৪
এরই মধ্যে ঘটনাটা ঘটল। চতুর্দশী ভায়লেটের প্রেমে পড়লেন দেবেশ্বর। কিন্তু দেবেশ্বরকে আড়াল দিয়ে ঢেকে রাখলে ঠাকুরদাসের দ্বিতীয়পক্ষের বড় ছেলে গোপাল।
রত্নেশ্বর রায় পত্র লিখে ঠাকুরদাসকে আসবার কথা জানালেন। কিন্তু সে এল না। রত্নেশ্বরের ডায়রীতে আছে—“অন্য কেহ হইলে ঠাকুরদাস পাল বলিয়া কেহ আর শ্যামনগরে ইহার পর থাকিত না।
“ইতিমধ্যেই পিড্রুজ আমার নিকট অভিযোগ করিয়াছে যে, গোপাল অঞ্জনার কন্যা ভায়লেটকে লইয়া কিছু বাড়াবাড়ি করিতেছে। কতদিন হইতে ব্যাপারটা ঘটিয়াছে তাহা সঠিক বলিতে পারিল না, তবে কিছুদিন হইতে অর্থাৎ এবার গ্রীষ্মের ছুটিতে দেবেশ্বরের সঙ্গে সে এখানে আসিয়া এইরূপ কাণ্ড শুরু করিয়াছে। সুতরাং পিড্রুজকে দিয়া অনায়াসে এই ঘটনা লইয়া ঠাকুরদাসের সঙ্গে ঝগড়া বাধিতে পারে। ঠাকুরদাসের সঙ্গে পিজদের একটা বিবাদ ইতিমধ্যেই জন্মিয়াছে। শ্যামনগরের বৃদ্ধি কোর্ট মারফৎ মামলার রায়ের বলে হইলেও আমাদের কাছারীতে পিজ এবং তাহার অনুচরেরাই মোতায়েন আছে। কিন্তু না, তাহা করিব না। তাহাতে অধর্ম হইবে। অধর্ম আমি করিব না। পূর্বের সে-সকল দিবস বিগত হইয়াছে, যে-কালে প্রজার ঘর জ্বালাইয়া দেওয়া চলিত, ইচ্ছামত গুপ্তঘাতক দ্বারা হত্যা করা চলিত, তাহাদের ঘরের বধুকন্যা জোরপূর্বক হরণ করা মাত্র একটা হুকুমের অপেক্ষা রাখিত। আজ নূতন কাল নূতন আলোক নূতন উত্তাপ অনুভব করিতেছি। দক্ষিণেশ্বর গিয়া আশ্চর্য মানুষ দেখিয়া আসিলাম। ঠাকুর রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব। পূর্বে রামব্রহ্ম ন্যায়রত্নের নিকট দীক্ষা লইয়াছি, নহিলে এই মহাসাধকের নিকট দীক্ষা লইয়া ধন্য হইতাম। বাংলাদেশের মানুষের বিশেষ করিয়া কলিকাতায় যেন একটা নূতন জোয়ার আসিতেছে। তাহা ছাড়া ভায়লেট অঞ্জনার কন্যা।”
যাহা হউক দেবেশ্বরকে ডাকিয়া গোপাল সম্পর্কে সাবধান করিয়া দিলাম। দেবেশ্বর নতমুখে দাঁড়াইয়া শুনিল এবং ঘাড় নাড়িয়া জানাইল সে সাবধান করিয়া দিবে। দেবেশ্বর আমার কুল-উজ্জ্বলকারী পুত্র। যেমন রূপে কন্দর্প কি কুমার কার্তিকেয়, তেমনি গুণে মেধায় অসাধারণ। বাল্যকালে আমার নিজের মেধা ও স্মৃতির কথা স্মরণ করিয়া মনে করিতে সংকোচ নাই যে সে আমা অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। এই সকল লজ্জাকর কথাগুলি সে শুনিল—মাথা হেঁট করিয়াই শুনিল—ক্ষণে ক্ষণে সে লাল হইয়া উঠিতেছিল কিন্তু আমার মুখের দিকে দৃষ্টি তুলিল না। কোন প্রশ্ন করিল না। হাঁ, ইহাই তো আভিজাত্য। ইহাই তো শীলতা। কিন্তু আমি ভাবিতেছি হতভাগ্য গোপালের কথা।”
ভায়লেটকে রত্নেশ্বর রায় নেপথ্যে থেকে অঞ্জনার কন্যা হিসেবে মানুষ করছিলেন। শেষ জীবনটায় তিনি তাকে অর্থসাহায্য করেই কর্তব্য শেষ করেন নি, তার মৃত্যুকালে গোপনে তার বাড়ীতে গিয়ে ভায়লেটের ভার নিয়ে এসেছিলেন। ভার নিয়ে তাঁর সমস্যা দাঁড়িয়েছিল কি ভাবে ভায়লেটকে মানুষ করবেন? সেই গোয়ানীজ আধা পর্তুগীজটার মত? কিংবা অঞ্জনার মেয়ের মত? আলফানসো পিভুজের দেহের যা গড়ন গায়ের যা রঙ তাতে তাকে বারো আনা পর্তুগীজ বলা চলত। এবং তার যা চরিত্র তার যা পেশা তাতেও তাকে হারমাদদের খাঁটি বংশধর বলা যেত। কিন্তু অঞ্জনা বামুনের মেয়ে; সেকালে রত্নেশ্বর রায়ের মত জমিদারপুত্রের মুখে দু’চারটে সরস কথা শুনে আর তার নিজের প্রতি কয়েকটা তারিফ বাক্য শুনে বামনের চাঁদ ধরার সাধ জেগেছিল—নিজে গলে জল হয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু রত্নেশ্বরের যে স্পর্শে সে গলতে পারত সে স্পর্শ পায় নি বলেই ক্ষোভের বশে চলে গিয়েছিল ওই দুঃসাহসী আলফানসো পিড্রজের সঙ্গে। হয়তো সে সেদিন আরও ঘৃণ্য কাউকেও বরণ করতে পারত। কিন্তু তার মোহ বেশীদিন টেকে নি। এবং ভাগ্যক্রমে আলফানসোও তার হারমাদি ট্র্যাডিশনকে উজ্জ্বলতর করে খুন হয়ে তাকে রেহাই দিয়েছিল। অঞ্জনা আবার ফিরে আসতে চেয়েছিল। কিন্তু ফেরা আর সম্ভবপর ছিল না এবং উপায়ও ছিল না। একদিকে সমাজ ছিল কঠোর। আর অন্যদিকে তার নিজেরও ধরেছিল মৃত্যু-রোগ। মৃত্যু আসন্ন বুঝে সে রত্নেশ্বর রায়কে শেষ দেখা দেখতে চেয়ে চিঠি লিখেছিল। এবং তা সে পেয়েও ছিল। রত্নেশ্বর রায় ওই পিছন দিকের মেথরদের দরজা দিয়েই ময়লা কাপড়জামা পরে নিঃশব্দে চোরের মত বেরিয়ে গিয়েছিলেন এই জানবাজারের বাড়ী থেকে। এবং গিয়ে উঠেছিলেন দেশী ক্রীশ্চানপাড়ায় ওই এলিয়ট রোডের আশেপাশে কোন একটা খোলার বাড়ীতে।
বিস্তৃত বিবরণ লেখেন নি রত্নেশ্বর রায় তাঁর ডায়রীতে। সে লিখবার মতো লোক তিনি ছিলেন না। কঠিন কাঠের মত লোক। কাঠ হলেও বলব রত্নেশ্বর রায় ছিলেন সেকালের চন্দন কাঠ। কিন্তু রক্তচন্দন। অত্যন্ত শক্ত। অনেক ঘষলে তবে রক্তরাঙা কাঠের রস বের হয়।
যাক। অঞ্জনার কাছে বাগ্দান করে এসেছিলেন—ভায়লেটকে তিনি এই কলকাতার বাড়ীতে যেন ফেলে না রাখেন। কোন মিশনে না দেন। যাতে ও একেবারে ফিরিঙ্গী ক্রীশ্চান না হয়ে যায়। অঞ্জনা বলেছিল—দেশে তো অনেক দেশী ক্রীশ্চান আছে—মুখুজ্জে বাঁড়ুজ্জে চাটুজ্জে—বামুন ক্রীশ্চান, কায়স্থ ক্রীশ্চান, বদ্যি ক্রীশ্চান আছে তো। তেমনি দেখে একটা বিয়ে দিলে আমি স্বস্তি পাব।
কথা দিয়ে এসেছিলেন রত্নেশ্বর রায়। কিন্তু কাজটি করা খুব সহজ ছিল না সুলতা। তবু তিনি করেছিলেন যথাসাধ্য। হিলডার বাবা পিড়ুজের সঙ্গে আলফানসোর সম্পর্ক ছিল খুড়ো-ভাইপো। খুব নিকট সম্পর্ক, কিন্তু ওদের সমাজে তো সম্পর্কের মূল্য খুব বেশী নয়। তবে সেখানে রত্নেশ্বর রায়ের দাক্ষিণ্যে মূল্যটা হয়ে উঠেছিল অত্যন্ত বাস্তব; টাকা আনা পাই। এবং কীর্তিহাটের গোয়ানপাড়ায় বাড়ী ঘর পর্যন্ত। এবং এই পিজই ভায়লাকে তার সৎবোন পরিচয় দিয়ে নিয়ে গিয়েছিল গোয়ানপাড়ায়। সেখানে কয়েকটা বছর কাটতে কাটতে ভায়লা যখন বারো-তেরো বছরের হয়ে উঠল, তখন রত্নেশ্বর রায় অকস্মাৎ একদিন মেয়েটাকে দেখলেন। দেখলেন কিশোরী ভায়লার চোখে একটু বিচিত্র দৃষ্টি ফুটছে। এবং গালে যেন একটা লালচে আভা দেখা দিয়েছে। গোয়ানপাড়ায় অন্য রঙ্গিনী মেয়েগুলোর সঙ্গে রঙ্গ ক’রেই ওই কাঁসাইয়ের দহে নেমে জল তোলপাড় ক’রে স্নান করছিল। তিনি দাঁড়িয়েছিলেন বিবি মহলের ছাদে। তামাটে রঙের মেয়েগুলোর মধ্যে উজ্জ্বলতমা কালো কুঞ্চিতকেশিনী ভায়লেটকে চিনতে তাঁর বিলম্ব হয় নি। মেয়েটা বড় হয়ে উঠেছে। এবার অঞ্জনার কাছে শেষ প্রতিশ্রুতি পালন করতে হবে। মেয়েটার বিয়ে দিতে হবে দেশী ক্রীশ্চানের ঘর দেখে।
তাদের সমাজ স্বতন্ত্র, জীবনের ভঙ্গি স্বতন্ত্র। তারা ধর্মে ক্রীশ্চান কিন্তু তারা ফিরিঙ্গি নয়। তারা ভারতীয় ক্রীশ্চান। সেকালে বামুন ক্রীশ্চান কায়স্থ ক্রীশ্চানের সঙ্গে করণ কারণ করত না। করলেও তা খুব বেশী নয়—বিরল ছিল। ব্রাহ্মদের মধ্যেও তাই।
তবু অর্থের জোর এবং জেদী শক্তিশালী মানুষেরা সব পারে। তার সঙ্গে যদি বুদ্ধি এবং কৌশলের মাথা থাকে তবে লক্ষ্মী সরস্বতী শক্তি একসঙ্গে অঘটন ঘটাতে পারে সুলতা।
রত্নেশ্বর রায়ের তিনই ছিল।
শুধু রত্নেশ্বর রায় কেন, গোটা বাংলাদেশের জমিদারদের দিকে তাকিয়ে দেখ, এই কালটা তাদের উজ্জ্বলতম জীবনাধ্যায়। মুঘল আমলের একেবারে মধ্যযুগীয় হালচাল বদলে গিয়ে নতুন হালচাল শুরু হয়েছে। যে হালচালের জন্য ইংরেজ সরকার একটু সচকিত হয়েছেন। সাত-আট বছরের মধ্যে ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস জন্ম নেবে এইসব বিত্তসম্পত্তিশালী এবং ইংরিজী লেখাপড়া জানা লোকেদের নেতৃত্বে। বিবেকানন্দের পদধ্বনি নেপথ্যে তখন বাজছে। সুতরাং ইংরেজের চকিত না হয়ে উপায় ছিল না। তারা রাষ্ট্রশক্তি হিসাবে যা করেছে—করছে, তার সঙ্গে মিশন ইস্কুলগুলোও কাজ করে যাচ্ছে। শুধু ঈশ্বরের পুত্র জেসাস ক্রাইস্টের অনুগামী ভক্ত তৈরী করছে না, ক্রীশ্চান ইংরেজ রাজ্যের খুঁটি তৈরী করবার কল্পনা করছে। রত্নেশ্বর রায় মেদিনীপুরের মেয়েদের মিশন ইস্কুলে ভায়লেটকে ভর্তি করবেন ভাবলেন। কিন্তু সেখানে ব্রাত্যদের, বিশেষ করে সাঁওতালদের ভিড় দেখে ওখান থেকে ফিরে এসে ভাবছিলেন কি করবেন?
তাঁর সেদিনের ডায়রীতে আছে—“পিজকে লইয়া ক্রীশ্চান মিশন দেখিতে মেদিনীপুর শহরে গিয়াছিলাম। কিন্তু সেখানে দেখিলাম—যাহাদের ক্রীশ্চান করিয়া পাদরী সাহেবরা লেখাপড়া শিখাইতেছে তাহাদের অধিকাংশই সাঁওতাল অথবা এদেশে যাহাদের আমরা চুয়াড় বলিয়া থাকি তাহারাই। এখানে ভায়লেটকে দেওয়ার প্রশ্নই উঠে না। তাহাতে মহা অপরাধ হইবে। সুতরাং বহু চিন্তা করিয়া স্থির করিলাম ইহাদের যে একটি খড়ো গির্জা উহারা খাড়া করিয়াছে, সেইটিকে মেরামতাদি করাইয়া একজন আমাদের দেশী ক্রীশ্চান পাদরীকে বেতন দিয়া লইয়া আসিব। সে পাদরীর কাজ করিবে এবং একটি পাঠশালাও করিয়া দিব। সেখানে ছেলেমেয়েরা কিছু কিছু পড়িবে। তাহার দ্বারাই ভায়লেটকে বিশেষ করিয়া পড়াইবার ব্যবস্থা করিব। এই পাদরী সাহেবকে দিয়া ভায়লেটকে adopted daughter করাইয়া জাতে উঠাইব।”
সব ব্যবস্থাই অত্যন্ত দ্রুত করে ফেলেছিলেন রত্নেশ্বর রায়। এবং প্রাথমিক ইস্কুলটির জন্যই তাঁর এতগুলি ইস্কুল—গোটা আষ্টেক মাইনর স্কুলে আংশিক সাহায্য, কীর্তিহাটে শ্যামনগরে দুটো এইচ ই ইস্কুল, কীর্তিহাটে একটা চ্যারিটেবল ডিসপেনসারী করা সার্থক হ’ল। এই প্রাইমারী স্কুলটির দ্বারোদঘাটন করেছিলেন ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট এবং সেই বৎসরই তিনি হয়েছিলেন রায়বাহাদুর। সেটা ১৮৭৭ সাল। এবং সেই উপলক্ষেই রত্নেশ্বর রায়ের যুবরাজ দেবেশ্বর দেখলেন ভায়লেটকে।
দেবেশ্বরের বয়স তখন পনের বছর। এই স্কুল প্রতিষ্ঠা উপলক্ষ্যে কীর্তিহাটে এসে ছিলেন বাপের নির্দেশে। সঙ্গে এসেছিল গোপাল।
গোপাল ছিল দেবেশ্বরের সাথী অনুচর-মুখে বলতেন দাদা।
ঠাকুরদাস পাল তার দাদাঠাকুরকে ত্যাগ করেছিল। কমলাকান্ত রত্নেশ্বর হলেন, ঠাকুরদাস তাঁকে ছাড়ল। কিন্তু গোপাল দেবেশ্বরের সঙ্গে থাকল—তাতে আপত্তি করে নি। নিজেও দেবেশ্বরকে প্রাণের তুল্য ভালবাসত।
অনুষ্ঠানটা হয়েছিল সরস্বতী পূজোর সময়। সভায় গাঁদাফুলের মালা পরিয়েছিল ভায়লেট। ডায়াসে বসেছিলেন সস্ত্রীক ডিস্টিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট। নিচে দুপাশে দুখানা চেয়ারে সিমেট্রি রেখে বসেছিলেন পিতাপুত্র; একদিকে রত্নেশ্বর রায় অন্যদিকে দেবেশ্বর রায়। এবং তাঁদের সঙ্গে আরও অভ্যাগত সরকারী কর্মচারীবৃন্দ। তাদের সঙ্গে ছিলেন নবনিযুক্ত বৃদ্ধ বাঙালী পাদরী সাহেব।
গাঁদাফুলের মালা বোঝাই ঝুড়ি নিয়ে পিজ যাচ্ছিল ভায়লেটের সঙ্গে, ভায়লেট তার নির্দেশমত মালা পরিয়ে দিচ্ছিল অতিথিদের গলায়। সবশেষে পালা এল দেবেশ্বরের-শেষ মালাটি ভায়লেট পরিয়ে দিলে দেবেশ্বরকে। সঙ্গে সঙ্গে দেবেশ্বর হলেন শরাহত।
* * *
দেবেশ্বর রায় জীবনে ডায়রী রাখেন নি। জীবনে সেদিনের যে বিবরণটুকুর কথা বললাম সেটুকু দেবেশ্বর রায়ের কোন কিছু থেকে পাই নি। পেয়েছি তাঁর পিতা স্বনামধন্য কীর্তিহাট-সিংহ রত্নেশ্বর রায়ের ডায়রী থেকে। ভায়লেট যখন দেবেশ্বরের গলায় মালা পরায়, তখন ভায়লেট নিজেই আড়াল ক’রে দেবেশ্বরকে ঢেকে রেখেছিল। এবং নিজে ভায়লেটও পিছন ফিরে ছিল রত্নেশ্বর রায়ের দিকে, নইলে নিশ্চয় তিনি দুজনের মুখ দেখে ভবিষ্যৎ অনুমান করতে পারতেন। হয়তো সেইদিনই ভায়লেট দেবেশ্বর রায়ের নাগালের অনেক বাইরে চলে যেতো।
চোখেও দেখেন নি কিছু, কানেও দেবেশ্বর সম্পর্কে কোন নিন্দার কথা শোনেন নি। তিনি যে কঠোর নিষ্ঠায় নিজেকে সংযমের শাসনে শাসিত রেখেছিলেন তা অঞ্জনার বিবরণেই স্পষ্ট, এ ছাড়াও মধ্যে মধ্যে তাঁর ডায়রীতে যে সব অকারণ আত্মনির্যাতনের বিবরণ পাওয়া যায় তা পড়ে বিস্মিত হতে হয় এবং সে বিস্ময় একটা ভয়ে পরিণত হয় সুলতা, যখন জানতে পারি যে কোন নারীর প্রতি আকর্ষণকে নিঃশেষে মুছে ফেলবার জন্য নিজের অন্তরের কোমলতম অংশের একটুকরো পর্দা ঝামা দিয়ে অথবা উখা দিয়ে ঘষে তুলে দিতেন। তার অনেক দৃষ্টান্ত আছে। এবং তার থেকে তিনি সম্পত্তি অর্জনের ব্যাপারে যে কত সুবিধা পেয়েছেন তার হিসেবও রায়বাড়ীর জবানবন্দীর একটা বড় হিসেব। কিন্তু সে কথা থাক। দেবেশ্বর রায়ের কথা বলি
দেবেশ্বর রায় ভায়লার দেওয়া মালা কণ্ঠে ধারণ করে শরাহত কুরঙ্গের মত লুটিয়ে পড়লেন। সভা থেকে ফিরে এসে শরীর ভাল নেই বলে শুলেন। ডাক্তার এসে দেখে গেল। বলে গেল, সর্দি হয়েছে। বিশেষ কিছু না।
কিন্তু দেবেশ্বর রায়ের গোপালদা বুঝেছিল—তার রাজাভাইয়ের কি হয়েছে। গোপাল দেবেশ্বর থেকে মাস কয়েকের বড় কিন্তু এ সব বিষয়ে দেবেশ্বর থেকে অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে। লেখাপড়ার পালাও সে তখন শেষ করেছে। প্রথমটা কীর্তিহাট এইচ ই স্কুলে দেবেশ্বর এবং সে দুজনেই পড়ত, অবশ্য দেবেশ্বর পড়ত উঁচু ক্লাসে; সে পড়ত নিচে। তারপর সেকেন্ড ক্লাসে উঠতেই ছেলেকে কলকাতার শিক্ষায় শিক্ষিত করতে রত্নেশ্বর রায় দেবেশ্বরকে কলকাতায় পাঠিয়ে গার্জেন টিউটারের তত্ত্বাবধানে রেখে দিলেন। গোপাল কীর্তিহাটে ফেল ক’রে ক’রে চলে গেল শ্যামনগর। মধ্যে মধ্যে পালিয়ে এসে উঠত কলকাতায় জানবাজারের বাড়ীতে তার রাজাভাইয়ের প্রেমের টানে। কলকাতা দেখে বেড়াত। এ বিষয়ে ঠাকুরদাস খুব অসুখী ছিল না বা ছেলের উপর অসন্তুষ্ট ছিল না। তার যত কিছু ক্ষোভ অভিমান সব রত্নেশ্বর রায়ের উপর। দেবেশ্বর তার কাছে ছিল সোনার পুতুলের মত পরম প্রিয়। গোপালের চেয়েও সে বেশী ভালবাসত দেবেশ্বরকে!
দেবেশ্বর ছুটিতে কীর্তিহাট এলে সে এখানে একবার আসত। দেবেশ্বরকে দেখে সমাদর করে বাড়ী ফিরে যেত। রত্নেশ্বর রায়ের সঙ্গে দেখা ইচ্ছে করেই করত না। হয়ে গেলে খুব খাতির করে প্রণাম করে চলে যেত। দাদাঠাকুর আর বলত না সে। হুজুরও তার জিভে আসত না। সে বলত—প্ৰভু।
বলত—প্রভুর শরীর-মেজাজ ভাল আছে? এবং নগদ একটি টাকা সেলামী দিয়ে প্রণাম করত। রত্নেশ্বর রায় গম্ভীরভাবেই জবাব দিতেন। তিনি অবশ্য ‘তুই’ বলেই কথা বলতেন এবং কাছারীতে রোকা দিতেন—ঠাকুরদাস পালের বিদায়-খরচ। সেটায় প্রতিবারই কাপড়-চাদরের ব্যবস্থা থাকত। ঠাকুরদাস অমান্য করে ফিরিয়ে দিত না, নিত, কিন্তু সে কাপড়-চাদর নিয়ে সে কীর্তিহাটের সীমানা পার হত না; কাউকে না কাউকে বিলিয়ে দিয়ে যেত।
গোপালকে বলত-আমার সোনাবাবার কাছে আছিস, আমি খুশী আছি। এখানে তো কিছু হল না। তা সোনাবাবার কাছে কলকাতায় থেকে চোখোল-মুখোল হ; কিছু-মিছু কর। বুঝলি এখানকার চাষবাস আছে, সে কুলকম্মে তো এখনও একা আমাকেই কুলোয় না, তার মধ্যে তুই আর মাথা গলিয়ে করবি কি! ওখানে থাকলে আমি নিশ্চিন্ত থাকি, বুঝলি।
বিরোধ বা মান-অভিমান সত্ত্বেও দুই পিতা যেমন পুত্রদের সম্পর্কে নিশ্চিন্ত ছিলেন, পুত্রেরাও তেমনি পরস্পরকে ভালবেসেছিল এবং পরস্পরের প্রতি নির্ভরশীল হয়ে উঠেছিল। গোপাল তখন তরিবৎ করে দেবুভাইকে সিদ্ধির শরবৎ থেকে আরম্ভ করে বছর খানেক—দেড়েকের মধ্যেই হুইস্কির গেলাস সোডা মিশিয়ে যথাসময়ে যোগাতে শুরু করেছে। তখন একটা হুইস্কি ছিল O. H. M. S. অন হিজ ম্যাজেস্টিস সার্ভিস। তার বোতল কিনে এনে গোপাল নিজের বাক্সে পুরে রাখত। সকালবেলা থেকে গার্জেন টিউটরের কাছে দেবেশ্বর একরকম ছিলেন, স্কুলে ছিলেন আর একরকম; গার্জেন টিউটরের কাছে যা, তার সঙ্গে একটুখানি আমীরী চাল যোগ হত। রবীন্দ্রনাথের ষোল বছর বয়সের ছবি আছে দেখেছ কিনা জানি না; জরির টুপি, আচকান, পায়জামা-পরা ছবি; সেটা তখন উঠি-উঠি করছে; তার জায়গায় কোঁচানো কাপড়, সিল্কের পাঞ্জাবি চলিত হচ্ছে। সেই পোশাক পরে দেবেশ্বর রায় কম্পাসের বগিগাড়ী অর্থাৎ একঘোড়া-টানা বগিগাড়ীতে স্কুলে যেতেন। বিকেল থেকে রাত্রি দশটা পর্যন্ত আবার গার্জেন টিউটরের অধীনে। দেবেশ্বর রায় শান্ত, বুদ্ধিমান, ধীর; স্কুলে ক্লাসের প্রথম দুজনের মধ্যে একজন। টিউটর ছাত্রের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ রচনা করেন। দশটার পর দেবেশ্বরের ছুটি হয়। দেবেশ্বর কোন একটা রাগিণী ভাঁজতে ভাঁজতে বার্নিশ করা চটি টানতে টানতে উপরে এসে ঘরে বসে ডাকেন—গোপালদা রে।
—কি রাজাভাই!
—বড্ড তেষ্টা পেয়েছে গোপালদা।
—আমি ঢেলে রেখে বসে আছি সেই কখন থেকে। নাও, খাও। বলে সোডা মেশানো হুইস্কির গ্লাস তাঁর হাতে তুলে দেয়। তৃষ্ণার্তের মত সেটা শেষ করে দেবেশ্বর বলেন-আর একটু দে না গোপালদা।
—আরও খাবে? জানাজানি হলে তোমারও বিপদ আমারও বিপদ।
—তা ঠিক। কিন্তু আর একটুখানি। একটু। এই এতটুকু।
এই গোপালদা এবং এই তার রাজাভাই দেবেশ্বর রায়। ছিপছিপে পাতলা, লম্বায় তখনই প্রায় ছফুটের কাছাকাছি, সোনার বর্ণ রঙ, তার উপর নীলাভ শিরাগুলো যেন এই সৌন্দর্যের একটা বিচিত্র ইতিবৃত্ত লিখে রেখেছে—হাতের তালু, পায়ের তলা গাঢ় গোলাপী। সে নাকি দেখলেই মানুষ মুগ্ধ হয়ে যেত। ঠাকুরদাস পাল ছেলেবেলায় তাঁকে দুই হাতে তুলে ধরে দোলাতো আর বলত —“ও আমার নদের ছবি, যে দেখবি সে পাগল হবি।”
সুলতা, আমার মেজদাদু, আমাকে প্রথম দেখে বলেছিলেন, তাই তো ভাই, আমায় যে তুমি ধাঁধা ধরালে হে। আমার দাদা তোমার পিতামহ রায়বংশের শ্রেষ্ঠ সুপুরুষ ছিলেন, বাংলাদেশে এমন রূপ জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ী ছাড়া দেখি নি। দাদা আমার তাদের কাছেও ম্লান ছিলেন না।
সেই তরুণ কিশোর দেবেশ্বর রায় ভায়লেটকে দেখে শরাহত হল। ভায়লার বয়স তখন তেরো পার হয়ে চৌদ্দয় পড়েছে। চতুর্দশ বসন্তের একগাছি মালা!
সভা থেকে ফিরে এসে সে শরীর খারাপ বলে শুয়ে পড়ল।
ডাক্তার দেখে বলে গেল—সীজন চেঞ্জের সময় সর্দি লেগেছে। ও কিছু না।
দেবেশ্বর চুপ করে শুয়েছিলেন, তাঁর বাসনা তখন উদ্দাম হয়ে ছুটেছে। লাগামছেঁড়া ঘোড়ার মত। ভায়লা—ভায়লা-ভায়লা। তার গালের গোলাপী রঙ, কালো চোখ, কোঁকড়ানো কালো চুল কিছুতেই সে ভুলতে পারছিল না।
এক সময় গোপাল এসে ঘরে ঢুকল। দেবেশ্বরের শিয়রের কাছে বসেছিলেন তাঁর মা। গোপাল তাঁকে বললে—আপনি জ্যাঠাইমা এখন যান, আমি বরং রাজাভাইয়ের কাছে বসি। সরস্বতী ঠাকরুণ প্রায় সন্ধ্যে থেকেই বসে আছেন। তিনি বললেন—তাই বস রে তুই। একটু বরং গল্প-টল্প কর। তাতে হয়তো ভাল থাকবে। দেবু, আমি যাই, ওঁর খাওয়া-টাওয়াগুলো একবার দেখি।
দেবেশ্বরও তাই যেন খুঁজছিলেন। এ-কথা তিনি বলবেন কাকে? বিশ্বব্রহ্মাণ্ড খুঁজে এক গোপালদা ছাড়া তো কাউকে তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন না। তিনি বললেন—তাই যাও।
সরস্বতী বউরাণী চলে যেতেই গোপাল দরজার পাল্লাদুটো ভেজিয়ে দিয়ে ফিরে কাছে এসে খাটের বিছানার উপর কনুই দুটো রেখে ঝুঁকে পড়ে বললে—সায়েবদের জন্যে আনা এক বোতল স্যাম্পেন বাগিয়েছি রাজাভাই। কিন্তু কি হল বল তো?
বলতে লজ্জা পেয়েছিলেন দেবেশ্বর। গোপাল ঘাড় নেড়ে প্রশ্ন করেছিল—ওই ভায়লা?
দুইহাতে গোপালের গলা জড়িয়ে ধরে দেবেশ্বর বলেছিলেন—ওকে নইলে আমি বাঁচব না গোপালদা। আমি মরে যাব।
গোপালদার পক্ষে কাজটা দুরূহ হয় নি। সেকালটায় অবশ্য ধনীর পক্ষে মুগ্ধা দরিদ্রকন্যাকে আয়ত্ত করা কোন বড় অপমানের মধ্যেই গণ্য ছিল না, তবে বর্ণভেদে অর্থাৎ জাতের উঁচু-নীচু ভেদে একটু-আধটু তফাত হত। নিশ্চয়ই হত। কিন্তু এছাড়াও আর একটা চিরন্তন ধারা আছে প্রেমের পথে—সেটা হল সনাতন ধারা; যে-ধারায় রাজকন্যার জন্যে রাখাল ছেলে পাগল হয়, আবার রাজপুত্রকে দেখে ভিক্ষুকের কন্যা লালায়িত হয়ে ওঠে। রাখাল ছেলে রাজার মেয়েকে বড় পায় না সুলতা, তবে রাজার ছেলে কৌতুকবশে ভিক্ষুক-কন্যাকে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে। আবার প্রেমেও পড়ে। সে রাজকন্যেও পড়ে, ভিখিরীর মেয়েও পড়ে।
ভায়লাও প্রেমে পড়েছিল এবং সে-প্রেমও দর্শনমাত্র প্রেম। সুতরাং কাজটা দুরূহ হয় নি গোপালের পক্ষে। তবে গোপালই এটাকে সম্ভবপর করে তুলেছিল, নইলে সে-সাহস বা সে-বুদ্ধি দেবেশ্বর রায়ের ছিল না। তখনও ততখানি শক্ত হয়ে উঠতে পারেননি।
সেটা সহজ এবং সরল করে দিয়েছিল গোপালদা।
সুলতা, পল্লীগ্রাম সরল বটে। অচতুরও বটে। শহরের মত জটিল নয় এ-কথা নিশ্চয় কিন্তু জীবনের বৃন্দাবনে জটিলা-কুটিলা-বৃন্দা সেখানেও আছে। আজও আছে। সেকালে আরও অনেক বেশী ছিল। যে-আমলের কথা বলছি, সে-আমলে ধনী জমিদারদের এবং উচ্চবর্ণের এসব ক্ষেত্রে অন্যায় করবার একটা বে-আইনী আইন থানার দারোগাদের ঘুষ নেওয়ার মত জানাশোনা ভাবেই চলিত ছিল। এতে মনে কেউ কিছু করত না। হয়তো ঘৃণা একটু করত, ঠাট্টা একটু-আধটু করত, বেশী হলে একটা সামাজিক আন্দোলন হত, তাতে যৎকিঞ্চিৎ কাঞ্চনমূল্য ব্রাহ্মণকে দিলেই মাপ হয়ে যেত। এবং গ্রামের যারা দুষ্ট দুর্দান্ত প্রকৃতির তাদের হয়তো কিঞ্চিৎ দিতে হত। এটা অবশ্য উচ্চবর্ণের সাধারণজনের পক্ষে। কিন্তু জমিদার বা ধনশক্তির অধীশ্বরের মান্য আলাদা। তাঁর লোকের সঙ্গে বা তাঁর বাড়ীর মুখে কোন রমণী যদি গভীর রাত্রে পথ ধরত, তবে এই দুষ্টেরা সসম্ভ্রমে সরে যেত।
কীর্তিহাটে এটি কিন্তু ছিল না, রত্নেশ্বর রায়ের কঠিন শাসনে। তাঁর হুকুম ছিল চৌকিদার এবং নিজের বাড়ীর বরকন্দাজদের উপর এবং সাধারণ লোকের উপরও বটে যে, যদি এমন ঘটনার কোন সন্ধান কেউ পায় বা সন্দেহ করে, তবে সে যেন তৎক্ষণাৎ তাঁকে জানায়। গ্রামের কয়েকটা ব্রাত্য স্বৈরিণী যুবতী যারা এই ধরনের পেশা এবং নেশায় একটু বেশী প্রমত্তা হয়েছে, তাদের তিনি অর্থব্যয় করে নবদ্বীপ পাঠিয়ে দিয়ে গ্রামকে পাপমুক্ত রেখেছিলেন। কিন্তু তাঁরই গ্রামে, তাঁরই কিশোর কন্দর্পের মত দেবেশ্বর রায়ের সঙ্গে ভায়লেটের মিলনের ব্যবস্থা অনায়াসে করে ফেললে গোপাল। এতটুকু বেগ পেতে হল না। বিচিত্রভাবে সে সমস্ত সমস্যার সরল সহজ সমাধান করে দিলে।
খানিকটা ঘুরেফিরে এসে বললে—রাজাদাদা, বেশ একখানা ভাল করে প্রেমপত্র লিখে দাও। তা নইলে সে ভয় খাচ্ছে। আমি বলে পাঠিয়েছিলাম, মেয়েটা শুনে কেঁদেছে। কিন্তু তারপরই বলেছে, উঁহু, উ যদি মিছে করে বলে, বাবুর নাম করে আমাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে—। বুঝেছ? তুমি রাজাদাদা, একখানা চিঠি লেখ। বেশ ভাল করে চিঠি লেখ। আমি ভালবাসি। আমি ভালবাসি। ভায়লা, তোমাকে নইলে আমার দুনিয়া অন্ধকার, আমার বুক হু-হু করছে। এইসব আর কি! তুমি তো লেখাপড়া জান ভাল, আমার মত তো নও। বাগিয়ে লেখ। বুঝেছ! তার আগে দাঁড়াও বোতলটা খুলি, খানিকটা স্যাম্পেন খেয়ে নাও। বুঝেছ। ব্রেন একবারে খুলে যাবে।
সুলতা তার মুখের দিকে বক্রদৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। শুধু তাই নয়, সে-দৃষ্টি তীক্ষ্ণ এবং খানিকটা রুক্ষও বটে। সুদীর্ঘ রায়বংশের জবানবন্দী সে শুনছে দু’দিন ধরে, নির্বিকার ভাবেই শুনে আসছে। কখনও একটু হেসেছে, কখনও দৃষ্টিটা উদাস হয়েছে; কখনও মুখের রেখায় ক্রোধ ফুটে উঠেছে—কপালে কুঞ্চনরেখা জেগেছে এই পর্যন্ত। এই প্রথম তার দৃষ্টি বক্র এবং তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। তার থেকে খানিকটা ক্রোধের উত্তাপও অনুভব করা যায়।
সুরেশ্বর সেদিকে লক্ষ্য করে নি। সে বলেই চলেছিল সামনের দেওয়ালের ছবিগুলোর দিকে চোখ রেখে। যে-ছবিখানার দিকে সে তাকিয়েছিল, সেখানা বন্দুক হাতে দেবেশ্বর রায়ের ছবি। কিন্তু চারদিকে প্যানেল করে অনেকগুলো ছোট ছোট ছবি আঁকা আছে। একটাতে একটা কুঞ্জের মত মনোরম পরিবেশের মধ্যে ভায়লেট এবং দেবেশ্বর পরস্পরে হাত ধরে মুগ্ধ ও মুগ্ধার মত তাকিয়ে আছেন। তারপর সুসজ্জিত ঘরে সোফার উপর দেবেশ্বরের কোলে মাথা রেখে ভায়লেট শুয়ে আছে এবং মুগ্ধার মত তার দিকে তাকিয়ে আছে। একটাতে দেবেশ্বর একমনে চিঠি লিখছেন। কিন্তু প্রত্যেক ছবিতেই গোপাল পাল উঁকি মারছে।.
সুলতা সুরেশ্বরকে বাধা দিয়ে বলে উঠল—তুমি থামো সুরেশ্বর।
তার কণ্ঠস্বর শুনে এবার চমকে উঠল সুরেশ্বর, চকিত এবং বিস্মিত দৃষ্টিতে সে সুলতার দিকে মুখ ফিরিয়ে প্রশ্নের সুরেই বললে-কি হল সুলতা?
গম্ভীরভাবেই সুলতা বললে—তুমি ভুলে যাচ্ছ যে, গোপাল পাল আমার ঠাকুরদার কাকা, তাঁর সম্পর্কে যেভাবে উক্তি করছ, তাতে আমি ঠিক স্বস্তিবোধ করছি না। সেকাল হলে সহ্য হয়তো করতে হত, কিন্তু কাল অনেকটা বদলেছে। কি বলছ এসব তুমি?
কিছুক্ষণ সুলতার মুখের দিকে তাকিয়ে সুরেশ্বর বললে —তোমার কথা শুনে ভারী ভাল লাগল, সুলতা। কথাটা আমার মনে ছিল—ভুলে আমি যাই নি। এবং তাঁর সম্পর্কে বানিয়েও কিছু বলি নি আমি। এ সমস্ত বৃত্তান্ত আমি চিঠিপত্রের মধ্য থেকে সংগ্রহ করেছি।
—চিঠিপত্র? এসব বৃত্তান্ত কে কাকে চিঠিতে লিখেছেন বা লিখতে পারেন সুরেশ্বর?
—তিনি দেবেশ্বর রায়, সুলতা।
—কাকে লিখেছিলেন তিনি এসব কথা?
—তাঁর পিতৃদেব, যিনি সাধারণের কাছে সিংহ ছিলেন, তাঁকেই লিখেছিলেন।
—তাঁর বাবাকে লিখেছিলেন তিনি এইসব কথা?
—হ্যাঁ, সব কথা। তবে অবশ্যই লেখার ভঙ্গিটা একটু স্বতন্ত্র ছিল।
—এ আর কতটা স্বতন্ত্র হতে পারে, সুরেশ্বর?
—অনেক অনেক! সত্যকে যখন নির্ভয়ে কেউ প্রকাশ করে, তখন সেই সত্যই তাকে প্রকাশের ভাষা যুগিয়ে দেয়। এসব চিঠিপত্রের কতক ছিল অন্নপূর্ণা-মার কাছে যা তাঁকে লেখা এবং কিছু ছিল বিমলাকান্তের কাছে, যা রত্নেশ্বর রায় পাঠিয়েছিলেন তাঁর কাছে এবং কতক পেয়েছি এই অতিসঞ্চয়ী আশ্চর্যশৃঙ্খলা এবং সত্যবাদী রত্নেশ্বর রায়ের দপ্তর থেকে। তুমি পড়ে দেখতে পার। তবে যে-ক্ষেত্রে কথাটা তোমার গায়ে বা মনে আঘাত দিয়েছে, সেক্ষেত্রে বলার ভঙ্গীর দোষ আমারই হয়েছে। দেবেশ্বর রায় যা লিখেছিলেন, সেইখানটাই তোমাকে আগে শোনাই। তিনি লিখেছেন—“সেই সভাস্থলে ভায়লেট যখন আমার গলদেশে মাল্য পরাইয়া দিল, তখন তাহার গাল দুটিতে রক্তিমাভা ফুটিয়া উঠিল, চক্ষুদ্বয় আনত হইল, আমার বক্ষাভ্যন্তরে যেন মৃদঙ্গধ্বনির মতো ধ্বনি উঠিতে ছিল, আমি কম্পিত হইতেছিলাম, সেও কম্পিত হইতেছিল। এবং তখন হইতেই মনে হইল এই ভায়লেটই আমার জন্মজন্মান্তরের স্ত্রী বা প্রিয়তমা; তাহাকে নহিলে আমি বাঁচিব না। তাই বাড়ী আসিয়া উদ্বিগ্ন-উদ্বেগপূর্ণ হৃদয়ে অসুস্থের মত শয়ন করিয়া রহিলাম। কোন কিছুই ভাল লাগিতেছিল না। রায়বংশের উত্তরাধিকারিত্ব নহে, গোটা সংসারের আর কোন জন আমার কেহ নহে। শুধু ওই ভায়লেট। তাহার জন্য আমি সবই ত্যাগ করিতে পারি। মাতা আমার শিয়রে গোপালদাকে বসাইয়া আপনার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করিতে গেলেন। গোপালদা এক বোতল স্যাম্পেন চুরি করিয়া সরাইয়াছিল সাহেবদের জন্য আনীত সামগ্রী হইতে; সে আমাকে তাহাই খাওয়াইল। অদ্য আর কোন কথাই গোপন করিব না, আমি বৎসরখানেক অবধি মদ্যপান করিতেছি। গোপালদা কখনওই কোন অন্যায় আমাকে শিক্ষা দেয় নাই। আমি প্রলুব্ধ হইয়া যে অন্যায় করিতে চাহিয়াছি, তাহাতে সে আমাকে আনন্দিত এবং খুশী করিতে প্রাণপণ করিয়া আমার অভিলাষ পূর্ণ করিয়াছে।
ভায়লেটের ক্ষেত্রেও তাই হইল, আমি স্যাম্পেন পান করিয়া সকল সংকোচ এবং সকল লজ্জা-সরম অতিক্রম করিয়া বলিলাম —গোপালদা, আমি ওই ভায়লেটকে ভালবাসিয়াছি। উহার জন্য আমার চিত্ত অধীর হইয়া উঠিয়াছে; আমার জীবন মিথ্যা মনে হইতেছে। উহাকে না পাইলে আমি বাঁচিব না। আমি আত্মহত্যা করিব।
গোপালদা আমার জন্য সব করিতে পারে, প্রাণটাও দিতে পারে বলিয়া জানিতাম। সে তৎক্ষণাৎ বলিল—তাহার জন্য চিন্তা তুমি করিও না, আমি ইহার ব্যবস্থা অবিলম্বে করিতেছি।
পরদিন সকাল হইতে সে বাহির হইল। এবং বেলা দ্বিপ্রহর সময় ফিরিয়া আসিয়া কহিল—“রাজাদাদা, তোমার পছন্দ আছে, তোমার চক্ষু আছে, তুমি সত্য সত্যই দেবেশ্বর। সে-কন্যাটি অপর গোয়ান-কন্যার মত নহে। এবং সে সত্যই তোমাকে মনে মনে পতিরূপে বরণ করিয়াছে। আমি একজন দূতীকে তাহার নিকট পাঠাইয়াছিলাম। অর্থের কথায় অতিশয় ক্রুদ্ধা হইয়াছে। সে অর্থ চায় না। সে নিজেকে বিক্রয় করিবে না। একমাত্র ভালবাসার জন্য নিজেকে সমর্পণ করিবে। কিন্তু সন্দেহ করিতেছে যে তোমার নাম করিয়া দূতী তাহাকে লইয়া গিয়া অন্য কাহাকেও সমর্পণ করিবে। অথবা তুমি তাহাকে উপভোগের কারণে লইয়া গিয়া কয়েকদিনের পর উচ্ছিষ্টের মত পরিত্যাগ করিবে। তাহা ছাড়া তুমি রাজা, তুমি ব্রাহ্মণ, সে ক্রীশ্চান গোয়ান, সে দরিদ্র ইত্যাদি। অতএব তুমি তাহাকে একখানি পত্র লিখিয়া দাও। খুব ভাল করিয়া লেখ। লেখ, তুমি তাহাকে ভালবাস। তুমি তাহাকে জীবনে পরিত্যাগ করিবে না। দেখ জমিদার, ধনীর ছেলেদের কত রক্ষিতা ইত্যাদি থাকে; তোমার ঠাকুরদাদার সোফিয়া বাঈয়ের গল্প তো এখানকার সকল লোকে করে। তাহার কথা শুনিয়া ভায়লেটকে আমি আরও ভালবাসিলাম। সঙ্গে সঙ্গে রোমিও-জুলিয়েটের প্রেমের কথা মনে পড়িল। পত্র লিখিতে বসিয়া কয়েকখানা পত্রই ছিঁড়িলাম। মনোমত হইল না। গোপালদা সেই দ্বিপ্রহরেই আমাকে খানিকটা স্যাম্পেন খাওয়াইয়া বলিল- ঘরে বসিয়া লেখ। আমি বাহিরে পাহারা দিতেছি। কেহ আসিলে ঘরে ঢুকিতে দিব না। এই কর্তা বা গিন্নী-মা আসিলে তোমাকে শব্দ করিয়া ইশারা দিব, তুমি তৎক্ষণাৎ বিছানায় শুইয়া পড়িবে। যেন ঘুমাইয়া গিয়াছ। আমি বলিব দেবু-ভাইয়ের মস্তক ধরিয়াছে।”
সুলতার মুখ প্রসন্ন হয়নি। সে অপ্রসন্ন মুখেই সামনের দিকে তাকিয়ে রইল। সুরেশ্বর বললে—দেখ সুলতা, দেবেশ্বর এবং গোপাল পালের সম্পর্কটা ছিল তাদের নিজস্ব সম্পর্ক এবং তাদের যে কাল সেই অনুযায়ী। আমরা তাদের উত্তরাধিকারী, আমাদের সম্পর্ক আমাদের মত। এখানে আমি জমিদারের ছেলে, একজন ইংরেজ সমর্থনকারী ইংরিজী কাগজের এডিটোরিয়েল স্টাফের অন্তর্ভুক্ত পাকা জার্নালিস্টের ছেলে—একসময় আমি ‘বিদায় সত্যাগ্রহ’ বলে স্টেটসম্যানের চিঠির কলমে চিঠি লিখেছিলাম; আমার থেকে আজ তোমার মান বেশী, তুমি এম-এ পাশ, কলেজের প্রফেসর, পলিটিক্যাল পার্টির মেম্বর, তোমাদের পার্টি যদি আগামী ইলেকশনে জেতে, তবে তুমি হয়তো একজন মিনিস্টারও হবে। তখন তুমি যা-হয় করো। কিন্তু এখন আমার জবানবন্দীর এইখানের এইটুকুতে মুখভার করো না। গোপাল পাল আমি বলছি নে সুলতা, ইচ্ছে করেই না; যা করেছিলেন আমার ঠাকুরদাদার জন্যে, তা অন্য কেউ করেনি বা করে না। সেই জাতের কড়াকড়ির কালে নিজের জাত আর এই দুর্ধর্ষ গোয়ানদের হাতে তাঁর জীবন, সব তিনি বিপন্ন করেছিলেন দেবেশ্বর রায়ের জন্য। সে দেবেশ্বরও গোপন করেননি, আমিও করছিনে। অন্যায় কিছু বললে গায়ে তোমার লাগতে অবশ্যই পারে কিন্তু অন্যায় বাড়াবাড়ি করে লাভ কি? শচীন সেনগুপ্তের সিরাজউদ্দৌলা নাটকে এক জায়গায় নবাব ‘সিরাজউদ্দৌলা’ ওয়াটসকে বলছেন—তোমার যা চরিত্র, তাতে তোমার মাথা মুড়িয়ে ঘোল ঢেলে গাধার ওপর চড়িয়ে গোটা শহর ঘুরিয়ে বের করে দেওয়া উচিত দেশ থেকে। দেখ, নবাবীকালের অভিনয় হচ্ছে বলে এটা ইংরেজ রাজত্বে ইংরেজও সহ্য করেছে। স্বাধীনতার পর অবশ্যই আমরা সবাই স্বাধীন সবাই প্রধান- ভারতও জেগেছে, কিন্তু জেগেছে বলে এমন অসহিষ্ণু হয়ো না। আমি তোমাকে বলছি, হলপ করেই বলছি, যা বলব তাতে দেবেশ্বর রায় থেকে গোপাল পাল এবং তাঁর বাপ ঠাকুরদাস পালই বড় হয়ে গেছেন রায়বাবুদের চেয়ে। শুধু চুপ করে শোন।
***
দেবেশ্বর রায় পত্র লিখে দিয়েছিলেন গোপালদার হাতে। এবং পরের দিন দিনের বেলা গোপালদা বলেছিলেন—চল আমার সঙ্গে। বন্দুক নাও। শিকার করতে যাচ্ছ। বুঝেছ? ভায়লা আসবে ওই সিদ্ধেশ্বরীতলার জঙ্গলে। ওখানে তো গোয়ান-টোয়ানরা কেউ আসে না। বারণ আছে। ওখানে একটা ভাঙা পড়ো বাড়ীর মত আছে, কে একজন তান্ত্রিক থাকত একজন যোগিনী নিয়ে। সেই বাড়ীটা আমি পরিষ্কার-ঝরিষ্কার করিয়ে রেখেছি। ভায়লাকে সিদ্ধেশ্বরী মায়ের কবচ বলে একটা কবচ পাঠিয়ে দিয়েছি, বলেছি, এই কবচ পরলে কোন ভয় নাই। সে নিয়েছে কবচ, ঠিক আসবে।
সুরেশ্বর হঠাৎ চুপ করে গেল। তারপর ঘাড় নেড়ে হয় আক্ষেপ বা ব্যঙ্গ করে বললে-এ সেই শ্যামাকান্তের ভাঙা ঘর। সে ঘরে ‘মনোহরা’ যোগিনী বলে ব্রাত্য মেয়েটাকে নিয়ে সে বামাচারী সাধনা বা সাধনার নামে কদাচার ব্যভিচার যা বল তাই করেছিল। এ ঘরে লোকজন ঢুকত না। প্রথম ছিল একটা ছিটেবেড়ার ঘর, তারপর শ্যামাকান্তের পর সোমেশ্বর রায় কিছুদিন ওই মনোহরা মেয়েটাকে নিয়ে ওখানে যেতেন। তখন কাদা দিয়ে পাকা ইট গেঁথে একখানা ঘর তৈরী করিয়েছিলেন। এবং সাধনার শিমূল গাছটির তলাটাও সুন্দর ক’রে দিয়েছিলেন। বীরেশ্বর রায় ঘরখানাকে ভেঙে ফেলতে ইচ্ছে করেও পারেননি। সোমেশ্বর রায়ের যে দলিল তাতে এই ঘর এবং সিদ্ধেশ্বরীতলা রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা করা ছিল। ভবানীর পরিচয় এবং শ্যামাকান্তের জীবনের বিচিত্র কথা জানার পর বীরেশ্বর রায় ওই শিমূলতলা এবং ওই ঘরখানাকে মেরামত করিয়ে শ্যামাকান্তের মৃত্যুদিনে পূজার ব্যবস্থা করেছিলেন। সেও তিনি দলিলভুক্ত করে তার জন্য আর্থিক সংস্থান ক’রে দিয়ে গেছেন। সে সংস্থান আজও বজায় আছে। কিন্তু কোন অনুষ্ঠান আজ আর হয় না। তার জন্য রায়বংশের কেউই চিন্তিত নয়। সিদ্ধেশ্বরীতলার সিদ্ধাসনের কোন গৌরব কোন পবিত্রতাই ছিল না। আমি সেখানে একটা কিছু করে এসেছি। সে যথাসময়ে বলব, সুলতা। এখন সেদিনের কথা শোন। সেই দিন সেই ঘর পরিষ্কার করিয়ে রাখিয়েছিলেন গোপাল পাল। সেই ঘরে তাঁর প্রাণের প্রিয় দেবুভাইয়ের প্রথম বাসরশয্যা হবে।
রত্নেশ্বর রায় সিদ্ধেশ্বরীতলার একটি সংস্কার করেছিলেন। তিনি একটা গণ্ডী এঁকে দিয়েছিলেন চারিদিকে, মধ্যে মধ্যে এক একটা পিপে গেঁথে দিয়ে বলে দিয়েছিলেন এর ভেতরে যেন কোন গোয়ান বা কোন ব্রাত্য প্রবেশ না করে। এর বাইরে একটা জায়গা ছিল সেটা রত্নেশ্বর রায়ই তৈরী করিয়ে দিয়েছিলেন, যেখানে গোয়ানরা বা ব্রাত্যরা ইচ্ছে হলে পুজো বা মানত মানসিকের অর্ঘ্য দিতে পারে।
এই গণ্ডীর মধ্যে ভায়লেটকে আসতে রাজী করানো সহজ কথা ছিল না। তার ব্যবস্থা সুকৌশলেই বল আর আপন বিশ্বাসমতই বল—করেছিলেন দেবেশ্বরের গোপালদা। প্রথম পাঠিয়েছিলেন সিদ্ধেশ্বরীর কবচ। তাই গলায় ঝুলিয়ে প্রেমমুগ্ধা কিশোরী ভায়লেট—সে এসে দাঁড়িয়েছিল ওই গণ্ডীর প্রান্তে। দেবেশ্বর অপরাহ্ণের আগে থেকেই বন্দুক হাতে করে ওই সিদ্ধেশ্বরীতলার জঙ্গলের প্রান্তে প্রান্তে শিকারের ছল ক’রে ঘুরে বেড়াচ্ছিলেন। তারপর একসময় ক্লান্তি অপনোদনের ছলে জুতো খুলে সিদ্ধেশ্বরীতলার গণ্ডীর মধ্যে ঢুকে বসে উৎকণ্ঠিত হৃদয়ে জীবনের প্রথম প্রিয়া বা নারী যাই বল তার জন্য প্রতীক্ষা করছিলেন। সূর্য তখন পাটে বসেছে, লগ্ন বলতে গোধূলি লগ্ন, সেই লগ্নে কম্পিত পদক্ষেপে অভিসারিকা ভায়লেট এসে দাঁড়িয়েছিল ওই সীমার, প্রান্তভাগে।
দেবেশ্বরও কম্পিত পদক্ষেপে এসে দাঁড়িয়ে তার হাত ধরেছিলেন। দেবেশ্বর রায়ের গোপালদা দিয়েছিলেন নববিধান। দু’গাছা ফুলের মালা—ওই গাঁদাফুলেরই মালা গেঁথে এনেছিলেন এবং বলেছিলেন—নাও মালাবদল ক’রে বিয়ে ক’রে নাও। আর এই সিদ্ধেশ্বরী মায়ের সিঁদুর—ওর সিঁথিতে ছুঁইয়ে দাও। আর ভায়লেটকে বলেছিলেন—তুমি মনে মনে বল—বিয়ে ক’রে আমি হিন্দু হলাম—বল!
বিচিত্র ভাগ্যের বিধান নয়, সুলতা? অন্তত আমার কাছে তাই। আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি শ্যামাকান্তের কর্মফলের চক্রান্ত ওই সিদ্ধাসনের পাশে ওই বিকৃত আচারে ধর্মের নাম ক’রে ব্যভিচারের জন্য সোমেশ্বর রায়ের তৈরী করা ঘরের মধ্যে ব্রাহ্মণ জমিদারসন্তান এবং ক্রীশ্চান মেয়ে ভায়লেট ওইভাবে ধর্মের নাম ক’রেই সমাজ লোকাচার ধর্ম সব কিছুকে লঙ্ঘন করে প্রথম মিলিত হয়েছিল!
—না-না-না। বাধা এখন দিয়ো না। তুমি যা বলবে তা আমি জানি এবং তা আমি মানি। তোমার থেকেও হয়তো আরও বেশী উদার আমি, সুলতা। তোমরা রাজনৈতিক কর্মী, সংসারে লোকেদের সামনে নিজেকে তোমাদের শুদ্ধ পবিত্র এবং পরিচ্ছন্ন চরিত্রবান মানুষ বলে প্রমাণিত করতে হয়। আমি মানি, লোকাচার সমাজ ধর্ম এসব থেকেও হৃদয়ের অকৃত্রিম আকর্ষণ মিলনের আকুতি অনেক বড়। অনেক বড়। রামী চণ্ডীদাসের মত ভাঙ্গতে পারলে তা স্বর্গীয় হয়। ভাঙেও অনেক। ভেঙে হয়তো সমাজ থেকে নির্বাসিত হয়ে লোকের দ্বারা বর্জিত হয়ে ধর্মের ধ্বজাধারীদের দ্বারা নির্যাতিত হয়ে পথের পাশে প’ড়ে মরে। অনেক সময় পুরুষ অত্যাচার সইতে না পেরে একদিন নারীটিকে পথে ফেলে দিয়ে দাঁতে কুটো ক’রে ফিরে আসে ঘরে। সমাজ যৎকিঞ্চিৎ কাঞ্চনমূল্যের বিনিময়ে প্রায়শ্চিত্ত করিয়ে তাকে ফিরিয়ে নেয় কিন্তু মেয়েটাকে চলে যেতে হয় হারিয়ে, কোথায় কেউ খোঁজ রাখে না। হয়তো দেহটাকে সম্বল করে পথে নেমে যতদিন দেহটা থাকে ততদিন কোন রকমে খায়-দায়, মদ খেয়ে পাগলের মত হাসে দেহব্যবসায়িনীর জীবনযাপন করে। তারপর একদিন মরে এবং সেদিন তারই মত জনকয়েক ভাগ্যহতা হতভাগিনী হরিধ্বনি দিয়ে কাঁধে করে নিয়ে যায় শ্মশানে, পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে আসে। মুসলমান বা ক্রীশ্চান হলে কবরে যায়। তবে মুসলমান এবং ক্রীশ্চান ধর্মের এখানে নারীর পক্ষে একটা উদারতা আছে, যে উদারতাকে আমি শ্ৰদ্ধা করি প্রশংসা করি, তার কাছে মাথা নোয়াই। মানুষের আত্মার পরিশুদ্ধির জন্যই নীতি তৈরী করেছে ধর্ম, আত্মাকে ধ্বংস করবার জন্য, মানুষকে হত্যা করবার জন্য নীতি তৈরী হয় নি। এমন নীতি দুর্নীতি, চণ্ডনীতি, জীবনে ধ্বংসনীতি।
* * *
—এক গ্লাস জল!
—তুমি অত্যন্ত উত্তেজিত হয়েছে সুরেশ্বর। বলে সুলতা ডাকলে—রঘু—রঘু! তোমার বাবুর জন্যে এক গ্লাস জল নিয়ে এস।
সুরেশ্বর তার মাথার লম্বা চুলগুলো পিছন দিকে ঠেলে আঙুল চালাতে চালাতে বললে—তা হয়েছি সুলতা। তুমি আঘাত দিয়েছ আমাকে। হয়তো তুমি বলবে-আঘাত তুমিই আমাকে আগে দিয়েছ, তা হলে বলব-না-না-না। তা দিই নি। নিজে ইচ্ছে করে তুমি নিজের মনে নিজে আঘাত করে আমার নামে অপবাদ দিচ্ছ।
জল নিয়ে এসে যে দাঁড়াল সে রঘু নয়, সে অৰ্চনা।
—অৰ্চনা! তুই এখনও জেগে রয়েছিস?
—রয়েছি। পাশের ঘরেই ছিলাম। ওই কুড়ারাম রায়ের পাঁচালীটা পড়ছিলাম। আর তোমাদের কথাও শুনছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে এও ভাবছিলাম, শত দুঃখকষ্ট নানান অভাব নানা ঝঞ্ঝাটের মধ্যেও ভাঙা বাড়ীতে বাস করত রায়েরা, বাঙলাদেশের জমিদারেরা—তারা কি সবাই তোমার মত এমনি করে পাগল হয়ে গেল? না ফাঁসির আসামীর মত রাত্রি জেগে সেলের মধ্যে বসে আছে!
গ্লাসের জলটা নিঃশেষে পান ক’রে সুরেশ্বর বললে-কে কি করছে তা জানিনে, তবে এইটুকু বলতে পারি যে অধিকাংশ জমিদারই তো আজ দেউলে এবং আজ তারা সবাই প্ৰায় এ অচলায়তন ভেঙে বেরুতে চায়। অনেক আগেই অনেকজনে এ থেকে বেরিয়ে এসে জীবনসমুদ্রে নতুন স্টীমলঞ্চ ভাসিয়ে জমিদারী বজরাটাকে গাধাবোটের মত পিছনে বেঁধে দিয়েছেন। আজ যদি শান্তির ব্যাঘাত ঘটে থাকে তবে এঁদেরই ঘরে। নইলে পাড়াগাঁয়ের ছোটখাটো অসংখ্য জমিদার নিশ্চিন্তে নিদ্রা যাচ্ছে। তারা খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসে মুক্ত আলো হাওয়ায় দাঁড়িয়ে বাঁচবে। কিন্তু সে সব কথা থাক। যা বলছিলাম তাই বলি। তুই কি এখানে বসবি অর্চি, না—
—বসলে আপত্তি কি অসুবিধে হবে না তোমাদের?
—আমার হবে না। আমার যখন হবে না তখন সুলতারও হবে না। কারণ বাধবার কথা সংকোচ হবার কথা যে বলে যে কনফেসার তার। যে শোনে তার নয়।
তারপর সে সুলতার মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে—সুলতা?
হেসে সুলতা বললে-আমি অনেকক্ষণ আগেই অর্চনাকে বলেছিলাম—আপনিও এসে বসুন না! প্রথম রান্না করতে গেলেন। তারপর—
চুপ ক’রে গেল সুলতা; মনে পড়ে গেল খেতে বসে কথাপ্রসঙ্গে যে অপ্রিয় কথা উঠে খাওয়ার আনন্দ নষ্ট করে দিয়েছিল সেই কথাটা।
আবার শুরু করলে সুরেশ্বর, বললে-রায়বংশের অপরাধ আমি খুঁজে খুঁজে জমা করে পাহাড় করেছি। তার মধ্যে জমিদার হিসেবে নালিশ মকদ্দমা সত্য মিথ্যা অনেক করেছি। রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর অঙ্ক কষে প্রজাকে ঘায়েল করতেন। জোতদার যখন বড় হয়ে উঠেছে সম্পন্ন হয়ে উঠেছে তখন তাকে ডেকে সমাদর করেছেন, প্রয়োজনমত আরও বড় এবং সম্পন্নতর হবার জন্য ঋণ দিয়েছেন। খাজনা বাকী ফেলেছেন এবং পরে সব জমে যখন পাহাড় হয়েছে তখন নালিশ ক’রে তার বুকে পাহাড় চাপিয়ে তাকে শেষ করে দিয়েছেন। আবার উল্টোও হয়েছে, যারা ঋণ নেয় নি তাদের কোথায় কার কাছে ঋণ আছে খোঁজ ক’রে হ্যান্ডনোট তমসুদ কিনে নালিশ করেছেন। জিতেছেন সর্বত্র তা নয়; বহু ক্ষেত্রেই হেরেছেন। কিন্তু হেরেও তো তিনি হারতেন না, মুনসেফ কোর্টে হেরে সবজজ কোর্ট জজ কোর্ট সেখান থেকে হাইকোর্টে আপীল করতে করতে এগিয়ে চলেছেন, পিছনে পিছনে প্রজাকে হাঁটতে হয় বাধ্য হয়ে। ক্লান্ত পদক্ষেপে নিঃস্ব এবং রিক্ত অবস্থায় হয়তো হাইকোর্ট থেকেও জয়ধ্বজা হয়ে বাড়ী আসতে আসতে ভেঙে পড়ে গেছে। এমন অনেক অনেক আছে। এদের দেনা শোধ করা আজ আর রায়বংশের কারুর পক্ষে সম্ভবপর নয়। সর্বস্বান্ত হয়েও নয়।
কিন্তু রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর থেকে দেবেশ্বর রায় পর্যন্ত সারাজীবন অবনত মস্তকে ঠাকুরদাস পাল আর গোপালদাস পালের ঋণ ভালবাসা স্বীকার করে গেছেন। আমি তাও জানি এবং তোমার সঙ্গে গোপালদাস পালের সম্পর্কও জানি, সে মনে রেখেই আমার মন্তব্য করে রেখেছি। আজ যদি গোপালদাস পাল এসে আবির্ভূত হন এখানে তবে তোমার কথায় প্রতিবাদ করেই বলবেন—তুই জানিস নে সুলতা, দেবু রাজাভাই আমার কি ছিল আর আমি তার কি ছিলাম, সে আমার জন্যে কি করেছে তা তুই জানিস নে। আর দেবু রাজাভাই যে কি মানুষ ছিল তাও তুই জানিস নে। তুই চুপ কর।
সুলতা হেসে বললে—বেশ, তাই মেনে নিলাম। বল তোমার কথা।
—হ্যাঁ দেবেশ্বর রায়, ষোল বছরের দেবেশ্বর রায় বিচিত্রভাবে এই শ্যামাকান্তের সিদ্ধাসনে সিদ্ধেশ্বরীতলায় যেখানে তিনি তাঁর জীবনের অভিশপ্ত নারীসাধনা আরম্ভ করেছিলেন, সেইখানেই পাতলেন জীবনের প্রথম বাসর। মিলিত হলেন প্রথম এক ক্রীশ্চান কুমারীর সঙ্গে। ক্রীশ্চান কুমারী অঞ্জনার কন্যা। রায়বাহাদূর রত্নেশ্বর অঞ্জনার প্রতি তাঁর গোপন প্রেমের ঋণশোধের অভিপ্রায়ে ক’দিন আগে চার্চের সংস্কার করে স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছেন তাকে শিক্ষিত করে তুলবেন বলে! একটি কুমার এবং কুমারীর সে বাসরসন্ধ্যার কথা উহ্য থাক। তা কল্পনা করবারও আমার অধিকার নেই। দেবেশ্বর রায় যে পত্রে এসব কথা নির্ভয়ে দ্বিধাহীনচিত্তে তাঁর বাঘের মত বাপকে খুলে লিখেছেন তাতে শুধু ওই কথাটুকুই আছে।
“সেদিন সন্ধ্যায় গোপালদার ব্যবস্থায় আমরা উভয়ে ওই গৃহে’র মধ্যে মিলিত হইলাম। এবং ইহার পর অসুখের অজুহাতে যে কয়েকদিনই ওখানে থাকিয়াছি—নিত্যই নিয়মিতভাবে মিলিত হইতাম। গোপালদাদার ব্যবস্থা মত সময়টা পরিবর্তিত হইত, কোন দিন সন্ধ্যায়, কোন দিন দ্বিপ্রহরে কোনদিন বা গভীর রাত্রে সেখানে যাইতাম। ভায়লেটও আসিত। আমরা সর্বপ্রকারে পরস্পরের নিকট প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হইয়া গভীর ভালবাসায় আবদ্ধ হইলাম।”
***
ষোল বছরের এক ধনীপুত্র এবং এক চতুর্দশী ক্রীশ্চান কন্যা। অর্ধশ্বেতাঙ্গিনী দরিদ্র অসহায় অনাথ। অবস্থাবৈগুণ্যে বাংলাদেশের পল্লীতে প্রায় দেশীয় ক্রীশ্চানদের সঙ্গে বাস করে। কথাটা গোপন ছিল না–থাকবার কথা নয়। কিন্তু দেবেশ্বরের গোপালদা দেবেশ্বরকে এমন ভাবে নিজের আড়ালে ঢেকে রেখেছিলেন যে, যে কানাঘুষোই উঠেছিল ক’দিনে সেটার মধ্যে দেবেশ্বরকে কেউ ধরাছোঁয়ার মধ্যে পায় নি, পেয়েছিল গোপালকেই। কিন্তু গোপালদাসকেও রত্নেশ্বর রায় কম ভালবাসতেন না। তাঁর কাছে সে কম প্রশ্রয় পেতো না।
দেবেশ্বরের সে সঙ্গী ছিল, যা দেবেশ্বর খেয়েছে সেও তাই খেয়েছে, পরার কথাটা ঠিক বলতে পারব না, তবে গোপালদাস সে আমলে যে কাপড়জামা পরেছে তা অন্তত ঠাকুরদাস পালের যোগাবার সাধ্য ছিল না। ঠাকুরদাস রত্নেশ্বর রায়ের ছেলেবেলার আদরে ঠাকুরা, তাঁর প্রাণরক্ষাকর্তার ছেলে সে; তার দ্বিতীয় বিবাহ হয়েছে তাঁর বিবাহের সঙ্গে, তাকে তিনি ভালবাসতেন কিন্তু তাঁর সৎকর্মে বিরুদ্ধাচরণের জন্য তিনি তার উপর বিরূপ হয়েছিলেন। ঠাকুরদাসের ‘ঘি দিয়ে ভাজ নিমের পাত—নিম না ছাড়েন আপন জাত’ এই কটূ-কথা তাঁর কানে গিয়েছে, তিনি সহ্য করেছেন। তিনি তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন সে আসে নি, তাও তিনি কিছু বলেন নি। মনের ক্ষোভ মনেই চেপে রেখেছিলেন। কিন্তু তার জন্য গোপালের উপর বিরূপ কোন দিন হন নি তিনি। তার পরিচয় রায় বংশের জমাখরচের খাতার মধ্যে আছে। চিঠিপত্রের মধ্যেও আছে।
বিরূপ হলেন এইবার। পিড়ু এসে জানালে গোপালদাস তাদের পাড়ায় ঘোরাফেরা করে, তার ভাবভঙ্গি দেখে লোকে তার সঙ্গে ভায়লেটের নাম জড়িয়ে পাঁচ কথা বলছে। ভায়লেট পিডুজের নিজের কেউ নয়, তবু সে তার সম্পর্কিত কাকা আলফাসোর মেয়ে, তার উপর খোদ রায়হুজুর তার ভার নিয়েছেন, তার জন্য এত করছেন। পাদরী সাহেব এনে ইস্কুল বসিয়েছিলেন, তার পিছনে গোপাল লেগেছে এ নালিশ সে জানিয়ে যাচ্ছে।
কথাটা নিয়ে ভাবছিলেন রত্নেশ্বর নায়। কিন্তু খুব বেশী কিছু একটা করেননি, শুধু কলকাতার নায়েবকে লিখে দিয়েছিলেন —“গোপালের উপর কিঞ্চিৎ লক্ষ্য রাখা প্রয়োজন। তাহার স্বভাবচরিত্র মন্দ হইতেছে কিনা এ বিষয়ে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখিবেন। এবং তাহাকে বলিবেন—এখানে তাহার নামে কিছু মন্দ কথা লোকে আমার নিকট বলিয়াছে। আমি তাহা বিশ্বাস করি নাই। তবে তাহার সাবধান হওয়া উচিত বলিয়াই আমি তাহাকে নির্দেশ দিতেছি।”
এদিকে নবীন দুটি প্রাণ পরস্পরের জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। এত ব্যাকুল যে অদর্শন আর সহ্য হচ্ছিল না। কিন্তু ভায়লেটের করবার কিছু ছিল না। কি করবে সে? সে কাঁদত।