দুর্গা ঘর খুলিয়া দিল। ঘর-দুয়ার সে পরিষ্কার রাখিত; আবারও সে একবার ঝাটা বুলাইয়া জল ছিটাইয়া দিল।
দেবু রাস্তার উপর দাঁড়াইয়া চারিদিকে দেখিতেছিল। চাষী-সদ্গোপ পল্লীর অবস্থা দেখিলে চোখে জল আসে। প্রতি বাড়িতে তখন ভাঙন ধরিয়াছে। জীর্ণ চালের ছিদ্ৰ দিয়া বর্ষার জলের ধারা দেওয়ালের গায়ে হিংস্ৰ জানোয়ারের নখের অ্যাঁচড়ের মত দাগ কাটিয়া দিয়াছে, জায়গায় জায়গায় মাটি ধসিয়া ভাঙন ধরিয়াছে।
জগন অতিরঞ্জন করে নাই; পঞ্চগ্রামের সব শেষ হইয়াছে।
কত লোক যে এই কয় বৎসরে মরিয়াছে তাহার হিসাব একজনে দিতে পারিল না। একজনের বিস্মৃতি অন্যজন স্মরণ করাইয়া দিল। এমন মরণ তাহারা মরিয়াছে যে, মরিয়া তাহারা হারাইয়া গিয়াছে। যাহারা আছে, তাহাদের দেহ শীর্ণ, শীর্ণতার মধ্যে অভাব এবং রোগের পীড়নের চিহ্ন সৰ্ব অবয়বে পরিস্ফুট, কণ্ঠস্বর স্তিমিত, চোখের শুভ্রচ্ছদ পীত পাণ্ডুর, দৃষ্টি বেদনাতুর, কালো মানুষগুলির দেহবর্ণের উপরে একটা গাঢ় কালিমার ছাপ, জোয়ান মানুষের দেহ-চর্মে পর্যন্ত কুঞ্চনের জীর্ণতা দেখা দিয়াছে। শুধু তাই নয়—মানুষগুলি যেন সব বোবা। হইয়া গিয়াছে।
দেবু এমন অনুমান করিতে পারে নাই।
তাহার মনে পড়িল সেদিনের কথা। সে যেদিন জেলে যায়—সেই দিনের মানুষের মুখগুলি।
সে কি উৎসাহ! প্রাণশক্তির সে কি প্রেরণাময় উচ্ছাস! সে কথা মনে হইলে—আজ সব শেষ হইয়া গিয়াছে বলিয়াই মনে হয়।
একে একে অনেকেই আসিল। মৃদুস্বরে কুশল প্ৰশ্ন করিল দেবু কুশলপ্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলে উদাসভাবে দুঃখের হাসি হাসিয়া বলিল—আর আমাদের ভাল-মন্দ।
এই কথায় একটা কথা দেবুর মনে পড়িয়া গেল।
তিরিশ সালে আন্দোলনের সময় একদিন তাহাকে তাহারা প্রশ্ন করিয়াছিল—আচ্ছা, এতে কি হবে বল দিকিনি!
দেবুও তখন জানি না এসব কথা। অস্পষ্ট ধারণা ছিল ত্র। নিজেরই একটি অদ্ভুত কল্পনা ছিল; তাই সেদিন আবেগময়ী ভাষায় তাহাদের কাছে বলিয়াছিল। সে অদ্ভুত কল্পনা তাহার একার নয়, পঞ্চগ্রামের মানুষ সকলেই মনে মনে এমনই একটি অদ্ভুত কাল্পনিক অবস্থা কামনা করে।
সে সেদিন বলিয়াছিল—উহারই মধ্যে মিলিবে সর্ববিধ কাম্য। সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, অন্ন, বস্ত্র, ঔষধ-পথ্য, আরোগ্য, স্বাস্থ্য, শক্তি, অভয়। প্রত্যাশা করিয়াছিল—আর কেহ কাহারও উপর অত্যাচার করিবে না, উৎপীড়ন থাকিব না, মানুষে কেহই আর অন্যায় করিবে না, মানুষের অন্তর হইতে অসাধুতা মুছিয়া যাইবে, অভাব ঘুচিয়া যাইবে, মানুষ শান্তি পাইবে, অবসর পাইবে, সেই অবসরে আনন্দ করিবে, তাহারা হাসিবে, নাচিবে, গান করিবে, নিয়মিত দুটি বেলা ইষ্টকে স্মরণ করিবে।…
লোক মুগ্ধ হইয়া তাই শুনিয়াছিল।
একজন বলিয়াছিল—শুনে তো আসছি চিরকাল—এমনি একদিন হবে। সে তো সত্যকালে যেমনটি ছিল গো! বাপ-ঠকুরদাদা সবাই বলে আসছে তো!
দেবু সেদিন আবেগবশে বলিয়াছিল—এবার তাই হবে।
তাহারা সে কথা বিশ্বাস করিয়াছিল—সত্যযুগের কথা। শুধু কি ওইটুকুই সত্যযুগ। গরুর রঙ হইবে ফিট সাদা, মানুষের চেয়েও উঁচু হইবে। গাইগরুগুলি দুধ দিবে অফুরন্ত, পাত্র হইতে উথলিয়া পড়িয়া মাটি ভিজিয়া যাইবে। সাদা পাহাড়ের মত প্রকাণ্ড আকারের বলদের একবারের কৰ্ষণেই চাষ হইবে। মাটিতে আসিবে অপরিমেয় উর্বরতা, ফসলের প্রতিটি বীজ হইতে গাছ। হইবে, শস্যের মধ্যে কোনোটি অপুষ্ট থাকিবে না। মেঘে নিয়মিত বর্ষণ দিবে; পুকুরে পুকুরে। জল কানায় কানায় টলমল করিবে। মানুষ এমন আকারে ছোট, দেহে শীর্ণ থাকিবে না, বলশালী দীর্ঘ দেহ হইয়া তাহারা পৃথিবীর বুকে নিৰ্ভয়ে স্বচ্ছন্দে ঘুরিয়া বেড়াইবে।…
এবার এই দীর্ঘকাল জেলের মধ্যে থাকিয়া দেবু অন্য মানুষ হইয়াছে। তাহার কাছে আজ। পৃথিবীর রূপ পাল্টাইয়া গিয়াছে। সে জানিয়াছে, এদেশের মানুষ মরিবে না। মহামঙ্গলময় মূর্তিতে নবজীবন লাভ করিবে। চার হাজার বৎসর ধরিয়া বার বার সংকট আসিয়াছে—ধ্বংসের সম্মুখীন হইয়াছে—সে সংকট সে ধ্বংস সম্ভাবনা সে উত্তীর্ণ হইয়া আসিয়াছে। নবজীবনে জাগ্রত হইয়াছে। সে সমস্ত কথাগুলি স্মরণ করিয়া কথাগুলির মধ্যে শুধু পিতৃ-পিতামহের নয়—যুগযুগান্তরের অতীতকালে মানুষের এই ইতিহাসের সঙ্গে তাহার নূতন মনের কল্প-কামনার অদ্ভুত মিল প্রত্যক্ষভাবে অনুভব করিল। শুধু তাই নয়, মানুষের জীবনীশক্তির মধ্যে অমরত্বের সন্ধান পাইয়াছে সে। অমর বৈকি! দিন দিন মানুষের বুকের উপর মানুষের অন্যায়ের বোঝা চাপিতেছে। অন্যায়ের বোঝা বাড়িয়া চলিয়াছে বিন্ধ্যগিরির মত মানুষের প্রায় নাভিশ্বাস উঠিতেছে। কিন্তু কি অদ্ভুত মানুষ, অদ্ভুত তাহার সহনশক্তি, নাভিশ্বাস ফেলিয়াও সেই বোঝা নীরবে বহিয়া চলিয়াছে; অদ্ভুত তাহার আশা—অদ্ভুত তাহার বিশ্বাস! সে আজও সেই কথা বলিতেছে, সে দিন-গণনা করিতেছে-কবে সে দিন আসিবে। মানুষ এই দেশের মানুষ মরিবে না। সে থাকিবে। থাকিবে যাবচ্চন্দ্ৰদিবাকরং।
রামনারায়ণ এখন ইউনিয়ন বোর্ডের প্রাইমারি স্কুলের পণ্ডিত। দেবুর পাঠাশালা উঠিয়া যাইবার পর সে-ই এখানকার নূতন পণ্ডিত হইয়াছে। দেবুর জ্ঞাতি। সে হাসিমুখে আসিয়া হাজির হইল। ভাল আছ দেবু-ভাই?
তাহাকে দেখিয়া দেবুর ইরসাদকে মনে পড়িল। কেমন আছে সে?
–ইরসাদ-ভাই! সে কেমন আছে? এখানেই আছে তো?
–হ্যাঁ। পাঠশালা ছেড়ে সে মোক্তারি পড়ছে। আর কৃষক-সমিতি করছে।
–ইরসাদ-ভাই কৃষক-সমিতি করছে? ইরসাদের মাথাতেও পোকা ঢুকিয়াছে।
–হ্যাঁ। দৌলত শেখেরা লীগ করেছে। ইরসাদ কৃষক-সমিতি করেছে।
–ইরসাদের শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে ঝগড়া মেটে নি বোধহয়?—দেবু হাসিল।
–না। তবে সে আবার বিয়ে করেছে।
–বিয়ে করেও ইরসাদ কৃষক-সমিতি করছে?—বলিয়া দেবু আবার হাসিল।
রামনারায়ণ কিন্তু রসিকতাটুকু বুঝিল নাসে বলিল, তা তো জানি না ভাই। বলিয়াই অন্য প্রসঙ্গে আসিয়া পড়িল—বলিল রহম-চাচা কিন্তু গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে দেবু-ভাই।
দেবু চমকিয়া উঠিল। গলায় দড়ি দিয়ে মরেছে।
রামনারায়ণ বলিল—মনের ক্ষোভে গলায় দড়ি দিলে রহম-চাচা। বাবুরা সেই জমিটা নিলেম করে নিলে। সেই ক্ষোভেই!… রামনারায়ণ তাহার ঘাড়টা উল্টাইয়া দিল।
দেবু এক মুহূর্তে স্তব্ধ স্তম্ভিত হইয়া গেল। রহম-চাচা গলায় দড়ি দিয়েছে।
জগন আসিয়া বলিল—খাবার রেডি দেবু-ভাই, স্নান কর। যাও যাও সব, এখন যাও। উ বেলায় হবে সব।
দুপুরের সময় দেবু একা বসিয়া ভাবিতেছিল।
সামনে শিউলি গাছটার দিকে চাহিয়া সে ভাবিতেছল—এলোমেলো ভাবনা। শিউলিতলার রৌদ্রস্নান-করা শিউলিগুলি হইতে একটি অতি সকরুণ মৃদু গন্ধ আসিতেছে। শরতের দ্বিপ্রহরে রৌদ্র ঝলমল করিতেছে। সামনে পূজা। দুর্বল দেহেও মানুষ পূজা উপলক্ষে ঘর-দুয়ার মেরামতের কাজে লাগিয়াছে। বর্ষার জলের দাগের উপর গোবরমাটির ঘন প্রলেপ বুলাইতেছে। জগন তাহাকে বলিয়াছিল—সব শেষ হইয়া গিয়াছে। কিন্তু না। তাহার কথাই সত্য। তাহারা বাঁচিয়া আছে। বাঁচিতে চায়। তাহারা মরিবে না। তাহারা সুখ চায়, স্বাচ্ছন্দ্য চায়, ঘর চায়, দুয়ার চায়, আরও অনেক চায়নূতন জীবনে সে সত্যযুগের সুখে-স্বাচ্ছন্দ্যে-শান্তিতে পুনরুজ্জীবন পরিপূর্ণ চায়। তাহারা নিজেদের জীবনে যদি না পায়, তবে পুত্ৰ-পৌত্ৰাদি রাখিয়া যাইতে চায় তাহারা সে সব পাইবে।
ওদিকে একটা দমকা হাওয়া শিউলি গাছটাকে আলোড়িত করিয়া দিয়া গেল। গাছের পাতায় যে ঝরা ফুলগুলি আটকাইয়া ছিল, ঝরিয়া মাটিতে পড়িল।
দেবু লক্ষ্য করিল না। সে ভাবিতেছিল, সবাই থাকিবে–মরিবে শুধু সে-ই নিজে। তাহার নিজের জীবনে তো এসব আসিবে না। তাহার পরে—সন্তানসন্ততির মধ্যেও সে থাকিবে না। তাহার সঙ্গেই তো সব শেষ।
ঠিক এই সময় শিউলি ফুলের ম্লান গন্ধ তাহার নাকে আসিয়া ঢুকিল। চকিত হইয়া দেব। চারিদিকে চাহিল। মনে হইল, বিলুর গায়ের গন্ধ পাইল যেন, পরক্ষণেই বুঝিল, না—এ শিউলির গন্ধ।
অথচ আশ্চর্য, বিলুর মুখটা ঠিক মনে পড়িতেছে না। মনে করিতে গেলেই। চাবুকমারা ঘোড়ার মত তাহার সারাটা অন্তর যেন চমকিয়া উঠিল।
হায় রে, হায় রে মানুষ!
দাওয়া হইতে সে প্রায় লাফ দিয়া পড়িয়া দ্রুত চলিতে আরম্ভ করিল।
হঠাৎ থমকিয়া দাঁড়াইল। আবার ফিরিয়া আসিল শিউলি গাছের তলায়।
কতকগুলা শিউলি ফুল কুড়াইয়া লইয়া চলিতে শুরু করিল।
আজ তিন বৎসর বিলু-খোকনের চিতার ধারে যাওয়া হয় নাই। সে ফুলগুলি হাতে করিয়া শ্মশানের দিকে চলিল।
সারাটা দুপুর সে সেই চিতার ধারে বসিয়া রহিল।
তীর্থে যাইবার পূর্বে সে বিলু-খোকনের চিতাটি বাঁধাইয়া দিয়াছিল। দেখিল, বৎসর বৎসর ময়ূরাক্ষীর পলি পড়িয়া চিতা সে মাটির নিচে কোথায় বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে। পাঁচ-সাত জায়গা খুঁড়িয়া সে চিতাটি বাহির করিল। কেঁচার খুঁট ভিজাইয়া ময়ূরাক্ষী হইতে জল আনিয়া ধুইয়া পরিষ্কার করিল। বারবার ধুইয়াও কিন্তু মাটির রেশের অস্পষ্টতা মুছিয়া মনের মত উজ্জ্বল করিতে পারিল না। শেষে ক্লান্ত হইয়া তাহার উপর সাজাইয়া দিল ফুলগুলি।
অনেকক্ষণ বসিয়া থাকিয়া সে হাসিল। ওই শিউলি ফুলগুলির সঙ্গেই তার তুলনা চলে। এতক্ষণ বসিয়া একমনে চিন্তা করিয়াও সে বিলু-খোকনকে স্পষ্ট করিয়া মনে করিতে পারিল না। মনে পড়িল ন্যায়রত্নের কথা। তিনি স্পষ্ট করিয়া তাঁহার পুত্র শশিশেখরকে মনে করিতে পারেন না বলিয়াছিলেন। বলিয়াছিলেন শশিশেখর তাহার মধ্যে আছে, শুধু শশিশেখর যাহা তাহাকে দিয়া গিয়াছে তাহারই মধ্যে। বিলু-খোনও ঠিক তেমনিভাবেই তাহার মধ্যে আছে। রূপ তাহাদের হারাইয়া গিয়াছে। মধ্যে মধ্যে চকিতের মত মনে পড়িয়া আবার মিলাইয়া যায়। আবার অন্ধকার রাত্রে শ্মশানে বাতাসের শব্দের মধ্যে তাহাদের অশরীরী অস্তিত্বের চাঞ্চল্য কল্পনা করিয়া দেহের স্নায়ুমণ্ডল চেতনাশূন্য, অসাড় হইয়া যায়। দেবু হাসিল।
বেলা গড়াইয়া গেল, সে গ্রামে ফিরিল।
তাহার দাওয়ার সম্মুখে গ্রামের লোকজনেরা আসিয়া বসিয়াছে। কোনো একটা উত্তেজিত আলোচনা চলিতেছে। ইরসাদ-ভাইও আসিয়াছে, জগন বসিয়া আছে। সে আসিয়া। দাঁড়াইল।
ইরসাদ আসিয়া তাহাকে বুকে জড়াইয়া ধরিল।আঃ, দেবু,-ভাই, কত দিন পর! আঃ!
উত্তেজিত আলোচনা চলিতেছেনবীনকৃষ্ণের একটা জোতের নিলাম লইয়া। রামনারায়ণ বলিতেছেনূতন আইনেও এ ডিক্রি রদ হইবে না!
নূতন প্রজাস্বত্ব আইন পাস হইয়াছে। সেই আইনের ধারা আলোচনা হইতেছে।
নবীন উত্তেজিত হইয়া বলিতেছে–আলবত ফিরবে। কেন ফিরবে না?
জগন মন দিয়া ডিক্রিটা পড়িতেছে। দেবুকে দেখিয়া জগন ডিক্রির কাগজটা রাখিয়া। বলিল-আমাদের এখানেও কৃষক-সমিতি করা যাক; দেবু-ভাই!
ইরসাদ উৎসাহিত হইয়া উঠিল। দেবু বলিল—বেশ তো! কালই কর। তাহার মন যেন। এমনই কিছু চাহিতেছিল। জগন তখনই কাগজ-কলম লইয়া বসিয়া গেল। ঠিক সেই সময়েই চিৎকার করিতে করিতে আসিয়া হাজির হইল হরেন ঘোষাল।—ব্রাদার, তোমার পথ চেয়েই বসে আছি। আমার কথা কেউ শোনে না। এবার লগবই।
জগন বলিল–থাম ঘোষাল!
দেবু হাসিয়া বলিল–কি? ব্যাপারটা কি?
ঘোষাল বলিল—সর্বজনীন দুর্গাপুজো। এবার লাগতেই হবে, জংশনে হচ্ছে। আমি কতদিন থেকে বলছি।
দেবু বলিল—বেশ তো। হোক না সর্বজনীন পুজো!
ঘোষাল তৎক্ষণাৎ একটা কাগজ-কলম লইয়া বসিয়া গেল।
সন্ধ্যার পূর্বেই আসিয়া উপস্থিত হইল বাউরি-মুচির দল। কলে খাঁটিয়া তাহারা সবে ফিরিয়াছে। ফিরিয়াই দেবুর খবর পাইয়া তাহারা ছুটিয়া আসিয়াছে। দলের নেতা সেই পুরাতন সতীশ। সতীশও আজকাল কলে কাজ করে। তাহার গরু-গাড়ি লইয়া কলের মাল বহিয়া। থাকে। চাষও আছে। চাষের সময় করে চাষ। কলের মজুরি পাইয়া সকলেই মদ খাইয়াছে। সতীশ তাহাকে প্রণাম করিয়া হাতজোড় করিয়া বলিল—আপুনি ফিরে এলেন পরানটা আমার জুড়লো।
অটল বলিল-আমাদের পাড়ায় একবার পদার্পন করতে হবে।
—কেন? কি ব্যাপার?
–গান। গান শুনতে হবে।
–কিসের গান?
–আমাদের গান।
সুতরাং পদাপ্পন করিতেই হইবে।
দেবু হাসিয়া ইরসাদ এবং জনগনকে বলিল—চল ভাই। গান শুনে আসি।
লোকগুলি মন্দ নাই; কলে খাটে-পেটে খাওয়ার কষ্ট বিশেষ নাই, পরনের বেশভূষাতে দৈন্য সত্ত্বেও শহরের কিছু ছাপ লাগিয়াছে, কিন্তু ঘর-দুয়ারগুলির অবস্থা ভাল নয়। কেমন যেন একটা পড়ো বাড়ির ছাপ লাগিয়াছে। কয়েকখানা ঘর একেবারেই ভাঙিয়া গিয়াছে। যাইতে যাইতে দেবু প্রশ্ন করিল—এ ঘরগুলো খসে পড়ছে কেন সতীশ?
সতীশ বলিল—যোগী, কুঞ্জ, শম্ভু ওরা সব চলে গিয়েছে সাহেবগঞ্জ। বলে গেল—যাক এখন ভেঙে, ফিরে এসে তখন ঘর আবার করে লোব।
ওদিকে ঢোল বাজিতে আরম্ভ হইল।
সতীশ গান ধরিল—
ভাল দেখালে কারখানা–
দেবু পণ্ডিত অ্যানেক রকম দেখালে কারখানা;
হুকুম জারি করে দিলে মদ খেতে মানা।
দেবু বলিলনা, ও গান শুনব না। অন্য গান কর সতীশ।
–ক্যানে, পণ্ডিত মশায়?
–না, অন্য গান কর। ফুল্লরার বার মেসে গান কর। …
গান যখন ভাঙিল, তখন রাত্রি অনেক।
ইরসাদকে ওইখান হইতে বিদায় দিয়াই সে ফিরিল। জগন মাঝখানেই একটা ক আসায় চলিয়া গিয়াছে। বাউরি-পাড়া পার হইয়া খানিকটা খোলা জায়গা। শরতের গাঢ় নীল আকাশে পুবদিক্ হইতে আলোর আভা পড়িয়াছে। কৃষ্ণপক্ষের সপ্তমীর চাঁদ উঠিতেছে। সে দাঁড়াইল। বাড়ি ফিরিবার কোনো তাগিদ তাহার নাই। আজ এবেলা খাবার ব্যবস্থা করিতেও সে ভুলিয়া গিয়াছে। দুর্গারও বোধহয় মনে হয় নাই। হইলে সে নিশ্চয় এতক্ষণ তাগিদ দিত। দুর্গা এখন অন্যরকম হইয়া গিয়াছে। তাছাড়া তাহার শরীরও খুব দুর্বল। হয়ত জ্বর আসিয়াছে। উঠিতে পারে নাই।
দূরে তাম্রাভ জ্যোৎস্নার মধ্যে পঞ্চগ্রামের মাঠ নরম কালো কিছুর মত দেখাইতেছে। ময়ূরাক্ষীর বাঁধের গাছগুলিও কালো চেহারা লইয়া দাঁড়াইয়া আছে। বাঁধের গায়ের চাপ-বধা শরবন কালো দেওয়ালের মত মনে হইতেছে। ওই অৰ্জুন গাছটার উঁচু মাথা! ওই গাছটার তলায় শ্মশান, বিলু-খোকনের চিতায় সে আজই ফুল দিয়া আসিয়াছে। আশ্চর্য, তাহাদের অভাবটা আছে। তাহারাই হারাইয়া গিয়াছে। এই মুহূর্তেই মনে পড়িতেছে—খাবারের কথা। বাড়ি গিয়া। কি খাইবে তাহার ঠিক নাই। হাসি আসিল প্রথমটা। তারপর মনে হইল—বিলু থাকিলে খাবার তৈয়ারি করিয়া সে তাহার জন্য প্রতীক্ষা করিত। সে একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল।
সে আবার চলিতে আরম্ভ করিল।
সে স্থির করিয়াছে—আবার সে পাঠশালা করিবে। পাঠশালার ছেলেদের সে লেখাপড়া শিখাইবে, তাহাদের কাছে বেতন লইবে। বিনিময়! সেবা নয়, দান নয়। দেনা-পাওনা! সে তাহাদের লেখাপড়ার মধ্যে তার জীবনের আশ্বাসের কথা জানাইয়া ও বুঝাইয়া দিয়া যাইবে। বুঝাইয়া দিয়া যাইবে জানাইয়া দিয়া যাইবে—তোমরা মানুষ, তোমরা মরিবে না, মানুষ মরে না। সে বাঁচিয়া দুঃখ-কষ্টের বোঝা বহিয়া চলিয়াছে—পিঠ বাঁকিয়া গিয়াছে ধনুকের মত, বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ড ফাটিয়া যাইতেছে মনে হইতেছে, চোখ ছটকাইয়া বাহিরে আসিতে চাহিতেছে–তবু সে চলিয়াছে সেই সুদিনের প্রত্যাশায়। সেদিন মানুষের যাহা সত্যকার পাওনা—তাহা। তোমরা পাই ব। সুখ, স্বাচ্ছন্দ্য, অন্ন, বস্ত্র, ঔষধ, পথ্য, আরোগ্য, অভয়-এ তোমাদেরও পাওনা। আমি যাহা শিখিয়াছি–তাহা শোন-আমি কাহারও চেয়ে বড় নই, কাহারও চেয়ে ছোট নই। কাহাকেও বঞ্চনা করিবার আমার অধিকার নাই, আমাকেও বঞ্চিত করিবার অধিকার কাহারও নাই।… মানুষের সেই পরম কামনার মুক্তি একদিন আসিবেই। সেই দিনের দিকে চাহিয়াই মানুষ দুঃসহ বোঝা বহিয়া চলিয়াছে। সযত্নে রাখিয়া চলিয়াছে, পালন করিয়া চলিয়াছে—আপন বংশপরম্পরাকে। যে মহা আশ্বাস সে পাইয়াছে, তাহাতে তাহার স্থির। বিশ্বাস মুক্তি একদিন আসিবেই। যেদিন আসিবে, সেদিন পঞ্চগ্রামের জীবনে আবার জোয়ার আসিবে; সে আবার ফুলিয়া ফাঁপিয়া গৰ্জমান হইয়া উঠিবে। শুধু পঞ্চগ্রাম নয়, পঞ্চগ্রাম হইতে সপ্তগ্রাম, সপ্তগ্রাম হইতে নবগ্রাম, নবগ্রাম হইতে বিংশতি গ্রাম, পঞ্চবিংশতি গ্রাম, শত গ্রাম, সহস্র গ্রামে জীবনের কলরোল উঠিবে। সে হয়ত সেদিন থাকিবে না; তাহার বংশানুক্রমও থাকিবে না।
চলিতে চলিতে সে হঠাৎ থমকিয়া আবার দাঁড়াইয়া গেল। তাহার মনের ওই অবসন্নতার যেন চকিতে একটা রূপান্তর ঘটিয়া গেল। সমস্ত দেহের স্নায়ুতে শিরায় একটা আবেগ সঞ্চারিত হইল। সে কি পাগল হইয়া গেল? জীবনের সকল অবসন্নতা কিসে কাটাইয়া দিল একমুহূর্তে? এ। কি মধুর সঞ্জীবনীময় গন্ধ! দমকা বাতাসে শিউলি ফুলের গন্ধ আসিয়া তাহার বুক ভরিয়া দিয়াছে। সে বুঝিতে পারে নাই, আচমকা অভিভূত হইয়া পড়িয়াছিল।ওই গন্ধটির মধ্যে যেন কি একটা আছে। অন্তত তাহার কাছে আছে। তাহার সমস্ত শরীর শিহরিয়া উঠিল, রোমাঞ্চ দেখা দিল শীর্তের মত। স্বপ্নবিষ্টের মত সে গন্ধ অনুসরণ করিয়া আসিয়া দাঁড়াইল তাহার বাড়ির সামনের সেই শিউলি গাছের তলায়। দেখিল বাতাসে টুপটাপ করিয়া একটি দুটি ফুল গাছের ডাল হইতে খসিয়া মাটিতে পড়িতেছে। পাপড়িগুলিতে এখনও বাঁকা ভাব রহিয়াছে। সবেমাত্র ফুটিতেছে। সদ্য-ফোটা শিউলির গন্ধের মধ্যে সে বিভোর হইয়া দাঁড়াইয়া রহিল। কত ছবি তাহার মনে পর পর জাগিয়া উঠিল। বুকের ভিতরটা চঞ্চল হইয়া উঠিতেছে।
–কে? কে ওখানে? নারীকণ্ঠে কে প্ৰশ্ন করিল।
আবিষ্টতার মধ্যেই দেবু বলিল—আমি।
দেবুর দাওয়া হইতে নামিয়া আসিল একটি মেয়ে। জ্যোত্সার মধ্যে সাদা কাপড়ে তাহাকে অদ্ভুত মনে হইতেছিল, সে যেন অশরীরী কেহ। বাড়ি হইতে বাহির হইয়া আসিল ও কে? বিলু? না। চাঞ্চল্য সত্ত্বেও আজ তাহার মনে পড়িল একদিনের ভ্রমের কথা।
-বাপ্রে! সেই সন্ধেবেলা থেকে এসে বসে রয়েছি—বলিতে বলিতেই সে আসিয়া। দাঁড়াইল একেবারে দেবুর কাছটিতে। আরও কিছু মেয়েটি বলিতে যাইতেছিল কিন্তু বলিতে পারিল না। দেবু ঝুঁকিয়া পড়িয়া তাহাকে দেখিল; মেয়েটি বিস্মিত হইয়া গেল। সত্যই কি দেবু চিনিতে পারে নাই? অথবা চিনিয়াও বিশ্বাস করিতে পারিতেছে না? পরমুহূর্তেই দেবু তাহার চিবুকে হাত দিয়া তাহার মুখখানি আকাশের শুভ্ৰ জ্যোত্মার দিকে তুলিয়া ধরিল। এই তো, এই তো—এই তো–নবজীবন-ইহাকেই যেন সে চাহিতেছিল। বুঝিতে পারিতেছিল না।
মেয়েটি বলিল-আমায় চিনতে পারছেন না? আমি স্বর্ণ।
–স্বর্ণ?
স্বর্ণ বিস্মিত হইয়া গিয়াছিল। বলিল–হ্যাঁ। বলিয়াই হেঁট হইয়া দেবুকে প্ৰণাম করিল। তারপর বলিল বিকেলবেলা খবর পেলাম। সন্ধের সময় এসেছি। জংশন দিয়েই তো এলেন! একটা খবর দিলেন না?
দেবু কোনো উত্তর দিল না। বিচিত্র দৃষ্টিতে সে তাহাকে দেখিতেছিল। এই স্বর্ণ! তিন বৎসরে—এ কি পরিপূর্ণ রূপ লইয়া তাহার সম্মুখে আসিয়া আজ দাঁড়াইল? পরিপূর্ণ স্বাস্থ্যে শরতের ভরা ময়ূরাক্ষীর মত স্বর্ণ। চোখে-মুখে জ্ঞানের দীপ্তি, সর্বদেহ ভরিয়া তরুণ স্বাস্থ্যের নিটোল পুষ্টি, গৌর-দেহবর্ণের উপর ফুটিয়া উঠিয়াছে রক্তোচ্ছাসের আভা। মুহূর্তের জন্য তাহার মনে পড়িল পদ্মকে।
স্বর্ণ তাহাকে ডাকিল—দেবু-দা।
—কি স্বর্ণ!
—আসুন, বাড়ির ভিতরে আসুন। রান্না করে বসে আছি। কতবার দুর্গাকে বললাম ডাকতে। কিছুতেই গেল না।
—তুমি আমার জন্য রান্না করে বসে আছ? দেবু অবাক হইয়া গেল।
–হ্যাঁ। এখানে এসে দেখলাম, রান্নাবান্নার কোনো ব্যবস্থা হয় নি, বেশ মানুষ আপনি! দেবু একদৃষ্টে তাহাকে দেখিতেছিল।
পদ্মের সঙ্গে স্বর্ণের পার্থক্য আছে। পদ্মের মধ্যে উল্লাসের উচ্ছাস আছে—স্বৰ্ণ নিরুজ্জ্বসিত। স্বর্ণকে দেখিয়া তাহার পলক পড়িতেছে না।
স্বৰ্ণ আবার ডাকিল–দেবু-দা! এমন করে চেয়ে রয়েছেন কেন?
প্রগাঢ় স্নেহ এবং সম্ভ্রমের সঙ্গে দেবু হাত বাড়াইয়া স্বর্ণের হাতখানি ধরিয়া বলিল—তোমার সঙ্গে আমার অনেক কিছু বলবার কথা ছিল স্বর্ণ।
স্বর্ণ তাহার স্পর্শে থরথর করিয়া কাঁপিয়া উঠিল। জ্বর-জর্জর মানুষের মত দেবুর হাতখানি উত্তপ্ত। স্বর্ণ হাতখানা টানিয়া লইতে চেষ্টা করিল, দেবুর হাতের মুঠা আরও শক্ত হইয়া উঠিল। মৃদু গাঢ়স্বরে সে বলিল ভয় পাচ্ছ স্বর্ণ! ভয় করছে তোমার?
—দেবু-দা! একান্ত বিহ্বলের মত স্বর্ণ অর্থহীন উত্তর দিল।
–ভয় কোরো না। তুমি তো সেই চাষীর ঘরের অক্ষর পরিচয়হীনা হতভাগিনী মেয়েটি। নও। ভয় কোরো না। হয়ত এই মুহূর্তটি চলে গেলে আর আমার কথা বলা হবে না। স্বর্ণ, আমি আজ বুঝতে পেরেছি। আমি তোমাকে ভালবেসেছি।
স্বৰ্ণ কাঁপিতেছিল। দেবুকে ধরিয়াই কোনোরূপে দাঁড়াইয়া রহিল।
রাত্রি চলিয়াছে ক্ষণ-মুহূর্তের পালকময় পক্ষ বিস্তার করিয়া। আকাশে গ্ৰহ-নক্ষত্রের স্থান-পরিবর্তন ঘটিতেছে। কৃষ্ণপক্ষে সপ্তমীর চাঁদ আকাশে প্রথম পাদ পার হইয়া দ্বিতীয় পাদের খানিকটা অতিক্ৰম করিল। ধ্রুবতারাকে কেন্দ্ৰ করিয়া সপ্তর্ষিমণ্ডলের প্রদক্ষিণ সমাপ্ত হইতে চলিয়াছে। জ্যোৎস্নালোকিত শরতের আকাশে শুভ্র ছায়াপথ আকাশবাহিনী নদীর মত এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত, শুভ্র ফেনার রাশির মত ওগুলি নীহারিকাপুঞ্জ। ক্ষণে ক্ষণে তাহাদের রূপান্তর ঘটিতেছে; চোখে দেখিয়া বোঝা যায় না।
দেবু স্বর্ণকে বলিয়া চলিয়াছে–তাহার যে কথা বলিবার ছিল। তাহার নিজের কথা, পঞ্চগ্রামের কথা, ভবিষ্যতের পরিকল্পনা। সেই পুরনো কথা। নূতন যুগের আমন্ত্রণ, নূতন ভঙ্গিতে, নূতন ভাষায়, নূতন আশায়, নূতন পরিবেশে। সুখস্বাচ্ছন্দ্যভরা ধর্মের সংসার–
দেবু বলিল—তোমার আমার সে সংসারে সমান অধিকার, স্বামী প্রভু নয়–স্ত্রী দাসী নয়–কর্মের পথে হাত ধরাধরি করে চলব আমরা। তুমি পড়াবে এখানকার মেয়েদের শিশুদের, আমি পড়াব ছেলেদের–যুবকদের। তোমার আমার দুজনের উপাৰ্জনে চলবে আমাদের ধর্মের সংসার।
দুর্গা তাহাদের কাছেই বসিয়া সব শুনিতেছিল। সে অবাক্ হইয়া গেল।
শুধু তাহাদের নয়—পঞ্চগ্রামের প্রতিটি সংসার ন্যায়ের সংসার; সুখস্বাচ্ছন্দ্যে ভরা, অভাব নাই, অন্যায় নাই, অন্ন-বস্ত্র, ঔষধ-পথ্য, আরোগ্য, স্বাস্থ্য, শক্তি, সাহস, অভয় দিয়া পরিপূর্ণ উজ্জ্বল। আনন্দে মুখর, শান্তিতে স্নিগ্ধ। দেশে নিরন্ন কেহ থাকিবে না, আহার্যের শক্তিতে–ঔষধের আরোগ্যে নীরোগ হইবে পঞ্চগ্রাম; মানুষ হইবে বলশালী, পরিপুষ্ট, সবলদেহ-আকারে তাহারা বৃদ্ধিলাভ করিবে, বুকের পাটা হইবে এতখানি, অদম্য সাহসে নিৰ্ভয়ে তাহারা চলাফেরা করিবে। নূতন করিয়া গড়িবে ঘর-দুয়ার, পথ-ঘাট। ঝকঝকে বাড়িগুলি অবারিত আলোয় উজ্জ্বল মুক্ত বাতাসের প্রবাহে নিৰ্মল সুস্নিগ্ধ। সুন্দর সুগঠিত সুসমান পথগুলি বাড়ির সম্মুখ দিয়া, পঞ্চগ্রামের মাঠের মধ্য দিয়া, সুদূরপ্রসারী হইয়া চলিয়া যাইবেশিবকালীপুর হইতে দেখুড়িয়া দেখুড়িয়া হইতে মহাগ্রাম, মহাগ্রাম হইতে কুসুমপুর, কুসুমপুর হইতে কঙ্কণা, কঙ্কণা হইতে ময়ূরাক্ষী পার হইয়া জংশনের দিকে। গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে, দেশ হইতে দেশান্তরে যাইবে সেই পথ। সেই পথ ধরিয়া যাইবে পঞ্চগ্রামের মানুষ, পঞ্চগ্রামের শস্য-বোঝই গাড়ি দেশ-দেশান্তরে। শত গ্রামের সহস্র গ্রামের মানুষ তাহাদের জিনিসপত্র লইয়া সেই পথ ধরিয়া আসিবে পঞ্চগ্রামে।
স্বর্ণ স্তব্ধ হইয়া অপলক চোখে দেবুর দিকে চাহিয়া কথা শুনিতেছে; লজ্জা সংকোচ কিছুই যেন নাই। শুধু তাহার মুখখানি অল্প অল্প রাঙা দেখাইতেছে।
দুর্গা দেবুর সব কথা বুঝিতে পারিতেছে না—তবু একটা আবেগে তাহার বুক ভরিয়া উঠিতেছে; শুনিতে শুনিতে চোখ হইতে তাহার জল গড়াইয়া আসিল।
দেবু বলিল—সে দিনের প্রভাতে মানুষ ধন্য হবে। পিতৃপুরুষকে স্মরণ করবে ঊর্ধ্বমুখে সজল চোখে। আমাদের সন্তানেরা আমাদের স্মরণ করবে; তাদের মধ্যেই আমরা পাব তাদেরই চোখে আমরা দেখব সেদিনের সূর্যোদয়।
হঠাৎ দুর্গা প্রশ্ন করিয়া বসিল—সে আর থাকিতে পারিল না—বলিল জামাই!
দেবু তাহার মুখের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল বল্। একটু অপেক্ষা করিয়া থাকিয়া প্রশ্ন করিল—কিছু বলছিলি?
কথাটা দুর্গার মত প্রগভাও বলিতে গিয়া বলিতে পারিতেছিল না। জামাই-পণ্ডিতের ভরসা পাইয়া সে বলিল-আমাদের মত পাপীর কি হবে জামাই? আমরা কি নরকে যাব?
হাসিয়া দেবু বলিলনা দুৰ্গা নরক আর থাকবে না রে। সবই স্বৰ্গ হয়ে যাবে। ছোটবড়র ছোট থাকবে না-অচ্ছ্বত-ছুতের অঞ্ছত থাকবে নাভাল-মন্দের মন্দ থাকবে না।
–তাই হয়? কি বলছ?
–ঠিক বলছি রে। ঠিক বলছি। মানুষ চার যুগ তপস্যা করছে—এই নতুন যুগের জন্যে। এই আশার নিয়মেই রাত্রির পর দিন আসে দুর্গা। দিনের পর মাস আসে, মাসে মাসে বছরের পর বছর আসে পার হয়। মানুষেরা সেই আশা নিয়ে বসে আছে। সে দিনকে আসতেই হবে।
দুর্গা মনে মনে বলিল—সেদিন যেন জামাই তোমাকে আমি পাই। বিলু-দিদি মুক্তি পেয়েছে আমি জানি। স্বর্ণও যেন সেদিন মুক্তি পায় নারায়ণের দাসী হয়। আমি আসব এই মর্তে—তোমার জন্যে আসব, তুমি যেন এস। আমার জন্যে একটি জন্মের জন্যে এস। তোমার কথা আমি বিশ্বাস করলাম। করছি এই জন্যে। তোমাকে পাবার জন্যে।
কৃষ্ণাসপ্তমীর চাঁদ মধ্য আকাশে পৌঁছিতেছে, বর্ণ তাহার পাণ্ডুর স্তিমিত হইয়া আসিতেছে; রাত্রি অবসানের আর দেরি নাই।
আশ্বিনের প্রথমে মাঠে চাষীদের অনেক কাজ নিড়ানের কাজ, অনেকের ক্ষেতে আউশ পাকিয়াছেন কাটার কাজ রহিয়াছে—এই ভোরেই চাষীরা মাঠে যাইবে। মেয়েরা ঘরদুয়ারে মাড়ুলী দিতেছে। তাহাদেরও এখন সমস্ত ঘরগুলিকে ঝাড়িয়া কালি ফেরানোর মত নিকানোর কাজতাহার উপর আল্পনা আঁকার কাজ। পূজায় মুড়ি ভাজার কাজ, ছোলা পিষিয়া সিউই ভাজার কাজ, নাড়, তৈয়ারির কাজ-অনেক কাজ রহিয়াছে। এমনি করিয়া পালে-পার্বণে ঘর নিকাইয়া আল্পনা দিয়া ঘরগুলিকে শ্ৰীসম্পন্ন করিতে হয়। সম্মুখে মহাপূজা আসিতেছে। ময়ূরাক্ষীর ওপারে জংশন শহরে কলের দশ-বারটা বাঁশি বাজিতেছে—একসঙ্গে। সতীশদের পাড়ায় সাড়া পড়িয়া গিয়াছে—কলের কাজে যাইতে হইবে। কত কাজ! কত কাজ!! কত কাজ!!! গাছে চারিদিকে পাখিরা কলরব করিয়া ডাকিয়া উঠিল। দুর্গা আকাশের দিকে চাহিয়া বলিল—ভোর হয়ে গেল। যাই, ঘরে-দোরে জল দিই! স্বর্ণও উঠিয়া গলায় আঁচল দিয়া দেবুকে প্ৰণাম করিল। বলিল-আমায় গিয়ে তুমি নিয়ে এস। যেদিন নিয়ে আসবে, আমি আসব। দুর্গার চোখ হইতে দুটি জলের ধারা নামিয়া আসিয়াছে। ঠোঁটের প্রান্তে প্রান্তে হাস্যরেখা ফুটিয়া উঠিয়াছে।
অন্ধকার কাটিয়া সূর্য উঠিতেছে প্ৰভাত চলিয়াছে ক্ষণ মুহূর্ত প্রহর দিন রাত্রির পথ বাহিয়া সেই প্রকাশিত প্রভাতের দিকে।