কীর্তিহাটের কড়চা – ৪র্থ খণ্ড – ২০

২০

বিচিত্র মানুষের মন, আর  তার থেকেও বেশী বিচিত্র মানুষের কর্মফেরের জের, এদের নাগপাশ থেকে মানুষের পরিত্রাণ নেই। গ্রামের লোকেদের বাড়ী বাড়ী গিয়ে ঠাকুমার শ্রাদ্ধ সম্পর্কে পরামর্শ দেবার জন্য বলতে গিয়ে মনে বড় কষ্ট পেলাম।

লোকের বাড়ী বাড়ী যাবার জন্যে পরামর্শ দিয়েছিলেন নায়েব। বললেন—আগের কালে রায়বাড়ীর ক্রিয়াকর্মে গ্রামে লোকের বাড়ী যাওয়া হত না, ডাকাও হত না; শ্রাদ্ধাদি সামাজিক ক্রিয়াতে অধিষ্ঠানের নিমন্ত্রণ করতে যেতেন বাড়ীর পুজুরী আর আহারের নিমন্ত্রণ করতেন ঠাকুরবাড়ির পরিচারক। পান-সুপুরি-পৈতে দিয়ে বরণের ব্যবস্থা আছে, তা কর্তারা থালাখানা এনে আসরে নামিয়ে দিয়ে বলতেন, ব্রাহ্মণেভ্য নমঃ। বলে চলে যেতেন। আপনার মাতৃশ্রাদ্ধেও তাই হয়েছে। কিন্তু এখন হালচাল পাল্টে গিয়েছে বাবু; এখন নিজে না গেলে লোকে ঠিক—। অতুলেশ্বর তখন খালাস হয়ে এসেছে, সে দাঁড়িয়েছিল সেখানে, আমাকে সে প্রায় নির্দেশ দিয়ে কথা বললে। বললে—লোকের বাড়ী বাড়ী যেতে হবে তোমাকে। নাহলে আমি বারণ করব। আমি হেসে বললাম—নিশ্চয় যাব। জমিদার আমি সাজব না। কিন্তু কল্যাণেশ্বর প্রভৃতি রায়বাড়ীর নবীনেরা বললে, দেখ, আমাদের মেজতরফে ভাঁটা পড়েছে, আমরা যাই যাই, তুমি যাবে কেন? তুমি সে ইজ্জতটা রাখ। তুমি তো এখানে থাকবে না, সুরোদা! অতুলকার কথা তুমি শুনো না।

মেজদি বললেন—না সুরো, তুই অতুলের কথা শোন।

অর্চনা বললে-না সুরোদা, তুমি যাও।

গোবরডাঙার খুড়ীমা ডেকে বললেন-সুরেশ্বর, তুমি কল্যাণদের কথা শুনো না। তুমি যাও। তোমার পিতামহীর শ্রাদ্ধ, তোমার কর্তব্য, তুমি যাও।

শুধু ব্রাহ্মণবাড়ী নয়, সুলতা—গ্রামের সকল পাড়ায় পাড়ায় প্রধানদের বাড়ীতে বাড়ীতে যেতে হল। রায়বাড়ীর নিমন্ত্রণ বরাবরই পঞ্চগ্রামের সপ্তগ্রামের, গ্রামের আবাল-বৃদ্ধবনিতারা নিমন্ত্রণ খেয়ে গেছে, কিন্তু সেকালে নিমন্ত্রণ হত পাড়ার প্রান্তে দাঁড়িয়ে নিমন্ত্রণ ছুঁড়ে দিয়ে; একখানা করে রোকা পাঠাতে হত। লেখা থাকত “অত্র রোকায় রায়বাড়ীর নিমন্ত্রণ জানিবা। রায়বাড়িতে…উপলক্ষ্যে ভূদেব ভোজন হইবেক এবং তৎপর অন্যান্য সকলজনকে ভুরিভোজনে আপ্যায়িত করা হইবেক, উক্ত ভোজনের আসরে তোমাদের পাড়ার সকলকে মায় আগত-স্বগত কুটুম্বস্বজনকে নিমন্ত্রণ জানানো যাইতেছে।”

এবার আর রোকায় নিমন্ত্রণ চলল না, আমাকে যেতে হল। গেলাম পাড়ায় পাড়ায়। ব্রাহ্মণ এবং বর্ধিষ্ণু শুদ্রদের ঘরে ঘরে। তারপর শ্রাদ্ধের আয়োজনের পরামর্শের জন্য সর্বাগ্রে আহ্বান জানাতে হল কংগ্রেস কমিটির প্রেসিডেন্টকে।

সেখানে নিয়ে গেল অতুলেশ্বর।

কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট রঙ্গলাল ঘোষ তখন নেই। মারা গেছেন। তাঁর জায়গায় প্রেসিডেন্ট হয়েছেন তাঁর উকীল ছেলে। অতুলেশ্বর সেক্রেটারী। গ্রামে সদ্‌গোপদের সংখ্যাধিক্য, সুতরাং প্রেসিডেন্ট তারা ছাড়া কেউ হতে পারে না। রঙলাল ঘোষের সেই উকীল ছেলেটি দাবী করলেন শ্রাদ্ধ যে রকমই করি, যত খরচই করি, কংগ্রেস কমিটির সামনে একটা সংগ্রাম আসছে, তার জন্য কংগ্রেস ফাণ্ডে টাকা দিতে হবে। সেও দিতে আমি রাজী হলাম, কিন্তু তবু পরিপূর্ণ সহযোগিতা পেলাম না ওদের কাছে। তার কারণ ওই গোয়ানপাড়ায় ভায়লেটের স্মৃতিরক্ষার জন্য কিছু করবার সঙ্কল্প করেছিলাম। কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট বেঁকে বসলেন ওই কথায়—না, তা করতে পাবেন না।

ঠাকুমা বলে গিয়েছিলেন তাঁর শ্রাদ্ধের সঙ্গে যেন ভায়লার জন্যে কিছু করি। বলেছিলেন—ওরে, বড়বাবু মারা গেলেন ভায়লার পিছনে ছুটতে গিয়ে। আর বড়বাবু মারা গেলে আমি মরতে পারলাম না, ভায়লা অনায়াসে বিষ খেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে মরল।

ভায়লেট মেয়েটি গলায় কেন দড়ি দিয়েছিল জানি না, তবে আমার ঠাকুমা তার ওই ব্যাখ্যাই করেছিলেন। এবং স্বামীর শ্রাদ্ধের দিনে রাত্রি এক প্রহরের সময় উদ্ভ্রান্ত হয়ে টাকা নিয়ে গিয়েছিলেন গোয়ানপাড়ায় গির্জের পাদরীর কাছে; ভায়লেটের শ্রাদ্ধ হোক, এই তিনি চেয়েছিলেন। কিন্তু তাও হয় নি, কারণ গভীর রাত্রে কারুর দেখা পান নি। ফলে রায়বাড়ীতে মেজতরফ তাঁকে।

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সুরেশ্বর বললে—আমি তাঁর কথায় সঙ্কল্প করেছিলাম, গোয়ানপাড়ায় ভায়লেটের স্মৃতিরক্ষার জন্য কিছু করে দেব। আর ভায়লেটের কবরের যদি কোন সন্ধান মেলে, তবে কবরটিতে অন্ততঃ একটা মার্বেল ক্রশ বসিয়ে কবরটি মার্বেল দিয়ে ঢেকে দেব। কিন্তু বাধা পড়ল তিন দিক থেকে। কীর্তিহাটের কংগ্রেস ও গ্রামের তরফ থেকে, রায়বাড়ীর ছেলেদের তরফ থেকে এবং সব থেকে আশ্চর্যের কথা, গোয়ানপাড়া থেকেও এল বাধা।

* * *

ঠাকুমা যদি কীর্তিহাটে তাঁর শ্রাদ্ধ করতে না বলতেন, আর ভায়লেটের স্মৃতির জন্যে কিছু করতে না বলতেন, তবে এইখানে ছেদ টেনে দিয়ে বলতাম,—এই শেষ। কলকাতায় থাকতাম, নায়েব-গোমস্তরা জমিদারী চালাত, হিসেব দিত; আমি নিশ্চিন্ত মনে আজকের দিনটির অপেক্ষা করে থাকতাম। কিন্তু ঠাকুমার শেষ ইচ্ছা পালন করতে গিয়ে প্রথমেই পেলাম বাধা।

কীর্তিহাটের কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট বললেন—গোয়ানপাড়ায় কিছু করা হবে না। করতে গেলে বাধা পড়বে। গ্রামের লোকে হয়তো খাবে না। আপনাকে ওদের নিয়েই থাকতে হবে।

না খাওয়ার অর্থ ভীষণ। অন্ততঃ আমার ঠাকুমার শ্রাদ্ধের ক্ষেত্রে। তাহলে যে অপরাধে তাঁকে রাধাসুন্দরের মন্দিরে ঢুকতে দেওয়া হয় নি, যে অপরাধে তাঁর ছেলে যজ্ঞেশ্বর রায় তাঁর পৈতৃক কোম্পানীর কাগজ তাঁদের নামে লিখিয়ে নিয়েছিলেন, সেই অপরাধ কায়েম হয়ে যাবে।

গোয়ানপাড়ার ক্রীশ্চান বাসিন্দেরা সেই ভোটের সময় থেকে কংগ্রেসবিরোধী—ইংরেজদের সমর্থক হয়েছে প্রকাশ্যে। তাদের সঙ্গে মুসলীম লীগের পাণ্ডারা হাত মিলিয়েছে।

 তার সঙ্গে মনে পড়িয়ে দিলে অতুল—তুমি তো একবার ভুগেছ। ভোটের পর গোয়ানপাড়া পুড়িয়ে দিয়েছিল যারা, তুমি তাদের ঘর নতুন করে গড়বার জন্যে সাহায্য করতে চেয়েছিলে, তার জন্য–।

সবটা না বলে অতুল থেমে গেল। জানে তো মনে আমার আছে। শুধু বলে দিলে, এবার আবার তার থেকেও কিছু বেশী হবে।

আমি অতুলকে বলেছিলাম—অতুলকাকা, এটাও তো জান যে, সেদিন পুলিস এসে যখন আমাকে রক্তমাখা অবস্থায় পেয়েছিল, তখন আমি যে জবানবন্দী দিয়েছিলাম, তার জন্যেই কীর্তিহাটের গ্রামের কারুর গায়ে আঁচ লাগে নি।

—জানি। কিন্তু সে না করে তোমার উপায় ছিল না। সে করতে তুমি মরালি বাধ্য ছিলে।

—মরালি বাধ্য ছিলাম?

—অন্তত আমি তাই মনে করি।

একটু ভেবে আমি বলেছিলাম—তাই যদি মনে কর অতুলকাকা, তবে আমি আর তোমার বা তোমাদের সাহায্য চাইব না। আমি যা পারি যেমন পারি নিজেই করব। গ্রামের লোক যা করে করুক।

—বেশ কর।

অতুল চলে গিয়েছিল। মেজদিদি, অৰ্চনা স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। অতুল এমন কথা বলতে পারে, তারা তা ভাবতে পারে নি।

সাহস দিয়ে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন গোবরডাঙার খুড়ীমা। এবং শেষ শয্যায় শুয়ে ধনেশ্বর রায়। ক’দিনের মধ্যে তিনি ভেবে ভেবে সব চক্ষুলজ্জা, সব মিথ্যে মর্যাদার মোহ ত্যাগ করে নিজের বিগত অন্যায়কে স্বীকার করে নিতে পেরেছিলেন। স্বীকার করেছিলেন—“রাধাসুন্দরের চত্বরে সেদিন উমা দেবীকে ঢুকতে দেই নি, বড়তরফকে দেবোত্তর থেকে বঞ্চিত করবার জন্যে। কিন্তু বড়তরফের বড়ছেলে যজ্ঞেশ্বর রায় জটিল বিষয়ী এবং দুর্দান্ত নিষ্ঠুর। তিনি মাকে পাগল বানিয়ে তাঁকে বৃন্দাবনে বনবাসে দিয়ে বিষয়ের মুঠো এতটুকু আলগা হতে দেন নি। আমি দোষ স্বীকার করছি। তার প্রায়শ্চিত্ত আমি করে যাব সুরেশ্বর, আমি বিছানায় শুয়ে এই পঙ্গুদশায় যতটা পারি সাহায্য করব।”

গোবরডাঙার খুড়ীমা বলেছিলেন—তুই পিছিয়ে আসিস নে সুরেশ্বর। জ্যাঠামায়ের শেষ ইচ্ছে তোকে পূর্ণ করতেই হবে। ভায়লেট মেয়েটা তাঁর মরণের খবর পেয়ে গলায় দড়ি দিয়েছিল, এ ভালবাসা কে অস্বীকার করবে! জ্যাঠাইমার মত সতীসাধ্বী হয় কে? ভায়লেটের ভালবাসার দাম তিনি বুঝবেন না তো বুঝবে কে?

বাধা এল অন্য দিক হতে। গোয়ানদের দিক হতে। তারা বললে—ভায়লেটের কবর তারা ছুঁতে দেবে না। সে কবর যেমন আছে তেমনি থাকবে। চাই নে তার মার্বেলের আবরণ, মার্বেলের ক্রশ। দেবেশ্বর রায়ের সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক ছিল এ কথা যে বলবে তার জিভ তারা ছিঁড়ে নেবে।

দিন-সাতেকের মধ্যেই আমার নামে একটা নোটিশ এল। তমলুকের এস-ডি-ও আদেশ জারী করেছেন, নির্দেশ দিয়েছেন, গোয়ানপাড়ার কবরস্থানে শান্তিভঙ্গের আশঙ্কায় তোমাকে নির্দেশ দেওয়া যাচ্ছে যে, সেখানে কোন কিছু করবার চেষ্টা যেন না করা হয়। লোকজনসহ সেখানে যেন না যাই।

আমি নায়েবকে বললাম—গোয়ানপাড়ার কে এসেছে নোটিশ জারী করাতে, তাকে ডাকুন।

নায়েব বাইরে গিয়ে ফিরে এসে বললে—তারা কেউ আসবে না।

আমি নিজে বাইরে গেলাম। দেখলাম আদালতের পিওনের সঙ্গে তিন-চারজন গোয়ান এসেছে। তাদের নাম মনে পড়ল না। ভুলে গেছি বছর দুয়েকের মধ্যে। তাদের দিকে তাকিয়ে বললাম—দু বছর আগে যখন তোমাদের ঘর পুড়েছিল, তখন তোমাদের টাকা দিয়েছিলাম। আমি তোমাদের অপমান করি নি। ভায়লেটের কবর আমি বাঁধিয়ে দিতে চাই, তোমরা দেবে না। ভাল কথা। কিন্তু ভায়লেটের নামে যদি চার্চে টাকা দিই বা তার নামে একটা কিছু করে দিই গোয়ানপাড়ায়, তাহলে তাও কি নেবে না তোমরা?

ওরা চুপ করে রইল। এ-ওর মুখ তাকালে। কিন্তু মুখে কিছু বলতে পারলে না। চলে গেল। বিকেলবেলা বিবিমহলের ঘরে বসেছিলাম, রঘু এসে বললে—সেই মেয়েটি এসেছে। সেই কুইনি বলে মেয়েটি। তার সঙ্গে আছে পাড়ার পাদরী সাহেব।

কুইনি এল যেন জ্বলতে জ্বলতে। প্রচণ্ড ক্ষোভ নিয়ে। সে বললে—না, গোয়ানপাড়ার কেউ কিছু নেবে না আপনার কাছে। আপনারা বড়লোক, আপনারা লজ্জাহীন, আপনারা অন্ধ, আপনারা অনুভবশক্তিহীন; আপনারা মনে করেন দুনিয়াকে আপনারা কিনে রেখেছেন; জমির জমিদারীস্বত্ব কিনেছেন, সঙ্গে সঙ্গে মানুষকেও কিনেছেন ভেবেছেন। চোখে দেখতে পাচ্ছেন না, মনে অনুভব করতে পারছেন না যে দিনকাল পাল্টেছে, মানুষ আর আপনাদের হুকুম মানবে না, আপনাদের দেওয়া অপমান সইবে না। কেন আপনি এমন করে অপমান করতে চাইছেন আমার মাতামহের মা ভায়লেট পিদ্রুসকে? কি অধিকার আপনার?

একসঙ্গে এতগুলো কথা বলে সে হাঁফাতে লাগল।

আমি অবাক বিস্ময়ে  তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।

সুলতা- নারীর প্রতি পুরুষের মোহ যদি পাপ হয় তবে পাপদৃষ্টি দিয়েই আমি তাকিয়েছিলাম তার দিকে। বিলেতে হারা রে এবং লরা নাইট অথবা শম্পা রে’র সঙ্গে দেখা হওয়ার পর থেকে তরুণী নারীর দিকে মোহ নিয়ে তাকাতে গেলেই কেমন দৃষ্টি-বিভ্রম ঘটত আমার; ধীরে ধীরে তার মুখে চোখে রঙে হাসিতে অশ্রুতে রায়বংশের কারুর না কারুর আদল ভেসে উঠত, জীবন আমার শামুকের মত খোলার মধ্যে গুটিয়ে যেত; এই প্রথম কুইনির সামনে তার ব্যতিক্রম ঘটল।

মনে পড়ল, মেদিনীপুরের বাসায় ওকে দেখে আমার জীবনে সর্বপ্রথম এই মোহময় বাসনা জেগেছিল। প্রথম যৌবনে তোমাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখেছিলাম, কিন্তু জীবনের বাসনা এমনভাবে জোয়ারে উচ্ছ্বসিত হয়ে অজস্র ফেনা মাথায় করে ফুলে-ফেঁপে ওঠে নি। আদিম মৌলিক দেহবাদের প্রথম উচ্ছ্বাস। রায়বংশে পুরুষ থেকে পুরুষান্তরে ধর্ম শক্তি ও সম্পদের লালনে এই দেহবাদ দুর্দান্ত-দুর্দমনীয় হয়ে রক্তের মধ্যে মিশে ছিল, আজ তাতে প্রবল জোয়ার এসেছে। মেদিনীপুরের বাসায় সেদিনের উচ্ছ্বাসের প্রথম জাগরণ

এবার দু বছর পরে কুইনি আরও মোহময়ী হয়ে উঠেছে আমার চোখে।

আমার প্রপিতামহ রায়বাহাদুরের অতৃপ্ত কামনা যেন আমার এই কামনার মধ্যে ফুটেছে।

আমার পিতামহ দেবেশ্বর রায়ের ভায়লেটের প্রতি যে কামার্ততা, তা যেন আমার বুকের মধ্যে আগ্নেয়গিরির মত অগ্ন্যুদগার করছে।

ওকে না পেয়েই জীবন আমার শূন্য হয়ে রয়েছে।

ওর উপর অধিকার রয়েছে। ও আমার অঞ্জনার মেয়ের বংশের মেয়ে, দেবেশ্বর রায়ের প্রথম ভালবাসার (হোক সে অবৈধ ভালবাসা) ফল, প্রথম সন্তানের দৌহিত্রী। ওকে আমিই লেখাপড়া শিখিয়ে এমন রূপে ফুটিয়েছি, ও আমার। ওকে আমার পেতেই হবে। মনে পড়ল, গতবার পুলিসের হাত থেকে রায়বংশের সন্তানদের এবং এই গ্রামের লোকেদের, বিশেষ করে রঙলাল ঘোষকে বাঁচাবার জন্য বলেছিলাম- “আমার কুইনির ওপর দুর্বলতা আছে।”

সে কথাটা আমি মিথ্যা বলি নি। সে কথা সত্য।

কুইনিকে দেখছিলাম। আর মনে হচ্ছিল—।

থামল সুরেশ্বর। চোখ বুজে মনে মনে কোন ভাবনা বা চিন্তাকে উপভোগ করলে সে, মুখে ক্ষীণ রেখায় একটু হাসি ফুটে উঠল। একবার ঘাড়ও নাড়লে, মনে মনে কোন মধুর চিন্তা উপভোগ করার আনন্দে। তারপর বললে—তুমি গিরিশবাবুর বিল্বমঙ্গল পড়েছ বা অভিনয় দেখেছ সুলতা? আমি পড়েছি, অভিনয়ও দেখেছি এ্যামেচারে। তাতে চিন্তামণির রূপ এবং দেহ-মোহে অন্ধ বিশ্বমঙ্গল বাপের শ্রাদ্ধের দিন শ্রাদ্ধ করেই চিন্তামণির বাড়ী রওনা হচ্ছে দুর্যোগ মাথায় করে। তুফানে প্রলয়ঙ্করী নদী, খেয়াঘাটে নৌকা নেই, কিন্তু তা উন্মত্ততার কাছে বাধা নয়। সে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে কাঠ বলে একটা গলিত শবকে আশ্রয় করে নদী পার হল। বাড়ির পাঁচিলের গর্তে মুখ ভরানো সাপের লেজ ধরে পাঁচিলে উঠে চিন্তামণির ঘরে এল। চিন্তামণির বিস্ময়ের সীমা রইল না। সে উঠে সব দেখে বললে—তুমি কি? বিশ্বমঙ্গল তার মুখপানে ই অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে, কোন ভ্রূক্ষেপ নেই, অন্য কথা নেই, শুধু একটি কথা—“চিন্তামণি, তুমি অতি সুন্দর! তুমি অতি সুন্দর!”

আমি ঠিক সেই ভাবেই কুইনির দিকে তাকিয়ে ছিলাম।

আশ্চর্য মোহ কুইনির সর্বাঙ্গে। তার রুক্ষ চুলে, তার রুক্ষ সৌন্দর্যে। উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের মধ্যে ঈষৎ একটা বিদেশী ফ্যাকাশে আভাস। তার আয়ত চোখের শুভ্রচ্ছদের মধ্যে ঈষৎ নীলাভা, তার চোখের তারা কালো নয় পিঙ্গল; তাও আমার কাছে অপরূপ বলে মনে হল।

আমি তার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম।

পুরাণের কাল হলে বলতাম, আমি মদন-বাণ-বিদ্ধ, জর্জরিত। অতি-বাস্তববাদীর ভাষায় আমি তখন আদিম-কামনায় আদিম মানুষের মতই কামার্ত।

কুইনি আমার সে-দৃষ্টির সম্মুখে কেমন যেন ভীতার্ত হয়ে উঠল, বোধ করি আমার দৃষ্টির উত্তাপ তাকে গলাতে চাচ্ছিল। ভয়ে সে নিজের পাশের দিকে চকিতদৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে নিলে, তার সঙ্গী বৃদ্ধ পাদরী বসে আছেন কিনা। তাঁকে দেখে আশ্বস্ত হয়ে আমাকেই তিরস্কার করে তাঁকে বললে—উঠে আসুন ফাদার। উনি শুধু অসভ্যই নন, উনি বর্বর। ওঁকে আমি ঘৃণা করি। আই হেট হিম।

আমার দিকে তাকিয়ে বললে—আর আপনি আমাদের এমন করে অপমান করবেন না। ভায়লেট পিদ্রুজের আত্মাকে শান্তিতে কবরের তলায় ঘুমুতে দিন।

আমি শুধু একটা কথা বলেছিলাম—আমাকে তুমি ভুল বুঝো না কুইনি। তুমি আমার উপর অবিচার করছ। অপমান আমি তোমাদের করি নি। আমার পিতামহ ভায়লেট পিদ্রুজকে ভালবাসতেন এবং ভায়লেটও তাঁকে ভালবাসত।

কুইনি দাঁড়ায় নি, শুনতে চায় নি সে এ-কথা, দ্রুতপদে বেরিয়ে চলে গিয়েছিল। এতক্ষণে বৃদ্ধ পাদরী আমাকে বলেছিলেন—কুইনি ঠিক বলেছে সুরেশ্বরবাবু, কেন একটি দুঃখিনী মেয়ের অশান্ত আত্মার গলায় কলঙ্কের মণিহার পরিয়ে তাকে আরও দুঃখ দেবেন, লজ্জা দেবেন! তাছাড়া আর একটা কথা বলি—। আপনি গোয়ানদের জন্যে অনেক কিছু করেছেন। এই চার্চের জন্য জমি দিয়েছেন, অর্থও দিয়েছেন। তাই আপনার মঙ্গলের জন্যই বলছি, ওরা অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছে। কিছু করতে গেলে হয়তো গোয়ানরা আপনার অনিষ্ট করবে।

* * *

তাতে আমি ভয় পাই নি সুলতা। তখন রায়বংশের রক্ত আমার মধ্যে জেগে উঠেছে। ভয় আমি গোয়ানদেরও পাই নি, কীর্তিহাটের লোকদেরও পাই নি—আমি ঠাকুমার শ্রাদ্ধে দু’হাত খুলে খরচ করেছিলাম। ব্রাহ্মণদের ভোজন-দক্ষিণা দিয়েছিলাম, দীয়তাং ভুজ্যতাং রব তুলেছিলাম ভোজন আয়োজনে।

তখনও ১৯৪১ সাল সুলতা। জ্যৈষ্ঠ মাস। তখনও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ ইয়োরোপ-আফ্রিকায় সীমাবদ্ধ; ফ্রান্স পড়েছে। ডানকার্ক থেকে ইংরেজ কোনও রকমে প্রাণ-মান বাঁচিয়ে ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে ইংল্যান্ডে এসেছে। হিটলার বলকানে ঢুকেছে। আফ্রিকায় নতুন ফ্রন্ট খুলেছে। আবিসিনিয়ায় ইটালীয় বাহিনীর সঙ্গে  তার শুরু। তখনও ভারতবর্ষে তার আঁচ পৌঁছোয় নি, জিনিসপত্রের বাজারে ধানচালের গোলায় কন্ট্রোল বসে নি; তখনও বাজার সস্তাগণ্ডা, তখনও শ্রাদ্ধে বিবাহে ক্রিয়াকর্মে বাধানিষেধ নেই। আমি প্রচুর আয়োজন করে ঠাকুমার শ্রাদ্ধ সমারোহের সঙ্গে সুসম্পন্ন করলাম।

পরামর্শটা দিলেন বড়জ্যাঠামশাই।

যজ্ঞেশ্বর রায়। দেবেশ্বর রায়ের জ্যেষ্ঠপুত্র; রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায়ের প্রিয়তম পৌত্র। রায়বংশের মধ্যে নারী সম্পর্কে রত্নেশ্বর রায়ের পর সংযমী পুরুষ। তিনি হাই ব্লাডপ্রেসার নিয়েও এসে শ্রাদ্ধ করে চলে গেলেন। মায়ের শেষকৃত্য করে প্রায়শ্চিত্তই শুধু করলেন না, উমা দেবীর গহনার অর্ধেক ভাগ নিয়ে চলে গেলেন। তিনিই পরামর্শ দিলেন।

বললেন—রায়বাহাদুর বলতেন, যেখানে চামড়ার জুতো চলে না, সেখানে চাঁদির জুতো চালাতে হয়। পথের ধুলোর উপর হাঁটবে, তখন চামড়ার জুতো পরো, মানুষের মাথার উপর দিয়ে হাঁটতে হলে রূপোর জুতো তৈরী করে পরো, দেখবে মানুষগুলো মাথা পেতে দিয়ে বলবে—আমার মাথায় পা রাখুন। টাকা তোমার আছে সুরেশ্বর, তাই খরচ করে তিনি যা বলে গেছেন তাই কর। যখন করতে নেমেছ তখন পিছিয়ো না। টাকায় সব হয়।

তর্ক নিশ্চয় উঠবে। এবং কথাটাও নিশ্চয় সত্য নয়। কিন্তু তখন সত্য মনে হয়েছিল, সত্য হয়েও উঠেছিল। শ্রাদ্ধে কোন বাধা আসে নি। তবে হ্যাঁ, গোয়ানপাড়া নিমন্ত্রণ নেয় নি। কিন্তু কিছু দরিদ্র গোয়ানরা গোপনে এসে মিষ্টি খেয়ে গিয়েছিল।

শুধু তাই নয়, সঙ্কল্প যা করেছিলাম তা কোনটা অপূর্ণ থাকে নি, তা রাখি নি আমি। শ্রাদ্ধের পরদিনই কাঙালী-বিদায় কাঙালী ভোজনের মধ্যে আর একটি অনুষ্ঠান করেছিলাম। রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায় চ্যারিটেবল ডিসপেন্সারীর সঙ্গে দেবেশ্বর রায় হসপিটালের পত্তন করেছিলাম। তাতে উমা দেবীর নামে চারটে বেড। আর একটা বেড ছিল অহিন্দুদের জন্য রিজার্ভড। তার নাম কি হবে তা বলি নি, তবে বুঝতে কারুর বাকি থাকে নি ওই বেডটি শেষ পর্যন্ত কার নামে হবে। তবু কেউ জিজ্ঞাসা করে নি বা করতে সাহস করে নি।

অতুলেশ্বর জিজ্ঞাসা করেছিল—এই বেডটা কি—

বলেছিলাম—অহিন্দু ক্রীশ্চান মুসলমানদের জন্যে থাকবে।

—কার নামে হবে?

—অনুমান করতে তো পেরেছ। কিন্তু ওতে আপত্তি করলে হাসপাতাল আমি এখানে করব না। আশা করি এতে তোমাদের জোর খাটবে না।

অতুলেশ্বর চুপ করেছিল। গোয়ানরা কেউ আসে নি। তবে আলোচনা করেছিল। তাতে তারা অখুশীত্ব প্রকাশ করে নি। খুশী হয়েছে এইটে গোপন করেছিল।

আর একটা মন্দির গড়েছিলাম। গড়েছিলাম সিদ্ধাসনের জঙ্গলে, ছোট একটি মন্দির তৈরী করিয়েছিলাম—পনের ফুট উঁচু মন্দির। যে-ঘরটায় শ্যামাকান্ত মনোহরা যোগিনীকে নিয়ে শক্তিসাধনা করেছিলেন বা শক্তিসাধনার নামে ব্যভিচার করেছিলেন, যে ঘরে সতেরো বছরের তরুণ কন্দর্পের মতো দেবেশ্বর রায় চোদ্দ-পনেরো বছরের কিশোরী ভায়লেটের সঙ্গে প্রথম মিলিত হয়েছিলেন দেবেশ্বর রায়ের মৃত্যুর পর যে ঘরে চালের কাঠে দড়ি বেঁধে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল ভায়লেট, সেই ঘরের ভাঙা দেওয়ালগুলোর ভিতে ভিত খুঁড়ে মন্দিরের পত্তন করেছিলাম। সিদ্ধাসনের একটি মার্বেলের বেদী তৈরি করিয়ে দেবার সংকল্প করেছিলাম।

বোধ হয় তোমার মনে আছে, ওই সিদ্ধাসনে পূজো শুধু হিন্দুরাই দিত না, গোয়ানরাও দিত; হিন্দুরা পাঁঠা বলি দিত বিজয়াদশমীর দিন—গোয়ানরা নৈঋত কোণে একটা নির্দিষ্ট জায়গায় মুর্গী বলি দিত।

বাতাসা-মণ্ডার পূজা ভোগ দিতে তারা বেদীর কাছে এসে নামিয়ে দিত। ১৯৪১ সাল ‘৪২ সাল পর্যন্তও দিয়েছে।

৪১ সালে হাসপাতালের সঙ্গে ভিত পত্তন করেছিলাম এবং মনে মনে সংকল্প করেছিলাম—মন্দির সম্পূর্ণ হলে ওই মন্দিরের মেঝেতে বেদীর নীচে একটা মার্বেল ট্যাবলেট বসিয়ে দেব, যাতে লেখা থাকবে—যে-নারী তাঁর প্রেমাস্পদের মৃত্যুতে বিরহ সহ্য করতে না পেরে এখানে স্বেচ্ছায় দেহত্যাগ করেছিলেন, তাঁর অক্ষয়স্বর্গ হয়েছে এই সিদ্ধাসনের প্রসাদে।’

মুখে সঙ্কল্প প্রকাশ করি নি। গোড়ায় কেউ বুঝতেও পারে নি।

***

এক বছর পর।

১৯৪২ সাল, অক্টোবর মাস। তখন মেদিনীপুর দাউ-দাউ করে জ্বলছে। আগস্ট মুভমেন্ট আরম্ভ হয়ে পূর্ণ বেগে চলেছে। ভারতবর্ষে বৃটিশ সাম্রাজ্যের ভিত্তিভূমি বাংলা দেশে—সেই বাংলা দেশের মেদিনীপুর জেলায় তখন থানা পুড়ছে, সরকারী আপিস পুড়ছে। বড় বড় বাঁশের ডগায় তেরঙ্গা ঝাণ্ডা উড়ছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে মেদিনীপুর বৃটিশ সাম্রাজ্য থেকে। সেই সময় এই মন্দিরে কীর্তিহাটের কড়চার রায়বাড়ীর জবানবন্দীর শেষ ঘটনা ঘটল।

ওই মন্দিরেই আমার কাঁধে একজন গোয়ান ছুরি মারলে।

বিচিত্র ঘটনা। আমার জবানবন্দীর শেষ ঘটনা।

রক্তে মন্দিরের মেঝের সাদা মার্বেল লাল হয়ে গেল। এবং তাতেই ধুয়ে গেল দেবেশ্বর রায়ের অপরাধ। তাতেই আমি মুক্তি পেলাম শ্যামাকান্তের অভিশাপ থেকে। তখন বঙ্গোপসাগরে সাইক্লোন আসছে। পরের দিনই মেদিনীপুরের সমুদ্রকূলে তুফান তুলে ঢুকবে। তাতেই ধ্বসে যাবে বৃটিশ সাম্রাজ্যের ভিতের মূল পাথরটা, ফেটে যাবে।  তার সঙ্গে সঙ্গে রায়বাড়ীর তিন-মহলা বাড়ীও ভাঙবে, ফাটবে।

ঘটনাটা ঘটল পঞ্চমীর দিন সন্ধ্যায়।

১৯৪২ সালের আশ্বিনের দুর্গাপঞ্চমী। আকাশে তখনও মেঘের কোন ঘটা নেই, কোন ইশারা নেই, বঙ্গোপসাগরে কোথায় কোন্ দিগন্তে বায়ুমণ্ডলের নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়েছে তা কেউ জানে না, হয়তো প্রকৃতি নিজেও সচেতন নন; শরতের আকাশে মেঘরৌদ্রের খেলা চলেছে; পুজোর ঢাক তখন ভোরবেলা আর সন্ধ্যেবেলা একবার করে বেজে যায়; তাকে ধুমূল দেওয়া বলে।

১৯৪২ সালে মেদিনীপুরের অবস্থা তখন ভয়ঙ্কর। আগস্ট মুভমেন্ট আরম্ভ হয়ে গেছে।

ইয়োরোপের যুদ্ধ পশ্চিম থেকে পূর্ব দিগন্তে ছিটকে এসে পড়েছে। পার্ল হারবার থেকে শুরু করে জাপানীরা হংকং সিঙ্গাপুর কেড়ে নিয়ে গোটা বার্মা মুলুকটাই ছিনিয়ে নিয়েছে। ইংরেজের পল্টন হ’টে হ’টে ক্লান্ত হয়ে খেতে খেতে ঘুমিয়ে পড়তে পড়তে কোন রকমে ইন্ডিয়াতে এসে হাঁফ ছেড়েছে। ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলও কেড়ে নেবে আন্দাজ করে রিট্রিটের প্ল্যানিং করে ফেলেছে। মেদিনীপুর সমুদ্রকূল অঞ্চলে নৌকো সাইকেল এসব ইংরেজ সরকার কেড়ে নেবার নোটিশ দিয়েছে। এরই মধ্যে কংগ্রেস কুইট ইন্ডিয়া রেজলুশন নিয়ে বলেছে—“ভারতবর্ষ ছেড়ে তোমরা চলে যাও।” অন্য দিকে বাজারে জিনিসপত্রের দর হু-হু করে চড়তে শুরু করেছে।

বাংলা দেশে কলকাতা থেকে শুরু করে আসাম অঞ্চল পূর্ববঙ্গ জুড়ে ইংরেজ এবং আমেরিকান সৈন্যে ছেয়ে গেছে।

এরই মধ্যে কুইট ইন্ডিয়া রেজলুশন থেকে আগুন লেগে গেল দেশে। গোটা ভারত বর্ষেই লাগল আগুন কিন্তু বাংলা দেশে মেদিনীপুর জেলা হয়ে ছিল বারুদের গাদা। সেই গাদায় বিস্ফোরণ ঘটে গেল।

মেদিনীপুরের আত্মার প্রতীক মাতঙ্গিনী হাজরা—তিনি থানা দখল করতে গিয়ে গুলি খেয়ে মারা গেলেন। কিন্তু থানার দখল দিয়ে গেলেন সাধারণ মানুষদের হাতে। কীর্তিহাটের দখল নিয়ে বসল কীর্তিহাট কংগ্রেস, কংগ্রেসের সভাপতি রঙলাল ঘোষের ছেলে, সেক্রেটারী অতুলেশ্বর রায়।

থানার দারোগা পালিয়েছিল —কনেস্টবলেরাও পালিয়েছিল—একজন এ-এস-আই ধরা পড়ে দেশী সরকারের হাতে অ্যারেস্টেড হয়েছিল। সঙ্গে সঙ্গে যারা ইংরেজপক্ষের লোক তারা হয়েছিল নজরবন্দী। তার মধ্যে ছিলাম আমি। আমি জমিদার; আমি এর আগে মেজদির কেসে এবং অতুলেশ্বরের কেসে কংগ্রেসকে সাহায্য করেছি বটে তবুও বার বার হুকুম অমান্য করেছি। আর নজরবন্দি হল গোটা গোয়ানপাড়ার লোকেরা। যে সব লীগপন্থী মুসলমান আনাগোনা করছিল তারা অদৃশ্য হয়ে গেল। ফিরে গেল আপন আপন নিরাপদ আস্তানায়।

তখন সবে হাসপাতাল তৈরি শেষ হয়েছে; বিছানাপত্র এবং সরঞ্জামও এসেছে কিন্তু অনুষ্ঠান করে উদ্বোধন হয় নি। পূজোর আগেই উদ্বোধনের কথা—উদ্বোধনের জন্য জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এম এম খানের আসবার কথা। কিন্তু বিপ্লব বল বিপ্লব, বিদ্রোহ বল বিদ্রোহ তার আগুন জ্বলবার পরই আমার উপর পরওয়ানা জারী হল—হাসপাতাল অবিলম্বে খোলা হবে। ওপেন করবেন কংগ্রেস সভাপতি।

হাসপাতালের জরুরী প্রয়োজন। আহত হচ্ছে যারা তাদের চিকিৎসা চাই।

তাই হ’ল। আমি সেদিন হাত জোড় করে কংগ্রেস সভাপতিকে আহ্বান করে বললাম —আপনি যে অনুগ্রহ করে এই দেবেশ্বর রায় হাসপাতাল উদ্বোধন করতে সম্মত হয়েছেন তাতে রায়বংশ এবং আমি কৃতকৃতার্থ। আপনি জননায়ক

জিভে আটকায় নি। সংকোচও বোধ করি নি সুলতা। বরং যেন কিছুটা খুশিই হয়েছিলাম। তবে স্বাচ্ছন্দ্য বোধও করি নি। কারণ এদের দলে আমার স্থান অনেক নিচে এটা মনে করে আড়ষ্ট হয়ে জীবনের ছন্দে সহজ উল্লাস আসবে কি করে বল। তবে আনুগত্যের শপথ নিয়েছিলাম। বিনিময়ে অস্থায়ী স্থানীয় সরকার আমাকে বন্দী করে ঘরে আবদ্ধ রাখে নি বটে তবে নজরন্দীত ক’রে রেখেছিল। গতিবিধি সীমাবদ্ধ ছিল গ্রামের মধ্যে। চিঠি লেখা বারণ ছিল। আরও বাধানিষেধ ছিল কিছু কিছু। আমি এরই মধ্যে চেয়েছিলাম ওপারে সিদ্ধাসনের মন্দিরে যাওয়ার অধিকার। আমি একটা অজুহাত অনেক খুঁজে খুঁজে বের করেছিলাম। ওই সিদ্ধাসনের মন্দিরে আমি ফ্রেস্কোর মত ছবি আঁকব।

প্রার্থনা আমার মঞ্জুর করেছিলেন কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট। কারণ গোটা গোয়ানপাড়াটা গত দু’বছরের ভোট ঝগড়া থেকে সন্দেহভাজন হিসেবে তখন সতর্ক স্বেচ্ছাসৈনিকদের কড়া পাহারায় রয়েছে। এবং আমি নজরবন্দী হলেও বিশেষ সম্মানিত নজরবন্দী। আমার দেওয়া হাসপাতালেই কংগ্রেসী স্বেচ্ছাসেবকদের চিকিৎসা হচ্ছে। এমন কি প্রেসিডেন্ট নিজেই ওপেনিংয়ের সময় ওই অহিন্দুদের জন্য সংরক্ষিত বেডটির নামও ঘোষণা করেছেন—ভায়লেট পিদ্রুজ বেড। কিন্তু রিজার্ভড রাখার শর্তটি তুলে দিয়েছেন। স্বাধীন ভারতবর্ষে ওই জাতিভেদ চলবে না। বলেছেন—হিন্দু মুসলমান ক্রীশ্চান ভেদ আমাদের নেই, তারা আমাদেরই আপন লোক। তবে বিশ্বাসঘাতকতা কারুরই বরদাস্ত করা হবে না।

গোয়ানরা বলতে কিছু পারে নি, সাহস করে নি। তারা তখন হেরে গেছে, তখন গোটা পাড়াটাই কড়া পাহারায় বাস করছে। কোন অসম্মান নেই কোন নির্যাতন নেই। তবে বাইরের লোক ভিতরে আসতে পারে নি, ভিতরের লোক বাইরে অর্থাৎ গ্রামের বাইরে যেতে পায় না। বাইরে যে কাজ থাক বা বাইরে থেকে যে জিনিসের প্রয়োজন হোক তা করে দেয় বা এনে দেয় কংগ্রেসের স্বেচ্ছাসেবকরা।

এই বিচিত্র অবস্থার মধ্যে নিত্য আমি যেতাম সিদ্ধাসনের নতুন মন্দিরে ছবি আঁকতে। কিন্তু আঁকা হত না। কি আঁকব ভেবে পেতাম না। কল্পনার মধ্যে ক্রমাগত দেবেশ্বর রায় ও ভায়লেট পিদ্রুজের ছবি ভেসে উঠত। আঁকতে ইচ্ছে হত দেবেশ্বর এবং ভায়লেটের প্রথম মিলন দৃশ্য এবং ভায়লেটের ও দেবেশ্বর রায়ের মৃত্যুদৃশ্য।

সে ট্যাবলেটটা তখনও বসানো হয় নি। সেটা কলকাতায় বরাত দেওয়া ছিল, এসে পৌঁছয় নি।

আগস্ট মাস থেকে অক্টোবর—দুর্গাপঞ্চমীর দিন পর্যন্ত নিত্য যেতাম। ছবি আঁকার অজুহাতে, কিন্তু ছবি আঁকতে নয়। যেতাম আমি কুইনিকে দেখতে।

আমার জবানবন্দীতে আমি মিথ্যা বলব না। এর আগেই আমি বলেছি—ঠাকুমার শ্রাদ্ধের সময় যখন কুইনিকে দেখেছিলাম তখন থেকেই আমি  তার মোহে আচ্ছন্ন, তার কামনায় আমি প্রমত্ত এবং কায়িক মিলনের কামনার সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক নিকট এবং নিগূঢ় বলে তার প্রেমেও আমি প্রেমার্ত বলতে দ্বিধা করছি নে।

কুইনি আমাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। বলেছে সে আমাকে ঘৃণা করে, কিন্তু আমি তাতেও তিক্ত হই নি, বিমুখ হয় নি, প্রত্যাখ্যানেও আমি আহত হই নি, তার উপর ক্রুদ্ধ হতে পারি নি। বরং উল্টো হয়েছিল, আমি আরও বেশী করে আকৃষ্ট হয়েছি। নিত্য সে প্রেম, সে কামনা তিলে তিলে বেড়ে সে তিলোত্তমার মত সম্পূর্ণ হয়ে প্রাণপ্রতিষ্ঠার প্রতীক্ষায় আছে।

মন্দির শুরু করবার পর থেকেই আমি কাজ দেখবার অছিলায় নিত্য যেতাম। তখনও আগস্ট মুভমেন্ট আরম্ভ হয় নি। তখনও গোয়ানপাড়া ও কীর্তিহাটের লোকেদের সঙ্গে রেষারেষি বেধে চলেছে। আমিও তখন জমিদার। স্বাধীন আমার গতিবিধি। প্রয়োজন ছিল কিনা জিজ্ঞাসা করলে বলব—আমার মত লোকের পক্ষে যাবার কোন প্রয়োজন ছিল না। কারণ এমন করে দাঁড়িয়ে থেকে নিজে তদারক করে কাজ করানো আমার স্বভাবের বাইরে, কখনও করাই নি। হিসেবীও আমি নই। বাবা এত প্রচুর রেখে গিয়েছিলেন যে হিসেব আমাকে করতে হত না। প্রায় শেষ করে এনেছি—তবুও ছিল। ঠাকুমার মৃত্যুর পর হাসপাতাল পত্তন করে ওখানেই থেকে গেলাম। গিয়েছিলাম যে সব আকর্ষণে তার মধ্যে দুটো আকর্ষণ বড় ছিল—একটা ছিল জমিদারীর জেদের আকর্ষণ আর একটা কুইনির আকর্ষণ। কুইনিকে দেখতে পাব। তার উপরে নেশা ধরে গেছে আমার। জীবন কামনার্ত হয়ে তাকে চাচ্ছে।

আমার চোখে তখন কুইনির রূপ এক আশ্চর্য রূপ।

কিন্তু কুইনি কাঁসাই পার হয়ে কীর্তিহাটে আসত না। গোয়ানরাও না।

কুইনির এবং বৃদ্ধ পাদরীটির ব্যবস্থায় ওরা এই কীর্তিহাটের সঙ্গে ভোটের ঝগড়া থেকেই একটা সংগঠন গড়ে তুলেছিল। ঠাকুমার শ্রাদ্ধে ভায়লেট পিদ্রুজ আর দেবেশ্বর রায়ের সম্পর্ক নিয়ে ঝগড়াটাকে আরও পাকিয়ে তুলে নিজেদের সংগঠনটিকেও শক্ত করে তুলেছিল। কীর্তিহাটে তারা আসত না। এখানকার ফ্রি প্রাইমারী স্কুলে ছেলে-মেয়েদের পাঠাতো না। এখানকার গার্লস স্কুলে মেয়েরা যারা পড়তে আসত, তাদেরও ছাড়িয়ে নিয়ে কুইনি নিজে একটা কোচিং ক্লাস খুলেছিল। এমন কি কীর্তিহাটের দোকানে জিনিসপত্র কেনাও বন্ধ করে গ্রামেই একটা মুদীর এবং একটা ছোটখাটো মনিহারীর দোকান খুলেছিল। এ গ্রামে প্রয়োজন হলে যখন কাউকে আসতে হত তখন দু’তিনজন মিলে আসত। কীর্তিহাটের লোকেরা যেতে হলে পাঁচ-সাতজন মিলে দর্পভরে যেত। গোমেশ ডিক্রুজ আমার বাড়ির চাকরি ছেড়ে দিয়েছিল। আমি যখন জমিদারীর নেশায় কুইনির আকর্ষণে ওখানে থাকতামস্, তখন কলকাতা থেকে দু’জন নেপালী দারোয়ান রেখেছিলাম। কিছুদিন পর আরও একজন ওখানকার দুর্ধর্ষ লাঠিয়ালকেও রেখেছিলাম। দস্তুরমত জমিদারী আসর সাজিয়ে বসে, ঠাকুমার স্মৃতিরক্ষার কাজটাকে আশ্রয় করে ওখানে কুইনিকে জয় করতে চেয়েছিলাম। এ নেশা সম্ভবতঃ সংসারে সব নারীপুরুষই যৌবনকালের সঙ্গে অল্প হলেও করে থাকে কিন্তু নেশা যাকে ধরে তার আর নিষ্কৃতি থাকে না। মদ অনেকে খায় কিন্তু মদে খাওয়া বলে একটা কথা আছে, মদে যাকে খায় তার যেমন আর নিষ্কৃতি থাকে না, এক্ষেত্রেও ঠিক তাই। নারীকে দেখে পুরুষের ভাল লাগে কিন্তু যে পুরুষ কোন বিশেষ নারীর নেশায় পড়ে তার আর ঘৃণা থাকে না, লজ্জা থাকে না, ভয় থাকে না, তার জন্য সে অপমান গ্রাহ্য করে না, আঘাত গ্রাহ্য করে না, সব কিছুকে মাথায় করে নিয়েও তাকে পেতে চায়। আমি কুইনিকে তেমনি করে চেয়েছিলাম।

ওই দারোয়ানদের একজনকে সঙ্গে করে ওই সিদ্ধাসনের মন্দিরের কাজ দেখতে যেতাম। দেখতে যাওয়ার গুরুত্বের উপর জোর দেবার জন্য উড়িষ্যা থেকে পাথরের কারিগর এনে পাথরের কাজ করাবার প্ল্যান জুড়ে দিয়েছিলাম। এবং ওই মন্দির থেকে একটু সরে লাঠিয়াল বাগ্দীদের একটা পল্লী বসিয়েছিলাম, জমি দিয়ে, ঘর করবার খরচ দিয়ে, যেন গোয়ানরা মন্দিরটার ক্ষতি না করে, ভেঙে না দেয়।

গোয়ানরা আসত একটা সীমানা অবধি। তারা সেখান থেকে দাঁড়িয়ে দেখত। এদের সঙ্গে একবার না একবার কুইনি আসতো। আমি একখানা চেয়ার পেতে বসে থাকতাম এই সময়টুকুর জন্য। কুইনিকে দেখে মন তৃপ্তিতে ভরে যেত।  তার দিকেই তাকিয়ে থাকতাম। সে সহ্য করতে পারত না আমার দৃষ্টি, বেশ একটু উত্তপ্ত হয়েই সে চলে যেত। আমার চিত্ত দ্বিগুণ অতৃপ্ত হয়ে উঠত। কিছুদিন সে একেবারেই আসত না। আমি অশান্ত অতৃপ্ত মনে সারাক্ষণ বসে থেকে ফিরে আসতাম অপরাহ্ণে। রাত্রে ঘুমুতে পারতাম না। মদ্যপান করে ঘরে বসে হয় বাঁশের বাঁশী নয় তো বেহালা নিয়ে সেই ছবির ঘরে বসে সুর তুলতাম। গভীর রাত্রি পর্যন্ত বাজত আমার বাঁশী, অথবা আমার বেহালা। লোকে আমাকে ঘৃণা করতে শুরু করেছিল। কারণ আমার মনের কথা আমি ঢেকে রাখি নি আবরণ দিয়ে। আবার জবরদস্তি করে উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করেও কিছু বলি নি, যার জন্যে লোকে আমাকে শাস্তি দিতে পারে।

বেশ কিছুদিন না আসার পর কুইনি একদিন এল। আমার মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল বোধ হয়। ওদের সীমানা রেখার ওপাশে দাঁড়িয়ে বললে—শুনুন!

আমি উঠে গেলাম।

তীব্র ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বললে-আপনি এখানে কেন আসেন? কিসের জন্য?

মন্দির দেখতে আসি বলি নি আমি। আমি বলেছিলাম—আমার ভাল লাগে বলে আসি। স্থানটিকে আমি ভালবাসি। এবং—

—কি?

—থাক সে কথা, অনুক্তই থাক।

—আপনি অতি ইতর। বলে সে চলে যেতে যেতে বলেছিল—আর আসবেন না।

—আমি আসবো।

আমার কথা সে শোনে নি, সে চলে গিয়েছিল।

কিছুদিন পর অতুল এসে একদিন বললে-সুরেশ্বর, এতকাল পর তুমি সত্যিই জমিদার রায়বংশের ধারা ধরলে। জ্যাঠামশাই দেবেশ্বর রায়ের পার্টটা রাখবার জন্য কোমর বেঁধে লাগলে শেষ কালটায়!

বেশ খোশমেজাজে ছিলাম। অর্থাৎ নেশার মৌজে। বললাম- তোমার নীল রক্ত দেউলে হয়ে লাল হয়ে গেছে অতুল খুড়ো। যে মাথা তাজ পরে সেই মাথা কাটা যায়, তাই বলে তাজ পরতে কেউ ছাড়ে না। দরকার হলে মাথাটা দেব গো।

অতুল বলেছিল—তার দেরী নেই সম্ভবতঃ—কারণ আগস্ট তখন সামনে। আগস্টের প্রথমেই কংগ্রেস কুইট ইন্ডিয়া মুভমেন্ট রেজলুশন নিলে।

দেখতে দেখতে দেখতে সারা ভারতবর্ষে আগুন জ্বলল। বাংলাদেশে জ্বলল প্রথম মেদিনীপুরে। মাতঙ্গিনী হাজরার রক্ত দিয়ে সিক্ত মাটির উপর স্বাধীন ভারতের পতাকাদণ্ড পোঁতা হল। মেদিনীপুরে ব্রিটিশ সরকারের অধিকার উচ্ছিন্ন হয়ে গেল। পল্টন ছেড়ে দিয়ে ইংরেজ আবার তাকে কায়েম করতে চেয়েছে, বাইরে দেখানোর মত দখলও একটা নিয়েছিল বটে কিন্তু আর মেদিনীপুরে ঠিক ইংরেজ রাজত্ব কায়েম হয় নি।

সেই সময়ে মন্দিরের পাথর বসানোর কাজ হচ্ছিল। একটা কথা বলতে ভুলেছি, প্রথম যখন মাপ অনুযায়ী লালচে পাথরের স্ল্যাবগুলি এল তখন একটা বিস্ময়ের সাড়া পড়ে গিয়েছিল চারিদিকে। পাথর বসাচ্ছে মন্দিরে! আশ্চর্য মন্দির তৈরী হচ্ছে!

গোয়ানপাড়ার লোক আগে এসেছিল। ভিড় করে দাঁড়িয়ে তারা দেখেছিল। কিছুক্ষণ পর অনেকদিন পর এসেছিল কুইনি। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখে সে চলে গেল।

পাথরের স্ল্যাবগুলির উপর নক্সার ডিজাইন আমি নিজে করে দিয়েছিলাম। রায়বাড়ীর কথা কীর্তিহাটের কড়চার একটা খসড়া আমি তার মধ্যে ফুটিয়ে দিতে চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু নক্সার মূল ডিজাইনটা ছিল লতার মধ্যে বিকশিত পদ্মের সারি। যদি কোনদিন কীর্তিহাট যাও তুমি দেখে খুশী হবে এ কথা বলতে পারি।

ওই নক্সা যখন দেওয়ালের গায়ে রূপ নিয়েছে, স্ল্যাবগুলি বসানো হয়েছে, তখন একদিন বেড়ার ওপাশে দাঁড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ দেখে আমাকে ডাকলে, বললে—শুনুন!

গেলাম। সে বললে—এত সুন্দর মন্দির তৈরী করছেন কেন? কিসের, কার মন্দির?

আমি বললাম—উপলক্ষ্য হিসেবে সবাই যা বলে তাই, সিদ্ধাসনের দেবী যোগিনীর মন্দির। যাঁর পুজো হয় বিজয়াদশমীর দিন, বাসন্তীপূজার সময়। আসলে এ মন্দির আমি উৎসর্গ করছি একটি ভালবাসার উদ্দেশে। এখানে একটি তরুণ একটি তরুণীকে প্রথম ভালবেসে মিলিত হয়েছিল, এবং পরে ওই প্রেমাস্পদের মৃত্যুতে মেয়েটি স্বেচ্ছায় মৃত্যুকে ডেকে তাঁকে পেতে চেয়েছিল। তারই জন্যে এত সুন্দর করে গড়ছি।

স্থিরদৃষ্টিতে মন্দিরের দিকে তাকিয়ে সে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিল। অনেকক্ষণ।  তার আশেপাশে আরও কয়েকজন গোয়ানও ছিল। আমিও আমার আসনে ফিরে গিয়ে বসি নি, বেড়াটা মাঝখানে রেখে সে যতক্ষণ ছিল ততক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎ একসময় সে ভিড় ঠেলে চলে গিয়েছিল।

পরের দিন থেকে আবার সে আসা বন্ধ করেছিল, কিন্তু স্তব্ধ দ্বিপ্রহরে তাকে দেখতে পেতাম সে গোয়ানপাড়ার ভিতরে তার বাড়ীর জানালা ধরে দাঁড়িয়ে আছে।

যেদিন পাথর বসানো শেষ হল সেদিন আশ্বিনের আকাশ ঝলমল করছিল। পিতৃপক্ষ শেষ হয়েছে। মহালয়া গেছে আগের দিন। মন্দিরের বাইরে ভারা খুলল। ভিতরের কাজও শেষ হয়ে গেছে; সেদিন অনেক লোক এল দেখতে।

আমি খুঁজলাম কুইনিকে। এত লোকের মধ্যে কাউকে যেন আর দেখতেও পেলাম না। অনেক খুঁজে তাকে দেখতে পেলাম ভিড়ের মধ্যে। মন্দিরটাই দেখছিল সে। আমি তাকেই দেখছিলাম। হঠাৎ চোখে চোখ মিলল। সে আমার দিকে তাকালে।

বাড়ী ফিরে এলাম সন্ধ্যাবেলা।

আসবার সময় কাঁসাইয়ের খেয়াঘাটে দাঁড়িয়েছিল গোমেশ। সে হেঁট হয়ে নমস্কার করে বললে—হুজুর! আপনার জন্যেই দাঁড়িয়ে আছি।

বললাম—কেন? দরকার আছে?

সন্ধ্যার আবছায়ার মধ্যে সে আমার হাতে একখানা কাগজ দিলে। তার সঙ্গে গুঁজে দিলে একটা ভাঁজকরা টুকরো কাগজ। বললে—একটা দরখাস্ত দিলাম হুজুর। এবার পুজোর সময় কাপড়চোপড় কিছু হবে না হুজুর!

বাড়ী এসে দরখাস্তখানায় চোখ বুলিয়ে টুকরো কাগজটা দেখলাম। খুব সুন্দর ক’রে পিন দিয়ে জুড়ে দেওয়া ছিল। তাতে লেখা ছিল। “মন্দির শেষ হ’ল, এরপর দয়া করে আর এপারে আসবেন না। আমার মিনতি। এরা অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে উঠেছে। আমি পঙ্গুর মত অসহায়। আপনার অনিষ্ট করবে।”

আমি উথলে উঠেছিলাম সুলতা। ঠিক সেই সময়েই কে ডেকেছিল-সুরেশ্বর!

চমকে উঠেছিলাম। ডাক মেজদিদির। মেজদিদিকে কলকাতায় অর্চনার কাছে রেখেছিলাম। তিনি এসেছেন সেদিন। অতুল তাঁদের খবর দিয়েছে—“শ্যামাকান্তের অভিসম্পাত সুরেশ্বরের ঘাড়ে ভর করিয়াছে। সে গোয়ানপাড়ার কুইনি মেয়েটার জন্য উন্মত্ত হইয়া উঠিয়াছে।”

আমি চমকে উঠেছিলাম। সত্যিই কি তাই? পুরুষ নারীর জন্য পাগল হয়, নারী পুরুষের জন্য পাগল হয়। দেহসম্ভোগের অন্তহীন অতৃপ্তিতে মানুষ বিকৃতমস্তিষ্ক হয়। আবার মহাপ্রকৃতির অভিসম্পাতে শ্যামাকান্ত ইহকাল পরকাল সব হারিয়ে নিজের গলা টিপে নিজেকে পীড়িত করেন। মাথা কুটে রক্তাক্ত করেন নিজেকে।

আমি কি—। হয় তো তাই। কিন্তু ফিরবার শক্তি আমার ছিল না। আমার আপসোসও ছিল না। কুইনির জন্য ইহকাল হারাতে আমার এতটুকু খেদ ছিল না। আমি সব হারাতে প্রস্তুত ছিলাম। আমার সব সম্পদ। আমার জীবন ব’লে বাড়াবাড়ি করব না। তবে তাও পারতাম। কুইনির জীবন বিপন্ন হলে তাকে রক্ষা করবার জন্যে সে বিপদের সঙ্গে লড়তে যেতাম, তাতে মৃত্যু হলে মরতাম। কুইনিই যদি সেই প্রকৃতি হয়, রহস্যময়ী হয়, তবে তাকে না আমি বলব না। তার জন্যে পাগলও হব না।

থাক সুলতা, এখন যা হয়েছিল বলি। তবে―।

তবে—একটা কথা বলে নিই। কুইনির প্রতি এই আকর্ষণ যে কেন এত প্রমত্ত, তা আমি বিশ্লেষণ করে দেখেছি। ঠিক পুরো বুঝতে পারি নি। শুধু এইটুকু বলতে পারি—তার রূপের মধ্যে এমন একটা কিছু ছিল, যা আমার পুরুষচিত্তকে প্রমত্ত করে। আর একটা কথা। এটা এর আগে বলেছি। বার বার মনে হত, ও আমাদের—ও আমাদের-আমাদের সম্পর্ক আছে ওর সঙ্গে। মনে পড়ত অঞ্জনাকে, রত্নেশ্বর রায়কে। মনে পড়ত দেবেশ্বর রায় এবং ভায়লেটকে।

* * *

পরদিন সকালে উঠে চা খেয়ে উঠে দাঁড়ালাম। যাব সিদ্ধাসনের মন্দিরে। কিন্তু কাল মন্দিরের কাজ শেষ হয়েছে। এর মধ্যে ঘরে মেজদি, অতুলেশ্বর থেকে ওপারে গোয়ানদের মধ্যে এ নিয়ে একটা সাড়া পড়ে গেছে। এবং সময়টা এমন যে, আজ আর আমার ব্যক্তিগত অধিকার, সম্পত্তিগত অধিকার, কোন অধিকারই আমার স্বাধীন যথেচ্ছ বিচরণের পথ খোলা রাখে নি। আগস্ট মুভমেন্টের প্রথম ঝাপটা চলে গেছে। সাব-ডিভিশন এবং বড় বড় সরকারী এলাকার জায়গাগুলোয় পুলিস মিলিটারীর সাহায্যে আবার শৃঙ্খলা ফিরেছে বটে কিন্তু  তার বাইরে অধিকাংশ অঞ্চলেই বিপ্লবী স্বাধীন সরকারের অধিকার কায়েম আছে। অধিকাংশ মানুষ স্বাধীন সরকারের পক্ষে। তারাই তাদের সৈনিক। সরকারী পক্ষের লোক বলে যারা চিহ্নিত, তারা কড়া নজরের মধ্যে বসবাস করছে। তাদের উপর নির্যাতন নেই, কিন্তু তারাই ভয়ে প্রায় পঙ্গু হয়ে গেছে। চোর-ডাকাত প্রভৃতি দুর্ধর্ষ মানুষেরাও স্বাধীন সরকারের অনুগত সৈনিক হিসেবে সৎ হয়েছে এবং বিনিদ্র হয়ে কাজ করছে।

আমি জমিদার, সেই হিসেবে এবং একদিন বিদায় সত্যাগ্রহ লিখেছিলাম, সেই হিসেবে তাদের খাতায় দাগী আসামী। আবার মেজদিদির কেসে অতুলেশ্বরের কেসে আমি লড়েছি এবং কীর্তিহাটের কংগ্রেস সভাপতি যেদিন আমার বিচার করবার জন্য আসামী হিসেবে তলব করেছিলেন, সেদিন পুলিসের কাছে আমি তাঁদের বাঁচিয়ে জবানবন্দী দিয়েছি বলে আমার নামের পাশে চিত্রগুপ্তের খাতার মত, তাদের ডোসিয়ারে কিছু পুণ্যফলও আছে। আমার হাসপাতাল আমি কংগ্রেস সভাপতিকে দিয়ে ওপেন করিয়েছি এবং আজ গোটা হাসপাতালটাই তাঁদের হাতে দিয়েছি, এটাও আমার একটা পুণ্যফল। তাই আমার এ স্বাধীনতাটুকু ছিল। আজ সকাল থেকে যেন ওখানে না যাই তার একটা সাবধান-বাক্য অতুলেশ্বর উচ্চারণ করে গেছে। গোমেশের হাত দিয়ে সাবধান করে দিয়েছে কুইনী। কিন্তু তাই আমাকে বেশী করে টানলে। কুইনি আমার জন্যে উৎকণ্ঠিত হয়েছে। আমি না গিয়ে পারি!

আমি একটু ভেবে রঙ-তুলি একটা ঝোলায় পুরে রওনা হয়ে গেলাম। প্রেসিডেন্টের কাছে ছবি আঁকবার অজুহাতে ওপারে যাবার নতুন অনুমতি নিয়ে চলে গেলাম।

ওপারের ঘাটে যেখানে নামতাম, সেটা গোয়ানপাড়ার সামনে পড়ে। ওখানে নামতেই কতকগুলো মেয়ের সঙ্গে দেখা হল। তারা মুখে কাপড় চাপা দিয়ে হেসে বললে, বাবু ফের এসেছে আজ!

তারপর ঘটনাটা অতর্কিতেই কতকটা ঘটে গেল। ওখানে যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই। বোধ হয় ঘণ্টাখানেকের ভেতর। সেদিন রাজমজুরেরা নেই। থাকবার মধ্যে সঙ্গে আছে একজন দারোয়ান আর আছে যেসব শক্তপোক্ত লাঠিয়ালি-জানা ছোটজাতের হিন্দুদের বাস করিয়েছি তাদের বাড়ীর মেয়েরা। পুরুষেরা চাষের কাজে গেছে। ওদিকে গোয়ানপাড়ায় গোয়ানদের রাগের আগুন সুযোগ পেয়ে জ্বলে উঠেছে।

কেন আসবে বাবু-এই পারে কেন আসবে? তারা জানে কি জন্যে বাবু আসে। তারা আর সইবে না। পাড়ার সব থেকে নওজোয়ান ছেলেটি এসেছিল হনহন করে। তখন কুইনি এসে বেড়ার ওধারে দাঁড়িয়েছে। আমি তার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। তার চোখে-মুখে উত্তেজনা। সে হাঁপাচ্ছিল উত্তেজনায়।

সে বললে—কেন এসেছেন? আবার কেন এসেছেন?

হেসে বললাম—মন্দিরের ভেতরে ছবি আঁকব।

—ছবি?

—হ্যাঁ।

—না। আঁকতে হবে না, পাবেন না আঁকতে, যান, ফিরে যান বাড়ী।

আমি একটু হেসে বললাম—না। বলেই আমি পিছন ফিরলাম, গিয়ে মন্দিরের সিঁড়িতে পা দিলাম। ঠিক সেই মুহূর্তে ঘটল কাণ্ডটা। বলতে গেলে কয়েকটা নিমেষ ফেলতে যে সময় লাগে, তারই মধ্যে

প্রথমেই শুনলাম—কুইনি চীৎকার করে বললে—না, না। জন—জন! না।

চমকে পিছন ফিরে দেখলাম একজন জোয়ান গোয়ান। সে ক্রুদ্ধ হয়ে ছুটে প্রায় আমার পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে, হাতে তার ছুরি। ঠিক সেই মুহূর্তে তার পিছনে ছুটে এসে তাকে সবলে কোমরে জড়িয়ে ধরলে কুইনি।—না। বলে চীৎকার করে উঠল সে। কুইনি তাকে অনুসরণ করেই ছুটে এসেছে তার পিছন পিছন।

জন তাকে ঝাঁকি দিয়ে ঝেড়ে ফেলে দিয়ে আমার উপর ছুরি তুললে। যেটুকু সময় পেয়েছিলাম, তাতেই আমি তাকে আটকাবার জন্য হাত তুললাম, ধরলামও কিন্তু আটকাতে পারলাম না। তবু ছুরিখানা সে আমার বুকে বসাতে পারলে না। হাতখানা চেপে ধরে ঠেলে তুলে ধরতে চেয়েছিলাম, তারই ফলে বুকে না বসে আঘাতটা লাগল আমার কাঁধে। ওদিকে মাটি থেকে উঠে কুইনি আবার তাকে জাপটে ধরলে। ইতিমধ্যে আমার দারোয়ান ছুটে এসেছে—একটা গোলমাল উঠেছে। চারদিক থেকে লোকেরা এসেছে।

এরই মধ্যে আমি যেন কিছুক্ষণের জন্য জ্ঞান হারিয়েছিলাম।

যখন জ্ঞান হল, তখন দেখি শুয়ে আছি হাসপাতালে। আমার শিয়রে বসে আছেন মেজদি। শুনলাম জন ধরা পড়েছে। তাকে হাতে-পায়ে বেঁধে রেখে দেওয়া হয়েছে। আর  তার সাহায্যকারিণী এবং এই ষড়যন্ত্রের নায়িকা হিসেবে কুইনিকেও বন্দিনী করা হয়েছে। তবে সেও জনের ছুরিতে আঘাত পেয়েছে। তার আঘাত লেগেছে বাহুতে। হাসপাতালের ভায়লেটের নামে উৎসর্গ করা বেডে তাকে রাখা হয়েছে; ভলান্টিয়ারের পাহারাধীনে।

ওদিকে পরামর্শ চলছে—কেসটা নিয়ে কি করা হবে।

—ইংরেজের থানায় পাঠানো হবে? ইংরেজের আদালতে বিচার হবে? ওদিকে গোটা কীর্তিহাটের লোকেরা গোয়ানদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। একবার তারা গোয়ানপাড়া পুড়িয়ে দিয়েছিল। এবার তারা পাড়া নিশ্চিহ্ন করে দেবে।

মেজদিকে বললাম—মেজদি, তুমি অতুলকে বল। অপরাধ ওদের নয়। অপরাধ আমার। ভালবাসা আমার অপরাধ। কুইনিকে আমি ভালবাসি। ওরা তা সইতে পারেনি। কুইনি আমাকে বাঁচাতে গিয়ে আঘাত পেয়েছে।

ষষ্ঠীর দিন সন্ধ্যা থেকে আকাশে ক্রুদ্ধ সাইক্লোনের নাকাড়া বাজল। সে-সাইক্লোন সপ্তমীর দিন এসেছিল কলকাতায়। মেদিনীপুরে এসেছিল ষষ্ঠীর মধ্যরাত্রে। সন্ধ্যা থেকে আরম্ভ হয়েছিল উন্মত্ত ঝড়ের প্রলয়ঙ্কর মাতামাতি। সন্ধ্যা থেকে আকাশ নিকষ কালো অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল। খবর এসেছিল কাঁথির ওদিকে নাকি সৃষ্টি নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সমুদ্রের তুফান এসে সব ধুয়ে নিয়ে যাবে। সমুদ্রের ঝড়ের সঙ্গে মেদিনীপুরের পরিচয় সৃষ্টির আদি থেকে। তারা জানে। তারা খবর পাঠায়। তারা আকাশের দিকে তাকিয়ে খবর পড়তে পারে। সেদিন কংগ্রেস হুকুম দিয়েছিল—গোটা কীর্তিহাটের লোক এসে আশ্রয় নিক রায়বাড়ীর পাকা ইমারতের মধ্যে। ইস্কুল, হাসপাতাল, কাছারী যেখানে যত পাকাবাড়ী আছে, এস সকলে, তার মধ্যে এসে আশ্রয় নাও। আমাকে হুকুম দিয়েছিল বিবিমহলে যেতে।

আমি আমার বেড থেকে উঠে এসে দাঁড়িয়েছিলাম কুইনির বেডের ছোট্ট ঘরখানিতে। কুইনি বসে দু’হাতে মুখ ঢেকে কাঁদছিল। ডাকলাম —কুইনি!

কুইনি মুখ তুলে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল।

আমি তাকে বললাম—ভয় কি? চল, আমার সঙ্গে চল। হাসপাতালের অন্য লোকেরা আসছে। আমার সঙ্গে বিবিমহলে চল―। যাবে না?

—গোয়ানদের কি হবে?

—তারাও এপারে এসে কীর্তিহাটের লোকেদের সঙ্গে রায়বাড়ীতে থাকবে। আমি প্রেসিডেন্টের আছে নতজানু হয়ে বলব।

সেই ঝড়ের মাতামাতির মধ্যেই আমি সেই আহত অবস্থাতেই তাকে নিয়ে এসে উঠেছিলাম বিবিমহলে।

সত্য কথা বলতে গেলে, সেই আমার কুইনির সঙ্গে বিবাহ। সেই প্রলয়ঙ্কর ঝড়ের মধ্যে ভীতার্ত নির্বাক কুইনীকে আমি সারারাত বুকে জড়িয়ে ধরে বাসর যাপন করেছিলাম। সত্য অর্থে বাসর সুলতা।

মাথার উপর প্রলয়ঙ্কর ঝড়ের গর্জন একটানা বয়ে চলেছিল। মধ্যে মধ্যে বড় বড় গাছ ভেঙে পড়ার শব্দ হচ্ছিল। বিবিমহলের নীচের তলায় একটা চোরকুঠুরীর কথা বোধ হয় বলেছি। সেটা সেকালের স্ট্রং-রুম। এই ঘরেই ব্রজদা লুকিয়ে রেখেছিল বীরেশ্বর রায়ের এবং দেবেশ্বর রায়ের স্মরণীয় ঘটনার খাতা এবং ডায়েরীগুলো। সেই ঘরের মধ্যে মেঝের ওপর কম্বল পেতে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে আমি ভয়ার্ত কুইনিকে পাশে নিয়ে একট কম্বল দুজনে গায়ে জড়িয়ে বসে ছিলাম। নির্বাক স্তব্ধ। ঘরের আলো নিভে গিয়েছিল। একটা পাঁচ-ব্যাটারীর টর্চ ছিল, সেটা জ্বেলে বসেছিলাম। আলোর ফোকাসটা পড়েছিল দেওয়ালের গায়ে, আর চারিপাশে একটা আলোকিত আভাস—হ্যাঁ, তাছাড়া কি বলব? একটা আভাস ফুটে উঠেছিল। তারই মধ্যে, মধ্যে মধ্যে সে আমার বুকের উপর ঘুমে ঢুলে পড়ছিল, কখনও আমি পড়ছিলাম তার উপর; ঘুম ভেঙে গিয়ে পরস্পরের দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ একটি করে হাসি ফুটে উঠছিল আমার মুখে। দেহসম্ভোগ নয়, পরস্পরের দেহের উত্তাপে একটা নরম নিশ্চিত্ততার আরাম বা আনন্দ যাই বল—তার মধ্যে ডুবেছিলাম। বাংলা কবিতার একটা লাইন মনে পড়ছে—মোহিতলালের নারী কবিতার লাইন।

‘সন্তান মরিছে বুকে, তখনই যে নবগর্ভাধান’। এ মৃত্যুকে মাথায় করে আমাদের মিলন হয়েছিল সুলতা।

***

এখানেই যবনিকা ফেলে দিতাম নাটক হলে। অন্তত মানুষের গড়া স্টেজের নাটক হলে। পৃথিবীর রঙ্গমঞ্চে যে নাটক চলে, সে নাটকে নাটকীয় মুহূর্ত আসে, সংঘাত আসে; যবনিকা পড়ে না, নাটকও শেষ হয় না। নাটক চলে।

পৃথিবীর কীর্তিহাট যে কোণে, সেই কোণেও রায়বাড়ীর জীবন-নাটকে ওই ঘটনার পরও একটা লৌকিক বিবাহ আমাদের হল। সমাজ রাষ্ট্র এরা তো মানুষের মনের বিবাহকে মানে না—তাদের বিধানমত বিবাহ করিয়ে ছাড়ে।—তাই হল।

এই প্রাকৃতিক তাণ্ডবে মেদিনীপুরের সাধারণ মানুষ অবসন্ন হয়ে পড়েছিল। সম্ভবত মনে আছে তোমার–তিনদিন ধরে মেদিনীপুর পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। এর মধ্যে হাজার দরুনে লোক মরেছে, হাজারে হাজারে জন্তু-জানোয়ার মরেছে। সমুদ্রের পঞ্চাশ-ষাট ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাস সমস্ত দক্ষিণ উপকূল ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। গাছপালা কুরুক্ষেত্রের অক্ষৌহিণী সেনার মত ধরাশায়ী হয়েছে। গৃহহীন মানুষ জলসিক্ত মাটির বুকের উপরেই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।

এরই মধ্যে ডি এম বলেছিলেন—ঈশ্বর মেদিনীপুরকে শাস্তি দিয়েছেন।

স্বর্গত শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় বাংলা ক্যাবিনেটের মন্ত্রী তখন। তিনি এসে জন-সাধারণের নৌকো কেড়ে নেওয়ার প্রতিবাদ করায় একজন ডেপুটি বলেছিল—সরকারী প্রয়োজনে নৌকো কেড়ে নেওয়া দরকার হয়েছিল তাই নিয়েছি।

অত্যন্ত উদ্ধতভাবে বলেছিল।

কীর্তিহাটেও ওই সরকারী দাপটের ঢেউ এসে লাগল।

দু’দিন পর। রিজার্ভ ফোর্স নিয়ে এসে হাজির হল একজন ইন্সপেক্টার।  তার সঙ্গে খড়্গপুরের মিসেস হাডসন এবং একজন অ্যাংলো ভদ্রলোক। অতুল, কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট মণ্ডল-এঁরা অবশ্য তার আগেই সরে গেছেন। গ্রামের লোকেই সরিয়ে দিয়েছে।

রিজার্ভ ফোর্স প্রথম এসেই কিছু লোককে অ্যারেস্ট করেছিল। মিসেস হাডসন এবং সেই অ্যাংলো ভদ্রলোক এসেছিলেন গোয়ানদের সাহায্য দিতে। কিন্তু তাদের পেলেন এখানেই। গোয়ানদেরও আশ্রয় দেওয়া হয়েছিল গার্লস স্কুলে। তাদের কথায় তারা পুলিসের কাছে নালিশ করলে, জমিদার সুরেশ্বর রায় কুইনিকে জোর করে ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। কুইনি আটকে রয়েছে বিবিমহলে।

আমি তখন ঘুরে দেখছিলাম রায়বাড়ী। চারিদিক ঘুরে দেখছিলাম।

রায়বাড়ীর তিনটে সিঁড়ি, তিনটে চিলেকোঠা।

চিলেকোঠাগুলো সবই ভেঙে গেছে। উত্তরদিকের গোটা আলসে ভেঙেছে।

সব থেকে বড় ক্ষতি হয়েছে—বিভিন্ন সময়ে তৈরী রায়বাড়ীর বিভিন্ন মহলগুলোর জোড়ের মুখে ফাট ধরেছে।

বিবিমহলের সব থেকে যেটা শোভার বস্তু, আরামের স্থান, ছাদের উপর আটকোণা ছত্রিঘর, যেখানে বসে আমি ছবি আঁকতাম, বাঁশী-বেহালা বাজাতাম, যেখানে বসে থাকতেন বীরেশ্বর রায়, সেই ছত্রিঘরখানাও ভেঙে পড়ে গেছে।

ধানের গোলা ভেঙে ধান ছড়িয়ে পড়েছে, ভেসে গেছে। ইন্সপেক্টর কনস্টবল নিয়ে এসে আমার হাত চেপে ধরল। বললে —আপনাকে অ্যারেস্ট করছি। আপনি কুইনি মুখার্জী বলে ক্রীশ্চান মেয়েটিকে—

মিসেস হাডসন পা ঠুকে বলে উঠল—You are a scoundrel, you have—

অ্যাংলো ভদ্রলোকটি একটা চড় বসিয়ে দিল আমার গালে। প্রস্তুত ছিলাম না আমি। পরমুহূর্তেই আমার রায়-রক্ত সাড়া দিয়ে উঠল—আমি ঝাঁকি দিয়ে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লাম তার উপরে। কিন্তু তাদের সঙ্গে পারি নি আমি। তারা অনেক। আমি একা। সাহায্যের জন্য কেউ ছিল না।

সাইক্লোন এবং বন্যা-বিধ্বস্ত কীর্তিহাট, মানুষেরা ক্লান্ত, ভেঙে পড়েছে। প্রতিবাদ করবার কেউ নেই। সাহায্য করতে কে আসবে! আমাকে তারা ধরে বেঁধে ফেললে অপরাধীর মত।

—কোথায় কুইনি?

এবার আমি আত্মসম্বরণ করে বললাম- আমার ঘরে। বিবিমহলে। সে আমার ভাবী স্ত্রী—

কথা বলতে দিলে না আমাকে। অপরাধীর মতই কোমরে দড়ি বেঁধে টেনে নিয়ে এল বিবিমহলে। কুইনী ছুটে বেরিয়ে এল খবর পেয়ে আমার কোমরে দড়ি দেখে, আমার বিধ্বস্ত চেহারা দেখে সে থমকে দাঁড়াল।—কেন ওঁকে বেঁধেছেন? কি করেছেন উনি?

মিসেস হাডসন বললেন —কুইনি তুমি সেফ? তোমার কোন অমর্যাদা —?

কুইনি এক কথায় সব কথার জবাব দিলে—আগে ওঁকে ছেড়ে দিন। উনি আমার ভাবী স্বামী। আমি ওঁকে ভালবাসি।

এ নিয়ে সমস্যা অনেকের কাছে ছিল কিন্তু আমার কাছে ছিল না। কুইনির কাছেও না।

ওই গোয়ানপাড়ার পাদরী বুড়ো ম্যারেজ রেজিস্ট্রারের কাজ করেছিলেন।

আবার বাড়ীতে মেজদি বলেছিলেন, তাঁরা বিবিমহলে দাঁড়িয়েছিলেন —মেজদি, গোবরডাঙার খুড়ীমা, বর্ধমানের খুড়ীমা, অর্চনার মা, ব্রজদার বোন; মেজদি বলেছিলেন—কুশণ্ডিকাটা করবিনে রে? কুইনি তো আসলে মুখুজ্জে। পরে না হয় ক্রীশ্চান হয়েছে।

গোবরডাঙার খুড়ীমা একটা বেলপাতায় খানিকটা কালীমায়ের প্রসাদী সিঁদুর বাড়িয়ে দিয়ে বলেছিলেন—অন্তত এটা দিয়ে দে সুরেশ্বর।

কুইনী তাতে আপত্তি করে নি। একটু হেসেছিল। কালীবাড়ী নারায়ণ-মন্দিরেও সে যেতে চেয়েছিল। অন্তত আগ্রহ ছিল। কিন্তু যাবার পথ আটকালে রায়েরা। কল্যাণেশ্বরেরা। এবার কল্যাণেশ্বর একা নয়। গোবরডাঙার খুড়ীমাও বলেছিলেন—না, সেটাতে হ্যাঁ বলতে পারব না।

তবে সিদ্ধাসনের নতুন মন্দিরে আমরা দু’জনে প্রণাম করে এসেছিলাম। কেউ আপত্তি করে নি।

ওখান থেকে গোয়ানপাড়ায় ওদের গির্জেতে গিয়েছিলাম দু’জনে। সেখান থেকে ফিরে এসে শুনলাম, রায়বাড়ীর শরিকদের জটলা হচ্ছে।

আমি পরের দিন কুইনীকে নিয়ে কলকাতায় চলে এলাম। প্রয়োজন নেই। দেবোত্তরের সেবায়েত স্বত্বের একের ষষ্ঠাংশ অংশে আমার প্রয়োজন নেই। আমার ব্যক্তিগত জমিদারী পত্তনী দরপত্তনী স্বত্ব সে কেউ নিতে পারবে না।

যদি পারে তাতেও আমার প্রয়োজন নেই।

না। প্রয়োজন নেই।

গোটা রায়বাড়ীটাই ফেটে হাঁ হয়ে গেছে। ছাদের আলসে ভেঙে পড়েছে। ছাদে জল পড়ছে। বিবিমহলের ছত্রি উড়েছে। এবার পড়বে, ভেঙে পড়বে হুড়মুড় করে।

১৭৯৯ সালে দেওয়ান গঙ্গাগোবিন্দ সিংহ এবং তাঁর সুযোগ্য পাটোয়ার কানুনগো—কুড়ারাম রায় ভটচাজ লর্ড কর্নওয়ালিসের হুকুমে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কায়েম করে গিয়েছিলেন এবং সঙ্গে সঙ্গে কালী-মার নামে জমিদারী কিনে, সন্তান-সন্ততিদের অন্নপূর্ণার আশীর্বাদে দুধে-ভাতে রেখে হাসিমুখে চোখ বুজেছিলেন—আজ ১৯৪২ সালে আগস্ট মুভমেন্টের মধ্যে একটা প্রলয়ঙ্কর ঝড় এসে সে জমিদারীর সব কিছু আছড়ে ফেলে মড়মড় করে ভেঙ্গে দিয়ে গেল। খবর আসতে লাগল—বড় বড় জমিদারবাড়ীর কোথাও ভেঙ্গেছে মাথা, কোথাও ভেঙ্গেছে মাঝখানে। কোথাও ভেঙ্গেছে ভিত থেকে।

এখন এখানে যে মাথা গুঁজে থাকতে চাইবে সে চাপা পড়বে। প্রজারা আর বেগার দেয় না। ইট-কাঠ চাপা পড়লে তাদের ধরে এনে আর ইট-কাঠ সরানো যাবে না। তোমাদের চাপা পড়ে মরতে দেখলে তারা হাততালি দিয়ে হাসবে। পালাও, এখান থেকে পালাও।


© 2024 পুরনো বই