কীর্তিহাটের কড়চা – ৩.৩

ব্রজেশ্বর বললে—কিছু বল রাজাভাই। আমি ভাই অকপটে সব বলেছি তোমাকে, দিব্যি গেলে বলতে পারি, একটি মিথ্যে বলিনি।

বললাম-কি বলব তাই ভাবছি। বলবার কিছু পাচ্ছিনে ব্রজদা।

—ব্রজদা না বলে প্রজাদা বলো। তুমি রাজা। কিন্তু শুনলাম মদ খাচ্ছ!

—তা খাচ্ছি।

—অবাক বলতে হবে। মদ খেয়েও তুমি—। মুখের দিকে তাকাল।

জিজ্ঞাসা করলাম —কি?

ব্রজেশ্বর বললে—আমি খবর সব নিয়েছি। মদ খেয়েও তোমার মন ওদিকে ছোটে না।

—কোন দিকে?

—কোন্ দিকে আবার? শিব ছুটেছিল মোহিনীর পেছনে। এখানে পটোরা গান গায়—শিব বাগ্দিনীর পিছনে বাগ্দিপাড়ায় ঘুরত। ব্রহ্মা মদ খেয়ে নিজের কন্যা সন্ধ্যার দিকে তাকিয়েছিল। মানুষের কথা বাদই দাও। মদ খাও, খেয়ে মন ছোটে না? এখানে এমন সোনার চাঁদ গোয়ানপাড়া—ছুঁড়িদের যেমন দেহ, তেমনি রঙ্গ। ওরা একসঙ্গে মেমসাব, আবার দণ্ডকারণ্যের শবরী! তুমি এখানে মদ খেয়ে, ছবি এঁকে, বেয়ালা বাজিয়ে কাটিয়ে দিলে!

চুপ করে রইলাম। মনে মনে যাচাই করছিলাম সুলতা। ব্রজেশ্বর পাষণ্ড হোক, মূর্খ হোক, যা হোক, কথায়বার্তায় রসরসিকতা যারই ফোয়ারা ছুটিয়ে থাক, তার মধ্যে দুপুরের রৌদ্রের মত একেবারে সাদা এবং প্রখর উত্তাপের মত সত্যের বাতাবরণ সৃষ্টি করেছিল। আবহাওয়া কথাটা বলব না, খাপ খাবে না এখানে। ব্রজেশ্বরকে মিথ্যে বলতে ইচ্ছে হয় নি।

—প্রিন্স ব্রাদার!

—ভাবছি ব্রজেশ্বরদা। না-ভেবে তো বলা ঠিক হবে না।

—জান, কেন জিজ্ঞেস করছি জান?

—কেন?

—দেখ, সুখেশ্বর-কাকা একেবারে ‘ঔরংজেব’ ছিল। সে যদি ভাই অমনি বাদশাহীর আসরে প্রিন্স হয়ে জন্মাত, তবে ঠিক ওই খেল খেলত। ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট ছিল—ঠিকেদারী ও করত, আমাকে নিয়ে আমার বেনামে ঠিকেদারী চালাত। বলেছি তো—নেটিভ স্টেটে পর্যন্ত চিঠি লিখত কায়দা করে—তাতে মধ্যে মাঝে বিশ-পঞ্চাশ-একশোও এসেছে। রায়বাড়ীর সম্পত্তি, দাদুর মত ধুরন্ধর, তার কাছ থেকেও বেনামে বন্দোবস্ত নিয়েছে। আমি জানতাম বলে কিছু কিছু টাকার ভাগ আমাকে দিত। কিন্তু তার চেয়েও বড় কাণ্ড করেছিল—রায়বাড়ীর সব মোক্ষম দলিল কাগজপত্র হাতিয়ে রেখেছিল। দাদু যে দাদু, সেও জানতে পারেনি। তিনি সেরেস্তা থেকে অনেক কাগজ-খাতা সরিয়ে রেখেছিলেন। তিনি ঠাকুরের সিন্দুক থেকে গহনা বের করে গালিয়ে বিক্রী করলেন। জমা-খরচের জোচ্চুরিতে মারলেন। কিন্তু সুখেশ্বর কাকা সেই সময় সরালেন রাজরাজেশ্বরের মুকুট থেকে পাথর আর সরালেন কখানা দলিল, কখানা বাঁধানো খাতা। একখানা খাতা ইংরিজীতে লেখা-বীরেশ্বর রায়ের ডায়েরীগোছের। আর একখানা রায়বাহাদুরের ডায়েরী। বুঝেছ?

—সে খাতা কোথায়? সোজা হয়ে বসেছিলাম আমি।

—সুখেশ্বর-কাকা একটা শক্ত ট্রাঙ্কে ভরে রেখেছিলেন নিজের শোবার ঘরে—মাথার শিয়রে। মধ্যে মধ্যে বলতেন, এই তোমাদের মানে তোমার বাবার সম্পর্কে; বলতেন, ভারী হিংসে ছিল তাঁর। যোগেশ্বরদার ও হতেই হবে। যজ্ঞেশ্বরদার হবে দেখবি। তোমার মা যখন যজ্ঞেশ্বর জ্যেঠার দেবোত্তর পত্তনী নিলেন, বাড়ী কিনলেন, তখন বলেছিলেন, বাবা মরুক, তারপর পাশা উল্টে দেব আমি। মোক্ষম অস্ত্র আমার কাছে আছে।

অধীর হয়ে উঠেছিলাম আমি, বলেছিলাম, —আমি টাকা দেব ব্রজদা, তুমি দিতে পার সুখেশ্বর কাকার ছেলেদের কাছ থেকে এনে ওই খাতা?

—সবুর রাজাভাই। সবুর কিজিয়ে। উ বিলকুল দপ্তর হামারা পাশ হ্যায়। গোপেশ্বর যেদিন খুন করলে মেজকা’কে, তার দিনতিনেক পর ঠিকেদারীর বিল করবার জন্যে খাতা বার করতে গিয়ে সেই ট্রাঙ্ক আমি খুলেছিলাম। এবং সেই সময় কি মনে হল, ওই দপ্তরটি আমি বের করে নিয়েছিলাম। সে আমি কিছু পড়েছিলাম। ইংরিজী লেখা, সেই কতককালের লেখা, পড়তে পারিনি আমি, কিন্তু রায়বাহাদুরের ডায়েরী আমি পড়েছি। ডায়েরী খুব সংক্ষেপ বটে। তবে তার মধ্যে মাঝে মাঝে বড় বড় লেখা আছে। মানে দিল খুলে লিখেছেন। অনেক বড় বড় কথা। ভাল ভাল কথা তাতে আছে।—মধ্যে মধ্যে এমন চিত্তচাঞ্চল্য হয়, কামার্ত হইয়া উঠি, তখন দিগবিদিক জ্ঞানগম্যি সব তিরোহিত হইয়া যায়। মন বলে, তুমি ধনী জমিদার-পুত্র, ভূমি পৃথিবীতে আসিয়াছ ভোগ করিতে। না করিলে তুমি মূর্খ। তোমার অধিকারের মধ্যে সবই তো তোমার। ইচ্ছা করিলেই পাইতে পার। কেন মিথ্যা মুর্খের মত সংযম করিয়া নিজেকে পীড়া দিতেছ? মধ্যে মধ্যে এমন চিত্তচাঞ্চল্য ঘটে যে, নিজেকে স্থির রাখিতে পারা সুকঠিন হইয়া ওঠে। দুরন্ত ক্রোধ হয় সবকিছুর উপর। ইষ্ট-নাম করিতেছি। তাহাতেই বা শান্তি কোথায়? আজ স্ত্রীকে, সকলকে তিরস্কার করি। কাছারীতে উগ্র হইয়া থাকি। দেহধারণের একি পাপ, একি শাস্তি!

ব্রাদার, সে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমি যে আমি, আমার ভয় লেগেছিল পড়তে। কিন্তু কথাগুলো তো সত্যি। নিজেকে খতিয়ে দেখেছি। তফাৎ—তিনি ছুটতেন না, আমি ছুটি পিছনে পিছনে। গালও খেয়েছি কত মেয়ের কাছে—। তা তোমার—

—আমার ভয় লাগে রজেন্সারদা, আমায় ভয় লাগে। বাবার সব কথা মনে পড়ে যায়। মায়ের মুখ মনে পড়ে। কেমন একটা দুরন্ত ভয় লাগে আমার। নিজেকে শান্ত করি কি করে জান? শান্ত করি, যাকে ভাল লাগে, তার ছবি আঁকি। ছবিতে তাকে অন্যে চিনতে পারে না, আমি পারি।

—রাজা! মুখের দিকে তাকিয়ে রইল ব্রজেশ্বর। তারপর বললে, বুঝতে ঠিক না পারলেও ঝাপসা ঝাপসা বুঝছি। তোমাকে সেলাম।

—কিন্তু সেই খাতাগুলো আমাকে দেবে ব্রজেশ্বরদা? বিশ্বাস কর, আমি কাউকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করতে সেগুলো ব্যবহার করব না।

—রাজাসাব, সে আমি জানি। খাতাগুলো আমি লুকিয়ে রেখে গেছি। জানি না উইয়ে খেয়েছে কিনা। যদি না খেয়ে থাকে, আমি দেব তোমাকে। দেব কেন? দিয়ে রেখেছি সুরেশ্বর। কলকাতা যাবার সময় সঙ্গে নিতে পারিনি ভয়ে। কোথায় যাবে। ওবাড়ীতে রাখিনি, কে হাতাবে। এই বিবিমহলে—ওই কোণে একটা কুঠুরী আছে। তাতে আছে সব ভাঙা ছবি, কাঠকাঠরা, দেওয়ালে একটা খোলা আয়রনচেস্ট গাঁথা ছিল—আমি তারই মধ্যে রেখে গেছি—ন্যাকড়াটার ওপর কালি দিয়ে লিখে দিয়েছিলাম-”রায়বাহাদুরের শ্রাদ্ধের ফর্দ” ইত্যাদি। সে কেউ নাড়েনি বলেই আমার বিশ্বাস, যদি তুমি এবার এসে ফেলে না দিয়ে থাক। ও-ঘরটায় বীরেশ্বর রায়ের বন্দুক-টোটা থাকত। দরজাটা খুব মজবুত। মদও থাকত। তারপর কাঠকাঠরা ঢুকেছিল বাড়ী যখন তোমার বাবা মেরামত করান তখন। তুমি ওটাকে সাফটাফ করাওনি তো?

—ভেবেছিলাম করাব। রঙ-তুলির ছবির আড্ডা করব। কিন্তু ছোট আর আলো কম বলে করিনি। কই চল, দেখ কোথায় রেখেছ?

—এখুনি?

—এখুনি।

বাধা পড়েছিল। অর্চনা আর মেজঠাকুমা এসে ঘরে ঢুকলেন। অর্চনা বললে—বাবাঃ বাবাঃ, দু’ভাইয়ের কি এত কথাবার্তা চলেছে গো, যার আর শেষ নেই? আমরা পিত্যেশ করে বসে থাকব কত?

মেজঠাকুমা বললেন—আমি বলিনি ভাই। অর্চি আমাকে সামনে করে এল। বলে, বান বিঁধলে তোমাকেই বিধবে। ব্রজকে ছেড়ে দাও ভাই সুরেশ্বর। বাড়ী থেকে ডাকতে এসেছে। বউয়ের ঘুম পেয়েছে। এতটা পথ এসেছে। আমরা আজ ওদের ফুলশয্যা করব। বুঝেছ? এখানে তো কিছু হয়নি।

—আর একটু, পাঁচ মিনিট দাঁড়াও, ঠাকুমা। পাঁচ মিনিট। তারপর না-হয় ব্রজদার ফুলশয্যাতে আমি বাজাব, ব্রজদা গাইবে, সুন্দর গলা ওর। আর কে নাচবে তা ঠিক তোমরাই করে দেবে। মনটা আমার সত্যই খুশী হয়ে উঠেছিল সেই মুহূর্তে। ব্রজেশ্বর যা দিয়েছে, তাতে আমার মন একেবারে ভরে গিয়েছে। অতীতকালেরই একটা মোহ আছে। রায়বাড়ীর অতীত কাল, সে আমার অতীতকাল; একান্তভাবে আপনার। যার মধ্যে সূত্র পাব, যা ধরে আমি কেন এমন হলাম, সেই সত্য জানতে পারব। আরও আকৃতি ছিল, তোমার এবং আমার মধ্যে যে ব্যবধান হঠাৎ আবিষ্কার করেছি, তা কি পূর্ণ করা যায় না। এর মূল্য তোমার কাছে কতটা মনে হচ্ছে জানি না—

***

দীর্ঘক্ষণ স্তব্ধ হয়ে শুনেই চলেছিল সুলতা, কোন কথা বলেনি। এক বিচিত্র সত্য অতীতকালের মধ্য থেকে এসে সামনে দাঁড়িয়ে তাকেও অভিভূত করেছিল। তার অতীত পুরুষে ছিল এক ঠাকুরদাস পাল। রত্নেশ্বর রায়ের অনুগৃহীত জন। কেমন একটা অস্বস্তি তার মনে হচ্ছিল বইকি! সে রত্নেশ্বরকে রক্ষা করতে গিয়ে তার স্ত্রী-পুত্রকে বাঁচাতে পারেনি। তাকেই আবার রত্নেশ্বর খুব সম্ভবত পিজ গোয়ানকে দিয়ে খুন করিয়েছিলেন। তাতে একটা ক্ষোভও হচ্ছিল তার। এই অঙ্গস্তি এবং এই ক্ষোভ দুই মিলিয়ে একটা কি তৈরী হয়েছিল, তার মূল্য নিশ্চয় সে অনুভব করেছে।

এতক্ষণে সে সুরেশ্বরের কথার জবাবে বললে-মূল্য অনেক মনে হচ্ছে সুরেশ্বর। না-হলে এতকাল পরে সব সম্পর্ক চুকিয়ে দেবার পর তোমার এই ছবিগুলির সামনে নির্বাক হয়ে বসে তোমার কথা শুনছি কেন? বয়স অনেকটা হয়েছে। এইভাবে সারারাত্রি জেগে গল্প শোনার তো কথা নয়। বল তুমি। থেমো না। রাত্রি একটা পার হয়ে গেছে। বল।

ঢং করে ঘড়িতে একটা ঘণ্টা বাজল। সুলতা বললে, ক্লকটা ফার্স্ট আছে, দেড়টা হয়নি এখনও। একটা বাইশ। বল।

.

ব্রজেশ্বর খুঁজে পেয়েছিল দপ্তরটা। আমি খুলে দেখেছিলাম তৎক্ষণাৎ। আমার হাত কাঁপছিল। কেন তা জানি না। বেশ ঠক্‌ঠক্ করে কাঁপছিল। ব্রজেশ্বর বলেছিল—রাজা, হল কি তোমার?

হেসে বলেছিলাম—জানি না।

সে বলেছিল—আমায় দাও। গিঁটটা অনেক দিনের। মজে গেছে।

সে-ও খুলেছিল অনেক কষ্টে। দু খানা খাতাই ছিল তাতে। একখানা ডিমাই আট পেজী। চামড়ায় বাঁধানো ছিল। সেটা আমার হাতে দিয়ে বলেছিল—এইটেই ইংরেজীতে লেখা, বীরেশ্বর রায়ের। আর এটা রত্নেশ্বর রায়ের। একেবারে পুরো ডিমাই সাইজের। সেটা বাংলায়।

এর মধ্যে এসেছিল অৰ্চনা।—হল তোমাদের?

ব্রজেশ্বর বলেছিল—হল।

—কটা বাজছে মনে আছে? এগারটা।

.

সুরেশ্বর সুলতাকে বললে, আজ দেড়টা বাজে। সেদিন এগারটা বাজছিল তখন। ও-ঘরে ক্লক ঘড়িতে ঘণ্টা বাজা তখনও শেষ হয়নি।

ব্রজেশ্বরদা আমাকে বলেছিল—চলো রাজা, তুমি আমার বাসী ফুলশয্যাতে বাজনা বাজাবে, এ আমার খুব ভাল লাগছে। তুমি বাজাবে, আমি গাইব। নাও, তোমার বেহালাটা নাও।

চুপি চুপি বলেছিল—একটু খেয়ে নেবে নাকি? রাত্রি হয়ে গেছে—।

—না। চল।

ব্রজেশ্বরদা সেদিন ভাল গান গেয়েছিল। তবলা বাজিয়েছিল ব্রজেশ্বরের সৎ-কাকা। মেজঠাকুরদার দ্বিতীয় পক্ষের এক ছেলে। ওই করেই সে একরকম ফেরে এ অঞ্চলে। নেশা করে। চমৎকার তার হাত।

শেষে গান গেয়েছিল মেজদি এবং অর্চনা। ব্রজেশ্বর কিছুতেই ছাড়েনি। অনুরোধ ছিল তার অর্চনাকে। কিন্তু অর্চনা ধরেছিল—মেজদিকে গাইতে হবে।

মেজদি অগত্যা গেয়েছিলেন সাদামাটা একখানা কীর্তন। তাও মাঝপথে ছেড়ে দিয়ে বলেছিলেন—দূর! সব মাটি করে দিলাম। আমার হয় না বলছি। সত্যিই হচ্ছিল না। সুতরাং শেষ করবার কথাও কেউ বলেনি।

তারপর ধরেছিল অর্চনা। সুলতা, মেয়েটার গলা যেন মধুঢালা। কি বলব তোমাকে। কাজী নজরুলের গানের খুব চল তখন। নজরুলের গজল গাইলে। আমি বেহালায় ছড় টানছিলাম ওর মুখের দিকে তাকিয়ে। নেশা লাগছিল। গান শেষ করলে অর্চনা, তখনও আমি ছড়ি টানছি।

অৰ্চনা বললে—এখনও ছড়ি টানো যে!

ছড়িটা তুলে বললাম—তাই তো!

ঠাকুমা খিল খিল করে হেসে উঠলেন। বললাম—তা হাসতে পার মেজদি। অর্চনার কাছে ঠকে গেছি।

ঠাকুমা বললেন—দেখো যেন প্রেমে পড়ো না ভাইবোনে। গান শুনে প্রেমে পড়ার নজীর আছে। আমার দাদাশ্বশুর সায়েবীমেজাজের মানুষ ছিলেন। এ-দেশের মেয়ে তাঁর চোখে ধরত না।

—ঠাকুমা! শাসিয়ে উঠল অৰ্চনা।

ঠাকুমা দমলেন না, বললেন—এক বন্ধুর বাসরে গানে বাজনায় আমার দিদিশাশুড়ীর কাছে ঠকে এমন প্রেমে পড়লেন যে, সেই কলকাতায় বসে থেকে বিয়ে করে, ব্যান্ড বাজিয়ে ঘরে ঢুকলেন।

—এমন অসভ্য তুমি! ঠাকুমাগুলো এমনিই হয়।

উঠে গেল অর্চনা। সকলে হেসে উঠল। ব্রজেশ্বরদা বলছে—এবাড়ীতে এমন মেয়ে একটাও নেই।

রাত্রি তখন প্রায় দুটো।

বাড়ি ফিরে এসে অনেকটুকু মদ্যপান করেছিলাম। খাতাগুলো সামনে ছিল। যে আনন্দটুকু নিয়ে ফিরে এসেছিলাম, তা তখন উত্তেজনায় পরিণত হয়েছে। ভয় হচ্ছে। আবার অদম্য কৌতূহল।

***

সে কৌতূহল দমন করতে পারিনি। খুলে পড়েছিলাম।

মোটা কাগজের খাতা। পাতাগুলো হলদে হয়ে এসেছে। মধ্যে মাঝে লালচে ছাপ। কোণগুলো আপনাআপনি দুমড়েছে কুঁকড়েছে। নেড়ে দেখলাম, ভেঙে যাচ্ছে। সন্তর্পণে নাড়তে হবে। বেশ টানা লেখা। বোধহয় কুইন-পেনে লেখা। লেখা ভাল কিন্তু টান আছে, আর কালি ওই লাল-হলদে রঙের বিবর্ণতার মধ্যে অস্পষ্ট হয়ে এসেছে। একটুক্ষণ মন দিয়ে দু-চারটে লাইন পড়তে পড়তে টানের ছাঁদটা আর্টিস্টের লাইনের ঢংয়ের মত চোখে পড়ে, অক্ষর স্পষ্ট হয়ে উঠল।

This is not my diary. I don’t keep my diary and don’t like to keep diary like others. What is the use of writing what you do everyday? You do the same thing-today-tomorrow-day after tomorrow-you eat you drink you do this and that-you sleep. It seems to me that it is ludicrous to write them every night-before you retire. But this is something else. Something has happened today-that very seldom happens. Wonderful something, memorable something! That’s why I am writting down-in details lest I should forget them. It is just like writing down a poetry-You hear from a poet, which will never he published.

অনেক উচ্ছ্বাস আছে। তারপর নিজের পরিচয় দিয়েছেন। পড়তে পড়তে মনে হল দাম্ভিক উগ্র শক্ত সাহসী বিলাসী এক রসিক মানুষ সামনে এসে দাঁড়ালেন।

I am Bireswar Roy- son of Someswar Roy of Kirtihata. I can easily say—Prince of Kirtihata—I am My father is really the king of the place. But he is a coward, he is shrewd-and he is-devoted to idolatary. I am opposed to it. I don’t believe in it. Neither do I believe in other theory or thesis about God. No I do not, I don’t believe in Rev. Hill’s preachings also. I do not believe what Raja Rammohan Roy says. But my father is an affectionate father. I love him. Still I have ignored his repeated request to marry — where is the girl—that will be my wife?

.

স্ত্রী হবার মত নিজের যোগ্য কন্যা বাংলা দেশে তিনি খুঁজে পান নি। কলকাতায় সাহেবদের পাঠশালা থেকে হিন্দু কলেজে কিছুদিন পড়াশোনার পর দেশে এসেছিলেন বাপের সঙ্গে।

.

এখানে এসে রেভারেন্ড হিলকে বাড়ীতে রেখে বীরেশ্বরের পড়ার ব্যবস্থা করেছিলেন সোমেশ্বর। এখানে আরও আকর্ষণ পেলেন বীরেশ্বর। নীলকর রবিনসনের বাড়ী। তাঁর ছেলে-মেয়ের সঙ্গে মেলামেশার আকর্ষণ তাকে এখানে বাঁধলে। তার সঙ্গে শিকার করে, ঘোড়ায় চড়ে, হিল সাহেবের কাছে পড়ে, এক অদ্ভুত মানুষ হয়ে উঠলেন। না পড়লেন শাস্ত্র, না পড়লেন দর্শন, এমন কি হিল সাহেব বাইবেলখানা বার দুই পড়িয়ে আর পড়াতে পারেন নি। কিন্তু ইংরিজী ভাষায় পারঙ্গম হলেন। জীবনী পড়লেন। আইন পড়লেন এবং ঘোষণা করলেন, তিনি ঈশ্বর-ফিশ্বরে বিশ্বাস করেন না। কালীকে মানেন না! রাজরাজেশ্বর নামক নুড়িকেও মানেন না। ব্রাহ্মদের ব্রহ্মাকেও মানেন না। ইংরেজদের গড, মুসলমানদের আল্লা কিছুকেই না।

I do not believe in anything, any form of God—not in Kali not in that round shaped stone-not in Brahma, not in God nor in Allha.

এর সঙ্গে তিনি শিখলেন গান। কণ্ঠস্বর ভাল ছিল না কিন্তু কালোয়াত হবার খুব একটা ঝোঁক ছিল।

এই বীরেশ্বর রায় তাঁর যোগ্য কন্যা দুনিয়াতে, অন্ততঃ এই বঙ্গদেশে, যেখানে অষ্টমবর্ষে গৌরী হিসাবে বধু-বরণ করতে হয়, সেখানে পাবেন কোথায়? রবিনসনের কন্যা ছিল কিন্তু সেদিকে মন টেনেছিল কি না কেউ বলতে পারে না। তিনি লেখেন নি। বরং লিখেছেন, আমার হাসি পায় যখন জন রবিনসন এবং তার বোন মেরী কথায় কথায় কপালে বুকে কাঁধে হাত দিয়ে ক্রশ আঁকে। এরা একেবারে মূর্খ কুঠীয়াল। বোধ করি ওদের দেশের লাঠিয়াল ছিল। শব্দ দুটো ইংরিজীর মধ্যে ব্যবহার করেছেন।

তিনি সেদিন স্মরণীয় ঘটনার খাতা হিসেবে এই খাতা আরম্ভ করে লিখছেন—

Today-26th April ।৪42, ।4th Baisakh ।250 B.S. is a memorable day for me. I have found her out. She is she-whom I have wanted all my life and have searched her even in my everyday dreams. Yes-she is the she.


© 2024 পুরনো বই