১৬. মিথ্যে বলে নি পাগলা

মিথ্যে বলে নি পাগলা। এক ডোজ ক্যানাবিসিন্ডিকাতে বৃদ্ধ সাধুর ঘুম এসেছে; ঘুম যখন এসেছে। তখন যন্ত্রণারও উপশম হয়েছে এবং নাড়ির স্পন্দন পাওয়া যাচ্ছে। কিন্তু বুঝতে কিছু পারা গেল না।

সাধুসন্ন্যাসীর ধাতু-প্রকৃতিও স্বতন্ত্র। সাধারণ মানুষের সঙ্গে অনেক প্রভেদ। জীবনে আচার এবং বিধিনিয়ম পালনের প্রভাব দেহের ওপর অমোঘ। দেহের সহনশক্তি আশ্চর্য ভাবে বেড়ে যায়। তেমনি আশ্চর্য ক্রিয়া করে ওষুধ। অকর্ষিত মৃত্তিকায় প্রথম চাষের বীজের মত। সুতরাং বলা তো যায় না। মৃত্যু সন্নিকটবর্তী হয়েও এদের প্রাণশক্তির কাছে হার মেনে ফিরে যায়। এমন অনেক ক্ষেত্রে দেখেছেন জীবন দত্ত। তাঁর বাবাও এ কথা তাকে বলে গেছেন। বলেছিলেন এদের নাড়ি দেখে সহজে নিদান হেঁকো না, বাবা। আগে জেনে নিয়ো—তাদের নিজের দেহরক্ষার অভিপ্রায় হয়েছে কি না। মানুষের অভিপ্রায় প্রচণ্ড কাজ করে, যে রোগী হতাশ হয়ে ভেঙে পড়ে তাকে বাঁচানো কঠিন হয়। সাধুদের হতাশা নাই, মনটি এদে। শক্ত। ইচ্ছাশক্তি প্রবল। এবং মৃত্যু বরণের অভিপ্ৰায় ওঁরাই করতে পারেন।

সাধু গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে রয়েছে। ডাক্তার বললেন–রাত্রিটা সজাগ থেকো ভোলানাথ। রাত্রে যদি ঘুম ভাঙে—তবে জল খেতে দিয়ে। আর কিছু না। আমি ভোরবেলা আসব।

শশী খুব হাসতে লাগল। আত্মপ্রসাদের আর অবধি নাই তার। ডাক্তার তাকে ডেকে সঙ্গে নিলেন।আয় একসঙ্গে যাই।

শশীও সঙ্গ ধরলে। বললে—চলুন রামহরির কেসটা বলে রাখি। কাল আপনাকে যেতেই হবে।

ডাক্তার বললেন– শশী, আজ যা করেছিস করেছিস, এমন কাজ আর করিস না।

–কী? বুড়োকে ক্যানাবিসিন্ডিকা দেওয়া?

–হ্যাঁ। অন্যায় করেছিল।

–অন্যায় করেছি তো বুড়ো সুস্থ হল কী করে?

–কী করে তা বলা শক্ত। গাঁজা খাওয়া অভ্যেস আছে, সেই গাঁজা না খাওয়ার জন্যেও একটা যন্ত্রণা ছিল রোগের যন্ত্রণার সঙ্গে—সেটা উপশম হয়েছে–তার ওপর মাদকের ক্রিয়া আছে। এখন ঘুম ভেঙে এর ফল হয়ত মারাত্মক হবে।

–উঁহুঁ! বুড়ো সেরে উঠবে এ আমি বলে দিলাম। কুড়ো বাউরির মেয়েটার নিউমোনিয়ায় কেরোসিনের মালিশ দিলে সবাই আপনারা গাল দিয়েছিলেন কিন্তু সেরে তো গিয়েছিল।

ডাক্তার ধমক দিয়ে বললেন– শশী, এ সব পাগলামি ছাড়। শেষ পর্যন্ত বিপদে পড়বি।

–আমি পাগল?

–হ্যাঁ, তুই পাগল। আমার আর কোনো সন্দেহ নাই।

একটু চুপ করে থেকে শশী বললে—তা বেশ। পাগলই হলাম আমি। তা বেশ। আবার খানিকটা চুপ করে থেকে বললে—কাল কিন্তু রামহরিকে দেখতে যেতে হবে। আমি কল দিয়ে রাখলাম।

রামহরির কী হল?

—সে সাত-দুগুণে চোদ্দখানা ব্যাপার। এবার যাবে।

—যাবে তো আমাকে টানাটানি কেন? যাক না। এ বয়সে গেলেই তো খালাস। না, যেতে চায় না কামারবুড়ির মত! তা রামহরির এ ইচ্ছে স্বাভাবিক। আবার যেন মালাচন্দন করেছে এই বয়সে!

হ্যাঁ। বছর পঁচিশেক বয়স মেয়েটার। কিন্তু রামহরি বাচবার আশায় আপনাকে ডাকছে। না। ডাকছে নিদান দিতে হবে, বলে দিতে হবে জ্ঞানগঙ্গা যেতে পারে কি না। বড় ইচ্ছে জ্ঞানগঙ্গা যায় উদ্ধারণপুর কি কাটোয়া। জ্ঞানগঙ্গা গিয়ে বেশিদিন বলে তো মুশকিল। কন্ট্রোলের বাজার এ জেলার চাল ও জেলায় যাবার হুকুম নাই। কিনে খেতে গেলে অনেক টাকা লাগবে।

বকবক করে বলেই চলল শশী।

—চোরের রাজ্য বুঝেছেন, সব চোর। আপাদমস্তক চোর। রাজা চোর, রানী চোর, কোটাল চোর,সব চোর। আমি চোর, তুমি চোর—সব চোর। চালের দর ষোল টাকা? তাও এ জেলায় ষোল তো ও জেলায় ছাব্বিশ, আর দুপা ছাড়াও ছত্রিশ—আর এক পা ওদিকে চল্লিশ।

মশায় ঠিক কথাগুলি শুনছিলেন না। তিনি ভাবছিলেন। ভাবছিলেন রামহরির কথা। শশী আপন মনেই বকে চলেছিল। হঠাৎ একবার থেমে আবার আরম্ভ করলে। এবার কথার সুর আলাদা। দেশের সমালোচনা বন্ধ করে অকস্মাৎ সরস রসিকতায় সুরসিক হয়ে উঠল শশী। বললে—রামহরি জ্ঞানগঙ্গা যাবে কিন্তু বেহিসেবি কাণ্ড করে তো যাবে না, কদিন বাঁচবে–আপনাকে বলে দিতে হবে; সেই হিসেব করে চাল ডাল বেঁধে নিয়ে যাবে। বলে, ঠাকুর, তোমার কী বল? দশ দিন বেশি বাঁচলে চাল কম পড়বে। তখন নগদ দামে কিনতে হবে। পাঁচ দিন। কম বাঁচলে চাল বাড়বে। সে চাল ঘরে ফিরে নিতে নাই, বেচে দিতে হবে। সেসব তো আমার হাত দিয়ে হবে না। তবে পরের হাত দিয়ে। পাঁচভূতে সব তচনচ করে দেবে আমার। বুঝুন ব্যাপারটারামহরি যে হিসেব নেবে তার উপায় থাকবে না। ব্যাটা বলে—তাতে আমার স্বর্গে। গিয়েও শান্তি হবে না। আমি বলি–স্বর্গে যাওয়াই হবে না তোর। রথে চড়ে বলবিরোখো রোখো! আমি নাম। রথ ফিরিয়ে দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে দেখবি। মহা মুশকিল। গঙ্গাতীরে মৃত্যুভূত হবারও উপায় থাকবে না, সে হলে সান্ত্বনা থাকত রামহরির ঘাড় ভাঙতে পারত। পিছু পিছু গিয়ে খোনা স্বরে বলতে পারত-পেঁ—অ্যাঁমার টাকা ফিরে পেঁ।

হি-হি করে হাসতে লাগল শশী।

শ্রাবণের অন্ধকার রাত্রির মধ্যে দুজনে পথ হাঁটছিলেন।

বৃদ্ধ জীবন মশায় আপনার মনে রামহরির কথা ভাবছিলেন। এমনটা কী করে হল? কেমন। করে হয়? জ্ঞানগঙ্গা যেতে চায় রামহরি? বিনা ভাবনায়, বিনা কামনায় বৈরাগ্যযোগ—মুক্তিপিপাসা কি জাগে? আমি মরব এই কথা ভেবে প্রসন্নমনে সমস্ত কিছু পিছনে ফেলে অভিসারে চলার মত চলতে পারে? দীর্ঘকাল প্রতীক্ষার পর যুবতী বধূর স্বামী-সন্দর্শনে যাওয়ার কালে। বাপের-ঘরের-উঠানে-পাতা খেলাঘর ফেলে যাওয়ার মত যেতে পারে?

রামহরি প্রথম জীবনে ছিল ছিচকে চোর; তারপর হয়েছিল পাকা ধানচোর; বার দুয়েক জেল খাটার পর হঠাৎ রামহরির দেখা গেল ঘোরতর পরিবর্তন, রামহরি কপালে ফোটা তিলক কেটে। গলায় কষ্ঠীমালা পরে হয়ে উঠল ঘোরতর ধার্মিক। জীবিকা নির্বাহের জন্য ব্যবসা শুরু করলে। তরকারির ব্যবসা। চাষীর ক্ষেত থেকে তরকারি কিনে হাঁটে বাটে ঘুরতে লাগল অর্থাৎ ফড়ে হয়ে উঠল। মুখে রামহরি চিরকালই ফড়ে অর্থাৎ কথা সে বেশি চিরকালই বলত—এবার ব্যবসায়েও তাই হয়ে উঠল। লোকের বাড়ি ক্রিয়াকর্মে বরাত এবং বায়না নিয়ে তরকারি সরবরাহ করত। কিন্তু এর অন্তরালে ছিল তার আসল ব্যবসা। নদীর ধারে জঙ্গলের মধ্যে দস্তুরমত কবিরাজের মৃতসঞ্জীবনী চোলাইয়ের পাকা পদ্ধতিতে মদ তৈরি করত। জঙ্গলের মধ্যেই বোতল এবং টিনবন্দি করে পুঁতে রাখত। ওখানেই শেষ নয়, নদীর চরের পলিমাটিতে সে গাঁজার গাছ তৈরি করে গাঁজাও উৎপন্ন করত এবং তার কাটতিও ছিল প্রচুর। দেশটা তান্ত্রিকের দেশ ছিল—মন্ত্র হোক বা না হোক, জানুক বা না জানুক, লোকে কারণ করত। কপালে সিঁদুরের ফোঁটা, মুখে কালী-কালী, তারাতারা রব আর কারণকরণে শতকরা নিরেনব্বই জন ছিল সিদ্ধপুরুষ। সুতরাং হাজার দরুনে সিদ্ধপুরুষের প্রসাদে রামহরির লক্ষ্মীলাভের পথে সিংহদ্বার না হোক বেশ একটা প্রশস্ত ফটক খুলে গিয়েছিল। উদ্যোগী পুরুষ রামহরির সাহস ছিল অপার, নবগ্রামে থানার সামনের রাস্তা দিয়ে কুমড়ো-কাঁকুড়ের বোঝার তলায় অন্তত চার-পাঁচটা বোতল নিয়ে সে। সহাস্য মুখে চলে যেত এবং হাঁটে বসে তাই বিক্রি করত। কুমডোর মুখ কেটে ভিতরের শাস বীজ বের করে নিয়ে তার মধ্যে আনত গাঁজা। বাড়িতে দেব প্রতিষ্ঠা করেছিল সুপবিত্র নিম্ব কাষ্ঠের গৌরহরি। কিন্তু ঠাকুরটির বক্ষপঞ্জর ছিল কঁপা। দস্তুরমত মাথা খাঁটিয়ে বুক এবং পিঠের দুদিক দুখানি স্বতন্ত্র কাঠে গড়ে ভিতরে গর রেখে পাকা মিস্ত্রি দিয়ে এই দৈব গুদামটি সে তৈরি করিয়েছিল। এবং পিঠের দিকের কাঠের নিচে উপরে দুটি ঢাকনিযুক্ত মুখ রেখেছিল। উপরেরটি খুলে গাঁজা পুরত এবং প্রয়োজনমত বের করে তি। এরপর আর-এক ধাপ উপরে উঠে রামহরি রীতিমত দাসজী হয়ে উঠেছিল। তরকারির ব্যবসা তুলে দিয়ে মুদির দোকান এবং ধান কেনার ব্যবসা শুরু করে-ভেক নিয়ে দাস উপাধি নিয়ে গণ্যমান্য হয়ে উঠেছিল কয়েকখানা গ্রামের। মধ্যে। শুধু ভেকই নেয় নাই, নিজের স্বজাতীয়া স্ত্রী এবং পুত্রকে দূর করে দিয়ে একটি উচ্চবর্ণের বিধবাকে ঘরে এনে বৈষ্ণবী করেছিল। ক্ৰমে ক্ৰমে আরও বোধহয় দু-তিনটি। এদের জনদুই পৌঢ় বয়সে দারোয়ানীর মত ঘুঁটে কুড়িয়ে মরে পরিত্রাণ পেয়েছে। একজন পালিয়েছে। শেষেরটি অরুণী—সেইটিই এখন রামহরির সুয়োরানী।

সেই রামহরি সজ্ঞানে মৃত্যু কামনা করে গঙ্গাতীরে চলেছে? মুক্তি চায় সে? বিস্ময় লাগে। বৈকি!

শশী তামাক টেনে শেষ করে কোটা হাতে ধরে নিয়ে বললে-কাল চলুন একবার। আমি বেটাকে বলেছি, ফি পাঁচ টাকা লাগবে। ডাক্তারবাবু তো আর কলে যান না, তবু বলে-কয়ে রাজি করাব। তা তাতেই রাজি।

কথাটা ডাক্তারবাবুর কানে গেল না। তার মনোরথ চলেছিল ছুটে। পলকে যুগান্তর অতিক্রম করে পিছনের পরিক্রমা সেরে বর্তমানে এসে সেই মুহূর্তেই স্থির হল বোধ করি। তিনি হাসলেন।

শশী বললে–হাসছেন যে?

জীবন বললেন– নবগ্রামের কর্তাবাবুর চিকিৎসার জন্যে কলকাতা যাওয়া মনে আছে তোর শশী?

—তা আবার নাই! বাড়ি থেকে পালকি করে বেরিয়ে—সব ঠাকুরবাড়িতে প্রণাম করে—

–সে তো জ্ঞানগঙ্গা যারাই গিয়েছেন—তারা সবাই তো তা করেছেন রে। সে নয়।

–তবে?

—কর্তা কাশী গেলেন না, উদ্ধারণপুর গঙ্গাতীর গেলেন না, গেলেন কলকাতা। কলকাতাও গঙ্গাতীরে। কিন্তু গঙ্গাতীরে দেহ রাখতে ঠিক যান নি। গিয়েছিলেন চিকিৎসা করিয়ে বাঁচতে।

তা হবে না? বিশাল সম্পত্তি, অগাধ ধন, এত কীৰ্ত্তি—এসব ছেড়ে মরতে কেউ চায় নাকি?

–হ্যাঁ রে, তাই তো বলছি। তার হয় নি আর রামহরির সেই বাসনা হল। রামহরি যা করেছে তার পক্ষে তো সেও কম নয় রে! অনেক! তার ওপর তরুণী পত্নী।

এবার হাঁ করে শশী জীবন ডাক্তারের মুখের দিকে চেয়ে রইল।

জীবনমশায় হেসেই বললেন– হাঁ করে আর তাকিয়ে থাকিস নে। বাড়ি যা। রাত্রি অনেক হয়েছে। কাল যাব। দুপুরের পর গাড়ি পাঠাতে বলিস।

শশী বললে—দু রাস্তার মোড় বুঝি এটা?

–হ্যাঁ।

এইখান থেকেই পাকা রাস্তা থেকে কাঁচা রাস্তা ধরে জীবন ডাক্তার যাবেন নিজের গ্রামে। পাকা রাস্তায় শশী যাবে নবগ্রাম।

জীবনমশায় বললেন–নেশাভাঙ একটু কম করিস শশী।

শশী মাথা চুলকে লজ্জা প্রকাশ করে বললে ভাবি তো। পারি না। তারপর অত্যন্ত ব্যস্ত হয়ে বললে—চলুন আপনাকে পৌঁছে দিয়েই যাই। ভারি অন্ধকার আর রাত্রি অনেক হয়েছে।

হতভাগা! আমাকে দাঁড়াতে হবে না। যাবাড়ি যা। আমাকে দাঁড়াবে? তোকে দাঁড়াবে কে? পরক্ষণেই একটা কথা মনে করে জীবন দত্ত সচকিত হয়ে উঠলেন, বললেন––আচ্ছা চল, আমিই তোকে পৌঁছে দিয়ে বাড়ি ফিরব।

মনে পড়ল। মাসকয়েক হল শশীর মা মারা গেছে। শশী হয়ত এত রাত্রে ভয় পাচ্ছে। একলা যেতে। একটু আগেই বলছিলগলাইচণ্ডী থেকে ফিরবার পথে ওর গা ছমছম করেছিল অর্থাৎ ভয় পেয়েছিল শশী। ওঃ! সেই জন্যেই সে দেবস্থানে ঢুকেছিল?

জীবনমশায় বললেন– সত্যি বল তো শশী–কী ব্যাপার? তুই কি ভয় পেয়েছিল?

শশী মাথা চুলকে বললে—মানে—আমার মা–

—তোর মা?

–মনে হয় আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়। মনে হয় নয় মশায়, সত্যি।

জীবন মশায় বললেন–চল, ওসব কথা থাক।

শশী বললে–মা আমাকে ভয় দেখায় না—আগলায়। বুয়েছেন না! শশী বকবক করলে। সারা পথটা। তার মধ্যে রামহরির কথাই বেশি। ওই বেটার নিদেন হেঁকে দেখিয়ে দেন একবার ছোকরা ডাক্তারকে!


© 2024 পুরনো বই