পথের ধারে ঘরের বদলে কুলি-ব্যারাকেই নিতাই দিবাস্বপ্ন শুরু করিল। গান গাহিয়া সে টাকা পাইয়াছে। কবিয়াল সৃষ্টিধর বলিয়াছে তাহার হইবে। সুতরাং তাহার আর ভাবনা কি?
ট্রেনভাড়া সমেত নিতাই পাইয়াছিল ছয়টি টাকা। কিন্তু ট্রেনভাড়া তাহার লাগে নাই। এই ব্রাঞ্চ লাইনটিতে নিতাই অনেকদিন কুলিগিরি করিয়াছে – গার্ড, ড্রাইভার, চেকার সকলেই তাহাকে চেনে, রাজার জন্য তাহাকে সকলেই ভাল করিরাই জানে, সেই জন্য ট্রেনভাড়াটা তাহার লাগে নাই, ছয়টা টাকাই বাঁচিয়াছিল! জুতা চৌদ্দ আনা, চাদর বারে আনা, দেশলাই বিড়ি আনা দুইয়েক—এই এক টাকা বারে আনা বাদে চার টাকা চার আন সম্বল লইয়া নিতাই ফিরিয়াছে। প্রত্যাশা আছে, আবার শীঘ্রই দুই-একটা বায়ন আসিবে। নিতাইয়ের ধারণা যাহারা তাহার গান শুনিয়াছে তাহদের মুখে মুখে তাহার নাম চারিদিকে ছড়াইয়া পড়িতেছে—
—“নতুন একটি ছোকরা, মহাদেবের দলে দোয়ারকি করেছিল, দেখেছ?
–হ্যাঁ! হ্যাঁ! ভাল ছোকরা। বেড়ে মিষ্টি গলা।
—উঁহু। শুধু গলাই মিষ্টি নয়, কবিয়ালও ভাল। এবার মহাদেবের মান রেখেছে ওই। মহাদেব তো বেহুঁশ, ও-ই গান ধরলে—‘কালো যদি মন তবে কেশ পাকিলে কাঁদ ক্যানে।‘ তাতেই আসর একেবারে গরম হয়ে উঠল। দাও জবাব—কালো যদি মন্দ তবে কালো চুলের এত গরব কেন? এত ভালবাস কেন? পাকলেই বা মন খারাপ কেন?
—বল কি! ওই ছোকরার বাধা গান ওটা?
—হ্যাঁ।
—তা হলে আমাদের মেলাতে ওই ছোকরাকেই আন।”
নিতাই মনে মনে নিজের দরও ঠিক করিয়া রাখিয়াছে। মহাদেব আট টাকা লইয়া থাকে, ছিষ্টিধর দশ টাকা; নিতাই পাঁচ টাকা হাকিবে, চার-টাকা-রাত্রিতে রাজী হইবে। এখন একজন ঢুলি চাই। রাজনের ছেলে যুবরাজকে দিয়া কাসী বাজানোর কাজ দিব্য চলিবে। এবার সে আরও ভাল গান বাঁধিয়াছে। সুরও হইয়াছে তেমনি। ‘ও আমার মনের মানুষ গো—তোমার লাগি পথের ধারে বঁধিলাম ঘর; ছটায় ছটায় ঝিকিমিকি তোমার নিশানা, আমায় হেথা টানে নিরস্তর।’ ইহাতেই মাত হইয়া যাইবে। একবার সুযোগ পাইলে হয়। মুস্কিল এখানেই। কবির পালায় এমন গান গাহিবার সুযোগ সহজে মেলে না। তবুও আশা সে রাখে। এই কারণেই ঢং ঢং করিয়া ট্রেনের ঘণ্টা পড়িলেই সে তাড়াতাড়ি আসিয়া স্টেশনে বসে। ট্রেনের প্রতি যাত্রীকে সে লক্ষ্য করিয়া দেখে। মেলা-খেলা লইয়া যাহারা থাকে, তাহদের চেহারার মধ্যে একটা বিশিষ্ট ছাপ আছে, নিতাই সেই ছাপ খুঁজিয়া ফেরে। কেবল যায় না বেলা বারোটার ট্রেনের সময়, কারণ ওই সময়টিতে আসে ঠাকুরঝি।
মাসখানেক পর। গভীর রাত্রি। নিতাই চুপ করিয়া বসিয়াছিল। সে ভাৰিতেছিল।
সেদিন তাহার হাতের সম্বল আসিয়া ঠেকিয়াছে একটি সিকিতে। তাহার মনটা অকস্মাৎ আবার ভাঙিয়া পড়িতে চাহিতেছে। কোনরূপে আর চারিটা দিন চলিবে। তার পর? আবার কি মোট বহন করিতে হইবে?
নহিলে? উপোস করিয়া মানুষ কয়দিন থাকিতে পারে?
এদিকে ঠাকুরঝির কাছে দুধের দাম বাকী পড়িয়া যাইতেছে। দশ দিন আগে অরষ্ঠ সব সে মিটাইয়া দিয়াছে, দশ দিনের দশ পোয় দুধের দাম দশ পয়সা বাকী। নিতাই স্থির করিল, আজই সে দুধের রোজে জবাব দিবে।
পরদিন দ্বিপ্রহরে, রেল-লাইনের বাকের মুখে যেখানে লাইন দুইটা মিলিয়া এক হইয়াছে বলিয়া মনে হয়, সেইখানে দৃষ্টি নিবদ্ধ করিয়া সে দাঁড়াইয়া রহিল। আজই তার শেষ দাঁড়াইয়া থাকা। ‘ও আমার মনের মানুষ’–গান আর শেষ হইল না, হইবেও না; আজ হইতে সে ভুলিয়া যাইবে, আর গাহিবে না। ওইখনেই অকস্মাৎ এক সময়ে দেখা গেল, মাথায় ঘটি— সাদা ধপধপে কাপড় পরা ঠাকুরঝিকে।
ঠাকুরঝি আগাইয়া কাছে আসিল। তাহাকে দেখিয় নিতাই হাসিল। ঠাকুরঝি বলিল—না বাপু, তুমি এমন ক’রে দাঁড়িয়ে থেকো না। নোকে কি বলবে বল দেখি?
একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া নিতাই বলিল—নোকে কি কথা বলবে জানি না। আমি তোমাকে একটি কথা বলবার নেগে দাঁড়িয়ে আছি।
নিতাই এখন ভদ্রভাষায় কথা বলিতে চেষ্টা করে, তাই’ল-কারকে ন-কার করিয়া তুলিয়াছে। লোহাকে বলে নোয়া, লুচিকে বলে নুচি, লঙ্কা—নঙ্ক, লোক—নোক হইয়া উঠিয়াছে তাহার কাছে। রাজনা, ঠাকুরঝি তাহার ভাষার এই মার্জিত রূপের পরম ভক্ত।
নিতাইয়ের কথা শুনিয়া ঠাকুরঝি সপ্রশ্ন ব্যগ্র দৃষ্টিতে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। কি কথা? অকারণে মেয়েটির বুকের মধ্যে হৃৎপিণ্ডের স্পন্দন মুহূর্তে দ্রুত হইয়া উঠিল। কি কথা বলিবে কবিয়াল?
নিতাই বলিল—অনেক দিন থেকেই বলব মনে করি, কিন্তুক—
একটু নীরব থাকিয় নিতাই বলিল—আর ভাই দুধের পেয়োজন আমার হবে না। ঠাকুরঝি মুহূর্তে কেমন হইয়া গেল। একথা শুনিবে তাহা তো সে ভাবে নাই! তাহার মুখের শ্ৰী মুহূর্তে মুহূর্তে পরিবর্তিত হইতেছিল। বর্ষার রসপরিপুষ্ট ঘনশ্যাম পত্রীর মত তাহার সে মুখখানি মুহূর্তে মুহূর্তে পরিবর্তিত হইয়া হেমন্ত শেষের পাতার মত পাণ্ডুর হইয়া আসিল। সে- হইতেছিল সম্পূর্ণভাবে তাহার অজ্ঞাতসারে। সে নির্বাক হইয়া শুধু নিতাইয়ের মুখের দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়াই রহিল। নিতাইয়ের কথার শেষে তাহার মুখ এবার যে পাণ্ডুর হইয়া গেল, তাহার আর পরিবর্তন ঘটিল না। অনেকক্ষণ পরে সে যেন কথা খুঁজিয়া পাইল। কথাটা নিতাইয়েরই কথা। সেই কথাটাই সে যেন কম্পিতকণ্ঠে যাচাই করিয়া লইল-আর দুধ নেবে না?
–না! —ক্যানে? কি দোষ করলাম আমি? তাহার চোখ দুইটি জলে ভরিয়া উঠিল।
নিতাই কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিল, উত্তর দিবার শক্তি তাহার ছিল না। কোনরূপে নিজেকে সামলাইয়া লক্ট্রয়া বলিল—মিথ্যে কথা একেই মহাপাপ, তার ওপর তোমার কাছে মিথ্যে বললে পাপের আমার পরিসীমা থাকবে না। আমার সামর্থে কুলুচ্ছে না ঠাকুরঝি!
তারপর একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া সে বলিল–দরিদ্র ছোটলোকের কবি হওয়া বড় বিপদের কথা ঠাকুরঝি।
কাতর অহ্নয়ে ব্যগ্রতা করিয়া মেয়েটি বলিয়া উঠিল—তোমাকে পয়সা দিতে হবে না কবিয়াল। অকুষ্ঠিত আবেগে সে নিতাইয়ের হাত দুইটি চাপিয়া ধরিল।
নিতাই তার মুখর দিকে চাহিয়া কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিল, তারপর বলিল—না জানতে পারলে তোমার স্বামী পেহার করবে, শাশুড়ী তিরস্কার করবে, ননদে গঞ্জনা দেবে—
ঠাকুরঝি প্রতিবাদ করিয়া উঠিল—না না না। ওগো, একটি গাই আমার নিজের আছে, আমি বাবার ঘর থেকে এনেছি, সেই গাইয়ের দুধ আমি তোমাকে দোব।
নিতাই চুপ করিয়া রইল।
—লেবে না? কবিয়াল—? মেয়েটির কণ্ঠস্বর কাঁপিতেছিল, দৃষ্টি ফিরাইরা নিতাই দেখিল, আবার তাহার চোখ দুইটিতে জল টলমল করিতেছে।
সাত্ত্বনা দিবার জন্যই নিতাই মৃদু হাসিল। সঙ্গে সঙ্গে ঠাকুরঝির মুখেও হাসি ফুটিয়া উঠিল। নিতাইয়ের মুখের হাসিকেই সন্মতি ধরিয়া লইয়া মুহূর্তে সে উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিয়াছে। এবং সেই উচ্ছ্বাসেই সে পুলকিত দ্রুত লঘুপদে নিতাইকে অতিক্রম করিয়া আসিয়া নিজেই নিতাইয়ের বাসায় দুয়ার খুলিয়া ফেলিল। ঘরকন্না তাহার পরিচিত; দুধের পাত্রটি বাহির করিয়া দুধ ঢালিয়া দিয়া দ্রুততর পদে বাহির হইয়া গ্রামের দিকে পথ ধরিল।
নিতাই পিছন হইতে ডাকিল—ঠাকুরঝি!
ঠাকুরঝির যেন শুনিবার অবসব নাই, তাহার যেন কত কাজ। নিজের গতিবেগ আরও একটু বাড়াইয়া দিয়া সে চলিয়া গেল।
তখন চলিয়া গেলেও ফিরিবার পথে সে আসিয়া আবার বারান্দায় বসিয়া পা দোলাইতে দোলাইতে বলিল—দাও, চা দাও। আমার নতুন কাপে দাও।
চায়ের কাপটি নামাইয়া দিয়া নিতাই বলিল-একটি কথা শুধাব ঠাকুরঝি?
চায়ের কাপে চুমুক দিয়া ঠাকুরঝি বলিল—বল?
—আমাকে বিনি পয়সার কেনে দুধ দেবে ঠাকুরঝি?
ঠাকুরঝি স্থিরদৃষ্টিতে তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল। নিতাই আবার প্রশ্ন করিল—বল কিসের লেগে?
ঠাকুরঝি বলিল-আমার মন।
নিতাই অবাক হইয়া গেল—তোমার মন?
ঠাকুরঝি বলিল—হ্যাঁ। আমার মন।
তারপর হাসিয়া মুখ তুলিয়া সে বলিল—তুমি যে কবিয়াল! কত বড় নোক! বলিয়াই সে চায়ের কাপটি ইবার অছিলা বাহির হইয়া গেল। ফিরিয়া দেখিল দুই হাসিমুখে দাঁড়াইয়া আছে, তাহার হাতে দুইটি গাঢ় রাঙা কুষ্ণচূড়া ফুল। ফুল দুইটি আগাইয়া দিয়া নিতাই বলিল—নাও। কবিয়ালের হাতে ফুল নিতে হয়।
ঠাকুরঝি লজ্জায় মুখ ফিরাইয়া বলিল—না।
—তবে আমিও দুধ নোব না। ঠাকুরঝি লঘু ক্ষিপ্ৰহাতে ফুল দুইটি টানিয়া লইয়া এক রকম ছুটিয়াই পলাইয়া গেল।
নিতাই নূতন গানের কলি ভাঁজিতে বসিল। আজ আবার নূতন কলি মনে হইয়াছে। ‘ও আমার মনের মানুষ গো। গানটির শুধু দু’কলি আছে আর নাই; ও গানটি ভুলিবার সংকল্পই সে করিয়াছিল, কিন্তু বিধাতা দিলেন না ভুলিতে,—ঐ গানটিকে সে পুরা করিতে বসিল। বড় ভাল গান।
‘ছটায় ছটায় ঝিকমিকি তোমার নিশানা’—গুন গুন করিতে করিতেই সে একখানা কাঠ উনানে গুঁজিয়া দিল। ট্রেন চলিয়া গিয়াছে, ডিউটি শেষ করিয়া এইবার রাজন চা-চিনি লইয়া আসিবে, আবার একবার চা খাইবে।
নূতন কলি আসিয়াছে। বড় ভাল কলি। নিতাই খুব খুশী হইয়া উঠিল –
আহা—“সেই ছটাতে ঘর পুড়িল পথ করিলাম সার!”
তাই বটে, পথই সে সার করিয়াছে। কিন্তু তার পর? হ্যাঁ–হইয়াছে। পাইয়াছে সে পাইয়াছে—সেই পথের চারিদিকেই বাঁশী বাজিতেছে—পথে দাঁড়াইয়া থাকিতে দুঃখ কষ্ট নাই।
“চারদিকে চার বৃন্দাবনে বংশী বাজে কার?”
কার আবার? সেই ব্রজের বাঁশী! সে বাঁশী যে চিরকাল বাজিতেছে। প্রেম হইলে তবে শোনা যায়, নহিলে যায় না! সে শুনিয়ছে!
সে আজ স্পষ্ট অনুভব করিল—ঠাকুরঝিকে সে ভালৱাসে।
ঠাকুরঝিও তাহাকে ভালবাসে।
গুন গুন করিয়া নিতাই আপন মনে আখর দিল—
“বংশী বাজে তার।
ও রাধা রাধা রাধা বলে—
তারপর? তারপর? আহা—! সেই বাঁশী। না। না –হাঁ। —
“ঘর জ্বলিল—মন হারালো ছটায় সুরে গো!
সুখের একি আকুলু আতান্তর।”
আতান্তরই বটে। এ বড় আতান্তর!
অকস্মাৎ তাহার গান বন্ধ হইয়া গেল। একটা কথা মনে হইতেই গান বন্ধ করিয়া সে শিহরিয়া উঠিল।
ঠাকুরঝি ভিন্ন জাতি, অন্য একজনের সহিত তাহার বিবাহ হইয়াছে। এ যে মহাপাপ! ও;! এ বড় আতান্তর!
অনেকক্ষণ নিতাই চুপ করিয়া রহিল। নির্জনে বসিয়া সে বার বার তাহার মনকে শাসন করিতে চেষ্টা করিল। বার বার সে শিহরিয়া উঠিল। তাহার অবাধ্য মন কিছুতেই শাসন মানিতে চায় না। অবাধ্য মন লজ্জা পায় না, দুঃখিত হয় না, সে যেন কত খুশী হইয়াছে, কত তৃপ্তি পাইয়াছে! ঘরের প্রতিটি কোণে যেন ঠাকুরঝি দাঁড়াইয়া আছে—অন্ধকারের মধ্যে ক্ষারে-ধোওয়া ধপধপে কাপড় পরিয়া সে যেন দাঁড়াইয়া আছে নিতাইয়ের মনের খবর জানিবার জন্য। নিতাই অধীর হইয়া উঠিল, তাড়াতাড়ি উঠিয়া ঘরের জানালাটা খুলিয়া দিল। উদাস দৃষ্টিতে সে জানালা দিয়া চাহিয়া রহিল রেলের লাইনের দিকে। রেলের সমান্তরাল লাইন দুইটা যেখানে মিশিয়া এক হইয়া গিয়াছে মনে হয়, সেইখানে নিতাইয়ের আজ মনে হইল একটি স্থির স্বর্ণবিন্দু জাগিয়া রহিয়াছে, সে অচঞ্চল—সে নড়ে না—আগায় না, চলিয়া যায় না, স্থির। ঠাকুরঝি যেন ঘর হইতে বাহির হইয়! ওইখানে গিয়া দাঁড়াইয়া আছে। জানাল খুলিয়া দেওয়ায় রাগ করিয়া চলিয়। যাইবার পথে সে ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া দেখিতেছে, কবিয়াল তাহাকে ডাকে কিনা!
নিতাইয়ের বুকের ভিতরটা কেমন করিয়া উঠিল। সে ঘর হইতে বাহির হইয়া গিয়া বসিল কৃষ্ণচূড়া গাছটার তলায়। রাঙা ফুলে ভরা গাছ। ‘চিরোল চিরোল’ পাতার ডগায় থোপা থোপা ফুল! গাছটার এমন অপরূপ বাহার নিতাই আর কখনও দেখিয়াছে বলিয়া মনে হইল না। সামনেই রেল লাইনের ওপাশে ৰন-আউচের গাছ–বন-আউচের মিঠা গন্ধ আসিতেছে। কদমের গাছটায় কচি পাতা দেখা দিয়াছে। বর্ষা নামিলেই কদমের ফুল দেখা দিবে। বাবুদের সুমবাগানে দুইটা কোকিল পাল্লা দিয়া ভাকিতেছে; একটু ‘চোখ গেল’ পাখী ডাকিতেছে চণ্ডীতলার দিকে। ‘মধুকুলকুলি’ পাখীগুলি নাচিরা নাচির উড়িয়া বেড়াইতেছে। রঙীন প্রজাপতির যেন মেলা বসিয়া গিয়াছে কৃষ্ণচুড়া গাছটার চারিপাশে। তাহারা উড়িয়া উড়িয়া ফিরিতেছে।
ঠাকুরঝি যেন দ্রুতপদে চলিয়৷ আসিতেছে এই দিকে। নিতাইয়ের শরীর যেন কেমন ঝিমঝিম করিতেছে সে চোখ বুজিয়া বসিয়া রহিল। মনে মনে ডাকিল—এস। ঠাকুরঝি, এস। তোমার মনের কথা জামি বুঝিয়াছি। তুমি এস।
আমার পাপ হয় হোক, নরকে যাইতে হয় হাসিমুখেই যাইব, তবু তোমাকে বলিতে পারিব না—তুমি এস না। সে কি পারি? সে কথা কি মুখ দিয়া বাহির হইবার? এস তুমি, এস।
তাহার মনে হইল নষ্টচাঁদের কথা। সে চাঁদ দেখিলে নাকি কলঙ্ক হয়। নিতাই কিন্তু কখনও সে কথা মানে নাই। মনের মধ্যে তাহার আবার গান গুনগুন করিয়া উঠিল। আপনি যেন কলিটা আসিয়া পড়িল—
“চাঁদ দেখে কলঙ্ক হবে ব’লে কে দেখে না চাঁদ?”
ঠাকুরঝি তাহার সেই চাঁদ। ঠাকুরঝি যদি আর না আসে, তবে নিতাই বাঁচিবে কি করিয়া? এখানে থাকিয়া সে কি করিবে? কোথায় মুখ তবে? সে এইখানে বসিয়া ওই পথের দিকে চাহিয়৷ চাহিয়া চোখের দৃষ্টি হারাইয়া ফেলিবে।
“চাঁদ দেখে কলঙ্ক হবে ব’লে কে দেখে না চাঁদ?”
তার চেয়ে চোখ যাওয়াই ভাল ঘুচুক আমার দেখার সাধ।
ওগো চাঁদ, তোমার নাগি—”
ও-হো-হো! গানের কলি হু-হু করিয়া আসিতেছে!
“ওগো চাঁদ তোমার নাগি—ন হয় আমি বৈরাগী,
পথ চলিব রাত্রি জাগি সাধবে না কেউ আর তো বাদ।”
হায়, হায়, হায়! একি বাহারের গান! ওগো, ঠাকুরঝি। ওগো, কি মহা ভাগ্যে তুমি আসিয়াছিলে, কবিয়ালকে ভালবাসিয়াছিলে, তাই তো–তাই তো আজ এমন গান আপনি-আপনি আসিয়া পড়িল!
নিতাই উঠিল। সে চলিল ওই রেল লাইনের পথ ধরিয়া যে পথে ঠাকুরঝি আসে। কিছু দূর গিয়া পথ নির্জন হইতেই সে ওই গানটা ধরিয়া দিল।
রেল লাইনের বাঁধে ছেদ পড়িয়াছে নদীর উপর। বাঁধের মাথা হইতে পুল আরম্ভ হইয়াছে। বাঁধ হইতে নিতাই নামিল নদীর ঘটে; নদীতে অল্প জল, এক হাঁটুর বেশী নয়। হাঁটিয়াই ঠাকুরঝি নিত্য নদী পার হইয় আসে-যায়। নিতাই গিয়া নদীর ঘাটে দাঁড়াইল।
নিতাই চলিয়াছিল একেবারে বিভোর হইয়া। বাঁ হাতখনি গালে রাথিয়া ডানহাতের অঙ্গুষ্ঠ ও মধ্যম আঙ্গুল দুইটি জুড়িয়া সে যেন ঠাকুরঝিকেই উদ্দেশ করিয়া গাহিতে গাহিতে চলিয়াছিল। হয়তো সে একেবারে ঠাকুরঝির শ্বশুরবাড়িতে গিয়াই হাজির হইত। নদীর ঘাটে পা দিয়াই হঠাৎ তাহার খেয়াল হইল। তাই তো, সে কোথায় যাইতেছে? এ কি করিতেছে সে? ঠাকুরঝির শ্বশুরবাড়িতে সে যদি গিয়া দাঁড়ায়, এই গান গায়, বলে—ঠাকুরঝি এ চাঁদ কে জান? এ চাঁদ আমার তুমি! তবে ঠাকুরঝির দশা কি হইবে? ঠাকুরঝির স্বামী কি বলিবে? তাহার শাশুড়ী ননদ কি বলিবে? পাড়া-প্রতিবেশী আসিয়া জুটিয়া যাইবে। তাহারা কি বলিবে? সকলের গঞ্জনার মধ্যে পড়িয়া ঠাকুরঝি—, তাহার চোখের উপর ভাসিয়া উঠিল ঠাকুরঝির ছবি। দিশাহারার মত তাহার ঠাকুরঝি দাঁড়াইয়া শুধু কাঁদিবে।
ঠাকুরঝির নিন্দায় ঘর-পাড়া-গ্রাম-দেশ ভরিয়া যাইবে। ঠাকুরঝি পথ হাঁটিবে, মাথা হেঁট করিয়া পথ হাটিবে, লোক আঙ্গুল দেখাইয়া বলিবে—ওই দেখ কালামুখী যাইতেছে।
কুৎসিত অভদ্র লোক ঠাকুরঝিকে কুৎসিত কুকথা বলিবে।
সে যদি ঠাকুরঝিকে মাথায় করিয়া দেশান্তরী হয়, তবুও লোকে বলিবে-মেয়েটা খারাপ, নিতাইয়ের সঙ্গে ঘর ছাড়িয়া পলাইয়া আসিয়াছে। ঠাকুরঝি সেখানেও মাথা তুলিতে পরিবে না।
নিতাই নদীর ঘাটে বসিল।
আপন মনেই বলিল—আকাশের চাঁদতুমি আমার ঠাকুরঝি। তুমি আকাশেই থাক। আঃ–আজ কি হইল নিতাইয়ের! আবার কলি আসিয়া গিয়াছে –
“চাঁদ তুমি আকাশে থাক—আমি তোমায় দেখব খালি।
ছুঁতে তোমার চাইনাকো হে—সোনার অঙ্গে লাগবে কালি।”
নিতাই গান ভাঁজিতে ভাঁজিতে আবার ফিরিল।
রাজা বলিল—কাঁহা গিয়া রহা ওস্তাদ?
নিতাই হাসিয়া বলিল—গানা, রাজন, গান। বহুত বঢ়িয়া বঢ়িয়া গান আজ এসে গেল ভাই। তাই গুনগুন করছিলাম আর মাঠে মাঠে ঘুরছিলাম।
—হাঁ| বঢ়িয়া বঢ়িয়া গান?
–হাঁ, রাজনা, অতীব উত্তম, যাকে বলে উচ্চাঙ্গের গান।
—বইঠে। তব, ঢোলক লে আতা হাম। রাজা ঢোল আনিয়া বসিয়া গেল। নিতাই একমনে গাহিতেছিল—চাঁদ তুমি আকাশে থাক—
হঠাৎ বাজনা বন্ধ করিয়া রাজা বলিল—আরে ওস্তাদ, জাঁখসে তুমা্রা পানি কাহে নিকালতা ভাই?
চোখ মুছিয়া নিতাই বলিল–হাঁ রাজনা, পানি নিকাল গিয়া। কিয়া করেগা! চোখের জল যে কথা শোনে না ভাই!
পরদিন নিতাই সকাল হইতেই বসিয়া ছিল ওই কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায়। আজ সকাল হইতেই তাহার মনে হইতেছে—মনে তাহার কোন খেদ নাই, কোন তৃপ্তিও নাই। সে যেন বৈরাগীই হইয়া গিয়াছে।
কাল সমস্ত দিন-রাত্রি মনে মনে অনেক ভাবিয়াছে সে। সন্ধ্যায় গিয়াছিল রাজনের বাড়ী। রাজার স্ত্রী বড় মুখরা; ইদানীং রাজা নিতাইকে নানাপ্রকার সাহায্য করে বলিয়া সে নিতাইয়ের উপর প্রায় চটিয়াই থাকে। তবু সে গিয়াছিল। রাজা খুশী হইয়াছিল খুব। আশ্চর্যের কথা— কাল রাজার বউও তাহাকে সাদর সম্ভাষণ করিয়াছিল। ঘোমটার মধ্য হইতেই বলিয়াছিল— তবু ভাগ্যি যে ওস্তাদের আজ মনে পড়ল।
নিতাই তাহারই কাছে কৌশলে কথাপ্রসঙ্গে জানিয়াছে—ঠাকুরঝির স্বামীর সমস্ত বৃত্তান্ত।
ঠাকুরঝির স্বামীটি নাকি দিব্য দেখিতে!
—রঙ পেরায় গোরো, বুঝলে ওস্তাদ, তেমনি ললছা-ললছা গড়ন। লোকটিও বড় ভাল। দুজনাতে ভাবও খুব, বুঝলে!
অবস্থাও নাকি ভাল। দিব্য সচ্ছল সংসার। রাজার স্ত্রী বলিল–যাকে বলে ‘ছছল-বছল’। আট-দশটা গাই গরু। দুটো বলদ। ভাগে চাষ-বাস করে। ঠাকুরঝির তোমাদের পাঁচজনার আশীর্বাদে সুখের সংসার।
নিতাই বলিয়াছিল—আহ! আশীৰ্বাদ তো চব্বিশ ঘণ্টাই করি মহারাণী।
রাজার স্ত্রী অদ্ভুত। সে এতক্ষণ বেশ ছিল, এবার ওই মহারাণী বলাতেই সে খড়ের আগুনের মত জলিয়া উঠিল। ওই—ওই কথা আমি সইতে লারি। মহারাণী। মহারাণী তো খুব। মেথরাণী, চাকরাণী তার চেয়ে ভাল। না ঘর না দুয়োর। র্যালের ঘরে বাস –আজ এখানা, কাল সেখান।
রাজা মুহূর্তে আগুন হইয়া উঠিয়াছিল—কেঁও হারামজাদী? কেয়া বলতা তুম?
—কেয়া বোলতা তুম কি? হক কথা বলব তার ভয় কি?
তাহার পরেই কুরুক্ষেত্র। রাজা ধরিয়াছিল তাহার চুলে। তাহদের শান্ত করিবার জন্য নিতাই বারকয়েক চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু সে চেষ্টায় কিছু হয় নাই। রাজার স্ত্রী প্রায় রাত্রি বারোটা-একটা পর্যন্ত কাঁদিয়া রাজাকে গাল দিয়াছে, নিতাইকে গাল দিয়াছে। তাহার জের টানিয়া আজ সকালেও একদফা হইয়া গিয়াছে।
নিতাইয়ের উদাসীনতা অবশ্য সেজন্য নয়।
কাল সমস্ত রাত্রি সে মনের সঙ্গে যুদ্ধ করিয়া মনকে বুঝাইয়াছে। ভাল তুমি বাস, কিন্তু সে কথা মনেই রাখ, কাহাকেও বলিও না—ঠাকুরঝিকেও না। তাহার মুখের ঘরসংসার-সে ঘর তাহার নিত্যনূতন মুখে ভরিয়া উঠুক। তুমি তাহার মনের সরমের বাঁধ ভাঙিয়া তাহার সে মুখের ঘর ভাসাইয়া দিও না।
বেল দ্বিপ্রহরের সময় ঠাকুরঝি আসিল ঘড়ির কাঁটার মত। রেল লাইনে জাগিয়া উঠিল সোনার বরণ একটি ঝকঝকে বিন্দু, তাহার পর ক্রমশ জাগিয়া উঠিল কাশফুলের মত সাদা একটি চলন্ত রেখা। ক্রমে কাছে আসিয়া সে হইল ঠাকুরঝি। একমুখ হাসি লইয়া ঠাকুরঝি তাহার সামনে দাঁড়াইল।
—কবিয়াল!
নিতাই অশ্রু-উদ্বেল কণ্ঠে বলিল—ঘরে বাটি আছে, দুধটা রেখে যাও।
সে বুঝিতে পারিল না কেন তাহার চোখে অকারণে জল আসিতে চাহিতেছে।
—না। তুমি এস। আমি অত সব লারব বাপু! আর—
—কি আর?
—রোদে এলাম, বসব একটুকুন।
—না ঠাকুরঝি। এমন ভাবে আমার ঘরে বসা ঠিক নয়। দেখ পাঁচজনে দুষ্য ভাববে।
ঠাকুরঝি স্তব্ধভাবে স্থিরদৃষ্টিতে নিতাইয়ের দিকে চাহিয়া রহিল।
নিতাই বলিল—বিশ্রাম করবে যদি তো তোমার দিদির বাড়ী রয়েছে। আমি এক বেটাছেলে বাড়ীতে থাকি। পাঁচজনের দু্ষ্য ভাবার তো দোষ নাই। দেখ তুমিই বিবেচনা ক’রে দেখ ঠাকুরঝি! তাহার মুখে নিরুপায় মানুষের সকরুণ হাসি ফুটিয়া উঠিল।
ঠাকুরঝি হনহন করিয়া চলিয়া গেল।
নিতাই একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়া স্তব্ধ হইয়া বসিয়া রহিল।
দিন এমনি ভাবেই চলিতে আরম্ভ করিল। নিতাই উদাসীন হইয়া বসিয়া থাকে। গানও আর তেমন গায় না। ঠাকুরঝি আসে, সেও আর নিতাইয়ের সঙ্গে কথা বলে না। দ্রুতপদে আসিয়া দাঁড়াইয়া, দুধের বাটিতে দুধ ঢালিয়া দেয়, চলিয়া যায়।
ইহারই মধ্যে নিতাই একদিন বলিল—শোন।
ঠাকুরঝি শুনিতে পাইল, কিন্তু দাঁড়াইল না। একবার মুখ ফিরাইয়া নিতাইয়ের দিকে চাহিয়া দেখিয়াই আবার চলিতে আরম্ভ করিল।
নিতাই আবার ডাকিল—যেও না, শোন। ঠাকুরঝি!
ঠাকুরঝি এবার দাঁড়াইল।
—শোনা, এদিকে ফেরো।
ঠাকুরঝি ফিরিয়া দাঁড়াইল। নিতাইয়ের চোখেও মুহূর্তে জল আসিয়া পড়িল। সে তৎক্ষণাৎ ঘুরিয়া দাঁড়াইয়া হাত নাড়িয়া ইঙ্গিত করিয়া বলিল—না, না। যাও তুমি। বলব, আর একদিন বলব।
ঠাকুরঝি আর দাঁড়াইল না, চলিয়া গেল।
দিন কয়েক আবার সেই আগের মত চলিল। কেহ কাহারও সঙ্গে কথা বলে না। একদিন ঠাকুরঝি দুধ ঢালিয়া দিয়া চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া রহিল। কয়েক মুহূর্ত পরে বলিল— সেদিন যে কি বলব বলেছিলে—বললে না?
নিতাই বলিল—বলব।
—বল।
কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া নিতাই বলিল—আর একদিন বলব ঠাকুরঝি। ঠাকুরঝি একটু হাসিল। সে হাসি দেখিয়া নিতাইয়ের বুক একটা প্রচণ্ড দীর্ঘনিশ্বাসে আলোড়িত হইয়া উঠিল। ঠাকুরঝি সঙ্গে সঙ্গে ফিরিল, বাড়ী হইতে বাহির হইয়া চলিয়া গেল।
নিতাইয়ের বুক-ভরা দীর্ঘনিঃশ্বাসটা এতক্ষণে ঝরিয়া পড়িল। যে কথাটা বলা হইল না সেই কথা গান হইয়া বাহির হইয়া আসিল।
“বলতে তুমি ব’লো নাকে, (আমার) মনের কথা থাকুক মনে।
(তুমি) দূরে থাকো সুখে থাকো আমিই পুড়ি মন-আগুনে!”
অনেকদিন পরে নিতাইয়ের মনে গান আসিয়াছে; দুঃখের মধ্যেও নিতাই খুশী হইয়া উঠিল। গুন গুন করিয়া গান ধরিয়া নিতাই চলিল বাবুদের বাগানের দিকে। বাবুদের বাগানে তাহার গানের অনেক সমঝদার আছে। বাগানের প্রতিটি গাছ তাহার সমঝদার শ্রোতা। এই বাগানেই সে প্রথম-প্রথম কবিগান অভ্যাস করিত। গাছগুলি হইত মজলিসের মানুষ। তাহাদের সে তাহার গান শুনাইত। আজও বাগানে আসিয়া সে গান ধরিল, ওই গানটাই ধরিল—
“সাক্ষী থাক তরুলতা, শোন আমার মনের কথা,
এ বুকে যে কত বেথা—বোঝ বোঝ অনুমানে।
আমিই পুড়ি মন-আগুনে।”
গান শেষ করিয়া সে চুপ করিয়া বসিল। না, এমনভাবে আর দিন কাটে না। এই মনের আগুনে সে আর পুড়িতে পারিবে না। শুধু মনের আগুনই নয়, পেটের আগুনের জালা, সেও তো কম নয়! রোজগার গিয়াছে; পুঁজি প্রায় ফুরাইয়া আসিল। রোজগারের একমাত্র পথ মোটবহনা, কিন্তু কবিয়াল হইয়া তো ঐ কাজ সে করিতে পারিবে না। অন্যত এখানে সে পারিবে না। এখান হইতে তাহার চলিয়া যাওয়াই ভাল। তাই করিবে সে। কালই গিয়া মা চণ্ডীকে প্রণাম কুরিয়া মনে মনে বলিবে—মা গো, তোমার অভাগা ছেলে নিতাইচরণকে কবিয়াল করিলে, কিন্তু তাহার মনের দুঃখ পেটের দুঃখ বুঝিলে না। কোন উপায় করিলে না। সে চলিল, তাহাকে বিদায় দাও তুমি। তাহার মনে পড়িয়া গেল অনেক দিনের আগের একটা শোনা গানা, বাউলেরা গাহিত, ক্ষুদিরামের ফাঁসির গান—
“বিদায় দে মা ফিরে আসি ।”
ওই প্রথম কলিটা লইয়া তাহার পাদপূরণ করিতে করিতে সে ফিরিয়া আসিয়া চুপ করিয়া বসিল।
“বিদায় দে মা ফিরে আসি;
বলতে কথা বুক ফাটে মা চোখের জলে ভাসি।”
স্তব্ধ হইয়া সে বসিয়া ছিল। তাহার সে স্তব্ধতা ভাঙিল রাজনের ক্রুদ্ধ চীৎকারে। সে সচকিত হইয়া উঠিল। রাজা কাহাকে দুর্দান্ত ক্রোধে ধমক দিতেছে—চোপ রহো!
পরক্ষণেই স্ত্রী-কণ্ঠে তীক্ষ কর্কশ ধ্বনি ধ্বনিত হইয় উঠিল—চা-চিনি নিয়ে যাবে! কেনে? কিসের লেগে? লাজ নাই, হায়া নাই, বেহায়া, চোখখেগো মিনসে!
আর কথা শোনা গেল না, শোনা গেল দুপ-দাপ শব্দ, আর স্ত্রীকণ্ঠে আর্ত চীৎকার। রাজা নীরবে স্ত্রীকে প্রহার করিতেছে, রাজার স্ত্রী উচ্চ চীৎকারে কঁদিতেছে। নিতাই ছি-ছি করিয়া সারা হইল। নাঃ, এই চায়ের পর্বটা বন্ধ করিয়া দিতে হইবে।
—ওস্তাদ! ওস্তাদ! স্ত্রীকে প্রহার করিয়া সেই মুহূর্তটিতেই রাজা আসিয়া ঘরে ঢুকিল। —বানাও চা –পন্রা ষোলা আদমীকে মাফিক। প্রায় পোয়াখানেক চা, আধসেরটাক চিনি সে নামাইয়া দিল। রাজার স্ত্রীর দোষ কি? এত অপব্যয় কেহ চোখে দেখিতে পারে? আর এত চা-চিনি হইবেই বা কি?
নিতাই গম্ভীরভাবে বলিল-রাজন!
রাজন নিতাইয়ের কথায় কানই দিল না, সে বাসার বাহিরে চলিয়া গেল, দুয়ারের সামনে দাঁড়াইয়া হাঁকিল—হো ভেইয়া লোক হো! হাঁ হাঁ, হিঁয়া আও। চলে আও সবলোক, চলে আও।
নিতাই বিস্মিত হইয়া উঠিয়া আসিল।
মেয়ে-পুরুষের একটি দল আসিতেছে। ঢোল, টিনের তোরঙ্গ, কাঠের বাক্স, পোঁটলা— আসবাবপত্র অনেক। মেয়েদের বেশভূষা বিচিত্র, পুরুষগুলিরও বিশিষ্ট একটা ছাপ-মার চেহারা। এ ছাপ নিতাই চেনে।
—চা দাও ভাই, মরে গেলাম মাইরি! কথাটা যে বলিল, সে ছিল দলের সকলের পিছনে, দলটি দাঁড়াইতেই সে আসিয়া সকলের আগে দাঁড়াইল। একটি দীর্ঘ কৃশতনু গৌরাঙ্গী মেয়ে। অদ্ভুত দুইটি চোখ। বড় বড় চোখ দুইটার সাদা ক্ষেতে যেন ছুরির ধার,—সেই শাণিত-দীপ্তির মধ্যে কালো তারা দুইটা কৌতুকে অহরহ চঞ্চল। বৈশাখের মধ্যাহ্ন রৌদ্রের মধ্যে যেন নাচিয়া ফিরিতেছে মধুপ্রমত্ত দুইটা কালো পতঙ্গ—মরণজয়ী দুইটা কালো ভ্রমর।
রাজনের মুখের দিকে চাহিয়া মেয়েটা আবার বলিল—কই হে, কোথায় তোমার ওস্তাদ না ফোস্তাদ?
রাজন নিতাইকে দেখাইয়া বলিল-ওহি হামারা ওস্তাদ।
নিতাই অবাক হইয়া গিয়াছিল, সে ইহাদের সকল পরিচয় দেখিয়াই চিনিয়াছে—ঝুমুরের দল। কিন্তু ইহারা আসিল কোথা হইতে? সে কথা নিতাইকে জিজ্ঞাসা করিতে হইল না। রাজা নিজেই বলিল–
ট্রেনসে জোর করকে উতার লিয়া। হিঁয়া গাওনা হোগা আজ। তুমকে ভি গাওনা করনে হোগা ওস্তাদ।
মেয়েটা ঠোঁট বাঁকাইয়া বলিয়া উঠিল—ও হরি, এই তুমার ওস্তাদ নাকি? অ-মা-গ-অ! বলিয়াই সে খিলখিল করিয়া হাসিয়া উঠিল; সে হাসির আবেগে তাহার দীর্ঘ কৃশ-তনু থরথর করিয়া কাঁপিতে লাগিল। মেয়েটা শুধু মুখ ভরিয়া হাসে না, সর্বাঙ্গ ভরিয়া হাসে। আর সে হাসির কি ধার! মানুষের মনের মনকে কাটিয়া টুকরা টুকরা করিয়া ধূলার ছুঁড়িরা ছিটাইয়া ফেলিয়া দেয়।