কীর্তিহাটের কড়চা – ৪র্থ খণ্ড – ৬

চুঁচড়ো থেকে ফিরে বাড়ী পৌঁছেই রত্নেশ্বর নিচের ওই হলঘরে থমকে দাঁড়িয়েছিলেন। প্রত্যাশা করেছিলেন, দেবেশ্বর সহাস্যমুখে তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়ে প্রণাম করবার জন্য দাঁড়িয়ে থাকবে বা কাঠের সিঁড়ির উপর, ম্যাটিংয়ে চটির দ্রুত শব্দ তুলে ছুটে নেমে আসবে।

গম্ভীর রাশভারী মানুষ রত্নেশ্বর রায়। রায়বংশের কাঠামো, তার উপর জীবনের প্রথম দিকটা কাশীর জল-হাওয়ায়, ঘিয়ে-ময়দায়, ল্যাংড়া আম, কাশীর পেয়ারা এবং বাদাম-পেস্তা খেয়ে আর কুস্তি করে, সাঁতার কেটে মজবুত হয়ে গড়ে উঠেছেন, চোখের চাউনিতে ছিল একটা তীক্ষ্ণ এবং অবজ্ঞার দৃষ্টি, অল্পেই কপালে সারি সারি কুঞ্চনরেখা দেখা দিত। তাঁর সামনে সহজে কেউ মুখ তুলে কথা বলতে পারত না। কিন্তু দেবেশ্বর প্রসন্ন হাসিমুখে তরুণকণ্ঠে উৎসাহের সুরে “বাবা” বলে ডাকলে রত্নেশ্বর আর এরকম হয়ে যেতেন। প্রণাম করতে করতে দুই হাতে তুলে ধরে বুকে জড়িয়ে ধরতেন। তারপর তার কাঁধে হাত দিয়ে কথা বলতে বলতে উপরে উঠে যেতেন এক প্রবীণ ও এক নবীন বন্ধুর মত।

সেদিন তিনি দাঁড়িয়েই রইলেন। দেবেশ্বরের চটির শব্দ উপরে বাজল না, এগিয়ে এল না। তিনি ডাকলেন-দেবু! দেবেশ্বর!

সাড়া মিলল না। এবার তাঁর মধ্য থেকে বেরিয়ে এল কীর্তিহাটের এস্টেটের জমিদার রত্নেশ্বর রায়, যে রত্নেশ্বর রায় ম্যাজিস্ট্রেটকে অ্যালিবি সাক্ষী রেখে দশ ক্রোশ দূরের রাধানগরের দে-সরকারের ঘর জ্বালিয়ে এসেছেন, দাঁড়িয়ে হুকুম দিয়ে দে-সরকারের হাত ভেঙে দিয়েছেন, যে রত্নেশ্বর রায়ের অভিষেকের উৎসবের সময় গোপাল সিংয়ের মত দুর্ধর্ষ দুর্দান্ত খুনে দাঙ্গাবাজকে একদিনে নাগপাশে বেঁধে এনে দাসখত লিখিয়েছেন, সেই জমিদার!

শুধু একটা ধমক। কাউকে উদ্দেশ করে নয়। সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন—কোথায় দেবেশ্বর?

নিস্তব্ধ নির্বাক হয়ে গিয়েছিল গোটা বাড়ীটা। একটা সূচ পড়লে শোনা যেত।

—কোথায় সে? তারপর দেবেশ্বরের খাস চাকরকে ধমক দিয়ে বলেছিলেন—এই শূয়ার কি বাচ্চা! শুনতে পাচ্ছিস নে?

সঙ্গে সঙ্গে দীর্ঘ পদক্ষেপে এগিয়ে এসে তার গালে ঠাস করে একটা চড় মেরে বলেছিলেন—কোথায় সে? এই হারামজাদা!

এরপর কথাটা প্রকাশ হতে কতক্ষণ লাগে? প্রকাশ হয়ে পড়েছিল—“বড়বাবু সন্ধ্যে হলেই চলে যান, যেখানে গোপাল থাকে সেখানে। ফেরেন সকালবেলা।”

চমকে উঠেছিলেন রত্নেশ্বর রায়। কিন্তু মুখ থেকে একটি কথাও বের হয়নি। হয়তো মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করে নিয়ে থাকবেন, গোপাল যেখানে থাকে, সেখানে? তাহলে? সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়েছিল ভায়লেটকে। তাহলে?

কত প্রশ্ন, কত ক্ষোভ, কত ক্রোধ এর সঙ্গে জেগেছিল তার প্রকাশ বাইরে কেউ কিছু দেখেনি। দেখতে পায় নি। এবং রত্নেশ্বর রায়ের ডায়রীতেও তার এতটুকু প্রকাশ নেই। তবে গোপন করেন নি ঘটনাটাকে।

রত্নেশ্বরের ১৮৭৮ সালের ডায়রীখানা নিয়ে সুরেশ্বর পড়লে-”বাড়ী পৌঁছিয়া দেবেশ্বরকে দেখিলাম না। সকলকে প্রশ্ন করিলাম। কেহ উত্তর দিল না। নতমুখে মাটির দিকে তাকাইয়া রহিল। আমার সন্দেহ হইল। এবার ধমক দিয়া জিজ্ঞাসা করিতেই শুনিলাম, এলিয়ট রোডে একখানি বাড়ী ভাড়া বা লিজ লইয়া সেখানেই দেবেশ্বর রাত্রিযাপন করে। গোপালও সেখানে থাকে। সুতরাং ভায়লেট! সে-ও সেখানে থাকে। বাড়ী ভাড়া করিবার সাধ্য গোপালের নাই। সুতরাং এ-কর্মের সকল দায় দেবেশ্বরের। তৎক্ষণাৎ আমি গৃহাভ্যন্তর হইতে বাহির হইয়া আসিয়া উচ্চকণ্ঠে হাঁকিলাম—ওসমান! গাড়ী লে আও জলদি! ওসমান! এবং বিক্ষুব্ধ অন্তর লইয়া সম্মুখের বারান্দায় পদচারণা করিতে লাগিলাম। গাড়ী আসিতেই তাহাতে আরোহণ করিয়া বলিলাম—ওসমান! ওসমান সেলাম করিয়া কহিল—জী হুজুর।

কিসকা নিমক তুম খাতে হো? হামারা?

—জরুর! হামারা বাপ আপনা বাপকে নিমক খায়া, হাম আপকে নিমক খাতা।

—হাঁ। নিমকহারাম যো হোতা হ্যায়—উসকা পর খুদা নারাজ হোতা হ্যায়, জিন্দীগি বরবাদ হো যাতা হ্যায়। কেয়া, বাত ঠিক হ্যায় কি, নেহি?—

—হাঁ হুজুর, ঠিক হ্যায়!

—বাস্, চলো, মুঝে, মেরা লড়কা তুমলোগোঁ কা বড়াবাবু, সামকো যাঁহা যাতা হ্যায়, হুঁয়া লে চলো। আর কোই আদমী উনকা হুঁয়া খবর না দে।—চলো!

এলিয়ট রোডের বাড়ীখানা অধিকাংশ ফিরিঙ্গীপাড়ার বাড়ীর মত একতলাই ছিল, কিন্তু দোতলায় একখানা প্রশস্ত ঘর দেবেশ্বর নিজে করে নিয়েছিলেন। হাজার হলেও জমিদারের ছেলে, নিতান্ত একতলায় খুব একটা সুলভ-প্রাপ্যতার মধ্যে থাকতে তাঁর মন চাইত না। নিচে একখানা ঘরে থাকত গোপাল। একখানা ঘরে থাকত ভায়লেটের সঙ্গে এসেছিল যে গোয়ানীজ মেয়েটি সে; আর বাকীগুলোয় কোনটা ছিল বিলিতী কায়দায় ড্রইংরুম, কোনটায় করেছিলেন লাইব্রেরী, সেখানে মাস্টার এসে ভায়লেটকে পড়াতো, লেডী করে তুলত।

রত্নেশ্বরের গাড়ী গিয়ে বাড়ীটার সম্মুখে দাঁড়াল। তিনি ফটকটা খুলে থমকে দাঁড়ালেন। অতর্কিতে ঢুকলেন না।

ডাকলেন—বেশ উচ্চকণ্ঠেই ডাকলেন—দেবেশ্বর!

উপরে হাসির শব্দ উঠছিল, বন্ধ হয়ে গেল। নিস্তব্ধ বাড়িখানা যেন ভয়ার্ত হয়ে গেছে। আবার রত্নেশ্বর ডাকলেন—দেবেশ্বর। এবং এবার গিয়ে সামনের দরজায় ধাক্কা দিলেন।

—দরজা খোল দেবেশ্বর!

উত্তর একটা এল। কিন্তু কথায় নয়। বন্দুকের শব্দে। একটা বন্দুকের শব্দ উঠল দোতলায়।

রত্নেশ্বর চমকে উঠলেন। ডাকলেন—ওসমান! ভাঙো, দরজা ভাঙো।

দরজা ভেঙে ঘরে ঢুকে ওসমানকেই বললেন—ওসমান, কোথায় দেবেশ্বর?

উপর থেকে তখন কাতর আর্ত চীৎকারে বুক ফাটিয়ে ভায়লেট ডাকছে—রাজাবাবু- আমার রাজাবাবু—

উপরের ঘরে এসে দরজার মুখে দাঁড়ালেন রত্নেশ্বর রায়। দেখলেন—দেবেশ্বর চিৎ হয়ে পড়ে আছে, রক্তের মধ্যে যেন ভাসছে। তার বুকের উপর পড়ে চীৎকার করে কাঁদছে ভায়লেট—রাজাবাবু- My darling—রাজাবাবু—My prince-রাজাবাবু।—

অন্নপূর্ণা-মা বললেন-দেবেশ্বর জানত, বাপ আসবেন দিনে। কিন্তু গাড়ী হাওড়া থেকে দিনের বেলা ফিরে এসেছিল। বাপ আসেননি, চুঁচড়ো গেছেন ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে—এই খবর পেয়েই দেবেশ্বর দারুণ খুশী হয়ে উঠেছিল। তৎক্ষণাৎ চলে গিয়েছিল এলিয়ট রোডের বাড়ী; সারাদিনরাত আজ ভায়লেটকে নিয়ে আনন্দ করবে। ভোর ভোর বাড়ী ফিরে এসে ভাল ছেলে সাজবে।

ভাল ছেলে সাজবার ইচ্ছে তার ছিল না। মিথ্যে কথায় তার শুধু অরুচিই ছিল না, ঘেন্না করত সে মিথ্যে কথা বলতে। সে কতবার বলেছে—মিথ্যে কথা বললে নিজের কাছে নিজের মান যায় রাঙাপিসী। যুধিষ্ঠির নাকি ধর্মপুত্র, তাঁর মা কুন্তীর গর্ভের ধর্মরাজের ঔরসে তাঁর জন্ম, সে সত্য গোপন ছিল না, তাই তাতে পাপ ছিল না; নিজে যুধিষ্ঠির সত্যবাদী ছিলেন বলে তাঁর রথ চলত বাতাসের উপর দিয়ে, মাটি থেকে কিছুটা ওপরে। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে গুরু দ্রোণকে বধ করবার জন্য তাঁকে দিয়ে বলাতে হল, অশ্বত্থামা মরেছে। মরেছিল অশ্বত্থামা হাতী। কৃষ্ণ বললে—’হাতী’ কথাটা বলে দরকার কি? বল অশ্বত্থামা মরেছে, তাতেই দ্রোণ শোকার্ত হবে। দুর্বল হবে। যুধিষ্ঠির বললেন-অশ্বত্থামা হত ইতি গজ। ইতি গজ শব্দ দুটি আস্তে বলেছিলেন বলে গোটা কথাটাই মিথ্যের সামিল হল। রথখানা তাঁর চিরদিনের জন্য মাটিতে নামল। কিন্তু বাবাকে এমন ভয় করে যে, সব গোলমাল হয়ে যায়। বাবার সকল কাজ আমার ভাল লাগে না। মনে হয়, বাবার মত নিষ্ঠুর অহঙ্কারী স্বার্থপর মানুষ আর নেই।

ওই ভয় করে এবং গোলমাল হয়ে যায় বলেই সে ভায়লেটকে বিয়ে করে ক্রীশ্চান হবে এবং ব্যবসা করে বড় হবে সংকল্প করে আমাকে চিঠি লিখেছিল টাকার জন্য। নিজের আংটি বোতাম, হীরে-নীলা বেচে যে টাকা পেয়েছিল, সে টাকাটায় বাড়ী কিনে আর সারিয়ে খরচ করে ফেলে আপসোস হয়েছিল। এত খরচ না করলেই হত। কিন্তু যে দেবেশ্বর কীর্তিহাটের রায়দের উন্নতির চরম সময়ে জন্মেছে এবং রাজা-রাজড়ার ছেলেদের মত মানুষ হয়েছে, সে প্রথম প্রেম করে যে ঘর বাঁধবে, তাতে টাকা খরচ না করে পারে! পারেনি। খরচ করেছিল। এবং খরচ করে তখন ব্যস্ত হয়েছিল টাকার জন্য, টাকা নিয়ে সে ব্যবসা করবে। ব্যবসা সে জানত না কিন্তু সাহস তার ছিল।

যাক ওসব কথা, সে আমল বোঝা কঠিন তোদের পক্ষে। তখন ছড়া ছিল—হট্টমালার দেশের ছড়া। হীরে-পোড়ানো মাজনে দাঁত ঘষত, মুক্তো-পোড়ানো চুনে পান খেতো; দুধে তারা আঁচাতো। হীরের মাজনটা অতিরঞ্জন কিন্তু বাকীগুলো সব সত্যি। রায়বাড়িতে জামাই হোক আর বউ হোক—প্রথম খেতো সোনার থালায়। আর আঁচাবার সময় গাড়ুতে যে জল দেওয়া হত, তাতে অর্ধেকটা দুধ মেশানো থাকত। এই অর্চনার বিয়েতে রথীনকে আঁচাতে জল দেওয়া হয়েছিল, তাতেও দু-ঝিনুক দুধ মিশিয়ে দেওয়া হয়েছিল। রায়বাড়ীর সে-সম্পদ কল্পনা করতে পারবিনে রে। আমার বিয়ে হয়েছিল দশ পার হয়ে এগার বছরে। তখন কীর্তিহাটের লক্ষ্মীর ঘরে বড় বড় লোহার সিন্দুক মেঝেতে গাঁথা ছিল। সেগুলো ভর্তি ছিল টাকা-সোনাদানায়। তাছাড়া কলকাতার ব্যাঙ্কে ছিল। কোম্পানীর কাগজে ছিল। বউবাজারের বড়ালদের একচেটে ছিল কোম্পানীর কাগজ কেনাবেচার ব্যবসা; রায়বাড়ীর জন্যে বছর বছর কোম্পানীর কাগজ আলাদা করে রেখে দিত তারা। তারা জানতই যে, এ কাগজ তারা কিনবে।

সেই বংশের বড় ছেলে, কলকাতার সেকালের সমাজে বড় হচ্ছে, মেলামেশা করছে। শুধু তাই নয়, তার মধ্যে একটা সেকালের আগুন ছিল রে। ভায়লেটের সঙ্গে প্রেম করে সে দুঃখিত হয়নি, লজ্জিতও হয়নি, হয়তো সেদিন এমন হঠাৎ রাত্রিকালে তার বাঘের মত বাবা যদি না হাজির হতেন, তবে সে হয়তো ভেবেচিন্তে একটা বোঝা-পড়া করতে চেষ্টা করত। কিন্তু সে প্রত্যাশা করেনি যে, তার বাবা রত্নেশ্বর রায় এসে এমনভাবে নিজে হাজির হবেন। বাবার গলার আওয়াজ পেয়ে সে চমকে উঠেছিল, ভায়লেট হাসছিল খিল-খিল করে, সে হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরে বলেছিল—চুপ!

ভায়লেট তার দিকে তাকিয়েছিল সভয় বিস্ময়ে। কি হল?

ঠিক সেই মুহূর্তে গোপালদা ছুটে এসে বলেছিল—রাজাভাই, সর্বনাশ হয়েছে। কর্তাবাবু!

আবার ডাক ভেসে এসেছিল- দেবেশ্বর!

এবার গোপাল দুড়দুড় করে নেমে পালাবার সময় বলেছিল- পালিয়ে এস খিড়কীর দরজা দিয়ে।

—ওই মেথর ঢোকে যেদিক দিয়ে?

—নইলে আর পথ নেই।

—তুই যা। তুই পালা। ওই পথ দিয়ে আমি পালাতে পারব না।

—তাহলে? কি করবে?

—আমার যা হয় হবে। তোকে ভাবতে হবে না।

—ভায়লা-?

ভায়লেট উত্তর দেয়নি, দেবেশ্বরকে আঁকড়ে ধরে দাঁড়িয়ে ছিল। দেবেশ্বর বলেছিলেন—আমি বাঁচলে ও বাঁচবে। আমি যদি মরি, তবে যা হয় হবে। ওদিকে তখন নীচে দরজায় জোরে জোরে ধাক্কা পড়ছে। ভেঙে ফেলবে দরজা।

দেবেশ্বরেরও চারিদিক বন্ধ, রত্নেশ্বরের হুকুম শুনতে পাচ্ছেন তিনি—ভেঙে ফেল। তোড় দো। ওদিকের দরজা আটক কর। কোনদিকে পরিত্রাণের কোন পথ নবীন দেবেশ্বরের চোখে পড়েনি, শুধু পড়েছিল বন্দুকটা। একনলা ব্রিজ লোডিং গান্ একটা—দেবেশ্বর নিজের জন্য লাইসেন্স করিয়ে কিনেছিলেন; সেই বন্দুকটাও ওই বাড়ীতেই তিনি রেখেছিলেন। কোন বিপদের ভয় করে রেখেছিলেন—এটা ঠিক নয়, তবে দেবেশ্বর রায় যে বাড়ীতে তাঁর প্রথম প্রিয়াকে নিয়ে বাস করবেন, সে-বাড়ীর দরজায় সঙ্গীনদারী পাহারাদার থাকবে না এটা তাঁর ঠিক ভাল লাগেনি। তিনি সঙ্গীনওলা বন্দুক এবং তার সঙ্গে পাহারাদারের লাইসেন্সের চেষ্টা করছিলেন গোপনে। সেটা না হওয়া পর্যন্ত নিজের অতিপ্রিয় এই একনলা বন্দুকটিকে ভায়লেটের শোবার ঘরের কোণে খাড়া করে রেখেছিলেন।

গোপাল চলে যেতেই দেবেশ্বর একবার চারিদিক তাকিয়ে দেখে দেখতে পেয়েছিলেন এই বন্দুকটাকে। তিনি ছুটে গিয়ে বন্দুকটা তুলে নিয়ে তাতে টোটা পুরে শোবার ঘরের দরজা পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েছিলেন।

তাঁর চিঠিতে আছে—”আত্মহত্যা করিবার জন্য সেদিন বন্দুক আমি তুলি নাই। অপমানের হাত হইতে বাঁচিবার জন্যই বন্দুকে টোটা পুরিয়া আমি নিচে নামিয়া যাইতেছিলাম। ইচ্ছা ছিল যে বেতনভোগী ভৃত্যদিগের পাশবিক বলের উপর নির্ভর করিয়া আপনি আমার বাড়ীতে আমাকে অপমান করিতে আসিয়াছলেন, তাহাদিগের সহিত আমি বুঝাপড়া করিব। আমার দারোয়ান নাই, আপনার আছে, আমি একনলা বন্দুক হাতেই তাহাদিগকে ঠেকাইয়া বলিব—চলিয়া যাও। কিন্তু ভায়লা ভয় খাইল। সে পিছন হইতে জড়াইয়া ধরিল। বলিল-আমার রাজাবাবু, না-না-না, এমন তুমি করিও না। না। তাহাকে তখন জিজ্ঞাসা করিলাম-তবে কি করিব? তুই বল–কি করিব? সে উত্তর দিতে পারে নাই। আমার একটা কথা মনে হইল, বলিলাম—তবে আয় আমরা দুইজনেই মরি। আমি তোকে গুলী করিয়া মারিয়া নিজে আত্মহত্যা করিব। কিন্তু সে তাহাতে আরও ভয় পাইয়াছিল। তখন আমার আর আপসোসের সীমা ছিল না। এ কাহাকে আমার জীবনসঙ্গিনী করিয়াছি? এখন মনের মধ্যে আগুন আরও প্রবলভাবে জ্বলিয়া উঠিল। বলিলাম—বেশ, তবে তুই থাক। আমিই মরিব। ইহার পর আর বাবার সম্মুখে মুখ তুলিয়া দাঁড়াইতে পারিব না। সঙ্গে সঙ্গে বন্দুকটা থুনীর নিচে লাগাইয়া বাঁটা মাটিতে রাখিবার চেষ্টা করিলাম কিন্তু দেখিলাম বন্দুকটা আমার থুনী অপেক্ষা ছোট; ওদিকে দরজাটা ভাঙিয়া পড়িল বলিয়া মনে হইল, সঙ্গে সঙ্গে আমি বন্দুকের নলটাকে বুকে লাগাইয়া পা দিয়া ঘোড়াটা টিপিয়া দিলাম। তাহার পর আর জ্ঞান ছিল না। কিন্তু আজ আবার বাঁচিয়া উঠিয়া মনে হইতেছে—গলায় লাগাইলাম না কেন! তাহা হইলে বাঁচিয়া থাকিয়া আপনি জন্মদাতা পিতা আপনার সহিত পত্রে এই ঘটনা লইয়া আলোচনা করিতে হইত না। আপনি আমাকে একরূপ বন্দী করিয়া রাখিয়াছেন। ভায়লেটের কি হইয়াছে, তাহাকে লইয়া আপনি কি করিয়াছেন, তাহা আমাকে জানাইবার জন্য আপনার নিকট মিনতি করিতেছি। গোপালদাদা কোথায়? তাহার কি করিলেন? আপনি এইসব সংবাদ আমাকে জ্ঞাত করুন। অন্যথায় আমি আর মরিবার চেষ্টা করিব না। এবার আমি বিদ্রোহ করিব। এই বাটী হইতে বাহির হইয়া গিয়া ক্রীশ্চান মিশনারীদের শরণাপন্ন হইব। সেখান হইতে রক্ষা করিতে আপনি আমাকে পারিবেন না।”

সুরেশ্বর বললে—অন্নপূর্ণা-মা বললেন—চিঠিখানা পুরো এক মাস এক সপ্তাহ পর, যেদিন ব্যান্ডেজ খুলে দিলে সাহেব ডাক্তার—সেইদিন সে বিছানায় শুয়ে শুয়ে চিঠিখানা লিখছিল, আমি ঘরে ঢুকলাম। বললাম—এ কি! সকালে ব্যান্ডেজ কেটেছে বিকেলে চিঠি লিখছিস। কাকে চিঠি লিখছিস দেবু?

আমরা কাশী থেকে এসেছিলাম সেই ঘটনা যেদিন ঘটে সেইদিন, রাত্রে খবর পেয়ে। জোড়াসাঁকোর জ্যেঠামশাইয়ের বাড়ী থেকে জানবাজারের বাড়ীতে এসেছিলাম। সাহেব ডাক্তার দেখে বললে বটে—জখম এমন কিছু নয় রায়বাবু, শুধু বগলের নীচে খানিকটা মাংস কেটে বেরিয়ে গেছে, সারতে বেশীদিন লাগবে না। তবুও যত্ন আর সাবধানতার অন্ত ছিল না। কীর্তিহাট থেকে সরস্বতীবউ এসেছিলেন; সেবার জন্যে তখন মেম-নার্স পাওয়া যেত, মেম-নার্স এসেছিল। একজন দেশী ডাক্তার চব্বিশ ঘণ্টাই বাড়ীতে থাকত। আমি কাশী চলে যেতে পারিনি। দেবুর ওই অবস্থায় যার জন্যে এসেছিলাম, একটা বিষয়ের মিটমাটের জন্যে তাও হয়নি, আর দেবুর জন্যে যে-মেয়েটির বিয়ের কথা পাকা করতে চেয়েছিলাম তাও হয়নি। আর আমি কাছে থাকলেই দেবু স্বস্তিতে থাকত, শান্তিতে থাকত। উঠে গেলেই চাকর-ঝি যাকে সামনে পেত বলত, রাঙাপিসীকে ডেকে দে।

আমার বদলে বউদি—সরস্বতী-বউ গেলে চোখ বুজে চুপ করে পড়ে থাকত। কথা বলত না।

বউদি বিরক্ত হতেন। বেরিয়ে এসে আমাকে বলতেন—তুই যা অন্নপূর্ণা, আমাকে দেখে মুখ গোঁজ করে চোখ বুজল।

আমি গিয়ে বসে ডাকতাম-দেবু! দেবু রে!

বোজা চোখ অমনি খুলে যেত, বলত—কোথা গিয়েছিলে?

—কেন? কি হল? শুয়ে ঘুমো না।

—তোমার পায়ে পড়ি রাঙাপিসী, তুমি খবর এনে দাও ভায়লেটের কি হল? সে কোথায়? আমি বিশ্বাস করি না, আমি বিশ্বাস করি না। He can do anything and everything.

—কি বলছিস?

—ঠিক বলছি। তোমার সঙ্গে সম্পত্তি নিয়ে কি করছেন দেখছ না? ন্যায়তঃ ধর্মতঃ সম্পত্তি তোমার। বীরেশ্বর রায়ের ঔরসে ভবানী দেবীর গর্ভে তুমি জন্মেছ; উনি সোমেশ্বর রায়ের দৌহিত্র, তাঁকে বীরেশ্বর রায় সন্তান হবে না বলে পোষ্যপুত্র নিয়েছিলেন এবং সম্পত্তি দানপত্র করে দিয়েছিলেন বলে সে-সম্পত্তি তিনি তোমাকে দেবেন না। আমি গল্প শুনেছি—প্রথম যৌবনে ওঁর বিয়েরও আগে ম্যাজিস্ট্রেট পুলিস সাহেবকে কীর্তিহাটের বাড়ীতে ইস্কুলের ফাউন্ডেশন স্টোন পাতবার জন্যে এনে রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার সময় নকল অসুখের ভান করে দশ ক্রোশ দূরে রাধানগরে দে সরকারদের বাড়ী পুড়িয়ে দিয়ে এসেছিলেন। গোপাল সিং নামে এক ছত্রি প্রজাকে এনে নিষ্ঠুরভাবে শাসন করেছিলেন—

অন্নপূর্ণা-মা বললেন—কথাগুলো আমার কানেও কটু ঠেকছিল রে। আমি তাকে বাধা দিয়ে বললাম, না, তুই জানিসনে ঠিক। সে-সব আমার বাবার আমলের কথা, বীরেশ্বর রায়ের আমলের।

—তাও জানি। তাতেও আমার বাবা অংশীদার! তারপরের কথা তুমি জান না রাঙাপিসী। বিয়ে হয়েছে এগার বছর বয়সে, প্রথম কেটেছে তোমার কাশীতে বিমলাকান্ত ঠাকুর্দার কাছে; আমি এখানে কীর্তিহাটে কলকাতায় আছি, দিনরাত্রি শুনছি, দেশের ধন্যপুরুষ রত্নেশ্বর রায়ের সুনামের কথা, খ্যাতির কথা আর চোখে দেখছি তাঁর আসল চেহারা। আমার দাদামশায় Retired Subdivisional Officer—সিগার মুখে দিয়ে আসেন, তিনি উপদেশ দিয়ে যান, কি ভাবে কি করা উচিত। কিসে সুনাম হবে। I know them, I know them. আমি বলতে পারব না—এ case-এ তিনি কি পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু দিয়েছেন-তা নিশ্চিত। একটা অনাথা ক্রীশ্চান মেয়ে যার তিনকুলে কেউ নেই, তাকে কিছু করা কি অসম্ভব?

দেবুর কথাটা আমার খুব বাড়াবাড়ি মনে হতো না সুরেশ্বর। সে-আমলে কি এমন কঠিন কাজ। রবিনসন সাহেবের মত একজন ইউরোপীয়ানের বাচ্চাকে খুন করাতে যারা পারে, তার জন্যে যারা আসর সাজিয়ে দেয়; থানার দারোগাদের টাকা ঢেলে দিয়ে মুখ বন্ধ করতে পারে, তাদের কাছে এটা কি একটা শক্ত কাজ?

আলফানসো মরেছে, অঞ্জনা মরেছে, তার বেটী, সে রত্নেশ্বর রায়ের ছেলের মন ভুলিয়েছে, জাতি-ধর্ম তার যৌবনে রূপের জোয়ারে ভাসিয়ে দিয়েছে—সেখানে মেয়েটাকে—

আমি শিউরে উঠতাম। খোঁজ করবার চেষ্টা করলাম অনেক-অনেককে দিয়ে, কিন্তু আশ্চর্য কাণ্ড সুরেশ্বর, জানবাজারের চাকর-বাকর, মানুষজনের পেটের মধ্যে এই কথাগুলো যেন কোথায় হারিয়ে গেছে, তারা স্মরণ করতে পারে না; ভায়লেট বলে কাউকে জানে না—নাম কখনও শোনেনি, এমনি তাদের চাউনি, এমনি তাদের মুখের ভাব।

যেন ঠোঁটদুটো সেলাই করে দিয়েছে।

সেদিন চিঠিখানা লিখছিল, লেখা প্রায় শেষ করে এনেছিল, সে চিঠিখানা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললে—প’ড়ে দেখ!

প’ড়ে শিউরে উঠে বললাম-এই চিঠি তুই দাদাকে দিবি?

—না দিয়ে কি করব পিসী? আমার জন্যে যদি বাবা ভায়লেটকে কি গোপালদাকে চিরদিনের জন্যে সরিয়ে দিয়ে থাকেন, তবে হয়।

থেমে গেল দেবেশ্বর। তারপর সামলে নিয়ে বললে-আবার আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে। এবার আর কেউ আমাকে বাঁচাতে পারবে না। এবার আর ভুল হবে না।

ঠিক এই সময়ে সুরেশ্বর, হঠাৎ পাশের ঘরে গলা ঝেড়ে পরিষ্কার করার শব্দ শুনে আমি চমকে উঠলাম, দেবেশ্বরের মুখখানা যেন শ্বেতপাথরের তৈরী মুখের মত হয়ে গেল।

দাদার গলা। দাদা যে পাশের ঘরে কখন ঢুকেছিলেন, আমরা কেউ দেখিনি, আর বুঝতে ও পারিনি।

সুরেশ্বর বলল—একটু পরিষ্কার করে বলি সুলতা, দোতলার মাঝখানে যে ঘরখানায় বাবার আমলে ড্রয়িংরুম ছিল, যে ঘরখানার আমার ছবির প্রথম একজিবিশন হয়েছিল, যে ঘরখানায় বীরেশ্বর রায় থাকতেন তাঁর অসুখের সময় সেই ঘরে রাখা হয়েছিল দেবেশ্বর রায়কে আর তার পাশের যে ঘরটা ওদিকে অন্দরের সঙ্গে যুক্ত, যে ঘরে আমার মা মারা গিছলেন, যে ঘরে ভবানী দেবী বসে পুজো করতেন, যে ঘরে বসে রত্নেশ্বর রায় বীরেশ্বর রায়কে লেখা ভবানী দেবীর পত্র এবং তাঁর পালক পিতার পত্র পড়ে আত্মপরিচয় জেনেছিলেন- জেনেছিলেন, তিনি বিমলাকান্তের এবং বিমলা দেবীর সন্তান নন- তিনি বীরেশ্বর রায় এবং ভবানী দেবীর পুত্র, এ ঘর সেই ঘর। ভবানী দেবীর পুজোর ঘরই জানবাজারের বাড়ীর লক্ষ্মীর ঘর। ঘরখানার নামই ছিল লক্ষ্মীর ঘর। ওঘরে দেওয়ালে এখনও লোহার সিন্দুক পোঁতা আছে। সে আমলে এই ঘরেই আরও কয়েকটা লোহার সিন্দুক ছিল, তাতে এখানকার লগ্নী-ব্যবসার কাগজপত্র, কোম্পানীর কাগজ থাকে-থাকে সাজানো থাকত। রত্নেশ্বর রায় নতুন কোম্পানীর কাগজ কিনে সিন্দুকে তুলে রাখতে এসেছিলেন।

একশো বছর নয়, তবে পঁচাত্তর বছর আগে, এসব কাজ অর্থাৎ সিন্দুক খোলা, টাকা, সোনাদানা, মোহর, জহরত নাড়াচাড়া করার সময় লোকে অনেকটা সন্তর্পণেই করত। ব্যাঙ্ক তখন হয়েছে, তবুও মোহর কিনে কলসীবন্দী করে জমা করা আর কোম্পানীর কাগজ কিনে রাখার চলই ছিল বেশী।

অন্নপূর্ণা-মা বললেন—দাদা এখানকার নায়েবকে সঙ্গে নিয়ে বিশ্বাসী দারোয়ানকে দরজায় রেখে অন্দরের দিকের দরজা খুলে ঘরে ঢুকেছিলেন। এবং কোম্পানীর কাগজ সিন্দুকে রেখে, সিন্দুক বন্ধ করার সময় এঘরে দেবু যে সব কথা আমাকে বলছিল তা সব শুনেছিলেন। শুধু কিছুক্ষণ শুনেই নায়েবকে বলেছিলেন—তুমি নিচে যাও।

নায়েব নিচে নেমে গেলে তিনি দাঁড়িয়ে দেবুর কথা শুনতে শুনতে আর সহ্য করতে পারেননি, শব্দ করে গলা ঝেড়ে একটা সাড়া দেওয়া অভ্যেস তাঁর ছিল, ঠিক সেই শব্দ করে সাড়া দিয়ে দারোয়ান বচ্চন সিংকে ডেকে বলেছিলেন—“বচ্চন, এই দরওয়াজাটা খোল তো!”

ভারী দরজা, মোটা লোহার খিল, তার সঙ্গে হুক, খোলা সহজ নয়। বচ্চন সিং ছিল পালোয়ান, সে অল্পক্ষণেই খুলে ফেলে দরজাটা খুলে দিয়ে পাল্লাদুটো ঠেলে দিলে, আর দাদা বেরিয়ে এসে এ-ঘরে ঢুকলেন।

সুরেশ্বর, সে-মূর্তি এখনও মনে পড়ছে আমার। পরনে গরদের ধুতি, গায়ে গরদের চাদর। হাতে লোহার সিন্দুকের চাবির থোলো, পা খালি। লক্ষ্মীর ঘরে ঢুকেছিলেন বলে এই বেশ আর খালি পা। চোখ মুখ দেখে কিছু বুঝতে পারা যায় না, শুধু রায়বংশের সোনার মত যে গায়ের রঙ, তাতে যেন খানিকটা সিন্দূর লেগেছে বলে মনে হল।

এসেই প্রথমে নার্সকে বললেন—তুমি একটু বাইরে যাবে?

নার্স বাইরে যেতেই দাদা বললেন—যে-সব কথা তুমি বলেছিলে তোমার রাঙাপিসীকে, তা অন্তত এই নার্সটার সামনে বলা উচিত হয়নি। পিতৃনিন্দা সত্য হলেও করতে নেই। তবুও যদিই কর, তবে বাইরের লোকেদের সামনে করাটা ঠিক নয়।

আর লুকিয়ে কারুর কথা শোনা উচিতও নয়, সে অভ্যাসও আমার নেই, কিন্তু আজ অকস্মাৎ হয়ে গেল, শুনে ফেললাম; সাড়া দিতে ভুলে গেলাম। অনেকক্ষণ পর্যন্ত কথা বলবার মত ঠিক অবস্থা ছিল না আমার।

থাক্ সে কথা। এ আমার ভাগ্য। আমি রায়বংশের ধারাকে নির্মল করবার জন্যে, অভিশাপের ধারা থেকে বাঁচাবার জন্যে যে চেষ্টা করেছি সে মিথ্যে হয়ে গেছে। সে সব কথা থাক। এখন যা জানবার জন্যে ব্যগ্র হয়েছ তাই বলি। এ বাড়ীর কোন লোককে আমি বিশেষ কিছু জানতে দিইনি। ভায়লেটকে তুমি ভালবেসেছ, তাকে তুমি আমার চোখে ধুলো দিয়ে কীর্তিহাট থেকে নিয়ে এসে এখানে রেখেছিলে, সেখানে গুজব রটেছিল গোপালের নামে। আমি খুব ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম। গোপাল যদি ঠাকুরদাসের ছেলে না হত, তবে তার ঘাড়ে মাথা থাকত না। ভায়লেট আলফাসোর কন্যাই শুধু নয়, সে অঞ্জনার মেয়ে। অঞ্জনার কাছে তার মৃত্যুশয্যায় আমি প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম—।

অপূর্ণা-মা বললেন—দাদা চুপ করে গেলেন। দাঁতে দাঁত টিপে দাঁড়িয়ে রইলেন। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ল দুটি ধারায়। কিছুক্ষণ পর অজগরের মত একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললেন-শোনো, ভায়লেটকে আমি খুন করাইনি, গোপালকে আমি কোন শাস্তি দিইনি। তবু রায়বংশের জাত আর মানটাকে আমাকে বাঁচাতে হবে, তাই অপবাদ গোপালের নামে রয়েছে—রয়েছে। তাকে আমি লোক পাঠিয়ে এইটুকু শুধু বলেছি যে, সে যেন কীর্তিহাট কি শ্যামনগর আর না যায়। তাকে বলেছি, আমি তাকে পাঁচ হাজার টাকা দেব, সে এখানে ব্যবসা করুক, বিয়ে করুক। আরও টাকার প্রয়োজন হয় তাকে আমি দেব। সে ঠাকুরদাসের ছেলে, সে তোমার অপরাধ রায়বংশের কলঙ্ক মাথায় নিয়েছে। তার অঙ্গ কেউ স্পর্শ করতে পারবে না। তবে তোমার সঙ্গে আর তার সম্পর্ক থাকবে না।

আর ভায়লেট! ভায়লেট অন্তর্বত্নী—।

বুঝতে পারলে না? অন্তর্বত্নীর অর্থ? অন্তসত্ত্বা। সন্তান হবে তার। তাকে এক মিশনের নিরাপদ আশ্রয়ে আমি রেখেছি। তার যাবতীয় খরচ আমি বহন করব। তোমার বাপকে তুমি বিশ্বাস কর। অন্ততঃ এই কথাটা বিশ্বাস কর। তবে —।

একটু থেমে গম্ভীর গলা আরও গম্ভীর করে তুলে বললেন—তবে তোমার বিবাহ দেব আমি দু-এক মাসের মধ্যেই। বিবাহ তোমাকে করতেই হবে। তার জন্য তুমি প্রস্তুত থেকো। বলে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেলেন। নিজেই দরজা বন্ধ করে দিলেন। খিল হুক বন্ধ হল একে একে।

অন্নপূর্ণা-মা বলেছিলেন-সুরেশ্বর, তোকে বলব কি, আমরা—মানে আমি আর দেবু দুজনেই যেন বোবা হয়ে গিয়েছিলাম। ওই ক’টা কথা রে, তার যে কি ভার আর ওই যে আস্তে গলায় বলা, তার শব্দ যেন আমাদের শুধু বোবা না, কালা সুদ্ধ করে দিলে।

দরজাটা বন্ধ হতে হতে আবার খুলল, আবার। দাদা বললেন—ভায়লেটকে আমি নিরাপদে রেখেছি, তার সন্তান হলে তার ভারও আমি বয়ে যাব। তোমার পাপ–আমি ক্ষমা কোনমতেই করতাম না; করলাম তার কারণ এ পাপ তোমার নয়, এ পাপ রায়বংশে জন্মেছ বলে তার ভাগী হতে বাধ্য হয়েছ; রায়বাড়ীর আশেপাশে সে কেঁদে কেঁদে বেড়িয়েছে, দরজায় ধাক্কা দিয়ে বেড়িয়েছে। দরজা খোলো-দরজা খোলো। কিন্তু আমি সারাজীবন জেগে থেকে ঢুকতে দিইনি। তুমি জানতে না–অসতর্ক মুহূর্তে সে তোমাকে আশ্রয় চেয়েছে, তুমি ধনীর ছেলে মানীর ছেলে ভূস্বামীর ছেলে, তাকে আশ্রয় দিয়েছ। দিয়ে ফেলেছ। জানতে না। শ্যামাকান্তের অপরাধ—যোগভ্রষ্টতার শাস্তি, সোমেশ্বর রায়ের-বীরেশ্বর রায়ের ধারা আমি রুখতে গিয়েও পারলাম না। অঞ্জনার রূপ ধরে বাড়ী এসে ঢুকেছিল বুঝতে পারিনি।

বলেই চুপ করে গেলেন। দরদর করে চোখ থেকে জল গড়াল। একফোঁটা দু’ফোঁটা নয় রে—ধারা বয়ে গেল। এরই মধ্যে কখন যে সরস্বতী-বউ এসে ঘরে ঢুকেছিলেন, আমরা কেউ জানতে পারিনি; তিনি দরজার মুখে দাঁড়িয়েছিলেন বারান্দা আগলে; পাছে সেখানে দাঁড়িয়ে কেউ এসব কথা শুনে ফেলে।

হঠাৎ দরজাটা বন্ধ করে তিনি যখন ঘরে এসে ঢুকলেন, তখন আমাদের খেয়াল হল। তিনি এসে স্বামীর হাত ধরে বললেন—করছ কি? এসব হচ্ছে কি বল তো? যা হয়েছে তা হয়েছে, ভাগ্যকে ধন্যবাদ দাও যে ছেলেটা বেঁচেছে। বাবা এসেছিলেন, তিনি ফিরে চলে গেলেন, বলে গেলেন—ওবেলা আসবেন। এর মধ্যে আসতে চাইলেন না। বললেন—জমিদারবাড়ীতে রাজাদের বাড়ীতে যে সব কাণ্ড ঘটে, তার তুলনায় এটা আর কি এমন একটা ব্যাপার।—শুধু তোমার জন্যে বললেন—এতখানি কড়াকড়ি ভাল নয়; ও একটু কড়া বেশী। ছেলেটা এত ভয় পেয়েছিল যে সুইসাইড করতে গেছল। চল—মুখ-হাত ধুয়ে শরবৎ খাবে চল।

দাদা যেন এতক্ষণে সম্বিৎ ফিরে পেলেন। সরস্বতী বউয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে চলে গেলেন—ওই লক্ষ্মীর ঘরের ভিতর দিয়েই। দরজা বন্ধ করলেন। এদিক থেকে দারোয়ান এসে ঠেলে দেখলে।

আমরা চুপ করে বসে রইলাম।

আমি দাদার কথা শুনে কেঁদে ফেলেছিলাম। চোখ মুছে দেবুর মুখের দিকে তাকালাম।

—অবাক হয়ে গেলাম সুরেশ্বর। দেখলাম —দেবেশ্বর গুম্ হয়ে যেন বসে আছে। দাদার মত এমন একজন কড়া মানুষ, যার মুখের দিকে প্রজারা তাকাতে পারত না, তার চোখের জল তাকে যেন এতটুকু ভেজাতে পারেনি। কালা-বোবা সে আমারই মত হয়েছিল কিন্তু সে আমার মত গলেনি।

আমি তাকে ডাকলাম—দেবু!

সে নড়লে না, যেমন বসেছিল তেমনি বসে রইল, যেদিকে তাকিয়েছিল সেইদিকেই তেমনিভাবে তাকিয়ে রইল—শুধু বললে-বল রাঙাপিসী!

তার সেদিনের সেই লেখা চিঠিখানা টেনে নিলাম, সে আপত্তি করলে না; বললাম—এটা ছিঁড়ে দে। ক্ষমা চেয়ে একখানা চিঠি লেখ।

—না।

—না? অবাক হয়ে গেলাম আমি।

—না।

—এরকম চিঠি তুই লিখতে পারবিনে।

—তা লিখব না। যা উত্তর চাচ্ছিলাম—তা পেয়ে গেছি। ভায়লেটকে উনি যখন ভাল জায়গায় রেখেছেন, বলেছেন—আর গোপালদার সম্বন্ধে যা করব বলেছেন, তাতে আমি অবিশ্বাস করব না। তা উনি করবেন। অন্ততঃ লোক দেখিয়েও করবেন। কিন্তু ক্ষমা আমি চাইব না।

আমি চুপ করে রইলাম। দেবু বললে—শুনেছ? এই অবস্থার মধ্যেও বাবা আমার কনে ঠিক করেছে? একটি দশ বছরের খুকী।

—তুই কি বিশ-তিরিশ বছরের বুড়ো? তোর কনে দশ বছরের ছাড়া ক’ বছরের হবে? ও মেয়েকে আমি জানি।

—জান? মেয়েটি ভাল তো? মানে, সইতে পারবে তো আমার মত মানুষকে?

—কেন রে? তুই এমন মন্দ মানুষ কি মস্ত মানুষ এ-কথা তোকে বললে কে?

—নিজেই বলছি। আমাকে বিয়ে যে করবে, সে হয় আমার ভালবাসায় জ্বলে মরবে রাঙাপিসী, আমার ভালবাসার উত্তাপ আগুনের মত। নইলে আমার অবহেলায় ফেলে দেওয়া অপছন্দ পোশাকের মত এককোণে পড়ে থাকবে। ধুলোয় পোকা-মাকড়ে ভরে যাবে।

সুরেশ্বর, আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করেছিলাম—দেবু, এরকম কথাবার্তা তোর হল কি করে রে? কি করে শিখলি?

—তা জানিনে পিসী, তবে শিখেছি। আপনি কথাবার্তা আসে। ভেতর থেকে যেন কে যুগিয়ে দেয়। সে-কথা থাক। যা বলছি শোন, তুমি বিয়ের সম্বন্ধ করেছ, বিয়ে আমি করব। ভালও তাকে বাসতে চেষ্টা করব। ভায়লেটের উপর আমার আকর্ষণ আর নেই। সেদিন ওকে বলেছিলাম—দাঁড়া, তোকে গুলী করি, তারপর নিজে গুলী খেয়ে আত্মহত্যা করব। দুজনে একসঙ্গে মরব, দুঃখ থাকবে না। তা দেখলাম-কি ভয়! একসঙ্গে মরতে যে ভয় করে, তার ভালবাসার আবার দাম কি? কানাকড়িও না। হিদুর মেয়ে তবু বাধ্য হয়ে বিধবা হয়ে স্বামীর বদলে ঈশ্বর ভজে বাঁচে। কোন মানুষকে আর বিয়ে করে না। এ তো ক্রীশ্চান, আমি বেঁচেছি তাই, মরলে তো আর কাউকে বিয়ে করে দিব্যি গাধাবোটের মত অন্য স্টীমারের টানে ভেসে চলত। নাঃ—ওকে আর আমার চাইনে—ওকে আমি আর কোনদিন ফিরে দেখব না। হিন্দু মেয়েই ভাল। কিন্তু বাবাকে তুমি বল আমার ভিক্ষোয়ের সম্পত্তি দেবোত্তর, আমাকে লিখে দিতে। আমি আলাদা হয়ে যাব। বাবার সঙ্গে একসঙ্গে থাকতে হলে আবার আমাকে আত্মহত্যা করতে হবে।

সুরেশ্বর বললে—অন্নপূর্ণা-মা এখানেই নিজে মুখে কথা বলা শেষ করেছিলেন। তার কারণ বন্ধ দরজায় টোকা পড়েছিল, টোকা নয়, মৃদু ধাক্কা; আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম—কে?

বাইরে থেকে উত্তর এসেছিল—আমি রথীন!

অর্চনা মুখ নত করেছিল লজ্জায়; আমি একটু হেসেছিলাম; অন্নপূর্ণা-মা বলেছিলেন—যা, দোর খুলে দে। বাপ রে বাপ-মালিক এসেছে, ওঠ ওঠ!

অর্চনা গিয়ে দরজাটা খুলে দিতেই একরাশ ওষুধের গন্ধ ছড়িয়ে রথীন ঢুকল। হাতে একখানা খাম। হেসে বললে-ক’টা বাজছে ঠিক আছে মা-মণি? নিজের পিতৃবংশের গল্প বলতে গিয়ে বারোটা বাজিয়ে ফেললে যে। আর তো দেখি ক’ মিনিট বাকি। ডাক্তার হিসেবে বলতে পারি, রাতে বারোটার পর যে একটা বাজে, সেটা সচরাচর কেউ শুনতে পায় না। জন্মান্তর স্মৃতি কারুর থাকে না। তোমার বয়স পঁচাত্তর পার হয়েছে। তবু তুমিই হলে এ বংশের সব। তোমার উপর কথা বলবার ক্ষমতা তোমার নাতিদের নেই। পুত্রবধূর নেই। অর্চনাকে মা বল, সে-হিসেবে বাবাত্ব দাবী করে বলছি, ঘুমিয়ে পড়, আর না।—

অন্নপূর্ণা-মা বললেন—হেসেই বললেন—ওরে, আমার বাবা হওয়া সোজা কথা নয় রে; আমার বাবা ছিলেন সত্যিকারের রাজা। বুঝলি—তাঁর জীবনে কলঙ্ক অনেক, মদ খেতেন, তারপর বাঈজী ছিল কিন্তু সে-সব আমার মাকে না পেয়ে, বুঝলি। অৰ্চনা-মাকে সেইভাবে আদর করলে বাবা বলব, নইলে না। উঃ–কি এত ওষুধের ঝাঁঝালো গন্ধ রে গায়ে।

—ইথার, স্পিরিট, লাইজল গন্ধওলা ওষুধের কি আর শেষ আছে। এক্ষুনি তো হাত ধুচ্ছিলাম স্পিরিট লাইজল দিয়ে। ওটা আমার বাতিক। তুমি কিন্তু এখন শোও। এখন সুরেশ্বরদা, তোমার নামে টেলিগ্রাম এসেছে, জানবাজারের বাড়ী থেকে নিয়ে তোমার রঘুয়া এসেছে। তারই জন্যে আমাকে আসতে হল। নাহলে—

—টেলিগ্রাম?—

—হ্যাঁ, মেদিনীপুর থেকে। আমি খুলেছি—। কে একজন সুধাকর টেলিগ্রাম করেছেন- ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট বি আর সেন is considering the case of your mejdidi come sharp—


© 2024 পুরনো বই