কালো কেশে রাঙা কুমুমের শোভা দেখিয়া গান রচনা করিয়া কবি হওয়া চলে, কিন্তু ও শোভা দেখিতে দেখিতে পথ চলা চলে না। নিতাই সত্য সত্যই একটা হুঁচোট খাইল—বিষম হুঁচোট। পায়ের বুড়ো আঙুলের নখটার চারিপাশ কাটির রক্ত বাহির হইয়া পড়িল। সে ওই গানখানা ভাঁজিতে ভাঁজিতে চণ্ডীতলায় চলিয়াছিল। নির্জন পথ—বাঁ হাতখানি গালের উপর রাখিয়া নিতাই বেশ উচ্চ কণ্ঠেই গান ধরিয়া চলিয়াছিল—মধ্যে মধ্যে ডান হাতের তর্জুনী নির্দেশ করিয়া যেন কালো চুলে রাঙা কুসুমের শোভাটি কাহাকেও দেখাইয়া দিতেছিল; যেন দ্রুতপদে ঠাকুরঝি তাহার আগে আগেই চলিয়াছে এবং তাহার রুক্ষ কালে চুলে রাঙা কৃষ্ণচূড়ার গুচ্ছটি ঝলমল করিতেছে।
হঠাৎ আঙুলে হুঁচোট খাইয়া বেচারী বসিয়া পড়িল। দুর্বল শরীরে চোট খাইয়া মাথা ঘুরিয়া গিয়াছে। এ কয়দিন নিতাই এখন একবেলা খাইতেছে। উপার্জন নাই, পূর্বের সঞ্চয় যাহা আছে, সে অতি সামান্য; সে সঞ্চয় আবার দোকানে লাগাইতে হইবে। সেই জন্য নিতাই একবেলা খাওয়া বন্ধ করিয়াছে; একেবারে অপরাহু বেলায় সে এখন কোনদিন রাঁধে পয়েস, কোনদিন খিচুড়ি। কথাটা সে রাজাকেও বলে নাই, ঠাকুরঝিকেও না। তাহারা জানিলে বিষম আপত্তি তুলিবে। রাজা হয়ত পাঁচ-সাত টাকা বানাৎ করিয়া ফেলিয়া দিয়া বলিবে— চালাও পানসী—বানাও খানা—ফিন্ দরকার হোনেসে দেগা।
রাজার মত বন্ধু আর হয় না। এদিকে রাজা সত্য-সত্যই রাজা। বিপ্ৰপদ যে-সব নাম তাহাকে দিয়াছে, তাহার প্রত্যেকটি এখন নিতাইকে পীড়া দেয়, কেবল একটি ছাড়া—সে নামটি হইল সভাকবি, রাজার সভাকবি। রাজার কাছে কোন লজ্জাই তাহার নাই; কিন্তু রাজার স্ত্রী রাণী নয়, সে রাক্ষুসী। বাপ রে। মেয়েটার জিভে কি বিষ। সর্বাঙ্গে যেন জাল ধরাইয়া দেয়। মিলিটারী রাজা কঞ্চির আঘাতে মেয়েটার পিঠথান ক্ষত-বিক্ষত করিয়া দেয়—তবু তাহার জিভ বিষ ছড়াইতে ছাড়ে না; সে পডিয়া পডিয়া কাঁদে আর অবিরাম গাল দিয়া চলে।
মর্মচ্ছেদী জালা-ধরানো নিষ্ঠুর গালিগালাজ। পৃথিবীর উপরেই তাহার আক্রোশ, মধ্যে মধ্যে ট্রেনকেও সে অভিসম্পাত দেয়। ট্রেনের সময় রাজা ডিউটি দিতে গেলে যদি তাহার রাজাকে প্রয়োজন হয়, তবে সে স্টেশন-মাস্টার হইতে গার্ড, ট্রেন, সকলকে গালি-গালাজ দিতে আরম্ভ করে। সেই গালি-গালাজগুলি স্মরণ করিয়া নিতাই দুঃখের মধ্যেও হাসিয়া ফেলিল। রাজার বউয়ের গালি-গালাজের বাঁধুনী বড় চমৎকার, কবিয়ালেরাও এমন চমৎকার বাঁধুনী বাঁধিয়া গালি-গালাজ দিতে পারে না। কালই ট্রেনখানাকে অভিসম্পাত দিতেছিল— “পুল ভেঙে পড়ে যমের বাড়ী যাও; যে আগুনের আঁচে ‘হাঁকিড়ে’ ‘হাঁকিড়ে চলছ—সেই আগুনের তাতে অঙ্গ তোমার গ’লে গ’লে পড়ক! যে চাকায় গড়গড়িয়ে চলে সেই চাকা মড়মড়িয়ে ভেঙে গুড়ো হয়ে যাক—যে চোঙার গলায় চিলের মত চেঁচাও সেই গলা চিরে চৌচির হোক। তুমি উল্টিয়ে পড়, পাল্টিয়ে পড়; নরকে যাও।” বলিহারি বলিহারি! মহাদেবের আঁস্তাকুড়ের এঁটো পাতা কোথায় লাগে ইহার কাছে!
রাজা অবসর পাইলেই নিতাইয়ের কাছে আসিয়া বসে, তাই তাহার আক্রোশ নিতাইয়ের উপর কিছু বেশী। রাজার অনুপস্থিতিতে নিতাইকে শুনাইয়া কোন অনামা ব্যক্তিকে গালিগালাজ করে। সে হাসে। রাজার আর্থিক সাহায্য আর কিছুতেই লওয়া চলিবে না। রাজা দিতেও ছাড়িবে না, গোপনও করিবে না এবং রাণী জানিতে পারিবেই। সে জানিতে পারিলে আর রক্ষা থাকিবে না। কালই একটা কাণ্ড ঘটিয়া গিয়াছে, ঠাকুরঝির চা খাওয়া রাণী দেখিয়াছে। চা খাইতে খাইতে নিতাইয়ের রসিকতায় ঠাকুরঝি খিলখিল করিয়া হাসিতেছিল। রাজার বউ বোধ হয় কোখাও যাইতেছিল, হাসির শব্দে সে উঁকি মারিয়া দুইজনকে একসঙ্গে দেখিয়া সঙ্গে সঙ্গেই মুখ সরাইয়া লইয়া চলিয়া গিয়াছিল। ঠাকুরঝি বেচারী মুহূর্তে যেন শুকাইয়া উঠিয়াছিল, তাহার সঙ্গে নিতাইও। পরমুহূর্তেই বাড়ীর বাহিরে রাজার স্ত্রীর শ্লেষতীক্ষ কণ্ঠ বাজিয়া উঠিয়াছিল—
“হাসিস না লো কালামুখী-আর হাসিস্ না,
লাজে মরি গলায় দড়ি—লাজ বাসিস্ না?”
ঠাকুরঝির আর চা খাওয়া হয় নাই, চা জুড়াইয়া গিয়াছিল, জুড়ানো চা রাখিয়া সে এক ঘটি ঠাও জল খাইয়া তবে বাড়ী ফিরিয়াছিল।
হুঁচোটের ধাক্কাটা সামলাইয় নিতাই কোনমতে চণ্ডীতলায় আসিয়া উঠিল। চণ্ডীমাকে প্ৰণাম করিয়া সে মোহন্তের সম্মুখে হাত জোড় করিয়া দাঁড়াইল।
মোহন্ত সস্নেহেই বলিলেন—এস, কবিয়াল নিতাইচরণ এস।
নিতাই কৃতার্থ হইয়া গেল। সে মোহন্তকে প্রণাম করিল।
—জয়োস্তু! তারপর, সংবাদ কি?
—আজ্ঞে প্রভু, আমাকে মেডেল দোব বলেছিলেন!
—মেডেল!
—আঞ্জে হ্যাঁ।
—আচ্ছ, সে হবে। পাবে। মোহন্ত অকস্মাৎ উদাসীন হইয়া উঠিলেন। সহসা চণ্ডীদেবতার মহিমা উপলব্ধি করিয়া গম্ভীর স্বরে ডাকিয়া উঠিলেন—কালী কৈবল্যদায়িনী মা!
নিতাই চুপ করিয়া কিছুক্ষণ বসিয়া রহিল। এমন ভাবাবেশের মধ্যে মোহন্তকে আর বিরক্ত করিতে সাহস করিল না। কিছুক্ষণ পর ওদিকে চণ্ডীর দাওয়ার উপর একটা শব্দ উঠিল—ঠং।
মোহন্ত মুহূর্তে উঠিয়া পড়িলেন। ওদিকে চণ্ডীমায়ের মন্দিরে যাত্ৰী আসিয়াছে, বোধ হয় একটা প্রণামী ছুঁড়িয়াছে।
মোহন্ত ফিরিয়া আসিতেই নিতাই সুযোগ পাইয়া আবার হাত জোড় করিয়া বলিল— বাবা!
ভ্রূ কুঞ্চিত করিয়া মোহন্ত বলিলেন—বলেছি তো, পরে হবে। আসছে বার মেলার সময়, সমস্ত লোকের সামনে মেডেল দেওয়া হবে।
নিতাই অত্যন্ত বিনয় করিয়া বলিল-আজ্ঞে, বিদায় কিছু দেবেন না?
—বিদায়! টাকা?
—আজ্ঞে।
মোহন্ত সকৌতুকে কিছুক্ষণ নিতাইয়ের দিকে চাহিয়া রহিলেন, সে দৃষ্টির সম্মুখে নিতাইয়ের অস্বস্তির আর সীমা রহিল না। অকস্মাৎ মোহন্ত কথা বলিলেন—ভালা রে ময়না; ভাল বুলি শিখেছিল তো! টাকা! মায়ের স্থানে টাকা! গান গাইতে পেয়েছিল সেইটে ভাগ্যি মনিস না!
মোহন্তের কথার সুরে যেন চাবুকের জাল ছিল; সে জালায় নিতাই চমকিয়া উঠিল। লজ্জার আর সীমা রহিল না তাহার। সত্যই তো—গান গাহিতে পাইয়া সে-ই- তো ধন্য হইয়া গিয়াছে। আবার টাকা চার কোন মুখে।
ইহার পর কোন কথা না বলিয়া সে একবুকম ছুটিয়া পলাইয়া আসিল। ফিরিবার পথে কিন্তু অকস্মাৎ তাহার চোখে জল আসিল; অকস্মাৎ মহাদেব কবিয়ালের ছড়াটা মনে পড়িয়া গেল—সেদিন গানের আসরে মহাদেব বলিয়াছিল, ‘আঁস্তাকুড়ের এঁটোপাতা স্বগ্গে যাবার আশা গো!’ ঠিক কথা, মহাদেব কবিয়াল,—আঁস্তাকুড়ের এঁটোপাতা স্বর্গে যায় না, যাইতে পারে না। কবিয়াল মহাদেব হাজার হইলেও গুণী লোক, সে ঠিক কথাই বলিয়াছে। তাহার কবি হওয়ার আশা আর আঁস্তাকুড়ের এঁটোপাতার স্বর্গে যাইবার আশা—এ দুই-ই সমান।
আপন মনেই সে বেশ পরিস্ফুট কণ্ঠে যেন নিজেকে শুনাইয়াই বলিয়া উঠিল-দু-রো! অর্থাৎ নিজের কবিয়ালত্বকেই দূর করিয়া দিতে চাহিল। এবং সঙ্গে সঙ্গেই ঠিক করিল আবার এই বারোটার ট্রেন হইতেই সে মোটবহন’ আরম্ভ করিবে।
বিপ্ৰপদ ঠাট্টা করিবে, তা করুক। কবিয়াল হইয় তাহার কাজ নাই। সে মনকে বেশ খোলসা করিয়াই সকৌতুকে গান ধরিল, মহাদেবের সেই গানটি—
আঁস্তাকুড়ের এঁটোপাতা—স্বগ্গে খাবার আশা গো!
ফরাৎ ক’রে উড়ল পাতী—স্বগ্গে যাবার আশা গো!
হয়রে কলি—কিই বা বলি–গরুড় হবেন মশা গো।
খানিকটা আসিয়াই তাহার কানে একটা শব্দ আসিয়া ঢুকিল। ট্রেন আসিতেছে না? হ্যাঁ! ট্রেনই তো! সঙ্গে সঙ্গে চলার গতি সে দ্রুততর করিল। রাজা এতক্ষণে স্টেশনে গিয়া হাজির হইয়াছে। সিগন্যাল ফেলিবে, ট্রেনের ঘণ্টা দিবে। ঠাকুরঝি বোধ হয় তালাবদ্ধ ঘরের সম্মুখে হতভম্ব হইয়া দাঁড়াইয়া আছে। সে তো আজ কিছুতেই রাজার বাড়ী যাইবে না। কাল ছড়ার মধ্যে যে কুৎসিত ইঙ্গিত রাজার স্ত্রী করিয়াছে! সে ছুটিতে আরম্ভ করিল।
হাঁপাইতে হাঁপাইতে সে যখন স্টেশনে আসিয়া পৌঁছিল, ট্রেনখানা তখন বিসর্পিল গতিতে সবে স্টেশন হইতে বাহির হইয়া যাইতেছে। নিতাই হতাশ হইয়া একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া দাঁড়াইয়া গেল। রোজগার কলকাইয়া গেল, ঠাকুরঝি চলিয়া গিয়াছে।
হঠাৎ কানে আসিল কে তাহাকে ডাকিতেছে—নিতাই!
স্টেশনের স্টলে দাঁড়াইয়া বণিক মাতুল তাহাকে দেখিয়া উৎসুক হইয়া ডাকিতেছে—নিতাই, নিতাই!
বাতে আড়ষ্ট বিপ্রপদ বহুকষ্টে দেহসমেত ঘাড়খানা ঘুরাইয়া হাসিতেছে,—সেও ডাকিল,— কপিবর, কপিবর!
নিতাই অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া উঠিল। একটা কঠিন উত্তর দিবার জন্যই সে স্টেশনে আসিয়া উপস্থিত হইল। বণিক মাতুল কিন্তু বেশ খানিকটা খুশী সুরেই বলিল—নাঃ, সত্যিকারের গুণীন বটে আমাদের নিতাই। ওরে তোর কাছে যে লোক পাঠিয়েছে মহাদেব কবিয়াল। বায়না আছে কোথায়। গাওনা করতে হবে।
অপ্রত্যাশিত সংবাদে নিতাই হতবাক হইয়া গেল।
মহাদেব কবিয়াল তাহার কাছে লোক পাঠাইয়াছে! বায়না আছে! অকস্মাৎ তাহার সে বিস্ময়-বিমূঢ়তা কাটিল রাজনের চীৎকারে। উচ্ছ্বসিত আননে রাজন প্রায় গগনস্পর্শী চীৎকার করিয়া ডাকিতেছে—ওস্তা—দ! ওস্তা—দ!
রাজনের সঙ্গে একজন লোক। মহাদেবের দোয়ারের দলের একজন দোয়ার। এই মেলার আসরেই সে গান করিয়া গিয়াছে। নিতাই তাহাকে চিনিল।
—বায়না, ওস্তাদ, বায়না আয়া হ্যায়! সুজা আবার উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিল। লোকটি নিতাইকে নমস্কার করিয়া বলিল—ভাল আছেন? এতক্ষণে নিতাই প্রতিনমস্কার করিয়া মৃদুস্বরে বলিল—আজ্ঞে হ্যাঁ। আপনাদের কুশল? ওস্তাদ ভাল আছেন?
—আজ্ঞে হ্যাঁ। তিনিই পাঠালেন আপনার কাছে। একটা বায়না ধরেছেন ওস্তাদ, আপনাকে দলে দোয়ারকি করতে হবে। মহাদেব কবিয়ালের শরীর ভাল নাই। গলা বসেছে। আপনার ভাল গলা। ওস্তাদ আপনাকে দিয়ে গাওয়াবে। আপনি নিজেও গাইবেন—এই আর কি!
রাজা বলিল—জরুর, জরুর, আলবৎ, আলবৎ যায়েগা! চলিয়ে তো বাসামে, বাতচিৎ হোগা, চা খেয়াগা।
নিতাই রাজার কথাকেই অনুসরণ করিল, আজ তাহর সব গোলমাল হইয়া যাইতেছে।
মহাদেব কবিয়াল তাহার কাছে লোক পাঠাইয়াছে—বায়না আছে! সেও বলিল—হ্যাঁ—হ্যাঁ–নিশ্চয় যাব, নিশ্চয়। আসুন, বাসায় চা খেতে খেতে কথা হবে।
বাসার ছয়ারে আসিয়া নিতাই আশ্চর্য হইয়া গেল, একটি ঝোপের আড়ালে—কৃষ্ণচূড়া গাছটির ছায়াতলে, ও কে বসিয়া?
ঠাকুরঝি!
উৎসুক উচ্ছ্বসিত দৃষ্টিতে ফিরিয়া চাহিয়াই ঠাকুরঝি লজ্জায় যেন কেমন হইয়া গেল। কিন্তু পরমুহূর্তেই সে আত্মসম্বরণ করিয়া বেশ ধীর ভাবেই বলিল—কোথা গিয়েছিলে বাপু, আমি দুধ নিয়ে বসে আছি সেই থেকে!
নিতাই বলিল—কাল একটুকু সকাল ক’রে দুধ এনে বাপু! কাল বারোটায় আমি কবি গাইতে যাব। তার আগেই যেন—
রাজা কথাটা সংক্ষিপ্ত করিয়া দিল—হাঁ, হাঁ, ঠিক আয়েগি; ঘড়িকে কাঁটাকে মাফিক আতি হ্যায় হামার ঠাকুরঝি। আজ রাজাও ঠাকুরঝির উপর খুশী হইয়া উঠিয়াছে। ঠাকুরঝির মুখখানিও সেই খুশীর প্রতিচ্ছটায় মুহূর্তে উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। ঠাকুরঝি যেন কাজল দীঘির জল! ছটা ছড়াইয়া পড়িলে সঙ্গে সঙ্গে ঝিকমিক করিয়া উঠে; আবার মেঘ উঠিলে আঁধার হয় – কে যেন কালি গুলিয়া দেয়!
ঠাকুরঝি সেই খুশীর ছটামাখা মুখে নিতাইয়ের মুখের দিকে চাহিল—তুমি কবিগান গাইতে যাবে কবিয়াল? বায়না এসেছে?
কথাটা ঠাকুরঝিও শুনিয়াছে।
নিতাই ফিরিল পাঁচদিন পর। ট্রেন হইতে যখন সে নামিল, তখন তাহার ভোল পালটাইয়া গিয়াছে। তাহার পায়ে সাদা ক্যাম্বিশের একজোড়া নূতন জুতা, ময়লা কাপড়জামার উপর ধপধপে সাদা নুতন একথান উড়ানি চাদর। মুখে মৃদুমন্দ হাসি—কিন্তু বিনয়ে অত্যন্ত মোলায়েম। ট্রেনে সারা পথটা সে কল্পনা করিতে করিতে আসিতেছে, স্টেশনমাস্টার হইতে সকলেই তাহাকে দেখিয়া নিশ্চয় বিস্মিত শ্রদ্ধার সঙ্গে সম্ভাষণ করিয়া উঠিবে।
–এই যে নিতাই! আরে বাপ রে, চাদর জুতো! এই যে, বাপ রে তোকে চেনাই যায় না রে!
উত্তর নিতাই ঠিক করিয়াই রাখিয়াছিল।
—আজ্ঞে, চাদরখানা বাবুরা শিরোপা দিলেন। আর জুতো জোড়াটা কিনলাম।
শিরোপার কথাটা অবশ্য মিথ্যা; জুতা-চাদর দুইই নিতাই নগদমূল্যে খরিদ করিয়াছে! গেরুয়া না পরিলে সন্ন্যাসী বলিয়া কেহ স্বীকার করে না, ‘ভেক নহিলে ভিথ মিলে না’; চাদর না হইলে কবিয়ালকে মানায় না। নগ্নপদ জনের পদবী মানুষ সহজে স্বীকার করিতে চায় না। তাই নিতাই পাদুক ও চাদর কিনিয়াছে। স্টেশনে নামিয়া প্রত্যাশাভরে মুখ ভরিয়া বিনীত অথচ আত্মপ্রসাদপূর্ণ হাসি হাসিয়া সে সকলের মুখের দিকে চাহিল। কিন্তু তাহার মুখের দিকে চাহিয়া দেখিয়াও কেহ যেন তাহাকে দেখিল না; সম্ভাষণ দূরের কথা, কেহ একটা প্রশ্নও করিল না। যে প্রশ্ন করিবার একমাত্র মানুষ, সে তখন ইঞ্জিনের কাছে কর্তব্যে ব্যস্ত ছিল। মালগাড়ী শাণ্টিং হইবে। গাড়ি কাটিয়া রাজা ইঞ্জিনে চড়িয়া হাঁক মারিতেছিল—এই! হট যাও, এই—এই বুড়বক! হটো-হটো!
নিতাইয়ের মনটা উদাস হইয়া গেল। মানুষ বৈরাগ্যভরে যেমন জনতাকে জনবসতিকে পাশ কাটাইয়া পথ ছাড়িয়া আপথে সকলের অলক্ষিতে অগোচরে চলিয়া যায়, তেমনি ভাবেই সে স্টেশনের মেহেদীর বেড়ার পাশের অপরিছন্ন স্থানটা দিয়া স্টেশন অতিক্রম করিয়া আসিয়া উঠিল আপনার বাসার দুয়ারে। মনটা তাহার মুহূর্তে উদাস হইয়া গিয়াছে; শুধু মনই নয়, সারা দেহেই সে যেন গভীর অবসয়তা অনুভব করিতেছে।
হঠাৎ কানে ঢুকিল–গুণ গুন স্বর।
“কালো যদি মন তবে কেশ পাকিলে কাঁদ কেনে?”—গুনগুন করিয়া অতি মৃদুস্বরে কে গান গাহিতেছে! ওই ঝোপটার আড়ালে; কৃষ্ণচূড়াগাছটির তলায়। মুহূর্তে ভাটার নদীতে যেন ষাঁড়াষাঁড়ির ঘান ডাকিয়া গেল।, ঠাকুরঝি! তাহারই বাঁধা গান গাহিতেছে ঠাকুরঝি। রবার-সোল ক্যাম্বিশের জুতা পায়ে নিঃশব্দে নিতাই আসিয়া তাহার পিছনে দাঁড়াইল এবং অপরূপ মৃদুস্বরে গাহিল,
‘কালো কেশে রাঙা কুসুম হেরেছ কি নয়নে?”
ঠাকুরঝি চমকিয়া উঠিয়া দাঁড়াইল সচকিত বন্ত কুরঙ্গীর মত–বাবা রে! কে গো?
পরমুহূর্তেই সে বিস্ময়ে নির্বাক হইয়া গেল—কবিয়াল!
নিতাইয়ের মুখ ভরিয়া আবার হাসি ফুটিয়া উঠিল, পরম স্নেহভরে সে ভক্ত অনুরাগিণীটিকে বলিল—এস, চা খেতে হবে একটু!
ঘরে আসিয়া নিতাই চাদরখানি গল হইতে খুলিয়া রাথিতে গেল। কিন্তু বাধা দিয়া ঠাকুরঝি বলিল—খুলো না, খুলো না; দাঁড়াও দেখি ভাল ক’রে!
ভাল করিয়া দেখিয়া ঠাকুরঝি বলিল–আচ্ছা সাজ হইছে বাপু। ঠিক কবিয়াল কবিয়াল লাগছে। ভারি সোন্দর দেখাইছে।
নিতাই বলিল-বাবুরা শিরোপা দিলে চাদরখানা।
—ম্যাডেল? ম্যাডেল দেয় নাই?
—সে আসছে বার দেবে। মেডেল কি দোকানে তৈরী থাকে ঠাকুরঝি!
—ত চাদরখানাও আচ্ছা হইছে। তুমি বুঝি খুব ভাল গায়েন করেছ, লয়?
হাস্যোদ্ভাসিত মুখে কহিল—খুব ভাল। ‘কালো যদি মন্দ তবে’ গানখানাও গেয়ে দিয়েছি।
সঙ্গে সঙ্গে কালো মেয়েটির মুখখানিও কেমন হইয়া গেল; চোখের পাতা দুইটা নামিয়া আসিল। সে দুইটা যেন অসম্ভব বকমের ভারী হইয়া উঠিয়াছে। নত চোখে সে বলিল—না বাপু ছি! কি ধারার নোক তুমি? —
নিতাই হাসিয়া বলিল—দাঁড়াও, দাঁড়াও, ভুলেই গিয়েছিলাম একেবারে।
—কি?
—চোখ বোজ দেখি। তা নইলে হবে না।
—কেন?
—আঃ, বোজই না কোন চোখ। তারপর চোখ খুললেই দেখতে পাবে।
ঠাকুরঝি চোখ বন্ধ করিল; কিন্তু তবু সে তাহারই মধ্যে মিটমিটি চাহিয়া দেখিতেছিল। নিতাই পকেটে হাত পুরিয়াছে।
—উ কি, তুমি দেখছ! নিতাই ঠাকুরঝির চাতুরী ধরিয়া ফেলিল। বোজ, খুব শক্ত করে চোখ বোজ।
পরক্ষণেই ঠাকুরঝি অনুভব করিল তাহার গলায় কি যেন কুপ করিয়ু পড়িল। কি? চকিতে চোখ খুলিয়া ঠাকুরঝি দেখিল, সূতার মত মিহি, সোনার মত ঝকঝকে একগাছি সূতাহার তাহার গলায় তখনও মৃদু মৃদু দুলিতেছে।
ঠাকুরঝি বিস্ময়ে আনন্দে যেন বিবশ ও নির্বাক হইয়া গেল।
—সোনার?
—না, সোনার নয়, কেমিকেলের। সোনার আমি কোথায় পাব বল? আমি গরীব।
ঠাকুরঝির অন্তর তারস্বরে বলিয়া উঠিল—ত হোক, তা হোক, এ সোনার চেয়েও অনেক দামী। হারখানির ছোঁয়ায় বুকের ভিতরটা তাহার থররর করিয়া কাঁপিতেছে, বসন্তদিনে দুপুরের বাতাসে অশ্বখগাছের নূতন কচি পাতার মত।
—ওস্তাদ! ওস্তাদ!
রাজা আসিতেছে; ট্রেনখানা চলিয়া গিয়াছে, ডিউটি সারিয়া রাজা স্টেশনের প্লাটফর্ম হইতে হাঁকিতে হাঁকিতে আদিতেছে।
ঠাকুরঝি চমকিয়া উঠিল, সঙ্গে সঙ্গে নিতাইও চকিত হইয়া উঠিল। মুহূর্তে ঠাকুরকি গলার সূতী-হারখানি খুলিয়া ফেলিল। শঙ্কিত চাপা গলায় বলিল—জামাই আসছে।
নিতাইও যেন কিংকৰ্তব্যবিমূঢ় হইয়া গেল—ত হ’লে?
পরমুহূর্তেই সে ঘর হইতে বাহির হইয়া গেল, তখনও তাহার গলায় চাদর, পায়ে জুতা। খানিকট আগাইয়া গিয়াই সে সবিনয়ে রাজাকে নমস্কার করিয়া বলিল—রাজন, আপনার শরীর কুশল তো?
রাজার চোখ বিস্ময়ে আনন্দে বিস্ফারিত হইয়া উঠিল—আরে, বাপ রে, বাপ রে! গলামে চাদর—
বাধা দিয়া নিতাই বলিল—শিরোপা।
–শিরোপা!
—হাঁ। বাবুরা গান শুনে খুশী হয়ে দিলেন।
–হাঁ?
–হাঁ ।
—আরে, বাপ রে, বাপ রে! রাজা নিতাইকে বুকে জড়াইয়া ধরিল, তারপর বলিল—আও ভাই কবিয়াল, আও।
—কোথায়?
—আরে, আও না। সে তাহার হাত ধরিয়া টানিতে টানিতে লইয়া গেল বণিক মাতুলের চায়ের দোকানে।
—মামা! বনাও চা। লে আও মিঠাই।
বেনে মামাও যুবাক হইয়া গেল নিতাইয়ের পোশাক দেখিয়া। বাতে-পঙ্গু বিপ্ৰপদ অন্যদিকে চাহিয়া বসিয়া ছিল,—আড়ষ্ট দেহখানাকে টানিয়া সে ফিরিয়া চাহিয়া নিতাইকে দেখিল, তাহারও চোখে রাজ্যের বিস্ময় জমিয়া উঠিয়াছে।
নিতাই সবিনয়ে বিপ্ৰপদর পদধূলি লইয়া আজ কতদিন পরে সুপ করিয়া টানিয়া লইল। তারপরে সবিনয়ে হাসিয়া বলিল—চাদরখানা বাবুরা শিরোপা দিলেন প্রভু।
বেনে মামা বলিল–আমাদিগে কিন্তু সন্দেশ খাওয়াতে হবে নিতাই।
–নিশ্চয়। খাও ন মাতুল, সন্দেশ তো তোমার দোকানেই। দাম দেব।
—নেহি, হাম দেঙ্গে দাম। বানাও ঠোঙ্গা। কাঠের একটা প্যাকিং-বাক্স টানিয়া রাজ চাপিয়া বসিল, নিতাইয়ের হাত ধরিয়া টানিয়া পাশের জায়গায় বসাইয়া দিয়া বলিল—বইঠ্ যাও।
এতক্ষণে বিপ্ৰপদ কথা বলিল, সে আজ আর রসিকতা করিল না, ঠাট্টাও করিল না, সপ্রশংস এবং সহৃদয় ভাবেই বলিল—তারপর গাওনা কি রকম হ’ল বল দেখি নিতাই?
নিতাই উৎসাহিত হইয়া উঠিল; বিপ্ৰপদকে আজ জয় করিয়াছে। ইহার অপেক্ষ বড় কিছু সে কল্পনা বা কামনা করিতে পারে না। সে আবার একবার বিপ্ৰপদর পদধূলি লইয়া জোড়হাত করিয়া বলিল—আজ্ঞে প্রভু, গাওনা আপনার চরম। দু’দিকেই দুই বাঘা কবিয়াল— এ বলে আমাকে দেখ ও বলে আমাকে দেখ; একদিকে ছিষ্টিধর, অন্যদিকে মহাদেব। লোকে লোকরণ্যি। তার মেলাও তেমনি।
বেনে মামা ঠোঙায় মিষ্টি ভরিয়া হাতে হাতে দিয়া বলিল—খেতে খেতে গল্প হোক। খেতে খেতে! সকলকে ঠোঙা দিয়া সে নিতাইয়ের ঠোঙাটি অগ্রসর করিয়া ধরিল। কিন্তু নিতাইয়ের অবসর নাই—কথার সঙ্গে তাহার হাত দুইটিও নানা ভঙ্গিতে নড়িতেছে।
বিপ্ৰপদ ও এতক্ষণে ধীরে ধীরে সহজ হইয়া উঠিয়াছে, সে চট করিয়া বেনে মামার হাত হইতে ঠোঙাটি লইয়া ধমক দিয়া উঠিল—ভাগ বেট বেরসিক কাহাঁকা! কবিরা সন্দেশ খায় কোন্ কালে? কবিরা চাদের আলো খায়, ফুলের মধু খায়, কোকিলের গান খায়। তারপর নিতাইকে সম্বোধন করিয়া বলিল—হ্যাঁ, তারপর নিতাইচরণ? একদিকে ছিষ্টিধর, একদিকে মহাদেব। লোকে লোকারণ্যি! তারপর? বলিয়া সে দুইহাতে ঠোঙা ধরিয়া মিষ্টি খাইতে আরম্ভ করিল।
নিতাইয়ের উৎসাহ কিন্তু উহাতে দমিত হইল না। সে সমান উৎসাহেই বলিয়া গেল— একদিন, বুঝলে প্রভু, মহাদেবের নেশাটা খানিকট বেশী হয়ে গিয়েছিল। সেদিন—মহাদেব হয়েছে কেষ্ট, ছিষ্টিধর রাধা। ছিষ্টিধর তো ধুয়ো ধরলে—“কালো টিকেয় আগুন লেগেছে— তোরা দেখে যা গো সাধের কালাচাঁদ।” গালাগালির চরম করে গেল। ওদিকে মহাদেব তখন বমি করছে। দোয়াররা সব মাথায় জল ঢালছে। আমি সেই ফাঁকে এসে ধরে দিলাম ধুয়ে —“কালো যদি মন তবে কেশ পাকিলে কাদ কেনে?” বাস, বুঝলেন প্রভূ, বাবুভাই থেকে আরম্ভ করেসে একেবারে ‘বলিহারি, বলিহারি’ রব উঠে গেল। সঙ্গে সঙ্গে শিরোপা এই চাদরখানা গলার ওপরে বীপাং করে এসে পড়ল।
কথাটা সত্য। নিতাই ধুয়াটা ধরিয়াছিল এবং লোকে সত্যই ভাল বলিয়াছে, কিন্তু শিরোপার কথাটা ঠিক নয়।
তবে শিরোপা পাইলে অন্যায় হইত না। নিতাই মেলায় গাওনা করিয়াছে ভালো। তার সুমিষ্ট কণ্ঠস্বর এবং বিচিত্র বিচার-দৃষ্টি একটা নূতন স্বাদের সৃষ্টি করিয়াছিল। সত্যই তো— কালো যদি মন্দই হইবে—তবে কালো চুলে সাদা রঙ ধরিলে—মন তোমার উদাস হইয় ওঠে কেন? নিতাই বার বার এই প্রশ্নটির জবাব চাহিয়াছিল। ছিষ্টিধর খ্যাতিমান কবিয়াল–সে মানুষকে জানে এবং চেনে–সে এ প্রশ্নের জবাব রসিকতা করিয়া উড়াইয়া দিতে চাহিয়াছিল। গাহিয়াছিল—
“কালো যদি মন তবে কেশ পাকিলে কাঁদি ক্যানে?
কাঁদি না রে! কলপ মাখি!
কলপ মাখি,–না হয়, বউ তুলে দেয় হ্যাঁচকা টানে।”
লোকে খুব হাসিয়াছিল বটে কিন্তু ওই অদ্ভুত প্রশ্নটির অন্তর্নিহিত সকৌতুক বিষন্ন তত্ত্বটি কাহারও মন হইতে মুছিয়া যায় নাই। পালা শেষের পর বহুজন পরস্পরের মুখের কাছে হাত নাড়ির গাহিয়া প্রশ্ন করিয়াছে –
“কালো যদি মন্দ তবে—কেশ পাকিলে কাদে ক্যানে?”
পরের দিন আসরে নিতাইকে মহাদেব ইচ্ছা করিয়াই ছিষ্টধরের মুখের কাছে আগাইয়া দিয়াছিল। সেদিন ছিষ্টিধর দ্রোণ, মহাদেব একলব্য। আগের দিন প্রচুর বমি করিয়া মহাদেবের শরীরও ভাল ছিল না, গলাটাও বসিয়া গিয়াছিল। ছিষ্টিধরের কাছে হারের ভয়ও ছিল। তাই সম্বন্ধ পাতাইবার পর মহাদেব উঠিয়া আসর বন্দনা করিয়া বলিয়াছিল—
আমার চুল পেকেছে দাঁত ভেঙেছে ব্যস আমার অনেক হলো—
ব্যাধের বেটা একলব্য বয়স তাহার বছর ষোলো;
আমাকে কি মানায় তাই? তাই হে দ্রোণ মোর বক্তব্য
একলব্যের বাবা আমি নিতাই হল একলব্য।
বলি–মানাবে ভাল হে!
ইহার উত্তরে ছিষ্টিধর উঠিয়া প্রথমেই কপালে চাপড় মারিয়া গাহিয়াছিল—
—টাকা কড়ি চাই নে কো মা—তোর দণ্ডসাজা ফিরিয়ে নে
হায় মহিষের কৈলে বাছুর বধের হুকুম ফিরিয়ে নে।
নিজে বধলি মহিষাসুরে—
ছানাটাকে দিলি ছেড়ে—
আমায় বলিস বধতে তারে এ আজ্ঞে মা ফিরিয়ে নে।
তাহার পর মহাদেব এবং নিতাইকে জড়াইয়া গালাগালির আর আদি অন্ত রাখে নাই ছিষ্টিধর! মূল স্বর তার ওই। নিতাই যদি মহাদেবের পুত্র হয় তবে তাহারা অন্ত্যজ ব্যাধও নয়, তাহারা অসুর; মহাদেব ব্যাটা মহিষাসুর আর নিতাইটা মহিষাসুরের বাচ্চা!
–হ্যায় অমুরের শ্বশুরবাড়ীর ঠিক ঠিকানা নাই—
গরুর পেটে হয় দামড়া
গায়ে তাহার বাঘের চামড়া
বিধাতা সে অধোবদন—এ ব্যাটা ঠিক তাই।
সে যেন নিষ্ঠুর আক্রোশে কোপাইয়া কুচি কুচি করিয়া কাটা! মহাদেবও অধোবদন হইয়াছিল। ভাঙা গলা লইয়া জবাব দিবার তাহার উপায় ছিল না। কিন্তু নিতাই দমে নাই। সে উঠিয়া গান ধরিয়া দিয়াছিল অকুতোভয়ে। তাহার আর হার-জিতের ভয় কি? সে গান ধরিয়াছিল—
ভাণ্ড পুত্র দ্রোণ ব্রাহ্মণ তোমার কাগু দেখে অবাক হে!
—মহাশয়গণ আমাকে উনি জন্তুপুত্র বলে গাল দিলেন। কিন্তু ওঁর জন্ম ভাণ্ডে—মাটির কলসীতে।
নারিকেলে নিন্দে করেন—ও কষুটে গুবাক হে!
—মানে সুপুরী। মশায় সুপুরী।
কিন্তু আর যোগায় নাই। ইহার পর সে উন্ট পথ ধরিয়াছিল। নিজেই হার মানিয়া লইয়া—মার খাওয়ার লজ্জাকে লঘু করিয়া লইতে চেষ্টা করিয়াছিল। ছড়া ধরিয়াছিল—
বাস্তন প্রধান ওহে দ্রোণাচার্য্য
গুরু হয়ে তোমার এ কি অন্যায় কার্য্য
আমি একলব্য নহি সভ্য ভবঃ
না হয় ব্যাধের ছেলে বনে আমার রাজ্য
কিন্তু তোমার শিষ্য কহি সত্য ন্যায্য।
দশের সাক্ষাতে-পা নিলাম মাথাতে—
বলিয়াই ছিষ্টিধরের পায়ের ধূলা মাথায় লইয়া বলিয়াছিল—এখন রণং দেহি হারজিৎ হোক ধায্য। এবং একেবারে শেষ পালাতে হারিয়া নাস্তানাবুদ হইয়া সে হাত জোড় করিয়া বলিয়াছিল–
পভুগণ শুনুন নিবেদন!
আমি হেরেছি হেরেছি সত্য এ বচন।
হেরেই কিন্তু হয় সার্থক জীবন।
ছিষ্টিধর বলিয়া উঠিয়াছিল–নিশ্চয় নিশ্চয়। তাহার কারণ,—
মুণ্ডু কাটা যায় ধূলাতে গড়ায়
জিব বাহির হয় উল্টায় নয়ন।
এবং নিজেই জিব বাহির করিয়া চোখ উন্টাইয়া ভঙ্গি করিয়া অবস্থাটা প্রকট করিয়া দেখাইয়া দিয়াছিল। লোকে হো-হো করিয়া হাসিয়া প্রায় গড়াইয়া পড়িয়াছিল। নিতাই এই হাসির রোলের উপরেও এক তান ছাড়িয়াছিল—
–আ—আহা–।
তাহার সুস্বরের সেই মুর-বিস্তার মুহূর্তে সকলের উপর ছড়াইয়া পড়িয়া তাহদের কৌতুক উচ্ছ্বাসকে স্তব্ধ করিয়া দিয়াছিল। বর্ষার জলো হাওয়ার মাতামতির উপর ছড়াইয় পড়া গুরুগম্ভীর জলভরা মেঘের ডাকের মত বলিলে অন্যায় বলা হইবে না, কারণ নিতাইয়ের গলাখানি তেমনই বটে। এবং গান ধরিয়া দিয়াছিল। খাঁটি গান। আপনার মনে অনেক সময় সে অনেক গান বাধে—গায়। তাহারই একখানি গান।
আহা—ভালবেসে—এই বুঝেছি
সুখের সার সে চোখের জলে রে—
তুমি হাস—আমি কাঁদি
বাঁশী বাজুক কদম তলে রে!
আমি নিব সব কলঙ্ক তুমি আমার হবে রাজা
(হার মানিলাম) হার মানিলাম
দুলিয়ে দিয়ে জয়ের মালা তোমার গলে রে!
আমার ভালবাসার ধনে হবে তোমার চরণপূজা
তোমার বুকের আগুন যেন আমার বুকে
পিদীম জ্বালে রে।
উহাতেই আসরময় বাহক পড়িয়া গিয়াছিল।
ছিষ্টিধর বলিয়াছিল—তোর এমন গলা নিতাই—তুই যাত্রার দলে-টলে যাস না কেন? কবিগান করে কি করবি?
নিতাই আবার তাহার পায়ের ধূলা মাথায় লইয়া বলিয়াছিল—সে তো পরের বাঁধা গান গাইতে হবে ওস্তাদ।
সবিস্ময়ে ছিষ্টিধর প্রশ্ন করিয়াছিল—এ তোর গান?
—আঞ্জে হ্যাঁ ওস্তাদ।
ছিষ্টিধর কিছুক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়াছিল—তাহার পর বলিয়াছিল—হবে, তোর হবে। কিন্তু–
—কিন্তু কি ওস্তাদ?
—কবিয়ালিও ঠিক তোর পথ নয়। বুঝলি! কিন্তু তু ছাড়িস না। ভগবান তোকে মূলধন দিয়েছেন। খোয়াস না। বুঝলি!
ইহার পর নিতাইয়ের সেরাত্রে সে কি উত্তেজনা। সারারাত্রি জাগিয়া স্বপ্ন দেখিয়াছিল। কত স্বপ্ন!
পরের দিন মেলায় বাহির হইয়া নিজেই চাদর জুতা কিনিয়া সাজিয়া-গুঁজিয়া, আয়নায় বার বার নিজেকে দেখিয়া, মনে মনে অনেক গল্প ফাঁদিয়া বাড়ী ফিরিয়াছিল। বাবুর শিরোপা দিয়েছেন। সুখ্যাতির অজস্র সম্ভার সে তো দেখাইবারই নয়—তবে শিরোপাই তাহার প্রমাণ। দেখ। তোমরা দেখ!
শিরোপার গল্প শেষ করিয়া চা খাইতে থাইতে নিতাইয়ের মনে হইল ঠাকুরঝির কথা। সে কি এখনও ঘরের মধ্যে বসিয়া আছে? নিতাই তাড়াতাড়ি চায়ের কাপ হতেই উঠিয়া আসিয়া প্লাটফর্মের লাইনের উপর দাঁড়াইল। সমান্তরাল শাণিত দীপ্তির লাইন দুইটি দূরে একটা বাঁকের মুখে যেন মিলিয়া এক হইয়া গিয়াছে।
কই? সেখানে তো স্বর্ণবিন্দুশীর্ষ চলন্ত কাশফুলের মত তাহাকে দেখা যায় না!
তবে? সে কি এখনও ঘরে বসিয়া আছে?
দোকানে বসিয়া রাজা হাঁকিতেছিল—ওস্তাদ। ওস্তাদ!
—হাঁ, আসছি, আসছি। বাড়ী থেকে আসছি একবার।
নিতাই দ্রুতপদে আসিয়া বাড়ীতে ঢুকিল। হাঁ, এখনও সে বসিয়া আছে। নিতাইকে দেখিবামাত্র সে উঠিয়া পড়িল। কোন কথা না বলিয়া সে পাশ কাটাইয়া চলিয়া যাইতে উদ্যত হইল। নিতাই তাহার হাত ধরিয়া বলিল—রাগ করেছ?
মেয়েটি মুহূর্তে কাঁদিয়া ফেলিল।
—কি করব বল? ওরা কি ধ’রে ছাড়তে চায়—
—না। আমি বসে রইলুম, আর তুমি গেলা ওদের সঙ্গে গল্প করতে!
—তোমার হাতে ধরছি—
ঠাকুরঝি এবার হাসিয়া ফেলিল।
—ব’স, একটুকুন চা খাও। তোমার লেগে নতুন কাপ এনেছি—এই দেখ। সে পকেট হইতে একটি নূতন স্টীলের মগ বাহির করিল –ভুলে গিয়েছিলাম এতক্ষণ। নিতাই হাসিল।
—না। বেলা– বলিয়াই বেলার দিকে চাহিয়া সে শিহরিয়া উঠিল।–ওগো মাগো! সঙ্গে সঙ্গে দ্রুতপদে চলিতে আরম্ভ করিল।
সমস্ত পথটাই সে ভাবিতেছিল এই বিলম্বের জন্য কি বলিবে! চলিতে চলিতে হঠাৎ মনে পড়িয়া গেল হারের কথা। সে খুঁট খুলিয়া হারখানি বাহির করিল। গলায় পরিল। সঙ্গে সঙ্গে সৰু আশঙ্কার কথা ভুলিয়া গেল।
পথে একটি ছোট নদী। স্বচ্ছ অগভীর জলস্রোতে তাহার কম্পিত প্রতিবিস্থের গলায় সোনার হার বিক্মিক্ করিতেছে, মেয়েটি সেই প্রতিবিম্বের দিকে চাহিয়া স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া গেল, ধীরে ধীরে চঞ্চল জল স্থির হইল। এইবার একবার সে হার-পরা আপনাকে বেশ করিয়া দেখিয়া লইল, তারপর হারখানি খুলিয়া খুঁটে বঁধিয়া নদী পার হইয় গ্রামে প্রবেশ করিল।
কি বলিবে, সে এখনও স্থির করিতে পারে নাই, তবে তিরস্কার সহ করিতে সে আপনাকে প্রস্তুত করিয়াছে।
নিতাই এখনও দাঁড়াইয়া আছে কৃষ্ণচুড়া গাছটির তলায়। ফাঙ্কনের দ্বিপ্রহরের দিক্চক্রবাল ধূলার আস্তরণে ধূসর হইয়া উঠিয়াছে, বাতাস উতলা হইয়াছে, সেই উতলা বাতাস ধূলা উড়াইয়া লইয়া বহিয়া যায়, যেন দূরের নদীর প্রবাহের মত। নিতাইয়ের মন এখনও চঞ্চল। সে এখনও সেষ্ট ঝাপসা আস্তরণের মধ্যে যেন একটি স্বর্ণবিন্দুশীৰ্ষ কাশফুল দেখিতে পাইতেছে। সে স্থির দৃষ্টিতে দিগন্তের দিকে চাহিয়া গুনগুন করিয়া গান ভাঁজিতেছিল। হঠাৎ তাহার মনে মনে একটা বিচিত্র কথার মালা গাঁথিযয়া উঠিল। নিজেরই একসময় মনে প্রশ্ন জাগিল—কেন সে এমন করিয়া পথের ধারে দাঁড়াইয়া থাকে? ওই মেয়েটি তাহার কে? মনই বলিল—কে আবার—‘মনের মানুষ’। মনের মামুষের জন্যই সে পথের ধারে দাঁড়াইয়া থাকে ৷ সাধ হয় এই পথের ধারেই ঘর বাঁধিয়া বাস করে। পথের দিকে চাহিয়া দাঁড়াইয়া থাকে, হঠাৎ এক সময়ে তাহার আসার নিশানা ঝিকমিক করিয়া উঠে। সেই কথাগুলিই সাজাইয়া গুছাইয়া স্বরতরঙ্গের দোলায় আপন মনেই গুন গুন ধ্বনি তুলিয়া দুলিতে লাগিল—
“ও আমার মনের মানুষ গো!
তোমার লাগি পথের ধারে বঁধিলাম ঘর!
ছটায় ছটায় ঝিকিমিকি তোমার নিশানা,
আমায় হেথা টানে নিরন্তর।”
তাহাই সে করবে। পথের ধারে ঘর বাঁধিয়া অহরহ দাওয়ায় বসিয়া পথের পানে চাহিয়া থাকিবে। ঘর হইতে ঠাকুরঝি বাহির হইলেই তাহার মাথার ঘটিতে রোদের ছটা লাগিয়া ঝিলিক উঠিবে, সে ঘটিতে ওঠা ছটার ঝিলিক আসিয়া তাহার চোখে লাগিবে। গান বাঁধিয়া সে সুরে ভাঁজিতে লাগিল—
ও আমার মনের মানুষ গো!