পাগলা পাদরী এখানে এসেছে আজ বছর আষ্টেক। ১৯৩৬ সালে। সেবার এখানে দুর্ভিক্ষ মহামারী হয়েছিল। এটা উনিশশো চুয়াল্লিশ সাল। পৃথিবীতে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চরম পর্যায়ে উঠেছে।
মহাযুদ্ধের দুর্যোগ একটা সাইক্লোনের মত পৃথিবীর সঙ্গে ভাগ্যাহত বাঙলাদেশের উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে। দেশ সমাজ ঘর ভেঙেচুরে পড়ে গেল। দুর্ভিক্ষে মহামারীতে মানুষ মরছে–ঝড়ে ঝটকা-খাওয়া পশুপক্ষীর মত। হাহাকার উঠেছে চারিদিকে। হাহাকার! হাহাকার আর হাহাকার! দেশজোড়া স্বাধীনতা আন্দোলনও সাময়িকভাবে ক্ষীণ হয়ে এসেছে। ইংরেজ ও আমেরিকার যুদ্ধোদ্যম বাঙলাদেশের এ-প্রান্ত থেকে ও-প্রান্ত পর্যন্ত পরিব্যাপ্ত হয়েছে। চট্টগ্রাম ফেনী-গৌহাটি-ডিগবয়-ডিমাপুর-কোহিমার পরে উখরা-পানাগড়-পিয়ারাডোবা-বাসুদেবপুর–খঙ্গপুর-মেদিনীপুর নিয়ে যুদ্ধের ঘাটির সে এক বিচিত্র বেষ্টনী। পিচঢালা সুগঠিত পথের একটার সঙ্গে অন্যটার যোগাযোগে একটা বিস্তীর্ণ বিরাট ভূখণ্ডব্যাপী মাকড়সার জাল।
গ্রামে গ্রামে অন্নাভাবে হাহাকার, শহরে শহরে ক্ষুধার্ত কঙ্কালসার ভিক্ষুকদের সকরুণ কাতর প্রার্থনা, একটু ফ্যান! একমুটো এঁটোকাটা। মাগো মা!
দোকানে চালের বদলে খুদ। তার সঙ্গে বালি ধুলো কাঁকর।
এরই মধ্যে চলে মিলিটারি কনভয়। জিপ-ট্যাঙ্ক-ওয়েপনকেরিয়ার, আরও হরেক রকমের বিচিত্রগঠন অটোমোবিল। মাথার উপরে ওড়ে ইংরেজ আর আমেরিকানদের যুদ্ধের প্লেন। গাড়িগুলোতে বোঝাই হয়ে চলে ইংরেজ এবং আমেরিকার পল্টন। তার সঙ্গে নিগ্রো কাফ্রী। যাবার সময় পথের ধারে মাঠে নেমে পড়ে এ-দেশের দুর্ভিক্ষ ক্লিষ্ট ক্ষুধার্তদের উপর কমলালেবুর খোসা, চিবানো কোয়া ছুড়ে দিয়ে যায়। চিৎকার করে ডেকেও যায়, হে। হাতছানি দিয়েও ডাকে।
হি হি করে হাসে।
কেউ কেউ আবার টাকা আধুলি ছুড়ে দেয়। ওরা দল বেঁধে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে ধুলোর উপর। শুকনো মাটির ধুলো ওড়ে। ওদের সর্বাঙ্গে লাগে। ওদিকে বিদেশী সৈনিকদের ক্যামেরা ক্লিক-ক্লিক শব্দে মুখর হয়ে ওঠে। তাদের মুখে ফুটে ওঠে বিচিত্ৰ হাসি। ঘৃণা অনুকম্পা কৌতুক সবকিছু আছে সে-হাসির মধ্যে।
মধ্যে মধ্যে দেখা যায়, দল বেঁধে শ্বেতাঙ্গ সেপাইরা জিপে চড়ে চলেছে। সমস্বরে গান জুড়ে দিয়েছে, অথবা প্ৰমত্ত কলরব তুলেছে। এবং তাদের ঠিক মাঝখানে শহর থেকে সংগ্রহ করা একটা কি দুটো নিম্নশ্রেণীর দেহ-ব্যবসায়িনী, তাদের সকল আনন্দের উৎস, কড়া বিলাতি মদের নেশায় স্থলিতবসনা, অবশদেহ, টলছে বা ঢুলছে, ওদেরই অট্টহাসির সঙ্গে প্রমত্ত উল্লাসে হেসে সুর মেলাতে চাচ্ছে। পথে-ঘাটে যুবতী মেয়ের দেখা পেলেই ডাক-হ্যালো হনি! মাই নি! হনি হতভাগিনীরা ভয়ে শুকিয়ে কাঁপতে কাঁপতেও ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে পালায়। দু-চার জন, স্বৈরিণী যারা, তারা দাঁড়িয়ে নির্লজ্জার মত দাঁত মেলে হাসে।
পিয়ারাডোবায় একটা এরোপ্লেনের আড়া তৈরি হয়েছে। কয়েক মাইল দূরে বাসুদেবপুরে ছোট একটা। মোরারে ওয়েসলিয়ান চার্চের বাঙলোটার সামনে পুরীর রাস্তা আর স্থানীয় একটা যায়।
রাস্তার মিশবার জায়গাটার পাশেই শালজঙ্গলের কোল ঘেঁষে প্রান্তরটা খুঁড়ে বড় বড় পেট্রল-ট্যাঙ্ক বসেছে। এখান থেকে পাইপ-লাইন চলে গেছে বাসুদেবপুরে পিয়ারাডোবা পর্যন্ত। বুলডোজার চালিয়ে মাটি কেটে বন কেটে জঙ্গলে কয়েকদিনের মধ্যে গড়ে তুলেছে বিচিত্র সামরিক ঘাঁটি। ময়দানবের হাতের মায়াপুরীর মত। পিয়ারাডোবা স্টেশন থেকে সাইডিং এসেছে। বড় বড় ট্রেন এসে থামে। ট্রেন থেকে নামে প্ৰমত্ত বিদেশী সৈনিকের দল। মার্কিন সৈন্যদের পকেটে নোটের তাড়া। সঙ্গে প্রচুর টিনবন্দি খাদ্য। বিস্কুট রুটি। সাইডিঙের পাশে, স্টেশনের রেললাইনের পাশে টিনের ছড়াছড়ি নয়—টিনের গাদা।
হতভাগ্য দুর্ভিক্ষপীড়িত অর্ধনগ্ন মানুষেরা টিন কুড়িয়ে নিয়ে যায়, চেটে চেটে খায়। দিনরাত্রি আকাশ মুখরিত করে বম্বার ফাইটারগুলো মাথার উপর ঘুরছে। কোনোটা নামছে, কোনোটা উঠছে।
সন্ধের পর ইলেকট্রিক বাতি জ্বলে ওঠে। ইঙি পরানো, কিন্তু তবু তার ছটা আশপাশে ছড়িয়ে পড়ে। ওদের আড্ডাঘরে বাজনা বাজে, নাচ হয়। হো-হো শব্দে উল্লাসধ্বনি ওঠে। ঝিল্লিমুখর শালবনের মধ্যে নিবিড় অন্ধকার চমকে ওঠে। মাঝে মাঝে ঝিল্লিরাও বোধহয় স্তব্ধ হয়ে যায়। বোধ করি প্রায় দুশো বছর আগের সামন্ত রাজাদের আমলে পাইকদের মশালের আলো, মাদলের বাজনা, হারা-রা ধ্বনি-তাণ্ডবের পর বনভূমির অন্ধকার এইভাবে আর চমকায় নি, ঝিঝিরাও হঠাৎ থামে নি। বর্গীদের আমলের পর বনভূমির মধ্যে ছড়ানো গ্রামগুলি এমনভাবে আর সভয়ে আলো নিভিয়ে অন্ধকারের আবরণে ঘুমিয়ে পড়ে নি। এসব গ্রামগুলি পাকা রাস্তা থেকে দূরে দূরে। বনের ভিতরের দিকে। সেখানে তারা অন্ধকারের মধ্যেই শোনে, পাকা রাস্তার উপর ঘর্ঘর শব্দ তুলে মোটর চলছেই, চলছেই। কখনও কখনও পল্টনের হইহই শব্দ। তারই মধ্যে মেয়ের গলায় খিলখিল হাসি শুনে তারা অন্ধকারের মধ্যেই চোখ বড় করে স্থিরদৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবে—এ মেয়েরা কারা? কোন্ দেশের? কোন্ জাতের?
পাগলা পাদরী সরে গিয়ে আস্তানা গেড়েছেন। পাকা রাস্তা থেকে আরও দূরে জঙ্গলের মধ্যে। তিনি যে গ্রামখানায় ছিলেন, সেই গ্রামখানাকেই সরে যেতে হয়েছে সামরিক কর্তৃপক্ষের আদেশে। অবশ্য টাকা তারা অনেক পেয়েছে।
রেভারেন্ড কৃষ্ণস্বামী জঙ্গলের ভিতরের পায়ে-চলা পথ ধরে বাইসিক্লে চড়ে এসে ওঠেন পাকা রাস্তায়। মোরামের মোড় থেকে অনেকটা তফাতে, বিষ্ণুপুরের দিকে এগিয়ে এসে বুধবার শনিবার তিনি ওলায় যান। ওখানকার লেপার অ্যাসাইলামে কুষ্ঠরোগীদের চিকিৎসা করেন। পুরী থেকে এই অঞ্চলটায় কুষ্ঠরোগের প্রাদুর্ভাব বেশি। কুষ্ঠ অন্ধত্ব এ অঞ্চলের অভিশাপের মত। সপ্তাহে দু-দিন রেভারেন্ড কৃষ্ণস্বামী ভোরবেলা উঠে যান, ফেরেন বিকেলবেলা। সেদিন আষাঢ়ের প্রথম। কৃষ্ণস্বামী বিকেলবেলা ফিরছিলেন। তাঁর বিচিত্র পরিচ্ছদের উপর মাথায় একটা দেশী টোকা, চোখে একটা গগস। বৃষ্টি তখনও নামে নি। আষাঢ়ের দিন-দীর্ঘতম এবং সব থেকে বেশি উত্তাপ; পৃথিবীর নিকটতম সূর্যের উত্তাপে পৃথিবী যেন ঝলসাচ্ছিল। চষা মাঠের উপর গরম বাতাসে ধুলো উড়ছিল।
বাবাসাহেব তার অভ্যস্ত গতিতে বাইসিক্ল চালিয়ে চলেছেন। গোটা রাস্তাটা ছেড়ে দিয়ে একপাশ ধরেই চলেছেন তিনি। প্রচণ্ড জোরে আসে মিলিটারি ট্রাকগুলি, মুহূর্তের অন্যমনস্কতায় অথবা হিসেবের ভুলে প্রচণ্ড জোরে গিয়ে ধাক্কা মারে পথের পাশের গাড়িতে। ভেঙে উল্টে যায় গাড়ি; চালক আরোহীর আর্তনাদ শোনা যায়। কখনও পথ ছেড়ে গিয়ে পড়ে মাঠের উপর। দুচারখানা উটে যায়, আরোহীরা ছিটকে পড়ে। আঘাত কম হলে উঠে ধুলো ঝেড়ে নিয়ে হোহে করে হাসে। দু-চারখানার চালক আশ্চর্য দৃঢ়তার সঙ্গে স্টিয়ারিং ধরে চষা মাঠের উপর দিয়ে কিছু দূর চালিয়ে গিয়ে গতিবেগ সংবরণ করে ব্রেক কষে। গাড়ি থেকে নেমে নিজের ভাষায় একটা অশ্লীলতম গালাগালি উচ্চারণ করে অকারণে। আশ্চর্য, ঈশ্বরের নাম করে না।
রেভারেন্ড কৃষ্ণস্বামী ভাবতে ভাবতেই চলেছিলেন। বর্গীর হাঙ্গামার সময়, ছিয়াত্তরের মন্বন্তরে, সামন্ত রাজাদের সঙ্গে যুদ্ধের কালে, পাইক-বিদ্রোহের সময় কি এমনই হয়েছিল দেশের অবস্থা? মানুষ কি এমনি করেই দেউলে হয়ে গিয়েছিল? অন্তরের সঞ্চয় তার এত ক্ষীণ এবং ক্ষণজীবী?
হায় বুদ্ধ! হায় ক্রাইস্ট! হায় ঈশ্বরের পুত্ৰ! হায় শচীনন্দন গৌরাঙ্গ।
এ-দেশের দুর্ভিক্ষপীড়িত হৃতসর্বস্ব শিক্ষায়-বঞ্চিত এই মানুষগুলির তবু তো দোহাই আছে। হয়ত ভগবানের কাছে রেহাইও আছে। কিন্তু ওই বিদেশী সৈনিকগুলি! এদের চেয়েও ওরা হতভাগ্য। মৃত্যু ভয়ে অধীর। অসহায়। অহরহ দুরন্ত ভয় তাড়া করে বেড়াচ্ছে। ওরা আকণ্ঠ মদ্যপান করে জীবন নিয়ে ছুটছে ঊর্ধ্বশ্বাসে, গাছে ধাক্কা খেয়ে মরছে। গাড়ি উটে পড়ে চেপটে যাচ্ছে। ছুটতে ছুটতে পথের মধ্যে যা পাচ্ছে ভোগ করবার, তা-ই ভোগ করে যাচ্ছে। কোথায় শিক্ষা, কোথায় সভ্যতা, কোথায় জীবন-গৌরব?
হায় ক্রাইস্ট!
ক্রুশে বিদ্ধ হয়ে তোমার মৃত্যুই সত্য। রেসারেকশন কল্পনা। মানুষের রচনা-করা মিথ্যা আশ্বাস!
হয় বুদ্ধ! হায় চৈতন্য!
চৈতন্যদেব এই পথে পুরী থেকে গয়া গিয়েছিলেন। খোলে-করতালে ঈশ্বরের নামে মুখরিত হয়েছিল এ-সব অঞ্চলের আকাশ-বাতাস।
বিষ্ণুপুরের বৈষ্ণব দেবতারাও মিথ্যা। পারলে না রক্ষা করতে মানুষকে। রাজা গোপালদেবের বেগার মিথ্যে। নাম করায় কোনো ফল হয় নি। আত্মরক্ষার শক্তি না থাক, ওদের মত প্ৰচণ্ড বর্বর শক্তিকে ঠেকাবার মত শক্তি মানুষের না থাক, আত্মাকে রক্ষা করার শক্তিও তারা পেলে না। জপের মালার ঝুলিটা নেহাতই ভেঁড়া নেকড়ার ঝুলি।
সামনেই লেবেল ক্রসিং। বাইসিক্ল থেকে কৃষ্ণস্বামী নামিয়ে দিলেন তার পা দুটো। ছ-ফুট লম্বা মানুষটির পক্ষে ওই যথেষ্ট। ক্রসিঙের পাশেই গেটম্যানের বাসা।
কৃষ্ণস্বামীর চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল। বাস্তবে ফিরে এলেন। এই জীবন। এ জীবন যতক্ষণ আছে, ততক্ষণ নিজের কাজ করতে হবে।
বংশী! বংশী হে–!
খুলে গেল গেটম্যানের ঘরের দরজা। বেরিয়ে এল গেটম্যান রামচরণ।
বাবাসাহেব!
হঁ। বংশী কই হে?
বংশী রামচরণের ছেলে। বংশীর কুষ্ঠ হয়েছে। প্রাথমিক অবস্থা। কৃষ্ণস্বামীই যাওয়াআসার পথে ছেলেটির মুখের চেহারা দেখে ধরেছেন। এবং অনেক বুঝিয়ে চিকিৎসা করাতে রাজি করিয়েছেন। এ রোগের ইনজেকশনে বড় যন্ত্রণা হয়। বংশী অধিকাংশ দিন পালায়। কৃষ্ণস্বামী। বংশীকে প্রলুব্ধ করবার জন্য কিছু না কিছু নিয়ে আসেন। কোনোদিন একটা পুতুল। কোনোদিন একটা ছবি। কোনোদিন কিছু খাবার। কোনোদিন অন্য কিছু। আজও বংশী পালিয়েছে। রামচরণ চারিদিকে তাকিয়ে দেখেও ছেলের সন্ধান পেলে না। সে তারস্বরে ডেকে উঠল–হ-বং-শী-রে–! বং-শী-ঈ–!
কৃষ্ণস্বামী বাইসিটি গেটম্যানের ঘরের দেওয়ালে ঠেসিয়ে রেখে, দাওয়ার উপর উঠে দাঁড়ালেন। রামচরণের স্ত্রী ঘর থেকে বেরিয়ে একটা মোড়া পেতে দিলে কৃষ্ণস্বামী মোড়ায় বসে তার আলখাল্লার মত জামাটার পকেট থেকে বের করলেন একটি বাঁশি। বললেন, এইটো বাজিয়ে ডাকো হে!। বাঁশির ডাক শুনলে কাছে-পিঠে থাকলে আখুনি বেঁরায়ে আসবেক।
তার আগেই কিন্তু সামনে রাস্তার ধারের একটা আমগাছের উপর থেকে ঝপ করে বংশী লাফিয়ে পড়ল। আসছেক গ, আসছেক গ! সেই গ বাবা, সেইবটেক গ!
কৌতূহলের তীব্রতায় তার ঈষৎস্ফীত মুখখানা যেন থমথম করছে। চোখ দুটো জ্বলজ্বল করছে।
কে? কে আসছেক হে বংশীবদন? হেসে প্রশ্ন করলেন কৃষ্ণস্বামী। আমি তুমার লেগ্যা কেমন বাঁশি এনেছি দেখো হে? বংশীবদন লেগ্যা বংশী।
বংশীর মন কিন্তু বাঁশিতে ভুলল না। তার স্থির জ্বলজ্বলে দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল সামনের রাস্তার দিকে। দূরে একটা বাক, সেই বাঁকের মাথায়। সে বোধহয় বাবাকেই বললে, সেই মেয়াছেল্যাটা গ! সেই মাথায় টকটকে রাঙা ফেটা বাধা! গাছের শিরডগাল থেকে আমি দেখ্যাছি। ঝড়ের পারা গাড়িটা আসছে, আর রাঙা ফেটা বাধা সি বসে রইছেক। রোদ লেগ্যা ঝকমকো করছেক। উই উই উঁহুঁ। দূরে বাঁকের মাথায় গর্জন ধ্বনিত হয়ে উঠেছে। সত্যই একখানা জিপ আসছে। সত্যই পিছনের পড়ন্ত রোদে কারও মাথার গাঢ় লাল টুপি স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।
রামচরণ বললে, দেখলাম অনেক বাবাসাহেব। কিন্তুক এমন মেয়েছেল্যা আমরা দেখি নাই বাবার কালে। মেমসাহেব গো!
হাসলেন কৃষ্ণস্বামী। ধুতি চাদর আর চটির দেশের শুধু ধুতিসম্বল দরিদ্র রামচরণ এবং বালক বংশীবদনের মন কোনো বিচিত্ৰবাসিনী বিদেশিনীকে দেখে বিস্ময়ে অভিভূত হয়ে গেছে। জিপখানা সত্যই ঝড়ের বেগেই আসছে। মেয়েটা হ্যাঁ, এরা বলেছে ওটি মেয়ে—লাল-টুপি পরা মেয়েটি যেন দুলছে উলছে। এপাশ থেকে ওপাশ। জিপের সামনে চালকের পাশেই বসে টলছে। মনে হচ্ছে শ্বেতাঙ্গিনী। পাশে চালক একজন বলিষ্ঠদেহ শ্বেতাঙ্গ। গায়ে শুধু গেঞ্জি, মাথায় টুপিটা আছে, অফিসারের টুপি। স্পিড কমিয়ে বাঁক নিয়ে লেবেল-ক্রসিংটা পার হয়ে চলে গেল গাড়িটা। কিন্তু কিছুদূর গিয়েই ব্রেক কষে দাঁড়াল। তার ঝুঁকিতে মেয়েটা টলে পড়ে যেতে যেতে রয়ে গেল। সামনের ড্যাশ-বোর্ডে উপুড় হয়ে পড়ে কোনোক্রমে আঁকড়ে ধরলে একটা রড। আবার পিছু হটতে লাগল গাড়িটা। এসে দাঁড়াল রামচরণের বাড়ির সামনে। শ্বেতাঙ্গটি নামল।
তার ট্রাউজারের কাপড়ের চিণতা দেখে কৃষ্ণস্বামী বুঝতে পারলেন, আমেরিকান অফিসার।
হে-ম্যান! ওয়াটার ওয়াটার। পানি!
জড়িত কণ্ঠে, আদেশের সুরে মেয়েটিও বললে, পানি লাও! ই–উ! ইউ! শুন নেহি!
কৃষ্ণস্বামী উঠে দাঁড়ালেন। চোখের গগসটা খুলে দাওয়া থেকে নেমে এসে জিপের কাছে দাঁড়ালেন। স্থির দৃষ্টিতে মেয়েটির দিকে চেয়ে রইলেন। বিচিত্ৰবেশিনীই বটে। পরনে পাশ্চাত্যের আধুনিকতম ফ্যাশনের লালরঙের লম্বা পেন্টালুন বা শ্লাক্স, গায়ে হাফ-হাতা টেনিস-কলার মিহি সিল্কের ব্লাউস, মাথায় রাঙা টকটকে সিল্কের কাপড়ের লম্বা ফালির শিরোভূষণ। আশ্চর্যভাবে লালসা-উদ্রেক-করা মোহিনী বেশ। তেমনি যেন নির্লজ্জ!
আমেরিকানটি তার সামনে এসে পেন্টালুনের পকেট থেকে একখানা নোট বের করে সামনে ধরে বললে, ডোন্ট য়ু আন্ডারস্ট্যান্ড, ম্যান? ওয়াটার, পানি–পানি–
মেয়েটি প্রায় সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠল, ইউ সোয়াইন!
আমেরিকানটি আবার ধমক দিয়ে উঠল, ইউ বিচ, স্টপ, আই সেইউ স্টপ! কিপ সাইলেন্ট!
কৃষ্ণস্বামী হেসে পরিষ্কার ইংরেজিতে বললেন, প্লিজ, প্লিজ ডোন্ট অ্যাবিউজ হার লাইক দ্যাট, শি ইজ ইল।
নাথিং। ইউ ডোন্ট নো ম্যান, একটা পুরো বোতল মদ ওই কুত্তীটা ঢকটক করে গিলেছে। মাতাল হয়েছে। জল দাও। ভেবেছিলাম রাস্তার ধারে পুকুর পেলে ওকে চুবিয়ে ওর নেশা ছুটিয়ে দেব। তোমাদের বাড়ি দেখে দাঁড়ালাম। মনে হচ্ছে অজ্ঞান হয়ে যাবে। নেশা, কেবল নেশা।
কৃষ্ণস্বামী বললেন, অফিসার, আমি একজন ডাক্তার। আমি দেখতে পাচ্ছি, ও অসুস্থ। আমি বলছি তুমি ওকে নামাও। ওর এক্ষুনি শুশ্ৰুষার দরকার। আমার কলব্যাগে ওষুধ আছে। এক দাগ ওষুধ দিতে চাই। বিশ্বাস করো আমাকে, আমি মেডিক্যাল কলেজের পাস করা ডাক্তার।
বলতে বলতে ওদিকে মেয়েটি ঢলে পড়ে গেল গদির উপর।
কৃষ্ণস্বামী গিয়ে তাঁর দীর্ঘ দুটি বাহু প্রসারিত করে তাকে তুলে নিলেন। বললেন, রামচরণ, তোমার খাঁটিয়াটা পেড়ে দাও।
স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন মুখের দিকে। দৃষ্টি না ফিরিয়েই বললেন, অফিসার, প্লিজ ওর মাথার বাঁধনটা, কাপড়ের ফালিটা, খুলে দাও।
হাত বাড়িয়ে একটু ঝুঁকি দিয়েই মাথার কাপড়ের ফালিটা টেনে খুলে ফেলে দিলে অফিসারটি। আশ্চর্য ঘন কালো একরাশ চুল ছড়িয়ে পড়ল।
কৃষ্ণস্বামী সযত্নে তাকে শুইয়ে দিলেন খাঁটিয়ার উপর।
অনেক শুশ্ৰুষার পর মেয়েটির চেতনা হল। একদাগ ওষুধও তাকে খাইয়েছিলেন কৃষ্ণস্বামী। চেতনা হবার আগে হড়হড় করে বেশ খানিকটা বমি করলে মেয়েটি। তার গায়ের জামাটা ভেসে গেল। খানিকটা কৃষ্ণস্বামীর হাতে জামায় লাগল। দুর্গন্ধে জায়গাটার বায়ুস্তরও যেন দূষিত হয়ে উঠল। কৃষ্ণস্বামী সযত্নে সব ধুয়ে মুছিয়ে দিলেন। অফিসারটি নির্লিপ্তের মত বসে বসে দেখলে, আর সিগারেটের পর সিগারেট খেয়ে গেল। মধ্যে মধ্যে দু-চারটে কথা বলছিল। সবই প্রশ্ন। যেন থেকে থেকে হঠাৎ মনে উঠছিল। পারম্পর্যহীন। একটা প্রশ্নের সঙ্গে আর-একটার কোনো সম্পর্ক নেই।
চৈতন্যহীন মেয়েটি অসাড় হয়ে পড়ে ছিল; তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, ইজনট শি বিউটিফুল? ফাইন আইজ অ্যান্ড আইলিডস ইজ্ন্ট্ ইট্? হে হোয়াট ড়ু য়ু সে?
কৃষ্ণস্বামী শুশ্ৰুষা করতে করতেই বললেন, ইয়েস, শি হ্যাজ গট এ সুইট ফেস।
সত্য, মেয়েটির রূপ আছে এবং রূপে আশ্চর্য মোহও আছে। বিশেষ করে মাথার চুল ঘন। কালো আর অপরূপ সুন্দর চোখ ও চোখের পাতা। চোখের পাতার রোমগুলি সুদীর্ঘ। সুন্দর আয়ত চোখ দুটিকে আরও সুন্দর করে তুলেছে।
আবার কিছুক্ষণ পর হঠাৎ প্রশ্ন করলে, ইজ ইট এনিথিং ভেরি সিরিয়স?
কৃষ্ণস্বামী বললেন, হতে পারত। নেশার উপরে এই গরমে হিট স্ট্রোক হতে পারত। অবশ্য এখনও আশঙ্কা যায় নি।
আবার কয়েক মিনিট পর প্রশ্ন হল, তুমি বললে, তুমি একজন ডক্টর। কোয়ালিফায়েড মেডিক্যাল ম্যান। মনেও হচ্ছে তাই। কিন্তু এরকম পোশাক কেন তোমার?
আমি একজন সন্ন্যাসী। ভারতবর্ষের সন্ন্যাসীদের নানান রকম পোশাক আছে। কিন্তু এই রঙটা হল সবার রঙ।
ক্যান ইউ টেল ফরচুন?
নো।
শুধু ডাক্তার?
হ্যাঁ, আর সন্ন্যাসী!
এ কী, তোমার গলায় ও কী? ক্রশ?
হ্যাঁ, ক্ৰশ। আমি ভারতীয় খ্রিস্টান সন্ন্যাসী।
ভারতীয় খ্রিস্টান সন্ন্যাসী! ইয়ু আর এ রেভারেন্ড!
কৃষ্ণস্বামী উত্তর দিলেন না। মেয়েটির সেবায় মন দিলেন। মেয়েটির মুখের দিকে চেয়ে রইলেন। জ্যামিতির দুটি কোণ সমান দুটি ত্রিভুজে যেমন মিলে যায় তেমনি দুটি মুখ মিলে যাচ্ছে।
আবার কিছুক্ষণ পর অফিসারটি বললে, বলতে পার এই ধরনের মেয়ে তোমাদের দেশে কত আছে? স্ট্রেঞ্জ গার্ল! আপন মনেই বলতে লাগল, ওর সঙ্গে আমার দেখা পুরীতে। অন দ্য। সি-বিচ! স্ট্রেঞ্জ গার্ল! এক ঘণ্টার মধ্যে আমরা বন্ধু হয়ে গেলাম। আশ্চর্য বন্য! কী হাসতে পারে! কী প্রচণ্ড রাগে! কী মদ খায়! সিগারেটে একটা টান দিয়ে ধোঁয়া ছেড়ে আবার বললে, সেই থেকে আমার সঙ্গে ঘুরছে। আবার বললে, শি ইজ এ স্পাের্ট-কিন্তু বড় ওয়াইড়।
কৃষ্ণস্বামী বললেন, জ্ঞান হচ্ছে। তোমার কাছে আর একটু মদ আছে? শি নিডস—
মেয়েটি মদ খেয়ে মুখ একটু বিকৃত করে বললে, ওয়াটার–প্লিজ! ওয়াটার–টাণ্ডা জল!
মুখে জল দিলেন কৃষ্ণস্বামী। মেয়েটি আবার হাঁ করলে, আবার জল দিলেন কষ্ণস্বামী। তারপর চোখের নিচে আঙুল রেখে হেসে বললেন, লেট মি লুক অ্যাট ইওর আইজ! লুক অ্যাট মাই ফেস!
মেয়েটির ভুরু কুঁচকে উঠল, তীক্ষ্ণতর হয়ে উঠল দৃষ্টি।
আমেরিকান অফিসারটি বললে, হেডোন্ট ও সব কোরো না, ড়ু-ই হিয়ার? তার পরে বললে, হঠাৎ চিৎকার করে, হঠাৎ চড় মেরে বসে। শি ইজ হিস্টিরিক!।
ততক্ষণে কিন্তু মেয়েটা ধড়মড় করে উঠে বসেছে। তীব্র দৃষ্টিতে তীক্ষ কণ্ঠে চিৎকার করে উঠল, ইউ ব্ল্যাকি–লিভ মি–; ছেড়ে দাও আমাকে-কালা আদমী কোথাকার!
অফিসারটি চিৎকার করে উঠল, শাট আপ, ইউ বিচ! শাট আপ, আই সে!
কৃষ্ণস্বামী হেসে প্রসন্নকণ্ঠে মেয়েটির কপালে ভিজে হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, তুমি অসুস্থ। আমি ডাক্তার। আমার কথা তোমার শোনা উচিত। আর একটুক্ষণ শুয়ে থাক তুমি। সুস্থ হয়ে উঠবে। তোমার মাথায় যন্ত্রণা হচ্ছে আমি জানি। তুমি এই বড়িটা খেয়ে ফেলো। প্লিজ! পিস অ্যান্ড বি স্টিল।
মেয়েটি যেন অকস্মাৎ স্তব্ধ হয়ে গেছে। তার দিকে বিচিত্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
কৃষ্ণস্বামী ব্যাগটা খুলতে খুলতে আবৃত্তির সুর এনে বলেই চলেছিলেন, পেশেন্স ইউ ইয়ং রোজ-লিপ্ড্ মেড–পেশেন্স প্লিজ
শেক্সপীয়রের ওথেলো নাটকের অংশ আবৃত্তি করছিলেন। এক্ষেত্রে খেটে গেছে।
অফিসারটি হেসে উঠল, হে ডক ইউ আর এ পোয়েট–আ–দ্যাটস্ ফাইন!
মেয়েটি ক্লান্ত হয়ে চোখ বুজে শুয়েছে এরই মধ্যে। কিন্তু তার মসৃণ ললাটে কয়েকটি রেখা। বিস্ময়ের বা প্রশ্নের কুঞ্চনে পুষ্ট হয়ে জেগে উঠেছে। চোখের কোণে কালো দাগ-জীবনে
অমিতাচারের রথের চাকার দাগের মত।
নাও, খেয়ে ফেলে। একটা পিল বের করে কৃষ্ণস্বামী ডাকলেন।
বড়িটা খেয়ে মেয়েটি উঠে বসল। বললে, নো। নেভার। সে হতে পার না তুমি। নো। তারপর হাত বাড়িয়ে অফিসারকে বললে—এ স্মোক প্লিজ! নেলপলিশ লাগানো আঙুলের ডগায় নিকোটিনের দাগ। অফিসারটি সোৎসাহে বলে উঠল, নাট শি ইজ ও-কে। টেক ইট। গেট আপ মাই হনি। হিয়ার ইজ ফায়ার। সে সিগারেট দিল মেয়েটিকে। এবং লাইটারটা জ্বেলে ধরিয়ে দিল সিগারেটটা।
তারপর কৃষ্ণস্বামীর দিকে চেয়ে বললে, ও ঠিক হয়ে গেছে, ডক, ও-কে। আমরা এবার যাব। অনেক ধন্যবাদ তোমাকে। এই নাও।
খান দুয়েক দশ টাকার নোট বের করে ধরলে।
কৃষ্ণস্বামী বললেন, অনেক ধন্যবাদ। কিন্তু মাপ করা আমাকে। এই আমার ধৰ্ম। এই আমার ঈশ্বরোপাসনা। কায়েস্টের নামে তোমাকে অনুরোধ করছি।
মেয়েটি স্থির বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এবং অক্লান্তভাবে সিগারেট টেনে ধোঁয়া ছেড়ে চলেছে।
মুখ ফিরিয়ে নিলেন কৃষ্ণস্বামী।
জীবনের বন্ধ-করা ঘরে যেন ভিতর থেকে ঘা পড়ছে। কে যেন মাথা ঠুকছে।
গাড়িখানা গর্জন করে চলে গেল। বংশী বললে—মেয়াটা তাকায়ে রইছে দেখ বাবা! বাবাসাহেব উয়ার নেশাটো ছুঁটায়ে দিলেক কিনা! রেগেছে!