ষক। ছুটির শেষে তিনি আসিয়া বিবাহের কথা শুনিয়া জ্ব কুঁচকাইয়া গম্ভীর হইয়া উঠিলেন। তারপর আপনার দাড়িতে বারকয়েক হাত বুলাইয়া না-এর ভঙ্গিতে ঘাড় নাড়িতে নাড়িতে বলিলেন, ননী, আই ওন্ট অ্যালাও ইট। চোদ্দ বছরের ছেলের বিয়ে! অ্যাবসার্ড।
শিবুকে তিনি আদেশ করিলেন, ডোন্ট ম্যারি।
পিসিমা বিব্রত হইয়া মাস্টারকে ডাকিয়া বলিলেন, হ্যাঁ বাবা রতন, বিয়েতে আপত্তি করে তুমি? শিবু একেবারে বেঁকে বসেছে।
মাস্টারের নাম রামরতনবাবু, লোকে অন্তরালে তাহাকে পাগল বলিয়া থাকে; এক কালে পঠদ্দশায় তাহার মাথা নাকি সত্য সত্যই খারাপ হইয়াছিল। মাস্টার যেন কত গোপনীয় কথা বলিতেছেন, এমনই ভঙ্গিতে বলিলেন, দেখুন, একটা ছড়া বলি, আমরা হলাম কুম্ভকার জাতি, আমাদের জাতের ছড়া। কুম্ভকারে ধূম্রাকার ধূম্রাকারে মেঘাকার-মেঘাকারে জলাকার, বুঝলেন? কুম্ভকার হাঁড়ি পোড়ালে আর জল হল। কেন? না, হাঁড়ি পোড়ালে হল ধোঁয়া, ধোঁয়া থেকে মেঘ, মেঘ থেকে জল। আজ শিবুর বিয়ে দেবেন, বিয়ে দিলেই, বউ এলেই শিবু পড়বে না ভাল করে; বাস, তা হলেই সব মাটি। বাল্যবিবাহ অবশ্য আমি ভালই বলি, এত বাল্যকালে নয়।
পিসিমা বলিলেন, অল্পবয়সে শিবুর ফাড়া আছে মাস্টার, তা ছাড়া আমাদের ভাগ্য তো দেখছ। তাই একটি ভাগ্যমানী মেয়ের ভাগ্যের সঙ্গে শিবুকে আমি জড়িয়ে দিতে চাই। মাস্টার গম্ভীর হইয়া উঠিলেন, বারকয়েক দাড়িতে হাত বুলাইয়া বলিলেন, জানেন পিসিমা, ও আমি অনেক দেখেছি, ওতে আমি বিশ্বাস করি না। আমার একটাই ছেলে হয়েছিল, সেটা মারা গেছে। বড় মেয়েটা বিয়ের পরই বিধবা হয়েছে। অথচ কোষ্ঠীতে তার কিছু লেখা ছিল না; ভাগ্যের নাম হল অদৃষ্ট, ও কি অঙ্ক কষে ধরা যায়, না রাশিচক্রের মধ্যে দিয়ে দেখা যায়?
পিসিমা চুপ করিয়া রহিলেন। তিনি এই মানুষটিকে বিশেষ সম্মান করিয়া চলেন। এই উদার। লোকটি অন্তরে অন্তরে শিবু এবং শিবুর জন্য সমগ্র পরিবারটির প্রতি যে অকৃত্রিম শুভেচ্ছা পোষণ করিয়া থাকেন, সেই শুভেচ্ছার বলেই তিনি এ সংসারে অলঙনীয় হইয়া উঠিয়াছেন।
কিছুক্ষণ পর পিসিমা বলিলেন, কিন্তু কথা দিয়ে ফেলেছি মাস্টার, এখন কি আর অমত করা ভাল?
মাস্টার বলিলেন, বেশ তো, কথা পাকা হয়ে থাক, তারপর বিয়ে হবে পাঁচ বছর পরে। শিবুকে আমি বড়মানুষ গড়ে তুলব পিসিমা।
মাস্টার উঠিয়া পড়িলেন। বাড়ির বাহিরে আসিতেই রতন-পাচিকা বলিল, শুনুন মাস্টার মশায়। রতন তাহার অপেক্ষাতেই দাঁড়াইয়া ছিল।
রতন বলিল, মামীমা শিবুর মা বললেন, বিয়েতে অমত করবেন না। পিসিমা বড় আঘাত পাবেন। আর বললেন, বিয়ে হয়ে শিক্ষার পথে বাধা হয় তা ঠিক কিন্তু বিয়ে হয়েও মানুষ শিক্ষিত হয়, বড় হয়। একটু কঠিন হয়, কিন্তু কঠিনকে ভয় করতে গেলে কি চলে?
মাস্টার দাড়িতে হাত বুলাইয়া বলিলেন, , মায়ের কথাই ঠিক বলেই মনে হচ্ছে। হুঁ, তা বটে। মা যখন বলেছেন। মাস্টার আবার ফিরিলেন, পিসিমা!
পিসিমা বিরক্ত হইয়াই বসিয়া ছিলেন। তিনি উত্তরে মাস্টারের দিকে ফিরিয়া চাহিলেন মাত্র। মাস্টার বলিলেন, না, হয়ে যাক বিয়ে, যখন কথা দেওয়া হয়েছে আর আপনি ইচ্ছে। করেছেন, হয়ে যাক; তারপর দেখা যাবে। কিন্তু একশো টাকার বই কিনে দিতে হবে বিয়ের খরচ থেকে।
পিসিমা হাসিয়া ফেলিলেন, বলিলেন, তোমাকে কিন্তু আমি বিয়েতে বরের মাস্টারের উপযুক্ত সাজে সাজিয়ে পাঠাব। গরম কোট, শাল, এইসব গায়ে দিতে হবে। চটের সেই অলেস্টার কিন্তু গায়ে দিতে পাবে না।
মাস্টারের সত্য সত্যই একটা চটের মত কাপড়ের ওভারকোট আছে। মাস্টার বলিলেন, তা তো পরতেই হবে পিসিমা, সে তো হবেই কিন্তু ওই বাইনাচ খেমটা, ওগুলো করতে পাবেন। না। খুব করে গরিব লোকদের খাওয়াতে হবে।
বেশ, তুমি যাতে অমত করবে, সে হবে না।পিসিমা প্রসন্ন মনেই মাস্টারের নির্দেশ মানিয়া লইতে রাজি হইলেন।
মাস্টার আসিয়া পড়ার ঘরে প্রবেশ করিয়া বলিলেন, না, বিয়েটা করে ফেল্ শিবু। আর্লি ম্যারেজ এক হিসাবে ভাল-গুড। করে ফেল্ বিয়ে।
শিবুর জবাব দিবার কিছু ছিল না, কারণ মাস্টারের আদেশ শিরোধার্য করিলেও বিবাহের প্রতি তাহার বিদ্বেষ তো ছিলই না, বরং অনুরাগই ছিল। এ কথার কোনো জবাব না দিয়া শুধু হাতের বইখানা রাখিয়া দিয়া একখানা বই সে তুলিয়া লইল। রাখিয়া দেওয়া বইখানি তুলিয়া মাস্টার দেখিলেন মেঘনাদবধ কাব্য। চোখ তাহার দীপ্ত হইয়া উঠিল, বলিলেন, এ গ্রেট বুক।—বলিয়াই তিনি আবৃত্তি আরম্ভ করিলেন
সম্মুখ সমরে পড়ি বীরচূড়ামণি
বীরবাহু চলি গেলা যবে যমপুরে
অকালে; কহ হে দেবী অমৃতভাষিণী
কোন্ বীরবরে বরি সেনাপতি পদে
পাঠাইলা রণে পুনঃ রক্ষকূলনিধি
রাঘবারি।
আবার যখন বড় হবি, যখন মিল্টন পড়বি, দেখবি, তারও প্যারাডাইস লস্টের প্রথমে এমনই করেই তিনিও জিজ্ঞাসা করছেন, তার কবিতার ছন্দের এমনই সুর। এই যে অমিত্রাক্ষর ছন্দ, এ মাইকেল মিল্টনের কাব্য থেকেই নিয়ে বাংলায় ঢেলেছিলেন। মিল্টন মহাকবি, কিন্তু শেষ বয়স তার বড় কষ্টে গিয়েছে, অন্ধ হয়েছিলেন। গ্রেট মেনদের লাইফ একখানা পড়ে ফেল, বুঝলি? তুই রবীন্দ্রনাথের বই কী কী পড়েছিস? কথা ও কাহিনীখানা পড়েছিস?
সোৎসাহে ঘাড় নাড়িয়া শিবু বলিল, ওটা পড়েছি স্যার। কিন্তু পণ্ডিত মশাই যে বড় নিন্দে করেন রবীন্দ্রনাথের।
উত্তরে খুব গোপনীয় সংবাদের মত মাস্টার ছাত্রের কানে কানে কহিলেন, রবীন্দ্রনাথ ইজ এ গ্রেট পোয়েট। মস্ত বড় কবি। অ্যান্ড তোদর পণ্ডিতমশাই নোজ নাথিং।
আপনি রবীন্দ্রনাথকে দেখেছেন, শান্তিনিকেতন তো আপনাদের বাড়ির খুব কাছে?
রাজার মত, দেবতার মত রূপ, কতবার দেখেছি। জানিস শিবু, যখন মন খারাপ হয়, চলে যাই শান্তিনিকেতনে।–মাস্টার উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিলেন।
আপনি সুরেন্দ্রনাথকে দেখেছেন? বক্তৃতা শুনেছেন?
একটা ভলক্যানো—আগ্নেয়গিরি, বুঝলি? এই তো সেদিন বোলপুর এসেছিলেন, তোর যে অসুখ হয়ে গেল, নইলে নিয়ে যেতাম।
এবার আমায় শান্তিনিকেতন নিয়ে যেতে হবে স্যার।
যাবি তুই আমাদের বাড়ি শিবুঃ কঙ্কালী পুজোর সময় চৈত্র-সংক্রান্তিতে যদি যাস, এত মাংস খাওয়াব তোকে, তোর পেট ফেটে যাবে। জানিস, আমরা হলাম বৈষ্ণবমন্ত্ৰ উপাসক, আমাদের তো কেটে মাংস খাওয়াতে নেই। কিন্তু ওই পুজোর সময় চার-পাঁচশো বলিদান হয়, তখন মাংসের অভাব হয় না। শান্তিনিকেতন দেখবি, আমাদের বাড়ি দেখবি। অবিশ্যি আমাদের বাড়ি ভাল নয়, গরিব লোকের বাড়ি তো। কিন্তু এককালে আমরা গরিব ছিলাম না, ব্যবসাতে সব লোকসান হয়ে গেল। ফুঁ দিয়ে আলো নিবিয়ে দিলে যেমন হয়—নলিনীদলগতজলমতিতরলং, বুঝলি?
শিবু বলিল, আমি এবার ঠিক যাব কিন্তু, তখন গরম বললে শুনব না। আপনিও পিসিমার কথায় সায় দেবেন, তা হবে না। মাস্টার বলিলেন, তুই একটা ইডিয়েট। কোন জায়গায় কথা মানতে হয়, কোন জায়গায় মানতে হয় না, জেদ ধরতে হয় খুব করে, সেটা ঠিক বুঝতে পারি না।
ঘড়িটা পাশের হলঘরে ঢং ঢং করিয়া বাজিতে আরম্ভ করিল। মাস্টার চকিত হইয়া বলিলেন, এঃ, নটা বেজে গেল!
অঙ্ক কষা হল না যে স্যার!—শিবুও চকিত হইয়া উঠিল।
গাড়ু ও গামছা পাড়িয়া মাস্টার বলিলেন, আজ সন্ধেবেলা কেবল অঙ্ক, কেবল অঙ্ক। সতীশ, সতীশ, তেল নিয়ে আয়। বেশি করে আনবি, বলবি, মহিষাসুরের মত দেহ, সেই উপযুক্ত দাও।
মাস্টার স্নান করিতে যাইবেন দেড় মাইল দূরবর্তী ঝরনায়। ফিরিবার সময় প্রকাণ্ড একটি গাড়ু ভরিয়া জল আনিবেন, সেই জল ছাড়া অন্য জল তিনি পান করেন না। স্কুলেও তাহার সঙ্গে সঙ্গে চলে ওই জলাধার।
শিবু বাড়িতে আসিতেই পিসিমা বলিলেন, মাস্টার কী বললেন? বললেন, মা-পিসিমার অবাধ্য হতে?
শিবু কোনো উত্তর দিল না, প্রসঙ্গটা যে বিবাহের, এটুকু বুঝিতে তাহার বিলম্ব হয় নাই। বিবাহের কল্পনায় আনন্দ এবং লজ্জা ক্রমশই তাহার মনটাকে পরিব্যাপ্ত করিয়া ফেলিতেছে। বিবাহের কথা মনে হইলেই তাহার পুষ্পিত মালতীলতাটার কথা মনে জাগিয়া ওঠে। কাহার বিবাহে প্রীতি-উপহারে সে পড়িয়াছিল—সোনার স্বপন বিবাহ-বাসনা সেই কথাটাই তাহার
মনে মনে গুঞ্জন করিয়া ওঠে।
স্কুলে আসিয়া বাইসিক্লখানা বারান্দার রেলিঙে চেন দিয়া বাঁধিয়া ক্লাসে ঢুকিয়া দেখিল, বেঞ্চের উপর মাত্র দুইটি ছেলের বই রহিয়াছে, যাহাদের বই তাহারাও কেহ নাই, বোধহয় বাহিরে গিয়াছে। শিবু জানালায় দাঁড়াইয়া বোর্ডিং প্রাঙ্গণের দিকে চাহিল, ছেলেদের কতক খাওয়া হইয়া গিয়াছে, কতক খাইয়াছে।
সহসা তাহার চোখে পড়িল, যাহাকে সে খুজিতেছে, সে কুয়ার ধারে দাঁড়াইয়া তাহাকে লক্ষ্য করিয়াই মৃদু মৃদু হাসিতেছে। শিবুরই সমবয়সী সুন্দর ছেলেটি। ছেলেটি কমলেশ, শিবুর। ভাবী বধূ নান্তির বড় ভাই। মাতৃহীন সংসার তাহাদের তালাবন্ধ। নান্তি ও অপর ছোট ভাইগুলি তাহাদের মাতামহীর নিকট থাকে, কমলেশ থাকে বোর্ডিঙে। এই বড়দিনের বন্ধে সে কলিকাতায় গিয়াছিল, বোধহয় সকালের ট্রেনেই আসিয়াছে।
কমলেশ জানালার ধারে আসিয়া বলিল, ব্রাদার-ইন-ল মানে কী?
হাসিয়া শিবু বলিল, তোমার মানের বইয়ে কী লেখে জানি না, আমার বইয়ে লেখা আছে। তালব্য শয়ে আ-কার লয়ে আ-কার।
কমলেশ বলিল, থ্যাংক ইউ। তারপর অনেক কথা আছে তোমার সঙ্গে।
শিবু বলিল, ছুটির পর, কেমন?
আমি আজ আর ক্লাসে যাব না। সমস্ত রাত জেগে ট্রেনে এসেছি। এস না আমার ঘরে।
নাঃ, বাঁদর ছেলেরা সব ঠাট্টা করবো।
তিনটে পিচকিরি এনেছি ফায়ার-ব্রিগেডের জন্যে, আধ বালতি জল ধরে, আর অনেক দূর যায়।
সত্যি?-শিবু তখনই ক্লাস হইতে বাহির হইয়া পড়িল। তাহাদের পল্লীসেবা-সমিতিতে একটা ফায়ার-ব্রিগেড আছে; বালতি, কাস্তে, মই, এই লইয়া কোথাও আগুন লাগিলেই তাহারা সব ছুটিয়া যায়। ফায়ার-ব্রিগেডের ক্যাপ্টেন ওই কমলেশ।
সন্ধ্যায় পড়িতে বসিয়া শিবু লক্ষ্য করিল, তাহাদের খামার-বাড়িতে ক্রমাগতই গাড়ি আসিয়া ঢুকিতেছে, লোকজনও অনেক জমায়েত হইয়াছে বলিয়া বোধ হইল। মাস্টার ইকোয়েশন বুঝাইতেছিলেন। হঠাৎ তাহার চোখে পড়িল; শিবু কিছুই শুনিতেছে না। তিনি গর্জন করিয়া উঠিলেন, ইউ ফলো মাই ফিঙ্গার। ওদিকে কী দেখছিস?
শিবু বলিল, এত গাড়ি কেন স্যার, ওখানে?
মাস্টার উঠিয়া সেদিকের জানালাটা বন্ধ করিয়া দিয়া বলিলেন, নাউ ফলো মি।
তারপর অঙ্ক কষা চলিতে লাগিল। অঙ্ক কষা শেষ হইলে তিনি বলিলেন, তাই তো রে, অনেক লোক যে চুপিচুপি গোলমাল করছে! ডাকাত পড়ল নাকি?
শিবু হাসিয়া ফেলিল, না স্যার, কেষ্ট সিং রয়েছে, মহলের কয়েকজন পাইক রয়েছে।
উঁহু, যদি তারা এসেই ওদের মুখে কাপড় দিয়ে বেঁধে ফেলে থাকে? খুব চুপিচুপি আয় আমার সঙ্গে। দাঁড়া, একগাছা লাঠি নিই।
কিন্তু তাহার আর প্রয়োজন হইল না, ঘর হইতে বাহির হইবার মুখেই দেখিলেন বারান্দায় কেষ্ট সিং ও কয়েকজন পাইক নায়েবের নিকট দাঁড়াইয়া তাহার উপদেশ শুনিতেছে, খুব। সক্কালেই গাড়ি নিয়ে গিয়ে হাজির হবে। রাত্রে কেন যাবে? তা হলে বলবে, চুরি করে গাছ নিয়ে গেল। মোটকথা, গাড়িতে বোঝাই করবে ওরা যাবার আগেই। বাস্, তারপর আটক করে, তখন তোমরা আছ, তোমাদের লাঠি আছে।
শিবু ব্যাপারটা বুঝিয়াছিল, তাহার মন কেমন খুঁতখুঁত করিতেছিল, সে বলিল, তবু সিংমশায়, ওরা বলবে, ঠকিয়ে নিয়ে গেল।
সিং মহাশয় বলিলেন, সব জায়গায় কি বলে কাজ হবে? বলের চেয়ে বুদ্ধিতে কাজ বেশি। বুদ্ধিৰ্যস্য বলং তস্য, নাকি মাস্টারমশাই?
মাস্টার বলিলেন, ইয়েস। এই হল মর্ডানিজম। তারপর বারবার ঘাড় নাড়িয়া তিনি বলিলেন, পিসিমা ইজ গ্রেট। অদ্ভুত বুদ্ধি। কাম শিবু, রানী ভবানীর গল্প বলব, আয়, বাংলাদেশের জমিদারের বাড়ির বউ। তিনি কী বলেছিলেন জানিস, পলাশীর যুদ্ধের ষড়যন্ত্রের সময়?–খাল কেটে কুমির এনো না। ক্রোকোডাইল—এ ডেঞ্জারাস রেপ্টাইল।
পরদিন সকালেই কাঠ বোঝাই গাড়ির পর গাড়ি আসিয়া সাত-আনির বাঁড়ুজ্জেবাবুদের খামারে ঢুকিয়া পড়িল, পিছনে পিছনে কেষ্ট সিং ও পাইকের দল। নির্বিঘ্নে কাজ সমাধা হইয়া গিয়াছে, কেহ বাধা দিতেও যায় নাই। একজন আসিয়া দেখিয়া সেই যে সংবাদ দিতে গেল, আর ফিরিল না।
সতীশ নায়েবের সম্মুখে একখানা টিপ ফেলিয়া দিল, গাড়োয়ান ও পাইকদের বকশিশ।