সীতারাম
দ্বিতীয় খণ্ড
সন্ধ্যা-জয়ন্তী
প্রথম পরিচ্ছেদ
সীতারাম প্রথমাবধিই শ্রীর বহুবিধ অনুসন্ধান করিয়াছিলেন। মাসের পর মাস গেল, বৎসরের পর বৎসর গেল। এই কয় বৎসর সীতারাম ক্রমশঃ শ্রীর অনুসন্ধান করিতেছিলেন। তীর্থে তীর্থে নগরে নগরে তাহার সন্ধানে লোক পাঠাইয়াছিলেন। কিন্তু ফল দর্শে নাই। অন্য লোকে শ্রীকে চিনে না বলিয়া সন্ধান হইতেছে না, এই শঙ্কায় গঙ্গারামকেও কিছু দিনের জন্য রাজকর্ম হইতে অবসৃত করিয়া এই কার্যে নিযুক্ত করিয়াছিলেন। গঙ্গারামও বহু দেশ পর্যটন করিয়া শেষে নিষ্ফল হইয়া ফিরিয়া আসিয়াছিল।
শেষে সীতারাম স্থির করিলেন যে, আর শ্রীকে মনে স্থান দিবেন না। রাজ্যস্থাপনেই চিত্তনিবেশ করিবেন। তিনি এ পর্যন্ত প্রকৃত রাজা হয়েন নাই; কেন না, দিল্লীর সম্রাট তাঁহাকে সনন্দ দেন নাই। তাঁর সনন্দ পাইবার অভিলাষ হইল। সেই অভিপ্রায়ে তিনি অচিরে দিল্লী যাত্রা করিবেন, ইহা স্থির করিলেন।
কিন্তু সময়টা বড় মন্দ উপস্থিত হইল। কেন না, হিন্দুর হিন্দুয়ানি বড় মাথা তুলিয়া উঠিতেছিল, মুসলমানের তাহা অসহ্য হইয়া উঠিল। নিজ মহম্মদপুর উচ্চচূড় দেবালয় সকলে পরিপূর্ণ হইয়াছিল। নিকটে গ্রামে গ্রামে নগরে নগরে গৃহে গৃহে দেবালয় প্রতিষ্ঠা, দৈবোৎসব, নৃত্য-গীত, হরিসংকীর্ত্তনে দেশ চঞ্চল হইয়া উঠিল। আবার এ সময়ে, মহাপাপিষ্ঠ, মনুষ্যাধম মুরশিদকুলি খাঁ12 মুরশিদাবাদের মসনদে আরূঢ় থাকায়, সুবে বাঙ্গালার আর সকল প্রদেশে হিন্দুর উপর অতিশয় অত্যাচার হইতে লাগিল-বোধ হয়, ইতিহাসে তেমন অত্যাচার আর কোথাও লিখে না। মুরশিদ কুলি খাঁ শুনিলেন, সর্বত্র হিন্দু ধূল্যবলুণ্ঠিত, কেবল এইখানে তাহাদের বড় প্রশ্রয়। তখন তিনি তোরাব খাঁর প্রতি আদেশ পাঠাইলেন-“সীতারামকে বিনাশ কর |”
অতএব ভূষণায় সীতারামের ধ্বংসের উদ্যোগ হইতে লাগিল। তবে, ‘উদ্যোগ কর’ বলিবামাত্র উদ্যোগ হইয়া উঠিল না, কেন না, মুরশিদ কুলি খাঁ সীতারামের বধের জন্য হুকুম পাঠাইয়াছিলেন, ফৌজ পাঠান নাই। ইহাতে তিনি তোরাবের প্রতি কোন অবিচার করেন নাই, মুসলমানের পক্ষে তাঁহার অবিচার ছিল না। তখনকার সাধারণ নিয়ম এই ছিল যে,-সাধারণ ‘শান্তিরক্ষার’কার্যফৌজদারেরা নিজ ব্যয়ে করিবেন,–বিশেষ কারণ ব্যতীত নবাবের সৈন্য ফৌজদারের সাহায্যে আসিত না। এক জন জমিদারকে শাসিত করা, সাধারণ শান্তিরক্ষার কার্যের মধ্য গণ্য-তাই নবাব কোন সিপাহী পাঠাইলেন না। এ দিকে ফৌজদার হিসাব করিয়া দেখিলেন যে, যখন শুনা যাইতেছে যে, সীতারাম রায়, আপনার এলাকার সমস্ত বয়:প্রাপ্ত পুরুষদিগকে অস্ত্রবিদ্যা শিখাইয়াছে, তখন ফৌজদারের যে কয় শত সিপাহী আছে, তাহা লইয়া মহম্মদপুর আক্রমণ করিতে যাওয়া বিধেয় হয় না। অতএব ফৌজদারের প্রথমকার্যসিপাহী-সংখ্যা বৃদ্ধি করা। সেটা দুই এক দিনে হয় না। বিশেষ তিনি পশ্চিমে মুসলমান-দেশী লোকের যুদ্ধ করিবার শক্তির উপর তাঁহার কিছু মাত্র বিশ্বাস ছিল না। অতএব মুরশিদাবাদ বা বেহার বা পশ্চিমাঞ্চল হইতে সুশিক্ষিত পাঠান আনাইতে নিযুক্ত হইলেন। বিশেষত: তিনি শুনিয়াছিলেন যে, সীতারামও অনেক শিক্ষিত রাজপুত ও ভোজপুরী (বেহারবাসী) আপনার সৈন্যমধ্যে নিবিষ্ট করিয়াছেন। কাজেই তদুপযোগী সৈন্য সংগ্রহ না করিয়া সীতারামকে ধ্বংস করিবার জন্য যাত্রা করিতে পারিলেন না। তাহাতে একটু কালবিলম্ব হইল। ততদিন যেমন চলিতেছিল, তেমনই চলিতে লাগিল।
তোরাব খাঁ বড় গোপনে এই সকল উদ্যোগ করিতেছিলেন। সীতারাম অগ্রে যাহাতে কিছুই না জানিতে পারে, হঠাৎ গিয়া তাহার উপর ফৌজ লইয়া পড়েন, ইহাই তাঁহার ইচ্ছা। কিন্তু সীতারাম সমুদয়ই জানিতেন। চতুর চন্দ্রচূড় জানিতেন। গুপ্তচর ভিন্ন রাজ্য নাই-রামচন্দ্রের ও দুর্মুখ ছিল। চন্দ্রচূড়ের গুপ্তচর ভূষণার ভিতরেও ছিল। অতএব সীতারামকে রাজধানী সহিত ধ্বংস করিবার আজ্ঞা যে মুরশিদাবাদ হইতে আসিয়াছে, এবং তজ্জন্য বাছা বাছা সিপাহী সংগ্রহ হইতেছে, ইহা চন্দ্রচূড় জানিলেন।
ইহার সকল উদ্যোগ করিয়া সীতারাম কিছু অর্থ এবং রক্ষকবর্গ সঙ্গে লইয়া দিল্লী যাত্রা করিলেন। গমনকালে সীতারাম রাজ্যরক্ষার ভার চন্দ্রচূড়, মৃণ্ময় ও গঙ্গারামের উপর দিয়া গেলেন। মন্ত্রণা ও কোষাগারের ভার চন্দ্রচূড়ের উপর, সৈন্যের অধিকার মৃণ্ময়কে, নগররক্ষার ভার গঙ্গারামকে, এবং অন্তঃপুরের ভার নন্দাকে দিয়া গেলেন। কাঁদাকাটির ভয়ে সীতারাম রমাকে বলিয়া গেলেন না। সুতরাং রমা কাঁদিয়া দেশ ভাসাইল।
12- ইংরেজ ইতিহাসবেতত্তৃগণের পক্ষপাত এবং কতকটা অজ্ঞতা নিবন্ধন সেরাজউদ্দৌলা ঘৃণিত, এবং মুরশি্দ কুলি খাঁ প্রশংসিত। মুরশিতদের তুলনায় সেরাজউদ্দৌলা দেবতাবিশেষ ছিলেন।
দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
কান্নাকাটি একটু থামিলে, রমা একটু ভাবিয়া দেখিল। তাহার বুদ্ধিতে এই উদয় হইল যে, এ সময়ে সীতারাম দিল্লী গিয়াছেন, ভালই হইয়াছে। যদি এ সময় মুসলমান আসিয়া সকলকে মারিয়া ফেলে, তাহা হইলেও সীতারাম বাঁচিয়া গেলেন। অতএব রমার যেটা প্রধান ভয়, সেটা দূর হইল। রমা নিজে মরে, তাহাতে রমার তেমন কিছু আসিয়া যায় না। হয় ত তাহারা বর্শা দিয়া খোঁচাইয়া রমাকে মারিয়া ফেলিবে, নয় ত তরবারি দিয়া টুকরা টুকরা করিয়া কাটিয়া ফেলিবে, নয় ত বন্দুক দিয়া গুলি করিয়া মারিয়া ফেলিবে, নয় ত খোঁপা ধরিয়া ছাদের উপর হইতে ফেলিয়া দিবে। তা যা করে করুক, তাতে তত ক্ষতি নাই, সীতারাম ত নির্বিঘ্নে দিল্লীতে বসিয়া থাকিবেন। তা, সে এক রকম ভালই হইয়াছে। তবে কি না, রমা তাঁকে আর এখন দেখিতে পাইবে না, তা না পাইল, আর জন্মে দেখিবে। কই, মহম্মদপুরেও ত এখন আর বড় দেখাশুনা হইত না। তা দেখা না হউক, সীতারাম ভাল থাকিলেই হইল।
যদি এক বৎসর আগে হইত, তবে এতটুকু ভাবিয়াই রমা ক্ষান্ত হইত; কিন্তু বিধাতা তার কপালে শান্তি লিখেন নাই। এক বৎসর হইল, রমার একটি ছেলে হইয়াছে। সীতারাম যে আর তাহাকে দেখিতে পারিতেন না, ছেলের মুখ দেখিয়া রমা তাহা একরকম সহিতে পারিয়াছিল। রমা আগে সীতারামের ভাবনা ভাবিল-ভাবিয়া নিশ্চিন্ত হইল। তার পর আপনার ভাবনা ভাবিল-ভাবিয়া মরিতে প্রস্তত হইল। তার পর ছেলের ভাবনা ভাবিল-ছেলের কি হইবে? “আমি যদি মরি, আমায় যদি মারিয়া ফেলে, তবে আমার ছেলেকে কে মানুষ করিবে? তা ছেলে না হয় দিদিকে দিয়া যাইব। কিন্তু সতীনের হাতে ছেলে দিয়া যাওয়া যায় না; সৎমায় কি সতীনপোকে যত্ন করে? ভাল কথা, আমাকেই যদি মুসলমানে মারিয়া ফেলে, তা আমার সতীনকেই কি রাখিবে? সেও ত আর পীর নয়। তা, আমিও মরিব, আমার সতীনও মরিবে। তা ছেলে কাকে দিয়ে যাব?”
ভাবিতে ভাবিতে অকস্মাৎ রমার মাথায় বজ্রাঘাত হইল। একটা ভয়ানক কথা মনে পড়িল, মুসলমানে ছেলেই কি রাখিবে? সর্বনাশ! রমা এতক্ষণে কি ভাবিতেছিল? মুসলমানেরা ডাকাত, চুয়াড়, গোরু খায়, শত্রু-তাহারা ছেলেই কি রাখিবে? সর্বনাশের কথা! কেন সীতারাম দিল্লী গেলেন! রমা এ কথা কাকে জিজ্ঞাসা করে? কিন্তু মনের কথা এ সন্দেহ লইয়াও ত শরীর বহা যায় না। রমা আর ভাবিতে চিন্তিতে পারিল না। অগত্যা নন্দার কাছে জিজ্ঞাসা করিতে গেল।
গিয়া বলিল, “দিদি, আমার বড় ভয় করিতেছে-রাজা এখন কেন দিল্লী গেলেন?”
নন্দা বলিল, “রাজার কাজ রাজাই বুঝেন-আমরা কি বুঝিব বহিন!”
র। তা এখন যদি মুসলমান আসে, তা কে পুরী রক্ষা করিবে?
ন। বিধাতা করিবেন। তিনি না রাখিলে কে রাখিবে?
র। তা মুসলমান কি সকলকেই মারিয়া ফেলে?
ন। যে শত্রু, সে কি আর দয়া করে?
র। তা, না হয় আমাদের মারিয়া ফেলিবে-ছেলেপিলের উপর দয়া করিবে না কি?
ন। ও সকল কথা কেন মুখে আন, দিদি? বিধাতা যা কপালে লিখেছেন, তা অবশ্য ঘটিবে। কপালে মঙ্গল লিখিয়া থাকেন, মঙ্গলই হইবে। আমরা ত তাঁর পায়ে কোন অপরাধ করি নাই-আমাদের কেন মন্দ হইবে? কেন তুমি ভাবিয়া সারা হও! আয়, পাশা খেলিবি? তোর নথের নূতন নোলক জিতিয়া নিই আয়।
এই বলিয়া, নন্দ, রমাকে অন্যমনা করিবার জন্য পাশা পাড়িল। রমা অগত্যা এক বাজি খেলিল, কিন্তু খেলায় তার মন গেল না। নন্দা ইচ্ছাপূর্বক বাজি হারিল-রমার নাকের নোলক বাঁচিয়া গেল। কিন্তু রমা আর খেলিল না-এক বাজি উঠিলেই রমাও উঠিয়া গেল।
রমার নন্দার কাছে আপন জিজ্ঞাস্য কথার উত্তর পায় নাই-তাই সে খেলিতে পারে নাই। কতক্ষণে সে আর এক জনকে সে কথা জিজ্ঞাসা করিবে, সেই ভাবনাই ভাবিতেছিল। রমা আপনার মহলে ফিরিয়া আসিয়াই আপনার একজন বর্ষীয়সী ধাত্রীকে জিজ্ঞাসা করিল, “হাঁ গা-মুসলমানেরা কি ছেলে মারে?”
বর্ষীয়সী বলিল, “তারা কাকে না মারে? তারা গোরু খায়, নেমাজ করে, তারা ছেলে মারে না ত কি?”
রমার বুকের ভিতর ঢিপ্ ঢিপ্ করিতে লাগিল। রমা তখন যাহাকে পাইল, তাহাকেই সেই কথা জিজ্ঞাসা করিল, পুরবাসিনী আবালবৃদ্ধা সকলকেই জিজ্ঞাসা করিল। সকলেই মুসলমানভয়ে ভীত, কেহই মুসলমানকে ভাল চক্ষুতে দেখে না-সকলেই প্রায় বর্ষীয়সীর মত উত্তর দিল। তখন রমা সর্বনাশ উপস্থিত মনে করিয়া, বিছানায় আসিয়া শুইয়া পড়িয়া ছেলে কোলে লইয়া কাঁদিতে লাগিল।
তৃতীয় পরিচ্ছেদ
এ দিকে তোরাব খাঁ সংবাদ পাইলেন যে, সীতারাম মহম্মদপুরে নাই, দিল্লী যাত্রা করিয়াছেন। তিনি ভাবিলেন, এই শুভ সময়, এই সময় মহম্মদপুর পোড়াইয়া ছারখার করাই ভাল। তখন তিনি সসৈন্যে মহম্মদপুর যাত্রা করিবার জন্য প্রস্তুত হইতে লাগিলেন।
সে সংবাদও মহম্মদপুরে পৌঁছিল। নগরে একটা ভারি হুলস্থূল পড়িয়া গেল। গৃহস্থেরা যে যেখানে পাইল, পলাইতে লাগিল। কেহ মাসীর বাড়ী, কেহ পিসীর বাড়ী, কেহ খুড়ার বাড়ী, কেহ শ্বশুরবাড়ী, কেহ জামাইবাড়ী, কেহ বেহাইবাড়ী, বোনাইবাড়ী, সপরিবার, ঘটি-বাটি, সিন্দুক, পেটারা, তক্তপোষ সমেত গিয়া দাখিল হইল। দোকানদার দোকান লইয়া পলাইতে লাগিল, মহাজন গোলা বেচিয়া পলাইতে লাগিল, আড়তদার আড়ত বেচিয়া পলাইল, শিল্পকর যন্ত্র-তন্ত্র মাথায় করিয়া পলাইল। বড় হুলস্থূল পড়িয়া গেল।
নগররক্ষক গঙ্গারাম দাস, চন্দ্রচূড়ের নিকট মন্ত্রণার জন্য আসিলেন। বলিলেন, “এখন ঠাকুর কি করিতে বলেন? সহর ত ভাঙ্গিয়া যায় |”
চন্দ্রচূড় বলিলেন, “স্ত্রীলোক বালক বৃদ্ধ যে পলায় পলাক, নিষেধ করিও না। বরং তাহাতে প্রয়োজন আছে। ঈশ্বর না করুন, কিন্তু তোরাব খাঁ আসিয়া যদি গড় ঘেরাও করে, তবে গড়ে যত খাইবার লোক কম থাকে, ততই ভাল, তা হলে দুই মাস ছয় মাস চালাইতে পারিব। কিন্তু যাহারা যুদ্ধ শিখিয়াছে, তাহাদের এক জনকেও যাইতে দিবে না, যে যাইবে, তাহাকে গুলি করিবার হুকুম দিবে। অস্ত্র-শস্ত্র একখানিও সহরের বাহিরে লইয়া যাইতে দিবে না। আর খাবার সামগ্রী এক মুঠাও বাহিরে লইয়া যাইতে দিবে না |”
সেনাপতি মৃণ্ময় রায় আসিয়া চন্দ্রচূড় ঠাকুরকে মন্ত্রণা জিজ্ঞাসা করিলেন। বলিলেন, “এখানে পড়িয়া মার খাইব কেন? যদি তোরাব খাঁ আসিতেছে, তবে সৈন্য লইয়া অর্দ্ধেক পথ গিয়া তাহাকে মারিয়া আসি না কেন?”
চন্দ্রচূড় বলিলেন, “এই প্রবলা নদীর সাহায্য কেন ছাড়িবে? যদি অর্ধপথে তুমি হার, তবে আর আমাদের দাঁড়াইবার উপায় থাকিবে না; কিন্তু তুমি যদি এই নদীর এ পারে কামান সাজাইয়া দাঁড়াও, কার সাধ্য এ নদী পার হয়? এ হাঁটিয়া পার হইবার নদী নয়। সংবাদ রাখ, কোথায় নদী পার হইবে। সেইখানে সৈন্য লইয়া যাও, তাহা হইলে মুসলমান এ পারে আসিতে পারিবে না। সব প্রস্তুত রাখ, কিন্তু আমায় না বলিয়া যাত্রা করিও না |”
চন্দ্রচূড় গুপ্তচরের প্রত্যাগমনের প্রতীক্ষা করিতেছিলেন। গুপ্তচর ফিরিলেই তিনি সংবাদ পাইবেন, কখন কোন পথে তোরাব খাঁর সৈন্য যাত্রা করিবে; তখন ব্যবস্থা করিবেন।
এ দিকে অন্তঃপুরে সংবাদ পৌঁছিল যে, তোরাব খাঁ সসৈন্য মহম্মদপুর লুঠিতে আসিতেছে। বহির্বাটীর অপেক্ষা অন্তঃপুরে সংবাদটা কিছু বাড়িয়া যাওয়াই রীতি। বাহিরে, “আসিতেছে” অর্থে বুঝিল, আসিবার উদ্যোগ করিতেছে। ভিতর মহলে, “আসিতেছে” অর্থে বুঝিল, “প্রায় আসিয়া পৌঁছিয়াছে”। তখন সে অন্তঃপুরমধ্যে কাঁদাকাটার ভারি ধুম পড়িয়া গেল। নন্দার বড় কাজ বাড়িয়া গেল- কয়জনকে একা বুঝাইবে, কয়জনকে থামাইবে! বিশেষ রমাকে লইয়াই নন্দাকে বড় ব্যস্ত হইতে হইল-কেন না, রমা ক্ষণে ক্ষণে মূর্ছা যাইতে লাগিল। নন্দা মনে মনে ভাবিতে লাগিল, “সতীন মরিয়া গেলেই বাঁচি- কিন্তু প্রভু যখন আমাকে অন্তঃপুরের ভার দিয়া গিয়াছেন, তখন আমাকে আপনার প্রাণ দিয়াও সতীনকে বাঁচাইতে হইবে |” তাই নন্দা সকল কাজ ফেলিয়া রমার সেবা করিতে লাগিল।
এ দিকে পৌরস্ত্রীগণ নন্দাকে পরামর্শ দিতে লাগিল-“মা! তুমি এক কাজ কর-সকলের প্রাণ বাঁচাও। এই পুরী মুসলমানকে বিনা যুদ্ধে সমর্পণ কর-সকলের প্রাণ ভিক্ষা মাঙ্গিয়া লও। আমরা বাঙ্গালী মানুষ, আমাদের লড়াই ঝগড়া কাজ কি মা! প্রাণ বাঁচিলে আবার সব হবে। সকলের প্রাণ তোমার হাতে-মা, তোমার মঙ্গল হোক-আমদের কথা শোন |”
নন্দা তাহাদিগকে বুঝাইলেন। বলিলেন, “ভয় কি মা! পুরুষ মানুষের চেয়ে তোমরা কি বেশী বুঝ? তাঁরা যখন বলিতেছেন ভয় নাই, তখন ভয় কেন? তাঁদের কি আপনার প্রাণে দরদ নাই-না আমাদের প্রাণে দরদ নাই?”
এই সকল কথার পর রমা বড় মূর্ছা গেল না। উঠিয়া বসিল। কি কথা ভাবিয়া মনে সাহস পাইয়াছিল, তাহা পরে বলিতেছি।
চতুর্থ পরিচ্ছেদ
গঙ্গারাম নগররক্ষক। এ সময়ে রাত্রিতে নগর পরিভ্রমণে তিনি বিশেষ মনোযোগী। যে দিনের কথা বলিলাম, সেই রাত্রিতে, তিনি নগরের অবস্থা জানিবার জন্য, পদব্রজে, সামান্য বেশে, গোপনে, একা নগর পরিভ্রমণ করিতেছিলেন। রাত্রি তৃতীয় প্রহরে, ক্লান্ত হইয়া তিনি গৃহে প্রত্যাগমন করিবার বাসনায় গৃহাভিমুখী হইতেছিলেন, এমন সময়ে কে আসিয়া পশ্চাৎ হইতে তাঁহার কাপড় ধরিয়া টানিল।
গঙ্গারাম পশ্চাৎ ফিরিয়া দেখিলেন, একজন স্ত্রীলোক। রাত্রি অন্ধকার, রাজপথে আর কেহ নাই-কেবল একাকিনী সেই স্ত্রীলোক। অন্ধকারে স্ত্রীলোকের আকার, স্ত্রীলোকের বেশ, ইহা জানা গেল-কিন্তু আর কিছুই বুঝা গেল না। গঙ্গারাম জিজ্ঞাসা করিলেন, “তুমি কে?”
স্ত্রীলোক বলিল, “আমি যে হই, তাতে আপনার কিছু প্রয়োজন নাই। আমাকে বরং জিজ্ঞাসা করুন যে, আমি কি চাই |”
কথার স্বরে বোধ হইল যে, এই স্ত্রীলোকের বয়স বড় বেশী নয়। তবে কথাগুলা জোর জোর বটে। গঙ্গরাম বলিলেন, “সে কথা পরে হইবে। আগে বল দেখি, তুমি স্ত্রীলোক, এত রাত্রে একাকিনী রাজপথে কেন বেড়াইতেছ? আজকাল কিরূপ সময় পড়িয়াছে, তাহা কি জান না?”
স্ত্রীলোক বলিল, “এত রাত্রে একাকিনী আমি এই রাজপথে আর কিছু করিতেছি না-কেবল আপনারই সন্ধান করিতেছি |”
গ। মিছা কথা। প্রথমতঃ তুমি চেনই না যে, আমি কে?
স্ত্রী। আমি চিনি যে, আপনি দাস মহাশয়, নগররক্ষক।
গ। ভাল, চেন দেখিতেছি। কিন্তু আমাকে এখানে পাইবার সম্ভাবনা, ইহা তোমার জানিবার সম্ভাবনা নাই; কেন না, আমিই জানিতাম না যে, আমি এখন এ পথে আসিব।
স্ত্রী। আমি অনেক্ষণ ধরিয়া আপনাকে গলিতে গলিতে খুঁজিয়া বেড়াইতেছি। আপনার বাড়ীতেও সন্ধান লইয়াছি।
গ। কেন?
স্ত্রী। সেই কথাই আপনার আগে জিজ্ঞাসা করা উচিত ছিল। আপনি একটা দু:সাহসিক কাজ করিতে পারিবেন?
গ। কি?
স্ত্রী। আমি আপনাকে যেখানে লইয়া যাইব, সেইখানে এখনই যাইতে পারিবেন?
গ। কোথায় যাইতে হইবে?
স্ত্রী। তাহা আমি আপনাকে বলিব না। আপনি তাহা জিজ্ঞাসা করিতে পারিবেন না। সাহস হয় কি?
গ। আচ্ছা, তা না বল, আর দুই একটা কথা বল। তোমার নাম কি? তুমি কে? কি কর? আমাকেই বা কি করিতে হইবে?
স্ত্রী। আমার নাম মুরলা, ইহা ছাড়া আর কিছুই বলিব না। আপনি আসিতে সাহস না করেন, আসিবেন না। কিন্তু যদি এই সাহস না থাকে, তবে মুসলমানের হাত হইতে নগর রক্ষা করিবেন কি প্রকারে? আমি স্ত্রীলোক যেখানে যাইতে পারি, আপনি নগররক্ষক হইয়া সেখানে এত কথা নহিলে যাইতে পারিবেন না?
কাজেই গঙ্গারামকে মুরলার সঙ্গে যাইতে হইল। মুরলা আগে আগে চলিল, গঙ্গারাম পাছু পাছু। কিছু দূর গিয়া গঙ্গারাম দেখিলেন, সম্মুখে উচ্চ অট্টালিকা। চিনিয়া বলিলেন, “এ যে রাজবাড়ী যাইতেছ?”
মু। তাতে দোষ কি?
গ। সিং-দরজা দিয়া গেলে দোষ ছিল না। এ যে খিড়কি। অন্তঃপুরে যাইতে হইবে না কি?
মু। সাহস হয় না?
গ। না-আমার যে সাহস হয় না, এ আমার প্রভুর অন্তঃপুর! বিনা হুকুমে যাইতে পারি না।
মু। কার হুকুম চাই?
গ। রাজার হুকুম।
মু। তিনি ত দেশে নাই। রাণীর হুকুম হইলে চলিবে?
গঙ্গা। চলিবে।
মুরলা। আসুন, আমি রাণীর হুকুম আপনাকে শুনাইব।
গঙ্গা। কিন্তু পাহারাওয়ালা তোমাকে যাইতে দিবে?
মুরলা। দিবে।
গঙ্গা। কিন্তু আমাকে না চিনিলে ছাড়িয়া দিবে না। এ অবস্থায় পরিচয় দিবার আমার ইচ্ছা নাই।
মুরলা। পরিচয় দিবারও প্রয়োজন নাই। আমি আপনাকে লইয়া যাইতেছি।
দ্বারে প্রহরী দণ্ডায়মান। মুরলা তাহার নিকটে আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, “কেমন পাঁড়ে ঠাকুর, দ্বার খোলা রাখিয়াছ ত?”
পাঁড়ে ঠাকুর বলিলেন, “হাঁ রাখিয়েসে। এ কোন্?”
প্রহরী গঙ্গারামের প্রতি দৃষ্টি করিয়া এই কথা বলিল। মুরলা বলিল, “এ আমার ভাই |”
পাঁড়ে। মরদ যাতে পার্রবে না। হুকুম নেহি।
মুরলা তর্জন গর্জন করিয়া বলিল, “ই:, কার হুকুম রে? তোর আবার কার হুকুম চাই? আমার হুকুম ছাড়া কার হুকুম খুঁজিস? খ্যাংরা মেরে দাড়ি মুড়িয়ে দেব জানিস না?”
প্রহরী জড়সড় হইল, আর কিছু বলিল না। মুরলা গঙ্গারামকে লইয়া নির্বিঘ্নে অন্তঃপুরমধ্যে প্রবেশ করিল। এবং অন্তঃপুরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া দোতালায় উঠিল। সে একটি কুঠারি দেখাইয়া দিয়া বলিল, “ইহার ভিতর প্রবেশ করুন। আমি নিকটেই রহিলাম, কিন্তু ভিতরে যাইব না |”
গঙ্গারাম কৌতূহলাবিষ্ট হইয়া কুঠারির ভিতর প্রবেশ করিলেন। মহামূল্য দ্রব্যাদিতে সুসজিত গৃহ, রজতপালঙ্কে বসিয়া একটি স্ত্রীলোক- উজ্জ্বল দীপাবলীর স্নিগ্ধ রশ্মি তাহার মুখের উপর পড়িয়াছে, সে অধোবদনে চিন্তা করিতেছে। আর কেহ নাই। গঙ্গারাম মনে করিলেন, এমন সুন্দরী পৃথিবীতে আর জন্মে নাই। সে রমা।
পঞ্চম পরিচ্ছেদ
গঙ্গারাম কখনও সীতারামের অন্তঃপুরে আসে নাই, নন্দা কি রমাকে কখনও দেখে নাই। কিন্তু মহামূল্য গৃহসজ্জা দেখিয়া বুঝিল যে, ইনি একজন রাণী হইবেন; রাণীদিগের মধ্যে নন্দার অপেক্ষা রমারই সৌন্দর্য্যের খ্যাতিটা বেশী ছিল-এ জন্য গঙ্গারাম সিদ্ধান্ত করিল যে, ইনি কনিষ্ঠা মহিষী রমা। অতএব জিজ্ঞাসা করিল, “মহারাণী কি আমাকে তলব করিয়াছেন?”
রমা উঠিয়া গঙ্গারামকে প্রণাম করিল। বলিল, “আপনি আমার দাদা হন-জ্যেষ্ঠ ভাই, আপনার পক্ষে শ্রীও যেমন, আমিও তাই। অতএব আপনাকে যে এমন সময়ে ডাকাইয়াছি, তাহাতে দোষ ধরিবেন না |”
গ। আমাকে যখন আজ্ঞা করিবেন, তখনই আসিতে পারি-আপনিই কর্ত্রী-
র। মুরলা বলিল যে, প্রকাশ্যে আপনি আসিতে সাহস করিবেন না। সে আরও বলে- পোড়ারমুখী কত কি বলে, তা আমি কি বলব? তা, দাদা মহাশয়! আমি বড় ভীত হইয়াই এমন সাহসের কাজ করিয়াছি। তুমি আমায় রক্ষা কর।
বলিতে বলিতে রমা কাঁদিয়া ফেলিল। সে কান্না দেখিয়া গঙ্গারাম কাতর হইল। বলিল, “কি হইয়াছে? কি করিতে হইবে?”
র। কি হইয়াছে? কেন, তুমি কি জান না যে, মুসলমান মহম্মদপুর লুঠিতে আসিতেছে- আমাদের সব খুন করিয়া, সহর পোড়াইয়া দিয়া চলিয়া যাইবে?
গ। কে তোমাকে ভয় দেখাইয়াছে? মুসলমান আসিয়া সহর পোড়াইয়া দিয়া যাইবে, তবে আমরা কি জন্য? আমরা তবে তোমার অন্ন খাই কেন?
র। তোমরা পুরুষ মানুষ, তোমাদের সাহস বড়-তোমরা অত বোঝ না। যদি তোমরা না রাখিতে পার; তখন কি হবে?
রমা আবার কাঁদিতে আরম্ভ করিল।
গ। সাধ্যানুসারে আপনাদের রক্ষা করিব, আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন।
র। তা ত করবো-কিন্তু যদি না পারিলে?
গ। না পারি, মরিব।
র। এই আমার গহনাপাতি আছে, সব নাও। আর আমার টাকাকড়ি যা আছে, সব না হয় দিতেছি, সব নাও। তুমি কাহাকে কিছু না বলিয়া মুসলমানের কাছে যাও। বল গিয়া যে, আমরা রাজ্য ছাড়িয়া দিতেছি, নগর তোমাদের ছাড়িয়া দিতেছি, তোমরা কাহাকে প্রাণে মারিবে না, কেবল এইটি স্বীকার কর। যদি তাহারা রাজি হয়, তবে নগর তোমার হাতে—তুমি তাদের গোপনে এনে কেল্লায় তাদের দখল দিও। সকলে বাঁচিয়া যাইবে।
গঙ্গারাম শিহরিয়া উঠিল—বলিল, “মহারাণী! আমার সাক্ষাতে যা বল্লেন বল্লেন-আর কখনও কাহারও সাক্ষাতে এমন কথা মুখে আনিবেন না। আমি প্রাণে মরিলেও এ কাজ আমা হইতে হইবে না। যদি এমন কাজ আর কেহ করে, আমি স্বহস্তে তাহার মাথা কাটিয়া ফেলিব |”
রমার শেষ আশা-ভরসা ফরসা হইল। রমা উচ্চৈঃস্বরে কাঁদিয়া উঠিল। বলিল, “তবে আমার বাছার দশা কি হইবে?” গঙ্গারাম ভীত হইয়া বলিল, “চুপ করুন! যদি আপনার কান্না শুনিয়া কেহ এখানে আসে, তবে আমাদের দুই জনেরই পক্ষে অমঙ্গল। আপনার ছেলের জন্যই আপনি এত ভীত হইয়াছেন, আমি সে বিষয়ে কোন উপায় করিব। আপনি স্থানান্তরে যাইতে রাজি আছেন?”
র। যদি আমার বাপের বাড়ী রাখিয়া আসিতে পার, তবে যাইতে পারি। তা বড় রাণীই বা যাইতে দিবেন কেন? ঠাকুর মহাশয় বা যাইতে দিবেন কেন?
গ। তবে লুকাইয়া লইয়া যাইতে হইবে। এক্ষণে তাহার কোন প্রয়োজন নাই। যদি তেমন বিপদ দেখি, আমি আসিয়া আপনাদিগকে লইয়া গিয়া রাখিয়া আসিব।
র। আমি কি প্রকারে সংবাদ পাইব?
গ। মুরলার দ্বারা সংবাদ লইবেন। কিন্তু মুরলা যেন অতি গোপনে আমার নিকট যায়।
র নিশ্বাস ছাড়িয়া, কাঁপিয়া বলিল, “তুমি আমার প্রাণ দান করিলে, আমি চিরকাল তোমার দাসী হইয়া থাকিব। দেবতারা তোমার মঙ্গল করুন |”
এই বলিয়া রমা গঙ্গারামকে বিদায় দিল। মুরলা গঙ্গারামকে বাহিরে রাখিয়া আসিল।
কাহারও মনে কিছু ময়লা নাই। তথাপি একটা গুরুতর দোষের কাজ হইয়া গেল। রমা ও গঙ্গারাম উভয়ে তাহা মনে বুঝিল। গঙ্গারাম ভাবিল, “আমার দোষ কি?” রমা বলিল, “এ না করিয়া কি করি-প্রাণ যায় যে |” কেবল মুরলা সন্তুষ্ট।
গঙ্গারামের যদি তেমন চক্ষু থাকিত, তবে গঙ্গারাম ইহার ভিতর আর একজন লুকাইয়া আছে দেখিতে পাইতেন। সে মনুষ্য নহে-দেখিতেন-
*দক্ষিণাপাঙ্গনিবিষ্টমুষ্টিং নতাংসমাকুঞ্চিতসব্যপাদম্ |
* * * চক্রীকৃতচারুচাপং প্রহর্তুমভ্যুদ্যতমাত্মযোনিম্ ||
এ দিকে বাদীর মনেও যা, বিধির মনেও তা। চন্দ্রচূড় ঠাকুর তোরাব খাঁর কাছে এই বলিয়া গুপ্তচর পাঠাইলেন যে, “আমরা এ রাজ্য মায় কেল্লা সেলেখানা আপনাদিগকে বিক্রয় করিব-কত টাকা দিবেন? যুদ্ধে কাজ কি-টাকা দিয়া নিন না?”
চন্দ্রচূড় মৃণ্ময়কে ও গঙ্গারামকে এ কথা জানাইলেন। মৃণ্ময় ক্রুদ্ধ হইয়া চোখ ঘুরাইয়া বলিল, “কি! এত বড় কথা?”
চন্দ্রচূড় বলিলেন, “দূর মূর্খ! কিছু বুদ্ধি নাই কি? দরদস্তুর করিতে করিতে এখন দুই মাস কাটাইতে পারিব। তত দিনে রাজা আসিয়া পড়িবেন |”
গঙ্গারামের মনে কি হইল বলিতে পারি না। সে কিছুই বলিল না।