ফাল্গুনে ওই জমিদার-বাড়িতে সাপ ধরে আনার পর। চৈত্র মাস তখন। পিঙলার ভাদুমামা আর এক মানুষ হয়ে ফিরে এল। কিন্তু গঙ্গারাম সেই গঙ্গারাম। বাবুরা কন্যেকে বিদায় করেছিলেন দু হাত ভরে। দশ টাকা বকশিশ, নতুন লালপেড়ে শাড়ি, গিন্নিমা নিজের কান থেকে মাকড়ি খুলে দিয়েছিলেন।
নাগু ঠাকুর তাঁর প্রসাদী কারণ দিয়েছিলেন, আর দিয়েছিলেন অষ্টধাতুর একটা আংটি। নিজে কড়ে আঙুল থেকে খুলে পিঙলার হাতে দিয়ে বলেছিলেন—নে। নাগু ঠাকুরের হাতের আংটি। আমার থাকলে, তোকে আমি হীরের আংটি দিতাম। কামরূপে মা-কামাখ্যার মন্দিরে শোধন করে এ আংটি পরেছিলাম আমি। এ আংটি হাতে রাখলে মনে মনে যা চাইবি তা-ই পাবি।
রাঢ়ের সে আমলের টাকু মোড়ল আর এ আমলে নাগু ঠাকুর—এই দুই বড় ওস্তাদ। টাকু মোড়ল ছিল কামরূপের ডাকিনী-মন্ত্ৰসিদ্ধ। টাকু মোড়ল নিজের ছেলেকে টুকরো টুকরো করে কেটে বড় একটি ঝুড়ি ঢাকা দিত। মন্ত্র পড়ে ডাক দিত ছেলের নাম ধরে। ঝুড়ি ঠেলে বেরিয়ে ছেলে আসত জীবন্ত হয়ে। আজও রাঢ়ের বাজিকরেরা জাদুবিদ্যার খেলা দেখাবার সময় টাকু মোড়লের দোহাই নিয়ে তবে খেলা দেখায়—দোহাই গুরুর, দোহাই টাকু মোড়লের।
নাগু ঠাকুর হালের ওস্তাদ। ডাকিনী-মন্ত্ৰ জানে, কিন্তু ও-মন্ত্রে সে সাধনা করে নাই। নাগু ঠাকুর সাধনা করেছে ভৈরবী—তন্ত্রে। লোকে তাই বলে। তবে ডাকিনী বিদ্যা, সাপের বিদ্যা, ভূত বিদ্যাসবই নাকি জানে নাগু ঠাকুর। ঠাকুরের জাত নাই, ধৰ্ম নাই, কোনো কিছুতে অরুচি নাই, সব জাতির ঘরে যায়, সব কিছু খায়, পৃথিবীতে মানে না কিছুকে, ভয়ও করে না। কাউকে। এই লম্বা মানুষ, গোরা রঙ, রুখু লম্বা চুল, মোটা নাক, বড় বড় চোখ, হা হা শব্দ তুলে হাসে, সে হাসির শব্দে মানুষ তো মানুষ গাছপালা শিউরে ওঠে। গঙ্গারাম ডাকিনী-মন্ত্ৰ জানে শুনে তার সঙ্গে এক হাত বাণ কাটাকাটি খেলতে চেয়েছিল। গঙ্গারাম খেলে নাই। বলেছিল–গুরুর বারণ আছে বেরাহ্মণের সঙ্গে, সনেসীর সঙ্গে খেলবি না।
নাগু ঠাকুর হা-হা করে হেসে বলেছিল—আমার জাত নাই রে বেটা নিয়ে চল্ তোদর গায়ে, থাকব সেখানে, তোদের ভাত খাব আর সাধন করব। এমনি একটা কন্যে দিস, ভৈরবী করব।
চৈত্র মাসের তখন মাঝামাঝি।
হিজলের চরে পোড়ানো ঘাসের কলচে রঙের উপর সবুজ ছোপ পড়েছে। কচি কচি সবুজ ঘাসের ডগাগুলি দেখা দিয়েছে। গাছে গাছে লালচে সবুজ কচি পাতা ধরেছে। বিলের জলের উপর পদ্মের পাতা দেখা দিয়েছে। কোকিল, চোখ-গেল, পাপিয়া পাখিগুলোর গলার ধরা-ধরা ভাব কেটেছে, পাখিগুলো মাতোয়ারা হয়ে ডাকতে শুরু করেছে। ওদিকে হিজলের দক্ষিণপশ্চিম মাঠ তিল-ফসলের বেগুনি রঙের ফুলে হয়ে উঠেছে রূপসরোবর। এদিকে বেদেপাড়ায় হলুদ আর লাল রঙের ঢেউ খেলছে। বেদেপাড়ায় বিয়ে শাদি সাঙার কাল এসেছে; সকল ঘরেই ছেলে-মেয়ে আছে, ধুম লেগেছে সকল ঘরেই।
বাতাসে আউচফুলের গন্ধ, আউচফুল ফুটেছে বিলের চারিপাশে অষ্টাবক্ৰ মুনির মত। আঁকাবাঁকা খাটো গাছগুলি থোলো থোলা সাদা ফুলের গুচ্ছে ভরে গিয়েছে। মাঠময় পাতাঝরা বাঁকাচোরা বাবলা গাছগুলির ডগায় ডগায় সবুজ টোপার মত নতুন পল্লব সবে দেখা দিয়েছে।
সেদিন নোটনের কন্যে আর গোকুলের পুত্র, হীরে আর নবীনের বিয়ে। তিন বছরের হীরে, নবীনের বয়স দশ। গায়ে হলুদ মাখছে বেদে এয়ারা, রঙ খেলছে, উলু পড়ছে; ঢোল কাসি বাজাচ্ছে পাশের গায়ের বায়েনরা, মরদেরা মদ তুলছে, মদের গন্ধে যত কাক আর শালিকের দল এসে পড়া ছেয়ে গাছের ডালে বসেছে। বেলা তখন দুপুরের কাছাকাছি, পাড়ায় শোরগোল উঠল।
নাগু ঠাকুর আসিছে। নাও ঠাকুর।
পিঙলা বসে ছিল একা নিজের দাওয়ায়।
সে চমকে উঠল। বুকের ভিতরটা কেমন যেন গুরগুর করে উঠল। মনে পড়লনাগু ঠাকুরের সে মোটা ভরাট দরাজ কণ্ঠস্বর, তার সেই মূৰ্তি, লম্বা মানুষ, গোরা রঙ, মোটা নাক, বড় বড় চোখ, প্রশস্ত বুক, গলায় রুদ্ৰাক্ষ আর পৈতে। সেই হা-হা করে হাসি। গগনভেরী পাখির ডাকে আকাশে নাকাড়া বাজে, নুগু ঠাকুরের হাসিতে বুকের মধ্যে নাকাড়া বাজে।
নাগু ঠাকুর আসিছে। নাগু ঠাকুর!
উত্তেজনায় পিঙলার অবসাদ কেটে গেল। সে উঠে দাঁড়াল।
যেমন অদ্ভুত নাগু ঠাকুরতেমনি আসাও তার অদ্ভুত। কালো একটা মহিষের পিঠে চড়ে এসে সাঁতালীতে ঢুকল। সঙ্গে হিজলের ঘাসচরের বাথানের এক গোপ। ঠাকুরের কাছে প্রকাণ্ড এক ঝোলা। মহিষের পিঠ থেকে নেমে হা-হা করে হেসে বললে—পথে ঘোষেদের মহিষটা পেলাম, চড়ে চলে এলাম। নে রে ঘোষ, তোর মোষ নে।
তারপর বললে—বসব কোথা? দে, বসতে দে।
তাড়াতাড়ি ভাদু নিয়ে এল একটা কাঠের চৌকি।-বসেন, বাবা বসেন।
বসল নাগু ঠাকুর। বললে—ভাত খাব। কন্যে, তোর হাতেই খাব।
হাতের চিমটো মাটিতে বসিয়ে দিলে। পিঙলা বিচিত্র বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল। সে দৃষ্টিতে যত আতঙ্ক, তত বিস্ময়। লাল কাপড় পরনে, গৌরবর্ণ, দীর্ঘাকৃতি, উগ্ৰ আয়ত চক্ষু, মোটা নাক-নাগু ঠাকুর যেন দাতাল হাতি। না, নাগু ঠাকুর যেন রাজগোখুরা। কথা বলছে আর দুলছে, সঙ্গে সঙ্গে দুলছে তার বুকের উপর রুদ্ৰাক্ষের মালা। কপালে। ডগডগ করছে সিঁদুরের ফোঁটা, ঝকমক করছে রাঙা চোখ। পিঙলার বুকের ভিতরটা গুরগুর করে। কাঁপিছে নাগু ঠাকুরের ভারি ভরাট কণ্ঠস্বরে।
ভাদু বললেকন্যে, পেনাম কর গ। পিঙলা!
—অ্যাঁ? প্রশ্ন করলে পিঙলা; ভাদুর কথা তার কানেই যায় নাই; সে মগ্ন হয়ে রয়েছে নিজের অন্তরের গভীরে।
ভাদু আবার বললে—পেনাম কর গ ঠাকুরকে।
ঠাকুর নিজের পা দুটো বাড়িয়ে দিয়ে বললে—পেনাম কর। তোর জন্যেই আসা। মাবিষহরির হুকুম এনেছি। তোর ছুটির হুকুম হয়েছে।
ছুটির হুকুম হইছে?
চমকে উঠল পিঙলা, চমকে উঠল সাঁতালীর বেদেপাড়া।
নাগু ঠাকুর দাড়িতে হাত বুলিয়ে মাথা ঝুঁকি দিয়ে বললে—নাগু ঠাকুর শাক দিয়ে মাছ ঢাকে না। মিছে কথা বলে না। এই কন্যেটাকে দেখে আমার মন বললেওকে না হলে জীবনই মিছে। বুকটা পুড়তে লাগল। কিন্তু কন্যে যেখানে বিষহরির আদেশে বাবদ্ধ হয়ে সাঁতালীতে রয়েছে, তখন সে কন্যেকে পাই কি করে? শেষ গেলাম মায়ের কাছে ধরনা দিতে চম্পাইনগররাঙামাটি। পথে দেখা হল এক ইসলামী বেদে-বেদেনীর সঙ্গে। তোক ইসলামী বেদিনী, সাক্ষাৎ বিষহরির দেবাশিনী। সে-ই বলে দিলে আমাকে কন্যের দেনা এবারে শোধ হয়েছে, কন্যের এবারে ছুটি। নিয়ে যাও এই নাগ, এই নাগ দেখিয়ো। বোলো—এই নাগ বার্তা এনেছে বিষহরির কাছ থেকে। কন্যের মুক্তি, কন্যের ছুটি।
প্রকাণ্ড ঝুলির ভিতর থেকে নাগু ঠাকুর বার করলে একটা বড় ঝাপি। পাহাড়ে চিতি রাখা ঝাঁপির মত বড়। খুলে দিলে সে ঝাপিটা। মুহূর্তে শিস দিয়ে দাঁড়িয়ে উঠল নাগ; নাগ নয় মহানাগ। রাত্রির মত কালো, বিশাল ফণা মেলে সে বুকের উপর দাঁড়িয়ে উঠল,–ছোবল মারলে মানুষের বুকে ছোবল পড়বে, বসে থাকলে ছোবল পড়বে মাথায়। ছয় হাত লম্বা কালো কেউটে। কালো মটর-কলাইয়ের মত নিম্পলক চোখ, ভীষণ দুটি চেরা জিত।
মাথা তুলে দাঁড়াতেই নাগু ঠাকুর হেঁকে উঠল সাপটাকেই হাঁক দিয়ে সাবধান করে দিলে, না-হয় উত্তেজনার আতিশয্যে হক মেরে নাগটাকে যুদ্ধে আহ্বান জানালে। সে হেঁকে উঠল—এ–ই!
সাপটা ছোবল দিয়ে পড়ল। সাধারণ গোখুরা কেউটের ছোবল দেওয়ার সঙ্গে তফাত আছে—অনেক তফাত। তারা মুখ দিয়ে আক্রমণ করে, এ আক্রমণ করে বুক দিয়ে। আড়াই হাত তিন হাত উদ্যত দেহের ঊর্ধ্বাংশটা একেবারে আছাড় খেয়ে পড়ছে। মানুষের উপর পড়বার সুযোগ পেলে দেহের ভারে এবং আঘাতে তাকে পেড়ে ফেলবে; বুকের উপর পড়লে চিত হয়ে পড়ে যাবে মানুষ। তখন সে তার বুকের উপর চেপে দুলবে আর কামড়াবে। সাতালীর বেদেরাও এ নাগ দেখে বারেকের জন্য চঞ্চল হয়ে উঠল।
পিঙলা চিৎকার করে ছুটে এল—ঠাকুর। তার হাতও উদ্যত হয়ে উঠেছে। সে ধরবে ওর কণ্ঠনালী চেপে। সমস্ত দেহখান নিয়ে ঠাকুরের বুকের উপর আছাড় খেয়ে পড়বার আগেই ধরবে।
নাগু ঠাকুর কিন্তু রাঢ়ের নাগেশ্বর ঠাকুর! দুৰ্দান্ত সাহস, প্রচণ্ড শক্তি, সে তার লোহার চিমটেখানা শক্ত হাতে তুলে ধরেছে। কণ্ঠনালীতে ঠেকা দিয়ে তাকে আটকেই শুধু দিলে না, সাপাকে উলটে ফেলে দিয়েছে।
সঙ্গে সঙ্গে কৌতুকে অট্টহাস্যে ভেঙে পড়ল।
ওদিকে ভিড় ঠেলে এগিয়ে এল গঙ্গারাম। সে সামনে এসেই থমকে দাঁড়িয়ে গেল। শঙ্কিত কণ্ঠে বলে উঠল—শঙ্খচূড়! ই তুমি কোথা পেল্যা ঠাকুর? মুই দেখেছি, কামাখ্যামায়ের থান যি দ্যাশে, সেই দ্যাশে আছে এই নাগ। আরেঃ, বাবা!
নাগু ঠাকুর বললে—সে আমি জানি না। আমি জানি, এ হল নাগলোকের নাগ। বিষহরির বাৰ্তা নিয়ে এসেছে। নাগিনীর মুক্তি হয়েছে, তার ঋণ সে শোধ করেছে। বলেছে আমাকে বিষহরি দেবাংশিনী, সে এক সিদ্ধ যোগিনী। মায়ের সঙ্গে তার কথা হয়। তার সঙ্গের যে বেদে সে আমাকে বললে—তুমি মিছে কথা ভেব না ঠাকুর। এ মেয়ে সামান্য লয়। মা-গঙ্গার জলে কন্যে ভেসে এসেছে। আমার ভাগ্যি, আমার পায়ের গায়ে আটকে ছিল, আমি তুললম যত্ন করে সেবা করে চেতনা ফেরালম, কন্যে জ্ঞান পেয়ে প্রথম কইল কি জান? কইলমা-বিষহরি, কি করলে জনুনী, এই তোমার মনে ছিল? সাক্ষাৎ নাগলোকের কন্যে ও মেয়ে। মা-বিষহরির সঙ্গে ওর কথা হয়।
নাগু ঠাকুর বললে আমার রাঢ় দেশে বাড়ি শুনে আমাকে বললে, রাঢ়ে তোমার বাড়ি, তবে গো তুমি তো হিজল বিল জান? মা-মনসার আটন যে হিজলে—সেই হিজল! বিষবিদ্যা জান বলছ, তা গিয়েছ কখনও সেখানে? সাঁতালী জান? সাঁতালীর বিষবেদেদের জান? আমি অবাক হয়ে গেলাম। শুধালাম—তুমি জানলে কি করে? সে কন্যের চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল। বললে—ঠাকুর, নাগলোকের কালনাগিনীর এক মায়ের পেটের অনেক কন্যের একএকজনাকে যে এক এক জন্মে সেখানে ঋণশোধ করতে জন্ম নিতে হয়। আমিও এক জন্মে সেখানে জন্ম নিয়েছিলম। বড় দুঃখ, বড় যাতনা, বড় বঞ্চনা, বড় তাপ পেয়ে জন্ম শেষে মায়ের থানে গেলম, বললম তুমি মুক্তি দাও। আর দুঃখ তাপ দিয়ো না। মা আমাকে ফের পাঠায়ে দিলেন নরলোকে, বললেন যা তবে সেই তপস্যা কর গে যা। সেই তপ করছি ঠাকুর। মায়ের বিধান মানতে পারি নাই, তার জন্যে শাস্তি পেলম ইসলামী বেদের লায়ে এসে উঠলম। তার অন্ন খেলম। তবে মানুষটা ভাল। ভারি ভাল। তাতেই তো ওর সঙ্গে ঘর বেঁধেছি। ঘর না ছাইমা-মনসার আটনে ঘুরে বেড়াই; মায়ের থানে পূজা করি তার আদেশ মাগি। বলিমাগো, মুক্তি দাও। দেনা শোধ কর। আমাকে শুধালে—তা তুমি কেন এমন করে বাঞ্জুলা বাউলের মত ঘুরছ। ঠাকুর? ব্যাহ্মণের ছেলে, কি তোমার চাই? আমি তাকে বললাম-কন্যে, তোর মত, তোরই মত এক কন্যে, সেও নাগলোকের কন্যে, জন্মেছে নরলোকে, তার জন্যে আমার সবকিছুতে অরুচি, তাকে না পেলে আমি মরব; তারই জন্যে ঘুরছি এমন করে। আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না, কালো মেয়ে, তার দুই হাতে দুই গোখুরা, আঃ, সে রূপ আমি ভুলতে পারছি না! সে হল ওই সাঁতালী গাঁয়ের নাগিনী কন্যে তার নাম পিঙলা। আজ এক মাস ঘর থেকে বেরিয়েছি। যাব চম্পাইনগর-রাঙামাটিমা-বিষহরির দরবারে; ধরনা দোব। হয় মা আমাকে কন্যেকে দিক নয় তো নিক আমার জীবন, নিক বিষহরি। সে কন্যে পলকহীন চোখে চেয়ে রইল; আকাশবাতাস, গাছ-পালা, নদী-পাহাড় পার হয়ে তার দৃষ্টি চলে যাচ্ছিল আমি দেখলাম। গুরুর নাম দিয়ে বলছি—সে আমি দেখলাম। চলে গেল-অ্যাঁধার রাত্রে আলো যেমন চলে তেমনি করে চলে গেল। না, পাহাড়ে গাছপালায় আলো ঠেকা খায়, সে দৃষ্টি তাও খায় না। সে চলে। তার দৃষ্টি চলল। আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। সে হঠাৎ বললে—পিঙলা, পিঙলা, পিঙলা কন্যে। সাঁতালী গাঁয়ের বিষহরির দেবাশিনী, নাগিনী কন্যে। কালনাগিনীর মত কালো লম্বা দীঘল দেহ, টানা চোখ, টিকালো নাক, মেঘের মত কালো এক পিঠ চুল, বড় মনের যাতনা তার, দারুণ পরানটার দাহ। কন্যে কাঁদে গ। কন্যে কাঁদে, বুকের মধ্যে একগাছ চাপার কলি, কিন্তু সে ফুটতে পায় না। বুকের আগুনে ঝরে যায়।
গোটা সাঁতালীর বেদেরা বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে শুনছিল নাপ্ত ঠাকুরের অলৌকিক কাহিনী। শঙ্কায় তারা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। বড় ঝাপিটার ভিতর মধ্যে মধ্যে গর্জাচ্ছে সেই মহানগটা। আর শোনা যাচ্ছে জনতার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ। বিয়েবাড়ির বাজনা থেমে গিয়েছে। ভাদুর চোখ দুটো বড় হয়ে উঠেছে, জ্বলছে। গঙ্গারামের চোখের দৃষ্টি ছুরির মত ঝলকাচ্ছে। বেদের মেয়ে অবিশ্বাসিনী, বেদের মেয়ে পোড়ারমুখী, মুখ পুড়িয়ে তার আনন্দ; বেদেদের পাড়ায় পাড়ায় অনেক গোপন খেলা;—তার জন্য অনেক বিধান; সন্ধ্যার পর মেয়ে বাড়ি ফিরলে, সে বাড়ি ঢুকতে পায় না;–শিয়াল ডাকিলে পরে বেদেরা লিবে না ঘরে, বেদেনীর যাবে জাতি কুল। সে সব পাপ খণ্ডন হয় ওই এক বিষহরির কন্যার তপস্যায়, তার পুণ্যে। নাগু ঠাকুরের কথার মধ্যে যদি দেবতার কথার আদেশের প্রতিধ্বনি না থাকত তবে নাগু ঠাকুরকে তারা সড়কিতে বিঁধে ঝাজরা করে দিত। আরও আশ্চর্য নাগু ঠাকুর; সে সব জানে, তবু তার ভয় নাই। কেন সে ভয় করবে? এ তো তার কথা নয়, দেবতার কথা। বিষহরির এক কন্যার কথা। সে সশরীরে এসেছে নাগলোক থেকে, তপস্যা করছে জীবনভোর। যে তপস্বিনী যোগিনী-কন্যার সঙ্গে মা বিষহরির কথা হয় তারই কথা সে বলছে।
বিস্ময়ে বিচিত্র ভাবোপলব্ধিতে পিঙলা যেন পাথরের মূর্তি। পলকহীন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। সে ঠাকুরের দিকে। বড় বড় চোখ, মোটা নাক, গৌরবর্ণ দেহ, কপালে সিঁদুরের ফোঁটা, মাথায় বড় বড় রুক্ষ কালো চুলের রাশি, মুখে দাড়ি গোঁফ। গমগম করছে তার ভরাট গলার আওয়াজ। বলছে সেই কাহিনী। বলছে পিঙলার বুকের ভিতরের চাপাগাছে ভরে আছে চাপার কলি। কিন্তু ঝরে যায়, বুকের আগুনে ঝলসে সব ঝরে পড়ে যায়। একটাও কোনো দিন ফোটে না।
পিঙলা অকস্মাৎ মাটির উপর পড়ে গেল, মাটির পুতুলের মত।
নাগু ঠাকুর তার গৌরবর্ণ গোলালো দুখানা হাত দিয়ে কালো মেয়েটিকে তুলে নিতে গেল। এমন যে নাগু ঠাকুর, যার গলার আওয়াজ শুনে মনে হয় শিঙা বাজছে বুঝি, সেই মানুষের গলায় এবার যেন শানাই বেজে উঠল, সে ডাকলে—পিঙলা! পিঙলা!
তার আওয়াজকে ঢেকে দিলে এবার গঙ্গারামের চিৎকার, সে চিৎকার করে উঠল–খবরদার! সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে পড়ল নাগু ঠাকুর আর পিঙলার মাঝখানে। নাগু ঠাকুরের বাড়ানো দুখানা হাতে দুহাত চেপে ধরলে। চোখে তার আগুন জ্বলছে। গঙ্গারাম ডোমন করেত, সে ফণা তোলে না, তার চোখ স্থির কুটিল, আজ কিন্তু গঙ্গারাম গোখুরা হয়ে উঠেছে। সে বললে—খবরদার ঠাকুর! কন্যেরে ছুঁইবা না। হও তুমি বেরাহ্মণ, হও তুমি দেবতা, সাঁতালীর বিষবেদের বিষহরির কন্যের অঙ্গ পরশের হুকুম নাই।
এবার ভাদু গর্জন করে সায় দিয়ে উঠল! হঁ! অর্থাৎ ঠিক কথা, এই কথাটাই তারও কথা, গোটা সাঁতালীর বেদেজাতের কুলের কথা।
ভাদুর সঙ্গে সঙ্গে গোটা বেদেপাড়াই সায় দিয়ে উঠল–হঁ।
নাগু ঠাকুর সোজা মানুষ, বুকের কপাট তার পাথরে গড়া কপাটের মত শক্ত, সে কখনও নোয়ায় না, সে আরও সোজা হয়ে দাঁড়াল। বড় বড় চোখে দৃষ্টি ধকধক করে উঠল। সে চিৎকার করে উঠল, শিঙা হেঁকে উঠল—বিষহরির হুকুম! মা কামাখ্যার আদেশ।
গঙ্গারাম বললে—মিছা কথা।
ভাদু বললে—পেমাণ কি?
নাগু ঠাকুর এবার নিজের হাত ছাড়িয়ে নেবার জন্য আকর্ষণ করে বললে–হাত ছাড়।
–না।
নাগু ঠাকুর যেন দাতাল হাতি, এক টানে লোহার শিকল ঝনঝন শব্দ করে ছিঁড়ে টুকরো। টুকরো হয়ে যায়। নাগু ঠাকুরের এক ঝকিতে গঙ্গারামের হাত দুখানা মুচড়ে গেল, সেমোড়ের যন্ত্রণায় তার হাতের মুঠি খুলে গেল এক মুহূর্তে। হা-হা শব্দে হেসে উঠল নাগু ঠাকুর। নাগু ঠাকুরের ভয় নাই। চারিপাশে তার হিজলের ঝাউবন ঘাসবনের চিতাবাঘের মত বেদের দল; তারই মধ্যে দাঁড়িয়ে সে হা-হা করে হেসে উঠল।
সঙ্গে সঙ্গে তার বুকে পড়ল মুগুরের মত হাতের একটা কিল। অতর্কিতে মেরেছে গঙ্গারাম। একটা শব্দ করে নাগু ঠাকুর টলতে লাগল, চোখের তারা দুটো ট্যারা হয়ে গেল, টলতে টলতে সে পড়ে গেল কাটা গাছের মত।
গঙ্গারাম বললে—বাঁধ্ শালাকে। রাখ্ বেঁধ্যা। তাপরেতে—
ভাদু সভয়ে বললে–না। বেরাহ্মণ। গঙ্গারাম–
–কচু। উ শালার কুনো জাত নাই। শালা বেদের কন্যে নিয়া ঘর বাঁধিবে, উর আর জাত কিসের?
—ওরে, সিদ্ধপুরুষের জাত থাকে না।
হা-হা করে হেসে উঠল গঙ্গারাম। বললে—অ্যানেক সিদ্ধপুরুষ মুই দেখিছি রে। সব ভেলকি, সব ভেলকি। হিহি হি হি করে হাসতে লাগল গঙ্গারাম।