৭
রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায়ের জমিদার-জীবনের প্রথম কাজ শ্যামনগরের প্রতিশোধে দে-সরকারদের ঘর পোড়ানো। ট্যারা দে-সরকারের হাত ভেঙে দেওয়া। তখনো তিনি পোষ্যপুত্র হয়ে নিজের বাপ-মায়ের সন্তান হয়ে খাঁটি মালিক হন নি।
জন রবিনসনের সঙ্গে বোঝাপড়া করেছিল পিদ্রুস। করিয়েছিলেন বীরেশ্বর রায়। রত্নেশ্বর রায় জমিদারী পেয়ে জমিদার হিসেবে প্রথম বোঝাপড়া করেছিলেন গোপাল সিংয়ের সঙ্গে।
তাঁর ডায়রীর যে অংশে পূর্বকথা লেখা ছিল তার শেষ কথা গোপাল সিংয়ের কথা। লিখেছিলেন—“এবার গোপাল সিং ধ্বংসযজ্ঞ। সমিধ প্রস্তুত। আমি জমিদার হইয়া তাহাতে আহুতি দিব।”
এই কথাতেই পূর্বকথা শেষ। তার পরই আরম্ভ হয়েছে তাঁর দিনলিপি, ডেলি ডায়রী। সেদিন ছিল দোল পূর্ণিমা। ১২৬৪ সাল। সেদিনের ডায়রী লিখতে গিয়েও তিনি গোপাল সিংয়ের কথা ভুলতে পারেন নি।
সেদিন বীরেশ্বর রায় যজ্ঞ করে রত্নেশ্বরকে পোষ্যপুত্র গ্রহণ করেছিলেন।
বীরেশ্বর রায় এই অনুষ্ঠানে বিরাট উদ্যোগ করেছিলেন। জীবনের এতদিনের সমস্ত দুর্ভোগ দুশ্চিন্তা অশান্তির স্তুপকে বোধহয় এই যজ্ঞে জ্বালিয়ে ছাই করে দিতে চেয়েছিলেন।
উৎসব তখনকার দিনে যতরকম হতে পারে, করেছিলেন; কবিগান, খেমটা নাচ, বাঈনাচ, যাত্রাগান, পাঁচালী, আতসবাজি, রায়বেশের নাচ, তারের খেলা- কোন কিছু বাদ দেন নি।
সোফিয়া বাঈ এসেছিল। সোফিয়া বাঈ কিন্তু বাঈ হিসেবে আসেনি। সে এসেছিল সত্যকারের আত্মীয়ের মর্যাদা নিয়ে। সে কালটা ছিল বিচিত্র; গোপন পর্যন্ত ছিল না যে এই সোফিয়া বাঈই বীরেশ্বর রায়ের অনুগৃহীতা। এ মর্যাদা তাকে দিয়েছিলেন ভবানীদেবী স্বয়ং।
রত্নেশ্বর রায় কিন্তু এর মধ্যেও গোপাল সিংকে ভোলেন নি। লিখেছেন—“এই অনুষ্ঠানে গোপাল সিং আইসে নাই। উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইয়াছে।”
দেওয়ানজী গিরীন্দ্র আচার্য অনেক চিন্তা করেই এই অনুষ্ঠানেই একটি বিশেষ পর্ব যোগ করেছিলেন। রত্নেশ্বর বীরেশ্বর রায়ের আমমোক্তারনামার বলে এই অনুষ্ঠানেই সমুদয় খাসমহলের মণ্ডলদের আহ্বান করেছিলেন। আগামী বৎসরের সদর পুণ্যাহের দিন ধার্য করেছিলেন এই দিনেই। মহলের হাটের ডাক, ঘাটের ডাক, জলকর ফলকর বনকর বাৎসরিক বন্দোবস্তির ব্যবস্থা করে মৌজা বীরপুরেও ঢোলশহরৎ করে জানিয়েছিলেন বীরপুরের মণ্ডলান বন্দোবস্ত এই সময়েই হবে।
বীরপুর বন্দোবস্ত নেওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত গোপাল সিংকে নাকচ করবার জন্য অনেক খরচ করে যে বিস্তৃত জাল ফেলেছিলেন, তা প্রায় বাতিল বা নাকচ হবার সম্ভাবনা ছিল এতে। তবু তিনি এ ব্যবস্থা করেছিলেন। কারণ এ পর্যন্ত হাজার দরুনে যে সব বাকী খাজনার মামলা দায়ের হয়েছিল, তাতে বীরপুরকে মণ্ডলান তৌজি হিসেবে স্বীকার করা হয় নি। এই ঢোল শহরতে ‘মণ্ডলান’ প্রথা স্বীকার করেছিলেন রায়েরা। তবে এতে গোপাল সিংকে আনতে হবে কীর্তিহাটে!
রত্নেশ্বর রায় তখন নতুন—তিনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন—কি হবে এতে?
—মণ্ডলান স্বত্ব ডাক হবে। অন্য লোকেও ডাকবে।
—যদি নিজে না আসে? অন্য লোক পাঠায়?
—বেনাম ডাক নেব না। লিখে দিয়েছি। তাছাড়া আমাদের সে রাইট আছে বাবুজী! বলে বই খুলে দেখিয়ে দিয়েছিলেন—এই পড়ে দেখ—
“Their power to summon and if necessary to compel the attendance of their tenants was maintained.”
আচার্য বলেছিলেন—হাত আমাদের লম্বা বাবুজী—খেলতে পারলেই হল। তোমার মাতুলের দোষ কি জান, বড় জেদী আর একগুঁয়ে। ওই যে ধরেছেন মণ্ডলান স্বত্ব স্বীকার করব না, তো করবই না! দেখ না আমি কি করি।
রত্নেশ্বর রায় বলেছিলেন—শুনেছি বীরপুর মৌজার চারপাঁচখানা গ্রামের লোক তার খুব বাধ্যও বটে, আবার বাঘের মতো ভয়ও করে; কে ডাকতে আসবে তার সঙ্গে টক্কর দিতে?
***
কথাটা মিথ্যে শোনেন নি রত্নেশ্বর। গোপাল সিং শ্যামনগরে গিয়ে তাঁর কাছে চড় খেয়ে শোধ নেবার জন্য দে-সরকার এবং রবিনসনের কাছে যে আস্ফালন করেছিল তা কতখানি সত্য তা যাচাই করে নিয়েছিলেন রত্নেশ্বর।
বীরপুরের গোপাল সিং সত্যই বিচিত্র চরিত্রের মানুষ!
হয়তো সে আমলটাই বিচিত্র সুলতা! সে-আমলে দুচারখানা গ্রামের মধ্যে এমনি ধরনের এক-একজন লোক ছিল। যারা ছিল গ্রামের সর্বেসর্বা প্রধান। তারা ব্রাহ্মণ পণ্ডিত নয়, তারা সম্পত্তিশালী দুর্ধর্ষ লোক। চোর ডাকাতকে শাসন করত, আবার আশ্রয় দিত, ধরে এনে বেঁধে মারত, আবার দারোগা ধরতে এলে তাকে লুকিয়ে রাখত। মামলায় টাকা দিয়ে সাহায্য করত, সাজা হয়ে গেলে তারা নিশ্চিন্ত হয়ে জেলে যেত এই মানুষদের ভরসায়। দুর্বৎসরে খেতে দিত, সুবৎসরে কষে আদায় করে নিত। দারোগাকে সেলাম করত। কনস্টেবলকে ‘তুম্’ বলত। রাইটার আর জমাদারকে বলত ইয়ার। মাসে মাসে খাসী, বড় মাছ, ঘি, চাল, দুধ, তরকারী সাজিয়ে একটা ক’রে ভেট পাঠাতো। নিজে দিত না, পরের কাছ থেকে নিয়ে দিত। সাধুসন্ন্যাসীর সেবা করত, তুকতাকের কবচ মাদুলি নিত, শঙ্খনির্মাল্য নিত। কাপড় কম্বল দিয়ে বিদায় করত। কিন্তু ধর্মালোচনা করত না—শুনত না! মামলায় মিথ্যা বলত। দিনকে রাত করত, দরকার হলে খুন করাত, আবার বাত দিলে বলত জাত দিলাম। বাত রাখতে পারলে জাত থাকবে। নইলে বাতের সঙ্গে জাতও যাবে। কাউকে রক্ষা করব বললে প্রাণ দিয়ে যথাসর্বস্ব পণ করে তাকে রক্ষা করতে চেষ্টা করত।
অধিকাংশেরই বিচার ছিল খেয়ালমত; বুদ্ধি তাদের ছিল না তা নয়, কিন্তু বুদ্ধির সবটাই ছিল কুটিল। ওই খেয়ালের বিচারকে সমর্থন করতে প্রয়োগ করত। মদ খেত, গাঁজা খেত; রক্ষিতা রাখত; রক্ষিতা থাকত ঘরেই। আবার উন্মত্ত হলে ও পাপের সীমা থাকত না।
আইন এরা মানত না। নিজের এলাকায় নিজের আইন তৈরী করত। জমিদারদের ক্ষুদে সংস্করণ। জমিদাররা এদের জন্যেই এমন হয়েছিল, না, জমিদারদের অনুকরণে বা তাদের থেকে বাঁচবার জন্য এমন হয়েছিল, তা বলতে পারব না সুলতা। সেটা অনুসন্ধান ক’রে দেখতে পারো। হয়তো বা সে কালের এইটেই ছিল রাষ্ট্রের চরিত্র, সমাজের চরিত্র, মানুষের চরিত্র।
গোপাল সিংয়ের কথা বলি।
গোপাল সিং বীরপুর মৌজায় বাঘ ছিল। বাংলাদেশের মাটির মানুষ ব্রাহ্মণ, কায়স্থ সদগোপ মাহিষ্য এদের থেকে কিছু স্বতন্ত্র—ভুলতে পারত না সে ছত্রি। গ্রামের শ্রেষ্ঠ জমিটুকু ছিল তার। সচ্ছল সংসার। সম্পদ টাকাকড়ি কত ছিল বলা কঠিন কিন্তু ধান ছিল তার প্রচুর। একটা পুকুরের চারি পাড়ে খড়ের ‘বড়’ অর্থাৎ মোটা দড়ি পাকিয়ে তারই বেড় দিয়ে তৈরি গোলায় বাঁধা থাকত। কেউ বলে একশো কেউ বলে দেড়শো গোলা পুকুরটাকে ঘিরে, সে এক আশ্চর্য শোভার সৃষ্টি করত।
উঠত ভোরে; তারপর ডন বৈঠক দিয়ে ছোলা গুড় আর সদ্যদোওয়া ফেনাসুদ্ধ দুধ খেয়ে লম্বা ছিলমে গাঁজা খেয়ে, মাথায় মুরেঠা বেঁধে গায়ে আংরাখা পরে, বেরিয়ে এসে একটা পাক দিয়ে আসত মাঠে। হেঁটে যেত না, যেত ঘোড়ায়। ভাল দেশী ঘোড়া ছিল তার। পাঞ্জাবীদের কাছে কিনত। তারপর এসে বসত দলিজার তখতপোশে। মণ্ডলান তৌজি বীরপুরের মণ্ডল সে, তার সেরেস্তা ছিল, সেরেস্তা অবশ্য জমিদারের নামাঙ্কিত। রোকা থেকে সকল কাগজপত্রেই লেখা থাকত জমিদারের নাম। রসিদ ‘চেক’-এতেও থাকত জমিদারের নাম জমিদারের শীলমোহর। তবে হুকুম ছিল তার। তার হুকুমে গোমস্তা কাজ করে যেত ‘রোকা’ যা দিত তাতে তার দস্তখত থাকত জমিদারের মণ্ডল গোপাল সিং ছত্রি।
তখতপোশে বসে আবার খেত গাঁজা, তারপর মদ। শুধু মদ গোপাল সিং কখনো খেত না। গাঁজা খেয়ে মদ খেতো। বলতো বাবা, কালী মায়ের বেটা আমি। নেশা করি মাকে মনে দেখবার লেগে। তা নিচে পাতি বাবাকে, তারপর তার উপর খাড়া করি মাকে। মা তখন জিভ বার ক’রে হাসে।
সবই ছিল তার প্রকাশ্য ব্যাপার। জীবনে যা অপ্রকাশ্য তা তার স্বার্থের ব্যাপার, বিষয়ের ব্যাপার।
গ্রামের প্রজারা এসে বসে থাকত। তাদের নালিশ শুনত। জরিমানা আদায় করত। ভেট নিত। কেউ আনত খাসী, কেউ আনত তরকারী, সে শাক পর্যন্ত; কেউ আনত ঘি কেউ দুধ। খাজনা আদায় হত। দরখাস্ত জানাতো।
দলিজার কাজ সেরে গোপাল সিং স্নান করতে যেত পুকুরে; ঝাঁপিয়ে পড়ত কুমীরের মত। প্রচুর সাঁতার কেটে উঠত। তারপর কালীমা গোবিন্দজী থেকে ষষ্ঠীমাকে প্রণাম করে এসে খেতে বসত। সে খাওয়াও নাকি একটা পর্ব ছিল। মাছের মাথা ভিন্ন খাওয়া হত না। এবং পাঁচ পোয়া চালের ভাত সে খেতো। তার সঙ্গে ছোলার দাল। তারপর ঘুম। টানা সন্ধে পর্যন্ত। সন্ধের সময় উঠেই নেশা-যোগ। আগে বাবার ভোগ তারপর মায়ের ভোগের প্রসাদ পেয়ে সন্ধ্যার মজলিশ। সে গ্রামসুদ্ধ লোক। সে দুপুররাত্রি পর্যন্ত। তারপর অন্দরে। তিনটি বিবাহ ছিল—তার উপর ছিল রক্ষিতা দাসী!
কিন্তু এই সব নয় গোপাল সিংয়ের। বর্ষার সময় গোপাল সিংয়ের আর এক রূপ ছিল। পাঁচখানা গ্রামের লোক আসত তার দলিজায়। বর্ষায় ধান ফুরিয়েছে, চাষের সময় ধান চাই।
‘গাঁজার নেশার পাটার উপর মদের নেশার বিগ্রহ চড়িয়ে’ গোঁফে তা দিতে দিতে গোপাল সিং প্রশ্ন করত—কোন্ গ্রামের রে তোরা বেটারা?
—পাঁচপাড়ার আমরা সিংমশায়!
—কতজনে নিবি, কত ধান চাইরে শারা! হিসেব করে বল।
—হিসেব করে এনেছি সিংমশায়। চার পৌটি ধান আমাদের চাই।
মানে একশো ষাট মণ!
গোপাল বলত—দেখ তো দাশজী, কোন্ কোন্ গোলায় পুরো এক এক পৌটি ধান আছে? দাশজী গোমস্তা বলে দিত নম্বর।
গোপাল বলত-যা এই এই নম্বরের গোলা চারটে ভেঙে ধান নিয়ে যা। খড়ের বড় তুলে রেখে যা।
তারা চলে যেত খুশী হয়ে। আর একদল এসে দাঁড়াত—আমরা সাওতা থেকে এসেছি। প্ৰণাম।
—তোদের কত চাই?
—আমাদের লোক কম, দু পৌটি চাই।
—শা-লোক কম কেনে রে? বেশি হয়ে যা না। আমি বারণ করেছি। দুটো-তিনটে বিয়ে কর। বলে দাও দাশ দুটো গোলার নম্বর
আবার অন্য গ্রাম আসত। তারা নম্বর জেনে নিয়ে চলে যেতো। ‘বাখারের খড়ের দড়ি খুলে ধান তুলে গাড়ি বোঝাই করত; খড়ের দড়ি সযত্নে জড়ো করে রেখে যেত গোপাল সিংয়ের চাষবাড়িতে। মেপে দেখার রেওয়াজ ছিল না। কিন্তু কম হত না কখনো। আবার ধান উঠলে মাঘ মাসের শেষ থেকে শুরু করে গোটা ফাল্গুন ধান বোঝাই গাড়ি আসত। গ্রামের লোকেরা প্রণাম করে বলত—আমরা পাঁচপাড়ার লোক, ধান এনেছি।
–এসেছিস শা—রা। বেশ করেছিস। যা, যে বাখার ভেঙেছিলি সেই বাখারে ধান তুলে বড় বেঁধে দিয়ে যা। পুরো এনেছিস?
—আজ্ঞে হ্যাঁ। আসল সব আছে। তবে বাড়ি পুরো দিতে পারছি না সিংমশায়, এবার ফলন খারাপ।
—কত বাকী থাকল লিখে দিয়ে যা।
সিংয়ের তরফেও কেউ ধান মেপে নিত না।
শুধু এই নয়, গোপাল সিংয়ের আর এক চেহারা ছিল। বিবাদী সম্পত্তি দখল নিতে সাহায্যের জন্য লোক আসত। বিবাদী জমি দখল দিয়ে দিতে হবে সিংজী।
—কোথাকার গো?
—নসীমপুরের।
—কার সঙ্গে ফৌজদারী?
—নসীমপুরের সাহাদের সঙ্গে।
–ওরা কাকে আনবে?
—শুনছি—গোপ গাঁয়ের গোপদের।
—তারা গোপ? শা―মরদ বটে!
—আপনাকে যেতে হবে।
—যাব। দুশো টাকা লিব।
—আজ্ঞে—
—ভাগরে শা—ভাগ। আজ্ঞেতে নেই গোপাল সিং। হাঁ বললে আছে! আধা টাকা রেখে যা। আধা টাকা গিয়ে আগে লিব—তারপরে নামব। মামলা খরচ শা–তোদের।
তাই ঠিক দিনে যেত গোপাল। ফাটাফাটি করে মিনিট পনেরোর মধ্যে দুচারটেকে ঘায়েল করে তাদের ভাগিয়ে দিয়ে চলে আসত। দুচার লাঠি খেয়েও আসত। কিন্তু জখম হয়ে মাটি সে নেয় নি কখনো। ফৌজদারী মামলায় আসামী হত। কিন্তু বিচিত্র অ্যালিবি রেখে যেতো, যার জোরে অধিকাংশ সময় বেরিয়ে আসত।
কেউ আসত শত্রুর উপর শোধ নিতে হবে।
—কি করতে হবে?
–শিক্ষা দিতে হবে।
—বাবা লিখাপড়ি জানি না আমি। মারধর জানি। জান লিতেও জানি। বাকি কি করতে হবে বল?
—ঘা-কতক উত্তম মধ্যম।
—শা, হাত লিব না পা লিব না কান কেটে লিব—তাই বল্। হাত পা ভাঙতে লিব একশো টাকা, কান কেটে লিতে দেড়শো!
জান নিতে হবে বললে বলত—কি করেছে তুমার? বেটী বহু বহেন কারুকে বাহার করেছে? তোমার কারুর জান লিছে? সি হলে পর লিতে পারি। রাখো পানশো। নাম বলো। হদিশ বলো। সাত দিনের অন্দরে লাশ মিলবে মাঠে, না তো ঘাটে, না তো রাস্তার উপর! না-হলি ভাগো!
ঘরে আগুন দিতে হলে পাঁচ দশ টাকা।
পথের মধ্যে লোকের সামনে কান মলে দিতে হলে পঁচিশ টাকা। তার সঙ্গে দুটো থাপ্পড় দিতে হলে আরো দশ টাকা। তার সঙ্গে গাঁজা মদ!
এও সব নয়। এমন যে গোপাল, থানায় তার খাতির খুব। খাসী মাছ ঘি তরকারী দুধ, মধ্যে মধ্যে টাকা, এ গোপাল দিত। কিন্তু তাই সব নয়। তার এলাকার কোন আসামীকে তার সাহায্য ভিন্ন পুলিশ ধরতে পারত না।
কিছুদিন আগে, শ্যামনগর পুড়িয়ে আসার পরই একটা ঘটনা ঘটেছিল, সেকথা লোকের মুখে গল্প হয়ে উঠেছিল। সকালে দলিজার সামনে দিয়ে যাচ্ছিল থানার নতুন রাইটার, সঙ্গে দুজন কনেস্টবল। গোপাল সিং তাকে দেখেই ‘আরে-আরে আরে—’ বলে পরম আগ্রহভরে এসে বলেছিল—চামারি সিং, কাহর যায়েগা ভাইয়া? ই বাবু?—
—আপনার এলাকায় এলাম সিংজী। ইনি নৌতুন জমাদার! বলে সে আলাপ করিয়ে দিয়েছিল রাইটারবাবুর সঙ্গে। গোপাল তাকে সাগ্রহে আহ্বান করেছিল তার বাড়ীতে। আসেন আসেন। বসেন। তামাকুল পিয়েন। শরবত আন, পান আন, মদ আন। খাসী এনে কাট!
রাইটারবাবুটি পুরনো বন্ধু। সিংজীর সঙ্গে অনেক মদ্যপান করেছেন। তাঁর মারফতে অনেক ঘুষ নিয়েছেন। কিন্তু আজ তিনি কান দেন নি। তিনি আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে বলেছিলেন-না। একজন ফেরারী আসামীর সন্ধানে এসেছি। খবর পেয়েছি সে এসেছে। আমাকে যেতেই হবে।
—আরে বসেন মশাই। উ শালাকে হামি হাজির করে দিব। কেনে ভাবছেন আপনি। বসেন, মৌজ করেন। মদ খান। রাত যে যা চান তাই দিব। কাল সকলে শা–কে লিয়ে মজেসে চলিয়ে যাবেন।
কিন্তু মুন্সীসাহেব শোনেননি। চলে গিয়েছিলেন। ফিরেছিলেন সন্ধে নাগাদ—অত্যন্ত ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্ত হয়ে—শূন্য হাতে।
গোপাল আবার তাঁকে পাকড়েছিল। বসেন বসেন। ই কি বাত! এই রাতে ফিরবেন, না খানা, না পিনা। তা হয় না মশা।
মুন্সীবাবু অগত্যা ছিলেন, সম্মুখে রাত্রি, পথও অনেকটা এবং ক্ষুধার্ত, ক্লান্ত দুই-ই ছিলেন সকলে। গোপাল তাদের সমাদর করে মদ্য, মাংস, খিচুড়ি, মাছের মুড়ো খাইয়ে বিছানা করে শুতে দিয়েছিল। একটি যুবতীও দিয়েছিল। গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিলেন মুন্সীবাবু। কিন্তু হঠাৎ ঘুম ভেঙে গিয়েছিল। ঘরের মেঝেটা জলে ভিজে উঠেছে, বিছানা ভিজেছে এবং বাইরে থেকে কারা হুড় হুড় করে জল ঢালছে জানলা দিয়ে।
মেয়েটা একপাশে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কালটা ছিল শীতকাল। মুন্সীবাবু ভিজে বিছানায় শুয়েছিলেন, তাঁর কাপড় জামাও ভিজে গেছে। তিনি কাঁপতে কাঁপতে উঠে ঘরে পা দিতে গিয়ে কাদায় পা দিয়েছিলেন, মাটির মেঝে জলে ভিজে কাদা হয়ে উঠেছে।
—এ কি?
মেয়েটা জবাব দিয়েছিল—সিংজী।
—সিংজী?
—হ্যাঁ, সিংজীর লোকেরা জানালা দিয়ে জল ঢালছে।
—কেন?
—তা জানি না।
মুন্সীসাহেব দরজায় এসে খিল খুলে দরজা টেনে দেখেছিলেন, দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। তিনি তারস্বরে চিৎকার করেছিলেন—সিংজী। সিংজী। গোপাল সিং বাবু। ও মশায়।
বাইরে অট্টহাস্য বেজে উঠেছিল। হা-হা-হা! কেমন মজা!
এটা গোপালের কৌতুক। তার রস-রসিকতা এইরকম। কিন্তু শেষরক্ষা করেছিল গোপাল। দরজা খুলে ভিজে মুন্সীকে বের করে শুকনো কাপড় পরিয়ে শুকনো ঘরে শুকনো শয্যায় শুতে দিয়েছিল। শুধু তাই নয়, সকালে উঠেই মুন্সীসাহেব তাঁর ফেরারী আসামীকেও হাজির পেয়েছিলেন। গোপাল সিংয়ের লোকেরাই তাকে লুকিয়ে ফেলেছিল মুন্সী যেতে যেতে, আবার তারাই তাকে হাজির করে দিয়েছে মুন্সীজী উঠতে উঠতে।
গোপাল মুন্সীকে বলেছিল—এই লেও বাবা, তোমার আসামী। লিয়ে যাও। কিন্তু বাবা, গোপাল সিংকে ডিঙিয়ে ঘাস খেতে যাইও না। গোপাল ঘোড়া আছে না—হাঁতি আছে, উট আছে। ডিঙানো যায় না। বললাম-বস বাবা, মৌজ করো। শুনলে না। তাই হাতের খেল দেখিয়ে দিলম।
আসামীটাকে বলেছিল—যা রে শালা যা। বুরা কাম করিয়েছিস, সাজা লিতে হবে। আজ না লিস, কাল লিতে হবে। তা যা চলে যা। তোর ‘বালবাচ্চা জরু অরু’ রইল। আমি রইলম। খানে মিলবে, পরনের কাপড়া মিলবে। সো সব কুছ আমি দিব। যা।
***
এই গোপাল সিং।
রায়বাহাদুর রত্নেশ্বরের প্রথম দিনের ডায়রী দশ পৃষ্ঠা জুড়ে লেখা। অনুষ্ঠানের উৎসবের বিবরণ থেকে মায়ের কোলে ফিরে আসার আবেগময় মনোভাবের বর্ণনার সঙ্গে গোপাল সিংয়ের কথা অনেকটা জায়গা জুড়ে আছে।
—সে যদি নাই আসে। তবে কি করবেন? কে ডাকবে? এই গোপালকে কে শত্রু করবে? অথচ মণ্ডলান তৌজী স্বীকার দোষ হয়ে যাচ্ছে। রত্নেশ্বর দেওয়ানকে চিন্তিত ভাবেই কথাগুলো বলেছিলেন।
হেসে গিরীন্দ্র আচার্য বলেছিলেন—বাবুজী, লোক আছে। ডাকবার লোক আমার হাজির আছে।
—হাজির আছে? কে?
আচার্য ডেকে বলেছিলেন—ভগবান মণ্ডলকে ডাক তো। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এক দীর্ঘকায় প্রায় সাড়ে ছ ফুট লম্বা অনুপাতে শীর্ণকায় এক প্রৌঢ় এসে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করেছিল।
ভগবান মণ্ডল অবস্থায় গোপাল সিংয়ের সমকক্ষ লোক। কিন্তু নির্বিরোধী। এতকাল পর্যন্ত গোপালের অনুগতই ছিল। সে যা বলেছে, তাই মেনেছে। কিন্তু আর মানবে না। সে ডাকতে প্রস্তুত আছে। কীর্তিহাটের জামাই সে। আচার্য তার শ্বশুর শ্যালকদের দিয়ে তাকে জাগিয়েছেন। মণ্ডলান তুমি নাও। মাথা হেঁট করে কতকাল থাকবে?
ভগবান রাজী হয়েই এসেছে এখানে।
গিরীন্দ্র আচার্য বলেছিলেন—ফৌজদারী হবেই। গোপাল ছাড়বে না। ওতেই সে জালে পড়বে। ভগবানকে সামনে রেখে লড়বে আমাদের লোক। গোয়ানদের আমি ঠিক করে রেখেছি। এই সমারোহের মধ্যেই বীরেশ্বর রায় গোয়ানদের বসতের জায়গা দিয়েছিলেন ওই সিদ্ধপীঠের জঙ্গলের পাশে খানিকটা দূরে ওই লালমাটির ডাঙার উপর। একেবারে কাঁসাইয়ের ধারে। হিলডার বাবা পিদ্রুস ওদের সর্দার। পিদ্রুস তখন পঁচিশ-তিরিশ বছরের জোয়ান। রবিনসনের মৃত্যুর পর পুলিশ তার উপর নজর রেখেছে। সে রায়বাবুর আশ্রয়ে এসেছিল বাঁচবার প্রত্যাশায়।
গোপাল সিং কিন্তু আসে নি। একটা গুজব কেমন করে রটেছিল যে বীরেশ্বর রায় প্রতিজ্ঞা করেছেন গোপাল এলে তাকে ধরে কালীমায়ের স্থানে নরবলি দেবেন। বিচিত্রভাবে গুজব নিজের গড়ন নিজে নেয় সংসারে। গুজব রটেছিল বীরেশ্বর রায়ের নিরুদ্দিষ্টা সতীবউ বারো বছর কালী সাধনা করেছেন। তার উদযাপন হবে নরবলি দিয়ে। গোপাল সেই বলি।
.
কথাটা সেকালে অবিশ্বাস্য ছিল না। নরবলি তখনো ছিল। তান্ত্রিকেরা দিত গোপনে শ্মশানে, লোকালয় থেকে দূরে; ডাকাতেরা বড় ডাকাতি করবার আগে অনেক সময় নরবলি দিত। জেদের ক্ষেত্রে জমিদারেরাও নরবলি দিয়েছে। নিজে গোপালও বলি হিসেবে নরবলি না দিক, নরহত্যা কয়েকটা করেছে, তার মধ্যে একটাকে নরবলিই বলা চলে। ছিরুদাসকে সে কালীপূজার রাতে অন্ধকার মাঠে এক কোপে কেটেছে। কাছাকাছি অঞ্চলের মধ্যে শিবপুরের ছিরুদাস একসময় দুর্দান্ত দুর্ধর্ষ হয়ে উঠেছিল—মানত না সে কাউকেই। সম্পত্তিবান লোক, লোকে বলত একদল ডাকাত তার অধীনে আছে। বর্তমানে গোপাল সিং যা করে তাই সে তখন করত। বলতে গেলে গোপালের গুরুও সে বটে এবং গোপাল তাকে খুন করেই তার গদিতে বসেছে তাও বটে। স্থানীয় সম্পত্তিবান ব্রাহ্মণ কায়স্থ গন্ধবণিক তালুকদার পত্তনীদার এবং সংগৃহস্থেরা ছিরুদাসের ঔদ্ধত্যে পীড়িত এবং লাঞ্ছিত দুইই হয়েছিলেন। শেষে তারা একজোট হয়ে প্রতিকারে বদ্ধপরিকর হয়ে কাণ্ডটা করেছিলেন। গোপাল তখন নবীন যুবক। গন্ধবণিক তালুকদার লোকাই চন্দ হয়েছিল জোটের মাথা। সেদিন কালী পুজো। লোকাই চন্দের বাড়িতে সেদিন গোপাল হাজির ছিল। নেমন্তন্নে গিয়েছিল। রাত্রি-দুপুরে পুজো। লোকাই চন্দ উপোস করে বসেছিল। গোপালও বসেছিল কাছে। ওই কথাই হচ্ছিল। গোপাল বলেছিল—হামি পারি চন্দবাবু!
—তুমি পারো? হেসে বলেছিল—এত সোজা নয় গোপাল!
—না পারলে দুয়ো দিবেন। ছত্রি থেকে গোপাল খারিজ হয়ে যাবে!
মাথায় কারণের ঝোঁক ছিল, সেই ঝোঁকের মাথাতেই হচ্ছিল কথাবার্তা। এমন সময় একজন পাইক এসে বলেছিল—ছিরুদাস এসেছে।
—ছিরুদাস!
—হ্যাঁ। কালীপুজোর খবর করতে এসেছে। নেমন্তন্নপত্ত করেছিলেন।
—নিয়ে আয়। না—আমি যাচ্ছি।
উঠে যাচ্ছিল চন্দ, গোপাল বলেছিল—হামাকে একটা তলোয়ার দিবেন? কি দাও? ঘরেই ক’খানা রামদা আর তলোয়ার সাজানো ছিল।
—গোপাল!
—দিয়া দেখেন।
—কিন্তু আমার গ্রামের মধ্যে নয়।
—ঠিক আছে। তাই হোবে।
—দেখে নিয়ে যাও!
—হামি এই দরজা দিয়ে নিকলে যাচ্ছি। একটুকুন দেরী করবেন।
ছিরুদাস চাষীর ছেলে, দুর্দান্তপনার জোরে সম্পত্তিবান হয়ে সে প্রতিষ্ঠিত মর্যাদাবানদের গায়ে-গা-দিয়ে বসবার শখে একজন অনুচর সঙ্গে ক’রে কালীপূজার দিন সন্ধে থেকে তত্ত্বতল্লাস করতে বেরিয়েছে। সে দাঁড়িয়েছিল কালীমূর্তির সামনে। চন্দ তাকে অতিথি হিসেবেই আহ্বান করেছিল। আপ্যায়িতও করেছিল। কয়েক পাত্র কারণ পান করে উঠেছিল ছিরুদাস।—উঠলাম চন্দমশায়!
চন্দের মনে দ্বিধা হচ্ছিল। অতিথি এসেছে! তার উপর গোপাল একলা গেল, যদি না পারে, তবে সব প্রকাশ হয়ে পড়বে।
চন্দ বলেছিল—আজ থাক না দাস।
—আজ্ঞে না। ওইটি আজ্ঞে করবেন না। বাড়ী আমাকে ফিরতেই হবে। অনেক শালা তক্কে আছে। আমি বাড়ী নাই জানলে বাড়ী মেরে দেবে। তাছাড়া গুরুর বারণ আছে—বাইরে রাত আমি কাটাব না। মানুষ ঘুমোয়—না-মরে! পরের বাড়ীতে ঘুম আর যমের দুয়োরে মাথা দেওয়া দুই সমান।
চন্দ বলেছিল—তবে সঙ্গে লোক দি, অপেক্ষা কর।
নিজের হাতের লাঠির মধ্য থেকে একটা ধারালো চকচকে গুপ্তি বার করে বলেছিল-”যাঁহা ছিরুদাস তাঁহাই ভীমপুর”। এই আমার দোসর। আপনাদের আশীর্বাদে মানুষ তো মানুষ, ভূত প্রেত পিশাচে ছিরুকে পথ ছেড়ে দেয়।
বলে হাসতে হাসতে চলে গিয়েছিল। গ্রাম পার হয়েই বিস্তীর্ণ মাঠ একটা। ছিরু চলে যাওয়ার আধঘণ্টাও হয় নি—মাঠ থেকে একটা চিৎকার উঠেছিল। সে চিৎকার ভীষণ চিৎকার। চমকে উঠেছিল চন্দ। কি হল?
গোপাল ধরা পড়ল? মরল? সে ভাবছিল লোক পাঠাবে কি পাঠাবে না। হঠাৎ ছুটে এসে পড়েছিল ছিরুদাসের সঙ্গের লোকটা।—চন্দমশায়!
চন্দ আবার চমকে উঠেছিল।—কি হল?
হাঁপাতে হাঁপাতে লোকটা বলেছিল—সর্বনাশ হয়ে গেল হুজুর। মাঠের মধ্যে একটা গাছের উপর থেকে লাফ দিয়ে পড়ল একটা দানোর মত কি। তারপর—
—তারপর কি?
—একখানা দা দিয়ে—
—কি? কি?
—দাস মশায়কে এক কোপ। তারপর আমাকে। আমার হাতে মশাল ছিল। আমি লাঠি ধরতেই পারলাম না। দাসমশায়ও গুপ্তি খুলতে পারলে না। আমার হাতে কোপ লেগেছে। মশাল পড়ে গিয়েছে। সে দাসমশায়ের বুকে বসে কোপাচ্ছে।
লোকজন গিয়েছিল হৈ হৈ করে। স্বয়ং চন্দ গিয়েছিল। হৈ হৈ সে-ই করিয়েছিল। গোপাল জানে, সেটা চন্দমশায়ের ইশারা। গোপাল তখন অমাবস্যার অন্ধকারের মধ্যে দূরে চলে যাচ্ছে। যেতে যেতে হেসে উঠে সেই জনহীন মাঠে বলে উঠেছিল—জয় কালী!
পরদিন পরিচ্ছন্ন পোশাক পরে মুরেঠা বেঁধে এসে চন্দকে নমস্কার করে বলেছিল—আপনার বাড়ীতে কালীপুজো হয়েছে কাল। পেসাদ লিতে এলম।
চন্দ খাতির করে বসিয়ে বলেছিল-এস-এস-এস। প্রসাদ সর্বাগ্রে তোমার হে! তুমি সাধক! বস!
কথাটা গোপালের মনে পড়েছিল। গোপাল সেইজন্যে আসে নি, তবে উকীল সে পাঠিয়েছিল! উকীল, মজবুত উকীল-মহিষাদল স্টেটের নায়েব। মহিষাদলের কাছারীতেও সে গিয়েছিল। রাজাবাহাদুর তাকে তিরস্কার করেছিলেন। গোপালের বিবরণ তাঁর অজানা ছিল না। বীরেশ্বর রায় তাঁর সঙ্গে যে সম্ভ্রমপূর্ণ ব্যবহার করেছিলেন, তিনি শীলদের সঙ্গে মিটমাটের জন্য রাজা রাধাকান্ত দেব বাহাদুরের কাছে গিয়েছিলেন, রাজাবাহাদুরকে যে কথা বলেছিলেন, সবকিছুই তাঁর কানে এসেছিল। এবং শ্যামনগরে সে দে সরকার এবং রবিনসনের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গোটা গ্রাম পুড়িয়ে দিয়েছে এবং রত্নেশ্বরকে পুড়িয়ে মারবার জন্য ঘরে শিকল দিয়ে বন্ধ করেছিল, তাও জানতেন।
তিনি বলেছিলেন—আমার উচিত এখান থেকেই তোমাকে বেঁধে কীর্তিহাটে পাঠানো। যাও তুমি, আমার সম্মুখ থেকে চলে যাও! আমি একটি কথাও তোমার জন্যে বলব না, বলতে পারব না!
গোপাল অসহায় বোধ করেছিল প্রথমটা। তারপর সে নিজেকেই নিজে বলেছিল, কুছ পরোয়া নেহি হ্যায়।
তারপর ধরেছিল নায়েবকে। রাজাসাহেব এ নিমন্ত্রণে নিজে যাবেন না, তবে তাঁর আশীর্বাদ লৌকিকতা নিয়ে যাবে তাঁর সদর নায়েব। সেই নায়েবকে ধরেছিল গোপাল এবং কবুল করেছিল—খেয়া কোনরকমে ঘর ঢুকাইয়া দিন নায়েববাবু, আমি একশো টাকা কবুল করছি আপনার নজরানা!
***
সেদিন গোপাল নিজে এলে কি হত বলা কঠিন। সেদিন রায়বাড়ীতে দেবতা-মন্দির থেকে, কাছারী থেকে অন্দর পর্যন্ত পরিপূর্ণ সন্তোষের একটা অতিপ্রসন্ন বাতাবরণের সৃষ্টি হয়েছিল।
নাটমন্দিরে হয়েছিল পোষ্যপুত্র গ্রহণের যজ্ঞ। বিমলাকান্ত অশ্রুসজল চক্ষে দান করেছিলেন কমলাকান্তকে, দান গ্রহণ করেছিলেন বীরেশ্বর এবং ভবানীদেবী। জল সকলের চোখ থেকেই গড়িয়ে পড়েছিল। তাঁরাও কেঁদেছিলেন, সঙ্গে সঙ্গে যাঁরা দেখেছিলেন তাঁরাও কেঁদেছিলেন।
যজ্ঞশেষে অন্দরে লক্ষ্মীর ঘরের সামনের দরদালানে রায় পরিবারের সকলে রত্নেশ্বরকে আশীর্বাদ করেছিলেন।
প্রথমেই আশীর্বাদ করেছিলেন একসঙ্গে যুগল বীরেশ্বর রায় এবং ভবানী দেবী।
সেই কাত্যায়নী দেবীর বোন বীরেশ্বর রায়ের মাসিমা বসে বলে দিচ্ছিলেন ক্রমপর্যায়। এ আর এক মানুষ। বীরেশ্বর রায় পুত্রের হাতে দিয়েছিলেন নিজের হাতের হীরের আংটি। ভবানী দেবী দিয়েছিলেন একসেট সোনার বাসন।
ভদ্রমহিলা বলেছিলেন-ওমা! বাটি যে খালি গো। ওতে বাটি ভরে দুধ দাও। তুমি মা। দাও দাও। ওগো দুধ আন—দুধ আন। সন্তান নিচ্ছ—মা–ও কি সোনায়-দানায় মেলে? মেলে মায়ের দুধে। একবাটি দুধে তোমার মাই থেকে গেলে একফোঁটা মিশিয়ে দাও। না থাকে, ওই ঘরে যাও, গিয়ে দুধে মাইয়ের বোঁটা ঠেকিয়ে দাও। তারপর মুখে অন্ন দাও দুটি। ওই অন্নপ্রাশন হল। হ্যাঁ। তারপর দুজনে বস। বীরেশ্বর আর তুমি। বউমা, তুমি ছেলেকে আগে কোলে নাও। উঠে বস ভাই রাজাবাবু নাতি আমার, রায়বংশের এ-কুল ওকুল দুকুলের শিবরাত্রির শলতে—মায়ের কোলে উঠে বস। মায়ের কোলে এলে তুমি। বা-বা-বা-কি মানিয়েছে দেখ! মা দুর্গার কোলে কার্তিক! যশোদার কোলে গোপাল বলব না মা, গোপাল বড় নিষ্ঠুর, মাকে কাঁদিয়েছিলেন। মা কৌশল্যার রামচন্দ্র। এই ঠিক। ফিরে এল হারানিধি, এসে রাজপাটে বসবে! দুঃখ হচ্ছে কি জান—সীতা নাই! আঃ, আজ সীতা থাকলে কি হত? আঃ, যাত্রায় গান শুনেছিলাম -অযোধ্যার প্রজারা কাঁধে ভার নিয়ে গান গেয়েছিল-’আয় ভাই ভার নিয়ে যাই অযোধ্যায় রাম রাজা হবে।’ এ ঠিক তাই!
কে ভিড়ের মধ্যে থেকে বলে উঠেছিল—তুমি তো রয়েছ ঠাকুমা, সীতা হয়ে বাঁয়ে ব’স না! আনন্দের টলমল সরোবরে যেন দমকা বাতাসে একটা তরঙ্গোচ্ছ্বাস উঠেছিল। মেয়েরা সব হেসে উঠেছিল খিল খিল করে। বীরেশ্বর রায়ের মত দুর্দান্ত পুরুষের সামনেও তাদের হাসতে ভয় হয় নি।
বীরেশ্বর রায় নিজেও মৃদু মৃদু হেসেছিলেন। ঠাকুমাটি বলেছিলেন—কে লা?
কেউ সাড়া দেয় নি। ঠাকুমা বলেছিলেন-এ নিশ্চয় অঞ্জনা! ও নইলে কে বলবে এমন কথা। মর—মর-মর। আমার মানাবে না ভাবিস বুঝি? ওলো, আমি রাজকুমারী রানী কাত্যায়নীর মাসতুতো বোন। আমাদের গায়ের রঙ সোনার মত, রূপ আমাদের লক্ষ্মীর মত! সাজলে এখনো নাতিকে ভোলাতে পারি! মরণ!
আবার হাসির রোল উঠেছিল। ঠাকুমা বলেছিলেন—থাম, হাসিস নে, শুভকর্ম হয়ে যাক। বউমা, এইবার ছেলেকে চুমু খাও, খেয়ে তুমি বীরেশ্বরের কোলে দাও। নাও বাবা বীরু, কোলে নাও ছেলে, তোমার বংশধর—তুমিও চুমু খাও।
—এইবার নাতি, তুমি বস ভাই মা-বাবার সামনে কোলের কাছে। আমরা পাঁচজনে আশীর্বাদ করি। প্রথমে আমি!
বলে ধানদূর্বার সঙ্গে একটি মোহর দিয়ে তিনি আশীর্বাদ করেছিলেন। একখানি রূপোর থালায় মোহর সাজানো ছিল, বীরেশ্বর সেখানা ছেলেকে এগিয়ে দিয়ে বলেছিলেন—প্রণাম কর। প্রণামী দাও।
রত্নেশ্বর রায় ঠাকুমাকে পাঁচখানা মোহর দিয়ে প্রণাম করেছিলেন।
পিছন থেকে সেই কণ্ঠস্বর আবার শোনা গিয়েছিল—সুদসুদ্ধ নগদ বিদেয় ঠাকুমা!
সকলে আবার হেসে উঠল। এবার বেশী। যেন হাওয়াতে বর্ষার এলোমেলো মাতন লেগেছে। এবং কালটাও যেন ভরা-ভর্তি বর্ষা বলে মানিয়ে গেছে বড় ভাল।
ঠাকুমা মুখঝামটা দিয়ে বলেছিলেন—মর মর মর! এমন মুখ যদি না হবে তো এমন কপাল হবে কেন তোর?
সঙ্গে সঙ্গে জবাব এল—কেন ঠাকুমা, কপালটা আমার মন্দ কিসে বল। ফক্কাপুরের রাজরাণী, খুদকুঁড়োতে পেট ভরাই, রাত্রে ভাঙা ঘরে চাঁদের আলো, বাড়ীর পাঁদাড়ে ঝোপেঝাড়ে শেয়াল ফৌজ পাহারা দেয়। রাজা আমার হবুচন্দর, খায়দায় কাঁসি বাজায়। কপাল আমার মন্দ কিসে বল?
বীরেশ্বর রায়, ভবানী দেবী, রত্নেশ্বর সকলেই এই মেয়েটির খোঁজে কৌতুক এবং কৌতূহলভরে তাকিয়ে দেখেছিলেন। কিন্তু তাকে কেউ দেখতে পায়নি। মেয়েটি পিছনে আত্মগোপন করে দাঁড়িয়েছিল।
বীরেশ্বর বলেছিলেন—মেয়েটি কে মাসিমা?
—আমারও বটে তোমার মায়েরও বটে—ভাইয়ের নাতনী। আমার আপন ভাই। তোমার মায়ের তা হলে মাসতুতো ভাই। তাহলে দেখ তোমার মামাতো ভায়ের বেটী। তোমার ভাইঝি সম্পর্কে। নাম হল অঞ্জনা। ওদের গেরামে অঞ্জনাঠাকরুন কালীমা আছে, তার দোর ধরেই হল ওই বেটী। তা আমাকে মধ্যে মধ্যে নেকে চিঠি, তোমাদের খবর নেয়; এবারে তুমি রাজসূয় অশ্বমেধ করছ বাবা, দেশদেশান্তরের লোক এল। প্রজাসজ্জন, তালুকদার, পত্তনীদার, বড় বড় নোক, হাকিম, হুকিম, তা আমিও ওকে নিকেছিলাম—আসবি—অবশ্যি অবশ্যি আসবি। চোখের সাথক করে যাবি।
ভবানী দেবী বলেছিলেন—বেশ করেছেন মাসিমা। উচিত করেছেন। বলা তো আমাদেরই কর্তব্য ছিল। তা আমরা তো ঠিক জানতাম না! বেশ করেছেন।
বীরেশ্বর রায় ভবানীকে বলেছিলেন—তুমি খবর করো!
এদিকে আশীর্বাদ একের পর এক হয়েই চলেছিল। রত্নেশ্বর প্রণাম করে অন্য সকলকেই এক মোহর করে প্রণামী দিয়ে চলেছিলেন!
আশীর্বাদের পালা শেষ হ’তেই এসেছিল প্রণামের পালা। রত্নেশ্বরের সঙ্গে সম্পর্কে যারা ছোট তারা এবং দাসীরা ভিড় করে এসেছিল এগিয়ে। হঠাৎ ঠাকুমা বলেছিলেন—অঞ্জনা কই? ও অঞ্জনা? তুই তো বড় লো! আয় আয়। কাল তো হিসেবে হল তুই সাতদিনের বড়! আয় না লো!
এবার এগিয়ে এল অঞ্জনা। বললে-না ঠাকুমা, প্রণাম আমি নিতে পারব না। আমি সাত দিনের বড়, উনি আমার থেকে চৌদ্দ আঙুল মাথায় উঁচু। আমি মনে মনেই বলছি—ভগবান মঙ্গল করুন। মা কালী রক্ষে করুন আপদে বিপদে। জমিদার আছেন রাজা হোন। বলেই সে এগিয়ে এসে প্রথম প্রণাম করেছিল বীরেশ্বর রায়কে। একটি উজ্জ্বল শ্যামবর্ণা দীর্ঘাঙ্গী মেয়ে, সুন্দর মুখশ্রী, মাথায় একরাশ ফোলা কোঁকড়া চুল, নাকটি একটু খাটো, চোখদুটি অপরূপ সুন্দর; একটু রোগা দেখাচ্ছে। পরনের কাপড়খানা পোশাকী কিন্তু পুরনো। হাতে দুগাছি শাঁখা আর বাঁ হাতে নোয়া। একটু শীর্ণ। দেহে পরিচ্ছদের অভাব যেন প্রকট হয়ে রয়েছে।
বীরেশ্বর তার মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ ক’রে বললেন—সুখী হও মা। কিন্তু প্রণাম নেবে না কেন রত্নেশ্বরের? সম্বন্ধে বড়।
—না—না মামাবাবু। না। বলে সে ভবানীর পায়ে প্রণাম করেছিল।
ভবানী দেবী তার চিবুকে হাত দিয়ে মুখে ঠেকিয়ে বলেছিলেন—ছেলেপুলে কি মা?
বলে উঠলেন ঠাকুমা। তবে আর বলছি কি মা। ছেলেপুলে হয় নি।
বীরেশ্বর বললেন—প্রণাম কর রত্নেশ্বর।
রত্নেশ্বর সর্বাগ্রে কয়েকখানা মোহর তুলে নিয়ে প্রণাম করতে উদ্যত হল। মেয়েটি সঙ্গে সঙ্গে একটু সরে এসে হেঁট হয়ে অঞ্জলি পেতে বললেন-দিন হাতে দিন। সোনা পায়ে রাখবার ভাগ্যি আমার নয়। আর প্রণাম ওই হল। রাজাবাবুর কোন্ দূর সম্পর্কের গরীব বোন, রাণী কাত্যায়নী দেবীর মাসতুতো বোনের খুড়তুতো ভাই তার নাতি। কথায় বলে ‘সইয়ের বউয়ের বকুল ফুলের বোনপো বউ-এর বোনঝি জামাই’। দিন ।
বলে অঞ্জলি পেতে মোহর কটা নিয়ে মাথায় ঠেকিয়ে বলেছিল-বাবু রত্নেশ্বরকে রাজা কর ঠাকুর। ধনে পুতে সংসারে ভরে দাও।
কণ্ঠস্বরে তার এমন আন্তরিকতা যে সকলে তার কথায় মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল।
এরপর সম্পর্কে ছোটদের প্রণামের পালা, তারপর দাসীদের। কুটুম্ব সজ্জন—গ্রামের জ্ঞাতিদের মেয়েরা দল বেঁধে এসেছিল। এবং তারা ভিড় করে ‘ঠুঠাক’ প্রণাম শুরু করে দিয়েছিল। এতক্ষণে রত্নেশ্বর সহজ হয়ে উঠেছিলেন। হাসিমুখে প্রত্যেকের হাতে একটি করে গিনি দিয়ে তাদের বিদায় শেষ করেছিলেন।
তারপর বাড়ীর দাসদাসীরা।
বীরেশ্বর বলেছিলেন-বেলা তিন প্রহর হয়ে গেছে। তোমরা একসঙ্গে প্রণাম কর। তোমাদের সকলে প্রত্যেকে পাঁচ টাকা করে পাবে।
ভবানী দেবী বলেছিলেন—আমার সঙ্গে আয় রত্ন। একটা কাজ বাকী আছে। আয়। বলে বলেছিলেন—মহাবীর, এখন কেউ যেন না আসে!
বীরেশ্বর রায় তখন প্রায় সুস্থ, শুধু একটা পা একটু টেনে চলতে হয়; লাঠি নিতে হয়েছে। তার সঙ্গে তিনি রত্নেশ্বরের কাঁধের উপর ভর দিয়ে সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলেন। দোতলায় এই মহলে তিনি ভবানী এবং রত্নেশ্বর ছাড়া কেউ থাকে না। আর একজনকে ভবানী দেবী নিয়ে এসেছেন, সে হল সোফি বাঈ। বিবিমহল বিশিষ্ট অতিথিতে ভর্তি। বাইজীর দল, খেমটার দল, সেসব অন্য জায়গায় থাকে। সোফিকে ভবানী এখানে একখানা কোণের ঘরে থাকতে দিয়েছেন। বীরেশ্বর রায় কিছু বলেন নি। রত্নেশ্বর বলেছিল—লোকে কি বলবে?
ভবানী বলেছিলেন—কি বলবে? বলবার কি আছে? আমার বাপের শেষকৃত্য আমি করতে পারি নি, ও করেছে। তারপর ছ’ বছর ও ওঁর সেবা করেছে। এতেও যদি ওর থাকলে নিন্দে হয়, তবে সে নিন্দে মাথায় ক’রে নিতে হবে। তাছাড়া ওর আচার-আচরণ, খাওয়া-দাওয়া কোনটেতে কোন্ নিন্দের কি আছে বল? তুই কি ভেবেছিস রত্ন, মাসোহারার নাম করে ওর মুখ-বন্ধের জন্যে বেঁধে রেখেছিস? ছি!
রত্নেশ্বর আর কথা বলেন নি। সোফি বাঈ সেইদিন থেকেই রায়বাড়ীর তনখা নিয়ে জানবাজারেই কাছাকাছি একটা বাড়ীতে থাকে। নিত্য সন্ধ্যার সময় আসে, বীরেশ্বরের সামনে মেঝেতে বসে থাকে, ভবানী দেবী বসে থাকেন বীরেশ্বর রায়ের বিছানায়; কথাবার্তা বলেন। গল্পগুজব করেন তারপর একখানা গান গেয়ে চলে যায়। বেশভুষা করে না সোফিয়া। হিন্দুস্থানী মেয়েদের ঢঙে লালপেড়ে শাড়ি পরে। আভরণের মধ্যে হাতে দুগাছি বালা, চুল সাধারণত এলোই থাকে। কোন কোন দিন বেণী রচনা করে সাধারণ একটা খোঁপা বাঁধে।
স্কুলের বনিয়াদ পত্তনের সময় একবার সে এসেছিল। সেবার বীরেশ্বর তাকে নিয়ে এসেছিলেন, সাহেবদের এদেশী খাঁটি গান গেয়ে শোনাবার জন্যে। এবার ভবানী নিয়ে এসেছেন। তাঁদের স্বামীস্ত্রীর জীবনের শুভকর্মে সোফিয়াকে তিনি বাদ দিতে পারবেন না। এবং প্রথমে বিবিমহলে জায়গা দিয়ে তাঁর মনটা খুঁতখুঁত করছিল, তাই তিনি এক কোণের একখানা ঘরে তাকে এনে রেখেছেন।
তার খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। রান্না সোফিয়ার একজন হিন্দু দাসী করে দেয়। দেবতার প্রসাদও খায়। খায় না শুধু মাংস প্রসাদ। এমনিতেও সে মাছ মাংস পেঁয়াজ এসব খায় না।
রত্নেশ্বরকে নিয়ে গেলেন ভবানী নিজের ঘরে। বললেন—বস। তারপর নিজে গিয়ে ডাকলেন সোফিকে।
সোফি উপরতলায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে দরদালানে এই অনুষ্ঠানপর্বটি দেখছিল। ভবানী এগিয়ে এসে তার হাত ধরে নিয়ে এসে বললেন—বেটাকে আশিস করো সোফি।
—আমি? বুকে হাত দিয়ে অসীম বিস্ময় প্রকাশ করে বললে-আমি?
—হ্যাঁ। তুমি! বাবুজীর তুমি সেবা করেছ। বহুৎ সেবা করেছ। আমার পিতাজীর তুমি শেষ কাজ করেছ। তুমি আমার বহেন সোফি। আমার বেটা সে কি তোমার বেটা নয়? তোমার আশিস না নিলে তো ওর আশিস পুরা হবে না সোফি!
সোফি অকস্মাৎ চোখ বন্ধ করেছিল, সঙ্গে সঙ্গে দুটি জলের ধারা নেমেছিল চোখ থেকে। তারপর চোখ খুলে কাপড়ের খুঁটে চোখের জল মুছে হেসে বীরেশ্বরকে বলেছিল—মালিক, আপনিও কি এই হুকুম করছেন?
বীরেশ্বরও বোধহয় আবেগে বিচলিত হয়েছিলেন, তিনি মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকিয়েছিলেন। মুখ না ফিরিয়েই তিনি বললেন—আমার কলেজার কথা ভবানী জানে সোফি।
সোফি এবার জিজ্ঞাসা করেছিল—ববুয়া। বেটা বলব? বলেছিল রত্নেশ্বরকে। রত্নেশ্বর সারাজীবন চরিত্র সম্পর্কে সজ্ঞানে কঠোর নিষ্ঠার সঙ্গে সকল রকমের ছুৎমার্গ পরিহার করে চলেছেন। কিন্তু সেদিন তিনিও আবেগে অভিভূত হয়েছিলেন, তাঁর মনকে তিনি কঠোর কঠিন করে রাখতে পারেন নি। তিনি মুখে উত্তর দেন নি, হাঁটু গেড়ে বসে ওই মুসলমানী বাঈয়ের পা ছুঁয়ে কপালে ঠেকিয়ে মাথা হেঁট করেছিলেন আশীর্বাদের জন্যে। সোফিয়া তার মাথার ডান হাত ঠেকিয়ে অন্য হাতখানি উপরে তুলে চোখ বুজে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে তার চিবুক স্পর্শ করে ঠোঁটে ঠেকিয়ে বলেছিল—মেরি জিন্দেগী সফল হো গয়ি। আল্লা মেহেরবান, আমার এই বেটাকে তুমি দুনিয়ার বাদশা করে দিয়ো।
তারপরেই সে চলে গিয়েছিল নিজের ঘরে।