বড় ভাল কলি হইয়াছে। নিতাইয়ের নিজেরই নেশা ধরিয়া গেল –
“কালো যদি মন্দ তরে কেশ পাকিলে কাঁদ কেনে?”
বাহবা, বাহবা, বাহবা! কেন কাঁদ?
ওদিকে চায়ের জল টগবগ করিয়া ফুটিয়া উঠিল। ব্যস্ত হইয়া নিতাই ফুটন্ত জলের হাঁড়িটা নামাইয়া চা ফেলিয়া দিয়া একটা কলাই-করা লোহার থাল চাপা দিল। ফুটন্ত জলে প্রত্যেক জনের জন্য এক চামচ চা দিয়া পাঁচ মিনিট অপেক্ষ করুন’–বেনে মামার স্টলে নিতাই চা প্রস্তুত করিবার বিজ্ঞাপন পড়িয়ছে! কিন্তু তাহার পর কি?
চা দিয়া আবার সে আপন মনে কলিটা ভাজিতে আরম্ভ করিল। দ্বিতীয় কলি আর মনোমত হইতেছে না। সে জানালা দিয়া বাহিরের যাবতীয় কালো বস্তুর দিকে চাহিয়া রহিল। কিন্তু তবু পছন্দসই দ্বিতীয় কলি আসিল না। অন্য দিন সে গরম জলে চা দিয়া মনে মনে এক হইতে ষাট পর্যন্ত পাঁচবার গনিয়া যায়, তারপর দুধ চিনি দেয়। আজ আর সে হইয়া উঠিল না, কেবলই কলিটা গুনগুন করিয়া ভাজিয়া মনে মনে দ্বিতীয় কলি খুঁজিয়া খুঁজিয়া ফিরিল। অকস্মাৎস্তুহার চায়ের কথা মনে হইতে সে দুধ চিনি দিয়া চ ছাকিয়া লইল। কলাইকরা লোহার মগে চা লইয়া বাকিটা রাজার জন্য ঢাকা দিয়া রাখিয়া সে আসিয়া বসিল কৃষ্ণচুড়া গাছটির তলায়। এটি তাহার বড় প্রিয় স্থান। ঘন কালো সরু সরু পাতায় ছাতার মত গাছটি; নিতাই বলে –‘চিরোল-চিরোল পাতা’। তাহার উপর যখন চৈত্রের শেষ হইতে থোপ-থোপা লাল ফুলে ভরিয়া উঠে, তখন নিতাই প্রায় অহরহই গাছটির তলায় বসিয়া থাকে ফুলের লোভে ছেলের দল আসে, নিতাই তাহাদিগকে ঝরা ফুল দিয়া বিদায় করে, গাছে চড়িয়া ফুল তুলিতে দেয় না।
স্টেশন হইতে রাজার হাঁক-ডাক আসিতেছে। এই ট্রেনটার সঙ্গে মালগাড়ী থাকে, এখানকার মাল থাকিলে গাড়ী কাটিয়া দিয়া যায়—সেই গাড়ী শান্টিং হইতেছে। নিতাইও আগে নিয়মিত অন্য কুলিদের সঙ্গে মালগাড়ী ঠেলিত। সহসা তাহার মনের গান চাপা দিয়া জাগিয়া উঠিল জীবিকার ভাবনা। কুলিগিরি সে আর করিবে না, সে কবিয়াল। কুলিগিরি না করিলে অন্ন জুটিবে কেমন করিয়া?
এই ভাবনার মধ্যেই হঠাৎ চোখে পড়িল লঘু ক্ৰত গমনে ঘন ঘন পা ফেলিয়া ধপধপে মোটা কাপড় পর, হাল্কা কাশফুলের মত চলিয়াছে ঠাকুরঝি মাথায় সোনার টােপরের মত ঝকঝকে পিতলের ঘাট। ঠাকুরঞ্চির কখাও যেমন দ্রুত, চলেও সে তেমনি ক্ষিপ্ৰ গতিতে। ঢাঙা নয়, অথচ সরস কাচু বাঁশের পর্বের মত অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলিতে বেশ একটি চোখজুড়ানো লম্বা টান আছে। ওই দীঘল ভঙ্গিটি নিতাইয়ের সব চেয়ে ভাল লাগে। আর ভাল লাগে তাহার কালে কোমল ত্র। যুক্তবারই সে ঠাকুরঝিকে দেখে ততবারই এই কথাগুলি তাহার মনের মধ্যে সাড়া
তোলে।
ঠাকুরঝি আজ অত্যন্ত দ্রুত চলিয়াছে। নিতাই মনে মনে একটু হাসিল—তাহাকে দেখিয়াই ঠাকুরঝি এমন হনতুন করিয়া চলিয়াছে। শক্তি থাকিলে ঠাকুরঝি নিশ্চয় মাটি কাঁপাইয়া পথ চলিত। কিন্তু রাজনের এমন কড়া কথা বলা ভাল হয় নাই। আলকাতরার মত রঙ হইলেও ঠাকুরঝি তো মন্দ দেখতে নয়! মন্দ কেনা, ভালই। কালো রঙে কি আসে যায়!
‘কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কাঁদ কেনে?’
নিতাই ডাকিল—ঠাকুরঝি! অ ঠাকুরঝি!
ঠাকুরঝি গ্রাহ্য করিল না, সে হনহন করিয়াই চলিয়াছে।
—আমার দিব্যি! নিতাই ইকিয়া বলিল।
ঠাকুরঝি থমকিয় দাঁড়াইল।
মিঠা সরু আওয়াজে দ্রুতভঙ্গিতে মেয়েটি বলিল—না, আমার দেরি হয়ে যাবে।
—একটা কথা। শোন শোন।
—না। ওইখান থেকে বল তুমি।
—আমার দিব্যি৷
অত্যন্ত দ্রুত গতিতে ঠাকুরঝি এবার আগাইয়া আসিয়া নিতাইয়ের সম্মুখে দাঁড়াইয়া বলিল— তোমার দিব্যি যদি আমি না মানি?
—না মানলে মনে বেথা পাব, আর কি ঠাকুরঝি নিতাই ছলনা করিয়া বলিল না, আন্তরিকতার সহিতই বলিল।
অপেক্ষাকৃত শান্ত সুরেই এবার মেয়েটি বলিল—লাও কি বলছ, বল!
তাহার মুখের দিকে চাহিয়া মিষ্ট হাসি হাসিয়া নিতাই বলিল—রাগ করেছ?
মুহূর্তে ঠাকুরঝির ভীরু চকিত দৃষ্টি ভরা চোখ দুইটি সজল হইয়া উঠিল। কিন্তু সে উদ্দীপ্ত কণ্ঠে বলিল—কালো আছি, আমি আপনার ঘরে আছি। কেউ তো আমাকে খেতে পরতে দেয় না!
নিতাই হাসিয়া বলিল—আমি কিন্তু কালো ভালবাসি ঠাকুরঝি। ঠাকুরঝির মুখের কালো রঙে লাল আভা দেখা যায় না, তবু তাহার লজ্জার গাঢ়তা বোঝা যায়। নিতাই কিন্তু গ্রাহ্য করিল না, সে গালে হাত দিয়া মৃদ্ধ স্বরে গান ধরিয়া দিল—
কালো যদি মন্দ তবে কেশ পাকিলে কাঁদ কেনে।
লজ্জিত ঠাকুরঝি এবার সবিস্ময়ে শ্রদ্ধাম্বিত দৃষ্টিতে নিতাইয়ের দিকে চাহিল, বলিল—লতুন গান? বলিয়া সে সঙ্গে সঙ্গেই বলিল—কাল তুমি বাপু ভারি গান করেছ।
—ভাল লেগেছে তোমার?
—খুব ভাল।
—এস, এস, একটুকুন চা আছে—খাবে এস।
—ন না। ঠাকুরঝির চা খাইতে বেশ ভালই লাগে, কিন্তু মেয়েদের ভাল লাগার কথা নাকি বলিতেই নাই। ছি!
নিতাই আবীর দিব্যি দিল—আমার দিব্যি। নিতাই বাসার দিকে ফিরিল। রাজনের জন্য যে চাটুকু ছাঁকিয়া রাখিয়াছিল, সেটা উনানের উপরে বসানোই ছিল, সেটা দুইটা পাত্রে ঢালিরা একটা ঠাকুরঝিকে আগাইরা দিল। মেয়েটি আবার সলজ্জ ভাবে বলিল—না, না, তুমি খাও।
—না, তা হবে না। তাহলে বুঝব, তুমি এখনও কোধ করে আছ।
বাটিটা টানিয়া লইয়াসকৌতুক বিস্ময়ে ঠাকুরঝি বলিল—কোধ কি গো? কোধ?
—রাগ। কোধ’ মানে হ’ল গিয়ে তোমার রাগ! কয়ে রফল ‘ও’কার ধ, কোধ! ‘হিংসা কোধ অতি মন্দ কভু নহে ভাল’। বুঝলে ঠাকুরঝি, এই কারুর হিংসে করো না, আর কোধ করো না। কোধের নাম হ’ল চণ্ডাল।
গভীর বিস্ময়ে মেয়েটি নিতাইয়ের দিকে চাহিয়। প্রশ্ন করিল—আচ্ছা, তুমি এত সব কি ক’রে শিখলে?
গম্ভীরভাবে নিতাই উপরের দিকে চাহিয়া পরম-তত্ত্বজ্ঞের মতই বলিল—ভগবানের ছলনা ঠাকুরঝি! নইলে কবিয়াল ক’রেও তিনি আমাকে ‘ডোম’-কুলে পাঠালেন কেনে, বল?
নীরব বিস্ময়ে মূর্তিমতী শ্রদ্ধার মত মেয়েটি কবিয়ালের দিকে চাহিয়া রহিল, তাহার চোখের উপর ভাসিতেছিল—শত শত লোকের বিস্মিত দৃষ্টির সম্মুখে এই লোকটি মুখে মুখে ছড়া বাঁধিয়া গান গাহিতেছে!
অকস্মাৎ একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া নিতাই বলিল—সবই তার লীলা। না হলে আমাকে ঠাট্টা করে কপিবর, মানে হনুমান বলে!
চকিত উত্তেজনায় ঠাকুরঝির ভ্র দুইটি কুঞ্চিত হইয়া উঠিল, সে প্রশ্ন করিল-কে? কে বটে, কে?
আবার একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া নিতাই বলিল—সে আর শুনে কি করবে বল? লাও, চা খাও। জুড়িয়ে গেল।
ঠাকুরঝি এবার পিছন ফিরিয়া বসিল, জামাই বা নিতাইয়ের দিকে মুখ রাখিয়া সে কখনও কিছু খায় না। পিছন ফিরিয়া বসিয়া চায়ের বাটিতে চুমুক দিয়া সে বলিল—না, বলতে হৰে তোমাকে। কে বটে, কে সে? জামাই বুঝি? জামাই অর্থে রাজন।
—না না, ঠাকুরঝি, রাজন আমার পরম বন্ধু, বড় ভাল নোক।
—হ্যাঁ, ভাল নোক না ছাই। যে কট কটে কথা!
—না, না। আজ তোমাকে ওটা পরিহাস করে বলেছে। তুমি শালী, পরিহাসের সম্বন্ধ।
—পরিহাস কি গো?
—ঠাট্টা, ঠাট্টা। তোমার সঙ্গে তো ঠাট্টার সম্বন্ধ।
ঠাকুরঝি চুপ করিয়া রহিল, নিতাইয়ের কথাটা সে মনে মনে স্বীকার করিয়া লইতেছিল। ঠাকুরঝির কোমল কালো আকৃতির সঙ্গে তাহার প্রকৃতির একটি ঘনিষ্ঠ মিল আছে, সঙ্গীত ও সঙ্গতের মত। কয়েক মুহূর্ত পরেই সে বলিল—তা বটে। জামাই আমাদের রাগীদার হোক, নোক ভাল।
—ভারি ভাল নোক।
—কিন্তু তোমাকে উ কথা কে বললে, বলতে হবে। সে মুখপোড়া কে বটে, কে?
—গাল দিয়ে না ঠাকুরঝি, জাতে ব্রাহ্মণ। ওই যে বণিক মাতুলের দোকানে বক্র মুনির মত বসে থাকে আর ফরফর করে বকে? ওই বিপ্ৰপদ ঠাকুর।
—কেন উ কথা বলবে?
—ছেড়ে দাও কথা। জাতে ব্রাহ্মণ, আমি ছোট জাত-তা বলে বলুক।
—আঃ ভারি আমার বাভন। কই, এমনি মুখে মুখে বেঁধে গান করুক দেখি, একবার দেখি। উত্তেজনায় ঠাকুরঝির মাথার কাপড় খসিয়া গেল।
নিতাই মুগ্ধ কণ্ঠে বলিয়া উঠিল, বা-বা-বা! ভারি মানিয়েছে তো ঠাকুরঝি!
ঠাকুরঝির রুক্ষ কালে চুলের এলে খোপায় এক থোক টকটকে রাঙা কৃষ্ণচুড়া ফুল। লজ্জায় মেয়েটি সচকিত হরিণীর মত তাহার খসিয়া-পড়া ঘোমটাখানি ক্ষিপ্ৰ হস্তে, দ্রুত ভঙ্গিতে মাথায় তুলিয়া দিতে চেষ্টা করিল। কিন্তু নিতাই একটা কাণ্ড করিয়া বসিল, সে খপ করিয়া হাতখানি ধরিয়া বাধা দিয়া বলিল—দেখি! দেখি! বা-বা-বা!
মেয়েটি লজ্জায় অধোমুখ ও কাঁদো কাঁদো হইয়া গেল, বলিল—ছাড়ে। ছাড়ে।
মুহূর্তে নিতাইয়ের কাণ্ডজ্ঞান ফিরিয়া আসিল, সে তাহাকে ছাড়িয়া দিল। ছাড়া পাইয়া সঙ্গে সঙ্গে মেয়েটি চায়ের বাটিটা হাতে নতমুখে ছুটিয়া পলাইয়া গেল–বাটিটা ধুইবার অজুহাতে। নিতাই লজ্জিত স্তব্ধ হইয়া নতমুখে বসিয়া রহিল। ছি! ছিঃ! ছি! এ কি করিল সে?
চুপ করিয়াই সে বসিয়াছিল, হঠাৎ ইং শব্দে সে মুখ তুলিয়া দেখিল—ঠাকুরঝি বাটিটা নামাইরা দিয়া আপনার ঘটীটি তুলিয়া লইয়া চলিয়া যাইতেছে। সে মুখ ফিরাইয়া চাহিল। সলজ্জ হাসিতে ঠাকুরঝির কাঁচা মুখখানি রৌদ্রের ছটায় কচি পাতার মত ঝলমলে হইয়া উঠিয়াছে। চোখোচোথি ইইতেই ঠাকুরঝি হাসিয়া চট করিয়া মুখ ফিরাইয়া লইল, সেই বেগে তাহার আবার মাথার ঘোমটা খসিয়া গেল। ঠাকুরঝি এবার ছুটিয়া পলাইয়া গেল, ঘোমটা তুলিয়া না দিয়াই —তাহার রুক্ষ কালো চুলে লাল কৃষ্ণচূড়া পরিপূর্ণ গৌরবে আকাশের তারার মত জ্বলিতেছে!
না, ঠাকুরঝি রাগ করে নাই। ওই যে, যাইতে যাইতে আবার ফিরিয়া চাহিয়া হাসিতেছে। কিন্তু কালো চুলে রাঙা কৃষ্ণচূড় বড় চমৎকার মানাইয়াছে।
ঠাকুরঝি ক্রমে ক্রমে স্বর্ণবিন্দুশীর্ষ কাশফুলের মত ছোট হইয়া পথের বাঁকে মিলাইয়া গেল। নিতাই বসিয়া আপন মনেই ঘাড় নাড়িতে আরম্ভ করিল। দ্বিতীয় কলিটাও তাহার মনে আসিয়াছে।
“কালো কেশে রাঙা কুসুম হেরেছ কি নয়নে?”