৮
বিকেলে হয়েছিল বাইরের লোকেদের সঙ্গে সম্ভাষণ। নায়েব আচার্য এই দিনেই পুণ্যাহের দিন স্থির করেছিলেন। কালীবাড়ীর বারান্দায় বীরেশ্বর রায়ের পাশে বসে রত্নেশ্বর রায় পুণ্যাহের টাকা গ্রহণ করবেন স্থির ছিল।
পুণ্যাহ সাধারণত বৎসর শুরু না হলে হয় না। চৈত্র মাসে আখেরী গেলে তবে পুণ্যাহের কথা। কিন্তু সে প্রথা লঙ্ঘন করে আচার্য দোলের দিন পুণ্যাহের ব্যবস্থা করেছিলেন। বলেছিলেন-আমরা চৈত্র কিস্তির রাজস্ব দাখিল করে দাখিলা নিয়েছি কালেক্টরিতে। সুতরাং সম্পত্তিতে তো আমাদের স্বত্ব আগামী বছরেও বজায় আছে। প্রজাদের সঙ্গে বছরের হিসেবনিকেশ চৈত্রতেও শেষ হবে না। চলবে। সুতরাং পুণ্যাহ করব, তাতে কার কি বলবার আছে?
বিকেলে বীরেশ্বর ক্লান্ত ছিলেন বলে নিচে নামেন নি। তিনি সন্ধ্যার পর নামবেন। রত্নেশ্বর একলা বসেই পুণ্যাহের ‘সেহা’ ও টাকা নিচ্ছিলেন। পাশে গিরীন্দ্র আচার্য বসে ‘সেহা’ অর্থাৎ মহালদিগরের নামধাম ইত্যাদি মিলিয়ে নিয়ে টাকা গুনে রত্নেশ্বর রায়ের হাতে দিচ্ছিলেন এবং দুজন নায়েব বসে সেহাগুলিতে এস্টেটের মোহর ছাপ দিয়ে মণ্ডলদের ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন। এবার পুণ্যাহের টাকার সঙ্গে আরো একদফা টাকার আমদানী ছিল। সেটা রায়বংশের নতুন উত্তরাধিকারী রত্নেশ্বর রায়ের নজরানা। মণ্ডলেরা নজর দিয়ে প্রণাম করছিল। একজন কর্মচারী লিখে যাচ্ছিলেন নজরানাদাতা প্রজার নাম ও পরিমাণের অঙ্ক। ওদিক থেকে আর একজন বিদায় করছিল মণ্ডলদের। প্রত্যেককে কাপড় চাদর এবং নগদ টাকা দিয়ে বিদায়। টাকা রাখা হচ্ছিল রূপোর ঘড়াতে!
পুণ্যাহ আরম্ভে ঢাক বেজে থাকে—আবার শেষেও বাজে। ঢাকের অগ্রাধিকার বজায় রেখেও রসুন-চৌকি বাজবার ব্যবস্থা। পুণ্যাহের আমদানী শেষ হলেই টাকার ঘড়া নিয়ে গিয়ে কালীমায়ের বেদীর নিচে রাখা হবে। সঙ্গে সঙ্গে ঢাক বাজবার কথা।
কিন্তু আচার্য হাত তুলে ঢাক বাজাতে নিষেধ করে হেঁকে ঘোষণা করে বললেন —কাল সকালে মহলদিগরের খেয়াঘাট যা সরকারী নয়, আর হাট, তার সঙ্গে বার্ষিক জলকর আর বনকরের পাতা মহল, কয়লা মহলের ডাক হবে। যারা ডাকবে তারা যেন উপস্থিত হয়। আর একটা কথা, এবার পুণ্যাহে সব মহলের পুণ্যাহের টাকা এসেছে। আসেনি একমাত্র মণ্ডলান তৌজি বীরপুরের টাকা! সুতরাং এই মণ্ডলান তৌজির মণ্ডল আর মণ্ডল থাকতে চায় না বা অক্ষম। কাজেই কাল ওইসব ডাকের সঙ্গে এই বীরপুরের মণ্ডলপদ ডাকের ওপর বিলি করা হবে। সর্বাগ্রে এই মণ্ডলানের ডাক হয়ে তবে অন্য ডাক হবে। নে, এবার বাজা। না, দাঁড়া। সন্ধের পর রাজরাজেশ্বর প্রভুর মা আনন্দময়ীর দোল খেলা হবে। তারপর রাত্রে হবে কীর্তন গান। আর কৃষ্ণযাত্রা। বাজী পুড়বে। ব্যাস হয়েছে, নে, বাজা।
ঢাক বাজতে শুরু করেছিল।
সমস্ত কিছুর মধ্যে আনন্দ এবং উল্লাসের একটা স্রোত বইছিল, তার মধ্যে একটি অন্তঃস্রোত বইছিল বা গভীর একটা ঘূর্ণি আবর্তিত হচ্ছিল, যেটির লক্ষ্য হল গোপাল সিং। বহুজন অর্থাৎ বহুপ্রজার ছোটখাটো দরবারও আছে। বাকী খাজনা পড়ে গেছে, কিছু মাফ চাই। না-হলে পেরে উঠছে না। দু’একজন অতি নাতোয়ান প্রজা বাকীটা সবই মাফ চায়। কেউ এসেছে-তার একটি মালের পুকুর আছে, সেটি সে সেলামী দিয়ে নির্দায় বা মোকররী মৌরসী করে নিতে চায়।
কেউ চায়—জমিদারের খাস পুকুর বন্দোবস্ত নিতে।
কেউ চায়-তার বাপ জমিদারের খাস পতিতে গাছ লাগিয়েছিল সেই গাছগুলির ছাড় নিতে। হুজুরের দয়া হলে যদি তলস্থ জমিটুকুও পায় তবে সে একটা বাগান করবে। ছেলেরা আম কাঁঠাল খাবে।
দু’চারজন এসেছে—দেবতা প্রতিষ্ঠা করবে তার জন্য পাকা ইমারতের অনুমতি চাই।
অনেক ব্রাহ্মণ এসেছেন, তাঁদের কারুর আছে টোল, কারুর আছে দেবসেবা, তাঁরা জমিদার দপ্তর থেকে বৃত্তিপ্রার্থী। কেউ কেউ দু-চার বিঘা জমিপ্রার্থী। বাউল-বৈরাগীরাও এসেছে, তারা মহাপ্রভুর সেবা করে, আখড়া স্থাপন করেছে। সেবার জন্য দু-চার বিঘা জমি তারাও চায়। তবে তারা ব্রাহ্মণদের মত নিষ্কর চায় না, খাজনা দেবে, তবে সেলামী দিতে পারবে না।
গোমস্তাদের মধ্যেও প্রার্থী আছে, তারা তহবিল তছরূপ করেছে, মামলা হচ্ছে বা হবে, তার থেকে তারা অব্যাহতি চায়।
কুম্ভকারেরা এসেছে—জমিদারের খাস জায়গায় মাটি নিতে, খাজনা দিতে হয় সেটা মাফের অনুমতি হোক।
মেদিনীপুরে মাদুরের অনেক কারিগর আছে। তারা মাদুরের কাঠির চাষ করে জলা জায়গায়, বিলে, পুকুরে, তার খাজনা লাগে, সেটা মাফ করা হোক।
কোনো গ্রামের লোকের আর্জি—তাদের গ্রামে পানীয় জলের অভাব, পুকুর একটি কাটিয়ে দেওয়া হোক।
কোন গ্রাম চায় গ্রামের সরকারী দেবস্থানের উন্নতির জন্য অর্থসাহায্য।
গুজব রটেছে, এবার বীরেশ্বর রায় কল্পতরু হয়েছেন, ফেরাবেন না কাউকে। ওই নতুন বংশধরের হাত দিয়ে যে যা চাইবে দেবেন।
এরই মধ্যে গোপাল সিংয়ের ব্যাপারটি শুধু ক্রুর-কুটিল। দেওয়ান আচার্য দীর্ঘাকৃতি ভগবান মণ্ডলকে চোখে চোখে রেখেছেন। সে এসে উঠেছে তার শ্বশুরবাড়ীতে, কিন্তু দুবেলা তার খাবার নিমন্ত্রণ রায়বাড়ীতে। জলখাবার বা দেবতার প্রসাদ উপলক্ষ্য করে মিষ্টান্ন ফলমুল ভগবানের শ্বশুরবাড়ীতে ভগবানের জন্য পাঠানো হচ্ছে, মায় ভাল তামাক, টিকে পর্যন্ত পাঠাতে ভোলেন নি তিনি। একজন অতি সাধারণ লোককে তিনি ভগবানের শ্বশুরবাড়ীর সামনে মোতায়েন রেখেছেন ভগবানের উপর নজর রাখবার জন্য। ভগবান যেন না পালায়। কয়েকবার তাকে ডেকে কথা বলে বুঝতে চেষ্টা করেছেন, সে সাহসে ঠিক আছে কিনা। এবং সাহসও তাকে দিয়েছেন।
এবেলা পুণ্যাহ শেষ হতেই বীরেশ্বর রায়ের ঘরে রত্নেশ্বরকে বসিয়ে ভগবানকে ডেকে পাঠালেন। এ ঘরের দরোয়ান এখন ছেদী সিং, সে কাটা পা নিয়ে একটা চওড়া টুলের উপর মস্ত মুরেঠা বেঁধে বসে থাকে; হুকুমমত বাইরের লোককে দরজা ছেড়ে দেয়। আচার্য বললেন—ছেদী, খুব লম্বাসে এক আদমী, সমঝা—কালাসে—আয়েগা, পাইক লে আয়েগা, উস্কা খাতির দেখলাবে। আর বলবে, চলে যাইয়ে মণ্ডলজী, ছোটা হুজুর তো আপকা লিয়ে বৈঠা হ্যায়। আঁ? উসকা পাশ হামলোকের কাম হ্যায়। উ লেনে হোগা। সমঝা
—হ্যাঁ হুজুর। সমঝ লিয়া! খাড়া হো যাঁউ?
—না-না। খাড়া কেন হোগা? ওতনা নেই। তবু ওরই মধ্যে সমঝাচ্ছো না? থোড়া খাতির! হুঁ!
বলে হেসে তিনি ঘরের মধ্যে গিয়ে রত্নেশ্বরকে বুঝিয়েছিলেন, কি বলতে হবে! রত্নেশ্বর বলেছিলেন—ভগবান নেবে। আপনি ভাববেন না। আমি তাকে বোঝাবার জন্যে ঠাকুরদাস দাদাকে লাগিয়ে রেখেছি! ঠাকুরদাসদের সঙ্গে কুটুম্বিতে আছে।
একটু হেসে আচার্য বলেছিলেন—বহুৎ আচ্ছা বাবুজী সাহেব। আপনার বুদ্ধি রাজবুদ্ধি। জানেন একটা কথা আছে, কাঁটার মুখে শান দিতে হয় না, কাঁটা আপনার ধার নিয়েই গজায়; তেমনি রাজা জমিদারের ছেলেকে রাজবুদ্ধি শেখাতে হয় না, ও নিয়েই জন্মায়।
.
রত্নেশ্বর ভগবানকে কথা দিয়েছিলেন—তুমি শুধু সামনে দাঁড়াও ভগবান। যা করবার আমি করব। টাকা লোক সব আমার। কিছু ভাবতে হবে না তোমাকে
উবু হয়ে বসে হাতজোড় করে ভগবান বলেছিলেন- আমি ঠিক আছি হুজুর। আজ পঁচিশ বছর এই মনে মনে জপছি। এই দ্যাখেন।
বলে হাঁটুর উপরে কাপড়টা তুলে দেখিয়েছিল, উরুতের উপর এক দাগ। কাটা দাগ।
—ওটা কি?
—গোপাল আমাকে কুপিয়েছিল হুজুর। তখন আমার জোয়ান বয়স। গোপালও তখন জোয়ান, আমরা হাম জুটি। প্রথম প্রথম আমি মশায় ওর ডান হাত ছিলাম। আমার বাবার অবস্থা ভাল ছিল খাতির করত! একবার বাবু আমার জ্যেঠার জমি কিনলে পাঁচ কাঠা, জ্যেঠার কন্যেদায়ের সময়। তার সঙ্গে আমাদের এক কিত্তে জমি, হুজুর দো ডাকলে রা কাড়ে, সে কিত্তেটার অর্ধেক আর পাঁচকাঠা জমির সঙ্গে রাতারাতি আল কেটে এক করে দিলে। আমি সামলাতে পারি নাই, মশায় ছুটে গিয়ে ওকে বলেছিলাম—ডাকাত কোথাকার?
ও মশায় হেঁসো দিয়ে কেটে তাল খাচ্ছিল। সেই হেঁসোটা খপ করে বসিয়ে দিলে এইখানে। ছ মাস বিছানায পড়েছিলাম। কিন্তু কি করব? রাজাদের প্রিয়পাত্র। দারোগামুন্সীর সঙ্গে খাতির। মুখ বুজে আজ এই পঁচিশ বছর পড়ে আছি। সয়ে যাচ্ছি। এবার আপনকার মত বল পেয়েছি, আমি পিছুব কেন?
—মেয়েছেলে সব নিয়ে এসেছ?
—আজ্ঞে হ্যাঁ। সবাই এসেছে।
—দেখ, আমার ধারণা, খবরটা পৌঁছুবামাত্র ও খেপবে। ঘরে আগুন লাগানো ওর একটা ঝোঁক। শেকল দিয়ে আগুন দেয়। সেই জন্য বলছি। ঘর পুড়লে আমি ঘর করে দেব। বুঝেছ। আমি লোকবল দেব!
—গরু-বাছুর? তার ব্যবস্থা?
—সে ম্যানেজারবাবুর কথা মত কাল ভোরে আমার লোকেরা চরাবার নাম করে নিয়ে যাবে মাঠে, আপনকার কুতুবপুরের কাছারীর চাপরাসীরা ধরে নিয়ে যাবে কাছারীতে।
ঠাকুরদাস বসেছিল তার পিঠের কাছে। পৃষ্ঠবলের মত। ঠাকুরদাস সেই কলকাতা থেকে এ পর্যন্ত বরাবর রত্নেশ্বরের সঙ্গে আছে। শুধু শ্যামনগরের শোধের সময় তাকে কলকাতায় একরকম আটক রাখা হয়েছিল। আসতে দেওয়া হয়নি। সে সঙ্গে থাকলে অ্যালিবি সত্ত্বেও বিপদের সম্ভাবনা, ছিল। শ্যামনগর ফিরতেও দেন নি আচার্য। বলতেন—কত্তার হুকুম নাই। তুমি যাও, গিয়ে হুকুম নিয়ে এস।
কিন্তু সে ভরসা ঠাকুরদাসের হত না। এবার সে এসেছে এবং শ্যামনগরের অভ্যাগত ভট্টাচার্যদের জ্ঞাতিদের এবং অন্যান্য লোকেদের দেখাশুনার ভার তার উপর। শ্যামনগরে ধর্মঘট আজও অব্যাহত ভাবে চলছে। গত আট মাস ধরে একটি পয়সা আদায় পায় নি দে সরকার। ওদিকে রবিনসনের দেনার ডিক্রীতে ঠাকুরপাড়ার কুঠী ক্রোক হয়ে আছে। ওয়ারিশান সাব্যস্ত হয় নি বলে আজও নীলামে ওঠে নি। ঠাকুরদাসের স্ত্রী-পুত্র গেছে। সংসারে কেউ নেই। ঘরের মমতা বলতে ঘর আর জমি ছাড়া কিছু নেই। সে বেশ আছে। এবং তারও প্রতিজ্ঞা—শ্যামনগর দে-সরকারদের হাত থেকে কীর্তিহাটে না আসা পর্যন্ত সে শ্যামনগরে ফিরবে না।
এ বাড়ীতে সমাদরের মধ্যে সে ভাল আছে। অনেক কিছু বুঝেছে। গোপাল সিংয়ের উপর ক্রোধ তার কম নয়। রবিনসন গেছে, দে সরকার ঘায়েল হয়েছে, এবার গোপাল সিং। সে রত্নেশ্বরের কথামত ভগবান মণ্ডলকে ভজিয়েই চলেছে।
সে এবার বললে—দাদাবাবু, আপনি একবার কর্তার সঙ্গে দেখা করিয়ে দেন কাকা মশায়ের। ওঁর একটা কথা। বুঝলেন না—তা হলেই ব্যস্!
গিরীন্দ্র আচার্য একটু হেসে বললেন—কেন হে ঠাকুরদাস, শালগ্রামের আর ছোট-বড় আছে নাকি? তোমাদের বুড়ো শিব জলে থাকেন সম্বচ্ছের, চৈত্তির মাসে তুলবার সময় দেখা যায়, অনেক বাচ্চা শিব হয়েছে। বাচ্চা হলে কি হবে, তারাও শিব। উনি বলছেন—
—আজ্ঞে না। তবে কত্তার চরণের ধুলো মাথায় নিলে বুকে বল হবে। কত বড় প্রতাপ এই আর কি! একবার কাছ থেকে চোখে দর্শন। আর দুটো বাক্যি।
রত্নেশ্বর হেসে বললেন—বেশ তো! তুই যা তো, ঠাকুরদাস দাদা দেখে আয় তো কি করছেন উনি। মাকে বলে আয়, একবার আমি যাব একজনকে নিয়ে। ওঁর সঙ্গে কটা কথা আছে!
উপরের দক্ষিণের বারান্দায় বীরেশ্বর তখন আলবোলায় তামাক খাচ্ছিলেন। ঘুমিয়েছেন এই কিছুক্ষণ আগে পর্যন্ত, তাকিয়ায় হেলান দিয়ে বসে কাঁসাইয়ের ওপারের পশ্চিম দিগন্তের দিকে তাকিয়ে আছেন। আজ জীবনের সব বিক্ষোভ যেন মিটে গেছে। সাম্রাজ্যে যেন সম্রাট হয়ে বসেছেন। কিন্তু বাঁ-পাখানা দুর্বল হয়ে গেল।
সামনে কয়েকখানা চিঠি পড়ে ছিল। কলকাতা থেকে এসেছে। তার মধ্যে একখানা চিঠি লিখেছেন বন্ধু কালীপ্রসন্ন সিংহ। তাঁকে একখানা দীর্ঘ চিঠি লিখে এসেছিলেন বীরেশ্বর রায়। কলকাতায় ফিরে অসুস্থ অবস্থার জন্য দেখা করতে পারেন নি। কোন খবরও দেন নি। এসব কথা জানাতে কেমন সঙ্কোচবোধ করেছিলেন। কিন্তু এই উপলক্ষ্যে তাঁকে চিঠি লিখে যতটা জানানো সম্ভবপর তা জানিয়েছেন।
সিংহ তাঁর চোখা কলমে অল্প কয়েক ছত্র লিখেছেন।
“রায়মহোদয়, পত্রযোগে ভবদীয় বিবরণে চমৎকৃত হলেন। কাশীধামের বিখ্যাত সতীমাতা আপনার হারানো সহধর্মিণী! এ আশ্চর্য কাণ্ড! তাঁর কথা অনেক শুনেছি মশায়। এমন কি তাঁদোড় রাম মল্লিক—তাঁর নাম করতে গদগদ হয়ে ওঠে। বলে, তাঁর চলে যাওয়ার পথ থেকে ধুলো কুড়িয়ে পুরিয়া করে নিয়ে এসেছে। পরিহাস করছি নে মশায়, মহিলাটির বিবরণ অন্যের কাছে শুনে শ্রদ্ধা হয়েছে। যাক্ আপনি ভাগ্যবান। একটা অঙ্গ কমজোরী হয়ে যাওয়ার কল্যাণে তিনি ফিরেছেন, এখন অঙ্গটাকে অক্ষম করে বসে থাকুন অন্তত তার ভান করুন। তিনি সচলা হয়ে পাশে বসে সেবা করুন। তারপর ভাগ্নেকে পোষ্যপুত্র নিচ্ছেন, এও উত্তম কথা। কলকাতায় এলে দেখব তাঁকে। এই উপলক্ষ্যে তাঁর জন্য একটি সোনার ঘড়ি পাঠালাম। বলবেন—জমিদারবাড়ীর ছেলেরা দশটার আগে বিছানা ছাড়ে না; হুতোম প্যাঁচা বলে—এতেই তাদের সর্বনাশ। বাবাজীকে ঘড়ি ধরে চলতে বলবেন, সাতটার আগেই যেন বিছানা থেকে ওঠেন। বলবেন—ভুগোলে যাই লেখা থাক, লোহিত সাগর পূর্বদিকে, সেটা যেন তিনি কলম্বাসের মত ভোরে উঠে আবিষ্কার করেন।”
তিনি তাকিয়ে আছেন পশ্চিম আকাশে সূর্যাস্তের দিকে। ভাবছেন কথাটা সিংহকে লিখতে হবে। লিখবেন—“আমি কিন্তু দিবানিদ্রান্তে পশ্চিমদিকে লোহিতসমুদ্র দেখিলাম।”
ভবানী দেবী বসেছিলেন ঘরের মধ্যে, তাঁর সামনে বসে আছেন মাসিমা নিস্তারিণী দেবী। ঠাকুরদাস ভিতরের দিকের বারান্দায় দরজার এপাশে দাঁড়িয়ে ডাকলে—মা।
—কে?
—আমি ঠাকুরদাস মা
—ঠাকুরদাস? রত্নের কাজ শেষ হল?
—হয় নি। পুণ্যের ঘড়া আনা বাকি আছে। মায়ের অর্চনা হচ্ছে।
–সে তো সন্ধের পর হবে। তুমি একবার আসতে বল তো তাকে।
—তিনি পাঠালেন মা—
—তাকে পাঠিয়ে দাও বাবা, আমি শুনব তার কাছে। আমারও জরুরি দরকার আছে। ঠাকুরদাস তাড়াতাড়ি রত্নেশ্বরের ঘরে এসে বললে—মা তোমাকে খুঁজছেন, যাও! রত্নেশ্বর এসে দাঁড়ালেন। ভবানী দেবীও ঘরে একলা বসেছিলেন, তখন নিস্তারিণী দেবী চলে গেছেন।
—আমাকে ডেকেছ?
—হ্যাঁ, এসব কি হচ্ছে তোর?
—কি মা?
—মাসিমা কাঁদতে কাঁদতে এসেছিলেন। বলেছিলেন—তিনি শুনেছেন, তাঁকে নাকি তুই তাড়িয়ে দিবি প্রতিজ্ঞা করেছিস? কেন? আমাকে সেদিন ওই কথা বলেছিলেন বলে? আমার শাশুড়ি যদি থাকতেন, তিনি যদি বলতেন? কি করতিস তুই?
রত্নেশ্বর অন্যদিন হলে প্রতিবাদ করতেন, মনে মনে ক্ষুব্ধ হতেন। কিন্তু আজ তা হলেন না। মনটা পরিপূর্ণ হয়ে আছে। একটু হেসে বললেন—তাড়িয়ে দেব বলি নি। ঠিক করেছিলাম মাসোহারা দিয়ে কাশী পাঠিয়ে দেব। এ বাড়ীর গিন্নীগিরিটা ঘুচিয়ে দেব।
—না। উনি যেমন আছেন তেমনি থাকবেন।
রত্নেশ্বর অত্যন্ত সহজভাবে বললেন—তা থাকুন। তুমি বলছ নিশ্চয় থাকবেন। কিন্তু ওঁকে বললে কে?
—বলেছেন যেই হোক। বলেছেন ন্যায়রত্নমশায়। উনি শুনেছিলেন ম্যানেজারবাবুর কাছে। কিন্তু ওসব হবে না।
—হবে না। ঠিক আছে। আমার নিজের মনটাও আজ খুঁত-খুঁত করছে দুপুরবেলা থেকে। উনি সেই তখন আশ্চর্য সুন্দরভাবে সব করালেন। আর কি সুন্দর কথাগুলো বললেন। আমি মা আশ্চর্য হয়ে গেছি। ভাবছিলাম, হ্যাঁ রায়বাড়ীতে ক্রিয়াকর্ম চালাবার জন্যে ওঁর মত গিন্নী না হলে চলে না। সঙ্গে সঙ্গে ভাবছিলামও প্রতিজ্ঞা করেছি, ভাঙব কি করে! তা ভালই হল তোমার হুকুম!
ভবানী দেবী বলেছিলেন—উনি আরো বলেছিলেন’ অঞ্জনার জন্যে। ওর স্বামীকে একটা চাকরি দিয়ে ওকে এখানে রাখার কথা। মেয়েটির বড় খারাপ অবস্থা। বড় দুঃখ। ওকে তোকে
বলতে বলে গেলেন।
রত্নেশ্বর বললেন—বেশ তো, তুমি বললে তাই হবে। তোমার ওই মাসশাশুড়িটির পর এমনি একটি অন্দর-সুপারইনটেনডেন্ট তো একজন লাগবে। অঞ্জনা মেয়েটি তা পারবে। হয়তো ঠাকুমার থেকে ভাল পারবে! উনি কোথায়?
—উনি? মৃদু ধমকে উঠলেন ভবানী। একটু চুপ করে থেকে চুপিচুপি বললেন—জানিস, তুই ওঁর কথা হলেই উনি-তিনি বলে সারিস, তিনি মনে দুঃখ পান। চাপা মানুষ, বলেন না। মধ্যে মধ্যে আমাকে বলেন—রত্ন এখনো আমাকে তোমার মত নিতে পারলে না। নিলে না।
—কেমন লজ্জা করে। বেধে যায়!
—না। বাধবে কেন? যা, উনি বারান্দায় বসে আছেন, তামাক খাচ্ছেন।
রত্নেশ্বর এগিয়ে গিয়ে দরজা থেকেই ডাকলে—বাবা!
—রত্নেশ্বর! এস!
***
সুরেশ্বর বললে—সুলতা, তাই বলছিলাম, মনে মনে হিংসা, ক্রোধ যতই থাক, সেদিন যদি গোপাল আসত আর আবেদন জানাতে পারত, তবে কি হত ঠিক বলা যায় না। সমস্ত রায়বাড়ীতে সেদিন সন্তোষের একটা পরিপূর্ণ বাতাবরণ সৃষ্টি হয়েছিল। ক্ষোভ যা কিছু ওই গোপালকে নিয়ে না আসাতে এ পক্ষের সে ক্ষোভ আরো বেড়েছিল।
রায়বাড়ীর এত বড় উৎসব সমারোহের মধ্যে গোপাল সিং সম্পর্কে বিদ্বেষ ও আক্রোশের অন্তঃশীলা স্রোতটি কোথাও একবার অযথা এঁকে-বেঁকে যায় নি, সোজা বেয়ে গিয়েছিল ক্যানেলের খালের মত।
রচনাটি দেওয়ান গিরীন্দ্র আচার্যের। মহিষাদলের নায়েব ওকালতি করেছিল গোপালের জন্য। দেওয়ান আচার্য বলেছিলেন-ও কথাটা বল না হে। কত টাকা দিয়েছে গোপাল? টাকাটা তাকে ফিরে দিয়ো। আমি তোমাকে দেব ও টাকাটা।
সে আর কথা বলে নি।
পরদিন সকাল থেকে কার্যসূচী অনুযায়ী কাজ হয়ে চলেছিল। প্রথমেই ছিল একদিকে দানপর্ব, অন্যদিকে ডাকপর্ব।
কাছারীতে হচ্ছিল হাট-ঘাট, জলকর বনকরের ডাক। আর ঠাকুরবাড়ীতে চলছিল দান।
‘ডাক’-এর কাজ চালাচ্ছিলেন দেওয়ান আচার্য। তবে প্রথমেই বীরসিং মৌজার ‘মণ্ডলান’ ডাকের সময় নিজে বীরেশ্বর রায় এসে বসেছিলেন একবার। সেটা এসেছিলেন আচার্যের কথায়। ভগবানের মনোভাব বুঝে তিনি বলেছিলেন—ওই সময়টায় খোদ মালিক মানে আপনি বসলে ভাল হয়। বল পাবে।
বীরেশ্বর রায় আগের দিন সন্ধ্যার সময় রত্নেশ্বরের কথায় ভগবানের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। সাহসও দিয়েছিলেন। আচার্য হুঁশিয়ার লোক, তিনি তবুও ওই অনুরোধ করেছিলেন, এবং বীরেশ্বরও এসে বসেছিলেন। বীরপুরের মণ্ডলান পদের ডাক ডাকতে একটি মাত্র লোক, ভগবান মণ্ডল, সে এসে দাঁড়িয়ে হাত জোড় করে বলেছিল—হুজুর যদি অনুমতি দেন তো আমি ডাকতে পারি।
বীরেশ্বর হেসে বলেছিলেন—তুমি তো ভগবান মণ্ডল?
—আজ্ঞে হ্যাঁ। হুজুরের বীরপুরেরই প্রজা।
—বেশ তো। ডাকো। গোপাল তো আসে নি। ডাকো।
মানুষ মাত্রেই আপন সাধ্যভোর চতুর। ভগবানও সাধ্য-চাতুর্যের সঙ্গে দশের সম্মুখে তার অভয় এবং সাহায্যের প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিয়েছিল। বলেছিল—ডাকতে হুজুরের অভয় চাই, আশ্রয় চাই। নইলে আমি সামান্য লোক, চাষী মানুষ, আমি পারব ক্যানে?
বীরেশ্বর বলেছিলেন—নিশ্চয়। সে তুমি পাবে বইকি! নিশ্চয় পাবে। আমার কর্মচারী যাবে, পাইক-বরকন্দাজ দরকার হলে তাও পাবে। সবই পাবে। ডাকো।
ভগবান এক ডাকেই পেয়েছিল মৌজা বীরপুরের মণ্ডলান পদ। বীরেশ্বর রায় তাঁর নজরানা না নিয়ে ডাক মঞ্জুর করে উঠে চলে গিয়েছিলেন অন্দরে। তারপর কাজ চালিয়েছিলেন আচার্য।
ওদিকে নাটমন্দিরে রত্নেশ্বর বসে ছিলেন দুজন নায়েবকে নিয়ে, তিনি মহালের দেবস্থান মেরামতি বা নির্মাণ-খরচা দান ও প্রার্থীদের কাউকে কিছু জমি, কাউকে বার্ষিক বৃত্তি, কাউকে পুকুরের ছাড়, কাউকে বাগান করিবার অনুমতি মঞ্জুর করছিলেন। এ সবের ফর্দ কর্মচারীরা আগে থেকেই করে রেখেছিল, তাতেই তিনি সই করে দিচ্ছিলেন।
প্রহর খানেক, প্রহর দেড়েকের মধ্যেই এ কাজ শেষ হয়ে গিয়েছিল। তারপর আরম্ভ হয়েছিল লোকজনের জন্য উৎসব। সে নানারকম।
অন্যদিকে চলছিল আর এক বড় সমারোহের আয়োজন। তৃতীয় দিনে সব বিশিষ্ট বড় বড় লোকের শুভাগমন হবে। সাধারণ লোকজন অনেকেই চলে যাবে। তারপর হবে বিশিষ্ট অতিথি আপ্যায়ন। তমলুকের এস-ডি-ও আসবেন, কাঁথির এস-ডি-ও আসবেন। মেদিনীপুরের ডি-এস-পি, তিনটে মুন্সেফী কোর্টের মুন্সেফ, পুলিশের সার্কেল ইন্সপেক্টর, উকীল-মোক্তাররা আসবেন।
কাল সকাল থেকে বারোটার মধ্যে সকলে এসে পড়বেন। এর মধ্যে মেদিনীপুরের সদর এস-ডি-ও আসছেন সস্ত্রীক পুত্র-কন্যা নিয়ে, তাঁদের নিয়ে আসছেন বীরেশ্বরের খুড়তুতো দাদা দেবপ্রসাদ ঘোষাল এবং বউদি জগদ্ধাত্রী দেবী। ওঁরাই অনুরোধ করেছিলেন সদর এস-ডি-ও রাধারমণ চ্যাটার্জিকে সপরিবারে নিমন্ত্রণ করতে। রাধারমণবাবু দেবপ্রসাদবাবুর ভায়রা ভাই; জগদ্ধাত্রী দেবীর পিসতুতো বোনকে বিয়ে করেছেন। তাঁরা কীর্তিহাটের কথাবার্তা শুনে কীর্তিহাটে আসবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। জগদ্ধাত্রী দেবী এবং দেবপ্রসাদবাবু এই কারণেই প্রথমদিন আসতে পারেন নি, তাঁরা ওদের সঙ্গে নিয়ে আসবেন।
.
সুরেশ্বর বললে–আচার্য পাকা শিকারীর মত ব্যবস্থা করেছিলেন। ওই হ্যারিসের মত; সে যেমন শিকারীর জন্যে মাচা বেঁধে তাকে সেখানে বসাবার আগে জানোয়ারের ট্র্যাকটির ডাইনে-বাঁয়ে, এখানে-ওখানে ডালের টুকরো ফেলে রেখে জানোয়ারটিকে সোজা নিয়ে আসে মাচানের সামনে, ঠিক তেমনি ব্যবস্থা করেছিলেন।
গোপাল সিংকে জানোয়ার আমি বলছি নে, তবে গোপাল সিংকে বাঘ বলব। নরব্যাঘ্র। বিক্রম তার বড়, ক্রোধ তার অসংহত, বুদ্ধি-বিবেচনা কম এবং তাকে সে অবহেলাই করে। কতকগুলো চাতুরী তার জানা আছে, তাই সে অভ্যাস করে রেখেছে। তার অতিরিক্ত বুদ্ধির খেলা যেখানে, সেখানে সে হেরে যায়। প্রবীণ বাঘের মত চতুর, সাবধানী—চেনা পথ ছাড়া অচেনা পথে হাঁটে না। কিন্তু এবার আচার্য তার খাদ্য নিয়ে টান মেরে ছেড়ে দিতেই সে বেরিয়ে এল। ঠিক পথে পথে এল।
আচার্য জানতেন আসতে হবে।
বীরপুরের মণ্ডলান ডাকের কথা তার কাছে পৌঁছুবামাত্র সে ক্ষিপ্ত হবে। দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে কিছু একটা করবেই। সম্ভাবনাটা ছিল ভগবানের উপর ঝাঁপ দেবে। ভগবান সপরিবারে কীর্তিহাটে। আজ সকালেই তার গরু-বাছুর মাঠে যাবার কথা, কুতুবপুরের সীমানা বরাবর। সেখানে কুতুবপুরের কাছারীর পাইক-বরকন্দাজরা গরুগুলোকে ঘেরাও করে কাছারীতে পুরবে। নিষ্ফল আক্রোশে গোপাল ভগবানের জনশূন্য বাড়ীতে আগুন দিয়ে দোলপার্বণের নেড়াপোড়া বা বহ্ন্যুৎসব করবে। হয়তো কুতুবপুর পর্যন্ত ধাওয়া করতে পারে। কাছারীও পুড়তে পারে।
তিনি কীর্তিহাটেও সাবধানতা অবলম্বন করেছিলেন।
তারপরই গোপাল পড়বে শিকারীর মাচার সামনে।
পরদিন সকালে এখানে সাহেব-সুবার আগমন হবে। তাঁদের সামনেই আসবে খবরটা।
গোপাল সিংয়ের গতরাত্রির কীর্তিত রিপোর্ট।
সরকারী সাহেবদের একটা ডিউটি হল অত্যাচারী জানোয়ার শিকার করা!
সুবিধা আর একটু প্রশস্ত হয়ে গেল। সেটা হল মেদিনীপুরের সদর এস-ডি-ও রাধারমণবাবুর জন্যে। তিনি আত্মীয়। দেবপ্রসাদবাবুর ভায়রা ভাই। সদর এস-ডি-ও ফিরে গিয়ে সঙ্গে সঙ্গেই কালেক্টারকে জানাতে পারবেন।
এত বড় উৎসবের মধ্যে বিচিত্রভাবে গোপাল সিংকে নিয়ে তাঁরা যে জাল রচনা করেছিলেন কেউ অনুমানও করতে পারে নি যে, সে জাল আশী বছর পরে পর্যন্তও বিস্তৃত হয়ে রইল এবং তাতে পড়বে এবার গোপাল সিংয়ের কেউ নয়, রায়বাড়ীর এক ছেলে এবং এক মহিমাময়ী বিধবা বধু। রত্নেশ্বরেরই পুত্রবধু!
***
রত্নেশ্বর রায় ডায়রীতে লিখেছেন—“সে দিন গোপাল সিংয়ের চিন্তা ছাড়া আর কোন চিন্তাই আমার ছিল না। নানা চিন্তা হইতেছিল।”
কখনো ভাবছিলাম—যা আমরা ভাবছি, তা যদি গোপাল না করে। যদি সে ধীর হয়ে অপেক্ষা করে। তারপর? তারপর ভগবানের সঙ্গে মিটমাট করে নেয়! যদি! চমকে উঠে ভেবেছিলেন—যদি ভগবান গোপালের বেনামদারই হয় গোড়া থেকে? তাহলে তো হেরে গেলাম।
অন্তত এক বছরের জন্য হেরে গেলাম। গোপাল তার বেনামদার ভগবানকে সামনে রেখে গোঁফে তা দিয়ে বেড়াবে, আর বলবে—আরে বাবা, হামি গোপাল সিং! হামি শিয়ালকে মানে না বাবা। রায়বাবু! উ লোকেরা শিয়াল আছে। তাহলে এক বৎসর অন্তত কীর্তিহাট অঞ্চলে মুখ দেখানো চলবে না।
পথ আছে। গোয়ানরা আছে। ওরা সব পারে। কলকাতায় লোক মিলবে। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন রত্নেশ্বর।
ফাল্গুনের শেষ। কীর্তিহাট অঞ্চলের লালমাটি ফাল্গুনেই উত্তাপ আকর্ষণ করে। খেয়ে বিছানায় শুয়েও ভাবছিলেন। টানা পাখা চলছিল। তখন চিন্তার মোড়টা ফিরেছে। তখন ভাবছিলেন—খবরটা এতক্ষণে নিশ্চয় পৌঁচেছে বীরপুরে। এতক্ষণে কেন? আগেই পৌঁচেছে। আচার্যের হুকুম আছে কুতুবপুর কাছারীর উপর যে, বেলা এক প্রহর বাদে, ভগবানের গরু-বাছুর আটক করার পরই, বীরপুর মৌজার ডাকের কথা চাউর করে দেবে।
খবর গোপাল পেয়েছে। সে ভগবানের বাড়ী পর্যন্ত এসে ফিরে গেছে নিষ্ফল আক্রোশে। বাড়ীতে কিংবা হয়তো পথে পথে আস্ফালন করে বেড়াচ্ছে! ভাবছে কি করবে? অনেক কিছু করতে পারে গোপাল। অসাধ্য কর্ম তার কিছু নেই। এই আজ রাত্রে, এখানে নানা উৎসব। কাল কীর্তন-কৃষ্ণযাত্রা গেছে। আজ খেমটা নাচের আসর পড়বে। বারোটার পর শুরু হবে যাত্রাগান। বাইরে শামিয়ানা খাটিয়ে বড় একটা আসরে কবিগান, চম্পাবতীর গান চলবে। লোক আজ অনেক জমবে। গোপাল হয়তো চলে আসবে এই সুযোগে। একটু ভোল পাল্টে এলে কে চিনবে। মুখে গামছার ফেটা বেঁধে–!
ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। ঘুম নয় তন্দ্রার মতো।
সে তন্দ্রার মধ্যে গোপাল সিং রত্নেশ্বর রায়কে ছাড়ে নি, অথবা রত্নেশ্বর তাকে ছাড়েন নি। স্বপ্ন বা তন্দ্রার মধ্যে কল্পনায় তিনি ছদ্মবেশী গোপাল সিংকে দেখেছিলেন ভিড়ের মধ্যে। সে যেন ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে রায়বাড়ির দোতলার দিকে তাকিয়ে আছে ক্রুদ্ধ কুটিল দৃষ্টিতে। তিনি চিৎকার করে উঠেছিলেন—পাকড়ো! পাকড়ো! ওই ওই! তিনি বুঝতেও পারছিলেন এটা সত্য নয়, স্বপ্নের মতো কিছু, তবু জেগে উঠতে পারছিলেন না। জাগিয়ে দিলেন ভবানী দেবী। দরজা ঠেলে ঘরের মধ্যে ঢুকে গায়ে হাত দিয়ে ডাকলেন—রত্ন! রত্ন!
এতক্ষণে উঠে বসেছিলেন রত্নেশ্বর এবং লজ্জিতও হয়েছিলেন। মা জিজ্ঞেস করেছিলেন- এমনভাবে চেঁচাচ্ছিলি কেন? স্বপ্ন?
হেসে রত্নেশ্বর বলেছিলেন—হ্যাঁ। দেখছিলাম, শয়তান গোপাল সিং এসে ভিড়ের মধ্যে লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়ীতে রাত্রে থাম বেয়ে উঠবার মতলব করছে।
ভবানী দেবী বলেছিলেন-তোকে যে গোপাল সিংয়ের আক্রোশ পেয়ে বসল রত্ন! ঠিক সেই সময় দরজায় দাঁড়িয়ে একটি তরুণী মেয়ে বলেছিল—খুড়ীমা!
—আনো! ভিতরে এস!
মেয়েটি ঘরের ভিতরে ঢুকল, হাতে একটি রূপোর গেলাস। দরজার মুখে বাইরের আলো-কে পিছনে রেখে দাঁড়িয়েছিল বলে রত্নেশ্বর তাকে চিনতে পারে নি। কিন্তু ঝি সে নয়, এটা বুঝতে পেরেছিলেন। জিজ্ঞাসা করেছিলেন–কে?
—অঞ্জনা!
—ও!
—বড় কাজের মেয়ে। বড় ভাল। ওকে আজ সকালে বললাম—তুমি এখানেই থাকো। বুঝলে। আপন বাড়ীই ভাববে। তা বললে—খুড়ীমা, যে বাড়ীতে থাকি, সে বাড়ীর খড়ের চালে খড় নেই, শুয়ে চাঁদের আলো দেখি, রোদের তাপে পুড়ি। এত বড় বাড়ী, আপনার ভাববার মত ভাবনা কোথায় পাব? বরং ভাবনা হবে এমন বাড়ীতে থাকব কেমন করে। বললাম—থাকবে ওই আপনার ভেবে। ভাবতে পারলে ও ভাবনা হবে না। বললে—কি করতে হবে আমাকে? বললাম —মাসিমার সঙ্গে থেকে শিখে নাও সব। মাসিমা আর কদিন। পরে সব তুমি করবে। বললে—বেশ। বিকেলবেলা শরবৎ তৈরী করে এনেছে নিজে থেকে। বললে—দেখুন তো খুড়ীমা, কেমন হয়েছে? করে আনলাম আপনাদের জন্যে। কি চমৎকার করেছে, কি বলব! বাবু খেয়ে তারিফ করলেন। চমৎকার হয়েছে! তোর জন্যে আনতে বললাম—নে, খেয়ে দেখ!
—দাঁড়াও, মুখে জল দিই!
.
সত্যই শরবৎটুকু চমৎকার লাগল। স্বাদ তো বটেই, ঘোল এবং চিনির সঙ্গে আম-আদার স্বাদ ও গন্ধ; এবং আরো কিছু আছে। শরবৎটুকুতে গাঢ় এবং মিষ্টি গন্ধ দিয়েছে। আম-আদার গন্ধকে ছাপিয়ে উঠছে সে গন্ধ!
মুখে নিয়ে খানিকটা খেয়ে রত্নেশ্বর বললেন—তাই তো!
কাশী অঞ্চলে শরবতের চল খুব, তরিবৎত্ত খুব। কাশীতে মানুষ রত্নেশ্বর আবার চুমুক দিয়ে বললেন—আতর? কিসের আতর?
ভবানী দেবী বললেন—আমিও বুঝতে পারিনি। কিন্তু উনি ঠিক ধরেছেন।
—কিসের গন্ধ বল তো? রত্নেশ্বর তাকিয়েছিলেন অঞ্জনার মুখের দিকে।
এতক্ষণে কালকের সেই বাক্পটু অঞ্জনা বেরিয়ে এল। চুপ করে মিষ্টি হাসিমুখেই সে দাঁড়িয়ে ছিল এতক্ষণ। বললে—তা শুনে আপনি কি করবেন? তারপর একটু হেসেই বললে-বউদি এলে বরং শিখিয়ে দেব।
রত্নেশ্বর বলেছিলেন-তার তো দেরী আছে। এখন গরমকালটা শরবৎটা তৈরী করিয়ে খাব।
—তার জন্যে তো আমি রইলাম। আমি করে দেব। শুধু এই শরবৎ কেন, আরো জানি।
দেখবেন কাল খাওয়াব।
—কিন্তু গন্ধটা কিসের? খুব চেনা মনে হচ্ছে।
—মুচকুন্দ ফুলের। জ্যাঠামশাই ঠিক ধরেছেন। মুচকুন্দ ফুল সকালবেলা ঘোলের মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছিলাম, তাতে গন্ধটা মিশে গিয়েছে। তারপর শরবতের সময় পাঁপড়ি বেটে মিশিয়ে দিয়েছি।
ভবানী দেবী প্রসন্ন হাসিমুখে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন এতক্ষণ, এবার তিনি বললেন—রান্না মশলা বড় কথা নয়, বড় কথা হাত। রান্না হয় হাতের গুণে। অঞ্জনার হাতই সুন্দর। জানিস, সকালবেলা পুজোর উয্যুগ করেছিল। সে যে কি পরিপাটি করে ফুলগুলি থরে থরে রেখে, বেলপাতাগুলি বেছে থালা সাজিয়ে দিয়েছিল, মনে হচ্ছিল থালাখানি সামনে নামিয়ে দিলেই পুজো হয়ে যাবে। মা হাত বাড়িয়ে ধরে নেবেন।
অঞ্জনা গ্লাসটি তুলে নিয়ে চলে গেল। ভবানী দেবী বললেন—বড় ভাল মেয়ে রে। অনেক গুণ ওর।
রত্নেশ্বর হেসে বললেন—একটু বেশী কথা বলে।
—তা বলে। কিন্তু কথা কইতে জানে। কথাতেও মধু আছে।
—না। শুধু মধু না, একটু টক স্বাদ আছে।
—ওর স্বামীকে একটা চাকরি করে দে। উনি তোকে বলতে বলেছেন।
হয়তো অঞ্জনার স্বামীর চাকরি হয়ে যেত কিন্তু বাইরে থেকে বীরেশ্বরের ডাক এল রত্নেশ্বর!
সঙ্গে সঙ্গে ডাকলেন গিরীন্দ্র আচার্য।—বাবুজী!
চঞ্চল হয়ে উঠলেন রত্নেশ্বর। বুঝলেন কোন খবর এসেছে। গোপাল সিংয়ের খবর।
—যাই। বলে উত্তর দিয়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি। ভবানী দেবীও তাঁর পিছনে-পিছনে গেলেন। তাঁর উৎকণ্ঠার অবধি ছিল না। স্বামী-পুত্রকে ফিরে পেয়ে সংসারজীবনে সম্রাজ্ঞীর মতো ফিরে এসেও তিনি স্বস্তি পাচ্ছেন না। এসব তাঁকে বড় পীড়িত করে। কিন্তু ‘না’ বলতেও পারছেন না। এত বড় জমিদারী, রাজার মর্যাদা, এসব রাখতে গেলে এ না করেই বা উপায় কি?
খবর গোপাল সিংয়েরই খবর। কিন্তু কল্পনার বাইরে চলে গেছে। গোপাল সিং নিজের স্ত্রী এবং পুত্রকেই মারাত্মক ভাবেই জখম করেছে। এবং নিজের ঘরে আগুন দিয়েছে; সেই আগুন এই ফাল্গুনের দুপুরে তার ঘরকেই পোড়ায় নি—গোটা গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে; গোটা মৌজা বীরপুরেই লেগেছে। মৌজা বীরপুর এখনো পুড়ছে। গোপাল সিং ফেরার।
খবর এনেছে কুতুবপুর কাছারীর সওয়ার বরকন্দাজ। ঘটনাটি ঘটেছে এইভাবে। বেলা এক প্রহরের সময়, গোপাল সিং মাঠ থেকে ফিরে, শিবকে গাঁজা ভোগ দিয়ে তার প্রসাদ নিয়ে, মা-কালীকে কারণ নিবেদন করে সবে প্রথম পাত্র প্রসাদটি পেয়েছে এমন সময় সদরের নির্দেশমত কুতুবপুর কাছারীর একজন বরকন্দাজ ঢেঁড়াদার নিয়ে বীরপুর মৌজার মণ্ডলান পদের নতুন মণ্ডল ভগবানদাস মণ্ডলের নাম ঘোষণা করে জানিয়ে দিচ্ছিল-”আজ থেকে নতুন ডাক মোতাবেক বীরপুরের নতুন মণ্ডল হল ভগবানদাস মণ্ডল। পুরানো মণ্ডল গোপাল সিং-এর মণ্ডলান খারিজ।”
গোপাল ঢেঁড়ার শব্দ শুনেই চমকে উঠেছিল। সঙ্গে সঙ্গে লাফ দিয়ে উঠে হাতের লাঠিটা নিয়েই ছুটে বেরিয়েছিল পথে।
কৌন শালারে! কার এতনা বড়া ছাতি আর কলেজা বীরপুরে এসে গোপাল সিংয়ের বিনা হুকুমে ঢেঁড়া পেটে ডুগ ডুগ আওয়াজ তুলে। কার গর্দানে দুটো মুণ্ড, কৌন শুয়ারের বাচ্চার চারটে হাত। হঠাৎ ডুগ ডুগ আওয়াজ থেমে গেল। একটা গোলমাল উঠল। গোপাল আরো জোরে ছুটল।
পথে দেখা হয়েছিল নিজের ছেলের সঙ্গে। ছেলে তখন শুনেছে। সেও গর্ভাচ্ছে। ফুঁসছে। কিন্তু সে গোপাল সিংয়ের মত নয়; সে অনেকটা স্থিরমস্তিষ্ক। সে ভাবছিল —কি করবে। ঢেঁড়াদারকে আর বরকন্দাজকে ভাগিয়ে দিলেই কি জিতবে তারা? ভাগাতে হবে, ভাগাবার জন্যেই দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু শুধু ভাগাবে? না, মারপিট করবে? ভেবে-চিন্তে সে রক্তারক্তি বা অন্য হাঙ্গামা না করে এগিয়ে গিয়ে ঢেঁড়াদারের ডুগডুগিটা ছিনিয়ে নিয়ে বরকন্দাজকে ধমক দিয়ে বা গায়ের জোরে ভাগিয়ে দেওয়াটাই ঠিক করে এগিয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে ছিল নিজেদের ক’জন অনুগত লোক, ঢেঁড়াটা ছিনিয়েও নিয়েছিল, বরকন্দাজের সঙ্গে দু’চার লাঠির ঠোকাঠুকি হয়েছিল এবং শেষে তার পাগড়ি-লাঠি কেড়ে নিয়ে ভাগিয়ে দিয়েছিল।
আচার্যের নির্দেশ ছিল মার খেয়ে এস, মেরে আসামী হয়ে এসো না।
ঠিক এই সময়ে গিয়ে পড়েছিল পাগলা হাতীর মত গোপাল সিং।
কেয়া হুয়া?
সমস্ত শুনে ঠাস করে ছেলের গালে মেরেছিল এক চড়। হারামীর বাচ্ছা, কুত্তার কুত্তা, শুধু ঢেঁড়া কেড়ে নিয়ে ছেড়ে দিলি? শালা বরকন্দাজের জানটা নিলি না রে—বাঁদীর বাচ্চা!
ছেলের বয়স চল্লিশের কাছে। সে বলেছিল—গালাগালি করো না, ঘরে চল। মগজ গরম করলে কাম হয় না। মগজ গরম করে বুরবুকেরা।
আবার চড় তুলেছিল গোপাল তার গালের উপর। ছেলে খপ করে হাত ধরে রুখে দিয়েছিল। তারপর বাপ-বেটায় শুরু হয়েছিল হাত-কাড়াকাড়ি। ওদিকে বিপদের আশঙ্কা করে বাড়ী থেকে ছুটে বেরিয়ে এসেছিল গোপালের বড়-স্ত্রী, বড় ছেলের মা। সে এসে পিছন থেকে তাকে জড়িয়ে ধরেছিল—নেহি, নেহি, নেহি। শুনো, শুনো বাবু শুনো—নেহি।
গোপালের পৈশাচিক ক্রোধ উঠেছিল জ্বলে, সে ছেলেকে ছেড়ে দিয়ে স্ত্রীকে লাথি মেরে মাটিতে ফেলে, তার বুকে চেপে বসে টিপে ধরেছিল তার গলা। এমন ছেলে যার পেটে হয়, তার মরাই ভাল। মেরেই ফেলবে সে।
ছেলে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি, সে বাপকে ধরে টেনে ছাড়াতে চেষ্টা করেছিল ছাড়ো, ছাড়ো, ছাড়ো।
গোপাল এবার স্ত্রীকে ছেড়ে মাটি থেকে লাঠিটা কুড়িয়ে নিয়ে মেরেছিল ছেলের মাথায়। লোহার বোলো লাগানো লাঠি। সে লাঠির ঘায়ে ছেলের মাথা ফেটে রক্তে ভাসিয়ে দিয়েছিল তার মুখ-বুক সমস্ত। ছেলে কয়েক মুহূর্ত পরেই ধড়াস করে পড়ে গিয়েছিল মাটির উপর।
ওদিকে তখন লোক জমায়েত হয়েছে প্রচুর, গ্রামের প্রায় সকল লোক ছুটে এসেছে চিৎকার শুনে। তারা আর থাকতে পারেনি। তারা সকলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল গোপালের উপর এবং তাকে আটকে ফেলেছিল। গোপাল তাদের কুৎসিত গালাগালি করে হুকুম করেছিল—ছোড় ছোড় হারামীরা—ছোড় রে-শালা লোক, ছোড়! উসকো জান লেগা আমি। আমার মান-ইজ্জত বরবাদ করে দিয়েছে ওই লেড়কা। ওকে মেরেই ফেলব আমি।
সে তখন উন্মত্ত—বিকারগ্রস্ত। হাতে আটক পড়ে সে থু-থু করে থুথু ছুঁড়তে আরম্ভ করেছিল।
গোপালের অন্য ছেলেরা এবং মাতব্বরেরা পরামর্শ করে তাকে ধরে এনে একখানা ঘরের মধ্যে পুরে শিকল- তালা দিয়ে বন্ধ করেছিলেন। এবং বড় ছেলের ও গোপালের স্ত্রীর সেবার দিকে মন দিয়েছিল। গোপালের স্ত্রী অজ্ঞান হয়ে ছিল অনেকক্ষণ। বড় ছেলের মাথায় ক্ষতটা গভীর এবং শঙ্কাজনক। সে-ও অজ্ঞান। রক্তস্রাব হচ্ছিল প্রচুর। জনকয়েক মাতব্বর বড় ছেলের ক্ষতস্থানে বিশল্যকরণী গাঁদার পাতা লাগিয়ে রক্ত বন্ধ করতে না পেরে কাপড় পুড়িয়ে চুন মিশিয়ে ‘করালী’ প্রলেপ তৈরী করে লাগাবার ব্যবস্থা করেছিল। আর বড় ছেলের ছেলে, সে আঠারো-উনিশ বছরের নতুন জোয়ান, সে ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে গোপাল সিংকে অভিসম্পাত করছিল। ঘরের ভিতর গোপাল সিংও নিষ্ফল আক্রোশে গর্জাচ্ছিল। হঠাৎ উত্তপ্ত উন্মত্ত মস্তিষ্কে শয়তান জেগে উঠেছিল। ঘরের মধ্যে পেয়েছিল চকমকি-শোলা। আর পেয়েছিল চোলাইকরা মদের বোতল। তাই নিয়ে সে ষাট বছর বয়সেও কসরৎ করে উঠেছিল ঘরের ভিতরের সাঙায়। সাঙায় দাঁড়িয়ে ঘরের চালের বাখারির কাঠামো ভেঙে খড় ছাড়িয়ে চালের উপর উঠে মদটা ঢেলে দিয়েছিল চালের খড়ের উপর, তারপর চকমকি ঠুকে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল চালের মাঝখানে।
এ-কাজ সে নিঃশব্দে করে গিয়েছিল। প্রথমটা কারুর নজরে পড়েনি। আগুন দাউ দাউ করে জ্বলে উঠতেই গোপাল উল্লসিত চিৎকার করে বলেছিল—যা সব ছাই হয়ে। যা সব জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে। যা—।
কাউকে চালে উঠতে দেয়নি, যে উঠবে, তাকে সে দাও দিয়ে কোপাবে বলে ভয় দেখিয়েছিল।
স্তম্ভিত হয়ে উঠেছিল লোকেরা। গোপাল জ্বলন্ত খড় টেনে বের করে ছুঁড়তে শুরু করেছিল চারিদিকে। জ্বলে যাক বীরপুর। ছাই হয়ে যাক। সব শালা বেইমান।
ফাল্গুনের দুপুরে রাঢ় অঞ্চলে এলোমেলো তপ্ত হাওয়া বয়। সেই হাওয়াটা তখন উঠেছে। আগুন বাতাসে ছুটতে লাগল।
গোপাল সিং একসময় ধপ করে পথের উপর লাফিয়ে পড়ে ছুটল। সে বুঝতে পেরেছিল—গ্রামের লোকেরা এমন কি নিজের বাড়ীর লোকেরাও আজ তার শত্রু। তাকে ধরতে পারলে তারা তার হাতে-পায়ে বেঁধে ওই জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডে ফেলে দেবে। একবিন্দু করুণাও আজ আর তার জন্যে কোথাও কারুর মনে নেই। এই আগুনেই সব পুড়ে গেছে।
ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে সে পালিয়েছে। পথ ধরে বেরিয়ে মাঠে পড়ে মাঠে-মাঠে ছুটে পালিয়েছে।
গোটা বীরপুর এখনো জ্বলছে। ফাল্গুনের দুপুর-রাঢ়ের এলোমেলো গরম হাওয়া আগুনের সঙ্গ পেয়ে দুরন্ততর বেগে মাতামাতি করে নাচিয়েছে আগুনকে। জ্বলন্ত ঘরের খড় শিখার বেগে আকাশে খানিকটা উপরে উঠে হাউইয়ের আগুনের মত বেঁকে দূরে দূরান্তরে ছড়িয়ে পড়েছে এর ঘরে, ওর ঘরে; কয়েক মুহূর্ত পরেই সে চালগুলোও জ্বলে উঠেছে। পথ-ঘাট পুকুরের জল পোড়া খড়ের টুকরোয় ছেয়ে কালো হয়ে গেছে।
লোকে অভিসম্পাত দিচ্ছে গোপাল সিংকে।
আর কাকে দেবে? গোপালের স্ত্রীর গলা থেকে এখনো কাশির সঙ্গে রক্ত উঠছে। ছেলের এখনো জ্ঞান হয়নি। গোটা গ্রামের ঘরের আশ্রয় নেই। কামাখ্যা মায়ের মন্দির পাকা; একটা পাকা নাট-মন্দিরও আছে, সেইখানে আশ্রয় নিয়েছে গোপালের পরিবারবর্গ। বাকী লোকেরা গাছতলায় এসে দাঁড়িয়েছে। কয়েকটা গোহত্যা হয়ে গেছে। গরু পুড়ে মরেছে। বেড়াল-কুকুর তাও পুড়েছে।
বেঁচে আছে গোপালের পুকুরপাড়ের ধানের বাখার। ওগুলোই লোকে চেষ্টা করে বাঁচিয়েছে। তাও সমস্ত বাখারের খড়ের চাল তুলে ফেলে বাঁচাতে হয়েছে। কতকগুলো রাখার খুলে ধানের রাশি ছড়িয়ে পড়ে আছে চারিদিকে। না বাঁচিয়ে উপায় ছিল না। নইলে লোকে খাবে কি?
দেওয়ান আচার্য কথা শেষ করে বললেন—এমনটা হবে ঠিক ভাবিনি। তবে কাজ শেষ। গোপালের চিতা গোপাল নিজে জ্বালিয়েছে। আমাদের আর কিছু করতে হবে না। শুধু থানাতে খবরটা পাঠাতে হবে। সে কুতুবপুর কাছারী থেকে গিয়েছিল-আমি পাঠিয়ে এসেছি।
শুনছিলেন তিনজন—বীরেশ্বর রায়, ভবানী দেবী, রত্নেশ্বর রায়। বীরেশ্বর আলবোলা টানছিলেন কিন্তু কখন যে নলটা রেখে দিয়েছিলেন বা হাত থেকে খসে পড়েছিল, তাঁর খেয়াল ছিল না। কথা শেষ হতেই তিনি একটা নিঃশ্বাস ফেলে ডান হাতখানা বাড়িয়ে নলটা হাতড়ালেন। চাকর মহেন্দ্র দূরে দাঁড়িয়েছিল, সে এসে নলখানা তুলে দিল তাঁর হাতে।
ভবানী দেবী একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন—মা গো!
বীরেশ্বর তাঁর দিকে তাকিয়ে বললেন —হুঁ।
—কি করলে বল তো?
—কি? একটু হাসলেন বীরেশ্বর।
আচার্য বললেন—আমরা কি করলাম বলুন মা? আমরা আইনের পথ ছাড়া চলি নি। যা করেছে সে নিজেই করেছে।
—করেছে, কিন্তু—।
—না মা, কোন কিন্তু নেই। আমরা কিছু করিনি। বলুন!
—বাঘের খাঁচায় মানুষকে ঢুকিয়ে দিলে বাঘ মানুষটাকে মারে, ছিঁড়ে ফেলে। বাঘই মানুষটাকে মারে খুড়োমশাই। কিন্তু তাতে বাঘের পাপ হয় না। পাপ মানুষেরই হয়।
বীরেশ্বর রায় হাতের নলটা ফেলে দিয়ে বললেন—মানুষ তো একরকম নয়, সতীবউ। মানুষে মানুষে প্রভেদ আছে। রাজা আর প্রজা, জমিদার আর রাইয়ত এক নয়। রাজাকে মধ্যে মধ্যে বাঘের খাঁচায় মানুষকে ফেলে দিতে হুকুম দিতে হয়। কাশীতে তো কোম্পানী রাজ্য রাখতে মিউটিনির সময় কি করলে চোখে দেখেছ। ছেদীর কটা নাতিকে গুলী করে মেরে দিয়েছে। ছেলে দুটোর ফাঁসি দিয়েছে। ছেদীর ঠ্যাঙটাই কাটা গেছে। রাজধর্ম একটা আলাদা আছে। রাম রাবণকে সাজা দিতে গোটা বংশটাকে ধ্বংস করেছিলেন। ওখানে সাধারণের সঙ্গে বিচার চলে না। আপনি এক কাজ করুন।
আচার্য তাঁর মুখের দিকে তাকালেন।
বীরেশ্বর বললেন—কুতুবপুর কাছারীতে আজ রাত্রেই লোক পাঠান—কুতুবপুরের কাছারীর খাসজোতের সমস্ত খড় বীরপুরের প্রজাদের দেওয়া হবে। যা কাপড় এসেছে এখানে বিতরণের জন্যে তার কিছু কাপড় পাঠিয়ে দিন। কাপড়-চোপড় পুড়ে গিয়ে থাকবে। ধান-চাল দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। গরীবদের দশ-পাঁচ টাকা দাতব্য —আর গৃহস্থ প্রজা যারা ঋণ চাইবে, তাদের ঋণ দেওয়া হবে।
রত্নেশ্বর রায় মুখে একটি কথাও বলেননি। যা ভেবেছিলেন লেখা আছে তাঁর ডায়রীতে।
“এরূপ শোচনীয় দুর্ঘটনা ঘটিবে, তাহা আমি কল্পনা করি নাই। গোপাল সিংয়ের উপর কঠিন ক্রোধ ও আক্রোশ সত্ত্বেও এমন পরিণতিতে আমি বিমূঢ় এবং বেদনাহত হইয়া পড়িয়াছিলাম। পিতৃদেব সুকৌশলে কস্টেলো পিদ্রুসকে দিয়া জন রবিনসনকে হত্যা করাইয়াছিলেন। আমি প্রথমটা ভীত হইয়াছিলাম। কিন্তু ধীরে ধীরে সাহস সঞ্চয় করিয়া সবিস্ময়ে দেখিয়াছিলাম।”
অত্যাচারী নীলকরদের বিরুদ্ধে তখন সারা বাংলায় একটা বিক্ষোভ জেগে উঠেছিল, তার সঙ্গে রবিনসনের নারী-লোলুপতার জন্য একটা ঘৃণা জমে উঠেছিল মানুষের মনে। নারীহত্যাও সে করেছিল। তাছাড়া যার কান্নায়-দুঃখে এই ক্ষোভ আক্রোশ সত্ত্বেও মানুষ এতটুকু দুঃখ পায় এমন কেউ তার এ-পৃথিবীতে ছিল না।
রত্নেশ্বর লিখেছিলেন—“এমন পাষণ্ডের এই পরিণাম মানুষের কৌশলে সংঘটিত হইলেও, ভাবিয়াছিলাম ইহাই বিধাতা-নির্দিষ্ট দণ্ড। ঐ মানুষের মাথায় বজ্রাঘাত হইলে আরো খুশী হইতাম কিন্তু এই পরিণামেও কোন দুঃখ পাই নাই।
“দে-সরকারকে দণ্ড আমি নিজে দিয়াছি। তাহাতেও আপসোস করি নাই। কখনও করিব না। কারণ সে গোটা শ্যামনগর পুড়াইয়াছিল, আমাকে পুড়াইয়া মারিতে চাহিয়াছিল; আমি তাহার ঘর পুড়াইয়া দিয়াছি। ডাকাতেরা তাহার অধর্মসঞ্চিত অর্থ লইয়াছে, কিন্তু তাহার বাড়ীর নারী-শিশুদের অঙ্গ স্পর্শ করি নাই। হাতটা ভাঙিয়া দিয়াছি। শুনিয়াছিলাম, লোকটা স্বহস্তে জাল করিত। কিন্তু গোপাল সিংয়ের ক্ষেত্রে এ কি হইল? গোপাল সিং নিজে মরিলে কোন দুঃখ হইত না। কিন্তু এ কি হইল? নিজের পুত্রকে সে হত্যা করিল? শুনিতেছি সে বাঁচিবে না। লোকটা পাষণ্ড দুর্দান্ত, সে আমার মাতার অপমান করিয়াছে। রবিনসন ও দে-সরকারের হুকুমে সে-ই শ্যামনগরে আগুন জ্বালাইয়াছে, আমার পৃষ্ঠদেশে পোড়ার দাগ এখনো সামান্য ঘর্ষণে জ্বালা করে। কিন্তু তবু মন হায় হায় করিতেছে।”
ভবানী দেবী বলেছিলেন—বাঘের খাঁচায় লোক ফেলে দিলে বাঘ তাকে হত্যা করে কিন্তু হত্যার পাপ বাঘের তাতে একবিন্দু নেই, পাপ সবটাই মানুষের
এই কথাটাই অমোঘ মনে হয়েছিল রত্নেশ্বরের। তিনি অত্যন্ত বিচলিত হয়েছিলেন। সেই মুহূর্তে তাঁর মনে হয়েছিল—“একদিন জমিদার আমি হইব, ইহা জন্মমাত্রেই স্থির হইয়াছিল। কিন্তু তাহা মনে মনে জানিয়াও এমন কল্পনা কখনো করিতে পারি নাই। অত্যাচারী বলিয়া রাজবংশকে ঘৃণা করিয়াছি। ভাবিয়াছিলাম, জমিদার হইয়া আমি আদর্শ জমিদার হইব।”
বীরেশ্বর রায় ভবানীকে বলেছিলেন—মানুষে মানুষে প্রভেদ আছে সতীবউ। রাজা আর প্রজা, জমিদার আর রায়ত এক নয়। রাজার হাতে শাসনের ভার আছে। রাজাকে মধ্যে মধ্যে বাঘের খাঁচায় মানুষকে ফেলে দিতে হুকুম দিতে হয়। রাজধর্ম আলাদা। মিউটিনি দমন করতে কোম্পানী কাশীতে বালকদেরও গুলী করে মেরে ফেলেছে। রাম রাবণকে সবংশে বধ করেছিলেন।
কথাটা শুনে রত্নেশ্বর যেন পড়তে পড়তে একটা আশ্রয় পেয়েছিলেন। ডায়রীতে লিখেছেন—“পিতার উত্তর শুনিয়া চমকিয়া উঠিলাম, তাঁহার বাক্যই যেন আশ্ৰয়-দণ্ড হইয়া আমাকে আশ্রয় দিল। আমি বল পাইলাম। পিতৃদেব ঠিক কথা বলিয়াছেন। রাজধর্মের মতই জমিদারধর্মও স্বতন্ত্র। ইহা দুর্বলের জন্য নহে। দুষ্টকে দমন করিতে গিয়া যাহা ঘটিয়াছে, তাহার জন্য পাপ করিয়াছি মনে হইলে জমিদারী আসনে বসা চলিবে না। দৃঢ় হইতে হইবে।”
“তবে আজ হইতে ইহাও প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, অতঃপর যাহাই করিব, তাহা আইনসম্মত প্রকাশ্যপথে করিব। জমিদারী ধর্মে আইনই ধর্ম। সেখানে যাহা ঘটিবে, তাহার জন্য আমার কোন আপসোসের কারণ থাকিবে না।”
সুরেশ্বর বিষণ্ণ হেসে বললে—তাও পারেননি তিনি। তিনি ঠাকুরদাসদাদাকে পিদ্রুসকে দিয়ে খুন করিয়েছিলেন। এবং তার আগেও আরো একটা হত্যা তিনি করিয়েছিলেন। সে-ও অবশ্য তিনি দুষ্টকে দণ্ড দিয়েছেন।
সুলতা সবিস্ময়ে প্রশ্ন করলে সে কে?
—সে? সে একজন গোয়ান চাপরাসী। রায়বাড়ীর অন্দরের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ সন্দেহে তাকে তিনি নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিলেন।
চমকে উঠল সুলতা। রায়বাড়ীর অন্দরের সঙ্গে?
—হ্যাঁ। ওই অঞ্জনা মেয়েটির সঙ্গে।
সুলতা বললে-ওঃ!
সুরেশ্বর বললে—তোমাকে বলব কি সুলতা, ওই কীর্তিহাটের বিবিমহলে বসে আমি জমিদার হলাম বাধ্য হয়ে। আমাকে তুমি জানতে-একালের মানুষ। আমি একালের সত্যকেই বড় করেই কাজ করছিলাম। আমার স্বার্থের চেয়ে মানুষের দাবিতে প্রজার দিকটাই বড় করে দেখেছি। কিন্তু আমারও মনে হয়েছিল শোধ নিতে শিবু সিংয়ের উপর। শোধ না নিলে আমার অন্যায় হবে। ধর্মচ্যুত হব আমি। আমার ইজ্জত আর থাকবে না। রত্নেশ্বর রায়ের কাল- ১৮৫৯ সাল। আমার কাল ১৯৩৭ সাল। দেশে স্বাধীনতা আন্দোলন আগুন হয়ে জ্বলে উঠেছে। রায়বাড়ীর ছেলে অতুল জেলে। কুমারী মেয়ে অর্চনা, সে তাতে জড়িয়ে পড়েছে। মেজঠাকুমাও জেল খাটছেন। সে সময়ে প্রজাপীড়ন কতটুকু করতে পারা যায়? যতটুকু যায় ততটুকু করেছি আমি। সুলতা, আমি শিবু সিংয়ের ফ্রি-শিপ বন্ধ করতে পারিনি—করিনি। কিন্তু বোর্ডিং ফ্রি-শিপ বন্ধ করেছিলাম। হরি সিংয়ের সঙ্গে কয়েকটা মামলাও শুরু হয়েছিল। কিন্তু সময়ে সুমতি হয়েছিল। চেতনা হয়েছিল এই ডায়রী পড়ে। নিবৃত্ত হয়েছিলাম।
একটু চুপ করে থেকে সুরেশ্বর বললে —বাংলাদেশে, তাই বা কেন, পৃথিবীতে জমিদার এমন একজনও নেই বা হয়নি যে প্রজা দমনের নামে মানুষকে পীড়ন করেনি। ও হয় না।
গোপাল সিংয়ের ধ্বংস পর্ব, আচার্য দেওয়ান এটার নাম দিয়েছিলেন গোপালমেধ যজ্ঞ, শেষ হতে বেশী দিন লাগেনি। মাস-তিনেকের মধ্যে শেষ হয়ে গেল। গোপাল সিংয়ের ফাঁসি হবার কথা। কারণ গোপালের ছেলে ওই রাত্রেই মারা গিয়েছিল। থানায় তার খবর এবং এজাহার দিয়ে এসেছিল কুতুবপুর কাছারীর নায়েব। গোপাল তখন পালিয়েছে। কিন্তু বিচিত্র কথা কি জান, গোপালকে ফাঁসির হাত থেকে বাঁচালেন ভবানী দেবীর অনুরোধে বীরেশ্বর রায়।
পরের দিন ভোররাত্রে ভবানী দেবী উঠে স্নান সেরে মন্দিরে এসেছেন, মঙ্গলারতি হচ্ছে মায়ের; তাঁর সামনে হাতজোড় করে হাঁটু গেড়ে বসল আপাদমস্তক চাদর ঢাকা একটি মেয়ে। গোপাল সিংয়ের কনিষ্ঠা পত্নী। তার দুটি শিশুপুত্রকে নিয়ে এসেছে রায়বাড়ীর সতী বউরাণীর কাছে।
—রাণীমাঈ, ভিখ্সা!
ভোরবেলা তখন আবছা অন্ধকার রয়েছে। নাটমন্দিরে একটা পঁচিশ-বাতি সে-আমলের ঝোলানো কেরোসিনের চিমনি জ্বলছে। গোটা নাটমন্দিরে অল্প কিছু লোক। সারারাত্রি প্রায় উৎসব চলেছে। রাত্রি তিনটে নাগাদ উৎসবের বাতি নিভেছে। গ্রাম-গ্রামান্তরের লোকেদের কাছে-পিঠের লোকের বাড়ী, দূরান্তরের লোকেরা এখানে-ওখানে রায়বাড়ীর চারিপাশে এবং শামিয়ানা খাটানো আসরের উপর শুয়ে আছে। হুকুম ছিল—কোন মধ্যবিত্ত অবস্থাপন্ন ঘরের মেয়েছেলে থাকলে তাদের যেন ঠাকুরবাড়ীতে জায়গা দেওয়া হয়। এ-মেয়েটি কখন এসেছে কেউ জানে না। এসে ঠাকুরবাড়ীর নাটমন্দিরেই আশ্রয় নিয়েছিল। উৎসবমত্ত রায়বাড়ীর কারুরই ঠিক খেয়াল নেই।
সতী বউরানী আরতির পর মন্দির থেকে নামছেন, এরপর যাবেন, গিয়ে পুজোতে বসবেন। নাটমন্দির এবং মন্দিরের মাঝখানে, যেখানে হাড়িকাঠ পোঁতা আছে, সেইখানে তিনি নামবামাত্র এই অবগুণ্ঠনবর্তী এসে নতজানু হয়ে হাতজোড় করে বসল। ভবানী দেবীর পিছনে ছিল অঞ্জনা এবং তার দাসী দামিনী। বাকী রায়বাড়ীর অধিবাসিনী কুটুম্বিনীরা সব তখন ঘুমিয়ে আছে। দারোয়ান- চাপরাসীরা ঢুলছে। পুরুষদের মধ্যে ন্যায়রত্ন এবং পরিচারক ছাড়া আর কেউ নেই।
এই আবছা অন্ধকারে ছায়ামূর্তির মত অবগুণ্ঠনাবৃতা মেয়েটিকে এমনভাবে হাঁটু গেড়ে বসতে দেখে প্রথমটা ভবানীদেবী ভেবেছিলেন, সে দেবীকে প্রণাম করছে। তিনি সরে দাঁড়ালেন সম্মুখ ছেড়ে। কিন্তু মেয়েটি বললে,—রাণীমাঈ, ভিসা!
অস্ফুটপ্রায় স্বর, কিন্তু তার মধ্যেও কাতরতার অন্ত ছিল না। বুকফাটা দীর্ঘ-নিঃশ্বাসের সঙ্গে যেন বেরিয়ে এল।
চমকে গিয়ে পিছিয়ে এলেন ভবানী দেবী। এই শেষরাত্রে এমন অকস্মাৎ সামনে নতজানু হয়ে বসে দীর্ঘনিঃশ্বাসের সঙ্গে কে তাঁর কাছে ভিক্ষা চাচ্ছে?
একলা তিনি চমকে ওঠেন নি, অঞ্জনা এবং দাসীটিও চমকে উঠেছিল। ন্যায়রত্ন মন্দিরের ভিতর থেকে বাইরে এসে সদ্য পা দিয়েছেন, তিনিও চমকে উঠে বলেছিলেন—কে?
পরিচারক তাড়াতাড়ি নেমে এসে বলেছিল- কে গো? কে? কে তুমি!
ভবানীদেবী তখন নিজেকে সামলেছেন, তিনি পরিচারককে বলেছিলেন—তুমি সরে যাও। দেখছ না, মেয়েটি ঘোমটা দিয়ে রয়েছে, আমার সঙ্গে কথা বলছে। তুমি সর।
ভবানী দেবী মেয়েটির জোড় করা হাত দু’খানির রঙ এবং তার হাতের রূপোর মোটা কাঁকনির দিকে তাকিয়ে বুঝতে পেরেছিলেন, সে ভাল ঘরের মেয়ে এবং ঠিক এ-দেশের নয়। ভিসা কথাটা তাঁর কানে ঠিক সুরটি তুলেছিল।
পরিচারক সরে গেলে তিনি তাকে প্রশ্ন করেছিলেন—তুমি কে বাছা?
—আমি ভিসা মাংতে এসেছি রাণীমাঈ!
—বল কি ভিসা চাও?
—আমার বাচ্চাদের বাপের জান। আমার সিঁথির সিঁদুর। দুনিয়ায় কেউ রাখতে পারবে না বলছে লোকেরা, কিন্তু আমি জানে রাণীমাঈ, আপনি পারেন। আমি শুনিয়েছি, আপনি আপনার স্বামীকে বাঁচাইয়েছেন। কালীমায়ী আপনার বাত শুনেন।
অঞ্জনা এতক্ষণ অবাক হয়ে শুনছিল, সে বললে—তোমার স্বামীর কি হয়েছে বল। কোথায় বাড়ী বল। কি নাম?
ভবানী দেবী বলেছিলেন—থাক। তুমি আমার সঙ্গে ভিতরে এস।
তিনি তাকে অন্দরে নিচের তলায় নিয়ে গিয়ে একটা ঘরে বসিয়ে বলেছিলেন—কোথা থেকে এসেছ মা? বীরপুর থেকে?
ঘোমটাসুদ্ধ মাথাটা নড়ে উঠেছিল—হ্যাঁ।
—বুঝেছি তা। তোমার ভিসা ভিসা শুনেই বুঝেছি। তার উপর তোমার হাতের রঙ, মোটা কাঁকনি। কতক্ষণ এসেছ?
—রাত পহেলা প্রহরে বয়েলগাড়ী জুড়ে সঙ্গে আদমী নিয়ে বেরিয়েছি মায়ী, শেষরাতে এসে পঁহুছুলাম।
—গোপাল সিংয়ের ছেলে কেমন আছে?
—মরে গেছে মায়ী।
—তার মা কি তুমি?
না-এর ভঙ্গিতে মাথাটা নড়ে উঠল।—না। তারপর বললে—উ বড়কী আছে।
—হুঁ। সে? সে কি করছে?
—উকেও জখম করেছে মায়ী। তার উপর। ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল মেয়েটি। একটু স্তব্ধ থেকে ভবানী দেবী জিজ্ঞাসা করলেন- গোপাল সিং?
—সে যে কোথায় ভেগেছে মাঈজী, সে-ই জানে।
—হুঁ।
—কাল পুলিশ এসেছিল মাঈজী। ইজাহার নিয়ে গেল, বড়ি বেটার লাস ভি আটকে রেখেছে। আজ সুবায় নিয়ে যাবে। লোকে বলছে উসকা ফাঁসি হোয়ে যাবে মায়ী। আপনি বাঁচান।
মায়ী আপনি বাঁচান। ভবানী দেবী একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বলেছিলেন—আমি কি করে বাঁচাব মা? রায়বাড়ী তো কিছু করে নি; যা ক’রেছে তার ফল ফলে গেছে। গোপাল সিং রায়বাড়ীর পাইক বরকন্দাজ খুন করলে তো আমি চাপা দিতে বলতাম। কিন্তু গোপাল রাগের বশে নিজের ছেলেকে। ওঃ!
গোপালের স্ত্রী বলেছিল—মাঈজী, আজ সারা গাঁওয়ের লোক তার উপর খাপ্পা হয়ে গিয়েছে। তাকে পেলে হয়তো ছিঁড়ে ফেলবে, আরো খুন-খারাবি হবে; তাকে ধরিয়ে দেবার জন্যে লোকে তাকে খুঁজছে। এক, তুমি বাঁচাতে পার। বাঁচাও তুমি। মায়ী আমার বালবাচ্চারা ছোট।
হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল সে।
—কিন্তু আমি কি করব বল?
—তা আমি জানি না মায়ী। তবে তুমি পারো। তোমার পতিকে তুমি সাবিত্রীর মত বাঁচিয়েছ। মা কালীর সঙ্গে তোমার বাতচিত হয়। এ আমাকে সবাই বলছে।
—কি বলছে?
একটু চুপ করে থেকে সে বললে—মাঈজী, সবাই বলছে কালীমায়ীর রোষে সিংয়ের এই হাল হয়েছে। তোমার মত সতীকে সে কটু কথা বলেছিল, তারই সাজা দিয়েছে মা। তুমি খুশী হলেই—মাফ্ করলেই সে বাঁচবে।
ভবানী বলেছিলেন-মা, আমি কোনোদিন তাকে শাপশাপান্ত করিনি। তবু তুমি বলছ, আমি অন্তর খোলসা করে বলছি-মা, গোপালকে বাঁচাও মা, গোপালকে বাঁচাও মা, গোপালকে বাঁচাও মা, গোপালকে বাঁচাও। আর—
একটু চুপ করে থেকে ভেবে বলেছিলেন—আর আমি জিজ্ঞাসা করছি, তোমাদের হুজুরকে, গোপালকে বাঁচাবার কোন পথ আছে কিনা! তাঁরা কিছু পারেন কিনা। যদি থাকে তবে নিশ্চিন্ত হও—তা আমি করব।
গোপালের স্ত্রী মেঝের উপরে হাত রেখে বসেছিল, সে হাতখানা মেঝের ধুলোতেই বুলিয়ে নিয়ে নিজের কপালে ঠেকিয়েছিল।
ভবানী দেবী বলেছিলেন—কিন্তু তুমি তো কাল থেকে কিছু খাওনি মা!
কপালে হাত দিয়ে ক্লান্ত স্বরে বউটি বলেছিল-থোড়া পানি পিয়েছি মায়ী। আর কিছু কি খাওয়া যায়?
—যায় না। কিন্তু তবু খেতে হয় মা। কিছু খাও তুমি। তারপর নিজের ঝি দামিনীর দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন-দামিনী, তোর উপর এর ভার রইল। কিছু খাওয়া ওকে। আর এ বাড়ীর কারুকে পরিচয় দিসনে যে গোপাল সিংয়ের স্ত্রী। মানুষ শত্রু হলে বড় নিষ্ঠুর; তার ওপর-
একটু ম্লান হেসে বলেছিলেন—বড়লোক হলে তখন আর তার শেষ থাকে না।
তারপর অঞ্জনাকে নিয়ে ওপরে চলে এসেছিলেন।