০৬. দুর্যোগময়ী রাত্রির গাঢ় অন্ধকার

দুর্যোগময়ী রাত্রির গাঢ় অন্ধকার আবরণে ঢাকা পৃথিবী; আকাশে জ্যোতিলোক বিলুপ্ত, গাছপালা দেখা যায় না, গ্রামকে চেনা যায় না, একটা প্রগাঢ় পুঞ্জীভূত অন্ধকারে সব কিছুর অস্তিত্ব বিলুপ্ত হইয়া গিয়াছে। উৎকণ্ঠিত মানুষ কয়টি আপনাদের ঘন-সান্নিধ্য হেতু স্পর্শবোধ এবং মৃদু কথাবার্তার শব্দবোধের মধ্যেই পরস্পরের কাছে বাঁচিয়া আছে। এই অখণ্ড অন্ধকারকে কোনো একস্থানে খণ্ডিত করিয়া জ্বলিতেছে একটা নৰ্তনশীল অগ্নিশিখা। উৎকণ্ঠিত মানুষগুলির চোখে শঙ্কিত দৃষ্টি। দেবু ঠিক সম্মুখেই দাঁড়াইয়া ছিল; এই সব বিলুপ্ত করিয়া দেওয়া অন্ধকারের মধ্যে সে স্থানটা নিৰ্ণয় করিতেছিল। এই গ্রাম, এই মাঠ, এখানকার দিদিগন্তের সঙ্গে তাহার নিবিড় পরিচয়। সে যদি আজ অন্ধও হইয়া যায়, তবুও সে স্পর্শে, গন্ধে, মনের পরিমাপের হিসাবে সমস্ত চিনিতে পারিবে চক্ষুষ্মনের মত। তাহার উপর বর্তমানে এই অঞ্চলের মধ্যে উদ্ভূত হইয়াছে। অহরহ কর্মস্পন্দনে মুখরিত এক নূতন পুরী; এই দুর্যোগে-ভরা অন্ধকারের মধ্যেও সে সমানে সাড়া দিতেছে। ময়ূরাক্ষীর ওপারে জংশন-স্টেশন; স্টেশনের চারিপাশে কলকারখানা, সেখানে মালগাড়ি শান্টিঙের শব্দ–মিল-এঞ্জিনের শব্দ উঠিতেছে, মধ্যে মধ্যে বাজিয়া উঠিতেছে রেল এঞ্জিনের বাঁশি।

দেবুর সম্মুখের দিকেই ওই বাম কোণে পশ্চিম-দক্ষিণে জংশনের সাড়া উঠিতেছে। জংশনের উত্তর প্রান্তে ময়ূরাক্ষী নদী। জংশন সৃষ্টির আগে এমন অন্ধকার রাত্রে এই পল্লীর মানুষকে ময়ূরাক্ষীই দিত দিক-নির্ণয়ের সাড়া। দেবুদের বামপাশে দক্ষিণ দিকে পূর্ব-পশ্চিমে বহমানা ময়ূরাক্ষী।

ওই ময়ূরাক্ষীকে ধনুকের জ্যার মত রাখিয়া অর্ধচন্দ্রাকারে ওই কঙ্কণা। পাশে কঙ্কণার উত্তর-পূর্বে কুসুমপুর, তাহার পাশে মহুগ্রাম; মহুগ্রামের পাশে শিবকালীপুর, শিবকালীপুরের পূর্ব-দক্ষিণে ময়ূরাক্ষীর কোল ঘেঁষিয়া বালিয়াড়া দেখুড়িয়া। অর্ধচন্দ্রাকার বেষ্টনীটার মধ্যে প্রকাণ্ড এই মাঠখানা দৈর্ঘ্যে প্রায় ছয় মাইল, প্রস্থে চার মাইলের অল্প কিছু কম। মাঠখানার নামই পঞ্চগ্রামের মাঠ। পাঁচখানা মৌজার সীমানারই জমি আছে এই মাঠে। এই বিস্তীর্ণ মাঠখানার বুকের মধ্যে এক জায়গায় এই রিমিঝিমি বর্ষণের মধ্যেও আগুনের রক্তাভ শিখা যেন নাচিতেছে, বোধহয় বাতাসে কাঁপিতেছে। অন্ধকারের মধ্যে দেবু হিসাব করিয়া বুঝিল, সতীশ ঠিক অনুমান করিয়াছে, জায়গাটা মৌলকিনীর বটতলাই বটে।

কোন বিস্মৃত অতীতকালে কেহ মৌলকিনী নামে ওই দিঘিটা কাটাইয়াছিল। দীঘিটা প্ৰকাণ্ড। দিঘিটা এককালে এই পঞ্চগ্রামের মাঠের একটা বৃহৎ অংশে সেচনের জল যোগাইয়াছে; ওই দিঘিটার পাড়ের উপর প্রকাণ্ড বটগাছটাও বোধহয় দিঘি কাটাইবার সময় লাগানো হইয়াছিল। আজও রৌদ্রদীপ্ত তৃষ্ণার্ত পথিক ও কৃষক, গরু-বাছুর, কাকপক্ষী দিঘিটার জল খায়, ওই গাছের ছায়ায় দেহ জুড়াইয়া লয়; কিন্তু রাত্রে বহুকাল হইতেই ওই বটতলাতে মধ্যে মধ্যে জমাট-বস্তীর আলো জ্বলিয়া ওঠে। জমাট-বস্তীর আরও কয়েকটা স্থান আছে—মৰূরাক্ষীর বাঁধের উপর। অৰ্জুনতলায়, কুসুমপুরের মিঞাদের আমবাগানেও অন্ধকার রাত্রে এমনই ভাবে আলো জ্বলে। আজিকার আলো কিন্তু মৌলকিনীর বটগাছতলাতেই জ্বলিতে।

দেবু বলিল—মৌলকিনীর বটতলাই বটে, ভূপাল। মশালের আলোও বটে।

ভূপাল বলিল-আজ্ঞে হ্যাঁ। ভল্লার দল।

–ভল্লার দল?

–হুঁ। একেবারে নিয্যস। মশাল জেলে ভল্লারা ছাড়া অন্য দল তো আগেভাগে মশাল জ্বলে জমায়েত হয় না।

ভল্লা অর্থাৎ বান্দীর দল। বাংলাদেশে ভল্লা বাণীরা বহু বিখ্যাত শক্তিমান সম্প্রদায়। দৈহিক শক্তিতে, লাঠিয়ালির সুনিপুণ কৌশলে, বিশেষ করিয়া সড় কি চালনার নিপুণতায় ইহারা এককালে ভয়ঙ্কর দুর্ধর্ষ ছিল। এখনও দৈহিক শক্তি ও লাঠিয়ালির কৌশলটা পুরুষপরম্পরায় ইহাদের বজায় আছে। ডাকাতিটা এককালে ইহাদের গৌরবের পেশা ছিল। ইংরেজ আমলে বাংলাদেশের অভিজাত সম্প্রদায়ের নবজাগরণের সময় নব্য আদর্শে অনুপ্রাণিত সমাজ নেতাদের সহযোগিতায় শাসক সম্প্রদায় বাংলার নিম্নজাতির দুর্ধর্ষ সম্প্রদায়ের সঙ্গে এই ভল্লাদের বহুল পরিমাণে দমন করিয়াছেন। তবুও তাহারা একেবারে মরে নাই। আজ অবশ্য তাহাদের শক্তির ঐতিহ্য তাহারা অত্যন্ত গোপনে বাঁচাইয়া রাখিয়াছে। মেয়েদের মত ঘাঘরা-কাঁচুলি পরিয়া রায়বেঁশের দল গড়িয়া নাচিয়া বেড়ায়। ক্ষেত্রবিশেষে একটু বেশি পুরস্কার পাইলে দৈহিক শক্তি ও লাঠিখেলায় নিপুণতার কসরৎ দেখায়। সাধারণত এখনও ইহারা চাষী, বাহ্যত অত্যন্ত শান্তশিষ্ট; কিন্তু মধ্যে মধ্যে বিশেষ করিয়া এই বর্ষাকালে কঠিন অভাবের সময় তাদের সুপ্ত দুপ্ৰবৃত্তি জাগিয়া ওঠে। তখন তাহারা পরস্পরের সঙ্গে কয়েকদিন অভাব-অভিযোগের দুঃখব্যথার কথা বলিতে বলিতে কখন যে ডাকাতির পরামর্শ অ্যাঁটিয়া বসে, সে কথা নিজেরাও বুঝিতে পারে না। পরামর্শ পাকিয়া উঠিলে তাহারা একদা বাহির হইয়া পড়ে। ভল্লা বাণী ছাড়াও অবশ্য এই ধারার সম্প্রদায় আছে; ডোম আছে, হাঁড়ি আছে। মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যেও এই শ্রেণীর দল আছে; আবার সকল সম্প্রদায়ের লোক লইয়া মিশ্ৰিত দলও আছে।

ভূপাল বলিল,—এ ভল্লা বাণীর দল। দেখুড়িয়া গ্রামখানা ভল্লা বাণীর গ্রাম। গ্রামে অন্য বর্ণের বাসিন্দারাও কিছু কিছু আছে, কিন্তু ভল্লারাই সংখ্যায় প্রধান। পূর্বকালে দেখুড়িয়ার ভল্লারাই ছিল পঞ্চগ্রামের বাহুবল। আজ দুইশত বৎসরের অধিককাল তাহারা লুঠেরা হইয়া দাঁড়াইয়াছে।

মানুষ কয়টি স্তব্ধ হইয়া দাঁড়াইয়া ছিল। মধ্যে মধ্যে মৃদুস্বরে কয়েকটি কথা হইতেছে, আবার চুপ হইয়া যাইতেছে। ওদিকে গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে সেই দূরে একই স্থানে জ্বলিতেছে মশালের আলোটা। দেবু না থাকিলে ইহারা অবশ্য আপন বুদ্ধিমত যাহা হয় করিত। দেবুর প্রতীক্ষাতেই সকলে চুপ করিয়া আছে।

সতীশ বাউরি বলিলপণ্ডিত মশায়?

–হুঁ।

–হাঁক মারি?

হাঁক মারিলে জাগ্ৰত মানুষের সাড়া পাইয়া নিশাচরের দল চলিয়া যাইতে পারে। অন্তত এ গ্রামের দিকে আসিবে না বলিয়াই মনে হয়। কিন্তু উহারা যদি মাতিয়া উঠিয়া থাকে, তবে আর মুহূর্ত বিলম্ব না করিয়া এ গ্রাম বাদ দিয়া অপর কোনো প্রসুপ্ত পল্লীর উপর ঝাঁপাইয়া পড়িবে।

ভূপাল বলিল—ঘোষ মশায়কে একটা খবর দি পণ্ডিত মশায়, কি বলেন?

—শ্ৰীহরিকে?

–আজ্ঞে হ্যাঁ। বন্দুক নিয়েছেন, বন্দুক আছে। কালু শেখ আছে ঘোষ মশায়ের বাড়িতে। তা ছাড়া ঘোষ মশায় ঠিক বুঝতে পারবেন—এ কীর্তি কার। বলিয়া ভূপাল একটু হাসিল।

শ্ৰীহরি ঘোষ এখন গ্রামের পত্তনীদার; সে এখন গণ্যমান্য ব্যক্তি। কিন্তু এককালে সে যখন ছিরু পাল বলিয়া খ্যাত ছিল, তখন দুর্ধর্ষপনায় সে ওই নিশাচরদেরই সমকক্ষ ছিল। অনেকে বলেচাষ এবং ধান দান করিয়া জমিদার হওয়ার অসম্ভব কাহিনীর অন্তরালে ওই সব নিশাচর সম্প্রদায়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কাহিনী লুক্কায়িত আছে। সে আমলে ছিরু নাকি ডাকাতির বামালও সামাল দিত। অনিরুদ্ধ কর্মকারের ধান কাটিয়া লওয়ার জন্য একবার মাত্রই তাহার ঘরখানা তল্লাশ হয় নাই, তাহারও পূর্বে আরও কয়েকবার এই সন্দেহে তাহার ঘর-সন্ধান। হইয়াছিল। এখন অবশ্য সে জমিদার প্রভাবশালী ব্যক্তি, এখন শ্ৰীহরি আর এইসব সংস্রবে থাকে না; কিন্তু সে ঠিক চিনিতে পারিবে—এ কাহার দল। হয়ত দুর্দান্ত কালু শেখকে সঙ্গে লইয়া বন্দুক হাতে নিঃশব্দে আলো লক্ষ্য করিয়া অন্ধকারের মধ্যে অগ্রসর হইয়া, এক সময় হঠাৎ বন্দুক। দাগিয়া দিবে।

দেবু বলিল—এ রাত্রে দুর্যোগে তাকে আবার কষ্ট দিয়ে কাজ নাই ভূপাল। তার চেয়ে এক কাজ কর। সতীশ, তুমি তোমাদের পাড়ার নাগরা নিয়ে, নাগা পিটিয়ে দাও; কটা নাগরা আছে তোমাদের?

–আজ্ঞে, দুটো।

—বেশ। তবে দুজনে দুটো নাগরা নিয়ে গায়ের এ-মাথায় আর ওমাথায় দাঁড়িয়ে পিটিয়ে দাও।

নাগরার শব্দ–-বিশেষ করিয়া বর্ষার রাত্রে নাগরার শব্দ এ অঞ্চলে আসন্ন বন্যার বিপদজ্ঞাপন সংকেত ধ্বনি। ময়ূরাক্ষীর বন্যায় বধ ভাঙিলে এই নাগরার ধ্বনি ওঠে; পরবর্তী গ্রাম জাগিয়া ওঠে; সাবধান হয়, তাহারাও নাগরা বাজায়—সে ধ্বনিতে সতৰ্ক হয় তাহার পরবর্তী গ্রাম।

ডাকাতি হইলেও এই নাগরাধ্বনির নিয়ম ছিল এবং আছে। কিন্তু সব সময়ে এ নিয়ম প্রতিপালিত হয় না। গ্রামে ডাকাত পড়িয়া গেলে তখন সব ভুল হইয়া যায়। তা ছাড়া নাগরা। দিলেও ভিন্ন গ্রামে লোক জাগে বটে, কিন্তু সাহায্য করতে আসে না। কারণ পুলিশ-হাঙ্গামায় পড়িতে হয়, পুলিশের কাছে প্রমাণ দিতে হয় যে সে ডাকাতি করিতে আসে নাই, ডাকাত ধরিতে আসিয়াছিল।

নাগরার কথাটা সতীশদের ভালই লাগিল। সতীশ সঙ্গে সঙ্গে দলের দুজনকে পাঠাইয়া। দিল। কিন্তু ভূপাল ক্ষুণ্ণ হইয়া বলিল ঘোষ মশায় বোর্ডের মেম্বর লোক। খবরটা ওঁকে না দিলে ফৈজতে পড়তে হবে আমাকে।

শ্ৰীহরিকে সংবাদ দিতে দেবুর মন কিছুতেই সায় দিল না। একটুখানি নীরব থাকিয়া বলিল—চল, আমরাই আর একটু এগিয়ে দেখি।

–না, আর এগিয়ে যেও না।

স্ত্রীলোকের দৃঢ়তাব্যঞ্জক চাপা কণ্ঠস্বরে সকলে চমকিয়া উঠিল। দেবুও চমকিয়া উঠিল,-গাঢ় অন্ধকারের মধ্যে নিতান্ত অপ্রত্যাশিতভাবে নারীকন্ঠে কে কথা বলিল? বিলু! বিলুর অশরীরী আত্মা।

আবার নারীকণ্ঠ বলিয়া উঠিল—বিপদ হতে বেশিক্ষণ লাগে না জামাই।

দেবু এবার সবিস্ময়ে প্রশ্ন করিল—কে? দুর্গা?

–হ্যাঁ।

সমস্বরেই প্রায় সকলে প্ৰশ্ন করিয়া উঠিল—দুগ্‌গা?

–হ্যাঁ। বলিয়া সঙ্গে সঙ্গেই সে রসিকতা করিয়া বলিল ভয় নাই, পেত্নী নই, মানুষ, আমি দুগ্‌গা।

–তুই কখন্ এলি?

দুর্গা বললি সতীশদা থানাদারকে ডাকলে, পাড়ায় ডাকলে, আমার ঘুম ভেঙে গেল। ঘরে থাকতে নারলাম, ওই সতীশদাদাদের পিছু পিছু উঠে এলাম।

—বলিহারি বুকের পাটা তোমার দুগ্‌গা! ভূপাল ঈষৎ শ্লেষভরেই বলিল।

—বুকের পাটা না থাকলে, থানাদার, রাত-বিরেতে পেসিডেনবাবুর বাংলোতে নিয়ে যাবার জন্য কাকে পেতে বল দেখি? বকশিশই তোমার মিলত কি করে? আর চাকরির কৈফিতই বা কাটাতে কি করে?

কথাটার মধ্যে অনেক ইতিহাসের ইঙ্গিত সুস্পষ্ট; ভূপাল লজ্জিত হইয়া স্তব্ধ হইয়া গেল। ঠিক এই মুহূর্তেই গ্রামের দুই প্রান্তে নাগরা বাজিয়া উঠিল। দুর্যোগময়ী স্তব্ধ রাত্রির মধ্যে ড়ুগড়ুগড়ুগ ধ্বনি দিগৃদিগন্তে ছড়াইয়া পড়িল। দেবু হাঁক দিয়া উঠিল—আ—আ–হৈ! সঙ্গে সঙ্গে সকলেই হাঁক দিয়া উঠিল সমস্বরে—আ-আ-আ—হৈ! আ—হৈ!। দূরে অন্ধকারের মধ্যে যে আলোটা বাতাসে কাঁপিয়া যেন নাচিতেছিল—সে আলোটা অস্বাভাবিক দ্রুততায় কাঁপিয়া উঠিল। আবার দেবু এবং সমবেত সকলে হাঁক দিয়া উঠিল—আহৈ আহৈ! ওদিকে গ্রামের ভিতরে ইহারই মধ্যে সাড়া জাগিয়া উঠিল। স্পষ্ট শোনা যাইতেছে স্তব্ধ রাত্রে পরস্পর পরস্পরকে ডাকিতেছে। একটা উচ্চ কণ্ঠের প্রহরা-ঘোষণার শব্দ উঠিল। এ শব্দটা শ্ৰীহরির লাঠিয়াল কালু শেখের হাক! ওদিকে নাগরা দুইটা ড়ুগড়ুগ শব্দে বাজিয়াই চলিয়াছে।

এবার দূরে মাঠের বুকে অন্ধকারের মধ্যে জ্বলন্ত আলোটা হঠাৎ নিম্নমুখী হইয়া অকস্মাৎ যেন। মাটির বুকের ভিতর লুকাইয়া গেল। স্পষ্ট বুঝা গেল মশালের আলো কেহ জলসিক্ত নরম মাটির মধ্যে খুঁজিয়া নিভাইয়া দিল। ওদিকে আরও দূরে আরও একটা নাগরা অন্য কোথাও, সম্ভবত বালিয়াড়া দেখুড়িয়ায় বাজিয়া উঠিল।

এতক্ষণে দেবু বলিল এবার তুমি ঘোষ মহাশয়কে খবর দিয়ে এস ভূপাল। কাজ কি কৈফিয়তের মধ্যে গিয়ে!

পিছন হইতে কাহার গম্ভীর কণ্ঠস্বর ভাসিয়া আসিলভূপাল!

হারিকেনের আলোও একটা আসিতেছে। ভূপাল চমকিয়া উঠিল—এ যে স্বয়ং ঘোষ মশায়! শ্ৰীহরি নিকটে আসিতেই হাতজোড় করিয়া সসম্ভ্ৰমে বলিল হুজুর।

—কি ব্যাপার?

–আজ্ঞে, মাঠের মধ্যে জমাট-বস্তী।

–কোথায়?

—মৌলকিনীর পাড়ে মনে হল। আলো জ্বলছিল এতক্ষণ, আমাদের নাগরার শব্দ আর হক শুনে আলো নিভিয়ে দিয়েছে।

—আমাকে খবর দিস নাই কেন?

দেবু বলিল—দেবার ব্যবস্থা হচ্ছিল। তুমি নিজে এসে পড়লে।

—কে? দেবু খুড়ো?

–হ্যাঁ।

–হুঁ। কারা, কিছু বুঝতে পারলে?

—কি করে বুঝব? তবে মশালের আলো দেখে ভূপাল বলছিল ভল্লার দল। হঠাৎ বন্দুকের শব্দে সকলে চমকিয়া উঠিল। বন্দুকের মধ্যে কার্টিজ পুরিয়া আকাশমুখে পর পর দুইটা ফাঁকা আওয়াজ করিয়া দিল শ্ৰীহরি। তীক্ষু উচ্চ শব্দ ইটা বাত্রির অন্ধকারকে যেন চিরিয়া ফাড়িয়া দিল। চেম্বার খুলিয়া ফায়ার-করা কার্টিজ দুইটা বাহির করিয়া, শ্ৰীহরি বলিল—দেবু খুড়োয় এ সব হল গিয়ে তোমাদের ধর্মঘটের ধুয়োর ফল।

দেবু স্তম্ভিত হইয়া গেল। সবিস্ময়ে সে বলিল-ধর্মঘটের ধুয়োর ফল? মানে?

–হ্যাঁ। এ তোমার দেখুড়ের তিনকড়ি মোড়লের কাণ্ড। তিনকড়ি তোমাদের ধর্মঘটের একজন পাণ্ডা। ভল্লাদের দল অনেক দিনের ভাঙা দল। এই হুজুগে সে-ই আবার জুটিয়েছে। আমি খবর পেয়েছি। তিনকড়ি মাঠের মধ্যে চাষ করতে করতে কি বলেছে জান? বলেছে–বৃদ্ধির শখ একদিন মিটিয়ে দেবে। আমার নাম করে বলেছে, তাকে দোব একদিন মুলোর মত মুচড়ে।

দেবু ধীরভাবেই বলিল–ও সব কথার কোনো দাম নাই শ্ৰীহরি। তুমিও তো বলেছ শুনতে পাই—যারা বেশি চালাকি করবে, তাদের তুমি গুলি চালিয়ে শেষ করে দেবে।

অকস্মাৎ পিছনের দিকে একটা চটাস করিয়া শব্দ উঠিল—কে যেন কাহাকে প্রচণ্ড জোরে চড় মারিয়াছে; সঙ্গে সঙ্গে তীক্ষকণ্ঠে দুর্গা বলিয়া উঠিল—আমার হাত ধরে টানিস, বদমাস পাজি!

শ্ৰীহরি হারিকেনটা তুলিয়া ধরিল। দুর্গার সম্মুখেই দাঁড়াইয়া আছে শ্ৰীহরির লাঠিয়াল কালু। শ্ৰীহরি ঈষৎ হাসিয়া বলিলকে দুর্গাঃ।

দুর্গা সাপিনীর মত ফোস করিয়া উঠিল—তোমার লোক আমার হাত ধরে টানে?

শ্ৰীহরি কালুকে ধমক দিল—কালু, সরে আয় ওখান থেকে। তারপর আবার ঈষৎ হাসিয়া বলিল—এই এখানে কোথায় এত রাতে? পরমুহূর্তেই নিজের উত্তরটা আবিষ্কার করিয়া বলিল–আ! দেবু খুড়োর সঙ্গে এসেছিস বুঝি!

দেবু কয়েক মুহূর্ত শ্ৰীহরির মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়া দুর্গাকে বলিল-আয় দুর্গা, বাড়ি আয়, এত রাত্রে মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে ঝগড়া করে না। সতীশ, এস, তোমরাও এস।

তাহারা সকলেই চলিয়া গেল, কেবল ভূপাল শ্ৰীহরি ঘোষকে ফেলিয়া যাইতে পারিল না। শ্ৰীহরি বলিল—কালই থানায় ডায়রি করবি। বুঝলি?

—যে আজ্ঞে।

–দেখুড়ের তিনকড়ির নামে আমার ডায়রি করা আছে। দারোগাবাবুকে মনে করিয়ে দিবি কথাটা। বলিস কাল সন্ধের দিকে আমি থানায় যাব।

 

ভূপালও জাতিতে বাগদী; পুলিশের চাকরি তাহার অনেক দিনের হইয়া গেল। তাহার অনুমান সত্য–স্থানটাও মৌলকিনী দিঘির পাড়ের বটতলায়ই বটে এবং জমায়েত যাহারা হইয়াছিল তাহারাও ভল্লা বাণী ছাড়া আর কেহ নয় কিন্তু নেতৃত্ব তিনকড়ির নয়; শ্রীহরির অনুমান ভ্রান্তও বটে, আক্রোশপ্রসূতও বটে। তিনকড়ি জাতিতে সদ্‌গোপ, শ্ৰীহরির সঙ্গে দূর সম্পর্কের আত্মীয়তাও আছে; কিন্তু শ্রীহরির সঙ্গে বিবাদ তাহার অনেকদিনের। তিনকড়ি দুর্ধর্ষ গোয়ার। পৃথিবীতে কাহারও কাছে বাধ্যবাধকতার খাতিরে মাথা নিচু করে না। কঙ্কণার লক্ষপতি বাবু হইতে শ্রীহরি পর্যন্তওদিকে সাহেবসুবো হইতে দারোগা পর্যন্ত কাহাকেও সে হেঁটমুণ্ডে জোড়হস্তে প্ৰণাম জানায় না। এজন্য বহু দুঃখ-কষ্টই সে ভোগ করিয়াছে।

দেখুড়িয়ার ভল্লা বাণীদের নেতা সে বটে; কিন্তু তাহাদের ডাকাতি কি চুরির সহিত তাহার কোনো সংস্রব নাই। ডাকাতি করার জন্য সে ভল্লাদের তিরস্কার করে, অনেক সময় রাগের মাথায় মারিয়াও বসে। সে তিরস্কার, সে প্রহার ভল্লারা সহ্য করে; কারণ তাহাদের পাপের ধনের সহিত সংস্রব না রাখিলেও মানুষগুলির সঙ্গে তিনকড়ির সম্পর্ক অবিচ্ছেদ্য, বিপদের সময় সে কখনও তাহাদের পরিত্যাগ করে না। ডাকাতি কেসে, বি-এল কেসে তিনকড়িই তাহাদের প্রধান সহায়, সে-ই তাহাদের মামলা মকদ্দমার তদবির তদারক করিয়া দেয়, তাহাদের পাপার্জিত ধন দিয়াই করে, কিন্তু একটি পয়সার তঞ্চকতা কখনও করে না। অবশ্য তদবির করিতে গিয়া ওই পয়সা হইতেই সে অল্পস্বল্প ভালমন্দ খায়—বিড়ির বদলে সিগারেটও কেনে, মামলা জিতিলে মদও খায়, কিন্তু তাহার অতিরিক্ত কিছু নয়। যাহা অবশিষ্ট থাকে, তাহার পাই-পয়সাটি সে ভল্লাদের ফিরাইয়া দেয়। লোকে এই কারণেই সন্দেহ করেভল্লাদের গোপন পাপ-জীবনযাত্রারও নেতা ওই তিনকড়ি। পুলিশের খাতায় বহুস্থানে তাহার উল্লেখ আছে। ভল্লাদের প্রায় প্রতিটি কেসেই পুলিশ তিনকড়িকে জড়াইতে চেষ্টা করিয়াছে কিন্তু কিছুতেই কৃতকার্য হইতে পারে নাই। ভল্লাদের মধ্যে কবুল-খাওয়া লোকের সংখ্যা অতি অল্প। কালেভদ্ৰে নিতান্ত অল্পবয়সী নতুন কেহ হয়ত পুলিশের ভীতি-প্রলোভনময় কসরতে কাবু হইয়া কবুল করিয়াছে, কিন্তু তাহাদের মুখ হইতেও কখনও তিনকড়ির নাম বাহির হয় নাই।

বি-এল কেস—এসব ক্ষেত্রে পুলিশের মোক্ষম অস্ত্র। কিন্তু বি-এল কেসে অর্থাৎ ব্যাড লাইভলিহুড বা অসদুপায়ে জীবিকা-উপার্জনের অভিযোগের পথে প্রথম ও প্রধান অন্তরায় তিনকড়ির পৈতৃক জোতজমা। জোতজমা তাহার বেশ ভালই ছিল। এবং গোয়ার হইলেও তিনকড়ি নিজে খুব ভাল চাষী; এ অঞ্চলের কোনো সাক্ষীই একথা অস্বীকার করিতে পারে নাই। এ বিষয়ে তার কয়েকটা ব্ৰহ্মাস্ত্রের মত প্রমাণ আছে। জেলার সদর শহরে অনুষ্ঠিত সরকারি কৃষি-শিল্প ও গবাদি-পশু প্রদর্শনীতে চাষে উৎপন্ন কপি, মুলা, কুমড়া প্রভৃতির জন্য সে বহু পুরস্কার পাইয়াছে, সার্টিফিকেট পাইয়াছে। বার দুয়েক মেডেলও পাইয়াছে;ভাল বলদ, দুধালো গাইয়ের জন্যও তাহার প্রশংসাপত্র আছে। সেইগুলি সে দাখিল করে।

এতদিনে অবশ্য পুলিশের চেষ্টা সফল হইবার সম্ভাবনা হইয়াছে। চাষে এমন উৎপাদন সত্ত্বেও তিনকড়ির জোতজমার অধিকাংশ জমিই নিঃশেষ হইয়া আসিয়াছে। পঁচিশ বিঘার মধ্যে মাত্র পাঁচ বিঘা তাহার অবশিষ্ট আছে।

তিনকড়ির একসময় প্রেরণা জাগিয়াছিল—সে তাহাদের গ্রামের অধীশ্বর বৃক্ষতল-অধিবাসী বাবা মহাদেবের একটা দেউল তৈরি করাইয়া দিবে। সেই সময় তাহার হাতে কতকগুলা নগদ টাকাও আসিয়াছিল। তাহাদের গ্রামের খানিকটা সীমানা ময়ূরাক্ষীর ওপার পর্যন্ত বিস্তৃত ওপারের জংশন স্টেশনে নতুন একটা ইয়ার্ড তৈয়ারি করিবার প্রয়োজনে সেই সীমানার অধিকাংশটাই রেল কোম্পানি গভর্নমেন্টের ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন আইন অনুসারে কিনিয়া লয়। ওই সীমানার মধ্যে তিনকড়িরও কিছু জমি ছিল বাবা দেবাদিদেবেরও ছিল। বাবার জমির মূল্যটা বাবার অধীশ্বর জমিদার লইয়াছিলেন, টাকাটা খুব বেশি নয়—দুই শত টাকা। তিনকড়ি পাইয়াছিল শচারেক। তাহার উপর তখন তাহার ঘরে ধানও ছিল অনেকগুলি। এই মূলধনে তিনকড়ি উৎসাহিত হইয়া গাছতলাবাসী দেবাদিদেবকে গৃহবাসী করিবার জন্য উঠিয়া পড়িয়া লাগিয়া গেল। জমিদারের কাছে গিয়া প্রস্তাব করিল, দেবাদিদেবের জমির টাকাটা হইতে বাবার মাথার উপর একটা আচ্ছাদন তুলিয়া দেওয়া হউক! জমিদার বলিলেন-দুশো টাকায় দেউল হয় না।

তিনকড়ির অদম্য উৎসাহ, সে বলিল-আমরা চাঁদা তুলব, আপনি কিছু দেন, ভল্লারা গতরে খেটে দেবে হয়ে যাবে একরকম করে। আরম্ভ করুন আপনি।

জমিদার বলিলেনতোমরা আগে কাজ আরম্ভ কর, চাঁদা তোল—তারপর এ টাকা আমি দেব।

তিনকড়ি সে কথাই স্বীকার করিয়া লইল এবং ভল্লাদের লইয়া কাজে লাগিয়া গেল। প্রায় হাজার ত্রিশেক কাঁচা ইট তৈয়ারি করিয়া ফেলিয়া জমিদারকে গিয়া বুলিল-কয়লা চাই, টাকা দেন।

জমিদার আশ্বাস দিলেন—একেবারে কয়লা-কুঠি থেকে কয়লা আনবার ব্যবস্থা করব।

কয়লা আসিবার পূর্বে বর্ষা আসিয়া পড়িল, ত্রিশ হাজার কাঁচা ইট গলিয়া আবার মাটির স্থূপে পরিণত হইল, বহু তালপাতা কাটিয়া ঢাকা দিয়াও তিনকড়ি তাহা রক্ষা করিতে পারিল না। রাগে ফুলিয়া উঠিয়া এবার সে জমিদারকে আসিয়া বলিল—এ ক্ষতিপূরণ আপনাকে দিতে লাগবে।

জমিদার তৎক্ষণাৎ তাহাকে খেদাইয়া দিলেন।

তিনকড়ি ক্ষিপ্ত হইয়া দেবোত্তরের অর্থ আদায়ের জন্য জমিদারের নামে নালিশ করিল। দুই শত টাকা আদায় করিতে মুনসেফি আদালত হইতে জজ আদালত পর্যন্ত সে খরচ করিল সাড়ে তিনশত টাকা। ইহাতেই শুরু হইল তাহার জমি বিক্রয়। টাকা আদায় হইল না, উপরন্তু জমিদার মামলাখরচ আদায় করিয়া লইলেন। লোকে তিনকড়ির দুর্বদ্ধির অজস্র নিন্দা করিল, কিন্তু তিনকড়ি কোনোদিন আফসোস করিল না। সে যেমন ছিল তেমনি রহিল, শুধু ওই দেবাদিদেবকে প্রণাম করা ছাড়িল;আজকাল যতবার ওই পথে সে যায়-আসে, ততবারই বাবাকে দুই হাতের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখাইয়া যায়।

দেবাদিদেবের উদ্ধার চেষ্টার পরও তাহার যাহা ছিল—তাহাতেও তার জীবন স্বচ্ছন্দে চলিয়া যাইত। কিন্তু ইহার পরই শিবু দারোগার নাকে ঘুষি মারার মামলায় পড়িয়া সে প্রায় তিন বিঘা জমি বেচিতে বাধ্য হইল। শিবু দারোগা আসিয়াছিল তাহার ঘর সার্চ করিতে। কোনো কিছু সন্দেহজনক না পাইয়া শিবচন্দ্রের মাথায় খুন চড়িয়া গেল; ক্ষুব্ধ আক্ৰোশে যথেচ্ছ হাত-পা চালাইয়া তিনকড়ির ঘরের চাল-ডাল-নুন-তেল ঢালিয়া মিশাইয়া সে একাকার করিয়া দিল। খানাতল্লাশিতে তিনকড়ি আপত্তি করে নাই, বরং মনে মনে সকৌতুকে হাসিতেছিল। এমন সময় শিবু দারোগার এই প্রলয়ঙ্কর তাণ্ডব দেখিয়া সে-ও ক্ষেপিয়া গেল। ধ করিয়া বসাইয়া দিল শিবচন্দ্রের নাকে এক ঘুষি। প্রচণ্ড ঘুষি—দারোগার নাকের চশমাটা একেবারে নাক-কাটিয়া বসিয়া গেল। দারোগার নাকে সে দাগটা আজও অক্ষয় হইয়া আছে। সেই ব্যাপার লইয়া পুলিশ তাহার নামে মামলা করিল। সঙ্গে সঙ্গে সে-ও দারোগার নামে মামলা করিল-ওই তাণ্ডব। নৃত্যের অভিযোগে। গ্রামের ভল্লারা সকলেই তিনকড়ির সাক্ষী, প্রচণ্ড তাণ্ডব নৃত্যের কথাটা সকলেই একবাক্যে নিৰ্ভয়ে বলিয়া গেল। পুলিশ সাহেব আপোসে মামলা মিটাইয়া লইলেন। ততদিনে কিন্তু তিনকড়ির আরও তিন বিঘা জমি চলিয়া গিয়াছে।

বর্তমানে তিনকড়ি প্ৰজা ধর্মঘটে মাতিয়া উঠিয়াছে। কিন্তু তাই বলিয়া ভল্লাদের লইয়া শ্ৰীহরির ঘরে ডাকাতি করিবার মত মনোবৃত্তি তাহার নয়। অবশ্য সে মাঠেও ও-কথাটা বলিয়াছিল দেব ছিরেকে একদিন মুলোর মত মুচড়ে।… কথাটা নেহাতই কথার কথা। তাহার কথারই ওই ধারা; তাহার স্ত্রী যদি একটু উচ্চকণ্ঠে কথা বলে, তবে তৎক্ষণাৎ সে গর্জন করিয়া ওঠে–টুঁটিতে পা দিয়ে দোব তোর নেতার মেরে, দেখবি? …

সেদিন দেখুড়িয়ায় যে নাগরা বাজিল সে নাগরা তিনকড়িই বাজাইতেছিল।

এই গভীর দুর্যোগের রাত্রে নাগরার শব্দ শুনিয়া তিনকড়ির স্ত্রীর ঘুম ভাঙিয়া গিয়াছিল। তিনকড়ির ঘুম অসাধারণ ঘুম। খাইয়াদাইয়া বিছানায় পড়িবামাত্র তাহার চোখ বন্ধ হয়, এবং মিনিট তিনেকের মধ্যেই নাক ডাকিতে শুরু করে। নাকডাকা আবার যেমন-তেমন নয়, ধ্বনিবৈচিত্র্যে যেমন বিচিত্র, গর্জনগাম্ভীর্যে তেমনি গুরুগম্ভীর। রাত্রিতে প্রসুপ্ত পল্লীপথে তিনকড়ির বাড়ির অন্তত আধ রশি দূর হইতে সে ধ্বনি শোনা যায়। একবার এ অঞ্চলের থানায় নূতন জমাদার প্রথম দিন দেখুড়িয়ায় রোদে আসিয়া তিনকড়ির বাড়ির আধ রশিটাক দূরে হঠাৎ থমকিয়া দাঁড়াইয়া চৌকিদারটাকে বলিয়াছিল—এই! দাঁড়া!

চৌকিদারটা কিছু বুঝিতে পারে নাই, তাহার কাছে অস্বাভাবিক কিছুই ঠেকে নাই, সে একটু বিস্মিত হইয়া প্রশ্ন করিয়াছিল—আজ্ঞে?

জমাদার দুই পা পিছাইয়া গিয়া চারিদিকে চাহিয়া গৰ্জনের স্থান নির্ণয় করিবার চেষ্টা করিতেছিল, দাঁত খিঁচাইয়া বলিল সাপ,হারামজাদা, শুনতে পাচ্ছ না? গোঙাচ্ছে? … তারপরই বলিয়াছিল—সাপে নেউলে বোধহয় লড়াই লেগেছে। শুনতে পাচ্ছিস?

এতক্ষণে চৌকিদারটা ব্যাপার বুঝিয়া হাসিয়া বলিয়াছিল—আজ্ঞে না।

-না? আরব বেটাকে এক থাপ্নড়।

–আজ্ঞে না, উ তিনকড়ি মোড়লের নাক ডাকছে।

–নাক ডাকছে?

–আজ্ঞে হ্যাঁ। তিনকড়ি মোড়লের।

জমাদার বিস্ফারিত নেত্রে আবার একবার প্রশ্ন করিয়াছিল–নাক ডাকছে?

এবার চৌকিদারটা আর হাসি সামলাইতে পারে নাই, খু খুক করিয়া হাসিয়া বলিয়াছিল–আজ্ঞে হ্যাঁ, নাক।

—কোন তিনকড়ি? পুলিশ সস্পেক্ট যে লোকটা?

–আজ্ঞে হ্যাঁ।

–রোজ ডাকিস্‌ লোকটাকে?

চৌকিদারটা চুপ করিয়াছিল, কোনোদিনই ডাকে না, ওই নাকডাকার শব্দ হইতেই তিনকড়ির বাড়িতে থাকার প্রমাণ লইয়া চলিয়া যায়।

জমাদার বলিয়াছিল—থা, ডাকিস্ না বেটাকে। যেদিন নাক না-ডাকবে সেদিন খবর করি।–কিছুক্ষণ পর আবার বলিয়াছিল—বেটা বড় সুখে ঘুমোয় রে!

এমনি ঘুম তিনকড়ির। এ ঘুম ভাঙাইলে আর রক্ষা থাকে না। কিন্তু আজ এই নিশীথরাত্রে নাগরার শব্দ শুনিয়া তিনকড়ির স্ত্রী লক্ষ্মীমণি স্থির থাকিতে পারিল না। সে চাষীর মেয়ে, নাগরার ধ্বনির অর্থ সে জানে, তাহার মনে হইল, ময়ূরাক্ষীতে বুঝি বন্যা আসিয়াছে। তিনকড়ির একটি ছেলে, একটি মেয়ে; ছেলেটির বয়স বছর ষোল, মেয়েটির বয়স চৌদ্দ। তাহাদেরও ঘুম ভাঙিয়াছিল। মেয়েটি মায়ের কাছেই শোয়, ছেলে শোয় পাশের ঘরে। তিনকড়ি শুইয়া থাকে বাহিরের বারান্দায়; পাশে থাকে একটা টেটা; একখানা খুব লম্বা হেঁসো দা এবং একগাছা লাঠি।

দরজা খুলিয়া বাহিরে আসিয়া তিনকড়ির স্ত্রী তাহাকে ঠেলা দিয়া জাগাইল—ওগো—ওগো–ওগো!

প্রবল ঝাঁকুনিতে তিনকড়ি একটা চিৎকার করিয়া উঠিয়া বলিল—এ্যাঁও! কে রে?—সঙ্গে সঙ্গে সে হাত বাড়াইল হেঁসো দাখানার জন্য।

লক্ষ্মীমণি খানিকটা পিছাইয়া গিয়া বার বার বলিল—আমিআমিওগো আমি, ওগো আমি-আমি লক্ষ্মী-বউ! আমি সন্নর মা!

–কে? লক্ষ্মী–বউ?

–হ্যাঁ।

–কি?

–নাগরা বাজছে, বোধহয় বান এসেছে।

–বান?

–ওই শোন নাগরা বাজছে।

তিনকড়ি কান পাতিয়া শুনিল। তারপর বলিল–হুঁ।

লক্ষ্মীমণি বলিল–ঘর-দোর সামলাই?

তিনকড়ি উত্তর না দিয়া সেই দুর্যোগের মধ্যেই বারান্দার চালে উঠিয়া বারান্দার চাল হইতে তাহার কোঠা-ঘরের চালে উঠিয়া দাঁড়াইয়া কান্ পাতিল। নাগরা বাজিতেছে। হকও উঠিতেছে। কিন্তু এ হক তো বন্যা-ভয়ের হাঁক নয়! আ—আ—হৈ! এ যে চৌকিদারি হক। এদিকে ময়ূরাক্ষী হইতে তো কোনো গো গো ধ্বনি উঠিতেছে না। নদীর বুকে ডাক নাই। তবে তো এ ডাকাতির ভয়ের জন্য নাগরা বাজিতেছে। কাহারা? এ কাহারা?

তাহার গ্রামের পথেও চৌকিদার এবার হাঁকিয়া উঠিল—আ—আ–হৈ!

তিনকড়ি বার বার আপন মনে ঘাড় নাড়িল–হুঁ!–হুঁ! হু! ডাকাতির ভয়ে গ্রামে গ্রামান্তরে নাগরা বাজিতেছে, আর দেখুড়িয়ার ভল্লাদের সাড়া নাই! তাহারা লাঠি হাতে বাহির হয় নাই; বদমাশ পাষণ্ডের দল সব!—সে চালের উপর হইতেই হাঁক মারিল—আ-আ–হৈ!

চৌকিদারটা প্রশ্ন করিল—মোড়ল মশাই?

–হ্যাঁ। দাঁড়া। তিনকড়ি কোঠার চাল হইতে বারান্দার চালে লাফ দিয়া পড়িল, সেখান। হইতে লাফাইয়া পড়িল একেবারে উঠানে। দেরি তাহার আর সহিতেছিল না। দরজা খুলিয়া বাহিরে আসিয়া সে বলিলভল্লাপাড়ায় কে কে নাই রে? ডেকে দেখেছিস?

চৌকিদারও জাতিতে ভল্লা। সে চুপি চুপি বলিলরাম নাই একেবারে নিয্যস। গোবিন্দ, রংলেলে (রঙলাল), বিদ্বেন, তেরে (তারিণী) এরাও নাই। আর সবাই বাড়িতে আছে।

—থানার কেউ রোদে আসবে না তো আজ?

–আজ্ঞে না।

তিনকড়ি আপন মনে দাঁতে দাঁত ঘষিতে আরম্ভ করিল। ওদিকে দুর্যোগময়ী রাত্রির পুঞ্জীভূত অন্ধকারটা যেন চিরিয়া-ফাড়িয়া পর পর দুইটা বন্দুকের শব্দ ময়ূরাক্ষীর কূলে কূলে ছুটিয়া চলিয়া গেল। তিনকড়ি শঙ্কিত হইয়া বলিল–বন্দুকের শব্দ?

–আজ্ঞে হ্যাঁ।

পিছন হইতে তিনকড়ির ছেলে ডাকিল–বাবা!

ছেলে গৌর এবং মেয়ে স্বর্ণ বাপের বড় প্রিয়। গৌর মাইনর স্কুলে পড়ে, বাপের সঙ্গে চাষেও খাটে। ছেলের ধার তেমন নাই, নতুবা তিনকড়ি তাহাকে বি-এ, এম-এ পর্যন্ত পড়াইত। মধ্যে মধ্যে আক্ষেপ করিয়া বলে—গৌরটা যদি মেয়ে হত, আর স্বর্ণ যদি আমার ছেলে হত!

সত্যিই স্বর্ণ ভারি বুদ্ধিমতী মেয়ে, মেয়েটি তাহাদের গ্রাম্য পাঠশালা হইতে এলপি পরীক্ষা দিয়া মাসে দুই টাকা হিসাবে বৃত্তি পাইয়াছিল। কিন্তু তারপর তাহার পড়ার উপায় হয় নাই। তবু সে দাদার বই লইয়া আজও নিয়মিত পড়ে; মাকে গৃহকর্মে সাহায্য করে। চমৎকার সুশ্রী মেয়ে, কিন্তু হতভাগিনী। স্বর্ণ সাত বৎসর বয়সে বিধবা হইয়াছে। তিনকড়ির ওই ক্ষুব্ধ কামনার মধ্যে বোধ হয় এ দুঃখও লুকানো আছে। স্বর্ণ যদি ছেলে হইত আর গৌর যদি মেয়ে হইত, তবে তো তাহাকে কন্যার বৈধব্যের দুঃখ সহ্য করিতে হইত না; গৌর তো স্বর্ণের ভাগ্য লইয়া জন্মগ্রহণ করিত না। ছেলে গৌর তাহার অত্যন্ত প্রিয়। বাপের মতই বলিষ্ঠ। ভোেররাত্রি হইতে বাপের সঙ্গে মাঠে যায়, বেলা নয়টা পর্যন্ত তাহাকে সাহায্য করে; তারপর সে স্নান করিয়া খাইয়া জংশনের স্কুলে পড়িতে যায়। বাবুদের স্কুল বলিয়া তিনকড়ি তাহাকে কঙ্কণায় পড়িতে দেয় নাই। যে বাবুরা দেবতার সম্পত্তি মারিয়া দেয়, তাহাদের স্কুলে পড়িলে তাহার ছেলেও পরের সম্পত্তি মারিয়া দিতে শিখিবে—এই তাহার ধারণা! চারিটায় বাড়ি ফিরিয়া গৌর আবার সন্ধ্যা পর্যন্ত বাপকে সাহায্য করে, তাহার পর সন্ধ্যায় বাড়ির একটিমাত্র হারিকেন জ্বালিয়া রাত্রি দশটা পর্যন্ত পড়ে।

ছেলের ডাকে তিনকড়ি উত্তর দিল—কি বাবা?

–ঘর-দোর সামলাতে হবে না?

–না। তোমরা ঘরে গিয়ে শোও। আমি আসছি। ভয় নাই, কোনো ভয় নাই! বানের ভেঁড়া নয়।—বলিয়া চৌকিদার রতনকে ডাকিল–রতন আয়।

গ্রামের প্রান্তে মাঠের ধারে আসিয়া তাহারা দাঁড়াইল জমাট-বস্তীর সন্ধানে। চারিদিকে অন্ধকার থমথম করিতেছে। সঠিক কিছু বুঝা যাইতেছে না। হঠাৎ তিনকড়ি বলিলরতন!

–আজ্ঞে।

–আঠার সালের বান মনে আছে?

আঠার সালের বন্যা ময়ূরাক্ষীর তটপ্রান্তবাসীদের ভুলিবার কথা নয়। যাহারা সে বন্যা দেখিয়াছে, তাহারা তো ভুলিবেই না, যাহারা দেখে নাই, তাহারা সে বানের গল্প শুনিয়াছে; সে গল্পও ভুলিবার কথা নয়। রতন বাণীর পক্ষে তো আঠার সালের বন্যা তাহার জীবনের একটা বিশেষ ঘটনা। আঠার সালের বন্যা আসিয়াছিল গভীর রাত্রে এবং আসিয়াছিল অতি অকস্মাৎ। তখন রতনের ঘর ছিল গ্রামের প্রান্তে ময়ূরাক্ষীর অতি নিকটে। গভীর রাত্রে এমন অকস্মাৎ বান। আসিয়াছিল যে, রতন স্ত্রী-পুত্র লইয়া শুধু হাতে-পায়েও ঘর ছাড়িয়া যাইতে পারে নাই, অগত্যা আপনার ঘরের চালে উঠিয়া বসিয়াছিল। ভেরবেলায় ঘর ধসিয়া চালাখানা ভাসিল, ভাসিয়া চলিল বন্যার স্রোতে! দুৰ্দান্ত স্রোত। রতন নিজে সাঁতার দিয়া আত্মরক্ষা করিতে পারি, কিন্তু স্ত্ৰীপুত্রকে লইয়া সে স্রোতে সাঁতার দিবার মত ক্ষমতা তাহার ছিল না। সেদিন তিনকড়ি এবং ওই রামভল্লা অনেকগুলি আলাদড়ি বাঁধিয়া এক এক করিয়া সাঁতার দিয়া আসিয়া চালে দড়ি বাঁধিয়াছিল। শুধু তাই নয়, ঠিক সেই মুহূর্তেই রতনের স্ত্রী টলিয়া পড়িয়া গিয়াছিল বন্যার জলে। রামভল্লা ও তিনকড়ি ঝাঁপ দিয়া বন্যার জলে পড়িয়া তাহাকেও টানিয়া তুলিয়াছিল। সে কথা কি রতন ভুলিতে পারে? সেই অন্ধকারেই রতন হাত বাড়াইয়া তিনকড়ির পা ছুঁইয়া নিজের মাথায় হাত বুলাইয়া বলিল—সে কথা ভুলতে পারি মোড়ল মশাই? আপুনি তো

—আমার কথা নয় রতন। রামার কথা বলছি। যদি ভাল ভালয় ফিরে আসে। রতন বলিল—ওই দেখুন, আপথ ধরে ওই কালো কালো সব গাঁ ঢুকছে।


© 2024 পুরনো বই