কীর্তিহাটের কড়চা – ৪.৫

কি হবে তাঁর রাজত্বে? কে ভোগ করবে তাঁর রাজত্ব? রাজত্ব কি মানুষ নিজের জন্যে অর্জন করে? বংশের জন্য করে। না-খেয়ে তিল তিল করে সঞ্চয় করে রেখে যায় তাঁর বংশধরেরা ভোগ করবে বলে।

তাঁর রাজত্ব ভোগ করবে কমলাকান্ত?

না। তা হবে না। তা দেবেন না তিনি।

লোকে তাঁকে বলে—বিবাহ কর। কি হয়েছে, স্ত্রী জলে ডুবে মরেছে। মরেছে? ভবানী মরেছে? যা হয়েছে তাই হয়েছে। বিবাহ তিনি আর করবেন না। না। ও মেয়েজাত, ও জাতকে নিয়ে বেদের সাপ নিয়ে খেলার মত খেলতে হয়। গলায় পরতে নেই। সে বিষদাঁত ভেঙে বিষের থলি গেলেও না। ওরা পাক কষতে পারে। তোমাকে শ্বাসরোধ করে মেরে দেবে।

তার থেকে তিনি কুড়ারাম রায়ের বহুকষ্টে সঞ্চিত অর্থ, যা সোমেশ্বর বাড়িয়েছেন, তাঁর আমলেও বাড়ছে তা তিনি ভোগ ক’রে সব শেষ ক’রে দিয়ে যাবেন।

শুধু—শুধু ওই জনি। জন রবিনসন। প্রশ্ন ওই বেটা ইংরেজবাচ্চা। চার্লস রবিনসন ইংল্যান্ডে মোট বইত মাথায় করে। এখানে এসেছিল কোম্পানীর পল্টনে চাকরী নিয়ে। তারপর পল্টনে চাকরীর মেয়াদ ফুরুলে লাটসাহেব ওয়েলেসলীর চাকরীতে ঢুকেছিল একরকম চাকরের কাজ নিয়ে। সেখানে থাকতেই ইংল্যান্ড থেকে আসা একটা মেমসাহেবকে বিয়ে করেছিল। তার দৌলতেই হয়েছিল মেদিনীপুরে নুনের ট্যাক্স আদায়কারী। তাঁর বাবার সঙ্গে আলাপ সেই সময়ে। তাঁর বাবাই তাকে টাকা দিয়ে খালাড়ী ইজারা নিয়ে নুনের কারবারে নামিয়েছিলেন। তারপর নুন থেকে রবিনসনের মাথায় ঢুকল নীলকুঠী। সোমেশ্বর রায়কে বলেছিল—রায়, নুনের কারবার থেকে নীলের কারবারে অনেক বেশী লাভ। নুনের লাভ তো কোম্পানী চুষে নেয়। তার থেকে নীলে নামো। সোমেশ্বর হিসেব ক’রে বুঝে নীলের কারবারেই টাকা লগ্নী করেছিলেন। ইংরেজ জাত, মিথ্যে বলেন নি নায়েব ঘোষাল, ওরা যাই করে থাক এ দেশের, এ দেশের লোককে কিচ্ছু করতে দেয় না, দেবে না। নীলকুঠীর ব্যবসা সাহেবদের একচেটে। ও বেটারা খুন করছে, ডাকাতি করছে, লোককে বেঁধে মারছে, মেয়েদের ইজ্জত মারছে, কিন্তু ওদের সব মাফ। জেলার ম্যাজিস্ট্রেট কালেকটার, ওপরের কর্মচারীরা শিকার করতে আসে, নীলকুঠীতে ওঠে। গোগ্রাসে খায়, মদ গেলে, কুঠীওয়ালাদের মেয়ে বউ নিয়ে হুল্লোড় করে, ওদের ঘোড়া হাতী নিয়ে শিকার করে—বাস; আর কি চাই? চালাও পানসী!

কিছুদিন আগে ঈশ্বর গুপ্ত সংবাদ প্রভাকরে লিখেছিলেন—“যে সকল সাহেব যখন এ দেশে আইসেন, তখন তাঁহাদিগের ঐশ্বর্যের কথা কি বলিব, এক ছেঁড়া টুপি পচা কাপড়ের প্যাকেট পান্টুলন এবং এক কাচের টম্বল সম্বল মাত্র, কৌশলক্রমে কোন ব্যবসা ফাঁদিয়া বাবু কাড়িতে পারিলেই কিছুদিনের মধ্যেই তাঁহার আর আধিপত্যের সীমা থাকে না, তখন প্রকৃত এক কৃষ্ণ বিষ্ণুর মধ্যে হইয়া উঠেন।…আমরা কি মূর্খ আর সাহেবরা কি চতুর, আমারদিগের টাকায় ও আমারদিগের পরিশ্রমে সৌভাগ্য করিয়া, আবার কথায় কথায় আমাদিগ্যেই রাস্কেল বলে, ঘুসি মারে, চক্ষু রাঙ্গায়, যখন কিছু থাকে না, তখন কত তোষামোদ করে, পরে হৃষ্টপুষ্ট হইলেই “ডেম, বগর লায়ার বেঙ্গলিস” ভিন্ন কোন কথা শোনা যায় না…!”

ঠিক লিখেছেন ঈশ্বর গুপ্ত। সোমেশ্বর রায়ের টাকায় চার্লস রবিনসন- লাটসাহেবের খানসামা রবিনসন কুঠীয়াল সাহেব হয়েছিল। আজও বীরেশ্বর রায়ের টাকা খাটে জন রবিনসনের কুঠীতে। সেই জন—জনির মেজাজ গরম হয়েছে। বাঘিনীর পেটে যাচ্ছিল, বাঁচিয়েছিলেন বীরেশ্বর রায়, সেই তার অপরাধ! তার জন্যে লোকে তাকে ব্যঙ্গ করে। করবেই। এবং তার জন্য তার রাগ হবে বীরেশ্বর রায়ের উপর। তাও হবে। হিতোপদেশের ইন্দুরছানাকে যে ঋষি বর দিয়ে বাঘ করে তাকে ইন্দুর-বাঘ খেতে যাবেই। এই নিয়ম!

মহিষাদলের সম্পত্তি কিনবে জন, জনি। লাটসাহেবের খানসামা চার্লস সাহেবের ব্যাটা।

আর এক গ্লাস হুইস্কি ঢেলে খেলে বীরেশ্বর রায়।

না—তা হতে দেবেন না! জনিকে বাড়তে দেবেন না। না।

নিচে পাল্কীর বেহারার হাঁক উঠল। একটু নড়ে-চড়ে বসলেন বীরেশ্বর রায়। কে এল? সম্ভবতঃ সোফিয়া! আজকের ঝড়বৃষ্টিতে কলকাতার রাস্তা কাদা জলে ভরে গেছে।

গাড়ী যায় নি। পাল্কী গেছে।

কলকাতার বাড়ীর ট্যাক্স গাড়ীর ট্যাক্স নিয়ে ইংরেজপাড়া পরিষ্কার হচ্ছে। খোয়া পড়ছে। আলো জ্বলছে। আর নেটিব পাড়া কাদা খানা খন্দকে ভর্তি, অন্ধকারে ঢেকে আছে।

সোফিয়া এসে ঘরে ঢুকে সেলাম করলে—বন্দেগী মেরি মালিক, রাজাসাহেব খোদাবন্দ!

—এস-এস।

—ক্যা, বাঁদীকে দেরী হুয়া? আপ খুদ নিজু হাঁত সে সিরাজী লিকে পিঁতে হেঁ? লেকেন আভি তো আট নেহি বাজা হ্যায় মালেক!

হেসে রায় বললেন-না-না। বেশ ঠাণ্ডা করেছে।

—হাঁ–হাঁ-হাঁ—আজ তো বহুত মৌজকে রাত হ্যায়। কিন্তু আমি কি করে মালিক! এই জল ঝড় রাস্তার গর্দা পানি, আপনার সওয়ারী গেল, তবে তো বের হতে পারলাম!

বসল সোফিয়া একটা স্বতন্ত্র আসনে। হাতের পাখা, জর্দার কৌটো রেখে এগিয়ে এল রায়ের কাছে এবং গেলাস বাঁ হাতে ধরে বোতল তুলে ঢেলে গেলাস এগিয়ে দিয়ে বললে-পিজিয়ে মেরি মালেক!

তারপর বললে—আজ কি জমকদার কালো মেঘের তুফান উঠেছিল মালেক, দেখেছ?

রায় বললেন—দেখেছি। কিন্তু তুমি জান, আজকের এই জমকদার মেঘের তুফান এক ফকীর মিয়া-কি-মল্লার গেয়ে নিয়ে এসেছে।

সবিস্ময়ে সোফিয়া বললে—বল কি মালেক! সাচ বাহ্?

—বিলকুল সাচ সোফিয়া। নিজ আঁখ সে ম্যয় দেখা…

–হাঁ! বিস্ময়ে তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে উঠল।

রায় বললেন—এই বাড়ীতে সোফিয়া। এই বাগানে বসে সে মল্লার ভাঁজলে। মেঘ তখন ওই কোণে জেরাসে। তারপর ও গাইতে লাগল আর হু-হু করে ছুটে এল মেঘ, ফুলে ফুলে, হাজারো কালো মর্দানা হাঁতিকে মাফিক! আমি তার সঙ্গে তানপুরা বাজিয়েছি। খুব ভাগ্যি যে আমি তার গান থামিয়ে জোর করে তাকে ঘরে টেনে এনেছিলাম, না হলে বিজলী গিরতো ওই ফকীরের উপর।

—উ ফকীর? কাঁহা গয়া উ? চলা গয়া?

–নেহি। মওজুদ হ্যায়। তুমারই লিয়ে ময়নে উনকে মওজুদ রাখ্যা হুঁ!

—হাঁ?

—হাঁ! সেইজন্যে ব্যস্ত হয়েছিলাম তোমার জন্যে। তোমাকে দেখাব। ফকীরকে বলব কি—ফকীর মেরি সোফিয়াকে তুমি কিছু শিখিয়ে দাও! তোমার খানাপিনা গাঁজাভাঙ যা লাগবে সব বন্দোবস্ত করব আমি। আমি নিজেও শিখব!

—সে বহুত আচ্ছা হবে মালিক। বহুত আচ্ছা হবে। আমীর তোমার মেহেরবানীর আর কিনারা নেই। আমি তোমার বাঁদী হয়ে থাকব।

রায় হেসে চাকরকে ডাকলেন—জলা।

জলা—জলধর, রায়ের খাস চাকর। সে এসে দাঁড়াল। রায় বললেন—সেই পাগল কি করছে দেখ। ডেকে আন–বল আমি ডাকছি! বুঝলি।

জলধর ঘাড় নেড়ে চলে গেল।

রায় বললেন—দাও, আরও ঢাল।

—আরও খাবে মালিক? এত বড় ফকীর আসছে—মেজাজ তো তোমার ঠিক রাখতে হবে।

—মেজাজ ঠিক থাকবে সোফিয়া। ও ভাবনা তুমি ভেবো না! দাও!

সোফিয়া ঢালতে লাগল। রায় হেঁকে বললেন—তবলচী সারেঙ্গীদারকে পাঠিয়ে দে! কে আছিস!

তবলচী সারেঙ্গীদার বাইরে বসেছিল, বিনা হুকুমে তাদের ঢুকবার নিয়ম নেই। তারা এসে সেলাম বাজিয়ে ফরাসের উপর বসল। তবলা বাঁয়া পাখোয়াজ তানপুরা সারেঙ্গী সব নামিয়ে বাঁধতে বসল।

হঠাৎ একটা ভয়ার্ত চীৎকারে ঘরখানা চমকে উঠল। রায়ও চমকে উঠলেন—দেখলেন- পাগল ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে সামনের দিকে বিস্ফারিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে চীৎকার করছে এবং ভয়ে থরথর করে কাঁপছে।

রায় উঠে গিয়ে পাগলের কাঁধে হাত রেখে ঝাঁকি দিয়ে বললেন—এই! এই! এই পাগল—এই! কি হ’ল?—এই!

—না—না—না—। আর ভয় দেখিয়ো না। না—। আমি পালাচ্ছি। আমি পালাচ্ছি।

ব’লে মুহূর্তে নিজেকে ছাড়িয়ে একরকম ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটে সিঁড়ি দিয়ে নেমে চলে গেল। অবাক হয়ে গেলেন বীরেশ্বর। পাগলের চীৎকার শোনা যাচ্ছিল। সে নিচের বারান্দা —সেখান থেকে নেমে বাগানের মধ্যে দিয়ে ফটক পার হয়ে বেরিয়ে চলে গেল!

***

সুরেশ্বর বললে-সুলতা, বীরেশ্বর রায়ের ওই চামড়ায় বাঁধানো খাতার মধ্যে বিবরণটি আছে। এরপর তিনি কয়েকদিনই ওই ময়দানে ঘুরেছেন ওই পাগলের সন্ধানে। কিন্তু তাকে পান নি। কেউ বলতে পারে নি। রায় তাঁর খাতাতে লিখেছেন—হি ইজ এ মিস্টিরিয়াস ম্যান। আই ডু নট বিলিভ ইন দিজ থিংস, স্টিল আই ক্যান নট ডিনাই হিম। নো—আই ক্যান নট! বাট্ হোয়াট ইজ ইট দ্যাট মেড হিম সো মাচ অ্যাফ্রেড? সোফিয়া ওয়াজ নার্ভাস, শকড। শী থট দ্যাট দি ক্রেজী ফকীর ক্রায়েড ইন কন্টেম্পট লাইক দ্যাট টু সী হার। নো; হি ডিড নট লুক এ্যাট হার এ্যাট অল। হি ওয়াজ লুকিং স্ট্রেট অ্যাট দি ওয়াল। হোয়াট ইজ ইট হি স দেয়ার।

(He is a mysterious man. I do not believe in these things, still I cannot deny him. No, I cannot. But what is it that made him so much afraid? Sofia was nervous, shocked. She thought that the Crazy Fakir cried in contempt like that to see her. No, he did not look at her at all. He was looking straight at the wall. What is it he saw there.)

সোফিয়া সেদিন অভিশাপগ্রস্ত পুরাকালের কোন কন্যার মত প্রাণহীন হয়ে গিয়েছিল। কয়েকবারই সে বীরেশ্বর রায়কে বলেছিল—হামারা কেয়া হোগা মেরা মালেক? এ কেয়া হো গয়া?

বীরেশ্বর রায় বলেছিলেন—কুছ নেহি হুয়া। ডরো মৎ।

সোফিয়ার চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়েছিল। তার বিশ্বাস হয়েছিল, ফকীর তাকে অভিশাপ দিয়ে গেলেন। সে অভিশাপে না-হতে পারে এমন কিছু নেই দুনিয়ায়। তার রূপ তার যৌবন তার জীবন সবই ঝরে যাবে গলে যাবে, অকালেই শুকিয়ে যাবে হয়তো।

বীরেশ্বর রায় তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন—কিচ্ছু ভয় করো না, ওসবে কিছু হয় না। তার প্রমাণ তো দেখেছ। ওই তো ভবানীকে বলত ওর ওপর দেবতার দয়া আছে। জন্ম থেকে গানে সিদ্ধি তারই ফল। সব ঝুট। ওই তো তার ছবি ওই দেওয়ালে টাঙিয়ে রেখেছি ইচ্ছে করে। তার ছবিকে সামনে রেখে তোমার সঙ্গে মহতি করি, কিন্তু তাতে কি হয়েছে? কিছু হয়নি। সোফিয়া দেওয়ালের দিকে তাকালে। দেওয়ালে ভবানীর একখানা অয়েল পেন্টিং ঝুলছে। সদ্য বিবাহের পরই শখ করে বীরেশ্বর রায় ওই অয়েল পেন্টিংখানা আঁকিয়েছিলেন সাহেব শিল্পীকে দিয়ে।

কঠোর নিষ্ঠুর বীরেশ্বর রায় ছবিখানা ইচ্ছে করে এই ঘরে টাঙিয়ে রেখেছেন।

সোফিয়া এতে খুশী হয়েছিল। ভবানী যে বিয়ের আসর থেকে তার গানের মাঝখানে বীরেশ্বরকে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল তার জন্য মনে তার ক্ষোভ এবং ক্ষত ছিল। মধ্যে মধ্যে ছবিখানার দিকে তাকিয়ে সে মুখ টিপে হাসত। আজ ছবিখানার দিকে তাকিয়ে সে বললে—জনাব, হুজুর, মেরা মালেক, ওই তসবীরখানা তুমি সরাও। দোহাই তোমার। আমার মালুম হচ্ছে কি—ঠোঁট দুটো তার কাঁপতে লাগল। অনেক কষ্টে সে-কান্না সামলে সে বললে-ওই ওরই গোস্যায় আজ এই হয়ে গেল। দেখ তুমি, ওর চোখ যেন জ্বলছে।

—জ্বলছে? কোথায়?

বীরেশ্বর রায় ছবির দিকে তাকিয়ে দেখেছিলেন এবং বলেছিলেন—কই, কোথায় চোখ জ্বলছে?

—তুমি দেখ মালিক, ভাল করে তাকিয়ে দেখ।

—দেখা হ্যায় সোফিয়া। নেহি! উ তো রোতি হ্যায়!

বীরেশ্বরের মনে হয়েছিল ভবানীর ছবির চোখ সজল, ছল-ছল করছে। টলটলে হয়ে চোখের কোলে কোলে জমে রয়েছে। এখুনি বুঝি ঝরে পড়বে।

কিন্তু সোফিয়ার তা মনে হয়নি।

দুজনেই ছবিটার দিকে তাকিয়ে বসে ছিল। সারেঙ্গীদার তবলচী এরা ব্যাপার দেখে সন্তর্পণে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যে থাকতে তাদের অস্বস্তিও হয়েছিল, ভয়ও পেয়েছিল তারা। তাদের দুটো ভয়-একটা ভয় ওই ফকীরের রোষ সোফিয়ার সঙ্গী হিসেবে তাদের উপরে ও পড়েছে। আর একটা ভয় বীরেশ্বর রায়ের মেজাজের ভয়। কখন মেজাজ বিগড়ে যায় হুজুর খাপ্পা হয়ে উঠে বলবেন- বেতমিজ বেয়াদপ কাঁহাকা, সহবৎ জান না, তরিবৎ জান না? কেন, কেন এখানে বসে আছ? কেন? তারপরই হয়তো হাঁকবে—চাবুক—

কিছুক্ষণ পর সোফিয়া বলেছিল—হুজুর মালিক!

ছবির দিকে তাকিয়ে থেকেই রায় বলেছিলেন—কি?

—বাঁদীকে আজ ছুট্টি মিলবার হুকুম হোক মালিক! আজ আমার শরীর মন কেমন হয়ে গেছে, মনে হচ্ছে হয়তো আমি মরে যাব!

তার চোখ থেকে জল গড়াচ্ছিল।

তার দিকে এবার তাকিয়ে দেখলেন রায়, তারপর বললেন—যাও। আজ তোমার ছুটি। কাল ছবিটা আমি খুলেই দেব।

সোফিয়া সেলাম ক’রে চলে গেল। রায় চাকরকে বললেন—ও বাড়ী যাবে, কাহারদের বল পাল্কী ক’রে পৌঁছে দিয়ে আসবে। সঙ্গে যেন বরকন্দাজ যায়।

তিনি বসে রইলেন ভবানীর ছবির দিকে তাকিয়ে। বললেন-অন্তত নরকে স্থান তোমার। মুক্তি তোমার নেই। পাবে না কোন দিন।

তারপর বোতলটা টেনে নিলেন।

কিছুক্ষণ পর বেরিয়ে এলেন বারান্দায়, ডাকলেন—জলধর! ওসমানকে ডাক।

ওসমান আসতেই বললেন—গাড়ি জোতো ওসমান। তুরন্ত!

ওসমান সভয়ে বললে —হুজুর!

—কি?

—এতনা রাত—

—কি হয়েছে তাতে? ওই ফকীরকে খুঁজে বের করতেই হবে।

—ও ফকীরকে তো মিলবে না হুজুর মালিক। ওকে তো হাজার ছুঁড়েও মিলবে না।

—মিলবে না? কেন?

—ও তো হাওয়া হয়ে গেল হুজুর। এই ফটক থেকেই হাওয়া হয়ে গেল। আমি নিজু আঁখ সে দেখেছি।

—তুমি উল্লুক। গিধ্বড়। বেওকুফ কাঁহাকো, আদমী হাওয়া হয়? হতে পারে!

—হম নিজু আঁখসে দেখা হ্যায় হুজুর।

ধমকে উঠলেন রায়-ইয়ে ঝুট হ্যায়! ই কভি নেহি হো সক্তা হ্যায়!

—হোতা হ্যায় মালেক! হামেশা হামেশা হোতা হ্যায়!

—ওসমান!

—মালিক, নোকরী আমি ছেড়ে দিচ্ছি হুজুর। আমি যেতে পারব না। বালবাচ্চা নিয়ে ঘর করি। আমাকে মাফ করুন হুজুর। আজ ও ফকীর গোস্যা হয়ে চলে গেল ফটকের ওপারে, গিয়ে হাওয়া হয়ে চলে গেল, ওর পিছনে গেলে ওকে কখনও মিলবে না। উপরন্তু ফকীরের বেশী গোস্যা হলে বিপদ ঘটে যাবে।

—ঘোড়াতে জিন দিয়ে নিয়ে এস আমি ঘোড়ায় চড়ে যাব।

—হুজুর!

এবার চীৎকার করে উঠলেন বীরেশ্বর। ওসমান সভয়ে চলে গেল। কিছুক্ষণ পর ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে বীরেশ্বর রায় বেরিয়ে গেলেন ময়দানের দিকে।

চৌরিঙ্গীর ওপাশে ময়দানে গোলপাতার জঙ্গলের মধ্যে তখন কোলাহল করে শেয়াল ডাকছে। অন্ধকার ময়দান। আজ বৃষ্টির পর একটা ভ্যাপসা গন্ধ উঠছে। রাস্তায় কাদা। তারই মধ্যে রায় এগিয়ে গেলেন। ডানদিকে অর্থাৎ পশ্চিম দিকে পড়ে রইল রেসপন্ডেন্সিয়া ওয়াক। ঘোড়াটা ওই দিকটা চেনে। ওই দিকেই যেতে চাচ্ছে। জঙ্গলের দিকে নরম মাটিতে ঘোড়াটা যেতে চাচ্ছে না। বার বার ঘাড় বেঁকাচ্ছে। রায় চাবুকটা দিয়ে সজোরে আঘাত করলেন ঘোড়াটাকে।

চীৎকার করে ডাকলেন—পাগল! এই পাগল!

ময়দানের গোলপাতায় জঙ্গলের উপর দিয়ে কলকাতায় সন্ধ্যার পর যে ঝড়ো হাওয়া বয়, সেই হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। একটা একটানা শব্দ উঠছে সর সর সর সর।

প্রহর ঘোষণা করে শেয়ালেরা স্তব্ধ হয়েছে। বাতাসের শব্দ ছাড়া আর কোন শব্দ নাই। ওই উত্তর-পশ্চিম দিকে খানিকটা দূরে লাটসাহেবের বাড়ীর আলো জ্বলছে। বীরেশ্বর রায় ফিরে এলেন। পাগলের কোন সাড়া কোন সন্ধান মিলল না।

***

সারারাত্রি বীরেশ্বর রায়ের ঘুম হয়নি।

ওইদিনের ঘটনা, যা তিনি স্মরণীয় বলে লিখে রেখেছেন, তার মধ্যে আছে- For the rest of the night-I lay wide awake and thought over the matter.


© 2024 পুরনো বই