কীর্তিহাটের কড়চা – ৪.১০

১০

মেজঠাকুমাকে সুরেশ্বর প্রথমটা কথার উত্তর দিতেই পারে নি। অকস্মাৎ তার যেন স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল। কালকের আধখানা রাত্রি যেন বর্তমান থেকে হারিয়ে গেছে। একটু পর স্মরণ হল, ও-বাড়ীতে ব্রজেশ্বরদার নতুন বউ নিয়ে যে আসর পড়েছিল তার কথা। সেখানে সে বাজিয়েছে, ব্রজেশ্বরদা গান গেয়েছে, অৰ্চনা গান গেয়েছে, মেজঠাকুমাও কীর্তন গেয়েছেন। রায়বাড়ীর দেউলে দশায়—ভাঙা আসরে—ব্রজেশ্বরদা’র দু’নম্বর বাসর হয়ে গেছে। তারপর সে এ বাড়ীতে এসে কীর্তিহাটের ভট্টাচার্যদের—ভাগ্যপরিবর্তনে রায় খেতাবধারীদের তৃতীয় পুরুষ বীরেশ্বর রায়ের ডায়েরী পড়ছিল। ডায়েরী নয়—স্মরণীয় ঘটনাপঞ্জী। এমনই তন্ময় হয়ে ছিল, যে তন্ময়তার মধ্যে সে উনিশ শতকের কীর্তিহাটে এবং কলকাতায় ঘুরে বেড়িয়েছে। সকালে মেজঠাকুমা জানালা খুলে দিতেই দিনের আলোয় তার খেয়াল হ’ল এটা উনিশ শো ছত্রিশ সাল,—এপ্রিল মাসের শেষ। সেটেলমেন্ট হচ্ছে। আজ একটা দিনও আছে। মাঠে যাওয়ার জরুরী দরকারও আছে। সামনের দেওয়ালে যে ক্যালেন্ডারটা ঝুলছে তাতে সেটেলমেন্ট আপিসের তলবের দিনগুলি লাল পেন্সিলে একটা করে তেকাটার চিহ্ন সে নিজে হাতে এঁকে দিয়েছে। জরীপের তিন ঠ্যাঙওয়ালা টেবিলটার প্রতীক।

মেজঠাকুমা বললেন—কি পড়ছিলি সারারাত ধ’রে? এটা তো দেখছি খাতা? কি আছে এতে? সম্পত্তির দলিলের নকল? না—বিবরণ? কি? না। সেগুলো তো বেশ বড় হয়। এর থেকে অনেক লম্বা! চওড়াও বেশী!

একটু হেসে সুরেশ্বর বললে—এতে রায়বাড়ীর কুলজী আছে মেজদি। বীরেশ্বর রায় নিজে হাতে লিখে গেছেন। আরও খানতিনেক খাতা আছে—তাতে কুলজী লিখে গেছেন- রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায়। রায়বাড়ীর ভাল মন্দ গৌরব কলঙ্ক সব আছে।—

—ডায়েরী?

—হ্যাঁ।

—কোথায় পেলি? এর খোঁজ যে তোর মেজঠাকুরদা কত করেছে রে! ছিল তাঁর কাছেই।—তিনি লুকিয়ে রেখে দিয়েছিলেন। ওই ঠাকুরদের গহনার সিন্দুকে শ্বশুরমশাই রেখেছিলেন। খুব দামী রেশমী কাপড়ে বেঁধে। তার উপর কাগজ সেঁটে লিখেছিলেন-”এ কেহ পড়িবে না! পড়িলে মহাপাতকের ভাগী হইবে।” উনি পড়েন নি। রেখে দিয়েছিলেন। তারপর কিছুদিন পর আর পাওয়া যায় নি। উনি সেই মণি-হারা সাপের মত দিনকতক গর্জে গর্জে মাথা কাছড়ে কাছড়ে বেরিয়েছিলেন। তারপর তো—ওই সর্বনাশ ঘটে গেল। তুই কি করে পেলি সুরেশ্বর?

সুরেশ্বর কপালের রুক্ষু চুলগুলো পিছনের দিকে ঠেলে দিয়ে চোখ বুজে মাথাটি চেয়ারের মাথায় রেখে বললে—ব্রজদা কাল রাত্রে আমাকে বের করে দিয়েছে মেজদি। এই বাড়ীতেই চোরাকুঠুরিতে সে লুকিয়ে রেখেছিল। মেজঠাকুরদার কাছ থেকে ও দুখানা সরিয়েছিলেন সুখেশ্বরকাকা। সেটা ব্রজদা জানত। কাকা মারা যাবার পর হিসেবের খাতায় ট্রাঙ্ক খুলে সে বের করে নিয়েছিল।

—কিন্তু তুই পড়লি কেন সুরেশ্বর? পড়তে যে মানা ছিল! এ তুই কি করলি ভাই?

সুরেশ্বর বললে-কিন্তু এমন কোন লেখা কাগজ তো এতে সাঁটা ছিল না ঠাকুমা! ব্রজদাও আমাকে এমন কোন কথা বলে নি!

—কিন্তু ছিল আমি জানি। তিনি আমাকে বলেছিলেন। তা-হলে —।

হঠাৎ সুরেশ্বরের চোখদুটো বিস্ফারিত হয়ে উঠল। মনে পড়ল—সে সেখানে পড়া শেষ করেছে সেখানে বীরেশ্বর লিখেছেন—বউঠান চিঠিখানা হাতে দিলেন। হাতের লেখা দেখিয়া চমকিয়া উঠিলাম। এ যে ভবানীর হাতের লেখা!

রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর লিখেছিলেন, বলছেন মেজঠাকুমা —কেহ পড়িয়ো না। মহাপাতকের ভাগী হইবে। তবে—? তবে কি?

ভবানী দেবীকে খুন করেছিলেন তিনি? ভবানী দেবী কি?

বুকের ভিতরটা ধড়ধড় করে উঠল।

মেজঠাকুমা বললেন—তা হলে সুখেশ্বর ছিঁড়েছে। এ কেবল সেই পারতো।

রঘু চা দিয়ে গেল। চায়ের দিকে তাকিয়ে দুধটা দেখে সারারাত্রি জাগা দেহটা কেমন যেন বিদ্রোহ করে উঠল—সে সেটাকে ঠেলে দিয়ে বললে—র-চা নেবু দিয়ে ক’রে আন রঘু, দুধ-চা খেতে ইচ্ছে করছে না।

—র-চা খাবি? সে যে ভয়ানক কষা রে। শরীর ক’ষে যাবে।

—না ঠাকুমা। খুব ভাল জিনিস, খেয়ে দেখ না!

—না, তোর ভাল জিনিস তুই খা। বাবাঃ—ওই আবার খায়!

এই সময়েই ব্রজেশ্বরের গলার সাড়া মিলল—ভাই রাজা!

—এস ব্রজদা!

—তোমার ভাই সুরেশ্বর নাম না হয়ে রাজেশ্বর কি রাজরাজেশ্বর হওয়া উচিত ছিল। বলতে বলতেই ব্রজেশ্বর ঘরে ঢুকল। ঠাকুমা বললেন—দেখ না এসে শুনি রঘু বললে—বাবু কাল খায়নি—ঘুমোয় নি—সারারাত খাতা নিয়ে পড়েছে। সকাল হয়ে গেছে—তবু খেয়াল নেই।

—তাই তো রাজা, চোখ দুটো যে রাঙা হয়ে উঠেছে! মুখখানা থমথম করছে। কাল রাত্রে—। না। সে ঘরের কোণের ব্র্যাকেটের উপর রাখা বোতলটার দিকে তাকিয়ে দেখে বললে, –না। তবে?

রঘু র-চায়ের কাপ নিয়ে এসে ঢুকল। নামিয়ে দিলে টেবিলে।

ব্রজেশ্বর বললে—র-চা আর আছে রে? আমাকে দে এক কাপ।

মেজঠাকুমা বললে—তবে আমাকেও একটু দে রে রঘু। চেখে দেখতে হল তো! কি মধু আছে ওতে!

ব্রজেশ্বর বললে—কি পড়ছিলে বলছিল মেজঠাকুমা? বলেই সে সামনের খাতার দিকে তাকিয়ে বললে—ও! সঙ্গে সঙ্গেই পড়তে শুরু করেছিলে?

এই সময় বাইরে পথের উপর ঢেঁড়া বাজল ডুগডুগ শব্দে। যেন বিবিমহলের সামনেই বাজিয়ে দিলে কেউ

মেজঠাকুমা বললেন—ঢেঁড়া কিসের? কোরোক (ক্রোক) নাকি? এই সকালে? দেখরে ব্রজ, তুই না হয় উঠে দেখ!—

উঠে দেখতে হল না। সঙ্গে সঙ্গেই ঢেঁড়াদার বা তার সঙ্গের লোক উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করলে- আজ বিকেলে মিটিং হবে। মেদিনীপুর থেকে জাতীয় নেতারা আসবেন। সকলে দলে দলে যোগদান করবেন।

চঞ্চল হয়ে উঠল সুরেশ্বর। ব্রজেশ্বর কেমন যেন ঠাণ্ডা হয়ে গেল!

মেজঠাকুমা বললেন—অতুলেশ্বর! এ সেই তার কাজ। এই চারদিন আগে গ্রামে ফিরেছে। সেই আমার ভাজের সৎকারের দিন শ্মশান থেকে এসে একদিন কি দুদিন পর কোথায় গিয়েছিল। ফিরল কাল। তার কাজ। এবার একটা হাঙ্গামা বাধাবে। সারা দিন গ্রামের ছোঁড়াদের মধ্যে ঘুরেছে।

ওদিকে আবার ঘোষণা উঠল-দলে দলে আসবেন। নুতন শাসনতন্ত্র ও আগামী নির্বাচন সম্পর্কে আলোচনা হবে। মেদিনীপুরের শহীদদের শ্রদ্ধাঞ্জলি দেওয়া হবে।

***

সুরেশ্বরের মুখখানা ফ্যাকাশে হয়ে গেল। মনের মধ্যে একটা ঝড় উঠে গেল—এরই মধ্যে। কলকাতা হলে হয়তো উঠত না। এখানে না উঠে পারলে না। এ-মেদিনীপুর!

বিচিত্র মেদিনীপুর! পরগনায় পরগনায় রাজার অঞ্চল মেদিনীপুর, বড় বড় জমিদারের অঞ্চল মেদিনীপুর। ক্ষুদিরামের দেশ মেদিনীপুর। সত্যেন বোসের বাড়ী, হেম কানুনগোর বাড়ী; এখানে অম্বিকানগর প্রথম লক্ষ্যভেদের স্থান। দুর্দান্ত মেদিনীপুর। পাইক বিদ্রোহের দেশ। নাড়াজোলের রাজা দেবেন্দ্রলাল খাঁ, বীরেন্দ্রনাথ শাসমল, সাতকড়িপতি রায়, কিশোরীপতি রায়, তরুণ নেতা সতীশ সামন্ত, রামসুন্দর সিং! নামগুলি একনিঃশ্বাসে মনে পড়ে গেল।

সামনে এসে দাঁড়াল ক’জন তরুণ কিশোর। বেঙ্গল ভলেন্টিয়ার্সের ভলেন্টিয়ার্স। বাংলার ইতিহাসে গিরিয়ার যুদ্ধে বাঁকুড়ার বারো বছরের ছেলে জলিম সিংহের উত্তরাধিকারী। অগ্নিশিখা! পেডি, ডগলাস, বার্জকে এই ক্রুদ্ধ বহ্নিশিখায় পুড়ে ছাই হয়ে যেতে হয়েছে। প্রদ্যোত, অনাথ, মৃগেন, ব্রজকিশোর, রামকৃষ্ণ, নির্মলজীবনের দেশ মেদিনীপুর! তাদের আত্মার উত্তাপে উত্তপ্ত মেদিনীপুর!

ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট এ জেলায় আসতে চায় না। এখন বৃদ্ধ গ্রিফিথ এসেছে। গারোয়ার রাইফেলসের থার্ড ব্যাটেলিয়ন এসে ঘিরে রেখেছে শহর মেদিনীপুর। রাত্রে সেখানে কার্ফু। লাল নীল সাদা কার্ড দিয়ে মেদিনীপুরের তরুণদের চিহ্নিত করেছে। নিষ্ঠুর অত্যাচারে অত্যাচারিত মেদিনীপুর। সন্তোষ বেরাকে লাঠি দিয়ে পিটিয়ে মেরেছে। নারীদের লাঞ্ছনা করেছে। অর্থদণ্ড করেছে—পিউনিটিভ ট্যাক্স।

শুধু খাস মেদিনীপুর শহর বা সাবডিভিশন নয়, তমলুক সাবডিভিশনেও অত্যাচার চলেছে। অর্থদণ্ড দিয়েছে।

কিছুকালের জন্য হৃতচৈতন্যের মত মেদিনীপুর স্তব্ধ ছিল। সেই কারণে দুমাস আগে এখানে সেটেলমেন্টের নোটিশ পেয়ে এখানে আসবার সময় সুরেশ্বর নিশ্চিন্ত মনে এসেছিল। কথাগুলো মনে পড়েনি।

সে ১৯৩০ সালে জেল থেকে বেরিয়ে এসে যে চিঠি ছেপেছিল তা তার মনে পড়ে গেল। “বিদায় সত্যাগ্রহ!”

তার বাবার লেখা ইংলিশম্যানের এডিটোরিয়ালগুলির কথা মনে পড়ল।

আজ যেন তার সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে। ১৯৩০ সালে জেলের মধ্যে সত্যাগ্রহী বন্দীদের আচরণে যে সত্যাগ্রহবিরোধী একটা উন্মত্ত উচ্ছৃঙ্খলতার প্রকাশ দেখে একটা রেখা টেনেছিল সত্য ও অসত্যের মধ্যে, সত্যাগ্রহের মহান নীতির মধ্যে যে দুর্নীতির মুখের একটি উঁকি দেখেছিল, তাতেই সে ভেবেছিল সব বিষাক্ত হয়ে গেছে। সংস্পর্শ থেকে দূরে সরে এসেছিল সে।

আজ মেদিনীপুরের বিবিমহলে বসে কংগ্রেসের ‘ঢেঁড়া’ শুনে এবং ঘোষণা শুনে তার শরীর মন চঞ্চল হয়ে উঠেছে।

মনে পড়ছে কাল রাত্রে বীরেশ্বর রায়ের স্মরণীয় ঘটনালিপির মধ্যে পড়া কয়েকটি ঘটনার কথা।

গভর্নর জেনারেল লর্ড ডালহৌসির সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে সম্ভ্রমে, শ্রদ্ধা—শ্রদ্ধাই বা কেন—একান্ত আনুগত্যের আতিশয্যে নতজানু হয়ে বসে তাঁর হাতে মাথা ঠেকিয়েছিলেন। সে আমলের কলকাতায় নতুন অভিজাতমহলকে মনে পড়ছে। তার থেকে শুধু একটি সর্ববাদীসম্মত সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায় যে মহান ইংরাজ ভারতের ত্রাণকর্তা—অধঃপাত এবং অজ্ঞানের অন্ধকারে সেই মশালধারী পথ-প্রদর্শক। ইংরেজ বিশ্ববিজয়ী ইংরেজ অজেয়!

১৯২১ সালেও তার বাবা তাই ভেবেছেন। ১৯৩০ সালে সেও বিচিত্রভাবে এমন কিছু একটা ভেবেছিল। আশ্চর্য! তার সংস্পর্শে এসে শিবেশ্বর ঠাকুরদার পচধরা বংশ থেকে অতুলেশ্বর বেঁচে গেল?—বিচিত্র!

এখানে এসে অবধি সে কংগ্রেস দেশ স্বাধীনতা এ নিয়ে কোন জটলা কোন আলোচনা শোনে নি। আজ অতুলেশ্বর ঘোষণা করে ঢেঁড়া বাজিয়ে জানাচ্ছে?

সুরেশ্বর বললে—ব্রজদা, একবার অতুলেশ্বরকে আমার কাছে আনতে পারো? তার মনে পড়ল অতুলেশ্বরকে সে দেখেছে তার বাবার শ্রাদ্ধের সময়। রায়বংশের রূপ তার মধ্যেও আছে। আর দেখেছিল মেজঠাকুমার ভাজের মৃত্যুর দিন। কিন্তু বিবিমহলে সে কোনদিন এসে দেখা করেনি। কেন করেনি আজ তার কারণটা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তার কাছে!

ব্রজেশ্বর বললে দেখি, ছোট আংকলটি তো আমার যত ঠান্ডা তত গরম। ওর বিচার তো অদ্ভুত। ওর ন্যায়শাস্ত্রটাই আলাদা। বুঝেছ। তবে তোমার এই মেজদিকে বল না। উনি তো তাঁর জননী। শিবেশ্বর রায়ের তৃতীয়পক্ষটি ওই একটি ছেলের কাছেই জননী। বাকী সকলের কাছে ঘুঁটেকুড়ুনী।

—এই দেখ ব্রজ, আবোলতাবোল তুই বকিসনে।

—আবোলতাবোল? বল তো ঠাকরুণ, যে টাকাটা তুমি আজ দাদুর মৃত্যুর পর থেকে রাজাভাইয়ের কাছ থেকে মাস মাস পাও, তার থেকে কত টাকা তুমি তোমার ওই দুলালটিকে গোপনে দিয়ে থাক?

—কে বললে?

—আমি বলছি। অহং। আই।

—তুই বললেই হবে? তুই তো আজ দেশ ছেড়েছিস সেই মেজকর্তার, সুখেশ্বরের মৃত্যুর পর। ফিরছিস এতকাল পরে নতুন ধিঙ্গী বউ নিয়ে। কি করে জানলি তুই?

—এই দেখ! ওগো ঠাকুরুণ, লগ্নে যাদের চাঁদ থাকে তাদের লোকে বলে লগনচাঁদা। তারা আর কিছু না হোক, লোকের মন গলাতে পারে। কাল এসেই আমি সব শুনে নিয়েছি অর্চনার কাছে! অর্চনা আমাকে সব বলেছে। সেও ছিটে-ফোঁটাটা পায়, তা ছাড়া আমার অতুলেশ্বর আংকলের ও তো সহকারিণী। সে তো তুমিও জান গো! জান না? সম্মুখে তোমার কনিষ্ঠ ভ্রাতার মতো শ্রীমান রাজা নাতি, তোমাকে ল্যাভেন্ডার সাবান মাখায়, তুমি সাবানের খুসবয়ের সঙ্গে নাতি-সোহাগী ঠাকুমার গরব ছড়িয়ে বেড়াও, বল তো তার দিব্যি করে!

মেজঠাকুমা পুতুল হয়ে গেলেন।

এতক্ষণে সুরেশ্বর বললে-এতে তুমি লজ্জা পাচ্ছ কেন ঠাকুমা? এতে তো লজ্জার কিছু নেই। অতুলেশ্বর তোমার ছেলে, তাকে কিছুটা মানুষ করেছ; মমতা স্বাভাবিকও বটে, আর ধর্ম ন্যায় সব সম্মতই বটে। এ ছাড়া অতুলেশ্বর যা করে দেশের কাজ, সে তো পুণ্যের কাজ গৌরবের কাজ। তাকে টাকা দাও স্নেহ কর, এতে লজ্জা কেন পাচ্ছ। যে টাকা তোমাকে মা দিয়ে গেছেন, আমি যা আজও দিচ্ছি, তা তো দান নয় ভিক্ষে নয়—প্রণামী—তোমার পাওনা। ও নিয়ে যাকে দেবে যা করবে তাতে আমি কিছু ভাববই বা কেন, ভাববার অধিকারই বা কি?

অকস্মাৎ মেজঠাকুমার চোখ থেকে জল গড়াতে লাগল। তিনি আঁচল টেনে মুছতে মুছতে নীরবে উঠে চলে গেলেন। ও ঘর থেকে ডেকে বললেন—তুই ভাই খাওয়া-দাওয়া কর, স্নান কর—। ব্রজ, তুই ভাই একটু তাগিদ দিয়ে এসব করা।

.

চোখ বুজে বসেছিল সুরেশ্বর। ব্রজেশ্বর বললে—কাল রাত্রে দেখি তুমি প্রায় যোগাসনে বসেছিলে রাজা। ওই দ্রব্যপূর্ণ বোতলটা খুলে যা আমি খেয়েছিলাম খানিকটা, তারপর আর একটি বিন্দুও দেখছি কমেনি!

সুরেশ্বর চোখ বুজেই বললে—তুমি একবার অতুলেশ্বরকে নিয়ে এস। সে বোধ হয় আমাকে ঘৃণা করে। তুমি তো জান—আমি তিরিশ সালে জেল থেকে ফিরে একখানা চিঠি লিখেছিলাম।

ব্রজেশ্বর বললে—জানি রাজা। সে সময়ে মন্দ কথা আমিও বলেছি। তখন তো আলাপ ঠিক হয় নি। দেখাই হয়েছিল জ্যাঠামশায়ের শ্রাদ্ধের সময়। তারপর তার কারণও শুনেছি আলাপ হয়ে। তবে অতুল তোমাকে ঘেন্না ঠিক করবে না। সে রকম সে নয়। বুঝেছ! জাত ওর আলাদা!

—তুমি একবার এনো ওকে।

—আলাপ করবে? টাকাকড়ি দেবে? তা দাও তো দেখ অতুলের সঙ্গে আমিও কোমর বেঁধে নেমে যাই দেশোদ্ধারে।

—তুমি ব্রজদা, ইনকরিজি। আমি ওর একটা ছবি আঁকব।

—ছবি আঁকবে? মহাপুরুষ বলে? সকৌতুকে হাসলে ব্রজেশ্বর।

সুরেশ্বর বললে—তাতে আশ্চর্য কি ব্রজদা! হতেও পারে। কাল রাত্রে বীরেশ্বর রায়ের স্মৃতিকথায় পড়ছিলাম, তিনি কলকাতায় গিয়ে দরখাস্ত করে লর্ড ডালহৌসির সঙ্গে ইন্টারভিউ পেয়েছিলেন। ইন্টারভিউ মানে সেলাম জানানো। লাটসাহেবের সামনে গিয়ে অভিভূত হয়ে হাঁটু গেড়ে বসে তাঁর হাতখানা মাথায় ঠেকিয়েছিলেন। একলা তিনিই এ কাজ করেন নি, সেকালে অনেকে করেছেন। তাঁর বংশধরদের মধ্যে তোমাদের মেজতরফে যা ঘটেছে তা তুমি জান, কে বলবে বল যে, যে ভালটুকু আছে তা ওই অতুলেশ্বরের মধ্যে জমা নেই? তবে এতখানি নাই বা বললাম, খেয়াল হয়েছে, ছবি একটা ওর এঁকে রাখব আমি।

ব্রজেশ্বর চুপ করে রইল কিছুক্ষণ। তারপর বললে—তা আনব ওকে। বললেই আসবে। কত ভাল তা আমি জানি না, তবে ভাল ও বটে। সে ছেলেবেলা থেকে। বাবা-কাকারা সকলেই সেই যাকে বলে ‘বেগুনে কেন খাড়া-না বংশাবলীর ধারা’। এক ক্ষুরে ন্যাড়া মাথা। ওই কেমন করে বেগুন নয় সগুন বা সেগুন বলতে পার, ওতে কাঁটা নেই এবং সার আছে।

তারপর হাসতে হাসতে বললে—ওর পাশে আমার ছবি একটা এঁকো, খুব ভাল পোজ দিয়ে দেব।

রঘু এসে দাঁড়াল।

ব্রজ বললে—নাও ওঠো। চানটান করে ফেল রাজাভাই, দ্রুত এসে দাঁড়িয়েছে! মেজদি বলে গেছে আমাকে। মেজদি আমার পোড়াকপালী রাজরাণী, ওকে আমরা অকথা কুকথা বললে ও চুপ করে সহ্য করে কিন্তু ও যখন বলে—তা আমার কথা শুনবি কেন রে, আমি তো তোমাদের ঠাকুরদার এঁটো ভাতের কেনা দাসী! তখন ভাই সহ্য হয় না। নাও ওঠো।

রঘু এতক্ষণে বললে—নায়েববাবু আসিয়েছেন।

—নায়েববাবু! ডাক। বলে উঠে দাঁড়াল সুরেশ্বর। বললে-এবার ওঠালে ব্রজদা। সেটেলমেন্টের সাহেবের বড়শির টান পড়ল বোধ হয়। আজ যেন কি কি ব্যাপার আছে। সাহেবটির বদমেজাজের কারণটা আজ বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। আজ চার বছর মেদিনীপুরে যে জঙ্গীরাজত্ব চলছে, সাহেবের মেজাজের ভিতটা তার ওপর। ঠিক খেয়াল হয়নি!

নায়েব এসে ঘরে ঢুকল—এখানকার এজমালি দেবোত্তরের নায়েব। সুরেশ্বর বললে—এই উঠেছি আমি। স্নান করে নিই। কোর্ট তো দশটায়। দেরী আছে এখনও।

—আজ্ঞে হ্যাঁ। সময় এখনও আছে। তবে আমি তার জন্যে আসিনি। একটা বিষয়ে আপনার মত জানতে এসেছি। কাল অনেক রাত্রে ধনেশ্বরবাবু প্রণবেশ্বরবাবু পরামর্শ করে ওঁদের মত বললেন, তখন আমি এসেছিলাম এখানে আপনাকে বলতে। কিন্তু আপনি ও-বাড়ীতে ছিলেন কাল। মাথা চুলকাতে লাগল নায়েব। বলতে পারলে না—ও-বাড়ীতে আপনি তখন ব্রজবাবুর বিয়ের উৎসবে গানবাজনা করছিলেন।

সুরেশ্বর বললে—হ্যাঁ, কাল ব্রজদার বিয়ের বাসী ফুলশয্যে ছিল—

ব্রজেশ্বর সংশোধন করে দিয়ে বললে-বকেয়া ফুলশয্যে ব্রাদার। রাজাভাই, তুমি কীর্তিহাটে এসেছ জমিদারী রক্ষে করতে, বাসী নয় বকেয়া বলতে হয়। বকেয়া থাকলেই আদায়, বাসী হলে এ-যুগে ফেলে দিতে হয়। পান্তাভাতের রেওয়াজ অনেককাল উঠে গেছে। কি গো নায়েববাবু!

নায়েব একটু হাসলে কিন্তু চুপ ক’রে রইল।

সুরেশ্বর বললে—কথাটা কি? বলুন।

—আজ ওই কাঁসাইয়ের ওপারের গোয়ানপাড়ার বুঝারত আছে। তা গোয়ানরা বলেছে বাস্তু ওদের সমস্ত নিষ্কর। কিন্তু ওঁরা দুজন বলছেন—নিষ্কর নয়, সমস্ত বাস্তু চাকরান। এরা ডাক-হাঁক করবে প্রয়োজন মত, বাড়ীর ক্রিয়াকর্মে খাটবে, এ শর্তে ওদের বাস করিয়েছিলেন রাজাবাবু মানে বীরেশ্বর রায় মশায়। তা ওঁরা বললেন আপনাকে বলতে। বলেছেন—এ ব্যাপারে একমত হয়ে এই কথা না বললে খুব অনিষ্ট হবে এস্টেটের।

কথাটা খুব বোধগম্য হল না সুরেশ্বরের। মোটামুটি বুঝলেও ঠিক ব্যাপারটা যেন ধরতে পারছে না।

নায়েব বললে—ওটা আসলে যাদব রায়ী নিষ্কর। খোদ আদি কর্তা রায়ভটচাজমশায়ের আমলে ওটা তিনি কিনেছিলেন। ওই সিদ্ধপীঠটীট নিয়ে একশো আট বিঘা জঙ্গল-জমি যাদব রায় নিষ্কর দিয়েছিলেন, এই গ্রামের সেকালে শ্যামাদাস চক্রবর্তীকে, তিনি তান্ত্রিক ছিলেন, ওই সিদ্ধপীঠ তাঁরই সাধনপীঠ। রায়ভটচাজমশায় তাঁর উত্তরাধিকারীর কাছে কিনেছিলেন। ঘন জঙ্গল ছিল নাম ছিল, ছিটমহল চিত্রং। তা পরেতে রাজাবাবু বীরেশ্বর রায় ওই গোয়ানদের এসে বসালেন সিদ্ধপীঠের এলাকার বাইরে ওই ডাঙাটায়। অবিশ্যি জমিদারী শাসনে তখন ওদিকে লাগত। খাজনাও কখনও ওরা দেয় নি। কাজ করেছে, খাতায় মাইনে বলে খরচও লেখা আছে। তা নিষ্কর না চাকরান তা জানতেন তাঁরা। লাখরাজ সেরেস্তার কিন্তু চাকরান বলে ওদের নামে কোন পত্তন নাই। তা কর্তারা বলছেন পুরনো আমলের চেকে পত্তন দেখাবেন। তখন কথাটা আপনাকে বলা আমার কর্তব্য। মানে যা দেখছি, আপনার মত তো আলাদা!

—তার মানে পুরনো আমলের চেকবইয়ে যে সব খরচ না হওয়া সাদা গোটা চেক আছে, তাই লিখে প্রজার অংশ কেটে ফেলে দেবেন? কিন্তু ধরা পড়বেন না তাতে? লেখা কালি? এসব মিলবে?

ব্রজেশ্বর বললে—রাজাভাই শিখেছ অনেক কিন্তু শিখতে বাকীও অনেক। ব্রাদার, ফার্স্ট ক্লাসে পঞ্চতন্ত্র পড়েছিলাম তার একটা শ্লোকে ছিল শাস্ত্র অপার বিঘ্ন অনেক। কিন্তু তাতেও রাজার ছেলেরা মুখ্যু থাকেনি। ব্রাদার, জমিদারেরা ও রাজারা পক্ষযুক্ত পক্ষীর মতো, কেউ গরুড় কেউ চামচিকে। গরুড় ঘরের কোণে ওড়ে না। ওড়ে চামচিকে। তখন তাদের ধর্মকর্ম আলাদা। এও তাই ব্রাদার। কষের কালি আছে, শরের কলম আছে, পুরনো হাতে লেখায় এক্সপার্ট আছে, চালের গাদা আছে। ও আমার পিতাঠাকুর ঠিক মেরে দেবেন। ইংরিজী লেখাপড়া হয় নি সে আলাদা কথা কিন্তু এ শাস্ত্রে তিনি পণ্ডিত, সুখেশ্বরকাকা থাকলে থোকা সুদ্ধ তৈরী হয়ে যেত। তিনি এ বিষয়ে ডক্টরেট ডিগ্রীধারী ছিলেন।

ব্যাপারটা বুঝতে দেরী হ’ল না সুরেশ্বরের। সে বললে-আমি তাহ’লে বলব, আমার কোনদিকেই কোন আপত্তি নেই। সে গোয়ানদের দাবিতেও নেই ধনেশ্বরকাকাদের দাবিতেও নেই। কারণ আমি জানিনে কিছু।

***

গোটা গোয়ানপাড়া সেদিন সেটেলমেন্ট আপিসের সামনে। দল বেঁধে বসে আছে গাছের তলায়, গোলমাল করছে। সকলের মাঝখানে ব’সে হলদীবুড়ী, সেই বকছে বেশী। তার পাশে বসে আছে একটি চৌদ্দ-পনেরো বছরের মেয়ে। মেয়েটির মধ্যে এমন কিছু আছে যাতে বিশেষ করে চোখে পড়ে।

সুরেশ্বরেরও চোখে পড়ল। চমৎকার মুখের শ্রী। বড় টানা চোখ, নাকটি একটু ছোট, কপালখানিও ছোট। নাকে একটি খাঁজ। ঠোঁটের গড়নটা একটু বাঁকা। ওর সব শ্রীই যেন ওইখানে জমা হয়ে আছে। মাধবী ফুলের ঠিক মাঝখানে যেন হলদে আভাটুকুই মাধবীর রূপের উৎস, এও ঠিক তেমনি।

কিন্তু এ রূপের চেয়েও যা বেশী চোখে পড়ে ওর শান্ত স্বভাব এবং পরিচ্ছদের পরিচ্ছন্নতার জন্য। পরিচ্ছদ আর কি? মাত্র একটা হাঁটু পর্যন্ত ফ্রক। পায়ে একজোড়া সস্তা চটি। নিম্নাঙ্গে হাফপ্যান্ট। কিন্তু সবকিছুর মধ্যে পরিচ্ছন্ন শ্রী ওকে অন্য সকল গোয়ান মেয়েপুরুষ থেকে পৃথক ক’রে রেখেছে।

এদিকে ক্যাম্পের সামনে ভদ্রজনদের ভিড়। এ গ্রাম, আশপাশ গ্রাম থেকে বিষয়ী লোকেরা এসেছেন, অবিষয়ীরাও এসেছেন, কারণ একটুকরো জমির উপর একখানা ঘর যার আছে তাকে এ দরবারে না এসে উপায় নেই। ধনেশ্বরকাকা, প্রণবেশ্বরদা, সুখেশ্বরকাকার ছেলে কল্যাণেশ্বর একখানা কম্বল পেতে কাগজপত্র নিয়ে বসেছেন। সুরেশ্বরের জন্যেও রঘু একখানা সতরঞ্জি এনে পেতে রেখেছে।

সুরেশ্বরকে দেখে একজন হলদীবুড়ীর পিঠে হাত দিয়ে ডাকলে। হলদীবুড়ী এদিকে পিছন পিরেই হাত-পা নেড়ে আপনমনে বকছিল। পিঠে হাত দিয়ে ডাকার জন্যে অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে সে ঘাড় ফিরিয়ে বললে-কে রে বেতমিজ? হাঁ? পিঠে হাত দিয়ে ডাকিস? মারব থাপ্পড়—

—ওই দেখ—কলকাতার রায়বাবু এসে গেলেন!

—কলকাতার রায়বাবু? ফিরে বসল বুড়ী! তারপর সে উঠল। ওই মেয়েটির হাত ধরে সে এসে সুরেশ্বরের সামনে দাঁড়াল —সেলাম হুজুর! রাজাবাবু, আমাকে চিনছেন? সেই সিবার হুজুরের বাবার ছেরাদের সময় সেলাম দিলাম—

সুরেশ্বর বললে—হ্যাঁ হ্যাঁ, চিনেছি বইকি। তুমি গোয়ানদের সর্দারের মেয়ে—

—হাঁ হুজুর। আমি পিদ্রুর বেটী। লোকে আমাকে হলদী বলে-আমার নাম হল হিলডা। হাঁ। কুইনি, সেলাম দে বাবুকে, সেলাম দে।

মেয়েটি বেশ সবিনয়ে মাথা নামিয়ে বললে-গুড মর্নিং সার।

হেসে সুরেশ্বরও বললে-গুড মর্নিং। কি নাম বললে হিলডা?

—কুইনি। ই নাম দিয়েছে ওর মা। বাবা ওর গোয়ানীজ নাম দিল না, দিলে বাঙালী নাম দুটো নাম ওর। কি নাম বল্ কুইনি!

—আমার নাম অরুন্ধতী গুপ্তা।

বিস্ময়ের আর অবধি রইল না সুরেশ্বরের। সে বললে—তুমি তাহ’লে—এদের মধ্যে-

—ওর মা, সে কলকাতায় থাকত, কিছু লিখাপড়া করল তো ওকে সাদী করলে ওর বাপ বাঙালী ক্রীশ্চান ছিল সে। তারপরে সে মরে গেল। ওর মায়ের খুব কষ্ট হল। তখুন কি করবে বাবু, আবার ফিরে এল কলকাতায় আমাদের মত গোয়ানীজ পাড়ায়। তারপর মা-টার তো বেমার হল। খবর পেয়ে আমি আনলাম ইখানে। ইখানে এসে সে মরল-বেটীটা থাকল আমার কাছে। কার কাছে দিব? আমার আপনার ছিল ওর মা। এই দু বছর হয়ে গেছে। ভাল মেয়ে বাবু।

—আচ্ছা। তোমাদের তো আজ সব গোয়ানপাড়ার বুঝারত?

—হাঁ হুজুর। তা এ কি বিচার রায়বাবু লোকের? আমরাদিগে সে রাজা রায়বাবু ইখানে ডেকে আনলে, বাবা বলছিল আমাকে কি গোয়ানরা রাজা রায় হুজুরকে জান বাঁচালে, উনার রাণীকে গোয়ান লোক মা বলত—উ তো দেওতা ছিল হুজুর। রাজা রায় ওই বনের পাশে জমিন দিয়ে বললে-ই জমিনের উপর ঘর বানাও, গাঁও বানাও, খাজনা মাপ–নাখরাজ দিলাম। আজ ই লোক বলে- চাকরান? বলে চেক আছে রসিদ আছে! ঝুটাবাত বিলকুল ঝুটাবাত।আপনি খুব আচ্ছা লোক, আমীর ভদ্দর লোক, আপনার লেগে বসে আছি বাবু, আপনি কি বলবে? বলেন বাবু–আপনার রায় শুনবে আমি!

ততক্ষণে গোয়ানরা সব এসে হলদী বা হিলডার পিছনে ভিড় করে দাঁড়িয়েছে।

—আমি তো এসবের কিছুই জানি না হিলডা। আমি কোন কিছুতেই আপত্তি করব না।

হিলডা হাত দুখানা নেড়ে দিয়ে বললে-হা-হা-হা। আপনে জমিদার, আপনে বলে আমি জানে না! হা-হা-হা। জমিদার কলকাতায় বসে থাকবে, জমিদারীর কিছু জানবে না তো রায়ত বাঁচবে কি করে? হা হা হা। উ রোজ ই গাঁয়ের লোকের ঘরবাড়ী গরু চরবার জমিন সব আপনি বললে নাখরাজ। গোয়ান লোক কি করলে হুজুর? উ বাত কেনো বলছে না আপনে?

সুরেশ্বর ভেবে পেলে না কি ক’রে ওকে বুঝিয়ে দিতে পারে ব্যাপারটা। যা জানি না, তা জানি বলাও তো মিথ্যা বলা। গোয়ানদের জমির খাজনা সে চায় না, সে মাপ করে দিতে পারে; কিন্তু অন্য শরিকদের ক্ষতি করবার তো অধিকার তার নেই। লাখরাজ যা কিছু তা এখনও মেজতরফের আছে। ওটা তারা বিক্রী করে নি।

গোয়ানপাড়া চাকরান প্রতিপন্ন হলে সম্ভবতঃ একশো টাকা পরিমাণ খাজনা হতে পারবে। তার অংশ তারা পাবে। সে লাখরাজ স্বীকার করলে সেটা তাদের লোকসান হবে। সে দেখলে সকলে তার মুখ চেয়েই রয়েছে। তার কথার মর্ম কেউ বোঝে নি। হঠাৎ তার দৃষ্টি পড়ল ওই কুইনি মেয়েটির উপর। মনে হল চেষ্টা করলে ওকে বোঝাতে পারা যায়। সে বললে—তুমি একটু বুঝিয়ে বলতে পার। সম্পত্তি তো আমার একলার নয়। আমি জমিদার হয়ে সব জানি না এটা কথা ঠিক বটে। কিন্তু শরিক যখন আছে তখন কেমন ক’রে বলতে পারি যে এ লাখরাজই বটে!

হঠাৎ পিছন থেকে ধনেশ্বরের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। বললে—না জান, সহজ বুদ্ধিতে এটা তো বুঝতে পার হে রাজাবাবু, যে লাখরাজ সম্পত্তি কাউকে লাখরাজ দিতে গেলে বিক্ৰী করতে হয়। একই জমিতে আমরাও লাখরাজ স্বত্বের মালিক ওরাও লাখরাজ স্বত্বের মালিক-এ কি করে হয়!

কথাটা অত্যন্ত স্পষ্ট করে দিলে ধনেশ্বর। সুরেশ্বরের মনে পড়ল ব্রজেশ্বর বলেছিল- আমার বাবা লেখাপড়াতে পাশ করতে পারেনি। কিন্তু জমিদারী বিদ্যেতে বি-এ এম-এ। কথাটা সত্য। এক কথায় পরিষ্কার করে দিয়েছে আইনসম্মত স্বত্বের কথা।

—কখুনও খাজনা আমরা দিলাম? এতবড় বাড়ীর বাবু আপনে–ই বাত ঝুটাবাত-

—ঝুটাবাত? অ্যাঁ? ঝুটাবাত? খাজনা শুধু রূপেয়াতে হয়? আর টাকা খাজনার কথা তো বলিনি আমরা। বলেছি বেগারের কথা, চাকরান!

—চাকর আমরা কারুর না। মনিব আমাদের কেউ না। রাজাবাবু রায় হুজুর এখানে এনেছিল। জমি দিয়েছিল পিয়ার করে। আমরা কাম দিয়েছি তলব দিয়েছি। ডিকুরুজ কাম করছে ই বাবুর কাছে, তলব দেয় না? সচ বলো তুমি মঝলা তরফ কা বড়াবাবু, কখনও আমরা লোক বেগার দিলাম? বলো! আমার বাবা রায়বাহাদুরের কাজ করতো রূপেয়া মিলত না? বাবা–রায় বাবুলোকের বেইজ্জতি করেছিল এক বদমাস—বাবা আমার নিমক খেতো রায়বাহাদুর রায়বাবুর, উসকে জান নিয়ে লিল। ফাঁসি গেল। রায়বাহাদুর এতো টাকা খরচ করলে। তুমি বাবুরা ও বাবুর পোতা, বেটার বেটা, আজ তুমি লোক এই বাত বলবে? হা-হা-হা!

—আমি বলব হিলডা। আমি বলব-আমরা খাজনা কখনও নিইনি—বেগারও নিইনি। আমারও অংশ আছে।

কথাটা যে বললে তার কণ্ঠস্বর সুরেশ্বরের পরিচিত নয়। সে ফিরে দেখলে সে অতুলেশ্বর!

—আ, ছোটকাবাবু! স্বদেশীবাবু! রাজা হয়ে যাবে তুমি! হাঁ!

ধনেশ্বর একটা ক্রুদ্ধ গর্জন করে উঠল—তুই রাজদ্রোহী। এইভাবে তুই প্রজা বিদ্রোহ করতে চাস!

ব্যাপারটা কতদূর গড়াতো তা কেউ বলতে পারে না। কল্যাণেশ্বর এসে তার পথটা বন্ধ ক’রে দিলে এক কথায়। ওদের কথা পরে মীমাংসা হবে জ্যাঠামশায়। এখন গভর্নমেন্ট থেকে আপত্তি পড়েছে সমস্ত লাখরাজে!

—মানে?

—আসুন না ক্যাম্পে।

***

সুরেশ্বর বললে—ব্যাপারটা একটু জটিল। জমিদারীর কথা না বুঝলে ঠিক ধরা যাবে না, বুঝতে পারবে না। এবং না বুঝলে রায়বাড়ীর ইতিহাস-আমার জবানবন্দী সম্পূর্ণ হবে না।

আমিও সেদিন এই তথ্যগুলিকে তিক্ত কষায় বস্তুর মতই অতি কষ্টে আস্বাদন করেছিলাম।

ক্যাম্পে তখন মেদিনীপুর কালেক্টরেটের খাস তালুক বিভাগের একজন কর্মচারী এসে আপত্তি দাখিল করেছিলেন এই গোটা লাখরাজটার উপর। যার নাম ছিটজঙ্গল মহল চিরং।

পুরনো কাগজ ম্যাপ দাখিল ক’রে তিনি বলছিলেন—স্যার, এই ছিটজঙ্গল মহল চিত্রং, পরগনা মাজনামুঠার অন্তর্গত। এর রেভেন্যু মৌজা মাজনার মধ্যে ভুক্তান হয়ে থাকলেও এই ছিটমহলের খাজনা পুরনো রেকর্ডে ধার্য করা আছে একশো পাঁচ টাকা বারো আনা ছয় পাই। এখন এঁরা এই ষোলআনা ছিটমহল লাখরাজ বলে দখল করলে, এর রেভেন্যু আসবে কোথা থেকে।

পরগনা মাজনামুঠার মালিক ছিলেন রাজা যদুরাম রায়, সে পলাশীর যুদ্ধের সময়। তারপর দুপুরুষ পরে তাঁর বংশ লোপ হলে, সম্পত্তির মালিক হন তাঁর অবীরা পুত্রবধূ সুগন্ধা দেবী। তাঁর আমলে পারমানেন্ট সেটেলমেন্ট হয়। সুগন্ধা দেবী পারমানেন্ট সেটেলমেন্টে খাজনার হার মানতে রাজী হন নি। ফলে তখন সরকারী খাস আদায়ে আদায় হয়েছে খাজনা। কিন্তু সদাশয় কোম্পানী রাজবংশের স্বত্বলোপ করেন নি। আদায়-খরচা এবং রেভেন্যু কেটে নিয়ে রাজবংশের বিধবাকে লাভ যা তা দিতেন। তাঁর অবর্তমানে সম্পত্তি নিয়ে দত্তক পুত্র আর দৌহিত্র বংশে মামলা হয়। দৌহিত্র বংশ জয়ী হয়। এই পারমানেন্টের সময় এখানকার কালেক্টরেটে রেভেন্যু নির্ধারণের ভার নিয়ে আসেন কানুনগো কুড়ারাম ভট্টাচার্য বা রায়-ভট্টচার্য। তিনিই এই ছিটজঙ্গল-মহল চিত্রং লাখরাজ হিসেবে খরিদ করে এর রেভেন্যু মাজনা তৌজির ঘাড়ে চাপিয়ে যান। কিন্তু রেভেন্যু ডিফল্টে বার বার এই সম্পত্তি হস্তাস্তর হয়ে হয়ে শেষ সরকারী খাসমহল হিসেবে গণ্য হয়। মধ্যে মধ্যে পাঁচ বছর দশ বছরের জন্য টেম্পোরারী বন্দোবস্ত হয়েছে। গত বৎসর থেকে সে ব্যবস্থা রহিত করে সরকার ১৯৩৬-এর ১লা জানুয়ারী থেকে খাসে রাখাই স্থির করেছেন। এখন মাজনামুঠা সরকারী খাসমহল, খাসমহলের জমিদারী স্বত্বের মালিক। সেই হিসেবে আমরা আপত্তি দিচ্ছি যে এই ছিটজঙ্গল মহল লাখরাজ হতে পারে না। কেননা এই রেভেন্যু চুয়ান্ন টাকা সরকারকে পেতেই হবে। এই তার কাগজ—এই তার ম্যাপ। এই দেখুন!

হাকিম হরেন ঘোষ একটু হেসে বললেন—কি? আপনাদের কি বলবার আছে এতে? এই যে কলকাতার রায়বাবু! আপনার কাছে তো কুড়ারাম রায়েরা পাঁচালী-টাঁচালী হরেক রকম আছে, শুনছি আজকাল ছবি আঁকা ছেড়ে কাগজপত্র নিয়ে কি সব গবেষণা-টবেষণা করছেন অনেক কিছু। কিছু বলুন!

সুরেশ্বর খোঁচাটা একটু নিষ্ঠুর ভাবেই অনুভব করলে। মুখচোখ লাল হয়ে উঠল। বলতে গেল—না—আমার বলবার কিছু নেই। যা পাচ্ছেন তা লিখুন। আমরা কিছু নমুদ পেলে পরের স্টেজে এ নিয়ে আবার লড়ব।

ওদিকে বাইরে তখন গুঞ্জন উঠেছে চারিদিকে, রাজা যদুরামের লাখরাজ বাতিল হবে? তবে কোন্ লাখরাজ থাকবে? লোকে বলে রাজা যদুরামের নিষ্কর খাঁটি সোনার মোহর এবং তাতে নাকি মা লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ আছে।

সরকারী খাসমহলের কর্মচারীটি বললেন—এই ছিটজঙ্গল মহলে একশো আট বিঘার যে প্লট রয়েছে এ ছাড়াও আঠাশ বিঘা আবাদী জমির একটি প্লট রয়েছে, সে জমি রেকর্ড হয়েছে দয়াল ভট্টাচার্যের নামে।

দয়াল ভট্টাচার্য—সেই দল ভটচাজ যিনি শিবেশ্বর রায়েরও খুড়ো, রায়বাহাদুর রত্নেশ্বরের জ্ঞাতিভাই। যিনি নাড়ী দেখে রোগ নির্ণয় করতে পারেন, যিনি সুরেশ্বরকে সোমেশ্বর রায় আর তাঁর স্ত্রী বাঘিনী ঠাকুরুণ রাজকুমারী কাত্যায়নীর গল্প বলেছিলেন—তিনি এবার এগিয়ে এসে বললেন—নজীর আমার কাছে আছে হুজুর। আমার দলিল রয়েছে, এই দেখুন। ১২৯৯ সালের খরিদা দলিল। স্বর্গীয় কুড়ারাম রায়-ভট্টাচার্য যখন গ্রামে ফিরে প্রথম বসবাসের ইচ্ছা করেন, তখন আমার প্রপিতামহ তার কাজকর্ম দেখতেন। জ্ঞাতি আমরা। তখন খুব নিকট জ্ঞাতি। এই দু-পুরুষ ছাড়াছাড়ি। তা রায়-ভটচাজমশায় এই লাখরাজ সম্পত্তি কেনেন, তিনি ওই জঙ্গল আর নেন না। আমার প্রপিতামহকে এই আবাদী জমি দেন। টাকা বোধ হয় তিনিই দিয়েছিলেন। এতেই সব আছে দেখুন। রাজা যদুরামের দেওয়া লাখরাজ-ও লাখরাজ অক্ষয়। দেখুন এতেই বিবরণ পাবেন। খোদ নবাব মীরজাফর আলি খাঁয়ের ছাড় দেওয়া আছে। রায় যদুরামের নিষ্কর কোনক্রমেই বাতিল হবে না।


© 2024 পুরনো বই