চার মাস পর।
উনিশশো একান্ন সালের সেপ্টেম্বর মাস। আশ্বিন সন্ধ্যা। প্রদ্যোত ডাক্তার বাইরের বারান্দায় কলব্যাগ, ব্লাডপ্রেসার পরিমাপের যন্ত্র নিয়ে কলে যাবার জন্য প্রস্তুত হয়ে বসে আছে। পাশে ছোট টুলের উপর চায়ের কাপ নামানো।
মঞ্জু ঘর থেকে বেরিয়ে এল, সেও বাইরে যাবে বোধহয়। চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে সে বললে—এ কী, খেলে না চা?
—নাঃ। ভাল লাগল না।
–ভাল হয় নি? আমি তৈরি করে আনব?
–না, ভালই লাগছে না। একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে প্রদ্যোত বললে—শেষটায় ভদ্রলোকের সঙ্গে এমন জড়িয়ে গেলাম! তোমার অসুখের সময় সাহায্য সব ডাক্তারেই করেছিলেন, কিন্তু মশায়ের সাহায্যের চেয়ে ভালবাসা বড়।
একটু চুপ করে বোধ করি ভেবে বললেওটা বোধহয় প্রবীণের ধর্ম। আমরা পারি না। বয়স না হলে হয় না। কিন্তু
স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললে—কিন্তু তুমি আজই এলে, এই ঘণ্টাখানেক আগে ট্রেন থেকে নেমেছ, আজ তুমি না গেলেই পারতে। শরীর তোমার এখনও ঠিক সুস্থ হয় নি।
অসুখের পর মঞ্জুকে চেঞ্জে পাঠিয়েছিলেন। আজই মঞ্জু বিকেলের ট্রেনে ফিরেছে।
মশায়ের অসুখ; প্রদ্যোত দেখতে যাচ্ছে শুনে সেও যাবে বলে তৈরি হয়েছে। মশায়ের অসুখ; আজ চার মাসই তিনি অসুস্থ। মধ্যে মধ্যে শয্যাশায়ী হয়েছেন, আজ তিন দিন অসুখ বেশি। রোগ রক্তের চাপ, ব্লাডপ্রেসার আক্রমণ হৃৎপিণ্ডে; করোমারি থ্রম্বসিস।
মঞ্জু বললে–না-না। আমার কিছু হবে না। আমার শরীর ঠিক আছে।
–ঠিক আছে? হাসলে প্রদ্যোত—মনের ইমোশনে বোঝা যায় না। প্ৰথম অসুখের খবর পেয়ে যখন মশায়কে দেখতে গেলাম, তখন মশায় যন্ত্রণার মধ্যেও হেসে বলেছিলেন—স্নেহ, দয়া, ভালবাসা কোনো কিছুরই আতিশয্য সে ক্ষমা করে না ডাক্তারবাবু। পাপ পুণ্য যার জন্যেই হোক, জীবনের উপর পীড়ন করলেই সেই ছিদ্রে তার দূত এসে আশ্রয় নেয়। আমারও নিয়েছে। কাল খুব দূরে নয় ডাক্তারবাবু।
বাঁ হাতে নিজের ডান হাতের মণিবন্ধ ধরে নাড়ি অনুভব করে হেসে বলেছিলেন—মনে হচ্ছে, ঘামের বাইরে গ্রামে ঢুকবার মুখে সে পদার্পণ করেছে। গ্রামে ঢুকেছে।
সেদিন মনের অবস্থা ছিল বিচিত্র।
মঞ্জরীকে দেখে বেরিয়ে যখন এসেছিলেন তখন তার বৃদ্ধ দেহের শিরায় উপশিরায় রক্তস্রোত দ্রুতবেগে বইছিল।
মন তখন এক বিচিত্র উপলব্ধির আস্বাদ অনুভব করেছে। সে এক আশ্চর্য উল্লাস!
তার ওপর হাসপাতালের ফটকে প্রদ্যোত তাকে বলেছিল—এই আপনাদের নিদান হকা? এ যে শিখতে ইচ্ছে করছে।
বাড়ি ফিরবার পথে মনে হয়েছিল—সেই অন্ধকারের মধ্যে তিনি আরণ্য গজের মত বেরিয়ে পড়েন মৃত্যুগহ্বরের সন্ধানে। জনহীন দিকহারা প্রান্তর খ খ করছে, অথবা গভীর নিবিড় মহা অরণ্য থমথম করছে; অসংখ্যকোটি ঝিল্লীর ঐকতান ধ্বনিত হচ্ছে; মৃত্যুর মহাশূন্যতার মধ্য দিয়ে জীবনপ্রবাহ চলেছে জন্ম থেকে জন্মান্তরে; সেইখানে উল্লাসধ্বনি করে সেই মহাগহ্বরে ঝাঁপ দিয়ে পড়েন নবজন্মের আশায়। নিজের নাড়ি ধরে পথ হেঁটেছিলেন, কিন্তু আনন্দের আবেশে অনুভূতিযোগ স্থির হয় নি। বাড়িতে গিয়ে মরি বোষ্ট্রমিকে দেখে তারই সঙ্গে চলে গিয়েছিলেন অভয়ার নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে।
আতর-বউ বারণ করেছিলেন, কিন্তু শোনেন নি। শুধু তাই নয়, আতর-বউয়ের কথায় দুরন্ত ক্ৰোধে তিনি যে চিঙ্কার করেছিলেন সে চিৎকার আজও মশায়ের নিজের কানের পাশে বাজছে। জীবনে এমন চিৎকার তিনি কখনও কোনোদিন করেন নি।
আতর-বউই প্রথম ক্রুদ্ধ হয়ে বলেছিলেন–এই বয়সে, এই রাত্রে নিমন্ত্রণ খেতে চলেছ! এমন অভর পেট তোমার; বনবিহারীকে খেয়ে ভরে নি?
মুহূর্তে প্রচণ্ড চিৎকারে রাত্রির আকাশ চমকে উঠেছিল—তিনি চিৎকার করে উঠেছিলেন–
আতর ব-উ–
মরি বোষ্টুমি চমকে উঠেছিল, সঙ্গের লোকটার হাত থেকে লণ্ঠনটা পড়ে দপ করে নিতে গিয়েছিল।
অভয়া অন্ধকারের মধ্যে দাওয়ার উপর তার প্রতীক্ষাতেই দাঁড়িয়ে ছিল। সারাটা দিন নিরস্তু উপবাসিনী, কুশাগ্রে জল পর্যন্ত খায় নি। কালও অর্ধ উপবাস। নিজের ঘরের গাছের ফল আর মধু খেয়ে থাকবে। আগামী জন্মে পাবে অবৈধব্য ফল। যতদিন সে জীবিত থাকবে ততদিন মৃত্যু ওর স্বামীর সান্নিধ্যে আসতে পারবে না। সাক্ষাৎ মৃত্যুবই ব্যাধিতে আক্রান্ত হলেও মৃত্যুকে ফিরে যেতে হবে অভয়ার এ জন্মের এই ব্ৰতচারণের পুণ্যফলের প্রভাবে। সাবিত্রী করেছিলেন এই ব্ৰত। সত্যবানের প্রাণ গ্রহণ করে মৃত্যুর অধিপতি চলেছিলেন মৃত্যুপুরীর মুখে। অপার্থিব পথ অপার্থিব রহস্যলোক সেখানে। পার্থিব দৃষ্টি সেখানে অন্ধ। কিন্তু এই ব্ৰতপালনের পুণ্যে সাবিত্রী মৃত্যুপতিকে অনুসরণ করেছিলেন; এই পুণ্যবলে মৃত্যুপতিকে পরাভূত করে ফিরিয়ে এনেছিলেন স্বামীর জীবন। সাবিত্রীর কাহিনী সত্য কি না, এই ব্ৰত করে আজও এমন ভাগ্য হয়েছে কারও কি হয় নি, এ বিচার কেউ করে না; আবহমান কাল গভীর বিশ্বাসে এই ব্ৰত করে এসেছে। এদেশের মেয়েরা। অভয়ার উপবাসশীর্ণ মুখে সে বিশ্বাসের গাঢ়তম ছাপ দেখেছিলেন। তাঁকে দেখে অভয়ার মুখে শুক্লা প্রতিপদের ক্ষীণ চন্দ্ৰলেখার মত একটি বিশীর্ণ হাসির রেখা ফুটে উঠেছিল। সে দেখে মশায়ের মন থেকে ক্রোধের অস্বস্তির রেশ নিঃশেষে মুছে গিয়েছিল, আশ্বিনের পূর্ণিমার নির্মেঘ আকাশের মত সারা মনটা ঝলমল করে উঠেছিল। মনে মনে বলেছিলেন চিকিৎসক হিসেবে আমি জানি, মৃত্যু পাপের বিচার করে না, পুণ্যের করে না; সে আসে ক্ষয়ের পথে, ক্ষয় যেখানে প্রবল সেখানে সে অপরাজেয়, সে ধ্রুব! তবু আজ আমি বার বার আশীর্বাদ করছি, এ সত্য হোক, পরজন্মে তোমার স্বামীর জীবনে ক্ষয় প্রবল হলেও যেন তোমার পুণ্যবলের কাছে মৃত্যু হার মানে।
তাঁর সামনে খাবারের থালা নামিয়ে দিয়ে অভয়া বলেছিল—আমার এ অনেক দিনের সাধ। প্রতিবার সাবিত্রীব্রতের সময় মনে হয়েছে ব্রাহ্মণভোজন করিয়ে পূর্ণ হল না। আপনি খেলে তবে পূর্ণ হয়।
হেসে তিনি বলেছিলেন–পূর্ণ হোক মা এবার।
—আপনাকে কী দেব বলুনঃ আপনি তো রাত্রে শুনেছি দুধ আর ফল বা খই, এ ছাড়া খান না। তাই দি? দুধ, আম, কলা, এইসব আর মিষ্টি।
—তুমি যা দেবে মা, তাই খাব। তাই অমৃত।
–একখানা লুচি? একটু ঝোল? একটু তরকারি?
–যা তুমি নিজে হাতে রান্না করেছ তাই দাও।
সত্যই অমৃতের মত মনে হয়েছিল। দীর্ঘদিন এমন প্রসন্ন রুচির সঙ্গে খান নি তিনি। খেয়ে উঠে মনে হয়েছিল খাওয়ার পরিমাণ যেন বেশি হয়ে গেল।
শেষত্রে এইটুকু ছিদ্রপথে তার দূত এসে বুকের উপর চেপে বসল। বুকের মধ্যে মনে হল পাষাণভার চেপেছে; হৃৎপিণ্ড পরিত্রাহি আক্ষেপে মাথা কুটতে লাগল; মস্তিষ্কের স্নায়ু শিরা আচ্ছন্ন হয়ে আসছিল, অনুভূতি একটা বিরাট শূন্যতার মধ্যে হারিয়ে গেল, শুধু জৈবিক অনুভবশক্তিটুকু নিজেকে প্রবুদ্ধ করে প্রাণপণে চিৎকার করে উঠল, যন্ত্ৰণাকাতর চিৎকার! একটা গোঙানি।
আতর-বউ ঘুমান নি। মনের আক্ষেপে সারাটা রাত্রিই তিনি চোখের জল ফেলেছেন। নিঃশব্দে। মুহূর্তে তিনি উঠে আলোটা জোর করে দিয়ে তাঁর শিয়রে এসে বসেছিলেন। চিকিৎসকের পুত্রবধূ, চিকিৎসকের গৃহিণী, ছেলেও চিকিৎসক হয়েছিল, আতর-বউ বুকের উপর আছাড় খেয়ে পড়েন নি, বিহ্বল হয়ে কান্নাকাটি করেন নি; মাথায় মুখে চোখে জল দিয়ে বাতাস করে শুশ্রুষা করেছিলেন। অর্থহীন বিস্ফারিত দৃষ্টিতে মশায় তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলেন।
আতর-বউ ইন্দ্রকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন কিশোর এবং বিনয়ের কাছে, সেতাবকেও সংবাদ পাঠিয়েছিলেন। কিশোর এবং বিনয়ই সংবাদ দিয়েছিল হরেনকে এবং প্রদ্যোতকে। তারা যখন এসেছিল তখন মশায় খানিকটা সুস্থ হয়েছেন।
রক্তের চাপ দুশো চল্লিশ; হৃৎপিণ্ডে আক্রমণ হয়েছে।
বিকেলবেলা মশায় বলেছিলেন ওই কথা।
পাপপুণ্যের বিচার মৃত্যুর কাছে নাই। বলেছিলেন, জলমগ্নকে উদ্ধার করতে গিয়ে তার পাকে জড়িয়ে পড়লেও মৃত্যু আসে, আবার কঠিন হিংসায় কাউকে ছুরি মারতে গিয়ে ছুরি খেলেও মৃত্যু আসে। ওখানে সে নির্বিকার।
নিজের নাড়ি ধরে বলেছিলেন—সে আসছে। মনে হচ্ছে গ্রামের বাইরে তার পায়ের শব্দ উঠছে; গ্রামে ঢুকবার মুখে ধর্মরাজ স্থানের বকুলতলায় বসে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে। হেসেছিলেন। একটু।
প্রদ্যোত বলেছিল, আপনাকে কিছু বলা আমার উচিত নয়, এটা ঠিক আপনার থেম্বসিস নয়, একটা স্প্যাজ্মের মত। এ তো চলে যাচ্ছে। পার হয়ে যাবে।
দিন পনেরর মধ্যে সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। তখন বলেছিলেন গঙ্গাতীরে যাবেন।
সে যাওয়া তার হয় নি। নিজেই মত পরিবর্তন করেছিলেন। আতর-বউয়ের কথা ভেবে। বলেছিলেন, না থাক। আতর-বউ একা পড়বে। ওর দুঃখ-কষ্টের সীমা থাকবে না। এখানে আপনারা আছেন—দুঃখ-কষ্টের ভাগ নিচ্ছেন। সেখানে? কে নেবে ভাগ?
আতর-বউ একটি কথাও বলেন নি। তিনি যেন পাথর হয়ে গেছেন। বনবিহারীর স্ত্রী, তার ছেলে একবার এসেছিল, দেখে চলে গেল। মশায় প্রথম আক্রমণের পর সামলে উঠেছিলেন। উঠে-হেঁটে বেড়াচ্ছিলেন।
প্রদ্যোত বলেছিল, আমি বলেছিলাম, আপনি সেরে উঠবেন।
মশায় হেসেছিলেন। কোনো কথা বলেন নি।
প্রদ্যোত অনুযোগ করে বলেছিল—আমাদের কিন্তু একটা কথা বলবার আছে। আপনি নিজের নাড়ি বার বার দেখেন।
মশায় জবাব দিয়েছিলেন সে আমি অনেকদিন থেকেই দেখি ডাক্তারবাবু।
-না। ওটা দেখতে পাবেন না।
হেসে মশায় বলেছিলেন-বহু লোকের নাড়ি দেখে তার মৃত্যুদিন বলে এলাম। নিজে যখন সুস্থ ছিলাম–তখন দেখেছি—তার হদিস পাবার জন্য। আর আজ যখন সে কাছে এল—তখন তার পায়ের শব্দ যাতে শুনতে না পাই, তার জন্যে তুলো খুঁজে কান বন্ধ করে বসে থাকব। ডাক্তারবাবু?
প্রদ্যোত এ কথার জবাব দিতে পারে নি। মশায় আবার বলেছিলেন মৃত্যুর জন্যে আমার আতঙ্ক নাই ডাক্তারবাবু। সুতরাং ওতে উদ্বেগের জন্যে আমার রক্তের চাপ বাড়বে না। তবে
একটু চুপ করে থেকে বলেছিলেন—তবে প্রথম দিন প্রস্তুত ছিলাম না তো; একেবারে অকস্মাৎ ঘুমের মধ্যে হৃৎপিণ্ডে আক্ৰমণ হল। তখন ভয় পেয়েছিলাম, একেবারে অসহায় শিশুর মত আতঙ্কে চিৎকার করে উঠেছিলাম। মতির মাকে তিরস্কার করেছিলাম, কিন্তু ওর দোষ নেই। মৃত্যুভয়ের তুল্য ভয় নেই, মৃত্যুরোগের যন্ত্রণার তুল্য যন্ত্রণা নেই। কিন্তু সে ভয়কে পার হয়ে আজ কি আমি উটপাখির মত বালির মধ্যে মুখ খুঁজে বসে থাকব?
***
তিন মাস পর দ্বিতীয় আক্রমণ হয়েছিল। আক্রমণের পূর্বদিন নিজেই বলেছিলেন ডাক্তারবাবু, এইবার সে বকুলতলা থেকে বিশ্রাম সেরে উঠে দাঁড়াল।
কথাটা প্রদ্যোতের মনে ছিল না। তাই বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করেছিল, আজ্ঞে?
–আবার একটা ঝাপটা আসবে ডাক্তারবাবু। রক্তের চাপ বাড়বে।
–কই না তো! প্রেসার তো সেই একই আছে!
–বাড়বে। নাড়িতে বুঝতে পারছি আমি।
তাই বেড়েছিল। পরের দিন প্রেসারের গতি ঊর্ধ্বমুখী দেখা গিয়েছিল। সন্ধেতে প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন। আজ চার দিন আগে হয়েছে তৃতীয় আক্রমণ।
প্রদ্যোত ডাক্তার বললে—কাল থেকে প্রায় ধ্যানে বসেছেন। চোখ বন্ধ করে আধশোয়া হয়ে বসে রয়েছেন। আমাকে বললেন–ঘুমের ওষুধ আমাকে দেবেন না, ঘুমের মধ্যে মরতে আমি চাই না। আমি সজ্ঞানে যেতে চাই।
মঞ্জু বললে–মায়ের দিদিমার মৃত্যুর খবরটা শুনেছেন? বলেছ?
–বলতে চেয়েছিলাম, উনি শোনেন নি। পত্ৰখানা পকেটে করেই নিয়ে গিয়েছিলাম। বললাম, আমার শাশুড়ির সেই বুড়ি দিদিমা, কাঁদীর ভূপীবাবুর স্ত্রী, তাঁর হাত দেখে যে বলেছিলেন—! উনি হাত নেড়ে বারণ করলেন। মৃদুস্বরে বললেন– ওসব থাক।
***
বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় মশায় চোখ বুজে অর্ধ-আচ্ছনের মত পড়ে ছিলেন। মৃত্যুর প্রতীক্ষা করছিলেন। সে আসছে তিনি জানেন। তার পায়ের ধ্বনি যেন তিনি। শুনতে পেয়েছেন। সেই প্রথম আক্রমণের দিন থেকেই জানেন। কিন্তু তা তো নয়, শেষ মুহূর্তে সজ্ঞানে তার মুখোমুখি হতে চান। তার রূপ থাকলে তাকে তিনি দেখবেন; তার স্বর থাকলে সে কণ্ঠস্বর শুনবেন; তার গন্ধ থাকলে সে গন্ধ শেষ নিশ্বাসে গ্রহণ করবেন তার স্পর্শ থাকলে সে স্পৰ্শ তিনি অনুভব করবেন। মধ্যে মধ্যে ঘন কুয়াশায় যেন সব ঢেকে যাচ্ছে। সব যেন হারিয়ে। যাচ্ছে। অতীত, বর্তমান, স্মৃতি, আত্মপরিচয়, স্থান, কাল সব। আবার ফিরে আসছেন। চোখ চাইছেন। সে এল কি? এরা কারা? বহুদূরের অস্পষ্ট ছায়াছবির মত এরা কারা?
অতি ক্ষীণভাবে ওদের স্বর যেন কানে আসছে। কী বলছে? কী?
–কী হচ্ছে? মশায় ঘাড় নাড়লেন, জানি না। ঘাড় নাড়তে নাড়তেই ক্লান্ত চোখের পাতা দুটি আবার নেমে এল। প্রদ্যোত দেখলে প্রগাঢ় একটি শান্তির ছায়া শীৰ্ণ মুখমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ছে।
মশায় কী দেখলেন–প্রদ্যোত বুঝতে পারলে না।
সেই মুহূর্তেই আতর-বউ মশায়ের মুখখানি ধরে বললেন–ধ্যান সাঙ্গ হল? মাধবের চরণাশ্রয়ে শান্তি পেলে? আমি? আমাকে? আমাকে সঙ্গে নাও!
শান্ত আত্মসমর্পণের মত তিনি স্বামীর বিছানায় লুটিয়ে পড়লেন।