রাত্রি নয়টার পর দুই দলে পাল্লা দিয়া গান আরম্ভ হইল। কিন্তু তাহার মধ্যে চণ্ডীদাসের গান, মহাজনের পদ নাই। আকাশ আর পাতাল। রাত্রির আলোকোজ্জল মেলার নৈশ-আনন্দসন্ধানী মানুষের জনতার মধ্যে নগ্ন জীবনের প্রমত্ত তৃষ্ণার গান। বক্ষোভাণ্ডের মধ্যে প্রবৃত্তির উত্তাপে আনন্দরস গাঁজিয়া যেন স-ফেন মদ্যরসে পরিণত হইয়াছে।
প্রথম আসর পাইয়াছিল বিপক্ষ দল। সে-দলের কবিয়ালটি রঙ-তামাশায় দক্ষ লোক। আসরে নামিয়াই সে নিজে হইল বৃন্দে দূতী–নিতাইকে করিল কৃষ্ণ; পালা ধরিল মানের। অভিমানিনী নায়িকার দূতীরূপে সে গানে কৃষ্ণকে গালাগালি আরম্ভ করিল। ধূয়া ধরিল—
“কা-দা জা-মের বো-দা–কষের রসে ওলো মজেছে কালা,
আমের গায়ে মিছে— ধরিল রঙ—মিছে সুবাস ঢালা।
চন্দ্রাবলী কাদা জাম—
রাধে আমার পাকা আম—”
তাহার পরেই সে আরম্ভ করিল খেউড়। চন্দ্রাবলীর রূপ গুণ কাদা জামের সহিত তুলনা উপলক্ষ্য করিয়া সে বসনের রূপ-গুণের অশ্লীল বিকৃত ব্যাখ্যা আরম্ভ করিয়া দিল। তবে লোকটার ছন্দে দখল আছে, আসরটাকে অশ্লীল রসে মাতাল করিয়া তুলিল। এ দলের পুরানো কবিয়াল বসন্তের চড় খাইয়া যে দল ত্যাগ করিয়াছে, সেই লোকটাই বসস্তের প্রতিটি দোষ ও খুতের সংবাদ ওই দলের কবিয়ালকে দিয়াছে। কবিয়ালটা বসন্তের দিকে আঙুল দেখাইয়া চন্দ্রাবলীর খেউড় গাহিয়া গেল। সঙ্গে সঙ্গে অশ্লীল ভঙ্গিতে নৃত্য শুরু করিল বিপক্ষ দলের মেয়েগুলি। তাহারা পর্যন্ত বসন্তের দিকে আঙুল দেখাইয়া নাচিল।
নিতাই শঙ্কিত হইয়া উঠিল। এই খেউড়ের আসরে তাহার গান জমিবে না, জমাইতে সে পারিবে না, খেউড় তাহার যেন আসে না। মুখে যেন বাধে। কিন্তু শঙ্কা তাহার নিজের পরাজয়ের জন্য নয়। সে বসন্তর কথা ভাবিয়াই শঙ্কিত হইয়া উঠিতেছিল। যে মেয়ে বসন্ত! একদণ্ডে সে আগুন হুইয়া উঠে। আসরেই সে একটা কাণ্ড না করিয়া বসে! বার বার সে বসন্তর মুখের দিকে চাহিতেছিল। কিন্তু এই পাল্লার ক্ষেত্রে আশ্চর্য ধৈর্য বসন্তের; চুপ করিয়াই বসন্ত বসিয়া আছে—যতবার নিতাইয়ের চোখে চোখ মিলিল, ততবার তাহার মুখে হাসি ফুটিয়া উঠিল। সে হাসির অর্থ বুঝিতে নিতাইয়ের ভুল হইল না, হাসিয়া বসন্ত ইঙ্গিতে বলিতে চাহিতেছিল—শুনছ? এর শোধ দিতে হবে; নিতাইয়ের মনে পড়িল গতরাত্রের কয়টি কথা, বসন্ত তাহাকে প্রথম সম্ভাষণেই বলিয়াছে—কয়লা-মানিক লয়, তুমি আমার কালোমাণিক। আমার ছিদ্র কুম্ভে জল রেখেছ, আমার মান রেখেছ তুমি।
বসন্তকে আজ বড় ভাল দেখাইতেছে। নাচের আসরের সাজসজ্জা করিবার তাহার অবকাশ হয় নাই; এলোচুৰ্ণই পিঠের উপর পড়িয়া আছে, লালপেড়ে তসরের শাড়ীখানিই সে একটু আঁটসাট করিয়া পরিয়াছে; সকলের চেয়ে ভাল লাগিতেছে তাহার চোখের সুস্থ দৃষ্টি। মেয়েরা আজ কেহই মদ খায় নাই, সেও খায় নাই। কিন্তু আশ্চর্য! বসনের চোখের দৃষ্টিই সকলের দৃষ্টির চেয়ে সাদা মনে হইতেছে। অদ্ভুত দৃষ্টি বসন্তের! চোখে মদের নেশার আমেজ ধরিলে তাহার দৃষ্টি যেন রক্তমাখা ছুরির মতো রাঙা এবং ধারালো হইয়া উঠে। আবার সুস্থ
বসন্তের চোখ দেখিয়া মনে হইতেছে—এ চোখ যেন রূপার কাজললতা।
বিপক্ষ দলের ওস্তাদ গান শেষ করিয়া বসিল। আশেপাশে শ্রোতার দল জমিয়াছিল, পচা মাছের বাজারে মাছির মত। পয়সা-আনি দুয়ানি-সিকি-আধুলিতে প্যালার থালাটা ততক্ষণে একেবারে ভরিয়া উঠিয়াছে, গোটা টাকাও পড়িয়াছে দুই-তিনটা। গান শেষ হইতেই শ্রোতার হরিবোল দিয়া উঠিল—হরি হরি বল ভাই। বিচিত্র, ইহাই উহাদের সাধুবাদ!
পাশেই সস্তা তেলেভাজা ও মাংসের দোকান—মদও বিক্ৰী হয় গোপনে—সেখানে আর এক দফা ভিড় জমিয়া গেল –এবং দলের দুইটা মেয়েকে লইয়া দোকানের ভিতর চেয়ার টেবিলে আসর করিয়া বসাইয়া কয়েকটি শৌখিন চাষী খাবার খাইতে বসিয়া গেল।
কপালে হাত ঠেকাইয়া মা-চণ্ডীকে প্রণাম করিয়া নিতাই উঠিল। কিন্তু হাত-পা তাহার ঘামে ভিজিয়া উঠিয়াছে। গলা যেন শুকাইয়া যাইতেছে —এই এত বড় মদ্য-তৃষাতুর জনতা, ইহাদের কি দিয়া সে তৃপ্ত করিবে? অনেক ভাবিয়া সে গান ধরিল—
“মদ সে সহজ বস্তু লয়,
চোখেতে লাগায় ধাঁধাঁ—কালোকে দেখায় সাদা—
রাজা সে খানায় পড়ে রয়!”
কবিয়ালদের সকলের চেয়ে বড় বুদ্ধি হইল কূটবুদ্ধি; এবং বড় শক্তি হইল গলাবাজি, অর্থাৎ জোর করিয়া আপন বক্তব্যকে প্রতিষ্ঠিত করা। হয়-কে নয় এবং নয়-কে হয় করিয়া গলার জোরেই কবিয়লিরা জিতিয়া যায়। বুদ্ধি করিয়া অশ্লীল রসের গালিগালাজ বাদ দিয়া নিতাই সেই চেষ্টা করিল। সে ধরিল—
“বৃন্দে তুমি নিন্দে আমার কর অকারণ,
নয় আকারণ—কারণ থেয়ে মত্ত তোমার মন।”
নতুবা ওগো মাতাল বৃন্দ, তুমি নিশ্চয় চন্দ্রাবলীর নিন্দা করিতে না। চন্দ্রাবলী কে? যে রাধা, সেই চন্দ্রাবলী। যে কালী, সেই কৃষ্ণ। চন্দ্রাবলীর দিকে ভাল করিয়া চাহিয়া দেখ। আগে তেঁতুল খাও, মাথায় জল দাও-নেশা ছুটাও, তারপর চন্দ্রাবলীর দিকে চাও। দেখিবে চন্দ্রাবলীর মধ্যে রাধা, রাধার মধ্যেই চন্দ্রাবলী। রাধাতত্ত্বের মানের পালার দশ পৃষ্ঠার দশম লাইন পড়িয়া দেখিও। তারপর সে আরম্ভ করিল—চন্দ্রাবলীর রূপবর্ণনা। অর্থাৎ বসন্তের রূপকেই সে বর্ণনা করিল। একেবারে সপ্তম স্বর্গের বস্তু করিয়া তুলিল। বসন্ত নাচিতেছিল। সুস্থ দেহমনে আজ সে বড় ভাল নাচিতেছিল –কিন্তু রূপ-যৌবন আজ কামনায় লাস্যে তীব্র ও তীক্ষ হইয়া উঠে নাই। সেটা নেশার অভাবেও বটে এবং নিতাইয়ের গানে ঐ রসের অভাবেও বটে। শুধু বসন্তের নাচই নয়, ক্রমে ক্রমে আসরটা ধীরে ধীরে ঝিমাইয়া পড়িতে আরম্ভ করিল; জনতা কমিয়া আসিতে শুরু হইল। দুই-চারিজন যাইবার সময় বলিয়া গেল-দূর!
তাহাদের থালায় প্যালা পড়িল না বলিলেই হয়। প্রৌঢ়া কয়েকবার নিম্নস্বরে নিতাইকে বলিল—রঙ চড়াও, ওস্তাদ, রঙ চড়াও! ঢুলিদার বসন্তের কাছে গিয়া বলিল—একটুকুন হেলেছলে, চোখ একটুকুন খেলাও!
বসন্ত চোখ খেলাইবে কি, চোখ ভরিয়া তার বার বার জল আসিতেছে। হেলিয়া দুলিয়া হিরোল তুলিবে কি, দেহ যেন অবসাদের ভারে ভাঙিয়া পড়িয়াছে। আসরে নামিয়া শ্রোতাদের এমন অবহেলা তাহাকে বোধ করি কখনও সহ্য করিতে হয় নাই। নিতাইয়ের গানের তত্ত্বকথার বিরক্ত হইয় তাহার দিকে লোকে ফিরিয়াও চাহিতেছে না। নিতাইয়ের ধর্মকথার জ’লো রসে তাহার নাচে রঙ ধরিতেছে না। সর্বোপরি দলের পরাজয়টাই তাহার কাছে মর্মান্তিক হইয়া উঠিতেছে। নিম্নশ্রেণীর দেহব্যবসায়িনী রূপ-পসারিনী তাহারা, দেহ ও রূপ লইয়া তাহাদের অহঙ্কার আছে, কিন্তু সে শুধু অহঙ্কারই—জীবনের মর্যাদা নয়। কারণ তাহাদের দেহ ও রূপের অহঙ্কারকে পুরুষের আসিয়া অর্থের বিনিময়ে পায়ে দলিয়া চলিয়া যায়। পুরুষের পর পুরুষ আসে। দেহ এবং রূপকে এতটুকু সন্ত্রম করে না, রাক্ষসের মত ভোগই করে, চলিয়া যাইবার সময় উচ্ছিষ্ট পাতার মত ফেলিয়া দিয়া যায়। তাই ইহাদের জীবনের সকল মর্যাদা পুঞ্জীভূত হইয়া আশ্রয় লইয়াছে নৃত্যগীতের অহঙ্কারটুকুকে আশ্রয় করিয়া। ওই দুইটা বস্তুই যে তাহদের জীবনের একমাত্র সত্য—সে কথা তাহারা বুঝে। তাহারা বেশ ভাল করিয়াই জানে যে, ভাল নাচগানের যে কদর—তাহা মেকী নয়। হাজার মানুষ চুপ করিয়া শোনে তাহদের গান, বিস্ফোরিত মুগ্ধদৃষ্টিতে দেখে তাহদের রূপের মধ্যে বিচিত্র এক অপরূপের অভিব্যক্তি। মরুভূমির মত জীবনের ওইটুকুই তাহাদের একমাত্র শ্যামল সজল আশ্রয়কুঞ্জ। এই শ্রেষ্ঠত্ববোধেই তাহারা অগণ্য শ্রোতার উপস্থিতিকে নগণ্য করিয়া মাথা তুলিয়া নাচে, গায়। সমাজে গণ্যমান্য প্রতিষ্ঠাসম্পন্ন লোকের সঙ্গেও অকুষ্ঠিত দাবিতে গানের তাল মান লইয়া তর্ক করে। খেউড় কবির দলের অপরিহার্য অঙ্গ, বিশেষ করিয়া ঝুমুরযুক্ত কবির দলের পক্ষে। খেউড় না জানিকে এ দলে গাওনা করার অধিকারই হয় না। মাসী বলে—কত বড় বড় মুনি-ঋষি কামশাস্ত্রে হার মানিয়া —শেষ তাহদের কাছে শিষ্যত্ব লইয়াছে। তাহা হইলে খেউড় ছোট জিনিস কিসে? আজ দলের পরাজয়ের সঙ্গে—সেই মর্যাদা ধূলায় লুটাইয় পড়িতেছে বলিয়া অবসাদে বসন্ত যেন ভাঙিয়া পড়িয়াছে। জিতিতে হইলে কবিয়াল ও নাচওয়ালী দুজনকে একসঙ্গে জিতিতে হইবে। একজন জিতিবে, একজন হারিবে—তাহা হয় না।
কোনমতে গান শেষ করিয়া পরাজয়ের বোঝার ভারে মাথা হেঁট করিয়া নিতাই বসিল। ঢোলের বাজনায় তেহাই পড়িল—বসন্তও নাচ শেষ করিল। নাচ শেষ করিয়া আসরে সে আর বসিল না; শ্রান্ত অথচ ক্ষুব্ধ পদক্ষেপে বাহির হইয়া গেল। প্রৌঢ়ী দলনেত্রী তাহার দিকে চাহিয়া কেবল প্রশ্নের সুরে ডাকিয়া বলিল—বসন?
বসন ফিরিয়া দাঁড়াইল—বলিল শরীর খারাপ করছে, মাসী। প্রৌঢ়া হাসিল, বলিল—দেখ না, দোসরা আসরে বাবা আমার কি করে! বসন্ত নিতাইয়ের দিকে একবার ফিরিয়া চাহিল। নিতাই দেখিল—সে চোখে তাহার ক্ষুরের ধার। পরমুহূর্তেই বসন্ত বাহির হইয়া গেল।
প্রৌঢ়া কিন্তু অদ্ভূত। সে যেন এতটুকু বিচলিত হয় নাই। দলের বেহালাদারকে নির্বিকার ভাবেই বলিল—প্যালার থালাটা আন।
লোকটি প্যালার থালা অনিয়া নামাইয়া দিয়া বলিল—কয়েকটা দোয়ানীর বেশী আর পড়ে নাই। সবসুদ্ধ দু টাকাও হইবে না।
প্রৌঢ়া বলিল–গুনে দেখ কত আছে। তারপর সে পানের বাটাটা টানিয়া লইয়া বলিল— মেলার আসর, রঙ-তামাসা-খেউড়ী-খোরাকী লোকেরই ভিড়! নইলে বাবার গানে আর ওই ফচকে ছোড়ার গানে? গান তো বোঝ তুমি, তুমিই বল কেনে?
বেহালাদার বলিল—ত বটে। তবে রঙেরই আসর যখন, তখন না গাইলে হবে কেনে বল? রঙের গানও তো গান।
প্রৌঢ়াকে স্বীকার করিতে হইল। সে বলিল—একশো বার। রঙ ছাড়া গান না গান ছাড়া রঙ! একটা মোট পান মুখে পুরিয়া সে আবার বলিল—ওস্তাদের মার শেষ আসরে। দেখ না, বাবা আমার কি করেই দেখ না!
নিতাই চুপ করিয়া বসিয়া ভবিতেছিল।
নির্মলা, ললিতা মেয়ে দুইটির মুখেও হাসি নাই, পরস্পরে তাহারা মুখভার করিয়াই কথা বলিতেছে—বোধ হয় এই হারজিতের কথাই হইতেছে। দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া নিতাই মাথা হেঁট করিল। সকলের লজ্জা যেন জমিয়া জমিয়া বোঝা হইয়া তাহার মাথার উপর প্রচণ্ডভারে চাপিয়া বসিতেছে। শুধু তো লজ্জাই নয়, দুঃখেরও যে তাহার সীমা ছিল না। খেউড় যে তাহার কিছুতেই আসিতেছে না!
ওদিকে বিপক্ষ দলের ঢুলী বাজনা আরম্ভ করিয়া দিল; লোকটার বাজনার মধ্যে যেন জয়ের ঘোষণা বাজিতেছে। বাজানোর ভঙ্গির মধ্যেও হাতের সদম্ভ আস্ফালন। ও-দলের কবিয়াল বোধ হয় বাহিরে ছিল—সে একেবারে নাটকীয় ভঙ্গীতে একটা ছড়া কাটিতে কুটিতে ছুটিয়া আসরে আসিয়া প্রবেশ করিল—
“হায়—হায়—হায়—হায় কালাচাঁদ বলে গেল কি?”
‘কুকুরী আর ময়ুরী, সিংহিনী আর শূকরী, শিমূলে আর বকুলে, কাকে আর কোকিলে, ওড়না আর নামাবলী, রাধা আর চন্দ্রাবলী—তফাৎ নাইক, একই?’ ইহার পরই সে আরম্ভ করিল অশ্লীলতম উপমা। সঙ্গে সঙ্গে আসরে যেন বৈদ্যুতিক স্পর্শ বহিয়া গেল। লোকে হরিবোল দিয়া উঠিল। এবার লোকটা একটু থামিয়া সুর ভাঁজিয়া গান ধরিল—
“আ—কালাচাঁদের কালো মুখে আগুন জ্বেলে দে গো—
টিকেয় আগুন দিয়ে রাধে তামুক খেয়ে লে গো!”
অর্থহীন উপমায় যে-কোন প্রকারে কতকগুল গালিগালাজ দিয়া এবং অশ্লীল কদর্য ভাব ও উপমার অবতারণা করিয়া সে আসরটাকে অল্প সময়ের মধ্যেই জমাইয়া তুলিল।
নিতাই আসর হইতে উঠিয়া চলিয়া গেল।
ও-দলের একটা মেয়ে নাচিতে নাচিতে আসিয়া তাহাকে ধরিয়া নিজেই আথর দিয়া গাহিয়া উঠিল–
“ধর ধর ধর কালাচাঁদে, পলায়ে যে যায় গো!
এক আমি ধরতে লারি সবাই মিলে আয় গো!”
আসরে একটা তুমুল হাসির রোল পড়িয়া গেল। নিতাই কিন্তু তাহাতেও রাগ করিল না। সে হাসিমুখেই মেয়েটির এই তীক্ষ উপস্থিত বুদ্ধির জন্য আন্তরিক প্রশংসা করিয়া বলিল—ভাল, ভাল! ভাল বলেছ তুমি!
আসর হইতে বাহির হইয়া আসিয়া নিতাই ঝুমুর দলের আস্তানায় বসন্তের খুপরির দুয়ারে দাঁড়াইল। খড়ের আগড়টা আধখোলা অবস্থায় রহিয়াছে। ভিতরে একটা লণ্ঠন মৃদুশিখায় জ্বলিতেছে। বাহিরে খোলা আকাশের তলায় উঠানে বিস্তীর্ণ অন্ধকারের মধ্যে সেই একটা অগ্নিকুণ্ডই উজ্জ্বলতর হইয়া জ্বলিতেছে এবং তাহারই সম্মুখে মহিষের মত প্রচণ্ডকায় লোকটা পূর্ণ উদর হিংস্র কোন পশুর মত বাসা আগলাইয়া চুপ করিয়া বসিয়া রহিয়াছে। পদশব্দে সে ফিরিয়া চাহিল, এবং নিতাইকে দেখিয়া নিশ্চিন্ত হইয়া আবার মুখ ফিরাইয়া ঝিমাইতে লাগিল। নিতাই বসন্তের ঘরের দুয়ারে দাঁড়াইল, ঢুকিতে সাহস করিল না। দেহ-ব্যবসায়িনীর ঘর! সে বাহির হইতেই ডাকিল—বসন?
—কে? ঘরের ভিতর হইতে বিরক্তিভর কণ্ঠস্বরে বসন্ত উত্তর দিল।
—আমি নিতাই। রসিকতা করিয়া ‘কয়লা-মণিক বলিতে তাহার মন উঠিল না।
—কি?
—ভেতরে যাব?
—কি দরকার?
—একটু’ন কাজ আছে।
মুহূর্তে বসন্ত নিজেই বাহিরে আসিয়া দাঁড়াইল। অধীর অস্থির ক্ষুব্ধ পদক্ষেপে সে ঘরের ভিতর হইতে নিতাইয়ের সম্মুখে আসিয়া ঝলকিয়া উঠিল, ঠিক খাপ হইতে একটানে বাহির হইয়া আসা তলোয়ারের মত। বাহিরের অগ্নিকুণ্ডের আলোর রাঙা আভা পূর্ণ দীপ্তিতে তাহার সর্বাঙ্গে যেন ঝাঁপ দিয়া পড়িয়া ঝলকিয়া উঠিল। নিতাই দেখিয়া শঙ্কিত হইল। আজিকার অপরাহের পূজারিণী, শান্ত স্নিগ্ধ নম্র সে বসন্ত আর নাই, এ সেই পুরানো চেনা বসন্ত। তাহার সর্বাঙ্গে ক্ষুরের ধার ঝলসিয়া উঠিয়াছে। রাঙা আলোর প্রতিচ্ছটায় সে যেন রক্তাক্ত। সে ফিরিয়া আসিয়া মদ খাইয়াছে। চোখে ছটা বাজিতেছে।
বসন্ত বলিল—আমি যাব না। আমি যাব না। কেনে এসেছ তুমি?
নিতাই কোন উত্তর দিতে পারিল না। শঙ্কিত দৃষ্টিতে বসন্তর মুখের দিকে চাহিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল।
অকস্মাৎ কঠিনতম আক্রোশে বসন্ত তাহার গালে সজোরে একটা চড় বসাইয়া দিল, বলিল —ন্যাকার মত আমার সামনে তবু দাঁড়িয়ে! কেনে, কেনে, কেনে? প্রশ্নই করিল, কিন্তু উত্তরের অপেক্ষা করিল না। মুহূর্তে যে অধীর অস্থির গতিতে বাহির হইয়া আসিয়াছিল সেই গতিতেই সে ঘরের ভিতরে ঢুকিয়া গেল। এই আঘাত করিয়াও যেন তাহার ক্ষোভ মেটে নাই। ঘরের ভিতরে ঢুকিয়া সে নিজের কপালে কয়ট চাপড় মারিল; তাহার শব্দটাই সে কথা বলিয়া দিল।
নিতাই কিছুক্ষণ চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর সেই আগলদার লোকটার কাছে আসিয়া ডাকিয়া বলিল—পালোয়ান!
লোকটা দলের মধ্যে পালোয়ান বলিয়া পরিচিত। নেশায় ভাম লোকটা রাঙা চোখ তুলিয়া তাহার দিকে শুধু চাহিল মাত্র, কথার উত্তর দিল না। সম্মুখের কয়টা দাঁত শুধু বাহির হইয়া পড়িল।
নিতাই বলিল—তোমার কাছে মাল আছে? মদ?
নিরুত্তর লোকটা এদিক-ওদিক হাতড়াইয়া একটা বোতল বাহির করিয়া আগাইয়া দিল। বোতলটা হাতে করিয়াও নিতাই একবার ভাবিল—তারপর এক নিঃশ্বাসে খানিকটা গিলিয়া ফেলিল। বুকের ভিতরটা যেন জ্বলিয়া গেল; সমস্ত অন্তরাত্মা যেন চিৎকার করিয়া উঠিল; দুর্নমনীয় বমির আবেগে—সমস্ত দেহটা মোচড় দিয়া উঠিল, কিন্তু প্রাণপণে সে আবেগ সে রোধ করিল। ধীরে ধীরে আবেগটা যখন নিঃশেষিত হইল তখন একটা দুর্দান্ত অধীরতাময় চঞ্চল অমুভূতি তাহার ভিতরে সদ্য জাগিয়া উঠতেছে। সে তখন আর এক মানুষ হইয়া যাইতেছে। সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবীও আর এক পৃথিবী হইয়া যাইতেছে। আশ্চর্য!
সব যেন দুলিতেছে; ভিতরটা জ্বলিতেছে; দুনিয়া যেন তুচ্ছ হইয়া যাইতেছে! এখন সে সব পারে। সে-কালের ভীষণ বীরবংশী বংশের রক্তের বর্বরত্বের মৃতপ্রায় বীজাণুগুলি মদের ম্পর্শে— জলের পর্শে মহামারীর বীজাণুর মত, পুরাণের রক্তবীজ হইয়া অধীর চঞ্চলতায় জাগিয়া উঠিতেছে।
আবার সে খানিকটা মদ গলায় ঢালিয়া দিল।
দ্বিতীয়বার আসরে যখন সে প্রবেশ করিল তখন তাহার রূপটাই পাল্টাইয়া গিয়াছে। সে আর এক মানুষ হইয়া উঠিয়াছে। নীতিকথাগুলো ভুলিয়াছে, পাপপুণ্য লইয়া হিসাব-নিকাশ ভূলিয়াছে, হা-হা করিয়া অশ্লীল ভঙ্গিতে হাসিতে ইচ্ছা হইতেছে।
হইবে না কেন? সামাজিক জীবনে মানুষের যাহা কিছু পাপ, যাহা কিছু কদৰ্য, যাহা কিছু উলঙ্গ অশ্লীল তাহাই আবর্জনা-স্তুপের মত যেখানে জমা হয়, সেই বিষাক্ত পরিবেশের মধ্যে তাহার জন্ম। দারিদ্র্য ও কঠিন দাসত্বের অনুশাসনের গণ্ডীর ভিতর বঙ্গ যুগ যাহারা বাস করিয়া আসিতেছে, সে তাহাদেরই সন্তান। মা সেখানে অশ্লীল গালিগালাজে শাসন করে, উচ্ছ্বসিত স্নেহে অশ্লীল কথায় আদর করে, সন্তানকে সকৌতুকে অশ্লীলতা শিক্ষা দেয়। অশ্লীলতা, কদৰ্য ভাষা, ভাব নিতাইয়ের অজানা নয়। কিন্তু জীবনে সামান্য শিক্ষা এবং কবিয়ালির চর্চা করিয়া সে-সব সে এতদিন ভুলিতে চাহিয়াছিল। সে-সবের উপর একটা অরুচি, একটা ঘৃণা তাহাব জন্মিয়াছিল। কিন্তু আজ বসন্তের কাছে আঘাত খাইরা সেই আঘাতে ক্ষোভে নির্জলা মদ গিলিয়া সে উন্মত্ত হইয়া গেল। মদের নেশার মধ্যে দুরন্ত ক্ষোভে অর্জন-করা সব কিছুকে ভুলিয়া সে উদগীরণ করিতে আরম্ভ করিল জাস্তব অশ্লীলতাকে। ছন্দ এবং সুরে তাহার অধিকার ছিল, কণ্ঠস্বর তাহার অতি সুমিষ্ট; দেখিতে দেখিতে আসর জমিয়া উঠিল।
আসরে ঢুকিবার মুখেই সে কবিয়ালসুলভ নাটকীয় ভঙ্গিতে দাঁড়াইয়া উচ্চকণ্ঠে দোহারদে ডাকিয়া কহিল—দোহারগণ!
সবিস্ময়ে সকলে তাহার দিকে ফিরিয়া চাহিল। ওই অপ্রস্তুত হওয়ার পর নিতাই যে আবার ফিরিবে এ প্রত্যাশা কেহ করে নাই। তাহারা সাড়া দিতে ভুলিয়া গেল।
বুলিল না মাসী। সে চতুর। সে মুহূর্তে সাড়া দিল—বল ওস্তাদ!
নিতাই বলিল—
ধৰ্ম্ম কথায় যখন মন ওঠে না—বসে না—তখন দিতে হয় গাল!
ছুঁচের মত মিহি ধারে যখন কাজ হয় না তখন চালাতে হয় ফাল।
যখন ঠাণ্ডা জলে গলে না ডাল—
তখন কষে দিতে হয় তেঁতুল কাঠের জ্বাল!
ওদিকের কবিয়ালট রসিকতা করিয়া বলিয়া উঠিল—বলিহারি কালাচাঁদ, টিকেয় আগুন দিয়েছ লাগছে; তেতেছ!
নিতাই বলিল—এমন তেমন তাতা নয় বিন্দে, জ্বলছি! সেই জ্বালাতে তোকে বলছি— শোন! সহজে তো তুই শুনবি না –দোহারগণ!
–হাঁ—হাঁ!
নিতাই শুরু করিল—
বুড়ী দূতী নেড় কুত্তি জুত্তি ছাড়া নয় সায়েস্তা
ছড়ির বাড়ি মারলে ভাবে একি আমার সুখ অবস্থা!
বুড়ীকে ছড়ি মেরে কিছু হয় নাই। এবার লাগাও জুতি—লাগাও পঁয়জার! তারপর প্রৌঢ় লোকটার মুখের দিকে আঙুল দেখাইয়া বলিল—বুড়ীর কোঁচকা মুখে টেরীর বাহার দেখুন, তেলকের বাহার দেখুন—
এ বুড়ো বয়সে বৃন্দে কোচক মুখে রসকলি কাটিস নে!
রসের ভিয়েন জানিস নেকে গেঁজলা তাড়ি ঘাঁটিস নে!
তারপর তার মুখের কাছে আঙুল নাড়িয়া বলিল—
ফোকলা মুখে লম্বা জিভে ঝরা লাল চাটিস নে!
আসরে হৈ-হৈ পড়িয়া গেল। আসর জমিয়া গিয়াছে। সে নিজেও সেই জমজমাটের মধ্যে হারাইয়া গিয়া মিশিয়া একাকার হঠয়া গিয়াছে। সে গান ধরিল—
বুড়ী মরে না—মরণ নাই!
হায়—হায়!
গানের সঙ্গে সে নাচিতে লাগিল।
বুড়ী খানকী নেড়ী কুটনী মরে নাই, মরে নাই
ও হ্যায়, তার মরণ নাই—মরণ নাই!
তাহার পর একটার পর একটা অশ্লীল বিশেষণ তাহার মুখ হইতে বাহির হইতে লাগিল। শ্রোতাদের অট্টহাসিতে রাত্রিটা যেন কাঁপিতেছে, সমস্ত আসর এবং আলো তাহার চোখের সম্মুখে দুলিতেছে। একটা মানুষ দুইটা বলিয়া বোধ হইতেছে। ওই তো দুইটা ললিতা; ওই তো বাজাইতেছে দুইটা বায়েন; মাসীও দুইটা হইয়া মৃদু মৃদু হাসিতেছে। অকস্মাৎ একসময়ে সে দেখিল—বসন্তও দুইটা হইয়া নাচিতেছে! বাহবা-বাহবা–সে কি নাচ। বসন্ত কখন আসিয়া আসরে নামিয়া নাচিতে শুরু করিয়া দিয়াছে।
চরমতম অশ্লীলতায় আসরটাকে আকণ্ঠ পঙ্ক-নিমগ্ন করিয়া দিয়া টলিতে টলিতে সে বসিল। এবার তাহদের প্যালার থালাট ভরিয়া উঠিয়াছে। তাহার গান শেষের সঙ্গে সঙ্গেই এবার বিপুল কলরবে হরিধ্বনি উঠিল।
প্রৌঢ়া তাহার পিঠে হাত বুলাইয়া বলিল—বাবা আমার! এই দেখ, মাল না খেলে কি মেলা-খেলায় গান হয়? যে বিয়ের যে মস্তর! বসন, বাবাকে আমার আর এক পাত্য দে। গলা শুকিয়ে গিয়েছে।
বসন! এতক্ষণে নিতাই স্থির দৃষ্টিতে বসন্তের মুখের দিকে ফিরিয়া চাহিল।
নিতাইয়ের চোখ রক্তমাখ, পায়ের তলায় সমস্ত পৃথিবী জুলিতেছে; শঙ্কা, সঙ্কোচ, সমস্তই ভুলিয়া গিয়াছে জয়ের আনন্দের উচ্ছ্বাসে। বসন্ত, অসঙ্কোচ দৃষ্টিতে নিতাইয়ের চোখে চোখ মিলাইয়া চাহিয়া রহিল। সে চোখে তাহার কামনা ঝরিতেছে। নিতাইয়ের বুকেও কামনা সাড়া দিয়া উঠিতেছে। কিন্তু আশ্চর্য বসন্ত! সে হাসিতেছে। কিছুক্ষণ পূর্বে সে নিতাইয়ের গালে চড় মারিয়া যে নিষ্ঠুর অপমান করিয়াছে, তাহার জন্য এখন সে একবিন্দু লজ্জাও বোধ করিতেছে না; বরং উচ্ছ্বসিত আনন্দে তাহার চোখ-মুখ ঝলমল করিতেছে। নিতাইয়ের গরবে সে গরবিনী হইয়া উঠিয়াছে।
—দাও, পত্য দাও। নিতাই হাসিল।
—এস, ঘরে এস, ভাল মদ আছে—বেলাতী। বসন্ত তাহার হাত ধরিয়া গরবিনীর মত তাহাকে লইয়া চলিয়া গেল।
ঘরে কাচের গেলাসে বিলাতী মদের সঙ্গে জল মিশাইয়া বসন্ত নিতাইকে দিল। নিঃশব্দে গেলাসটি শেষ করিয়া নিতাই বসনের দিকে চাহিয়া হাসিল। এ বসন্ত যেন নূতন বসন্ত; নিতাইয়ের নেশার ঘোর ঝলমল করিয়া উঠিল।
সে আবার হাত বাড়াইল। তাহার তৃষ্ণা জাগিয়াছে। বলিল-দাও তে, আমাকে আর এক গেলাস দাও।
বসন্ত হাসিয়া আবার অল্প একটু তাহাকে দিল। সেটুকুও পান করিয়া নিতাই বলিল— দাঁড়াও, তোমাকে একটুকুন দেখি।
বসন হাসিয়া বলিল—না, চল আসরে চল।
—না। দাঁড়াও। সে বসন্তর হাত চাপিয়া ধরিল।
বসন্ত দাঁড়াইল। নিম্নশ্রেণীর দেহব্যবসায়িনী; পথে পথে ব্যবসায়ের বিপণি পাতিয়া যাহাদের ব্যবসায় করিয়া ঘুরিতে হয়—লজ্জ তাহাদের থাকে না, থাকিলে চলে না। পথে নামিয়া লজ্জাকে প্রথম পথের ধুলায় হারাইয়া দিয়া যাত্রা শুরু করে। বসন্ত তাহদের মধ্যেও আবার লজ্জাহীন। সেই বসন্তের মুখ তবু আজ রাঙা হইয়া উঠিল।
এবং আরও আশ্চর্যের কথা; মুহূর্ত পরেই তাহার চোখে জল দেখা দিল। সে কাঁদিয়া ফেলিল। নিতাই সবিস্ময়ে বলিল—তুমি কাঁদছ কেনে?
মুখ ফিরাইয়া লইয়া বসন্ত বলিল—না, আমাকে তুমি দেখো না। এক পা সে পিছাইয়াও গেল। সঙ্গে সঙ্গে দুই পা আগাইয়া আসিয়া নিতাই বলিল—কেন?
বসন্ত বলিল—আমার কাশরোগ আছে। মধ্যে মধ্যে কাশির সঙ্গে রক্ত ওঠে। সন্ধ্যায় সন্ধ্যায় জ্বর হয় দেখ না? টপ টপ করিয়া বসন্তের চোখ হইতে এবার জল ঝরিয়া পড়িল। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সে আঁচল দিয়া চোখ মুছিয়া হাসিল।
—হোক। নিতাইয়ের বুকখানা তখন ফুলিয়া উঠিয়াছে; উচ্ছৃঙ্খল বর্বর, বীরবংশীর সস্তান রূঢ়তম পৌরুষের ভয়াল মূর্তি লইয়া অগ্রসর হইয়া আসিল। সে রূপ ঠাকুরঝি কখনও সহ করিতে পারিত না। কিন্তু বসন্ত ঝুমুর দলের মেয়ে, তার রক্তের মধ্যে বর্বরতম মামুষের ভীষণতম ভয়াল মূর্তি সহ করিবার সাহস আছে। নিতাইকে অগ্রসর হইতে দেখিয়া বিষন্ন দৃষ্টিতে প্রসন্ন মুখে সে তাহার প্রতীক্ষা করিয়া রহিল। এবং নিতাইয়ের বাহুবন্ধনের মধ্যে নিৰ্ভয়ে নিজেকে সমর্পণ করিয়া পিষ্ট হইতে হইতে সে মৃদুস্বরে গাহিল :
“বঁধু তোমার গরবে গরবিনী হাম গরব টুটাৰে কে!
তেজি’ জাতি কুল বরণ কৈলাম তোমারে সঁপিয়া দে’।”
নিতাইয়ের বাহুবন্ধন শিথিল হইয়া পড়িল। গান শুনিয়া সে মুগ্ধ হইয়া গেল—এ কি গান! তাহার নেশা যেন ফিক হইয়া যাইতেছে। এ কি মুর। তাহার স্খলিত হাত দুইখানা বসন্ত নিজেই নিজের গলায় জড়াইয়া লইয়া আবার গাহিল—
“পরাণ-বঁধুয়া তুমি,
তোমার আগেতে মরণ হউক এই বর মাগি আমি!”
অপূর্ব! অপূর্ব লাগিল নিতাইয়ের; চোখ তাহার জলে ভরিয়া উঠিল। ধরা গলার সে প্রশ্ন করিল—কোথা শিখলে এ গান? এ কোন কবিয়ালের গান?
হাসিয়া বসন্ত দুইটি হাত জোড় করিয়া প্রণাম করিয়া গাহিল—
“যে হোল সে হোল—সব ক্ষমা কর বলিয়া ধরিল পায়,
রসের পাথারে না জানে সাঁতার ডুবল শেখর রায়।”
গান শেষ করিয়া সে বলিল—মহাজনের পদ গো!
অধীর মত্ততার মধ্যেও নিতাইয়ের অন্যরের কবিয়াল জাগিয়া উঠিল। সে বসন্তের দুই হাত নিজের গলায় জড়াইয়া লইয়া ধরিয়া বলিল—আমাকে শেখাবে?
বসন্ত আবেগভরে নিতাইয়ের মুখ চুমায় চুমায় ভরিয়া দিল।