কীর্তিহাটের কড়চা – ৪র্থ খণ্ড – ১৬

১৬

তিনি আজও বেঁচে আছেন। কথাটা কিন্তু কারুরই মনে থাকে না। তাঁর কথাটুকু বললেই রায়বাড়ীর কথা শেষ।

সেদিন তাঁর কথা শুনলাম।

সেদিন-মানে ১৯৩৭ সালের এপ্রিল মাসে। তোমার মনে আছে বোধ হয়, মেদিনীপুর শহরের সুধাকরবাবু উকীলের টেলিগ্রাম পেয়ে আমি  কলকাতা থেকে গিছলাম মেদিনীপুর। তখন মেদিনীপুর খানিকটা শান্ত হয়ে এসেছে; জেলা ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে এসেছেন মিস্টার বি আর সেন। তিনি মেদিনীপুরের দমননীতির কড়াকড়ি ক্রমশ শিথিল ক’রে আনছেন। মেজঠাকুমার যে জেল হয়েছিল তার মেয়াদ শেষ হয়েও তিনি খালাস পান নি, জেলগেটেই তাঁকে আটক আইনে আটকে জেলেই রাখা হয়েছিল। মিস্টার সেন তাঁর কেসের ফাইল প’ড়ে তদন্ত করে তাঁকে ছেড়ে দেবেন—উকীল কথাটা জানতে পেরে আমাকে টেলিগ্রাম করেছিলেন। আমি মিস্টার সেনের সঙ্গে দেখা করে মেজঠাকুমার জন্যে অপেক্ষা করে আছি। এরই মধ্যে কুইনি হিলডা এসেছিল। সঙ্গে খঙ্গপুরের ইন্ডিয়ান ক্রীশ্চানদের একটি মহিলা। কীর্তিহাটের লোকেদের বিরুদ্ধে, বিশেষ করে রায়বাড়ীর লোকেদের বিরুদ্ধে অভিযোগ করতে এসেছে। তারা কংগ্রেসকে ভোট দেয়নি বলে তাদের উপর অন্যায় জুলুম করছে তারা। অভিযোগ করতে এসেও আমার কথা শুনে হিলডা এসেছিল আমার কাছে। কুইনির ইচ্ছে খুব ছিল না, ক্রীশ্চানদের প্রতিনিধিস্থানীয়া মেয়েটির তো আদৌ ছিল না ইচ্ছে। কিন্তু হিলডার জেদে আসতে হয়েছে। তাদের আশ্বাস দিয়ে বলেছি, কয়েকটা দিন অপেক্ষা কর, আমাকে কীর্তিহাট ফিরতে দাও। সেখানে লোকেদের সঙ্গে কথা বলে, বুঝে উত্তর দেব। যদি নিবারণ করতে না পারি তবে তোমাদের বলে দেব, তখন তোমরা যা খুশী করবে। কুইনিকে আমিই খড়্গপুরে ইস্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছি, আমিই তার খরচ দিই। না হলে হয়তো কুইনি হিলডার কথা শুনত না। তার পরের দিনের কথা বলছি। পরের দিন সকালেই মেজঠাকুমা মুক্তি পেলেন। তাঁকে নিয়ে এলাম শহরের বাসায়।

শীর্ণ হয়ে গেছেন মেজদি। তাঁর কান্তি যেন মলিন হয়ে গেছে। দৃষ্টিতে একটা উৎকণ্ঠা ফুটে উঠেছে। মাথার চুলগুলো কেটে ফেলেছেন। বয়স যেন দশ বছর বেড়ে গেছে।

জিজ্ঞাসা করলাম—এ কি মেজদি! আমি তো তোমার সঙ্গে মাস দুয়েক আগে দেখা করে গেছি, এর মধ্যে তোমার শরীর এমন খারাপ হ’ল কেন?

মেজদি ম্লান হেসে বললেন—ওরে, খালাস পাব শুনে দুর্ভাবনায় এমন হয়ে গেছি ভাই।

—দুর্ভাবনা কিসের মেজদি?

—দুর্ভাবনা কিসের? দুর্ভাবনা সব কিছুরই ভাই। অন্নের দুর্ভাবনা, বস্ত্রের দুর্ভাবনা, মাথা গুঁজবার ঠাঁইয়ের দুর্ভাবনা—দুর্ভাবনা কিসের নয় তাই বল!

—আমি বেঁচে থাকতে দুর্ভাবনা ভাবছ মেজদি!

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে মেজদি বললেন—রায়বাড়ীতে আমার বড়দি-রায়বাড়ির বড়গিন্নী, তোর ঠাকুমাকে, তার দুই ছেলে থাকতেও বৃন্দাবনে নির্বাসনে যেতে হয়েছে। আজও কেউ তাঁর খোঁজ করে না। তাঁর নিজের পৈতৃক টাকা ছিল। তাই তিনি মান বাঁচিয়ে বৈষ্ণব হয়ে বেঁচে আছেন। আমার যে কিছুই নেই সুরেশ্বর।

আমি বলেছিলাম সুলতা, বলেছিলাম—মেজদি, আমি তো আছি।

হেসে মেজদি বলেছিলেন না। ও ভরসা করতে বলিস নে। মানী মানুষ যারা তাদের পান থেকে চুন খসলেই অপমান হয়। তারা সব দুঃখ সইতে পারে, অপমানের দুঃখ সইতে পারে না। জেল-ফেরত সৎমাকে ধনেশ্বর, জগদীশ্বর সহ্য করবে না রে। তোর ঠাকুমা—রায়বাড়ীর বড়বাবুর স্ত্রী মানিকবউ-এর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল স্বামীর অবহেলায়। তার ওপর স্বামীর এই মৃত্যুতে হয়ে গেলেন উন্মাদ পাগল।

বলতে বলতে থেমে গেল সুরেশ্বর। কিছুক্ষণ পর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললে—সুলতা, দেবেশ্বর রায় নদীর গর্ভে পড়েছিলেন অজ্ঞান হয়ে, লোকজনে অনেক খুঁজেপেতে তাঁকে তুলে নিয়ে এল। আমার ঠাকুমা মানিকবউ তখন ছিলেন গোবিন্দ-মন্দিরে। রাধাগোবিন্দের সামনে সন্ধ্যেবেলা থেকে সে আমলে বারো মাস কথকতা হত; নিযুক্ত কথক ছিল। ক্রমান্বয়ে কৃষ্ণলীলার কথকতা চলত। মানিকবউ কথকতা শুনে হাসতেন, কাঁদতেন, কখনও কখনও উঠে গিয়ে গোবিন্দের সামনে গিয়ে হাত মুখ নেড়ে কথা বলতেন। কথকতা শেষ হলে নিজের হাতে শয্যা রচনা করে রাধাগোবিন্দকে শয়ান করিয়ে নিজের ঘরে ফিরতেন। সেদিন বড়বাবুর অসুখের খবর নিয়ে মাঠাকরুণকে জানাতে গিয়েছিল অনন্ত, কিন্তু সে তাঁর কানে যায় নি। তিনি শোনেন নি। বার বার বলেছিলেন- যা যা। বড়বাবুকে ঘুমুতে বলগে যা। এখন আমি যেতে পারব না। গেলে ঠাকুর রাগ করবেন। তাতে তারই

অমঙ্গল হবে। যা।

অগত্যা কথকতাতেই মধ্যপথে ছেদ টেনেছিলেন কথকঠাকুর। মানিকবউ ঠাকুরকে শয়ান করিয়ে এসে স্বামীর ওই অবস্থা দেখে আছড়ে পড়েছিলেন স্বামীর বুকে। আর প্রাণ ফাটিয়ে ডেকেছিলেন—বড়বাবু—বড়বাবু গো, বড়বাবু আমি যে এলাম, কথা বল, আমি তোমার মানিকবউ, কথা বলবে না? বড়বাবু!

সকালবেলা খবর রটেছিল—সিদ্ধাসনের জঙ্গলে ভায়লা বিষ খেয়ে মরেছে।

মানিকবউ শুনে নাকি হঠাৎ যেন বোবা হয়ে গিয়েছিলেন। না, হল না সুলতা। শুধু তো বোবা নয়, তিনি যেন শুকিয়েও গিয়েছিলেন। চোখের জল শুকিয়েছিল; কণ্ঠের স্বর বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পাথরের মূর্তির মত বসেছিলেন কিছুক্ষণ। তারপর ধীরে ধীরে উঠে চলে গিয়েছিলেন স্বামীর বিছানার পাশ থেকে।

দেবেশ্বর রায়কে নিয়ে সকলে যখন ব্যস্ত, তখন দীর্ঘ অবগুণ্ঠন টেনে একটি মেয়ে খিড়কীর পথে রায়বাড়ি থেকে বেরিয়ে, কাঁসাই পার হয়ে গিয়ে উঠেছিল সিদ্ধাসনের জঙ্গলে। যেখানে সিদ্ধাসন থেকে খানিকটা দূরে ভিড় জমিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল গোয়ান মেয়েপুরুষেরা, মাঝখানে নামানো ছিল ভায়লেটের মৃতদেহ।

ঘোমটার ভিতর থেকে সকলের পিছনে দাঁড়িয়ে তিনি বলেছিলেন—“সর্ তো রে, সর্ তো একটু দেখি! ওরে সর্ না। একবার দেখতে দে।”

পুরুষেরা তাঁকে কেউ চিনত না, কিন্তু গোয়ান মেয়েরা অনেকে তাঁকে দেখেছে, তারা চিনত, তারা তাঁকে রায়বাড়ীর বড়গিন্নী বলে চিনেছিল। তারা সসম্ভ্রমে লোকজন সরিয়ে দিয়ে দেখতে দিয়েছিল ভায়লেটের মৃতদেহ। মৃতদেহের পাশে বসে মানিকবউ তাকে বলেছিলেন- “ বেঁচে পাস নি তাই ম’রে পেলি। নয়? আমি কি করব বল? বিশ্বাস কর, আমাকে এরা ধরে এর সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিল। তাকে আমি পাই নি। চেয়েছিলাম, পাই নি। তুই পেয়েছিলি—তোকে পেতে দেয়নি। আমার দোষ নেই। তা এবার পেলি, এবার শাস্তি হল!”

খবর নিয়ে ছুটে এসেছিল একজন গোয়ান। লোকজন গিয়ে তাঁকে নিয়ে এসেছিল, তখন তিনি বদ্ধ পাগল। কিন্তু পাগলামির একমাত্র সূত্র ওই। ওই ভায়লেট।

বাড়ী এসে ধুয়ো ধরেছিলেন—“ভায়লেট সতী হয়েছে। ওকে সতীঘাটে বড়বাবুর সঙ্গে দাহ কর।”

রায়বাড়ীর অন্দরের মধ্যে একেবারে মাঝখানকার ঘরে তাঁকে জোর ক’রে ভিতরে পুরে তালা দিয়ে বন্ধ করে রাখা হয়েছিল। স্বামীকে আর তিনি দেখতে পান নি। কিন্তু শ্রাদ্ধের দিনে বাধালেন হাঙ্গামা। ছেলেদের বললেন—বড়মায়ের শ্রাদ্ধ কর

ছেলেদের বড়মা মানে, ভায়লেট।

কোন রকমে তাঁকে স্নান করিয়ে কাপড় ছাড়িয়ে আবার ঘরে বন্ধ করা হয়েছিল, কিন্তু কখন কোন্ ফাঁকে যে কে দরজা খুলে দিয়েছিল কেউ জানে না; মানিকবউ ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ে সটান গিয়ে উঠেছিলেন গোয়ানপাড়ায়। তাঁর হাতে ছিল পুঁটলি-বাঁধা গহনা আর টাকা। তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে। যখন খোঁজ হল, তখন রাত্রি অনেকটা, লোকজন সমস্ত দিন পরিশ্রম করে ক্লান্ত, কাঙালীতে কীর্তিহাট ভরে গেছে। লোকের দাওয়া থেকে শুরু করে প্রতিটি গাছতলায় পর্যন্ত মানুষ শুয়ে আছে, বসে আছে। ঘুরছে ফিরছে কাঁদছে এঁটোকাঁটা চেয়ে বেড়াচ্ছে। তার মধ্যে কোথায় খোঁজ করবে মানিকবউয়ের! মানিকবউয়ের গায়ের রঙ গৌরবর্ণ, কিন্তু রাত্রি অন্ধকার, তার মধ্যে তাঁকে চিনে বের করা সম্ভবপর ছিল না। গোয়ানপাড়ার কথাটা কারুর মনে হয় নি।

সকালবেলা খোঁজ হয়েছিল।

গোয়ানেরাই খোঁজ দিয়ে গিয়েছিল। মানিকবউ গহনার পুঁটলি নিয়ে গোয়ানপাড়ায় গিয়ে ওই গির্জের বারান্দায় বসে ছিলেন। সকালে লোকজনদের ডেকে বলেছিলেন—আমি রায়বাড়ীর বড়বউ। তোদের ভায়লা আমার সতীন। বড়বাবু তো ওকেই ভালবাসতেন। তা ভায়লা মল, তার শ্রাদ্ধ হল না। ছেলেদের বললাম—ছেলেরা করলে না। আমি করব শ্রাদ্ধ। তোদের পাদরীকে ডাক, আমার যোগাড়যন্ত্র করে দে। এই নে এই গয়নাগুলো নে, বিক্রী করে আন।

***

শিবেশ্বর রায় আত্মগোপন ক’রে ছিলেন, যজ্ঞেশ্বর রায়ও আত্মগোপন ক’রে ছিলেন। খুনের মামলার জন্য তখন ওয়ারেন্ট বেরিয়ে রয়েছে। শ্রাদ্ধ করেছিলেন যোগেশ্বর রায়, আমার বাবা। এবং মানিকবউ সম্পর্কে আপত্তি তুলেছিলেন ধনেশ্বর আর জগদীশ্বর। আমার বাবার থেকে ধনেশ্বরকাকা এক বছরের ছোট। জগদীশ্বরকাকা ধনেশ্বরকাকার থেকে দুবছরের ছোট। একজনের বয়স উনিশ, একজনের বয়স সতেরো। আত্মগোপন ক’রে থেকেও শিবেশ্বর রায় এই সময়ের অপূর্ব সুযোগটি ছাড়েন নি। ধনেশ্বরকাকা এবং জগদীশ্বর কাকা হঠাৎ একদিন গোবিন্দমন্দিরে মানিকবউয়ের পথ আটকালেন।

মেজদাদু শিবেশ্বর রায় আত্মগোপন ক’রে ছিলেন এই মেদিনীপুরেই—সেই বাড়িতে, যে বাড়ীতে আমি মেজদির অপেক্ষায় বসে ছিলাম ১৯৩৭ সালের এপ্রিল মাসে। যে বাড়ীতে বসে মেজদির কাছে এই সব কথা শুনছিলাম সেই বাড়ীতেই, আত্মগোপন মানে একটু আড়াল দিয়ে বসবাস করছিলেন। বাইরে Not at home নোটিশ টাঙিয়ে বাস করার মত। তিনি উকীলদের সঙ্গে পরামর্শ করছিলেন মানিকবউয়ের এই অপরাধ, এই গহনাগাঁটি নিয়ে গোয়ানপাড়ার গির্জের বারান্দায় পড়ে থাকার জন্যে, তার উপর পাতিত্য দোষ চাপিয়ে তার ছেলেদের দেবোত্তরের স্বত্ব থেকে বঞ্চিত করা যায় কিনা।

উকীল নাকি বলেছিলেন—পাতিত্য চাপানো যায় কিনা সে তো আমি বলতে পারবো না, তবে চাপাতে পারলে মূল দেবোত্তরের স্বত্ব থেকে বঞ্চিত করা যাবে এটা নিশ্চিত। আর ভেবে দেখুন, সেটা ঠিক হবে কিনা। ওই দেবোত্তরের সম্পত্তি পত্তনীদার, দরপত্তনীদার হিসেবে যা ভোগ করেন, তা তো ওদের যাবে না! ভেবে দেখুন ভাল ক’রে, একই মহালে শরীক হিসেবে থাকবেন। সেখানে ঝগড়া হবে।

তাতে শিবেশ্বর রায় দমেন নি। ছোট-তরফের রামেশ্বর বিলেত গেছে। তার স্ত্রী মারা গেছে এখানে। রামেশ্বর বিলেত থেকে হয় ফিরবে না, নয় মেম বিয়ে ক’রে ফিরবে। সুতরাং শরীক এখন তিন তরফ নয়, দু তরফ। দু তরফের এক তরফ বড়তরফকে পতিত করতে পারলে থাকবেন এক এবং অদ্বিতীয় মেজতরফের কর্তা—তিনি শিবেশ্বর রায়। তিনি তাঁর দুই ছেলেকে ডেকে উপদেশ দিয়ে ব্যবস্থা করলেন।

মন্দিরে ঢুকতে দিয়ো না-বলো পাতিত্য ঘটেছে। গোয়ানপাড়ায় কোথায় ছিলেন কার বাড়ীতে ছিলেন, কে বলতে পারে! কি খেয়েছেন কে জানে?

ধনেশ্বর তখন গোয়ানপাড়ার চোলাই করা মদের স্বাদ গ্রহণ করতে শুরু করেছেন। তখন তিনি উনিশ বছরের নবযুবক। সতের বছরের জগদীশ্বর রায়।

একটু থামল সুরেশ্বর। পাশেই বসেছিল অর্চনা। অর্চনা জগদীশ্বর রায়ের বড় মেয়ে; সম্ভবতঃ বলতে কুণ্ঠাবোধ করছিল।

অর্চনা বললে—থামলে কেন সুরোদা? বাবা জ্যাঠামশায়ের চেয়ে দু বছরের ছোট। তখনও ইস্কুলে পড়েন। রায়বাড়ীর রত্নেশ্বর রায় এইচ ই স্কুলে থার্ড ক্লাসে বছর তিনেক আছেন। তিনি মদ খেতেন রাত্রে, দিনে গন্ধের ভয়ে মদ খেতেন না, স্কুলে যেতে হত, তবে তাঁর বার্ডশাইয়ের ভিতর চরস গাঁজা পোরা থাকত। তিনি তিনটে নেশা করতেন—মদ গাঁজা চরস।

* * *

সুলতা বললে–থাক, এসব কথা থাক সুরেশ্বর। আমার প্রাণ হাঁপিয়ে উঠছে।

সুরেশ্বর বললে—শুনেই তোমার প্রাণ হাঁপিয়ে উঠছে সুলতা, আর রায়বাড়ীর হতভাগ্যেরা এরই মধ্যে বাস করছে, চীৎকার করছে, সে চীৎকার সেদিন শুনেছ খানিকটা, আবার আমার মত চীৎকারও করছে, পরিত্রাণ কর, পরিত্রাণ কর ব’লে। শোন—আর খুব বেশী নেই সেকালের কথা।

অর্চনা মাঝখানে বাধা দিয়ে বললে-আমি বলছি সুরোদা, তুমি থাম। বলেই সে বলে গেল—

জ্যাঠামশাই মানে ধনেশ্বর আর বাবা সেদিন উন্মাদিনী মানিকবউয়ের পথ আগলালেন।

—যেয়ো না জ্যাঠাইমা—যেতে পাবে না।

চমকে গেলেন মানিকবউ—যেতে পাব না?

—না, তোমার জাত গেছে।

—কি? কি? কি?

—তো—মা-র জাত গে—ছে।

আমার বাবা জগদীশ্বর রায় হাত-পা নেড়ে ভেঙিয়ে কথা বলে সুলতাদি। সে ছেলেবেলা থেকেই। হাত-পা নেড়ে মুখ ভেঙিয়ে সে বললে-সে-দি-ন কি-রি-শ্চান সতীনের ছাদ্ধ করতে গয়নার পুঁটলি নিয়ে সারারাত গোয়ানপাড়ায় পড়েছিলে। কোথা খেয়েছিলে? কার বাড়ীতে? তোমার জাত গিয়েছে, দেশসুদ্ধ লোক জানে। হৈ-হৈ উঠেছে। দশ হাজার কাঙালী এসেছিল। কি বলছে তারা শোন গে! ঢুকতে পাবে না তুমি।

তাদের মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন তিনি। তারপর হঠাৎ অজ্ঞান হয়ে পড়ে গিছলেন।

সুরেশ্বর বললে—আশ্চর্য সুলতা, পুরো একদিন অজ্ঞান হয়ে থেকে যখন জ্ঞান হল তখন তিনি যেন বোবা হয়ে গেছেন। মধ্যে মধ্যে জিজ্ঞাসা করেছেন—বড়বাবু তো তাকে ভালবাসতেন, একরকম বিয়ে করেছিলেন। তো বড়বাবুর জাত যায় নাই?

তখন বড়-তরফের সঙ্গীন অবস্থা। আমার বাবা যোগেশ্বর রায় ছুটে গেছেন দাদার কাছে যজ্ঞেশ্বর রায়ের কাছে। যজ্ঞেশ্বর রায়ও শিবেশ্বরের মত  কলকাতায় রয়েছেন। নিজের বাড়ীতে থাকেন না, অন্য বাড়ীতে থাকেন। বিডন স্ট্রীটে ওঁর যে বাড়ী ছিল, সেই ঠিক পাশের বাড়ী ভাড়া নিয়ে সেখানে ওয়ারেন্ট অ্যাভয়েড করে থাকতেন। তাঁর কাছে গেল ছোটভাই।

যজ্ঞেশ্বর রায় বললেন—মাকে নিয়ে এস কলকাতায়। পাগল সার্টিফিকেট নাও ডাক্তারের কাছে, তারপর একটা বাড়ী ভাড়া করে বন্ধ করে বেঁধেটেধে রেখে দাও। কথাটা বড় চাউর হয়ে গেছে। এ ছাড়া পথ নেই।

বাবা পারেন নি মাকে বেঁধে কলকাতায় আনতে।

জ্যাঠামশাই রাত্রে গিয়ে মাকে নিয়ে এসেছিলেন। তখন মানিকবউ উন্মাদ নন অথবা উন্মাদরোগের উপসর্গটা পাল্টে গেছে। মধ্যে মধ্যে চীৎকার করেন—ঠাকুর, তুমি এসে বল! সাক্ষী দাও, ঠাকুর!

বাকী সময়টা চুপ ক’রে পড়ে থাকতেন আর আপনমনে বলতেন—এই তোমার ইচ্ছে, নয়? তোমাকে ভজলে কলঙ্কের ভাগী হতেই হবে? বেশ, তাই হোক। হ্যাঁ, আমার জাত গিয়েছে। বড়বাবুকে যখন বিয়ে করেছিলাম তখনই গিয়েছিল। কিন্তু তখন তো শালগ্রাম হয়ে সাক্ষী হয়েছিলে! আপত্তি তো কর নি? কেন?

আবার চেঁচিয়ে উঠতেন—ঠাকুর, এসে বল! সাক্ষী দাও। ঠাকুর!

এরই মধ্যে সুলতা জ্যাঠামশাই তাঁর কাছ থেকে তাঁর পৈতৃক কোম্পানীর কাগজ সই করিয়ে নিজেদের নামে ট্রান্‌সফার করিয়ে নিয়েছিলেন। বাবাও তার ভাগ নিয়েছিলেন।

খবর অন্নপূর্ণা-মা পেয়েছিলেন। তিনি এসেছিলেন দেখতে ব্যবস্থা করতে। কিন্তু জ্যাঠামশায় তাঁর সঙ্গে ঝগড়া করে তাঁকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। বাবাকে দিয়ে তখন চেষ্টা করিয়েছিলেন অন্নপূর্ণা-মা, তাঁকে এই বাড়ীতে এনে যত্নের মধ্যে রাখতে, চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে। কিন্তু এরই মধ্যে মানিকবউ একদিন ছাড়া পেয়ে বেরিয়ে পালালেন।

পালালেন একেবারে বৃন্দাবনে।

বৃন্দাবনে ভিক্ষা করেই খেতেন প্রথম প্রথম। হঠাৎ তাঁর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল এক বৃদ্ধা বাঈজীর। আগ্রার কৃষ্ণাবাঈ। বাংলাদেশের চুঁচুড়ার কায়স্থ জমিদারগৃহিণী কৃষ্ণভামিনী। দেবেশ্বরের ভিক্ষা-মায়ের। তিনি তখন বৃন্দাবন-বাসিনী হয়েছেন। অর্থ ছিল প্রচুর। তিনি নিজের কুঞ্জ করে সেখানে বাস করতেন। দেববিগ্রহ ছিল নিজের। পূজো করতেন। পাগলীর সঙ্গে প্রায়ই দেখা হত। মধ্যে মধ্যে পাগলী চীৎকার করে ডাকত—ঠাকুর, সাক্ষী দাও! এসে বল, ঠাকুর!

বাংলা কথা শুনেই তিনি ওঁকে নিয়ে যেতেন নিজের বাড়ীতে, যত্ন করে খাওয়াতেন।

ওঁরই বাড়ীতে একখানা ফটোগ্রাফ ছিল—এনলার্জ করা ফটোগ্রাফ, ন্যাড়া মাথা খড়ম পায়ে দণ্ডধারী ব্রহ্মচারী দেবেশ্বর রায়ের। কৃষ্ণভামিনী দাসীর ভিক্ষাপুত্রের।

সেই ছবি দেখে মানিকবউ হা-হা করে কেঁদে উঠেছিলেন—ও কে? ও কে? ও কে গো?

তারপর চীৎকার ক’রে ডাকতে শুরু করেছিলেন—বড়বাবু! বড়বাবু। বড়বাবু গো! দেখ—দেখ—তোমার মানিকবউয়ের দুঃখ দেখ!—ভিক্ষা করছি, বড়বাবু! আমাকে সঙ্গে কর, বড়বাবু!

এরপর পাগলীকে আর চিনতে বাকী থাকে নি কৃষ্ণাবাঈয়ের। তিনি তাঁকে বুকে তুলে নিয়ে মায়ের মত, শাশুড়ীর মত কেঁদেছিলেন কপাল চাপড়ে বুক চাপড়ে। নিজের পরিচয় দিয়েছিলেন মানিকবউকে এবং তাঁকে নিজের সন্তানের মত রেখে কলকাতায় চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছিলেন–বউমা এখানে রইলেন।

সেই অবধি তিনি সেখানেই আছেন সুলতা। তিনি ভুলে গেছেন তাঁর সন্তান, সংসার, রায়বাড়ী, কীর্তিহাট; আর যজ্ঞেশ্বর রায় যোগেশ্বর রায়ও ভুলে গেছেন তাঁদের মাকে। কেন জান? কৃষ্ণাবাঈয়ের আশ্রয়ে থাকার পর আর তাঁকে মা বলে স্বীকার করলে কীর্তিহাটের দেবোত্তর সম্পত্তিতে অধিকার থাকবে না। শুধু তাই নয় সুলতা, বাংলাদেশের ধনী অভিজাতদের মহলে কৃষ্ণাবাঈয়ের সঙ্গে মায়ের বাস করার অপরাধ অমার্জনীয় অপরাধ। তাঁরা রটিয়ে দিয়েছেন, মা বৃন্দাবনে সন্ন্যাসিনী হয়ে গেছেন। কোন সম্পর্ক তিনি নিজেই রাখেন না।

তা তিনি রাখেন না। তিনি ভুলে যেতেই চান, কিন্তু ভুলে যেতে পারেন না। মধ্যে মধ্যে এ দেশের কেউ গেলে তাঁর যত্নের প্রশংসা করেন। আর “বহুমাঈজী”র কথায় ব্রজধামের লোকেরা শ্রদ্ধায় মাথা নোয়ান।

মেজদি সেদিন রায়বাড়ীর মানিকবউ, দেবেশ্বরের অবজ্ঞাতা স্ত্রীর কথা বলে বললেন—আমাকে বরং তাঁর কাছে পাঠিয়ে দে ভাই। বাকী দিন কটা আমি তাঁর কাছেই কাটাব।

সুলতা, মানিকবউরাণী সম্পর্কে সেই আমি প্রথম বিস্তৃত বিবরণ শুনলাম; বললেন মেজদি। মেজদি আমার কীর্তিহাটের জীবনে ভাঙা রায়বাড়ীতে আমার মা, আমার সহোদরা বড়দি, আমার রূপসী ঠাকুমা সখি। শুনে আমার সমস্ত শরীর ঝিমঝিম্ ক’রে উঠল। মনে হল আমার গলাটা কেউ চেপে ধরে শ্বাসরুদ্ধ করে মেরে ফেলতে চাচ্ছে।

ওঃ—মাকে নির্বাসন দিয়ে দেবোত্তরের অধিকার নিয়েছিলেন জ্যাঠামশাই আর বাবা। আর এইভাবে অপবাদ দিয়েছিলেন মেজদাদু শিবেশ্বর রায়!

মেজদি বললেন—ভাই, রামচন্দ্র সীতাকে বনবাসে দিয়ে রাজ্যরক্ষা করেছিলেন। তিনি তো ভগবান।

হায় পঙ্গু ভগবান! হায় রাজ্য! এ রাজ্যে তার দায় থেকে আমি কি করে বাঁচব বলতে পার ঠাকুর?

—মেজদি?

মেজদি অবাক হয়ে গিছলেন আমার কথা শুনে।

সুলতা, ঠিক এই সময়ে বেলা তখন দুটো; মেজদি জেল থেকে রিলিজড হয়ে বাড়ী এসে পৌঁছেছিলেন আটটা সাড়ে আটটায়; তারপর ঠাকুমার কথা শুনতে শুনতে দুটো বেজে গিয়েছিল, খেয়াল ছিল না, দুটো বেজে গেছে; কথায় ছেদ টেনে দিলে বাইসিকিলের ঘন্টা।

—টেলি-গিরাম!

***

টেলিগ্রাম-কলকাতা থেকে টেলিগ্রাম এসেছে—কাম ইমিডিয়েটলি ম্যাটার ভেরী সিরিয়াস।

রথীনের কাকা টেলিগ্রাম করেছেন।

 কলকাতায় সন্ধ্যাতেই রওনা হলাম সুলতা। মেজদিকে পাঠাতেই হল কীর্তিহাটে। কারণ মেজদি খালাস পেলেও কীর্তিহাটের মধ্যেই তাঁর গন্তব্যের গতিবিধি টেনে দেওয়া হয়েছিল। কলকাতায় পৌঁছুলাম রাত্রে। রাত্রি তখন এগারটা। হাওড়া থেকে বরাবরই গিয়ে উঠেছিলাম হরিশ মুখার্জি রোডের বাড়ীতে।

গিয়ে দেখলাম তাঁরা অন্নপূর্ণা-মায়ের শেষকৃত্য করে সেই মাত্র ফিরছেন কেওড়াতলা থেকে ভোরবেলা অন্নপূর্ণা-মা মারা গেছেন। রাত্রি আটটার সময় থেকে হার্ট অ্যাটাক হয়েছিল। সন্ধ্যার সময় বম্বে থেকে টেলিগ্রাম এসেছিল রথীন আত্মহত্যা করেছে। টেলিগ্রাম করেছিলেন রথীনের বাবা। রথীন এক নার্সকে নিয়ে বিলেত পালাচ্ছিল। রথীনের বাবা অর্চনাকে সঙ্গে নিয়ে তার পিছনে পিছনে ছুটে গিয়েছিলেন তাকে ধরতে তাকে ফেরাতে। সেখান থেকে টেলিগ্রাম করেছিলেন—রথীন নেই। আত্মহত্যা করেছে।

খবরটা শোনবামাত্র অন্নপূর্ণা-মা বুকে হাত দিয়ে ‘কি হল’ বলে ব’সে পড়েছিলেন। তারপরই অজ্ঞান হয়ে যান। ভোর চারটে নাগাদ দীর্ঘ আশী বছরের জীবনে বোধ হয় কালের হাতে হার মেনে ভোরের নিস্তব্ধতার মধ্যে মুখ লুকিয়ে চলে গেলেন।

কীর্তিহাটে যখন গিয়ে পৌঁছুলাম সুলতা, তখন কীর্তিহাট অত্যন্ত উত্তপ্ত। ওদিকে গোয়ানপাড়ায় সরকারী তাঁবু ফেলে রিলিফ সেন্টার খোলা হয়েছে। একটা ছোট পুলিস ক্যাম্প বসে গেছে তাদের রক্ষণাবেক্ষণের জন্যে; এদিকে কীর্তিহাটে সেটেলমেন্ট ক্যাম্পের জন্য নেওয়া বাড়ীগুলোতে একটা বড় দল পুলিস এসে বসেছে—তাদের সঙ্গে আছেন একজন এ-এস-পি। সাধারণ তদন্তের জন্য একজন ডেপুটিও এসে রয়েছেন তাদের সঙ্গে। অতুলেশ্বর যা করেছিল বা করতে পারত তা তার নিজস্ব পুণ্য। কিন্তু সেই পুণ্যে বিচিত্র ভাবে বোধ হয় কালমাহাত্ম্যে রায়বাড়ী এবং কীর্তিহাট পুণ্যবান হয়ে উঠেছিল। সেকালে পুলিস যার উপর অত্যাচার করেছে এই কারণে সে-ই পুণ্যবান বলে খ্যাতিলাভ করেছে। সে তোমার অবিদিত নয়। বিচিত্রভাবে গোয়ান নির্যাতন-পর্বে জমিদার-বাড়ী এবং কীর্তিহাটের হিন্দু প্রজারা একসঙ্গে এক দড়িতে বাঁধা পড়ার মত অপরাধে অপরাধী বলে নির্ধারিত হলেও তারা দমে নি; কারণ প্রমাণ ঠিক হাতেনাতে কিছু পাওয়া যায়নি। কীর্তিহাটের কেউই দমে নি। এরই মধ্যে জগদীশ্বরকাকা আত্মহত্যা করেছেন।

গোটা গোয়ানপাড়াটা পুড়ে গেছে। অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে জীবন্ত পুড়ে মরেছে হিলডাবুড়ী। চার্চের দুইদিকে দুখানা খড়ের ঘর ছিল—একখানায় ইস্কুল হত, অন্যখানায় থাকতেন পাদরী সাহেব। হিলডা জ্বলন্ত চার্চে ঢুকেছিল মাদার মেরীর ছবিখানা বাঁচাবার জন্যে। গোয়ানপাড়ার লোকে বলে-এর মধ্যে কীর্তিহাটের কংগ্রেসীরা আছে আর রায়-জমিদারেরা। আমরা কংগ্রেসকে ভোট দিই নাই বলে কংগ্রেসওলারা গোঁসা করে আমাদের এখান থেকে ভাগায়ে দিবে বলেছে, জমিদারবাড়ীর লেড়কা অতুলবাবু ভি কংগ্রেসে আছে। জেল থেকে সে হুকুম ভেজিয়েছে। আর জগদীশবাবু আউর সুখেশ্বরবাবুর লেড়কারা হামাদের ভাগায়কে জমিন কিনে লিবে, এহি মতলবে জবরদস্তি জুলুম লাগাইলে। পহেলে হামাদের গাছ কাটিয়ে লিলে।

এর সঙ্গে আরও অনেক অভিযোগ সুলতা। কমলেশ্বর ওদের খাসী ধরে বিক্রী করে দেয়। ওদের পাড়ার মেয়েদের পিছনে ঘোরে। দু-একজন মেয়ের সঙ্গে তার কলঙ্কের সম্পর্কও আছে।

প্রত্যক্ষ প্রমাণ তারা দিতে পারে। তারা এখানে একটা প্রতিবাদ মিটিং করেছিল। সুরাবর্দী সাহেবের লোক এবং খড়্গপুরের হাডসন এসেছিল মিটিংয়ে। তাদের উপর কংগ্রেসের লোকে যে অত্যাচার করছে তার প্রতিবাদ করেছিল তারা। সে মিটিংয়ে গোপাল সিং ছত্রির বাড়ীর যে ছেলেটির হাত কুপিয়ে খোঁড়া করে দিয়েছে বিমলেশ্বরকাকা, সেও তাতে বক্তৃতা করেছে। ক্রীশ্চান মুসলমান হিন্দুর মিলিত প্রতিবাদ কম্যুনাল বলা চলবে না। মিটিংয়ে প্রিসাইড করেছিল হিলডা। তার পাশে ছিল কুইনি। এই মিটিংয়ে কমলেশ্বরবাবু আর কীর্তিহাটের কংগ্রেস ভলান্টিয়াররা এসে ঢেলা মেরে মিটিং বরবাদ ক’রে দিতে চেষ্টা করেছিল।

জগদীশ্বরবাবু তাদের পাড়ায় বন্দুক ঘাড়ে নিয়ে শিকার করবার অছিলায় এসে শাসিয়ে বলেছিলেন, চলে যাও তোমলোগ হিয়াসে। দাম দেনেকো লিয়ে তৈয়ার হ্যায় হম। লেকেন হিয়া রহেন নেহি দেগা। কভি নেহি!

একটু উল্টোপাল্টা হল সুলতা। আগে জগদীশ্বরকাকার শাসানি, তারপর মিটিং। তারপর ছোটখাটো ব্যাপার। তারপরই একদিন পুড়ে গেল গোয়ানপাড়া। হিলডা পুড়ে মরল। তার ঠিক দুদিন পরই জগদীশ্বরকাকা আত্মহত্যা করলেন।

জগদীশ্বর রায়ের আত্মহত্যা আর হিলডার অগ্নিদাহে মৃত্যু, এবং কংগ্রেসকে ভোট না-দেওয়া এই তিনটেকে জড়িয়ে পুলিশ তার দক্ষ এবং শক্ত পাক দিয়ে বেশ একটা মজবুত রশি তৈরী করছিল, যাতে রায়বাড়ীর তরুণ ছেলে কটি থেকে কংগ্রেসের বৃদ্ধ সভাপতি রঙলাল ঘোষ সহ কীর্তিহাটের কয়েকজন মাতব্বরকে এক কেসে একসঙ্গে বেঁধে চালান দেওয়া যায়।

আমাকে আমার ম্যানেজার বললে, আপনি এখানে থাকবেন না বাবু, আপনি  কলকাতায় চলে যান। এখানে থাকলে বিপদ হবে। এবার—।

আমি অপেক্ষা করে রইলাম শেষটা শুনবার জন্যে। মুখের দিকে চোখের দৃষ্টিতে প্রশ্ন নিয়ে তাকিয়ে ছিলাম। বাকীটা সম্ভবতঃ বলার ইচ্ছে ম্যানেজারের ছিল না, তবু সে বললে, এবার মেজতরফকে সেরে দিয়ে যাবে। চষে দেবে পুলিস। গ্রামের লোকও আঙুল বাড়িয়ে সাহায্য করবে না। তার উপর জগদীশ্বরবাবু এবার এলেন যেন সাপের পাঁচ পা দেখে এলেন। অৰ্চনা বিধবা হল, আপনি তার বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন—উনি এক পয়সা খরচ করেন নি। সেই মেয়ের টাকা উনি নিজের কব্জায় পেয়ে একেবারে বিলকুল ভুলে বসে ভাবলেন—পুরনো আমলের রায়বাড়ীর দাপট ফিরিয়ে আনবেন। গোয়ানদের সঙ্গে কংগ্রেসের বিরোধ হয়েছে যেই শুনলেন, অমনি ধরলেন-আমি সোজা করে দিচ্ছি ওদের। হিলডাকে ডেকে বললেন, হিলডা, কিছু কিছু টাকা নিয়ে তোরা এখান থেকে চলে যা। যাদের আবাদী জমি আছে, তাদের দাম আমি দেব। এখানে তোদের থাকা চলবে না। আমি বারণ করলাম, বললাম —বাবু, সুরেশ্বরবাবু আসুন, তিনি বলে গেছেন দু পক্ষকেই। তা আমাকে ধমক দিয়ে বললেন-ছুঁচোর গোলাম চামচিকে কোথাকার, তুই আমাকে বারণ করতে আসিস?—

পিছন থেকে রঘু বললে—লালবাবু! অরচি দিদি আসিয়াছে নিচে।

অৰ্চনা আমাকে চিঠি লিখেছিল, অত্যন্ত বিব্রত হয়ে চিঠি লিখেছিল এইসবের জন্যে। তারপর জগদীশ্বরকাকা আত্মহত্যা করেছেন। না হলে আমি এসেই ওর সঙ্গে দেখা করতাম। হয়তো ও-বাড়িতেই নামতাম।

নিচে নেমে এলাম। দেখলাম অর্চনা চুপ করে একটা চেয়ারে বসে রয়েছে। স্থির নিস্পন্দের মত। নিঃশ্বাস পড়াও বুঝা যায় না। টেবিলের উপর নতদৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবনায় যেন ডুবে আছে। আমি পিছনে এসে দাঁড়িয়েছি তাও সে বুঝতে পারে নি। আমি ডাকলাম—অৰ্চনা!

নীরবে ঘাড় ফিরিয়ে তাকিয়ে আমাকে দেখে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। বুঝলাম জগদীশ্বর কাকার আত্মহত্যার আঘাতটা মর্মান্তিক হয়ে ওর বুকে লেগেছে। টেবিলের উপর মাথা রেখে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল অৰ্চনা। আমি সান্ত্বনা দিয়ে বললাম—কাঁদিসনে ভাই। কি করবি বল? এসব দুর্ঘটনা এমনভাবে ঘটে রে যে এক মিনিট কি আধ মিনিট আগেও কেউ বুঝতে পারে না, ধরতে পারে না।

অর্চনা বললে, সুরোদা, আমার জন্যে সে আত্মহত্যা করলে। আবার বাবা আমার মুখে কালি লেপে দিয়ে—ছি ছি, সুরোদা—আমি যে ছি ছি করে মরে গেলাম! কি করে আমি মুখ দেখাব, বলতে পার? কোথায় যাব, বলতে পার?

ঘটনাটা বিচিত্র সুলতা। অর্চনার অদৃষ্ট নয়, রায়বাড়ীর অদৃষ্ট অথবা কর্মফল যা বল তাই।

গোয়ানপাড়া পোড়া এবং জগদীশ্বরকাকার আত্মহত্যার মধ্যে অপ্রত্যক্ষ যোগ থাকলেও প্রত্যক্ষ কোন যোগাযোগ নেই। জগদীশ্বরকাকা গোয়ানদের উপর খুব চীৎকার ঝঙ্কার করেছেন, অনেক শাসনবাক্য প্রয়োগ করেছেন একথা সত্য, কিন্তু আত্মহত্যা তিনি তার জন্যে করেন নি।

অর্চনা বললে-সুরোদা, এ কথা মাকেও বলতে পারি নি, তোমাকে বলছি। তবে মা হয়তো আন্দাজ করেছে। বাবা আমাকে নিয়ে এখানে আসবার পর থেকেই আর এক মানুষ হয়ে গেলেন। বড় মানুষ! খাওয়া-দাওয়া চাল-চলন সমস্ত কিছুর হাল বদলে দিলেন। বাড়ীতে কাজ করবার চাকর রাখলেন, চাপরাসী রাখলেন; খাওয়া-দাওয়া, কাপড়-চোপড়, পোশাক-পরিচ্ছদে হঠাৎ যেন সব কিছুর বদল হয়ে গেল। এখানে এসেই আমার কাছে পাঁচশো টাকা চেয়ে নিয়েছিলেন কয়েক বিঘা জমি আমার নামে কিনবেন বলে। সেই টাকা থেকে এসব হচ্ছিল। জমি পরের নয়, জমি খানিকটা পতিত জমি, তাই তিনি আমার নামে চেক কেটে বন্দোবস্ত করে দিয়েছিলেন। আমি এসব জানি, বুঝি—কিন্তু প্রথমটা বুঝতে চাই নি, টাকাটা আমি দিয়েছিলাম। কোন কথা, কোথাকার জমি, কার জমি জিজ্ঞাসা করি নি। ইচ্ছে হয় নি সুরোদা। তবে আপসোস হয়েছিল—কেন ও-বাড়ী থেকে চলে এলাম!

ও বাড়ীর কথা তোমাকে বলি নি সুরোদা, বলতে পারি নি। ওখানে, মানে ও বাড়ীতে ওদের এই পুরুষটা পচে গেছে সুরোদা, একেবারে পচে গেছে। আমাদের মতই পচেছে। তবে শহরের পচন সুরোদা। দেখে ধরা যায় না। সুরোদা—।

অৰ্চনা এতক্ষণ পাথরের মত বসে শুনেই যাচ্ছিল। সে এবার বাধা দিয়ে বললে-ওদের বাড়ীর কথা তোমার রায়বাড়ীর কথার মধ্যে নাই বা বললে সুরোদা। হয়তো দুনিয়াতে এইটেই সাধারণ নিয়ম সুরোদা। মানুষ ওঠে তপস্যা করে, নামে প্রশংসায় মহিমায় অর্থে সামর্থ্যে অসাধারণ হয়ে উঠে বংশ প্রতিষ্ঠা করে যায়। তারপর এক পুরুষ, দু পুরুষ, তিন পুরুষে সব শেষ হয়ে পাঁকের মধ্যে ডুবে যায়। হারিয়ে যায়—আর কেউ খোঁজ করে না। তবে যেখানে যত বড়ত্ব সেইখানেই তত ছোটত্ব সুরোদা;  কলকাতা শহর তার এত ঝলমলে সভ্যতা, সেখানে মনুমেন্টের তলায় গান্ধীজী সুভাষচন্দ্র মানুষকে ডাকছেন, মানুষেরা ছুটে যায় পাগলের মত—ফাঁসিকাঠে ঝোলে, গুলীতে বুক পাতে। আবার সন্ধ্যের পর মানুষের চেহারা পাল্টায়। সে চেহারা তুমি দেখেছ। এবং সবাই জানে। ওদের বাড়ীতেও তাই হয়েছিল সুলতাদি; আমার নিজের দেওর যে সে আমার স্বামীর সব খবর রাখত, রাখত আমাকে বলবার জন্যে। আমার ভয় ছিল তাকে। তাই পালিয়ে এলাম বাবার সঙ্গে। তখন ম্যাট্রিক পাসও করি নি। কালটাও এখন থেকে পনের বছর আগে। তখনও ভালবাসার দাম ছিল, সতীত্বের দাম ছিল আমার কাছে, আর সত্যি কথা বলছি তোমাকে সুলতাদি, আমার স্বামীকে ওই ছ মাসেই প্রাণ ঢেলে ভালবেসেছিলাম।

একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে অর্চনা বললে—বাপের বাড়ী এলাম, এসে আর এক বিপদে পড়লাম। আমার টাকা আমার বিপদ হল। বাবা ওই টাকার উপর দৃষ্টি রেখেই আমাকে কীর্তিহাটে এনেছিলেন। তার জন্যে অনেক চোখের জল ফেলেছিলেন।

পাঁচশো টাকা প্রথম নিয়েছিলেন ক’বিঘে ডাঙ্গা লিখে দিয়ে, সে নিয়ে আমার অভিযোগও ছিল না, আগ্রহও ছিল না, ভাবছিলাম—জীবনটা কাটাব কি করে? কি নিয়ে থাকব? অপেক্ষা করেছিলাম সুরোদাদার, বৃন্দাবন থেকে ফিরলে তার সঙ্গে পরামর্শ করে যা হয় করব। সংসারে বলতে গেলে একান্ত আপন-জন, আপন সহোদর থেকেও অধিক ছিল ওই। কিন্তু তার আগেই গোল বেধে গেল।

গোয়ানদের সঙ্গে ঝগড়া একটা কংগ্রেসের চলছিল ভোট দেওয়া নিয়ে। হিন্দুর গ্রামে কংগ্রেস মানেই শতকরা নিরেনব্বুইজন। এদিকে সুখেশ্বর কাকার ছেলের সঙ্গে আর একটা ঝগড়া ওদের চলছিল দেনা-পাওনা নিয়ে। সুখেশ্বরকাকার আমল থেকেই ওঁর নিজের একটা মহাজনী কারবার ছিল। ওঁর পর কল্যাণেশ্বর দাদা প্রকাশ্যেই শুরু করেছিলেন। গোয়ানরা ছিল ওঁদের খাতক। সুখেশ্বরকাকা আগে সোনারূপোর জিনিস রেখে টাকা দিতেন, অনেকে বলত তিনি চুরির মাল ও সামলাতেন। কিন্তু কল্যাণেশ্বরদা প্রকাশ্যে কারবার ফেঁদে জমি-পুকুর-সম্পত্তি বন্ধক নিয়ে টাকা ধার দিত। বেশী টাকা কাউকে দিত না, কম টাকা চড়া সুদে দেওয়া ছিল তার কারবার। কারবারটা চলছিল ভাল; যাদের কেউ টাকা ধার দেয় না, তাদের টাকা দেওয়ার সুবিধে হল, মহাজন যা খুশি তাই লিখিয়ে নেয়। হঠাৎ সে সময় নতুন আইন হবে শোনা গেল। ফজলুল হক সাহেব ডেট সেটেলমেন্ট বোর্ড আইন তৈরী করছিলেন। কল্যাণেশ্বর দাদা শোনবামাত্র নালিশ করে বসে থাকলেন। আইন পাস হতে হতে ওদের জমি সব নীলেম করিয়ে নেবেন। ডিক্রীও হয়ে গেল। বাবাকে ডেকে কল্যাণেশ্বরদা বলেছিলেন—জ্যাঠামশায়, অর্চির জন্যে জমি কিনবেন, তা এই ডিক্রীগুলো কিনে নিন না। ও সবই তো নীলেমে উঠলেই সেল! সে জমি কেনার মতলব মাথায় ঢুকল বাবার। তখন বুঝতে পারি নি আমি। আমার মা বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু আশ্চর্য, প্রতিবাদ তিনিও করেন নি। বরং-একটা গভীর নিঃশ্বাস ফেললে অৰ্চনা।

সুরেশ্বর বললে-থাক, তুই চুপ কর। আমি বলছি রে। হ্যাঁ, খুড়ীমা জানতেন। আমাকে তিনি বলেছিলেন–বাবা, অর্চনার ভাগ্যে যা ঘটেছিল তা তো আর ফেরাবার পথ ছিল না। বিধবা মেয়ে, জীবনটা গোটাই আছে; নগদ টাকা থাকবে না, থাকে না, টাকাটায় জমি কেনা সব থেকে নিরাপদ, থাকবে। আর তা থেকে গোটা সংসারটাই সুখের স্বাচ্ছন্দ্যের মুখ দেখবে; ছেলেগুলোকে পড়াতে পারা যাবে। আর একটা মেয়ে আছে, তার বিয়ে দিতে হবে। কিন্তু অর্চনার এতে সায় ছিল না। একবার পাঁচশো টাকা দিয়েছিল। তার দরুন উনি পাঁচ বিঘে ভাঙ্গা জমিও লিখে দিয়েছিলেন। একেবারে ফাঁকি দেন নি।

হঠাৎ অতুল জেলখানা থেকে ওর দলের ছেলেদের কাছে খবর পাঠালে, গোয়ানদের ক্ষমা করো না। কঠিন শাস্তি দাও। নইলে এরপর কীর্তিহাটের লোকদের মান-ইজ্জত ওরা রাখবে না। লীগের সঙ্গে জোট বেঁধে বুকে বসে দাড়ি উপড়ে দেবে। ওখান থেকে ভাগিয়ে দাও। উঠে যাক ওখান থেকে। সুরেশ্বরের কথা শুনো না। সে একজন ধনীর শৌখিন খেয়ালী ছেলে। তাকে বলো এটা জমিদারীর ব্যাপার নয়। এবং জমিদারী এতে চলবে না।

তারপর পুড়ে গেল গোয়ানপাড়া।

সঙ্গে সঙ্গে কল্যাণদা ব্যস্ত হয়ে উঠল, জ্যাঠামশায়, ডিক্রীগুলো জারী করবার জন্যে এর থেকে ভাল সময় আর হতে পারে না। আমি আর ফেলে রাখব না। আপনি যদি নিতে চান তবে কিনে নিন। আমার চোদ্দটা ডিক্রীতে পাঁচ হাজার কয়েক টাকার ডিক্রী। চার হাজারে অর্চিকে আমি দিতে পারি। দেখুন। নাহলে আমার আরও খদ্দের আছে। কথাটা ভাঁওতা নয়; গোয়ানদের ঘর পুড়ে গেছে, সরকারী রিলিফ হয়তো মিলবে ঘর করবার জন্য কিন্তু এ অবস্থায় মামলা লড়ে নীলাম ঠেকানো সম্ভবপর হবে না। এবং আদালতের পেয়াদা নিয়ে কীর্তিহাটের লোকেদের সাহায্যে জমি দখলেও বেগ পেতে হবে না। ডেট সেটেলমেন্ট আইন পাস হয়ে বোর্ড বসতে বসতে এসব কাজ শেষ হয়ে যাবে। জগদীশ্বরকাকা মেয়েকে এসে বললেন—, কিন্তু কি সংকোচ হল, কোথায় সংকোচ হল বলা শক্ত…।

কথাটা অসমাপ্ত রেখে একটু যেন ভেবে দেখলে সুরেশ্বর, তারপর বললে—বলা শক্তই বা বলছি কেন সুলতা, বলা বোধ হয় খুব সোজা; জমিটা কিনে স্বার্থটা সিদ্ধি হবার কথা জগদীশ্বরকাকার নিজের বলেই সংকোচ হয়েছিল তাঁর। নাহলে হবার কথা নয়। যাক সংকোচ তাঁর হল, সংকোচভরেই কথাটা প্রথম বললেন অর্চনাকে। চার হাজার টাকার চেক একখানা লিখে দে। এ সুযোগ গেলে চট করে আর মিলবে না মা। কিন্তু অর্চনা দিলে না। হয়তো সংকোচ দেখে সন্দেহ হয়েছিল। কিংবা গোয়ানদের এই বিপদের মধ্যে ডিক্রীজারী করে তাদের জমিটুকু আত্মসাৎ করবার প্রবৃত্তি হয় নি-এও হতে পারে। সে বললে—না বাবা, ওসব জমিটমিতে আমার কাজ নেই। ও আমি কিনব না।

এক ধরনের বিষণ্ণ হাসি আছে যা কান্নার চেয়েও সকরুণ। সেই হাসি হেসে অৰ্চনা বললে-আমি বুঝতে পারি নি যে বাবা লোভের এবং জেদের এতখানি বশবর্তী হয়ে পড়েছেন। বুঝলে হয়তো চেকখানা লিখে দিতাম। কি করব আমি টাকা নিয়ে? অন্তত তখন তো তাই ভাবতাম। তখন তো পৃথিবী আমার কাছে অর্থহীন হয়েই গেছে। কিন্তু ঠিক বুঝতে পারি নি। বাবা আরও দুবার বলে কেমন যেন চোরের মত ফিরে গেলেন। দুপুরবেলা নিজের ঘরে বসে আমাকে গাল দিচ্ছিলেন নেশা করে। তার সঙ্গে মাও খোঁচা দিয়ে দু-চারটা কথা বলছিলেন। আমি স্বার্থপর। আমি সুরোদার কুহকে পড়েছি। সুরোদা না বললে আমি কিছু করব না, এমন ধরনের কথার গভীরে কুৎসিত ইঙ্গিতও ছিল। শুনে আমার মাথা কেমন গরম হয়ে গেল। আমি তাঁর ঘরে এসে প্রথম সামনাসামনি দাঁড়িয়ে বলে ফেললাম —তোমাদের মতলব আমি বুঝেছি। তোমরা আমার কল্যাণের জন্য আমাকে এখানে আনো নি। এখানে আমাকে এনেছ আমার সর্বস্ব শুষে নিতে। কিন্তু সে আমি দেব না। সে আমি বলে দিলাম।

আমি ভাবতে পারি নি সুলতাদি-ওঃ! আমি ভাবতে পারি নি। ওঃ,একটু থেমে নিজেকে সামলে নিয়ে আবার অর্চনা বললে রাত্রে খাবারের সঙ্গে মানে লুচির সঙ্গে সিদ্ধি মিশিয়ে দিয়েছিলেন মা। বাবার পরামর্শমতই দিয়েছিলেন। যাতে আমি অজ্ঞানের মত ঘুমিয়ে পড়ি।  কলকাতা থেকে আসবার সময় টাকা রেখেছিলাম ব্যাঙ্কে আর গয়না রাখবার জন্যে একটা নতুন লোহার সিন্দুক আলমারী এনেছিলাম। সেটা থাকত আমার মাথার শিয়রে। সেদিন খেয়ে উঠে কিছুক্ষণ পরই মনে হল মাথা ঘুরছে যেন, শরীরটা যেন কেমন করছে; তারই মধ্যে এক এক সময় অকারণে হাসতে ইচ্ছে হচ্ছে। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম মনে নেই। হঠাৎ এক সময়ে ঘুম ভাঙল। প্রথমটা বুঝতে পারলাম না কিছু, তারপর মনে হল কে যেন কি করছে মাথার শিয়রে। হয়তো নেশার ঝোঁকের মধ্যেই চীৎকার করে উঠেছিলাম—কে? কে? কে?

কার একখানা হাত মুহূর্তে আমার মুখের উপর এসে পড়ল। মুখ চেপে ধরে চাপা গলায় বললে—চুপ! সে গলার আওয়াজ ভয়ঙ্কর।

হাতখানাও অত্যন্ত কঠিন এবং নির্মম। পেষণের যন্ত্রণার মধ্যে বোধ হয় আমার নেশার ঘোর কেটে গিয়েছিল, আমি একটা গন্ধ থেকে চিনতে পেরেছিলাম এ হাত বাবার। গাঁজার গন্ধ উঠছিল। এদিকে এমনভাবে আমার মুখ চাপা পড়েছিল যে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছিল, প্রাণপণে ধাক্কা দিয়ে মুখ ছাড়িয়ে চীৎকার করে উঠলাম-বা-বা! বলতে পারব না সুরোদা, এতখানি শক্তি আমার কোথা থেকে এসেছিল।

সঙ্গে সঙ্গে দুখানা হাত সাঁড়াশীর মত আমার গলার উপর এসে পড়ল। দম বন্ধ হয়ে আসছিল, অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছিলাম। এরই মধ্যে কার যেন গলা শুনেছিলাম—ওগো, ওগো। আর কিছু শুনি নি। জানি না। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। যখন জ্ঞান হল তখন দেখি আমার মুখ মাথা জলে ভিজে গেছে, বিছানা ভিজে গেছে; আর কান্না উঠছে; গোলমাল উঠছে। ও ঘরে বাবা নিজের বন্দুকের নলটা মুখে পুরে ঘোড়া টিপে দিয়েছেন, খুলিটা ফাটিয়ে দমদম বুলেট বেরিয়ে গেছে। তেলোর কাছটা এতখানি জায়গায় একটা গহ্বর সৃষ্টি হয়ে গেছে।

এখানেই শেষ নয় সুলতাদি, কিন্তু সে কথা আমি বলতে পারব না। কোন মেয়েছেলে বলতে পারে না। রায়বাড়ী এত বড় বাড়ী। এত তার মান, এত তার মর্যাদা, এখনও জমিদারী সুরোদার টাকার বাঁধনে আটকে আছে—তার মর্যাদা মান তো বাঁচাতে হবে। তার জন্য হতভাগিনী একটা কন্যাকে বলি যদি দিতেই হয় তো না দিয়ে উপায় কি!

ওঃ! বলে সে দুই হাতে নিজের মুখ ঢাকলে।

সুরেশ্বর বললে-সুলতা, সম্পদের মধ্যে বিষ আছে। জীবনকে বিষিয়ে দেয়। রায়বাড়ি সেই বিষে একেবারে জর্জরিত হয়ে গিয়েছিল। আক্ষেপের সঙ্গে ঘাড় নেড়ে সুরেশ্বর বললে—ধনেশ্বর কাকা, মেজতরফের বড় ছেলে, তিনি ভাইপোদের সঙ্গে পরামর্শ করে রটিয়ে দিলেন কি জান সুলতা? রটিয়ে দিলেন, অর্চনার ঘরে গভীর রাত্রে সাড়া পেয়ে জগদীশ্বর উঠে এসেছিল বন্দুক হাতে করে। কিন্তু কন্যার কলঙ্ক বংশের কলঙ্ক ঢাকবার জন্যে নিজের ঘরে গিয়ে আত্মহত্যা করেছেন। অর্চনার মা মুখ টিপে বন্ধ করে রইলেন। প্রতিবাদ করা দূরে থাক, মুখ তুলে মেয়ের দিকে একবার তাকালেন না পর্যন্ত। হয়তো তাকাতে পারলেন না।

সুরেশ্বর বললে—সেদিন দুপুরবেলা বিবিমহলে টেবিলের উপরে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে সমস্ত কথা আমাকে ব’লে অর্চনা বললে—আমি কোথায় যাব, কি করব, কি করে এরপর জনসমাজে মুখ দেখাবো বলতে পার সুরোদা? আমাকে একটা পথ দেখিয়ে দাও।

আমি চুপ করে বসে সামনের জানালা দিয়ে তাকিয়ে ছিলাম কাঁসাইয়ের ওপারের সিদ্ধাসনের জঙ্গলের দিকে। যে জানালাটার নিচে মধ্যে মধ্যে গোয়ানপাড়ার মেয়েরা এসে খিলখিল করে হাসত, এবং বিবিমহলের একটু পশ্চিমে কাঁসাইয়ের দহের মধ্যে তারা মৎসকন্যার মত সাঁতার দিত, যে জানালাটার ওপাশেই কাঁসাই তীরভূমির লম্বা অর্জুন গাছগুলোর ডালে বসে ‘বউ কথা কও’ পাখী ডাকত—এটা সেই জানালা। আমি কোন পথই দেখতে পাচ্ছিলাম না। না সুলতা, পাচ্ছিলাম না নয়, পথ আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, কিন্তু সে কথা বলতে, অন্ততঃ অর্চনাকে বলতে আমার সাহস ছিল না এবং পূর্ণ-সত্য প্রকাশ করতে হলে নিজের ক্ষুদ্রতাও বলতে হবে; অকপটে স্বীকার করছি, পথ ছিল; দেখতে পাচ্ছিলাম অর্চনার আবার বিবাহের পথ, সেই পথই একমাত্র তার সার্থকতার পথ। কিন্তু আমি জানতাম অর্চনা সে পথ নেবে না, নিতে পারে না এবং কীর্তিহাটের রায়বংশের শেষ সমৃদ্ধ এবং সম্পদশালী পুরুষ, আমার জিহ্বা একথা উচ্চারণ করতে পারছিল না; বলবার চেষ্টা করতে গেলে ইচ্ছে হচ্ছিল নিজের গলা নিজে চেপে ধরি।

অথচ আমি টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরীর মডার্ন জার্নালিস্ট যোগেশ্বর রায়ের ছেলে, আমি নিজে আলট্রামডার্ন আর্টিস্ট সুরেশ্বর রায়। নগ্ন বাস্তবতা যে কি বিচিত্র সত্য তা সেদিন বোধ হয় প্রথম অনুভব করে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। জীবনে যাকে জীবনের দাবী বলে অন্তরে অন্তরে মানি, স্বীকার করি, বাইরে তাকে সমাজের দায়ে, বংশমর্যাদার দায়ে স্বীকার করতে পারলাম না। সুলতা, কিছুতেই আমি বলতে পারলাম না অর্চনাকে, অর্চনা তুই আবার বিয়ে কর। বরং মনে করতেই যেন মন কেমন করে উঠেছিল, রায়বাড়ীর বিধবা মেয়ে আবার বিয়ে করবে?

অর্চনা আমাকে আবার প্রশ্ন করলে-বলো সুরোদা, বলো আমি কি করি এখন! কি করা উচিত?

একটু চুপ করে থেকে বললে —তোমাকে একটা কথা বলি নি সুরোদা, তোমাকে বলি সেটা। আমার ভয় করছে, টাকা-গয়নার জন্যে আমাকে এরা মেরে ফেলতে পারে। কিংবা আমাকে—

চুপ করে গেল. অৰ্চনা।

সবিস্ময়ে জিজ্ঞাসা করলাম- তোর মিথ্যে কলঙ্ক দেবে?

—তা দিতে পারে। কিন্তু দিয়ে তো কোন লাভ হবে না। টাকাটা তো তাতে পাবে না। হয়তো আমার শ্বশুরবাড়ী থেকে যেটা মাসোহারা সেটা বন্ধ হতে পারে, কিন্তু যে টাকাটা ইনসিওরেন্সের দরুন পেয়েছি—যে গয়নাগুলো আছে সে তো আমারই থাকবে। লোভ তো ওদের এইগুলোর ওপরেই।

বুঝতে পারলাম না অর্চনা কি বলতে চাচ্ছে। বললাম—কি বলছিস তুই?

অর্চনা শুধু বললে-সুরোদা, সেজকাকার অসাধ্য কর্ম ছিল না। সে সব পারত। দাদু ঠাকুরদের গহনা গালিয়ে বিক্রী করে নিজেদের কতকগুলো পতিত জমি খারাপ জমি বিক্রী দেখিয়েছিলেন। কিন্তু সবটা করেছিলেন সুখেশ্বরকাকা। উনি তার মধ্যে থেকেও সোনা সরিয়েছিলেন, আর সরিয়েছিলেন দামী পাথর। জানতে পেরেও দাদু কিছু বলতে পারেন নি। কল্যাণেশ্বরদা তার থেকেও ভয়ানক, সে সব পারে। পারে না এমন কাজ নেই। ভয় আমার ওকেই। নইলে কত অনাথা বিধবা মেয়ে গ্রামের লোকের ভরসায় কুঁড়েঘরে দুঃখ মেহনত করে জীবন কাটিয়ে দেয়। পেটের ভাবনা ছাড়া আর কিছুর ভাবনা তো থাকে না। শুধু কল্যাণেশ্বর দাদা কেন?

—একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে অর্চনা বললে, সুরোদা, আমার সমবয়সী দু মাসের ছোট আমার থেকে, জ্যাঠামশায়ের ছেলে অরুণেশ্বর, তোমার জ্যাঠার ছেলে প্রণবেশ্বর—এদের কাউকে বিশ্বাস নেই। তুমি জান না সুরোদা, তুমি যেদিন বৃন্দাবনে গেছ, তার পাঁচদিন পর প্রণবেশ্বরদা এখানে এসে হাজির হয়েছে। বাবা মারা যাবার ঠিক পরদিন।

আমি শিউরে উঠলাম সুলতা। চোখ দুটো যেন আপনা থেকে বন্ধ হয়ে এল। রায়বাড়ীর দিকে তাকাতে আমার ভয় করছিল। কথাটা মুখে আনতে আনতে আমার জিভ কুঁকড়ে যায়। অর্চনা বললে-তোমার যায় কিন্তু সেদিন মানে বাবার মৃত্যুর পরই কথাটা ওদের মনে উঠেই ক্ষান্ত থাকে নি, জিভেও বেরিয়েছিল। আমি গিছলাম ঠাকুরবাড়ী। মনের একান্ত দুঃখে মায়ের কাছে চুপ করে বসেছিলাম, কাছারী ঘরে বসেছিল কল্যাণেশ্বর আর প্রণবেশ্বরদা। ওদের কথা হচ্ছিল। দুজনেই তারা আমার মনোরঞ্জন বা মনোহরণের চেষ্টা করবে। কল্যাণেশ্বর বলছিল—পাপ! হুঁ! তুমিও যেমন, ও পাপ নিরেনব্বুইটা ঘরে। মুসলমান ক্রীশ্চানদের তো দোষই নেই। আর ও তো খারাপ হবেই। সতেরো-আঠারো বছরে বিধবা হয়ে ও সতী থাকবে! বেশ আছ তুমিও! ওই পয়সা কপালে সুরোর ভাগ্যে আছে।

প্রণবেশ্বরদা উত্তর দিয়েছিলেন—আমার বিশ্বাস, যা হবার তা হয়ে গেছে। বলে হাততালি বাজিয়ে হেসে উঠেছিল, তারপর আবার বলেছিল, আমি তো সাফ কথা বলে দিছলাম জামাই ছোকরাকে—রথীনকে। সে বিশ্বাসও করেছিল।

সুরেশ্বর অর্চনাকে থামিয়ে দিয়ে বললে—সুলতা, আমার সেদিন মনে হয়েছিল রায়বংশ ধ্বংস হয়ে যাক। একটা ভূমিকম্প হোক, গোটা রায়বাড়ী থর-থর ক’রে কেঁপে হুড়মুড় করে সব ছেলেপিলে বুড়ো-বুড়ী ধ্বংস করে দিক। এদের বেঁচে থাকবার আর কোন অধিকার নেই। আমি দিগবিদিগ জ্ঞানশূন্য হয়ে যে কথাটা বলতে পারি নি, সেই কথাটাই বলে ফেললাম, বললাম—তুই আজই আমার সঙ্গে এখান থেকে চলে চল অৰ্চনা,  কলকাতায় চল। সেখানে তুই নতুন করে জীবন আরম্ভ কর। পিছনটা মুছে দে। ভুলে যা। আমি বলি—তুই পড়াশোনা আরম্ভ কর। পরীক্ষা দে। তোর যা বুদ্ধি তাতে তুই পাস করতে পারবি। নিশ্চয় পারবি। তারপর নিজে বিচার করে যা হয় করিস। ইচ্ছে হয় আবার বিয়ে করে ঘর-সংসার পাতিস। না হয় যা ভাল লাগবে করবি।

—ছি! অর্চনা আমাকে এমন একটা ছিছিক্কার দিয়েছিল উত্তরে যে সেটা আমাকে সূঁচের মত বিঁধেছিল সুলতা।

আমার রায়বংশে জন্ম সেটা যেন আমাকে চাবুক মেরে মনে করিয়ে দিয়েছিল। সেটা আজও ভুলি নি। ওর কাছে আমি মাথা হেঁট করেই থাকি। আজও ও ওর ওই সত্যটাকে সত্য করেই তুলে রেখেছে—রয়েছে। মিথ্যে হতে দেয় নি।

এরই মধ্যে কখন যে বিকেল হয়ে গিয়েছিল সেদিন তা জানতেও পারি নি। জানতে পারলাম নিচের কোলাহলে।

রঘুয়া এসে বললে—গোয়ানপাড়ার গোমেশ, ভিকু, আরও দুজন এসেছে, তারা দেখা করতে চায়। সঙ্গে একজন কনেস্টবল আছে।

গোমেশ, ডিক্রুজ আমার কাছেই কাজ করত। তারা এই ভোটের ঝগড়ার পর থেকেই কীর্তিহাটে ঢুকতে হবে বলে ভয়ে আসে না। এবং ভয় শুধু তাদেরই নয়—আমার ওখানকার নায়েবও আমার জ্ঞাতিদের ভয়ে তাদের রাখতে সাহস করে নি।

নিচে নেমে গেলাম। গোমেশ, ডিক্রুজ সেলাম করে বললে—হুজুর, দুপুরে ফিরে আসছেন শুনে এসেছি হামিলোক। এরপরই “হামিলোকের বাড়ীঘর সব কিছু পুড়ে গেলো বাবু! ছাই হয়ে গেলো!” বলে গোমেশ হাউহাউ ক’রে কেঁদে উঠল। “কিছু বাঁচলো না বাবু, কিছু না।”

ডিক্রুজ বললে—চার্চ পুড়ে গেলো, মেরী মায়ের ছবি ছিলো, পুড়ে গেলো। হামি লোককে রায়হুজুর একশো বরিষের নাগচ হল আনলেন। বসাইলেন। বাবু—

আমি তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বললাম-কি করব বল? আমি থাকলে হয়তো এমনটা হতো না। আমি ছিলাম না—এমন হয়ে গেল। বলতে পারব না কার দোষ, কে দায়ী। আর তা বলেও লাভ নেই। যাই হোক, কি করতে পারি ভেবে দেখি। কাল সকালে আমি তোমাদের পাড়ায় যাব। দেখে আসব।

গোমেশ বললে—ডরকে মারে আপনার নোকরি ছেড়ে দিয়েছি হুজুর। এই গাঁয়ে আমরা ঢুকতে পারি না। কুইনি একঠো চিঠি দিয়েছে আপনাকে। উভি আপনেকে যাবার কথা লিখেছে। আপনে নিজের চোখসে দেখেন কি হাল হ’ল গোয়ানদের।

কুইনির চিঠিখানা খুলে পড়ে দেখলাম, সে লিখেছে—“আপনার কথায় নির্ভর ক’রে কি অবস্থা হয়েছে গোয়ানদের এসে দেখে যেতে অনুরোধ করছি। আজই এলে সুখী হব। কারণ আমি কালই চলে যাব খড়্গপুর। তার আগে আপনার সঙ্গে দেখা হওয়া আমার প্রয়োজন। আজই আসতে অনুরোধ করছি। গোয়ানরা অনেকে ঠিক করেছে তারা তাদের জমি বেচে দিয়ে হয় খড়্গপুর চলে যাবে, নয়তো  কলকাতা কি আসানসোল।”

মনটা কেমন ক’রে উঠল সুলতা! চলে যাবে? ওরা এতকাল পরে চলে যাবে এখান থেকে? বিবেচনা ক’রে, বিচার ক’রে দেখলে এইটেই ঠিক যে, তাতেই তাদের মঙ্গল ছিল। তারা এসে পড়ত রেলওয়ে কলোনীতে। তাতে ক্রীশ্চানদের মধ্যে এসে অল্পদিনেই তাদের চেহারা পাল্টাতো। তারা কারখানায় ঢুকে প্রকাশ পেতো নতুন জীবনে। কিন্তু সে কথা মনেই এলো না। তার বদলে মনে এল মনে হল, চলে যাবে? না—যেতে দেব না।

অহঙ্কার হ’ল, ওরা আমার কথা শুনবে। গোয়ানপাড়া আমিই নিষ্কর ক’রে দিয়েছি। আমাকেই ওরা আজও রায়বাবু বলে মানে। হিলডা সেদিনও মেদিনীপুরে ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নালিশ করতে গিয়েও আমি মেদিনীপুরে রয়েছি জেনে আমার কাছে গিয়েছিল।

হিলডা আমার কথা রাখতে গিয়েই এমনভাবে পুড়ে মরল। কুইনিকে মনে পড়ল। কুইনিকে আমিই গড়ে তুলেছি। রায়বাড়ীর বড়তরফের কাছে এত বড় পাওনাদার আর কেউ নেই। আমার অত্যন্ত আপনার জন। শুধু বড়তরফেরই বা কেন? অঞ্জনা দেবীকে ধরলে সব তরফ দেনদার।

তারই জন্যে, সুলতা, আমার ছবির ধারায় দেখো তুমি অঞ্জনা এবং কুইনীর চেহারা একরকম। তফাৎ শুধু কালের মেকআপে। রত্নেশ্বর রায় অঞ্জনাকে ঘর ছাড়িয়ে নিজের কাছে এনে শুধু কোলের কাছে এক অন্ন পঞ্চাশব্যঞ্জন সাজিয়ে দিয়েছিলেন, কিন্তু খেতে দেন নি। উপবাসী রেখেছিলেন। আমার পিতামহের আগে দায় তাঁর।

আমি কোন কথা আর ভাবলাম না। অর্চনাকে বললাম—অৰ্চনা, তুই যা এখন ও বাড়ীতে। আমি গোয়ানপাড়া থেকে ফিরে এসে ও বাড়ীতে যাব। খুড়ীমার সঙ্গে কথা বলে তোকে আমি নিয়ে আসব এ বাড়।

অর্চনা মুখের দিকে তাকিয়ে বললে—গোয়ানপাড়া যাবে সুরোদা? এই সন্ধ্যের মুখে?

হেসে বললাম—ভয় নেই কিছু, ভাবিসনে। আমি তো ক্ষতি কারুর করি নি!

—তা কর নি। কিন্তু তোমার ক্ষতি হলে অন্যের অনেক লাভ হতে পারে সুরোদা!

বলললাম -না—না না। এত ভয় পেলে চলবে কেন! আমি শিগগির ফিরে আসব। গোয়ানদের আমি কথা দিছলাম রে। আমার কথাতেই ওরা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে নালিশ না জানিয়ে সেদিন ফিরে এসেছিল। আমি বলেছিলাম—আমি চেষ্টা করে দেখি। যদি মেটাতে না পারি, তা হলে যা হয় করবে তোমরা। আমার বিশ্বাস ছিল অৰ্চনা আমি মেটাতে পারব। রঙলাল ঘোষ এখানকার কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট, তিনি আমাকে ভালবাসেন। খাতির করেন। আমি এখানকার গোচর বাউ নিষ্কর করে দিয়েছি, আমার কথা থাকবে। কিন্তু তার আগেই তোর সর্বনাশের টেলিগ্রাম পেয়ে চলে গেলাম কলকাতা। তারপর বৃন্দাবন। এর মধ্যে আগুন জ্বলে গেছে। আমার একটা দায় আছে ভাই।

সুলতা, হঠাৎ মনে পড়ে গেল বৃন্দাবনের ঠাকুমার কথা। হোন তিনি পাগল, তবু তিনি আমার ঠাকুমা। তাঁর কথাটা আমার কানের পাশে যেন বেজে উঠল।—নাতি, ভায়লার দেনা আগে শোধ করো ভাই। তোমার ঠাকুরদার এত বড় দেনা আর নেই। এ দেনা শোধ না করলে তাঁর মুক্তি নেই।

একালে পরকাল অন্তত শিক্ষিত লোকে মানে না। আমি মানি কিনা জানি না, তবে সেদিন দশ আনা অন্ততঃ মানতাম না। তবু তাঁর কথাটা সেদিন সত্য বলেই মনে হয়েছিল।

অর্চনাকে বললাম—বলব, আরও কথা আছে তোকে বলব। এসে বলব। আমার না গিয়ে উপায় নেই।

কাঁসাই পার হয়ে গোয়ানপাড়া যেতে এবং ফিরে আসতে ঘণ্টাখানেক লাগে, আর ওখানকার কাজ মেটাতে লেগেছিল ঘণ্টাখানেক

কাজ খুব সংক্ষেপেই সেরে এসেছিলাম। প্রায় দেনদার যেমন পাওনাদারের টাকা দিতে গিয়ে বলে—হিসেবনিকেশ থাক, এই টাকা আমার আছে, এই আমি দিচ্ছি। এতে যদি খালাস দিতে হয় দিন; না-হলে দলিলের পিঠে উশুল দিয়ে লিখে রাখুন; পরে দেখব হিসেবনিকেশ ক’রে আর কত আপনার পাওনা।

কুইনি প্রত্যাশা করেছিল আমি আসব। পোড়া চার্চটার পাশে একটা টিনের চালা বেঁধে তখন সেখানে থাকে। হিলডার বাড়ীটা একেবারে পুড়ে গেছে। হিলডার বাড়ীই কুইনীর বাড়ী। ওই চালাটার সামনে বসবার একটু ব্যবস্থা ক’রে রেখেছিল। সেইখানেই বসেছিলাম।

গোয়ানপাড়ার লোকেরা ভিড় করে এসে ঘিরে দাঁড়িয়েছিল। তাদের দিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠেছিলাম। মানুষগুলির দৃষ্টিতে একটা বিরোধের রুক্ষতা যেন ঝিলিক মারছে। একটু অস্বস্তি বোধ না করে পারি নি। এ প্রত্যাশা তো করি নি আমি।

কে একজন বলে উঠল ভিড়ের মধ্যে থেকে—“ দেখেন আমাদের হাল দেখেন!” আমি কুইনিকে কাছে ডেকে বললাম —কুইনি, তুমি ওদের বল যে প্রত্যেক পরিবারকে আমি একশো টাকা হিসেবে সাহায্য দেব। আর তোমাদের চার্চের জন্যে আলাদা পাঁচশো টাকা দেব।

এতে সাধুবাদ উঠল না, জয়ধ্বনি দূরের কথা। চুপ ক’রে রইল সকলে। একজন কেউ বলে উঠল—একশো রূপেয়া-সে কি হোবে?

আমি হেসে বললাম—কিন্তু এর জন্যে তো আমার কোন অপরাধ নেই।

—আপনার না থাক, রায়বাবুদের দায় আছে। অতুলবাবু কংগ্রেসী কাম ক’রে জেল গেলো, তব ভি রায়বাড়ীর চাল ছাড়লে না। জেলসে হুকুম পাঠালে কি—গাঁও জ্বালা দেও।

অবাক হয়ে গেলাম আমি, বললাম -অতুলবাবু হুকুম পাঠিয়েছিল?

—হাঁ অতুলবাবু। আমরা জানি, শুনেছি।

মিসেস হাডসন গম্ভীরভাবে বসেছিল, সে বলল—So we have heard it is a very strong rumour. We shall try to prove it.

কুইনি বললে—সকলেই তাই বলছে।

বললাম—বলুক। সত্য হলে সেটা অতুলের দায়। আমার নয়। তবে তোমার দিদিয়ার ঘর পুড়ে গেছে, সে নিজে পুড়ে মারা গেছে, তার ক্ষতিপূরণ পুরো করব আমি

বাধা দিয়ে কুইনী বললে—ধন্যবাদ স্যার, কিন্তু সে আমি চাইনে, নেব না। এখানকার লোক আমি নই। আমি বাঙালী ক্রীশ্চান। আমি খড়্গপুর থেকে  কলকাতা চলে যাব। কীর্তিহাট থেকে, গোয়ানপাড়া থেকে দূরে থাকতে চাই।

আমি তার মুখের দিকে তাকালাম।

সে বললে–আপনি চার্চটি আগাগোড়া নতুন করে দিন। আমার দিদিয়া ওই চার্চের ভিতর মাদার মেরীর ছবি বাঁচাবার জন্যে ঢুকেছিল আর বের হ’তে পারে নি। ওতেই দিদিয়ার তৃপ্তি হবে।

বললাম—বেশ তাই দেব। আর নিজে আমি ম্যাডোনার ছবি এঁকে দেবো।

তবু লোকে খুব খুশী হয় নি। কেউ একজন পিছন থেকে ব্যঙ্গ ক’রে বলেছিল—জিমিদার! হিয়া জিমিদারী মারাতে আসছে। থুক্ ফেকো একশোও রূপেয়া পর। কি হোবে বাবা?

মনে মনে একটু বিষণ্ণ হাসি হাসলাম। কিন্তু কি করব? কোন উপায় ছিল না।

ফেরবার সময় আমার সঙ্গে গোমেশ ডিক্রুজ আসছিল। ওরা আমার কাছে কাজ করত। ওরা সে কৃতজ্ঞতাটুকু ভুলতে পারে নি। বা ওদের প্রত্যাশা তখনও ছিল। ওরা আমার সঙ্গে আসছিল আমাকে পৌঁছে দিতে। কাঁসাইয়ের গর্ভে তখন অন্ধকার যেন জমাট বেঁধে উপরে দিকে উঠছে। বিস্তীর্ণ বালুময় গর্ভ জুড়ে সেই অন্ধকারের মধ্যে ঝিঁঝিরা মুখর হয়ে উঠেছে। তারই মধ্যে তিনটি মানুষ যেন বোবা হয়ে গেছে মনে হচ্ছিল।

হঠাৎ এক সময় ডিক্রুজ বললে-নোকর হিসেবে আমাদের বাহ্ মনে রাখবেন হুজুর। সব লোককে শ রূপেয়া দিবেন—হামরাদের তো বেশী মিনসা চাই।

না বললাম না। বললাম—আচ্ছা।

ওরা এতক্ষণে মুখর হয়ে উঠতে চাইলে। আবোলতাবোলই বকছিল ওরা। আমি কান দিই নি। আমি ভাবছিলাম। ভাবছিলাম টাকাটা বোধ হয় মিথ্যেই অপব্যয় করলাম। বংশের দেনাপাওনা বলে কোন কিছুর অস্তিত্বই নেই। নিরর্থক। অর্থই হয় না। কিন্তু এই কথাটা যেন শক্ত এবং সোজা হয়ে ভেঙে পড়া আমার ভার সইতে পারছিল না। বেঁকে যাচ্ছিল। নুয়ে পড়ছিল। আসলে আমি আহত হয়েছিলাম। ওদের এই অকৃতজ্ঞতা আমি প্রত্যাশা করি নি।

হঠাৎ চমকে উঠলাম গোমেশের কণ্ঠস্বরে। ভয়ার্ত কণ্ঠে সে বলে উঠল-বাবুজী, অনেক লোক! বলেই তারা ছুটে পালাল। আমি চমকে উঠে মুখ তুলে দেখলাম কাঁসাইয়ের ঘাটের উপর অনেক কয়েকজন লোক দাঁড়িয়ে আছে। নিস্তব্ধ নীরব পাথরের মূর্তির মত। জিজ্ঞাসা করলাম-কে?

—আমরা কীর্তিহাটের। আপনার জন্যেই দাঁড়িয়ে আছি।

—আমার জন্যে—

—হ্যাঁ। আপনি আসুন আমাদের সঙ্গে।

—কেন? কি ব্যাপার?

—গ্রামে বিচার সভা বসেছে পঞ্চায়েতের। রায়বাড়ীর কালীমায়ের নাটমন্দিরে। আসুন আমাদের সঙ্গে।

গিয়ে দেখলুম—সত্যই নাটমন্দিরে গ্রামের লোকেরা জমায়েত হয়েছে। রায়বাড়ীর প্রবীণতম পুরুষ ধনেশ্বর রায় থেকে প্রণবেশ্বর, কল্যাণেশ্বর প্রভৃতিরা একদিকে বসে আছে; অন্যদিকে বসে আছে দয়াল দাদা থেকে ব্রাহ্মণ কায়স্থ প্রভৃতিরা; মাঝখানে বসেছেন বৃদ্ধ রঙলাল ঘোষ। পাশে তাঁর উকীল ছেলে।

কংগ্রেসের সভাপতি রঙলাল ঘোষ বিচারক সভাপতি। গ্রামের লোকেরা বিচার প্রার্থনা করেছেন। তাঁর সঙ্গে আজ কণ্ঠস্বর মিলিয়েছেন রায়বাড়ীর রায়বংশধরেরা।

অভিযুক্ত আমি। সুরেশ্বর রায়। রঙলাল ঘোষ বললেন—আসুন বাবা। বসুন। আপনার বিরুদ্ধে তো অনেক নালিশ গো!

সুরেশ্বর বললে—দপ্ করে যেন আমার মাথায় আগুন জ্বলে উঠেছিল। ইচ্ছে হয়েছিল চীৎকার করে উঠি। একদিন এই নাটমন্দিরেই ভয়ার্ত মেজদিদির হাত ধরে প্রায় টেনে এনে ধনেশ্বর, প্রণবেশ্বর, কল্যাণেশ্বর সকলের মুখের উপর চীৎকার করে বলেছিলাম, এখানকার মালিক আমি। আমার হুকুম ছাড়া অন্যের অন্যায় হুকুম আমি চলতে দেব না। মেজরায়গিন্নীর অপমান হলে আমি সহ্য করব না। দিন ঠাকুরমশাই, মেজদিকে পুষ্প-চরণোদক দিন।

কথাটা তোমার বোধ হয় মনে পড়বে সুলতা। সম্ভবত আরও মনে আছে সেদিনের কথা, যেদিন সেটেলমেন্ট সার্কেল অফিসার হরেন ঘোষের সামনে গোচর নিয়ে ধনেশ্বর-কাকাদের ঝগড়ার মধ্যে আমি আদিপুরুষ কুড়ারাম রায়ের কড়চার কথা স্মরণ করে বলেছিলাম —কীর্তিহাট বসতবাড়ি আর গোচর নিষ্কর দিয়ে গেছেন কুড়ারাম রায়, তখন ধন্য ধন্য করে উঠেছিলেন এই রঙলাল ঘোষ। সেদিন বলেছিলেন—হ্যাঁ, জমিদারের পুত্র ব্রাহ্মণের ছেলে বটেন বাবা আপনি! নমস্কার বাবা আপনাকে।

মনে পড়ে গেল, রত্নেশ্বর রায় যেদিন নিজের অধিকারে ফিরে এই কালী-মায়ের মন্দিরের বারান্দায় প্রথম কাছারী করেছিলেন, প্রজাদের প্রণাম আর সেলামী নিয়েছিলেন।

মনে পড়ল—তার পরের দিন বীরেশ্বর রায় রত্নেশ্বরকে নিয়ে কাছারীতে বসে পুণ্যাহ উপলক্ষে জমিদারীর সীমানার মধ্যে খেয়াঘাটের ডাক, হাটের ডাক আর মৌজা বীরপুরের মণ্ডলান আদায়ের ডাক করিয়েছিলেন, সেদিনের কথা।

আশ্চর্য সুলতা, জমিদারী নিজে কখনও করি নি। করতেও চাই নি। বরং প্রজারাই অযাচিত ভাবে আমার কাছে বিচারের জন্য এসেছে সময়ে সময়ে। আমি বিব্রত বোধ করেছি। কিন্তু সেদিন—যেদিন তারিখ ছিল ১৯৩৮ সালের মে মাসের শেষ, সেদিন ওই রঙলাল ঘোষের সামনে অভিযুক্ত হিসাবে দাঁড়াবার সময় দেখলাম, রায়বাড়ীর জমিদারত্বের সবটুকু আশ্রয়হারা হয়ে কখন আমার মধ্যেই আশ্রয় গ্রহণ করে বলছে—“আমাকে বাঁচাও। আমাকে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কুড়ারাম ভট্টাচার্য, তারপর সোমেশ্বর রায়, বীরেশ্বর রায়, রত্নেশ্বর রায় আমাকে গড়ে গেছেন; তারপর থেকে আমাকে সকলে হাতুড়ি মেরে ভেঙে ভেঙে আসছে, তার মধ্যে আমার মরতেও ভাল লাগছিল কিন্তু এইভাবে আত্মসমর্পণ করে বলিদানের জন্তুর মত মরতে আমার আর লজ্জার শেষ নেই—সীমা নেই।”

রঙলাল ঘোষ হাত দিয়ে সামনের আসরে আমার বসবার জায়গা নির্দিষ্ট করে দিলেন। আমি ভুরু কুঁচকে খানিকটা ভেবে নিয়ে বললাম- নালিশ আমার বিরুদ্ধে কে করলে আপনার কাছে?

সঙ্গে সঙ্গে অনেক লোক বলে উঠল—আমরা। আমরা গ্রামের লোক।

সমস্ত কণ্ঠ কটি তরুণ। প্রবীণেরা মাথা হেঁট করে বসে রইলেন।

আমি তাদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম—গ্রামের লোকের অভিযোগ কি, তা আমি জানি না কিন্তু অভিযোগের বিচারের এই আইন, এই ব্যবস্থা কে করলে? বিচার উনি করতে বসেছেন কিসের বলে?

একসঙ্গে অনেকগুলো হিংস্র মানুষ গর্জন করে উঠল। বললে—আমরা দিয়েছি, আবার কে? গ্রামের লোকেরাই দিয়েছি। কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট উনি, উনি ছাড়া বিচার করবেন কে?

রঙলাল ঘোষ এবারও বললেন—অন্যায় কথা হল বাবা, অন্যায় কথা হল! দেখুন, জমিদার হোন, ব্রাহ্মণ হোন, যা হোন—দশকে মানব না বললে চলবে না। দেশে আর দশে তফাত নেই বাবা। বিচার মানতে হবে। অভিযোগ শুধু গাঁয়ের লোকে করে নাই বাবা। আপনার বংশের এইসব এঁরাও করেছেন।

মাথার মধ্যে, বুকের মধ্যে একটা কি যেন পাক দিচ্ছিল। মনে হচ্ছিল চীৎকার করে উঠি। বলি—না-না-না!

আমার নীরবতার মধ্যে একজন কে বলে উঠল—উনি গ্রামের লোকের, দেশের লোকের ইচ্ছের বিরুদ্ধে, তাদের সঙ্গে একরকম বিরোধ করেই আজ ওই গোয়ানপাড়ায় গিয়ে তাদের ঘরপিছু একশো টাকা সাহায্য দেব বলে এসেছেন। চার্চকে নতুন করে গড়তে যা খরচ লাগবে দেবেন। ইচ্ছে করে গাঁয়ের অপমান করেছেন উনি। তাছাড়া উনি, গোয়ানরা গ্রামের লোকের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এনেছে, আনতে চাইছে, তাতেও এরকম সায় দিচ্ছেন, সাহায্য করছেন।

—এ তো আপনি করতে পাবেন না বাবা। এ তো হতে পারে না।

আমি বললাম—সুলতা, নিজেকে শক্ত করে নিয়ে শান্তকণ্ঠে বললাম—কে কাকে দান করবে কেন করবে—এ নিয়ে কারও কোন আপত্তি চলতে পারে বলে আমি মনে করি না ঘোষমশায়। মাফ করবেন, আপনার বিচার আমি মানতে পারলাম না। গোয়ানদের ঘর পুড়েছে, তাদের সাহায্য করাতে যদি আপনাদের সঙ্গে বিরোধ করা হয়, তবে তাই হল। উঠে দাঁড়ালাম আমি।

মুহূর্তে সমবেত কণ্ঠের আওয়াজ উঠল—তাই হল?

সঙ্গে সঙ্গে জনতিনেক বেশ শক্ত-সমর্থ জোয়ান এসে আমাকে রূঢ়স্বরে বললে—বসুন আপনি।

রঙলাল ঘোষ বললেন—মাথা ঠান্ডা করুন বাবা, রাগ করে কোন ফল হবে না। মাথা ঠাণ্ডা করে বসুন।

আমি চলে যেতে চাইলাম কিন্তু আমাকে জোর করে ধরে রাখলে ক’জনে। আমি স্তব্ধ হয়ে পাথরের মত দাঁড়ালাম। আমি বসব না, আমি মুখ খুলব না—আমি যেন পাথর হয়ে গেছি। কিংবা বলতে পার রায়বংশের শেষ জমিদার আমি পাথরের মত অটল থাকতে চেষ্টা করলাম।

হঠাৎ মনে হল যেন রায়বাড়ীর পলেস্তার-খসা নোনা ধরা ইটের ফাঁক থেকে অসম্ভব অবিশ্বাস্য অভিযোগ দাখিল করছে আমার বিরুদ্ধে।

—উনি অহিন্দু, উনি অধার্মিক, উনি টিপিক্যাল জমিদার, এখানে ডিভাইড অ্যান্ড রুল পলিসি চালিয়ে আমাদের বুকে বাঁশ দিতে এসেছেন। এই গোয়ানদের রায়বাবুরা এনে বসিয়েছিলেন মহাল শাসনের জন্যে। প্রজা দুরস্ত করবার জন্য। এখন প্রজার আমল -প্রজাদের শাসন করবার জন্যে গোয়ানদের কোলের কাছে টানছেন। উনি জানেন না কিংবা হয়তো জেনেও বুঝতে চান না যে, এই গোয়ানরা মুসলিম লীগের সঙ্গে দোস্তি করে যখন হিন্দু কীর্তিহাটের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে, সেদিন রায়বাবুদের কালীবাড়ীর গোবিন্দবাড়ীর উপর আক্রমণ হবে সব থেকে আগে। কম্যুনাল রায়ট বাধলে গোয়ানরা রায়বাবুদের সাহায্য করবে না, লীগের পাণ্ডাদের হুকুমে লীগের গুন্ডাদের হাতে লাঠি, শড়কি যুগিয়ে দেবে।

তাছাড়া পাকা সাতপুরুষের জমিদারনন্দন উনি, ইংরিজীতে বলে ব্লু ব্লাড তার মধ্যে লাম্পট্যের তৃষ্ণা আকণ্ঠ। এত বয়স পর্যন্ত বিবাহ করেন নি উনি; কেন করেন নি? প্রচুর টাকা আছে, উনি উদারতা দেখিয়ে স্বজন-সেবাপ্রীতি দেখিয়ে টাকা খরচ করেন, মনের এক ধরনের বিলাস চরিতার্থ হয়, প্রশংসা হয়, তার ফাঁকে ফাঁকে ওঁদের মতো লোকেরা বাসনা চরিতার্থ করবার সুযোগ করে নেন।

কথাগুলো বলছিলেন রঙলাল ঘোষের উকীল ছেলেটি। আমি অবাক হয়ে শুনছিলাম।

—ওই গোয়ানদের পিদ্রুস গোয়ান আমার বাবার পিসেমশাই ঠাকুরদাস পালকে খুন করেছিল। লোকে বলে রায়বাহাদুর ইশারা দিয়েছিলেন। গোয়ানদের একটা মেয়েকে নিয়ে এই সুরেশ্বরবাবুর ঠাকুরদাদা দেবেশ্বর রায়—কেলেঙ্কারির আর বাকী রাখেন নি। শেষ পর্যন্ত ওই গোয়ান মেয়েটার পিছনে পিছনে এসে ওই কাঁসাইয়ের ঘাটে মারা যান। মেয়েটা বিষ খেয়ে মরেছিল। সুরেশ্বরবাবু কুইনি মেয়েটাকে পড়ার খরচ যোগাচ্ছেন। কেন? লোকে বলে—সকলের দিকে ফিরে তাকিয়ে বললেন—কি বলে তা বোধ হয় কারুর অজানা নয়। রায়বংশে এ-দোষ চাঁদের কলঙ্কের মত। শুধু রায়বাবুরাই বা কেন, প্রায় সব জমিদারবংশেই আছে। যেখানে বিষয়, সেইখানে ব্যভিচার। তবে রায়বংশে একটু বেশী এই রকম বলে। সে সেই গোড়া থেকে। রক্ষিতা রাখতেন। জাত মানতেন না। ছোটজাত, বড়জাত বামুন পর্যন্ত—আপনাদের আত্মীয় পর্যন্ত মানতেন না।

* * *

সুলতা, এইরকম একটি রাত্রি আমার জীবনে আর কখনও আসেনি। মনে হচ্ছিল আমি মরে গেছি, আমার আত্মাকে অপরাধী করে হাজির করা হয়েছে ঈশ্বরের আদালতে, সেখানে দেখছি যেন আমার বিচারের জন্য টেনে এনে হাজির করা হয়েছে আমার পূর্বপুরুষদের। সে কুড়ারাম রায় ভট্টাচার্য থেকে আমার বাবা যোগেশ্বর রায় পর্যন্ত। আমার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ প্রমাণিত হবে তাঁদের জীবনের আচরণ থেকে। আমি যেন দেখছিলাম, হয়তো কল্পনায় দেখেছিলাম, তাঁরা যেন বিস্মিত, বিরক্ত, তার সঙ্গে বিব্রতও বটে। বীরেশ্বর রায় পর্যন্ত ক্ষুব্ধ, তবে বিব্রত নন। রত্নেশ্বর রায় চিন্তা করছেন। সত্যিই কি অপরাধ তিনি করেছেন? পুণ্যের বোঝার চেয়ে কি অন্যায়ের পাপের বোঝাটা ভারী হয়ে উঠল কালের হাওয়ায়? দেবেশ্বর রায় বেদনার্ত, আমার বাবাকে দেখলাম মাথা হেঁট করে দাঁড়িয়ে আছেন। শিবেশ্বর রায়, তিনিও দাঁড়িয়ে আছেন। বীভৎস তাঁর চেহারা। ছাদের উপর থেকে লাফিয়ে পড়ে তাঁর হাড়গোড় ভেঙে যে বীভৎস মূর্তি হয়েছিল, ঠিক সেই বীভৎস মূর্তি!


© 2024 পুরনো বই