কীর্তিহাটের কড়চা – ৪র্থ খণ্ড – ১৪

১৪

তখন লর্ড কার্জন ইন্ডিয়ার ভাইসরয়। বোধ করি এত বড় কঠিন ইম্পিরিয়েলিস্ট আর অ্যারোগ্যান্ট ভারতবর্ষ-বিদ্বেষী কেউ আসে নি। অন্তত ভাইসরয় হয়ে আসে নি। চার্চিল সাহেবের আদর্শ পুরুষ লর্ড কার্জন। তার সঙ্গে লর্ড কিচেনার তখন কম্যান্ডার ইন চীফ।

স্যার হেনরী ফ্লাওয়ার সেক্রেটারী অব স্টেট। এদের পায়ের চাপে গোটা ভারতবর্ষ মুমূর্ষুর মত আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। তারা সেই চিরন্তন মন্ত্র জপছে ত্রাহি মাং পুণ্ডরীকাক্ষ! রক্ষ মাম্ জগদীশ্বরে! রক্ষ দেবী-মহাদেবী, ত্রাহি! ত্রাহি! দেবী মহেশ্বরী!

নিরুত্তর আকাশ থেকে উত্তর যা আসে তা মেঘের ডাকের মধ্যে দিয়ে আসে, আকাশ কখনও কথা কয় না। ভারতবর্ষের গলায় ইংরিজী বুটের চাপটা একটু জোরালো করে হেনরী ফ্লাওয়ার নতুন পলিসি ঘোষণা করেছিলেন—

“The Government of India must always abide by the decision of the British Cabinet even when it was regarded by them as injurious to the interest of India”.

এবং বাংলাদেশে তখন নতুন প্রাণের সাড়াতে ইংরেজের মুখ ভারী হয়েছে। এমন কি জমিদারদের উপরেও মেজাজ খারাপ। জমিদারেরা পারমানেন্ট সেটেলমেন্টের পর আয় বৃদ্ধি করে খাজনা আদায়ের এজেন্ট বা গোমস্তা থেকে দস্তুরমত বিলেতের লর্ডদের সঙ্গে পাল্লা দিচ্ছে। সুযোগ পেলেই জমিদারদের উপর শাসন চালাচ্ছে। বাঙালী ইংরিজী শিখে ইংরেজের সঙ্গে টক্কর মেরে চলে। এ তাদের সহ্য হয় না। শাসনযন্ত্রটার স্ক্রু ক্রমাগত টাইট দিতে চাইছে তারা।

দেবেশ্বর রায় এরই বিরুদ্ধে লিখবার জন্য খবরের কাগজ বের করবেন স্থির করেছিলেন। জমিদারীর মোহ তাঁকে বাঁধতে পারে নি, কয়লার ব্যবসায়ের ঐশ্বর্যও তাঁকে ভোলাতে পারে নি। তিনি নতুন জীবনে নতুন কর্মে আত্মনিয়োগ করতে চেয়েছিলেন।

ছোটছেলে যোগেশ্বরকে বলেছিলেন—নাই বা পড়লে এম-এ। প্রেস কিনে কাজ শুরু কর। আমার সঙ্গে লেগে পড়।

সুরেশ্বর বললে—কিন্তু তা হ’ল না।

হঠাৎ বাধা এসে সামনে দাঁড়াল। অলঙ্ঘনীয় বাধা।

বলতে বলতে চঞ্চল হয়ে উঠল সুরেশ্বর। উঠে দাঁড়িয়ে বারকয়েক পায়চারি ক’রে সুরেশ্বর বললে—লোকে বলে এ বাধা রায়বাড়ীর সেই অলঙ্ঘনীয় অভিশাপের বাধা।

সেই ধর্মসাধনার বিকৃত পন্থায় যে অভিশাপ অর্জন করেছিলেন শ্যামাকান্ত, আর যে অভিশাপকে সম্পদের পথে কালনাগিনীকে বুকে ধরার মত ধরেছিলেন সোমেশ্বর রায়—সেই বাধা। নারীর বাধা!

লোকে অন্তত তাই বলে। শিবেশ্বর রায়ও তাই বলেছিলেন, বড় ছেলে যজ্ঞেশ্বর রায়ও তাই বলেছিলেন। এবং আরও অনেক জনেই তাই বলেছিল। বলেছিল—যে অভিসম্পাতকে রত্নেশ্বর রায় কঠোরভাবে বংশ থেকে বিদায় করেছিলেন, মুছে দিয়েছিলেন, সেই অভিসম্পাতকে দেবেশ্বর রায় সেই যোগিনীসাধনের সিদ্ধাসনের জঙ্গল থেকে বয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। এতদিন পর তাকে ছাড়তে গেলে সে ছাড়বে কেন? সে এসে তাঁর সামনে দাঁড়িয়েছিল।

দেবেশ্বর রায় ফিরে কলকাতায় এসেছেন শুনে তাঁর সামনে দীর্ঘদিন পরে এসে দাঁড়িয়েছিল ভায়লেট। তখন সে দুর্দান্ত মাতাল; পর পর ডাইভোর্স ক’রে তৃতীয় স্বামী নিয়ে ঘর করছে। ঘর করার অর্থ নিতান্তই একটা অর্থহীন ব্যাপার। এই হতভাগিনী মেয়েটাকে নিয়ে কতকগুলো পেশাদার দালাল শ্রেণীর জীব ব্যবসা করত মদ্য খাদ্য আর আশ্রয় দিয়ে। এলিয়ট রোডের যে বাড়ীটা রত্নেশ্বর রায় ভায়লেটের ছেলে পিদ্রুসকে দিয়েছিলেন, যাকে লেখাপড়া শেখাবার মাসোহারা দিতেন দেবেশ্বর রায়, সে ছেলের লেখাপড়া হয়নি, শেষ পর্যন্ত তাকে একটা চাকরি দিয়েছিলেন দেবেশ্বর রায় তাঁদের ফার্মে; ডকে তার কাজ ছিল; রায়-চক্রবর্তীর কয়লা চালান যেত দেশান্তরে, সে ডকে বোঝাইয়ের কাজ দেখত, সে ছেলে তখন মরেছে। একমাত্র কন্যাকে কোলে নিয়ে তার স্ত্রী শাশুড়ীকে বাড়ীতে ঢুকতে দিত না। সে বেড়াত পথে পথে। তখনও তার রূপ ছিল, তখনও তার দেহ ছিল; বিবাহের নামে আশ্রয় দিয়ে কয়েকটা পাষণ্ড তাকে ব্যবসার সামগ্রী করে তুলেছিল। প্রথম প্রথম হয়তো ভায়লেটের ভাল লেগেছিল কিন্তু ক্রমে ক্লান্ত শ্রান্ত হয়ে খুঁজেছিল একটি নিরাপদ আশ্রয়। অথবা তার অতৃপ্ত কামনা চেয়েছিল তার জীবনের প্রথম ভালবাসার মানুষকে। অথবা অভিশাপ নিজের আসন পাতবার জন্য চেয়েছিল অভিশপ্ত জনকে।

সে-কালে দেবেশ্বরের জীবনের পরিবর্তনের ঠিক মুখেই ভায়লেটের আবির্ভাব নিয়ে গবেষণার আর অন্ত ছিল না সুলতা। ছিল না বলেই তার উল্লেখ করছি।

কিন্তু আসলে প্রথমটা ছিল ব্ল্যাক মেলিংয়ের ব্যাপার। ভায়লেটের একটা মাসোহারা ছিল। সে আমলে সে মাসে চল্লিশ টাকা হিসেবে পেত এ বাড়ীর সেরেস্তার খাজাঞ্চির কাছ থেকে। কিন্তু তার বাড়ী ঢুকবার হুকুম ছিল না। টাকাটা লোক মারফত পাঠিয়ে দেওয়া হত। এবার ভায়লেটের স্বামী তাকে পাঠালে, তুই যা, বল এ টাকায় আমার কুলুচ্ছে না, আমাকে আরও কিছু দাও। ওই এলিয়ট রোডের বাড়ী থেকে তোকে তাড়িয়ে দিলে তোর বেটার বউ, তুই থাকবি কোথায়? তোকে একটা বাড়ী দিতে বল। এতনা বড়া আদমি―a rich man. I have seen the big house-beautiful horses and couches-he must pay.

ভায়লেট ভয় করত রায়বাবুকে। ভয় করত ভালও বাসত। দুই-ই। তার ঐশ্বর্য, তার জাঁকজমক—কীর্তিহাটের প্রতাপের স্মৃতি তার মনে পড়লে সে বিহ্বল হয়ে পড়ত। সেই রায়বাবু যখন তাকে চিঠি লিখে ভালবাসার কথা জানিয়েছিল তখন তার মনে হয়েছিল যে তার নিঃশ্বাস বোধ হয় বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু তরুণ রায়বাবুর বক্ষলগ্না হয়ে তার ভয় সত্ত্বেও সে কেমন আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল। কেবলই মনে হ’ত রায়বাবু, তার রায়বাবু, তার রায়বাবু!—তারপর কলকাতায় এসে কিছুদিনের মধ্যে অনেক কিছু শিখেছিল, অনেক কিছু পেয়েছিল কিন্তু ভয় তবু কাটে নি। সে ভয় আবার প্রচণ্ডতম হয়ে তাকে আচ্ছন্ন করলে যেদিন রায়বাবু বললে—দাঁড়া তোকে গুলী করি, করে নিজের বুকে গুলী করে দুজনে মরবো।

সে প্রথমটা ভয় পেয়েছিল নিজের মৃত্যুর জন্য। কিন্তু তাকে ঘৃণাভরে সরিয়ে দিয়ে নিজের বুকের কাছে বন্দুকের নল লাগিয়ে রায়বাবু যখন অবলীলাক্রমে বন্দুকের ট্রিগার টেনে দিলে, তখন তার আর আতঙ্কের সীমা ছিল না।

রায়বাবু কি না পারে।

তারপর থেকে সে আর রায়বাবুর সামনে আসে নি। রায়বাবুর জন্যে বুক তার ফেটে যেত তবু সে আসতে সাহস করত না। চৌরঙ্গীর পথে কতদিন রায়বাবুর ফিটন দেখে সে লুকিয়ে পড়েছে। ছুটতে ছুটতে পালিয়ে এসেছে। বুকের ভিতরটায় যেন ঝড় বয়ে গিয়েছে।

ছেলে মারা গেলে একবার সে এসেছিল, ছুটে এসেছিল ফ্রী স্কুল স্ট্রীট ধরে এই বাড়ীর ফটকে, কিন্তু ফটকেই থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণ পর চোখ মুছতে মুছতে ফিরে গিয়েছিল। সাহস হয়নি। এতকাল পর, তেইশ বছর পর তাকে প্রায় চাবুক মেরে পাঠালে তার নতুন স্বামী মিস্টার জোনস্!

জোনস্স্ত্ত তার সঙ্গে এসেছিল প্রথম দিন। এবং রায়বাবুর দেখা পেতে এতটুকু ঝামেলা পোয়াতে হয়নি। একেবারে সামনেই পেয়েছিল তাঁকে। দেবেশ্বর রায় বসেছিলেন বাগানের মধ্যে সেই বেদীটার উপর; যে বেদীটার উপর বসে বহুকাল আগে শ্যামাকান্ত স্নানযাত্রার দিন পশ্চিম আকাশে কালো মেঘের উঁকি দেখে মেঘমল্লার গেয়েছিলেন। সেই মার্বেলের বেদীটার উপর ব’সে দেবেশ্বর কথা বলছিলেন যোগেশ্বরের সঙ্গে।

হঠাৎ এসে দাঁড়াল তারা।

—Excuse me, sir—

দেবেশ্বর ফিরে তাকালেন। মুখ তাঁর লাল হয়ে উঠল। ভায়লেট তাঁর দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। ঠোঁট দুটো থরথর করে কাঁপছে।

দেবেশ্বর ছেলেকে বলেছিলেন—তুমি ভিতরে যাও যোগেশ্বর। হ্যাঁ, আর ফটকের দারোয়ানটাকে এক্ষুনি ডেকে ডিসমিস্ করে দাও।

যোগেশ্বর চলে গিয়েছিলেন। দেবেশ্বর জোনকে বলেছিলেন—Yes, what can I do for you, well before that-who are you please.

—Good evening sir-my name is Albert Jones-and let me introduce Violet Mrs. Jones…

—I see-she is Mrs. Jones now. And then?

হলদে দাঁত মেলে হেসে জোনস্ বলেছিল—She wants money Roy Babu, she is your old friend.

ভায়লেট মুখে কিছু বলে নি, বলতে পারে নি, কিন্তু অজস্রধারায় শুধু কেঁদেছিল। চোখ দিয়ে বাঁধভাঙা নদীর জলের মত জলের ধারা নেমেছিল।

—কত টাকা চাই?—ভায়লেট?

ভায়লেট উত্তর দিতে পারে নি, সে শুধু কেঁদেই গিয়েছিল। জোনস্ কিছু বলতে চেষ্টা করেছিল কিন্তু দেবেশ্বর বলতে দেন নি। বলেছিলেন—Please Mr. Jones—you please keep quiet. বল ভায়লা কত টাকা চাই—বল।

বলতে ভায়লেট কিছু পারে নি; তা না পারুক, দেবেশ্বর নিজেই খাজাঞ্চিকে ডেকে পাঁচশো টাকা নিয়ে ভায়লেটের হাতে দিয়ে বলেছিলেন—নিয়ে যাও। তারপর জোনসকে বলেছিলেন—দেখ মিস্টার জোনস্, আর যেন এ বাড়ীর ফটকে ওকে নিয়ে বা একলা মাথা গলাবার চেষ্টা করো না।

ভায়লেটকে বলেছিলেন—ভায়লা, তোমার ছেলের মেয়ে তোমার গ্র্যান্ড ডটার পাঁচ বছরের হল,—তাকে কনভেন্টে রেখে পড়ানোর ব্যবস্থা হয়ে আছে।—Don’t forget that you are now a Grandma. বুঝতে পারছ আমার কথা?

সেদিন তারা চলে গিয়েছিল। কিন্তু তারপর থেকে এই বাড়ীটার আশেপাশে হঠাৎ বেদনার্ত নারীকণ্ঠের ডাক উঠতে লাগল।

–রায়বাবু। মাই রায়বাবু!

একটা ফিরিঙ্গী মেমসাহেব —আধ-পাগলের মতো তার বেশভূষা—অঝোরঝরে কাঁদত আর ডাকত—রায়বাবু—মাই রায়বাবু!

দেবেশ্বর রায় বাইরে বারান্দায় বা বাগানে থাকলে ঘরে গিয়ে ঢুকতেন। হঠাৎ একদিন ছোটছেলেকে ডেকে বললেন—আমার মনে হচ্ছে নেমেসিসের মত একটা কিছু আসছে। আসবার কথাই বটে যোগেশ্বর। তার জন্যে আমি দুঃখিত নই অনুতপ্ত নই। তবে আমার একটা কাজ বাকী আছে। সেটা আমাকে সেরে ফেলতে হবে তার আগে। কাজটা তোমার মায়ের কাছে—তার সঙ্গে কাজ। তোমাকে একটা জিনিস বলে যাই, মাই লাস্ট ওয়ার্ড। তুমি লেখাপড়া শিখেছ। আমি যেটা চেয়েছিলাম নিজে—যেটা আমার সম্পদের জন্যে ঐশ্বর্যের জন্যে, অ্যান্ড —আরও কিছুর জন্যে হয় নি—সেটা তোমার হয়েছে। সেই জন্যে তোমাকে আমি নগদ টাকা আর বাড়ী দিয়েছি। তুমি বিজনেস কর, জমিদারী থেকে দূরে থেকো। অ্যান্ড ফ্রম উয়োম্যান। বিয়ে করে যদি সংসারী হ’তে পার—সাধারণ মানুষের মত, তা হ’লে বিয়ে করো। নইলে করো না।

যোগেশ্বর শুনেছিলেন অনেক কিছু। এই জানবাজারের বাড়ীতে পুরনো চাকরবাকর কর্মচারীদের চাপা কথার ফিসফাসের মধ্যে থেকে শুনেছিলেন। জানতেন তাঁর বাপের জীবন। তিনি চুপ করে ছিলেন। কি উত্তর দেবেন এর।

দেবেশ্বর ক’দিনের মধ্যেই ফিরে এসেছিলেন কীর্তিহাট।

স্ত্রীর কাছে তিনি ক্ষমা চেয়েছিলেন, হাতজোড় করে বলেছিলেন—আমাকে ক্ষমা কর।

স্ত্রী হেসেই সারা হয়েছিলেন।—ক্ষমা? কিসের ক্ষমা? বেটাছেলে আবার মেয়ের কাছে ক্ষমা চায়। তিনি শুনতেই চান নি কোন কথা। আপনার সেই ধরাবাঁধা জীবনের ছকের মধ্যে যথানিয়মে ঘুরেই বেড়িয়েছেন দিনরাত্রি। ভোরে উঠতেন—উঠেই গোবিন্দমন্দিরে। ফিরতেন গোবিন্দের ভোগের পর। তারপর অতিথিসেবা। বেলা চারটে পর্যন্ত বসে থাকতেন অতিথির জন্যে। তারপর আহার। শুতেন রাত্রি বারোটার সময়।

দেবেশ্বর রায় চুপ করে বসে থাকতেন স্ত্রীর প্রতীক্ষায়।

স্ত্রী এসে তিরস্কার করতেন—এ তোমার কি কাণ্ড, কি ব্যাপার? আমার উপর এ কি অত্যাচার শুরু করলে বল তো! কেন? বেশ তো ছিলে। আমি তো কোন আপত্তি করি নি, বাধা দিই নি।—

দেবেশ্বর কথা বলতেন না-হাসতেন।

এরই মধ্যে রায়বাড়ীতে শিবেশ্বর বাধালেন বিরাট মামলা। রত্নেশ্বর রায়ের কাছারীতে আগুন দেওয়ার প্রতিশোধ নেবার পথ না পেয়ে ধৈর্য হারিয়ে ফেলছিলেন তিনি-এমন সময় একটা খাসপতিতের উপর গো-পথের অধিকার নিয়ে ফৌজদারী বেধে গেল। একসঙ্গে গোহত্যা, নরহত্যা দুই হয়ে গেল। ওয়ারেন্টের ভয়ে শিবেশ্বর আর তাঁর বড় ছেলে ধনেশ্বরকে গা-ঢাকা দিতে হল। দেবেশ্বরকে বাধ্য হয়ে কাছারীতে বসতে হল।

এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন।

রত্নেশ্বর রায়ের খাস কাছারী—যে ঘরটায় অতুলেশ্বর পিস্তলের কার্টিজ, বোমার সরঞ্জাম লুকিয়ে রেখেছিল, সেটা রত্নেশ্বর রায় বড়ছেলেকেই দিয়ে গেছেন—সেই কাছারীর বারান্দায় সন্ধ্যার সময় বসেছিলেন দেবেশ্বর রায়।

হঠাৎ প্রচণ্ড চীৎকারে তিনি যেন ফেটে পড়লেন—গেট আউট, গেট আউট আই সে—গেট আউট।

এবং সঙ্গে সঙ্গে একটা লোকের প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ চীৎকার এবং তার পরমুহূর্তেই সে চীৎকার আর্তনাদের মত ধ্বনিত হয়ে উঠেছিল। না দেখেও সকলে বুঝতে পেরেছিল যে কোন একটা লোক ক্রুদ্ধ চীৎকার করে উঠেই পরমুহূর্তে আর্তনাদ করে ছুটে পালাল। তারপরেই একটি নারীকণ্ঠের আর্ত চীৎকার।

দেবেশ্বর রায়ের চাকর অনন্ত শুধু সাক্ষী ছিল।

দেবেশ্বর রায় সন্ধ্যায় অন্ধকারের দিকে তাকিয়েছিলেন আর আপনমনে সুর করে ইংরিজীতে কিছু বলছিলেন। সম্ভবতঃ কবিতা আবৃত্তি করছিলেন। সে আলো জ্বালতে গিয়েছিল ভিতরে। হঠাৎ বড়বাবু চীৎকার করে উঠেছিলেন Get out, get out I say—Get out. তাঁর চেয়ারের ঠেসানের পিছনে ঝুলিয়ে রাখা ছিল তাঁর মালাক্কা বেতের শখের ছড়িটা, সেই ছড়িটা টেনে নিয়ে তিনি আথালি-পাথালি পিট্‌ছিলেন একটা ফিরিঙ্গীকে। লোকটা প্রথমটা গর্জন করে উঠে হাত দিয়ে ধরতে চেষ্টা করেছিল এই ছড়িগাছটা কিন্তু তা পারে নি। না পেরে আর্ত চীৎকার করে ছুটে পালাল। তার সঙ্গে ছিল একটা ফিরিঙ্গী মেয়ে। সে মেয়েটা কাতর আর্তনাদ করে গড়িয়ে পড়েছিল বারান্দার উপর।

নিমাই এসে পাথরের মত দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। ওদিকে কাছারীর কর্মচারী ও লোকজন সকলে দূরে স্তব্ধ কৌতূহলে উদ্‌গ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে গেছে। পুরুষটার চীৎকারের সঙ্গে নারীকণ্ঠের চীৎকার শুনে তারা থমকে গেছে।

কিছুক্ষণ পর মেয়েটা উঠে দাঁড়িয়েছিল। দেবেশ্বর রায় কঠিনস্বরে তাকে উঠতে বলেছিলেন-সে-আদেশ সে অমান্য করতে পারেনি। উঠে মাথা হেঁট করে চলে গিয়েছিল।

দেবেশ্বর রায় ডেকেছিলেন—নিমাই।

মৃদুস্বরে নিমাই বলেছিল—হুজুর।

—যা, উপরে আমার ঘরে বাবার মৃত্যুর পর যে হুইস্কির বোতলটা তুই আমার সামনে ধরেছিলি, সেটা আলমারীতে রয়েছে। আজ যেন চোখে পড়েছে আমার। সেটা নিয়ে আয়।

—আজ্ঞে!

—যা, সেটা নিয়ে আয়। আর গ্লাস।

দীর্ঘ এক বছরের উপর সময়ের পর আবার সেদিন দেবেশ্বর রায় হুইস্কির বোতল নিয়ে বসেছিলেন।

বাধা কে দেবে? শিবেশ্বর-ধনেশ্বর মামলার ভয়ে কীর্তিহাট থেকে সরে গেছেন। দেবেশ্বরের ছেলেরা কলকাতায়। পারতেন এক স্ত্রী মানিকবউ কিন্তু তিনি সন্ধ্যায় তখন গোবিন্দজীর মন্দিরের বারান্দায় হাতজোড় করে বিগ্রহের মুখের দিকে তাকিয়ে আপনমনে কথা বলছেন, কখনও হাসছেন, কখনও তিরস্কার করছেন। নিমাই তাঁর কাছে গিয়েও ছিল, খবরও দিয়েছিল। কিন্তু তিনি বুঝতেই পারেন নি নিমাইয়ের কথা।

নিমাই বাধ্য হয়ে ফিরে এসেছিল। বাবুকে ফেলে ঠাকুরবাড়ীতে দাঁড়িয়ে মা-ঠাকরুণকে সমস্ত বুঝিয়ে বলবার মত সময় তার ছিল না। ফিরে এসে নিমাই চমকে উঠেছিল। বাবু কই? হুজুর?

বারান্দা শূন্য, ঘর শূন্য, দেবেশ্বর রায় নেই।

কোথায় গেলেন?

—হুজুর! বড়বাবু!

কাছারী সচকিত হয়ে উঠেছিল। সে কি? কোথায় গেলেন? বড়বাবু, দেবেশ্বর রায়, যিনি পাহাড়ের মত অটল, তিনি কোথায় গেলেন? কোথায় যাবেন? কাছারী থেকে হারিকেনের আলো হাতে হিন্দুস্থানী চাপরাশীরা ছুটেছিল। দেখতে দেখতে গোটা গ্রামটা সচকিত হয়ে উঠেছিল। তখনকার দিনে রায়বাড়ী কীর্তিহাটে হলেও কীর্তিহাটই ছিল রায়বাড়ীর মধ্যে। রায়বাড়ীর এলাকার বাইরে গ্রামের বসতি সে ছিল সম্পূর্ণ আলাদা। তার সঙ্গে রায়বাড়ীর সম্পর্ক ছিল মৌজা এবং লাটের সম্পর্ক। তার বেশি কিছু নয়। সম্পর্ক ছিল খাজনা দেওয়া-নেওয়ায়, সম্পর্ক ছিল অনুমতি গ্রহণের; গাছ কাটবে তার অনুমতি, ঘরের বনিয়াদ কাটবে তার অনুমতি, বিয়ের অনুমতি, শ্রাদ্ধের অনুমতি, তাছাড়া জীবনের প্রতি পদে নানা অনুগ্রহের অনুমতি নেবার জন্য। তাছাড়া অনুগ্রহ, সে অনেক, সে পদে পদে, অন্নপ্রাশনে, বিয়েতে, পৈতেতে—মাছ চাই, কাঠ চাই, কন্যাদায়ে অর্থও চাই। পিতৃদায়ে-মাতৃদায়ে-বাঁশ, কাঠ, মাছ, অর্থ চাই। প্রয়োজন হলে বিয়েতে রায়দের গাড়ী চাই। এছাড়া ইদানীং শিবেশ্বর শখের থিয়েটার খুলে রিহারসাল রুমে একটা প্রবেশাধিকার দিয়েছিলেন গ্রামের কিছু লোককে। সে অল্প কিছু। আজ কথাটা দেখতে দেখতে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ল। ছড়িয়ে পড়ল বিচিত্র চেহারা নিয়ে। কে রটালে, কার কল্পনা কেউ জানে না, বললে—সন্ধ্যার আবছা অন্ধকারে অশরীরী একটা পুরুষ আর একটা নারী, একটা প্রেত আর একটা প্রেতিনী বড়বাবুকে টেনে নিয়ে গেল।

গোটা গ্রামের মানুষের গুঞ্জন একটা কলরব সৃষ্টি করে তুলেছিল। পথে পথে আলো আর মানুষ। মানুষ আর আলো। কংসাবতীর তটভূমির জঙ্গল ভেঙে ভেঙে খোঁজ শুরু হয়েছিল।

—বড়বাবু! হু-জু-র! ব-ড়-বাবু!

শেষে প্রায় রাত্রি দুপুর নাগাদ দেবেশ্বরকে পাওয়া গিয়েছিল কাঁসাইয়ের গর্ভে বালুচরের উপর। অজ্ঞান হয়ে পড়ে ছিলেন। দেহের তাপ প্রবল। যেন পুড়ে যাচ্ছে। ধরাধরি করে তুলে এনে তাঁকে শুইয়ে দিয়েছিল তাঁর বিছানায়।

কিছুক্ষণ পর চোখ মেলেছিলেন কিন্তু দৃষ্টি বিহ্বল বিকারগ্রস্ত। চীৎকার করে উঠেছিলেন—গেট আউট, গেট আউট, গেট আউট! গেট আউট আই সে। শাট দি ডোর। শাট দি ডোর।

রাত্রি দুপুরের পর মানিকবউ দেবতাকে শয়ন করিয়ে অন্দরে এসে স্বামীর ওই অবস্থা দেখে সবিস্ময়ে প্রশ্ন করেছিলেন—কি হল?

কিন্তু উত্তর শোনেন নি। এসে শিয়রে বসে স্বামীর মাথা কোলে তুলে নিয়ে ডেকেছিলেন—বড়বাবু! বড়বাবু! বড়বাবু গো! বড়বাবু! কথা বল। বড়বাবু!

কিন্তু বড়বাবুর চেতনা আর ফেরে নি।

ওই এক কথাই তিনি বলেছেন শেষ পর্যন্ত। গেট আউট। আর শার্ট দি ডোর!

সুরেশ্বর বললে—সুলতা, জোন্স ভায়লেটকে নিয়ে কীর্তিহাট পর্যন্ত ধাওয়া করেছিল সেকথা নিশ্চয় বলতে হবে না। জোন্সকেই দেবেশ্বর রায়, আথালি-পাতালি বেত দিয়ে মেরেছিলেন।

জোন্স পালিয়েছিল সেই রাত্রেই। তার ভয় হয়েছিল—হয়তো বা তাকে খুন করেই ফেলবে রায়বাবু। গোয়ানরাও তাই বলেছিল তাকে। সে পালিয়েছিল কিন্তু ভায়লেট পালায় নি। সে ছিল। রায়বাবুর মৃত্যুর পর ভায়লেট ওই সিদ্ধাসনের জঙ্গলে সেই যোগিনীর ঘরের ভিতর বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছিল। ওখানটায় কল্কে ফুলের গাছ আছে প্রচুর। কল্কেফুলের বীজ বিষ, ওটা শিখেছিল অবশ্য এখানে এসেই। সে-কথা ভায়লেট ভুলে যায় নি।

সুরেশ্বর বললে—সুলতা, অর্চনাকে দেখে সেদিন আমি অদৃষ্টকে মেনেছিলাম। অর্চনা বিধবার বেশে বসে ছিল। আমাকে দেখে কাঁদে নি। পাথরের মূর্তির মত শুকনো চোখে বসেছিল সে।

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললে অৰ্চনা।

সুরেশ্বরও সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললে-তার সঙ্গে সুলতাও। সুরেশ্বর বললে—এত বড় দুঃখ আমি বাবার মৃত্যুসংবাদেও পাই নি। বরং চন্দ্রিকাকে নিয়ে যখন তিনি বম্বে থেকে চলে যান, তখন খবর পেয়ে এমনি ধরনের আঘাত পেয়েছিলাম। তবুও সে আঘাতের পরিমাণ এর থেকে কম। তাতে বাবার মৃত্যু-সংবাদ ছিল না। এতে একসঙ্গে দুটো। যদিও রথীনের মদ খাওয়ার কথা আমি মেদিনীপুর যাবার আগে জেনে গিয়েছিলাম এবং নারীসংক্রান্ত ব্যাপার নিয়ে কিছুটা সন্দেহও আমার হয়েছিল। একটা নার্স নিয়ে প্রণবেশ্বরদাদার সঙ্গে ওর আলাপের কথাও আমার কানে এসেছিল। অনুশোচনা আমার তখনই হয়েছিল কিন্তু হাতে তো আর কিছু ছিল না। ১৯৩৬-৩৭ সালে হিন্দুর ঘরে ডাইভোর্স দূরের কথা, স্বামীর দুষ্ট চরিত্রের জন্য স্বামী ত্যাগ করে স্বাধীনভাবে জীবন-যাপনের দৃষ্টান্তও দু-চারটের বেশী ছিল না। তাছাড়া কীর্তিহাটের রায়বাড়ীর মেয়ে। এবং যে মেয়ে অবিকল তার বৃদ্ধ পিতামহী সতীবউরাণীর মত দেখতে। রায়বাড়ীর প্রবীণদের বিশ্বাস—সতীবউরাণীর সে-জন্মে ভোগ করে আশ মেটে নি, তাই এ-জন্মে ভোগ করতে এসেছিলেন।

সতীবউরাণীর ভোগ-আকাঙ্ক্ষার ভাগ্য, আর রায়বাড়ীর ভাগ্য। ভরাভর্তি রায়বাড়ী—যিনি এসে সারাজীবন তপস্যা করলেন, সারাজীবন সন্ন্যাসিনী সেজে থাকলেন। বাক্সে ভরা রইল বেনারসী শাড়ী, মুরশিদাবাদের গরদের শাড়ী, বসোয়া বিষ্ণুপুরের গরদ তসরের শাড়ী, ঢাকাই বালুচরী ফরাসডাঙ্গা শান্তিপুরের শাড়ীর বোঝা সিন্দুকে তোলা রইল—মণিমুক্তা-হীরে-জহরতের জড়োয়া গহনা, খাঁটি পাকাসোনার ভারী ভারী গহনা-তপস্যা শেষ হলেও আর গায়ে পরলেন না। ফুলেল তেলের বোতল গড়াগড়ি গেল, চুলে মাখলেন না, বিলিতী খাঁটি ফরাসী দেশের সেন্ট-ল্যাভেন্ডারের বাহারে শিশি, দামী আতরের পলাকাটা শিশি আলমারীতে সাজানো রইল, কোনদিন মাখলেন না; তিনি যদি রায়বাড়ীর সে আমলের বেনারসী সিল্ক দূরে থাক, তাঁতের শাড়ীর সাধ মেটে না, এমন কি মিলের শাড়ীও, সময় সময় সেলাই দিয়ে পরতে হয়, হাতে সোনার পাত-মোড়া লোহা-পিতলের চুড়ি পরতে হয়, সেই আমলের ভোগের জন্য পুনর্জন্ম নিয়ে থাকেন, তবে তাঁর ভাগ্য ছাড়া কাকে দোষ দেব বল?

অর্চনাও সেদিন এ ঘটনাকে ভাগ্য বলেই মেনে নিয়েছিল। আমিও তাই মানতে চেয়েছিলাম কিন্তু ঠিক যেন পারি নি। দোষটা নিজের ঘাড়ে পড়ছিল। বার বার মনে হয়েছিল, ধনেশ্বরকাকার স্ত্রী জনাইয়ের কাকীমার দেওয়া সন্ধান পেয়ে আমি ছুটে এসেছিলাম, এসে অন্নপূর্ণা-মাকে পেয়ে তাঁর সাজানো সংসার দেখে ডাক্তার ছেলেটিকে দেখেই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। আর খোঁজ করলাম না। তার সঙ্গে বিয়ে দিলাম। টাকাকড়ির দিক থেকে সুবিধে করতে যাই নি, খরচ আমি অনেক করেছিলাম। এবং এই বিয়ের ব্যাপারটা না ঘটলে অন্নপূর্ণা-মা জানবাজারের বাড়ী আসতেন না। আর কুইনি এবং হলদীকে দেখে আমার পিতামহ তাঁর দেবুভাইপোর অপরাধ, তাঁর যৌবনের ভুলের পাপমোচনের কথাও তাঁর মনে হত না। সেটা এমন ভাবে মনে পড়েছিল যে, তিনি এলিয়ট রোডের বাড়ী খালাস করাটা অর্চনার বিয়ের পণের মধ্যে ধার্য করেছিলেন। তাতেও আমি অমত করি নি। বিয়েতে রথীন প্রথম অমত করেছিল, অন্নপূর্ণা-মা জোর করে তাকে রাজী করিয়েছিলেন। যজ্ঞেশ্বর রায় জ্যাঠামশাই আমার স্নেহের অপব্যাখ্যা করে বেনামী চিঠি দিয়েছিলেন, অন্নপূর্ণা-মা তাও অগ্রাহ্য করেছিলেন। কিন্তু সেদিন তিনি অগ্রাহ্য না করলেই ভাল করতেন।

হঠাৎ থেমে গেল সুরেশ্বর। তারপর বললে—মাঝখান থেকে একটা কথা বলে নিই সুলতা, কথাটা ১৯৩৭ সালের নয়—কথাটা যুদ্ধের সময়ের বছর কয়েক পরের। জ্যাঠামশায় মৃত্যুশয্যায় তখন। আমাকে ডেকেছিলেন। তাঁর দুই ছেলেই তখন ওয়ার-কন্ট্রাক্‌টের নামে যত হীনতম কাজ হতে পারে তা করছে। রোজগার যথেষ্ট করত কিন্তু বাপকে দেখতো না। সে-সময় তিনি নিদারুণ অভাবের মধ্যে পড়ে আমাকে ডেকেছিলেন টাকার জন্যে। সে-সময় পাঁচটা কথার মধ্যে বলেছিলেন—অর্চনা সম্পর্কে বেনামী চিঠি লিখেছিলাম, তার জন্য তখন অনুশোচনা হয় নি, আজ অনুশোচনা হচ্ছে। কিন্তু কি জানিস—আমি তোদের দুজনের যে ভাইবোনের ভালবাসা এটা সহোদর-সহোদরা হলেও আমার মনে সন্দেহ জাগাতো। তাছাড়া আমার একটা রাগ ছিল, আক্রোশ ছিল—কঠিন আক্রোশ। ধনেশ্বর আর জগদীশ্বর দুই ভাই আমার মাকে ঠাকুরবাড়ী ঢুকতে দেয় নি—বলেছিল, তোমার জাত গেছে জ্যাঠাইমা, তুমি ঠাকুরবাড়ী ঢুকো না। আমি তার শোধ নিয়েছিলাম। সেটা আমি ভুলি নি। জমিদারের বাচ্চা আমি, ব্যবসাদার হতে গিয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছি কিন্তু জাত যায় নি, জাতে সেই গোখরোই আছি—ডোরাদার বাঘই আছি, রাগ আমরা ভুলিনে। তবে মেয়েটা সতীবউরাণীর মত দেখতে, তাই দুঃখ হয়। আজ হচ্ছে।

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে চুপ করলে সুরেশ্বর। কিছুক্ষণ পর আবার বললে—ঐ কথাটা আগেও তো বলেছিলেন জ্যাঠামশাই, যখন এলিয়ট রোডের বাড়ীর দরুন পাঁচ হাজার টাকা আমার কাছে নেন। সেদিন কিন্তু সমস্ত ব্যাপারটার ব্যাখ্যা করেছিলাম অর্থগৃধুতা। কিন্তু বিধবা অর্চনাকে দেখে সেদিন মনে হল অর্চনার ভাগ্য।

পরের দিন ফিরে এলেন রথীনের বাপ। মানুষটি অসীম ধৈর্যশীল মানুষ, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিক হতে যেসব ধীর-স্থির মানুষ আনন্দ-বেদনা-উল্লাস-দুঃখ নিঃশব্দে অভিব্যক্তিহীন মুখে শুকনো চোখে সয়ে গেছেন, তাদের দলের মানুষ।

বিবরণ তাঁর কাছে জানলাম, সংক্ষেপে জানালেন তিনি। একান্ত অপরাধীর মতই জানালেন—দেখ সুরেশ্বর, ঠাকুরমা আজ নেই, তিনি খবর পেয়ে বাঁচবেন না এ আমি জানতাম; টেলিগ্রামে খবরটা সেই উদ্দেশ্যেই জানিয়েছিলাম। যদি এই খবরটা শব্দভেদী বাণের মত তাঁর বুকে বিঁধে প্রাণটা বেরিয়ে যায় তো যাক। তিনি যেন সব খবর না শোনেন না জানতে পারেন। অথচ আঘাতটা পান।

একটু চুপ করে থেকে বললেন-এ ভালই হয়েছে, তিনি সব না জেনেই চলে গেছেন। জেনেশুনে গেলে সে তাঁর পক্ষে বড় মর্মান্তিক হত। অনেক অহঙ্কার করে তপস্যা করার মত কৃচ্ছ্রসাধন করে তিনি শ্বশুরবাড়ী বাপের বাড়ী দুই কুল ছেড়ে নিজের কুল নিজে গড়ে এই বাড়ীর পত্তন করেছিলেন। ছেলে, নাতি, তারপর তাদের ছেলেদের নিয়ে তাঁর অহঙ্কার ছিল, প্রচণ্ড অহঙ্কার, লক্ষ্মী-সরস্বতী দুজনের চারখানি চরণকমল তাঁর ঘরে অচঞ্চল হয়ে বিরাজ করছেন। বলতেন—আলতারাঙা চারখানি পা আমি চোখ বুজলে দেখতে পাই-পদ্মের উপর রেখেছেন তাঁরা। কিন্তু তিনি জানতেন না, শুধু রথীন নয়, রথীনের আগে থেকেই এ বাড়ীর ধারা পাল্টেছে। কালের হাওয়ায় সব পাল্টে গেছে। লক্ষ্মীর আটন গেছে, সরস্বতীর পিঁড়ে গেছে; লক্ষ্মী-সরস্বতীর ভোল পাল্টেছে। এ-বাড়ীর ছেলেদের চরিত্র গেছে। মদ ঢুকেছে, তার সঙ্গে—

কথাটা এই সুলতা যে রথীনের ছোটকাকা গোপনে মদ খেতেন। রথীন ডাক্তারী পড়তে গিয়ে পড়ার সময় থেকে ভাইনাম গ্যালেসিয়া থেকে শুরু করেছিল। হাসপাতালে নার্সদের কাছে সে নিজে আকর্ষণের মানুষ ছিল—নার্সরাও কেউ কেউ তাকে আকর্ষণ করত।

১৯৩০ সালের পর থেকে কালটা অতিবিচিত্র। তার সংজ্ঞা বা তার স্বরূপ তোমার জানা সুলতা। রথীনের কাছে জীবনের চরিত্রের মূল্য কিছু ছিল না। কিন্তু সে-কথা সে সত্য হিসেবে ঘোষণা করে বলে নি কোন দিন–ক্লেভারলি সে এ সত্য গোপন করে চলে এসেছে চালিয়ে এসেছে। কেউ ধরতে পারে নি। সেদিন মানে যেদিন কলকাতা থেকে মেদিনীপুর আসি, সেইদিন শুধু আমি অনেক রকম ওষুধের গন্ধে ঢাকা-দেওয়া মদের গন্ধটাকে তার মুখের পান-জর্দার গন্ধের মধ্যে থেকে আবিষ্কার করেছিলাম। আমি চিনতাম গন্ধটাকে, তাই আবিষ্কার করতে পেরেছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে মনে খটকাও বেধেছিল—’অৰ্চনা এটা সইতে পারবে তো?’ জানতে সে পেরেছে এতে সন্দেহ আমার ছিল না, কিন্তু সইতে কতদিন পারবে বা এ নিয়ে তার সঙ্গে এরই মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি শুরু হয়েছে কিনা বুঝতে পারি নি।

মেয়েরা দুয়ে সুলতা। তাদের প্রকৃতিটাই অন্ধকারের মত, যতই উজ্জ্বল আলো জ্বালো, তার সবটা আলোয় স্পষ্ট হবে না, আলোর ঠিক নিচেটাতেই জমা করে রাখবে আপনার আসল স্বরূপকে।

নারী-প্রকৃতির আদিম স্বরূপ নাকি কালরাত্রি, মহারাত্রি, মোহরাত্রির অন্ধকারকে একসঙ্গে জমিয়ে তৈরী হয়েছে। ওকে জানা যায় না। নারীও বোধ হয় নিজেকে নিজে জানে না। আয়না না হলে মেয়েদের চলে না, আজকাল ভ্যানিটি ব্যাগে ব্যাগে ছোট আয়না হাতে হাতে ফেরে। অল্প কিছুক্ষণ পর পর আয়না দেখে মুখে তারা পাফ বুলায়। মোহের প্রলেপ বুলিয়ে দেয় প্রলেপের স্তরের উপর। নিজের অন্তরের দিকটা থেকে সে মহারাত্রির মত নিবিড় অন্ধকার। সে জানে না সে কি চায়, সে বোঝে না কেন সে কাঁদে, কেন সে হাসে!

রথীনকে সে মানিয়ে নিতে পারবে? বুঝিয়ে আপন করে নিতে পারবে? আমার সেদিন আপসোস হয়েছিল, আমি অতুলেশ্বরদের গুপ্ত সমিতির সঙ্গে অর্চনার সম্পর্কের কথাটা গোপন করেছি বলে। বলা আমার উচিত ছিল।

সন্দেহ আমার মিথ্যে হয় নি।

অর্চনার সঙ্গে রথীনের বিরোধ চলছিল এই নিয়ে। অৰ্চনা প্রকাশ করতেও পারত না—প্রকাশ্যে ঝগড়া করতেও পারত না; ভিতরে ভিতরে গুমরে গুমরে মরত। রথীন ওদিকে একজন অ্যাংলো নার্সের প্রেমে পড়েছিল।

রথীনেরও সন্দেহ ছিল অর্চনার উপর। জ্যাঠামশায়ের বেনামী পত্রের সন্দেহ। প্রণবেশ্বরদাদার সঙ্গে তার আলাপ ছিল—ওই অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান পাড়ার আলাপ। রথীনের চেম্বারে পেশেন্ট হিসেবে আলাপ। তার মধ্য দিয়ে সে একটা সত্য জেনেছিল। জেনেছিল—প্রণবেশ্বর বড় জমিদারবংশের ছেলে, এখন জমিদার থেকে তারা ইন্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট হয়েছে, তাদের বংশে সাতপুরুষ ধরে এই ট্র্যাডিশন চলে আসছে। চন্দ্রের কলঙ্ক যেমন ভূষণ, এ দোষটাও তেমনি তাদের জীবনের আভিজাত্যের পরিচয়। এবং সঙ্গে সঙ্গে এত টাকা খরচ করে তার সঙ্গে অর্চনার বিয়ে দেওয়ার ভারটা নেওয়ার মধ্যে, আমার স্নেহের মমতার অপব্যাখ্যাও সে করেছিল।

সে নাকি বলেছিল-গেলা গেল না বলে ওগরাতে হল।

তাতে রথীন খুব বিচলিত হয় নি। কারণ শিক্ষাদীক্ষার মধ্যে দিয়ে কালের হাওয়ায় এমন স্তরে সে তখন উঠেছে, যেখানে বিবাহের পূর্ব-জীবনের পতনস্খলনগুলো নিতান্তই আকস্মিক দুর্ঘটনার মত; হয়তো বা আরও লঘু কিছু-পথে পড়ে গিয়ে গায়ে ধুলোকাদার দাগের মতো—ধুয়ে দিলেই মুছে যায়, তার উপরেও যদি কিছু হয়, কেটেকুটে যায় এবং তাতে যদি সৌন্দর্যহানি ঘটে, তবে প্লাস্টিকসার্জারি আছে, তাতে শুধরে যাবে। এরপরও জীবনের দিগন্ত বিস্তৃত হয়েছে; সে দিগন্তে নারীও স্বাধীন, পুরুষও স্বাধীন—কেবলমাত্র গৃহের বন্ধনটুকু স্বীকার করে পরস্পরকে মেনে নিয়ে যার যা খুশি সে তা করে বা করতে পারে। কিন্তু খুব সহজ নয়, এবং সহজ হয়ও নি রথীনের পক্ষে। সে নিজের বেলা হাসপাতালে নার্সিংহোমে নার্সদের সঙ্গে কাজও করেছে, আবার অন্তরঙ্গতার চর্চাও করেছে কিন্তু বাড়ি এসে অর্চনাকে প্রশ্ন করেছে—বল, তোমার জীবনের কথা বলো। স্বীকার করো। আমি তা মেনে নেব। কারণ আমার জীবনেও পতনস্খলন হয়েছে। দু’-চারটে গল্পও বলেছে; এবং পাল্টে বলেছে-এবার তোমার কথা বলো।

অর্চনা বাঁচবার জন্য আঁকড়ে ধরেছিল অন্নপূর্ণা দেবীকে। অহরহ তাঁর কাছেই থাকত। তিনিও তাঁকে চাইতেন এবং অর্চনা তাঁকে আঁকড়ে ধরেছিল বলে আনন্দের তাঁর সীমা ছিল না। ভাবতেন—তাঁর মা পুনর্জন্ম নিয়ে তাঁর কাছে ফিরে এসেছেন তাঁকে যত্ন করতে। তাঁর শৈশবাবস্থায় সে যত্ন তাঁর মায়ের কাছে পাওনা ছিল, সেটা তাঁর মা দিতে এসেছেন তাঁর এই বৃদ্ধ বয়সে। এবং বলতেন—মরে আবার তোর পেটেই ফিরে আসব। এবার খুব যত্ন করিস।

আশী বছর বয়সে অন্নপূর্ণা-মায়ের দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়েছিল, তিনি অর্চনার মুখ বোধ হয় ভাল করে দেখতে পেতেন না, পেলে নিশ্চয় জিজ্ঞাসা করতেন—হ্যাঁরে অর্চি-মা, কি হয়েছে রে? মুখখানা এমন ধোঁয়াটে আকাশের মত কেন রে?

ব্যাপারটা কিন্তু রথীনের বাপ-মা জানতে পেরেছিলেন। অবশ্য সদ্য সদ্য জেনেছিলেন। ভাবছিলেন কি করবেন? অর্চনা সম্পর্কে তাঁরা খোঁজখবরের বাকী রাখেন নি। এবং অর্চনার সম্পর্কে খোঁজখবর করে সন্তুষ্ট হয়েই নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন যে, এ মেয়ে নিশ্চয় রথীনকে ফেরাবে।

ফেরাতে হয়তো পারত। কিন্তু অন্নপূর্ণা দেবীর জন্যেই তা ঠিক হয় নি। অন্নপূর্ণা দেবী কেড়ে নিয়েছিলেন অর্চনাকে এবং অর্চনাও পালিয়ে এসে তাঁকে আঁকড়ে ধরেছিল রথীনের জেরার হাত থেকে পরিত্রাণ পেতে।

ফাইনাল ইয়ারে প্রথম ওর মা জানতে পেরেছিলেন, মুখে মদের গন্ধ পেয়েছিলেন। কিন্তু এ যুগটা cleverness-এর যুগ, truth, sincerity এসবই বাতিল হয়ে গেছে সুরেশ্বর। আমরা যারা এগুলোকে মানি, তারা অধিকাংশই লড়াই করে হেরে যাচ্ছি। দু-চারজন, চারজনই বা কোথায়—চোখে তো পড়ছে দুটি মানুষ, বাংলাদেশে অশীতিপর রবীন্দ্রনাথ আর বাংলার বাইরে মহাত্মা গান্ধী, তাঁরা হেরেও হার মানতে চাচ্ছেন না। চীৎকার করে সত্যের সততার জয় ঘোষণা করে যাচ্ছেন। পৃথিবী হয়তো হাসছে। তারা অঙ্ক কষে মাপজোক করা cleverness দিয়ে মানুষের জীবনের গতির মোড় ফেরাতে চাচ্ছে, ফেরাচ্ছেও।

একটু হেসে বলেছিলেন—বল তো, রবীন্দ্রনাথ এখন বিরাট পুরুষ, তাঁর শান্তিনিকেতন তাঁর নিজের হাতে বুকের রক্ত ঢেলে গড়া প্রতিষ্ঠান, সেখানে তাঁর অবর্তমানে অন্তত পরের মানুষ না আসা পর্যন্ত কালটা চালাবার কেউ আছে?

গান্ধীজী? তাঁর সম্পর্কেও সেই কথা সুরেশ্বর। তাঁর পর তাঁর আদর্শ, তাঁর সাধনা অব্যাহত রাখবে কে?

শোকার্ত নগেনবাবু বলেছিলেন—কেউ বলে জওহরলাল, কেউ বলে সুভাষচন্দ্র, কেউ বলে রাজেন্দ্রপ্রসাদ। একজন বললেন—সকলে মিলে। অঙ্ক কষে ওটা বলা চলে সত্য। বস্তুজগতে গান্ধীজীর যে কাজ, তা এঁরা চালাতে পারবেন কিন্তু ভাবজগতে তা পারবেন না। তা হয় না। এ কালের পরিবর্তন।

বললাম তো, আমার ছোটভাই মদ ধরেছে। জানতে যখন পারলাম তখন দেরী হয়ে গেছে। বললে—স্বাস্থ্যের জন্য খাই, বড্ড খাটুনি। ডাক্তারের সার্টিফিকেট দেখালে।

তারপর রথীন। হেসে রথীনের বাবা বললে—সে ডাক্তারী পড়ত। নানারকম ওষুধের গন্ধ দিয়ে মদের গন্ধ ঢেকে রাখত। তার সঙ্গে বড্ড পান-জর্দা আর সিগারেট। ডিসেক্‌শন করবার সময় গন্ধ লাগে এই অজুহাতে সিগারেট ধরেছিল। আমরা মেনে নিয়েছিলাম। বুঝতে পারি নি—সতর্ক হই নি; ভাবি নি সিগারেট-জর্দা না খেয়েও অনেকে ডিসেকশন করে। কাল এমনি করেই প্রতারণা করে। আমাদের কালে সিগারেটেও দোষ ছিল। আমি, আমার মেজভাই পর্যন্ত খাই নি। মেজ অনেক বয়সে ধরেছে। ছোট তারপর রাত্রে খাওয়ার আগে ঘরে ব্র্যান্ডি খায়। নর-নারীর প্রেম বৈধ-অবৈধ—এ চিরকাল আছে। সংজ্ঞা অবশ্য কালে কালে পাল্টায়। কিন্তু একালে সব মিথ্যে হয়ে গেছে। শুনে আশ্চর্য হবে সুরেশ্বর যে রথীন বৌমাকে বিয়ে করার আগেই একটি অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান নার্স মেয়েকে বিয়ে করে তাকে বিলেতে মেট্রন ট্রেনিংয়ের জন্যে পাঠিয়ে দিয়েছে, টাকা যোগাচ্ছে। এবার সে নিজে পালাচ্ছিল বিলেত। এবং তার জন্যে সে বৌমার গহনা, তার মায়ের গহনা বিক্রী করে হাজার-তিরিশেক টাকা নিয়ে বম্বে পর্যন্ত পৌঁচেছিল। বৌমাই সেটা প্রথম জানতে পেরেছিল। আমরা জানতাম কি কাজে সে বম্বে যাচ্ছে। বৌমা ঠাকুমাকে বললে-ঠাকুমা কপাল চাপড়ে আমাকে ডেকে বললেন—যা গিয়ে দেখ, ধরে নিয়ে আয়। আমি গেলাম। ধরতেও পেরেছিলাম। জাহাজখানা ঠিক দিনে ছাড়ে নি। খুঁজে-পেতে ধরে ওকে নিয়ে এলাম হোটেলে। মাথা হেঁট করেই এল। হঠাৎ বললে-বাথরুম থেকে আসি। ঢুকল; মিনিট-দুই পরেই ফায়ারিং-এর শব্দ।


© 2024 পুরনো বই