কীর্তিহাটের কড়চা – ৩য় খণ্ড – ১১

১১

সুরেশ্বর থামল এইখানে। একটা সিগারেট ধরিয়ে কটা টান দিয়ে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললে। তারপর বললে—১৯৩৭ সালে সেদিন রত্নেশ্বর রায়ের ডায়েরীর ঠিক এইখানে এইভাবেই থেমেছিলাম সুলতা। মনে হয়েছিল পরলোক যদি থাকে তবে সেখানে ভবানী দেবীর আত্মা আজ কি বলছেন, কি করছেন?

একটা ছবি মনে রূপ নিয়েছিল এক মুহূর্তে।

মনে মনে অনেক সময় এমন হয়। মনের প্রশ্নের উত্তর ঝট করে একটা ছবি হয়ে জেগে ওঠে।

ঠাকুরদাস পালের মৃত্যু-বিবরণ পড়ে তোমার এমনি একটা ছবি ভেসে উঠেছিল মনে। প্রশ্ন জেগেছিল—একথা যখন জানবে সুলতা তখন সে কি করবে? কি বলবে?

যে ছবিটা জেগে উঠেছিল সেটা আজ মনে করতে পারি। তুমি যেন স্থির বিস্মিত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছ আর দুটি জলের ধারা চোখের কোণে টলটল করছে। নেমে ঝরে পড়বে বলে।

তেমনি সেদিন ভবানী দেবীর যে ছবিটা মনে জেগেছিল, সেটা কতবার ভেবেছি আঁকি কিন্তু আঁকা হয় নি। ভবানী দেবী যেন দু’হাতে মুখ ঢেকেছেন লজ্জায় অনুশোচনায়।

আমার কানের কাছে গুঞ্জন করে উঠেছিল অর্চনার কথাগুলি। বিমলেশ্বর কাকার স্ত্রীর কাছে যে কথাগুলি ওবেলা শুনেছিলাম, সেই কথাগুলি। “রাজরাজেশ্বর কি রায়বাড়ীর পেয়াদা, না মাকালী তাতারিণী প্রহরিণী যে দিনরাত তোমাদের হুকুম তামিল করবে?”

সেইদিন আমি কীর্তিহাটের রায়বাড়ীর খাঁটি মালিক, জমিদারবংশের সন্তান, খাঁটি জমিদার হয়ে উঠলাম। স্থির করলাম, এর শোধ আমি নেবই নেব। গোপাল সিংয়ের পৌত্র দফাদার হরি সিং, তাঁর ছেলে শিবু সিং। তাকে শাস্তি দিতে গিয়ে বিমলেশ্বর কাকা পারলেন না। উল্টে অপমানের বোঝা ভারী হল। এর শোধ আমি নেব।

বীরেশ্বর রায় তাঁর স্ত্রীর অনুরোধে যে ভুল করেছিলেন, সে ভুলের সংশোধন করব। গোপাল সিং সেদিন ভোরবেলা কালী মন্দিরের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে হাত জোড় করে বলেছিল—মাইজী, আপনেকে আমি খারাব বাত বলেছি, আমার পুরা সাজা হইয়েছে। ছোটা হুজুরকে আমি পোড়ায়ে মারবার জোগাড় করেছিলাম, তার ভি সাজা হামার মিলিয়েছে। দুনিয়া তিতা হয়ে গেলো মাইজী। পাপী, হমি বহুৎ পাপ করিয়েছি মা! হামার সাজা হইয়েছে। আমাকে মাফ্ করেন মা, আমাকে মাফ্ করেন আপনে!

ভবানী দেবী একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলেছিলেন—কিন্তু তোমাকে তো শাপশাপান্ত আমি করি নি বাবা!

—না মাইজী, আপনে দেবী, সাখাৎ দেবী। সে আমি জানে। তবু ভি বলেন—মাফ্‌ করলেন! বুক আমার পুড়িয়ে গেলো মাইজী। খাক হইয়ে গেলো!!

ভবানী দেবী বলেছিলেন—মাফ তোমায় করেছি, তোমার স্ত্রীকে মায়ের সামনে কথা দিয়েছি। তবু তুমি যখন বলছ, তখন আবারও বলছি, এই মায়ের সামনে বলছি—মাফ তোমাকে করলাম।

—মাইজী, আমার ইজ্জত—

—বেশ। সে কথাও দিচ্ছি গোপাল। বেইজ্জত তোমার হবে না। তবে কর্তাবাবু যা বলেছেন তা শুনেছ তুমি?

—হ্যাঁ মা।

—বেশ; বেইজ্জত তুমি হবে না। পুলিশের হাত থেকেও তুমি বাঁচবে। সে সব ব্যবস্থা আমি করেছি বাবা। তোমার স্ত্রীকে কথা দিয়েছি বলেই নয়, তোমার কৃতকর্মের এই ভয়ঙ্কর ফল দেখে আমি কেঁদেছি। তোমাদের ছোট হুজুরের বিয়ে হচ্ছে। বিয়ে হচ্ছে এ জেলার সদরের ডেপুটি সাহেবের মেয়ের সঙ্গে। আমি তাঁকে বলেছি-তিনিও আমাকে কথা দিয়েছেন। তুমি বেঁচেছ। তিনি বাঁচিয়েছেন।

গোপালকে তিনিই বাঁচিয়েছিলেন। বেইজ্জত হয়নি, কটু কথাও বলেন নি বীরেশ্বর রায়। এতটার কারণ বোধহয় দেওয়ান আচার্যের ওই চিঠি। আচার্যকে অপদস্থ করবার জন্যই তিনি এতটা করেছিলেন। প্রথম ক’দিন বীরেশ্বর রায় গোপালের সঙ্গে দেখাও করেন নি। তাকে থাকতে দিয়েছিলেন, দু-মহলা প্রকাণ্ড অন্দরের এক প্রান্তে চাকরদের ঘরে।

রায়বাড়ীতে তখন রায়বংশের লোক মাত্র তিনজন। কর্তা, গৃহিণী এবং পুত্র। আত্মীয়স্বজন যারা বারো মাস থাকত, তাদের সংখ্যা তখন দশজন। উৎসব উপলক্ষ্যে আরো অনেক আত্মীয় এলেও মোটমাট চল্লিশের বেশী হয়নি। বাইরের লোকজনের সামনে যাতে গোপালের অপমান না হয়, যাতে দেওয়ান আচার্যের হাত সহজে না পৌঁছায় তারই জন্য স্থান দিয়েছিলেন বাড়ীর ভিতরে।

রত্নেশ্বর রায়ের ডায়রিতে আছে—“পিতৃদেবের দূরদর্শিতায়, আশ্চর্য বুদ্ধিতে আমি নিত্য চমৎকৃত হইতেছি। অন্দর মহলে গোপাল সিং ও তদীয় পত্নী পুত্রকে স্থান দেওয়া আমার মনোমত হয় নাই। তাঁহাকে একথা নিবেদন করিতেই তিনি বলিলেন—তুমি এখনো বালক রহিয়াছ। তুমি দেওয়ান আচার্যকে সম্যক চিনিতে পার নাই। দেওয়ান আচার্য না পারেন এমন কর্ম নাই। অন্যত্র রাখিলে তিনি সহজেই তাঁহার প্রতিজ্ঞা পূর্ণ করিতে পারিবেন। আমি চমৎকৃত হইলাম। এ কথা আমার মনে হয় নাই। তিনি বলিলেন—রবিনসন সাহেবকে যে সুন্দর সুকৌশলে পর্তুগীজ স্ত্রীলোকের দ্বারা বশীভূত করিয়া এক পর্তুগীজ দ্বারাই শেষ করিল, তাহা স্মরণ কর। এখানে আর কোন ব্যক্তির সহিত বিবাদ করাইয়া দশ-বিশজন লোক দ্বারা তেমন কিছু করিলে কি করিবে!”

রাজকর্মচারীরা বিদায় নিয়েছিলেন পরের দিন। সদর এস-ডি-ও রত্নেশ্বর রায়ের ভাবী শ্বশুর আরো একদিন ছিলেন। বিবাহ পাকাপাকি স্থির হয়ে গেলে তিনি গেলেন।

রাধারমণবাবুর সামনেই গোপালকে ডেকে তিনি তাকে বলেছিলেন—রায়বাড়ীর গিন্নিমা তোমাকে ক্ষমা করেছেন। তোমার সে সব অপরাধের কথা আমি তুলব না। তোমার নিজের শাস্তি তুমি নিজে নিয়েছ, কিংবা ভগবান দিয়েছেন, তার ওপর আমার হাত নেই। এখন শোন, যা বলছি। একথা তোমার স্ত্রীকে বলেছি। সে রাজী হয়েই মেনে নিয়েছে। বীরপুরের তোমার জোতজমায় বেশিরভাগ জবরদখল। সে সমস্ত তোমাকে ইস্তফা দিতে হবে। যা তোমার নিজস্ব, তা পাবে তোমার বড় ছেলের ছেলেরা আর তোমার বড় স্ত্রী। বীরপুরে তুমি বাস করতে পাবে না। তোমাকে বাস করতে হবে নতুনহাটে, কীর্তিহাটের পাশেই, নতুন গ্রাম পত্তন করেছি সেখানে। সেখানে তোমাকে দশ বিঘে জমি, একটা বাড়ী, একটা খিড়কীর ডোবা—এই তোমাকে দেব, পাইকান বন্দোবস্ত করে। রায়বাড়ীর কাছারীতে তোমাকে রোজ সকালে আসতে হবে। সেলাম দিয়ে যাবে। দুরে চোখের বাইরে তোমাকে যেতে দিতে পারব না। রায়বাড়ীর ক্রিয়াকর্মে এ বাড়ীতে আসবে, মোতায়েন থাকবে, রাজী আছ?

গোপাল চুপ করেই থেকেছিল, সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিতে পারে নি।

রাধারমণবাবু বলেছিলেন-নীচে আমার দারোগা হাজির আছে। রাজী থাকিস তো বল। না থাকলে দারোগা নিজের কাজ করবে।

গোপাল রাধারমণবাবুর দিকে তাকিয়েছিল, সে তাঁকে চিনত না; তার কপালে ভ্রুকুটি জেগেছিল।

বীরেশ্বরবাবু বলেছিলেন—উনি মেদিনীপুরের এস-ডি-ও।

গোপাল এবার মাথা হেঁট করে বলেছিল—জান যখন ভিখ মেঙেছি হুজুর, তখন বিলকুল মেনে লিয়েছি।

একটু চুপ করে থেকে আবার বলেছিল—হ্যাঁ। আপনি আমাকে বাঁচাইলেন। বীরপুর ঢুকবার মুখ আমার নাই। আর আপনের তাঁবেদারি ছাড়া দুসরা কোন কাম—সেও ভি আমি পারবে না। বিলকুল মেনে নিলাম।

বীরেশ্বর রায় বলেছিলেন—হ্যাঁ। আমার তাঁবেদারি ছাড়া তুমি কোথাও গিয়ে বাঁচবে না। দেওয়ানজীর হাত থেকে।

বলেই তিনি থেমে গিয়েছিলেন। চাকরকে ডেকে বলেছিলেন—দেখ ছোট নায়েব কাগজপত্র নিয়ে ওপাশে বসে আছে। ডাক তাকে।

নায়েব এলে বলেছিলেন—কাগজপত্রে টিপছাপ নিয়ে নিন।

সুরেশ্বর বললে-সুলতা, গোপাল সিংকে রক্ষা করতে গিয়ে, হারাতে হল দেওয়ান গিরীন্দ্র আচার্যকে।

আচার্য দেওয়ান পরের দিনই এসে বলেছিলেন—আমার বয়স হল বাবা; এদিকে তোমাদের সংসারেও আর ঝঞ্ঝাট-ঝামেলা নাই। ছোটবাবু ভায়া এরই মধ্যে বেশ বুঝে নিয়েছেন, তীক্ষ্ণবুদ্ধি। এবার আমি ছুটি চাচ্ছিলাম।

বীরেশ্বর রায় বলেছিলেন—রত্নেশ্বরের বিয়ে বৈশাখে। এই সময় কি আপনার যাওয়া চলে?

গিরীন্দ্র আচার্য বলেছিলেন—বেশ; তারপর যেন আমাকে আর বেঁধে রেখো না বাবা। শরীর বড় ভেঙেছে আমার।

বীরেশ্বর অবলীলাক্রমে বলেছিলেন—না। ১লা জ্যৈষ্ঠ অষ্টম। ২রা জ্যৈষ্ঠ আপনি খালাস। আপনাকে আটকানো উচিতও হবে না। কারণ রত্নেশ্বর আপনাকে নিয়ে ঠিক চলতে পারবে না। আমার সঙ্গেই ওর সব মত মেলে না। কাল রাধারমণবাবুর সঙ্গে কথা হচ্ছিল। এই গোপালের কেস নিয়ে কথা। উনি বলেছিলেন—বীরেশ্বরবাবু, এ পথে জমিদারী চালানো আর যাবে না। ইংরেজ জাত বড় কঠিন জাত। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পাওয়ার। কিন্তু ওরা আইনকে বড় মানে। বিচারের সময় জজেরা ইংরেজ গভর্নমেন্টেরও খাতির করে না। জমিদারীর ধারা পাল্টান মশাই! রত্নেশ্বর বললে—আমি তো প্রতিজ্ঞা করেছি, বে-আইনী প্রজাশাসন—এ আমি কীর্তিহাট এস্টেট থেকে তুলে দেব। আপনার সঙ্গে ওর বনবে না। আমি ভাবলাম, আমিও হস্তক্ষেপ করব না, আপনাকেও বলব, দেওয়ান কাকা, এবার আমাদের সব ছেড়ে দিয়ে বসে বসে দেখাই ভাল। তা আপনি নিজেই বলছেন।

সুরেশ্বর বললে—গোপাল সিংয়ের কথা এখানেই শেষ। গোপাল সিং এরপর বেঁচে ছিল কম দিন না, দশ বছর। ১৮৬৯ সালে রত্নেশ্বরের ডায়রীতে আছে—“আজ গোপাল সিং মারা গেল। এস্টেটের একজন হিতৈষী লোককে হারাইলাম। লোকটি অতীতকালে যাহাই করিয়া থাক, শেষ জীবনে সে সত্য সত্যই সজ্জন ব্যক্তি হইয়াছিল; মদ্যপান ছাড়িয়া দিয়াছিল, বৈষ্ণব হইয়াছিল। কীর্তন শুনিতে শুনিতে প্রেমাশ্রু বিসর্জন করিত। অনুতাপ করিত। নেশার মধ্যে গঞ্জিকা সেবন করিত, কিন্তু তাহাতে তাহার ক্ষতি হয় নাই। অবগত হইলাম যে, সে মৃত্যুকালে হরি হরি জপ করিতে করিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করিয়াছে। আরো অবগত হইলাম যে, তাহার পুত্রকে রায়বাড়ীর আশ্রয়ে সদ্ভাবে অনুগত থাকিয়া জীবননির্বাহ করিতে বলিয়াছে। বলিয়াছে—এ কাল বড় কঠিন কাল, সে কাল গিয়াছে। ছোট রায়হুজুর ধার্মিক লোক। বিদ্বান পণ্ডিত লোক। আইন বোঝেন। তাঁহার আশ্রয়ে থাকিলে উন্নতি হইবে। সুখে থাকিবে। তাঁহাদের সহিত শর্ত মানিয়া চলিবে। উনি না থাকিলে আমি বাঁচিতাম না। ফাঁসিকাঠে ঝুলিতাম। গোবিন্দ আক্রোশে তোদেরও রাখিত না; শেষ করিয়া দিত। বাঁচিলে ভিক্ষা করিয়া খাইতে হইত। গোবিন্দ শেষ পর্যন্ত কালাপানিতে মরিয়াছে। ওপথে হাঁটিস না।”

গোবিন্দ সিং গোপালের বড় ছেলের বড় ছেলে। বড় নাতি। বাপের মৃত্যুর জন্যে তার সব আক্রোশ পড়েছিল গোপালের উপর। বীরেশ্বর রায় বিচার করে গোপালের ন্যায্য সম্পত্তিটুকু রেখে বাকি সবই—যা মণ্ডলান স্বত্বের মালিক হিসেবে দখল করেছিল, সে-সব কেড়ে নিয়েছিলেন, এবং বীরপুরের সম্পত্তি গোপালকেও দেন নি, দিয়েছিলেন ওই গোরিন্দ সিংকে বলতে গেলে, খেসারত হিসেবে তাকে দিয়েছিলেন। এতেই গোবিন্দ সিং রায়হুজুরের বিচারের সুনাম করে সব আক্রোশ ফেলেছিল তার পিতৃহন্তা পিতামহের উপর। সে নাকি শপথ করেছিল, ঠাকুরদার জান সে নেবেই। এবং এতে তাকে উৎসাহিত করেছিল তার পিতামহী; গোপালের বড় স্ত্রী। আরো একজন এতে তাকে ইন্ধন জুগিয়েছিল। সে লোকটি হচ্ছে রায়বাড়ীর পুরনো দেওয়ান গিরীন্দ্র আচার্য।

গিরীন্দ্র আচার্যকে দেওয়ান পদ থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন বীরেশ্বর রায়; ওই ২রা জ্যৈষ্ঠই সরিয়েছিলেন, কিন্তু তাঁকে নিজের মুঠি থেকে ছাড়েন নি। রায়বাড়ীতে দীর্ঘ তিরিশ বৎসর দেওয়ানী কালের হিসেব-নিকেশ দাবী করে দায়ী করেছিলেন বিশ হাজার টাকার জন্য। টাকাটার হিসেব মেলে নি। শেষে তাঁর কাছে দশ হাজার টাকার হ্যান্ডনোট লিখিয়ে নিয়ে বলেছিলেন—এটা আমি লিখিয়ে নিলাম, কিন্তু এ আমি আদায় কখনও করব না। আপনি এস্টেটের অনেক খবর জানেন, আপনার কাছে তার সবুদও আছে। এটা আমি তার জন্য হাতে রাখলাম। আর আপনার চিঠি আছে, সেটাও দেখিয়ে রাখি, সেটা আপনি এই সেদিন কুতুবপুরের নায়েবকে লিখেছিলেন—“সদর হইতে যে হুকুমই যাউক না কেন, যে কোনো অজুহাতে গোপালকে শেষ করিয়া দিবে। আমার জাতি রক্ষা করিবে।”

গিরীন্দ্র আচার্য হেসেছিলেন। বলেছিলেন—ও আমি জানি, বারুজীভাই চিঠিখানা গোড়াতেই নায়েবের হাত থেকে নিয়েছেন, সে খবর আমি জানি। বেশ তাই হল।

আরো বলেছিলেন—দেখ বাবা, নোকরি গোলামী লোকে করে পেটের জন্যে। তবে পেটের জন্যে কখনো মুনিবের ক্ষতি করি নি। মুনিব মেরে খেলে আজ কীর্তিহাটের অন্তত অর্ধেকটাই পেটে পুরতে পারতাম। তা আমি করি নি। তোমাদের কি আয় ছিল, কি আয় হয়েছে, তা তুমি জান। সে আমিই করেছি। পাপপুণ্য বাছি নি। তার অনেক নজীর আছে। পাবে সেরেস্তা খুললে। তিরিশ বছরে তিরিশটা জান খতম করিয়েছি, হয়তো বেশীই হবে। যারা বিরোধিতা করেছে তাদেরই, হয় হাতে, নয় ভাতে, মেরে রাজ্য নিষ্কণ্টক করে দিয়েছি। বীরপুর নিষ্কণ্টক করতে চেয়েছিলাম তোমাদেরই জন্যে। ভুল হয়েছিল, মাকালীর সামনে বলেছিলাম, গোপালকে খতম না করি তো আমি বামুন থেকে খারিজ। তবে, ভেবো না, তোমাদের দৌলতে অনেক করেছি আমি, আমি তোমাদের অনিষ্ট করব না। এই উপবীত ছুঁয়ে ইষ্টদেবতার নামে হলপ নিয়ে বলছি।

বীরেশ্বর রায় বলেছিলেন—এ হ্যান্ডনোট আমি আপনার বউমা সতী বউয়ের কাছে রেখে দিচ্ছি, তাহলে হবে তো?

—বাস-বাস-বাস। এ আর কথা কি আছে।

—আর একটা কথা বলি।

—বল।

—একখানি মহল আপনাকে পত্তনী বা দরপত্তনী প্রণামী দিতে চাই। আর আপনি শেষ জীবনটা মেদিনীপুরের ল’দপ্তরের ভার নিয়ে বসুন। দেওয়ানীতে যা পেতেন তাই পাবেন। অপরের কাজকর্মও করতে পারবেন। আপনার প্রতিজ্ঞার আর একটা বাকী আছে, শ্যামনগর এখনো রায় এস্টেটে আসে নি।

হেসে আচার্য বলেছিলেন—সে এই আষাঢ় বা আশ্বিন কিস্তিতেই হয়ে যাবে বাবা, ভেবো না। তাছাড়া, দে-সরকাররা মহাল রাখতে পৌষ মাসে একটা হ্যান্ডনোট কেটেছে। চৈত্র মাসে একটা হ্যান্ডনোট কেটেছে হুগলীর মহাজনের কাছে। সে হ্যান্ডনোট দুখানা আমি চোটা দিয়ে কিনবার কথাবার্তা পাকা করেছি। ওরা দুখানা হ্যান্ডনোটে আট হাজার নিয়েছে, সুদ মাসিক শতকরা এক টাকা, আমি বলেছি সুদ সমেত আট হাজার আর ধরাট দু হাজার দিয়ে হ্যান্ডনোট আমি কিনব। তারা রাজী। কিনেই আষাঢ়ের আগে নালিশ ঠুকে দিলে আর সামলাতে পারবে না, টাকাও পাবে না। শ্যামনগর ঘরে ঢুকে যাবে। আমাকে খালাসই দাও। আমার আর খুব ইচ্ছে নেই!

বীরেশ্বর বলেছিলেন-তা হয় না দেওয়ানকাকা। কারণ আমাকে অবসর নিতেই হবে। রত্নেশ্বরকে ভার দিয়েছি, তাকেই সব ছেড়ে দিতে চাই। ওর সঙ্গে আপনারই মতে শুধু বনবে না নয়, হয়তো আমার সঙ্গেও বনবে না। আমি হস্তক্ষেপ করতে গেলে ও অসন্তুষ্ট হবে। আমি কলকাতায় না-হয়, সতী বউ বলেছে—কাশী চলে যাব। ওর মাথার উপর লোক চাই। ওর শ্বশুর অবশ্য এস-ডি-ও, সরকারের ঘরে মুরব্বির জোর ভালই হয়েছে। কিন্তু কি জানেন, বিষয়বুদ্ধি এঁদের নাই। এঁরা শুধু সরকার চেনেন, খেতাব চেনেন, কিন্তু সম্পত্তি বাড়ানো, সম্পত্তি রক্ষা কি করে করতে হয়, তা জানেন না। রত্নেশ্বর এরই মধ্যে বলছে—নতুন কাল, নতুন কাল। সব ব্যবস্থা ঢেলে সাজাতে হবে।

***

সুলতা তখনো গোপাল সিংয়ের সেই দুই হাতে সাপ ধরা ছবিখানা দেখছিল। ছবিখানা তার আশ্চর্য ভাল লেগেছে।

সুলতা দেখতে দেখতে বললে—দাঁড়াও সুরেশ্বর, গোপাল সিংয়ের ছবিখানা একটু দেখি। আশ্চর্য বোল্ডনেস রয়েছে ছবিখানার মধ্যে।

সুরেশ্বর বললে—ও ছবিখানা শুধু গোপাল সিংয়ের ছবি নয় সুলতা; ওখানকার গোপাল বাংলার সেকালের দুর্ধর্ষ প্রাণশক্তির প্রতীক। সে শক্তি স্বার্থপর, ব্যক্তিকেন্দ্রিক কিন্তু ওরই চাপে সাধারণ মানুষগুলো চাপ বেঁধে, জমাট বেঁধে একটা শক্তি ছিল। তারা গোপালকে বেঁধে পঙ্গু করে দিচ্ছে।

সুলতা সপ্রশংস দৃষ্টিতে ছবিখানার দিকে তাকিয়ে রইল। হ্যাঁ, সেটুকু চমৎকার ফুটেছে!

সুরেশ্বর বললে—১৭৯৩ সাল থেকে ১৮৫৮ সাল পর্যন্ত গুনতিতে পঁয়ষট্টি বৎসর কাল সুলতা; পারমানেন্ট সেটেলমেন্ট থেকে ১৮৫৯ সালে নতুন ভূমিস্বত্ব সংস্কার আইন। এর মধ্যে জমিদারদের প্রশ্রয় দিয়ে, আশ্রয় দিয়ে এই দুর্ধর্ষ প্রাণশক্তিকে ইংরেজ শেষ করলে। তারপর হল নতুন আইন। তার আগে সুলতা, ১৭৫৭ সাল থেকে ৮ বছর পর ১৭৬৫ সাল, পলাশীর যুদ্ধ থেকে মীরকাসেম নবাবের পালা শেষ করে, বাদশাহের কাছে দেওয়ানী নিলে। ৬৫ সাল থেকে ১৭৯৩ সাল গুনতিতে ২৮ বছর, ধরতে পার তিরিশ-বত্রিশ-এর মধ্যে বাংলাদেশে নবাবী পালার পর জায়গীরদারী শেষ করে জমিদারী পালায় ফেলেছিল। রাজারা-মহারাজারা খেতাবটা রেখে জমিদারীই স্বীকার করে ইংরেজ রাজত্বের বনিয়াদ পোক্ত করেছিল। একদিকে করেছিল কোম্পানী সরকারের ফিনান্স ডিপার্টমেন্টকে শক্ত, অন্যদিকে এদেশের দুর্ধর্ষ মানুষ, যারা বর্গীর হাঙ্গামা পুইয়ে বেঁচেছে, গিরিয়া, পলাশী তারপর কাটোয়া-গিরিয়া-উধুয়ানালার বিপর্যয় মাথায় করে বেঁচেছে, বিশু ডাকাতের মত ডাকাত যারা নীলকুঠী লুঠ করে, নীল বাঁদরের অত্যাচার নিবারণ করতে চেয়েছে, যারা কুটিল মহাজনদের মেরেছে, যারা জমিদারদের সঙ্গে লড়েছে, তাদের শক্তি এমনিভাবে নাগপাশে বেঁধে জব্দ করতে বসল নতুন আইন।

“বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল পোহালে শর্বরী রাজদণ্ড রূপে।”

কোম্পানীর হাত থেকে রাজ্য এল ইংলন্ডেশ্বরীর হাতে। সাম্রাজ্যবাদের ভোল বদল হল দুনিয়া জুড়ে; ক্ষাত্র সাম্রাজ্যবাদের বদলে বৈশ্য সাম্রাজ্যবাদ। ইয়োরোপের সব জাতের ধাতই তাই। ইংরেজ তখন বিশ্ববিজয়ী হয়ে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মত চিরস্থায়ী সাম্রাজ্য স্থাপনের জন্য বদ্ধ পরিকর।

বৃটিশ এম্পায়ার এস্টাবলিশড বাই ল’।

সে রাজত্বে মানুষের এত শক্তি তার সহ্য হবে কেন। তাকে শেষ করে দিতেই হবে। ওই সব কথাই বলতে চেয়েছি ওর মধ্যে। ছবিখানা সত্যই বোল্ড হয়েছে।

ছবিখানার দিকে নিজে কিছুক্ষণ দেখে, বললে—১৮৫৯ সালে নতুন আইন পাশ হল, গভর্নর জেনারেলের কাউন্সিল তাই দিয়ে জমিদারকেও বাঁধলে। পারমানেন্ট সেটেলমেন্টের কনট্রাক্ট সই করে জমিদার ভেবেছিল, রাজার সঙ্গে কনট্রাক্ট বলে আমরাও রাজা। প্রজার দণ্ডমুণ্ডের মালিক। কিন্তু ইংরেজ তা ঘুচিয়ে দিলে। এবার স্পষ্টাক্ষরে বলে দিলে—না, প্রজারা শুধু সরকারের প্রজা, তোমাদের সঙ্গে কনট্রাক্ট, তোমরা খাজনা আদায় করবে। তা থেকে সরকারের দেয় দিয়ে বাকীটা পুত্র-পৌত্রাদি-ক্রমে ভোগ করবে।

১৮৫৯ সাল থেকে বাংলার প্রজাশক্তির সঙ্গে গণশক্তি শ্রান্ত ঘুমন্ত; জেগে উঠল প্রথমে ১৯২১ সালে। বিচিত্র কথা কি জান, শুনতে গিয়ে উত্তর পেয়েছি ৬২ বছর। আবার ১৯২১ সাল থেকে ১৯৫৩ সালে জমিদারী উচ্ছেদ ৩২ বছর।

সুলতা হেসে বললে—হঠাৎ ছবির মারফৎ জবানবন্দী দিতে গিয়ে যে রিসার্চ তত্ত্ব এনে বসলে? ওটা গবেষকদের হাতে ছেড়ে দাও। ওরকম গবেষণা একবার ১৮৫৭ সালে হয়েছিল, সেটা ফলে নি। আবার প্রত্যাশা ছিল—১৯৫৭-তে। কিন্তু তার দশ বছর আগে ১৯৪৭-এ ইংরেজ দেশ ছেড়েছে, স্বাধীনতা এসেছে। এসব চেতাবুনীওলাদের পক্ষে ভাল। তোমার কোন কাজে লাগবে না।

সুরেশ্বর হেসে বললে—দেখ, পথের ধারে খড়ি দিয়ে ছক এঁকে অদৃষ্ট গণনা কিংবা রবিবারে সাপ্তাহিক রাশিফল লেখার বাসনা আমার নেই। সেজন্য বলি নি। তবে কীর্তিহাটে বসে বসে ভাবতে ভাবতে এটা আমার চোখে পড়েছিল। তাই বললাম! এখন ফিরে যাচ্ছি ১৮৫৯ সালে।

গোপাল সিং এবং গোপাল সিংয়ের দৃষ্টান্তে মিউটিনির পর ইংরেজের শক্তির আতঙ্কে অন্য গোপালেরা দুরন্ত গোপাল থেকে সুবোধ গোপাল হয়ে গেল।

শুধু প্রজারাই নয়, ১৮৫৯ সালের আইনে, যে হাতে মিউটিনি দমন করেছিল ইংরেজ, নিঃশেষিত-শক্তি প্রজার মাথায় সেই হাতে অভয়মুদ্রা ফুটিয়ে, সেই হাতেরই তর্জনী উল্টে জমিদারকে শাসন করলে। জমিদারেরা পাল্টাল; পাল্টাতে বাধ্য হল।

তাদের কাছে ইংরেজ শুধু মিউটিনি-দমনকারী শক্তিই নয়। ইংরেজ তার আগেই ক্রিমিয়ান ওয়ার জিতেছে। এদেশের লোকে মধ্যে মধ্যে কল্পনা করত, খাইবার পাস হয়ে রুশ পল্টন আসছে; কখনো কখনো ইন্ডিয়ান ওসেনে রুশ রণতরীর গুজব উঠত। এ সবকিছুর স্বপ্নকে তাসের ঘরের মত সে ভেঙে দিয়েছে। সুতরাং তাদেরও শঙ্কিত এবং সাবধান না হয়ে উপায় ছিল না।

তার সঙ্গে আর একটা বিচিত্র ঘটনা ঘটল। কিসের থেকে বা কোন ঐতিহাসিক কারণে, না কোন বিচিত্র অভিপ্রায়ে দেশের মধ্যে একটা নতুন স্রোত বইতে শুরু করল।

রামমোহন, বিদ্যাসাগর এসেছেন, মাইকেল এসেছেন, বঙ্কিমের পদধ্বনি নিকটতর হয়েছে। ওদিকে দক্ষিণেশ্বরে এসেছেন এক ব্রাহ্মণ সন্তান। রাণী রাসমণির কালীবাড়ীতে পঞ্চবটীর তলায় রাত্রে বসে থাকেন, ঘুরে বেড়ান।

সুলতা, রত্নেশ্বর রায়ের মাতামহ শ্যামাকান্ত চট্টোপাধ্যায় যে ধর্মসাধনার বিকৃতিতে শুধু নিজের জন্যে নরকের দ্বার উন্মুক্ত করেই যান নি, গোটা দৌহিত্র বংশের মধ্যে তাঁর বাসনার পাপবীজ পুঁতে দিয়ে গিয়েছিলেন, সে ধর্মসাধনার পথেই গদাধর চাটুজ্জে স্বর্গের দ্বার মুক্তির পথ খুলতে চলেছেন।

১৮৬০ দশকের পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে।

নবজাতকের কান্নার মধ্যে দেবেন ঠাকুরের বাড়ীতে এক নবজাতকের স্বর শোনা যাচ্ছে। ওদিকে মধ্য কলকাতার দত্তবাড়ীতে বাজছে আর এক নবজাতকের কণ্ঠস্বর।

রবীন্দ্রনাথ এবং নরেন্দ্রনাথ দত্ত—স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁদের সঙ্গে ও পিছনে আরো অনেক সুলতা। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায়, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়।

সুলতা বললে—সে নাম অনেক সুরেশ্বর! সেসব আমি জানি!

—জান না—একথা আমি কখনই বলিনে। আমি বলেছি, এই যে স্রোত, এই যে ধারা, সেটা আর যাই হোক, সেটা ইংরেজের ভয়ে আসেনি। তবে যদি বল—ইংরেজ শাসন সেকালে দুষ্ট ছেলে শাসন করা কটন ইস্কুল, সেই ইস্কুলে পড়ে শাসনের ভয়ে দেশে ভাল স্রোত এসেছিল, তবে তাই না হয় হল। কিন্তু সেটা সেকালের উচ্চবিত্ত এবং উচ্চবর্ণের মধ্যে এসেছিল। সেটা রত্নেশ্বর রায়ের মধ্য দিয়ে রায়বংশে তিনি আনতে চেয়েছিলেন। শুধু কীর্তিহাটের রায়বংশেই নয়, অনেক জমিদার বংশেই এসেছিল।

তাই বীরেশ্বর রায় যে দেওয়ান আচার্যকে বলেছিলেন-রত্নেশ্বর বলছে, সেরেস্তাকে সে ঢেলে সাজাবে। পুরনো আমল আর চলবে না, সেটা তিনি মিথ্যে বলে আচার্যকে সরাতে চান নি। সে সত্যকে তিনি রত্নেশ্বরের সঙ্গে অল্প কথাবার্তা বলেই বুঝেছিলেন।

সেটা রত্নেশ্বর রায় করেছিলেন। অন্তত করতে চেষ্টা করেছিলেন। মোটামুটি পেরেছিলেন, একথাও আমি বলব।

একটু চুপ করে থেকে একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সে আবার বলেছিল—পরবর্তীকালে দুটি হত্যা তিনি করিয়েছিলেন, তবুও তিনি আইন এবং ধর্মকে বড় করেই চলেছিলেন, একথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না। অন্যে কেউ জানত না। অন্তত সাধারণ লোকে কেউ এ ধরতে পারে নি, বুঝতে পারে নি। তাঁর ডায়রী পড়ে আমি বুঝেছি, জেনেছি—আমিও তা বলতে পারব না। তার আগে–।

তার আগে আমি গোপাল সিংয়ের জীবনটা শেষ করে নিই। এমন একটা ঘরে-লাগা আগুন বা বনে-লাগা আগুনের মত জীবন শেষ দশ বৎসর কেরোসিন ডিবের নিরীহ আলোর মত জ্বলেছে। সেটা আর চোখে পড়বার মত নয়। আমি বিশ্বাসই করতে পারি নি।

১৯৩৭ সালের সেদিন, যেদিন বিমলেশ্বরকাকাকে ধরে নিয়ে গেল, সেই রাত্রে আমার মনে হয়েছিল, গোপাল নিশ্চয় এই ক্ষোভ তার ছেলেদের বুকের মধ্যে জ্বেলে দিয়ে গিয়ে থাকবে। নিশ্চয় সে বলে গেছে তার ছেলেকে, ছত্রির ছেলে আমি। আমার শিরটা মাটিতে ঠেকল তো মরণ আমার হইয়ে গেল। বাপের এই মরণের শোধ লিবি।

অবশ্য সে কথার উল্লেখ রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায়ের ডায়রীতে থাকবার কথা নয়। তবে একথা তাঁর মনের মধ্যে থাকলে, নিশ্চয় কখনো না কখনো কোন ঘটনায়, কোন কথায়, কোন আচরণে প্রকাশ পেয়ে থাকবে।

এরই জন্যে সুলতা, সেদিন অর্থাৎ ১৯৩৭ সালে, সেদিন রাত্রে আমি রত্নেশ্বর রায়ের দিনলিপিগুলো পাতার পর পাতা উল্টে গিয়েছিলাম। শুধু খুঁজে গিয়েছিলাম একটি নাম। গোপাল সিং। ১৮৫৯ সাল থেকে ১৮৬৯ সাল পর্যন্ত। প্রথম প্রথম প্রায় প্রত্যেক পৃষ্ঠায় গোপালের নাম পেয়েছি।

“গোপাল ঠিক কথামত আসিয়াছিল এবং হেঁট হইয়া সর্বসমক্ষে নমস্কার করিল। আমি হাসিয়া বলিলাম—ভাল আছ? সে বলিল—হ্যাঁ, হুজুরের মেহেরবানীতে ঠিক আছি।

আমি তাহাকে একটি সিকি বকশিশের হুকুম দিয়া হাতে দিয়া বলিলাম—খাজাঞ্চী-বাবুকে দাও।

সে আবার নমস্কার করিয়া চলিয়া গেল।”

বছরখানেক ধরেই এটা পেয়ে গেলাম। তারপর আর নিত্য নাম পাই নি। মধ্যে মধ্যে পেয়েছি।

১৮৬৯ সালে পেলাম গোপালের মৃত্যুসংবাদ।

রত্নেশ্বর রায় লিখেছেন—“আজ গোপাল সিং মারা গেল। মনটা খারাপ হইল। তাহার মৃত্যুতে একজন সত্যকার অনুগত হিতৈষী হারাইলাম।”

শেষ দিকে দেখলাম, “গোপাল তাহার পুত্রকে মৃত্যুকালে বলিয়া গিয়াছে, যেন রায়বাড়ীর আশ্রয় ছাড়িস না। তাঁহার কৃপাতেই ফাঁসির হাত হইতে বাঁচিয়াছি। এবং তোরাও বাঁচিয়াছিস। নহিলে হয় ভিক্ষুক হইয়া ভিক্ষা করিয়া বেড়াইতে হইত, অথবা যেসব দুর্ভিক্ষ গেল, তাহাতেই সকলে পথের ধারে মরিয়া পড়িয়া থাকিতে হইত।”

সেদিন এর উত্তর পাই নি।

তবে নিজেই একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছিলাম। মানুষ আগ্নেয়গিরি। তার বুকের আগুন কখনো নেভে না। শুধু তাই নয়, মানুষ মরে গেলেও তার বুকের আগুন তার বংশের বুকে জ্বেলে দিয়ে যায়। সিদ্ধান্ত আমার ভ্রান্ত নয়। ইতিহাস তার সাক্ষী দেবে। ১৯৩৭ সালে পৃথিবীতে এমনই একটা ভয়ঙ্করতম আগ্নেয়গিরি ধোঁয়াচ্ছিল। তখন সারা পৃথিবীতে হিটলারের কথায় বক্তৃতায় সে আগুন লকলক করে শিখা বের করে জ্বলছে।

একটু চুপ করলে সুরেশ্বর।

তারপর বললে—পরে আমি খবর নিয়েছিলাম। জেনেছিলাম, কিভাবে গোপাল সিংয়ের ক্ষোভটা বংশাবলীতে সঞ্চারিত হয়েছিল।

বিচিত্র পথ সুলতা। বিচিত্র পথ।

গোপালের সঙ্গে গোপালের স্ত্রীর মধ্যে মধ্যে ঝগড়া হত। সেই ঝগড়ার মুখে তার স্ত্রী বলত—তোমার মত বেইমান আমি দেখি নি। আমাকে তুমি আজ লাঠি-ঝাঁটা মারছ। বেইমান তুমি ‘পাসর’ গিয়েছ যে সেদিন আমি ছত্রির মেয়ে রায়গিন্নীর পা ধরে ‘ভিখ মাগোয়া’র মত ভিখ মেঙে তোমার জানটা বাঁচিয়েছিলাম।

গোপাল খেপে গিয়ে মাথা চাপড়ে বলত-বেইমান হামি না। বেইমান তু। তু ‘পাস ‘ গেলে কি তুর লেগে হামি গোপাল সিং এ মুলুকের শের, আজ হামি ‘শিয়ার’ হয়ে বেঁচে আছি। তুর আর তুর বেটা-বেটীর পেট ভরাবার জন্যে রায় কাছারীতে সেলাম দিয়ে চার আনা, আট আনা পয়সা লিয়ে আসি। আজ রায়বাড়ীর চাকরান জমি চষি। চাকর বনে গেলাম, স্রিফ তুর আর তুর বাচ্চাদের লেগে।

এর পর সে সবিস্তারে কখনো কখনো বলত-তার দুর্দশার কথা, লাঞ্ছনার কথা। কথাটা ছেলের বুকে প্রবেশ করেছিল এইভাবে।

ছেলের থেকে তার ছেলের বুকে। হরি সিং দফাদার।

হরি সিংয়ের ছেলে শিবু সিং।

তুমি শুনেছ সুলতা, শিবু সিংয়ের কাছে দফাদার হরি সিং ছোরা আর প্যাম্পলেট দেখে তাকে যে মুহূর্তে অতুলেশ্বরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট জেনেছিল, সেই মুহূর্তে তার বুকের পুরনো কথা নতুন হয়ে জেগে উঠেছিল। আগুন লেগেছিল। সারা রাত হরি সিং শিবুকে গোপাল সিংয়ের অপমানের কথা শুনিয়ে শুনিয়ে উত্তপ্ত করে তুলে তাকে থানায় নিয়ে গিয়ে দারোগার হাতে দিয়েছিল এবং শিবু সেই আগুনের দহনে গলে হয়েছিল অ্যাপ্রুভার।

গোপাল সিংয়ের কাহিনী শেষ ১৮৬৯ সালে। কিন্তু তার শিকড় থেকে গিয়েছিল। ১৮৬৯ সাল থেকে ১৯৩৭ সালে তা থেকে আবার গাছ বের হল। এবং ওখানেও শেষ হয় নি। তারপরও তার জের আছে, জের চলছে।

বিচিত্রতরভাবে পরে আর একটা এমনি মরা গাছের শিকড় থেকে গজানো গাছের সঙ্গে জড়িয়ে জট পাকিয়ে দিয়েছিল। এবং শেষ পর্যন্ত আমাকেই জড়িয়ে ধরেছিল পাকে-পাকে।

১৯৩৭ সালে সেদিন রাত্রে ঘুমোতে পারি নি। সেই দিনই করেছিলাম এই ছবিতে জবানবন্দীর পত্তন।

১৯৩৭ সালের ২৪শে জানুয়ারী; তারিখটা আমার মনে রয়েছে সুলতা, রায়বাড়ীর জবানবন্দী—কীর্তিহাটের কড়চা আমি আরম্ভ করেছিলাম।

সুরেশ্বর বললে—তার আগেই আমি ঠাকুরদাস পালের অপঘাত মৃত্যুর কথা জেনেছি, তোমার সঙ্গে সম্পর্কের সকল প্রত্যাশায় ছেদ টেনে দিয়েছি। কিন্তু কীর্তিহাটের রায়বংশের হিসেব- নিকেশের বোঝা বয়ে সারাজীবন বেড়াব-এ সংকল্প আমার ছিল না। ভেবেছিলাম—সেটেলমেন্টের হাঙ্গামাটা মিটিয়ে দিয়ে কোনরকমে এখান থেকে বেরিয়ে পালাব। চিরদিন আমার বদনাম আছে—আমি একজন উদ্ভট খেয়ালী মানুষ; অনেক টাকা আছে আমার, সুতরাং আমি কালো ঘোড়া, ব্ল্যাকহর্স, অবশ্যম্ভাবী রূপে শয়তান হবে আমার সওয়ার। এবং আমি তার চালনায় আমার ক্ষুরে অনেক কিছু—অনেক কোমল বক্ষ-ক্ষত-বিক্ষত করে দিয়ে একদা এক অন্ধকার গর্তে পা ভেঙে পড়ে সকল দৌড়ের অবসান করব। রায়বাড়ীর যে কলঙ্ক ঢাকতে রত্নেশ্বর রায় ঠাকুরদাস পালকে নিশ্চিহ্ন করেছিলেন সুকৌশলে, তা জানায় আমার পক্ষে কালো ঘোড়া হওয়ার বাধা ছিল না। কিন্তু—

কিন্তু হঠাৎ কোথা থেকে অতুলেশ্বর আর অর্চনা রায়বাড়ীর একটা বিচিত্র, বিস্ময়কর রূপ প্রকাশিত করে দিয়ে বিপদ বাধালে। শিবু সিং তারই মধ্যে এসে গোপাল সিংয়ের ঘটনার জের টেনে সামনে দাঁড়িয়ে আমাকে কেমন করে দিলে। মনে হল কি জান? মনে হল—রায়বংশের কর্মফলের মধ্যে একটা আশ্চর্য দ্বন্দ্ব বেধেছে। মন্দ কর্মের ফল ভাল কাজের পথ রোধ করে দাঁড়াচ্ছে। গিলে ফেলতে চাচ্ছে সকল পুণ্যকে। পুণ্য বল, ন্যায় বল, করতে হলে অন্যায়ের দেনা শোধ করে তবে করতে হবে।

একটু ভুল হল; তার আগে—মানে শিবু সিংকে নিয়ে বিমলেশ্বরকাকা যে নতুন দৃশ্যের পটোত্তোলন করলেন, ২৪শে জানুয়ারীর কদিন আগে থেকেই ছবি আঁকার কল্পনা আমার হয়েছিল। মনে আছে—আমি বলেছি—কুইনিকে নিয়ে হাঙ্গামা বাধিয়েছিল সেই ফিরিঙ্গী হ্যারিস! হ্যারিসের দাবি কুইনির ওপর। গোয়ান বুড়ি হিলডা তাকে তার হাতে দেবে না।

মীমাংসা করতে গিয়েছিলাম ছবি আঁকা ফেলে। ছবি আঁকব বলে ইজেলের উপর ক্যানভাস বসিয়ে সবে তুলে ধরেছি, ঠিক সেই সময়ে সে পিছু ডাকার মত ডাকলে। বললে-আমি মীমাংসা করে দেবার ভার নিয়েছি, কথা দিয়েছি, আশা করি আমার মত একজন লর্ড বংশের ছেলে সে-কথা কখনই খেলাপ করবেন না।

বিরক্ত হয়ে তখনই তুলি ফেলে উঠে গিয়েছিলাম। লোকজন কাউকে সঙ্গে না নিয়েই গিয়েছিলাম গোয়ানপাড়া। সেখানে গিয়ে ঝগড়ার মধ্যে রায়বংশের নাম উঠল। এবং অন্যের কাছে ধরা পড়ুক আর নাই পড়ুক, আমার কাছে ধরা পড়ল আসল সত্য। সে-সত্য ইঙ্গিতে আভাসে বলেছে যে, কুইনির উপর দাবি হিলড়াই করুক আর হ্যারিসই করুক, কুইনির দায় রায়বংশের। আমার পিতামহ দেবেশ্বর রায় তার জন্য দায়ী। আমি মাথা হেঁট করে চলে এসেছিলাম। মীমাংসা আমাকে করতে হয়নি। কুইনি হ্যারিসের দাবী প্রত্যাখ্যান করে, নীরবে চলে গিয়েছিল। মনে হয়েছিল, হিলডার দাবী সে মেনে নিলে। কিন্তু পরের দিন এসে সে আমাকে দেবেশ্বর রায়ের চিঠি আর রত্নেশ্বর রায়ের দলিল পড়তে দিয়ে চলে গেল।

আমি দেখতে পেলাম -শ্যামাকান্তের সোমেশ্বরের পাপ রত্নেশ্বরকে ডিঙিয়ে এসে আবার দেবেশ্বর রায়ের মধ্যে ফুটে বেরিয়েছে। শ্যামাকান্তের পাপ ধর্মের মধ্য দিয়ে, সোমেশ্বরের পাপ সম্পদের মধ্য দিয়ে।

মনে মনে ছবির কল্পনা জাগল—তিনখানা মুখ আঁকব। একের উপরে আর একটা শ্যামাকান্তের মুখের আউট-লাইনের মধ্যে সোমেশ্বরের মুখের লাইন, তার উপর দেবেশ্বরের মুখ। তার চারপাশে একটা কালো ধোঁয়াচ্ছন্নতার পরিবেষ্টনী।

১৯৩৭ সালের ২৩শে জানুয়ারী রাত্রে বিমলেশ্বরকাকা শোধ নিতে গেল শিবু সিংয়ের উপর। ২৪শে দারোগা এসে অ্যারেস্ট করলে। তাকে কোমরে দড়ি বেঁধে নিয়ে ঘোরালে সারা গ্রাম। দেখলাম ঘাতে-প্রতিঘাতে রায় বংশের কর্মফল আজও স্তব্ধ হয়নি। সে বয়েই চলেছে।

আমার নিজের মনের মধ্যেও অনুভব করলাম সে-স্রোত বইছে। বিমলেশ্বর কাকার স্ত্রী বর্ধমানের কাকী আমাকে শপথ করালেন-এর শোধ আমি নেব।

গোপাল সিংয়ের কাহিনীটা গোটা পড়লাম। রায়বংশের দায়-অপরাধ পেলাম না তা নয়, পেলাম; কিন্তু তার সঙ্গে পেলাম রায়বংশের ক্ষমাগুণেরও পরিচয়। এর পর ছ’মাস ধরে রায়বংশের ইতিহাস তন্নতন্ন করে রায়বংশের জবানবন্দী এবং কীর্তিহাটের কড়চা আঁকলাম ছবিতে। তার মধ্যে শুধু মানুষের অপরাধটাই পেলাম না, আরো কিছু পেলাম। ইতিহাস আমাকে বুঝিয়ে দিলে, একটা কালের গৌরব, আর একটা কালের অগৌরব। এক কালের ন্যায়, অন্য কালের অন্যায়। আমি তাকে এড়াতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু পারিনি, আমি জানি একালে জন্মে তার দৃষ্টিভঙ্গি তার নির্দেশ অস্বীকার করব কি করে?

ঠিক সেই কারণেই সুলতা, গোপাল সিংয়ের এই সাপ ধরা ছবিখানা—প্রতীক-ধর্মী হয়ে উঠেছে আপনাআপনি। ওটাতে গোপালের জীবন যেমন আছে, তেমনি আছে বাংলাদেশের একটা কালের ইঙ্গিত। প্রজাশক্তি বাঁধা পড়ল নাগপাশে।

কাল বদল হচ্ছে।

সেটা স্পষ্ট হয়েছে দেখ পরের ছবিতে। সেখানে প্রজার সঙ্গে জমিদার পাল্টাচ্ছে।

সুলতা বললে-ওটা তো রত্নেশ্বর রায়ের টোপর পরা ছবি—পাশে কনে-মুকুট পরা কনে তারপর—ওটা আবার কার বিয়ে?

সুরেশ্বর বললে-ওটা তোমার পূর্বপুরুষ ঠাকুরদাস পালের বিবাহ। বীরেশ্বর রায় এবং ভবানী দেবী—দুজনের বিবাহ একসঙ্গে দিয়েছিলেন। বীরপুরের ভগবান মণ্ডলের শ্যালকের মেয়ের সঙ্গে। কীর্তিহাটের যে রঙলাল মণ্ডল অতুলের ডাকা কংগ্রেসের সভায় সভাপতিত্ব করেছিলেন, যাঁর ছেলে উকীল হয়েছে, কনে তাঁর পিসিমা। শ্যামনগর পুড়ে যাওয়ার সময় তার স্ত্রীপুত্র সব গিয়েছিল। রত্নেশ্বরকে সে-ই বাঁচিয়েছিল। সেকথা ভোলেননি বীরেশ্বর রায় এবং ভবানী দেবী। রত্নেশ্বরও তাই চেয়েছিলেন।

সুলতা কিছুক্ষণ ছবিখানার দিকে নির্নিমেষ দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখলে। তারপর পরের ছবিখানা দিকে তাকিয়ে বললে-এখানা? এ তো রত্নেশ্বর রায়—সর্বালঙ্কারভূষিতা স্বর্ণলতা—

—ওটা নয়, ওর পরেরখানা, যেখানায় দেখ রত্নেশ্বর রায় কীর্তিহাটের কাছারীতে বসেছেন।

—কিন্তু এখানা? এখানায় রত্নেশ্বর রায় আর স্বর্ণলতা দেবী, তার সঙ্গে আর একটি মেয়ে–।

—ওই অঞ্জনা।

—অঞ্জনা! এই অঞ্জনা?

—হ্যাঁ, এই অঞ্জনা।

—অঞ্জনার ছবি এর আগে তো এঁকেছ?

—হ্যাঁ এঁকেছি। কিন্তু তার কোনটাতেই অঞ্জনার মুখ স্পষ্ট নয়। প্রথম আছে ভিড়ের মধ্যে—পুরবাসিনীদের সঙ্গে মিশে। তারপর যেটাতেই আছে, অঞ্জনা হয় পিছন ফিরে আছে, নয় মুখের অতি অল্প অংশই আছে।

সুলতা একদৃষ্টে ছবিখানার দিকে তাকিয়ে রইল। সুরেশ্বর বললে-কি দেখছ বল তো?

—কিন্তু মনে হচ্ছে এই ছাঁচের মুখ যেন দেখেছি। আরো আছে। বলছ অঞ্জনার মুখ কোথাও পুরো দেখাওনি। কিন্তু তবু মনে হচ্ছে কার সঙ্গে মিল রয়েছে। কার ঠিক মনে হচ্ছে না।

সুরেশ্বর সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে বললে—তার আর আশ্চর্য কি সুলতা। মানুষ শিল্পীর হাতে আর ক’রকমের ছবি আসবে বল। বড়জোর দুটো-তিনটে-চারটে। পোর্ট্রেট যারা আঁকে, তারা আসল মানুষ দেখে কিংবা ফটোগ্রাফ দেখে আঁকে। আমাকে তো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কল্পনা সম্বল করতে হয়েছে। রায়বংশের রায়দের অয়েল-পেন্টিং ছিল, ফটোগ্রাফ যখন থেকে হয়েছে, ফটোগ্রাফও পেয়েছি। বাকিদের তো সবই কল্পনায় এঁকেছি। মানুষের কথা ছেড়ে দাও, বিধাতাপুরুষ যে বিধাতাপুরুষ তিনি যখন সৃষ্টি করেন, একটা বংশের মানুষগুলোকে প্রায় এক রকমই করে থাকেন, মধ্যে মধ্যে অন্য বংশের মেয়ে এসে তাদের বংশের ছাপ মিশিয়ে একটু-আধটু পাল্টে দেন মাত্র।

সুলতা ছবিটা তখনো দেখছিল। সে বললে—কিন্তু ছবিটাতে তুমি একটা ঘটনার কথা বলেছ। সেটা কি? ঠিক তো রত্নেশ্বরের বিবাহিত জীবনের মধুচন্দ্রিমা নয়।

—না, তা নয়। ছবিটাতে দেখ নতুন বউ স্বর্ণলতা দেবী ইংরিজী বই হাতে বসে রয়েছেন। এস-ডি-ও রাধারমণবাবু ইংরিজী-নবীশ, তিনি মেয়েকে ইংরিজী পড়িয়েছেন। রায়বাড়ীর যে অন্দর রাজকুমারী বউ-রানী কাত্যায়নী দেবী পত্তন করে গিয়েছিলেন, সেই অন্দরের হাল বদলাচ্ছে স্বর্ণলতা দেবী থেকে। বীরেশ্বর রায়ের গৃহিণী সতীবউ, ভবানী দেবী মিশনারী ইস্কুলের মাস্টার মহেশ্বরবাবুর পালিতা কন্যা, তিনিও লেখাপড়া জানতেন, শুধু বাংলাই নয়, কিছু ইংরিজী ও শিখিয়েছিলেন। কিন্তু তা তাঁর ওপর প্রভাব ফেলতে পারেনি। তাঁর রক্তে এমন কিছু ছিল, যাতে শিক্ষার থেকে সংস্কার বড় হয়ে উঠেছিল। সেটা আবার জন্মগত সংস্কার। বাপের সঙ্গীতবিদ্যার অধিকার জন্ম থেকে নিয়ে জন্মেছিলেন। তার সঙ্গে ধর্মপিপাসা। যার জন্যে রাজ্যপাট তাঁকে বাঁধতে পারেনি। রাজরাণী হয়েও তিনি সন্ন্যাসিনীই থেকে গেছেন আজীবন। রায়বাড়ীর কীর্তিহাটের অন্দরে রাজত্ব চলছিল রাণী কাত্যায়নীর মাসতুতো বোন নিস্তারিণী দেবীর। আর কলকাতায় সোফি বাঈয়ের। রায়বাড়ীর অন্দরের হাল এই প্রথম পাল্টালো রত্নেশ্বর-বধু স্বর্ণলতা দেবীর পদার্পণে। এস-ডি-ও’র মেয়ে ইংরিজী বিদ্যে ইংরিজী ফ্যাশানের হাওয়া বইয়ে দিলেন সেখানে। অবশ্য যৎসামান্য। ছবিটাতে অঞ্জনা স্বর্ণলতা দেবীর নাম দিচ্ছে। রায়বাড়ীর বউদের আসল নাম ঢাকা দিয়ে পোশাকী নাম বা জমিদারশাহী নামকরণ হত। জাহাঙ্গীর বাদশার হারেমে ঢুকে মেহেরউন্নিসা হয়েছিলেন নুরজাহান বেগম। শাজাহান বাদশাকে বিয়ে করে নুরজাহানের ভাইঝি আরজুমন্দবানু হয়েছিলেন মমতাজ মহল। সেকালের জমিদার-রাজাদের বাড়ীতেও এই রেওয়াজ ছিল। ভবানী দেবীর দেওয়া রত্নবউ নামটা কিছুদিনের মধ্যেই পাল্টে হয়ে গিয়েছিল বিদ্যেবতী বউ। রায়বাড়ীর অন্দরের জ্ঞাতি-পোষ্যমেয়েরা ঠাট্টা করে নামটা দিয়েছিল। নিজেদের মধ্যে বলাবলি করত। স্বর্ণলতা দেবী চটেছিলেন। অঞ্জনা মেয়েটির কথা বলেছি সুলতা। তার একটা ছন্দ ছিল নদীর মত। সেটা যেমন সহজ তেমনি সুরেলা। সে এই বিদ্যেবতী নামটা পাল্টে দিয়ে নাম দিয়েছিল সরস্বতী বউ। সতী-বউয়ের বেটার বউ-সরস্বতী বউ!

সুলতা বললে-এসবগুলি কিন্তু চমৎকার ফুটেছে। গোপাল সিংয়ের ছবিটা বোধহয় সব থেকে বোল্ড। গোপাল সিং নাগপাশের সঙ্গে লড়াই করছে।

আর একটা সিগারেট ধরিয়ে সুরেশ্বর বললে—ঠিক ধরেছ। রায় এস্টেটের দুর্ধর্ষ দুর্দান্ত প্রজার রিপ্রেসেন্টেটিভ গোপাল সিং। ওর সঙ্গেই দুর্ধর্ষ দুর্দান্ত প্রজাকে জবরদস্তি জঙ্গীশাসন শেষ হয়েছিল রায় এস্টেটে। এই দেখ—এই সরস্বতী বউ নামকরণের ছবিখানার পরের ছবিখানায় রত্নেশ্বর রায় সেই নির্দেশই জারী করছেন কাছারীতে।

ওই দেখ, কাছারীর ঘরে বড় সেক্রেটারিয়েট টেবিল পড়েছে। গদীআঁটা চেয়ারে বসেছেন রত্নেশ্বর রায়। তাঁর ডানদিকে নতুন দেওয়ান দাঁড়িয়ে। দুপাশে সারিবন্দী কর্মচারী নায়েব-গোমস্তারা। পিতলের তকমা-আঁটা পোশাক পরা বরকন্দাজরা দরজায় দাঁড়িয়ে।

একটু থেমে বললে—ছবিখানাতে একটু অ্যানাক্রনিজমের মত দোষ আছে। দেখ, টানা পাখাগুলো একটু বেঁকে রয়েছে অর্থাৎ চলছে। পিছনে বড় তালপাখা হাতে একজন খানসামা। অথচ রত্নেশ্বরের গায়ে হাঁসিয়াদার শাল দিয়েছি। প্রলোভনটা সম্বরণ করা উচিত ছিল আমার। কিন্তু রত্নেশ্বর রায় জাঁকজমক ভালোবাসতেন। আর সভা-সমিতি, দরবার, কালেক্টরসাহেবের খাস কামরায় দেখা করবার সময় ছাড়া কখনো চোগা-চাপকান শামলা এসব পরতেন না। পরতেন কোঁচানো ধুতি, সে-আমলের পাঞ্জাবি, পাঞ্জাবির নীচে ফতুয়া কি গেঞ্জি পরতেন না। ফিফিনে পাঞ্জাবির ভিতর দিয়ে তাঁর দেহের গৌরবর্ণ ফুটে উঠত। বীরেশ্বর রায় প্রথম যৌবনে বাবরি চুল রেখেছিলেন। পরে কলকাতায় এসে কেটে ফেলেছিলেন। রত্নেশ্বর রায় গোড়া থেকেই খাটো করে চুল কাটতেন। দাড়ি গোঁফ দুই কামাতেন। শুধু সাদা পাঞ্জাবিতে কাছারীর দরবারে তাঁর জাঁকজমক-প্রিয় চরিত্র ঠিক প্রকাশ হত না বলেই হাঁসিয়াদার কাশ্মীরী শাল গায়ে দিয়েছি।

সুলতা ছবিখানা দেখছিল।

সুরেশ্বর পাশাপাশি তিনখানা ছবিতে রত্নেশ্বরের দৃষ্টি তিন রকম করেছে। শিল্পী সুরেশ্বরকে প্রশংসা না করে পারলে না সে। প্রথম বিবাহমণ্ডপে বর-বধুর ছবিতে রত্নেশ্বরের দৃষ্টি আনন্দোজ্জ্বল, প্রসন্ন হাসি ফুটেছে সে-দৃষ্টিতে। দ্বিতীয় ছবিতে, যেখানে স্বর্ণলতার নামকরণ করছে অঞ্জনা, সেখানে সে-দৃষ্টি অন্যমনস্ক। অঞ্জনা এবং স্বর্ণলতার মাঝখানে দিয়ে খোলা দরজায় নিবদ্ধ। দরজার চৌকাঠের মাথা থেকে সরু সাদা একটি দাগ, তাতে যেন একটা কি! তারই দিকে চেয়ে আছেন রত্নেশ্বর রায়। তৃতীয় ছবিখানায় তাঁর দৃষ্টিতে মালিকের দৃষ্টি। তীক্ষ্ণ, গম্ভীর।

সুরেশ্বর বললে—রত্নেশ্বর রায় সেদিন নির্দেশ প্রচার করেছিলেন—কীর্তিহাট এস্টেট এখন থেকে পুরনো আমলের বদলে নতুন আমলে এল। এ আমলে এস্টেট চলবে আইনের পথে। বে-আইনের পথে চলবে না। আইনে যতটুকু আছে, ততটুকু ছাড়া জোরজবরদস্তি বন্ধ

প্রজার খাজনা বাকী—তার কাছে তাগাদা কর, তারপর নালিশ কর। নালিশী ডিক্রীর টাকার এক পয়সা মুকুব নাই।

আবওয়াবের মধ্যে তছরি, তলবানা, নজরানা বহাল রইল। এছাড়া কোন মাঙন, কোন আবওয়াব রইল না।

স্বত্বস্বামীত্বের ক্ষেত্রে ফৌজদারী আমরা করব না। তারা করতে এলে আমরা অবশ্যই ঠেকাব।

কিন্তু এগিয়ে যাব না।

প্রজাকে মারধর বন্ধ।

কোন প্রজার কোন অন্যায়, কোন পাপ আমি বরদাস্ত করব না। কোন মামলায় হাইকোর্ট পর্যন্ত না লড়ে আমরা হার স্বীকার করব না। যে প্রজা এস্টেটের অবাধ্য হবে, তার সঙ্গে সর্বক্ষেত্রে মামলা হবে। সে খাজনা দিতে এলে নেবে না। তার পথ খোলা। সে আদালতে দাখিল করুক। আমরা আপোসে নেব না। প্রয়োজন হলে প্রতি কিস্তিতে নালিশ হবে। সে চার আনা দাবী হলেও নালিশ হবে।

সে-সব ক্ষেত্রে সরকারী খাস পতিতে সে গরু চরাতে পাবে না। বন্ধ করবে না পথ, আর বন্ধ করবে না ঘাট। তাছাড়া জমিদারের খাস যা কিছু তার এক গাছি ঘাস সে পাবে না।

রায় এস্টেটের গোমস্তা, নায়েব, বরকন্দাজ, পাইক প্রত্যেকের বেতন বৃদ্ধি হল। তাঁরা প্রজার কাছ থেকে বে-আইনী কিছু আদায় করতে পারবেন না। আরো একটা নির্দেশ ছিল–রায় এস্টেটের জমিদারীর মধ্যে যেসব দেবস্থলের মালিক জমিদার, যেখানে দেবস্থলের খরচ জমিদারের দেওয়া দেবোত্তরের থেকে চলে, সেখানে পুরোহিতপূজক অনাচারী হলে তা বরদাস্ত করা হবে না। তাছাড়াও অনাচারী তান্ত্রিক সাধু-সন্ন্যাসীর আশ্রম বাউল-বষ্টুমদের আখড়া এসবও তুলে দেওয়া হবে। এ তিনি বরদাস্ত করবেন না।

সবশেষে তিনি বলেছিলেন-তোমরা কেউ মনে করো না যে, এটা আমার উদ্ভট খেয়াল কিংবা খুব একটা সাধু-সন্ন্যাসী-গিরি করছি আমি। এটা হল এই আমলের পথ। আগেকার আমল চলে গিয়েছে। এ আমল নতুন। আগের আমল ছিল কোম্পানীর আমল; তারা ব্যবসা করতে এসেছিল। তারা লাভ করতে এসেছিল-লাভ হলেই সন্তুষ্ট থাকত; খাজনার টাকা আদায় তুমি যে করে হয় কর, আমি দেখব না, তুমি আদায় করে আমাকে দাও। বাস্। তাদের টাকা যুগিয়ে তুমি যা কর-কর, দেখব না। এখন ইংলন্ডেশ্বরী কুইন ভিক্টোরিয়া আমাদের কুইন; মহারানীর রাজত্ব। তাঁর চোখে সব প্রজা সমান। জমিদার প্রজা, বড়লোক গরীবলোক সবাই প্রজা, সবাই সমান। তার জন্যে আইন করেছেন, নতুন আইন হচ্ছে—হবে। সেই আইন মেনে চলতে সকলে বাধ্য। আগে ঘুষ চলত, এখনো হয়তো চলছে কিন্তু তা বেশীদিন বোধহয় চলবে না। ইংরেজদের বিচারের মত সূক্ষ্ম বিচার এদেশে ছিল না—এমন সুক্ষ্ম বিচার হয় না। কাজীর বিচার নয়। এ বিচার অতি সূক্ষ্ম বিচার। প্রজার উপর অন্যায় হলে জমিদার তো জমিদার, প্রজা আদালতে গিয়ে গভর্নমেন্টের নামে নালিশ করতে পারে। তারপর নতুন লেখাপড়া এনেছে ইংরেজ। লোকের চোখ খুলছে। ইংরেজ এদেশে একরকম ঈশ্বরপ্রেরিত। মস্ত বড় জাত। এতটুকু একটা দেশ—সারা পৃথিবী চষে বেড়াচ্ছে। তার পরাজয় কোথাও নেই। সুতরাং এসব আর চলবে না। আমার শ্বশুরমশাই এস-ডি-ও। তিনি আমাকে বলছিলেন-বাবাজী, তোমাদের এস্টেটের ধারাধরন পাল্টাও। ইংরেজ-জাত বড় কঠিন জাত। সাত সমুদ্র তেরো নদী পার হয়ে এসেছে, জাহাজ করেছে, স্টীমে চলছে। রেল-লাইন পেতে রেলগাড়ীতে তিন মাসের পথ তিন দিনে পৌঁছে দিচ্ছে। বিদ্যুৎশক্তিতে টেলিগ্রাফ করেছে, এখান থেকে দিল্লী খবর যাচ্ছে মুহূর্তে। দেশের হালের বদলের এই শুরু। এই বদলের সঙ্গে যারা বদলাবে, তারাই থাকবে, শুধু থাকবে নয়—উঠবে, দিন দিন উঠবে, যে না বদলাবে, সে মরবে।

সুরেশ্বর বললে-এই দীর্ঘ বক্তৃতাটির সবটাই তাঁর ডায়রীতে আছে। হয়তো আরো অনেক বলেছিলেন, কি বলেছিলেন জানি না, তবে এটুকু লিখে গেছেন। তার সঙ্গে আরো লিখেছেন—

“ইংরেজ ঈশ্বর-প্রসাদে আজ বিশ্ববিজয়ী। শুধু ভারতবর্ষ জয় করিয়াছে বলিয়াই নয়-ক্রিমিয়ায় সে বিজয়ী হইয়াছে। যে রুশ-ভীতির কথা লইয়া দেশে অনেক প্রকার জল্পনা কল্পনা করিত, তাহা মিথ্যা প্রমাণিত হইল। মধ্যে মধ্যে আফগানিস্তানের আমীরের কথা বলিত। বিশালকায় দুর্দান্ত, দুর্ধর্ষ আফগান সৈন্যের ভয় দেখিত, কিন্তু আফগানিস্তানের আমীর আজ ইংরেজরই অনুগ্রহ ভিক্ষা করিতেছে। ব্রহ্মদেশে পর্যন্ত ইংরাজ পদার্পণ করিয়াছে। ব্রহ্মের অধীশ্বর আজ রেঙ্গুন হইতে মান্দালয়ে পলায়ন করিয়াছে। ইংরাজ বিশ্ববিজয়ী। তাহার জ্ঞান-বিজ্ঞানের তুলনা নাই। আজ আইনমত না চলিয়া উপায় নাই। তাহা ছাড়াও পিতামহ সোমেশ্বর রায়ের এবং পিতৃদেবের দৃষ্টান্ত এবং মাতামহ শ্যামাকান্তের দৃষ্টান্ত মনে রাখিয়া নূতন ভাবে নূতন পথে যাত্রা শুরু করিতে আমি বদ্ধপরিকর। শ্যামাকান্তের এবং সোমেশ্বর রায় মহাশয়ের কুৎসিত কুসংস্কার আমি আমার জীবন এবং বংশ হইতে মুছিয়া দিতে বদ্ধপরিকর। পিতৃদেবের দুর্দান্ত দুঃসাহসের পথ, তাহাও পরিত্যাজ্য। আমি ঈশ্বর এবং ধর্মকে মানি না তাহা নয়, কিন্তু এই শবসাধনা, নারী লইয়া সাধনাকে, কুসংস্কার এবং বিকৃত ধর্মাচার বলিয়াই মনে করি। এবং পিতৃদেবের জীবনকেও আদর্শ বলিতে পারি না। ব্রাহ্ম আমি হইব না, ধর্ম পরিত্যাগ করিব না, কারণ উপায়ও নাই। প্রপিতামহ কড়ারাম রায় ভট্টাচার্য এই বংশ এবং এস্টেটের পত্তনই দেবসেবার উপর করিয়া গিয়াছেন। আমি শুদ্ধাচারে বৈদিক ধর্মমতে থাকিব এবং সম্পূর্ণ আইনের পথে চলিব। জমিদারীর ক্ষেত্রে রাজার আইনই একমাত্র ধর্ম।”


© 2024 পুরনো বই