কীর্তিহাটের কড়চা – ৩য় খণ্ড – ১০

১০

হতভাগ্য গোপাল সিং নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেছিল একবার। কিন্তু তার ভাগ্যে তা সফল হয় নি। তার মস্ত বড় ভুল হয়েছিল। নেশায় কালীসাধক গোপাল সিং ছুটে পালাবার সময় মায়ের নেশা বাবার নেশার একটাও সঙ্গে নেয় নি। যে নেশাটা করেছিল এই দুর্ঘটনার আগে, সেটা ছেড়ে গিয়েছিল বিকেল হতে-না-হতে। নেশা যখন ছুটল তখন দুরন্ত ফাঁসির ভয় তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছিল। যে ভয়কে সে চিরদিন ব্যঙ্গ করে ফাঁকি দিয়ে এসেছে, সেই ভয় সেদিন যেন তাকে পিছন থেকে আচমকা জাপটে ধরে হা-হা করে হেসে উঠে বলেছিল, এইবার!

সুরেশ্বর বললে—দুর্দান্ত গোপাল সিং শুনেছি, ঊর্ধ্বশ্বাসে মাঠ ভেঙে ছুটেছিল। বেলা দুপুরে; চৈত্র মাস তখন। দু-চারজন লোক তাকে দেখেছিল। এবং বিস্ময়ের তাদের সীমা ছিল না।

সিংজী ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে! কেন? কি হল?

গোপালের গ্রাম তখন অনেকটা পিছনে। প্রায় ক্রোশ-দুয়েক। যেসব লোক দেখেছিল, তারা ঘটনার কথা তখনো জানতে পারে নি। এমন কি দু ক্রোশ দুর থেকে বীরপুরের খড়ের চালের আগুনের ধোঁয়া বা গ্রামের লোকের চীৎকারও শুনতে পায়নি।

তারা সভয়ে সরেই গিয়েছিল। গোপাল সিং ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছে। তার সামনে পড়া মানে ছুটন্ত পাগল মহিষের সামনে পড়া। সামনে পড়লে সে বারকয়েক ক্ষুরের আঘাতে মাটি ছড়িয়ে-ছিটিয়ে মাথা নিচু করে শিং সোজা করে তাকে বিঁধে গেঁথে নেবে-তারপর ফেলে দেবে ছুঁড়ে। এবং বার বার গুঁতিয়ে তাকে ছিন্নভিন্ন করে দিয়ে চলে যাবে।

একজন তার সামনে পড়েছিল। সে তাকে দেখে আঁতকে উঠেছিল। কিন্তু গোপাল তাকে আঘাত করেনি, তাকে হুংকার ছেড়ে শাসন করেনি, সেও থমকে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। তারপর পাশ কাটিয়ে আবার সামনে ছুটেছিল।

সে পালাচ্ছিল।

রায়বাহাদুরের ডায়রীতে আছে, গোপাল তার কাছে বলেছিল- ধরা পড়বার ভয়ে সে পালাচ্ছিল।

কিন্তু না। আমি ডায়রী পড়ে তার ছবিটা মনে মনে কল্পনা করেছি। ধূলায় ধুসর তার সর্বাঙ্গ। চোখদুটো বিস্ফারিত। আতঙ্কিত দৃষ্টি তাতে। হাতে আত্মরক্ষার উপযুক্ত একটা লাঠিও নেই। সব ফেলে দিয়েই সে পালিয়েছিল গ্রাম থেকে। সে পালাচ্ছিল নিজের কাছ থেকে।

 

 

সংসারে মানুষের মধ্যে যে চরমতম দুর্ধর্ষ হার্ডেনড ক্রিমিন্যাল, সে পশুই হয়ে যায়। মানুষ হয়ে বেঁচে থাকে শুধু একটি জায়গায়। সে হল তার মমতার মধ্যে।

সেই মমতার ঘর রক্তের বন্যায় ভাসিয়ে ধ্বসিয়ে উপরের ছাউনিতে আগুন লাগিয়ে ছাই করে দিয়ে সে যখন পালাচ্ছিল, তখন তার পশুত্বের হিংসা এই ঘরভাঙা মানুষটার কাছেই ভয় পেয়ে পালাচ্ছিল।

গোপাল রায়বাহাদুরকে বলেছিল—হুজুর, পানির জন্যে ছাতি ফেটে যাচ্ছিল, ভুখে পেটে যেন আগুন জ্বলছিল, কিন্তু ডরকে মারে-কোন গাঁওয়ে ঢুকি নাই—ঢুকতে পারি নাই।

লোকালয়ে সে ঢুকতে পারেনি। কার কাছে যাবে? কি করে বলবে—আমার ছেলেকে আমি খুন করে ফেলেছি, আমাকে বাঁচাও, একটু লুকিয়ে থাকার জায়গা দাও! খুন সে নতুন করেনি। কিন্তু এমন দুর্বল এমন অসহায় সে কোনোদিন হয়নি। সে লোকালয়কে দুরে রেখে এসে ঢুকেছিল তিন ক্রোশ দূরের একটা জঙ্গলে। তখন রাত্রি নেমেছে। রাত্রির অন্ধকারে জঙ্গলের মধ্যে সে খানিকটা আশ্বস্ত বোধ করে একটা বড় বটগাছে উঠে মোটা ডালের খাঁজে লুকিয়ে বসেছিল। ঘুম তার হয়নি, কাঁদতেও সে পারেনি, সন্ধেবেলা থেকে একপ্রহর রাত্রি পর্যন্ত আশেপাশের গ্রামগুলো থেকে কুকুরের ডাক শুনে চমকে উঠেছে, গ্রামের হরিনাম-সংকীর্তন শুনে চমকে উঠেছে। গভীর রাত্রে চৌকিদারের হাঁক শুনে শুধু চমকেই ওঠেনি, তার যে বুক কখনো কাঁপেনি, সে বুকখানাও ধড়ফড় করে উঠেছে। মধ্যে মধ্যে তন্দ্রা এসেছে, সে বসে বসে ঢুলেছে এবং দুঃস্বপ্ন দেখে ধড়ফড় করে জেগে উঠেছে। রাত্রিশেষে ভোরের পাখর ডাক শুনে জেগে উঠে সব অবসাদ কাটিয়ে গাছ থেকে লাফিয়ে নিচে নেমেছিল। কিন্তু যাবে কোথায়?

গোপাল নিজেই পরে বর্ণনা করেছিল সেদিনের কথা। রত্নেশ্বর রায়ের কাছেই করেছিল।

 

 

বলেছিল—বাবুজী, ভোরবেলা পাখিগুলো ঘন ঘন একসঙ্গে কলকল করে ডাকে। সে-ডাক যেন মুসাফিরখানার ‘ভোরবেলা-উঠো উঠো চলো চলো ডাকে’র মত। আমার মনে হয়েছিল বাবুজী, যেন তামাম দুনিয়ায় ‘ধরো ধরো পাকড়ো পাকড়ো’ আওয়াজ উঠে গিয়েছে। আধা-ঘড়ি একঘড়ির মধ্যে দুনিয়া আলো হয়ে যাবে, লোকজন জেগে উঠবে। গরুর রাখালেরা গরু নিয়ে মাঠে আসবে, এই জঙ্গলের ধারে ধারে গরু চরাবে; কাঠুরেরা কাঠ কাঠতে আসবে, মেয়েলোক শুকনো ডাল ভাঙতে পাতা কুড়োতে আসবে। আমি যাব কোথায়? হাতে আমার কিছু ছিল না বাবুজী। হাতের লোহার বোলোওয়ালা ডাণ্ডাটা ফেলে দিয়ে ছুটে পালিয়েছি; স্রিফ দু হাত ছাড়া আমার কিছু নেই কাছে; আমাকে ধরতে এলে আমি করব কি? লড়ব কি দিয়ে?

মনে হল—মরে যাই। নিজে থেকে মরে যাই। মাথার মুরেঠা খুলে পড়ে গিয়েছে, আছে এক পরনের কাপড়, সেই কাপড় গাছের ডালে বেঁধে ফাঁস বানিয়ে ঝুলে পড়ি। কিন্তু তাও পারিনি হুজুর! নিজেই আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম আমার নিজের ভয় দেখে। হয়তো সঙ্গে সঙ্গে হ’লে পারতাম। তখন মনে মনে হচ্ছিল—এই জঙ্গল ধরে কোনরকমে পালিয়ে যাব, যাব একেবারে গঙ্গার ওপারে; সুন্দরবনের কোন গাঁওয়ে গিয়ে একদম ভোল পাল্টে কুঁড়ে বেঁধে থাকব। খাটব খাব। কিন্তু এই দিনের বেলা এ জঙ্গল থেকে বেরুনো হবে না।

গোপাল সিংকে এ অঞ্চলে না চেনে এমন আদমী নেই। দেখলেই চিনবে আর চিনলেই লোকে হৈ-হৈ করবে। এত রোজ ধরে গোপাল যে জুলুম-জবরদস্তি করেছে, তার আক্রোশ আজ গর্ত খুঁড়ে বের করা সাপের মত বেরিয়ে পড়েছে। ফণা তুলে দুলছে।

মনে পড়ে গিয়েছিল—জঙ্গলের মধ্যে একটা ভাঙা মন্দির আছে। বটগাছ উঠে মন্দিরটাকে ফাটিয়ে দিয়েছে, তবুও গাছের শিকড়েই আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

***

ওদিকে জঙ্গলের বাইরে তখন শোরগোল উঠেছে। সন্ধের মুখে সে যখন এই জঙ্গলে ঢোকে তখন দূর থেকে কেউ দেখেছিল। তখনো এতবড় খবরটা তার কাছে পৌঁছায়নি। খবরটা এসেছিল রাত্রে। তারপর প্রহরখানেক রাত্রে কুতুবপুর কাছারীর পাইকবরকন্দাজ এবং তাদের সঙ্গে গোপালের উপর যাদের আক্রোশ তাদের একটা দল গ্রামে এসে পৌঁছেছিল।

লোকটি বলেছিল—গোপাল সিং সন্ধের মুখে এই জঙ্গলে গিয়ে ঢুকেছে আমি দেখেছি। কিন্তু খবরটা তো শুনি নাই। ভাবলাম গোপাল সিং তো, তার তো হাজার কাজ। সেই কোন কাজে এই ভরসন্ধেতে জঙ্গলে ঢুকছে! ব্যস্ত-সমস্ত দেখে হেঁকে বলতেও সাহস হয়নি—“সিং মশায়, এই সন্ধেবেলা জঙ্গলে কোথা যাবেন?”

 

 

তার কথা শুনে গোটা দলটি গাঁয়ের ভিতর অপেক্ষা করে শেষরাত্রে রওনা হয়ে এসে এই সকালেই জঙ্গলের মুখে হাজির হয়েছে। শোরগোল উঠেছিল তাদেরই।

গোপালের ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটবার উপায় ছিল না। গাছে উঠে বসে থাকতেও ভরসা পায় নি। গাছে উঠলে অসহায়। তীর মারবে, বাঁটুল মারবে। সে যথা সম্ভব দ্রুতপদে এসে হাজির হয়েছিল ভাঙা মন্দিরটার সামনে। বটগাছের ডালপালায় ঢাকা মন্দিরটা পেয়ে সে যেন বেঁচে গিয়েছিল, এক কোণে সে লুকোবে। কিন্তু ঢুকতে গিয়ে থমকে দাঁড়িয়েছিল। প্রকাণ্ড একটা সাপের খোলস দরজার মাথার একটা ফাটল থেকে লম্বা হয়ে ঝুলে রয়েছে। কিন্তু সে লহমার জন্যে। গোপাল সাপকে ভয় করে না; গোপাল শুধু লাঠিবাজ দাঙ্গাবাজ খুনখারাবিবাজ নয়, সে আরো অনেক কিছু পারে—সাপ ধরতে পারে, সাপের ওঝা, ভূত প্রেত পিশাচ তাড়াতে পারে; তার হাতে তাবিজ আছে, জড়িবুটি আছে, ওসবের ভয় তার নেই। ভয় তার মানুষকে।

সে মন্দিরের মধ্যে ঢুকে পড়ে দরজার পাশের একটা কোণায় উবু হয়ে চুপ করে বসে ছিল। লোকজন এলেও দরজার মুখ থেকে সামনের কোণ দুটো খালি দেখে ফিরে যাবে।

কিন্তু; গোপাল বলেছিল রত্নেশ্বর রায়কে (পরবর্তীকালে), কিন্তু মানুষের পাপ যব পুরা হয়ে যায় বাবুজী তখন ভগবান নারাজ হন, তিনি নারাজ হলে পার কারুর নেই। গোপালের পাপ সে-রোজ পুরা হয়েছিল, ভগবান নারাজ। কোণে বসে থাকতে থাকতে গোপাল চমকে উঠেছিল একটা গোঙানি শুনে। সাপের গোঙানি। বাপ, সে কি গোঙানি!

যেন কাল গর্ভাচ্ছে। সতর্ক দৃষ্টিতে আওয়াজের জায়গাটা আন্দাজ করে তাকিয়ে ছিল দরজার মাথার দিকে। হাঁ। ঠিক দরজার খিলানের মাথায় বটের শিকড়ে ফাটানো একটা ফাটল থেকে একটা বড় ব্যাঙের মুখের মত মুখ আর তার দুটো পলকহীন কালো চকচকে চোখ দেখতে পেয়েছিল সে। তার মুখ থেকে চেরা জিভের দুটো কাঁটা লক্লক্ ক’রে খেলছিল আগুনের শিখার মত।

 

 

সাপকে ভয় করে না গোপাল, কিন্তু বে-কায়দায় পড়েছে সে। সাপটাই আছে কায়দার জায়গায়। মাথার উপর। মাটির উপর সামনা-সামনি লড়া যায়। কিন্তু মাথার উপর দুশমন থাকলে তাকে লড়াই কি ক’রে দেবে।

গোপালের মনে পড়েছিল, সে ঠিক এই কায়দায় ছিরুদাসের ঘাড়ের উপর গাছ থেকে লাফ দিয়ে পড়ে এক কোপে ঘায়েল করেছিল।

এক উপায়, হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে পালানো। সাপটা অনেক উঁচুতে। ছোবল দিতে পারবে না। তাই করবার জন্যে সে তৈরী হচ্ছিল। কিন্তু ততক্ষণে সাপটা নামতে শুরু করেছে। গোপাল পিছিয়ে এসে বসে তৈরী হয়েছিল সাপটাকে ধরবার জন্য। মাটিতে পড়ে ছোবল দেবার জন্য ঘাড় তুললেই তার ডানহাতও পাশ থেকে ছোঁ দেবে। চেপে ধরবে তার গলা। চোয়ালের নিচে। লক্ষ্যভ্রষ্ট সে হবে না। সে বিশ্বাস তার ছিল। লক্ষ্য করছিল সে সাপটাকে, সরসর করে পলেস্তারা ওঠা দেওয়াল বেয়ে নেমে আসছে। বিরাট গোখরো! আয় বাপ! দু’হাত এক করলেও এতবড় ফণা হয় না!

ওদিকে তখন মন্দিরের সামনে লোক! তারা গোপালকে দেখে হৈ-হৈ করে এগিয়ে এসেও থমকে গিয়েছিল—আয় বাপ!

সাপটা ফণা তুলেছে, তুলেছে গোপালের দিকে নয়, পিছনে দরজার কাছে মানুষের সাড়া পেয়ে ওদিকে ফণা তুলে গর্জন করে দাঁড়িয়েছে।

গোপাল এ সুযোগ ছাড়েনি। খপ করে সে ডান হাত দিয়ে ছোঁ মেরে সাপটার চোয়ালের নিচে সজোর মুঠিতে চেপে ধরে পা দিয়ে চেপে ধরেছিল লেজটা, যেন সেটা তার হাত জড়িয়ে ধরতে না পারে। এতটুকু ভুল তার হয় নি। নিখুঁত পরিকল্পনায় সাপটাকে ধরেছিল। তারপর পা দিয়ে চাপা লেজটা বাঁ হাতে ধরে সে বেরিয়ে এসেছিল মন্দির থেকে।

 

 

তারপর তখনকার সে মূর্তি দেখে এতগুলো বরকন্দাজ-পাইক গ্রামের লোক স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। তারা ভয় পেয়ে সরে এসেছিল। দাঁতে দাঁতে সজোরে চেপে নিষ্ঠুর মুঠিতে সে সাপটাকে ধরে বেরিয়ে এসে দাঁড়িয়েছিল মন্দিরটার ভাঙা দাওয়ার উপর। তার হাতের পেশীগুলো ফুলে উঠে দেখাচ্ছিল পাথরের টুকরোর মত।

সাপ বড় পিছল জীব। গোপাল সিংয়ের মুঠো থেকে মুখটা সঙ্কুচিত করে যত সে পিছলে বেরুবার চেষ্টা করছিল, তত শক্ত হচ্ছিল গোপালের মুঠো এবং সঙ্গে সঙ্গে চোয়াল।

চোখ দুটো ঠিকরে বেরুতে যাচ্ছিল যেন। লোকে অবাক হয়ে দেখছিল। কি করবে ভেবে পাচ্ছিল না। হঠাৎ গোপালই বলেছিল—কেউ হাতিয়ার দিয়ে কেটে দাও দুশমনের মাঝবরাবর। তারপর হামি ছুঁড়ে ফেলব। এমনি ফেলব তো শয়তান ফের শির উঠাকে তাড়া লাগাবে।

বরকন্দাজ রামপুজন চৌবে এগিয়ে গিয়ে তার হাতের তলোয়ার দিয়ে সাপটাকে দু টুকরো করে দিতেই গোপাল বাঁ হাতের লেজের অংশটা পায়ের কাছে সেখানে ফেলে দিয়ে ডান হাতে ধরা মুখের অংশটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল দুরে।

তারপর বলেছিল-লে পাকড়ো। বলে সে কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়েছিল সেই দাওয়ার উপর!

এ অংশটা রত্নেশ্বর রায়কে বলেছিল- রামপুজন চৌবে। তারপর তারা গোপালকে ধরে এনেছে কুতুবপুরের কাছারীতে। ঘোড়া হাঁকিয়ে রামপুজনই এসেছে কীর্তিহাটে।

গোপাল সিং ধরা পড়েছে। পাকড়েছে বলতে গেলে সে-ই। ভবানী দেবী স্বামীর কাছে বসেছিলেন। তিনি ছুটে এসেছেন ছেলের কাছে, ওরে মায়ের সামনে আমি কথা দিয়েছি। সে কথা আমার থাকবে না?

 

 

রত্নেশ্বর বললেন—সে কি! তাই হয়? তোমার কথা থাকবে না? এখনি লোক পাঠাব। বাবা কি বললেন?

—তিনি তোকেই ডাকছেন।

বীরেশ্বর রায় হুকুম দিয়েছিলেন—গোপালকে যেন পুলিশে দেওয়া না হয়। বা তার কোন অনিষ্ট না করা হয়। কাছারীতেই তাকে আটক রাখ। ঘোড়সওয়ার গিয়েছিল হুকুম নিয়ে। কিন্তু তার আগে একজন পাইক চলে গিয়েছিল রণপায় চড়ে। পাঠিয়েছিলেন আচার্য দেওয়ান।

তিনি বুঝেছিলেন মামলায় আর গোপালের কিছু হবে না। তিনি হুকুম পাঠিয়েছিলেন সেখানকার নায়েবকে—“যে-কোনো অজুহাতে পারো গোপালকে যেন শেষ করিয়া দেওয়া হয়। সদর হইতে যে হুকুমই যাউক না কেন, তুমি এ কার্য অবশ্য অবশ্য সমাধা করিবে। আমি শপথ করিয়াছি গোপালকে শেষ করিতে না পারিলে আমি ব্রাহ্মণ হইতে খারিজ। তুমি আমার জাতি রক্ষা করিবে।”

সুরেশ্বর বললে-ব্রিটিশ আমলাতন্ত্রের কথা অনেক শুনেছ সুলতা, কিন্তু জমিদারী সেরেস্তার আমলাতন্ত্রের কথা জান না। বাংলাদেশে জমিদারদের অপকর্মের বারো আনার দায় এই আমলাদের।

একটা কথা প্রচলিত আছে—’মাটি বাপের নয়, মাটি দাপের। মাটি কেনা যায় টাকাতে কিন্তু মাটি দখল হয় লাঠিতে।’

এ কথার সৃষ্টিকর্তা কে তা কেউ জানে না। তবে এই কথাটা জমিদারদের শিখিয়েছে এই আমলারা।

দেওয়ান গিরীন্দ্র আচার্যের মুখে এ কথা দিনে অন্তত দশবার উচ্চারিত হত। সুকৌশলে তাঁরা জমিদার আর প্রজাকে দুপাশে সরিয়ে রেখে এই লাঠিখেলার আসর পেতে রাখতেন। তবে একটা কথা বলব- তাঁরা কাজ করে গেছেন নিজের ভেবে। দেওয়ান আচার্য রায় এস্টেটকে ছোট থেকে বড় ক’রে তুলেছিলেন—

কথায় বাধা পড়ল—অতীত কথার ছেদ টেনে দিলে রঘু।

রঘু চাকর এসে দাঁড়াল।

—খাবার তৈয়ার হল। দিদিমণি পুছলেন কি খাবার দিবেন? ওঘরে ঘড়িতে ঢং ক’রে একটা শব্দ হল। সুলতা নিজের হাতঘড়িটা দেখে বললে—সাড়ে দশটা! সুরেশ্বর বললে—আরো আধঘন্টা পর। গোপাল সিংয়ের কথাটা শেষ করে নিই, কি বল সুলতা?

সুলতা গোপাল সিংয়ের ছবিটার দিকে তাকিয়ে বললে—হ্যাঁ, তাই শেষ কর!

সুরেশ্বর বললে—ছবিটা তোমার ভাল লাগছে!

—ছবি তোমার সবই ভাল সুরেশ্বর। আর ছবির টেকনিক কি স্ট্যান্ডার্ড বিচার তো আমি করছি না। আমি তোমার গল্প শুনে গল্পের মানুষটাকে মিলিয়ে নিচ্ছি। তার সঙ্গে ভাবছি রায়বাড়ীর কথা, সেকালের কথা।

হেসে সুরেশ্বর বললে—সে-কাল এ-কালের কাছে বিচিত্রই বটে। সব কালই তাই।

 

 

—আমি ভাবছি কি জান? গোপাল সিং আত্মহত্যা করতে পারলে না?

–সে আমিও ভেবেছি। কিন্তু পারে নি। আত্মহত্যার একটা ক্ষণ থাকে, সে ক্ষণটা পেরিয়ে গেলে আর পারে না। এটা সব কালের কথা। সে ক্ষণটা কখন পার হয়ে গিয়েছিল তা বলতে পারব না। তবে গোপাল একটা কথা বলেছিল, বলেছিল রত্নেশ্বর রায়কে কিছুদিন পর। তখন সে রায়বাড়ীর পোষমানা মানুষ। বলেছিল—ছেলেকে মাথায় লোহার বোলো বসানো লাঠিটা মেরে, স্ত্রীর বুকে চেপে বসে গলা টিপে ধরেছিল—লোকজনে তাকে ছাড়াতে এসে আক্রমণ করেছিল। সে কি হল তা বুঝতে পারে নি। মাথায় তখন আক্রোশের আগুন। সেই আগুনেই সে নিজের ঘর জ্বালিয়ে দিয়ে ছুটে পালিয়েছিল লোকেদের ভয়ে। লোকেরা যারা তার ভয়ে কাঁপত তারাই তাকে ধরে ওই আগুনে ফেলে পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল। এমনটা কখনো ভাবতে পারে নি। তাই ওদের ওই চেহারা দেখে হঠাৎ কেমন ভয় লেগে গেল। ওদিকে বড় পুত্রবধূ কেঁদে উঠল—’মরে গেছে, মরে গেছে।’ ‘একি হল একি করলে বলো!’ আমি সেই ভয়ে ছুটে পালালাম। তারপর সাপটা যখন ফণা তুলে দাঁড়াল মন্দিরের মধ্যে তখন যে কি ভয় হল বলতে পারব না; আমি তার কামড় খেয়ে মরতে পারতাম। কিন্তু ভয়ে পারলাম না। সেটাকে ধরে ফেললাম। মরতে পারলাম না। নিজে মরতে পারব না। ফাঁসি দিয়ে মারবে সরকার তাই মারুক। কিন্তু গোপাল মরল না। ভবানী দেবী তাকে বাঁচালেন। আচার্য দেওয়ান তাকে খুন করবার গোপন হুকুম পাঠিয়েছিলেন, তাও ব্যর্থ হয়ে গেল।

***

বীরেশ্বর রায় সন্ধেবেলা খোদ রত্নেশ্বরকে পাঠালেন গোপালকে বাঁচাতে। রণপা চেপে একজন পাইক কুতুবপুর কাছারী গেছে, দেওয়ান গিরীন্দ্র আচার্য তাকে পাঠিয়েছেন। খবরটা বীরেশ্বর রায়ের কানে চুপি চুপি তুলে দিয়ে গেল দেওয়ানের সহকারী সদর নায়েব বৈকুণ্ঠ চক্রবর্তী। বীরেশ্বর রায় তাকে বিদায় করে দিয়েই ছেলেকে ডেকে বলেছিলেন—তুমি নিজে যাও রত্নেশ্বর। না-হলে তোমার মায়ের বাক্য রক্ষা হবে না। আচার্য যা ব্যবস্থা করেছেন তাতে কাল সকালেই তাঁর দেবতার সামনে দেওয়া বাক্য ব্যর্থ হবে। অপরাধ হবে, মাথা হেঁট হবে। আর সঙ্গে সঙ্গে এই দেওয়ানের হাতে গিয়ে আমাদের বাঁধা পড়তে হবে। আমাদের কাছারীতে গোপালকে বেঁধে এনে রেখেছে। খুনের দায় আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়ে আমাদেরই দায়ে ফেলতে পারে। যে চাকর মনিবের হুকুমের বিপক্ষে যায় তাকে বিশ্বাস নেই। তুমি নিজে চলে যাও। গোপালকে বাঁচাতেই হবে!

তারপর নিজের মনেই যেন বলে উঠেছিলেন—“আমার জাত রক্ষা করা! মনিবের জাত যাক তাতে ক্ষতি নেই, চাকরের জাত বাঁচুক! জাত! চাকরের জাত!”

 

 

রত্নেশ্বর রায় ডায়রীতে লিখেছেন—“পিতৃদেবের মুখমণ্ডল রক্তবর্ণ ধারণ করিয়াছিল। প্রচণ্ড ক্রোধ তাঁহার হইয়াছে তাহা বুঝিতে পারিলাম। এবং চিন্তান্বিত হইলাম। কারণ কবিরাজ ডাক্তার সকলেই তাঁকে ক্রোধ করিতে নিষেধ করিয়াছে। এমন ক্রোধ তাঁহার এই কয়মাসে আমি কখনো দেখি নাই। বাল্যকাল মনে পড়িতেছে। যখন তাঁহার সম্মুখে গেলেই তিনি ক্রুদ্ধ হইতেন। বলিতেন—লইয়া যা, উহাকে এখান হইতে লইয়া যা। আজিকার ক্রোধ অন্যরূপ। প্রাণপণে ক্রোধকে চাপিয়া আছেন। আমি তাঁহাকে বলিলাম—আপনি ক্রুদ্ধ হইবেন না। আমি অবিলম্বে প্রতিকারার্থ কুতুবপুর গমন করিব।”

—কুতুবপুরের নায়েব যদি গোপালকে দেওয়ানের পত্র পেয়ে শেষ করেই থাকে তবে তাকে সঙ্গে সঙ্গে বেঁধে পুলিশের হাতে। না, পুলিশের হাতে দেওয়া ঠিক হবে না। কারণ ভবিষ্যতে প্রজাশাসনের জন্য বে-আইনী কিছু করতে হয় তা করতে ভয় পাবে কর্মচারীরা। তুমি তাকে বেঁধে এখানে পাঠাবে। কাল সকালে তুমি ফিরে আসবে। আমার উৎকণ্ঠার সীমা রইল না।

***

কুতুবপুরের নায়েব বিচক্ষণ লোক। দেওয়ান আচার্যের পত্র পড়ে তার খটকা লেগেছিল। “সদর হইতে যে হুকুমই আসুক না কেন, তুমি এ কার্য অবশ্য অবশ্য করিবে।” কথাটায় সে থমকে গিয়েছিল; “সদর হইতে যে হুকুমই আসুক না কেন?” তা হলে সদর থেকে অন্য রকম হুকুম আসবে বা আসছে। আচার্যের হুকুমই আগে পৌঁছেছিল। দেশী বাগ্দী পাইক রণপা চড়ে গেছে। রণপা, তুমি নিশ্চয় বোঝ সুলতা; সে কালের ‘রণপাত ভাল ঘোড়ার সমান যেত, এমনকি পাকা রণপা-দার হলে তার থেকেও জোরে যেতে পারতো। তা ছাড়া ঘোড়ার পথ সড়ক ধরে আর ‘রণপা’র পথ মাঠে মাঠে নাকের সোজা। রণপার একমাত্র বিপদ কাদায় জলে। কিন্তু মাসটা তখন চৈত্রের শেষ, সুতরাং কাদা জলের বাধা বিঘ্ন তখন পাবার কথা নয়।

বীরেশ্বর রায়ের হুকুমবাহী সওয়ারও খুব দেরীতে পৌঁছায় নি, ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই পৌঁছেছিল। হুকুমনামা পড়ে তিনি তখন ভাবছিলেন কি করবেন!

তখন গোটা বীরপুরের লোক ভেঙে এসেছে কাছারীতে। একদিনে একটি ঘটনায় বীরপুর বিজয় সম্পূর্ণ। গোপাল সিং বাঁধা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারা কুতুবপুরের কাছারীতে এসে হাজির হয়েছে। আনুগত্য জানাতেই এসেছে। এমন কি যে দুর্ধর্ষ লোক গোপালের ডান হাত বাঁ হাত বা হাতের আঙুল ছিল তারাও এসেছে। শুধু কীর্তিহাটের জমিদারের ভয়েই নয়, গোপালের এই নিষ্ঠুরতম কৃতকর্মের আঘাত কেউ সহ্য করতে পারে নি, এই ঘটনার পর বিমুখ হয়েছে সবাই।

এরই মধ্যে রাত্রি এক প্রহরের সময় রত্নেশ্বর রায় সদলে গিয়ে উপস্থিত হয়েছিলেন কাছারীর সামনে।

***

প্রথম কথা জিজ্ঞাসা করেছিলেন রত্নেশ্বর রায়- গোপাল সিং কোথায়?

নায়েব বুঝতে পেরেছিলেন প্রশ্নের অর্থ। সে বলেছিল—আছে হুজুর, বেঁধে রেখে দিয়েছি। না-হলে তো তাকে আটকানো যায় না! হয়তো দরজা ভেঙে আবার হাঙ্গামা করে

—ঠিক করেছেন! কি বলছে সে?

—কিছু না, মড়ার মত পড়ে আছে। বোবা হয়ে গিয়েছে। প্রথম কিছুক্ষণ চেঁচামেচি করেছিল। কিন্তু তারপর চুপ হয়ে গিয়েছে।

—ওর বাড়ীর লোকেরা? তারা আসেনি?

—কে আসবে? বড়ছেলে মরেছে; বড় স্ত্রী এখনো পড়ে আছে। এমন ক’রে গলা টিপে ধরেছিল যে এখনো জল খেতে পারছে না। ছোট বউ আছে, তার বয়স অল্প, সে কাছারীতে আসে নি। বড়ছেলের দুই ছেলে, তাদের উঠতি বয়স, তারা বলে-পেলে ওর জান নেবে। কে আসবে!

—চলুন, আমি তার সঙ্গে দেখা করব। আর একখানা গরুর গাড়ী ঠিক করুন। এক্ষুনি। আমি রাত্রেই ফিরব। গোপালকে নিয়ে যাব কীর্তিহাটে। কোথায় গোপাল?

গোপাল কাছারীবাড়ীর কয়েদ ঘরে হাতে পায়ে বাঁধা অবস্থায় পড়ে ছিল। ঘরখানার তালাবন্ধ দরজায় দুজন সমর্থ-শক্ত জোয়ান মোতায়েন ছিল। রত্নেশ্বর ঘরের দরজায় আসতেই তারা ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করলে।

তালা খুলে রত্নেশ্বর ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই তাকে ডেকেছিলেন—গোপাল সিং!

নায়েব বলেছিলেন—গোপাল সিং, ছোট হুজুর নিজে এসেছেন। গোপাল!

বিশালকায় গোপাল সিং হাতে পায়ে বাঁধা অবস্থায় মাটির উপর পড়েছিল, ধূলা মাথা সর্বাঙ্গ, পরনের কাপড়, গায়ের আংরাখা এখানে ওখানে ছেঁড়া; মাথায় বাবরি চুল, গাল পাট্টা গোঁপ ধুলোয় জট বেঁধে গেছে। অসাড় নিস্পন্দ। মুখখানা আলোর দিকে ঘোরালে গোপাল সিং; রত্নেশ্বর রায় দেখলেন, গোপালের মুখ আঘাতের চিহ্নে ক্ষত-বিক্ষত। কপালে কয়েকটা ক্ষতচিহ্নের উপর কালোরঙের কিছু জমাট বেঁধে আছে। বুঝলেন, গোপাল নিষ্ঠুর নির্যাতনে নির্যাতিত হয়েছে।

তিনি এগিয়ে গেলেন।

সুরেশ্বর বলতে বলতে থেমে গেল।

সুলতা তার মুখের দিকে তাকালে। দেখলে সুরেশ্বরের চোখ চক্‌চক্ করছে। কোন একটা উত্তেজনায় সে যেন উত্তেজিত হয়ে উঠেছে।

সুরেশ্বর তার দিক থেকে মুখ সরিয়ে নিয়ে একটু বেঁকে মাটির দিকে চেয়ে রইল কিছুক্ষণ। যেন কিছু ভাবছে। হঠাৎ একটা গভীর দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সুরেশ্বর মুখ ফিরিয়ে বললে—মাফ করো সুলতা, গোপাল সিংয়ের কথা বলছিলাম, হঠাৎ মনে পড়ে গেল ১৯৩৭ সালের সেই দিনের কথা। বিমলেশ্বর রায়কে কোমরে দড়ি বেঁধে পুলিশ গ্রাম ঘুরিয়ে নিয়ে বেড়াল। তারা দেখালে, ইংরেজের রাজসাক্ষীর উপর জুলুম করার ফল দেখো। এ যারা করবে, তাদের দশাও এই হবে।

কিন্তু তার সঙ্গে শিবুর বাবা গোপালের পৌত্র হরি সিং দফাদার যে কুৎসিত আস্ফালন ক’রে বেড়ালে, সেই কথাটা মনে পড়ে গেল। সে রায়বাড়ীর ঊর্ধ্বতন প্রত্যেক জনকে গাল দিয়ে বেড়িয়েছিল পুলিশ দলের সঙ্গে সঙ্গে।

কথাগুলো বলছিল সে বিমলেশ্বরকে।

—ডাকো—তোমার বাবা শিবেশ্বর রায়কে ডাকো। তার বাবা সে-ই সব-সে বড়া বদমাশ, সেই তুমাদের বাঘে গরুতে একঘাটে জলখাওয়ানো—সেই রায়বাহাদুর রায়বাবুকে ডাকো। তার বাবাকে ডাকো। রাখুক তোমাকে আজ। আঃ, আজ আমার বুকটা ঠাণ্ডা হল। হাঁ-আগুন মে জল পড়লো। আমার দাদো গোপাল সিংকে হাতে পায়ে বেঁধে কুতুবপুর কাছারীর কয়েদখানায় ধুলো আর গর্দার উপর ফেলে রেখেছিল। জমিদার! হাতে মাথা কাটে। যাও, আজ তুমি যাও, রায়বাহাদুরের বাহাদুর পোতা, বেটার বেটা তুমি যাও—হাজতঘরে হাত-পা বাঁধা হয়ে পড়ে থাকো গোপাল সিংয়ের মতন! হা-হা করে হেসে বলেছিল—আজ শোধ হইল। হাঁ কলেজা ঠাণ্ডা হইল। হাঁ-হাঁ বাবা, এখুন কি হয়েছে। তুমাদের ঘর পড়বে ইট খসবে নীলাম হবে। আমি কিনব। হাঁ আমি কিনব। আমার শিবুকে সরকার বিলাত পাঠাবে। ব্যালিস্টার হবে। বহুৎ টাকা রোজগার করবে-সে কিনবে। আর তুমাদের বহু বেটী আসবে, আর আমার দাদি যেমন করে রায়গিন্নীর পা ধরে কেঁদেছিল তেমনি করে কাঁদবে। ঘর থেকে তাড়াও না সিং সাহেব। ঘর থেকে তাড়াও না।

লোকে পুলিশের ভয়ে স্তব্ধ হয়ে শুনেছিল। সেদিন আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম এর শোধ নেব। কিন্তু পারি নি। কথাটা মনে হলে আজও শরীরে জ্বালা ধরে আমার। চুপ করলে সুরেশ্বর। কিছুক্ষণ পর বললে—থাক—। জবানবন্দীতে এসব কথার ঠাঁই নেই। গোপাল সিংয়ের ওই অবস্থা দেখে কিন্তু তরুণ রত্নেশ্বর রায় বিচলিত হয়েছিলেন।

তাঁর ডায়েরীতে তিনি লিখেছেন—“প্রচণ্ড ঝঞ্ঝাবাত্যায় উৎপাটিত বটবৃক্ষের মত ধুলিধূসর হইয়া পড়িয়াছিল। নায়েবের কথা শ্রবণ করিয়া সে সেই বন্ধন অবস্থার মধ্যেই মুখ ফিরাইয়া বিস্ফারিত দৃষ্টিতে আমার দিকে নিরীক্ষণ করিয়া রহিল।”

রত্নেশ্বর বলেছিলেন—গোপাল সিং!

হেসে গোপাল বলেছিল—আমাকে বেঁধে পুড়াইয়ে মারবেন, না, কালীমায়ের ঠাঁই কাটবেন?

রত্নেশ্বর বলেছিলেন—না গোপাল। আমার যে-ভালো-মায়ের অপমান করায় আমি তোমাকে চড় মেরেছিলাম, সেই ভালো-মা আমার তোমাকে ক্ষমা করেছেন, বলেছেন তোমাকে বাঁচাতে হবে। আমি তোমাকে বাঁচাতে এসেছি।

রত্নেশ্বর তাঁর ডায়রীতে লিখেছেন—“আমার বাক্য শ্রবণ করিয়া গোপাল স্তম্ভিত হইয়া গেল! কোন বাক্য তাহার মুখ হইতে নির্গত হইল না। আমি আবার বলিলাম—গোপাল আমি মিথ্যা বলি নাই। আমি তোমাকে কীর্তিহাটে লইয়া যাইব। অদ্য রাত্রেই অল্পক্ষণের মধ্যেই রওনা হইব। তোমার কনিষ্ঠা স্ত্রীও তোমার সঙ্গে যাইবে। ভালো মা তাহাকে আশ্রয় দিয়াছেন। সে পরশু রাত্রেই কীর্তিহাট গিয়া ভালো মায়ের শরণাপন্ন হইয়াছিল।”

এতক্ষণে গোপাল চিৎকার করে উঠেছিল—বাবুজী!

রত্নেশ্বর চমকে উঠেছিলেন। ক্রুদ্ধও হয়েছিলেন। কিন্তু আত্মসম্বরণ করে গম্ভীরভাবে বলেছিলেন—গোপাল!

গোপাল আর কথা বলে নি, ঘাড় নেড়ে জানিয়েছিলেন—না—না—না।

—তুমি যাবে না?

—না বাবুজী, যাব। জরুর যাব। আমি বলছি—না, কুছু না।

—তুমি সারাদিন কিছু খাও নি। কিছু খাও।

—পানি পিয়েছি বাবুজী।

—পানিতে তেষ্টা যায়, ক্ষিদে যায় না গোপাল, কিছু খাও।

কুছু খাব? বহুৎ খাইয়েছি ছোটা হুজুর, বহুৎ খাইয়েছি। জোয়ান বেটার মাথা ভেঙে কাঁচা কাঁচা রক্ত খাইয়েছি।

একটু চুপ করে ছিলেন রত্নেশ্বর রায়। তারপর বলেছিলেন—যা হয়ে গেছে তার উপায় নেই গোপাল সিং। তবু বাঁচতে হলে খেতে হয়—খাও কিছু। আমি তোমার ছোট স্ত্রীকে খবর পাঠাচ্ছি। সে আসবে। সে-ই তোমাকে খাওয়াবে।

গোপাল সিংয়ের কনিষ্ঠা পত্নী খবর পেয়ে এসে গোপালকে সত্যিই খাইয়েছিল। গোপাল কি খেয়েছিল জান সুলতা? সের খানেক দুধ। কিন্তু তার আগে সে রত্নেশ্বর রায়ের কাছে হুকুম নিয়েছিল, এক ছিলম গাঁজা খাওয়ার।

বলেছিল—নেশা না করলে মুখে কিছু রুচবে না ছোটা হুজুর। মদ খাব না। মদ খেলে খুন চাপে। গাঁজা! গাঁজা পিবার হুকুম না দিলে খেতে পারব না!

***

কীর্তিহাটে পৌঁছে গ্রামে ঢুকবার আগে গোপাল সিং একবার চঞ্চল হয়েছিল। হঠাৎ চিৎকার ক’রে উঠেছিল—না-না-না। ছোটা রায় হুজুর!

ঘোড়ার উপর রত্নেশ্বর রায় তখন অনেকটা এগিয়ে কীর্তিহাটে ঢুকছেন। তখন ভোররাত্রি; মধ্যরাত্রি পর্যন্ত উৎসব হয়েছে। সে রাত্রে রাজকীয় অতিথিদের উপস্থিতিতে বাঈনাচ, খেমটা নাচ হয়েছে। উৎসব শেষ হবার পর লোকজন ঘুমিয়েছে। পরপর তিনরাত্রি জাগরণের ঘুম। গ্রাম স্তব্ধ

রত্নেশ্বরের ডায়রীতে আছে—“আমি কাঁসাইয়ের বাঁধের উপর ঘোড়ার রাশ টানিয়া দাঁড়াইলাম। গোপাল সিং-এর গাড়ী অনেক পিছনে পড়িয়াছে। তাহাকে ফেলিয়া আমি গ্রামে ঢুকিলাম না। কারণ আমি দিব্যদৃষ্টিতে দেখিতেছি করুণাময়ী মদীয় মাতাঠাকুরানী গোপাল সিংয়ের নিরাপত্তার জন্য জাগিয়া আছেন। আমি একাকী গেলেও তিনি মানিবেন না। তদপেক্ষা তাহাকে সঙ্গে লইয়া যাওয়াই ভালো।”

কাঁসাইয়ের ওপারে এসেই গোপাল চিৎকার শুরু করেছিল। সওয়ার এপার থেকে এসে খবর দিয়েছিল রত্নেশ্বর রায়কে। রত্নেশ্বর রায় অত্যন্ত তিক্ত মনেই ফিরে ওপারে গিয়ে রূঢ়স্বরে জিজ্ঞাসা করেছিলেন—কি? চিৎকার করছ কেন?

গোপাল বলেছিল-আমাকে কেটে এই নদীতে গেঢ়ে দিন রায়বাবু, আমাকে হাত পা বেঁধে লিয়ে যাবেন না। মারিয়ে ফেলেন আমাকে। আমি গোপাল সিং–আমি—

এবার সে হাউ হাউ করে কেঁদেছিল ছোট ছেলের মত।

দীর্ঘ অবগুন্ঠনবতী গোপালের স্ত্রীও হাত জোড় করেছিল রত্নেশ্বরের সামনে।

রত্নেশ্বর কয়েক মুহূর্ত ভেবে হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দিতেই হুকুম দিয়েছিলেন। ভোররাত্রিতে তাঁরা এসে পৌঁছেছিলেন কীর্তিহাটের কাছারিবাড়ীর সামনে। সেদিনও তখন মঙ্গলারতি হচ্ছে। ভবানী দেবী মন্দিরের দাওয়ায় মায়ের সামনে হাত জোড় করে দাঁড়িয়ে ছিলেন। আরতি শেষ হতেই রত্নেশ্বর তাঁর সামনে এসে বলেছিলেন—গোপালকে সঙ্গে ক’রে নিয়ে এসেছি মা!

—এনেছিস! বলেই হাত জোড় করে দেবীর দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন- আমার মুখ রেখেছিস মা। রায় সংসারের মুখ যেন এমনি করে চিরদিন রাখিস, মা!


© 2024 পুরনো বই