কীর্তিহাটের কড়চা – ৪র্থ খণ্ড – ৯

সুরেশ্বর চুপ করলে। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সিগারেট ধরিয়ে উঠে গিয়ে দাঁড়ালে একখানা ছবির সামনে।

দেবেশ্বর রায় আর উমা দেবী—তাঁর স্ত্রীর ছবি। ছবিখানায় দুজনের মধ্যে যেন একটা পাতলা কালো যবনিকার আড়াল পড়ে আছে। সুলতার মনে হল, যেন একটা মূর্তি। নারী-মূর্তি।

সুরেশ্বর ছবিখানা দেখতে দেখতে বললে, দেবেশ্বর রায় সেই দিনই রাত্রে গোপালকে নিয়ে পায়ে হেঁটে চলে এসেছিলেন কীর্তিহাট থেকে। কীর্তিহাট থেকে কলকাতায়। শুধু স্ত্রীকে বলেছিলেন—চল আমার সঙ্গে।

স্ত্রী বলেছিলেন—আমি রায়বাড়ীর বউ, শ্বশুরের অনুমতি না নিয়ে যেতে পারব না। ব্যস, সেই অবধি এই আড়াল রয়ে গেল। ধর্ম, দেবতা, রায়বংশের লালসা যা বলবে বলতে পার।

একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললে সে।

সে ছবিখানার সামনে থেকে সরে গিয়ে দাঁড়াল আর একখানা ছবির সামনে। এ ছবিখানা তার নামকরা ছবি। Indian Madona। একটি কালো মেয়ের কোলে একটি ছেলে। তার পিছনে যে রঙের ব্যাকগ্রাউন্ড তাতে একটা ক্রুশের ছায়া পড়েছে।

সুলতা বললে-ও ছবিটা তো?

অর্চনা বললে—হ্যাঁ, কুইনির ছবি।

ঘড়িতে ঢং-ঢং-ঢং শব্দে তিনটে বাজল। সুরেশ্বর ছবিখানার ধার থেকে সরে এসে জানালার ধারে দাঁড়িয়ে জানালা খুলে দিলে। পূর্ব-আকাশে শুকতারাকে দেখা যাচ্ছে।

সুরেশ্বর বললে-রাত্রির তৃতীয় প্রহর পার হল। চতুর্থ প্রহরের সঙ্গে সঙ্গেই আমার জবানবন্দী শেষ হবে। কাল থেকে সাধারণ মানুষ সুরেশ্বর রায়। কীর্তিহাটের জমিদার বংশের সন্তান নয়। কাঠগড়ার ভেতর থেকে বেকসুর খালাসের রায় নিয়ে বেরিয়ে আসব।

জ্বলন্ত সিগারেট একটা দীর্ঘ টান দিলে সে। তারপর বললে-অৰ্চনা আছিস ভালই হয়েছে। অসঙ্কোচে এক গ্লাস হুইস্কি খেতে পারি। তুই না থাকলে আমার সঙ্কোচ হত। সুলতা নতুন কালের মেয়ে, রাজনৈতিক চেতনাও প্রখর, কিন্তু তবু Indian moral code থানা ওর কাছে পুরনো হয়নি। ও আমাকে বলেছে খেতে, কিন্তু তা আমি পারি নি। ভাবছিলাম, আর খাবই না। কোন দিনই না। কেননা জমিদারী যখন উঠে গেল, তখন রায়বংশের শেষ অভিজাত পুরুষ হিসেবে মদটা আমার ছেড়েই দেওয়া উচিত। তাতে যদি এবার বেণীর সঙ্গে মাথাটাও যায় তো যাক। এর আগে বহুবার ছেড়েছি, আবার ধরেছি। এবার আর না। সুতরাং শেষ গ্লাসটা খেয়ে নিই। রায়বংশের সাতপুরুষের মধ্যে কুড়ারাম রায় থেকে বীরেশ্বর রায়, রত্নেশ্বর রায় পর্যন্ত সবটাই বলেছি। এদিকে আমার খানিকটা এবং আমার বাবার সবটাই সকলের জানা। দেবেশ্বর রায়ের কথা বলছি। মদের গ্লাস হাতে না করে দেবেশ্বর রায়ের কথা বলা যায় না।

সুলতা হেসে বললে—কেন অকারণে তাঁর দোহাই পাড়ছ সুরেশ্বর? তুমি তো নিজে আর্টিস্ট। আর্টের দোহাই দিয়ে নিশ্চয় খেতে পার। লেখক, শিল্পী, সঙ্গীতজ্ঞ, অধ্যাপক, ছাত্র এমন কি ফরেন এম্বাসী কনস্যুলেটে অনেক খদ্দরধারীকেও এ পদার্থ পান করতে দেখা যায়। মন্ত্রী-টন্ত্রী যাঁরা, তাঁরা এদেশে যাই করুন, বিদেশে গিয়ে কি করেন বা বাড়ীতে কি করেন, তা হলপ করে কেউই বলতে পারবে না। স্বাধীনতা আসার পরও যদি মদ খাওয়ার স্বাধীনতা না থাকে তবে সে স্বাধীনতার মূল্য কি বল?

একটু দূরে দেরাজের মাথার উপর রঘু বোতল-গ্লাস-সোডা সব রেখে গিয়েছিল। সুরেশ্বর উঠে গিয়ে খানিকটা হুইস্কি গ্লাসে ঢেলে সোডা মিশিয়ে একটু চুমুক দিয়ে বললে—কুড়ারাম রায় ভটচাজ নবাবী আমলে কারণ পান করতেন মার নাম নিয়ে; সোমেশ্বর রায় মদও খেতেন, কারণও পান করতেন, বীরেশ্বর রায় ইংরেজদের এদেশী নবাবী ধরনে মদ্যপান করতে শুরু করে শেষে উন্মাদের মত খেয়েছেন। ওদিকে শ্যামাকান্ত ভ্রষ্ট তান্ত্রিক—ছিলেন রত্নেশ্বরের মাতৃবংশে। তাঁর বাপও ছিলেন তান্ত্রিক। মদ্যপান তিনিও করতেন। এতে প্রথম ছেদ টেনেছিলেন রত্নেশ্বর রায়। শ্যামাকান্তের পুত্রের দিকে বংশধারা বিমলাকান্তে শেষ। পূর্ণচ্ছেদ। কিন্তু রায়বংশে রত্নেশ্বরের পর আবার দেবেশ্বর এসে শুরু করলেন মদ্যপান। এবং রায়বংশে তিনিই প্রথম রায় অ্যারিস্টোক্র্যাট, যিনি খাঁটি মডার্ন ধরনে, মানে ইংরেজী ধরনে, ইংরেজদের মত, খাঁটি বিলিতী মদ খেতে ধরেছিলেন।

গ্লাসে চুমুক দিয়ে সে বললে—এবং নির্ভীকভাবে খেতে ধরলেন।

কলকাতায় ফিরে এসেই মদ ধরলেন, ফের প্রকাশ্যভাবে।

ওদিকে রত্নেশ্বর রায় পরের দিন সকালে ছেলের খবর শুনলেন। ছেলে চলে গিয়েছে রাত্রে গোপালকে নিয়ে। খবরটা বললেন পুত্রবধূ। নতমুখে দাঁড়িয়ে মাটির দিকে তাকিয়ে বললেন। নিজে থেকে নয়, ডেকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন শ্বশুর।

রত্নেশ্বর রায় বললেন—তুমি চলে যাও শিবেশ্বর রামেশ্বরকে নিয়ে।

বধূ নতমুখে বললে—আপনাকে ফেলে যাব কেমন করে? মা নেই!

রত্নেশ্বরের চোখ থেকে জল গড়িয়ে এসেছিল। বলেছিলেন—তাহলে এখানেই থাকো। সম্পত্তি আমি সব তোমার নামে দিয়ে যাব।

বধূ বললে—না।

—বেশ। যে নেবার তাকেই দেব আমি। আমার পৌত্রকে দেব।

অর্থাৎ দেবেশ্বরের প্রথম সন্তান। রত্নেশ্বর ছেলেকে চিঠি লিখলেন, তার কোন উত্তর পেলেন না। পেলেন নোটিশ ধরনের একখানা চিঠি।

“আমার ভিক্ষা-মায়ের সম্পত্তি আমাকে দিতে আপনাকে অনুরোধ জানাইতেছি।”

ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন রত্নেশ্বর রায়। জানালেন, “দলিলের নকল পাঠাইলাম, দেখিলেই বুঝিতে পারিবে, না পার, আইনজ্ঞ সলিসিটার এটর্নীর বাড়ী গিয়া পরামর্শ লইবে যে, ঐ সম্পত্তি কৃষ্ণভামিনী দাসী রাধাসুন্দরের নামে দেবোত্তর করিয়া ওই দেবোত্তরের ট্রাস্টি করিয়া গিয়াছে সরস্বতী বধুরাণীকে; এবং এই দেবোত্তর সম্পত্তির পত্তনীদার হইতেছেন বিমলাকান্ত ভট্টাচার্য এবং দরপত্তনীদার হইতেছেন ব্যক্তিগতভাবে রত্নেশ্বর রায়। এ সম্পত্তি কৃষ্ণভামিনী তোমাকে দেন নাই বা দিতে চাহেন নাই।”

এখানেই শেষ করেন নি, সঙ্গে পুত্রবধূ এবং শিবেশ্বর রামেশ্বরকে কলকাতায় পাঠিয়েছিলেন দেবেশ্বরকে শান্ত এবং ক্ষান্ত করবার জন্য। সঙ্গে নিজে এসেছিলেন। ছেলে হেসেছিল। রত্নেশ্বর পৌঁছেছিলেন অপরাহ্ণ বেলায়, তখন সবে কলেজ থেকে ফিরছেন দেবেশ্বর। দেবেশ্বর কিছু বলেননি, হেসেছিলেন।

বাপ সে হাসির অর্থ বোঝেন নি সেদিন। খেতে বসে জিজ্ঞাসা করেছিলেন—আইনজ্ঞদের পরামর্শ নিয়েছ?

ছেলে উত্তর দেন নি।

বাপ বলেছিলেন—হঠাৎ সম্পত্তির এমন কি প্রয়োজন হল? আমার থেকে পৃথক হতে চাও? স্বাধীনতা?

ছেলে এবারও উত্তর দেন নি। নিরুত্তর পুত্রকে পরাজিত ভেবে পিতা বিজয়ী বীরের মত কীর্তিহাট ফিরেছিলেন। ভার দিয়ে গিয়েছিলেন পুত্রবধূকে।

হঠাৎ একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সুরেশ্বর বললে—তোমাকে বোধ হয় বলি নি সুলতা এবং তুমিও জান না যে, ঠাকুমা আমার আজও জীবিত। উন্মাদ বলে ডাক্তারেরা। সমস্ত দিবা-রাত্রি শুধু জপই করে যান। কারুর সঙ্গে কথা না, বার্তা না, ডাকলে সাড়া দেন না, আপন মনেই আছেন ঠাকুর নিয়ে। কাউকে যেন চিনতেও পারেন না। চিঠি গেলে পড়েন না, ফেলে দেন। নিজের নাম, পরিচয় সব ভুলে গেছেন। প্রথম কিছুদিন বহরমপুরে রাখা হয়েছিল, তখন এ্যাসাইলাম ছিল ওখানে। তখন আহারনিদ্রা ত্যাগ করেছিলেন। শুধু জপ করতেন আর চীৎকার করতেন—মুক্তি দাও মুক্তি দাও মুক্তি দাও। তারপর ভায়লেন্ট হয়ে গেলেন। কপাল ঠুকতেন দেওয়ালে। তখন তাঁকে সেখান থেকে সরিয়ে তাঁর ইচ্ছানুযায়ী বৃন্দাবনে বাড়ী কিনে রাখা হয়। সেখানেই আছেন। বলেন—তপস্যা করছি। স্বামীর মুক্তির জন্য তপস্যা করছি। নিজের সন্তানদের মুখ দেখেন না। গেলে ক্ষেপে যেতেন শুনেছি। নিজের মনে বেশ থাকেন। তপস্যা করছেন।

আমার ইচ্ছে আছে, আমি এই সব ঋণ শোধ করে একবার যাব। তাঁর সঙ্গে দেখা করব। সম্ভবতঃ আমাকে পরিচয় দিতে হবে না, দেখলেই চিনতে পারবেন। তাঁকে বলব—দাদুর সব দেনা শোধ করেছি আমি। মেজদি এখন সেই বাড়ীতেই থাকেন, অন্যদিকে। এই অৰ্চনা গিয়েছিল। আমার বাবার মৃত্যু তিনি জানেন না, মায়ের মৃত্যু জানেন না, হয়তো বিয়ের কথাও জানেন না। তবুও আমাকে চিনবেন তিনি। দেবেশ্বর রায়কে তিনি নিশ্চয় ভুলে যান নি।

অর্চনা একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললে।

সুরেশ্বর বললে—ইম্পসিবল।—

একটু পর আবার আরম্ভ করলে—সুলতা, পিতাপুত্রের সে এক আশ্চর্য যুদ্ধ! চিঠিগুলো পড়লে অবাক হয়ে যাবে! কারণ যুদ্ধ হয়েছে শুধু চিঠিতে। যা চিঠিতে হয় নি—এমনি হয়েছে, তা আছে অন্নপূর্ণা-মাকে লেখা চিঠিতে। দেবেশ্বর রায়ের জবানীতে বলা।

* * *

বাপ ছেলেকে শাসিয়ে চলে গেলেন বিজয়গৌরবে। ভাবলেন, ছেলে নিশ্চয় বুঝেছে। কিন্তু দেবেশ্বর ভয়ে বুঝবার মত ছেলে ছিলেন না। রত্নেশ্বর রায় নিজের যৌবনকালটা ভুলে যাননি, তবে তিনি কথায় কথায় বলতেন—আমার সঙ্গে তোমাদের তুলনা ক’র না। আমি গরীবের ছেলে হিসেবে মানুষ হয়েছিলাম। দেবেশ্বরের প্রেমের কথাটাও স্মরণ করিয়ে দিতেন ইঙ্গিতে, বলতেন—জীবনের প্রথম থেকে ধর্মাচরণের আর ব্রহ্মচর্যের তেজ ছিল আমাদের। যা তোমাদের নেই। তোমরা সাহেব হতে চলেছ।

দেবেশ্বর এর উত্তর দিলেন কাজে।

পড়া ছেড়ে দিলেন। চাকরির খোঁজে বের হলেন। নিজের পায়ে দাঁড়াবেন। নিজের জীবন, নিজের ভবিষ্যৎ, তার সঙ্গে হয়তো জগৎটাকেই নিজের ছাঁচে ফেলে গড়ে নেবেন বলে কল্পনা করেছিলেন।

সুন্দর সুপুরুষ দেবেশ্বরের রূপের কথা বলেছি। তার সঙ্গে ছিল বাকপটুতা, শীলতায় ভদ্রতায় সম্ভ্রমে, ফলে আনত তরুণ গাছের মত- আবার প্রয়োজন হলে, বক্রতায় বাঁকা তলোয়ারের মত—ধারে ক্ষুরের মত। চলে গেলেন মেদিনীপুর, জমিদারী কোম্পানীর আপিসে। কীর্তিহাটের পরিচয়টা সেখানে সুবিদিত ছিল। চাকরি সহজেই মিলেছিল এবং ভাল চাকরিই মিলেছিল। মাইনেও ভালই দিয়েছিল। জেনারেল ম্যানেজার খুব খুশী হয়েছিল তাঁর কথায়। কীর্তিহাটের রায়বাহাদুরের ছেলে চাকরি চায় শুনে সবিস্ময়ে প্রশ্ন করেছিল—তুমি চাকরি করবে? কেন? -আমার ভবিষ্যৎ আমি নিজে গড়তে চাই। বাপের পয়সায় বড়লোক হয়ে সুখ আছে, গৌরব নেই। একটা লাকের কথা, একটা হল নিজের শক্তির কথা।

খুব খুশী হয়ে সাহেব তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন—এ কথা তো ইন্ডিয়ানদের মুখে শুনি না! তারা তো লাকেই সব বলে মানে।

—আমি মানিনে। তা ছাড়া।

—কি? বল!

—টিরানী (tyranny)

—মানে?

আমি পছন্দ করি না, টাইর‍্যান্ট হতে আমি চাইনে।

—জমিদারী মানেই tyranny-আমার বাবাকে আমি দেখেছি। যদিও তিনি আইনের পথ ছাড়া হাঁটেন না তবুও তা আইনসম্মত হলেও অত্যন্ত নির্মম নিষ্ঠুর।

—আমাদেরও তো জমিদারীর কাজ।

—আমি আপনার কাছে এসেছি জমিদারির কাজের জন্য নয়। আপনি কোন Industrial firm-এ আমাকে ঢুকিয়ে দিন। সেখানে আমার পথ আমি করে নেব।

তাই হয়েছিল। সাহেব তাঁকে নিজে সঙ্গে করে বড় সাহেবী ফার্মে নিয়ে গিয়ে তাঁকে সেখানে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন। কয়লার খনি, অভ্রের খনির মস্তবড় কারবার। সেখানে জমি জায়গার স্বত্ব পরীক্ষার কাজ দিয়েছিল তারা। প্রথমেই মাইনে দিয়েছিল একশো পঁচিশ টাকা।

চাকরি নিয়ে, প্রথম মাসের মাইনে পেয়ে বাড়ী ভাড়া করে স্ত্রীকে বলেছিলেন-চল, এ বাড়ী থেকে চলে যাব আমি। নতুন বাড়ী ভাড়া করেছি।

স্ত্রী জানতেন না যে স্বামী পড়া ছেড়ে চাকরি করছেন। কারণ দশটাতেই বেরিয়ে যেতেন ফিরতেন চারটেতে। ভাইরাও জানতে পারে নি।

অবাক হয়ে গেলেন স্ত্রী। বললেন—সে কি?

—হ্যাঁ। আমি চাকরি করছি। বাড়ী ভাড়া করেছি। এ বাড়ীতে আমি থাকব না। আমার সঙ্গে যাও তো চল। নয়তো আমি একলাই যাব। পরের কথা পরে হবে।

স্ত্রী বুঝলেন। তখনকার কালে মেয়েরা একালের মেয়েদের থেকে অনেক অল্পবয়সেই অনেক বেশী বুঝত। তিনি কথাটার মানে বুঝেও বললেন—তুমি বাপের ছেলে। আমি বেটার বউ। আমার অপরাধ তিল হলে তাল হয়। তা ছাড়া রায়বাড়ীর বউ আমি, আমি চঞ্চল হলে আমার অধর্ম হবে। আমি যেতে পারব না শ্বশুরের হুকুম ছাড়া।

দেবেশ্বর ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলেন এবার। বললেন—যদি আমি বিয়ে করি আবার?

—সে তো এমনিই করতে পার। কে বাধা দেবে তোমাকে? সতীন নিয়েই ঘর করব।

—যদি ক্রীশ্চান হয়ে যাই?

মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে এবার ওই ছোট্ট বধূটি বলেছিল—না, তা আমি পারব না।

—সে আমি জানি। বলে চলে গিয়েছিলেন দেবেশ্বর। এবং ওই বাড়ীতে বাস শুরু করে মদ্যপান আরম্ভ করেছিলেন মনের ক্ষোভে। দিনে চাকরি করতেন, বিকেলে বাড়ী ফিরে পোশাক বদলে বেরিয়ে যেতেন; বন্ধুবান্ধব মজলিশ গানবাজনার আসর সেরে বাড়ী ফিরতেন অনেক রাত্রে। চাকর অপেক্ষা করে থাকত। কলকাতার মজলিশে তাঁর তখন বিদগ্ধজন বলে খ্যাতি রটেছিল।

হঠাৎ চিঠি এল। চিঠি নিয়ে এলেন জানবাজারের বাড়ী থেকে ছোট ভাই রামেশ্বর। রত্নেশ্বর রায় লিখেছেন—“তুমি চাকরি লইয়াছ জানিয়া স্তম্ভিত হইলাম। পড়া ছাড়িয়াছ। স্বতন্ত্র বাসা করিয়াছ। কারণ কি অবিলম্বে জানাইবে। এবং পত্রপাঠ জানবাজারের বাড়ীতে ফিরিয়া আসিবে। পত্র আমাকে শিবেশ্বর লিখিয়াছে, বধূমাতা লেখেন নাই। পত্রসহ গাড়ী লইয়া যাইতে আদেশ দিলাম। এই গাড়ীতেই ফিরিয়া আসিবে।”

দেবেশ্বর গাড়ী ফিরিয়ে দিলেন। শুধু একখানা পত্র রামেশ্বরকে দিলেন, বললেন—বাবাকে যে পত্র লিখবি, তার সঙ্গে এটা পাঠিয়ে দিস। পত্রখানা সংক্ষিপ্ত;–”আমার চাকরি লওয়ায় আপনি বিস্ময় প্রকাশ করিয়াছেন কেন বুঝিলাম না। সংসারে যাহার যতই থাক, কাজ করা, উপার্জন করা অগৌরবের নয়। এবং সংসারে যেখানে পৈতৃক অন্নে জীবনধারণ করিলে পদে পদে স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হয়, সেখানে নিজের উপার্জিত অন্নে ভাগ্য গঠন করিলে শুধু স্বাধীনতাই অক্ষুণ্ণ থাকিবে না, পিতার গৌরবও বৃদ্ধি পাইবে বলিয়া মনে করি।”

এক সপ্তাহ পর আবার গাড়ী এসে দাঁড়াল। এবার গাড়ী থেকে নামলেন বধূ। পিছনে ছেলে কোলে নিয়ে ঝি। তার সঙ্গে রামেশ্বর। এবং গাড়ীর ছাদে বোঝাই বাক্স-পেটরা। এবং গৃহে গৃহিণীর মতই ঢুকে বললেন—বাবা আমাকে এখানে আসতে বলেছেন।

—এস। কিন্তু আমি যদি ক্রীশ্চান হয়ে থাকি?

—সে তুমি হতে পারো না।

হাসলেন দেবেশ্বর। শুধু বললেন-এ বাড়ীতে বাবুর্চি রান্না করে।

—সে আমি শুনেছি। জানি। ঠাকুর এক্ষুনি আসছে। বাবুর্চি থাকবে না। আর আমি এখানে থাকব বলে আসি নি, ধরনা দিয়ে তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যেতে এসেছি।

—অ! শুধু এইটুকু বলে দেবেশ্বর স্নানের জন্যে উঠলেন—আপিস যেতে হবে। এবং বাবুর্চির হাতে খেয়ে চলে গেলেন। বিকেলে ফিরে দেখলেন বাবুর্চি নেই। তার বদলে মেদিনীপুরের খাস কীর্তিহাটী চাটুজ্জেপুত্র জলখাবার তৈরী করেছে—লুচি- হালুয়া—ফল-মিষ্টি। কিন্তু তার তরিবৎ অনেক। দেবেশ্বর সন্ধ্যায় স্নান করে প্রসাধন করে বেরিয়ে গেলেন। ফিরলেন বারোটায়। মদ্যপান করেছেন কিন্তু চঞ্চল নন, স্থির, শুধু একটু বেশী গম্ভীর। দেখলেন খাবারের থালা নিয়ে স্ত্রী প্রতীক্ষা করে রয়েছে। পরদিন রাত্রি দুটো। সেদিনও ওই বধূটি খাবারের থালা নিয়ে দেওয়ালে ঠেস দিয়ে ঢুলছে। পরদিন এলেন দশটায়। এবং এই দশটাই নিয়ম হয়ে গেল। কিন্তু জানবাজার ফিরলেন না।

স্ত্রী রোজ বলেন—আজ ওবাড়ী চল।

—না।

রোজ এই এক কথা, ওই এক উত্তর। অবশেষে একদিন, প্রায় মাসখানেক পর, রাত্রে হঠাৎ এসে উপস্থিত হলেন রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায়। রাত্রি তখন প্রায় ন’টা। বাড়িতে পুত্রবধূ বড়ছেলে যজ্ঞেশ্বরকে ঘুম পাড়াচ্ছেন আর বঙ্কিমচন্দ্রের বই পড়ছেন। শ্বশুরকে দেখে ধড়মড় করে উঠে বললেন —বাবা!

—হ্যাঁ মা। কিন্তু দেবেশ্বর কোথায়?

নতমুখে পুত্রবধূ বললেন—তিনি তো বেরিয়েছেন আপিস থেকে ফিরে—।

—ফিরবে কখন?

চুপ করে রইলেন পুত্রবধূ। রায়বাহাদুর বললেন—হুঁ। তার পর বললেন-রামেশ্বর কোথায়? শিবেশ্বর? ওবাড়িতে শুনলাম শিবেশ্বর এখানে এসেছে।

—ওরা থিয়েটার দেখতে গেছে।

—থিয়েটার?

চুপ ক’রে রইলেন পুত্রবধূ। রায়বাহাদুর বললেন-এই ঘরে আমার একটা বিছানা করে দাও। রাত্রে আমি এখানেই থাকব। তারপর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন—ওঃ অভিশাপ বটে। এ আসনে তিনি বসেছিলেন রাত্রি দুটো পর্যন্ত। রাত্রি দুটোর সময় সেদিন দেবেশ্বর ফিরেছিলেন। পদক্ষেপ ঈষৎ স্খলিত; কণ্ঠস্বর একটু জড়িত। বললেন—তুমি দরজা খুলছ কেন, চাকর কোথায় গেল?

—চুপ কর। বাবা!

—কে?

—বাবা। কীর্তিহাট থেকে এসেছেন।

একবার চমকে উঠলেন দেবেশ্বর। তারপর এক মুহূর্ত ভেবে নিলেন। নাকের ডগায় কপালে গালে লালচে আভা ফেটে পড়ছে। চোখের দৃষ্টি স্বল্প ক্লান্ত, অথবা নেশায় নিমীলিত, পরনে বাহান্ন ইঞ্চি বহরের ফরাসডাঙার কোঁচানো কালাপেড়ে ধুতি, গায়ে সেকালের হাল ফ্যাশনের কিছু বদল হওয়া মুসলমানী আমীরী পাঞ্জাবি, কাঁধে পাটকরা দুধের মত রঙের রেশমী চাদর। গুন গুন করে গানের কলি ভাঁজতে ভাঁজতে ঘরে ঢুকেছিলেন, ফিরছেন বিশিষ্ট একজন ধনীর বাগানবাড়ির বাঈজীর গানের আসর থেকে। স্ত্রীর কথা শুনে থমকে গিয়ে কপাল কুঁচকে চোখ বুজলেন। মনে হল মনে মনে বলছেন- ব্যাপারটা ঠিক পছন্দ হচ্ছে না তাঁর!

স্ত্রী আবার সামনের ঘর দেখিয়ে দিয়ে বললেন—বাবা বসে আছেন।

একবার তাকিয়েও দেখলেন না দেবেশ্বর, শুধু বললেন-অ! তারপর তিনি সতর্ক পদক্ষেপে পা বাড়ালেন দোতলার সিঁড়ির দিকে।

স্ত্রী পিছন থেকে একটু উচ্চকণ্ঠেই ব্যাকুলভাবে বললেন—ওগো, বাবা বসে আছেন, দেখা কর!

এবার দৃষ্টি বিস্ফারিত করে ফিরে তাকালেন স্ত্রীর দিকে, বললেন—ভাল। দেখা করব। বলে এগিয়ে গিয়ে সিঁড়ির রেলিং ধরে উপরে উঠে গেলেন। এবং সামনেই মার্বেল টপ টেবিলের উপর হাত রেখে ভর দিয়ে দাঁড়ালেন। নিয়ম—চাকর এসে চেয়ার এগিয়ে দেবে, তিনি বসবেন, তারপর চাকর জামা জুতো চাদর একে একে খুলে নেবে। চটি এগিয়ে দেবে। ঘাড় হেঁট করে ভাবছেন, কপালে কুঞ্চন-রেখা দেখা দিয়েছে-এ কি! বাবা এমনভাবে আসবেন কেন?

হঠাৎ গম্ভীর কণ্ঠের ডাক শুনে চমকে উঠলেন।

—দেবেশ্বর! রত্নেশ্বর নিজেই উঠে এসেছেন, উত্তেজনার মধ্যে চটি জোড়াটা পায়ে না দিয়েই উঠে এসেছেন; দেবেশ্বর আবার চমকে উঠলেন একবার। এটা তিনি আশঙ্কা করেন নি। ঘাড় তুলে দেখে নিলেন একবার, বাপ কত দূরে, তারপর ঘাড় নামালেন। যেমন দাঁড়িয়ে ছিলেন তেমনি দাঁড়িয়ে রইলেন। প্রণাম করবার চেষ্টাও করলেন না।

—আমি জেগে বসে আছি, আর তুমি আমার সঙ্গে দেখা না করে চলে এলে?

দেবেশ্বর নীরব। তেমনি দাঁড়িয়ে রইলেন।

—আমাকে তুমি এমন ক’রে উপেক্ষা করতে সাহস কর? এতবড় স্পর্ধা! তবু দেবেশ্বর নীরব। এক চুল নড়লেন না। বরং এর আগে একটু-আধটু টলছিলেন, সেটুকুও বন্ধ হয়ে গেল।

—দেবেশ্বর!

নীরব দেবেশ্বর। রত্নেশ্বর বললেন—কথার উত্তর দাও!

—কাল সকালে উত্তর দেব। আজ আমি সুস্থ নই। বলে জুতো- জামা না ছেড়েই সামনেই শোবার ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন।

—দেবেশ্বর, দরজা খোল, দেবেশ্বর!

দেবেশ্বর উত্তর দিলেন, কিন্তু সরাসরি বাপকে নয়, ডেকে স্ত্রীকে বললেন—মানিকবউ, বাবার শোবার ব্যবস্থা করে দাও; আমার শরীরটা খারাপ করছে। তুমি একটু শিগগির এস। আমার সেই গুলী লাগা জায়গাটায় যেন কেমন ব্যথা জাগাচ্ছে। একটু মালিশ দিতে হবে। চাকরটাকে বল। তুমি বাবার ঘুমের ব্যবস্থা কর।

পরদিন বেলা আটটার সময় উঠলেন দেবেশ্বর, দেখলেন রায়বাহাদুর—কীর্তিহাটের একচ্ছত্র অধিপতি রত্নেশ্বর রায়—তাঁর প্রতীক্ষায় গম্ভীর মুখে চেয়ারে বসে আছেন। স্নান পুজো হয়ে গেছে। পুত্রবধূ ফল কেটে রূপোর রেকাবিতে সাজিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তার সঙ্গে কিছু মেওয়া ফল। বাইরে—জানবাজারের জুড়ি, কোচম্যান সহিস; চাকর দারোয়ান। কিন্তু সবাই স্তব্ধ। যেন একটা ঝড়ের পূর্বলক্ষণ।

দেবেশ্বরের জন্য চাকর ছিল উপরে। তিনি প্রাতঃকৃত্য সেরে চা না খেয়েই নিচে নেমে এলেন, এসে বাপকে প্রণাম করে সামনে দাঁড়ালেন। মাথা হেঁট করেই দাঁড়ালেন।

রত্নেশ্বর রায় বললেন—চা খেয়েছ?

ঘাড় নাড়লেন দেবেশ্বর-না।

রত্নেশ্বর বললেন–বউমা, চা আন।

পুত্রবধূ চলে গেলেন চা আনতে। রত্নেশ্বর তিরস্কার শুরু করলেন। প্রথমে মৃদুস্বরে, তারপর সে স্বর চড়ল। দেবেশ্বর স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েই রইলেন। যে মুহূর্তে পুত্রবধূ দরজায় ঢুকলেন, অমনি চুপ করে গেলেন। বধূ চা-খাবার এনে নামিয়ে দিলেন। রায়বাহাদুর বললেন—খাও।

ছেলে নড়ল না। বাপ বললেন-নইলে আমার খাওয়া হয় না। খাবার পড়ে রয়েছে, দেখছ না?

দেবেশ্বর এবার চা ও খাবারে হাত দিলেন। বাপও ইষ্টকে নিবেদন করে ফলের টুকরো মুখে দিয়ে ও-বাড়ীর সরকারকে ডেকে বললেন—দারোয়ান চাকরদের বল, এ বাড়ীর জিনিসপত্র গুছিয়ে নিক। সন্ধ্যেবেলা তক ওবাড়ী যাবে। কাল সকালে কীর্তিহাটে। বড়বাবু, বউমা, খোকার সব জিনিস যাবে কীর্তিহাটে।

এবার দেবেশ্বর বললেন-আমার আপত্তি আছে।

—কারুর আপত্তি আমি মানি না।

পুত্র চমকাল না কিন্তু অতর্কিতে এমন ধমকে বধূটি চমকে উঠল।

দেবেশ্বর হাসলেন। বধূটির লজ্জার আর সীমা রইল না। সঙ্গে সঙ্গে শ্বশুরের। শ্বশুর হেসে বললেন—এই ক্রোধ রিপুটা আর আমার গেল না। ভূমির অধিকারিত্বের সঙ্গে সম্বন্ধটা নিগূঢ়।

ছেলের হাসিকে গ্রাহ্য করলেন না। অর্থও ভুল করলেন, ভাবলেন বিনীত আত্মসমর্পণ। স্ফীতও হলেন। তাঁর কথা অক্ষরে অক্ষরে পালিত হল। সন্ধ্যায় এসে উঠলেন জানবাজারের বাড়ীতে। সেখানে শিবেশ্বর এবং রামেশ্বর অপরাধীর মত ঘরে লুকিয়েছিল। তাদের কয়েকটা কটু কথা বলে রেহাই দিলেন। খুশী হয়েছেন বড় ছেলেকে আয়ত্ত করেছেন।

কিন্তু কীর্তিহাটে এসে দেখলেন, ভুল তাঁরই। প্রচণ্ড ভুল করেছেন। তিনি অন্ধ।

সুরেশ্বর বললে—সুলতা, রত্নেশ্বর রায়ের ডায়রীতে যা আছে তাই বলি। আমি তাঁর চেয়ে ভাল ক’রে বলতে পারব না। লিখেছেন—“আমি ভুল করিয়াছি। আমিই অন্ধ, আমিই অন্ধ। দেবেশ্বরের যে লৌহকঠিন অবাধ্যতা এবং জেদকে ভাঙিয়াছি মনে করিয়াছিলাম সেটা ধৃতরাষ্ট্রের ভাঙা লৌহভীমের মত, একটা কৃত্রিম এবং অলীক বস্তু ছাড়া কিছু নয়।”

তিনি স্তম্ভিত হয়ে গেলেন যখন দেবেশ্বর স্বরূপে নিজেকে প্রকাশিত করলেন। তিনি কীর্তিহাটে এসে, পরদিন থেকেই অন্ন এবং আহার ত্যাগ করলেন। শুধু জল। এবং মৌনব্রত অবলম্বন ক’রে একখানা মোটা বই নিয়ে বসে রইলেন ইজিচেয়ারে।

কাছারীতে বসে একটা লাটের প্রজাদের সঙ্গে মিটমাটের কথা হচ্ছিল। লাটভুবনপুরের মধ্যে মৌজা খান-দশেক; দশখানা গ্রামের প্রজাদের সঙ্গে মামলা চলছিল দু বছর। বৃদ্ধির জন্যে মামলা করেছিলেন রায়বাহাদুর। প্রজারা বৃদ্ধি দিতে রাজী ছিল কিন্তু সে টাকায় এক আনা থেকে শুরু করে দু’ আনা পর্যন্ত উঠেছিল, তারপর খুঁট পেতে বসেছিল—লড়াই হয় হোক। এর বেশী দেবে না।

রায়বাহাদুরের দাবী ছিল—টাকায় চার আনা এবং প্রত্যেক জোতজমা জরীপ করে দেখে যার জমির পরিমাণ বৃদ্ধি পাবে, তার উপর খাজনা ধার্য।

নতুন কেনা লাট। বৃদ্ধির সম্ভাবনা অনেক। রায়বাহাদুর হুকুম দিয়ে গোমস্তা পাইক উঠিয়ে এনে কাগজ ফেলে দিয়েছিলেন মামলা সেরেস্তায়। সেখান থেকে গাদাবন্দী আর্জি গিয়ে পড়েছিল মুন্সেফী আদালতে। এ-লাটখানা ২৪ পরগণার অন্তর্গত, আলিপুর সদর সাব-ডিভিশনের এলাকা। দু’ বছর লড়ে প্রজারা গড়িয়ে পড়েছে—হুজুর, একটা মিটমাট করে নিন। টাকায় সিকি বৃদ্ধি দিতে গেলে আমরা মরে যাব। এতেই আমরা দু’ বছর মামলা করে ঘায়েল হয়ে পড়েছি। দশখানা গ্রামের মাতব্বর সে প্রায় পঞ্চজন হিসেবে হলে পঞ্চাশ হয় সুলতা, কিন্তু পঞ্চের চেয়ে বেশী এসেছিল, দশ হিসেবে একশো নয়, বিরাশী জন। দেবোত্তরের ভাণ্ডারের খাতায় খরচ লেখা আছে, চালের খরচ। “অদ্য লাটভুবনপুরের বিরাশীজন ও অন্যান্য স্থানের ত্রিশজন প্রজা আইসে—তাহাদের জন্য মায়ের ভোগ বরাদ্দ ব্যতীত বাড়তি চাউল বরাদ্দ—এক মণ আঠারো সের।”

খাস কাছারী—যে কাছারী ঘরে অতুলেশ্বর কার্টিজ আর বোমার সরঞ্জাম লুকিয়ে রেখেছিল, সেইটে তখন নতুন তৈরী হয়েছে—সেই ঘরে, ওই কুইন ভিক্টোরিয়ার অয়েল পেন্টিংয়ের নীচে তিনি বসেছিলেন, ফুরসী নলে টান দিচ্ছিলেন এবং মনে মনে প্রজাদের কতটা মাপ করা যায়, সেই কথা ভাবছিলেন। ঠিক সেই সময় তাঁর খাস চাকর এসে পিছনে দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে ডেকেছিল—হুজুর!—

চিন্তার মধ্যে থেকেই তিনি উত্তর দিয়েছিলেন—উঁ—। ছোট্ট উঁ।

—এই রোকাখানা। বলে সে একখানা কাগজ তাঁর সামনে এসে ধরেছিল।

—কি এটা? বলে রোকাখানা তুলে ধরে পড়েই গভীরতর চিন্তায় ভুরু-কপাল কুঁচকে, ঘাড়টা একটু ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়েছিলেন পলকহীন দৃষ্টিতে।

রোকাখানায় লেখা, পুত্রবধূ লিখেছেন—“আপনার ছেলে সকালবেলা হইতে কাহারও ডাকে সাড়া দিতেছেন না, জল ছাড়া কোন কিছু খাইতেছেন না, সকাল হইতে চা পর্যন্ত খান নাই। শুধু দু গ্লাস জল খাইয়াছেন। আমি কি করিব? কাহাকে বলিব? যাহা হয় আপনি করুন।”

কপালের কুঞ্চনরেখার সারির সংখ্যা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এবং দৈর্ঘ্যেও প্রসারিত হচ্ছিল দুই প্রান্তে। নাকের উপরেই ভ্রূর মধ্যে তিনটে রেখা জেগে উঠে ত্রিশূলের মত মনে হচ্ছিল। সব আলোচনা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। কে কথা বলবে এ-সময়? হঠাৎ তিনি উঠে দাঁড়ালেন, বললেন—আসছি আমি। মণ্ডলদের সব তামাক দিতে বল।

রত্নেশ্বর এসে দেখলেন দেবেশ্বর ইজিচেয়ারে বসে বই পড়ছেন। বাপের পায়ের চটির শব্দ শুনে মুখ তুলে দেখে উঠে নীরবে দাঁড়ালেন।

রত্নেশ্বর বললেন—তুমি কি আমাকে অপমান করতে বদ্ধপরিকর?

দেবেশ্বর ইজিচেয়ারের পাশে একটা তেপায়া ছিল, সেটার উপর থেকে একখানা কাগজ তুলে নিয়ে লিখে উত্তর দিলেন-”না। তবে আমারও একটা সম্মান আছে। সে সম্মান বজায় রাখিতে আমি মরিতে পর্যন্ত প্রস্তুত। আমিও রায়বংশের সন্তান, উত্তরাধিকারী। আমি রায়বাড়ীর প্রজা নহি। এবং আপনার প্রতি ভয়, আতঙ্ক সবকিছু—সেদিন গুলী করিয়া আত্মহত্যা করিতে গিয়াও বাঁচিয়া উঠিবার পর চলিয়া গিয়াছে। তদ্ব্যতীত আমার বয়স ষোড়শ বর্ষ অনেক দিন অতিক্রম করিয়াছে, আমি পুত্রের পিতা হইয়াছি।”

রত্নেশ্বর স্থিরভাবে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে একখানা চেয়ার টেনে নিয়ে ছেলেকে বলেছিলেন—বস।

দেবেশ্বর ইজিচেয়ারে বসেছিলেন। রত্নেশ্বর বলেছিলেন-তুমি আমার পুত্র নও? তুমি ভুল করলে আমি তোমাকে শাসন করব না?

লিখেই উত্তর দিয়েছিলেন দেবেশ্বর —“পুত্রেরও স্বাধীনতা আছে। সেও মানুষ। আমার ধারণা আমার ভাল-মন্দ বুঝিবার বয়স হইয়াছে এবং সেমত বিদ্যাবুদ্ধিও আয়ত্ত করিয়াছি। আমার জীবনের ভাল-মন্দ যেমন আপনি বিচার করেন, তেমনি আপনার চরিত্রের ভাল-মন্দ বিচার করিয়া নিজেকে গঠন করিয়াছি। যে কঠোরভাবে আপনি আত্মনির্যাতন করিয়াছেন, তাহার জন্যই আজ আপনি এমত প্রকার কঠিন ও কঠোর চরিত্র, রূঢ় প্রকৃতি। তাহার সঙ্গে স্বার্থবুদ্ধি জড়িত করিয়া যাহা করিয়াছেন, তাহাকে আপনি ধর্ম বলেন—আমি অধর্ম মনে করি।”

দেবেশ্বরের হাত চেপে ধরে রত্নেশ্বর বলেছিলেন-স্বার্থবুদ্ধির অপবাদ দিচ্ছ তুমি দেবেশ্বর?

সসম্ভ্রমে হাতখানি টেনে এবার মুখে বলেছিলেন—হাতখানা ছাড়ুন, মুখে এর উত্তর দিতে পারব না আমি। লিখে দিচ্ছি।

ছেলের হাত ছেড়ে দিয়েছিলেন রত্নেশ্বর। দেবেশ্বর লিখেছিলেন তার দুটি দৃষ্টান্ত আমার অন্তরে মর্মান্তিক ক্ষতের সৃষ্টি করিয়াছে। প্রথম আমার ভিক্ষা-মাকে যে কারণে দেশত্যাগিনী করিয়া নির্বাসনে পাঠাইয়াছিলেন, সে-কারণ এমন কোন অপরাধ নয়।

মাঝখানেই রত্নেশ্বর বলে উঠেছিলেন-না-না। তুমি জান না। তুমি জান না। সে আমার সর্বনাশ করত। সে আমাদের বংশের অভিসম্পাত, ছলনা করে প্রবেশ করেছিল। সর্বনাশ হয়ে যেত।

দেবেশ্বর লিখলেন, কিন্তু তাঁহার সম্পত্তি লইলেন কেন?

—তার স্বামীর তাই অভিপ্রায় ছিল। সম্পত্তি দেবোত্তর করা। এবং একজন ভ্রষ্টাচরিত্রার দেবোত্তরের সেবায়েত হবার অধিকার নাই।

—আমি স্বীকার করি না, দেবতার সেবা করিবার অধিকার নাই। পাপী-তাপী-পুণ্যাত্মা- পাপাত্মা সকলেরই অধিকার আছে।

দৃঢ়স্বরে রত্নেশ্বর বলেছিলেন—না-না। বেশ্যা নিজে দেবতা স্থাপন করে পূজা করতে পারে সে তার। কিন্তু সৎ শুদ্ধ গৃহস্থের স্থাপিত বিগ্রহের সেবায়েত ভ্রষ্টা হলে তার সে অধিকার থাকে না। থাকতে পারে না। যেমন জাতিচ্যুত বা জাত্যন্তর গ্রহণে পৈতৃক সম্পত্তিতে এমন কি পিতামাতার সঙ্গে তার কোন সম্পর্ক থাকে না। তাকে নির্বাসনে পাঠিয়েছিলাম, সেই রক্ষা দেবেশ্বর, হতভাগিনী মরে বেঁচেছে। নাহলে সে আমাকে বলেছিল, সে তোমার মা, তোমাকে সে কথা বলতে পারব না। তবু ইঙ্গিতে বলি, বলেছিল-সে মুসলমান বা ক্রীশ্চান হয়ে যাবে। ঠাকুর গঙ্গার জলে বিসর্জন দেবে।

দেবেশ্বর লিখে জানিয়েছিলেন, কৃষ্ণভামিনী মরেন নি। বৃন্দাবন থেকে মৃত্যু রটনা করে পালিয়ে এসে বাইজীবৃত্তি অবলম্বন করেছেন।

তিক্ত হেসে রত্নেশ্বর বলেছিলেন—তাও জান তুমি? সেও আমি জানি, কিন্তু কথাটা বলতে পারি নি তোমাকে।

এবার দেবেশ্বর স্তব্ধ হয়ে ছিলেন কিছুক্ষণ। তারপর আবার লিখেছিলেন, শূদ্রযাজক ব্রাহ্মণ রামহরি চক্রবর্তীকে স্ত্রী-পুত্রসহ নির্বাসনে পাঠাইয়াছিলেন। তাহা নিষ্ঠুরতা নয়?

—মৃত্যু? মৃত্যু নিষ্ঠুরতা নয়? কিন্তু তা নিয়ম। সমাজের মধ্যেও নিয়ম আছে। তার কিছু কিছু নিষ্ঠুর হয়ে থাকে।

এবার যেন পরাজিত হয়ে ক্ষিপ্ত উঠেছিলেন দেবেশ্বর। লিখেছিলেন-”আপনি ভ্ৰান্ত সংস্কারবলে আপনার মাতামহের ভ্রান্তির বা মস্তিষ্কবিকৃতির কলঙ্ককে বংশগত অভিসম্পাত বলিয়া ধরিয়া লইয়াছেন। এবং নিজেকে যন্ত্রণা দিতেছেন, আমাদিগকেও যন্ত্রণা দিতেছেন।”

সভয়ে রত্নেশ্বর বলেছিলেন-থাম থাম। তারপর বিস্ফারিত দৃষ্টিতে ছেলের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন—তুমি জান?

—জানি। মুখেই বলেছিলেন দেবেশ্বর।

—কে বললে?

এবার আবার কাগজ টেনে লিখে দিয়েছিলেন দেবেশ্বর, যাঁর মুখ চিরদিনের জন্য বন্ধ করিবার জন্য আপনি পিদ্রুজকে দিয়া খুন করাইলেন। ঠাকুরদাস জ্যাঠামশাই। গুলী লাগিয়া যখন শয্যাশায়ী ছিলাম, তখন জ্যাঠামশাই কলিকাতা আসিয়াছিলেন; গোপনে তিনিই আমাকে সব বলিয়াছিলেন। বলিয়াছিলেন, ইহাতে তোমার দোষ নাই, দেবু বাবা। তোমার বাবার পিতামহ-মাতামহ দুই দিক হইতে অভিসম্পাত আছে। আমাকে তিনি সাবধান করিবার জন্যই বলিয়াছিলেন। রায়বংশের নিন্দা করেন নাই।

—তবে? তবে তুমি কেন আমাকে এই কঠোরতার জন্য দোষারোপ করছ? আমি নিদারুণ কষ্ট স্বীকার করেছি। অঞ্জনা-কৃষ্ণভামিনী দুটো নারীকে বলতে গেলে, পঙ্কসমুদ্রে ফেলে দিয়েছি, তারা ডুবে গেছে। কেন? রায়বংশকে বাঁচাতে। তুমি মূর্খের মত, পশুর মত প্রলুব্ধ হয়ে সেই অভিশাপের হাতছানিতে ছুটছ।

চুপ করে বসেছিলেন দেবেশ্বর, উত্তর বোধহয় খুঁজে পান নি। বা যে উত্তর তিনি পরে দিয়েছিলেন, সেটা তখন-তখনই বাপের সম্মুখে লিখে দিতে পারেন নি। দিলে সেটা মুখের উপর জবাব করা হত।

ওদিকে কাছারী থেকে লোক এসেছিল। সময়টা ভর্তি কাছারীর সময়। সকালবেলায় প্রথম প্রহর পার হয়ে দ্বিতীয় প্রহরে ঢুকছে দিন। কীর্তিহাটে যারা আসবার জন্য সকালে বা রাত্রি থাকতে যাত্রা করেছে, তারা এসে পৌঁছে গেছে। ওদিকে ডাক এসেছে। মামলা সেরেস্তায় তো দশখানা তৌজির মাতব্বর বসে আছে। এর মধ্যে হরকরা খবর এনেছে, তমলুকের এস-ডি-ও সাহেবের চিঠি নিয়ে একজন লোক এসেছে। রত্নেশ্বর রায় ছেলেকে নীরব দেখে বললেন—ভেবে দেখ। কিন্তু গোটা বাড়ীতে, গোটা গ্রামে একটা শোরগোল তুলে জাহির কর না যে রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায়ের পুত্র অবাধ্য। সে তাঁকে অপমান করেছে। রায়বাহাদুর তাই নীরবে হজম করছেন। রত্নেশ্বর রায় বাঘ নয় শেয়াল হয়ে গেছে ছেলের কাছে।

তমলুকের এস-ডি-ও অর্শে ভুগছিলেন, তার জন্য ওল খেতে বলেছে কবিরাজ এবং স্থানীয় প্রধানেরা, তাই তিনি কীর্তিহাটের রায়বাহাদুরের কাছে পাঠিয়েছেন, কিছু ভাল ওল পাঠিয়ে দিন। এবং তাঁর বাড়ীতে জামাই-মেয়ে এসেছে, তাদের জন্যে একটা বড় মাছ এবং মনে করিয়ে দিয়েছেন, খুব ভাল মিহি -পাতির মাদুরের কথা

সেই ব্যবস্থা আগে করলেন। চিঠির উপর হুকুম লিখে পাঠিয়েছিলেন ম্যানেজারের কাছে। ওবেলার মধ্যে লোক যেন জিনিসপত্র নিয়ে তমলুকে পৌঁছয়। এই সব জিনিসের সঙ্গে আরও কিছু জিনিস, বাগানের অকালের আম, মর্তমান কলা, কিছু ভাল ঘি সের পাঁচেক যেন পাঠানো হয়।

তারপর কয়েকটা নালিশ এসেছে প্রজাদের। নিজেদের মধ্যে ঝগড়ার নালিশ। বিচার মহলের গোমস্তা করেছে, কিন্তু তা ঠিক মনঃপূত হয় নি, আপীল করেছে খোদ হুজুরের কাছে। সে সব দরখাস্তের উপর তারিখ দিয়ে গোমস্তাকে এবং প্রতিপক্ষকে হাজির হবার জন্য হুকুমনামা পাঠাবার নির্দেশ দিয়ে জমিদারী সেরেস্তায় নায়েবকে পাঠিয়ে দিয়েছেন।

তারপর ডাকঘরের ডাক দেখতে বসলেন; সাপ্তাহিক কাগজ এসেছে বাংলা-ইংরেজী। বঙ্গবাসী, হিতবাদী, অমৃতবাজার, ইংলিশম্যান সে সব ঠেলে রেখে সর্বাগ্রে খুললেন একখানা সরকারী খাম, আসছে কলকাতা থেকে। তিনি নতুন ভাইসরয়কে সেলাম জানাবার অনুগ্রহ প্ৰাৰ্থনা করেছিলেন, তার জবাব।

জবাব এসেছে, দরখাস্ত হিজ একসেলেন্সি পেয়েছেন, পরে সুবিধামত সময় ও সুযোগ অবশ্যই দেওয়া হবে। রায়বাহাদুরের নাম ভাইসরয় দপ্তরে অপরিচিত নয়।

শ্বশুর চিঠি দিয়েছেন, তাও উৎসাহজনক। তিনি কলকাতায় রাইটার্স বিল্ডিংসে তদ্বির করছেন। নূতন লাটসাহেব মার্কুইস অব রিপন। লিখেছেন—হঠাৎ খানিকটা অসুবিধা ঘটিয়া গেল, নতুবা নুতন লাট লর্ড রিপন উদার ব্যক্তি। তিনি নিশ্চয় সুবিধা দিতেন। সম্প্রতি আফগানিস্তান লইয়া রাশিয়ার সঙ্গে ইংরেজের যে কাড়াকাড়ি চলিয়াছিল, তাহাতে ইংরেজই জয়ী হইয়াছিল, হঠাৎ সেখানে আবার বিপর্যয় ঘটিয়াছে। তুমি নিশ্চয়ই কাগজে দেখিয়াছ যে, কাবুলের বৃটিশ এজেন্টকে একদল বিদ্রোহী আফগান সৈন্য হত্যা করিয়াছে। তাহার প্রতিশোধ লইবার জন্য লর্ড রবার্টস কাবুল অভিযান করিয়াছেন এবং কাবুল দখল করিয়াছেন। বর্তমানে কাবুলের আমীর শেখ আলিকে অপসারণ করিয়া তাঁহার ভ্রাতুষ্পুত্র আবদুর রহমানকে আমীরের পদে অভিষিক্ত করা হইতেছে। এখন এখানে দারুণ ব্যস্ততা। সুতরাং অন্যরূপ ভাবিবে না। এসব মিটিলেই তোমার ইন্টারভ্যুর সুযোগ মিলিবে। এবং আমি যতটা আঁচ পাইয়াছি, তাহাতে তোমাকে আরও বড় সম্মানে সম্মানিত করিবার কল্পনা আছে। তখনকার ১৮৬৪ সালের Cyclone-এর পর তুমি যে সদাব্রত খুলিয়া লোককে আশ্রয় দিয়া তাহাদিগকে বাঁচাইয়াছ, সেবা করিয়াছ, তাহার সরকারী রিপোর্ট দেখিলাম, তোমার ফাইলের মধ্যে উদ্ধৃত করিয়াছে।

“On the whole the death by sickness are estimated to have been equal to those caused by storm and flood making a total of at least 65.000; exclusive of the tracts not reported upon of all individuals specially amongst the zaminders who live like princes and lords by exacting money from these poor people, Roy Bahadur Ratneswar Roy is the first and foremost man to be named who did more than his best to serve these poor people. He gave them shelter and food, also served with medical help from his charitable dispensary.”

সুলতা, চিঠিপত্র সবই তখন ইংরিজীতে। দেবেশ্বরও ইংরিজী ছাড়া লিখতেন না।

যুগটাই ইংরেজের। কিন্তু সে কথা থাক। সেদিন ওই পত্রখানার কল্যাণে লাট ভুবনপুরের প্রজাদের মঙ্গল হয়েছিল। তাদের বৃদ্ধির বোঝার কিছু উপশম হয়েছিল। টাকায় এক আনা বৃদ্ধি মাফ হয়ে তিন আনা হয়েছিল।

প্রজারা সানন্দে মেনে নিয়েছিল। কারণ এ কথা সকল লোকে জানে যে, আইনে যা প্রাপ্য হয় তা রায়বাহাদুর মাফ দেন না। এক্ষেত্রে চার আনা বৃদ্ধি তিনি নিশ্চয় পেতেন। কারণ ধান-চালের দর ১৮৭০ সালের পর থেকে এই আশী সাল পর্যন্ত টাকায় দু-তিন আনা বেড়ে গেছে। এবং রায়বাহাদুর যে বিরাট বাঁধ দিয়েছেন বন্যা রোধের জন্য, তাতে ফসলের উৎপাদন নিশ্চয় বাড়বে।

রায়বাহাদুর হুকুম দিয়েই উঠে গিয়েছিলেন নিজের আপিসঘরে। এ ঘরটা সেই ঘর সুলতা, যেটা থেকে সিন্দুক খুলে পুলিসের দল লাফ মেরে পালিয়ে এসেছিল কাঁকড়া বিছের ভয়ে এবং যে সিন্দুক থেকে পেয়েছিলাম পত্রের দপ্তর, এটা সেই ছোট ঘরখানা। এবং সেই চেয়ার, সেই টেবিল।

সেখানে বসে তিনি চিঠির জবাব লিখতে বসেছিলেন শ্বশুরকে। হঠাৎ কি মনে হয়েছিল, তাঁর খাস চাকরকে ডেকে বলেছিলেন—যা চিঠিখানা বড়বাবুকে দেখিয়ে নিয়ে আয়। বলবি, কর্তাবাবু পড়ে দেখতে বললেন। ইচ্ছে কি ছিল অনুমান করতে পারি, সম্ভবত উদ্ধত পুত্রকে তাঁর কীর্তিকলাপের এ দিকটা স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। চাকর ফিরে এল দেবেশ্বরের চিঠি নিয়ে।

দেবেশ্বর তখন প্রায় উন্মাদ। মদ খেয়েছেন। বিলিতী মদ তাঁর বাক্সে লুকানো ছিল, বের করে খেয়েছেন এবং যে কথা বাপের সামনে লিখে দিতে পারেননি, সেই কথা লিখে ওই চাকর মারফৎ পাঠিয়ে দিয়েছেন। বলেছেন—এইটে দিস বাবাকে। যখন একলা থাকবেন তখন। দস্তুরমত খামে বন্ধ করে পাঠিয়েছেন। সবিস্ময়ে চিঠিখানা খুলে রত্নেশ্বর রায় স্তম্ভিত হয়ে গেলেন আবার।

ছেলে লিখেছে—“আপনি ভাবিয়া দেখিতে বলিলেন। আমি এসব কথা অনেক দিন হইতে ভাবিতেছি। আজও আবার ভাবিলাম। আপনার মতামতের সহিত আমার মতামত কোন প্রকারেই মিলিতেছে না। ইহার জন্য অর্থাৎ আমি স্বাধীন মত পোষণ করি বলিয়া আমি আপনার অবাধ্য নহি। ইহার সহিত বাধ্যতা- অবাধ্যতার কোন সম্পর্ক নাই। আপনি যাহা বিশ্বাস করেন, আমি তাহা বিশ্বাস করি না। আমি অবাধ্য নহি, আমি আমার স্বাধীন মতে চলিব। আপনি মদ্যপান করেন না, আমি মদ্যপান করি, তাহাতে দোষ দেখি না। এদেশে ওদেশে বড় বড় লোকে মদ্যপান করিয়াছেন, করেন। আপনি করেন না; তাহাও ভাল। আপনি জীবনে মদ্যপান করেন নাই, তজ্জনিত যে অতৃপ্ত তৃষ্ণা তাহাও বোধহয় আমার অন্তরে রহিয়াছে। আপনি বাল্যজীবনে আমাকে কঠোর সংযম শিক্ষা দিতে সম্ভবতঃ অত্যন্ত দুঃখ দিয়াছেন। শাসন করিয়াছেন। তাহাই আমাকে আপনার পথ ও মতকে আমার নিকট নিষ্ঠুর এবং দুর্গম করিয়া তুলিয়াছে। আমার লালসাকে উগ্র হইতে উগ্রতর করিয়াছে। আমি অনেক চিন্তা করিয়াছি, অনেক পড়াশুনা করিয়াছি, ইয়োরোপের শ্রেষ্ঠ দার্শনিকদের দর্শন পড়িয়াছি। আপনি এক ভ্রান্ত অভিসম্পাতভীতি দ্বারা ভীত হইয়া নিজের জীবনকে পীড়িত করিয়াছেন, আমাদিগকে পীড়িত করিতেছেন। ইহা মিথ্যা, ইহা ভ্রান্তি, অলীক। পৃথিবীতে যাহারাই ভূমির স্বামীত্ব ভোগ করে, তাহারাই সেই ভূমির শ্রেষ্ঠ ফসল ও ফল ভোগ করে, তাহারাই সেই ভূমিশ্রেষ্ঠ রূপবতী নারীর অধিকার পাইয়া থাকে। রাজাদের নবাব বাদশাহের অন্দর ও হারেমভরা নারীকুল তাহার প্রমাণ। পৃথিবীর কোন সমাজ তাহা দমন করিতে পারে না। আমাদের দেশে আজ ইংরাজ এক বিবাহ করে এবং তাহারা শক্তিবলে এ অনাচার দমন করে বলিয়া কিছুটা দমিত হইয়াছে মাত্র। কোন শাস্ত্রের দোহাই দিয়া ভূম্যধিকারীর এই অধিকার বিলুপ্ত হয় নাই বা হইবে না। আর ওই শাস্ত্রবাক্য “পৃথিবীতে একটি পুরুষের সহিত একটি নারী ব্যতীত অপর সকলের সম্পর্ক মাতৃ-সম্পর্ক বা কন্যা-সম্পর্ক”—ইহা ভুল। ইহা নিতান্তই কাপুরুষের কথা। সংস্কারাচ্ছন্নের কথা। সমাজের দিকে চাহিলেই তাহা বুঝিতে পারিবেন। আপনি দৃষ্টান্ত দিয়া থাকেন মাতৃসাধকদের। ইঁহাদের সম্পর্কে কটু কথা বলিতে চাহি না, এই দেশের প্রতি সম্মান রাখিয়াই বলিতেছি যে, তাঁহারা শিশু হইয়া জন্মগ্রহণ করেন এবং যতই দীর্ঘজীবন হউক তাঁহাদের শিশুত্ব কখনও ঘোচে না, শিশু হইয়াই তাঁহারা মরেন। জন্ম হইতে মৃত্যু পর্যন্ত স্তন্যলালসা মেটে না। তাঁহারা সব নারীকেই মা ভাবিয়া থাকেন ভাবিতে পারেন আমি তাহা পারি না, তাহা পারিব না। ইহা হাস্যকর। ইহাকে সত্যই যদি অভ্রান্ত সত্য বলিয়া মনে করেন বা করিতে পারিতেন তবে নিজে বিবাহ না করিলেই পারিতেন। যদি করিলেন, তবে রায়বংশের শিশুদের শেষ সূতিকাগৃহে করিলেই মিটিয়া যাইত।

ওই ভাব আমার জন্য নহে। আমি পুরুষ। আমি জীবনে চলার পথে একক চলিতে পারিব না। বা একজনের সঙ্গে খুঁটে খুঁট বাঁধিয়া চলিতে পারিব না। আপনাদের শাস্ত্র পুরাতন অচল। এ যুগের মানুষ তাহা মানিতে পারিবে না।

শৃঙ্খল দিয়া বন্দী করিয়া রাখিতে চান রাখিতে পারেন, আমি শক্তি থাকিলে তাহা ছিন্ন করিব এবং সমস্ত কিছু পরিত্যাগ করিয়া চলিয়া যাইব।”

সুরেশ্বর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললে-সুলতা, দেবেশ্বর যেন উন্মাদ হয়ে উঠেছিলেন। কীর্তিহাটের সেবায় তাঁর সিংহের মত বাপের সঙ্গে লড়াই করে তাঁর দাবী আদায় করে নিয়ে তবে ছেড়েছিলেন। কিন্তু মুখের কথা হয় নি। সব হয়েছে চিঠিতে। তার মধ্যে কোনটা এক লাইনের চিঠি। শুধু লেখা—

Respected Sir-My answer to your letter-is no.

শেষ চিঠিখানাতে কয়েকটা লাইন আছে তা মারাত্মক। লাইন-কটা আমার মনে গাঁথা আছে। “আপনার উপলব্ধি আপনার নিজস্ব। তাহা আমার নিকট দুর্বোধ্য। তাহা বুঝিতে পারি না। একান্তভাবে অর্থহীন যদি শাস্ত্রবাক্য হয়, তবে সে শাস্ত্র ভীরুর শাস্ত্র। সে শাস্ত্র কুসংস্কারাচ্ছন্নের শাস্ত্র। পৃথিবীতে একমাত্র গর্ভধারিণী জননী এবং নিজের ঔরসজাত কন্যা ও সহোদরা এই তিনটি নারী ব্যতীত অপর সকল নারীর সহিত আমার বিচার পুরুষের একটি মাত্র সম্পর্ক, নারী তাহার কাছে নারী ছাড়া আর কিছু নহে। আপনি অনেক সাধকদের দৃষ্টান্ত দিয়াছেন; দক্ষিণেশ্বর গিয়া রামকৃষ্ণ নামক একজন সাধককে দেখিয়া আসিবার জন্য বলিয়াছেন। কিন্তু তাহার প্রয়োজন নাই। ইহা আমাদের দেশের এই সকল সাধকদের নিকট এবং সাধারণ মনুষ্যগণের নিকট হয়তো পরম সৌভাগ্যের বিষয়। আপনি ইহাকে তৃতীয় নয়ন দ্বারা মহাসত্য বলিয়াছেন, কিন্তু আমি তাঁহাদের প্রতি সম্মান রাখিয়াই বলিতেছি যে, তাঁহারা শিশু হইয়াই জন্মান ও চিরজীবন শিশুত্ব ঘুচে না, এবং একলা সূতিকাগৃহে শিশুমৃত্যুর মতই মৃত্যুবরণ করেন। আজীবনের মধ্যে ইঁহাদের স্তন্যলালসা আর মেটে না। কিন্তু আমি তাহা ভাবি না। আমার ধারণা এবং এই প্রকৃতির কারণ নির্দেশ করিয়াছেন, আপনার মাতামহের প্রতি দেবতার অভিশাপকে। তাহাও আমি মানি না। কারণ জন্মান্তর স্বর্গ নরক ইত্যাদি সবই আমার নিকট অলীক কল্পনা।”


© 2024 পুরনো বই