কিছুকাল আগে রেডিয়ো থেকে কয়েকজনকে ‘মনে রাখার মত মানুষ’ এই পর্যায়ে নিজের নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার কথা বলতে বলা হয়েছিল। এই পর্যায়ের কথিকাগুলি সত্যই একেবারে বিস্ময়কর এবং কৌতূহলোদ্দীপক। ইংরেজিতে যাকে বলে Truth is stranger than fiction; কিন্তু যিনি fiction রচনা করেন তার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সত্য অবশ্যম্ভাবীরূপে তার fictionভুক্ত বা তার অঙ্গীভূত হয়ে বসে থাকে। অবশ্য যদি সে অভিজ্ঞতালব্ধ সত্য সদ্য-লব্ধ না হয়। পৃথিবীর সব লেখকই এই বিচিত্র বিস্ময়কর সত্যের মধ্য দিয়ে সেই জীবন-সত্যকে খুঁজে বেড়ান, স্বর্ণ-সন্ধানী বা মণিমাণিক্য-সন্ধানী দুঃসাহসীর মত। সে সন্ধান যার মেলে সেই ফকির থেকে হয় ধনী। এর সন্ধানেই বড় বড় লেখকেরা মানুষের মেলার মধ্যে বিহ্বলের মত ঘুরে বেড়িয়েছেন। লিখবার উদ্দেশ্যে ঘোরেন না, দেখবার উদ্দেশ্যেই ঘোরেন। লন্ডন প্যারিসের পথে গলিতে, রাশিয়ার শহরে গ্রামে ব্ল্যাক-সির তটভূমিতে বড় বড় লেখকেরা ঘুরেছেন, দেখেছেন। যারা পূর্বকালে এদেশে মহাকাব্য লিখেছেন তারা পদব্রজে ভারতের হিমালয় থেকে সমতল নগরগ্রাম অরণ্যভূম পরিভ্রমণ করেছেন। এই সত্য মিলে গেছে এমনই বিচিত্র মানুষের জীবন-সত্য থেকে। আমারও এ স্বভাব ছিল, আজও আছে। এককালে বাংলার মেলায় মেলায় ঘুরেছি। গ্রামে গ্রামে ঘুরেছি। এখনও ঘুরি। এমনি ঘোরার মধ্যে দেখা পেয়েছিলাম একজন মনে রাখার মত মানুষের। আমি লেখক, আমার মনে রাখার মত মানুষ মনেই থাকে নি আমার মনের সাগরে অবগাহন করে আমার লেখার মধ্য দিয়ে বেরিয়ে এসেছে। সপ্তপদী সৃষ্টির এই বিচিত্র সত্যটি ইদানীংকালে আমার রচনার মধ্যে সর্বাপেক্ষা বেশি প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বা বাস্তব-বৈচিত্র্য অনুসারী। এবং সত্য সত্যই এক্ষেত্রে Truth is stranger than fiction.
সপ্তপদীর সমাদর হয়েছে। এবং গল্পের নায়কের অস্তিত্ব ও সত্যের কথা রেডিয়ো শ্রোতাদের কাছে বলেছি ও প্রবন্ধের বইয়ের মারফত পাঠকদের কাছেও হাজির করেছি। সেইটুকু পরিশিষ্টে অন্তর্ভুক্ত করছি।
মানুষের বাস্তব জীবনে রাম মেলে না কিন্তু মহাকবি রবীন্দ্রনাথ মেলে–মহাত্মা গান্ধী মেলে–নেতাজী সুভাষচন্দ্ৰ মেলে—আমার জীবনেই মিলেছে। তারা তাদের কর্মে কীর্তিতে ইতিহাসের পাতার মারফতে চিরকাল মানুষের মনে থাকবেন। যারা না দেখেছে—তারাও রাখবে। কিন্তু এছাড়া কিছু মানুষ আছে যাদের ছবি ওঁদের ছবির নিচের সারিতে ঝুলানো থাকে, যাঁরা একান্তভাবে আমার কালে আমার মনেই অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন। আমার মুখে বা আমার লেখার মধ্যে আঁকা তাঁর ছবি হয়ত অনেক লোকের মনেই আঁকা হয়েছে। কতদিন তা উজ্জ্বল থাকবে তা বলতে পারিনে, সে নির্ভর করছে আমার লেখার সার্থকতার উপর। তবে সে মানুষ আমার মনে অক্ষয় হয়ে থাকবে চিরদিন। আমি লেখক বলেই এ-কথা বলছি। আমার কাছে মনে রাখবার মত মানুষ যারা—আমার লেখার মধ্যে অবশ্যই রূপ নিয়েছে। এক শশী ডোমই কি কম বার এসেছে ফিরে ফিরে! আজ বিশ্লেষণ-বিচার করতে গিয়ে দেখছি নিজেই আমি ছদ্মবেশ নিয়ে বেশিবার এসেছি। সে আমার নিজের কথা বলেছি। সে মনে রাখার মত মানুষের পর্যায়ে পড়ে না। কিন্তু প্রথম থেকেই একটি মানুষ অমৃত-ভরা স্বৰ্ণ-পাত্রের মত আমার চোখের সামনে আসছেন।
কদিন বা দেখা, কতটুকু বা পরিচয়, হিসেব করে বলতে বললে বলি–
১৯১৬ সালে সেন্টজেভিয়ার্স কলেজে ভর্তি হলাম। পড়বার সুযোগ হয়েছিল মাস ছয়েক। সেই সময় অতি দৃপ্ত প্রচুর উল্লাসে ভরা কলেজ মাতানো একটি লম্বা ছেলেকে দেখেছিলাম। তার পদক্ষেপ বলে দিত—এ আর কেউ নয়, সে; বহু কলরবের মধ্যে একটি, সবার উপরে ছাপিয়ে উঠত, শুনেই বুঝতাম সে; খেলার মাঠে গোলের মধ্যে বল নিয়ে ঢুকে গেল যে—সে আর কেউ নয়, সেসে। যেন একটা ঘূর্ণাবর্ত। বোধহয় ফোর্থ ইয়ারে পড়ত। আমাদের থেকে বয়সে বড়, কথা বলবার ক্ষেত্রও হয় নি—সুযোগও হয় নি। কলেজের দক্ষিণদিকে তখন জুনিয়ার ও সিনিয়ার কেম্ব্রিজ ইস্কুল—সেখানে পড়ে বড় বড় লোকের ছেলে আর এ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের ছেলে। মধ্যে মধ্যে দেখি সে তাদের মধ্যে বসে সিগারেট খায়। হঠাৎ গুজব শুনলাম ওই ছেলেটি ক্রিস্টান হচ্ছে। সেকালে মনটা ছাৎ করে উঠেছিল। হিন্দুর ছেলে ক্রিস্টান হয়ে যাচ্ছে? ছিছিছি! অকপটেই আজ স্বীকার করব যে সেকালে ক্রিস্টান ধর্ম ইংরেজদের ধর্ম–ইংরেজদের ধর্ম বলে তার উপর সাধারণভাবে হিন্দুরা প্রীত ছিল না। তা ছাড়া প্রতি ধর্মেই একটা গোঁড়ামি আছে। এবং তার মধ্যে আমাদের ধর্মের বিধিনিষেধের কঠোরতার সঙ্গে বিদ্বেষও বেশি এ-কথা অস্বীকার করব না।
আরও ছি—ছি করে উঠলাম যখন শুনলাম ক্রিস্টান ধর্ম সে গ্রহণ করবে একটি এ্যাংলো ইন্ডিয়ান মেয়েকে বিয়ে করবে বলে। তারা দুজনেই দুজনকে ভালবেসেছে। কিন্তু মেয়েটির বাপ বলেছেন-ক্রিস্টান না হলে তিনি এ বিবাহে মত দেবেন না। তাই সে বলেছে—ভাল কথা–ক্রিস্টানই সে হবে।
এরপর সে কয়েকদিনের মধ্যেই কলেজের পটভূমি থেকে মুছে গেল। আর তাকে দেখা গেল না। আর সে দুপদাপ পদধ্বনি শোনা যায় না, কণ্ঠস্বর শোনা যায় না; খেলার মাঠে লম্বা একটি খেলোয়াড়কে বল নিয়ে নেটের মধ্যে ঢুকে যেতে দেখা যায় না। শুনলাম-বিয়ে করে রেলে-টেলে চাকরি নিয়ে চলে গেছে।
ব্যস–মুছে গেল সে কলেজ-স্মৃতি থেকে। আমিও কমাস পর পুলিশের তাড়ায় পড়া ছেড়ে গ্রামে এলাম। বাড়িতে অন্তরীণ হলাম। দিনে দিনে বিস্মৃতির স্থূল অন্ধকার সে আমলের দেখা লক্ষ লক্ষ মানুষের সঙ্গে তাকে গ্রাস করল—যেমনভাবে মাটির স্তর গ্রাস করছে মহেঞ্জোদাড়ো-হরপ্পার সঙ্গে কত নামহীন গ্রামকে কত কুটিরকে। মনের বিস্মৃতির গ্রাস বোধ করি আরও বিচিত্র। আমার একটি গল্প আছে-এক তরুণ যাত্ৰাদলের গায়ক একটি গ্রাম্য তরুণীকে ভালবেসেছিল। কিন্তু মিলন তাদের হল না। দীর্ঘকাল পরে সেই যাত্ৰাদলের গায়ক-তখন সে প্রবীণ, এল সেই গ্রামে গাওনা করতে; সেই মেয়েটি তখন গৃহিণী-জননী-প্রৌঢ়া-জুলাঙ্গী : যাত্ৰাদলের গায়ক যতক্ষণ আসরে গান করলে ততক্ষণই সতৃষ্ণ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে খুঁজলে—তাকে যদি দেখতে পায়। মেয়েটি সামনেই বসে গান শুনছিল। কিন্তু কেউ কাউকে চিনতে পারলে না। বাহির সংসারে মানুষ মরলে তাকে পুড়িয়ে ছাই করি, মাটির তলায় কবর দি। মনের সংসারে মানুষ জীবিতকেও মাটির তলায় চাপা দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়। তাকে বোধ করি মাস কয়েকের মধ্যেই কবর দিয়েছিলাম মনের মধ্যে।
এর চল্লিশ বৎসর পর। ১৯৫৬ সাল। বিশেষ কারণে স্থান এবং পাত্রের নাম গোপন রেখেই বলছি সুদূর পার্বত্য অঞ্চলে ভারতবর্ষের প্রায় এক প্রান্তসীমায় গিয়েছিলাম সভাসমিতির নিমন্ত্রণে। যার বাড়িতে উঠেছিলাম তিনি একদা ছিলেন উচ্চপদস্থ রাজ কর্মচারী। আমারই সমবয়সী। জীবনের পরিচয় আদান-প্রদানের সূত্রে প্রকাশ পেল যে তিনি এবং আমি একই সালে, একই কলেজে, একই শ্রেণীতে পড়েছি। মুহূর্তে পরস্পরের বেশ একটু নিবিড় অন্তরঙ্গতা অনুভব করলাম। সঙ্গে সঙ্গে অতীতকাল সাড়া দিয়ে উঠল। সেই কলেজ জীবনের কথা ছোটখাটো টুকরো টুকরো বেরিয়ে আসতে লাগল। যেন প্ৰবল একটা বর্ষণে মাটি ধুয়ে বেরিয়ে পড়েছে। কয়েকটা কাচের বা শাকের চুড়ির টুকরো, কোনো একটা ভাঁড়ের ভাঙা কানাটা হয়ত বা গোটাই একটা খুরি বা পাথরের শিল। একে মনে আছে? ওকে? আছে বৈকি। সেই তো রোল নম্বর একশো কি এক? দাঁত দুটি উঁচু। কপালে চুলের একটা ঘূর্ণি?
–হ্যাঁ–হ্যাঁ। আর তাকে?
–কাকে বলুন তো? কেমন দেখতে?
একদিন তার সঙ্গে পার্বত্য অঞ্চলে জিপে ঘুরছি, দুধারে বন আর পাহাড়, হঠাৎ এক জায়গায় এসে প্রশ্ন করলেন—একে মনে আছে? আমাদের সময়ে ফোর্থ ইয়ারে পড়ত, লম্বা কালো হইহই করে মাতিয়ে রাখত সব। মেম বিয়ে করবার জন্যে ক্রিস্টান হয়েছিল?
বললাম–আছে বৈকি!
–দেখবেন তাকে?
–এখানে কোথায় সে?
–চলুন, দেখবেন।
জিপকে ঘুরিয়ে নিয়ে গেলেন একখানি গ্রামে। পাহাড়ের কোলে আদিবাসীদের গ্রাম। তার মধ্যে কাঠে তৈরি একটি চার্চ। সেই চার্চের পাদরী, একজন দীর্ঘ শীর্ণকায় মানুষ—মুখে আশ্চর্য প্রসন্ন হাসি। গ্রামের ছেলেদের পড়াচ্ছেন।
বললেন–উনি।
অবাক বিস্ময়ে প্রশ্ন করলাম—উনি?
–হ্যাঁ। কিছুদিন হল ওঁকে আবিষ্কার করেছি, কথায় কথায় পরিচয় হল—জানলাম উনিই তিনি।
সেই প্রচণ্ড দুর্দান্ত হইহই-করা ছেলে—যে একটি নারীর জন্যে ধর্ম-বাপ-মা সব বিসর্জন দিতে পারে—সেই ইনি। শান্ত-প্রসন্ন মধুর।
বন্ধু বললেন–একটা ট্রাজেডির দৃষ্টান্ত।
—মেয়েটি মরে গেছে?
—না। ঘটেছিল কী জানেন, এই যে ক্রিস্টান না হলে বিয়ে দেবে না, এ জেদ ছিল বাপের। মেয়েটি তা চায় নি। সে চেয়েছিল তিন আইনে বিয়ে হোক। ইনি ধর্ম মানতেন না, জাত মানতেন না। ইনি ক্রিস্টান হলেন, নিজের থেকে। এবং গিয়ে বললেন–আমি ক্রিস্টান হয়েছি। আর তো বাধা নেই।
মেয়ের বাপ বললেন– না।
কিন্তু মেয়ে সমস্ত শুনে অবাক হয়ে তাঁর মুখের দিকে চেয়ে রইল। তারপর বললে—তুমি আমার জন্যে, আই মিন একটি মেয়ের জন্যে, তোমার ঈশ্বর, তোমার ধর্ম ত্যাগ করলে?
উনি খুব উৎসাহের সঙ্গে হেসেছিলেন বলেছিলেন-—আমার জীবন দিতে পারি তোমার জন্য।
মেয়েটি বলেছিল–মাফ কর আমাকে। আমি তোমাকে বিয়ে করতে পারব না। তুমি আমার জন্যে এতকালের ঈশ্বরকে ত্যাগ করলে। কাল আমার থেকে কোনো সুন্দরী মেয়ে তোমার ভাল লাগলে আমাকে ত্যাগ করবে না কে বললে?
মেয়েটি ওকে বিয়ে করে নি। কোনো মতেই রাজি হয় নি। বাপ-মায়ের অনুরোধও রাখে নি।
উনি চলে এলেন মর্মাহত হয়ে। সারারাত ভাবলেন। স্থির করলেন ঈশ্বর এত বড়? এত প্রিয়? যার জন্যে সংসারের প্রিয়তম জনকেও উপেক্ষা করা যায়? তা হলে তিনি তাকেই খুঁজবেন। তার সেবাতেই জীবন নিয়োগ করবেন। সেই থেকে উনি এই কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন। প্রথমে ছিলেন-গারো পাহাড়ে। সেখানকার আদিবাসীদের সেবার মধ্য দিয়ে ঈশ্বর সাধনা করেছেন। পাকিস্তান হবার পর এখানে এসেছেন।
বললাম—সেই মেয়েটি?
–তার খবর উনি আর করেন নি, রাখেনও নি।
আমার মনে হল—আমার অন্তর্লোকের সকল স্তর ভেদ করে এক অতি-সাধারণ—অসাধারণ। মহিমায় মণ্ডিত হয়ে উঠে এসে সামনে দাঁড়িয়েছেন। অট্টহাসের বদলে প্রসন্ন ধীর হাস্যে সুপ্ৰসন্ন, দুর্দান্তপনার পরিবর্তে পরম প্রশান্ত, উল্লাস-চঞ্চলতার অধীরতার পরিবর্তে শান্ত ধীর।
মনে পড়ল বিখ্যাত উপন্যাস কুয়ো ভেডিস।
—Where goest Thou Lord!
উত্তর হল—To Rome, to be crucified again!
অল্প কয়েকটি কথা বলেছিলাম। উত্তরে কথা পেয়েছি অল্প। কিন্তু প্রসন্ন স্নিগ্ধ হাস্যে, যেন অমৃত ধারায় স্নানপুণ্য অনুভব করেছি।
জিজ্ঞাসা করলাম–ঈশ্বর পেয়েছেন?
শুনেছিলাম—পেয়েছি বৈকি। নইলে এত আনন্দ পাই কোথা থেকে?
ফিরে এলাম। আমার মনের স্মৃতির ঘরে একটি অতি সাধারণ মানুষের অসাধারণ জ্যোতির্ময় প্রতিকৃতি ঝুলিয়ে নিয়ে ফিরে এলাম। ঐতিহাসিক বিরাট পুরুষদের ছবির সারি অনেক উঁচুতে টাঙানো। ঘাড় উঁচু করে দেখতে হয়। এর ছবি ঠিক তাদের নিচেই ঝুলছে। মুখোমুখি হয়ে দাঁড়াই। আমার কাছে যিনি অবিস্মরণীয়—তিনি আমার লেখার মধ্যে দেখা না দিয়ে তো পারেন না। সপ্তপদীতে তিনিই কৃষ্ণেন্দু হয়ে দেখা দিলেন।
***
বাকি থেকে গেছে নায়িকার কথা। নায়িকার নাম রিনা ব্রাউন। অবশ্যই কাল্পনিক নাম। এবং কৃষ্ণের হারিয়ে-যাওয়া প্ৰেমিকার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক নেই। তাকে আমি দেখি নি। কথাও বিশেষ শুনি নি। রিনা তবু পুরো কাল্পনিক নাম। এ ক্ষেত্রে গল্প একটু সত্য—যা রূপকথার রাজকন্যার খসে-পড়া একগাছি সোনার বর্ণ চুলের এক অপরূপাকে মনে করিয়ে দেবার যা আমি পেয়েছিলাম তাই বলি। আসল মানুষটি এবং কৃষ্ণেন্দু যেমন এক নয় উপন্যাসের রিনা ব্রাউনও তেমনি সেই অসাধারণ মেয়েটি নয়—যে বলেছিল বা বলতে পেরেছিল, আমার মোহে তুমি যখন তোমার এতদিনের ধর্ম এতদিনের বিশ্বাসের ভগবানকে ত্যাগ করছ তখন কে বললে আমার থেকে সুন্দরী কাউকে দেখলে তাকে পরিত্যাগ করবে না। পূর্বেই বলেছি তাকে আমি দেখি নি তাকে আমি জানি না। যা ঘটেছিল তাতে সেই মেয়ের পক্ষে একমাত্র চিরকুমারী থাকাই উচিত। সত্য করে এই মেয়ের কী হয়েছিল বা হয়েছে তা সেই পাদরীও জানেন না। বাস্তব সত্য, গল্প উপন্যাসের কল্পনার বিচিত্র সত্য থেকেও অদ্ভুত। হয়ত অবিশ্বাস্য। লিখতে বসে রিনার চরিত্র নিয়ে বেশ ভাবনায় পড়েছিলাম। হঠাৎ একটি দেখা, মাত্র কয়েক বারে কয়েক ঝলক দেখা একটি ইংরেজ বা আমেরিকান বা এ্যাংলো-ইন্ডিয়ান বা ইংরিজিবাসিনী এক বিচিত্র বিদেশিনী মেয়ের কথা মনে পড়ে গেল। তার কয়েকটি কথা এবং ছবি মনের মধ্যে ভাসছে।
১৯৪৪ সালে পুরীর সমুদ্রতীরে তাকে প্রথম দেখেছিলাম। দীর্ঘাঙ্গী মেয়ে—চোখের পাতাগুলি ঘন কালো এবং ফুলের কেশরের মত দীর্ঘ। মাথার চুলে ঘনকৃষ্ণ শোভাই শুধু নয়–বিষুবরেখার অঞ্চলস্থ ঘাসের ঘন বৰ্ণাঢ্যতা এবং সমৃদ্ধিও তার রক্তের ইতিহাসের একটি সাক্ষ্য বহন করছিল। তার পরনে স্ন্যাক, গায়ে ফুলহাতা ব্লাউজ, মাথায় একখানা গাঢ় লাল রঙের রুমাল। উচ্চ-হাস্য-প্ৰমত্ত কণ্ঠস্বরে অৰ্ধস্থির পদক্ষেপে ঝড়োজীবনের ইঙ্গিত আর ইঙ্গিত ছিল। না—স্পষ্ট পরিচয় হয়ে ব্যক্ত হয়েছিল। এক মুহূর্তে পুরীর সমুদ্রতটের সকল মানুষের দৃষ্টি তার দিকে আকৃষ্ট হয়ে সবিস্ময়ে কয়েক মুহূর্তের জন্য বিস্ফারিত হত। সঙ্গে অবশ্যই অহরহ কেউনা-কেউ যুদ্ধের পোশাকপুরা শ্বেতাঙ্গ থাকতই। একদিন পূর্ণিমার রাত্রে সমুদ্রতটে তাকে তীব্ৰকণ্ঠে বলতে শুনেছিলাম—বোধ করি তার সঙ্গীর সঙ্গে ঝগড়া হয়েছিল—সে বলেছিল–What do I care for God? I am no Christian. My father did not baptize me. He was ashamed of me. I hate you. Yes I hate you. Your heaven is not my heaven. My heaven is hell. My God is the God of hell.-বর্বর মাতাল সৈনিকটা তাকে মেরেছিল মুখের উপর। ইংরেজের আমল, যুদ্ধের কাল, বি-এন-আর হোটেলের এলাকা–কয়েকজন এদেশের লোকের সঙ্গে আমিও ছিলাম কিন্তু কেউ কিছু বলে নি, বলতে সাহস করে নি এবং অনধিকার চর্চাও মনে হয়েছিল। পরদিন আবার তাকে দেখেছিলাম—মুখে তার কালসিটের দাগ; ঠোঁটটা ফুলে গেছে। সমান উৎসাহে প্ৰমত্ত পদক্ষেপে ঘুরছে। সর্বনাশের পথের যাত্ৰিনী।
এই মেয়েকে কলকাতাতেও চৌরঙ্গী অঞ্চলে দেখেছি। একদিন একা ময়দানে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখেছি নিশ্চল প্রতিমার মত; তখন অপরাহুবেলা। কী ভাবছিল কে জানে। তার স্বর্গের কথা? তার ঈশ্বরের কথা? তার জীবনের কথা?
তারপর তাকে দেখি শিলঙের পথে। বছর দেড়েক বাদে। এই সময়ের মধ্যেই তার জীবন দেহ অমিতাচারের ফলে দীর্ণ হয়েছে পোকা-ধরা লতার মত।
এর চেয়ে ভাল বাস্তব উপমা মনে হচ্ছে না। এই কিছুদিন আগে, বোধ করি মাস ছয়েক হবে, একটি ভাল অপরাজিতার লতা এনে বাড়িতে পুতেছিলাম। প্রথম সে বাড়তে লাগল ঘন সবুজ বর্ণে, চওড়া পাতার পর পাতা মেলে; মোটা সরস উঁটার সৰ্পিল বিস্তারে। চোখ জুড়িয়ে যেত। হঠাৎ গাছটায় পোকা ধরল। পাতা ছোট হল-কুঁকড়ে যেতে লাগল, ভঁটা শীর্ণ হল–শিরা-ওঠা হাতের মত লম্বা রেখা জাগল তাতে, পাতা উটার বর্ণে এমন একটা কিছু মিশল যা দৃষ্টিকে পীড়িত করে। এই মেয়েটির অবস্থাও তখন ঠিক তেমনি। গৌহাটি থেকে এক বাসে যাচ্ছিলাম। তার সঙ্গে ছিল একটি তরুণ যার বয়স তার থেকেও অনেক ছোট, দুগ্ধপোষ্য না হোক নিতান্তই কিশোর একটি, যুদ্ধক্ষেত্রে এসেছে, মেয়েটাই তাকে পাকড়েছে বা কিশোরটি যুদ্ধক্ষেত্রের আবহাওয়ায় তার কাঁচামাটির পেয়ালার মত কাঁচা অপরিণত জীবন-পাত্রে এই মেয়েটার জীর্ণ যৌবনের ঝাঁঝালো মদ ঢেলে আকণ্ঠ পান করতে ছুটে এসেছে বলির বিল্বপত্ৰভোজী পশুর মত। মেয়েটার হাত কাঁপছে। অর্থাৎ সুরা কম্পন শুরু হয়েছে। চোখ দুটো অহরহ ঢলঢল করছে। বিড়বিড় করে বকছে। বমি করতে শুরু করলে বাসে। গৌহাটির বাঙালিরা আমাকে প্রচুর কমলালেবু দিয়েছিলেন। সতৃষ্ণ দৃষ্টিতে সে তাকাচ্ছিল কমলাগুলির দিকে। আমি তাকে কয়েকটি লেবু দিয়েছিলাম। সে নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিল—কত দাম? আমি হেসে বলেছিলাম—তোমাকে দিলাম, তুমি অসুস্থ, খাও। আমি তো লেবু বিক্রি করি না।
মেয়েটিকে একদিন ফুটপাতে পড়ে থাকতেও দেখেছি; একটা জিপ এসে তুলে নিয়ে গেল।
মেয়েটির ওই কয়েকটি কথা মনে হল সপ্তপদীর নায়কের আমূল পরিবর্তনের কথা মনে করে। যে ঈশ্বরে বিশ্বাস করত নাসে বেরুল ঈশ্বর খুঁজতে, ঈশ্বর কী জানতে! রিনাই তো আঘাতের মধ্য দিয়ে দিলে তার ঈশ্বরকে। পেলে কি? বৃহত্তর ঈশ্বরবিশ্বাস, দৃঢ়তর বোধ পাওয়াই সম্ভব।
কিন্তু হারিয়ে রিক্ত হওয়াও তো অসম্ভব নয়।
ঈশ্বরের জন্য প্ৰিয়তম মানুষকে বর্জন করে। রিক্ততাই সাধারণভাবে মানবিক। পূর্ণতা অসাধারণ। অস্বাভাবিক না হলেও দুর্লভ। তাই মেয়েটির ওই সমুদ্রতীরের কথা মনে করে এবং শ্বেতাঙ্গ জাতির দুর্ধর্ষ বেপরোয়া দুঃসাহসের পথের দুর্মদেরা যেভাবে পৃথিবীময় নিজেদের দেহের প্রয়োজন মিটিয়ে সন্তান উৎপাদন করে তাদের ফেলে চলে এসেছে এবং বৰ্ণসঙ্কর সমাজ বলে নিজের সন্তানদেরই ঘৃণা করে এসেছে সে-কথা মনে করে ওই মেয়েটিকেই তার ওই কয়েকটা কথার মধ্যে ইতিহাসকে আশ্রয় করে রিনারূপে অঙ্কিত করছি। জানি যে, মেয়েটার রক্তের মধ্যেই হয়ত পাপ-পুণ্য না-মানার বীজ ছিল, হয়ত জন্ম-স্বৈরিণী, কিন্তু আমি তার কয়েকটা প্রদত্ত কথার মধ্যে একটা ব্যথা-বেদনার আভাস পেয়েছিলাম। কেবলমাত্র ওইটুকুর জন্যেই সে আমার মনে স্মরণীয় হয়ে আছে, তাই ওইভাবেই সমবেদনার তর্পণের জল তাকে অর্পণ করে তাকে এঁকেছি আর বলেছি—আমি লেখক, তুমি আমার কাছে এই তৰ্পণের তর্পণীয়া। তুমি আমার অনাত্মীয় অবান্ধব হয়ত বা অপঘাতই তোমার নিয়তি; তোমাকে তবু দিতে হবে আমার শ্রদ্ধার নির্মল জল। আমার শ্ৰদ্ধাতেই সে ফিরেছে। কুম্ভকোণমের কৃষ্ণস্বামীও যে আমার শ্রদ্ধায় মহিমান্বিত।