অষ্টম পরিচ্ছেদ
পরদিন সপ্তমীর সকাল।
সুখের রাত্রি সোনার নূপুর বাজাইয়া চঞ্চলা বিলাসিনীর মত অকস্মাৎ পোহাইয়া যায়। কেমন করিয়া কোন দিক দিয়া চলিয়া গেল বোঝা যায় না, ফুরাইয়া গেলে চমক ভাঙে। দুঃখের রাত্রিও। দাঁড়াইয়া থাকে না; বিষণ্ণ ক্লান্তি অসহনীয় হইয়া ওঠে, মনে হয় রাত্রির পার নাই, শেষ নাই; কিন্তু সেও এক সময় ফুরাইয়া যায়। রাত্রি শেষ হয়। সকাল হয়। মণ্ডলবাড়ির সেই দুঃখের ষষ্ঠীর রাত্রিও শেষ হইল। বড় বউ অচেতন হইয়া পড়িয়া গিয়াছিল। জ্ঞান হইয়াছে এই সকালবেলা। বাড়ি ঢুকো না এ কথা বলিয়াও সেতাব এই অবস্থায় তুলিয়া না আনিয়া পারে নাই। পথে পড়িয়া মরিতে দিবার মত অমানুষ সে নয়। অবশ্য পথে পড়িয়া মরিবার কথা নয়। মহাতাপ থাকিতে বড় বউ পথে পড়িয়া কখনও মরিবে না। মহাতাপকে সে কাদুকে তুলিয়া আনিতে দিবে না। কখনও না। একদিন সে বড় সাধ করিয়া ঘরে আনিয়া ছল। নিজেকে ভাগ্যবান ভাবিয়াছিল।
সকালবেলা চাঁপাডাঙার বউ চোখ মেলিয়া চাহিল।
মাথার শিয়রে সেতাব দাঁড়াইয়া ছিল, বসিয়া ছিল রাখাল ও বিপিন মণ্ডল। জ্ঞান হইতেছে না দেখিয়া রাখাল এবং বিপিনকে সেবই ডাকিয়া আনিয়াছে। রাখাল ভাল হাত দেখিতে পারে, বাজনায় যেমন তাহার দক্ষতা, নাড়িজ্ঞানও তাহার তেমনি সূক্ষ্ম। রাখাল তাহার হাতখানি দেখিতেছিল, চাঁপাডাঙার বউয়ের জ্ঞান হইতে দেখিয়া সে হাতখানি নামাইয়া দিল। বলিল–জ্ঞান হয়েছে, ভয় নাই। কি মা, চিনতে পারছ সব? মনে পড়ছে?
বড় বউ একটা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মাথায় ঘোমটা টানিয়া দিল।
রাখাল বলিল—এই দেখ। তবে নাড়ি বড় দুর্বল। যেন কদিন খায়টায় নাই। বুয়েচ না? ভাল করে খেতে দাও। এক বাটি গরম দুধ করে দাও দেখি।
অবগুণ্ঠনের অন্তরাল হইতে বড় বউ মৃদুস্বরে বলিল—মোড়ল জ্যাঠার কাছে আমার একটা নিবেদন আছে।
—আমার কাছে? বিপিন মোড়ল এ কথা শুনিবার জন্য প্রস্তুত ছিল না।
–আপনার কাছেই। হ্যাঁ।
–বল মা বল! কি বলছ বল!
–আমাকে একখানি গাড়ি ডেকে আমার মায়ের কাছে পাঠিয়ে দেন।
–ক্যানে মা? এই পূজার দিন।
সেতাব আর আত্মসংবরণ করিতে পারিল না। সে বলিয়া উঠিল—যাবে যাবে, তার জন্যে মোড়ল জ্যাঠাকে ক্যানে? আমিই পাঠিয়ে দোব। হ্যাঁ, দোব। হবে। হবে।
বড় বউ সে কথা গ্ৰাহ্য করিল না। বলিল—আর আপনারা পাঁচজনে থেকে, ওই মহাতাপকে তার ভাগ বুঝিয়ে দেন। সে পাগল। বিষয়-আশয় হাতে পেলে হয়ত বুঝবে, ঘরে থাকবে, নইলে ও ঘরে থাকবে না। বিবাগী হয়ে যাবে।
সেতাব বলিল, হবে, তাও হবে। এই পুজোর ভেতরেই চুলচেরা করে ভাগ করে দেব। পঞ্চায়েত ডেকেছি।
বিপিন বলিল, আঃ সেতাব! ছিঃ, তুমিও কি পাগল হলে?
–হয়েছি। হয়েছি। আপনারা সব ভাগ করে দেন। নইলে গলায় দড়ি দিতে হবে আমাকে। বলিতে বলিতে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল।
রাখাল ও বিপিন তাহার পিছনে পিছনে চলিয়া গেল।
দাওয়ার উপর তখন মহাতাপ টলিতে টলিতে উঠিয়া দাঁড়াইয়াছে। গত দিনের মাথার। আঘাতের ফলে এবং সারাদিন অনাচারের ফলে তাহার জ্বর হইয়াছে। এই দেহ লইয়াই কখন। বড় বউয়ের চেতনা হইবে—এই প্রত্যাশায় সে দাওয়ায় বসিয়া ছিল। সেখানে বসিয়াই ঘরের কথাগুলি সব শুনিয়াছে। ক্রুদ্ধ উৎসাহে উঠিয়া দাঁড়াইয়াছে।
সেতাব এবং বিপিন বাহির হইয়া আসিতেই সে বলিল হ্যাঁ, আমার বিষয় আমাকে বুঝিয়ে দাও! ভাগ করে দাও। ভাগ করে দাও।
সেতাব তাহার দিকে কঠোর দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল। বিপিন সে দৃষ্টি দেখিয়া শঙ্কিত হইয়া সেতাবকে ডাকিল-সেতাব! বাবা!
সেতাব মহাতাপকে বলিল, দোব। সেতাব না থাকলে পেতাপ মোড়লের জমিজেরাত সব দেনার দায়ে নিলেম হয়ে যেত। ভিক্ষা করে খেতে হত। তা হোক। আমার কর্তব্য আমি করেছি। তোর ন্যায্য ভাগ তুই পাবি।
–ঘোঁতন ঘোষের সঙ্গে শলা করে কত টাকার গয়না বাধা নিয়েছ—সেসব হিসেব আমাকে দিতে হবে।
—সে টাকার একটা পয়সা পেতাপ মোড়লের বিষয়ের টাকা নয়। সে আমার পরিবারের গয়না বিক্রি করা টাকা। গায়ের পঞ্চায়েত জানে বিয়ের সময় পাঁচশো টাকার অলঙ্কার দিয়েছিল শ্বশুর। সে গয়না বেচে দেনা শোধ করেছি। তাকেই আমি বাড়িয়েছি। সে আমার বিয়ের যৌতুক। আমার নিজস্ব।
মহাতাপ বলিল, বড় বউ সে টাকা তোমাকে দেবে না।
—মহাতাপ!–চিৎকার করিয়া উঠিল সেতাব।—বড় বউয়ের নাম তুই মুখে আনিস না। তোকে আমি বারণ করছি। তোকে আমি বারণ করছি।
সে হনহন করিয়া বাড়ি হইতে বাহির হইয়া গেল। তাহার সঙ্গে বিপিন চলিয়া গেল। শুধু রাখাল হতভম্ব হইয়া দাঁড়াইয়া সব দেখিতেছিল।
মহাতাপ সেতাবের শেষ কথাটায় খানিকটা দমিয়া গিয়াছিল; কেন সে বড় বউয়ের নাম মুখে আনিবে না? কেন? হঠাৎ সেই প্রশ্নটা তুলিয়া সে উঠানে নামিল-ক্যানে? ক্যানে শুনি? ক্যানে আমি বড় বউয়ের নাম মুখে আনতে পাব না, শুনি?
ঘর হইতে বাহিরে আসিয়া মানদা তাহার হাত ধরিল না, যেতে পাবে না।
উপর হইতে বড় বউয়ের কণ্ঠস্বর ভাসিয়া আসিল—মহাতাপ, যেয়ো না, ঘরে গিয়ে শোও। আমার দিব্যি, আমার মরা মুখ দেখবে।
মহাতাপ দাঁড়াইয়া গেল।
এতক্ষণে রাখাল বলিল–ঘোট বউমা, চাঁপাডাঙার বউকে একটু দুধ গরম করে দাও বাপু।
ছোট বউ সে কথায় কর্ণপাত করিল না। সে মহাতাপের পায়ের কাছে প্রায় পাগলের মত হাঁটু গাড়িয়া বসিয়া বলিল, মাথা খুঁড়ে মরব আমি।
রাখাল ধীরে ধীরে বাহির হইয়া গেল।
বাহিরে আসিয়া সে দেখিল, সেতাব বসিয়া পত্ৰ লিখিতেছে। দাঁড়াইয়া আছে নোটন। চিঠিখানা শেষ করিয়া সে পড়িয়া লইল—
শ্ৰীমণিলাল পাল কল্যাণবরেষু,
অত্র পত্রের ব্যাপার জরুরি জানিবে। তুমি পত্রপাঠ লোক মারফত চলিয়া আসিবে। এখানে তোমার ভগ্নী কিছুতেই থাকিতে পারিতেছে না। আমরা ভায়ে ভায়ে পৃথকা হইতেছি। এ সময় চাঁপাডাঙার বউকে ওখানে লইয়া না গেলে কোনো মতেই চলিবে না। তুমি পত্রপাঠ আসিবে। অন্যথায় চাঁপাডাঙার বউকে হয়ত একাই পাঠাইয়া দিতে হইবে। সে ক্ষেত্রে আমাকে দোষ দিলে চলিবে না। ইতি–
শ্ৰীসেতাবচন্দ্র মণ্ডল
পড়িয়া দেখিয়া চিঠিখানি মুড়িয়া নোটনের হাতে দিয়া বলিল, চলে যা। কাল মণিকে সঙ্গে করে নিয়ে আসবি। খবরদার, কোনো কথা ভাবি না।
নোটন চিঠিখানা লইতে হাত বাড়াইল।
রাখাল বলিল, সেতাব!
—ফ্যাচফাচ করিস না রাখাল। পিছু ডাকিস না। বাড়ি যা।
–ওহে, চাঁপাডাঙার বউমাকে–
–রাখাল, তু বাড়ি যা।
রাখাল থামিয়া গেল। ভয় পাইল।
সেতাব চিঠিখানা নোটনের হাতে দিয়া বলিল—তু সব বলবি। যা ঘটেছে মুখে বলবি। বুঝলি?
রাখাল চলিয়া গেল এবার।
সেতাব আবার বলিল—যাবার পথে ঘোঁতনকে ঘোঁতনকে বলবি, আমি ডেকেছি। আমি ডেকেছি।
নোটন তবু চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
সেতাব বলিল—কি? দাঁড়িয়ে রইলি যে?
ওদিকে চণ্ডীমণ্ডপে সানাই ঢোল ঢাক বাজিয়া উঠিল। সপ্তমী পূজার ঘট আনিবার সময় হইয়াছে।
সেতাব আবার বলিল, নোটন!
এবারে নোটন বলিল, ওই শোন, পূজার ঢাক বাজছে। ঘট আসছে মোড়ল। সে সব বুঝিয়াছে।
সেতাব রূঢ়কণ্ঠে বলিল, নোটন।
নোটন পুরনো লোক, এই ঘরের সুখদুঃখের সঙ্গে তাহার জীবনটা জড়াইয়া গিয়াছে শত পাকে সহস্ৰ বয়নে। সে বলিল, যা করবে পূজার পরে কোরো। মোড়ল, আজ সপ্তমী পুজোর দিন; ঠাকুরুনের ঘট আসবে, সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্মী পাতবে, আজ ঘর ভাঙার ধুয়ে তুলো না। বেসজ্জনের বাজনা বাজিও না।
সেতাব তাহার হাতের চিঠিটা লইতে উদ্যত হইল। বলিল, তুই যাবি কি না বল?
নোটন তাহার হাতখানা সরাইয়া লইয়া বলিল, যাব। তুমি মনিব। কথা শুনতে হবে আমাকে। চললাম আমি। কিন্তু মাঠে ধান মরছে, শো-শে ডাক ধরেছে মাটিতে। জল নাই। জল হবে না। আকাশের জল হবে না। এ আমি বললাম তোমাকে। যা হয় কোরো।
সে চলিয়া গেল।
পথে একটি বাড়ির দরজায় দাঁড়াইয়া তখন বহুবল্লভ বাউল একতারা এবং বায়া বাজাইয়া গান ধরিয়াছিল–
কমল-মুখ শুকায়ে গেছে, আয় মা আয় মুছায়ে দি,
মায়ের কোলে শয়ন কর মা, শীতলপাটি বিছায়ে দি।।
বল বল মা কানে কানে
কি দুঃখ পেলি কোমল প্ৰাণে
শ্মশান-তাপে জ্বলছে দেহ,
আঁচল-বায়ে ঘুচায়ে দি।
আয় মা মুখ মুছায়ে দি।
আগমনী গানের বাৎসল্য রস অনাবৃষ্টি—শুষ্ক শরতের আকাশের উত্তপ্ত নীলিমাকে সকরুণ করিয়া তুলিয়াছিল।
বড় বউয়ের কানে ওই গানের সুর ভাসিয়া আসিতেছিল। এ গান যেন দূর চাঁপাডাঙায় বসিয়া তাহারই মা গাহিতেছে। সে তো যাইবে। এ বাড়ির মেয়াদ তাহার ফুরাইয়াছে। সে কথা সে জানিয়াছে। তাহার নিজের চিত্তের সকল মায়া সব মমতাই কাটিয়াছে। তাহার স্বামীরও কাটিয়াছে। সব ভালবাসা মায়ানদীর মত শুকাইয়া গিয়া মরুভূমিতে পরিণত হইয়াছে। সেই মরুভূমির বুকের মধ্যে সেতাবের অন্তরের রূপটা ফুটিয়া উঠিয়াছে। সে চায় নূতন ঘর, নূতন সংসার, নূতন–
হাসি ফুটিয়া উঠিল তাহার মুখে। তাহার প্রতি এই কদর্য সন্দেহ একান্তভাবেই মিথ্যা। এতকাল এইভাবেই তো ঘর করিয়া আসিল সে। এমনিভাবেই তো সে মহাতাপকে স্নেহ করিয়াছে, এমনিভাবেই তো মহাতাপ আবদার করিয়াছে। কই, এতকালের মধ্যে এমন সন্দেহ তো হয় নাই? হঠাৎ আজ, আজ কেন হইল? ওই তাহার নূতন গোপন সাধটা তাহার চোখে ফুলি পরাইয়া দিয়া সংসারটাকে কালো করিয়া দেখাইয়া তাহাকে জোর দিতেছে।
ঠিক এই সময়েই কে ডাকিল, বউমা!
চমকিয়া উঠিল চাঁপাডাঙার বউ। সে সবিস্ময়ে প্রশ্নভরা দৃষ্টিতে সিঁড়ির দিকে চাহিয়া রহিল।
সিঁড়ির নিচে হইতে আগন্তুক কথা বলিল, আমি মা, রাখাল।
চাঁপাডাঙার বউ ধীরে ধীরে উঠিয়া বসিল।
রাখাল উঠিয়া আসিল; সে একা নয়, তাহার সঙ্গে একটি আট-নয় বছরের মেয়ে। তাহার হাতে এক বাটি দুধ। রাখাল বলিল, তোমার জন্যে দুটুকু নিয়ে এলাম মা। খাও তুমি। দে মা দেী, খুড়ীমাকে দুধের বাটিটা দে।
চাঁপাডাঙার বউ মাথার ঘোমটাটা বাড়াইয়া দিয়া বলিল, পূজার ঘট আসছে। আমাকে লক্ষ্মী পাততে হবে। তার আগে তো খাব না!
–মা, এই দেহে তুমি মাথা ঘুরে আবার পড়ে যাবে।
–না! পারব আমি। খুব পারব।
সে ধীরে ধীরে দেওয়াল ধরিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। বলিল, তুই রাষ্য দেী, আমি লক্ষ্মী পেতে এসে খাব।
রাখাল বলিল, খেঁদী, তুই সঙ্গে যা। বুঝলি, সঙ্গে যা।
ওদিকে ঢাক ঢোল সানাই কঁসির শব্দ উচ্চ হইয়া উঠিল। চণ্ডীমণ্ডপে ঘট আসিল। শাঁখ বাজিল, উলু পড়িল।
চণ্ডীমণ্ডপে এবার পূজার আয়োজন সবই হইয়াছে; কিন্তু তাহাতে প্ৰাণ নাই, সমারোহ জমিয়া উঠিতেছে না। সব যেন বিষণ্ণ চিন্তাভারক্লিষ্ট। আকাশে জল নাই, চাষীর দৃষ্টি আকাশের দূর-দিগন্তে, চিত্ত উদ্বেগকাতর। তাহার উপর সেতাবদের এই কলহটাও একটা বেদনাতুর প্রভাব বিস্তার করিয়াছে। ছেলেরা শুধু ছুটাছুটি করিতেছে। তাহার মধ্যে মানিকও রহিয়াছে। তাহাকে আনিয়াছে গোবিন্দ। খালি গা, জামাও কেহ একটা পরাইয়া দেয় নাই। সে একটা রঙিন বাঁশি লইয়াই খুশি আছে। সেইটাই সে বাজাইতেছে–পু-পু! পু-পু! বাজাইতেছে আর ঘুরিয়া বেড়াইতেছে।
মণ্ডলেরা বসিয়া আছে, তামাক টানিতেছে, কিন্তু আসর ঝিমাইয়া গিয়াছে। কেহ বড় একটা কথা বলে না। চেঁচাইতেছে শুধু টিকুরীর খুড়ী।
—অবিশ্বেস, অনাচার, অবিচার-বলি এর চেয়ে পাপ আর কি হবে? বলি ইয়েতে কি ধৰ্ম থাকে, না দেবতা তুষ্ট হয়। মোড়লেরা কি সব ধর্মজ্ঞান চিবিয়ে খেয়েছে নাকি? বলি পূজা করা কেনে?
বিপিন মণ্ডল সোজা হইয়া বসিল। বলিল—টিকুরীর বউ, তুমি এমন করে ফেঁচাও ক্যানে গো? বলি এমন করে চেঁচাও ক্যানে গো?
—চেঁচাবে না? বলি মোড়লেরা যে চোখ-কানের মাথা খেয়েছে। বলি সেতাবের থেকে এখনও পুজো এল না, সেদিকে নজর আছে?
পাঁচ আনার অংশীদার সেতাব চণ্ডীমণ্ডপের সম্মুখে রাস্তার উপর ঘোঁতনের সঙ্গে কথা বলিতেছিল।
বিপিন মণ্ডল বিস্মিত এবং ব্যস্ত হইয়া উঠিল। প্রতি বৎসর পূজায় চাঁপাডাঙার বউ ষষ্ঠীর সন্ধ্যা হইতে দশমী পর্যন্ত চণ্ডীমণ্ডপে সারাক্ষণ হাজির থাকিয়া সকল অনুষ্ঠান নিখুঁত করিয়া দেয়। সেতাবের দৃষ্টিও এদিকে খুব প্রখর। ভাগের ব্যাপারে সে সকল ভাগীর পূজা বুঝিয়া লয়, নিক্তির ওজনে মাপিয়া বুঝিয়া লইয়া ছাড়ে। একুশ সের আতপের নৈবেদ্য বরাদ্দ আছে। সেতাব চণ্ডীমণ্ডপে মাপের সের হাতে করিয়া বসিয়া থাকে। সর্বাগ্রে চাঁপাডাঙার বউ তাহাদের একের তিন অংশের সাত সের আতপ, সোয়া-পাঁচ গণ্ডা রম্ভার ভাগ সাতটা রম্ভা, সোয়া-পাঁচ পো চিনির সাত ছটাক চিনি, তাহার সঙ্গে আনুষঙ্গিক পূজার জিনিসগুলি একটি ডালায় গুছাইয়া সাজাইয়া লইয়া আসিয়া নামাইয়া দেয়। সেতাব সব বুঝিয়া লইয়া হাঁকাহকি করে—কই সব, কই গো! ভাগীদাররা সব ঘুমুচ্ছে নাকি?
এবার তাদের বাড়িতে একটা আকস্মিক কলহ বাঁধিয়া উঠিয়াছে, তবু পূজা আসিবে না–এ কথা কল্পনা করিতে পারে নাই। চাঁপাডাঙার বউয়ের অবস্থাও বিপিন নিজে দেখিয়া আসিয়াছে; সেতাবও কথার মধ্যে অনেক কিছু বলিয়াছে, তাহার অবশ্য আজ বাহির হইবার কথা নয়, সামর্থও নাই। কিন্তু সেতাব আছে, ছোট বউ আছে।
বিপিন উঠিয়া দাঁড়াইল। ডাকিল—সেতাব!
রাস্তার উপর হইতে সেতাব উত্তর দিল—যাই।
—যাই নয়। বাড়ি যাও। পূজার সামিগ্যিরি আসে নাই। পাঠিয়ে দাও।
টিকুরীর খুড়ী হাকিয়া বলিল—তোমাদের ছোট বউকে পাঠিয়ে দিও, বুঝলে বাবা! বড়। বউকে পাঠিও না।
ঠিক সেই মুহূর্তেই চণ্ডীমণ্ডপের পিছন দিক দিয়া প্রবেশ করিল পুঁটি ও বড় বউ। পুঁটি স্নান করিয়াছে, বড় বউও স্নান করিয়াছে। পুঁটির হাতে পূজার সামগ্রীর ডালা। সে আসিয়া ডালা নামাইয়া দিল।
পুঁটিকে তাহার মা পাঠাইয়া দিয়াছে। পাঠাইয়াছে গুজবের কথাটা বলিতে। বলিয়াছে, লজ্জা করলে চলবে না। বলবি। কাদু আমার পেটের মেয়ের অধিক! কিন্তু কাদুর অবস্থা দেখিয়া পুঁটি। সেকথা বলতে পারে নাই। বলিয়াছে, পুজো দেখতে এলাম দিদি তোমার বাড়ি। কাদু পূজার সামগ্রীর ডালাটা তাহার হাতেই দিয়া সঙ্গে লইয়া আসিয়াছে।
বড় বউকে দেখিয়া সকলে অবাক হইয়া গেল। এত বড় ঘটনা গ্রামে চাপা থাকিবার কথা নয়, সেতাব নিজেই চেঁচামেচি করিয়াছে। ইহার পরও বড় বউ আসিয়া চণ্ডীমণ্ডপে সকলের সমুখে দাঁড়াইবে, এ কথা কেহ কল্পনা করতে পারে নাই।
পুঁটি পূজার ডালাটা নামাইয়া দিল। বড় বউ গলায় আঁচল দিয়া প্ৰণাম করিল।
সমস্ত চণ্ডীমণ্ডপটা কয়েক মুহূর্তের জন্য এমন হইয়া রহিল যে সুচ পড়িলেও শোনা যায়।
প্ৰণাম সারিয়া উঠিয়া বড় বউই নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিল। বলিল-আমাদের পুজোর সামগ্রী। দেখে নাও, কে দেখছ?
এবার টিকুরীর খুড়ী মুখ খুলিল। সে বলিল, আমি দেখে নিচ্ছি, তা–ডালাটার দিকে একবার তাকাইয়া আবার পুঁটির দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলাপাডাঙার বউকে খুঁয়েছিস নাকি পুঁটি?
বড় বউ দাঁড়াইয়া বলিল—মোড়লবাড়ির ভাড়ার এখনও আমার হাতে টিকুরী খুড়ী। সেখানে লক্ষ্মী পেতে নিজে হাতে সামগ্রী বার করে সাজিয়ে নিজেই নিয়ে আসছিলাম। পুঁটি হঠাৎ এসে পড়ল। তুলে নাও! তোমাদের না বলায় হবে না। না বলতে হয় বলবেন ওই দেবতা। বসিয়া নিজেই সমস্ত সামগ্রী প্রতিমার সামনে নামাইয়া দিয়া বলিল—না বলতে হয় তুমি বল মা। আর কারুর কথা আমি শুনব না। আমার হাতের পুজো অশুদ্ধ যদি হয় তবে বজ্ৰাঘাত কর। আমার মাথায়; না হয় সর্পাঘাত হোক আমার। না হয় নিজের হাতের খাড়াটা দিয়ে আমার বুকে মার!
সকলে স্তব্ধ হইয়া গেল। শুধু বিপিন চিৎকার করিয়া উঠিল—বউমা! বউমা! বউমা!
বড় বউ কোনো দিকে দৃকপাত না করিয়া পুঁটিকে বলিলচ পুঁটি। তাহারা দুই জনে চলিয়া গেল।
টিকুরীর খুড়ী বলিল গঙ্গাজলের ঘটিটা কই? অ ইন্দেশের বউ।
সেতাব রাস্তার উপর হইতে উঠিয়া আসিয়া বিপিনকে বলিল-আজ সন্ধেবেলা তা হলে আমার ভাগের কাজটা সেরে দেন।
—আজ? সেতাব—
–না জ্যাঠা, আজই! আই! আই! এ কেলেঙ্কারি আমি আর সইতে পারছি না।
তাহাই হইল।
পঞ্চায়েত বসিয়া সেতাবের বিষয় ভাগ করিয়া দিল। সেতাবের হিসাবের কাজ বড় পরিষ্কার, কাগজপত্রে খুঁত ছিল না; এবং জমিগুলির মধ্যে কোন্ জমি কেমন ইহাও মোড়লদের কাহারও অজ্ঞাত ছিল না। জমি পুকুর ভাগ কাগজ লইয়া বসিয়া অল্প সময়ের মধ্যেই হইয়া গেল।
শেষের দিন বাসন-কোসন ভাগ হইল এবং বাড়ির উঠানে দড়ি ধরিয়া মাপিয়া ঘর ভাগ করিয়া দিল পঞ্চায়েত মণ্ডল। পঞ্চায়েতরা বাড়ির উঠানে দাঁড়াইয়া ছিল। সেতাব মহাতাপ দুই জনে দুই দিকে দাঁড়াইল। মানিক বাঁশিটা বাজাইয়া ফিরিতেছে—পু-পু-পু! বউয়েরা দুই জনেই ঘরের ভিতর।
ভাগের ব্যাপারে সেতাব কথা বলিল না। গোড়াতেই সে বলিয়াছে—আগে ও-ই বেছে নিক। শেষে আমি ঠকিয়েছি—এ কথা শুনব না।
উঠানে দড়ি ধরিয়াছিল একদিকে রামকেষ্ট, অন্যদিকে আর একজন। বিপিন বলিলবল। এখন কে কোন্ দিকে নেবে? এ দিকের ঘরখানা ভাল, তেমনি ওদিকে, রান্নাঘর করে নিতে হবে। সেতাব–?
মহাতাপ উঠিয়া আসিয়া বলিল—ভাল ঘর আমি নোব।
সেতাব হাসিয়া বলিল—তাই নেক। আমি পুরনো ঘরই নিলাম।
মহাতাপ নূতন ঘরের দাওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে উঠিয়া আসিয়া বলিল–বাস।
সেতাব বলিল, আপনারা একটু দাঁড়ান। আমি কাঁচা ইট, রাজ-মজুর ঠিক করে রেখেছি। মাটির দেওয়াল দিতে দেরি হবে। ইটের গাঁথনি আজই দেবে।–আয় রে! ওরে! শুনছিল।
কয়েক জন মজুর আসিয়া ঢুকিল। সেতাব বলিল–ওর মুখ আর আমি দেখব না।
মহাতাপ হঠাৎ উঠিয়া আসিয়া বলিল–গয়না যা বাধা নিয়েছে তার হিসেব কই? বিপিন জ্যাঠা!
সেতাব বলিল—সে তো আমার যৌতুক।
—সে তো বড় বউয়ের গয়না। বড় বউকে তো ও নেবে না।
–সে আমি বুঝব। তা নিয়ে তোর ওকালতি করতে হবে না।
–আলবৎ হবে।
বিপিন বলিল মহাতাপ, তুমি মিছে চেঁচামেচি কোরো না।
ঠিক এই সময়েই বড় বউয়ের ভাই মণিলাল আসিয়া বাড়ি ঢুকিল। মহাতাপ চিৎকার করিয়া বলিল—ওই, ওই বড় বউয়ের ভাই এসেছে। নোটন আনতে গিয়েছিল।
মণিলাল আসিয়া সেতাবকে প্রণাম করিল। বয়সে বড় বউ অপেক্ষা বছর তিনেকের ছোট। বেশ স্বাস্থ্যবান। চাষীর ছেলে। প্ৰণাম করিয়া বলিল—এ সব কি বললে নোটন, জামাই-দাদা?
—তোমার ভগ্নীকে নিয়ে আমার ঘর করা অসম্ভব মণিলাল। বিপিন আসিয়া হাত ধরিয়া বলিল—সেতাব, এ কাজ তুমি হঠাৎ কোরো না। সেতাব!
–না। সে আর হয় না জ্যাঠা। মণিলাল, তুমি তোমার ভগ্নীকে নিয়ে যাও। গাড়ি আমি ঠিক করে রেখেছি।
মহাতাপ ঘাড় নাড়িয়া বিজ্ঞের মত বেশ উল্লাসের সঙ্গেই বলিল—আমিও রেখেছি, গাড়ি ঠিক করে আমিও রেখেছি। হাঁ, আমিও মহাতাপ! হাঁ!
সে বেশ অহঙ্কারের সঙ্গেই, যাহাকে বলে দর্পভরে পদক্ষেপ, তেমনি পদক্ষেপে, কর্মরত মজুরওয়ালার কাটা দেওয়ালের ভিতরটার চারিদিকে বেড়াইয়া আসিল। যেন লাঠি খেলোয়াড় পায়তারা জিতেছে। সেই ভজিবার মুখে তাহার চোখে পড়িল মানদা কখন ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিয়া এক ভাগ লইয়া গুছাইতেছে। মহাতাপ থমকিয়া দাঁড়াইল। তারপর বলিল—নেহি নেহি নেহি।
মানদা থমকিয়া গেল। তারপর ঘোমটা টানিয়া চাপা গলায় বলিল—কোটা আমাদের?
–এইটাই। ওটাই মহাতাপ নিয়েছে।—বলিল বিপিন।
–তবে?
মহাতাপ কাছে আসিয়া বলিল—তোকে ছুঁতে হবে না আমার ভাগ। তুই তোর, কাপড়চোপড় গুছিয়ে নে। হাঁ! গাড়ি ঠিক করে রেখেছি আমি। তোর সঙ্গে আমার ঘর করা নেহি। চলেগা। হাঁ!
মানদার হাত হইতে বাসন কয়েকখানা পড়িয়া গেল।
সকলেই চমকিয়া উঠিল। বিপিন বলিল, ওরে মুখ্য, আধপাগল, বলছিস কি! ক্ষেপলি নাকি?
–অন্যায় কি বললাম? ক্ষেপব কেন?
–তবে এসব কি বলছিস? নিজের পরিবারকে নিবি না ক্যানে?
–ও নেবে না ক্যানে? ও পাঠিয়ে দেবে ক্যানে?
সকলে অবাক হইয়া গেল।
মহাতাপ বলিল, ওকে পাঠিয়ে দোব আমি দিয়ে সেই গাড়িতে বড় বউকে নিয়ে আসব আমি। আর নইলে শিবকেষ্ট-রামকেষ্টদের টিকুরীর খুড়ী ইন্দেশের খুড়ীর মত বড় বউকে ছোট বউকে ভাগ করে দাও তোমরা। বড় বউয়ের সঙ্গে ওর বনে না, আমার ছোট বউয়ের সঙ্গে বনে না। ছোট বউ ওর ভাগে যাক, বড় বউ আমার ঘরে থাকবে।
বিপিন বলিল, ছিছিছি! মহাতাপ তুই চুপ কর্। কেলেঙ্কারি বাড়াস নে। বাড়াস নে।
মহাতাপ চিৎকার করিয়া উঠিল—না-না-না, বড় বউকে আমি যেতে দেব না। বড় বউ ছাড়া আমার চলবে না।
সেতাব এক টুকরা ভাঙা ইট লইয়া সজোরে ছুঁড়িল।
মহাতাপকে লক্ষ্য করিয়া নয়। ছুঁড়িল বড় বউকে লক্ষ্য করিয়া। বড় বউ কখন আসিয়া সিঁড়ির দরজার মুখে দাঁড়াইয়া ছিল, কেহ লক্ষ্য করে নাই। সেতাব দেখিয়াছিল। কাঁচা ইটের টুকরাটা বড় বউয়ের পাশে দেওয়ালে লাগিয়া চুরমার হইয়া গেল। বিপিন সেতাবের হাত ধরিয়া টানিয়া বলিল, এস বাইরে এস। তাহাকে টানিয়া সে লইয়া গেল। খামার-বাড়িতে আসিয়া সেতাব বলিল, আমি নতুন করে সংসার করব। আবার বিয়ে করব আমি।
–করবে। আর আপত্তি আমি করব না।
–ঘোঁতনের বোন পুঁটির কথা আমি ঘোঁতনকে বলেছি।