হঠাৎ আজ নিজের নাড়ি ধরলেন জীবন মশায়, কত দেরি? কত দূরে সে? দীর্ঘক্ষণ নাড়ি ধরে বসে রইলেন। কই, কিছুই তো অনুভব করতে পারছেন না। কোথায় গেল তাঁর অনুভবশক্তি? ওই তরুণ ডাক্তারটির আঘাতে তিনি কি অন্তরে অন্তরে অসাড় হয়ে গেলেন?
–কী, হচ্ছে কী? নিজের নাড়ি দেখছ? প্রশ্ন করলেন আতর-বউ।
জীবন ডাক্তার ছেড়ে দিলেন নিজের নাড়ি। আতর-বউ এসেছে। আসবারই কথা। সারাটা জীবন ভাত খাওয়া শেষ করে, লোকজনকে খাইয়ে আতর-বউ পাখা হতে এসে তাঁর বিছানার। পাশে বসে। পান-দোক্তা খায়, বাতাস করে। কপূর দেওয়া জলের গ্লাসটি শিয়রে রেখে দেয়। হাতে সেবা করে, মুখে অনর্গল মর্মচ্ছেদী অথচ মিষ্ট কথা বলে যায়। তাঁকে উদ্দেশ্য করে বড় বলে না, নিজের কপালকে উদ্দেশ করে। আইনের পাঁচে তাকে ধরা যায় না। প্রতিবাদ করলেই আতর-বউ বলে—তোমাকে তো কোনো কথা আমি বলি নি। আমি বলছি আমার কপালকে। তুমি ফোঁস করে উঠছ কেন?
অনেককাল আগে জীবন ডাক্তার একবার ধৈর্য হারিয়েছিলেন। বলেছিলেন—তোমার কপালে যে ভগবান আমাকে বেঁধে অধিষ্ঠিত করে দিয়েছেন। আঘাত করলে আমাকেই লাগে যে!
আতর-বউ ঘাড় বেঁকিয়ে তির্যক দৃষ্টিপাত করে নিস্পৃহ কণ্ঠে প্রশ্ন করেছিলেন—তোমাকে লাগে?
–হ্যাঁ। বুঝতে পার না?
আতর-বউ একটা পাথরের খল নিয়ে কপালে ঘা মেরে কপালটা রক্তাক্ত করে তুলে বলেছিলেন কই? কই? কই?
এরপর থেকে জীবন ডাক্তার সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পেলেই চোখ বুজে পড়ে থাকেন ঘুমের ভান করে। আজ অতীত কথা স্মরণ করতে গিয়ে এমনই মগ্ন হয়ে গিয়েছিলেন যে পায়ের শব্দ শুনতে পান নাই।
আতর-বউ আবার প্রশ্ন করলেন শরীর খারাপ?
জীবন দত্ত চেষ্টা করলেন মিথ্যা বলতে। বলতে চাইলেন—শরীরটা যেন ভাল বোধ হচ্ছে না। কিন্তু বললেই এই আতর-বউ আর এক আতর-বউ হয়ে যাবে। শিশুর মত অসহায় করে তুলে সেবা-যত্নে জীবন ডাক্তারকে অভিষিক্ত করে দেবে।
কতবার জীবন দত্তের মনে হয়েছে এই আতর-বউই তাঁর জীবনের ছদ্মবেশিনী মৃত্যু। তাঁর বাবা বলতেন, তিনিও তার সুদীর্ঘ চিকিৎসক জীবনে বুঝেছেন, উপলব্ধি করেছেন, মৃত্যু অবগুণ্ঠনময়ী। দূর থেকে তাকে চেনা যায় না। তাকে দেখে ভয় হয়, কারণ সে আসে জ্বালাযন্ত্ৰণাময়ী ব্যাধির পশ্চাদনুসরণ করে—কালবৈশাখীর ঝড়ের অনুসারিণী বৰ্ষণধারার মত। প্ৰচণ্ড বিক্ষোভে ব্যাধির জ্বালায়, যন্ত্রণায় জীবনের ওপর তোলে বিক্ষোভ, মৃত্যু আসে বর্ষাধারার মত, সকল জ্বালা-যন্ত্রণার বিক্ষোভ জুড়িয়ে দিয়ে, প্রশান্ত স্নিগ্ধ করে দেয়। আতর-বউ ঠিক তাই। দূরে যতক্ষণ থাকে ততক্ষণ ভয়ঙ্করী, তার অরুদ্ধ তপ্ত কথাগুলি ব্যাধির জ্বালার মতই যন্ত্রণাদায়ক। কিন্তু
না। আতর-বউ তার জীবনে ব্যাধি, শুধুই ব্যাধি। মৃত্যু হল সেই মঞ্জরী। জীবনে তো আয়ু থাকতে কেউ মৃত্যুকে পায় না। তাই জীবন দত্ত মঞ্জরীকে পান নি। মধ্যে মধ্যে মৃত্যু ছলনা করে যায় মানুষকে, আসতে আসতে ফিরে যায়, ধরা দিতে দিতে দেয় না। রেখে যায় আঘাতের চিহ্ন; অনেক ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী ব্যাধি রেখে যায়। মঞ্জুরীও তাই করেছে। ছলনা করে চলে গেছে,
রেখে গেছে ব্যাধিরূপিণী আতর-বউকে।
নীরবে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন জীবন ডাক্তার। আতর-বউয়ের প্রশ্নের কী উত্তর দেবেন। ভেবে পেলেন না। আতর-বউ কিন্তু এ নীরবতায় উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। সরস মনে থাকলে জীবন ডাক্তার বলেন-আতর-বউ রাগলে টেম্পারেচার ওঠে ম্যালেরিয়ার জ্বরের মত। দেখতে দেখতে একশো পাঁচ।
আতর-বউ তার জীবনে ম্যালেরিয়াই বটে; পোষাই আছে; এতটুকু অনিয়ম ব্যতিক্রম হলেই প্রকট হয়ে উঠবে। অনিয়ম না হলেও অমাবস্যা পূর্ণিমাতে দেখা দেওয়ার মত মধ্যে মধ্যে জর্জর জ্বরোত্তাপ ফুটবেই।
আজ কিন্তু শশী হতচ্ছাড়া এসে আতর-বউকে স্বরূপে প্রকট করে দিয়ে গিয়েছে। আতরবউ শশীকে স্নেহও করেন। অনেকদিন শশী যে এ বাড়িতে কাটিয়েছে; আতর-বউয়ের ফাইফরমাশ শুনত, তাদের ছেলে-মেয়েদের কোলে-পিঠে করত; এ বাড়ি ছেড়েও শশী সম্পর্ক ছাড়ে নাই, মধ্যে মধ্যে আসে। শশীকে ডাক্তার বলেন-ওটা হল ম্যালেরিয়ার পিলে। ওটা কামড়ে উঠলেই ম্যালেরিয়া জাগবেন।
আতর-বউ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছিলেন, বললেন–বলি হাগা, কথা বললেও কি তোমার নিদান বুঝবার পক্ষে ব্যাঘাত হবে?
জীবন ডাক্তার এবার সোজাসুজি বললেন– শশী তোমাকে কী বলে গিয়েছে বল তো?
—শশী? শশী কী বলে যাবে? ছাই ফেলতে ভাঙা কুলো! সবতাতেই শশী। কার না শুনতে বাকি আছে যে, তুমি কামারবুড়ির নিদান হেঁকেছ? কে না এ চাকলায় শুনেছে যে, সরকারি ডাক্তার তোমাকে হাতুড়ে বলে প্রকাশ্যে অপমান করেছে। নিদান হকাতে বারণ করেছে। বলেছে দরখাস্ত করবে। মকদ্দমা করবে। শশী বলবার মধ্যে বলেছে—পায়ের হাড় ভেঙেছে—এতে উনি নিদানটা না হলেই পারতেন। নিদানের রুগী আছে বৈকি। সেখানে পাসকরা ডাক্তাররা থই পাবে না। এই তো তারই হাতে রুগী রয়েছে—ডাক্তাররা কেউ কিছু করতে পারলে না। তোমাকে ডাকতে এসেছিল শশী। শশীর ওপর দোষ কেন?
বৃদ্ধ জীবন ডাক্তার চুপ করে রইলেন। কী বলবেন? আমল পালটেছে, চিকিৎসা শাস্ত্ৰ এগিয়ে গিয়েছে। তিনি পিছিয়ে পড়েছেন। নইলে আগের কালের চিকিৎসা অনুযায়ী তাঁর নিদান ভুল নয়, বুড়ির যাওয়ার কথা, নিশ্চয় যাওয়ার কথা এই আঘাতের ফলে। তবে এ কালের সার্জারির উন্নতি, এক্স-রে আবিষ্কার এ সব তার অজানা নয়; কিন্তু সে চিকিৎসা ব্যয়সাধ্য।
তাই সে হিসেব তিনি করেন না। আরও একটা কথা,-বুড়ির এই সময় যাওয়াটা ছিল সুখের যাওয়া, সমারোহের যাওয়া। স্বেচ্ছায় যাওয়াই উচিত। তাঁর বাবা বলতেন।
তার বাবার কথাগুলি স্মরণ করবার অবকাশ পেলেন না তিনি। বাইরে থেকে কেউ তাকে ডাকলে—ডাক্তারবাবু!
চমকে উঠলেন ডাক্তার। আতর-বউও চকিত হয়ে উঠলেন। এ যে নবগ্রামের কিশোরের গলা। দুজনের মুখই মুহূর্তে প্ৰসন্ন হয়ে উঠল। কিশোর কিশোর আসে যেন বর্ষার দুর্যোগরাত্রির অবসান করে প্রসন্ন শরৎপ্রভাতের মত। বয়সে প্রৌঢ় হয়েও কিশোর চিরদিন কিশোরই থেকে। গেল। আজন্ম কুমার কিশোর উনিশ শো সাতচল্লিশ সাল পর্যন্ত ছিল রাজনৈতিক এবং সমাজসেবক কর্মী। এখন সে সব ছেড়ে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা করে বেড়ায়, তবে অভ্যাসবশে দু-চারটে পরের উপকার না করে পারে না, না করলে লোকেও ছাড়ে না। কিশোর ছেলেটি ডাক্তারের জীবনের একটা অধ্যায়। তাঁর জীবনে প্রকাণ্ড বড় একটি স্থান অধিকার করে আছে।
—ডাক্তারবাবু! আবার ডাকলে কিশোর।
–সাড়া দাও, আসতে বল! প্ৰসন্ন স্বরেই তিরস্কার করলেন আতর-বউ। এবং স্বামীর অপেক্ষা না করেই তিনি নিচে নেমে গেলেন,ডাকলেন—এস বাবা এস।
মোটা খদ্দরের কাপড় এবং হাত-কাটা খাটো পাঞ্জাবির উপর একখানা চাদর—এই হল কিশোরের চিরকালের পোশাক। প্রসন্ন প্রশান্ত সুশ্রী মানুষ। যে পোশাকেই হোক কিশোরকে মানায় বড় সুন্দর। কর্মঠ সরল দেহ, সবল প্রদীপ্ত মন; মানুষটি ঘরে ঢুকলেই ঘরখানি যেন প্ৰসন্ন হয়ে ওঠে।
কিশোর এসে মাটির উপরেই বসে পড়ল এবং বিনা ভূমিকাতেই বললে—একবার বেরুতে হবে ডাক্তারবাবু।
আতর-বউ একখানা আসন পেতে দিলেন, বললেন–উঠে বোলো কিশোর। মাটিতে কি বসে।
ডাক্তার হেসে বললেন–মহারাজ অশোক মাটিতে বসে রাজা হয়েছিলেন। কিশোর মাটিতে বসে একদিন রাজা না হোক মিনিস্টার হবে। কেমন কিপোর?
কিশোর হাত জোড় করে বললে—তার চেয়ে এই বয়সে বিয়ে করতে রাজি আছি ডাক্তারবাবু। এমনকি শনির দশায় পড়তেও রাজি আছি। কিন্তু আপনাকে একবার তাড়াতাড়ি উঠতে হবে। শেষের কটি কথায় কিশোরের কণ্ঠস্বরে উৎকণ্ঠা ফুটে উঠল—জানিয়ে দিলে সরস পরিহাসের মানসিকতা তার এখন নাই।
—কী ব্যাপার? কোথায় যেতে হবে?
–যেতে হবে আমাদের গ্রামেই। রতনবাবু হেডমাস্টার মশায়ের ছেলে বিপিনের অসুখ একবার যেতে হবে।
ডাক্তার বিস্মিত হলেন। বৃদ্ধ রতনবাবু এককালের নামকরা হেডমাস্টার, দুর্লভ দৃঢ় চরিত্রের মানুষ; তার ছেলে বিপিনও বাপের উপযুক্ত সন্তান, সপ্রকৃতির মানুষ, লব্ধপ্রতিষ্ঠ উকিল। বিপিন কয়েক বৎসর রক্তের চাপের আধিক্যে অসুস্থ রয়েছে। সম্প্রতি অসুখ বৃদ্ধি পাওয়ায় কলকাতায় গিয়েছিল চিকিৎসার জন্য। সেখান থেকে ওষুধপত্র নিয়ে দেশে এসে বিশ্রাম নিচ্ছে। বিশ্রামই এ রোগের চিকিৎসা। নবগ্রামের ডাক্তার হরেন চাটুজ্জে কলকাতায় গিয়েছিলেন এই উপলক্ষে। সেখানকার বড় ডাক্তারের কাছে চিকিৎসাবিধি বুঝে এসেছে এবং সেইমত চিকিৎসা সেই করছে। এখন হঠাৎ কী হল যে, কিশোর তাকে ডাকতে এসেছে?
কিশোর বললে–চলুন, পথে চলতে চলতে বলব।
কিশোর বলে যাচ্ছিল রোগের কথা। পথ চলতে চলতে কথা হচ্ছিল।
কলকাতায় বড় ডাক্তার রক্তের চাপ কমাবার জন্য রক্ত মোক্ষণ করেছিল। মূত্রাশয়ে দোষ পাওয়া গেছে। এখন গ্লুকোস ইনজেকশনই হল প্রধান চিকিৎসা। এর সঙ্গে অবশ্যই আরও অনেক ওষুধ আছে। এ ব্যবস্থায় কলকাতায় ভালই ছিলেন বিপিনবাবু। ভাল থাকতেই দেশে এসেছেন, হরেন ডাক্তার ভরসা দিয়েছিল; বড় ডাক্তারও সম্মতি দিয়েছিলেন। এখন দেশে ফিরে হঠাৎ রোগটি যেন বেঁকে দাঁড়িয়েছে। বিচিত্র এক উপসর্গ দেখা দিয়েছে—হিকা। আজ পাঁচ দিন হয়ে গেল হিক্কা চলছে সমানভাবে। হাসপাতালের ডাক্তার প্রদ্যোত বোসকেও ডাকা হয়েছিল, কিন্তু তাদের ওষুধে কোনো ফল হয় নাই। তবে একমাত্র ভরসার কথা এই যে, নাড়ির গতি বা হৃদযন্ত্রের গতির ওপর এখনও কোনো প্রতিক্রিয়ার লক্ষণ দেখা দেয় নাই। কিন্তু দিতে কতক্ষণ? কাল কিশোর হোমিওপ্যাথিক ওষুধ দিয়েছিল। তাতেও কোনো ফল হয় নাই। তাই আজ কিশোর জীবন মশায়কে ডাকতে এসেছে।
প্রদ্যোত ডাক্তারের নাম শুনে জীবন ডাক্তার সচেতন হয়ে উঠলেন, বললেন, হাসপাতালের ডাক্তারটি কি এখনও দেখছে? সেও কি থাকবে নাকি? তা ছাড়া হরেন? হরেনের মতামত নেওয়া। হয়েছে তো।
কিশোর তার দিকে ফিরে তাকাল, বললে–প্ৰদ্যোত ডাক্তারের কথা আমি শুনেছি। ডাক্তারবাবু। প্রদ্যোত ডাক্তার এমনিতে তো লোক খারাপ নয়, বরং ভাল লোক বলেই আমার ধারণা; হঠাৎ এমন অভদ্ৰ—
—ভদ্রতা-অভদ্রতার কথা নয় কিশোর। এ হল সত্য-মিথ্যার কথা। প্রদ্যোত ডাক্তারের যদি এই বিশ্বাসই হয় যে নাড়ি পরীক্ষা করে আমি যে ধরনের চিকিৎসা করি সে ভুল, সে মিথ্যা, তা হলে অবশ্যই তিনি আমাকে কঠোর ভাষায় তিরস্কার করতে পারেন। সে কথা এখন থাক। এখন আমি যে কথাটা জানতে চাচ্ছি তার উত্তর দাও। জীবন ডাক্তার পথের মধ্যেই থমকে দাঁড়িয়ে গেলেন।
কিশোর একটু বিস্মিত হয়েই ডাক্তারের দিকে ফিরে তাকালে। জীবন ডাক্তার বললেন– তুমি আমাকে খুলে বল কিশোর। তুমি কি সকলের সঙ্গে পরামর্শ করে সম্মতি নিয়ে আমার কাছে এসেছ? না, নিজেই এসেছ? তোমার তো এ ব্যাধি আছে। টাকাওয়ালা লোকের টাকাব্যাধি যেমন শোভন, তোমার পক্ষে এ কর্মটি তেমনি শোভনই বটে। পরের উপকার যারা করে, পরের ঘরের বিধি-ব্যবস্থা উলটে দিতে তাদের অধিকারও থাকে।
কিশোর এবার একটু হেসেই বললে—এই শেষ বয়সে আপনি অভিমান করলেন ডাক্তারবাবু! এবং এতখানি অভিমান?
—তা হয়েছে কিশোর। এবং সে অভিমান ছাড়তে পারব না। তুমি যখন যেখানে ডেকেছ—আমি গিয়েছি। আজ কিন্তু যেতে পারব না তোমার ডাকে।
–একা আমি ডাকি নি ডাক্তারবাবু। রোগীর বাপ আপনাকে আহ্বান জানিয়েছেন, রতনবাবু আপনাকে ডেকেছেন। বলেছেন, জীবন ডাক্তার নাড়িটা দেখলে আমি নিশ্চিন্ত হই। অন্তত অনিশ্চিত মনের সংঘাত থেকে নিষ্কৃতি পাই। সে ঠিক বলে দেবে।
অৰ্থাৎ মৃত্যুর কথা!
জীবন ডাক্তার একটু বিচলিত হলেন। বৃদ্ধ রতন তারই সমবয়সী। মাত্র দু বছরের ছোট। তার থেকে এক ক্লাস নিচে পড়ত। যে বছর জীবন ডাক্তার কঁদীর স্কুল থেকে ভূপী বোসের নাক ভেঙে দিয়ে পালিয়ে এলেন সেই বছরই রতন এম. ই. পরীক্ষায় বৃত্তি পেয়ে ওখানে গিয়ে ভর্তি হল। রতন এন্ট্রান্সেও বৃত্তি পেয়েছিল। চিরকালই ধীর প্রকৃতির মানুষ রতন। রতন এই কথা বলেছে? বলেছে—জীবন নাড়ি দেখলে আমি চিন্তার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাই! যা হবে সে ঠিক বলে দেবে!
বলবে বৈকি। জীবন ডাক্তার যে নিজের একমাত্র পুত্রের মৃত্যুর কথা তিন মাস পূর্বে থেকে নাড়ি দেখে জেনেছিলেন—শুধু জেনেই ক্ষান্ত হন নি, ঘোষণা করে জানিয়েছিলেন সে কথা। সুতরাং বলবে বৈকি রতন।
***
রতনবাবু মৃদুস্বরেই প্রশ্ন করলেন বটে কিন্তু মৃদু হলেও কণ্ঠস্বর কাপল না, প্রশ্ন করলেন কেমন দেখলে বল? কী দেখলে?
হাত ধুয়ে জীবন ডাক্তার উঠে দাঁড়িয়ে বললেন––হিকার জন্যে ভেবো না, ও দু-তিন দিনেই বন্ধ হয়ে যাবে।
অশীতিপর বৃদ্ধ হলেও রতনবাবু খাড়া সোজা মানুষ। এতটুকু নজ হন নি। অবশ্য মাথায়। তিনি খাটো এবং দেহেও তিনি ভারী নন। তবুও খানিকটা ঝুঁকে পড়ার কথা, কিন্তু তা তিনি পড়েন নি। চোখের দৃষ্টি বিষণ্ণ হলেও স্থির এবং শুষ্ক, সহজে জল তাঁর চোখে আসে না। সেই যৌবনে তিরিশ বৎসর বয়সে পত্নীবিয়োগের পর থেকে স্বপাকে নিরামিষ খেয়ে ছেলেকে মানুষ। করেছেন। আদর্শবাদী নীতিপরায়ণ মানুষ রতনবাবু। রতনবাবু ঈষৎ হেসে বললেন–আমার প্রশ্ন
তো তা নয়। আমি যা জিজ্ঞাসা করেছি সে তো তুমি বুঝেছ জীবন।
–বুঝেছি। কিন্তু–
–তোমার কাছে তো কিন্তু প্রত্যাশা করি না। তুমি স্পষ্ট বল বলেই তোমার জন্য আমার এত আগ্রহ।
ডাক্তার মাটির দিকে চেয়ে রইলেন।
–জীবন? মৃদুস্বরে ডাকলেন রতনবাবু।
–ভাবছি।
—আমার জন্যে? রতনবাবু বললেন– আমার জন্য ভেবো না। যস্য ছায়ামৃতং যস্য মৃত্যু তিনিই তো পরমানন্দ।
চমকে উঠলেন ডাক্তার। তার সমস্ত অতীতকালের স্মৃতি যেন মুহূর্তে আলোড়িত হয়ে উঠল। তাঁর নাড়ি পরীক্ষা-বিদ্যা শিক্ষার গুরু এই কথাটি বলতেন। জীবন আর মৃত্যু? যস্য ছায়ামৃতং যস্য মৃত্যু—তিনিই আনন্দস্বরূপ!
বাবা জগৎ মশায় নস্য নিয়েছিলেন এই সময়,সে-কথা জীবন ডাক্তারের আজও মনে আছে। তার ফলেই হোক আর হৃদয়াবেগের জন্যই হোক তাঁর কণ্ঠস্বর ভারী হয়ে উঠেছিল। ভারী গলার কথাগুলির প্রতিধ্বনিতে জীবন ডাক্তারের বুকের ভিতরটা যেন বর্ষার মেঘের ডাকে পৃথিবীর মত এক পুলকিত অনুভূতিতে অভিভূত হয়ে পড়েছিল। তিনি বলেছিলেন বাবা, এতে আমাদের দুই তত্ত্বই হয়, ইহলোক পরলোক দুই। পরমানন্দ স্বরূপ যিনি তিনিই আমার মাধব। আমাদের ইষ্টদেবতা।
ধ্যানযোগে সিদ্ধ চিকিৎসক যখন গভীর একাগ্রতায় তন্ময় হয়ে নাড়ি পরীক্ষা করেন—তখন জীবন এবং মৃত্যুর যুদ্ধ আর বিয়োগান্ত বলে মনে হয় না, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের চিরন্তন লীলা বলে মনে হয়, তখন অনায়াসেই বলা যায় যে সূর্যাস্তের কাল সমাগত। সূর্যোদয় সূর্যাস্তের আনন্দ এক, পৃথক নয়।
রতনবাবু অপেক্ষা করে তারই দিকে চেয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন এবার তিনি তাঁকে ডাকলেন–জীবন!
জীবন ডাক্তার সচেতন হয়ে উঠলেন, রতনবাবুর মুখের দিকে চেয়ে একবার যেন কেঁপে উঠলেন, বললেন, তেমন কোনো লক্ষণ আমি আজ পাই নি রতন। তবে
কী হবে? বল! দ্বিধা কোরো না। হাসলেন রতনবাবু; বিষণা এবং করুণ সে হাসি। এ হাসির সামনে দাঁড়ানো বড় কঠিন। অন্তত মুখ তুলে চোখে চোখ রেখে মিথ্যা সান্ত্বনা দেওয়া যায় না। মাথা হেঁট করে বলতে হয়।
জীবন ডাক্তার তাকে মিথ্যা বলতে চান নি। তিনি যা সত্য তাই বলতে যাচ্ছিলেন, তাই বোধ করি মাথা হেঁট করলেন না তিনি। বললেন–এ রোগটি হঠাৎ মারাত্মক হয়ে ওঠে; রোগের বৃদ্ধি ধীরে ধীরে হয় না, এবং বৃদ্ধির হেতুও হিসাবের বাইরে। যে-কোনো একটা আঘাতের ছুতো, দৈহিক হোক মানসিক হোক হলেই চরম সর্বনাশের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দেয়।
—সে আমি জানি।
—তা হলে আমার বলবার তো কিছু নাই রতন। রোগ এখন ষোলআনা দাঁড়িয়েছে। তবুও এমন কোনো লক্ষণ আমি পাই নি যাতে বলতে পারি সাধ্যাতীত। দুঃসাধ্য-কিন্তু অসাধ্য আমি। বলব না। তবে এ রোগের যা প্রকৃতি তাতে যে-কোনো মুহূর্তে অসাধ্য হয়ে উঠতে পারে। ভগবানের দয়া, সে দয়া তোমরা পিতাপুত্ৰে পাবার হকদার।
—হকদার! এ দয়ার উপর কি কারও হক আছে জীবন?
জীবন ডাক্তার এবার চুপ করে রইলেন। এ কথার সত্যই উত্তর নাই।
রতনবাবু বললেন–তুমি তা হলে হিষ্কাটা থামিয়ে দাও।
—আমার ওষুধে ডাক্তারদের আপত্তি হবে না তো? আলোপ্যাথি মতে যা ওষুধ সে বিষয়ে ওঁদের চেয়ে আমি তো অনভিজ্ঞ নই। আমি দেব আমাদের কৌলিক চিকিৎসা পদ্ধতি অনুযায়ী ওষুধ।
হরেন ডাক্তার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। সে বললে—আমাদের ওষুধে আপনার আপত্তি হবে। না তো? প্রয়োজন হলে আমরা একটা-দুটো ইনজেকশন দেব, গ্লুকোজ দেব, বিশেষ করে ঘুমের জন্য ইনজেকশন না দিলে ওঁর ঘুম হয় না। তা ছাড়া—প্রেসার বাড়লে—তার জন্যে ওষুধ দিতে হবে। আর একটা কথা–।
সেদিন প্রদ্যোত ডাক্তারকে নিদান সম্পর্কে যাই বলে থাক হরেন, জীবন ডাক্তার নাড়ি দেখে রোগ নির্ণয় করলে রক্ত মল মূত্র পরীক্ষা না করেও তার নির্ণয়মত রোগেরই চিকিৎসা করে যেতে পারে। এই কারণেই কথাটা বলতে হরেন ডাক্তার সঙ্কুচিত হল।
-বল, কী বলছ?
–আপনাকে বলার দরকার নেই, তবুও–। হরেন ক্ষমা প্রার্থনা করে হাসলে। বাকিটা আর বললে না।
জীবন ডাক্তার কিন্তু একটু অসহিষ্ণু হয়ে উঠলেন। প্রদ্যোত ডাক্তারের মুখ মনে পড়ে গেল। দুজনেই একালের ছেলে প্রায় এক সময়ের পাস-করা ডাক্তার। দীর্ঘকালের পরিচয়ের জন্য প্রদ্যোতের মত কঠিন তিরস্কার করতে না পারলেও উপদেশের ছলে তিরস্কার করতে পারে। অসহিষ্ণুভাবেই জীবন ডাক্তার বললেন–বলার দরকার আছে হরেন, তুমি যা বলছ প্রকাশ করে বল।
হরেন একটু ভেবে নিয়ে বেশ হিসেব করেই বললে—আমরা লক্ষ্য রেখেছি হার্ট আর কিডনির ওপর। তার জন্যে ওষুধ দিচ্ছি; আফিংঘটিত ওষুধে হিকা থামতে পারে। কিন্তু হার্টের কথা ভেবে সেসব ওষুধ ব্যবহার করি নি। প্রেসক্রিপশন তো আপনি দেখেছেন।
আমার ওষুধে হার্টের কোনো অনিষ্ট হবে না, আফিংঘটিত ওষুধ আমি দেব না হরেন, তুমি নিশ্চিন্ত থাক।