১২
সুরেশ্বরের ইচ্ছে হয়েছিল সে যায় সভার নির্দিষ্ট স্থানে। কিন্তু সে যায়নি। সম্বরণ করেছিল নিজেকে। সে জানে, যে-মন, যে-চরিত্র, যে-বাস্তবতাবোধ নিয়ে এ বিপ্লবের কর্মী হওয়া যায়, সে তার নেই। না—নেই।
হয়তো এ মন তাকে দিয়েছে তার অর্থনৈতিক অবস্থা, বাল্যকালে তার বাবা তাকে যা শিখিয়েছিলেন; যে-দৃষ্টি দিতে চেয়েছিলেন, সেই শিক্ষা, সেই দৃষ্টি। এবং তিরিশ সালে জেলের মধ্যে বিপ্লবীদের যে এক উন্মত্ত মনের বিচিত্র বাস্তববোধের পরিচয় পেয়ে সে শিউরে উঠেছিল, যা সহ্য করতে পারেনি, সেই অভিজ্ঞতা তাকে দুরে সরিয়ে দিয়েছে।
বীরেশ্বর রায়, রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায়, তা থেকে দেবেশ্বর রায়, তার পিতামহ তিনি গোপনে বিপ্লবীদের অর্থসাহায্য করতেন বলে সে শুনেছে, তাঁর পর তার বাবা যোগেশ্বর রায়-তিনি ইংলিশম্যান স্টেটসম্যানের চাকরি করেও, ইংরেজ সরকার সম্বন্ধে অনেক সমালোচনা করেছেন, স্টেটসম্যানের চাকরি ছেড়ে তিনি দেশবন্ধু দাশের কাগজেও লিখেছেন। তারপর সে। সে জেলে গিয়েছিল। ফিরে এসে সে অনুতপ্ত হয়েছিল। তারপর অতুলেশ্বর।
অতুলেশ্বর আজ গুলি খেয়ে মরতে হয়তো পারবে।
বিবিমহলে সেই ছত্রি-ঘরে বসে সুরেশ্বর বীরেশ্বর রায়ের স্মরণীয় ঘটনাপঞ্জীর খাতাখানা সামনে খুলে রেখে খানিকটা পড়েও আর পড়তে পারেনি। মন তার ওই মিটিং-এ কি হচ্ছে, তার ভাবনাতেই বার বার ঝাঁপ খেয়ে পড়তে চাচ্ছিল এবং পড়ছিল। গোটা বিবিমহলে এক রঘু ছাড়া কেউ নেই। মেজদি আসেননি, ব্রজেশ্বরও না। তারাও কি মিটিংয়ে কী হচ্ছে দেখতে গেছে? অথবা ঘরের মধ্যে তারই মত সংশয়াকুল হয়ে রয়েছে?
মিটিংটা হচ্ছে পুরনো তিনমহলা রায়বাড়ীর উত্তরে যে খিড়কীর দুধপুকুর আছে, তার ওপাশে যে ডোমপাড়ার পতিত প্রান্তরটা সেখানে। প্রৌঢ়া রাজকুমারী কাত্যায়নী একটা তেরো-চৌদ্দ বছরের ডোমের ছেলে গাছে চড়ে তাঁর গায়ের আশ্চর্য সুন্দর রং দেখেছিল বলে যে- ডোমপাড়ার গোটাটাই হাতী দিয়ে ভাঙিয়ে দিয়েছিলেন, এটা সেই প্রান্তর!
একটা কোলাহল ভেসে আসছে। ঠিক বুঝতে পারছে না সুরেশ্বর কী হচ্ছে। সে ছত্রিটায় বসেছিল, ছত্রিটার চারিদিকে আটটা থাম, নিচে রেলিং, বাকী উপরের দিকটা ছাদ পর্যন্ত সবই ফাঁকা, চারিদিকেই দেখা যায়। তবে অনেকটা দূরে রায়বাড়ী ওদিকটা আড়াল করে রেখেছে। সে দেখছিল, পথেঘাটে কোন লোক নেই। গ্রামের অন্য সকল দিক থেকেই প্রাণস্পন্দন, জীবন-গুঞ্জন সরে গিয়ে ওই—ওইখানটাতেই জমায়েত হয়েছে। প্রথম বারকয়েক ‘বন্দেমাতরম্’, ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ ধ্বনি উঠেছিল কিন্তু তারপর আর কোন ধ্বনি উঠছে না। উঠছে একটা বহু কণ্ঠস্বরের মিলিত বহুবাক্যের একসঙ্গে উচ্চারণের কোলাহল। তবু এখনও কোন বন্দুকের শব্দ ওঠেনি—এইটেই একমাত্র আশ্বাস
এদিকে দেখা যাচ্ছে, কংসাবতীর স্রোতোধারা চলে গেছে একটু পূর্বদিকের ছোঁয়াচ-লাগানো দক্ষিণমুখে। সন্ধ্যার লালচে আলোর ছোপ ধরেছে কাঁসাইয়ের জলে।
বিবিমহলের এই ছত্রিঘরের ঠিক নিচে দহটার বুকে কিছুতে অর্থাৎ কোন জলচর জীব হঠাৎ নড়ে উঠল; জলের বুকে গোলাকার বৃত্ত একটার পিছনে একটা ছুটছে। এই দহে ভবানী দেবী ঝাঁপ দিয়েছিলেন মরবার জন্য। কিন্তু মরেননি। ভেসে গিয়েছিলেন কাঁসাইয়ের স্রোতে। ওই পূর্ব-দক্ষিণ মুখে। ভবানী দেবীর চিঠিখানা কিছুক্ষণ আগে সে পড়েছে। জগদ্ধাত্রী দেবীকে লিখেছিলেন নিরুদ্দেশ হওয়ার সাত বছর পর। সাত বছর পর বীরেশ্বর রায়ের অহেতুক অনুমান সত্য হয়ে দাঁড়াল। ভবানী দেবী মরেননি। তিনি বেঁচে আছেন।
“মরিব মানস করিলেই মরণ আইসে না। পৃথিবীতে যাহার লিখনে যত দুর্ভাগ্য, যত দুর্ভোগ প্রহারের ব্যবস্থা বিধাতা লেখে, তাহা এড়ানো যায় না। ভোগ করিবার জন্য বাঁচিতে হয়। অদৃষ্টই বাঁচায়। আমি বর্ষার কাঁসাইয়ে মরিব বলিয়া ঝাঁপ দিয়াছিলাম, কিন্তু মরণ হয় নাই। বাঁচিয়াছি। কোথায় আছি, কেমন আছি তাহা লিখিব না। আর আমার ঘরে ফিরিতে সাহস নাই—ইচ্ছা নাই। ঠিকানাও দিব না। তিনি ঠিকানা পাইলে আমাকে নিশ্চয় খুঁজিয়া বাহির করিবেন এবং হয় গলা টিপিয়া নয় গুলি করিয়া মারিবেন। মরিতে আমার ভয় নাই কিন্তু তিনি স্ত্রী-হত্যার পাতকে পাপী হইবেন। হয়তো থানা-পুলিশ হইয়া একটা ভয়ানক কাণ্ড ঘটিবে। আবার তিনি হয়তো সব শুনিয়াও ক্ষমা করিয়া ঘরে লইতেও পারেন। তিনি সব পারেন। সমাজের আপত্তি হইলে ক্রীশ্চান হইয়া যাইবেন। কিন্তু আমাকে ঘরে লইলে সর্বনাশ হইবে। আমি দুর্ভাগ্য, আমি পাপ। তুমি জ্ঞাত আছ, আমি এক সাধক-তান্ত্রিকের কন্যা। আমার পালক বাবা বলিতেন, তাঁহাকে কামাখ্যা পাহাড় হইতে যোগিনী-ডাকিনীতে ঠেলিয়া নিচে ফেলিয়া দেয়। তিনি অনেক নিচে পড়িয়া মারা গিয়াছেন, নয় জন্তুতে খাইয়াছে। কিন্তু সে-ও আমার জন্মের জন্য। আমার জন্মের পাপেই তাঁহার এই পরিণাম হইয়াছে। আমার পাপেই আমার এমন স্বামী মদ ছাড়িয়া আবার মদ ধরিলেন, প্রায় পাগল হইলেন। আবার ঘরে ফিরিলে হয়তো সর্বনাশ হইবে। আমাকে মারিয়া ফেলিয়া নিজে মরিবেন। এত কথা তোমাকে লিখিতেছি এই জন্য যে, তুমি আমার বাল্যসঙ্গিনী ছিলে, বিয়ের সম্বন্ধে বড়-জা হইয়াছিলে, তুমি সব কিছু কিছু জান এবং আমার স্বামী তোমার দেওর। এখন বলিবার কথা এই যে, তুমি ভাই তাঁহাকে ডাকিয়া বুঝাইয়া-সুঝাইয়া নতুন বিবাহ দিয়া সংসারী করিয়া দিবা। তুমি আমা অপেক্ষা বয়সে ছোট, বাল্যকালের সঙ্গিনী, তথাপি তুমি সম্পর্কে বড়-জা, তুমি আমার প্রণাম জানিবা। ইতি-ভবানীকুমারী দেবী।”
এর নিচেই বীরেশ্বর রায় লিখেছেন-”পাপ তাহাতে সন্দেহ নাই। তাহাকে পাইলে খুন করিব, তাহাতেও সন্দেহ নাই। মহাপাপিনী, নইলে তাহার গর্ভস্থ সন্তান অবিকল বিমলাকান্তের মতো হইল কেমন করিয়া? কামার্ত পশু বিমলাকান্ত। সে-ও বুঝিয়া এই কারণেই পলাইয়াছে। আমার আক্ষেপ হইতেছে, ওই সন্তানটাকে গলা টিপিয়া আমি তাহার চক্ষের সম্মুখে মারিয়া ফেলি না কেন?”
সর্বাঙ্গ শিউরে উঠেছিল সুরেশ্বরের। সে আর নড়েনি, খাতাখানাকে দুরে সরিয়ে দিয়েছে। পড়তে সাহস হয়নি।
আবার ধন্যবাদও দিয়েছে যে, বীরেশ্বর রায়ের বংশের সন্তান নয় তারা। বিমলাকান্তের পুত্র কমলাকান্ত বীরেশ্বরের ভাগিনে, বীরেশ্বর রায়ের পোষ্যপুত্র হয়ে নাম হয়েছিল রত্নেশ্বর রায়। তার বংশধর তারা।
বিমলাকান্তের উপর নিষ্ঠুর ক্রোধের কারণ তার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল। হায় ধর্মপরায়ণ বিমলাকান্ত! হায় তোমার তান্ত্রিক সাধক পিতা শ্যামাকান্ত! হায় তোমার মাতামহ শুদ্ধাচারী ধার্মিক পদ্মনাভ ভট্টাচার্য!
অন্ধকার মেঘাচ্ছন্ন রাত্রে আকস্মিক একটা বিদ্যুতের চমকের মত একটা সত্য সুরেশ্বরের মনের মধ্যে ঝলসে উঠল।
রায়বংশে তীব্র নারী-দেহ-পিপাসা কোথা থেকে এল, তার উৎস যেন এই বিদ্যুৎ-চমকে স্পষ্ট পরিষ্কার ভাবে সে দেখতে পেয়েছে। বিমলাকান্ত এর উৎস। সে নিজেকেও তো জানে। তার রক্তের মধ্যে এর জোয়ার বা বন্যার আবেগ তো সে অনুভব করেছে। মনে পড়ে গেল গোপেশ্বরকে।
ওঃ! শিউরে উঠল সে। বিমলাকান্ত থেকে সে, ব্রজেশ্বর, গোপেশ্বর—এরা পঞ্চমপুরুষ। ওই বীজ এই সম্পদের ইনকিউবেটারে সযত্নপালিত হয়ে সমস্ত রক্তধারাকে বিষাক্ত করে দিয়েছে। তার আগে। থাক, পিতৃপুরুষদের কথা থাক।
হঠাৎ সেই মুহূর্তটিতেই উঠেছিল কয়েকবার মানুষের সমবেত কণ্ঠধ্বনি—বন্দেমাতরম্। বন্দেমাতরম্। বন্দেমাতরম্। জিন্দাবাদ। জিন্দাবাদ। জিন্দাবাদ। ইনকিলাব শব্দটা এতদূর পর্যন্ত পৌঁছোয়নি। সে-শব্দটি একজন বা দুজনে ধ্বনি দিয়ে থাকে। কিন্তু য’জনেই সে-শব্দটি ধ্বনি দিয়ে থাক, তার মধ্যে যে একটি কণ্ঠস্বর অতুলেশ্বরের, তাতে তার সন্দেহ ছিল না।
মন ফিরে এসেছিল আর একদিকে। ঘন কালো মেঘাচ্ছন্নতার মধ্যে প্রচ্ছন্ন সূর্যের আভাসের একটি রজতশুভ্র রেখার মতো অতুলেশ্বর। ও কোথা থেকে এল? হয়তো শ্যামাকান্ত যে শক্তিসাধনা অর্ধসমাপ্ত রেখে কাঁসাইয়ের বন্যায় মরেছিলেন, তারই পুণ্যফল!
হঠাৎ একটা উচ্চকণ্ঠের ডাক ভেসে এল যেন আকাশপথ ধরে। অনেকটা উঁচু থেকে ডাকছে—রাজাভাই!
বুঝতে বাকী রইল না কে ডাকছে। কিন্তু কোথা থেকে ডাকছে খুঁজতে গিয়ে তার নজরে পড়ল দুরে রায়বাড়ীর ছাদের আলসের গায়ে দাঁড়িয়ে ব্রজেশ্বর। চোখোচোখি হতেই সে চীৎকার করে বললে—অতুলকে অ্যারেস্ট করেছে।
বিস্মিত হল না সুরেশ্বর। সে তাকিয়েই রইল তার দিকে। হঠাৎ পিছনে থেকে কোন মেয়ে এসে ব্রজেশ্বরকে কি বললে।
—পুলিশ আসছে। বলেই ব্রজেশ্বর চলে গেল। বোধ হয় ছাদ থেকে নেমে গেল এবার দেখতে পেলে, দুরে ঠাকুরবাড়ীর ওপাশে, মা-কালীর নামে প্রতিষ্ঠা করা কালীসাগরের ওদিকের পাড় ধরে অনেক লোক ছুটছে। পালাচ্ছে। সম্ভবত পুলিশ তাড়া করেছে। মেদিনীপুর কংগ্রেস আজও বে-আইনী প্রতিষ্ঠান। পুলিশ বোধ হয় লাঠিচার্জ করেছে। এদিকে ‘বিবিমহল’ একখানি একক বাড়ী। এর পাশ দিয়ে এক গোয়ানপাড়ার লোক ছাড়া কেউ হাঁটে না। পূর্ব এবং দক্ষিণদিকটা ফাঁকা। শুধু বনই আছে। বসতির মধ্যে নদীর ওপারে গোয়ানপাড়া।
না–। আসছে। গোয়ানপাড়ার লোকই আসছে। ক’টি তরুণী মেয়ে আর জনকয়েক জোয়ান ছেলে। রোজী বলে প্রগল্ভা মেয়েটিও তার মধ্যে রয়েছে। আরও রয়েছে কুইনি। ওদের জিজ্ঞাসা করতে গিয়েও কিছু জিজ্ঞাসা করলে না সুরেশ্বর।
কি জিজ্ঞাসা করবে?
সত্যি কথা বলতে, তার একটু যেন সঙ্কোচও হচ্ছিল। নিজেকে ছোট মনে হচ্ছিল। এরা যে-ডাকে সাড়া দিয়েছে, সে ডাকে সে সাড়া দেয়নি।
ওরা চলে গেল রাস্তা ধরে গোয়ানপাড়ার ঘাটের দিকে।
চুপ করেই দাঁড়িয়ে রইল সুরেশ্বর। ভাবছিল—স্টেটসম্যানে ‘বিদায় সত্যাগ্রহ’ বলে যে পত্রখানা সে লিখেছিল, সে তো ন্যায়বিচারে মিথ্যা নয়। তবে-তবে সে কেন সঙ্কোচ বোধ করছে? কেন?
হঠাৎ চোখে পড়ল—বিবিমহল আর রায়বাড়ীর মাঝখানে যে বিশ বিঘের উপর আমবাগান, সেই বাগানের বৃহদায়তন গাছগুলোর গুঁড়ির আড়ালে আড়ালে একটি সচল নারীমূর্তি। কখনও দেখা যাচ্ছে, কখনও যাচ্ছে না। হঠাৎ একবার সে গাছের আড়াল থেকে বের হতেই সে তাকে চিনলে। সে অর্চনা। জগদীশ্বর-কাকার সেই সুষমাময়ী মেয়েটি।
অর্চনা, বাগানের গাছের আড়াল থেকে বেরিয়ে, এ-পাশ ও পাশ তাকিয়ে দেখে নিয়ে খুব দ্রুত হেঁটে এসে ঢুকল বিবিমহলেই।
সুরেশ্বরের মনে পড়ল, সকালবেলা ব্রজদা বলেছিল, মেজদি অতুলকে স্বদেশী করতে টাকা দেন। তিনি তার অভয়দাত্রী, তার অর্থসাহায্যদায়িনী। এবং অর্চনা তার সহকারিণী।
অর্চনা তবে পালিয়ে এসেছে। ব্রজদা বললে—ও-বাড়িতে পুলিশ এসেছে। অর্চনা কি ভয়ে পালিয়ে এসেছে? সে দ্রুত নিচে নেমে গিয়ে দাঁড়াল হলটায়। কিন্তু কই অৰ্চনা?
অকস্মাৎ নদীর ঘাটের উপর ছত্রিঘরের দরজাটা খোলার শব্দ হল। পুরনো দরজা সন্তর্পণে খুললেও শব্দ হয়। তারপরই একটা ভারী কিছু জলে পড়ার শব্দ। চমকে উঠল সুরেশ্বর। সে আবার হল থেকে বেরিয়ে ছুটে গেল ছত্রিঘরের দিকে। তখন দরজাটা বন্ধ আছে। পায়ের শব্দ শুনে অৰ্চনা চমকে উঠে ঘুরে দাঁড়াল।–কে?
—ভয় নেই। আমি সুরেশ্বরদা।
—সুরেশ্বরদা! ওঃ, চমকে উঠেছিলাম আমি। বলে আবার সে পিছন ফিরে দরজাটা দিতে গিয়ে বললে-ভালই হয়েছে। আমি এই দরজা দিয়েই বেরিয়ে যাচ্ছি। তুমি দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে চলে যাও। দেখো যেন ছত্রিঘরের ওদিকের দরজাটা দিতে ভুলো না। আমি বিবিমহলের পিছনে পিছনে চলে যাব।
—কোথায় যাবে?
—ঠাকুরবাড়ী ঢুকব গিয়ে।
—ঠাকুরবাড়ী?
—হ্যাঁ। বলে সে বেরিয়ে গেল। সুরেশ্বর আর কোন প্রশ্ন করতে পারলে না। প্রশ্নের সময় এ নয়। দরজা বন্ধ করে সে এসে আবার উপরের ছত্রিঘরে উঠল।
রায়বাড়ীতে গোলমাল উঠছে।
পুলিশ এসেছে তাহলে। হঠাৎ মনে হল, মেজদি? মেজদি অতুলেশ্বরকে ভালবাসেন। একমাত্র ওই ছোট ছেলেটিরই মা তিনি হতে পেরেছিলেন। তাঁকে?—তাঁকে যদি লাঞ্ছনা করে?
১৯৩০ সাল থেকে চট্টগ্রামে, মেদিনীপুরে ইংরেজের পুলিশ, এদেশী পুলিশ যে কুৎসিত বীভৎস অত্যাচার করেছে, তা যদি পাপ হয়, যদি অপরাধ হয়, তবে এই ইংরেজ রাজত্ব থাকবে না। কিন্তু তা মনে করলে আতঙ্ক হয়। এ যে মেদিনীপুর!
সে বেরিয়ে গেল রায়বাড়ীর দিকে।
হাতে হাতকড়া, কোমরে দড়ি-বাঁধা অতুল দাঁড়িয়ে আছে। তার জামাকাপড় ধূলায় ধুলিধূসর হয়ে গেছে, ছিঁড়ে গেছে। রায়বাড়ীর সুন্দরবর্ণের অধিকারী ছেলেটির কপালে কালসিটে পড়েছে। হাত ফেটে গেছে, লম্বা রুক্ষ চুলগুলি ধুলায় পিঙ্গল হয়ে উঠেছে। তার পাশে কোমরে দড়ি-বাঁধা, হাতে হাতকড়া পরানো বৃদ্ধ রঙলাল মণ্ডল। তার দেহে নির্যাতনের চিহ্ন। আরও তিনটি অতুলের সমবয়সী যুবক, তাদের একজনকে সে মেজদির ভাজের শব-সৎকারের সময় দেখেছে। পরিচয় সেইদিন সামান্যই হয়েছিল। একজন ও-পাড়ার গাঙ্গুলী-বাড়ীর ছেলে।
অতুল তাকে দেখে একটু হাসলে। সুরেশ্বরের বিস্ময়ের সীমা ছিল না ওই বৃদ্ধ রঙলালের হাতে হাতকড়া দেখে।
এ বৃদ্ধ? এ বৃদ্ধ কি করলে?
পুলিশ সার্চ করছিল অতুলেশ্বরের ঘর। শিবেশ্বর রায়ের ছেলের মধ্যে বাড়ী ভাগ হয়ে গেছে। অতুলেশ্বরের ভাগে তিনখানা ঘর পড়েছে। আসবাব সামান্যই, ভাঙা খাট একখানা। একটা পুরনো আলমারি। একটা চেস্ট-ড্রয়ার। তার উপর একটা পুরনো আমলের ড্রেসিং- আয়না। ক’টা ব্র্যাকেট। একটা শেলফে কতকগুলো বই। খানদুই চেয়ার। একখানা টেবিল, একখানা হাল-আমলে কেনা সস্তা ক্যাম্বিসের ফোল্ডিং ইজিচেয়ার। একখানা ঘর ফাঁকা। একখানা ঘরে কিছু বাসন। তোলা বাসন। কখানা পুরনো সতরঞ্জি। একখানা গালিচা। কতকগুলো ভাঙা কাঠ-কাঠরা। একটা কুলুঙ্গীতে খানকয়েক রূপোর বাসন। মাথায় ছাদের গায়ে ঝুলানো একটা ভাঙা ঝাড়লণ্ঠন।
ধনেশ্বর আপনমনেই বকে যাচ্ছেন—এই পরিণাম। অদৃষ্টের পরিহাস। রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায়। তাঁর পিতা বীরেশ্বর রায়। ইংরেজ রাজত্বের সম্ভ্রান্ত, স্বনামধন্য রাজভক্ত জমিদার। রাজা উপাধি পাবার কথা কিন্তু মৃত্যু হওয়ায় পাননি রত্নেশ্বর রায়। কত খাতির রাজদরবারে। আজ তাঁর বংশধর রাজদ্রোহী। বাঃ। বাঃ! বাঃ!
পুলিশ অফিসার দুজন কনেস্টবল নিয়ে সার্চ করে চলেছিল ভ্রূক্ষেপহীনভাবে। একজন সামনে বসেছিল একটা চেয়ারে, সিগারেট টানছিল।
ব্রজেশ্বর ওদিকে বারান্দায় রেলিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সে এসে রয়েছে সুরেশ্বরের কেনা অংশে। যে-অংশে মেজদি থাকেন।
সুরেশ্বরকে সহজে ঢুকতে দেয়নি পুলিশ। তার পকেট এবং কোমর সার্চ করে দেখে পরিচয় নিয়ে তবে ঢুকতে দিয়েছে। সে বলেছে—এইদিকটা তার নিজস্ব—সে তার নিজস্ব অংশে ঢুকবে।
সার্চ শেষ করে অফিসারটি উঠে বললে—আচ্ছা, চল।
তারা ভারী বুটের শব্দ তুলে নেমে চলে গেল। সঙ্গে নিয়ে গেল গ্রেপ্তার-করা লোক ক’জনকে।
চলে যেতেই ধনেশ্বর প্রখরভাবে মুখর হয়ে উঠল।
বিমলেশ্বর স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল তার অংশের বারান্দায়। সে উদাসী প্রকৃতির মানুষ। তাদের তিন সহোদরের মধ্যে সেই সব থেকে বড়। তার চোখ থেকে জল গড়াচ্ছে। তার ওদিকে কমলেশ্বর বসে আছে এবং কাঠি দিয়ে বারান্দায় পলেস্তারা চটাখসা মেঝের উপর কিছু লিখেই চলেছে আপনমনে।
সুরেশ্বর ব্রজেশ্বরকে জিজ্ঞাসা করলে—মেজদি কোথায়?
ব্রজেশ্বর আজ পাল্টে গেছে। সে সরস-কৌতুকপরায়ণতা নেই। বিষণ্ণ হয়ে গেছে। একটু বিষণ্ণ হেসে বললে—ধ্যানে বসেছেন। জপ করছেন।
সুরেশ্বর বারান্দা থেকে ঘরের দিকে এগিয়ে গেল। ব্রজেশ্বর বললে—ওখানে কোথায় যাবে? ঠাকুরবাড়ীতে? অতুল মিটিং করবে—সকাল থেকেই অস্বস্তি, কারণে অকারণে যমকে ডাকছিলেন। এস, নাও আমাকে, আর পারছিনে। মধ্যে মধ্যে বৃদ্ধ স্বামীদেবতাকে স্মরণ করে তাঁকে তিরস্কার করছিলেন-বুড়ো বয়সে বিয়ে করতে এই হতভাগী ছাড়া কি আর কাউকে খুঁজে পাওনি! কি গ্রহের জঞ্জালে আমাকে ফেলে গেলে! ওই তোমার ওখানে ঢেঁড়া যখন পড়ল তখন থেকে। দেখলে না, ছুটেই প্রায় পালিয়ে এলেন। অতুলকে বারণ করবেন। কিন্তু কোথায় অতুল। অতুল আর সারাদিন বাড়ী আসেনি। সে সকাল থেকে এদিক-ওদিক ঘুরে মিটিংয়ের ব্যবস্থা করে গিয়েছিল সেটেলমেন্ট ক্যাম্পে। গোয়ানদের তরফি ওকালতি করবে কে? সে তো তোমার দৌলতে মিটে গেছে শুনেছি। দু হাজার টাকার চেক কর্তন করেছ। সে ওখান থেকে ওই চেক নিয়ে মুহূর্তের জন্য বাড়ী এসেছিল। চেকখানা অর্চনার হাতে দিয়ে বলে গেছে মাকে দিস। বলিস, আজ হয়তো আমাকে ধরবে। পুলিশ আসছে খবর পেয়েছি। বলেই বেরিয়েছিল। মেজদি সঙ্গে সঙ্গে ছুটেছেন রায়বাড়ীর সংকটত্রাণের মা-বাবার কাছে। অর্থাৎ ঠাকুরবাড়ীতে। কি একটা আপদ উদ্ধার বিপত্তারণ মন্ত্রটন্ত্র আছে ভাই, যার মধ্যে শ্লোকে শ্লোকে ত্রাহি মাম, ত্রাহি মাম্ প্রার্থনা আছে সেটা পুজুরী বামুনের বেটীর মুখস্থ। তাই পাঠ করছে। অন্তত অর্চনা তাই বললে। কারণ সেও তার সঙ্গে ঠাকুরবাড়ী গিয়েছে, বোধ হয় সুরে সুর মেলাচ্ছে।
অর্চনার ছবিটা মনে পড়ে গেল সুরেশ্বরের। কিন্তু তা বললে না ব্রজেশ্বরকে। ব্রজেশ্বরকে সে অবিশ্বাস করে না। এ বাড়ীতে সেই তার সব থেকে অন্তরঙ্গ। উপকারী বন্ধু, আপনার জন। কিন্তু ব্রজদা বেশি কথা বলে। মদও খায়। কোথায় কাকে বলে বসবে কখন, তার স্থিরতা নেই। অর্চনা যে কিছু রাজনৈতিক অপরাধের প্রমাণ বা বস্তু আজ কাঁসাইয়ের দহে ফেলে দিয়েছে, তাতে সন্দেহ নেই।
আশ্চর্য লাগছে তার। আজকের দিনটা আশ্চর্য। যেন একটা যবনিকা উঠে গিয়ে একটা পরম বিস্ময়ের অকল্পিত দিগন্ত উদ্ভাসিত হল তার কাছে!
যদুরাম রায়। অতুলেশ্বর। অর্চনা। মেজঠাকুমা
মেজঠাকুমার উপর খানিকটা রাগ হল। মহিলা অসাধারণ অভিনয় করে অতুলেশ্বরের উপর তাঁর শ্রেষ্ঠ স্নেহের কথা জানতে দেননি।
তাকে কত কথাই না বলে এসেছেন তিনি। তাকে খাইয়ে ঠাকুরবাড়ী যাবার সময় বলে- ছিলেন—“আমার বংশীধারী গোবিন্দের সেবা হল, এইবার চললাম ভাই আমার প্রাণগোবিন্দ রাধামাধবের সেবা করতে।” কথাগুলোর গড়ন এমন এবং মেজঠাকুমার বলার ঢং এমন যে, শুনবামাত্র মোহ জাগে। কথাগুলো মেকি কি খাঁটি, কষে বা যাচাই করে দেখবার কথা মনেই হয় না। ঠাকুমা তাঁর যে সর্বাপেক্ষা প্রিয় একটি জীবনাধিক বালগোপাল আছে, সেকথা কোনদিন জানতে পর্যন্ত দেননি।
মনের কথাটা তার ভুরুতে কটা রেখার খাঁজে বোধ হয় ফুটে উঠেছিল। ব্রজেশ্বর বললে কি ভাবছ রাজাব্রাদার?
—ভাবছি। ভাবছি ব্রজদা, অতুল নিজে যা করেছে তাতে বংশের মুখ উজ্জ্বল করেছে কিন্তু ওই বৃদ্ধ মণ্ডলটিকে জড়ালে কেন? বেশ মারধর করেছে দেখলাম।
—তা বেশ। শুনলাম পুলিশ আনলফুল এসেম্বলী ডিক্লেয়ার করেই লাঠি চার্জ করেছিল। রঙলালকে বাঁচাতে অতুল ঝাঁপিয়ে পড়ে বুড়োকে বুক দিয়ে ঢেকেছিল। লাঠি পড়েছিল অতুলের ঘাড়ে। তারপর তাকে টেনে মাটিতে ফেলে বুটের লাথি মেরেছে। অতুল অজ্ঞানও হয়ে গিয়েছিল। তখন বৃদ্ধও বাদ যায়নি। তবে বৃদ্ধের যে পক্ষোদ্দাম হয়েছে। এককালের চাষীভূষি। জমিদাররা বলত হুকুমের গোলাম। একটা কথা দাদু বলতেন, মনে আছে—“চাষী সে বিনা দাতা নেহি, বিনা লাঠিসে দেতা নেহি।” পথে ভদ্রজন ব্রাহ্মণদের দেখলে হেঁট হয়ে প্রণাম করত। সে আজ উকীল-ছেলের বাবা, তার উপর এই আমল, অবস্থাও ভাল হয়েছে; বয়স হলে কি হবে, লিড হবার বড়ই বাসনা। অতুলের ঢেঁড়াদার ওবেলা বলেছিল—মেদিনীপুর থেকে নেতারা আসবেন। কথাটা মিথ্যে। তলে তলে ওই রঙলালকেই বলেছিল—আপনাকেই সভাপতি হতে হবে। রঙলাল তৎক্ষণাৎ রাজী। সভাপতি হবার বাতিকে পেয়েছে ওকে। এর আগে তিরিশ সালেও দু-চারবার সভাপতি হয়েছে। এবার মাশুল দিতে হল।
—হুঁ। একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেললে সুরেশ্বর। তারপর বললে-চললাম।
ব্রজেশ্বর বললে—আমি যাব সন্ধ্যের পর। এখন ভাই একখানা গাড়ীটাড়ীর যোগাড় দেখি। ভোরবেলা উঠে পালাব। আর এখানে না। বউ ভয় পেয়েছে। বলতে কি, আমিও নার্ভাস হয়েছি। কে জানে কোন্ ফ্যাসাদ বাধবে আবার। অতুল যে তলে তলে কি করে রেখেছে, কে জানে। বোমা-ফোমা যদি বানিয়ে-টানিয়ে থাকে, তবে তা গুষ্ঠিযুদ্ধ নিয়ে টানাটানি করবে।
সুরেশ্বর শিউরে উঠল। কথাটা তার মনে হয়নি।
অর্চনা দহের জলে কি ফেলে দিল? কিন্তু সেকথা মনে চেপে রেখেই বেরিয়ে এল বড়বাড়ী থেকে।
বিবিমহলে এসেই দেখা হল মেজঠাকুমার সঙ্গে। অর্চনাও রয়েছে। সুরেশ্বর বললে—আপদ উদ্ধার পাঠ শেষ হল? মা কি বললেন?
ঠাকুমার মুখখানা কেমন হয়ে গেল। বোধ হয় এই ধরনের কথা, গলার ওই সুর তিনি প্রত্যাশা করেননি।
অর্চনা বললে-তুমি খুব রেগেছ, না সুরেশ্বরদা?
অপ্রস্তুত হল সুরেশ্বর। এতে রাগ করা অন্যায়, এটা অলঙ্ঘনীয় বিধান। এ সত্য যে মানে, তার না মেনে উপায় নেই। রাগের হেতুটা এতে রাগ করার চেয়ে আরও লজ্জার কথা। সুতরাং অপ্রস্তুত হয়ে বললে—অতুল যা করেছে করেছে, তোমরা এতে জড়ালে কেন?
মেজঠাকুমা বললেন—ওরে, আমি যখন ষোল বছরের মেয়ে এ বাড়ীতে বউ হয়ে এলাম তখন সব ছেলেরা আমার ওপর রাগ করেছিল। অতুল তখন আট বছরের। ওই শুধু কাছে এসেছিল—মা বলেছিল। ধনেশ্বর জগদীশ্বর-সুখেশ্বরের তখন বিয়ে হয়েছে, ব্রজ হয়েছে কল্যাণ হয়েছে। ওরা সৎভাইদের নিয়ে তোর মেজঠাকুরদাকে আমাকে আলাদা ক’রে দিলে। উনিও বললেন—বাঁচলাম। কিছুদিন কেউ আমার সঙ্গে কথা বলেনি। ওই অতুল আসত রে। মা বলে কাছে দাঁড়াত। কোলে বসত। ছেলেরা খবর পেলে এসে টেনে ছিনিয়ে নিয়ে যেত। ও কাঁদত। ও এই বাউণ্ডুলেমি করে বেড়ায়, কত বারণ করেছি, কিন্তু রায়বংশের গোঁ, মানে নি। কিন্তু মা বলে যখন কাছে এসে বলত—এইগুলো খুব গোপনে লুকিয়ে রেখো তো মা। দেখো, অতুলের তা হলে হাতে দড়ি পড়বে। হ্যাঁ। তখন কি করব, রেখেছি। না-রেখে পারি, তুই বল!
—কিন্তু অর্চনাকে জড়ালে কেন?
–সে তুই ওকে জিজ্ঞেস কর ভাই। আমি বার বার বারণ করেছি রে, বার বার বারণ করেছি। অতুলের দোষ দিতে পারব না। এই ওর মুখের সামনে বলছি আমি। অতুলের পিছন পিছন কুকুরের মত ফিরেছে। অতুল একদিন লাল কালিতে ছাপা কতকগুলো কাগজ দিয়ে বললে-রেখে দাও তো মা। খুব সাবধানে রেখো। অর্চনা বারান্দার দিকের বন্ধ জানালাটার খড়খড়ি তুলে শুনছিল, সে ফিসফিস করে বললে—আমাকে দেখাও না ছোটকা? পায়ে পড়ি তোমার! সে এই গেল বছর! মেদিনীপুরে তখন দারুণ অত্যাচার! কি করবে অতুল, একটু ভেবে বললে—আয় ঝাঁটাখাগী, ঝাঁটা যার কপালে থাকে তাকে বাঁচায় কে? আয়। একখানা কাগজ পড়ে অর্চনা বললে—এগুলো সেঁটে দেবে দেওয়ালে তো? আমি আঠা ক’রে এনে দেব! তারপর এই এক বছর কাকার ভাইঝি হয়েছেন।
সুরেশ্বর বললে—আজ জলে কি ফেললি অৰ্চনা?
অর্চনা হাসলে, কথার উত্তর দিলে না। মেজদি বললেন-ও বলবে না। অতুলের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছে। সে তোকেও বলবে না। ওরা যা করে তা আমিও সব জানি না সুরেশ্বর।
—ব্রজেশ্বরদা জানলে কি করে? সকালে সে তোমার সামনেই বললে!
অর্চনার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেল। সে এবার বললে-আমি ওকে বলি নি সুরেশ্বরদা। ও ধরে ফেললে। রাত্রে আমরা যখন গানবাজনা করছিলাম, তখন ছোটকা এসে একবার দরজার সামনে দাঁড়িয়েছিল। আমি বুঝতে পেরেছিলাম কিছু বলবে। মেজঠাকুমা যখন কেত্তন গাইছিল, তুমি বাজাচ্ছিলে, আমি সেই ফাঁকে উঠে গিয়েছিলাম, ছোটকা বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল, আমার হাতে পেন্সিলের মত পাকানো একটা চিঠি দিয়ে বলেছিল—পড়ে ছিঁড়ে ফেলিস। যা। বলে ও চলে গেল। আমি চিঠিখানা নিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে পড়ছিলাম। হঠাৎ ব্রজদা ঘরে ঢুকল। ও দেখেছিল। আমি কি করব, পিছন দিকে হাত নিয়ে চিঠিখানা কচলে ছুঁড়ে খাটের তলায় ফেলে দিলাম। ও সটান এসে খাটের তলায় ঢুকে চিঠিখানা তুলে নিলে। ধরা পড়ে গেলাম। চিঠিখানায় লেখা ছিল—কাল মিটিং করবই। পুলিশ নিশ্চয় আসছে, একটা মারধর ধরপাকড় হবে। সকাল থেকে আমার সময় নেই। পুলিশ গাঁয়ে ঢুকলে আমার ঘরের কোণের সেই কাগজগুলো সরিয়ে ফেলিস। আর মাকে সাবধান করিস। এইটে পড়ে ও বললে—তুইও ওর সঙ্গে এইসব করিস নাকি? বললাম—করি আর কি বড়দা, ও এইসব করে বেড়ায়, এ তো ভাল কাজ কিন্তু এ বাড়ীর তো কেউ তা মনে করে না। ওকে গালমন্দ করে। আমরা—আমি আর ঠাকুমা—শুধু ওকে ভালবাসি। ও পোস্টার লেখে আমি আঠা করে দি। কখনও আমিও কালি বুলিয়ে দি। আর ঠাকুমা ওকে দরকার হলে টাকা দেয়। এখানে ওখানে যায় ঘোরে। টাকা তো পায় না। ঠাকুমা দেয়। আর কিছু বলি নি সুরেশ্বরদা। ভগবানের দিব্যি ক’রে বলতে পারি।
মেজদি বললে—আর তুই সে কথাটা গোপন করিসনে অর্চনা। সুরেশ্বরকে বল। সে সর্বনেশে জিনিসগুলো ফেলে দেবার ব্যবস্থা কর। ধরা পড়লে সর্বনাশ হবে। তার ফাঁসি দ্বীপান্তর যা হয় হবে হোক। কিন্তু গোটা বাড়ীটা ধ্বংস করে দেবে রে। আর ও ঘরখানা সুরেশ্বরের।
চমকে উঠল সুরেশ্বর।
—কোন্ ঘর?
—যে ঘরে তোর ঠাকুরদা-আমার বড় ভাসুর মারা গিয়েছিলেন। শ্বশুরঠাকুরের খাস কামরা। যোগেশ্বর-ভাসুরপো যে ঘরখানা সাজিয়ে বসবার ঘর করেছিলেন। ঘরখানা কাছারির লাগোয়া, নিচের তলায়। ও ঘর ভাসুরপো খুড়োকে মানে তোর মেজঠাকুরদাকেও খুলে দেয়নি। ঘরটারও নাকি দোষ আছে। ঘরখানা তৈরী করেছিলেন শ্বশুর; তৈরী করতে লাগিয়ে তীর্থে গেলেন, ফিরে এলেন অসুখ নিয়ে; ওই ঘরেই শুলেন, তারপর মারা গেলেন। বড় ছেলেকে বলে গেলেন এখানে থাকতে, ওই ঘরেই শুলেন, তারপর ভাসুর, ওই ঘর তাঁকে দিয়ে গেলেন। ভাসুর একদিন সকালে, কি হল, কার সঙ্গে কলকাতা থেকে কে একটা ফিরিঙ্গী এল, তার সঙ্গে চেঁচামেচি করলেন, তারপর মাথা ধরে শুলেন। ওই ঘরেই। বেহুঁশ অবস্থা। তারই মধ্যেই রাত্রে ধড়মড় করে উঠে বললেন—ঠাকুরবাড়ী—ঠাকুর বাড়ী। নিয়ে চল। ওই নিয়ে গেল—শুইয়ে দিলে, প্রাণ বেরিয়ে গেল। ভাসুরপো যোগেশ্বর ঘরখানা ভাগে পেয়ে মেরামত করালে, সাজালে, কিন্তু বসে নি। ক’দিনের জন্য তোর মাকে নিয়ে এখানে এসে থেকেছিল; তোর মা সব কথা শুনে তাকে বসতে দেয় নি। তখন আমার বিয়ে হয় নি। অতুলের মা তখনও বেঁচে। আমি এসে অবধি ও ঘরে দুটো তালা লাগানো। তোর মেজঠাকুরদাও ও ঘরের তালায় হাত দেন নি। ভয় করতেন। সবাই ভয় করে রে এ বাড়ীর। ওই ঘরটায়—ওই ঘরটার একটা জানালার শিক কোথায় খোলা আছে অতুল বের করেছিল, নয়তো সে-ই শিকটা খুলেছিল। ওই ঘরে সে কিসব রেখে গেছে।
—কি অৰ্চনা? জানিস তুই?
—বোধ হয়—
—কি বোধ হয়?
অত্যন্ত মৃদুস্বরে অর্চনা বললে-রিভলভারের গুলী আর বোমা তৈরী করবে বলে জিনিস এনেছিল, সেইসব রেখে গেছে।
—ওই ঘরের চাবি কোথায়?
—সে তো তোর ওই চাবির সঙ্গেই থাকবে। সে তো ভাসুরপো কাউকে দেন নি। খুব বড় বড় দুটো তালা।
সুরেশ্বরের মনে পড়ল দুটো বড় চাবি তার সুটকেসের পকেটের মধ্যে আছে।
***
তালা খুলে কিন্তু ঢুকতে বারণ করলে অর্চনা। বললে-তালা-চাবি খুলো না সুরেশ্বরদা, লোক-জানাজানি হবে। বাড়ীর লোক শুনলেই উঁকি মেরেও দেখতে আসবে। ওদিকে ছোটকা বা ওদের কেউ মার খেয়ে যদি বলে ফেলে তবে মুশকিল হবে। তার থেকে আমি রাত্রে ওই শিক খুলে ঢুকে খুঁজে নিয়ে আসি। আমি কখনও ঢুকি নি ঘরে। তবে ছোটকা বলেছিল যে ঘরের একদিকে কতকগুলো বড় তাকিয়া আছে। ইঁদুরে কেটেছে। সেই কাটা তাকিয়ার ভিতরে প্যাকেট মুড়ে রেখে দিয়েছে! তাকিয়াটার গায়ে একটা সিঁদুরের ফোঁটা দেওয়া আছে।
সুরেশ্বর বললে—তাই হবে। তালা খুলব না। কিন্তু তুই ঘরে ঢুকবিনে। আমি ঢুকব। আমাকে শুধু দেখিয়ে দে, কোন্ জানালার কোন্ শিক খোলা আছে।
রায়বাড়ীর ঠাকুরবাড়ী, উত্তর-দক্ষিণে লম্বা। মাঝখানে নাটমন্দির ঘিরে উত্তরদিকে দক্ষিণদ্বারী কালীমন্দির। পশ্চিমদিকে লম্বা সেরেস্তাখানা। পূর্বদিকে স্বতন্ত্র একটা চত্বর গোবিন্দমন্দির। তার পাশে আলাদা ভোগরান্নার ঘর। দক্ষিণদিকে নাটমন্দিরের পর এক সারি ঘর। এই নাটমন্দির এবং দক্ষিণদিকের ঘরগুলির মাঝখানে সোজা প্রশস্ত বাঁধানো পথ চলে গিয়েছে ওই শখের বড় ঘরখানা পর্যন্ত। ঘরখানা দক্ষিণদ্বারী; ঠাকুরবাড়ীকে বাঁয়ে পূর্বদিকে রেখে, বলতে গেলে আলাদা চত্বর। সামনে সেকালে সুন্দর বাগান ছিল। দক্ষিণদিকে বাগানের অল্প উঁচু আলসের মত পাঁচিলের গায়ে আরও একটা ফটক। এই ফটক দিয়েই সেকালে সাহেবসুবা মুসলমান-ক্রীশ্চান অর্থাৎ এই গোয়ানরা আসবে বলে এই ব্যবস্থা করেছিলেন রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায়। ঘরখানার সামনে প্রশস্ত বারান্দা। গোল থামের সারির মাথায় ছাদ। থামগুলোর উপর দিকে সেকালে শৌখীন কাঠের ঝিলমিলি ছিল। বারান্দার কোণে সারি সারি তিনটে পাকা সেগুনের সুন্দরগড়ন মোটা তক্তার দরজা। মাঝখানের দরজায় মোটা পিতলের কড়ায় দুটো ভারী তালা ঝুলছে। তালাগুলোও পিতলের। বিলিতী কোম্পানীর সেকেলে দামী তালা। পশ্চিমদিকে উঁচু পাঁচিলঘেরা ফলের বাগান। কলমের আমের কয়েকটা গাছ এখনও আছে। একটা বুড়ো লিচু, দু’তিনটে জামরুলের গাছ আছে। এদিকে ঘরখানার দুটো বড় জানালা। পিছনদিকে রায়দের অন্দরমহল। মাঝখানে একটা গলি। এ দেওয়ালে একটা দরজা দুটো জানালা। এই দরজা দিয়েই অন্দরমহলে যাওয়ার ব্যবস্থা ছিল। কিন্তু এ দরজাটা গেঁথে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দিয়েছিলেন যোগেশ্বর রায়, সুরেশ্বরের বাবা।
মেজখুড়ো তাঁকে লিখেছিলেন—“তুমি তোমার অংশ সবই মেরামত করাইয়াছ। আমার অংশও মেরামত করাইব। এবং আমার অনেকগুলি সন্তান, তাহাদের জন্য নতুন ঘরেরও প্রয়োজন। সেইজন্য তোমার বাড়ীর কিছু কিছু ঘর আমি ব্যবহার করিতে চাই। ওখানে থাকিয়া মেরামত নির্মাণের কাজ শেষ করিয়া লইতে চাই।”
যোগেশ্বর সঙ্গে সঙ্গেই সম্মতি দিয়েছিলেন। কিন্তু কয়েক বৎসরেও যখন শিবেশ্বর দখলকরা ঘরগুলি থেকে সরবার বা নিজের বাড়ীতে আলাদা ঘর তৈরীর কোন লক্ষণই দেখালেন না, তখন এই ঘরখানার পিছনে দরজা তিনি গেঁথে বন্ধ ক’রে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় রায়বাড়ীর যে দরজাটা ছিল এই দরজার রুজুরুজু, সেটাও গাঁথিয়ে দিয়েছিলেন। ফলে এই মধ্যবর্তী গলিটা হয়ে গিয়েছিল অব্যবহার্য। এইদিকেরই দুটো জানালার মধ্যে একটা জানালার—একটা নয় দুটো শিক সুকৌশলে খুলত অতুলেশ্বর। জানালার কপাটগুলো খোলাই ছিল, লোক-দেখানো বন্ধ করা ছিল; ঠেললেই খুলে যায়। একটু জোরে ধাক্কা দিয়ে খুলতে হয়। বন্ধ করারও নিজস্ব কৌশল ছিল অতুলের। সেটা করত তারের আংটার সাহায্যে।
অতুলেশ্বর যখন এ ঘরে ঢুকেছে তখন রায়বাড়ীর ছাদের আলসের উপর ঝুঁকে অর্চনা পাহারা দিয়েছে। সে সব বেশ ভাল করেই জানে। সে ছাদ থেকে শুধু পাহারাই দিত না। নিচের মুখে গলিতে টর্চ ফেলে তাকে আলো দেখাত।
সুরেশ্বর বিস্ময়বোধ করছিল—এই আশ্চর্য সুন্দর এবং সুকণ্ঠের অধিকারিণী এই মেয়েটির দুঃসাহস দেখে।
ঘরে ঢুকে সুরেশ্বর টর্চ জ্বালালে। অর্চনা ছাদের আলসেতে ঝুঁকে পাহারা দিচ্ছে। আজ সে একা নয়, তার পিছনে মেজদি দাঁড়িয়ে আছেন। গলির মুখে দাঁড়িয়ে ছিল রঘু।
সুরেশ্বর তিন ব্যাটারীর টর্চটা জ্বাললে, মেঝের উপর ধুলো জমে আছে, আলোর ছটা মেঝের উপরে পড়লেও সচকিত চামচিকেগুলো ফরফর করে উড়তে লাগল। কতকগুলো ইঁদুর ছোটাছুটি ক’রে কোথায় কোন্ ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে গেল বা কিছুর মধ্যে ঢুকে লুকিয়ে গেল। টর্চটাকে নিচের দিকে ঘুরিয়ে সুরেশ্বর দেখে নিলে তাকিয়ার গাদা কোথায়। সামনে কয়েক পা দূরে ঘরখানার মাঝখানে একখানা শতরঞ্জি পাতা রয়েছে। চাদরও পাতা ছিল, সেখানাকে গুটিয়ে জড়ো করে দিয়েছে একদিকে। দেওয়ালের গায়ে শতরঞ্জির উপর পাতা ফরাসের চারিপাশে খানকতক ভেলভেটের গদিমোড়া চেয়ার সোফা। ধুলোয় বিবর্ণ হয়ে গেছে সব। ভেলভেটের রংটা কি ছিল ঠিক বোঝা যায় না। চারিপাশে তুলো ছড়ানো। টর্চটার আলো গিয়ে পড়ল পাশে একটা কোণে একটা টেবিলের উপর। তার উপর গোটাকতক তাকিয়া রাখা। অনেকগুলো। প্রকাণ্ড বড় বড় তাকিয়া। সেগুলো ধুলোয় ঢাকা পড়েছে। তার মধ্যে কোনটায় সিঁদুরের চিহ্ন আছে বের করা সোজা নয়। পকেট থেকে রুমাল বের করে সে ঝাড়তে শুরু করলে। রাশি রাশি ধুলো উড়ে আচ্ছন্ন ক’রে দিলে তাকে। কিন্তু বের করতেই হবে সব। অতুলেশ্বর এই রায়বংশের বোধ করি শেষ ঘৃতদীপ। সেটিকে নিভতে দেওয়া হবে না। তার সঙ্গে অর্চনা। রায়বংশে রূপ আছে। বেছে বেছে শ্রেষ্ঠ রূপের গোলাপে গোলাপে মিলন ঘটিয়ে এ রূপ তৈরী হয়েছে। রায়বংশের সব মেয়েই শ্রীমতীর চেয়েও কিছু বেশী সুন্দরী বললে বেশী বলা হবে না। অহঙ্কারের অসৌজন্য ঘটবে না। কিন্তু অৰ্চনা তাদের মধ্যেও সুন্দরী। সুরূপার মধ্যে অপরূপা। তার মুখের ছাঁচটা ঠিক রায়বাড়ীর ছাঁচ নয়। ছাঁচটা আলাদা। কিন্তু তা রায়বাড়ীর মুখের ছাঁচ থেকেও বোধ হয় নিখুঁত। রঙ তার সব থেকে গৌরী। কণ্ঠস্বর তার—।
ভাবনায় ছেদ পড়ল। মন থেমে গেল। তার চোখে পড়েছে একটা তাকিয়ার গায়ে একটা সিঁদুরের ফোঁটা। একটা কাটা জায়গায় তুলো বেরিয়ে আছে। সে তার মধ্যে হাত ভরালে। খুঁজতে শক্ত কিছু হাতে ঠেকল। ভাল করে ঠাওর করে দেখলে—হ্যাঁ, একটা প্যাকেট। বেশ বড় প্যাকেট। গোল একটা কি। একটা নয় দুটো একসঙ্গে বাঁধা। সে টেনে বের করে আনলে সেটাকে। ব্যাডমিন্টন শাটলকক রাখবার গোল কাগজের খোল, দুটো খোল একসঙ্গে দড়ি দিয়ে একটা করে বেঁধে রেখেছে। সেটাকে রেখে সে আবার খুঁজলে। কটা গোল লম্বা কিছু পেলে। একটা দুটো তিনটে চারটে। বের করে টর্চের আলোয় দেখেই সে বুঝতে পারলে বোমার খোল। দিশী হাতে তৈরী খোল। বাকী তাকিয়াগুলো সে প্রত্যেকটি টিপে হাতে তুলে ওজন দেখে নিশ্চিন্ত হল। তখন সর্বাঙ্গ তার ঘামে ভিজে গেছে। তার সঙ্গে ধুলো তুলো লেগেছে চুল থেকে পা পর্যন্ত সর্বাঙ্গে।
এতক্ষণে সে নিশ্চিন্ত হল।
একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে সিগারেট ধরাতে গিয়ে থমকে গেল। না। হয়তো কাল সকাল পর্যন্ত এ গন্ধ এ ঘরে ঘুরবে, অল্প অল্প করে বের হবে জানালা দরজার ফাঁক দিয়ে।
এবার সে ফিরবে। কিন্তু তার পূর্বে টর্চটাকে ছাদের দিকে ফেলে দেখলে। সারি সারি তিনখানা টানা পাখার ফ্রেম ঝুলছে। ছাদের পলেস্তারা দু-এক জায়গায় খসে পড়ছে মেঝের উপর। কড়িতে বর্গায় রং বিবর্ণ হয়েছে। এবং সমুদ্রের উপর মেদিনীপুরের নোনা জলো হাওয়ায় মরচে ধরেছে। টর্চের শিখার আলোকবৃত্তকে সে নিচে নামালে দেওয়ালের উপর। অবাক হয়ে গেল সে। বড় অয়েল পেন্টিং। ও কে? পূর্ণাবয়ব অয়েল পেন্টিং দামী সোনালী গিটির ফ্রেমে বাঁধানো। সামনের অর্থাৎ দক্ষিণদিকের তিনটে দরজার মাথায় তিনখানা ছবি। রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায়। রায়বাহাদুরের মেডেল বুকের উপর চাপকানে এঁটে মাথায় পাগড়ি পরে দাঁড়িয়ে আছেন থ্রোন জাতীয় চেয়ারের হাতল ধরে। মাঝখানে একটু উঁচুতে প্ৰকাণ্ড কালীমূর্তি। তেলরঙে আঁকা। ধুলো অনেক পড়েছে। তবু টর্চের জোরালো আলোয় এবং তেলরঙের গুণে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। চমৎকার কালীমূর্তি! ভাল এঁকেছে শিল্পী। তার ওদিকে কে? ও, রায়বাহাদুর-গৃহিণী সরস্বতী দেবী! জানবাজারের বাড়িতে বুক পর্যন্ত ছবি আছে। সে সবও অয়েল পেন্টিং। পশ্চিমের দেওয়ালে দুখানা। বীরেশ্বর রায়। সিংহের মত পুরুষ। কি দৃপ্ত দৃষ্টি! নাক একটু মোটা। তার পাশে—ভবানী দেবী! পূর্ণাবয়ব। চেয়ারের হাত ধরে দাঁড়িয়ে। সর্বালঙ্কারভূষিতা। এ সেই ছবি। ওই যে ডান হাতে ছ’টা আঙুল। কাল রাত্রে সে পড়েছে। ছটা আঙুল। বিড়বিড় করে সেই তান্ত্রিক পাগল বলেছিল—না, সে তো নয়। ছটা আঙুল, সে তো নয়। শ্যামবর্ণা অপরূপা শ্রীময়ী। বিস্মিত হয়ে গেল সুরেশ্বর। আশ্চর্য তো। হ্যাঁ। হ্যাঁ। অর্চনার মুখের আভাস যেন ফুটে উঠছে। হ্যাঁ! হ্যাঁ! রায়বংশের মুখের ছাঁচের সঙ্গে অর্চনার ছাঁচ আলাদা। সে তো এই ছাঁচ। সে শিল্পী। সে তো দেখছে, মুখের অবয়বের রেখাগুলি এমন কি নাকে এবং চোখের ঈষৎ বঙ্কিম টান আছে, তাও মিলে যাচ্ছে। অর্চনার ছটা আঙুল নেই। আর এই ভবানী দেবী শ্যামবর্ণা আর অর্চনা গৌরী। নীল অপরাজিতা আর শ্বেত অপরাজিতা।
হঠাৎ কিছুর শব্দে তার একাগ্রতা ভাঙল। জানালায় ঠক্ঠক্ শব্দ হচ্ছে। ছাদের টর্চের আলো এসে পড়েছে খোলা জানালা দিয়ে। একটা ঢেলা এসে পড়ল জানালায়।
সুরেশ্বর জানালার মুখে এসে দাঁড়াল।
উৎকণ্ঠিত মৃদুকণ্ঠের ডাক আসছে—সুরেশ্বর! ওরে—
—আঃ, ঠাকুমা!
সুরেশ্বর বুঝলে দেরী হয়েছে তার। সে তার টর্চের আলো বাইরে ফেলে ইশারা দিলে। তারপর মৃদুস্বরে বললে—যাচ্ছি আমি।
বেরিয়ে এল সে। জানালার ও-পাশেই জিনিসগুলো রেখেছিল। সেগুলো বের করে নিয়ে অর্চনার ফেলা আলোয় জানালার কপাট টেনে দিয়ে শিক দুটো টেনে বসাতে চেষ্টা করলে। অৰ্চনা বললে-ঠুকে দাও সুরেশ্বরদা। দেখ না, পায়ের কাছেই একটা পাথর পাবে। ঠুকে বসাতে হবে।
সুরেশ্বর ঠুকে শিক দুটো বসিয়ে তার হাতের টর্চটা অর্চনার মুখের উপর ফেললে।
অর্চনা বললে-কি হচ্ছে?
অবিকল সেই মুখ।