সকালে নিতাই যখন উঠিল, তখন তাহার জিভের ডগা হইতে বুকের ভিতর পর্যন্ত তেতো হইয়া উঠিয়াছে; কপাল হইতে পায়ের নখ পর্যন্ত জ্বালা করিতেছে। নিজের নিশ্বাসেরই একটা বীভৎস দুৰ্গন্ধ নিজের নাকে আসিয়া ঢুকিতেছে। সর্বাঙ্গ যেন ক্লেদাক্ত উত্তাপে উত্তপ্ত, বিযে বিষাক্ত! শীতের প্রারম্ভে—তাহার উপর সকালবেলা—এই শীতের সকালেও তাহার মৃদু-মৃত্যু ঘাম হইতেছে। মাথার মধ্যে অত্যন্ত রূঢ় একটা যন্ত্রণা। সমস্ত চেতনা যেন গ্রীষ্মদ্বিপ্রহরের উত্তপ্ত মাঠের ধুলায় আচ্ছন্ন আকাশের মত ধূসর–এবং মাঠের মরীচিকার মত কম্পমান। পেট জ্বলিতেছে, বুক জ্বলিতেছে, ভিতরটা শুকাইয় যেন কাঠ হইয়া গিয়াছে।
বসন্ত ঘরের মধ্যেই ছিল, সে আপন মনে অল্প কাজ করিতেছিল। কয়েকদিনের বসবাসের জন্য তৈরী খড়ের ঘর, সেই ঘর সে গোছগাছ করিয়া পরিপাটি করিয়া সাজাইতে অকস্মাৎ ব্যস্ত হইয়া উঠিয়াছে। ভোরে উঠিয়াই ঘরকন্নার কাজগুলা যেন তাহাকে দুই হাত মেলিয়া হাতছানি দিয়া ডাকিয়াছে। মেলায় সে কয়েকখানা ছবি কিনিয়াছিল, নূতন আমলের সাধারণ দেশীয় লঘুরুচি শিল্পীদের হাতের বিলাতী বর্ণসমাবেশে আঁকা—জার্মানিতে ছাপা রাধাকৃষ্ণের প্রেমলীলার ছবি। দুখানা উলঙ্গ মেমসাহেবের ছবি। ছবিগুলি সে ঘরের বাঁশের খোঁটার গায়ে টাঙাইতেছিল। নিতাইকে উঠিতে দেখিয়া সে মৃদু হাসিয়া বলিল—উঠলে?
ওই হাসি এবং এই প্রশ্নেই নিতাইয়ের আজ রাগ হইয় গেল—রাঙা চোখে কঠিন দৃষ্টিতে চাহিয়া সে তিক্ত-কণ্ঠে উত্তর দিল—হ্যাঁ।
কণ্ঠস্বরের রূঢ়তায় বসন্ত প্রথমটা তাহার দিকে সবিস্ময়ে চাহিয়া রহিল, তারপর হাসিল, বলিল—শরীর খারাপ হয়েছে, না? হবে না? প্রথম দিনেই যে মদটা খেলে! মুখ হাত ধোও, চা খাও, খেয়ে চান কর। কাঁচা চা ক’রে দি। তুমি সেদিন দিয়েছিলে আমাকে, ভারি উপকার হয়েছিল।
নিতাই কথার উত্তর দিল না, টলিতে টলিতে বাহির হইয়া গেল। তাহার পায়ের তলার মাটি এখনও যেন কাঁপিতেছে।
প্ৰাত:কৃত্য সারিয়া সে যখন ফিরিল, তখন সে অপেক্ষাকৃত সুস্থ হইয়াছে। দীঘির ঘাটে মাথার যন্ত্রণা উপশমের জন্য বার বার মাথা ধুইয়া ফেলিয়াছিল। ভিজা চুল হইতে তাহার সর্বাঙ্গে জলধারা ঝরিতেছিল, সে ধারাগুলি পড়িতেছিল যেন উত্তপ্ত লোহার পাত্রে জলবিন্দুর মত। বসন্ত তখন একগাদা কাপড় লইয়া কাচিবার জন্য বাহির হইতেছিল। নিতাইকে দেখিয়া সে কাপড় রাখিয়া তাড়াতাড়ি চা করিয়া দিল। লেবুর রস দিয়া কাঁচা চা নিতাইয়ের বড় ভাল লাগিল, চায়ের বাটিটা শেষ করিয়া সে আবার ঘরের মেঝের বিছানো খড়ের উপরেই শুইয়া পড়িল। শুইবামাত্র নিতাই আবার ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। ঠিক ঘুম নয়, অশান্ত তন্ত্র। তাহারই মধ্যে নিতাই শুনিতে পাইল বসন্ত বলিতেছে—খড়ের ওপরেই শুলে?
সে চোখ মেলিয়া চাহিল। একগাদা ভিজা কাচ কাপড় কাধে ফেলিয়া আপাদমস্তক-সিক্ত বসন্ত দ্বারের গোড়ায় দাঁড়াইয়া তাহাকে ডাকিতেছে।
—ওঠ, একটা মাছুর পেতে একটা বালিশ দি। অ ভাই নির্মলা, তোর দাদাকে একটা মাদুর আর.একটা বালিশ দিয়ে যা, আমার সর্বাঙ্গ ভিজে।
নিতাই চোখ বুজিয়া জড়িত কণ্ঠে বলিল—না।
বসন্ত এবার আসিয়া তাহার হাত ধরিয়া আকর্ষণ করিয়া শাসনের সুরে বলিল—না নয়, ওঠ, ওঠ।
নিতাই এবার উঠিয়া বিস্ফারিত চোখে বসন্তর দিকে চাহিল।
—কই? দাদা কই? বলিয়া হাসিমুখে নির্মলা মেয়েটি আসিয়া ঘরে ঢুকিল। সযত্বে মাদুর ও বালিশ পাতিয়া দিতে দিতে বলিল—ওঃ, দাদা আমার আচ্ছা দাদা! যে গান কাল গেয়েছে!
নিতাইয়ের এতক্ষণে গত রাত্রির কথা মনে পড়িল। মস্তিষ্কের মধ্যে একটা বিদ্যুৎচমক খেলিয়া গেল।
এই মুহূর্তে ই ওপাশের খড়ের ঘর হইতে দলের নেত্রী প্রৌঢ়া বাহির হইয়া আসিল–বাবা আমার উঠেছে? পরমুহূর্তেই সে শিহরিয়া বলিয়া উঠিল—ও মা-গো। তোর কি কাণ্ড বসন? এই ক’দিন জর ছেড়েছে, আর আজ এই সকালেই তু এমনি করে জল ঘাঁটছিল!
মৃদু হাসিয়া বসন্ত বলিল—সব কাচতে হ’ল মাসী। এইবার চান করব।
—কাচবার কি দরকার ছিল?
নির্মল খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল—পিরীতি সামান্য নয় মাসী। দাদা কাল বমি ক’রে বিছানা-পত্য ভাসিয়ে দিয়েছে।
প্রৌঢ়াও এবার মৃদু হাসিল, বসন্তকে বলিল—যা যা, ভিজে কাপড় রেখে চান করে আয়। কাপড় ছেড়ে বরং ও-গুলো মেলে দিবি।
দুই চোখ বিস্ফারিত করিয়া নিতাই প্রশ্ন করিল—আমি বমি করেছি?
নির্মল আবার খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।
ঘাড় হেঁট করিয়া নিতাই ভাবিতেছিল—ঘরের এই দুৰ্গন্ধ তাহা হইলে তাহারই বমির দুর্গন্ধ! অনুভব করিল, তাহার সর্বাঙ্গে ওই বমির ক্লেদ লাগিয়া আছে। সেই গন্ধই নিশ্বাসের সঙ্গে তাহার ভিতরটাকে অস্থির করিয়া তুলিয়াছে! নিজের অঙ্গের ক্লেদ এইবার এক মুহূর্তে তাহার অসহ্য হইয়া উঠিল।
—মাথা ধরেছে, লয় গো দাদা? তুমি শোও, আমি খানিক মাথা টিপে দি! নির্মল তাহার কপালে হাত দিল। বড় ঠাণ্ডা আর নরম নির্মলার হাতখানি। কপাল যেন জুড়াইয়া গেল। ভারি আরাম বোধ হইতেছে। কিন্তু নিতাই স্নান না করিয়া আর থাকিতে পারিতেছে না। সে উঠিয়া দাঁড়াইল, বলিল—না চান করব আমি।
বসন্ত কাপড়গুলি রাথিতেছিল, সে বলিল—নির্মলা, ওই দেখ, ‘বাসকো’র পাশে ফুলেল তেলের বোতল রয়েছে, দে তো ভাই বার ক’রে। তারপর সে নিতাইকে বলিল—বেশ ভাল ক’রে তেল মাখো। দেহ ঠাণ্ডা হবে, শরীলের আরাম পাবে। আর সাবান লাও তো তাই লাও!
—না। বলিয়া সে বাহির হইয়া গেল। ইচ্ছা হইতেছে তাহার জলে ডুবিয়া মরিতে! চীৎকার করিতে ইচ্ছা হইতেছে।
সে যখন স্নান করিয়া ফিরিল, তখন বসন্ত স্নান করিয়া কাপড়চোপড় ছাড়িয়া বাক্স লইয়া কিছু করিতেছিল। নিতাই ঘরে ঢুকিতেই সে হাসিয়া বলিল-আজ কেমন সাজব, তা দেখবে। ওই দেখ, আয়না আছে, চিরুনি আছে, স্নো আছে, মুখে লাও খানিক।
স্নান করিয়া নিতাই সুস্থ হইয়াছে বটে কিন্তু মনের অশান্তি ইতিমধ্যে অত্যন্ত তীক্ষ্ম হইয়া উঠিয়াছে। ছি! এ সে করিয়াছে কি! ছি! ছি! ছি! স্নান করিয়া ফিরিয়া আসিবার পথে সে সংকল্প করিয়া আসিয়াছে, আজই সে পলাইয়া যাইবে। ইহারা যাইতে দিবে না, সুতরাং পলাইয়া যাওয়া ভিন্ন উপায় নাই। জিনিসপত্র পড়িয়া থাক, ‘বাজার ঘুরিয়া আসি’ বলিয়া সে বাহির হইয়া চলিয়া যাইবে। অন্য জিনিসপত্রের জন্য দুঃখ নাই। কিই বা জিনিসপত্র! কয়েকখান কাপড় দুইটা জামা একটা কম্বল, দুইটা কাঁথা বালিশ। দুঃখ কেবল তাহার দপ্তরটির জন্য। দপ্তর তো তাহার এখন নেহাৎ ছোটটি নয় যে গায়ের জোরে আলোয়ানের আড়াল দিয়া বগলে পুরিয়া লইয়া পালাইবে। রামায়ণ, মহাভারত এবং আরও অনেক পুরাণ লইয়া তাহার দপ্তরটা অনেক বড় হইয়া গিয়াছে। মেলায়, বাজারে—যেখানে সে গিয়াছে—দুই-একখানা করিয়া বই কিনিয়াছে। কবিগান, পাঁচালী, তর্জার গানত, কৃত্তিবাসী রামায়ণ, কাশীদাসের মহাভারত, মনসার ভাসান, চণ্ডীমাহাত্ম্য, সত্যপীরের গান, কবিকঙ্কণ চণ্ডী, অন্নদামঙ্গল—অনেক বই সে কিনিয়াছে। বাবুদের পাড়ায় ছেঁড়া পাতা কুড়াইয়া পড়িয়া ভাল লাগিলে সংগ্রহ করা তাহার একটা রোগ ছিল। সেগুলিও আছে। বাবুদের থিয়েটারের আশপাশ ঘুরিয়া কয়েকখানা আদি-অন্তহীন নাটকও তাহার সংগ্রহে আছে। এ ছাড়া নিজের লেখা গানের খাতা, সেও যে এখন অনেক হইয়াছে—সব গানই সে এখন খাতায় লিখিয়া রাখে।
একখানা কাপড় তুলিয়া ধরিয়া দেখাইয়া বসন্ত বলিল—উলঙ্গবাহার শাড়ী। এই কাপড় আজ পরব।
কথাটার ইঙ্গিত নিতাই বুঝিল। অর্থাৎ বসন্ত আজ প্রায় নগ্নরূপে নৃত্য করিবে। সে শিহরিয়া উঠিল।
বসন্ত বলিল—দেখব আজ কার জিত হয়, তোমার গানের, না আমার নাচের।
নিতাই আয়না-চিরুনিটা রাখিয়া দিয়া জামা পরিতে আরম্ভ করিল। মুহূর্তে সে দ্বিধাশূন্ত হইয়াছে, থাক তাহার দপ্তর পড়িয়া—সে চলিয়া যাইবে। এখানে সে থাকিতে পারিবে না।
—জামা পড়ছ যে? যাবে কোথা?
–এই আসি।
বসন্ত নিতাইয়ের আকস্মিক ব্যস্ততা দেথিয়া বিস্মিত হইল, বলিল—মানে?
—এই একটুকুন বাজার ঘুরে আসি।
—ন। এখন বাজারে যেতে হবে না। একটুকুম ঘুমিয়ে লাও। ওই দেখ খানিকট মদ ঢেলে রেখেছি, খাও, খোঁয়ারি ছেড়ে যাবে।
—না। আমি একবার মন্দিরে যাব।
—মন্দিরে?
–হ্যাঁ।
—এই বলছ বাজার, এই বলছ মন্দির। কোথা যাবে ঠিক করে বল কেনে?
—বাজারে যাব। রাধাগোবিন্দের মন্দিরেও যাব!
—চল। আমিও যাব।
নিতাই বিব্রত হইয়া চুপ করিয়া বসন্তর মুখের দিকে চাহিয়া রহিল।
রূপোপজীবিনীর কিন্তু অদ্ভূত তীক্ষ দৃষ্টি–নিতাইয়ের মুখের দিকে সে চাহিয়া ছিল, হাসিয়া বলিল—কি ভাবছ বল দেখি?
নিতাই উত্তর দিল না।
বসন্ত এবার বলিল—আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে মন সরছে না? লজ্জা লাগছে?
নিতাই প্রশ্নের জন্য প্রস্তুত ছিল না। অতর্কিত আকস্মিক প্রশ্নে সে চকিত হইয়া উঠিল; অত্যন্ত ব্যস্ত হইয়া বলিল-না—না—না। কি বলছ তুমি বসন! এস-এস।
বসন্ত বলিল—মুখ দেখে কিন্তু তাই মনে হচ্ছে আমার, তুমি যেন পালাতে পারলে বাঁচ। কে যেন তোমাকে দড়ি বেঁধে টানছে। আচ্ছা, বাইরে চল তুমি, আমি কাপড় ছেড়ে যাই।
নিতাই অবাক হইয়া গেল। বসন্তর চোখের দৃষ্টি তো ছুরি নয়–সূঁচ, একেবারে বুকের ভিতর বিঁধিয়া ভিতরটাকে তন্ন তন্ন করিয়া দেখিতে পায়। সে বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। কেমন করিয়া বসন্তকে এড়াইয়া চলিয়া যাইবে সে তা-ই ভাবিতে আরম্ভ করিল।
ওদিকে নির্মলা, ললিতা তাহাদের প্রিয়জন বেহালাদার ও প্রধান দোহারকে লইয়া তখন মদের আসর পাতিয়া বসিয়া গিয়াছে। মহিষের মত বিরাটকায় লোকটা–প্রৌঢ়া দলনেত্রীর মনের মানুষ। লোকটা অদ্ভুত। ঠিক সেই একভাবেই বসিয়া আছে, অনাদি অনন্তর মত। উহাকে দেথিয়া নিতাই তাহার সমস্ত কথা স্মরণ না করিয়া পারে না। লোকটা কথাবার্তা বলে না, আমড়ার আঁটির মত সৌষ্ঠবহীন রাঙা চোখ মেলিয়া চাহিয়াই থাকে। রাক্ষসের মত খায়; প্রায় সমস্ত দিনটাই ঘুমায়, রাত্রে আকণ্ঠ মদ গিলিয়াও ঠাঁয় জাগিয়া বসিয়া থাকে। তাহার সামনেই থাকে একটা আলো-আর একটা প্রজ্বলিত অগ্নিকুণ্ড। এই ভ্ৰাম্যমান পরিবারটির পথে-পাতা ঘরের গণ্ডির ভিতর রূপ ও দেহের খরিদ্দার যাহারা আসে তাহদের দৃষ্টি তাহার উপর না পড়িয়া পারে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দুর্দান্ত মাতালগুলা চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া তাহাকে দেখিয়া—অনেকটা শান্ত প্রকৃতিস্থ হইয়া ভদ্র সুবোধ হইয়া উঠে। লোকটা ভাম হইয়া একটা মদের বোতল লইয়া বসিয়া আছে, নিৰ্বিকার উদাসীনের মত। রান্নাশালার চালায় প্রৌঢ়া তেলেভাজা ভাজিতে বসিয়াছে।
ওই এক অদ্ভুত মেয়ে! মুখে হাসি লাগিয়াই আছে, আবার মুহুর্তে চোখ দুইটা রাঙা করিয়া এমন গম্ভীর হইয় উঠে যে, দলের সমস্ত লোক ত্রস্ত হইয়া পড়ে। আবার পরমুহূর্তেই সে হাসে। গানের ভাণ্ডার উহার পেটে। অনর্গল ছড়া, গান মুখস্থ বলিয়া যায়। গৃহস্থালি লইয়া চব্বিশ ঘণ্টাই ব্যস্ত। উন্মত্ত বুনো একপাল ঘোড়াকে রাশ টানিয়া চালাইয়া লইয়া চলিয়াছে। রথ-রথী-সারথি সবই সে একাধারে নিজে।
নির্মলা হাসিয়া ডাকিল—এস গো দাদা, গরীব বুনের ঘরে একবার এস।
হাসিয়া নিতাই বলিল—কি হচ্ছে তোমাদের?
—কালকে নক্ষ্মীর বার গিয়েছে, পারণ করছি সকালে। বসন কই? সে আসছে না কেনে? মদের বোতলটা তুলিয়া দেখাইয়া সে খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল।
নিতাই সবিনয়ে নীরবে হাত দুইটি কেবল জোড় করিয়া মার্জনা চাহিল।
বেহালাদার হাসিয়া বলিল—হ্যাঁ হ্যাঁ। তাকেই ডাক। কান টানলেই মাথা আসবে।
নিতাইয়ের পিছনেই বসন্তের সকৌতুক কণ্ঠস্বর ধ্বনিত হইয়া উঠিল—মাথা এখন পুণ্য করতে চলেছে, সঙ্গে সঙ্গে কানকেও যেতে হবে। তবে যদি কেটে লাও কানকে, সে আলাদা কথা!
বসন্তর কথা কয়টি নিতাইয়ের বড় ভাল লাগিল। বাঃ, চমৎকার কথাটি বলিয়াছে বসন! খুশী হইরা নিতাই পিছন কিরিয়া দেখিল—গতকালকার ভক্তিমতী পূজারিণীর সাজে সাজিয়া বসন্ত দাঁড়াইয়া আছে। বসন্ত হাসিয়া বলিল—চল।
পথের দুইধারেই দোকানের সারি।
বসন্ত সামগ্রী কিনিল অনেক। ফলমূল মিষ্টিতে পুরা একটা টাকাই সে খরচ ফেলিল। একটা সিকি ভাঙাইয়া চার আনার আধলা লইয়া নিতাইয়ের হাতে দিয়া বলিল— পকেটে রাখ।
নিতাই আবার চিন্তাকুল হইয়া উঠিয়াছিল। সে ভাবিতেছিল—এ বাঁধন কেমন করিয়া কাটিয়া ফেলা যায়, সেই কথা। মন্দির হইতে ফিরিলেই তাহাকে লইয়া আবার সকলে টানাটানি আরম্ভ করিয়া দিবে। বসন্তও তখন আর এ বসন্ত থাকিবে না। হিংস্র দীপ্তিতে তখন বসন্ত ক্ষুরধার হইয়া উঠিবে। বসন্তের রাত্রির রূপ তাহার তাহার চোখের উপর ভাসিতেছে। সে ঠিক করিল, ফিরিবার পথে বসন্তকে বাসায় পাঠাইয়া দিয়া পথ হইতেই সে সরিয়া পড়িবে। অজুহাতের অভাব হইবে না। তাহার কোন গ্রামবাসীর সন্ধান করিবার জন্য মেলাটা ঘুরিবার একটা অজুহাত হঠাৎ তাহার মনে আসিয়া গেল, সে সেটাকে আঁকড়াইয়া ধরিল। এই অবস্থায় বসন্ত আধলাগুলি তাহার হাতে দিতেই ভ্রূ তুলিয়া সে প্রশ্ন করিল—কি হবে?
—ও মা গো! রাজ্যের কানা খোঁড়া মন্দিরের পথে বসে আছে। দান করব। মৃদু হাসিয়া নিতাইয়ের মুখের দিকে চাহিয়া সে বিস্ময়ের ভ্র কুঞ্চিত করিয়া প্রশ্ন করিল—কি ভাবছ তুমি বল দেখি?
ব্যস্ত হইয়া নিতাই অভিনয় করিয়া হাসিয়া বলিল—কিছু না!
—কিছু না?
নিতাই আবার অভিনয় করিয়া বলিল, ভাবছি তোমাকে চিনতে পারলাম না। নিতাই হাসিল।
সে অভিনয়ে বসন্ত ভূলিল, বলিল—আমার ভারি মায়া লাগে গো! আহা! কি কষ্ট বল দিকিনি কানা খোঁড়া রোগ লোকদের? বাপ রে! বলিতে বলিতে সে যেন শিহরিয়া উঠিল। নিতাই সত্যই এবার অবাক হইয়া গেল। একি! বসন্তের চোখ দুইটা জলে ভরিয়া উঠিয়৷ সে টলমল করিতেছে!
চোখ মুছিয়া বসন্ত আবার হাসিয়া বলিল—সে হাসি বিচিত্র হাসি, এমন হাসি নিতাই জীবনে দেখে নাই—হাসিয়া বসন্ত বলিল—আমার কপালেও অনেক কষ্ট আছে গো! কাল তো তোমাকে বলেছি, আমার কাঁসির সঙ্গে রক্ত ওঠে। কাসের ব্যামো! এত পান-দোক্ত খাই তো ওই জন্যে। রক্ত উঠলে লোকে বুঝতে পারবে না। আর আমিও বুঝতে পারব না। দেখলেই ভয়, না দেখলেই বেশ থাকি। দলের কেউ জানে না, জানে কেবল মাসী। কিন্তু এখনও নাচতে গাইতে পারি, চটক আছে, পাঁচটা লোক দেখে বলেই দলে রেখেছে। যেদিন পাড়ু হয়ে পড়ব, সেদিন আর রাখবে না, নেহাৎ ভাল মানুষের কাজ করে তো নোক দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেবে। নইলে, যেখানে রোগ বেশী হবে, সেইখানেই ফেলে চলে যাবে, গাছতলায় মরতে হবে। জ্যাস্ততেই হয়তো শ্যালকুকুরে ছিঁড়ে খাবে।
নিতাই শিহরিয়া উঠিল। বলিল—বসন।
বসন বলিল—সত্যি কথা কবিয়াল—এই আমাদের নেকন। তবে আমার নেকন আরও খারাপ। তুমি সেই ইস্টিশানে গেয়েছিলে—‘ফুলেতে ধুলোতে প্রেম’ –কবিয়াল, তখন ধুলোর সঙ্গে মাটির সঙ্গে প্রেম হবে আমার। আরও কিছুক্ষণ চুপ করিরা থাকিরা সে আবার বলিল— দুৰ্ব্বো ঘাসের রসে আর কতদিন উপকার হবে।
রোজ সকালে বসন্ত দূৰ্বাঘাস থেতো করিয়া রস খায়। অত্যন্ত গোপনে সে এই কাজটি করে। নিয়মিত খাওয়া হয় না। তাহার অনিয়মিত উচ্ছৃঙ্খল জীবনযাত্রায় সম্ভব হইয়া উঠে না! মধ্যে মধ্যে প্রৌঢ়া মনে করাইয়া দেয়—বসন, সকালবেলায় দূৰ্ব্বোর রস থাস তো?
বসন্ত কখনও কখনও সজাগ হইয়া উঠে, কখনও বা ঠোঁট উল্টাইয়া বলে—ম’লে ফেলে দিয়ে। মাসি। ও আমি আর পারি না।
আবার কাসি বেশী হইলেই সে সভয়ে গোপনে দূৰ্বাঘাস সংগ্ৰহ করিতে ছোটে। ঘাস ছেঁচিতে ছেঁচিতে আপন মনেই কাঁদে।
মন্দিরের পথে চলিতে চলিতেই কথা হইতেছিল। সমস্ত কথা শুনিয়া নিতাইয়ের মনটা উদাস হইয়া উঠিল। একটা সুগভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস তাহাব বুক হইতে ঝরিয়া পড়িল। এমন হাসিতে হাসিতে বসন্ত তাহার কাঁসির অমুখের কথাগুলো বলিল যে নিতাইয়ের মনে হইল, বসন্তের ওই ক্ষীণ হাসিতে ঈষৎ বিস্ফারিত ঠোঁট দুইটির কোলে-কোলে লাল কালির কলমে টানা রেখার মত রক্তের টকটকে রেখা ফুটিয়া উঠিয়াছে। ‘ফেলিয়া চলিয়া যাইবে গাছতলায় মরিতে হইবে। জীবন্তই হয় তো শেয়াল-কুকুরে ছিঁডিয়া খাইবে!’ সে ছবিগুলা যেন তাহার মনের মধ্যে ফুটিতে লাগিল। অগ্র-পশ্চাৎ তাহার সব ভুল হইয়া গেল। পলাইবার কথা তাহার মনে রহিল না। অজুহাতটার কখাও ভুলিয়া গেল। শুধু নীরবে মাথা হেঁট করিয়া বসন্তের সঙ্গে মন্দিরের দিকে চলিতে আরম্ভ করিল।
কিছুক্ষণ পরেই বসন্ত আবার কথা বলিল—তাহার সে বিষন্ন কণ্ঠস্বর আর নাই; কৌতুকসরস কণ্ঠে মৃদু হাসিয়া বলিল—গাঁটছড়া বাঁধবে নাকি? গাঁটছড়া?
কথাটা বসন নেহাৎ ঠাট্টা করিয়াই বলিল। আশ্চর্য বসন! এইমাত্র নিজের মরণের কথা এত করিয়া বলিয়া ইহারই মধ্যে সে-সব সে ভুলিয়া বসিয়া আছে।
নিতাই তাহার মুখের দিকে চোখ তুলিয়া চাহিল। স্থির দৃষ্টিতে বসন্তকে কিছুক্ষণ সে দেখিল। শাণিত-ক্ষুরের মত ঝকঝকে ধারালো বসন্তের ধার ক্ষয় হইয়া একদিন টুকরা-টুকরা, হয়ত গুঁড়া হইয়া যাইবে উখায় ঘষা ইস্পাতের গুঁড়ার মত।
বসন্ত হাসিয়া বলিল—দেখছ?
–হ্যাঁ!
—কি দেখছ? কেয়াফুলও শুকোয়। চোখের কোণে কালি পড়েছে!
বসন্তের মুখে তখনও হাসির রেখা। সে হাসি আশ্চর্য হাসি।
নিতাই মুখে কোন উত্তর দিল না। হাত বাড়াইয়া বসন্তের আঁচলখানি টানিয়া লইয়া নিজের চাঁদরের খুটের সঙ্গে বাঁধিতে আরম্ভ করিল।
বসন্ত চমকিয়া উঠিল—ও কি করছ? সে এক বিচিত্র বেদনার্ত উত্তেজনাভরে সে আপনার কাপড়ের আঁচলখানা আকর্ষণ করিয়া বলিল—না না, না। ছি! ও আমি ঠাট্টা করে বলেছিলাম। তুমি কি সত্যি ভাবলে নাকি?
প্রসন্ন হাসিতে নিতাইয়ের মুখখানি উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল, সে বলিল—গিঁট আগেই পড়ে গিয়েছে বসন। টেনো না। আমি যদি আগে মরি, তবে তুমি সেদিন খুলে নিও এ গিঁট; আর তুমি যদি আগে মর, তবে সেই দিন আমি খুলে নোব গিঁট।
বসন্তের মুখখানি মুহূর্তে কেমন হইয়া গেল।
ঠোঁট দুইটা, শীতশেষের পাণ্ডুর অশ্বখপাত উতলা বাতাসে যেমন থরথর করিয় কাঁপে, তেমনি করিয়া কাঁপিতে লাগিল। তাহার রক্তাভ সুগৌর মুখখান যেন সঙ্গে সঙ্গে সাদা হইয়া গিয়াছে। গরবিনী দর্পিতা বসন্ত যেন এক মুহূর্তে কাঙালিনী হইয়া গিয়াছে।
নিতাই এবার হাসিয়া বলিল—এস এস, আমার আর তর সইছে না। ঠাকুরের দরবারে রাগ করে না।
—রাগ? বসন্ত বলিল—আমার রাগ সইতে পারবে তো তুমি?
—পায়ে ধরে ভাঙাব। নিতাই হাসিল। –এস এস।
বাসায় ফিরিতেই একটা কলরব পড়িয়া গেল। নির্মলা-ললিতাদের মদের নেশা তখন বেশ জমিয়া আসিয়াছে। ফুলের মালা গলায় গাঁটছড়া বাঁধিয়া নিতাই ও বসন ফিরিবামাত্র তাহাদের দেখিয়া তাহার হলুধ্বনি দিয়া হৈ হৈ করিয়া উঠিল। গাঁটছড়াটা খুলিবার কথা নিতাই বা বসন দুইজনের কাহারও মনে হয় নাই।
নিতাই হাসিতে লাগিল। আশ্চর্য, সে লজ্জা পাইল না–কোন গ্লানিও অনুভব করিল না।
আশ্চর্যের উপর আশ্চর্য, লজ্জা পাইল বসন্ত। গাঁটছড়াবাঁধা নিতাইয়ের কাধের চাদরখানা টানিয়া লইয়া সে লজ্জায় মাথা হেঁট করিয়া মৃদু মৃদু হাসিতে হাসিতে ঘরের মধ্যে গিয়া ঢুকিল।