–বেদের কন্যে সহজে পাগল হয় না। ধন্বন্তরিভাই; বেদের কন্যের পরান যখন ছাড়-ছাড় কর্যা উঠে, তখুন পরানটারেই ছেড়া দেয় হাসি মুখে বাসিফুলের মালার মতুন; লয়ত-বাধন ছিড়া আগুন জ্বালায়ে নাচিতে নাচিতে চলা যায়, যা পেলে পরান বাঁচে তার পথে। আপন মনেরে সে শুধায়—মন, কি চাস তা বল, খয়ে দেখ্যা ব। যদি ধরমে সুখ তো ধরম মাথায় লিয়া মর্যা যা; দে কুনও কালনাগের মুখে হাত বাড়ায়ে দে। দিয়া ভরপেট মদ খেয়ে ঘুমায়ে যা। আর তা যদি না চাস, যদি বাঁচিতে চাস, ধরমেকরমে-জাতিতে-কুলে-ঘরে গেরামে-পরানে আগুনের জ্বালা ধরায়ে দিয়া জ্বালায়ে দিয়া চল্যা যা তু আপন পথে।
মা-বিষহরির দয়ায় কন্যে পাগল হয় না ধন্বন্তরি!
কথাগুলি শিবরামকে বলেছিল পিঙলা নয়, শবলা। বিচিত্র বিস্ময়ের কথা বলার সঙ্গে শিবরামের আবার দেখা হয়েছিল, সে ফিরে এসেছিল।
শবলা বলেছিল—মুই গেছিলম। মহাদেব শিরবেদের সব্বনাশ করা-ঝাপ দিয়া পড়ছিলম গঙ্গার জলে। মরি মরব, বাঁচি বাঁচব, বাঁচিলে পিথিমীর মাটিতে পরানের ভালবাসা ঢেল্যা মাখায়ে তাতেই ঘর বেঁধ্যা, পরানের সাধ মিটার। ঘরের দুধারে দুই চাপার গাছ পঁত্যা, ফুলের মালা গলায় পর্যা, পরানের ধনে মালা পরায়ে—বাঁচব, পরান ভরায়ে বাঁচব। তা মরি নাই বেঁচেছি। দেখ চোখে দেখ, তোমার ধরম-বহিন—বেদের কন্যে, পোড়াকপালী, মন্দভাগিনী, কালামুখী, কুহকিনী নিলাজ শবলা তুমার ছামনে দাঁড়ায়ে—দুশমনের হাড়ে-গড়া দাঁতে ঝিকিমিকি করা হেসে সারা হতেছে। পেতনী নই, জ্যান্ত শবলা, দেখ, হুঁলি পর যদি চান। করতে হয় তো কাজ নাই; লইলে এই আমার হাতখানা পরশ করা দেখ, মই সেই শবলা। ধন্বন্তরি ভাই, বেদের কন্যের মনে বায়ু যখন ঝড় তুলে, তখন পরানের ঘরের দুয়ার ভেঙে ফেলায়।
হেসে ওঠে শবলা—খিলখিল করে হেসে ওঠে, যে হাসিতে মানুষের আর বিস্ময়ের অবধি থাকে না, ভাবে-নির্লজ্জ ভাবে এমন হাসি কি করে মানুষ হাসে–সেই হাসি হেসে বলা বললে—কি কইলম? পরানের দুয়ার ভেঙে ফেলায়? আ আমার কপাল, বেদের জাতের পরানের ঘরে আবার দুয়ার! দুয়ার লয় গো—আগড়। কোনোমতে ঠেকা দিয়া পরানের দুখ ঢেক্যা রাখা। ঝড় উঠলে সে কি থাকে? উড়ে যায়। ভিতরের গুমোট বাইরে এসে আকাশে বাতাসে ছড়ায়ে যায়। বায়ুতে বেদের জন্যে পাগল হয় না ধন্বন্তরিভাই। মুই পাগল হই নাই। পিঙলাসেও পাগল হয় নাই। মা-বিষহরির দয়া।
মাস চারেক পর। সে তখন কার্তিকের প্রথম। শিবরামের সঙ্গে শবলার দেখা হল। তার নতুন ঠিকানায়, আয়ুর্বেদ-ভবনের সামনে এসে চিমটে বাজিয়ে হাঁক তুলে দাঁড়াল।
জয় মা-বিষহরি! জয় ধন্বন্তরি! তুমার হাতে পাথরের খলে বিষ অমৃতি হোক; ধনে পুত্যে লক্ষ্মীলাভ হোক। যজমানের কল্যাণ কর, ভোলা মহেশ্বর।
শিবরাম জানতেন, বেদেরা আবার তার এখানে আসবে। ঠিকানা তিনি দিয়ে এসেছিলেন। নারীকন্ঠের ডাক শুনে ভেবেছিলেন–পিঙলা। একটু বিস্মিত হয়েছিলেন, পিঙলা পাগল হয় নাই? কিসে আরোগ্য হল? দেবকৃপা? বিষহরির পূজারিণীর ব্যাধি বিষহরির কৃপায় প্রশমিত হয়েছে? রসায়নের ক্রিয়া যেমন দুই আর দুই যোগ করলে চারের মত স্থিরনিশ্চয়, দেহের অভ্যন্তরে ব্যাধির প্রক্রিয়াও তেমনি সুনিশ্চিত; ব্যাধিতে তাই ঔষধের রসায়ন প্রয়োগে দুই শক্তিতে বাধে দ্বন্দ্ব, কোথাও জেতে ঔষধ, কোথাও জেতে ব্যাধি। ঔষধ প্রয়োগ না করলে ব্যাধির গতিরোধ হয়। না, হবার নয়। এ সত্যকে তিনি মানেন। আয়ুর্বেদ-পঞ্চমবেদ, বেদ মিথ্যা নয়। কিন্তু তার পরেও কিছু আছে, অদৃশ্য শক্তি, দৈব-অভিপ্ৰায়, দেবতার কৃপা! দৈববলের তুল্য বল নাই। আচার্য ধূর্জটি কবিরাজের শিষ্য হয়ে তিনি কি তা অবিশ্বাস করতে পারেন? রহস্য উপলব্ধির একটু প্রসন্ন হাসিতে তার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। বিস্ময় কেটে গেল। বেরিয়ে এলেন তিনি।
বেরিয়ে এসে কিন্তু তিনি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন।
সামনে দাঁড়িয়ে পিঙলা নয়—শবলা।
পিঙলা দীর্ঘাঙ্গী; শবলা বালিকার মত মাথায় খাটো। আজও তাকে পনের-ষোল বছরের। মেয়েটির মত মনে হচ্ছে।
পিঙলা দীর্ঘকেশী; শবলার চুল কুঞ্চিত কোঁকড়ানো, একপিঠ খাটো চুল।
শবলার চোখ আয়ত ডাগর; পিঙলার চোখ ছোট নয়, কিন্তু টানা–লম্বা।
শবলাকে পিঙলা বলে ভুল হবার নয়।
শবলার পিছনে সাঁতালীর কজন অল্পবয়সী বেদে, বয়স্ক লোকের মধ্যে নটবর আর নবীন।
শিবরাম বুঝতে পারছিলেন না কিছু। শবলা?
শবলা ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করে বললে—পেনাম ধন্বন্তরিভাই! তুমার আঙ্গিনায় আমাদের জনম জনম পেট ভরুক, আমাদের নাগের গরল তুমার খলে তুমার বিদ্যায় অমৃতি হোক, তুমার জয়জয়কার হোক।
প্ৰণাম সেরে উঠে নতজানু হয়ে বসেই বললে—আমাকে চিনতে লারছ ভাই?
এতক্ষণে বিস্ময় এবং স্নেহভরা কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন শিবরাম–শবলা!
–হাঁ গ। শবলা।
–আর সব? পিঙলা? গঙ্গারাম? ভাদু?—এরা? পিঙলা পাগল হয়ে গেছে, না?
শবলা তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। শিবরাম বুঝলেন, শবলা প্রশ্ন করছে—জানলে কি। করে? শিবরাম বিষণ্ণ হেসে বললেন—তার দেহে বায়ুরোগের লক্ষণ আমি দেখে এসেছিলাম। মানসিক দৈহিক পীড়ন সে নিজেই অত্যন্ত কঠোর করে তুলেছিল। বায়ু কুপিত হয়ে উঠল স্বাভাবিক ভাবে। আমি বলেছিলাম তাকে ওষুধ ব্যবহার করতে। কিন্তু–
–বায়ুরোগ? বায়ুর কোপ!
হাসলে শবলা। বললে—বেদের কন্যে সহজে পাগল হয় না ধন্বন্তরিভাই। পিঙলার মনে যে ঝড় উঠিল ভাই, সে ঝড়ে পেলয় হয়ে গেল সাঁতালীতে। মন্বন্তর হয়ে গেছে সাঁতালীতে। নাগিনী কন্যের মুক্তি হলছে।
***
সে এক বিচিত্র বিস্ময়কর ঘটনা।
শবলা বলে গেল, শিবরাম শুনে গেলেন।
শুনতে শুনতে মনে পড়ল আচার্য ধূর্জটি কবিরাজের কথা। একদিন তুলসীর পাতা তুলতে তুলতে বলেছিলেন, তুলসীর গন্ধ তৃপ্তিদায়ক কিন্তু পুষ্পগন্ধের মত মধুর নয়। স্বাদেও সে কটু। আমি যেন ওর মধ্যে অরণ্যের বন্য জীবনের গন্ধ পাই। তুলসীর জন্ম বৃত্তান্ত জান তো? সমুদ্রগর্ভে বা সমুদ্রতটে থাকত যে দৈত্যজাতি, তাদের রাজা জলন্ধর বা শঙ্খচূড়ের পত্নী তুলসীর তপস্যায় শঙ্খচূড় ছিল অজেয়। সে তো সব জান তোমরা। বিষ্ণু প্রতারণা করে তার তপস্যা ভঙ্গ করলেন; স্বামীর অমরত্ব লাভ ঘটল না, জলন্ধর বা শঙ্খচূড় নিহত হলেন। কিন্তু তুলসী মানবজীবনের মহাকল্যাণ নিয়ে, বিষ্ণুর মস্তকে স্থানলাভের অধিকার নিয়ে পুনর্জন্ম লাভে সার্থক হলেন। ওর গন্ধের মধ্যে আমি যেন সেই সমুদ্রতটের দৈত্যনারীর গাত্রগন্ধ পাই।
পিঙলাও কি কোনো নূতন বিষনাশিনী লতা হবে না নূতন জন্মে?
মহাদেব বেদের বুকে বিষের কাঁটা বসিয়ে দিয়ে প্রত্যুষে কুহক-আলোকের মত আবছা আলো আবছা-অন্ধকারের মধ্যে নগ্নিকা শবলা ভরা গঙ্গায় ঝাঁপ খেয়ে পড়েছিল। সে প্রতিশোধ নিয়েছিল। সে তখন প্রায় উন্মাদিনী।
বন্য আদিম নারীজীবন; চারিদিকে নিজেদের সমাজে অবাধ উদ্দাম জীবন-লীলা; তার প্রভাবে এবং স্বাভাবিক প্রবৃত্তিতে তার জীবনেও কামনা জেগেছিল, উদ্দাম হয়ে উঠেছিল—সে কথা শবলা গোপন করে নাই, অস্বীকার করে নাই। অনেক কাল পূর্বে প্রথম পরিচয়ে ভাই-বোন সম্বন্ধ পাতিয়েও সে পাতানো-ভাইয়ের কাছে চেয়েছিল অসামাজিক অবৈধ ভেষজ। সন্তানঘাতিনী হতেও সে প্রস্তুত ছিল, সে কথা বলতেও লজ্জা বোধ করে নাই। সে স্বীকার করেছিল, এক বীর্যবান বেদে তরুণকে সে ভালবেসেছিল, কিন্তু তাকে স্পর্শ করতে ভয় তার তখনও ছিল, পারে নাই স্পর্শ করতে। তাকে সুকৌশলে মহাদেব শিরবেদে সর্পাঘাত করিয়ে খুন করেছিল। তারপরই সে উন্মত্ত হয়ে উঠল।
শবলা বললে—আমার চন্ধু দুটা তুলি দিয়া ঢাকা ছিল ধরমভাই, খুল্যা ফেলালম মনের জ্বালায়—টেন্যা ছিড়া দিলম। চন্ধুতে আমার সর পড়িলরাতিরে দেখলম রাতি, দিনেরে দেখলম দিন। শিরবেদের স্বরূপ দেখ্যা পরানটায় আমার আগুন জ্বল্যা উঠল। হয়ত উয়ারও দোষ নাই; কি করিবে? বেদেকুলের দেবতা দুটি—একটি শিব, আরটি বিষহরি। শিব নিজে ধরমভেরষ্ট হয়্যা কুচনীপাড়ায় ঘুরে আপন কন্যের রূপে মোহিত হয়। বেদেকুলের কপাল।
শিবরাম ম্লান হেসে বলেনওদের দেবতা হওয়া সাধারণ কথা নয়। ওই শিবই পারেন। ওদের দেবতা হতে। ওদের পূজা নিতে দেবতাটি অম্লানমুখে গ্রহণ করেছেন উচ্ছঙ্খলতার অপবাদ, ধরেছেন বর্বর নেশাপরায়ণের রূপ, আরও অনেক কিছু। নিজেদের সমাজপতির শ্রেষ্ঠ শক্তিমানের জীবনের প্রতিফলনে প্রতিফলিত হয়েছেন রুদ্রদেবতা। বল্লাহীন জৈবিক জীবন স্বেচ্ছাচারে যা চায়, যা করে, তার দেবতাও তাই করেন। তারা বলে—দেবতা করে, তারই প্রভাব পড়ে মানুষের উপর। উপায় নাই, পরিত্রাণ নাই। প্রাণপণ চেষ্টা হয়ত করে, তবু অন্তরের অন্তস্থলে স্বেচ্ছাচারের কামনা কুটিলপথে আত্মপ্রকাশ করে।
মহাদেব শিরবেদের মধ্যেও সেই উদ্দাম ভ্ৰষ্ট জীবনের নিরুদ্ধ কামনা শবলা আবিষ্কার করেছিল। সে বলে—শিরবেদেদের উপরে শিবই চাপিয়ে গিয়েছেন তাঁর সেই ভ্ৰষ্ট জীবনের কামনার অতৃপ্তি। সবসবসকল শিরবেদের মধ্যেই তা প্রকাশ পায়। বেদেরা তা ধরতে পারে না, দেখতে পায় না, দু-একজন পেলেও তারা চোখ ফিরিয়ে থাকে। মহাদেবের দৃষ্টিও নাকি পড়েছিল শবলার উপর। চোখে দেখা যেত না, শবলা তা অন্তরে অন্তরে অনুভব করেছিল।
কিন্তু শবলা নাগিনী কন্যা হলেও তার তো বিষহরির মত নাগভূষায় ভূষিতা, গরলনীল, বিসরী মূর্তি ধরবার শক্তি ছিল না। তাই সে সেদিন শেষরাত্রে অসহ্য জীবনজ্বালায় উন্মাদিনী হয়ে তার নৌকায় গিয়ে উঠেছিল জলচারিণী সরীসৃপের মত। জলে ভিজে কাপড়খানা ভারী হয়ে উঠেছিল, শব্দ তুলেছিল প্রতি পদক্ষেপে, গতিকেও ব্যাহত করছিল; তাই সে খুলে ফেলে দিলে কাপড়খানা। উন্মাদিনী গিয়ে দাঁড়াল তার পাশে।
শিবরাম সে সব জানেন। শুনেছিলেন। বিস্মিত হন নাই। যে আগুন দেখেছিলেন তিনি। শবলার চোখে, তার যে উত্তাপ তিনি অনুভব করেছিলেন—তাতে শবলার পক্ষে অসম্ভব কিছু ছিল না। সব শুনতে প্রস্তুত ছিলেন। শিবরাম বললেন—সে সব আমি জানি শবলা।
–জান? শবলা কঠিন দৃষ্টিতে শিবরামের দিকে তাকিয়ে বললে—কি জান তুমি? মুই তার বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলম, সে আমারে দধিমুখী ভেবেছিল–
ঠোঁট বেঁকিয়ে বিচিত্ৰ হাসি হেসে সে বললে—এক কুড়ি চার বছর তখন আমার বয়স দধিমুখী দু কড়ি পারাল্ছে। আমাকে মনে ভেবেছিল দধিমুখী! মুই তখন সাঁতালী পাহাড়ের কালনাগিনীর পারা ভয়ঙ্করী। চোখে আগুন, নিশ্বাসে বিষ, ছামনে পড়ছে যে ঘাসবন সে ঝলসে কালো হয়ে যেতেছে। ওদিকে আকাশে ম্যাঘের ঘটাপটার মাঝখানে জেগা রইছেন বিষহরি চোখে তার পলক নাই, হাতে তাঁর দণ্ড; ইদিকে ঘুরছে হিন্তালের লাঠি হাতে চাঁদো বেনে—তার নয়নে নিদ্যে নাই, নাগিনীর অঙ্গে বিষের জ্বালা—বিষহরি তারে খাওয়াছেন বিষের পাথার। ঠিক তেমুনি আমার দশা তখুন। জ্ঞান নাই, গমি নাই, মরণে ভয় নাই, ধরমে ডর নাই, বুকে আমার সাতটা চিতার আগুন, সর্ব অঙ্গে আমার মরণ-জ্বরের তাপ। ভোর হতেছে তখন, চারিদিকে কুহকমায়ার আলো, সেই আলোতে সব দেখাইছিল ছায়াবাজির পারা। গাছ-পালা গাঁ-লা—আমার চোখে মুই তাও দেখি নাই; মুই দেখেছিলম অন্ধকার, সাত সমুদুরের পাথারের মত অন্ধকার থইথই করছিল আমার চোখের ছামনে। ঝাঁপ দিব হারায়ে যাব। আমার তখুন কারে ডর? কিসের ডর? মই যাব লরলে—উকে লিয়া যাব না? বুকের উপর নিজেরে দিলাম। ঢেল্যা। তাপরে দিলম পাপীর ঠিক কলিজার উপর কাটাটা বিধ্যা, লোহার সরু কটা, সুচের মত মুখ, ভিতরটা পাতাতে ভরা থাকে বিষ। সে বিষের ওষুদ নাই
তারপর সে ছুটে বেরিয়ে এসে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ভদ্রের দুকূল-পাথার গঙ্গার বুকে। কলকল-কলকল শব্দ, প্রচণ্ড একটা টান—মধ্যে মধ্যে শ্বাসকষ্টে বুক ফেটে যাচ্ছিল নইলে ভেসে চলেছে, যেন দোলায় দুলে চলেছে, আকাশ নাই, মৃত্তিকা নাই, চন্দ্ৰ নাই, সূর্য নাই, বাতাস নাই। শবলা বললে—বাস্, মনে হল হারায়ে গেলম। মুছে গেল সব। মনে হল খুব উঁচু ডাল থেক্যা পড়েছি, পড়ছি পড়ছি পড়ছি। তাপরেতে তাও নাই। কিন্তু হারায়ে গেলম না। চেতন হল—তখুন দেখি মুই একখানা লায়ের উপর শুয়ে রইছি।
—সে লা এক মুসলমান মাঝির লা। ইসলামী বেদে। বেদের কন্যেরে দেখেই সে চিনেছিল। চিহ্ন আমার ছিল। শবলা হাসলে।
শবলা শক্ত করে এলোখোপা বেঁধেছিল সেদিন। খোপায় খুঁজে নিতে হয়েছিল ওই বিষকাটা; আর এলোখোপার পাকানো চুলের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছিল পদ্ম-গে খুরার একটা বাচ্চা। প্রয়োজন হলে ওকেও ব্যবহার করবার অভিপ্রায় ছিল।
—শুনলুম যখন ভাই, কি সে ইসলামী বেদে, তখুন হাসল ম। বুঝলম, মা আমাকে সাজা দিছেন। এই ভাদর মাসের দুকূল-পাথার গাঙের লালবরন জলের পরতে পরতে ভবযন্ত্রণা থেকে মুক্তির পরশ; মহাপাপীর হাড়ের টুকরা কাকে চিলে ঠোঁটে কর্যা নিয়া যায়, যদি কোনো রকমে পড়ে মা-গঙ্গার জলে, তবে বরকের পথ থেক্যা স্বরগের রথ এস্যা তারে চাপায়ে ডক্কা বাজায়ে নিয়া যায়। আমার করমদোষ ছাড়া আর কি কইব? পাথার গাঙে কঁপায়ে পড়লম, বুক ফেট্যা গেল বাতাসের তরে, চেতনা হর্যা গেল, আর মুছা গেল, জুড়ায়ে গেল জ্বালা, ভুলে গেলম মনিষ্যি-জীবনের সকল কথা। বুলব কি ভাই, চুলে জড়ানো নাগের ছানা, যে নাগ ছটা মাস মাটির তলে থাকে, সে নাগটাও মরে গেছিল কিন্তু আমার মরণ হয় নাই। বুঝতে আমার বাকি রইল না, বিষহরি আমাকে ফিরায়ে দিছেন; জাতি নিয়া, কুল নিয়া ফিরায়ে পাঠায়ে দিছেন নরলোকে এক ইসলামী বেদের ঘরে দুঃখভোগের তরে।
কণ্ঠস্বর হঠাৎ দৃঢ় হয়ে উঠল শবলার। সে বললে, উপরের দিকে মুখ তুলে তাদের দেবী বষিহরিকে উদ্দেশ্য করে বললে কথাগুলি তা পাঠাও তুমি। একদিন তুমি নিজে বাদ করলা চাপদা বেনের সাথে, সে বাদে জীবন দিলেক নাগেরা; তুমি রইল্যা নিজের আটনে বস্যা, কালনাগিনীরে পাঠাইলা সোনার লখিন্দরকে দংশন করতে। কি পাপ—কি দোষ করেছিল লখিন্দর-বেহুলা? ছলতে হল বিষবেদের প্রেধানকে। তুমি পেলে পূজা, কালনাগিনী বেদেকুলে জনম নিয়া জনমে জনমে–তিলসুনা খাঁটিছে। আমাকে ফিরা পাঠাইলা নরলোকে দুঃখ ভোগের তরে বিধর্মীর ঘরে। ভাল। দুখের বদলে সুখই করিব মুই। যাক ধরম। স্বামী নিব, ঘর গড়িব, দুয়ার গড়িব, হাসিব নাচিব গাহিব, পুত্যকন্যায় সাজাইব আমার সংসার, তাপরেতে মরিব, তখুনি নরকে যাই যাইব। যমদণ্ডের ঘায়ে যদি আঙুলপেমান-পরান-পুতুলি আছাড়িপিছাড়ি করে, তবু তুমারে ডাকিব না।
–কিন্তু তা লারলম। দিলে না বিষহরি, দিলে না ওই ইসলামী বেদে। ওই বেদেরেই মুই পতি বলা বরণ করিছিলম। ইসলামী হলি কি হয়—দেবতা তো বেদের বিষহরি! তারে তো সি ভুলে নাই। সাঁতালীর বেদেকুলের যারা সাঁতালী থেক্য গাঙুলের জলে না ভাসায়ে আসিবার পথে সঙ্গ ছাড়িছিল, থেক্যা গেছিল পদ্মাবতীর চরে—তারাই তো হইছে ইসলামী বেদে। ভুলিবে কি কর্যা? সে কইল-বেদের কন্যে, ঘর বাঁধিবার আগে মায়েরে পেসন্ন কর। লইলে মায়ের কোপে, চাঁদো বেনের দশা হইবে। ঝড়ে বা ড়ুবিবে, পুত্যকন্যা নাগদংশনে পরান দিবে; সুখের আশায় ঘর বাঁধিব, দুখের আগুনে জ্বল্যা ছারখার হয়া যাবে। মায়েরে পেসন্ন কর। মনে কর কন্যে-নাগিনী কন্যের অদেষ্ট, পেথম সন্তানটিরে তারে।
শিউরে উঠল শবলা।
প্ৰবাদ আছে নাগিনী কন্যা যদি ভ্ৰষ্ট হয়ে পালিয়ে গিয়ে বাচে, সে যদি ঘর-সংসার বাঁধে, সে যদি তার জাতি-ধর্ম সব ত্যাগ করে, তবে মা-বিষহরির অভিশাপ গিয়ে পড়ে তার মাতৃত্বের উপর। সন্তান কোলে এলেই তার নাগিনী-স্বভাব জেগে ওঠে। নাগিনী যেমন নিজের সন্তান ভক্ষণ করে, নাগিনী কন্যা তেমনই সন্তান হত্যা করে।
আত্মসংবরণ করে শবলা উদাস দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল আকাশের দিকে।
কিছুক্ষণ পর একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললে—আর হল না ঘরবাধা। জমি পেলম, বাঁশ খড় দড়ি সবের ব্যবস্থাই করলম মনে মনে, পুঁজিরও অভাব ছিল নাই; কিন্তু তবু হল নাই। পচি আকাশের দিকে তাকিয়ে-কালো মেঘের কথা মনে পড়িল, বিদ্যুতের আলো মনে হইল, কড় কড় ডাক যেন মাথার মধ্যে ডেক্যা উঠল। ঘর বাঁধা হল নাই। পথে পথে ঘুরতে লাগলম। যোগিনী সাজলম, সাঁতালীর বিল বাদ দিয়া মা-বিষহরির আটনে আটনে ঘুর্যা বেড়ায়ে ধরনা দিলম। শুধু আমার তরে লয় ভাই, যোগিনী সেজ্যা তপ যখুন করছি, তখুন নাগিনী কন্যের তরেও খালাস চাইলম। বললম-জনী গ, শুধু আমাকে লয়, তুমি কন্যেরে এই বন্ধন থেকা খালাস দাও-খালাস দাও-খালাস দাও। কামরূপ গেলাম। মা-চণ্ডী মা-কামিক্ষেকে বললম–মা, আমারে খালাস দাও কন্যেরে খালাস দাও।পথে দেখা ঠাকুরের সাথে।
–কার সঙ্গে?
—নাগু ঠাকুর গ! মাথায় রুখু চুল, বড় বড় চোখ, খ্যাপাখ্যাপা চাউনি; সোনার পাতে মোড়া লোহার কপাটের মতুন এই বুক, তাতে দুলছে রুদ্দারিক্ষির মালা, অরুণ্যের দাঁতাল হাতির মতুন চলন-ঠাকুরকে দেখ্যা মনে হইল মহাদেব। দেখে তারে ডেকে কইলম-তুমি ঠাকুর কে বটে, তা কও? ঠাকুর কইল—আমার নাম নাগু ঠাকুর—মুই চলেছি মা-কামিথ্যের আদেশের তরে, মা-বিষহরির আদেশের তরে।
শিবরাম সবিস্ময়ে বললেন—তুমিই সেই যোগিনী?
—হুঁ, শবলা পোড়াকপালীই সেই যোগিনী।
শবলা বললে—ধন্বন্তরিভাই, ঠাকুরের কথা শুনা পিঙলার ভাগ্যের পরে আমার হিংসা হচ্ছিল। হায় রে হায়, রাজনন্দিনীর এমন ভাগ্যি হয় না; বেদের কন্যে মন্দভাগিনীর সেই ভাগ্যি!
শিবরাম বলেন—সত্যিই ঈর্ষার কথা। এমন বীরের মত গৌরবর্ণ পুরুষ, গেরুয়া পরা সন্ন্যাসীসে ওই বেদের মেয়ের জন্য জাতি ধর্ম সন্ন্যাস ইহকাল পরকাল সব জলাঞ্জলি দিয়ে। বনে পাহাড়ে দুর্গম পথে চলেছে, তাকে না পেলে তার জীবনই বৃথা, ওই বন্দিনী কন্যাটির মুক্তিই হল তপস্যা-এ ভাগ্যের চেয়ে কোন উত্তম ভাগ্য হয় নারীজীবনে? এ দেখে কোন নারীর না সাধ হয়–হায়, আমার জন্য যদি এমনি করে কেউ ফিরত!
বিপুলবিস্তার কোনো নদী, বোধহয় ব্রহ্মপুত্রের তীরে—ঘন বনের মধ্যে শবলার সঙ্গে নাগু ঠাকুরের দেখা হয়েছিল। বীরবপু নির্ভীক নাগু ঠাকুর মনের বাসনায় একা থ চলছিল। মধ্যে মধ্যে ডাকছিল—শঙ্করী! শঙ্করী। বিষহরি! শিবনন্দিনী!
হাতে ত্রিশূল দণ্ড; কখনও কখনও অরণ্যের গাঢ় নির্জনতার মধ্যে ছেলেমানুষের মত হক মেরে প্রতিধ্বনি তুলে কৌতুক অনুভব করেছিল—এ–প!
চার দিক থেকে প্রতিধ্বনি উঠছিল—এ–প! এ—প! এ–প!
সে প্রতিধ্বনি মিলিয়ে যেতে না যেতে আবার হেঁকে উঠছিল—এ—প!
শবলা বিস্মিত মুগ্ধ হয়ে নবীন সন্ন্যাসীর সঙ্গে পরিচয় করেছিল।
নাগুর কথা শুনে বুকের ভিতরটা কেমন করে উঠেছিল শবলার। সাঁতালী মনে পড়েছিল। পিঙলাকে মনে পড়েছিল। হিজলের বিল মনে পড়েছিল।
শবলার উত্তেজনার সীমা ছিল না। প্রথমেই সে সেই উত্তেজনায় ঠাকুরকে ধিক্কার দিয়ে বলেছিল—ঠাকুর, কেমন পুরুষ তুমি? এক কন্যেরে তোমার ভাল লেগেছে, তার তরে তুমার পিথিমী শূন্য মনে হচ্ছে, অথচ তুমি তারে কেড়ে লিতে পার না? এমুন বীর চেহারা তুমার, এমুন সাহস, বাঘেরে ডরাও না, সাপেরে ডরাও না, পাহাড় মান না, নদী মান না, আর কয়টা বেদের সাথে লড়াই করা কন্যেটাকে কো লিতে পার না?
নাগু ঠাকুর বলেছিল-পারি। নাগু ঠাকুর পারে না-তাই কি হয়? নাগু ঠাকুরের নামে রাঢ়ের মাটিতে মাটি খুঁড়ে ওঠে তার সাকরেদ শিষ্যের দল। মেটেল বেদে, বাজিকর, ওস্তাদ, গুণীন—এরাই শুধু নয়, নাগু ঠাকুর কুস্তিগীর, নাগু ঠাকুর লাঠিয়াল। নাগু সব পারে। সব পারে বলেই তা করব না। কন্যেকে কেড়ে আনলে তো কন্যে হবে ডাকাতির মাল। তাকে মুক্তি দিয়ে জয় করতে হবে। পিঙলা কন্যে লম্বা কালো মেয়ে, টানা দুটি চোখে আষাঢ়ের কালো মেঘ, কখনও বিদ্যুতের ছটা, কখনও সন্ধের অ্যাঁধারের মত ছায়া, পিঠে একপিঠ রুখু কালো চুল—সে হাসিমুখে লজ্জায় মাটির দিকে চেয়ে আস্তে আস্তে এসে আমার হাত ধরবে, তবে তো তাকে পাব আমি।
—আঃ–ধন্বন্তরিভাই, পরানটা আমার জুড়ায়ে গেল; পরানের পরতে পরতে মনে হল। রামধনু উঠেছে দশ-বিশটা।
–মায়েরে সেদিন পরান ভরা ডাকলাম। মনেও লিলে, কি, পিঙলা যখুন এমুন করা বেদেকুলের মান রেখেছে, আর নাগু ঠাকুরের মতুন এমন যোগী মানুষ যখুন মুক্তি যুঁজিতে আসিছে—তখুন মুক্তি ইবার হবে। রাতে সে দিনে স্বপন পেলম মুই। স্বপনে দেখলম পিঙলারে, হাতে তার পদ্মফুল—বিষহরির পুষ্প; সে আমাকে হেস্যা কইল—মুক্তি দিলে জননী, নাগিনী কন্যের খালাস মিলল গ শবলা দিদি। ধড়মড় করা উঠা বসলম। শেষত, সনসন করছে, ঝিঝি পোকার ডাকে মনে হচ্ছে অরুণিতে গীত উঠিছে, আমার বেদে ঘুমে নিথর; নাগু ঠাকুর ছিল একটা পাথরের উপর চিত হয়্যা, বুকে দুটা হাত, নাক ডাকিছে যেন শিঙা বাজিছে, শুধু জ্যো রইছে। মাথার কাছে ঝাঁপির ভিতর একটা নাগ-মহানাগ শঙ্খচূড়, ঠাকুরের নাক ডাকার সাথে পাল্লা দিয়া গর্জাইছে। সে-ই শুধু আমার স্বপনের সাক্ষী। ঠাকুরকে ডেক্যা তুল্যা কইলাম বিবরণ। কইলাম সাঁতালীতে গিয়া বলিয়ো তুমি, মুক্তি হইছে কন্যের, দেনা শোধ হইছে। এই নাগ তার সাক্ষী।
–কিন্তু সাঁতালীর বেদেরা মানলে নাই সে কথা। গঙ্গারাম শয়তানের দোসর, সে নাগু ঠাকুরের বুকে মারিল আচমকা কিল। নাগ দিল না সাক্ষী। নাগু ঠাকুর তো সে স্বপন নিজে দেখে নাই; তাই নিজে সেই আদেশের তরে চলা এল। পিঙলারে কইল—মুই আনিব, পেমান আনিব। মুক্তি হইছে।
কন্যা কইল—
শিবরাম সে কথা জানেন। পিঙলা দুই পাশে তালগাছের সারি দেওয়া রাঢ়ের সেই আঁকাবাকা মাটির পথের দিকে চেয়ে থাকে। আসবে নাগু ঠাকুরমহিষ কি বলদ কিছুর উপর চড়ে। কবে, কখন আসবে?
—রাঢ়ে আছে আর এক চম্পাইনগর, জান? আছে, আছে। বেহুলা নদীর ধারে চম্পাইনগরে বিষহরির আটন। নাগপঞ্চমীতে বিষহরির পূজার দিন-আজও গ্রামের বন্ধুরা শ্বশুরবাড়িতে থাকে। না, সেদিন তাদের বাপের বাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা। চম্পাইয়ের বধুরা বেহুলার বাসরের কথা স্মরণ। করে সেদিন চম্পাইনগর ছেড়ে চলে যায়। বাপের বাড়িতে গিয়ে মনসার উপবাস করে, চম্পাইনগরে বিষহরির দরবারে পূজা পাঠায়। সেই চম্পাইনগরে গিয়েছিল নাপ্ত ঠাকুর। সামনে আসছে নাগপঞ্চমী। চারদিক থেকে আসবে দেশান্তরের সাপের ওস্তাদেরা।
নাগু ঠাকুর সেখানে দিলে ধনা, মনে মনে বললে—যোগিনীকে দিলে যে আদেশ, সেই আদেশ আমাকে দাও বিষহরি। আদেশ না পেলে উঠব না। অন্ন জল গ্রহণ করব না।
এইখানে আবার দেখা হল শবলার সঙ্গে। শবলাও ওখানে এসেই তার ব্ৰত শেষ করবে। মুক্তি মিলেছে। তীর্থ-পরিক্রমায় দুটি তীর্থ বাকি। বেহুলা নদীর উপর চম্পাইনগর আর হিজলে সাঁতালী গাঁয়ে মা-বিষহরির জলময় পদ্মালয়, যেখানে লুকানো ছিল চাদসদাগরের সপ্তডিঙা মধুকর।
চম্পাইনগরে সাতালীর বিষবেদেরা যায় না। সে এ চম্পাইনগরই হোক, আর রাঙা মাটি চম্পাইনগরই হোক। মূল সাঁতালীর চিহ্ন নাই, কি দেখতে যাবে? আর কোন মুখেই বা যাবে? কিন্তু শবলা গেল। তার মুক্তি হয়েছে, আর সে তো তখন সাঁতালীর বেদেনী নয়।
নাগু ঠাকুরের সেই বীরের মত দেহের লাবণ্য শুকিয়ে এসেছে উপবাসে। কিন্তু চোখ দুটো হয়েছে ঝকমকে দুটো স্ফটিকের মত। বুকের উপর হাত রেখে পাথরে মাথা দিয়ে স্থিরদৃষ্টিতে উপরের দিকে চেয়ে ঠাকুর শুয়ে ছিল। একটা বড় কাঁকড়া বটগাছের তলায় শুয়ে ধরনা দিয়েছিল।
শবলা তাকে দেখে সবিস্ময়ে বললে–ঠাকুর।
ঠাকুর চমকে উঠল—যোগিনী।
—কই? পিঙলা কই? পিঙলা বহিন? ভাগ্যবতী?
–পিঙলাকে এখনও পাই নাই। প্রমাণ চাই।
–প্রমাণ?
–হ্যাঁ, প্রমাণ। প্রমাণ নিয়ে যাব, গঙ্গারামের বুকে কিল মারব, তারপর। হাসলে নাগু ঠাকুর, বললে—তারপর পিঙলাকে নিয়ে নাপ্ত ঠাকুর-ভৈরব আর ভৈরবী—বাধবে ডেরা, নতুন আশ্রম।
–নাগ? নাগ দিলে না সাক্ষী?
–না।
–কি সাজা দিছ তারে? চোখ জ্বলে উঠল শবলার।
—সেটাকে ফেলে এসেছি সাঁতালীতে। তাকে সাজা দেওয়া উচিত ছিল। টুঁটিটা টিপে টেনে ছিঁড়ে দিতে হত। কিন্তু মনের ভুল–মনেই পড়ে নাই।
–পিঙলা কি কইল?
–পিঙলা আমার পথ চেয়ে থাকবে। বলেছে—মুক্তির আদেশের প্রমাণ নিয়ে তুমি এস; আমি থাকলাম পথ চেয়ে।
—কি করিছ ঠাকুর? আঃ, কি করিছ তুমি? সাঁতালীর নাগিনী কন্যে বলিল-তুমার পথ চাহি থাকিবে; আর তুমি তারে সেথা ফেল্যা রেখ্যা আসিলে? আঃ, হায় অভাগিনী কন্যে!
–কেন? কি বলছ তুমি?
–তার পরানটা তারা রাখিবে না।
–না না। তুমি জান না। আর সেদিন নাই। পিঙলাকে তারা দেবতার মত দেখে।
–মুই জানি না, তুমি জান ঠাকুরঃ মুই কে জান, মুই শবলা-পাপিনী নাগিনী কন্যা। শবলা ছুটে গিয়ে বিষহরির সামনে উপুড় হয়ে পড়ল। বললে—আদেশ কর মা, তুমি আদেশ কর ঠাকুরকে। রক্ষে কর মা, কন্যেকে তুমি রক্ষে কর। রক্ষে কর পিঙলাকে।
কি জানে না ঠাকুর? শবলা যে জানে। দেবতার আদেশ হলেও কি সাঁতালীর বেদেরা মুক্তি দিতে চাইবে কন্যাকে? তাদের জীবনের সকল অনাচারের পাপের উচ্ছঙ্খলতার মধ্যে ওই তপস্বিনী কন্যার পুণ্য তাদের সম্বল; অনায়াস নির্ভাবনায় তারা মিথ্যাচরণ করে চলে, ওই অক্ষয় সত্যের ভরসায়। তারা কি পারে তাকে মুক্তি দিতে? দেবতার মত ভক্তি করে? হুঁ, করে হয়ত। পিঙলা হয়ত সে ভক্তি পেয়েছে। কিন্তু যে দেবতা পরিত্যাগ করে যাবে, কি, যেতে চায় তাকে তারা যে বাঁধবে, মন্দিরের দুয়ার গেঁথে দিয়ে চলে যাবার পথ বন্ধ করবে। কি জানে নাগু ঠাকুর।
মা-বিষহরি! আদেশ দাও।
দীর্ঘকাল পরে শবলার মনে হল, সে যেন সেই নাগিনী কন্যা–সম্মুখে বিষহরি, পৃথিবী দুলছে, বিষহরির বারিতে সাপের ফণাগুলি মিলিয়ে গিয়ে জেগে উঠছে মায়ের মুখ; বাতাস ভারী হয়ে আসছে, চারিদিক ঝাপসা হচ্ছে, সে নিজেকে হারিয়ে ফেলছে, তার ভর আসছে। সে চিৎকার করতে লাগল—বাঁচা আমার কন্যেরে বাঁচা, মুক্তি দে, খালাস কর। থরথর করে কাঁপতে লাগল শবলা। অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। সেই মুহূর্তে নাগু ঠাকুর উঠল লাফ দিয়ে, ধরনা ছেড়ে–আদেশ পেয়েছে সে। এই তো আদেশ!
****
সমারোহ করে এর পর নাগু ঠাকুর রওনা হল সাঁতালী।
সঙ্গে তার বিশজন জোয়ান, হাতে লাঠি সড়কি। নিজে চেপেছিল একটা ঘোড়ায়। সঙ্গে একটা বলদের গাড়ি। জন চারেক বায়েন—তাদের কাঁধে নাকাড়া শিঙা। নাগু ঠাকুরের মাথায় লাল রেশমি চাদরের পাগড়ি, গলায় ফুলের মালা। সঙ্গে সাকরেদরা পথের ধারের গাছ থেকে ফুল তুলে নিত্য নূতন মালা গেঁথে পরায়। শবলাও সঙ্গে চলেছে। সে তাকে রহস্য করছে। সে যে পিঙলার বোন, শ্যালিকা।
এবার না বিয়ে করতে চলেছে। সমারোহ হবে না?
সম্মুখে নাগপঞ্চমী।
নাগপঞ্চমীর পূজা শেষ করেই সাঁতালীর বেদেরা নৌকা সাজিয়ে বেরিয়ে পড়বে। দেশদেশান্তরে নৌকায় নৌকায় ফিরবে। নাগের বিষ, শুশুকের তেল, বাঘের চর্বি, শজারুর কাটা। লিবা গো! লিবা!
তার আগে–তার আগে যেতে হবে।
জন্মাষ্টমী চলে গিয়েছে কবে, অমাবস্যা গিয়েছে, আকাশে সন্ধ্যায় দ্বিতীয়ার চাঁদ উঠেছে। চারিপাশে ধান-থইথই মাঠ। আকাশে মেঘের ঘোরাফেরা চলছে। পথে মধ্যে মধ্যে বরযাত্রীর দল থামে। নাগু ঠাকুর হক দেয়—থাম্ বেটারা, ভাদ্র মাসে বিয়ে, নাগু ঠাকুরের বিয়ে, ভৈরব চলেছে—বন্দিনী নাগকন্যাকে উদ্ধার করে আনতে। এ কি সাধারণ বিয়ে রে! লে বেটারা, খাওয়াদাওয়া কর্।
গাড়ি থেকে নামে চাল ডাল শুকনো কাঠ। নামে বোতল বোতল মদ।-খা সব ভৈরবের সঙ্গীরা দত্যি-দানার দল! বাজা নাকাড়া শিঙে। নান্ সব্, নাচ্।
কাল নাগপঞ্চমী।
চতুর্থীর সকালে—ধানভরা মাঠের বাকে, তালগাছের সারির ফাঁক দিয়ে দেখা গেল সাঁতালী গ্রাম। ওই আকাশে উড়ছে হাজারে হাজারে সরালির দল! গগনভেরীরা, বড় বড় হাঁসেরা আজও আসে নাই। ওই দেখা যাচ্ছে ঝাউবন। তার কোলে বাতাসে দুলছে সাঁতালীর ঘাসবন। সবুজ সমুদ্রে ঢেউ খেলছে। মাঠের বুকে আঁকাবাকা বাবলা গাছে হলুদ রঙের ফুল ফুটেছে। মধ্যে মধ্যে শণের চাষ করেছে চাষীরা। হলুদ ফুলে আলো করে তুলেছে সবুজ মাঠ।
সবুজ আকাশে–হলুদ তারা-ফুল ফুটেছে।
–বাজা নাকাড়া শিঙা।
কড়কড় শব্দে বেজে উঠল নাকাড়া। বিচিত্র উচ্চ সুরে শিঙা।
—দে রে বেটারা, হাঁক দে।
বিশ-চব্বিশ জন জোয়ান হেঁকে উঠল—আ-বা-বা-বা-বা!
–জয়–বাবাঠাকুরের জয়!
ঢুকল বরযাত্রীর দল সাঁতালীর মুখে। পথ এখানে সংকীর্ণ।
কিন্তু শবলার বিস্ময়ের সীমা ছিল না।
আজ চতুর্থী কাল পঞ্চমী, বিষহরির পূজা। কই, বিষম-ঢাকি বাজে কই! চিমটা কড়া বাজে কই! তুমড়ী-বাশি বাজে কই!
নাকাড়ার শব্দ শুনে বেদেরা বিস্মিত হয়ে বেরিয়ে এল। কিন্তু—উল্লাস কই?
নাগু ঠাকুর হাঁকলে পিঙলা! কন্যে, আমি এসেছি। এনেছি হুকুম। এনেছি প্রমাণ। দে রে বেটারা, প্রমাণ দে।
বিশ জোয়ান কুক দিয়ে পড়ল।–আ—বা–বা-বা–বা! আ—
হুঙ্কার ছড়িয়ে গেল দিকে দিগন্তরে গঙ্গার কুল পর্যন্ত দিগন্তবিস্তৃত মাঠ জুড়ে।
–হিজল বিলে ঢেউ উঠল, পাখির ঝাক কলরব করে হাজার হাজার পাখায় ঝরঝর শব্দ তুলে উড়ল আকাশে।
বেদের দল সামনে এসে দাঁড়াল। সর্বাগ্রে ভাদু। হাতে তাদের চিমটে।
নাগু লাফিয়ে ঘোড়া থেকে নেমে বললে প্রমাণ এনেছি। কই, পিঙলা কই?
ভাদুর ঠোঁট দুটো কাঁপতে লাগল–নাই। পিঙলা নাই।
–পিঙলা নাই?
—না। চলে গেল। তুমি এনেছিলে কালনাগ, তারই বিষে মাত্র চার দিন আগে নাগপক্ষের প্রথম দিনে। প্রতিপদের প্রভাতে কন্যা পিঙলা এসে দাঁড়িয়েছিল বিশীর্ণা তপস্বিনীর মত। বললে—ডাক সব বেদেদের।
বেদেরা এল। কি আদেশ করবে কন্যা কে জানে? তপস্বিনীর মত কন্যাটির মধ্যে তারা। সাক্ষাৎ নাগিনী কন্যাকে প্রত্যক্ষ করেছিল।
কন্যা বললে—শিরবেদে কই?
গঙ্গারাম তখনও রাত্রির নেশার ঘোরে ঢুলছে। সে বললে—যাব নাই, যা।
কন্যা বললে—বেশ চল, মই যাই তার হোথাকে।
গঙ্গারাম জনতা দেখে টলতে টলতে উঠে দাঁড়াল। পিঙলা কিছু বলবার আগেই সে বললে ভাল হইছে তুমরা আসিছ। মুই ডাকতম তুমাদিগে। এই কন্যেটার অঙ্গে চঁপাফুলের গন্ধ উঠে গভীর রাতে। মুই অ্যানেক দিন থেকাই গন্ধ পাই। কাল রাতে মুই গন্ধ কুথা উঠে দেখতে গিয়া দেখেছি—কন্যের ঘর থেকে উঠে গন্ধ। শুধাও কন্যেরে। কি রে কন্যে, বল্।
স্তব্ধ হয়ে রইল বেদেরা। তারা তাকালে পিঙলার দিকে প্রবাদ সবাই শুনে এসেছে যে, সর্বনাশিনী নাগিনী কন্যা চম্পকগন্ধা হয়ে ওঠে। কিন্তু তারা এমন ঘটনার কথা জানে না। তারা প্রতীক্ষা করে রইল পিঙলার মুখ থেকে প্রতিবাদ শোনবার জন্যে। পিঙলা বললে–হাঁ, ওঠে। দুপহর রাতে বাস উঠে আমার অঙ্গ থেক্যা।
চোখ থেকে তার গড়িয়ে এল দুটি জলের ধারা।
—মুই বুঝতে পারি। মুই জানি না, ক্যানে এমুন হয়। তবে হয়। সিবারে যখুন বুলেছিল। শিরবেদে, তখুন উঠত না। এখন উঠে। মুই আর পারছি না। ঠাকুর বুলেছিল সে মুক্তির আদেশ আনিবে। আসিল না আদেশ। কাল রাতে আমার ঘরের পাশে কে পা পিছলে পড়া গেল। মুই তখুন কাঁদছি। মায়েরে বুছি—আমার ই লাজ তুমি ঢাক জননী! শব্দ শুন্যা দুয়ার খুল্যা দেখলম শিরবেদে। আমার লাজের কথা আর গোপন নাই। ঠাকুর আসিবার কথা, এল নাই। তুমরা এবার বিহিত কর, আমারে বিদায় দাও, মুই চল্যা যাই। বলেই সে নীরবে ফিরে এল নিজের ঘরে। ঘরে ঢুকেই দরজা দুটি বন্ধ করে দিলে।
গঙ্গারাম এতক্ষণে এল ছুটে। তার যেন হঠাৎ চৈতন্য হল।
–কন্যে পিঙলা! কন্যে!
ভাদুও এল ছুটে, সেও সমস্ত ব্যাপারটা বুঝেছে।
হাঁ, ঠিক তাই, ঘরের মধ্যে তখন নাগের গৰ্জনে যেন ঝড় উঠেছে এবং পিঙলা বেদনাকাতর স্বরে প্রার্থনা করছে—খালাস দে জননী,–খালাস! মা গ!
ভাদু লাথি মেরে ভেঙে ফেলে দিলে দরজা।
ঘরের মেঝের উপর পড়ে আছে পিঙলা। আর তার বুকের উপর পড়ে ছোবলের পর ছোবল মারছে ওই শঙ্খচূড়। পিঙলা বললে–হুঁশ করে ভাদুমামা। উরে আমি কামাই নাই ইবার।
পিছিয়ে এল গঙ্গারাম।
ভাদু চিমটের মুখে সাপটার মাথাটা চেপে ধরে বার করে আনলে। পিঙলা হাসলে। দুর্ধর্ষ ভাদু-চিমটের আঘাতেই সাপটাকে শেষ করলে। পিঙলাও চলে গেল। যাবার সময় বলে গেল ঠাকুর মিছা শোনে নাই, মিছা বলে নাই। মুক্তির হুকুম আসিছিল, ওই লাগটাই ছিল ছাড়পত্ত।
তারপর? তারপর আর কি? সাঁতালী দিবসে অন্ধকার।
নাগপক্ষে নিরানন্দ পুরী।…
নতুন নাগিনী কন্যার আর্বিভাব হয় নাই। সাক্ষাৎ দেবতার মত পিঙলা কন্যা নাই। তাই চিমটে বাজছে না, বিষম-ঢাকি বাজছে না, তুমড়ী-বাঁশি বাজছে না। আকাশে বাতাসে ফিরিছে। হায় হায় ধ্বনি।
শুন—ঐ ঝাউয়ের বাতাস, শুন ওই হিজল বিলের কলকলানি–হায় হায়।
অকস্মাৎ দানবের মত চিকার করে উঠল নাগু ঠাকুর–আ—
দু হাতে বুক চাপতে লাগল।
ছোট একটা ছেলে ছুটে এল—উ গ, শিরবেদে ছুটিছে গ। পালাইছে–হুই খালের পানে।
–অ্যাঁ! পলাল! বুক চাপড়ানো বন্ধ করে তে দাঁত টিপে দাঁড়াল নাগু ঠাকুর। তারপর চিৎকার করে উঠল—আমার কিল!
ছুটল নাগু ঠাকুর। সঙ্গে সঙ্গে কজন সাগরেদ।
ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে গঙ্গারাম। প্রাণের ভয়ে পালাচ্ছে।
পিছনে উন্মত্তের মত ছুটছে নাগু ঠাকুর। হাত বাড়িয়ে, চিৎকার করে।
হাঙরমুখী খালের ধারে একটা বিকট চিৎকার করে নাগু ঠাকুর ঝাঁপিয়ে পড়ল গঙ্গারামের উপর। দুজনে দুজনকে জড়িয়ে পড়ল নরম মাটির উপর।
গঙ্গারাম ধূর্ত চতুর; কিন্তু নাগু ঠাকুর উন্মত্ত ভীম।
বার কয়েক উলোট-পালটের পর বুকের উপর চড়ে বসে মারলে কিল। গঙ্গারাম একটা শব্দ করলে। বাক্ রোধ হয়ে গেল।
কিন্তু তাতেও নিষ্কৃতি দিলে না নাণ্ড ঠাকুর। বুকে মারলে আর এক কিল। তারপর তাকে টেনে নিয়ে এল সাঁতালীর বিষহরির আটনের সামনে। তখন গঙ্গারামের মুখ দিয়ে ঝলক দিয়ে রক্ত উঠছে। গড়িয়ে পড়ছে কষ বেয়ে। ফেলে দিলে সবার সামনে। তারপর কাঁদতে লাগল।
সমস্ত দিন কাঁদলে নাগু ঠাকুর। ছেলেমানুষের মত কাঁদলে।
সন্ধের পর মদ খেয়ে চিৎকার করতে লাগল। ঘুরে বেড়াতে লাগল গঙ্গার ধারে ধারে। কন্যে! কন্যে! পিঙলা! কন্যে!
শবলা এতক্ষণে কাঁদলে। বললে–সন্ধ্যার খানিক আগে–গঙ্গারাম মরিল। কি কিল মারছিল ঠাকুর, উয়ার কলিজাটা বুঝি ফেট্যা গেছিল। যেমন পাপ তেমুনি সাজা। ভাদুরে শ্যামকালে বুলেছিল–হাঁ, আমার সাজাটা উচিত সাজাই হছে ভাদু। কন্যেটার মরণের পর থেকা এই ভয়ই আমার ছিল। মরণকালে আমার পাপের কথাটা তুরে বলে যাই।
পিঙলাকে সে আয়ত্ত করতে চেয়েছিল। মহাপাপের বাসনায় পিঙলাকে জালে জড়াতে চেয়েছিল জাদুর জালে।
গঙ্গারাম চতুর ডোমন-করেত। জাদুবিদ্যা-ডাকিনীসিদ্ধ গঙ্গারামের বুদ্ধি কল্পনাতীত কুটিল। শিবরাম বলেন–শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। আমি কবিরাজ, আমি পিঙলার। ওই চম্পকগন্ধের কথা শুনে ভেবেছিলাম—এটা তার বায়ুকুপিত মস্তিষ্কের ভ্রান্তি, মানসিক বিশ্বাসের বিকার। কিন্তু তা নয়। জাদুবিদ্যা শিখেছিল গঙ্গারাম। আর অতি কুটিল ছিল তার বুদ্ধি। প্রকৃতিতে ছিল ব্যভিচারী। তার পাপ দৃষ্টি পড়েছিল পিঙলার উপর। কোনোক্রমে তাকে আয়ত্ত করতে না পেরে সে এক জটিল পন্থার আবিষ্কার করেছিল। কন্যাটির মনে সে বিশ্বাস জন্মাতে চেয়েছিল। তার অঙ্গে চাপার গন্ধ ওঠে। কল্পনা করেছিল, এই বিশ্বাসে শেষ পর্যন্ত উদ্ভ্রান্ত হয়ে পিঙলা একদিন রাতে বের হবে, নয়ত পালাতে চাইবে। পালালে সে তাকে নিয়ে পালাত। মুরশিদাবাদে সে যেত ওষুধের উপকরণ আনতে। সেখান থেকে সে এনেছিল চম্পকগন্ধ। নিত্য মধ্যরাত্রে সে এসে পিঙলার ঘরের পাশে দাঁড়ায়ে সেই গন্ধের আরক ছিটিয়ে দিত। বিচিত্র হেসে ঘাড় নেড়ে শবলা বললে–হায় রে!
পিঙলার মন বুঝবার শক্তি গঙ্গারামের ছিল না। সাধ্য কি?
আবার ঘাড় নেড়ে বলে—তাকেই দুষব কি ধরমভাই, বল?
দৈত্যকন্যা জলন্ধর-পত্নীকে ছলনা করবার সময় দেবতারও ভ্রম হয়েছিল! গঙ্গারামের কি দোষ
মৃত্যুকালে গঙ্গারাম সব পাপ স্বীকার করেছিল—শেষ বলেছিল—ঠাকুর ঠিক সংবাদ আনিছিল, কন্যে ঠিক করেছিল। আমাদের পাপে রোষ করা বিষহরি কন্যারে মুক্তি দিয়াছেন। পিঙলা যেমুন করে চলে গেল, তাপরে আর কি কন্যে আসে? কন্যে আর আসবেন নাই, কন্যে আর আসবেন নাই।
শবলা বললে—সব চেয়ে দুখ ভাই–
সবচেয়ে দুঃখ–মধ্যরাত্রে নাও ঠাকুরের শিষ্যরা মদ খেয়ে উন্মত্ত হয়ে সাঁতালীতে আগুন জ্বালিয়ে চরম অত্যাচার করে এসেছে। মনসার বারি কেড়ে নিয়ে এসেছে।
ভাদু নোটন তারা একদল সাঁতালী ছেড়ে চলে গিয়েছে কোন জঙ্গলের দিকে নিরুদ্দেশ। সাঁতালী পুড়ে গিয়েছে, মনসার বারি নাই, আর কি নিয়ে থাকবে সাঁতালীতে? গভীর অরণ্যে গিয়ে তারা বাস করবে।
আর একদল—এই এদের নিয়ে শবলা বেরিয়েছে রাঢ়ের পথে। আজ এসে দাঁড়িয়েছে শিবরামের চিকিৎসালয়ের সামনে।
আর সাঁতালীতে নয়,–অন্যত্র এদের নিয়ে বসতি স্থাপন করবে। মানুষের বসতির কাছে–গ্রামে তারা স্থান খুঁজছে।
নাগিনী কন্যা আর আসবে না, মুক্তি পেয়েছে, আর তো সাঁতালীতে থাকবার অধিকার নাই। সাঁতালীর কথা শেষ, নাগিনী কন্যের কাহিনী শেষ।–যে শুনিবা সি যেন দু ফোঁটা চোখের জল ফেলিও!