[কীর্তিহাটের কড়চা – ৩য় খণ্ড – মূল বইতে অধ্যায় বা পর্ব ভাগ করা নেই। প্রায় ৪০০ পেজের এ খণ্ডটি আমরা পোস্ট করার সুবিধার্থে ২০টি পর্বে ভাগ করে দিলাম]
১
সুরেশ্বর বললে—এই শ্যামাকান্তের অভিশাপ নাকি রায়বংশ বহন করছে-শুধু শ্যামাকান্তের নয়-এ পাপের অংশ—সোমেশ্বর রায়-ডাকাতি করে তাঁর কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে আত্মসাৎ করেছিলেন। এই ছিল রায়বংশের বিশ্বাস।
সেকালের বিশ্বাস।
সুলতা বললে-তার মানে তো বুঝলাম না। সোমেশ্বর রায় তাঁকে জলে ঠেলে ফেলে দিয়েছিলেন বলে?
সুরেশ্বর বললে—এ প্রশ্ন সেইদিনই বীরেশ্বর রায় তাঁদের কুলপুরোহিত রামব্রহ্ম ন্যায়রত্নকে করেছিলেন। যখন বীরেশ্বর রায় মহেশচন্দ্রের পত্র হাতে নিয়ে বসে ভাবছেন, তখনই রামব্রহ্ম ন্যায়রত্ব এসেছিলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। প্রয়োজন তাঁর জরুরি। কিন্তু দারোয়ান বলেছিল—হুজুরের বারণ আছে। এখন তো—
কুলপুরোহিত রামব্রহ্ম রায়বাড়ির শুধু পুরোহিতই ছিলেন না, তিনি সোমেশ্বর রায়ের দেবোত্তর স্টেটের একজন ট্রাস্টিও ছিলেন। তাঁর একটি অধিকার ছিল। তিনি গলা ঝেড়ে পরিষ্কার করে নেওয়ার ছলে সাড়া দিয়ে ডেকেছিলেন —বীরেশ্বর!
বীরেশ্বর রায় ঘাড়টি ফিরিয়ে সাড়া দিয়েছিলেন—কে? খানিকটা চিনতে পেরেছিলেন আওয়াজ থেকে; অন্য কেউ হলে হয় সাড়া দিতেন না, নয় দারোয়ানকে বলতেন—পরে আসতে বল!
রামব্রহ্ম বলেছিলেন—আমি রামব্রহ্ম।
সজাগ হয়ে উঠে বীরেশ্বর বলেছিলেন- আসুন!
ছেদী তাড়াতাড়ি লাঠিতে ভর দিয়ে উঠেই গিয়ে দরজাটা খুলে দিয়েছিল। রামব্রহ্ম এসেই বলেছিলেন—একটি কথা যে বলতে এসেছি বাবা!
—বলুন।
—তোমার ভাগিনেয়, বলতে গেলে রায়বাড়ীর বংশধর সে-ই। তুমি তো আর বিবাহ করলে না! কমলাকান্ত শ্যামনগরে এসেছে। শুনেছ?
—শুনলাম ছেদীর কাছে।
—কি জন্য এসেছে, শুনেছ?
—হ্যাঁ, রবিনসন নীলকুঠী করছে শ্যামনগর ঠাকুরপাড়ায়; সে তাদের জমিতে জোর করে নীল বুনিয়েছে। কমলাকান্ত এসেছে সেখানে; বিমলাকান্তের পত্র নিয়ে।
—হ্যাঁ। ছেদী তার সঙ্গে এসেছে। ছেদীর হাতে বিমলাকান্ত বাবাজী আমাকে পত্র দিয়েছে। লিখেছে, “কমলাকান্ত জেদী। তাহার প্রকৃতি বীরেশ্বরের মত। সে ঝগড়াঝাঁটি বাধাইয়া বসিতে পারে। কালটা বড়ই বিরুদ্ধ কাল। আমাদের গ্রহের ফেরও বটে এবং সিপাহী বিদ্রোহের পর ইংরাজদের আক্রোশ বাড়িয়াছেও বটে। সুতরাং বীরেশ্বরবাবুকে অনুরোধ করিবেন যেন এই বিবাদটা তিনি মিটাইয়া দেন।” তা বিমলাকান্ত কি তোমাকে কোনও পত্র দেয় নি?
—না। বীরেশ্বর রায় হেসে বলেছিলেন—তাতে তার সম্মানের হানি হত!
—না-না বাবা। বিমলাকান্ত দেবতুল্য ব্যক্তি। কিছু মনে করো না। অবিচার বরং তার ওপরই হয়েছে। কথাটা তোমাকে এতদিন আমার বলা উচিত ছিল; কিন্তু বলতে পারি নি। তোমার পিতা আমাকে তাঁর শেষ অসুখের সময় বলেছিলেন। বলেছিলেন-বিমলাকান্তের পিতার কাছে যে অপরাধ করেছি, তার আর মার্জনা নেই আমার। তার ফল আমি পেয়েছি। বুঝতে পারছি পরকালে অনন্ত নরক হবে আমার। তাছাড়া যে পাপ আমি ঘাড়ে করেছি, সে পাপ আমার বংশকে আশ্রয় করে বংশকেও নরকস্থ করবে।
—আপনি বিমলাকান্তের বাপকে, তান্ত্রিক শ্যামাকান্তকে, কাঁসাইয়ের বন্যায় ফেলে দেওয়ার কথা বলছেন?
সবিস্ময়ে রামব্রহ্ম বললেন—তুমি কি করে জানলে?
—জেনেছি।
—তবে?
বীরেশ্বর রায় বলেছিলেন—বাবা আপনাকে মৃত্যুর পূর্বে অসুখের সময় কি বলেছিলেন?
—তুমি তো জান বলছ, বাবা!
—তবু আমি আপনার কাছে শুনতে চাই। যা শুনেছি তা কতটা সত্য, তা একটু মিলিয়ে দেখতে চাই।
একটু চুপ করে থেকে রামব্রহ্ম ন্যায়রত্ন বলেছিলেন—সে আমি তোমাকে মুখে ব্যক্ত করতে পারব না। কারণ—একটু চুপ করে থেকে বলেছিলেন—তুমি তাঁর পুত্র, আমি তোমার পুরোহিত, তোমার পিতার পাপের কথা তোমাকে মুখে-মুখে বলতে জিহ্বা আড়ষ্ট হবে। আর তোমার মানও হয়তো—। হেসেছিলেন ন্যায়রত্ন। আমি ভালো করে স্মরণ করে লিখে জানাব। একটু দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলেছিলেন। তারপর বলেছিলেন—কিন্তু বিমলাকান্তের কথা থাক; কমলাকান্ত তোমার ভাগিনেয়, অদ্যাপি-তক বলতে গেলে তোমারও বংশধর, তাকে রক্ষা করা তোমার কর্তব্য। ছেদী চিঠি এনেছে, তার সঙ্গে একই নৌকাতে এসেছে আমার কন্যা এবং দৌহিত্রী। তাদের কাছে শুনলাম, বিপদ আসন্ন হয়ে উঠেছে বাবা। কমলাকান্তের সঙ্গে রবিন সাহেবের বচসা হয়ে গেছে। কমলাকান্ত শুধু বিমলাকান্তের রক্তধারা বহন করে না, সে বিমলার পুত্র, তোমাদের রক্ত রয়েছে, মহাজেদী। ইংরাজি লেখাপড়া শিক্ষা করেছে, সে ইতিমধ্যে গ্রামের লোকেদের নিয়ে বিবাদের জন্য প্রস্তুত হয়ে উঠেছে। সেই কারণেই আমার বৈবাহিক আমার কন্যা-দৌহিত্রীকে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে। বিলম্ব করলে হয়তো এমন কিছু ঘটে যাবে, যার আর প্রতিকার করবার কোনও পথ থাকবে না।
বীরেশ্বর রায় বলেছিলেন-আমি আজই পত্র লিখে লোক পাঠাচ্ছি। সঙ্গে সঙ্গে বজরাও পাঠাচ্ছি, কমলাকান্তকে এখানে নিয়ে আসবে। যা করবার আমি এখান থেকে করব। তার সেখানে থাকবার প্রয়োজন কি?
রামব্রহ্ম বিস্মিত হয়েছিলেন বীরেশ্বর রায়ের কথা শুনে। বালক কমলাকান্তের উপর বীরেশ্বর রায়ের ক্রুদ্ধ আক্রোশ এবং ঘৃণার কথা তিনি জানতেন, চোখে দেখেছেন তিনি। পাঁচ বছরের কমলাকান্তকে চাকর কোলে নিয়ে বেড়াত; ঠেলাগাড়ীতে চড়িয়ে বাগানে ঘোরাতো; বীরেশ্বর রায় সেখানে থাকলে বলতেন, নিয়ে যা এই উল্লুক, ওটাকে নিয়ে যা এখান থেকে। নিয়ে যা বলছি।
শেষ পর্যন্ত এমন হয়েছিল; তখন তিনি মদ্যপান করতে শুরু করেছেন; তিনি হুকুম দিয়েছিলেন—ওটাকে যেন তাঁর সামনে কেউ নিয়ে না আসে। যে আনবে চাবুক মেরে তার পিঠের চামড়া তুলে দেব আমি।
বীরেশ্বর রায় ভবানী দেবীকে নিয়ে থাকতেন বিবিমহলে। বিমলাকান্ত থাকতেন বাড়ীর দ্বিতীয় মহলটায়। কমলাকান্তকে মানুষ করবার জন্য দাসী ছিল—তাদের হাতে সে মানুষ হত। সে বড় ভালোবাসত ভবানী দেবীকে; বিবিমহলে যাবার জন্য ঝোঁক ধরত। কিন্তু সেখানে যেতে পেত না সে। ভবানী দেবীরও হুকুম ছিল না এ মহলে আসবার।
রামব্রহ্ম ন্যায়রত্ন থেকে সকলেই যা বুঝেছিল তা সহজ অনুমানের কথা। একসঙ্গে বিমলার এবং ভবানীর সন্তান হল, মৃতবৎসা দোষগ্রস্তা বিমলার ছেলে বাঁচল, আর ভবানীর প্রথম সন্তান মরল। এই দুঃখ এবং ক্ষোভ থেকেই হিংসায় এমন হয়ে উঠেছেন বীরেশ্বর রায়। শেষ পর্যন্ত বিমলাকান্ত পুত্র কমলাকান্তকে নিয়ে এখান থেকে চলে গেলেন, আর ফিরলেন না। সে আজ বারো বৎসর। এই বারো বৎসরের মধ্যে বীরেশ্বর রায় ভগ্নীপতি-ভাগিনেয়ের নাম মুখে আনেন নি। কোনও সংবাদ নেন নি। এমন কি নিজের বাপের উইলকে একরকম গায়ের জোরে নাকচ করে দিয়েছেন। কমলাকান্ত দৌহিত্র হিসাবে সোমেশ্বর রায়ের আর্ট আনা অংশের উত্তরাধিকারী, তাকে আজ এই বারো বছরের মধ্যে জমিদারীর লভ্যাংশ দেন নি। তত্ত্বতল্লাস বলেও কোন টাকা কি সামগ্রী তাকে পাঠান নি।
বিমলাকান্ত নির্লোভ মানুষ, সদাচারী পণ্ডিত মানুষ, সকলে বলে—মানুষটি দেব-চরিত্র। তিনি এ বিষয়ে কোন উচ্চবাচ্য করেন নি। কিন্তু কমলাকান্ত ছাড়বে না। সাবালক হলেই সে মামলা করবে। সকলের ধারণাই তাই।
গিরীন্দ্র আচার্য বলেন —মামলা হবেই ন্যায়রত্নমশাই। তার আগে কর্ম পরিত্যাগ করতে হবে। না হলে ধর্ম থাকবে না। বীরেশ্বর মিটমাট করবে না। সহজে বিষয় দেবে না। বিষয় বিষ। শেষে এতে কুরুক্ষেত্র হবেই। দেখুন, রাজা নবকৃষ্ণ দেব, ক্লাইবের দেওয়ান, লক্ষ লক্ষ টাকা, বিষয় তো একটা রাজ্য বিশেষ। তাঁর উইল নিয়ে মামলা হল পোষ্যপুত্র গোপীমোহন আর ছেলের সঙ্গে। ছেলে জানে হারবে, তবু মামলা করলে। দুই পক্ষে ছ লাখ টাকা খরচ করে শেষে মিটমাট। মামলা চলে বিলেত পর্যন্ত। এও তেমনি হবে।
আচার্য দু-চারবার সাহস করে একথা বীরেশ্বরকে বলেছিলেন। বীরেশ্বর ক্রুদ্ধ হয়ে বলেছিলেন- ও কথা বলবেন না আমাকে। আমি বেঁচে থাকতে তা হবে না। হতে দেব না। আমার মৃত্যুর পর যা হয় হবে। মামলায় যদি হারি, তবে তৎক্ষণাৎ বীরেশ্বর রায় দেহত্যাগ করবে।
তাই আজ এমন অপ্রত্যাশিত উত্তর শুনে ব্রাহ্মণ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিলেন, তিনি এগিয়ে এসে রায়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন—মঙ্গল হোক তোমার, মঙ্গল হোক বাবা। এই তো, এই তো মানুষের মতো কথা, তোমার মতো কথা! আজ তোমার পিতা পরলোকে তুষ্টি পাবেন।
বীরেশ্বর রায় নীরবেই সামনের দিকে তাকিয়ে ছিলেন। সে দৃষ্টি কিছুটা উদাস, কিছুটা বেদনাভারাক্রান্ত, কিন্তু সে দৃষ্টি প্রসন্ন।
রামব্রহ্ম বলেছিলেন—আমার কন্যা লক্ষ্মী এসেছে, ওখানে যে সব কাণ্ড চলছে, তাতেই ওরা তাকে এখানে পাঠিয়ে দিয়েছে। সে বলছিল—কমলাকান্তের নাকি চেহারা হয়েছে কার্তিকের মত। বাপেদের বংশের মত মাথায় খাটো নয়। এই লম্বা-চওড়া প্রশস্ত বুক, নাক আর চোখ এ দুটি—নাকি অবিকল তোমার মত। আমি বললাম—তা হবে না, ‘নরাণাং মাতুলক্রম’ যে মা।
বীরেশ্বরের মুখে এবার একটি বিচিত্র হাসি ফুটে উঠেছিল। শুধু তাই নয়, তাঁর বড় বড় উগ্র চোখ দুটিও নাকি জলে ভরে উঠেছিল। ন্যায়রত্নের আর বিস্ময়ের সীমা ছিল না।
.
সেইদিনই সন্ধ্যায় ন্যায়রত্ন চিঠি লিখে বীরেশ্বরের হাতে দিয়ে এসেছিলেন। সোমেশ্বর রায় মৃত্যুর পূর্বে তাঁকে ডেকে অকপটে নিজের পাপের কথা বলে গিয়েছিলেন। বলেছিলেন—সেকালের মানুষের বিশ্বাসমত পারলৌকিক শান্তির ব্যবস্থা করতে। নিজে বিছানায় বসে শাস্ত্রবিধানমত চান্দ্রায়ণ প্রায়শ্চিত্ত করেছিলেন।
বীরেশ্বর রায় চিঠিখানা খুলে সাগ্রহে পড়ে কিছুক্ষণ চোখ বুজে ছিলেন। হয় বুঝতে চেষ্টা করেছিলেন, নয় বিশ্বাস করতে মর্মান্তিক দুঃখ পেয়েছিলেন।
মহেশচন্দ্রের লেখা চিঠিখানায় শ্যামাকান্তের বিবরণের ঘটনার সঙ্গে কোন অমিল নেই।
অমিল ছিল দুজনের দৃষ্টিভঙ্গিতে। দুজনেই আপন দোষ দেখতে পান নি। এখানে কিছুটা তফাৎ—শ্যামাকান্ত নিজের দোষ দেখেন নি। সোমেশ্বর কিছুটা দেখেছিলেন। ন্যায়রত্ন লিখেছেন চিঠিতে—তিনি দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলিয়া বলিয়াছিলেন—আপনি জানেন, স্বচক্ষে দেখিয়াছেন, এই তান্ত্রিকের কী অত্যাচার আমি সহ্য করিয়াছি! আপনিই আমাকে এসব অনাচার বীরাচারের সম্পর্কে সতর্ক করিয়াছিলেন, আমি তাহাও শুনি নাই। বংশের জন্য আমি সব সহ্য করিয়াছিলাম। তবে পাপ আমার লোভ! আমার সন্তান বাঁচিল, অবশ্য কলিকাতায় সাহেব ডাক্তার চিকিৎসা করিবার সময় বলিয়াছিলেন—এবার রক্তদোষের চিকিৎসা হইল, এবার সন্তান রক্ষা পাইবে। কিন্তু তাহা আমি বিশ্বাস করি না। সন্তান ওই তান্ত্রিকই বাঁচাইয়াছেন। কারণ ওই সময়ে কোম্পানীর বিরুদ্ধে যে দশ হাজার ডিক্রী পাইলাম, তাহা তো পাইবার কথাই নয়। দুইটা একসঙ্গেই ঘটিল। আগে ডিক্রী পরে সন্তান। তান্ত্রিক হাসিয়া বলিলেন—এখন হইয়াছে কি, তোমাকে রাজা করিয়া দিব।
এতেই লোভ হয়েছিল সোমেশ্বর রায়ের। তাঁর বিচারের দৃষ্টিতে তিনি তান্ত্রিকের শক্তির দুটি মূলধন দেখতে পেয়েছিলেন। এক ওই সৌভাগ্যশিলা রাজরাজেশ্বর, আর তাঁর তান্ত্রিক সাধনা তপস্যার শক্তি, ওই মনোহরা যোগিনী!
তাঁর মনে মনে অভিপ্রায় ছিল-মনোহরাকে পেলে তিনিও এই সাধনা করতে পারবেন। এবং সিদ্ধিও পাবেন।
ইতিমধ্যে মনোহরাকে তিনি আকৃষ্ট করবারও চেষ্টা করেছিলেন। মনোহরা —যোগিনী, না দেবী, যাই হোক সে বাইরে ছিল একটা মাথাখারাপ দরিদ্র কন্যার মত। সামান্য রঙচঙে জিনিস পেলে সে খুশী হত। ভালো খেতে পেলে খুশী হত। আর তার স্নেহ পড়েছিল বিমলার উপর। ছেলে কোলে নিয়ে সে বসে থাকত পরমানন্দে। এই সুযোগ নিয়েছিলেন সোমেশ্বর। ক্রমে তাঁর বিশ্বাসও হয়েছিল যে, মনোহরার মন তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে। তিনি তাকে বলেছিলেন—ওই সাধুটাকে ছেড়ে দে না। আমার কাছে থাক। আমি কত জিনিস দেব; কত ভাল খেতে দেব! রানীর মত রাখব! কি?
পাগলী বলেছিল—আমাকে মারবে না ওর মত?
—না, না, না। মারব কেন?
—ও আমাকে মারে। বড় মারে।
—তাই তো বলছি, ওকে ছেড়ে দে।
—ও যে আমাকে খুন করে দেবে। ও খুনে। বাবারে!
—ওকে তাড়িয়ে দেব এখান থেকে।
—ও মন্তর জানে, মেরে ফেলবে আমাকে। তোমাকেও ফেলবে। ও তোমাকে ভয় করে না।
হঠাৎ সোমেশ্বরের গলা জড়িয়ে ধরে বলেছিল—তুমি ওকে খুন করে দিতে পার না। দাও না গো! তোমার কাছে আমি খুব ভাল হয়ে থাকব। তোমার মেয়েকে মানুষ করব। দাও না গো!
এই বীজ! বীজ অঙ্কুর মেলল। পাতা বের হল। ক্রমে ক্রমে সোমেশ্বর মনে মনে সাপের মত চক্রান্তের পাকে পাকে বিষধরের মত হিংস্র হয়ে উঠলেন। সেদিন রাত্রে ওই বন্যায় নৌকো ভাসিয়ে ওপারে যাবার পথে তাঁর মনে সঙ্কল্প জাগল। এই সুযোগ। বন্যার এই দুর্দান্ত তুফানে ফেলে দেবেন। রক্তপাত করতে হবে না, আঘাত করতে হবে না, শুধু জলে ফেলে দেওয়া। মারবে ওকে কাঁসাই। প্রত্যক্ষ অপরাধ হবে না।
তাই দিলেন। কিন্তু–।
সুরেশ্বর বললে—কথাটা বিচিত্র সুলতা, সোমেশ্বর রায় এই পাগল মনোহরাকে নিয়ে সাধন করতে সাহস করেন নি, তাকে আহারে-বিহারে নানা সামগ্রীতে সন্তুষ্ট করে নিজের বিলাস-সঙ্গিনীতে পরিণত করে তাকে আটকে রেখেছিলেন। ধারণা ছিল যোগিনী তুষ্ট হয়েই তাঁকে ধরা দিয়েছে। তার দয়াতে সব হবে।
তা হয়েছিল। সোমেশ্বর রায় তখন মহলের পর মহল কিনেছিলেন। রবিনসন সাহেবকে টাকা ধার দিয়ে তার কুঠীর লাভ থেকে লাভ পেয়েছিলেন। কলকাতায় একজন সাহেব অ্যাটর্নীকে টাকা ধার দিয়ে তার টণ্ডী হয়েছিলেন। কিন্তু কোন বিভূতি তিনি পান নি।
মেয়েটা বেঁচে ছিল বছর তিনেক। তিন বছর সোমেশ্বর উন্মত্ত ছিলেন তাকে নিয়ে। বীরেশ্বরের জন্মের পর সে মারা যায়। অনেক দেওয়ার সঙ্গে সে তাঁকে আরো একটি সামগ্রী দিয়ে গিয়েছিল, সে হল সোমেশ্বরের ব্রাত্যনারীর উপর একটা দুর্দমনীয় আকর্ষণ! এদিকে তাঁর রুচি আগে ছিল না। আগে বাঈজী রেখেছেন, বাড়িতে সেবাদাসী রেখেছেন কিন্তু ব্রাত্যনারীতে রুচি ছিল না। এবার এল এই রুচি। রাজকুমারী কাত্যায়নী এক কন্যা, এক পুত্রের পর স্বামীকে দিয়েছিলেন অবাধ স্বাধীনতা। যা ইচ্ছা করুন, তিনি তাঁর পুত্র-কন্যা এবং গৃহের গৃহিণীত্ব নিয়েই পরিতুষ্ট।
রামব্রহ্ম লিখেছিলেন—শুধু ব্যভিচারের জন্য যোগিনীকে লইয়া থাকার জন্য তিনি ভ্রষ্ট হইলেন, পাপগ্রস্ত হইলেন। তিনি স্বমুখে এই কথা আমাকে বলিলেন, এই পাপেই আমি ডুবিলাম। এই পাপ হইতে উৎপন্ন ব্যাধি হইতেই আমি মৃত্যুমুখে পতিত হইতে চলিয়াছি। অনন্ত নরকেও আমার বোধ হয় স্থান হইবে না। আপনি যথোচিত যাগ-যজ্ঞাদি করিয়া ইহার প্রতিকার করিবেন। তান্ত্রিকের নিকট ঋণ আমি শোধ করিয়াছি। বিমলাকান্তকে অর্ধেক সম্পত্তির অধিকারী করিয়াছি। কিন্তু মনোহরা যোগিনীকে লইয়া যে পাপ করিয়াছি ইহার প্রায়শ্চিত্ত কিসে হইবে জানি না!
সুরেশ্বর বললে-বীরেশ্বর রায় চিঠিখানা পড়ে কি ভেবেছিলেন, মনে তাঁর কোন প্রতিক্রিয়া হয়েছিল কিনা জানি না। তাঁর নিজের জীবনে সোফিয়া পর্বের মধ্যে এর কোন প্রভাব পেয়েছিলেন কিনা জানি না। তবে আমি যেন দেখেছিলাম। বিমলার থেকে বীরেশ্বর তিন বছরের ছোট; এই তিন বছরের মধ্যেই সোফিয়া এসেছিল তাঁর জীবনে। তবে সব ক’খানি চিঠি পড়ে তাঁর মনে পড়েছিল পাগলাবাবাকে, তার নিদর্শন আছে। এবং এই চিঠিগুলির প্রতিটি অক্ষর তাঁর সত্য মনে হয়েছিল। তিনি আকুল হয়ে পত্র লিখেছিলেন কমলাকান্তকে। কমলাকান্ত তাঁর কাছে রত্নেশ্বর; তিনি তাঁকে রত্নেশ্বর বলেই পত্র লিখেছিলেন। সে পত্রও আছে, এই দেখ। পড়ি শোন।
প্রাণাধিকেষু,
অসংখ্য কোটি আশীর্বাদ এবং স্নেহচুম্বনপূর্বক শ্রীমান রত্নেশ্বর বাবাজীবন অত্র পত্রে তোমাকে লিখি যে, ছেদী সিং এবং অত্র রায়রাজবাটীর পুরোহিত পূজ্যপাদ ন্যায়রত্নমহাশয় প্রমুখাৎ অবগত হইলাম যে, তুমি সম্প্ৰতি শ্ৰীশ্ৰীকাশীধাম হইতে দীর্ঘকাল পর কার্যব্যপদেশে শ্যামনগর বাটী আগমন করিয়া তত্র অবস্থান করিতেছ। নীলকর জন রবিনসন সম্প্রতি শ্যামনগর ঠাকুরপাড়ায় কুঠী পত্তন করিয়া তত্রস্থ জমিদার সরকারবাবুদিগের সহিত সহযোগ করতঃ ওখানকার ব্রাহ্মণ, কায়স্থ ও অপরাপর প্রজাদিগের উপর অযথা উৎপীড়ন করিতেছে, বলপূর্বক প্রজা সকলের ধান্য জমির ধান্যাদি ফসলসমুহ ভাঙিয়া দিয়া নীল বপন করাইতেছে। এমন কি রায়বাটীর জামাতা দৌহিত্রের জমিতেও জবরদস্তিপূর্বক নীল বপন করিয়া তোমাদিগের ভাগদার জোতদের নির্যাতন, অপমান করিয়াছে, তৎসংবাদসমূহ অবগত হইয়া প্রতিকারার্থ তুমি কাশীধাম হইতে আসিয়াছ। উত্তম করিয়াছ। এতাদৃশ উৎপীড়ন, জবরদস্তি, শুধুমাত্র অর্থক্ষতিকারকই নয়, ইহা মর্যাদাহানিকর ও অপমানজনক। অবশ্যই ইহার প্রতিবিধান প্রযোজন। কিন্তু বাবাজীবন, অত্র বাটী-যাহা তোমার বাটী-তথায় না আসিয়া শ্যামনগরে আসিয়া ওঠা তোমার কি উচিত হইয়াছে? এবং নিরাপদ হইয়াছে? ইহাতে আমি মর্মান্তিক দুঃখ অনুভব করিলাম, মর্মস্থলে আঘাত পাইলাম। দীর্ঘকাল তোমাকে নিরীক্ষণ করি নাই। তজ্জন্য বক্ষে তাপ অনুভব করি। আমার তো তুমি ব্যতীত কেহ নাই। যক্ষের মত সমস্ত আগলাইয়া বসিয়া আছি মাত্র। ছেদীর নিকট অবগত হইলাম এবং শ্রীযুক্ত ন্যায়রত্নকে তদীয় কন্যা বলিয়াছেন শুনিলাম যে, তুমি কুমার কার্তিকের মত সুন্দর হইয়াছ; রায়বংশের অনুরূপ বীরোচিত আকৃতি হইয়াছে এবং তোমার চোখ এবং নাসিকা অনেকটা আমার মত হইয়াছে। শুনিয়া অবধি চিত্ত, হৃদয় তোমাকে দেখিবার জন্য, তোমাকে বক্ষে লইবার জন্য বড়ই ব্যাকুল হইয়াছে।
আমি বজরা পাঠাইলাম, তুমি পত্রপাঠ এই বজরায় স্বীয় বাটীতে চলিয়া আসিবে। আমি ব্যাকুল হইয়া প্রতীক্ষা করিতেছি, বাড়ীঘর চুনকাম করিয়া পরিষ্কার করাইবার ব্যবস্থা করিলাম। আসিবার পূর্বে দ্রুতগামী নৌকায় কাহাকেও অগ্রে পাঠাইবে। এখানে স্ত্রী মাতার স্থানে এবং রাজরাজেশ্বরের স্থানে বিশেষ পূজা দেওয়া হইবে। নহবৎ বাদ্যের ব্যবস্থা করিব।
সর্বশেষে যাহা লিখিতেছি তাহা অতীব গুরুত্বপূর্ণ। ছেদী বলিল-তোমার সঙ্গেই তোমার ভালো-মা কল্যাণীয়া শ্রীমতী ভবানী দেবী তদীয় পিতৃদেবসহ কাশীধাম হইতে আগমন করিয়াছেন এবং শ্যামনগরে তোমাকে নামাইয়া তিনি অন্যত্র কোথাও গমন করিয়াছেন। ছেদী তাঁহার কোন ঠিকানা, নিশানা অবগত নহে। অবগত হইলে আমি নিজেই গমন করিতাম। তুমি তাঁহাকে মদীয় এই নির্দেশ জানাইবে যে তিনি যেন অত্র বাটী আগমনের জন্য প্রস্তুত হইয়া আমার অপেক্ষা করিয়া থাকেন। তুমি আসিলে তোমাকে সঙ্গে লইয়া তাঁহার নিকট গমন করিব এবং অত্র বাটীতে তাঁহাকে লইয়া আসিব। তাঁহাকে বলিবে, তিনি আগমন করিলেই তাঁহাকে সঙ্গে লইয়া আমি কলিকাতায় যাইব। তথায় আমি এক পাগলাবাবাকে জানি-সম্ভবত তাঁহাকে দেখিলে তাঁহার এতদিনের ব্রত উদযাপিত হইবেক। তুমি পত্রপাঠ এই বজরাতে বাটী চলিয়া আসিবে।
ইতি
আশীর্বাদক
শ্রীবীরেশ্বর রায় দেবশর্মণঃ
***
বীরেশ্বর রায় বাড়ী সংস্কারের ব্যবস্থা করেছিলেন। জমিদারী সেরেস্তার খাতায় খরচ লেখা আছে, ইমারত খাতে খরচ; শ্রীযুক্ত রত্নেশ্বর ওরফে কমলাকান্ত রায় ভট্টাচার্য আসিবেন বিধায় সমুদয় ইমারৎ সংস্কার চুনকাম ইত্যাদি করা হয়, তাহার জন্য ঝিনুকের চুন পোড়াই খরচ একদফা চার টাকা পাঁচ আনা পাঁচ গণ্ডা।
চাপরাসী, দারোয়ান, পাইকদের পাগড়ির জন্য লাল শালু খরিদ। এমনি অনেক খরচ সে সময় রায় এস্টেটে হয়েছিল। যাতে যে কেউ হোক বলবে, বীরেশ্বর রায় সেদিন মনের সকল সংশয় উত্তীর্ণ হয়ে অত্যন্ত উদ্গ্রীব হয়ে তাঁর সন্তানের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। হয়তো বা তিনি মনে মনে অভিযোগ করছিলেন ভবানী এবং বিমলাকান্তের উপর। কেন তারা তাঁকে বলে নি এতদিন? তারা তো এসব পরিচয় অনেক দিন আগে জেনেছে! সে সময় জানালে তো সব কিছুর মীমাংসা হয়ে যেত। যেদিন কলকাতায় —মহেশচন্দ্র ভবানীকে কলকাতায় বিমলাকান্তের কাছে নিয়ে সব কথা প্রকাশ করেছিলেন-সেই দিন!
রত্নেশ্বর তাঁর সন্তান, প্রথম সন্তান।
দিদি বিমলার জন্য সেদিন এ-সত্য গোপন করেছিলেন তাঁরা। তাঁরা তিনজনে। তিনি, বিমলাকান্ত এবং ভবানী। আর জানত বিমলা, সে নিজে চোর! সে গত। আর জানতেন তাঁর বাবা। সোমেশ্বর রায়। তিনিই এ সংবাদ গোপন করে রাখতে অনুরোধ করেছিলেন। বলেছিলেন—বিমলা গত হোক, ও বেশিদিন বাঁচবে না। তারপর তুমি পোষ্যপুত্র নিয়ে ফিরে নিও।
বিমলাকান্তও প্রতিশ্রুত হয়েছিলেন।
তাঁর এইসব চিন্তার কথার আভাস আছে তাঁর চিঠিতে। কাশীতে বিমলাকান্তকে তিনি চিঠি লিখেছিলেন। রত্নেশ্বর রায় সমস্ত চিঠি সযত্নে সংগ্রহ করে রেখেছিলেন। কাশীতে বিমলাকান্তকে এই অনুযোগ করেই চিঠি লিখেছিলেন বীরেশ্বর রায়। এবং তাঁকে লিখেছিলেন—“আপনি আমার কাছে পুত্রঋণে আবদ্ধ। তাহা পরিশোধ করিতে আপনি আসিবেন। অবিলম্বে আসিবেন। তাহাতে সরকারী কর্ম না থাকে, কর্ম পরিত্যাগ করুন। আপনি আবার বিবাহ করিয়াছেন, তিনি আমার কনিষ্ঠা সহোদরা। তাঁহাকে লইয়া আসুন, পিতাঠাকুর তাঁহার ঋণ পরিশোধার্থে অর্ধেক সম্পত্তি নামে রত্নেশ্বরকে দিলেও তাহা আপনার, আপনাকেই তাহা দিয়া গিয়াছেন। তাহা অবশ্যই আপনাকে গ্রহণ করিতে হইবে। আমার হৃদয় অধৈর্য পীড়িত হইয়া নিয়ত অশান্ত অধীর। আপনি অবিলম্বে আসুন। এবং আপনার পক্ষে আরো গুরুতর প্রয়োজন এই যে, সম্ভবত আমি মহাসাধক ভবদীয় পিতৃদেব ও মদীয় শ্বশুরমহাশয়কে জানি। তিনি অদ্যাপি জীবিত। পত্রপাঠ চলিয়া আসুন।” চিঠিখানা রেখে সুরেশ্বর বললে —বীরেশ্বর রায় কলকাতায় লোক পাঠিয়েছিলেন, জরুরি পত্র লিখেছিলেন সেখানকার নায়েব দেওয়ানকে।
“আপনি পত্রপাঠ ‘বহুবাজার’ গিয়া সোফিয়া বাঈজীর সন্ধান করুন। তাহার ওখানে পুজনীয় পাগলাবাবা আছেন কিনা সন্ধান লউন। যদি থাকেন, তবে তাঁহাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করিয়া জানবাজার বাটীতে আনিয়া পরম যত্নে রাখিয়া সেবা করিবেন। যদি না আসেন, তবে সদাসর্বদা বহুবাজারের বাটীর উপর নজর রাখিবার ব্যবস্থা করিবেন। যেন কোথাও চলিয়া না যান।
“যদি সোফিয়ারা ঐ বাটীতে না থাকে, তবে তাহারা এখন কোথায় বাস করিতেছে, পাগলাবাবাই বা কোথায় বাস করিতেছেন, বিচক্ষণ লোক নিযুক্ত করিয়া তাহার সন্ধান করুন। দেশান্তরে লোক প্রেরণ করিতে হইলে তাহাও করিবেন। অত্র কর্মে অর্থব্যয়ের জন্য চিন্তা করিবেন না। যত টাকা খরচ হয় করিবেন। সহস্র, পাঁচ সহস্র কোনমতে মালিকের মতের জন্য চিন্তিত হইবেন না!”
বীরেশ্বর রায়ের আকুতি, উল্লাস সম্ভবত বর্ষার কাঁসাইয়ের বন্যার মত উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছিল। পরিচয় তার সব কিছুতে রয়েছে। জমা-খরচের খাতায় একটা খরচ রয়েছে। তার মধ্যেও রয়েছে পরিচয়। বিবিমহলের জন্য আসবাব খরিদ। প্রত্যাশা তিনি অনেক করেছিলেন, এ আমি নিঃসন্দেহে বলতে পারি। কিন্তু কমলাকান্ত আসেন নি। ফাইলে চিঠি রয়েছে কমলাকান্তের। বজরা ফিরে এসেছিল। বজরা থেকে নেমে এসেছিল খানসামা কর্মচারী কৃষ্ণ সরকার, রাঁধুনী বামুন, আর চারজন চাপরাসী। এসে নীরবেই বোধ করি চিঠিখানা বীরেশ্বর রায়ের হাতে দিয়েছিল। এই সেই চিঠিখানা সুলতা।
বজ্রের মত চিঠি!
অশেষ সম্মানাস্পদেষু, মাননীয় মহাশয়,
ভবদীয় পত্রপ্রাপ্ত হইয়া কিঞ্চিৎ বিভ্রম ও বিভ্রান্তিতে পড়িলাম। আপনি প্রাণাধিক ইত্যাদি বহু সুমিষ্ট সম্বোধনে আপ্যায়িত করিয়া আমাকে অবিলম্বে কীর্তিহাট যাত্রা করিতে আদেশ করিয়াছেন। আমি বহু চিন্তা করিয়া এবম্বিধ আচরণের হেতু খুঁজিয়া পাইলাম না। ভাবিতেছি, এই কলিকালে কি দ্বাপরযুগের ধনুর্যজ্ঞ পর্বের ভূমিকা হইতেছে? মহাশয়ের সহিত প্রবল প্রতাপ মহারাজ কংসের তুলনা হইলেও হইতে পারে। কিন্তু আমি গরীব ব্রাহ্মণসন্তান। আমি নিজেকে শ্রীকৃষ্ণ মনে করিতে পারি না।
মহাশয়, কোন্ মুখে কি করিয়া এমত সুন্দর বাক্যগুলি লিখিয়াছেন তাহা অনুধাবন করিতে পারিলাম না। আপনি আমার মাতুল, ইহা আমার ভাগ্যের দোষ। আমি রায়বংশের দৌহিত্র, আমার রক্তে আপনাদের রায়বংশের রক্তের সংস্রব আছে ইহাতে আমি জ্বালা অনুভব করি। রায়বংশ ধনীর বংশ, কিন্তু তাহাদের পাপের সীমা নাই। এসব কথা আমি জানিতাম না। বীরপুরের ছত্রী গোপাল সিংহ প্রাচীন লোক, সে এখানে আসিয়া আপনার পিতা-পিতামহের কুৎসা করিয়া গেল। এবং স্বয়ং আপনি তাহার প্রমাণ। আপনি অত্যাচারী, আপনি মদ্যপ, আপনি লম্পট; মুসলমান বাঈজী রাখিয়া তাহাকে লইয়া কলিকাতার বসতবাটীতে উল্লাস করেন; আপনি নিজের সতীসাধ্বী দেবীতুল্যা পত্নীকে বিতাড়িত করিয়াছেন। মহাশয়, আমি ব্রাহ্মণসন্তান, সামান্য ব্যক্তি। তবে আমার পিতা দেবচরিত্র ব্যক্তি। পিতামহ শুনিয়াছি মহাসাধক ছিলেন। আপনার সহিত আমাদের সকল প্রকার সম্পর্ক অনেক দিন পূর্বেই ছিন্ন হইয়াছে। আমার পিতাকে আপনি একরূপ বিতাড়িত করিয়াছেন। আমাকেও করিয়াছেন। আপনার সহিত কোন সম্পর্কই আমার নাই। উক্ত কীর্তিহাটের পুরী আপনার নানাবিধ পাপপুরীতে পরিণত হইয়াছে। ওই পুরীতে আপন স্বত্বের বলে যেদিন প্রবেশ করিতে পারিব সেইদিন যাগযজ্ঞ দ্বারা সমস্ত শুদ্ধ পবিত্র করিয়া প্রবেশ করিব। তৎপূর্বে নহে। আপনার বজরা ফিরাইয়া দিলাম।
আপনি আমার ভালো-মা কোথায় আছেন জানিতে চাহিয়াছেন। তাহা আপনি পাইবেন না। তিনি আজ জীবনে তপস্যা সার করিয়াছেন। সমগ্র কাশীর লোকে তাঁহাকে সতী-মা বলিয়া ডাকে। তাঁহার মুখের দিকে কেহ চোখ তুলিয়া তাকায় না। আপনার মত পাপীর স্পর্শমাত্রে তাঁহার প্রাণবায়ু বহির্গত হইয়া যাইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। আপনি দয়া করিয়া তাঁহার কোন খোঁজ করিবেন না।
নীলকর জন রবিনসন সাহেবের সঙ্গে যাহা করিবার তাহা আমিই করিব। তবে যাহাতে রায়বংশের ভাগিনেয়ের মর্যাদাহানি হয় এমন কিছু করিব না, তাহাতে নিশ্চিত থাকিবেন। আমি মূর্খ নহি। সুতরাং অতঃপর এ লইয়া ভবদীয় শিরঃপীড়ার কারণ না ঘটিলে কৃতার্থ হইব। পরিশেষে নিবেদন ইতি।
নিবেদক
শ্রীকমলাকান্ত দেবশর্মা (আমার নাম রত্নেশ্বর নহে)।
সুরেশ্বর বললে—
চিঠিখানার মধ্যে ছিল বজ্রের আঘাত।
নির্মম আঘাত তিনি পেয়েছিলেন এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু কি করেছিলেন তা বলতে পারব না। তবে ঘটনার স্রোত তখন দ্রুত বইতে শুরু করেছে।
ঠিক চারদিন পরের লেখা একখানা চিঠি দপ্তরের মধ্যে রয়েছে। বীরেশ্বর লেখেন নি। বীরেশ্বর রায়কে লিখেছেন তাঁর দেওয়ান ম্যানেজার গিরীন্দ্র আচার্য। তিনি দিন পনের আগে মহল সফরে বেরিয়েছেন। ওই নতুন পত্তনী নেওয়া মহলদিগরে। সেসব মহলে অনেক কাজ। লাট কুতুবপুরের জমিদারী কাছারীকে নিজের কেন্দ্র করে ঘুরে বেড়াচ্ছেন মহলে মহলে।
সে আমলে জমিদারদেরও নিজেদের আকার-আয়তন মত চতুরঙ্গবাহিনী ছিল। ষোল কাহারের পাল্কি, বর্ক-আন্দাজ—যারা দস্তুরমত বড় পাগড়ি-কুর্তা এবং নাগ্রা জুতো পরে কোমরে তলোয়ার ঝুলিয়ে চলত; এরা অধিকাংশই ছিল হিন্দুস্থানী ডন-বৈঠক করা, ঘিউ-রুটি খাওয়া শরীর। নিত্যনিয়মিত কুস্তি করত এরা। তার সঙ্গে এদেশী লাঠিয়াল পাইক। কালো রঙ, পাকা বাঁশের মত শরীর, আঁটসাঁট করে হাঁটু পর্যন্ত খাটো কাপড়, গায়ে জমিদারবাড়ীর দেওয়া ইউনিফর্ম ফতুয়া, মাথায় লাল শালুর পাগড়ি, কাঁধে একখানা গামছা। হাতে চার হাত লম্বা এদেশী লাঠি। আর থাকত দুজন ঘোড়সওয়ার হরকরা; এরাও বর্ক-আন্দাজের শামিল, তবে এদের বিশেষ কাজ ছিল চিঠি নিয়ে যাওয়া-আসা। জরুরি চিঠি নিয়ে জমিদারী কাছারীতে আসা এবং তার উত্তর নিয়ে যাওয়া। এছাড়া গরুর গাড়ীতে আমীন এবং জরীপের সরঞ্জাম, তার সঙ্গে হিসাব-নিকাশনবিশ মুহুরী দুজন-তিনজন। আরো যেত রসুইয়ের বামুন, চাকর। সরঞ্জামেরও সমারোহ ছিল; রান্নার বাসন, বড় কড়াই, হাতা, বড় হাণ্ডা, শতরঞ্জি, তাকিয়া, চাদর, রূপা-বাঁধানো হুঁকো, তার সঙ্গে ডাবা হুঁকো। ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, সগোপ, মাহিষ্য প্রভৃতি বিভিন্ন জাতের জন্য আলাদা ব্যবস্থা। কল্কে তামাক ঝুড়িভর্তি। আর সঙ্গে চলে গজেন্দ্রগমনের সঙ্গে তালে তালে ঘণ্টা বাজিয়ে রাজহস্তীর মত জমিদার-হস্তী। কাছারী পৌঁছে দেওয়ান সরেজমিনে তদারকের প্রয়োজন হলে হাতীর পিঠে থাকেন। এই হাতী ঘোড়া গরুরগাড়ীর রথ এবং পদাতিক দিয়ে চতুরঙ্গবাহিনী।
উদ্দেশ্য ছিল, সমারোহ দেখিয়ে প্রথম দৃষ্টিতেই ত্রাস এবং সম্ভ্রম সঞ্চার করা।
নূতন মহলদিগরে প্রজাদের বাকী খাজনা আদায়, খাজনা বৃদ্ধি, পতিত জরীপ এবং পতিত জমি ভেঙে জমি তৈরীর ব্যবস্থা। তার সঙ্গে আছে মাঠের মধ্যে খাস পতিত সামিল সিচের পুকুর পঙ্কোদ্ধারের ব্যবস্থা; জমিদার কিছু টাকা দেবেন, বাকীটা বেগার ধরে কাটানো। নদীর ধারের মহলে নদীর বন্যা রোধের জন্য বাঁধ তৈরী। দেবস্থান মেরামত, দরকারমত দু-চার বিঘা জমি গ্রাম্য-দেবতার সেবার জন্য দান ইত্যাদি মহৎ কর্মও ছিল এর সঙ্গে। গ্রাম্য কলহ-বিবাদের বিচার করা হত।
চতুরঙ্গবাহিনী কাছারীতে এলে গ্রাম কলরবে মুখর হয়ে উঠত। নিত্য দেড় মণ দু মণ চাল রান্না হত। গ্রামের দরিদ্রজনেরা আসত, পাত পেতে বসে খেত, কুমড়োর ছক্কা, বেগুনের অম্বলসহযোগে ডাল-ভাত খেয়ে হরিবোল দিয়ে উঠে যেত। এ-হরিবোল জমিদারের জয়ধ্বনি। তাছাড়া গ্রামের সদ্গৃহস্থ মণ্ডলদের নিমন্ত্রণ করে খাওয়ানো হত। স্বয়ং দেওয়ান দাঁড়িয়ে থেকে খাওয়াতেন।
এবারের আয়োজনে ঘটা ছিল অনেক বেশী। এবার মণ্ডলান তৌজী বীরপুরের কাছাকাছি গ্রামের কাছারীতে দেওয়ানের কাছারী পড়েছে।
বীরপুর মণ্ডল প্রজা গোপাল সিং ছত্রীর এলাকা। সে-গ্রামে আজও খাজনা আদায়ের দপ্তর পড়ে নি। কথাবার্তাও না। যা হচ্ছে আদালত মারফত। এবার কাছাকাছি কাছারীতে স্বয়ং দেওয়ান এসে বসে কুরুক্ষেত্রের উদ্যোগপর্ব রচনা করছেন।
স্বয়ং বীরেশ্বর রায়ের আসবার কথা ছিল, কিন্তু সেদিন ছেদী সিং আসার পর সে-মত পরিবর্তন করে তিনি দেওয়ান আচার্যকেই পাঠিয়েছেন। তিনি কমলাকান্তকে পত্র লিখে বজরা পাঠিয়ে রায়বাড়ীর রঙ ফিরিয়ে মেরামত করে তার জন্যেই অপেক্ষা করছিলেন। এমন সময় এল ওই পত্রোত্তর।
ঠিক তার চার দিন পর এল দেওয়ান আচার্যের এক পত্র। পত্র নিয়ে এসেছে ঘোড়সওয়ার- হরকরা। সে-পত্র কমলাকান্তের ওই পত্রের পর যেন বজ্রাঘাতের বিদ্যুৎ এবং গর্জনের পর তার আগুন-জ্বলে-ওঠার চেহারা নিয়ে দেখা দিল।
দেওয়ান আচার্য লিখেছেন—হঠাৎ একটা জরুরি সংবাদ পেয়ে না জানিয়ে তিনি থাকতে পারলেন না। তাই সওয়ার হরকরা মারফত পাঠাচ্ছেন। আজই সন্ধ্যার সময়ে তিনি সংবাদ পেয়েছেন—বীরপুরের গোপাল সিং ছত্রী শ্যামনগর গিয়েছিল কমলাকান্তের কাছে। কমলাকান্ত শ্যামনগরে এসেছেন এ-সংবাদটা এ-অঞ্চলে রটে গেছে। সেখানে নীলকুঠীর সাহেবের সঙ্গে মামলা লড়বেন বলে গুজব খুব জোর হয়ে উঠেছে। গোপাল সিং ছত্রী খবর পেয়ে সেখানে গিয়েছিল, আজ ফিরে এসে নাকি গ্রামে প্রচার করেছে যে, কমলাকান্ত তাঁর তরফ থেকে তার মণ্ডলান স্বীকার করে নেবেন। শুধু তাই নয়, তিনি নাকি নালিশ দায়ের করছেন মেদিনীপুর আদালতে মামা বীরেশ্বর রায়ের বিরুদ্ধে। এবং প্রত্যেক মহলে ঢোলসহরত করে প্রজাদের জানিয়ে দেবেন যে, যারা বীরেশ্বর রায়কে ষোল আনা খাজনা দেবে, তারা নিজের দায়িত্বে দেবে। কমলাকান্ত সমুদয় সম্পত্তির আট আনা অংশের মালিক, তিনি তাঁর অংশের খাজনা নিজে আদায় নেবেন। বীরপুরের গোপাল সিং কাল বীরপুরে গ্রাম-দেবতার কাছে বলি দিয়ে পুজো দিয়েছে, সেই উপলক্ষ্যে দশখানা ঢাক নিয়ে সারা গ্রাম তোলপাড় করে বলেছে-এবার বীরেশ্বর রায়কে দেখ লেঙ্গে। নাকে ঝামা ঘষব। গোটা সম্পত্তি যাতে কোর্ট অব ওয়ার্ডসে যায় তার চেষ্টা করছে কমলাকান্ত।
দেওয়ান আচার্য দেখে গিয়েছিলেন —বীরেশ্বর শ্যামনগর থেকে কমলাকান্তকে সদরে আহ্বান জানিয়ে কীর্তিহাটে আনবার জন্য বজরা পাঠাচ্ছেন। পত্রের খসড়া তিনি দেখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বীরেশ্বর রায় খসড়া পড়তে দেননি, পড়ে শুনিয়েছিলেন।
সুরেশ্বর বললে—সম্ভবত ভবানী দেবীর কথা এবং পাগলাবাবার কথা তাঁকে জানতে দিতে চাননি। যেটুকু তিনি কমলাকান্তকে লিখেছিলেন, সেইটুকুই পড়ে শুনিয়েছিলেন। তারপর এই খবরে দেওয়ান আচার্য অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত হয়েছেন, তিনি লিখেছেন-তার খানিকটা তোমাকে পড়ে শোনাই সুলতা, বোধ হয় মুখে বলার চেয়ে ভাল হবে।—
বীরপুরের গোপাল সিং শ্যামনগর গিয়া কমলাকান্তের সহিত সাক্ষাৎকার করিয়াছে। এবং তাঁহার কাছ হইতে আশ্বাস লইয়া ফিরিয়াছে। গোপাল সিং নাকি কয়েকদিনের মধ্যেই শ্রীযুক্ত কমলাকান্তবাবু মহোদয়ের তরফ হইতে ঢোল শহরত করিয়া পরোয়ানা জারী করিতেছেন যে, প্রজাদিগের মধ্যে যাহারা শ্রীযুক্ত বীরেশ্বর রায়কে খাজনা প্রদান করিবে, তাহারা নিজের দায়িত্বে প্রদান করিবে। তাঁহার তরফ হইতে তাহা ওয়াশীল দিতে তিনি বাধ্য থাকিবেন না। এবং বৃদ্ধি সম্পর্কে তিনি শ্রীযুক্ত বীরেশ্বর রায়ের সহিত বন্দোবস্তমত কোন বৃদ্ধিই মঞ্জুর করিবেন না।
মিশ্র বলিলেন—তিনি লাট কুতুবপুরের সকল গ্রামেই সকল প্রজার কাছেই একপ্রকার কথাবার্তা শ্রবণ করিয়াছেন। সম্ভবত কোর্ট-অব-ওয়ার্ডসে দিবার চেষ্টা করিবেন।
সুতরাং অবিলম্বে মেদিনীপুরের আদালতে খোঁজ লওয়া আবশ্যক এইরূপ কোন মামলা দায়ের হইয়াছে কিনা। এবং শ্রীযুক্ত কমলাকান্ত ভায়াজীবনের সঙ্গে একটা রফা প্রয়োজন। বিবাদের ক্ষেত্রে গোপাল সিংহের সহিত তাঁহার যোগাযোগ অতীব ক্ষতিকর হইবেক। আরো শুনিলাম—শ্রীযুক্ত কমলাকান্তবাবু কীর্তিহাট মোকামে আসিতেছেন না। শ্যামনগর এখান হইতে সন্নিকট। মাত্র ক্রোশ-পনের দূর। শুনিতেছি সেখানে শ্রীকমলাকান্ত ধর্মঘট করিয়া সরকারবাবু ও রবিনসন সাহেবের সহিত ঘোরতর বিবাদের সৃষ্টি করিতেছেন।
অদ্য ভোর-ভোর সওয়ার যাত্রা করিতেছে। দ্বিপ্রহর বা তৃতীয়প্রহর নাগাদ পৌঁছিবে। আমাকে অবিলম্বে আপনার আদেশ জানাইবেন, আমি অতঃপর কি করিব।
শ্রীশ্রী স্ত্রীমাতার চরণাম্বুজে এবং শ্রীশ্রী রাজরাজেশ্বরের নিকট মালিকের সর্ববিধ কল্যাণ কামনান্তে ইতি—
নিবেদক ভবদীয় আশ্রিত
শ্রীগিরীন্দ্রচন্দ্র আচার্য
শেষে তোমাকে সম্বোধনটা শোনাই, নাহলে অসম্পূর্ণ থাকবে জমিদারের পরিচয়। মহামহিম মহিমার্ণব, প্রবলপ্রতাপ, বহুজন প্রতিপালক, অশেষ গুণান্বিত, শ্রীল শ্রীযুক্ত বাবু বীরেশ্বর রায় ভূস্বামী কীর্তিহাটস্য বরাবরেষু।
* * *
অজাতশত্রু বাপ বিম্বিসারকে বন্দী করে রাজা হয়েছিলেন। ঔরংজীব পিতা শাজাহানকে বন্দি করে রেখেছিলেন আগ্রা ফোর্টে। সেসব রাজ-রাজড়ার ব্যাপার। কিন্তু যখনকার কথা বলছি, তখন বাপ বা ঊর্ধ্বতন পুর্বপুরুষ মদ্যপ, অপব্যয়ী, ব্যভিচারী হলে ছেলে বা উত্তরাধিকারী সরকারে দরখাস্ত দিয়ে প্রার্থনা করত যে, উত্তরাধিকারী হিসেবে নিজ ন্যায্য স্বার্থরক্ষার জন্য অপব্যয়ী মালিকের হাত থেকে সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে ‘কোর্ট-অব-ওয়ার্ডসে’ নেওয়া হোক। তার নদীর তখন হয়েছে। কিছুদিন আগে বর্ধমান জেলার বনওয়ারিবাদ রাজবাড়ীর রাজাবাহাদুর এক মুসলমান বাঈজী নিয়ে কলকাতায় প্রমত্ত জীবনযাপন করতেন বলে তাঁর ছেলে নালিশ করে সম্পত্তি কোর্ট-অব-ওয়ার্ডসে দিয়েছিল। পুরনো রাজা মাসোহারা নিয়ে কলকাতায় থাকেন। এইসব নজীর সংগ্রহ করেছিলেন কমলাকান্ত।
বীরেশ্বর রায় তাতে ভয় পান নি। ভয় পাবার মানুষ তিনি ছিলেন না। তবু তখনো তিনি মত্ততায় অধীর। ক্রুদ্ধ হয়েও ক্রোধে জ্বলে উঠতে পারেন নি। তিনি রত্নেশ্বর রায়কে লিখেছিলেন—
কল্যাণবরেষু,
তোমার উদ্ধত স্পর্ধিত পত্র পাইয়া স্তম্ভিত হইলাম। এবং মনে মনে শঙ্কিত হইলাম যে, তোমার এবংবিধ উক্তির জন্য নরকেও তোমার স্থান হইবে না। হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হইলে এই প্রকারই হইয়া থাকে। ইহার জন্য তোমার প্রায়শ্চিত্ত প্রয়োজন। তুমি কাহাকে কি বলিয়াছ তাহা জান না। গোপাল সিং রায়বংশের অবমাননাকারী; তাহাকে রক্ষা করিতে উদ্যত হইয়াছ, তোমার পক্ষে ইহা যে কত বড় পাপ তাহা তুমি অবগত নহ।
তোমার সহিত পত্রালাপেও আমার মৃত্যুর অধিক যন্ত্রণা হইতেছে। তথাপি স্নেহ নিম্নগামী; এসব উন্মার্গগামিতা পরিত্যাগকরতঃ তুমি এখানে আসিয়া আমার সহিত সাক্ষাৎ করিবে। বরং তোমার ভালো-মাকে জিজ্ঞাসা করিবে, ইহাতে তোমার পাপ হইয়াছে কিনা। আমার বিশ্বাস তাহা তুমি কর নাই। তিনি কখনই একপ্রকার কার্য ও উক্তি অনুমোদন করিতে পারেন না। ইহা ব্যতীত শুনিতেছি, তুমি আমার নামে মামলা করিতে মনস্থ করিয়াছ। মহলদিগরের দোরবস্ত প্রজা সকলকে খাজনা দিতে নিষেধ করিয়া ঢোলশহরত করিবার কথা কর্ণে আসিতেছে। এ-কার্য করিলে তোমার আত্মঘাত করা হইবে। আমি আদালতে প্রমাণ করিয়া দিব যে, তুমি ‘সোমেশ্বর রায়ের কন্যা—বিমলাবালা দেবীর গর্ভজাত সন্তান নহ, শ্রীযুক্ত বিমলাকান্ত ভট্টাচার্যও তোমার জন্মদাতা পিতা নহেন। জালিয়াতি বা জাল করিয়া নয়, শ্রীযুক্ত বিমলাকান্ত এবং তদীয়া ভগ্নী শ্ৰীমতী ভবানী দেবীকেই সাক্ষী মান্য করিব। তাঁহারাই সাক্ষ্য দিবেন।
তুমি সাবধান হইবে। নিজেকে সম্বরণ করিবে। তোমাকে এসব কথা লিখিতে আমার হৃদয় বিদীর্ণ হইতেছে। অথবা তোমার অপরাধ কি? ইহা তোমার পিতৃ-মাতৃ উভয় বংশের উপর নিদারুণ অভিশাপের ফল। আমি ভবিষ্যৎ ভাবিয়া নিরতিশয় ব্যাকুল হইয়াছি। তুমি অন্তত তোমার ভালো-মায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া তাঁহার উপদেশ গ্রহণ কর। তুমি তোমার ভালো-মাকে বল-আমি তাঁহার জন্য ব্যাকুল হইয়া প্রতীক্ষা করিতেছি।
ইতি-
আশীর্বাদক
শ্রীবীরেশ্বর রায় দেবশর্মণঃ
চিঠি নিয়ে গিয়েছিল একজন সওয়ার বর্ক-অন্দাজ। নদীর পথ অনেক ঘুরপথ। তাতে অনেক দেরী লাগবে। এ যাবে সোজা পথে, নদী পার হতে হবে, রূপনারায়ণ। তা হোক, খেয়া আছে। বড়জোর তিন দিন লাগবে। কিন্তু ততদিনে কর্মফেরই হোক আর অদৃষ্টচক্রই হোক, সে একটা নিষ্ঠুর পাক খেয়েছে। গোটা শ্যামনগর তখন আগুন লেগে পুড়ে গেছে।
সওয়ার যখন গ্রামে পৌঁছল, তখনও অনেক ঘরের খড়শূন্য কাঠ ধোঁয়াচ্ছে। কমলাকান্তের ঘরখানায় শিকল দিয়ে বন্ধ করে একেবারে চারকোণে আগুন দিয়েছিল। ঘরের মধ্যে বন্ধ ছিল সে। আর এমনি করে আগুন দিয়েছিল ঠাকুরদাস পালের ঘরে। বাকী গ্রামটায় একসঙ্গে অনেক ঘরে আগুন দিয়েছিল। ফলে কেউ কারও সাহায্য করতে পারে নি। কমলাকান্তের গোটা পিঠটা পুড়ে গেছে। ঠাকুরদাস পালের সর্বাঙ্গ এখানে-ওখানে পুড়েছে। সে কমলাকান্তকে আগলে তার কাছেই শুতো। সে-ই কোনরকমে জানালা ভেঙে কমলাকান্তকে নিয়ে বেরিয়ে নীচে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। ওদিকে ঠাকুরদাস পালের বাড়ীতে তার স্ত্রী-পুত্র পোড়া চালের তলায় জীবন্ত দগ্ধ হয়ে গেছে।
কমলাকান্তকে আশ্রয় দিয়েছেন বিমলাকান্তের জ্ঞাতিরা। ঠাকুরপাড়ায় ঠাকুরদের ভিটের উপর নতুন তৈরী বাংলোটায় রবিনসন সাহেব মদ খেয়ে বন্দুক কাঁধে নিয়ে পায়চারি করছে এবং মধ্যে মধ্যে উড়ন্ত কাক-চিল মেরে আনন্দ করছে।
গোটা শ্যামনগর পুড়ে গেছে। যুগলপুরের দুখানা মৌজা—শ্যামনগর, রাধানগর; মিঞাঠাকুরদের ঠাকুরপাড়া ছিল শ্যামনগরেরই অন্তর্গত কিন্তু শ্যামনগর থেকে একটু দূরের শ্যামনগরেরই একটা আলাদা চক ছিল ওটা। তার পাশে পাকপাড়া আর একটা চক।
শ্যামনগরই সব থেকে বড় বসতি। অধিকাংশই ব্রাহ্মণ, কয়েকঘর বৈদ্য, তাছাড়া নবশাখদের পাড়া, গোপপাড়া, তেলিপাড়া, তামুলিপাড়া, মাহিষ্যপাড়া –অধিকাংশই সেকালের সজ্জাতি। এই শ্যামনগর বলতে গেলে একদিক থেকে অন্যদিক পর্যন্ত পুড়ে গেছে। অকস্মাৎ আগুন লেগে পোড়ে নি, আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে কুঠীয়াল জন রবিনসন। আগুন লাগিয়েছে নাকি বীরপুরের ছত্রী বদমাশ গোপাল সিং। এবং কমলাকান্ত এই আগুনে পুড়ে জখম হয়েছে, আর ঠাকুরদাস পালের স্ত্রী-পুত্র ঘরের পোড়া চাল চাপা পড়ে মারা গেছে। তাছাড়া গোয়ালে গরু পুড়েছে, ছাগল পুড়েছে, গৃহস্থের উঠোন-চাটা কুকুর-বেড়ালও পুড়েছে। দশ-পনের জন কিছু কিছু পুড়েছে, আর হাত-পা পুড়িয়েছে অনেক লোক।
পৃথিবীতে ঘটনার গতিপথ বিচিত্র। মেটিরিওলজিক্যাল ডিপার্টমেন্ট আবহাওয়ার খবরে বলতে পারে, আগামী চব্বিশ ঘণ্টার আবহাওয়ার খবরে বলছি—কাল শুকনো যাবে আবহাওয়া অথবা মেঘলা যাবে। কিন্তু মানুষের মনের গতি অতি বিচিত্র, কোন যন্ত্রেই তাকে মাপা বা ধরা যায় না।
ছত্রী গোপাল সিং এসেছিল বীরেশ্বর রায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে কমলাকান্তের পিছনে আশ্রয় নেবার জন্য।
কমলাকান্ত কাশী থেকে শ্যামনগর এসেছিলেন শুধু নিজের জমি উদ্ধার করবার জন্যেই নয়, তিনি নিজেও এসেছিলেন বীরেশ্বর রায়ের সঙ্গে একটা বোঝাপড়া করতে। কথাটা তাঁর নিজের মনে মনেই ছিল, ঘুণাক্ষরে বিমলাকান্তকে বা ভালো-মাকে জানতে দেন নি।
কমলাকান্ত রত্নেশ্বর রায় হয়ে ডায়রী রাখতে শুরু করেছিলেন। তাঁর ডায়রীর প্রথম খণ্ডটা একটু বিচিত্র। পৃষ্ঠার দুটো দিক—প্রথম পৃষ্ঠায় তিনি ডায়রী শুরু করেছিলেন, যেদিন তিনি বীরেশ্বর রায়ের পোষ্যপুত্র হয়ে রত্নেশ্বর রায় হলেন সেদিন থেকে, দুয়ের পৃষ্ঠায় তিনি তাঁর জীবনের পূর্বকথা লিখেছিলেন। তারই মধ্যে আছে তাঁর অকপট মনের প্রকাশ।
নিজের বংশ-পরিচয়—যে বংশ-পরিচয় তাঁর কাছে তাঁর বাল্যকাল থেকে সত্য বলে জানা ছিল তাই দিয়েছেন। যতটুকু কথা মনে পড়ে তা লিখেছেন। তার মধ্যে রয়েছে—’আমার বাল্যকাল তখন আমার চার বছর বয়স- আমার মামা বীরেশ্বর রায়কে দেখে বড় ভয় হত। আমার দিকে এমন করে তাকিয়ে থাকতেন যে আমি পালাতাম, পালাবার জন্য কান্না শুরু করতাম। এমন ছবি দুটো-চারটে আমার মনে যেন গেঁথে রয়েছে।’ তারপর কলকাতার কথা লিখেছেন। বছর-দুয়েক কলকাতায় ছিলেন। এরই মধ্যে ভবানী তাঁর বাবাকে নিয়ে কলকাতা এসেছেন—তিনি তাঁকে ‘ভালো-মা” বলে ডাকতেন। তাঁর কোলেই তিনি মানুষ হয়েছিলেন। ‘ভালো-মা’র প্রতি ভালবাসা ছিল বাপ বিমলাকান্তের চেয়েও বেশী। ভালো-মাকে পেয়ে যেমন খুশী হয়েছিলেন, তেমনি ক্রোধ তাঁর বেড়েছিল মামার উপর। সেই বয়সেই এটুকু বুঝেছিলেন যে, ‘ভালো-মা’ ওই মামা বীরেশ্বর রায়ের ভয়েই চলে এসেছেন। তারপর কাশী। কাশীর জীবনের অনেক ঘটনা আছে। সেখানে দুর্দান্তপনা করেছেন, ওখানকার বাঙালী ছেলেদের নেতৃত্ব করেছেন, কুস্তি লড়েছেন, গঙ্গায় সাঁতার কেটেছেন, হৈ-হৈ করেছেন, ভালো-মায়ের সঙ্গে মন্দিরে গিয়েছেন, বাপের সঙ্গে সন্ন্যাসী দেখতে গিয়েছেন; আবার আদালতে গিয়েছেন। কোম্পানীর সাহেবদের বাড়ীতে ও ক্যান্টনমেন্টে গিয়েছেন বাবার সঙ্গে। তাদের সঙ্গে নির্ভয়ে কথা বলেছেন। পড়াশুনা করেছেন, সংস্কৃত-ইংরাজী পড়তেন। বাংলা পড়াটা তখন খুব জরুরি ছিল না। বাবা পড়াতেন সংস্কৃত, ভালো-মায়ের বাবা দাদামশাই মহেশচন্দ্র পড়াতেন ইংরাজী।
তার সঙ্গে দিন দিন তাঁর আক্রোশ বৃদ্ধি পেয়েছে এই মামার উপর। তখন জেনেছেন সোমেশ্বর রায়ের দৌহিত্র হিসেবে তিনি মাতামহের উইলসুত্রে রায়বাড়ীর সম্পত্তির অর্ধেক অংশের উত্তরাধিকারী, দেবোত্তরের সেবাইত। তাঁর বাবা বিমলাকান্ত সমস্ত ত্যাগ করে এসেছেন কিন্তু সে ত্যাগ করবার অধিকার তাঁর নেই। আইন জেনেছেন। সে আইন-বলে তিনি তাঁর মদ্যপ বাঈজীবিলাসী মামাকে সমস্ত বিষয় এবং দেবত্র থেকে অপসারিত করতে পারেন। কিন্তু বিমলাকান্ত এবং তাঁর ভালো-মাকে তিনি এ-মনের কথা ঘুণাক্ষরে জানতে দেননি। তিনি জানতেন, তাঁরা তাঁকে তিরস্কার করবেন, বাধা দেবেন।
ডায়রীর এই বিবরণের মধ্যে এক জায়গায় লেখা আছে : “একদা আত্মসম্বরণ করিতে না পারিয়া অকস্মাৎ বলিয়া ফেলিয়াছিলাম—সে একটি পাষণ্ড; মহাপাপী। ঈশ্বরকে বলিহারি যে তিনি এমন জঘন্য কদর্য মানুষের মাথায় বজ্রাঘাত করেন না!”
ভালো-মা ঘরের ভিতরে ছিলেন, তিনি বাহির হইয়া আসিয়া বলিলেন—তুই কাহাকে এ কথা বলিতেছিস রে?
আমি বলিলাম—বলিতেছি আমার মাতুল মহাশয়কে। তোমার স্বামী কথাটা জিভে আটকাইয়া গেল।
ভালো-মা স্থিরদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাইয়া থাকিলেন। তাহাতে নিজেকে বড়ই ক্ষুদ্র মনে হইল। তিনি তীব্রকণ্ঠে বলিলেন—তোর জিহ্বা খসিয়া যাইবে। অনন্ত নরকে তোর স্থান হইবে না। তোর চতুর্দশ পুরুষ নরকস্থ হইলেন। তারপর ক্ষিপ্তের মতো স্বীয় ললাটে করাঘাত করিয়া বলিতে লাগিলেন- ফাটিয়া যাউক, ফাটিয়া যাউক, আমার এই মন্দ ললাট ফাটিয়া যাউক!
অতঃপর সে এক তুমুল কাণ্ড। তিনি জলগ্রহণ করিলেন না। মদীয় পিতৃদেব তাঁহার বাসাবাটী হইতে আসিয়া আমাকে যৎপরোনাস্তি তিরস্কার করিলেন। আমি অধোবদন হইয়া রহিলাম বটে, কিন্তু আমার মনের সঞ্চিত ক্রোধ আরো যেন পরিপুষ্ট হইয়া উঠিল। বাধ্য হইয়া ভালো-মা এবং পিতৃদেবের আদেশে আমাকে সারাদিন উপবাস করিতে হইল। এই নিন্দায় আমার জিহ্বা কলুষিত হইয়াছে বলিয়া তাঁহাদের নির্দেশক্রমে অহোরাত্র আমাকে ওই উপবাসী অবস্থায় শ্রীহরি শ্রীহরি শ্রীহরি শ্রীরাম শ্রীরাম জপ করিতে হইল।
তাহা করিলাম। ভালো-মায়ের জন্য আমি প্রাণ বিসর্জন দিতে পারি। তিনি আমার গর্ভধারিণীর অধিক। দেবী অপেক্ষাও পবিত্রা এবং পূজনীয়া। তাহার সঙ্গে পিতৃনির্দেশ অবশ্যই পালন করিলাম। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে প্রতিজ্ঞা করিলাম সুযোগ পাইলেই কলিকাতা যাইব। এবং মামলা দায়ের করিয়া এই বীরেশ্বর রায়ের দত্ত চূর্ণ করিব। প্রতিশোধ লইব। শুধু বীরেশ্বর রায়ের দীর্ঘজীবন কামনা করিলাম। যেন আমার পিতৃদেব এবং ভালো-মাতা হইতে দীর্ঘায়ু হন তিনি। তখন আমি আমার এই আক্রোশ ক্ষোভ মিটাইব।”
হঠাৎ সুযোগ এল। বিমলাকান্ত এবং ভালো-মা বর্তমানেই কমলাকান্ত বাংলাদেশে ফিরিবার সুযোগ পেলেন। চিঠি পেলেন ঠাকুরদাস পালের। “জমিতে সাহেব জবরদস্তি নীলচাষ করাইতেছে। আমি আর চাষ করিতে পারিব না। আতপের অভাবে ঠাকুরের ভোগ হইবে না। প্রতিকার যাহা হয় করিতে আজ্ঞা হয়।” বিমলাকান্ত বাধ্য হয়ে চিঠি দিয়ে কমলাকান্তকে শ্যামনগর পাঠালেন। শ্যামনগরের জমি জন রবিনসনের নীল চাষের গ্রাস থেকে উদ্ধার করবার জন্য। নিজে ছুটি পেলেন না। আদালতের কাছ থেকে তিনি তখন কমিশরিয়েটের কাজ পেয়েছেন।
জন রবিনসনকে পত্র দিলেন বিমলাকান্ত। ওদিকে রায় এস্টেটে গিরীন্দ্র আচার্যকে পত্র দিলেন। রামব্রহ্ম স্মৃতিতীর্থকে পত্র দিলেন। ডাকযোগে কলকাতায় বীরেশ্বর রায়কেও পত্র দিতে তিনি ভোলেন নি। কমলাকান্তকে প্রতিজ্ঞা করালেন, বল তুমি সেখানে গিয়ে তোমার মামার সঙ্গে ঝগড়া করবে না?
কমলাকান্ত বললেন—ঝগড়া আমি করব না কিন্তু তিনি যদি করেন!
—করলেও তুমি সহ্য করবে।
কমলাকান্ত এর উত্তর দিতে চান নি।
রত্নেশ্বর রায় তাঁর ডায়রীতে লিখেছেন-”আমি প্রতিজ্ঞা করিতে চাহি নাই। এ প্রতিজ্ঞা করিয়া দেশে আসিবার আমার কোনরূপই আগ্রহ ছিল না। কারণ আমার শ্যামনগর আগমনের মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল পৈতৃক জমি নীলকরের হাত হইতে উদ্ধার করা নয়, মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল কীর্তিহাটের সম্পত্তি। আমাকে পরিত্রাণ করিলেন ভালো-মা। আমি উত্তর দিবার পুর্বেই তিনি মধ্যস্থলে আসিয়া কহিলেন-না, তিনি তাহা করিবেন না!
আমি বলিলাম—যদি করেন?
তিনি বলিলেন—তাহার জন্য চিন্তা নাই। আমি দেশে যাইতেছি, তোর সঙ্গেই যাইব। তিনি কলহ করিলে তুই আমাকে বলিবি, আমি তাহার ব্যবস্থা করিব।
—কি ব্যবস্থা করিবে?
—আমি তোকে সঙ্গে লইয়া তাঁহার সম্মুখে গিয়া বলিব—এই আমরা আসিয়াছি, কি করিবেন করুন।
আমি বলিলাম—না-না-না। তাহা আমি পারিব না!
ভালো-মা বলিলেন—উত্তম, তাহাও তোকে করিতে হইবে না! শুধু আমাকে জানাইবি—তিনি ঝগড়া করিতেছেন।
আমি সুযোগ গ্রহণ করিলাম। বলিলাম—তাহাই হইবে। ভালো-মা শ্যামনগরের ঘাটে আমাকে নামাইয়া দিয়া চলিয়া গেলেন তাঁহার পিতার সঙ্গে। তাঁহার ব্রত উদ্যাপন আছে, বারো বৎসরের ব্রত। বারো বৎসর পূর্বে গঙ্গাসাগর তীর্থের নিকট এক জাগ্রত কালীমন্দিরে ব্রত গ্রহণ করিয়াছিলেন, বারো বৎসর অন্তে সেই মন্দিরেই ব্রত উদযাপন করিবেন। যাইবার সময়ও বলিয়া গেলেন—আমার চরণ স্পর্শ করিয়া বল তিনি ঝগড়া করিলে কিছু করিবার পুর্বে আমাকে না জানাইয়া কিছু করিবি না।
সঙ্কল্প ছিল এই প্রতিজ্ঞার সুযোগই আমি লইব। পিতা প্রতিশ্রুতি চাহিয়াছিলেন—বল তুমি মাতুল বীরেশ্বর রায়ের সঙ্গে কলহ করিবে না! আমি প্রতিজ্ঞা করি নাই, তৎপূর্বেই ভালো-মা মাঝখানে পড়িয়া বলিয়াছিলেন—না, তিনি তাহা করিবেন না। সুতরাং আমার কলহ করিতে বাধা নাই, ইহা আমি জানিতাম। সেই সুযোগই গ্রহণ করিলাম। কীর্তিহাটের পত্র লইয়া বজরা আসিতেই আমি তাহা প্রত্যাখ্যান করিলাম, সাদর পত্রের উত্তরে বজ্রসমতুল্য পত্রোত্তরে আঘাত হানিলাম। তিনি কলহ করেন নাই, ভালো-মাকে তো তাহা জানাইবার প্রয়োজন নাই!”
সুরেশ্বর বললে সেদিন শ্যামনগরে এসে কমলাকান্তের অবস্থা আমি কিছুটা অনুমান করতে পারি। আমার সঙ্গে মেলে। সেটেলমেন্টের বুঝারতের প্রথম দিন : যেই আমি কুড়ারাম রায়ের পাঁচালীর কথা উল্লেখ করে গোচর আর বসতবাড়ী লাখেরাজ বলে স্বীকার করে নিলাম, অমনি গোটা গ্রামের মানুষ আমাকে ধন্য ধন্য করে আমাকে তাদের পরম আশ্রয় করে তুললে। আমি তাই বিশ্বাস করলাম। স্ফীত হলাম।
কমলাকান্তকেও তাই বলে মেনে নিয়েছিল শ্যামনগরের লোক। প্রথম দিনেই সে জন রবিনসনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। বিমলাকান্তের চিঠিখানা বাংলোর ভিতরে পাঠিয়ে দিয়ে অপেক্ষা করছিল, জন রবিনসন চিঠিখানা পড়ে খুশি হয়েই বেরিয়ে এসে তাকে দেখে বিস্মিত হয়ে বলেছিল-আশ্চর্য তো! তুমি বীরের মত দেখতে, তুমি বিম্লাবাবুর ছেলে? I am so glad to see you young man!
বিমলাকান্তের চিঠিতে বেশী কিছু ছিল না, তিনি লিখেছিলেন—আমার ছেলেকে তোমার কাছে পাঠাচ্ছি। তার পরিচয়পত্র এটা। আশা করি আমাকে তোমার মনে আছে। সামান্য কাজের জন্য তাকে পাঠালাম, তার কাছে সব শুনবে।
কমলাকান্তও ভদ্রতা করে কয়েকটা কথা বলেছিল। জন রবিনসন বলেছিল-বল, কি করতে পারি? নিশ্চয়ই তোমাদের জমির কথা। ওয়েল, আজ নয়, কাম টু-মরো। আমি নিশ্চয় ব্যবস্থা করব। কিন্তু কিছু খাবে না? এ কাপ অফ টা?
ধন্যবাদ দিয়ে কমলাকান্ত বলেছিল—নিশ্চয়; খুব আনন্দের সঙ্গে খাব।
হেসে রবিনসন বলেছিল- বস, বস। এত খুশী হলাম আমি যে, হিন্দু গোঁড়ামি তোমার মধ্যে নেই। তোমার বাবা বিমলাবাবু আমাদের ওখানে আসত, তখন সে ছেলেমানুষ, কখনো এক গ্লাস জল খেতো না।
এইটুকুতেই প্রথম দিনেই গোটা শ্যামনগর মুখরিত হয়ে উঠেছিল। ওঃ, কি খাতির করেছে কুঠীয়ালসায়েব। হাত ধরে চেয়ারে বসিয়ে আদর কত! চা খাইয়েছে। যেটা ওই দে-সরকারদেরও বলে না। গ্রামের ভট্টাচার্যেরা অবশ্য সায়েবের ওখানে চা খাওয়ায় দুঃখিত হয়েছেন। কিন্তু মুখে কিছু বলেন নি। সাহসের কথায়, ইংরিজীতে কথা বলার পারঙ্গমতায় মুগ্ধ হয়ে প্রশংসা করে বলেছিলেন—ও-ও তো নিজে মস্ত জমিদার। কাশীতে শিক্ষা। তার উপর রায়েদের রক্ত আছে। বীরেশ্বর রায়কে ডেকে লাটসাহেব দেখা করে। চেহারা দেখছ না! নরাণাং মাতুলক্ৰম।
ঠাকুরদাস খুশী হয়েছিল সব থেকে বেশী। সে বলেছিল-বাপ জিন্দে ছেলে হয়, দাদাঠাকুর আমার মামা জিন্দে ভাগ্নে।
সন্ধেবেলা গ্রামের সকল লোক এসে তার বাড়ীতে বসে তাকে বলেছিল—দেখ ভায়া, তোমার কাছে আমরা একবার এলাম।
খুশী হয়ে কমলাকান্ত বলেছিলেন—আসুন। ঠাকুরদাসদা, যে-শতরঞ্জি এনেছি কাশী থেকে, সেইটেই পাতো। বসুন।
গ্রামের প্রবীণ তিনি, কমলাকান্তের সম্পর্কে ঠাকুরদা, তিনি বলেছিলেন—ভায়া, সাহেব তো তোমার জমি ছেড়ে দেবে। কিন্তু গ্রামের লোকের কি হবে? দেখ, গ্রামের মধ্যে কেউ ধনী হলে, শিক্ষিত হলে সকলে তার মুখের দিকে ভরসা করে চেয়ে থাকে। ধনী শিক্ষিত যিনি, তিনিও লোকের মুখের দিকে তাকান। তোমাদের সঙ্গে মিটিয়ে ফেলতে পারলে তো সাহেব এবার হাতে মাথা কাটবে।
তারপর বলেছিলেন-সাহেবের অত্যাচারের কথা। জান ভাই, বেটা মহিষাসুরের মত লম্পট। মেয়েদের ইজ্জত পর্যন্ত বিপন্ন হয়ে উঠেছে। তুমি আমাদের ছেড়ে মিটমাট করো না। আমাদের নিয়ে যা করবার হয় কর। না-হয় এক কাজ কর না। তুমি কীর্তিহাটের অর্ধেক অংশের শরিক, তুমি আমাদের সব জমিজেরাত কিনে নাও। আমাদের বরং তোমার মহলে জায়গা দাও। এখানে তুমি সাহেবের সঙ্গে ফয়সালা কর।
তরুণ কমলাকান্ত স্ফীত নিশ্চয় হয়ে উঠেছিলেন। তাছাড়া তিনি শহরের শিক্ষায়-দীক্ষায় অন্য ধরনের মানুষ। তার উপর তিনি জেদী, দুর্দান্ত—তাঁর দেহে বীরেশ্বর রায়ের রক্ত, তাঁর প্রকৃতি জন্মগত ধাতুর জন্য উগ্র অনমনীয়। তিনি বললেন—এ কথা বলতে হবে কেন ঠাকুরদা, এর জন্যেই আমি কাশী থেকে আসি নি! এ তো ডাকে চিঠি লিখলেই হত! আপনাদের ভরসায় আমি এখানে এসেছি। আপনাদের ছেড়ে আমি মিটমাট করব! তা কখনো করব না।
তাঁরা সকলে একবাক্যে সাধুবাদ দিয়ে উঠে গিয়েছিলেন।