কীর্তিহাটের কড়চা – ৪.১১

১১

সেটেলমেন্ট অফিসার হরেন ঘোষ দলিল এবং ছাড়পত্র পড়ে বললেন—এ তো অদ্ভুত। দেখুন মশায়, আপনি দেখুন। দেখে বলুন, কি লিখব

সরকারী খাসমহলের কর্মচারী পড়ে দেখে বললেন—অদ্ভুতই বটে। বলে পুরনো বিবর্ণ কাগজখানা কপালে ঠেকিয়ে বললেন-সরকারী ইন্টারেস্টের কি হবে-না-হবে তা জানি না, তবে চোখে দেখে চোখ সার্থক হল। রাজা যদুরামের হাতের লেখা। এই ছাড়পত্রের কোন নজীর, কোন নাবুদ নেই গবর্নমেন্টের ফাইলে। আগে একবার প্রাইস সাহেব জরীপ করেছিলেন, তাতেও এর উল্লেখ নেই।

.

পারমানেন্ট সেটেলমেন্টের আগে সামন্ততন্ত্রের সামন্তরাজা রাজা যদুরাম। মাজনামুঠা পরগনা নিয়ে এগার পরগনার মালিক। এগার পরগনার রাজস্ব ছিল নামমাত্র। কয়েকশো টাকা। গোটা মেদিনীপুরের রাজাদের রাজস্ব ছিল নামমাত্র। কোম্পানীর প্রথম বন্দোবস্তে ঝাড়গ্রামের রেভেন্যু হয়েছিল মাত্র ৪০০ চারশো টাকা। তখন মীরজাফর আলী খাঁ মুর্শিদাবাদে নবাব।

রাজা যদুরাম সকালে উঠে ব্রহ্মত্র দান না করে জল খেতেন না। ব্রাহ্মণকে দান, বৈষ্ণবকে দান, পীরকে দান। নিত্য দান করতে করতে নিষ্করে ভরে গেল তাঁর পরগনার পর পরগনা জমিদারী।

পলাশীর যুদ্ধের জন্য কোম্পানীকে যে টাকা দেবার কথা, সে-টাকার জন্য মেদিনীপুরের খাজনা নবাব কোম্পানীকে জাঁত দিয়েছিলেন। কোম্পানী নবাবকে জানালে, রাজা এইভাবে লাখরাজ দিলে মেদিনীপুরের এগার পরগনা লাখরাজ হয়ে যাবে। নবাব খবর পেয়ে তলব পাঠালেন রাজা যদুরামকে মুর্শিদাবাদের দরবারে হাজির হতে। রাজা অমান্য করলেন না নবাবের হুকুম, মুর্শিদাবাদে হাজির হলেন এবং পরদিন দরবারে নবাবকে নজরানা পেশকশ দিয়ে অভিবাদন করে দাঁড়ালেন।

নবাব তাঁকে বললেন—আমার কাছে খবর এসেছে, খোদ ইংরেজ কোম্পানী জানিয়েছে আমাকে। শুধু কোম্পানী কেন? তোমার পুত্র কুমার জয়নারায়ণও দরখাস্ত দিয়েছে। খবর এই যে, নিত্য তুমি লাখরাজ দান কর। এই দানের ফলে তোমার জমিদারী এগার পরগনার খাজনা ঘাটতি হয়ে গিয়েছে। এখন আমার হুকুম, এইসব লাখরাজ তোমাকেই নাকচ করে জমা-বন্দোবস্তি করতে হবে। আর—তুমি আর কোন লাখরাজ দিতে পারবে না।

রাজা যদুরাম একমুহূর্ত ভেবে নিয়ে বললেন —মহামান্য নবাববাহাদুর, আমি তা করতে অক্ষম। আমি হিন্দু, দান করে সেই দান ফিরিয়ে নিলে শাস্ত্রমতে শুধু আমি নরকস্থ হব না, আমার পূর্বপুরুষরা নরকস্থ হবে। লাখরাজ যা দিয়েছি, তা ফিরিয়ে নেওয়া অসম্ভব। আর ভবিষ্যতে দান বন্ধ করতে বলছেন, তা-ও আমি পারব না। কারণ এই সংকল্প আমি ভগবানের নাম নিয়েই ইষ্টদেবতাকে সাক্ষী রেখে গ্রহণ করছি।

নবাব ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন—পারতেই হবে। আমার হুকুম।

—আমাকে মার্জনা করবেন জনাব আলী খোদাবন্দ, আমি অক্ষম।

–তুমি অক্ষম?

—আমি অক্ষম।

নবাবের ক্রোধের সীমা রইল না। হয়তো গর্দান নেবারই আদেশ দিতেন। কিন্তু নিষ্ঠুরতর শাস্তির কল্পনা তাঁর মগজে এল। তিনি বললেন—ভাল। দেখি তুমি কি করে তোমার সংকল্পে অটুট থাক।

বলে আদেশ দিলেন—গর্ত খুঁড়ে রাজাকে কোমর পর্যন্ত পুঁতে রাখ। যেন নড়তে না পারে। কোন লেখার সরঞ্জাম কাছে না থাকে। দেখি কেমন করে দান করে? জল খেতে চাইলে দেবে। আহার চাইলে দেবে। শুধু দান বন্ধ কর।

তাই নাকি হল। তাঁকে কোমর পর্যন্ত মাটিতে পুঁতে রাখা হল। সকালে সংবাদ শুনে অনেকজনে তাঁকে দেখতে এসেছিলেন। সামনে ছিলেন এক ফকির। তিনি ফকিরকে ডেকে বললেন—ফকিরসাহেব, আমার এই দান আপনি দয়া করে গ্রহণ করুন। বলে হাতে ছিল একটি আংটি, সেইটি খুলে দান করলেন। ওই আংটিটা খুলে নিতে ভুল হয়েছিল নবাবের নোকরদের।

তারপর তিনি বললেন—দাও, আমাকে খাদ্য দাও। জল দাও।

নবাব সংবাদ পেয়ে কর্মচারীদের তিরস্কার করলেন এবং বললেন—দেখ, আর দান করবার মত ওর কাছে কি আছে, তা তন্ন তন্ন করে খুঁজে দেখ।

তাই দেখা হল। আর কোন কিছু ছিল না। নবাব সংবাদ শুনে বললেন—ভাল। কাল! কাল তুমি কি কর, তা আমি দেখব।

পরদিন রাজা যা করলেন, তা পৃথিবীতে কেউ কোনদিন ভাবেনি।

সামনের জনতা থেকে একজন ব্রাহ্মণকে ডেকে বললেন-আপনাকে আজ আমি আমার জীবনের বোধ হয় শেষ দান করব। বলে- সামনের মাটির বুক থেকে ছিঁড়ে নিলেন দুর্বার একটি টুকরো। আর ব্রাহ্মণকে বললেন-ওই অশ্বত্থগাছের একটি পাতা আমাকে দয়া করে এনে দিন। ব্রাহ্মণ বুঝতে পারলেন না এই পাতায় কি হবে। তবু এনে দিলেন। রাজা পাতাটি হাতে নিয়ে কঠোর দংশনে নিজের জিভের ডগায় ক্ষতের সৃষ্টি করলেন, রক্ত বেরিয়ে এল, গড়িয়ে পড়ল মাটিতে। তিনি তখন সেই দুর্বার ডাঁটাটি রক্তে চুবিয়ে পাতার উপর লিখলেন- আমার নিষ্কর বাস্তুভিটা আড়াইশত বিঘা আপনাকে দান করে ধন্য হলাম। ইতি লিখিতং শ্রীযদুরাম রায়, সাকিম মাজনামুঠা কিশোরপুর। অতি সংক্ষিপ্ত দানপত্র। যত সংক্ষেপে লেখা যায়। যতটুকু কুলোয় ওই অশ্বত্থগাছের পাতায়। বললেন-এর তলায় আঠা দিয়ে কাপড়ের টুকরোর উপর এঁটে নেবেন।

লোকে স্তম্ভিত হয়ে গেল। সওয়ার ছুটে গেল নবাবের কাছে খবর নিয়ে। জনাব আলী, তাজ্জব কি বাত্—। ওই কাফের হিন্দু রাজা–।

নবাব শুনে অবাক বিস্ময়ে কিছুক্ষণ সওয়ারের দিকেই তাকিয়ে রইলেন। তারপর খোদার নাম নিয়ে উঠে নিজে এলেন সেখানে। এবং দাঁড়িয়ে থেকে রাজাকে মাটি থেকে তুলে সমাদর করে নিয়ে এসে, হিন্দু নোকর ডেকে স্নান করাতে হুকুম দিলেন। ব্রাহ্মণ পাচক দিয়ে রান্না করিয়ে খাওয়ালেন। তাঁর নিজে হাতে হুকুমনামা লিখে দিলেন রাজা যদুরাম রায়ের দেওয়া নিষ্কর কোনকালে কারও হুকুমে খারিজ বা বাতিল হবে না। এবং রাজাকে বললেন—রাজাসাহেব, গোটা দুনিয়া যদি খোদা তোমাকে দিতেন, তবে তাঁকেও বলতে হত, রাজা, দান করবে তুমি নিশ্চয়, কিন্তু দুনিয়ার জরীপ—মাপের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে দান করবে। আমার অনুরোধ হল, তুমি এরপর দিন পাঁচ বিঘার বেশী লাখরাজ দান করো না।

যে ব্রাহ্মণকে এই বাস্তু দান করেছিলেন, নবাব স্বয়ং তাকে ডেকে, অর্থ দিয়ে এক টাকা খাজনায় ওই রাজবাড়ী প্রত্যর্পণ করিয়েছিলেন যদুরামকে।

এ লাখরাজ সেই যদুরাম রায়ের। এ ঘটনার পূর্বের দান। এখানকার তারাদাস চক্রবর্তী ছিলেন সিদ্ধ তান্ত্রিক। ওই জঙ্গলের মধ্যে শিমুলতলায় তিনি সাধনা করে সিদ্ধ হয়েছিলেন। তখন এই জঙ্গলে চিতাবাঘের খুব উপদ্রব ছিল, তাই নামই হয়ে গিয়েছিল চিতার আড়ং, তা থেকেই নাম চিতারং—সাধারণ লোকে বলে চিত্রং।

চক্রবর্তী এই সিদ্ধপীঠে করে যখন সিদ্ধ হলেন, তখন সংবাদ শুনে লোক পাঠিয়েছিলেন তারাদাস চক্রবর্তীর কাছে। তাঁকে ভূমি দান করে ধন্য হবেন।

চক্রবর্তী চেয়েছিলেন ওই সিদ্ধপীঠের জঙ্গল—ওই শিমুলতলাটুকু। রাজা তাঁকে সমস্ত ছিটমহলটাই দান করে, এই ছিটমহলের অংশমত যে রাজস্ব, তা ‘মাজনামুঠা মৌজায় নিজের নিষ্কর খাস জমির উপর জমাপত্তন করে পূর্ণ করে দিয়েছিলেন।

ওই লাখরাজের অপূর্ণনামায় স্পষ্ট করে সে-কথা লেখা আছে।

“আপনাকে অত্র ছিটমহল ‘চিতারং’ ব্রহ্মত্র দান করিলাম এবং নবাবী সেরেস্তায় লিখিত যে একশত পাঁচ সিক্কা তঙ্কা রাজস্ব ধার্য আছে, তাহা নবাব বাদশাহ দরবারে পূর্ণ করিবার জন্য পরগনা মাজনামুঠা অন্তর্গত মৌজা মাজনামুঠার এলাকায় আমার স্বকীয় নামীয় নবাবী ফারমানযুক্ত লাখরাজ হইতে একশত বিঘা জমি একশত পাঁচ টাকা বারো আনা দশ গণ্ডা খাজনায় জমাপত্তন করিয়া দিলাম। সুতরাং ইহাতে রাজদরবার হইতে এবং মদীয় স্থলাভিষিক্ত ভবিষ্যৎ জমিদার কাহারও কোন আপত্তির কারণ থাকিবেক না। ইতি—দেবব্রাহ্মণসেবক শ্রীযদুরাম রায়, রাজা, পরগণা মাজনামুঠা, সাকিম কিশোরপুর, ফৌজদারী মেদিনীপুর, সুবা বাংলা।”

সেটেলমেন্ট ক্যাম্পের ভিতরে-বাইরে সমস্ত জনতা একটি আশ্চর্য পবিত্র আচ্ছন্নতায় আচ্ছন্ন হয়ে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিছুক্ষণের জন্য সেই বিচিত্র স্তব্ধতার মধ্যে কয়েকটা পাখীর ডাক ছাড়া আর কোন শব্দ শোনা যায়নি। একটা বেনে-বউ পাখী খুব কাছেই ডেকেছিল ঘনপল্লব একটা অশ্বত্থগাছের মধ্যে। বেনে-বউ পাখীর ডাকের মধ্যে যেন কথার আভাস আছে। স্থানীয় লোকেরা কেউ বলে—পাখীটা বলে, গেরস্তের খোকা হোক। কেউ বলে, না। বলে “কৃষ্ণের পোকা হোক।” কেউ কেউ বলে-না-না-না, তাই বলতে পারে? বলে—“কৃষ্ণ কোথা হে।”

কোন কৃষ্ণানুরাগিণী বৈষ্ণবী পক্ষী-জন্ম নিয়ে এই বলে কেঁদে বেড়াচ্ছে। খুঁজে বেড়াচ্ছে।

সুরেশ্বরের মনে হয়েছিল—পাখীটা আজ বলছে—“যদুরাম কোথা হে।”

বাকী সব স্তব্ধ। বিষয়ী মানুষের মনও একটা ভাবের নিস্তব্ধতায় মগ্ন হয়ে গেছে।

.

এ স্তব্ধতা ভঙ্গ করেছিল পিছন থেকে হলদী বা হিলডার কণ্ঠস্বর।

—হুজুরবাহাদুর! ডিটিসাব!

এতক্ষণে সচেতনতা ফিরে এসেছিল মানুষদের মধ্যে। তারা নড়তে-চড়তে শুরু করেছিল, মৃদু গুঞ্জনে কথাবার্তা কইতে আরম্ভ করেছিল। খাসমহলের তরফের সরকারী কর্মচারী বলেছিলেন—ওটার একটা কপি করিয়ে নথির সঙ্গে অ্যাটাচ করে দিন স্যার। মুল ছাড়পত্রে একটা সই দিন, ক্যাম্পের শীল দিয়ে দিন। আমি ওর একটা কপি নেব। কপির সঙ্গে সমস্ত লিখে রিপোর্ট করে দেব। মনে হয় এরপর আর কিছু হবে না। এইখানেই শেষ হয়ে গেল।

—অসারসাব! আমার লোকের কি হবে? বাবুলোকের লাখরাজ তো কায়েম হোয় গেল। আমরাদের?

হরেনবাবু বললেন তাঁর চাপরাসীকে—বুড়ীকে বল, কিছুক্ষণ সবুর করতে হবে।

***

এরপর স্তব্ধ জনতা গুঞ্জন করতে শুরু করলে।

কিছুক্ষণ ধরে বাইরে যদুরাম রায়ের কথাই উঠল, ক্যাম্পের সামনে সমস্ত বাগানটা জুড়ে। গাছের তলায় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জটলার মধ্যে যদুরাম, যদুরাম, যদুরাম। পাখীর ডাকের মধ্যেও যেন যদুরাম, যদুরাম।

সব থেকে মুখর বক্তা- দয়াল ভটচাজ।

—রায়ভটচাজ ছাড়পত্তরখানা আমার প্রপিতামহকেই দিয়েছিলেন। এই নিষ্কর ছিটমহল যখন চক্রবর্তীদের দৌহিত্রদের কাছে কিনলেন, তখন ওখানা চেয়ে নিয়েছিলেন। বলেছিলেন—নবাব নামে নবাব, মালিক ইংরেজ। কোম্পানীই এখন সুবার দেওয়ান। নবাবী আমল শেষ। বলতে গেলে এরাই রাজা। মুসলমানেরা এদেশে থেকে এদেশের সব কিছু কিছু মানত। মন্দির ভেঙেছে, ধর্মের ওপর অত্যাচার করেছে, তবু মেনেছে। এদেশে থেকে থেকে বুঝত। এরা কিন্তু মেলেচ্ছ। এরা ওসব মানে না। এসেছে টাকা লুটতে, টাকা টাকা আর টাকা, টাকা ছাড়া কিছু বোঝে না। আমি দেওয়ানী সেরেস্তায় কাজ করি। আমি জানি, ওরা এখন লাখরাজ ব্রহ্মোত্তর দেবোত্তর বাজেয়াপ্ত করবার ফিকির-ফন্দী খুঁজছে। আয় বাড়বে। এখন, ওখানা না থাকলে তো চলবে না। ওখানা দিতে হবে। দিয়েছিল তারা। সম্পত্তিই যখন বেচলে, তখন ছাড়পত্তর নিয়ে কি আর ধুয়ে খাবে? রায়ভটচাজমশায় কাকা হতেন, আমার প্রপিতামহ নকুল ভটচাজের ভাইপো। নিজে ওই জঙ্গল ১০০ বিঘে নিয়ে জমি পঁচিশ বিঘে কিনিয়ে দিলে ভাইপোকে। তখন ছাড়পত্তরখানা ভাইপোকে দিয়ে বলেছিলেন—এটা তুই রাখ নকুল। আমি বা আমার ছেলে, তারা লাখরাজ প্রমাণ করতে পারবে। তুই হয়তো কষ্টে পড়বি, বেগ পাবি। ওটা তুই রাখ। তোদের ঘরের লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে রেখে দিস। তাতে কলোণও হবে। বছর-কতক আগে লক্ষ্মীর ঝাঁপিটা পুরনো হয়ে ‘বাঁধন-টাধন খুলে খসে গেল। হাজার হলেও বেত তো। তখন বেরুল—কড়ি, সে-আমলের সিঁদুরমাখা টাকার সঙ্গে এই কাগজ। আমি বলি—কিছু মন্তরটন্তর লেখাটেকা আছে বুঝি। তা দেখতে গিয়ে দেখি, এই দলিল আর তার সঙ্গে এই ছাড়পত্তর। বুয়েছ।

ধনেশ্বর একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে বললে—আমাদের সব বড় বড় ঘর ভর্তি কাগজ, সিন্দুক ভর্তি দলিল, সব যে কোথায় গেল!

হাত দুটো উল্টে দিল এবং বার দু-তিন হতাশভাবে ঘাড় নাড়লে। তারপর বললে—লক্ষ্মী যখন ছাড়ে দয়াল-ঠাকুরদা, তখন শুধু তিনিই যান না, তাঁর আসার নজীরপত্তরও সব নিয়ে চলে যান। তখন দলিলদস্তাবেজে উই ধরে; কাগজ উড়ে বেড়ায় বাতাসে। সারের গোবর মাটির মধ্যে পড়ে পচে যায়।

সকলে চুপ হয়ে গেল। চুপ হয়ে যাবারই কথা। এত বড় রায়বাড়ী। দু-পুরুষ আগে রত্নেশ্বর রায়ের আমলের ঐশ্বর্যের কথা, খ্যাতির কথা সকলের কাছে গল্প-কথা হয়ে আছে। তাই বা কেন, এই শিবেশ্বর রায় মেজকর্তা যখন প্রথম এখানে কর্তা হয়ে বসলেন—তখনকার কথাও অনেকে দেখেছে। ধনেশ্বর রায়ের প্রথম যৌবনে ঘোড়ায় চড়ে বেড়ানো; টমটম হাঁকানো, তাঁর বিলাসের কথা সকলের মনে আছে। রায়বাড়ীর শখের থিয়েটারের কথা এখনও ভোলে নি লোকে। বাড়ীতে ডান্সিং মাস্টার, এখানকার গরীব ঘরের সুকণ্ঠ ছেলেদের সখীর ব্যাচ নিত, সন্ধ্যায় রিহারশ্যাল দিত; ঘুঙুরের ঝমঝম ঝমঝম শব্দ উঠত। গান গাইত। এ তো কথায় কথায় লোকে বলে থাকে। চাপরাসওয়ালা চাপরাসী। হিন্দুস্থানী দারোয়ান। লাঠিয়াল পাইক গমগম করত কাছারিতে। সেই বাড়ী দেখতে দেখতে কি হয়ে গেল। তলা ফুটো নৌকোর মত ভুস করে ডুবে গেল। কাগজপত্র শুধু উইয়ে খায় নি, অযত্নে অবহেলায় ছড়িয়ে পড়ে উড়ে গেছে। দলিলপত্র কে কোথায় নিয়েছে, গেছে, নষ্ট করেছে কেউ তার খবর জানে না। দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়বে বইকি!

দয়াল ভটচাজ বললেন-ভাই, আমাদের পুঁথি-পত্তরের অবস্থাও ওই হয়েছে। তোমাদের জমিদারীর কাগজ, আমাদের পুঁথি। পুঁথি কি কম ছিল রে ভাই। বেতের কাঠের প্যাঁটরাবন্দী একঘর পুঁথি। সে সব ওইভাবে গিয়েছে। আমার নাতির ছেলেরা ইংরিজী ইস্কুলে পড়ে। তারা লাইবারি করবার জন্যে পুঁথিগুলোকে ফেলে দিয়েছে। কতকগুলো পুঁথিতে রঙচঙে কাঠের পাটার মলাট ছিল, সেগুলো নিয়ে রুল টানবার রুল করেছে। দলিলগুলো বাক্সতে আছে। আরও দুখানা ছিল লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে, আমার চোখে পড়েছিল বলে রেখেছিলাম।

সুরেশ্বর বসে ভাবছিল—ওখানা পেলে সে রূপো কি সোনার ফ্রেম করে বাঁধিয়ে রেখে দেয়। ভাবছিল, অন্তত ওটার ফটো সে তুলে নেবে। ভাবছিল, কিশোরপুরে গিয়ে যদুরামের ভাঙা বাড়ী দেখে আসবে। সেখানকার ইট-খিলেনের পলেস্তারায় যদি কোন লতাপাতা দেবমূর্তি আঁকা কারুকার্য পায় সংগ্রহ করে নিয়ে আসবে। ভাবছিল, যদুরাম রায়ের বংশধরেরা যদি কেউ থাকে। ভাবনার মধ্যপথে মনে পড়ল—সম্পত্তি গিয়েছিল তাঁর দৌহিত্র বংশে। তাঁর একমাত্র ছেলের একমাত্র নাবালক সন্তান মারা গেলে সম্পত্তির মালিক হয়েছিলেন যদুরামের নিঃসন্তান পুত্রবধূ সুগন্ধা দেবী। হঠাৎ মনে হল—চমৎকার নামটি তো! সুগন্ধা দেবী। একালে সুলতা, সুপ্রিয়া, মঞ্জু, মঞ্জুলিকা, এণাক্ষী, মীনাক্ষীর যুগে সুগন্ধা নামটি আশ্চর্য মিষ্টি এবং আশ্চর্য আধুনিক। ভাবছিল, সুলতাকে নামটা উপহার দেবে। সুলতা আছে থাক, সে তাকে সুগন্ধা বলে ডাকবে, চিঠিতে সম্বোধন করবে।

না। হঠাৎ মনে পড়েছিল, পিদ্রু গোয়ান খুন করেছিল ঠাকুরদাস পালকে। ঠাকুরদাস পাল সুলতার পূর্বপুরুষ। পিদ্রু গোয়ানের মামলায় রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায় পিদ্রুকে বাঁচাবার জন্য কয়েক হাজার টাকা খরচ করেছিলেন। পিদ্রুর কন্যা ওই হলদী বুড়ী হিলডাকে তিনি জমি দিয়েছিলেন। হিলডাকেই দিয়েছিলেন গোয়ানপাড়ার মণ্ডল অর্থাৎ প্রধানের পদ!

তাহলে? চকিতে একটা কথা মনে হল সুরেশ্বরের। সে এই ক’ মাসের মধ্যে জমিদারীর অনেক কিছু শিখেছে, বুঝেছে। তাহলে তো ধনেশ্বর-কাকা যা বলছেন তাই তো সত্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায়ের ভূস্বামীত্ব না থাকলে, গোয়ানপাড়ার ভূমির উপর জমিদারীত্ব না থাকলে কি করে তিনি হিলডাকে মণ্ডলের পদ দিতে পারেন? লাখরাজ স্বত্বের মালিক যখন লাখরাজ দেবেন, তখন মূল স্বত্ব চলে যাবে। বিক্রীর সামিল হবে। সুতরাং একটা কিছু দেনা-পাওনা ছিল। দেনা-পাওনার মধ্যেই জমিদার-প্রজা সম্বন্ধ! ছিল, একটা কিছু ছিল। চাকরান হওয়াই সম্ভব! তা হলে?

হিলড়া একটু দূরে বসে অনর্গল বকে যাচ্ছে। কানে আসছে সুরেশ্বরের

—হ্যাঁ রে বাবা, হ্যাঁ। দুনিয়ার হাল, কাজের সময়মে কাজী, কাজ হয়ে গেলো তো পাজী। আজ দরকার নেই। গোয়ানদিগে লিয়ে দরকার নেই। বাবুদের অভাব হল। এখন খাজনা বসাও! গোয়ান লোকের উপর খাজনা বৈঠাও। বাস। উ আমরা লোক দিব না বাবা। হ্যাঁ দিব না। ‘আতুল’বাবু ঠিক বাতায়েছে। এহি তো সরকারী টেক্সো আজ দিচ্ছে না লোক, কি করছে সরকার? ই তো জিমিদার। আমরা লোক-ভি দিব না। কংগ্রেসি বানাইব গোয়ানপাড়ায়। ই-ই-কুইনিকে সিকিটারী বানাইব। উ তো বুঝে। সমঝে সব। লিখাপড়ি জানে।

কে যেন কি বলতে গেল। হিলডা হাত তুলে তাকে শাসিয়ে ধমক দিলে,—চুপ। বেতমিজ কাঁহাকা! বাতের উপর বাত বলে!

হঠাৎ একটা কথা সুরেশ্বরের মনে হল। হ্যাঁ, হয়তো হতে পারে তা! সে সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। হন হন করে এগিয়ে গিয়ে ধনেশ্বর-কাকাদের জটলার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে ডাকলে, কল্যাণেশ্বর!

সুখেশ্বর রায়ের ছেলে কল্যাণেশ্বর। ব্রজেশ্বরদা বলেছিল—সুখেশ্বর-কাকা ছিলেন বিষয়- বুদ্ধিতে ডক্টরেট উপাধিধারী। ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট হয়ে বেনামীতে ইউনিয়ন বোর্ডের ইঁদারা, কালভার্ট ঠিকে নিতেন। ভারতবর্ষের নানান রাজ-রাজড়াদের চিঠি লিখতেন, কুমার সুখেশ্বর রায় নাম সই করে। লিখতেন, সর্বস্বান্ত রাজবংশের সন্তান আমি, অভাবগ্রস্ত, সাধারণের কাছে সাহায্য চাইতে মর্যাদায় বাধে। দেব-সেবা চালাতে হয়। কখনো লিখতেন, আমি কন্যাদায়গ্রস্ত। কখনও লিখতেন, আমার পিতৃশ্রাদ্ধ। কখনও লিখতেন, আমি আজ কঠিন রোগে শয্যাশায়ী, চিকিৎসার খরচ নেই। আপনি রাজা। ঈশ্বর আপনার কল্যাণ করুন, রাজ্যের শ্রীবৃদ্ধি হোক, এই নিঃস্ব সর্বস্বান্ত, মাত্র বংশ গৌরব সম্বল এই হতভাগ্যকে রাজোচিত সাহায্য করিবেন বলিয়া আশা করি। সই করতেন—Kumar Sukheswar Roy, Prince of Kirtihat। কল্যাণেশ্বর তাঁর উপযুক্ত পুত্র। সে এখন কন্ট্রাক্টারি করে; বাড়ী-ঘর কন্ট্রাক্ট নিয়ে এজমালী গাছ কেটে তার তক্তা থেকে দরজা জানলা সরবরাহ করে। সে ধনেশ্বর-প্রণবেশ্বর প্রভৃতির চক্রান্তের মস্তিষ্ক। কথায় ভদ্র, শুধু ভদ্র নয়, পারঙ্গম। ব্রজেশ্বরের পারঙ্গমতা অন্য ধরনের, তার মধ্যে মিষ্টতা, আমিরি আছে, কিন্তু উদ্ধত আভিজাত্যের উষ্ণ সম্ভ্রম নেই। এর সেইটে আছে। সে বিশিষ্ট কেউ একজন এবং ন্যায় ও সত্যপরায়ণ উন্নতশির কেউ বলে প্রমাণ করতে পারে।

কল্যাণেশ্বর তাকালে, বললে-কি? আমাকে ডাকছ?

—হ্যাঁ। একটা কথা আছে।

সে উঠে এল। বললে—বল।

—একটু ওদিকে চল, নিরিবিলিতে।

একটু সরে এসে একটা গাছতলায় দাঁড়িয়ে সুরেশ্বর বললে —আমার একটা প্রস্তাব আছে।

—প্রস্তাব? মুখের দিকে তাকিয়ে সে বললে —গোয়ানদের লাখরাজ স্বীকার করতে বলছ তো? কিন্তু আমরা স্বীকার করলেও তা দাঁড়াবে না। তা হলে বলতে হবে, ও লাখরাজ আমরা ওদের দান বা বিক্রী করেছি। কোন রকম বাধ্য-বাধকতা ওদের সঙ্গে আমাদের ছিল না, বা নেই। সে তুমি অতুল কোর্টের কাছে বললেও তা হবে না।

—সে আমি জানি বা বুঝি!

—না। তুমি ঠিক বোঝ না সুরেশ্বরদা। বিষয় খুব জটিল জিনিস। তাছাড়া প্ৰজাটুজা নিয়ে চরাও নি, নাড়-চাড় নি; কোথায় কোন্ ফাঁক তা তোমার জানা নেই। আমাদের কিছু প্রমাণ করতে হবে না। ওরা নিজেরাই প্রমাণ করে দেবে। ওদের গ্রামের চার্চের প্লট এলেই ঝগড়া বাধবে। গোয়ানেরা বলবে, সর্বসাধারণের। হিলডা চেঁচাবে—না, এটা আমার নামে রেকর্ড হবে। ঐ জমিন গ্রামের মণ্ডল হিসেবে রায়বাবুরা আমার বাবা-দাদাকে মণ্ডল করে দিয়ে দিলে। আমরা জমিদার, মণ্ডল আমরা নিযুক্ত করেছি। প্রমাণ হয়ে যাবে। তোমার অনেক আছে। তুমি ছেড়ে দিতে পার। কিন্তু আমরা কোথায় ছাড়তে পাব, বল? অন্ততঃ একশো টাকা খাজনা ধার্য হয়ে যাবে। তোমার দুয়ের-তিন; আমরা একের-তিনে বছরে তেত্রিশ টাকা পাঁচ আনা ছ গণ্ডা দু কড়া দু ক্রান্তি পাব। সেটা আমাদের কাছে অনেক। ওর দাম বিশগুণা পণে ছশো সাতষট্টি-আটষট্টি টাকা দাঁড়াবে। মাফ কর, ও হয় না।

সুরেশ্বর জুতোর ডগা দিয়ে মাটিতে দাগ কেটে ছবি আঁকছিল। পৃথিবীতে হাত পঙ্গু বা হাতকাটা কিছু চিত্রকরেরা পায়ে তুলি ধরে ছবি আঁকে। কেউ কেউ বা দাঁতে তুলি ধরে আঁকে। সে মধ্যে মধ্যে পায়ের ডগায় ধুলোর ওপর ছবি আঁকে; সে শুনছিল আর ছবি আঁকছিল। আঁকছিল গোয়ানপাড়ার ছবি, যেমনটা সে নদীর এপার

এপার থেকে গোয়ানপাড়াকে দেখেছে-বিবিমহলের ছাদের গোল ছত্রিঘর থেকে দেখেছে। কল্যাণেশ্বরের কথা সে বিশেষ মন দিয়ে শুনছিল না। কল্যাণেশ্বরের মুখে-মুখে হিসেবের অঙ্কের নির্ভুলত্ব তার মনকে আকর্ষণ করতেই পারে নি। সে ছবি আঁকছিল জুতোর ডগা দিয়ে আর ভাবছিল, কিভাবে প্রস্তাবটা উত্থাপন করবে! কেমন করে বলবে, ঠিক এই সময়টিতেই কল্যাণেশ্বর বললে, বিশগুণো পণে ওদের অংশের ওই পাড়াটার মূল্য হবে ছশো সাতষট্টি-আটষট্টি।

সঙ্গে সঙ্গে সুরেশ্বর বললে—ওই টাকাটা ওরা দিলে স্বীকার করে নিতে আপত্তি হবে তোমাদের?

—আপত্তি? না, তা হবে কেন? সত্য কথা বলতে বেগার আজকাল আর পাওয়া যাবে না, দেবে না। কংগ্রেসওলারা যা করলে না, তাতে আর কোন জমিদারই জমিদারী চালাতে পারবেন না। গভর্নমেন্টের চৌকিদারী ট্যাক্স, তাই দিচ্ছে না। এর পর বলবে, কোন খাজনাই দেব না। সুতরাং টাকা পেলে আপত্তি করব কেন? দেখ না, ওদের বল না। রাজী হয় তো ভালই! টাকা কিন্তু আগে চাই!

—টাকা তোমাদের আমি দিচ্ছি, এক্ষুনি দিচ্ছি। তবে চেক দেব। বিয়ারার চেক, মেদিনীপুর ব্যাঙ্কেও আমার এ্যাকাউন্ট আছে। সেখানকার চাও, কলকাতার চাও দিয়ে দিচ্ছি!

কিছুক্ষণ ওর মুখের দিকে সবিস্ময়ে তাকিয়ে রইল কল্যাণেশ্বর, তারপর একটু মুখ মটকে হেসে বললে—আচ্ছা, বলে দেখি জ্যাঠামশাইকে।

চলে গেল সে। সুরেশ্বর ফিরে নিজের সতরঞ্চিতে বসে নায়েব ঘোষালকে ডেকে সমস্ত বলে বললে-আপনি বিবেচনা করে কিভাবে কি করতে হবে ব্যবস্থা করে ফেলুন। যেন কোন দিকে ফাঁক না থাকে।

নায়েব একটু চুপ করে থেকে বললে-গোয়ানরা কিন্তু তাহলে আর কাউকে মানবে না!

সুরেশ্বরের মনে তখন যদুরাম রায়ের ছোঁয়াচ লেগেছে। সে বললে—না মানুক।

নায়েব ঘোষাল ফিরে এসে বললে—ওঁরা তো নতুন সুর তুলেছেন।

—নতুন সুর? কি? টাকা বেশী চাচ্ছেন?

—হ্যাঁ, টাকাই আসল কথা। বলছেন—ওই গোয়ানরাই ওখানকার বাস্তুর প্রজা। তা ছাড়া বাকীটা জঙ্গল। সিদ্ধপীঠ। ওর আয় এক পয়সা নেই। অথচ গভর্নমেন্টের সেস আছে, দিতে হবে। সে তো ঘর থেকে গোনা। তাহলে তোমার বাবুকে বল ওই জঙ্গল-টঙ্গল নিয়ে গোটা লাখরাজের অংশটাই নিয়ে নেন। আবার দামের বেলা বলছেন-মূল্যবান গাছ আছে। তার মূল্যও আছে।

মাথার ভিতরটা চন-চন করে উঠল সুরেশ্বরের। কিন্তু তার মনের মধ্যে তখনও রাজা যদুরাম রায়ের একটি কাল্পনিক মূর্তি ভাসছে। ক্রোধ তার সঙ্কল্পকে দৃঢ় করে দিলে। সে বললে—ডাকুন কল্যাণকে, ডাকুন।

নায়েব ডাকতে যাচ্ছিল, কিন্তু সে বিলম্ব তার সইল না। সে নিজেই এগিয়ে গেল। ওদের ওখানে গিয়ে বলল- নায়েবাবু সব বলেছেন আমাকে। বেশ তো তাই রাজী আছি, সমস্ত একশো আট বিঘের আপনাদের একের-তিন আমি কিনতে রাজী আছি। বলুন, কত চাচ্ছেন আপনারা।

ধনেশ্বর থিয়েটার করে উঠল-ও-হো, ও-হো, অ-হো কি মহৎ, কি মহিমা! ধন্য ধন্য ধন্য। এ যুগে তুমি ধন্য! হয়তো যদুরাম রায় জন্মান্তরে তুমি হয়ে ফিরে এসেছ। এই দান এও ভূমিদান। দেকুন, সকলে দেখুন!

লজ্জায় ক্রোধে লাল হয়ে উঠল সুরেশ্বর। তবুও সে নিজেকে সম্বরণ করে বললে—মহৎ আপনারাও কম নন। আপনাদের মহত্ত্ব থেকেই আমার মহত্ত্ব। কিন্তু ও কথাগুলো এক্ষেত্রে অবান্তর ধনেশ্বর-কাকা। চেঁচামেচি না করে কাজটা শেষ করে নিন।

কল্যাণেশ্বর ধমক দিলে ধনেশ্বরকে—জ্যাঠামশাই! আপনার মস্ত দোষ, আপনি যখন-তখন স্থান-কাল বিচার না করে অ্যাক্টিং শুরু করে দেন। বসুন আপনি চুপ করে। যা করবার আমি করছি!

কল্যাণেশ্বর বললে—দাম সুরেশ্বরদা উনি একটু অবুঝের মত চাচ্ছেন। আমি বুঝিয়ে বললাম, কিন্তু উনি-মানে গরজটা তোমার বুঝেছেন। বলছেন, দুটো মানে জঙ্গল আর গোয়ানপাড়া মিলিয়ে দুটোর—দাম একের-তিন অংশে দু হাজার টাকা চাচ্ছেন।

সুরেশ্বর একটি রোমাঞ্চকর স্বপ্নলোকে বিচরণ করছিল। অর্থাৎ তার অভাব নেই। কোটি নেই, পঞ্চাশ লক্ষও নেই, দশ লক্ষও নেই, তবু কয়েক লক্ষ আছে ব্যাঙ্কে। যা ফুরোতে তার জীবন কেটে যাবে। তার উপর বছরে নির্দিষ্ট আয় আছে, যার পরিমাণ বিশ হাজারের কম নয়। এখনও সে সংসারে একা মানুষ। বিচিত্র খেয়ালে খেয়ালী। আজ তাকে যদুরামের খেয়ালে পেয়ে বসেছে। হলদীবুড়ী হিলডা রায়বংশের যে দুর্নাম করছে, সে দুর্নাম সুরেশ্বরকে স্পর্শ করেছে। সে বীরেশ্বর রায়ের স্মরণীয় ঘটনা পড়ে শেষ করতে পারে নি, তবে এটা বুঝেছে, বীরেশ্বর রায় যখন এদের এখানে বসিয়েছেন, তখন নিশ্চয় তিনি এদের কাছে ঋণী। রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায়ের ঋণের সে আভাস পেয়েছে। পিদ্রু ফাঁসি গিয়েছে খুন করে। আজ সে ঋণ শোধ করবে। দু হাজার টাকা দাম শুনে সে ভ্রূকুঞ্চিত করলে না, বিরক্ত হল না, বললে—বেশ তাই নাও। চেক লিখে দিচ্ছি আমি।

নায়েব ঘোষাল বললে—একখানা দলিল তো করতে হবে! বিনা দলিলে—

—দলিল এক্ষুনি হতে পারে না?

—এক্ষুনি? তা কি করে, মানে—

কল্যাণেশ্বর বললে—স্ট্যাম্প, কাগজ আমার কাছে আছে। আমি রাখি। দলিল হবে না কেন বলছ ঘোষাল। হয়ে যাক না। ও তো সব এক প্লটে রেকর্ড হয়েছে। একশো আট বিঘে প্লট। গোয়ানদের অধীনস্থ চাকরানভোগী হিসেবে খতিয়ান হয়েছে। বিক্রী দলিল এক কলমে হয়ে যাবে। আর বয়ান কতটুকু। সংক্ষেপ করে লিখলেই হবে।

—কিন্তু জগদীশ্বরবাবু নেই। তিনি তীর্থে গিয়েছেন।

—তিনি আমমোক্তারনামা দিয়ে গেছেন তাঁর বড় ছেলেকে। তিনি সই করবেন।

সুরেশ্বর বললে—করে নিন। তাই করে নিন। ও কাজ আজই শেষ করব আমি। বলে সে ডাকলে, রঘু! পোর্টফোলিওটা দে।

রঘু বসেছিল একটু দুরে, তার কাছে ছিল জলের কুঁজো গ্লাস, টিফিন-কেরিয়ারে খাবার, পোর্টফোলিও।

রঘু পোর্টফোলিওটা এনে দিল। সুরেশ্বর চেক বই বের করে বললে—মেদিনীপুরের ব্রাঞ্চের চেক দি।

কল্যাণেশ্বর বললে–হাঁ, তাই দাও। আর বেয়ারার চেক দাও। ভাঙাতে সুবিধে হবে। ইতিমধ্যেই বিমলেশ্বর, কমলেশ্বর এবং অতুলেশ্বর এসে দাঁড়িয়েছিল কাছে। অতুলেশ্বর বললে—চেক কিন্তু নামে নামে দাও সুরেশ্বর। এক জায়গায় হলে আমাদের পক্ষে অসুবিধে হবে। কল্যাণেশ্বর ভ্রূকুঞ্চিত করে বললে-এখানে এই দশজনের সামনে ভাগাভাগি কর না ছোটকা। লোক হাসিও না!

শিবেশ্বর রায়ের দুই স্ত্রীর গর্ভে সন্তান হয়েছিল, ষোলটি তার মধ্যে আটটি পুত্র চারটি কন্যা জীবিত। প্রথম স্ত্রীর পুত্র ধনেশ্বর, সুখেশ্বর, জগদীশ্বর, সমরেশ্বর আর দ্বিতীয়া পত্নীর গর্ভের বিমলেশ্বর, কমলেশ্বর, অতুলেশ্বর। শিবেশ্বর থাকতেই প্রথম পক্ষের পুত্র তিনজন আপনাপন পরিবার নিয়ে পৃথক। দ্বিতীয় পক্ষের বিমলেশ্বর খানিকটা উদাসী মানুষ, সে ঘুরে বেড়ায় স্থানীয় তীর্থে-তীর্থে, কমলেশ্বর গাঁজা খায় মদও খায়। লোকের ছাগল গরু পেলে বেচে দেয় পাইকারদের। কখনও কখনও গাছও বেচে দেয় সকলের অজ্ঞাতে। বিমলেশ্বরের সংসার আছে কিন্তু ছোট দুজন বিবাহ করেনি। তারা দুজনেই সুরেশ্বর থেকে বয়সে ছোট। ধনেশ্বর সুখেশ্বর, জগদীশ্বর এদের জন্মকাল থেকে অবজ্ঞা করে এসেছে। এরাও তাদের বিরোধী। তাদের আশঙ্কা, চেক ধনেশ্বরদের হাতে পড়লে টাকা তারা পাবে না। বাড়ী মেরামত, এজমালী মামলা খরচ, পিতৃশ্রাদ্ধ অর্থাৎ শিবেশ্বরের শ্রাদ্ধ এই নিয়ে তারা টাকা কেটে নেবে।

অতুলেশ্বর বললে—কল্যাণ, লোকে হেসে হেসে ক্লান্ত হয়ে গেছে। আর তারা হাসবে না। চেক তুমি ছখানাই লেখো সুরেশ্বর। তা নইলে আমরা অন্তত সই করব না।

কল্যাণ বললে—তাহলে তাই করো। কি বলব?

সুরেশ্বর কোন কথা বললে না, সে চেক লিখতে বসল। নাম লিখে দু হাজার টাকা ছ ভাগ করতে গিয়ে থমকে গেল। তিন ছয়ে আঠারো। বাকী দুশোকে ছ ভাগ। মনে মনে বার কয়েক ভাগ করে মেলাতে না পেরে বললে—কত হবে কল্যাণ?

কল্যাণ বললে—লেখ না সাড়ে তিনশো করে। একশো টাকাই বেশী যাবে তোমার।

অতুলেশ্বর বললে—তিনশো তেত্রিশ টাকা পাঁচ আনা চার পাই হবে সুরেশ্বর। লেখ। ছখানা চেক লেখা শেষ হলে সে বললে—এই নাও, অতুলকাকা। তুমিই নাও, সব দিয়ে দাও। এতক্ষণে নায়েব ঘোষাল বললে, তাহলে রেজেস্ট্রির কথাটা কয়ে নিন। এর পর- কল্যাণ ভ্রূকুঞ্চিত করে ক্ষুব্ধকণ্ঠে বলে উঠল-এতখানি অবিশ্বাসের কথা কেন উঠছে সুরেশ্বরদা? না-না-না। এ—। এ কি? সই হয়ে গেছে দলিল, সাক্ষী-সাবুদ সই করেছে। সেটেলমেন্ট ক্যাম্পে দাখিল হচ্ছে, হাকিম দেখে এ্যাটেস্ট করে দিচ্ছেন-রেকর্ড সংশোধন হয়ে যাচ্ছে। এর চেয়েও কি রেজেস্ট্রি বেশী? আর আমরাও রায়বংশের ছেলে। সুরেশ্বরবাবুও যা আমরাও তাই। তফাত উনি ধনী, আমরা গরীব হয়ে পড়েছি। তা ছাড়া কথা যেখানে খোদ রায়বংশের ছেলেতে ছেলেতে হচ্ছে, তার মধ্যে কর্মচারী, সে নায়েব হোন আর ম্যানেজার হোন, কেন কথা বলবেন? এ কি কথা?

অভুলেশ্বর বললে—বেশ তো, থাক না। চেক ফেরত দাও। দলিল ছিঁড়ে ফেল। দরকার কি? রাখ।

সুরেশ্বর উঠে দাঁড়িয়ে বললে-না-না-না। ওঁর হয়তো ভুল হয়ে গেছে, হয়তো উনি কথাটা আমাকে বলতে পারতেন। তবে উনিও গ্রামের লোক, প্রবীণ মানুষ। নাও কাজটা সেরে ফেল। ওরা চলে গেল। সুরেশ্বর চোখ বুজে গাছের গুঁড়িটায় ঠেস দিয়ে বসে রইল। আজ দিনটা যেন বড় ভাল লাগছে। জীবনে এমন দিন একটা-আধটা আসে। যদুরাম রায়। রাজা যদুরাম রায়। রাজার গল্প শুনে সে যা করলে, তার মূল্য হয়তো অনেক হবে। কাল সারারাত বীরেশ্বর রায়ের স্মরণীয় ঘটনাপঞ্জী পড়ে শেষ করতে পারে নি। তিনিই এনেছিলেন এই গোয়ানদের। কেন এনেছিলেন সে কথা আজ জানতে পারবে। হয়তো তাঁর প্রজামেধ যজ্ঞে সমিধ সংগ্রহের জন্য এদের এনে বসবাস করিয়েছিলেন। হয়তো ওঁদেরও দু-চার-দশজন যজ্ঞে বলি হয়ে গেছে। রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায়ের প্রিয়পাত্র ঠাকুরদাস পাল —সুলতার পূর্বপুরুষকে—

—সালাম রাজাবাবু! বহুৎ-বহুৎ সালাম!

চোখ মেললে সুরেশ্বর। হিলডা দাঁড়িয়ে আছে সামনে। তার পিছনে গোয়ানেরা। হিলডার মুখখানার উপর বেলা তৃতীয় প্রহরের রোদ এসে পড়েছে। সে রৌদ্রে তার মুখে আঁকা মাকড়সার জালের মতো রেখাচিহ্ন আশ্চর্য স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে। তার পাশেই দাঁড়িয়ে সেই কিশোরী মেয়েটি, সেই কুইনি। তার মুখেও রোদ পড়েছে। রৌদ্রক্লিষ্টতার মধ্যেও তার কিশোর লাবণ্য যেন ঝলমল করছে। একটি পেলব লাবণ্য রয়েছে মেয়েটির মুখে। চমৎকার ছবি হয়। নাম দেওয়া যায় সকাল-সন্ধ্যা, এপার-ওপার। অনেক নাম হয়।

হিলডা তখন আপন মনেই বলছিল—আপনে সব কিনে নিলে রাজাবাবু। ই আচ্ছা হল। বহুৎ আচ্ছা, বহুৎ ভালা হল। আপনে রাজা আদমী, আমীর লোক। আমাদের বাড়ী-ঘর বিলকুল নাখরাজ করে দিবে। অতুলবাবু বলেছে সব। আমরা লোক আপনের নাম করব। কাম করব। যখুন বোলাবেন কাম করব। ই তো ভোট আসছে বাবু। ভোট হবে। ইবার আপনে খাড়া হয়ে যাও বাবুসাহেব। আমরা লোক বিলকুল ভোট দিব।

—হ্যাঁ হুজুর, আপনে খাড়া হয়ে যান।

সুরেশ্বর শেষ কথাগুলো শুনে চকিত হয়ে উঠল। ভোট? ইলেকশন? সঙ্গে সঙ্গে হাসিও পেল তার। চমৎকার পন্থা পেয়েছে এরা প্রতিদানের। ভোট! সে হেসেই বললে—না হিলডা, ভোটে আমি কোনদিন দাঁড়াব না। ভোট আমাকে দিতে হবে না।

অবাক হয়ে গেল হিলডা। সঙ্গে সঙ্গে সমস্ত গোয়ানরা। বিচিত্র এই রায়বাবুর এমন সুন্দর ছেলেটি ভোটও চায় না!

কুইনি এতক্ষণে কথা বললে—আপনি বুঝি কংগ্রেসের হয়ে দাঁড়াতে চান না স্যার?

সুরেশ্বর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলে। বললে—গান্ধীজীকে রোজ সকালে উঠে প্রণাম করি কুইনি। যারা ফাঁসিকাঠে প্রাণ দিয়েছে, তাদেরও প্রণাম করি। তবুও ভোটে আমি দাঁড়াব না। আমার ভাল লাগল তোমাদের বাস্তবাড়ী লাখরাজ করে দিতে, করে দিলাম। ভালবেসে দিলাম। তোমরা ভালবেসো তাহলেই হবে।

—সালাম হুজুর, হাজারো সালাম। হায় হায় হায়। বহুত রোজ আপনে বাঁচেন। গোয়ানরা ভি রোজ সকালে আপকে সেলাম দেবে।

সে সেলাম করেছিল, সঙ্গে সঙ্গে সব গোয়ানেরা। সেলাম করেনি শুধু কুইনি। হিলডা ধমক দিয়ে বলেছিল—আরে, এ তো বহুত বেতমিজ লড়কি। সেলাম দে!

কুইনি হাত জোড় করে নমস্কার করেছিল।—নমস্কার স্যার।

সুরেশ্বর সেদিন লজ্জিত হয় নি, সঙ্কুচিত হয় নি, সেলামের উত্তরে সেলামও দেয় নি তাদের। বড় ভাল লেগেছিল তার।

১৯৫৩ সালের ২৫শে নভেম্বর শেষরাত্রে জানবাজারের বাড়িতে সুলতা ঘোষ শুনতে শুনতে এতক্ষণে কথা বলেছিল। বলেছিল—লাগবারই কথা সুরেশ্বর। দান তো ধর্মের দোহাইয়ে পুণ্যের দাবীতে পরলোকে অক্ষয়-স্বর্গ-ই দেয় না, ইহলোকে দাতা-খ্যাতিও দেয়। কিন্তু ওর মধ্যে বীজের বীজফাটা দুটি পাতার মাঝখানে অঙ্কুরের একটা ডাঁটি থাকে। সেটা মাটির নিচের দিকে হয় শিকড়, উপর দিয়ে হয় শাখা-প্রশাখা। মাটির নিচের রস, আকাশের আলো, বাতাসের অক্সিজেন-কার্বন ডায়ক্সাইড, এসবে হয় তার অক্ষয় অধিকার। বনস্পতি তো না কাটলে সঙ্কুচিত বা লজ্জিত কিছু হয় না।

সুরেশ্বর হেসে বলেছিল—ধন্যবাদ তোমাকে। মাঝখানে ছেদ টেনে একটা সিগারেট খাবার কথা মনে করিয়ে দিয়েছ।

সিগারেট ধরিয়ে সে বলেছিল-যা বললে তার কোন প্রতিবাদ করব না। সংসারে কায়েমী স্বত্ব দু রকমের সুলতা। একটা মাটি, আর ধন-সম্পদের কায়েমী স্বত্ব, আর একটা হল মানুষের ভালবাসায় অধিকার। তা আমি পেয়েছি সুলতা। কিন্তু এক্সপ্লয়েট যাকে বল, তা করি নি। এখনও ইচ্ছে করলে করতে পারা যায়। তুমি যদি কোনদিন দাঁড়াতে চাও ইলেকশনে, তবে সেটা নিয়ে তোমাকে দিতে পারি।

মুখ লাল হয়ে উঠল সুলতার। সুরেশ্বর বললে—দোহাই তোমার সুলতা। আমি তোমাকে আঘাত করি নি, করতে চাইনে। সব অধিকার গেলেও বন্ধুত্বের অধিকারে রহস্যই করেছি। এখন ও তর্ক ছেড়ে দাও। আমার জবানবন্দী—ছবির মধ্যে কীর্তিহাটের কড়চা দেখাচ্ছি। সব শুনে, সব দেখে বিচার করো। তার আগে তর্ক না, বাদ না, প্রতিবাদ না! রাত্রি অনেক হয়েছে। শেষ প্রহরের দিকে ঢলেছে। স্বাধীনতার পরের কলকাতা। যে কলকাতায় সন্ধ্যের পর যুদ্ধের আমলের ময়দান-চারিণীরা স্বাধীন হয়ে ঘুরে বেড়ায়। যাদের বিচরণ এবং মাতামাতির কেন্দ্ৰস্থল এই ফ্রী স্কুল স্ট্রীট। শুধু যুদ্ধের পরের কলকাতা নয়, দাঙ্গার পরের কলকাতা, যেখানে গুণ্ডারা আজ বীরের পর্যায়ে উঠে মহাবীরের মত দাপাদাপি করে সারা রাত্রি। সেই কলকাতার সেই ফ্রী স্কুল স্ট্রীট নিস্তব্ধ। একখানা ফিটন চলছে না। একটা মোটর চলছে না। এখন একটা লগ্ন এসেছে, যে লগ্নটিতে আমার এই জবানবন্দী অতীতকালের প্রেতলোকে পৌঁছবে, হয়তো রায়েরা শুনবে। বর্তমানে তুমি শুনবে! আগামীকালের সূর্যোদয়েও তার রেশ চলবে। সুতরাং শুনে যাও মনে কর এককালের বন্ধুর জীবনের শেষ দিনের শেষ রাত্রে শেষ কথা শুনছ।

***

একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে সুরেশ্বর বললে—বিচিত্র কথা শোন সুলতা। সেদিন এত করেও গোয়ানদের মুক্তি দিতে পারলাম না।

—কেন?

—কাল আসে নি সুলতা। এই আজকের দিন, মানে ১৯৫৩ সালের ২৫শে নভেম্বর আসে নি বলে হল না। আইনে আটকাল।

দলিল শেষ হয়ে দাখিল হল। ধনেশ্বর রায়েরা সুরেশ্বরের নামে লাখরাজ ছিট জঙ্গলমহল- চিত্রং রেকর্ড করিয়ে দিলে। স্বত্ত্ব লাখরাজ—লাখরাজদার সুরেশ্বর রায়। সুরেশ্বর রায় বললে-গোয়ানরাও এতে লাখরাজ স্বত্বভোগী। ওদের সমস্ত বাস্তু লাখরাজ। ওরা কারুর প্রজা নয়। তাও রেকর্ড হল। স্বত্ব হল ভোগদখলসূত্রে নিষ্কর। কিন্তু প্রশ্ন উঠল—তাহলে এই দাগগুলো? পথ, পুকুর, গলিপথ, এবাড়ী-ওবাড়ীর মধ্যে কয়েকটা পতিত প্লট—যেগুলোতে ওদের গরু চরে, ছাগল চরে, যেগুলো ওদের গোরস্তান, সেগুলো কার মালিকানায় ওদের অধিকার দখল হবে, তার মীমাংসা করতে হবে। বল, তোমরাই বল, কার খতিয়ানভুক্ত হবে? এসব জমির মালিক কে? কার জমি?

হিলডা বললে—কার? না—না, উ তো আমরাদের নায় সাব। উ তো বাবুদের।—হাঁ, আমরা ভোগ করি, দখল করি। লেকিন মালিক তো নায়।

সুরেশ্বর বললে—লিখুন, সর্বসাধারণের। মালিকানি কারুর নয়। হলে সরকারের।

হরেনবাবু বললেন—তা হয় না রায়মশায়। লাখরাজের মধ্যে সরকারের কোন মালিকানা খতিয়ান কি করে থাকবে? সেটেলমেন্টের আইনে জমি থাকলেই সরকারের অধীনে মালিক একজন চাই। সাধারণতঃ জমিদারের অধীনস্থ জমিদারীতে খাসখতিয়ানে ওগুলো ঠাঁই পায়, কিন্তু সাধারণের ব্যবহার্য হিসেবে ব্যবহারের অধিকার থাকে সাধারণের। মালিক না থাকলে চলবে না। মালিক থাকতেই হবে। কারণ এদেশেরই নিজের কোন স্বত্ব নেই–এদেশ এক সম্রাটের সম্পত্তি। সম্রাট দেশকে জমিদারীতে ভাগ করে, জমিদারকে ঊর্ধ্ব এবং অধঃলোকের পর্যন্ত মালিকানি দিয়েছেন। মালিক না থাকলে কি করে বসবে? কিন্তু ছিটজঙ্গলমহল, চিত্রং, লাখরাজ। লাখরাজের মাঝখান দিয়ে যে রাস্তাঘাট রয়েছে, যে পুকুর রয়েছে, তা-ও লাখরাজ, সে জমিদারির খাস পতিতেও যেতে পারে না। এখন সেগুলো হবে কার?

সুরেশ্বর ভেবে এর মীমাংসা পেলে না।

হরেনবাবু সার্কেল অফিসার হাসলেন। ধনেশ্বর বললে-ওরে হয় না। এ হয় না। ভগবান তো স্বর্গের দ্বার খুলেই রেখেছেন, কিন্তু যাওয়া চাই তো দোর পর্যন্ত। যে যাবার, সে যায় রে, বাকীদের যাওয়া হয় না; খোলা দরজাটা হাঁ-হাঁ-ই করে।

হিলডা এবার এসে বললে—তবে উসব পথ, পতিতপুকুর আমরাদের রাজাবাবুর নামে রাখেন ডিপ্‌টিসাব। আর ওহি তো সত্যিও বটে। ঘরবাড়ী আমরাদের লাখরাজ, খাজনা আমরা দিই না, চাকরান ভি নায়, লেকেন বাবুর ইলাকাতে আমরা থাকি। জমিদার আমরাদের বটে। ওই করে দিন হুজুর।

হরেন ঘোষ অনেক ভেবে তাই করলেন। মূল লাখরাজদার শ্রীসুরেশ্বর রায়, তাঁর অধীনে গোয়ানরা ভোগদখলসূত্রে নিষ্কর স্বত্বের অধিকারী।

গোয়ানরা সুরেশ্বরকে সানন্দচিত্তে মালিক জমিদার বলে জয়ধ্বনি দিয়েই চলে গেল বাড়ী। ক’জনে বলে গেল—ই আচ্ছা হল। এহি ঠিক। ঝগড়া হোবে, গোলমাল হোবে তো বিচার কোন্ করবে? ই ভালা হল, আচ্ছা হল। জমিদার বিচার করবে।—

***

‘স্বর্গের সিংহদ্বার খোলাই আছে, দু-চারজন ভাগ্যবান সেখানে যায়, বাকি মানুষ ভাগ্যদোষে যেতে পারে না। দরজাটা খোলা হাঁ-হাঁ-ই করে।’

কথাটা ঘুরছিল সুরেশ্বরের মনের মধ্যে। কথাটা ধনেশ্বর-কাকা অবস্থা মিলিয়ে বলেছেন ভাল। হয় ভাগ্যবান হতে হবে, নয় ভাগ্যবিধাতাই বদল করতে হবে, যে-বদলের সঙ্গে ভাগ্যের বিধানটাই বদলে যায়।

উত্তরটা তার মনের মধ্যেই ধ্বনির প্রতিধ্বনির মত যেন বেজে উঠল।

বাড়ী ফিরছিল সে। ক্যাম্প-কোর্ট শেষ হয়ে এসেছে। সে একটু আগেই বেরিয়ে পড়েছে। নইলে হরেন ঘোষ হয়তো নতুন করে আলাপ জমাবার চেষ্টা করবে। আজকের আচার- ব্যবহারে কথায়বার্তায় তাই মনে হয়েছে তার। তাছাড়া তার মনকে আকর্ষণ করছে বীরেশ্বর রায়ের স্মরণীয় ঘটনাপঞ্জীর খাতাখানা।

একখানা চিঠি বীরেশ্বর রায়ের বউদি জগদ্ধাত্রী দেবী তাঁর হাতে দিলেন। বীরেশ্বর রায় হাতের লেখা দেখে চমকে উঠলেন। হাতের লেখা যে ভবানীর।

ভবানী দেবী দহের ঘাটে গায়ের গহনা খুলে গামছায় বেঁধে রেখে দিয়ে ভরা কংসাবতীর দহে ঝাঁপ দিয়েছিলেন। তাঁর দেহ পাওয়া যায়নি, না পাবারই কথা। ভেসেই চলে যাওয়ার কথা, গঙ্গার বুকে পড়ে সাগরতীর্থের মুখে। অবশ্য পথে ভাঁটার সময় চড়ায় লাগতেও পারে, হয়তো সুন্দরবনের জন্তু-জানোয়ারে ছিঁড়ে খেতে পারে, গঙ্গার স্রোতের টান থেকে কুমীরে টেনে নিয়ে গিয়েও খেতে পারে। অসংখ্য পচা মাংসভুক মাছ ঠুকরে খেতেও পারে। বাঁচার কথা তাঁর নয়।

তবু কেন জানি না, বীরেশ্বর রায় ভবানী মরেছে এ-কথা বিশ্বাস করেননি। কেন তা লেখেননি, তাঁর অনুমান সত্য। ভবানী দেবীর নিজের হাতের লেখা চিঠি তাঁর হাতে এসে পৌঁচেছে। কি লেখা আছে তা পড়বার মুহূর্তটিতেই মেজদি এসে পড়েছিলেন, বলেছিলেন—ওঠ।

তারপর ব্রজদা।

আবার তার মন দুর্নিবার আকর্ষণের টানে ঘরের মুখে চলেছে, সেই খাতা খুলে সে বসবে। হঠাৎ পিছন দিকে অনেক পায়ের শব্দ সুরেশ্বরের কানে এসে পৌঁছল যেন। শব্দটা উচ্চ হয়ে উঠছে। এবং এ-শব্দটা যেন চেনা। কলকাতায় পিচের রাস্তার উপর এ-ছন্দের পদশব্দের ধ্বনির সঙ্গে পরিচয় হয়েছে। মার্চের শব্দ। পায়ের বুট না থাকলে এ-শব্দ শুধু পায়ে ওঠে না।

সাইকেলের ঘণ্টা বাজছে। অসহিষ্ণু আরোহী ঘণ্টা দিচ্ছে। সে সরে দাঁড়াল, পাশ দিয়ে সাইকেল বেরিয়ে গেল খানচারেক। খাকী পোশাকপরা, কোমরের বেল্টে রিভলবার বাঁধা পুলিশ অফিসার। এবার সে ঘুরে দেখলে। খুব বেশি দূরে নয়, সেটেলমেন্টের ক্যাম্পের পাশ দিয়ে এই রাস্তাটা ধরেই চলে আসছে পুলিশবাহিনী। কুড়ি-পঁচিশজনের একটি আর্মড পুলিশবাহিনী। পথের ধুলো কুণ্ডলী পাকিয়ে উড়ছে। সেটেলমেন্ট ক্যাম্পে যেসব লোকেরা এসেছিল, তারা দল পাকিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে।

সুরেশ্বরের মন চকিতে বীরেশ্বর রায়ের কাল থেকে মুখ ফিরিয়ে আজকের অপরাহ্ণের কীর্তিহাটে ফিরে এল।

মেদিনীপুরের কীর্তিহাটে। সেখানে রায়বংশের ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে আছে অতুলেশ্বর।

আজ মিটিং হবে ঘোষণা করেছে ঢেঁড়া দিয়ে। কংগ্রেসের মিটিং। রিজার্ভ ফোর্স আসছে।

সুরেশ্বরের মনে ছবির কল্পনা জেগেছিল। তিনখানা ছবি। বা একখানাতেই তিনজনের ছবি—লর্ড ডালহৌসির সামনে নতজানু বীরেশ্বর রায়।

রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায়ের ছবি।

কংগ্রেসের ঝাণ্ডা হাতে অতুলেশ্বর।

না। তার সঙ্গে তারও ছবি না আঁকলে সম্পূর্ণ হবে না। ‘বিদায় বিপ্লব’ পত্র হাতে সুরেশ্বর রায়।

পুলিশবাহিনী তার পাশ দিয়ে চলে গেল।


© 2024 পুরনো বই