কীর্তিহাটের কড়চা – ৪.১

রাত্রি গভীর হয়েছে।  কলকাতা শহরের মত শহরও স্তব্ধ। জানবাজারের বুক চিরে চলে গেছে ফ্রি স্কুল স্ট্রীট, তার একটু আগে গিয়ে মিলেছে লিন্ডসে স্ট্রীটের সঙ্গে, লিন্ডসে স্ট্রীটের উত্তরে হগ সাহেবের মিউনিসিপ্যাল মার্কেট। ১৯৫৩ সালেও ফিটন ছিল অনেক। গোটা অঞ্চলটাতেই অ্যাংলোইন্ডিয়ান মুসলমানদের সংখ্যা বেশী। বোধ করি বাঙালী হিন্দু পরিবারের বড় বাড়ী হিসাবে রায়দের বাড়ীটাই শেষ বাড়ী। পশ্চিম গায়েই ফ্রি স্কুল স্ট্রীট। ফ্রি স্কুল স্ট্রীটে কিছুক্ষণ আগে কতক্ষণ তার হিসেব ঠিক নেই, এই অতীত কথায় বক্তা এবং শ্রোতার নিমগ্নতার মধ্যে সে হিসেব হারিয়ে গেছে, তবে কিছুক্ষণ আগেও মধ্যে মধ্যে মধ্যযুগের সেই নির্জন প্রান্তরে ধ্বনিত কোন দুঃসাহসী কিম্বা কোন পলাতকের ঘোড়ার ক্ষুরের আওয়াজের মত একটি ঘোড়ার ক্ষুরের আওয়াজ খপ-খপ খপ খপ শব্দ তুলে দূর থেকে কাছে এসে আবার দূরে চলে গেছে। দু-চারটে কুকুরের আওয়াজ শোনা গেছে মিউনিসিপ্যাল মার্কেটের ওদিক থেকে। মার্কেটের মাংসের দোকানে হাড় আর ফেলে দেওয়া চর্বি মাংস খেয়ে যে কুকুরগুলো সারাদিন পরস্পরের মধ্যে ঝগড়া করে আর দোকানের দিকে তাকিয়ে থাকে, তারাই এখন ফুটপাথে পড়ে আছে। মধ্যে মধ্যে কিছু দেখে চীৎকার করে উঠছে। আবার সব চুপচাপ হয়ে যাচ্ছে। এ অঞ্চলে অনেক বার, সেগুলোও বন্ধ হয়ে গেছে। এর আগে মাঝে মাঝে স্খলিত পায়ের প্রমত্ত জুতোর শব্দ, দু’চারটে জড়ানো কথা, গান বা আস্ফালন শোনা গিয়েছিল-তাও আর শোনা যায় না।

নভেম্বর মাসের পঁচিশ তারিখের রাত্রি; শীত ঘন হয়ে এসেছে, বাহিরে হয়তো আবছা কুয়াশার একটা আভাস ভাসছে; সব স্তব্ধ; এরই মধ্যে সুরেশ্বর বলে চলেছিল কীর্তিহাটের রায়বাড়ীর কড়চা, আর সামনে সাজানো ছবিগুলিকে দেখিয়ে বলছিল—এই দেখ!

১৯৪৮ সালে ভবানী দেবী জলস্রোতে ঝাঁপ দিয়ে কোথায় চলে গেলেন। বীরেশ্বর রায় কীর্তিহাট ছেড়ে এলেন।  কলকাতার এই বাড়ীতে বাস করতে লাগলেন। এই ফ্রি স্কুল স্ট্রীটে তাঁর জুড়ি ঠিক এমনি গভীর রাত্রে ক্ষুরের শব্দ তুলে, চাকার শব্দ তুলে ফিরে আসত। তখন রাস্তায় পিচ হয়নি, গাড়ীতে রাবার টায়ার হয় নি, রীতিমত রথচক্রের ঘর্ঘর শব্দে এপাড়ার অনেক ঘুমন্ত জনের ঘুম ভাঙিয়ে ফিরত বউবাজার থেকে। বউবাজারে সোফিয়া বাঈয়ের ঘরে তিনি আসর পেতেছিলেন। এ সেই সোফিয়া, যে কিশোরী বয়সে বীরেশ্বর রায়ের মামাতো ভায়ের বিয়ের আসরে তার মায়ের সঙ্গে গিয়েছিল মুজরো করতে। যার গান শুনতে বসে সবটা তার শোনা হয় নি। ভবানী দেবী এসে মুখ টিপে হেসে বলেছিলেন- আপনার ভাই—বর—বাঁধা পড়েছেন গানের দায়ে। বাসরে গানের আসরে ফেল করেছেন। তিনি আপনাকে ডেকেছেন তাকে খালাস করে নিয়ে যেতে।

এই সপ্রতিভ ও কিশোরীর সরস কৌতুকের আহ্বানে তিনি সোফিয়ার গান আধশোনা করে উঠে গিয়ে নিজে পড়েছিলেন ভবানী দেবীর আঁচলের বাঁধনে। সেই বাঁধন ভবানী দেবী খুলে দিতেই তাঁর মদের নেশার মধ্যে মনে পড়েছিল সোফিয়াকে। তিনি কলকাতায় এসে প্রথমেই কিনেছিলেন জুড়ি গাড়ী।

কলকাতা তখন জব চার্নকের হাট এবং ঘাট কলকাতা অর্থাৎ বাজার কলকাতা এবং বন্দর কলকাতা থেকে রাজধানী কলকাতার চেহারা নিচ্ছে।

লর্ড ওয়েলেসলীকে তখন বলত নবাব ওয়েলেসলী। একাধারে গবর্নর জেনারেল আবার জঙ্গীলাট। কলকাতাকে বেড় দিয়ে ষাট ফুট চওড়া সার্কুলার রোড বা বাহার সড়ক গঙ্গার ধারে ফোর্ট উইলিয়ম থেকে কলকাতার উত্তর সীমানা পর্যন্ত বাঁধিয়ে দিয়েছেন। গবর্নর জেনারেলের থাকবার জন্য বিরাট লাটপ্রসাদ বানিয়ে ফেলেছেন। তখন লর্ড ডালহৌসি ভবিষ্যতের গর্ভে, জায়গাটির নাম ডালহৌসি স্কোয়ার হয় নি। শুধু কলকাতার নয়, ব্যারাকপুরে বাগানবাড়ী হয়েছে। লাটসাহেবের বাড়ী চাকর-বাকরের বাহিনীতে ভরে গেছে।

কলকাতার লোক বসে নেই। তারাও এতে যোগ দিয়েছে। বড় বড় বাড়ী বাগানবাড়ীর ধুম পড়েছে। গাড়ী ঘোড়ার আমদানী হচ্ছে। ব্রুহাম-ল্যাণ্ডো-জুড়ি কম্পাস ফিটন। আবার টাউন হলও তৈরী হয়েছে সাধারণের চাঁদায়।

লাট প্রাসাদে ডিনার হয়, পার্টি হয়, মদের জোয়ার বয়, বলনাচ হয়। নাচের শেষে রাত্রে চলে তাদের মদের ব্যভিচার। ফিলিপ ফ্রান্সিস মাদাম গ্র্যান্ডের বাড়ী ছুটত মই ঘাড়ে ক’রে এটা ইতিহাসে লেখা আছে। ওখানেই শেষ নয়, ছোটখাটো সাহেবদের বাড়ীতে পোষা থাকত এদেশী মেয়ে। সে বিধবা ব্রাহ্মণকন্যা থেকে জমাদারনী পর্যন্ত। লোকে বলে ক্লাইব সাহেবের হারেম ছিল, হেস্টিংসেরও ছিল। জাহাজের সেলার এসে ফ্রি স্কুল স্ট্রীট অঞ্চলে দাপাদাপি করত। তার দেখাদেখি এদেশের ধনীদের বাগানবাড়ী হয়েছিল এবং দাপাদাপি ছিল বউবাজারের বাঈজীপাড়া থেকে হাড়কাটা রামবাগান সোনাগাছি পর্যন্ত। এসব পাড়া তখন জমে উঠছে সবে। সায়েবদের জন্যে বিলেত থেকে মেয়েরা আসছে বেশ্যাবৃত্তি করতে।

তারই মধ্যে চলে সভাসমিতি। তারই মধ্যে রাত্রিশেষে সুর্যোদয়ের ছটা বাজে। সকালে উঠে রাত্রের নেশা চোখ থেকে মুছে রাতের মানুষ আর এক মানুষ হয়ে ওঠে।

রামমোহন রায় ব্রাহ্মদর্শন প্রচার করেন, ইংরিজী শিক্ষার জন্য উঠেপড়ে লাগেন। সতীদাহ নিবারণের আন্দোলন করেন। বিদ্যাসাগর আন্দোলন করেন বিধবাবিবাহ নিয়ে। জমিদারেরা করেন ল্যান্ডহোল্ডার্স সোসাইটি, বৃটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটি, ডিস্ট্রিক্ট চ্যারিটেবল সোসাইটি। হিন্দু কলেজ, মেডিকেল কলেজ গড়ে উঠেছে। খবরের কাগজ হয়েছে। এনকোয়ারার, ইস্ট ইন্ডিয়ান, জ্ঞানান্বেষণ, ইন্ডিয়া গেজেট, বেঙ্গল হরকরা, সমাচার দর্পণ, সংবাদপ্রভাকর, সমাচার চন্দ্রিকা।

সুলতা বললে-সে-কালকে আমি জানি সুরেশ্বর। তুমি বীরেশ্বর রায়ের কথা বল।

সুরেশ্বর বললে—তুমি জান সে আমিও জানি। তবে আমি আমার এর পরের ছবিখানাকে তোমাকে বোঝাচ্ছি। দেখ এই ছবিখানাই সব থেকে বড় ছবি। দেখ ছবিটাকে উপরে নিচে ডেকরেশনের প্যানেল দিয়ে আসলে তিন ভাগে ভাগ করেছি। উপর আর নিচের প্যানেলে আছে সেকাল। দেখ—উপরের প্যানেলে লাট সাহেবের নতুন বাড়ী, দুপাশে লিভারি আঁটা চাকরের সারি, মাঝখানে দাঁড়িয়ে লর্ড ওয়েলেসলী। তারপর দেখ টাউন হল। ওই দেখ ডেভিড হেয়ার ঘড়ির দোকান বন্ধ করছে, বগলে বইয়ের গাদা। তার পাশে ডিরোজিও। তার পাশে চার্লস গ্র্যান্ট; তারপর মেকলে। ওই দেখ চৌরঙ্গীতে সাহেবদের গাড়ী চলছে, সামনে সহিস ছুটছে। ওই দেখ পাল্কি চলছে। ওই দেখ উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক। হিন্দু কলেজ, মেডিকেল কলেজ। বেন্টিঙ্কের হাতে গুটনো কাগজ, সতীদাহ প্রথা রহিত বিল, বিধবাবিবাহ বিল। নিচের প্যানেলে দেখ রামমোহন রায় উঁচু বেদীতে দাঁড়িয়ে একটি আঙুল দেখাচ্ছেন, লোকে দেখছে। এক ঈশ্বর ব্রহ্ম। তারপর দেখ দ্বারকানাথ ঠাকুর, তাঁর সামনে দুটো দরজা–ল্যান্ড হোল্ডার্স সোসাইটি, কার টেগোর এ্যান্ড কোং, য়ুনান ব্যাঙ্ক। ওর পরে একটা বাগান, ওটা প্রিন্স দ্বারকানাথের বেলগাছিয়া ভিলা। তারপর দেখ প্রসন্নকুমার ঠাকুর, রামগোপাল ঘোষ, রাধাকান্ত দেব-বগলে শব্দকল্পদ্রুম, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর—হাতে প্রথম ভাগ, ব্যাকরণ কৌমুদী, সীতার বনবাস, মাইকেল মধুসুদন দত্ত—হাতে মেঘনাদ বধ। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। রাজেন্দ্রলাল মিত্র। ওই দেখ প্যারীচরণ সরকারের হাতে ফার্স্ট বুক। ওই দেখ কালীপ্রসন্ন সিংহ বগলে মহাভারত। আবার ওই দেখ রাত্রে সাহেবদের বলনাচ। বাবুদের বাইজী খেমটা নাচের আসর। এরই মাঝখানে ওই দেখ, এই বাড়ীর মাঝখানের হলে বসে রয়েছেন বীরেশ্বর রায়। সামনে টেবিলে হুইস্কির বোতল গ্লাস। ওই পড়ে রয়েছে সোফার উপর সোফিয়া বাঈ। মদে তার জ্ঞান নেই। অপরূপ সুন্দরী ছিল সোফিয়া বাঈ। কেউ বলত কাশ্মীরী মেয়ে, কেউ বলত পার্সী মেয়ে। নিতান্ত শৈশবে কিনে মানুষ করেছিল ওর বাঈজী-মা!

১৮৫৫ সালের ৩১শে মের রাত্রি সেদিন।

তার আগে সুলতা, ১৮৪৮ সালের ২৩শে জুলাই, শ্রাবণ মাসের ৬ তারিখ ছিল, সেই তারিখে বীরেশ্বর রায় লিখেছিলেন তাঁর স্মরণীয় ঘটনালিপির বাঁধানো খাতাটাতে—Am I going mad? Yes it is madness! Let it come. তারপর থেকে বলতে গেলে মেরুন রংয়ের চামড়ায় বাঁধানো খাতাখানাকে একরকম সাদাই বলতে হবে। ১৮৪৯ সাল থেকে ১৮৫৪ সাল পর্যন্ত মাত্র কয়েকটা তারিখের কথা মাত্র দুচার বা আটদশ লাইনে লেখা। মাত্র ঘটনাটুকুর উল্লেখই আছে। বীরেশ্বর রায়ের চরিত্রবৈশিষ্ট্য আবেগের কোন স্পর্শ নেই। একরাত্রির শিকারের কথা আছে। যা ঘটেছিল তা ঘটনার বৈচিত্র্যেই রোমাঞ্চকর। বিস্তৃতভাবে লিখলে ভাল একটা শিকার-কাহিনী হতে পারত, কিন্তু দশ লাইনে লিখেছেন বীরেশ্বর রায়। একেবারে গোড়াতেই লেখা killed a tigress today. বিবরণ সংক্ষিপ্ত। জন রবিনসনকে খবর দিয়েছিলাম, সে এসেছিল। নৌকো করে হলদির মোহনার কাছে জঙ্গলে যেতে হয়েছিল। মাচা বাঁধা ছিল। শুনলাম বাচ্চা আছে সঙ্গে। বুঝলাম বাঘিনী। বললাম—ফার্স্ট শট আমার। জন বললে—না—আমার। আমি গেস্ট তোমার।

আমি বললাম—জনি, তুমি মিস করবে আমি নিশ্চিত।

জনি রেগে উঠল, বললে —বাজি?

বললাম—হারবে?

সে বলল—মানে? তুমি আজকাল গুনতে শিখেছ নাকি?

বললাম -না। নারীর প্রতি তুমি অন্ধভাবে আসক্ত। ওই সব এদেশের কালো মেয়েগুলোর যেটাকেই দেখ তার জন্যে পাগল হয়ে ওঠ। And it is a tigress she is beautiful and clever. ওদের তুমি চেন না! The striped tigresses are Brahmin ladies among the tigers.

জনি হেসে উঠল। বললে—তুমি একটা ডেভিল। আমার হাতেই ওটা মরবে। দেখ!

জোর করলাম না। কারণ ও আমার গেস্ট! কিন্তু যা ভেবেছিলাম তাই হল। The tigress came. বাঁধা ছাগলটা একবার চেঁচিয়েই চুপ করলে। বাঘিনীটা একটা গর্জন দিয়ে চুপ করলে। চাঁদের আলো ছিল। জনি নিশানা করে গুলি করলে। বাঘিনীটা লাফ দিয়ে উঠে ধপ করে পড়ল নিথর হয়ে। জনি হেসে উঠে-Bira, you have lost, বলে ঝপ্ করে লাফিয়ে পড়ল মাচা থেকে। মূর্খ! মাতাল! আমি বারণ করবার সময় পেলাম না। কিন্তু যা করতে হবে করতে ভুললাম না। বন্দুক তুললাম। আমি জানি জনি মিস করেছে গুলি। এবং ওই ব্যাঘ্র-নারীটি মরার ভান করে পড়ে আছে; she will now jump up on the foot! ঠিক তাই। মুহূর্তে বাঘিনী উঠে দাঁড়িয়ে দেহটাকে টান ক’রে একটা ভীষণ গর্জন করে উঠল। জনি মুহূর্তে হতভম্ব হয়ে গেছে, বন্দুক তুলতে হাত কাঁপছে। আমি বন্দুক ধরে স্থির। বাঘিনী লাফ দিল, আমি গুলি করলাম। এবং সে উঁচুতে উঠে আবার পড়ল ধপ করে। এবং আবার আমি গুলি করলাম। জনি নিচে গাছের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে নিঃশেষিতশক্তি ভেঙেপড়া মানুষের মত। বন্দুকটা ফেলে দিয়েছে মাটিতে নিজেই। এবার আমি লাফিয়ে পড়লাম। বাঘিনী মরেছে। প্রথম গুলিতেই মরেছে। মাথার খুলি ভেঙেছে। দ্বিতীয় গুলিটা লেগেছে বুকে। জনিকে বললাম—বাক আপ জনি! টেক এ সিপ অফ ব্রান্ডি। ইট ইজ নাথিং। পকেট থেকে ছোট বোতলটা বের করে দিলাম। বরং—বললাম —try a tiger and you will hit him. There you will never miss. খুব জোরে হেসে উঠলাম। জনি চমকে উঠে বললে—বীরা, স্টপ স্টপ। ফর হেভেন্‌স্‌ সেক ইউ স্টপ।

এটা সেপ্টেম্বরে। জুলাইয়ের ওই যে দিন ভবানী দেবী জলে ভেসে গেলে লিখেছিলেন—Am I going mad? তারপর এই প্রথম

তারপর ডিসেম্বরের ১০ তারিখে ক’লাইন লেখা।  কলকাতা যাচ্ছি আজ। সামনে বড়দিন।  কলকাতায় নেমন্তন্ন আছে অনেক। লাটসাহেবের সঙ্গে ইন্টারভিয়ু আছে। ল্যান্ডহোল্ডার্স সোসাইটি, ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটির মিটিং আছে। কিন্তু আর কি কীর্তিহাটে ফিরব? No! খুব বড় করে লেখা No!

ডিসেম্বরের ১৫ই লেখা—রাণী রাসমণির বাড়ীতে গিয়েছিলাম দেখা করতে। জানবাজারের বাড়ীর জায়গা ওঁরাই দান করেছিলেন। কৃতজ্ঞতা মানুষের থাকা উচিত। নইলে ওঁরা ধর্মবিশ্বাসী গোঁড়া হিন্দু, ওঁদের সঙ্গে আমার বনার কথা নয়। জামাই মথুরবাবু অতি ভদ্র এবং বেশ আভিজাত্য সম্পন্ন ব্যক্তি। He received me with dignity and kindness, very gracefully. তারপর রাণীর সঙ্গেও দেখা হল। একটি মহিমময়ী মেয়ে। আমাকে মায়ের মত আদর করলেন। ব্রাহ্মণ বলে সমাদর ভক্তি করলেন। I was charmed simply charmed She is really a queen.

১৮৫৫ সালের ১লা জানুয়ারী কিছু লেখা আছে। আজ খুব মদ খাচ্ছি। অনেক বিশিষ্ট অতিথি নিমন্ত্রণ করেছি। আজ সন্ধ্যার আসরে মনে হল আমি যেন কয়েক মাস ধরে একটা টানেলের অন্ধকারে অন্ধের মত পায়ের তলায় বন্ধুর মাটিতে হুঁচোট খেয়ে, পা দুখানাকে ক্ষতবিক্ষত ক’রে এবং উপর থেকে ঝরে পড়া জলে ভিজে অসুস্থ ক্লান্তদেহে জীবনের উপর বীতস্পৃহ মন নিয়ে কলকাতায় এসে অবারিত সুর্যালোকের মধ্যে নতুন স্বাস্থ্য, নতুন উৎসাহিত মন ফিরে পেয়েছি।

Today life is something wonderful to me. I wish to live. I want to live.

দু’দিন আগে লাটসাহেব লর্ড ডালহৌসির সঙ্গে দেখা করে এসেছি। A great personality and a great diplomat—an Empire builder. আমি তাঁকে কুর্নিশ করে অভিবাদন করেছি। তিনি হাসলেন। বেশ সদয় হাসি! আমি অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম।

ল্যান্ডহোল্ডার্স সোসাইটি এবং বৃটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটিতেও গিয়েছিলাম। বড় বড় লোকের সঙ্গে আলাপ হল।

They were all very friendly to me. And I also made them feel that I was also no small fry. They all felt my personality and appreciated what I spoke in the meeting.

আমি নীলের চাষে জমিদারদের যে সমস্যা হয়েছে তার ওপর বলেছি। জন রবিনসনের মুখ আমার মনে পড়ছিল। মধ্যে মধ্যে সাদা চামড়া বলে তার অনেক ঔদ্ধত্য সহ্য করতে হয়। নীল যেসব জমিতে চাষ হয় তার খাজনা আমরা পাই না বললেই হয়। Permanent settlement-এর সময় নীলের চাষ কতটুকু হত! এখন প্রায় ২৫ লক্ষ বিঘেতে নীলের চাষ হয়। তাতে ১, টাকা হারে খাজনা বাংলার জমিদারেরা পেলে তাদের পঁচিশ লক্ষ টাকা আয় বাড়ত। আমি গ্রেট দ্বারকানাথ ঠাকুরের কথাই উদ্ধৃত করেছিলাম। নতুন কথা বলি নি। তবুও যে জোরের সঙ্গে আমি বলেছি তা সকলেই ভাল বলেছেন।

প্রসন্নকুমার ঠাকুর আমাকে বললেন—

Roy, you stay here in Calcutta, we shall miss you if you go back to that village home of yours.

সেদিন আলাপ হয়েছে জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত সিংহ পরিবারের অল্পবয়সে খ্যাতিমান কালীপ্রসন্ন সিংহের সঙ্গে। আশ্চর্য উজ্জ্বল তরুণ। কত বয়স হবে? আমি ভেবেছিলাম ১৭।১৮ হবে। কিন্তু সিনহা হেসে বললেন—আমি এখনো পনেরোতে চলছি। এবারেই আগস্টে বিয়ে করেছি। সুতরাং বয়স যাই হোক, আমি একজন পরিপূর্ণ মনুষ্য। হাফ গ্লাস বেটার হাফ ইজ ফুল ওয়ান-মোর দ্যান ওয়ান। রসিক লোক। এরই মধ্যে বিদ্যোৎসাহিনী সভা বলে একটি শুরু করেছে। শুনে বিস্মিত হয়েছি দেখে তরুণটি বললে—ডিয়ার রায়সাহেব, “বাল্যাবধি ইচ্ছে কবি কালিদাস হব কিন্তু এখন সে ইচ্ছে ছেড়েছি, কারণ কালিদাস লম্পট ছিলেন। তারপর ভাবছিলাম, জনসন হব কিন্তু না, তিনি ছিলেন গরীবের ছেলে। তবে রামমোহন রায় হওয়া যায়।” মোট কথা বিখ্যাত হতে চাই। তার জন্য বিদ্যোৎসাহী হয়েছি। গ্রন্থ লিখে গ্রন্থকার হব। ব্রাহ্ম হতে চেষ্টা করছি। বিধবাবিবাহে উৎসাহ দেব।

বলে হাসতে লাগলেদ। বললেন—যখন লিখব তখন এসব কথা খুলে লিখব দেখবেন। আপনাকে এক কপি প্রেজেন্ট করব।

আমি তাঁকে ১লা জানুয়ারীর এই সান্ধ্য আসরে নিমন্ত্রণ জানালাম। সাদরে তিনি গ্রহণ করলেন। বললাম—নাচ-গানের ব্যবস্থা থাকবে।

তরুণ কালীপ্রসন্ন হেসে বলেছিলেন—That’s wonderful! আমার দুটো জিনিস জন্মলগ্নে বলতে গেলে বিধাতা-নির্দিষ্ট হয়ে গেছে। এই নাচ-গান আর সাহিত্য। আমার জন্মের দিন বাবা নাচ-গান জলসা করিয়েছিলেন। আর পণ্ডিত বিদায় করেছিলেন শাল দিয়ে।

Certainly I will come, Thank you Mr. Roy.

নাচ-গানের আয়োজন করেছি। আমার হৃদয় আজ অন্ধকার কাটিয়ে সকালের ফুলের মত ফুটছে। তার কারণ যে তরুণী বাঈজীটি এসেছে, সে আমার চেনা। সেই মামাতো-ভাইয়ের বিয়েতে যে নিতান্ত কিশোরী বয়সে তার মায়ের সঙ্গে গান করতে গিয়েছিল। সেও আমাকে চিনেছে। সে হাসলে। আমার দৃষ্টি দেখে সে আমার অভিলাষ বুঝেছিল। সকলে বিদায় হলে সে যখন বিদায় চাইলে তখন তার হাত ধরে বললাম-না। আজ বছরের প্রথম দিন। আজ থেকেই তোমাকেই আমি জীবনের সঙ্গে বাঁধতে চাই। বাকি গোটা জীবনটার জন্য।

সোফিয়া স্থিরভাবে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বাঁ-হাতে কান চাপা দিয়ে হেঁট হয়ে সেলাম বাজিয়ে বললে-বহুত মেহেরবাণী। লেকেন। হাসলে সে।

বললাম—লেকেন কি বল?

বেগম—বিবি

বললে—উয়ো আপকি বেগম—বিবি সাহেবা হুজুরাইন, সেদিন যেমন আমার গানের মাঝখানে তোমাকে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল, তেমনি করে এসে ঢুকবে আসরে এবং আজকের রাত্রিটিও শেষ হতে দেবে না, তখন কি হবে?

বললাম—সে নেই।

—নেই?

—না, চলি গয়ি।

—চলি গয়ি? কাঁহা?

—খোদা মালুম।

একটু চুপ করে থেকে সে বললে-আজ রাত থেকেই তোমার কাছে বাঁদী হয়ে রইল সোফিয়া!

.

১৮৫৫ সালের ৩১মে-র রাত্রি সেদিন।

সেইদিনের এই ছবি সুলতা। মদের নেশায় প্রায় হতচেতন হয়ে সোফিয়া পড়ে আছে। তবলা-বাঁয়া পড়ে আছে, ফুরসী গড়গড়া পড়ে আছে, হুঁকোদানে বাঁধানো হুঁকো রয়েছে, পানের বাটা, পিকদান রয়েছে; তবলচী সারেঙ্গীদাররা চলে গেছে। দুটো গোলাপপাশ গড়াচ্ছে। বীরেশ্বর রায় মদের বোতল গ্লাস টেবিলে রেখে বসে আছেন, বড় বড় চোখ রাঙা হয়ে উঠেছে। মদের নেশা যেন কিছুতেই ধরছে না।

একটা ঘটনা ঘটে গেছে। যার স্মৃতি কিছুতেই মন থেকে মুছছে না। আজ দক্ষিণেশ্বরে রাণী রাসমণি বিরাট কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন। বিরাট মন্দির, চারিদিকে ঘন জঙ্গলের মধ্যে উঁচু কাছিম পিঠে বিস্তীর্ণ জমির উপর গঙ্গার পোস্তা বাঁধিয়ে যে মন্দির তৈরী হয়েছে, তা সেন্ট জনস্ চার্চ থেকে জাঁকেজমকে হয়তো উঁচুতে কম হবে না। লক্ষ লক্ষ টাকা খরচ। নানান দেশ থেকে ব্রাহ্মণপণ্ডিত এসেছে। কাঙালীতে ভরে গেছে। যজ্ঞ হচ্ছে।  কলকাতার বড় বড় লোকেরা দেখতে গেছেন। জঙ্গলভরা দক্ষিণেশ্বর, পথে দু’পাশে জলা। তারই মাঝখান দিয়ে নতুন রাস্তা করিয়েছেন রাণী। লাট-প্যালেস থেকে যে রাস্তাটা উত্তরমুখে মারাঠা ডিচ পার হয়ে টালা-সিঁথি-বরানগরের ভিতর দিয়ে চলে গেছে ব্যারাকপুর লাটসাহেবের বাগানবাড়ী, যার দুধারে শুধু জঙ্গল-জলা, আর মাঝে মাঝে গোলপাতার বস্তী আর দু’চারটে বাগান বাড়ী, বরানগরের উত্তরে সেই রাস্তাটা থেকে নতুন রাস্তাটা পশ্চিমমুখে চলে গেছে মন্দির পর্যন্ত। এদিকে আর একটা রাস্তা বাগবাজার খাল পেরিয়ে কাশীপুরের ভেতর দিয়ে চলে গেছে। ওই রাস্তা দুটোর আজ হাতখানেক মাটি ধুলো হয়ে উঠে গেছে গাড়ীর চাকায় চাকায়। ল্যান্ডো বাগ ফিটন ব্রাউনবেরী আর ভাল ভাল ঘোড়া। সে একেবারে সারিবন্দী। দু ধারে কাঙালী চলেছে, তার মাঝখান দিয়ে গাড়ী। সামনে সহিসেরা হাঁকতে হাঁকতে যাচ্ছে—তফাৎ যাও, তফাৎ যাও। এর মধ্যে বীরেশ্বর ও গিয়েছিলেন। কিন্তু যেতে যেতে আপসোস করেছেন, কেন গাড়িতে এসেছিলেন। ধুলোতে সর্বাঙ্গ ভরে গেছে। এর থেকে চাঁদপালঘাট কি জগন্নাথঘাট থেকে বজরা করে এলে পারতেন। কিন্তু কিছুদিন আগে কেনা নতুন ফিটন, আর কালো ওয়েলার ঘোড়া দুটো দেখবার কেমন একটা ঝোঁক হয়েছিল। বীরেশ্বর রায় নিজেই লিখেছেন,—It was a mistake.

রায় সোফিয়াকে নিয়ে বেড়াবার জন্যে নতুন ফিটন আর জোড়া বাছাই করে কালো দুটো ঘোড়া কিনেছিলেন সম্প্রতি। গঙ্গার ধারে চাঁদপাল ঘাটে যেতে যে একটা পথ চলে গেছে দক্ষিণে, কাঁচাপথ, সেই পথে, কিছুদিন আগে তাঁর পুরানো গাড়ি আর ঘোড়াদুটো হেরে গিয়েছিল অন্য গাড়ির কাছে। নতুন ঘোড়া, নতুন ফিটন সেইজন্যে। গঙ্গার ঘাটে তাঁর দুখানা নৌকোও আছে। একখানা বড় বজরা, অন্যখানা পানসী। বড় বজরাখানা সোমেশ্বর রায় করিয়ে গিয়েছিলেন। ওখানায় গঙ্গা হয়ে কাকদ্বীপকে উল্টো দিকে রেখে হলদীর ভিতর হয়ে বর্ষার সময়ে সরাসরি কীর্তিহাটে যাওয়া যায়। শুকোর সময়ে জোয়ারো এলাকার পর, পাল্কি করে যান বাকী পথটা। কিম্বা হাতী। বীরেশ্বর রায় ঘোড়ায় যেতে ভালবাসেন।

থাক সে-কথা। কীর্তিহাট অনেক দূরে পড়ে গেছে। দিন দিন দূরত্ব বাড়ছে। সেখানে কোনদিন ফিরবার বাসনা তাঁর নেই।

ভর্তি দুপুরে ফিরবার সময় ওই কথা ভাবতে ভাবতেই ফিরছিলেন। রাণী রাসমণির কাছে তাঁরা উপকৃত। পিতামহ দান গ্রহণ করেছিলেন—এই জানবাজারের জমি। অবশ্য সেদিনের কুড়ারাম রায় ভট্টাচার্য কোম্পানীর সেরেস্তায় থেকে অনেক কিছু সুগম করে দিয়েছিলেন। তার জন্য তিনি তাঁর প্রাপ্যও নিয়েছিলেন। জমিটা দান। তাছাড়া রাণীকে বীরেশ্বর সত্যিই শ্রদ্ধা করেন। রাণী যেমন বুদ্ধিমতী, তেমনি তেজস্বিনী আবার তেমনি দানশীলা। জেলেদের উপর কোম্পানীর জুলুম বন্ধ করতে গঙ্গার জলকর বন্দোবস্ত নিয়ে যে বুদ্ধি এবং সাহস দেখিয়েছেন, তা রাণীরই উপযুক্ত। আবার পূজার সময় কোম্পানীর গোরাদের সামনে যে সাহস দেখিয়েছেন, সেও তাই। আবার  কলকাতায় এবং দেশে অন্নকষ্টের সময় তিনি কাশী যাওয়া বন্ধ করে সেই টাকা খয়রাত করে আর এক মহীয়সী রূপের পরিচয় দিয়েছেন। তিনি মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছেন—তাঁর নিমন্ত্রণ বীরেশ্বর উপেক্ষা করতে পারেননি। তিনি এসেছিলেন। কিন্তু এসেও তাঁর ভাল লাগে নি। কিছুক্ষণ থেকেই তিনি শরীর খারাপ বলে চলে আসছিলেন। সকালবেলা থেকে মদ খাননি। তার উপর পথের ধুলো, মেজাজ অত্যন্ত খারাপ ছিল। গাড়ীতে চড়ে কোচম্যানকে বলেছিলেন—জলদি। তুরন্ত যানা। বহুত তুরন্ত। তবিয়ৎ ঠিক নেহি হ্যায়। সমঝা?

—হাঁ হুজুর।

সামনে দুটো সহিস ছুটে চলেছিল ঊর্ধ্বশ্বাসে, ঘোড়ার আগে দৌড়ুতে হবে তাদের। দুটো সহিস পিছনে দাঁড়িয়েছিল। ওরা ক্লান্ত হলে এরা নেমে ছুটবে, ওরা গাড়ীর পিছনে দাঁড়াবে। বেলা একটা বেজে গেছে। পথে ভিড় তখন কমেছে। দক্ষিণেশ্বরের মুখে গাড়ী দু’একখানা আসছে। যাচ্ছে দু’চারখানা। কিন্তু মানুষের ভিড় তখনও নাগাড়ে চলেছে। শুধু দক্ষিণেশ্বরের ভিড় নয়, আজ ছিল স্নানযাত্রা—যত কুসংস্কারাচ্ছন্ন বদ্ধ জীব—গামছা কাপড় কাঁধে ফেলে দল বেঁধে চলেছে গঙ্গার ঘাটে। ছেলে-মেয়ে বুড়ো-জোয়ান। যারা ফিরেছে, তাদের কপালে কাদালেপা। গঙ্গামাটি। বুকেও তাই। চৌদ্দ জন্মের পাপ খণ্ডন হল। শুধু পাপই খণ্ডন হয় নি —পুণ্যের ফল বোঝা মাথায়, কাঁকালে, নতুন কেনা ধামায় ভরে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। পুণ্য দস্তুরমত ফল হয়ে দাঁড়িয়েছে। আম-কাঁঠাল। গঙ্গার ঘাটে কিনে বাড়ী ফিরছে। বাড়ী ফিরে খাবে, কলেরা হবে, মরবে। শুধু আম-কাঁঠাল নয়, বঁটি-খুন্তী চাটু-কড়াই, খেলনা চাকি, পুতুল অনেক কিছু।

হঠাৎ সামনের সহিসদুটো হৈ-হৈ করে উঠলো। সামাল সামাল।

কোচম্যান চীৎকার করে উঠল—এও উল্লু!

চমকে উঠে বীরেশ্বর সামনে তাকিয়ে দেখলেন—এক অর্ধ-উলঙ্গ বদ্ধ উন্মাদ, ঊর্ধ্ববাহু হয়ে ছুটে চলেছে সামনে আর চীৎকার করছে—না-না-না। পারছি না। পারব না। ছেড়ে দে, গলা ছেড়ে দে। বলি—বলি!

উন্মাদ, দিগ্বিদিক জ্ঞান নেই। গাড়ীর সামনে, সহিস-কোচম্যানের চীৎকারে হুঁশ নেই। চীৎকার করতে করতে ছুটেছে। কোচম্যান দু’হাতে জোড়া ঘোড়ার লাগামের রাশ টেনে ধরলে। কিন্তু ঘোড়াদুটো প্রমত্তশক্তির গতিতে ছুটছে সামনের দিকে, তারাও থামতে পারছে না। বীরেশ্বর মুহূর্তে ফিটনের সামনের ডগ-সিটে উঠে দুই হাতে কোচম্যানের ধরা লাগাম ধরে সজোরে হ্যাঁচকা টান দিয়ে টেনে ধরলেন। ঘোড়াদুটো সামনের দুটো পা তুলে, ডাইনে বেঁকে বাঁয় পড়তে পড়তে দাঁড়িয়ে গেল। লোকটা ঘোড়ার মুখের ধাক্কায় আছাড় খেয়ে পড়েছে। বীরেশ্বর লাফ দিয়ে নামলেন। ঘোড়াদুটোরই কষ কেটে গেছে। রক্ত পড়ছে। বীরেশ্বর বললেন—চাবুক! ওসমান—চাবুক!

লোকটা উপুড় হয়ে পড়ে আছে।

দুরন্ত-রাগে বীরেশ্বর হাঁকড়ালেন চাবুক–এ্যাও উল্লুক, শূয়ার কাঁহাকা! পিঠটা কেটে গেল, লোকটা শিউরে উঠে যেন চেতনা ফিরে পেল। উঠে বসল। বীরেশ্বরের হাতের চাবুক হাতেই থেকে গেল। পাগলটাকে তিনি চেনেন।


© 2024 পুরনো বই