নবমীর রাত্রিকাল। মণ্ডলবাড়ির সম্পত্তি ঘর-দুয়ার আজ দিনের বেলা ভাগ হইয়া গিয়াছে।
বাড়ির বাহিরে টাপর দেওয়া গরুর গাড়ি সাজানো রহিয়াছে। সকালেই বড় বউ চাঁপাডাঙা যাইবে চিরকালের মত হয়ত যাইবে।
বাড়ির উঠানে এক কোমর উঁচু কাঁচা ইটের দেওয়াল গাঁথা হইয়া গিয়াছে। ভারা বাধা রহিয়াছে। কাল বাকিটা শেষ হইবে।
সেতাব সর্বসমক্ষে ঘোষণা করিয়াছে তাহার সন্তান চাই। সে আবার বিবাহ করিবে। তবু তাহার বুকে যেন আগুন জ্বলিতেছে। কাদম্বিনীর উপর একটা কঠিন আক্রোশ বুকের মধ্যে আগুনের মত জ্বলিতেছে।
রাত্রি প্রথম প্রহর পার হইয়াছে, জ্যোত্সা ঝলমল করিতেছে। আকাশে আজ মেঘ দেখা দিয়াছে।
শুইবার ঘরে বড় বউ শুইয়া ছিল। সেতাবও শুইয়া ছিল, কিন্তু ঘুম তাহার আসে নাই। বড় বউকে বিদায় দিব, বিদায় দিব বলিয়া কয়দিন মাতিয়া উঠিয়াছিল; কাল বড় বউ চলিয়া যাইবে, আজ রাত্রে তাহার অন্তর কেমন অধীর হইয়া উঠিয়াছে। ক্রোধ, ক্ষোভ, জ্বালা, বেদনা, দুঃখ-—সে যেন সবকিছুর একটা সংমিশ্রণ। যেন আগ্নেয়গিরির গর্ভে ফুটন্ত বহু ধাতুর আলোড়ন। সে হঠাৎ উঠিয়া বসিল, কত দিন থেকে তুমি আমার চোখে এইভাবে ধুলো দিয়ে আসছ, বলতে পার? কত দিন?
বড় বউ উত্তর দিল না। সেতাব ঘরের মধ্যে একবার পায়চারি করিয়া আসিয়া কাছে। দাঁড়াইল। বলিল, আমার মুখে ক্যানে এমন করে চুনকালি মাখালে, ক্যানে? বলিয়াই দ্রুতপদে জানালার ধারে গিয়া দঁাড়াইল। সঙ্গে সঙ্গে ফিরিয়া আসিয়া বলিল, তুমি তো বিষ খাইয়ে আমাকে মেরে যা খুশি তাই করতে পারতে। তারপরই বলিল, গয়না, ওই গয়না কটা দিয়ে বিষয় বাঁচিয়ে তুমি আমায় ঠকিয়েছ। আমি কানা, আমি অন্ধ। তোমাকে তার একটি পয়সা আমি দোব না।
সে আসিয়া বিছানায় শুইয়া পড়িল। সঙ্গে সঙ্গে উঠিয়া কাছে গিয়া বসিল, বলিল, তোমাকে যেতে আমি দোব না! তোমার গলা টিপে মেরে ফেলব আমি।
বলিতে বলিতেই সে অস্থির হইয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। এক পাক ঘুরিয়া আসিয়া বলিল, জবাবও তুমি দেবে না! চাঁপাডাঙার বউ!
এতক্ষণে চাঁপাডাঙার বউ বলিলবল।
–আমার পা ছুঁয়ে বল তুমি।
–কি!
—যা দেখেছি তা ভুল। যা বুঝেছি তা ভুল। বল, আমার পা ছুঁয়ে বল? ওঠ।
সে বড় বউয়ের হাত ধরিয়া রূঢ় আকর্ষণে টানিয়া তুলিল এবং নিজের পাখানা বাড়াইয়া। দিয়া বলিল, আমার পা ছুঁয়ে বল?
বড় বউ তাহার মুখের দিকে স্থির দৃষ্টিতে চাহিয়া থামিয়া বলিল, না! তারপর উঠিয়া ধীরে ধীরে বাহিরে চলিয়া গেল। বাহিরে আসিয়া বারান্দায় শুইয়া পড়িল।
সামনে জ্যোৎস্না-ঝলমল পৃথিবী। আকাশে জ্যোৎস্না, গাছের পল্লবে জ্যোৎস্না। কিন্তু তাহার উপর একটা যেন ছায়া পড়িয়াছে। পূর্ব দিকে দিগন্তে মেঘ উঠিয়াছে, এক কোণে তাহারই ছায়া পড়িয়াছে—জ্যোৎস্না-আলোকিত পৃথিবীর উপর। মধ্যে মধ্যে বিদ্যুৎ চমকাইতেছে। সে চমক চকিত স্বল্প অস্পষ্ট। ইঙ্গিতস্পষ্ট প্রকাশ নয়।
শুইয়া শুইয়া কত কথাই তাহার মনে উঠিল। একবার মনে হইল সেতাবের পায়ে আছাড় খাইয়া পড়িয়া পা দুইটাকে জড়াইয়া ধরিয়া বলিবে—তুমি সত্যিই অন্ধ, তুমি সত্যিই অন্ধ। এই কথাটাই তোমার পা ছুঁয়ে আমি তোমাকে বলছি। আর শেষ মিনতি করছি, মেরেই ফেল আমাকে। মেরেই ফেল। কি করে এই মুখ নিয়ে চাঁপাডাঙায় গিয়ে দাঁড়াব আমি?
সেতাব ঘরের মধ্যে পায়চারি করিতেছিল। চিন্তায় সে অধীর অস্থির।
চাঁপাডাঙার বউয়ের উপর নিষ্ঠুর আক্রোশ যেন মুক্ত প্রবাহে বাহির হইবার পথ পাইতেছে। না। কোথায় যেন বাধা পাইয়া নিজের বুকে ফিরিয়া আসিয়া ধাক্কা মারিতেছে। কোনো মতেই সে অপরাধের পাহাড়টা উহার মাথায় চাপাইয়া দিয়া ছাড়িয়া দিতে পারিতেছে না। বড় বউ উপুড় হইয়া মুখ থুবড়াইয়া পড়িয়া গিয়া পিষিয়া যাইতেছে না। সে জলের ঘটি হইতে জল দিয়া মাথা ধুইয়া ফেলিল। তারপর শুইয়া পড়িল।
সব স্তব্ধ। রাত্রি শনশন করিয়া বহিয়া চলিয়াছে। অসংখ্য-কোটি কীটপতঙ্গ অবিরাম এক বিচিত্র ঐকতান বাজাইয়া চলিয়াছে। বাহিরে এক সময় একটা পাঁচা ডাকিয়া উঠিল। সেতাব। চমকিয়া উঠিল। কান পাতিয়া কিছু শুনিবার চেষ্টা করিল। কই, বড় বউয়ের নিশ্বাসের শব্দ শোনা যায় কই? সে সন্তৰ্পণে বিছানা ছাড়িয়া বারান্দার দিকের দরজার পাশে দাঁড়াইয়া উঁকি মারিয়া দেখিল।
আকাশের জ্যোৎস্না আভাস আসিয়া পড়িয়াছে। বারান্দার ভিতরে বারান্দার রেলিঙের খানিকটা পাশ পর্যন্ত জ্যোৎস্নই রহিয়াছে। সেখানে রেলিঙের ছায়া পড়িয়াছে। ভিতরটায় আবছা আলোঅ্যাঁধারি, তাহারই মধ্যে সাদা-কাপড়-ঢাকা বড় বউ নিথর হইয়া পড়িয়া আছে।
সে আবার আসিয়া বিছানায় শুইল। আবার উঠিল, একটা বালিশ তুলিয়া লইয়া জানালার ধারে রাখিয়া শুইয়া পড়িল। বাহিরে দিগন্তে মেঘ ঘন হইতেছে। বাতাস উঠিতেছে মৃদুমন্দ। সেই বাতাসে তাহার তন্দ্ৰা আসিল।
হঠাৎ তন্দ্ৰা ভাঙিয়া গেল। পায়ে যেন কিছুর স্পর্শ অনুভব করিতেছে সে। দেখিল, পায়ের তলার দিক হইতে চাঁপাডাঙার বউ সিঁড়ির দিকে মুখ ফিরাইয়া পা বাড়াইয়াছে। বারান্দার দরজাটা ঠিক পায়ের কাছেই। বারান্দা হইতে উঠিয়া আসিয়াছে বড় বউ। সিঁড়ি দিয়া নামিয়া চলিয়াছে। সেতাব চঞ্চল হইল না। সে স্থির হইয়া ঘুমন্তের মত পড়িয়া রহিল। বড় বউ নামিয়া গেল। সে উঠিয়া কান পাতিয়া রহিল। সিঁড়ির দরজাটা খুলিয়া গেল। এবার সে উঠিল, ঘরের এক কোণে কয়েকটা জিনিসের সঙ্গে ছিল একখানা দা। সে দাখানা লইয়া নামিয়া গেল।
মহাতাপ বাহিরের বারান্দায় পড়িয়া আছে। শুইবার আগে মানদাকে বলিয়াছে, শাসাইয়াছেনা, না। আমার ঘরে কাজ নাই। নে, তুই ঘর নে, দোর নে, বিষয় নে, আমি চাই না। এই বাইরে থাকছি রাতটার মত। কাল চলে যাব। নিশ্চয় চলে যাব।
বড় বউ সত্যই মহাতাপের বাড়ির দিকেই গেল। মাঝখানে উঠানে পঁচিল পড়িয়াছে। প্রায় হাত দুয়েক উঁচু পর্যন্ত গাথা হইয়া গিয়াছে। বড় বউ সন্তৰ্পণে পচিল পার হইয়া ওপারে দাওয়ার ধারে দাঁড়াইল। মহাতাপ বারান্দাতেই শুইয়া আছে। বারান্দার গায়ে খোলা দরজার ভিতর মিটমিটে লণ্ঠনের স্বল্পালোকিত ঘরে মানদা মানিককে লইয়া শুইয়া আছে, দেখা যাইতেছে। বড় বউ দাওয়ায় উঠিল। মহাতাপের মাথার কাছে একটি ছোট পুঁটুলি নামাইয়া দিয়া দ্রুতপদে। বারান্দার ওই প্রান্তে খিড়কির দরজা দিয়া বাহির হইয়া গেল।
মহাতাপও ভাল করিয়া ঘুমায় নাই। বড় বউয়ের দরজা খোলার শব্দে সে জাগিয়া উঠিল, তাকাইয়া দেখিল—একটি মূর্তি বাহির হইয়া গেল; অঙ্কুটস্বরে সে সবিস্ময়ে বলল, বড় বউ? সে হাতে ভর দিয়া উঠিয়া গেল। দেহে তাহার জ্বর রহিয়াছে। হাতে একটা কি ঠেকিল। সে সেটা লইয়া টিপিয়া দেখিল। এ কি? টাকা? গয়না? বড় বউয়ের দ্রুত অনুসরণ করিল। সে বুঝিয়াছে, সে বুঝিয়াছে। বড় বউয়ের মতলব সে বুঝিয়াছে।
সে বাহির হইয়া গেল।
সঙ্গে সঙ্গে মানদাও বাহির হইয়া আসিল বারান্দায়। খোলা খিড়কির দরজার দিকে চাহিয়া দেখিল সে। একটু হাসিল, তারপর সে অনুসরণ করিল।
এবার উঠানে নামিয়া আসিল সেতাব। তাহার হাতের দাখানা জ্যোৎস্নায় ঝলকিয়া উঠিল।
মহাতাপ খিড়কির দরজার বাহির হইয়া চারিদিকে চাহিয়া দেখিল। কয়টা গাছের তলায় অন্ধকার, তাহার ওপারে জ্যোৎস্নালোকিত পৃথিবী। ভরা পুকুরটা জ্যোৎস্নায় ঝকমক করিতেছে। চাঁদ পুকুরের জলে চাদমালা হইয়া কাঁপিতেছে।
পুকুরের ঘাটে দাঁড়াইয়া বড় বউ।
বড় বউ বসিল। কাপড়ের অ্যাঁচলের ফালি ছিঁড়িয়া ফেলিল। সে মরিবার জন্য আসিয়াছে। সে জলে ড়ুবিয়া মরিবে। কাপড়ের ফালি দিয়া পা দুইটিকে বাঁধিবো বুকের কাপড়ে একখানা ইট। শুইয়া শুইয়া সে অনেক ভাবিয়াছে। ছিঃ! ছিঃ! কোন্ মুখে সে চাঁপাডাঙায় ফিরিয়া যাইবে? লোকে শুধাইলে কি বলিবে?
সে সঙ্কল্প করিয়াই বাড়ি হইতে বাহির হইবার সময় তার গায়ের গহনা কয়খানা এবং গোপন সঞ্চয় শ দুয়েক টাকা পুঁটুলি বাঁধিয়া মহাতাপের মাথার শিয়রে নামাইয়া দিয়া আসিয়াছে। তাহার ছিল অনেক। সবই স্বামিত্বের দাবিতে সেতাব লইয়াছে। সে একটি কথাও বলে নাই। এই সামান্যটুকু সে মহাতাপকেই দিয়া যাইবে। মহাতাপকে বঞ্চিত করিয়াছে সেতাব।
বড় বউ পায়ে বাঁধন দিতেছিল।
গাছের তলার ছায়া হইতে মহাতাপ আসিয়া দাঁড়াইল। ডাকিল-বড় বউ!
চাঁপাডাঙার বউ চমকিয়া উঠিল। তাহার দিকে তাকাইয়া অস্ফুটস্বরে বলিল, মহাতাপ!
মহাতাপ বলিল, তুমি জলে ড়ুবতে এসেছ বড় বউ?
বড় বউ অবোধকে ছলনা করিতে চাহিল-কে বললে? আমি ঘাটে এসেছি ভাই। শরীরটা বড় জ্বলছে। চান করব।
—না।—ঘাড় নাড়িয়া মহাতাপ বলিল, আজ তুমি আমাকে ঠকাতে পারবে না। পায়ে তুমি দড়ি বাঁধছ! আমার মাথার শিয়রে তুমি গয়না-টাকা ফেলে দিয়ে এলে। আমি তখুনি বুঝেছি।
বড় বউ বলিল, আমি এই কলঙ্ক মাথায় নিয়ে চাঁপাডাঙায় কোন্ মুখে ফিরে যাব ভাই? তুমি কেন এসে এই সময়ে সামনে দাঁড়ালে মহাতাপ?
—আমি চলে যাচ্ছি। আমি কিছু বলব না। তুমি তাই মর। ওরা যে এমন ভাবে, তা আমি বুঝতে পারতাম না। তোমার গয়না-টাকা তুমি নাও। অ্যাঁচলে হাত না বেঁধেই ড়ুবে মর তুমি। যার পাওনা সে নেবে।
সে ফিরিতে উদ্যত হইল।
—মহাতাপ! দেও!
মহাতাপ ফিরিল। বড় বউ বলিল, ও তোমার পাওনা। তোমার দাদা তোমাকে ফাঁকি দিয়েছে।
আমি নিয়ে কি করব? তুমি ড়ুবে মর। আমিও চলে যাব ঘর থেকে। তুমি চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে আমিও পথ ধরতাম।
–না, না। ও কথা বলতে নেই। মানুর কি হবে? মানিকের কি হবে!
—সে ওই জানে।-হাতখানা উপরের দিকে তুলিয়া দিল।তুমি যে ঘরে থাকবে না, সে ঘরে আমি থাকব না।
বড় বউ নিজেও আজ সচকিত হইয়া উঠিল। বিরক্ত হইল। ছিছি, ছিছি! কঠিন কণ্ঠেই বলিল, কিন্তু ক্যানে? ক্যানে তুমি আমার জন্যে ঘর ছাড়বে মহাতাপ? তোমার বউ, তোমার ছেলে, তোমার ঘর, তোমার বিষয়–
—আঃ! তুমিও তাই বলছ? হা-হা-হারে। সে যেন হাহাকার করিয়া উঠিল। তারপর আবার বলিল—শুধু বউ বেটা বিষয় নিয়ে ঘর হয়? মা না থাকলে হয়, মা থাকতে তাকে ছেড়ে বউবেটা নিয়ে ঘর? আমার মা বলে গিয়েছে, বড় ভাজ তোর মা। ছেলেবেলায় খেলাঘরে তুমি মা হতে আমি ছেলে হতাম—মনে নাই? বলে নাই লক্ষ্মণের কথা, সীতার কথা?
সে ছবি মুহূর্তে মনের মধ্যে ভাসিয়া উঠিল; সে কি ভুলিবার?
মনে হইল, সেই সেকালের যুগেই যেন ফিরিয়া গিয়াছে।
মহাতাপ আবার বলিল, মরণকালে মা তোমাকে বলে নাই–বউমা, মহাতাপ আমার পাগল, ও মা ছাড়া থাকতে পারে না তুমি ওর মা হয়ো? তোমার ছেলে-পুলে থোক, কিন্তু ঐ তোমার বড় ছেলে। বলে নাই? মনে নাই?
–আছে ভাই।
মনে আছে কেন, এই মুহূর্তে চোখের সম্মুখে ভাসিতেছে।
শুধু তাহারই নয়, শুধু মহাতাপেরই নয়, সেতাবের চোখের সম্মুখেও ভাসিতেছে। সে যে তাহার সাক্ষী। মায়ের মৃত্যুকালে মা যখন কথাগুলি বলে তখন সেও যে দাঁড়াইয়া ছিল সেখানে।
একটা গাছের তলায় দা হাতে সেতার দাঁড়াইয়া কথাগুলি শুনিতেছিল; থরথর করিয়া সে কাঁপিয়া উঠিল। মনে পড়িল সবশেষে মা তাহাকে ডাকিয়া বলিয়াছিল—তুমি আমার বটবৃক্ষ। ঝড় বাজ অনেক সহ্য করে পোড়ড়া মণ্ডলবাড়িকে খাড়া করেছ। তোমার হায়ার তলায় এই দুটিকে দিয়ে গেলাম। মহাতাপ পাগলাটে, তাকে বউমা দেখবে। তুমি বড় বউমাকে দেখো। সাক্ষাৎ লক্ষ্মী আমার। ওর পয়েই সব। ওর অপমান কোরো না কখনও। ও আমার বড় অভিমানী।
এই নিশীথে গাছের ছায়ার মধ্যে সেই ছবি যেন স্পষ্ট ভাসিয়া উঠিল।
ওদিকে আকাশে শনশন করিয়া মেঘ উঠিতেছিল, কখন মেঘ জমিয়াছে—পাক খাইয়াছে; গুমট ধরিয়াছে তাহার পর মৃদু বাতাস উঠিয়াছে, মৃদু বাতাস প্রবল হইয়া উঠিয়াছে। মেঘ ধাবমান হইয়াছে—আকাশ ঢাকিয়া অসীম বিস্তারে প্রসারিত হইতেছে। মেঘে মেঘে সংঘর্ষ বাঁধিয়াছে। বিদ্যুৎ চমকাইয়া একটা মেঘগর্জন ধ্বনিত হইয়া উঠিল। গম্ভীর গুরু গুরু দীর্ঘায়িত মনোহর মেঘধ্বনি।
মহাতাপ বড় বউকে বলিল, তুমি তাই মর মা; মা-ই বলছি আজ। তুমি মর আমিও চলে যাচ্ছি—এই পথেই যাব। একেবারে গঙ্গাসাগর।
বড় বউ বলিল, মহাতাপ! না। সে কোরো না ভাই!
—না নয়! আমি ঠিক করে রেখেছি। তুমিই কি কম দুঃখ দিলে আমাকে? আমাকে নিয়ে তো ছেলের সাধ মেটে নাই তোমার! কত কবচ পরলে, কত উপোস করলে! গঙ্গাসাগরে ড়ুবে মরব আমি। যেন আসছে জন্মে তোমার কোলেই জন্যই আমি।
বড় বউ চিৎকার করিয়া উঠিল, আমার মাদুলি আমি ছিঁড়ে জলে ফেলে দিয়েছি।
একবারে বাধাবন্ধনহীন চিৎকারওই মেঘের ডাকের মত।
সঙ্গে সঙ্গে কোথা হইতে শিশুকণ্ঠের স্বর ধ্বনিত হইল–ব-মা! ব-মা!
বড় বউ চকিত হইয়া বলিয়া উঠিল—মানিক!
ওদিকে একটা গাছের ছায়ার তলা হইতে মানদা চিৎকার করিয়া উঠিল, মানিক!
মানিককে যে সে ঘরে একলা রাখিয়া আসিয়াছে! বাড়ির দরজাগুলা যে খোলা হাট হইয়াছে! মানিক!—বড় বউ উঠিতে লাগিল। কিন্তু পায়ের বাঁধনের জন্য পারিল না, পড়িয়া গেল। সে বলিল, মহাতাপ, মানিককে দেখ। মহাতাপ! আঃ, আমার পায়ের বাঁধনটা, আঃ!
দা হাতে গাছতলা হইতে ছুটিয়া বাহির হইয়া আসিল সেতাব।
মহাতাপ চিৎকার করিয়া উঠিল, না—না—
সেতাব বলিল, তোর পায়ে পড়ি। মহাতাপ। তোর পায়ে পড়ি। কেলেঙ্কারি বাড়াস নে। যা মানিককে দেখ! ওরে ছোট বউমা আমারই মত বাগানে এসে দাঁড়িয়ে ছিল। মানিক একলা ছিল। দেখ। আমি ওর পায়ের বাঁধন কেটে নিয়ে যাচ্ছি। যা।
সে বড় বউয়ের পায়ের বাঁধন কাটিয়া দিতে বসিল। বলিল, ছি-ছি-ছি!
ওদিকে বাড়ির ভিতর হইতে মানদার কণ্ঠস্বর ভাসিয়া আসিল–মানিক! মানিক!
একা মানিক ঘরে শুইয়া ছিল। বিদ্যুতের আলোয় মেঘের ডাকে তাহার ঘুম ভাঙিয়া গিয়াছিল। সে মাকে ঘরে পায় নাই। বাহিরে আসিয়াও কাহাকেও পায় নাই। দরজা খোলা হাট। অল্প ছিলকে মেঘ অবশ্য আকাশময়ই কুয়াশার মত দাগিয়া উঠিয়াছে। তাহাতে জ্যোত্সা ঢাকা পড়ে নাই, ম্লানও ঠিক হয় নাই, একটু রহস্যালোকের চেহারা পাইয়াছে। সে সেই আশোয় খোলা দরজার বাহির হইয়া পড়িয়াছে। হঠাৎ বড় বউয়ের উচ্চকণ্ঠের মহাতাপ ডাকের মধ্যে বড়মায়ের সাড়া পাইয়া বড়মা বলিয়া ডাক দিয়া পথে বাহির হইয়া পড়িয়াছে। কোথায় বড়মা! সকলেই তাহাকে ফেলিয়া গিয়াছে।
মানদা ঘরে ছুটিয়া আসিয়া ডাকিল, মানিক!
কিন্তু কই মানিক?
সে দিশাহারা হইয়া ওই বাগানের খিড়কির পথেই বাহির হইয়া ডাকিল, মানিক!
মহাতাপ ছুটিয়া আসিল—কই—মান্কে?
—জানি না-মানদা কাতরভাবে স্বামীর দিকে চাহিল।
মহাতাপ দাঁতে দাঁতে ঘষিয়া বলিল, কথা শুনতে গিয়েছিলে, ছেলেকে একা রেখে?
মানদা একবার ডাকিল, দিদি!
বাগানের ভিতর হইতে বড় বউ সাড়া দিল—মানু! মানিক!
–বাড়িতে নাই।–সে কাঁদিয়া উঠিল।
বড় বউ আসিয়া দাঁড়াইল। সে পাইতেছিল। তাহার পিছনে সেতাব। বড় বউ চিৎকার করিয়া ডাকিল-মানিক!
সেই মুহূর্তের ঘন কালো ঈশান কোণের মেঘে চাঁদ ঢাকিয়া দিল। সঙ্গে সঙ্গে আসিল বাতাস–একটা দমকা বাতাস। বাতাসের প্রথম ঝটকাটা চলিয়া গেল। তাহার পর সমান বেগ লইয়া ঠাণ্ডা বাতাস বহিতে লাগিল। সেই বাতাসের মধ্যে শোনা গেল একটা রঙিন বাঁশির ক্ষীণ আওয়াজ–পু পু!
বড় বউ বলিল, সদর রাস্তায়। ওই মানিকের বাঁশি।
সদর রাস্তাতেই বাহির হইয়াছিল মানিক। তাহার শিশুমনে চণ্ডীমণ্ডপে পূজাসমারোহের স্মৃতি। ধারণা জন্মিয়াছিল, তাহাকে ঘুম পাড়াইয়া রাখিয়া সকলে পূজা দেখিতে গিয়াছে। সেই পথেই তাহার বাঁশিটি বাজাইতে বাজাইতে চলিয়াছিল—পু-পু-পু-পু!
অকস্মাৎ জ্যোৎস্না মেঘে ঢাকিয়া অন্ধকার হইয় গেল।
মানিক ছুটিতে শুরু করিল।
সেও শুনিতে পাইতেছে বড়মা ডাকিতেছে, বাবা ডাকিতেছে, জ্যাঠা ডাকিতেছে, মা। ডাকিতেছে মানিক! মানিক! মানিক! মানিক!
চণ্ডীমণ্ডপ হইতেই তাহারা ডাকিতেছে তাহাতে তাহার সন্দেহ নাই। সে ছুটিতে ছুটিতে পথের বাঁকে দাঁড়ায়, রাস্তাটা চিনিয়া লয়, আবার চলিতে শুরু করে, একবার দুইবার হাতের বাঁশিটা বাজাইয়া লয়।
চণ্ডীমণ্ডপের প্রান্তে সে আসিয়া উপস্থিত হইল।
চণ্ডীমণ্ডপে তখন বড় বউ মাথা ঠুকিতেছে।–আমার মানিককে ফিরে দাও। আমার মানিককে ফিরে দাও।
মানিক উল্লাসের সঙ্গে বাঁশিতে ফুঁ দিয়া চণ্ডীমণ্ডপে বড় মায়ের কাছে দাঁড়াইল।
ওদিকে ঝুমঝম করিয়া বৃষ্টি নামিয়া আসিল।
পরদিন সূর্য উঠিলেন মনোহররূপে।
বর্ষণসিক্ত রাত্রির শেষে কাটাকাটা মেঘের ফাঁকে উঁকিঝুঁকি মারিয়া পূর্বাকাশ লালে লাল করিয়া পশ্চিম আকাশে রামধনু ঝাঁকিয়া পৃথিবীকে বরবর্ণিনীর মত সাজাইয়া দিয়া দিনের ঠাকুর হাসিতে হাসিতে আবির্ভূত হইলেন।
মণ্ডলবাড়ির সামনে তখন মণিলাল বিদায় লইতেছে।
যে টোপর-দেওয়া গাড়িখানায় বড় বউয়ের যাইবার কথা, সেই গাড়িখানাতেই মণিলাল একা বাড়ি ফিরিতেছিল।
সেতাব তামাক খাইতেছিল। মণিলাল হাসিয়া বলিল, মাকে কি বলব? শুধাবে তো কি হল? কাদু এল না ক্যানে?
সেতাব বলিল, বলবে! একটু ভাবিয়া লইয়া বলিল, তেনার জামাইকে ভূতে পেয়েছিল। আর কি বলবে? ভূত ছেড়ে গেল। পাঠালে না।
বড় বউ বাড়ির ভিতর হইতে মানিককে কোলে করিয়া আসিয়া বলিল, যাব রে যাব। বলবি মাকে, এই কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর পরই যাব; আমি, তোর জামাইদাদা দুজনাতেই যাব। লসম্বন্ধ করতে যাব। তোর বিয়ের সম্বন্ধ নিয়ে যাব। বলবি, কনে খুব ভাল। বেশ ডাগর। মায়ের সইয়ের মেয়ে। পুঁটি! তোর জামাইদাদা তো পাগল—
সেতাব বলিল, এই দেখ! এই দেখ! রাধে-রাধে-রাধে! কি যে বল!
বড় বউ হাসিতে লাগিল।
ঠিক এই সময়ে মহাতাপ আসিয়া হাজির হইল। তাহার সর্বাঙ্গে কাদা। মাথায় ব্যান্ডেজ ভিজা, চুল ভিজা, কাঁধে কোদাল। সে ইহার মধ্যে কখন মাঠে গিয়াছিল। সে নিজে মাঠের আল ভাঙিয়া দিয়াছিল; সেই কথা মনে পড়িয়া সে স্থির থাকিতে পারে নাই।
কৰ্কটে ছরকট, সিংহে শুকা, কন্যা কানে কান,
বিনা বায়ে তুলায় বর্ষে কোথা রাখিবি ধান।
কৰ্কট অর্থাৎ শ্রাবণে জলে জল ছরকট করিয়া দিলে, সিংহ অর্থাৎ ভাদে শুকা–রৌদ্র হইলে, কন্যা অর্থাৎ আশ্বিনে আল ভরিয়া কানায় কানায় জল থাকিলে ও তুলা অর্থাৎ কার্তিকে বিনা বাতাসে বর্ষণ হইলে ধান রাখিবার জায়গা কুলায় না খামারে। আশ্বিনে জমির আল কাটা থাকিলে চলে?
ওই খনার বচনটাই চাষীরা এমন দিনে গানের সুরে গাহিয়া বলে—
কৰ্কট ছরকট, সিংহে শুকা, কন্যা কানে কান,
বিনা বায়ে তুলা বর্ষে কোথায় রাখবি ধান,
বউ কনে যতন করে নিকাও অঙনখান।