কীর্তিহাটের কড়চা – ৩.১

মুছে দিয়ে ছেদ টেনে দিতে চাইলেও তা হয় না। ইতিহাসের একটা চক্রযন্ত্র আছে, তাতে অতীতকাল দাঁতওলা চাকার মত বর্তমানের চাকার গর্তে গর্তে ঢুকে নিজের সঙ্গে যুক্ত রেখে মানুষের জীবনকে চালায়। অতীতের কর্ম কর্মফল হয়ে তার আস্বাদ বর্তমানকে আস্বাদন না করিয়ে ছাড়ে না। সে তিক্ত হোক—বিষ হোক—আর অমৃত হোক বা মধুরই হোক। কাল যা খেয়েছি, তার পুষ্টিতেই আজ বাঁচি। এক যারা আহার নিদ্রা ত্যাগ ক’রে তপস্যা করে, সব ত্যাগ ক’রে সন্ন্যাসী হয়-বুদ্ধ চৈতন্য যাঁরা তাঁরা আলাদা।

সুরেশ্বর তা নয়। সে কি ক’রে রেহাই পাবে সুলতা, এ থেকে? জ্বরের সময় উপবাস করা অবস্থায় যা ভেবেছিল, সংকল্প করেছিল, তা পথ্য পাবার দিনটিতেই উল্টে গেল। অবিচার সুরেশ্বরের উপর করো না, সে ইচ্ছে করে তা করেনি।

ব্যাপারটা ঘটল এইভাবে। সে দিন সে পথ্য করে উঠেছে। মেজঠাকুমা কইমাছ আনিয়ে ঝোল রেঁধে বসে পথ্য করিয়েছেন, এমন সময় তার নায়ের এলেন—আজই একবার ক্যাম্পে যেতে হবে—ওঁরা হাজির হয়েছেন—আপত্তি দিচ্ছেন। পরিশেষে বললেন—ব্যাপার খুব জটিল ছোটবাবু!—সেই বাড়ীরই ব্যাপার তো! বাড়ী দেবোত্তরের টাকায় হয়েছে, এই তো? ও আর আমি পারছি না, ঘোষালমশাই। নিন, তাই নিন এঁরা।

ব্যাপারটাকে এমন ছোট ক’রে দেখবেন না বাবু। জাল ওঁদের প্রকাণ্ড। মতলব সাংঘাতিক আমি তো হতভম্ব হয়ে গিয়েছি।

—কি হ’ল?

—কাল ওঁরা গিয়েছিলেন মেদিনীপুরে। প্রণবেশ্বরবাবু, কল্যাণেশ্বরবাবু আর ধনেশ্বরবাবুর মেজছেলে ভূপেশ্বর তিন জন মিলে গিয়েছিলেন মেদিনীপুরের সব থেকে বড় দেওয়ানী উকীল সুধাবাবুর কাছে। প্রণবেশ্বরবাবু কলকাতার ব্যারিস্টারের কাছ থেকে যে মত এনেছিলেন তা যাচাই করতে। সুধাবাবু বলেছেন—হ্যাঁ, এ একটা খুব জোরালো পথ বটে। পয়েন্ট খুব স্ট্রং পয়েন্ট।

—বুঝলাম। কিসের? এরই তো?

—শুনুন আগে। এখানে যদি এই হয় যে সব দেবোত্তর! বাড়ী দেবোত্তর। দেবোত্তরের বাইরে সম্পত্তি নাই—তা হলে সেই নজীরে এঁরা—ওঁদের পূর্বপুরুষ কলকাতায় যে-সব বাড়ী পেয়েছিলেন, তাও দেবোত্তর হবে। জানবাজারের আপনার অংশের বাড়ী, তাও তাই হবে। হবে না? বুঝে দেখুন। সেটেলমেন্টের পরচার বলে, এখানকার সম্পত্তি নিয়ে মামলা ক’রে, তারই নজীরে তখন কলকাতার বাড়ী নিয়ে মামলা করবে। শিবেশ্বরবাবু কলকাতার বাড়ী বেচেছেন—তা ক্যানসেল হবে, যজ্ঞেশ্বরবাবু বেচেছেন—সে ক্যানসেল হবে, আপনার জানবাজারের বাড়ীর পার্টিশনে পাওয়া তাও ক্যানসেল হবে। বুঝে দেখুন!

চমকে উঠল সুরেশ্বর। অর্থাৎ তাকে একরকম সর্বস্বান্ত হতে হবে। জানবাজারের বাড়ীই তার একমাত্র সম্পত্তি—যা সমস্ত দেবোত্তরের মূল্যের চেয়েও মূল্যবান। এর তিন আনা অংশ মাত্র থাকবে তার।

মাথাটা ঝিমঝিম করে উঠল তার। পরক্ষণেই হল দারুণ ক্ষোভ-তারপর সেটা রূপান্তরিত হ’ল দুরন্ত ক্রোধে। ওঃ!

.

দুর্যোধন কপট পাশায় যে রাজ্য চৌদ্দ বছরের জন্য জিতেছিলেন, চৌদ্দ বছর পর সেই রাজ্য ফিরে দেবার সময় বলেছিলেন—বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচাগ্র মেদিনী। রায়বাড়ীর পার্টিশন কপট পাশার দান নয়। কুরু-পাণ্ডবদের মধ্যে যে আপোস বিভাগে রাজ্যভাগ হয়ে কৌরবেরা হস্তিনাপুরে—আর পাণ্ডবেরা ইন্দ্রপ্রস্থে রাজ্য করেছিলেন; তাই নাকচ করে সবটা গ্রাস করবার জন্য এটা ওদের পাশা খেলার চ্যালেঞ্জ—কপট পাশার দান ফেলার মত ব্যাপার। সুরেশ্বর যুধিষ্ঠির নয়—সে তাকে খুব পছন্দও করে না। সে অর্জুন ভীম এই দু’জনের ভক্ত। ও পাশার দান ও মেনে নেবে না। উত্তেজনায় উঠে দাঁড়িয়ে সে চুপ করে ভাবলে, বললে-দলিল আবার ভাল করে দেখুন।

—দেখেছি বাবু। দলিলে বাড়ীর কথার কোন উল্লেখ নেই। ঠাকুরবাড়ীর কথাই আছে। কিন্তু ওদের যুক্তিটা তো বুঝছেন! দেবোত্তরের টাকা থেকে তৈরী সব। দেবোত্তরের বাইরে কিছু নেই। সুতরাং বাড়ীও দেবোত্তর!

—কলকাতায় যে-ব্যবস্থা ছিল সোমেশ্বরের, তার থেকেই বলতে গেলে সম্পত্তি কিনেছিলেন তিনি। পওনী নিয়েছিলেন। বাড়ী তা থেকে হয়েছে।

—কিন্তু তার নমুদ কোথায়? নমুদ তো চাই।

—কেন? জানবাজারে খাতাপত্র নিশ্চয় থাকবে।

—আজ্ঞে না। সেসব আছে দেবেশ্বর রায়ের আমল থেকে। তাও কলিয়ারীর খাতাপত্র, সেসব বড়বাবু যজ্ঞেশ্বরবাবুর কাছে। তার আগেকার যা কিছু খাতাপত্র, সে রায়বাহাদুরের আমল থেকে এখানে এসেছিল।

হঠাৎ সুরেশ্বরের মনে পড়ে গেল, মেজঠাকুমা বলেছিলেন, সোমেশ্বরের কন্যা বিমলার বিবাহের আটদিনের মধ্যে অন্দরের নতুন মহলের ভিত কাটা হয়েছিল। সাল-সন-মাস এ পাওয়া গেছে একরকম কিন্তু খাতা চাই। দেবোত্তরের খাতা আছে। দেবোত্তর থেকে এ খরচ হয়ে থাকলে নিশ্চয় খরচ থাকবে।

দেবোত্তরের খাতার গাদা সে পেয়েছে। সেদিন খাতা ওলটাতে ওলটাতে রাজরাজেশ্বরের মুকুট এবং গয়না খরিদের খরচ দেখেছে। সে খাতার গাদা ওলটাতে ওলটাতে বিমলার বিয়ের বছরের খাতাটা পেলে। বিয়ের খরচের একজায়গায় ফর্দ তার পড়া ছিল। সে খাতাখানা ওলটাতে লাগল। বিয়ে হয়েছে আষাঢ় মাসে। বৈশাখ থেকে সে বিমল সায়র কাটানোর খরচের আরম্ভ আবিষ্কার করলে। কল্যাণীয়া শ্রীমতী বিমলা দেবী মাতার শুভবিবাহ উপলক্ষ্যে নূতন পুষ্করিণী বিমল সায়র কাটানোর শুভারম্ভ, মুনিষ (অর্থাৎ মজুর) দুইশত ষোলজন দৈনিক খাটুনির দাম এক আনা হিসাবে মোট সাড়ে তের টাকা।

পাতার পর পাতা ওল্টালে সে। নজরে পড়ল বিচিত্র, অবিশ্বাস্য অনেক কিছু। গব্য ঘৃত খরিদ পাঁচ টাকা মণ দরে ষোল সের ঘৃতের দাম—দুই টাকা। কিন্তু সেসব দিকে মন দেবার সময় ছিল না। বিয়ের দিন থেকে আটদিনের খরচ সে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে খুঁজে পেল কিন্তু অন্দরমহলের বা কোন বাড়িঘরের পত্তনের জন্য ভিত খোঁড়ার খরচ সে পেলে না। ভিত খোঁড়া শুধু হয় না। ভিত পূজা হয়। সোনা-রুপো-তামা দিয়ে বাস্তুদেবতার অর্চনা হয়। তার কোন নিদর্শন মিলল না।

এই সময় এলেন মেজঠাকুমা। সুরেশ্বর বললে—তুমি ঠিক জানো ঠাকুমা, ওই মাঝের মহলটা বিমলা দেবীর বিয়ের আটদিনের মধ্যেই পত্তন হয়েছিল?

—তাই তো গল্প শুনেছি। যার-তার কাছে তো শুনিনি, তাঁর কাছে শুনেছি। তাছাড়া মাটির পোড়ানো টালিতে সাল-সন লেখা আছে রে। একবারে দ্বিতীয় মহলে ঢুকবার যে বড় দরজাটা আছে, তার মাথায় লাগানো আছে। পুনুশীর অনন্তরাজ, মেদিনীপুরের ফারাতুল্লা রাজ এরাই গেঁথেছে। নকশা কাটবার মিস্ত্রি এসেছিল কলকাতা থেকে।

সুরেশ্বর নায়েবকে বললে, দেবোত্তরের খাতায় কোন খরচ নেই। এই খাতা দেখালেই হবে।

—ঠিক তা মানবে না। বলতে পারে—আরও খাতা ছিল।

—তা বলুক। সেও ওদের বের করে দেখাতে হবে। শুধু আপত্তি দিলেই হবে না। ওদেরও দেখাতে হবে!

—তাহলে আপনি একবার যদি আসেন—

—চলুন।

মেজঠাকুমা বললেন, আজই পথ্যি করে উঠেই রোদে রোদে যাবি কি? ম্যালেরিয়া জ্বর, অম্বল হবে আর হুঁ-হুঁ করে কাঁপান দিয়ে আসবে। তুই বরং চিঠি লিখে হাকিমের কাছে সময় চেয়ে পাঠা।

কথাটা সমীচীন বলে মনে হল। বেশ যেন ঘুমের আমেজও ধরে আসছিল। তাছাড়া চড়া রোদ্দুর মাথায় করে খারাপ মেজাজ নিয়ে বেরিয়ে শেষ পর্যন্ত যদি ওই মেজতরফের ধনেশ্বর প্রমুখদের ছোঁয়াচে বিশ্রী কিছু করে বসে সে, এই ভয়টাও হল। মাথাটা সত্যিই যেন উত্তপ্ত প্রখর হয়ে রয়েছে। কলকাতায় ফ্যানের তলায় যে-মেজাজ গড়ে উঠেছে, মেদিনীপুরের কড়া রোদের আঁচে ঝলসে সে-মেজাজ ঠিক থাকার কথা নয়। একখানা কাগজ টেনে নিয়ে সে দরখাস্তের ফর্মে একখানা পর লিখে দিলে নায়েবের হাতে—এটা দেবেন, তিন-চার দিন পত্র যে দিন দেবেন, আমি যাব। লিখেও দিয়েছি, মুখেও বলবেন।

নায়ের চলে গেল। সুরেশ্বর একটা সিগারেট ধরিয়ে গিয়ে কাসাইয়ের দিকের জানালাটার ধারে দাঁড়াল। বেলা বারোটা বাজছে। সূর্য প্রখর হয়ে উঠেছে। ওপারে বনটা স্তব্ধ হয়ে গেছে প্রায়। ক্বচিৎ দুটো চারটে পাখী এ-গাছ থেকে উড়ে ও-গাছে বসছে। গোটা দুয়েক ঘুঘুর সেই একটানা করুণ ঘু-ঘু ঘু, ঘু-ঘু ঘু শব্দ, একটা এদিক একটা ওদিক থেকে ভেসে আসছে। আর কয়েকটা বনকাক ডাকছে কক্-কক্ শব্দে। প্রখর উত্তপ্ত বাতাসের স্পর্শ তার মুখে-বুকে লাগছে। কংসাবতীতে জল এখন কম, ওপারে বালির চড়া পড়েছে। জলস্রোতটা প্রায় বিবিমহলের বনেদের হাতবিশেক দূরে বাঁধানো পোস্তার গা ঘেঁষে চলছে। কাঁসাইয়ের জল কাঁচ স্বচ্ছ, তাতে স্রোত ক্ষীণ, ক্ষীণ স্রোতের ধারায় দুপুরের সূর্যের ছটা গলানো রূপোর মত ঝলছে, মনে হচ্ছে তার উত্তাপও যেন অনুভব করা যায়। দুটো কুকুর উত্তাপক্লিষ্ট হয়ে জলে গা ডুবিয়ে বসে আছে।

হঠাৎ পিছনদিক থেকে মেজঠাকুমা এসে বললেন—সর।

পিছনের দিকে সুরেশ্বর তাকাতেই বললেন—জানালা বন্ধ করে দি। বিছানা করে দিয়েছে রঘু, শুগে যা। ভাল লাগবে। ছুড়িদের আসতে এখনও দেরী আছে। ওঃ কি দরদ বাবুসাহেবের জন্যে ওদের! অর্থাৎ গোয়ান মেয়ে।

সুরেশ্বরের জ্বরের ক’দিন তারা রোজ খোঁজ নিয়েছে। বাবুসাহেব কেমুন আছে? উত্তর মেজঠাকুমা দিয়েছেন—মরণ মুখপুড়ীদের, বাবুসাহেবেরও জন্যে চোখে ঘুম নেই! যা—পালা। বাবুর জ্বর হয়ে আছে।

সুরেশ্বর এসে বিছানায় গড়িয়ে পড়ে বললে—যার মেজঠাকুমা নেই তার কেউ নেই।

ঠাকুমা বললেন—তুই বড় ডেপো!

—তুমিই ক’রে তুললে।

—তোর সঙ্গে ফক্কুড়ি করবার সময় নেই আমার। আমি চললাম ঠাকুরবাড়ী, ভোগের সময় হয়েছে। তোর জ্বরের আগে বলেছিলাম—ভোগের মাছের মুড়ো যেন তোর জন্যে আসে। পাঠায় নি। তার পরদিন আমার ভাজ মরল, সেখানে গেলাম, তুইও গেলি, তার পরদিন থেকে তো জ্বরে পড়লি। আজ দাঁড়িয়ে থেকে মুড়ো এখানে পাঠাব তবে আমার কাজ!

—কি হবে? আমি তো খেয়েছি।

—ওবেলা পর্যন্ত দিব্যি থাকবে, ওবেলা খাবি। তুই যেন উঠে পড়বি নে, বুঝলি! একটু ছবি টবি আঁক না। খেয়ে ঘুমুলেও অম্বল হয়। বুঝলি। আমার ফিরতে দেরী হবে। সেই সন্ধ্যেবেলা। আমি ওই খাতা খুঁজব! অনেক খাতা সুখেশ্বর হাতিয়ে রেখেছিল। কল্যাণকে পেটে পুরে বের করবার চেষ্টা করব। আমি ওকে টাকা কবলাব। খাতা দিলে সেটা দিবি। অ্যাঁ!

—তুমি মেজদি অদ্ভুত!

—কেন রে?

—তুমি না পারো কি বল তো? মেজঠাকুরদার মত মানুষকে বশ মানাতে পার–ঝগড়া করতে পার। গোয়েন্দাগিরি করতে পার।

—আরও পারি রে। ল্যাভেন্ডার সাবান মেখে কলঙ্ক কিনতে পারি। তুই যে তুই কলকাতার আমীর তোকেও বশ মানাতে পারি।

বলে হেসে তিনি চলে গেলেন। সুরেশ্বর প্রসন্ন বিস্ময়েই মুগ্ধ হয়ে ঠাকুমার কথা ভাবছিল ছাদের কড়িকাঠগুলোর দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ টানাপাখাটা সচল হয়ে উঠল। ব্যাপারটা বুঝালে সুরেশ্বর;—মেজঠাকুমাই পাখাটানা ছোঁড়াটাকে, কিল না মারুন, ধমক মেরে সচেতন ক’রে দিয়েছেন।

চোখ জড়িয়ে আসছিল আরামে। ঘুমিয়েই পড়তো, হঠাৎ ওই বন্ধ জানালাটার ওপার থেকে বোধহয় কাঁসাই নদীটাই খলখল ক’রে যেন হেসে উঠল।

গোয়ান মেয়েগুলো এসেছে নদীর ধারে তার জানালার সামনে।

তোমাকে বলব কি সুলতা, সে স্মৃতি আমার মনের মধ্যে আমি আজও অনুভব করি। এবং শিউরে উঠি।

আমার বুকের ভিতরে যেন ওই হাসির প্রতিধ্বনি উঠল, আমার হৃৎপিণ্ডের স্পন্দনের মধ্যে। কান দুটো মুহূর্তে গরম হয়ে উঠল। হাতের তেলোয় ঘাম দেখা দিল। আমি শুয়ে থাকতে পারলাম না। রায়বংশের রক্ত উদ্বেল হয়ে উঠল, আমি বিছানা থেকে উঠে জানালার ধারে এসে দাঁড়ালাম। হাঁপাচ্ছিলাম এবং অন্ধকারের মধ্যেও নিষ্পলক হয়ে চেয়ে ছিলাম কিন্তু কিছু দেখিনি। ভয় এবং আকর্ষণের নিদারুণ দ্বন্দ্ব হচ্ছিল। তারই মধ্যে আকর্ষণই জিতেছিল। জানালার খড়খড়ি সন্তর্পণে তুলে চোখ রেখেছিলাম। খড়খড়িতে চোখ রেখে স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। যা দেখলাম, তা দেখব এ কল্পনা ছিল না। কল্পনায় ছিল ওরা দল বেঁধে কাসাইয়ের পাড়ে এসে দাঁড়িয়ে আমার বদ্ধ জানালার দিকে তাকিয়ে হাসছে। সাড়া দিচ্ছে আমাকে। আমি যে কেমন আছি সে খবর ওরা রাখে, দু তিন বেলা রাখে। ডিকু পিদ্রু য’বার পাড়ায় যায় ত’বার আমার স্বাস্থ্য সম্পর্কে মুখে মুখে এক একটি বুলেটিন ছড়িয়ে দেয়। ওরা তার উপরে এই ভরাদুপুরে কাঁসাইয়ের ওপারে ডাল ভাঙতে পাতা কুড়াতে এসে একবার খবর নিয়ে যায়। আজ নিশ্চয় খবর পেয়েছে যে, বাবুসাহেব আজ ভাত সুরুয়া খেয়েছে, সুতরাং বদ্ধ জানালার ধারে এসে ওরা হেসে সাড়া দিয়ে ডাকছে। কিন্তু তা নয়। যা দেখলাম সুলতা, সে কল্পনার বাইরে। মেয়েগুলো কাঁসাইয়ের জলে নেমেছে, সামান্য স্বল্পবাস অর্থাৎ ডুরে গামছা পরে এবং উদ্দাম হয়ে সাঁতার কাটছে আর হাসছে।

রবীন্দ্রনাথের কাশীর মহিষী করুণার যৌবনোচ্ছল শত সখীর মত ব্যাপার। তফাত সেটা ছিল শীতকাল, কাশীর শীত, সুতরাং তারা কিনারার উপরে উঠে ছুটোছুটি করেছিল আর এরা এই প্রখর গ্রীষ্মে কাঁসাইয়ের এক বুক জলে ডুবছে উঠছে, সাঁতার কাটছে আর জল ছুঁড়ছে আমার জানালার দিকে এবং খিলখিল করে হাসছে।

কাচস্বচ্ছ জলের ভিতর অর্ধনগ্ন নারীদেহ, সে যে কি মোহের সঞ্চার করে পুরুষের মনে- সে তুমি নারী তোমাকে বোঝাতে পারব না। পুরুষে অনুমান করে বুঝতে পারে। আদিম ঊষার কাল থেকে প্রকৃতি এমনি করেই পুরুষকে হাতছানি দেয়। পুরুষ যেখানে সভয়ে মা বলে কন্যা বলে সরে এসেছে সেখানে সে বেঁচেছে, আশীর্বাদ পেয়েছে। আর যেখানে তাকে প্রিয়া বলে দু’হাত মেলে এগিয়ে গেছে সেখানে তাকে সে পায়ের তলায় ফেলে বুকের উপর চড়ে নেচেছে। জীবজীবনে প্রকৃতি প্রথমদিকে পুরুষকে কাছে ডেকে তার সঙ্গে নমলীলা শেষ করে খেয়ে পেটে পুরেছে। তবু সেই কাল থেকেও তো পুরুষের এই সর্বনাশীর মোহে তার পিছনে ছোটার শেষ নেই। বুকের রক্ত তোলপাড় করে উঠল আমার। তোমাকে দেখে কখনও এ মোহ জাগেনি। এমন কি এই সেই শেফালির ঘরে টাকা দিতে গিয়েছিলাম, ওদের পাড়ায় পথের মেয়েকে টাকা দিয়ে তাদের বিস্মিত করে দিতে চেয়েছিলাম, তাদের দেখেও এ মোহ জাগেনি।

দেহ বোধহয় অবশ হয়ে যাচ্ছিল—মন মোহমগ্ন হচ্ছিল। হঠাৎ একটা দমকা বাতাসে জানালাটা সজোরে খুলে গিয়ে কপালে আমার আঘাত করলে, কপালটা কেটে গেল। আমার মোহ ভেঙে গেল। আমি চোরের মত ফিরে এলাম। কপালে রক্ত পড়ছিল, রঘুকে ডেকে বললাম-তুলো টিঞ্চার আইডিনে ভিজিয়ে লাগিয়ে দিয়ে ন্যাকড়া বেঁধে দিতে।

বসে ভাবতে ভাবতে গোপেশ্বরের কথা মনে পড়ল।

শিউরে উঠলাম। নিজেকে তিরস্কারই করছিলাম, কঠিন তিরস্কার।

অনেকক্ষণ পর মন শান্ত স্থির হল। আমি কাজের অভাবে ওই পুরনো খাতাগুলোই দেখতে লাগলাম। ওল্টাতে ওল্টাতে এসে পড়ল রাজরাজেশ্বরের মুকুট খরিদের পাতাটা। মাঃ হ্যামিল্টন এন্ড কোং, মোকাম কলিকাতা, মূল্য এক হাজার টাকা!

কালীমায়েরও সোনার মুকুট ছিল। সে শুধু সোনার। তাতে হীরে ছিল না। দাম কম ছিল। সোনার ভরি তখন চৌদ্দ-পনের-ষোল। দশ ভরি সোনায় মুকুটের দাম একশো ষাট আর বানি। মানে মজুরী—সে কত? বেশী হলে পঞ্চাশ টাকা! কুড়ারাম জহরৎ কেনেননি। তিনি সোনা কিনতেন। সোমেশ্বর কিনেছিলেন জহরত। তাঁর হাতে হীরের আংটি ছিল, দাম আড়াই হাজার টাকা। প্রসন্নকুমার ঠাকুরের বাবার হাতের আংটি হারিয়েছিল, তার দাম ছিল পঁচিশ হাজার টাকা। সে আংটি শ্যামবাজারের এক মিস্ত্রী কুড়িয়ে পেয়ে ফেরত দিয়ে বকশিশ পেয়েছিল এক হাজার টাকা। সোমেশ্বর কালীর ভক্ত তা হ’লে ঠিক ছিলেন না।

খাতা ওলটাতে লাগলাম।

কত বিচিত্র আইটেম; কত দুর্বোধ্য খরচ। বারবরদারী খাতে খরচ। মানে বুঝতে অনেক কষ্ট হয়েছিল। বুঝেও বুঝতে পারিনি। ইনাম বকশিশ সহজ কথা। বারবরদারী হল ট্রাভেলিং খরচ। টি.এ.। রোশনাই জলুস থেকে শুরু করে সংসার খাতে খরচে ঘুঁটে দেওয়ার খরচ—প্রত্যেকটি লিখে গেছে। জলসা নৃত্যগীত খাতে মোটা মোটা খরচ। বকশিশ খাতে বাঈজী বিদায়ে দরাজ হাতের পরিচয়। দানখয়রাত খাতে খরচ তার থেকে কম নয়। ভিক্ষুককে এক পয়সা থেকে ব্রাহ্মণকে এক টাকা থেকে একশো টাকা। আবার হাজার টাকাও আছে। কীর্তিকলাপে মন্দিরনির্মাণ পুষ্করিণী কাটা টোল-প্রতিষ্ঠা ইস্কুল-প্রতিষ্ঠা মেদিনীপুর সরকারী স্কুলে দান চার অঙ্কের হিসাব। জমিদারী তদ্বির উন্নতি খাতে খরচ দেখে চমকে উঠেছিলাম। কাঁসাইয়ের ধার বরাবর সাত আট মাইল লম্বা বাধ মেরামত খাতে কয়েক হাজার টাকা। হঠাৎ একখানা খাতায় চোখে পড়ল শুভবিবাহ খাতে খরচ। শ্রীমান দেবেশ্বরের বিবাহের খরচ।

আমার মন কৌতূহলে উতলা হয়ে উঠল।

পাতার পর পাতা উল্টে যেতে লাগলাম। আরম্ভ হয়েছে সিদ্ধি থেকে। সিদ্ধি এক পয়সা।

* * *

সে বিরাট খরচ।

কয়েকটা পৃষ্ঠা জুড়ে এক পয়সা থেকে হাজার দু হাজার পর্যন্ত দফায় দফায় খরচ জুড়ে সে এক পাঁচ অঙ্কের হিসাব। বারো হাজার পাঁচশো পঁয়ত্রিশ টাকা কয়েক আনা কয়েক গণ্ডা। দফায় দফায় পড়ে গেলাম। প্রতিটি আইটেম। কলকাতায় বউভাত হয়েছিল একটা। আর একটা বউভাত হয়েছিল কীর্তিহাটে। ব্রাহ্মণভোজন, শূদ্রভোজন, অপরাপর ভোজন, গোয়ানদের সিধা, মুসলমানের সিধা। বারুদের কারখানা। রোশনাই খরচ। কলকাতায় বাঈনাচ। কীর্তিহাটে যাত্রাগান। লাঠিয়াল বিদায়। কত খরচ, খরচের অন্ত নাই। এর মধ্যে পেলাম একজনের নাম। ঠাকুরদাস পাল। ঠাকুরদাসের ও তস্য পুত্র-কন্যার পোশাক বাবদ। গাত্রহরিদ্রা লইয়া যাইবার খরচ মাঃ শ্রীঠাকুরদাস পাল। শ্রীঠাকুরদাসদের পাথেয়। আবার দেখলাম অষ্টমঙ্গলার খরচ বরকন্যাসহ ঠাকুরদাস তত্ত্ব লইয়া যায়, তদ্ধাবদ খরচ একশত টাকা। কন্যাবাড়ীতে চাকর-বাকরদের বকশিশ বাবদ একশত টাকা, জিম্মা ঠাকুরদাস পাল।

আশ্চর্য এই ঠাকুরদাস পাল।

পিতামহ দেবেশ্বর রায়ের বিবাহের সর্বত্র যেন সে বিচরণ ক’রে বেড়াচ্ছিল। আমার আর বিস্ময়ের সীমা ছিল না।

চাকর? চাকরের আগে তো শ্রী লেখার রেওয়াজ ছিল না।

অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইলাম সুলতা। আমার প্রপিতামহ রত্নেশ্বর রায় ছিলেন সে আমলেরই শুধু নয় সকল আমলের দুর্লভ মানুষ। শুনেছি প্রথম জীবনে মাপা বীরেশ্বর রায়ের সঙ্গে। বিরোধ করেছিলেন তাঁর দুর্দান্ত জমিদারপনার প্রতিবাদে। অথচ এ বংশের দৌহিত্র হিসেবে তিনিই ছিলেন রায়েদের উত্তরাধিকারী; পরে মামার সঙ্গে মিটেছিল, মামা তাঁকে পোষ্যপুত্র নিয়েছিলেন। তিনি মামার সঙ্গে বিবাদ করেই ক্ষান্ত ছিলেন না। তা হলে সকলেই বলত, তিনি ঝগড়া করেছিলেন সম্পত্তির জন্য। তিনি নীল বিদ্রোহের সময় নীলকরদের বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। পরে সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হয়ে তিনি ইস্কুল করেছিলেন দুটো। চ্যারিটেবল হসপিটাল দিয়েছিলেন। ল্যান্ডহোল্ডারস অ্যাসোসিয়েশনের মেম্বর ছিলেন। সেকালের বড় বড় ধনী জমিদারমহলে তাঁর প্রতিষ্ঠা ছিল। তাঁর কজন পরম প্রিয়পাত্র ছিল, তাঁরা গ্রামজীবনের সাধারণ লোক। তাঁদের ভাইয়ের মত সমাদর করতেন। ঠাকুরদাস তাহলে তাঁদের কেউ? হঠাৎ মনে পড়ে গেল শ্যামনগরের ইস্কুলে একটা বৃত্তি আছে, মেডেল আছে, যার নাম ঠাকুরদাস স্কলারশিপ, মেডেলটার নাম ঠাকুরদাস মেডেল। গোল্ড সেন্টার্ড মেডেল। তাহলে? কে ঠাকুরদাস পাল? খাতা ওল্টাতে লাগলাম যদি তার কোন পরিচয় মেলে। কিছুদিন পরেই খরচ দেখলাম ঠাকুরদাস পালের পুত্রের বিবাহে বধূ সমাদরের যৌতুকের জন্য গহনা খরিদ একদফা এক হাজার টাকা!

সে আমলে এক হাজার টাকা তো কম নয়। তখন চৌদ্দ টাকা সোনার ভরি! তাছাড়া সাধারণ গৃহস্থঘরে সোনার গহনার প্রচলন হয়নি। গহনা ছিল রূপোর। উল্টেই যাচ্ছিলাম খাতার পাতা। নানান বিচিত্র খরচ। সেকাল যেন খরচের আইটেমগুলোর মধ্য দিয়ে নিজের একটা বিচিত্র কর উদ্ঘাটিত করছিল। কথকতার খরচ, রামায়ণ গানের খরচ, গায়ক বিদায়, আবার পাল্কি বহনের বেহারা খরচ, মদের জন্য ইনাম বকশিশ, ভট্টাচার্যপাড়ার শ্যামাচরণ ভট্টাচার্যের কন্যার বিবাহে সাহায্য; সে দু চার টাকা নয়, একশো টাকা। সন্ন্যাসীদের জন্য গাঁজা খরচ। সাপুড়েকে বকশিশ। গোয়ানপাড়ার সাহায্য। ঘরতৈরীর জন্য দশ ঘর গোয়ানকে একশত টাকা হিসাবে এক হাজার টাকা ওই গোয়ানরা! মনে আবার গোয়ানপাড়া জায়গা জুড়ে বসল।

গোয়ানদের এনে কংসাবতীর ওপারে ওই শক্তিসাধনার সিদ্ধপিঠ থেকে কিছুটা দুরেই বসত করিয়েছিলেন রত্নেশ্বর রায়। এই হুকুম দিয়ে গিয়েছিলেন বীরেশ্বর রায়—সোমেশ্বরের পুত্র, রত্নেশারের দুর্দান্ত মামা এবং রত্নেশ্বর তাঁর পুত্রও বটেন পোষ্যপুত্র হিসেবে।

অতীত কালের স্বপ্নের মধ্যে একটা বেলা কোথায় কোন দিকে কেটে গিয়েছিল ঠিক ছিল না তার। অনেকক্ষণ ওই গোয়ানপাড়ার দিকেই আমি তাকিয়েছিলাম। ওদের পাড়ায় যাই নি কোনদিন। ওদের সঙ্গে ভাল করে কথাও বলিনি, ওদের দিকে তাকাইওনি। তবে দেখছি বইকি। শুধু দেখা নয়, একটা আকর্ষণী বন্ধন যেন বেঁধে ফেলেছে। ডিকু—ডি ক্রুজ, রোজা রোজারিও আমার পেয়াদা হিসেবে কাজ করছে। কথাবার্তায় হিন্দি টান, হিন্দি-উর্দু মেশানো বিচিত্র বাংলা। ওরা নাকি। পর্তুগিজদের বংশ। গোয়া থেকে ওদের নিয়ে এসেছিলেন গোলন্দাজী করবার জন্য। এনেছিলেন হিজলীর নবাব। মহিষাদলের গর্গবাহাদুররাও কিছু এনেছিলেন। বাস করিয়েছিলেন। সে ইংরেজ আমলের আগে। তখন একদিকে বর্গীরা আসছে অন্যদিকে ফিরিঙ্গী জলদস্যু এই হারমাদরাই আসছে, ইংরেজ কোম্পানীর সঙ্গে হিজলী নিয়ে নবাবের ঝগড়া লাগছে। এরা তখন এখানে কামান দাগত। গোলন্দাজের কাজ করত। এরা তাদেরই বংশধর। কি জন্যে যে বীরেশ্বর রায় তাদের এখানে এনেছিলেন তা জানতেন তিনি আর জানতেন রত্নেশ্বর রায়। কিন্তু এরা এ অঞ্চলে মানুষদের বিচিত্র মেলার মধ্যে একটি অতিবিচিত্র রং এবং প্রকৃতি নিয়ে এসেছিল তাতে সন্দেহ নেই। এ দেশে এতকাল বাস ক’রে তার সবই একে একে এখানকার জলে বাতাসে রোদে মুছে মুছে প্রায় এক হয়েই এসেছে তবু কিছু বৈচিত্র্য এখনও আছে। সে মুখে আছে চোখে আছে চুলে আছে, কারু কারু রঙেও আছে। একটা পিঙ্গলাভা ফুটে বেরোয়। চোখে বস্ত্রাদী উগ্রতা এবং চোখের তারায় পিঙ্গলাভা আছে। প্রচুর মদ খায়। নিজেরাই চোলাই করে। মেয়েরা উগ্র অপকর্ষ প্রসাধন করে। নির্লজ্জার মত হাসে। জামা একটা করে পরে। বুড়ী মেয়েরা এখনও সেমিজ ধরনের ফ্রক বা গাউন পরে। আবার তরুণীরা আঁটোসাঁটো করে কাপড় সর্বাঙ্গে জড়িয়ে দেহভঙ্গিমাকে যথাসাধ্য প্রকট ক’রে এদেশের মেয়ের মত ঝুড়ি কাঁখে কাঠকুটো ভেঙে বেড়ায়। এবং নদীর ধারে কয়েকজন একসঙ্গে জুটলেই গলা মিলিয়ে গান গায়-নির্জন প্রান্তরে বা জঙ্গলের ভিতরে—“তিলেক দাঁড়াও হে নাগর, নয়ন ভরিয়া তোমায় দেখি।” সে নাগর। ব্রজের কানাই তাও তারা জানে। বাইবেলের কথা সামান্যই জানে। ওই সামান্যেই তাদের গভীর শ্রদ্ধা। মেইরী বলে কপালে বুকে আঙুল ছোঁয়ায়!

বিবিমহলের নিচেই কাঁসাই। তার ওপারের জঙ্গলের মধ্য থেকে কাঁসাইয়ের কিনারায় এসে কতদিন ওরা দাঁড়িয়ে সমস্বরে গেয়ে যায়—তিলেক দাঁড়াও হে নাগর! কোনক্রমে যদি আমার দেখা পায় সুলতা, তবে খিলখিল করে হেসে ওরা এ ওর গায়ে ঢলে পড়ে। আমি কখনও বিরক্ত হই কখনও খুশী হয়ে হাসি। তার উপর আজ যেন দারুণ মোহে পড়ে গেছি। আজই দুপুরে তাদের অর্ধনগ্ন দেহে সাঁতার দিতে দেখে কিছুক্ষণের জন্য যেন জগতের আদিম যে ঊষায় পুরুষ এবং প্রকৃতি নর এবং নারীরূপে এসে দাঁড়িয়েছিল সে ঊষাকে প্রত্যক্ষ করেছি।

সেদিন চোখে ওদের সেই আগেকার কালের আসল চেহারাটা কল্পনা করে মনে আবার একটা রঙ ধরিয়েছিলাম। সেকালের ওদের একটা পোশাকও মনে মনে ছবি আঁকিয়ে আমার মনে ভেসে উঠেছিল। আজকাল যারা ব্যান্ড বাজায় তাদের যে ধরনের বিচিত্র পোশাক সেই পোশাক পরিয়েছিলাম ওদের পুরুষদের। এবং মেয়েদেরও এমনি একটা ঢংয়ের পোশাক ও চুল বাঁধার ঢং মনে মনে ছকতে ছকতে এসে আবার দাঁড়িয়েছিলাম কাঁসাইয়ের ধারে বিবিমহলের দক্ষিণের খোলা বারান্দাটায়। তাকিয়েছিলাম ওপারে জঙ্গলের পশ্চিম ধার ঘেঁষে একটা টিলার উপর ওদেরই গ্রামটার দিকে। মধ্যে মধ্যে জঙ্গলের কোলে নদীর কিনারাটার দিকেও তাকাচ্ছিলাম। ওই মেয়েগুলোর প্রত্যাশায়। ওদের দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল। ইচ্ছেটা ঠিক কথা নয়, ঠিক কথাটা হল “বাসনা’। ওদের ভাল করে দেখতে পেলে মনে মনে পুরনো ছাঁদের পোশাক পরিয়ে একটা ছবি দাঁড় করানো যায়। কিন্তু ওদের সাড়াশব্দ অন্ততঃ গানের সাড়া ছিল না। দুরে গ্রামটা থেকে গরুর ডাক শুনতে পাচ্ছিলাম, মনে হচ্ছিল ওদের ঘরের চালের ওপর কটা মোরগ গলা ফুলিয়ে লড়াইয়ের হাঁক হাঁকছে। মধ্যে মধ্যে কুকুরের ঝগড়ার শব্দ উঠেছে। আর একটা মানুষের আভাস! কখনও একটা তীক্ষ্ণ নারীকণ্ঠ। ঠিক কি বলছে বোঝা যায় না। স্বরটা চিলের ডাকের মত ছড়িয়ে পড়ছে।

মনে আছে সুলতা, নদীর জলে তখন বিকেলের হলদে রোদের ছটা পড়ে রঙীন ঝকমকানি উঠছে। কাঁসাইয়ের জোয়ার আসে নীচের দিকে, এতদূর আসে না। ওপারের বন উজ্জ্বল রোদে ঝলসাচ্ছে। পাখীর ডাক উঠছে প্রচুর। কল-কল, কল-কল। কিচি-মিচি। কিন্তু সব আমার কাছে নিঝুম মনে হচ্ছে ওই মেয়েগুলোর সমবেত কণ্ঠের গানের অভাবে আর হাসির খিলখিল শব্দের অভাবে। এবং মনে হচ্ছে সামনের এই ছবিটা শুধু ব্যাকগ্রাউন্ড, কটা মেয়ের ছবির অভাবে অসম্পূর্ণ।

এমন সময় পিছন থেকে শুনলাম সরল মধুর কণ্ঠ আমার মেজদির। মেজদি পিছনে এসে দাঁড়িয়ে বলছেন—কি রে, এই দুপুরে এই বারান্দায় রোদ মাথায় করে দাঁড়িয়েছিস? তোর মেজদাদু পাখীটার ডাক উঠছে নাকি?

ফিরে তাকিয়ে বললাম—না!

—তবে?

মেজদিকে দেখে রসিকতা করতে ইচ্ছে হল—গোয়ানপাড়ার মেয়েগুলোর গান শুনব বলে দাঁড়িয়ে আছি।

—সে আমি বুঝেছি। কিন্তু ও শখ কেন বল তো? গোয়ানপাড়ার মেয়ে পাখীগুলোই বেশী রে। ও সুরে ভুলিস না। ওখানকার পুরুষগুলো মোর্গা ভাই, গলা ফুলিয়ে লডুয়ে হাঁক ছাড়া ডাক জানে না, আর সবই লডুয়ে মোর্গা। খুনখারাপিতে সিদ্ধহস্ত। মাস দু-চারটে কাটাকাটি ওরা করেই। ওদের পিদ্রু গোয়ানের গল্প শুনেছি, গায়ে কাঁটা দেয়। কি বাড়! আমার শ্বশুরের দাপে বাঘে বলদে জল খেত। সেই তাঁর ছেলেবেলার সাকরেদ-ভক্ত প্রিয়পাত্র ঠাকুরদাস পালকে দিনেদুপুরে ওই কাঁসাইয়ের পাড়ের উপর এই এতবড় ছোরা বুকে বসিয়ে দিয়েছিল। মরে গেল ঠাকুরদাস পাল। বলতে গেলে আমার শ্বশুরের চোখের সামনে। শুনি নাকি তাঁর ঘরেই দুজনের কথা কাটাকাঠি শুরু হয়। সেখান থেকে বেরিয়ে কাছারির বাইরে গিয়ে ওই খানিকটা নদীর ধার পর্যন্ত গিয়েই ঠাকুরদাস হাত চেপে ধরলে, অমনি—! শুনেছি নাকি ঘড়া দরণে রক্ত পড়েছিল।

—গোয়ানটার কি হল?

—তার অবিশ্যি ফাঁসি না দ্বীপান্তর কি হয়েছিল। সে আর ফেরেনি। লোকটা ডাকাত ছিল। তার মেয়েটা ওই যে হলদি বুড়ী—ওকে তো দেখেছ। সেই যে! সেই ভাসুরপোর শ্রাদ্ধের সময় এসে তোকে বউমাকে সেলাম দিলে। সালাম পহুঁছে হুজুরাইন, হামার ছোটা হুজুর! সে বললে-হমি লোক তো হিয়া পাতা পেড়ে নেই খাবো মালেক। হামরা তো হিন্দু নেহি। হমি লোক কিরিস্তান। আর হারমাদ হামরা—

মনে পড়ল সুরেশ্বরের। বুড়ীকে দেখেছিল বাবার শ্রাদ্ধের সময়।

অনেকটা বয়স বুড়ীর। রঙটা সত্যিই ফরসা। মাথায় চুলগুলো শনের মতই সাদা হয়ে গেছে প্রায়। চৌকো গৌরবর্ণ মুখখানায় দাগে দাগে একটা মাকড়সায় জাল আঁকা হয়ে গেছে। চোখ দুটো বেড়ালের চোখের মত কটা বা পিঙ্গল। পরনে ছিল একটা সেমিজের মত ছিটের গাউন। অর্থাৎ তার গাউনত্ব ছিল না। কিন্তু সেটা তার তোলা পোশাকী গাউন; সেদিনের বিশেষ ক্ষেত্রে তাদের বাড়ী আসবার জন্যই প’রে এসেছিল, তা বোঝা গিয়েছিল। তাতে ন্যাপথলিনের গন্ধ ছিল।

মেজঠাকুমা বলেছিলেন—পিদ্রুর সাজা হলে গোয়ানপাড়ার সকলে, গাঁয়ের সকলে ওকে ওর মাকে তাড়াবার জন্য বলেছিল আমার শ্বশুরকে। কিন্তু তাঁর বিচার ছিল অতি ন্যায্য। তিনি তো তাড়ানই নি বরং রক্ষে করেছিলেন। বলেছিলেন—যা করেছে পিদ্রু করেছে তার জন্য ওদের সাজা হবে কেন? সেজন্যে হলদি রায়বাড়ীর অবস্থা এত হীন হলেও খাতির না করে পারে না। তবে তোমাদের মানে ভাসুরের বংশের উপর খাতির বেশী। তার মানে জান?

—কি?

হেসে ঠাকুমা বললেন—আমার ভাই তোর মেজঠাকুরদার কাছে শোনা। তিনি বলতেন দাদার চেহারা ছিল কন্দর্পের মত। তাই বা কেন? কন্দর্পের চেয়ে বেশী। কন্দৰ্প তো কোমল কিশোর বা যুবক। দাদার ছিল বীরের মত চেহারা। এই লম্বা। তেমনি মুখ তেমনি চোখ, তেমনি রঙ। তেমনি বুকের ছাতি। তাকে দেখে ওই হারামজাদীদের লালসার অন্ত ছিল না। দাদারও ক’জন গোয়ান শিকারী ছিল, তার সঙ্গে যেত, বাঘ মারবার সময়। ….

হঠাৎ ঠাকুমা মুখে কাপড় চাপা দিলেন, বললেন—আমি বলেছিলাম, আর তুমি কালো একটু মোটাসোটা বলে তোমার দিকে তাকাতো না বুঝি? ওঃ জ্বলে উঠতেন। দশবার রাধা রাধা বলে বলতেন—শুনলে পাপ হয় এ কথা!

সুরেশ্বর চিন্তার রাজ্য থেকে ফিরে এসে মেজঠাকুমার সঙ্গেই মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল, উপভোগ করেছিল এই আশ্চর্য সেকেলে অথচ সর্বকালের মাধুর্যময়ী এই রূপসী ঠাকুমাটির কথাগুলি। উত্তরে নিজেও রসিকতা করবার লোভ সামলাতে পারেনি, বলেছিল—তুমি বুঝি তাঁকে পাহারা দিতে হলদিদের দল যখন আসত? ছাদে উঠেও গোয়ানপাড়ার দিকে তাকাতে দিতে না!

হেসে উঠলেন মেজঠাকুমা, সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলেন—যেন ঠোঁটের ডগায় উত্তরটি উদ্যত হয়েছিল, সেটা তোকে সাবধান করা দেখে বুঝতে পারছিস না! সেইজন্যে তো বলছি ভেতরে চল। মনসার কথায় আছে, মনসা যেন বেটীকে বলেছিলেন—সব দিক পানে তাকিয়ো না, দক্ষিণ দিক পানে তাকিয়ো না। তোর দাদু ছিলেন কালো এবং আমি যেকালে তাঁর পেয়েছিলাম সেকালে তিনি বুড়ো হয়েছিলেন। তোর দাদু তোকে দেখে বলেছিলেন—নাতি, তোমাকে দেখে দাদাকে মনে পড়ছে। তিনি রায়বংশের শ্রেষ্ঠ সুপুরুষ ছিলেন। তুমি তার তুল্য কি ভার থেকেও সুন্দর হে। তুমি সুন্দর তুমি নবীন। পাঁচজনে কলঙ্ক দিয়ে তোকে আমার নটবর করে তুলেছে। আমাকে ভাবনায় ফেলেছিস তুই। আয়, ওদিকে সেই মুখপুড়ী ছুড়িদের গানের জন্য কান পেতে দর্শনের জন্য চোখ পেতে থাকতে হবে না।

ঘরে এসে ডেকচেয়ারে বসলাম। টানাপাখা আবার চলতে লাগল।

দিনের বেলা খেয়ে না ঘুমিয়ে বিকেলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম সুলতা, তার মধ্যে স্বপ্ন দেখেছিলাম; কি দেখেছিলাম মনে নেই, তবে তার মধ্যে ঠাকুরদাস ছিলেন, আমার ঠাকুরদাও উঁকি মেরেছিলেন আর পিস্ত্র ছিল, গোয়ানপাড়ার মেয়েগুলোও ছিল। এলোমেলো জড়ানো স্বপ্ন। মানে মাথার মধ্যে সেকালের ওই ইতিবৃত্তগুলো মাতালের মদের নেশার মত ঘুরপাক খাচ্ছিল।

স্বপ্নের শেষের দিকটায় ঠাকুরদাসের রক্তাক্ত দেহ ছিল মনে আছে। একটু আতঙ্কের সঙ্গেই জেগে উঠলাম। তখন সন্ধ্যে হয়ে এসেছে—

রঘু চা এনে দিলে।

চা খেয়ে কি মনে হল, ভাবলাম, ঠাকুমা বললেন—ঠাকুরবাড়ী কাছারী থেকে বেরিয়ে কাঁসাইয়ের ধারটায় গিয়ে পিভ্রূ খুন করেছিল ঠাকুরদাসকে। জায়গাটা দেখে আসি।

বেরিয়ে পড়লাম।

কীর্তিহাট গ্রামখানা নদীর ধারে ধারে লম্বা—কলকাতার মত গড়ন। রায়বাড়ী তার এক পাশে। মানে যে দিকটা জুড়ে আছে তার পরে আর অনালোকের বসত নেই। নদীর ঘাটে গিয়ে একটা রাস্তা পড়েছে। তার ওপারেই গোয়ানপাড়া।

গিয়েছি অনেকবার। কিছুই ছিল না। থাকবার মধ্যে জঙ্গল। খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ফিরে গোয়ানপাড়ায় তখন হাঁকাহাঁকি ডাকাডাকি চলছে। গরুকে ডাকছে ছাগলকে ডাকছে। হাঁসকে ডাকছে-আ-তি-তি-তি। আ কোর কোর তি-তি-তি। আ—ছেলেগুলো কোলাহল করছে। বকাবকিও শোনা যাচ্ছে। কলহ নয়। গুরুজনেরা বকছে ছেলেমেয়েদের। আমার পাশ দিয়ে ক’টা গোয়ান মেয়ে কীর্তিহাটে বাজার ক’রে ফিরে এসে নদীর ঘাটে নামল। হাতে মুখে দড়ি বাঁধা কেরোসিনের বোতল, মাথায় একটা করে ডালা। আর একটা ক’রে সরষের তেলের ভাঁড়।

আমাকে দেখে ফিক ফিক করে এ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে হাসলে। আমি প্রাণপণে গম্ভীর হয়ে বিচরণ করছিলাম, বলতে পারো শিশিরবাবুর চিন্তামগ্ন আলমগীরের মত। ওদের দেখে ভয়ার্ত যেমন মেকী সাহস দেখায়, তেমনি পোজ নিয়েছিলাম আমার মনে আছে। কিন্তু ওরা ছাড়বার পাত্রী নয়, ওদের উপমা আমাদের পুরাণে, কাব্যে খুঁজে পাইনে। প্রমীলার রাজ্যের কথা শুনেছি। বিস্তৃত বিবরণ নেই। থাকলে বোধহয় উপমা মিলত। ওরা বললে, সেলাম মালিকসাহেব।

আমি বললাম, সেলাম।

—হুজুরের বোখার হয়েছিল। কতদিন জানালাতে দেখিনি। আর তবিয়ৎ ভাল হল?

–হ্যাঁ। হয়েছে।

তবুও ছাড়ান দিলে না। বললে, গোয়ানপাড়ার ঘাটে হুজুর?

বললাম, বেড়াতে এসেছি।

—তবে চলেন মালিক হমলোকের গাঁওয়ে।

বললাম না, তোমরা যাও।

—কোইকে ডেকে দিব হুজুরবাহাদুর?

—না।

—আর তসবীর আঁকো না মালিক?

—না।

—এই রোজা মেয়েটা বলে, হুজুরকে বলব, হুজুর হামার তসবীর আঁকো। তা ওর আঁক না। হুজুর। উর খুব শখ। আর উ দেখতে ভি খুব-সুরত আছে।

এবার খিল খিল করে হেসে উঠল I

আমি নিশ্চয় রাঙা হয়ে উঠেছিলাম। এরা তো সুলতা, অসীমা, সীমা নয়, এদের সঙ্গে আমার পেরে ওঠবার কথা নয়। আর এরা চীৎপুরের বাড়ীর দরজায় যারা পেটের অন্নের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে, তারাও নয় যে, পকেট থেকে টাকা দিয়ে ঘরে যেতে বললে কৃতজ্ঞতায় মাথা হেঁট করে মনে মনে পায়ে মাথা ঠেকাবে। এদের গায়ে হারমাদের রক্ত। এরা কাঁসাইয়ের ধারের জঙ্গলে বাস করা আদিম নারী। আমি ভঙ্গ দিলাম। যথেষ্ট গাম্ভীর্যের সঙ্গে ওদের দিকে একটা তির্যক দৃষ্টি নিক্ষেপ করে গাঁয়ের মুখে ফিরলাম। ফিরতে গিয়েই দেখলাম, পিছনে জঙ্গলের মধ্যে কে একজন লুকুচ্ছে। আমি গ্রাহ্য করলাম না, চলে এলাম। কিছুটা এসেছি অমনি মেয়েগুলোর তীক্ষ্ণ উচ্চকণ্ঠের ধ্বনি পেয়ে আবার থমকে দাঁড়ালাম। অশ্লীল ভাষায় গালাগাল দিচ্ছে কাকে। একটা কথা কানে এল-এঃ, রায়বাবুর বাড়ির লড়কা! কুর্তার পাকিটে একঠো দামড়ি নেহি, বাবু খিতাব। যা-যা, ভাগ! নেহি তো নাক কেটে লিবো রে শালা!

বুঝলাম, কোন রায়বংশের গুণধর ওদের পিছু নিয়েছিল। তাকেই এ-কথা বলছে।

দুপুরে নিজে যা করেছি তার জন্য লজ্জায় মরে গেলাম।

এবং তখনই বোধহয় জিতে গেলাম।

যৌবনের ধর্মকে আমি মানি। ব্যভিচারী বলে যারা সংসারে ঘৃণিত, তাদের বিচারও আমি সহানুভূতির সঙ্গে করেছি। কিন্তু হ্যাঙলামি-কাঙালপনা; নারীর সঙ্গে প্রেমের ক্ষেত্রে ছিঁচকে চোরের বা গাঁটকাটার কাজ যারা করে, তাদের ঘেন্না করে এসেছি। আমার এই জ্ঞাতি-পুত্রটিকে দেখে যে ঘেন্না হল তার ওপর, তার থেকেও বেশী ঘেন্না অনুভব করছিলাম নিজের ওপর। বিশ্বমঙ্গলের মত চোখ দুটোর ওপর ক্রোধের আর সীমা ছিল না।

খারাপ, অত্যন্ত খারাপ মন নিয়েই ফিরে এলাম।

একটা কথা এক সময় বিদ্যুচ্চমকের মত মনে হল, মানুষের এই পাপ রায়বংশে এমন করে বাসা বাঁধল কেন?

বাবার কথা মনে পড়ল। মাকে চিঠিতে লিখেছিলেন, সুরেশ্বরকে নারীদের থেকে দূরে থাকতে বলো। যদি নাই থাকতে পারে, তবে যেন বিবাহ করে।

আর একটা কথা মনে পড়ল, প্রকৃতির সঙ্গে পুরুষের সম্পর্ক মানুষ আর মানুষীর মধ্যে জুটিতেই আবদ্ধ রাখতে হয়। বাকি ক্ষেত্রে সম্পর্ক পিতা-কন্যা; মাতা-পুত্রের। কথাটা রায়বাহাদুর রত্নেশ্বরের। তিনি বলে গেছেন।

গোয়ান মেয়েগুলোকে মনে মনে মা বলতে গিয়েও পারিনি। তোমাকে মনে করতে চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু তোমার মুখ ঢেকে ওদের মুখ ভেসে উঠছিল। এরই মধ্যে কখন এসে পৌঁছে গিয়েছিলাম বিবিমহলের দরজায়। মাথা হেঁট করেই আসছিলাম। হঠাৎ শুনলাম, কে বললে—এই যে!

মাথা তুলে দেখলাম, সেটেলমেন্ট ক্যাম্পের পেশকার।

লোকটা কালো, রোগা, যারা খুব ধুর্ত হয়। বললে, এই তো বেড়িয়ে এলেন। তাহলে তো ভাল আছেন!

মেজাজ খারাপ হয়ে গেল, লোকটা কি দেখতে এসেছে আমার অসুখ কতটা সত্যি, তাই? লোকটা বলে চলেছিল—ওঃ, কতক্ষণ এসেছি, আধঘণ্টার উপর। চলুন, সাহেব বসে আছেন। মিসেস ঘোষ কাল কলকাতা যাবেন। হঠাৎ ঠিক হয়েছে। তাঁর ছবি এঁকে দেবার কথা আছে। সেটা নিয়ে যাবেন তিনি।

—মানে? এই রাত্রে?

—হ্যাঁ। কাল যে কলকাতা যাবেন, সেখানে দেখাবেন তিনি।

কি হয়ে গেল মেজাজ, বললাম, বলবেন, রাত্রে ছবি আঁকা হয় না।

—হেজাকবাতি ঠিক করে রেখেছি।

—বলবেন, হবে না। পারব না। আমার শরীর ভাল নেই।

—উনি চটে যাবেন। মেমসাহেব ঝোঁক ধরেছেন।

—তাহলে চটতে বলবেন। বিরক্ত করবেন না। বলে আমি ঘরে ঢুকে গেলাম। সুরেশ্বরের নিজস্ব কর্মচারী ঘোষাল। হরচন্দ্রেরই ভাইপো। সে বললে, কথাগুলো কড়া হয়ে গেল।

তার মুখের দিকে তাকিয়ে সুরেশ্বর বললে, তা হোক!

নায়েব বললে, পরশু থেকে কীর্তিহাটে বুঝারত হবে আজ ঢোল পড়ল। সাহেব নিজে করবেন।

—তা করুন।

—আপনাকে হয়রান করবে এই আর কি!

—কি হয়রান করবে?

—সঙ্গে সঙ্গে রোদে রোদে ঘোরাবে হয়তো। হয়তো আমাদের কথা শুনবে না। স্বত্বের ঘরে ওরা যা বলবে তাই লিখবে। ওদের তো লম্বা হাত!

—ঠিক আছে। আপনি কাগজপত্র ঠিক করে রাখুন, থাকলে দেখাবেন। না থাকলে বলবেন, কাগজ নেই, অন্যে যা বলছে তাই লিখুন তিনি। তারপর তো মুন্সেফ কোর্ট, ডিস্ট্রিক্ট কোর্ট, হাইকোর্ট আছে।

চুপ করে রইল নায়েব, কথাটা তার মনঃপুত হল না। সে একটু চুপ করে থেকে মাথা চুলকে বললে, একবার চলুন না সাহেবের কাছে। গিয়ে বলবেন, দেখুন লোকজনের সামনে পেশকার আপনার এইভাবে কথা বললে—

সুরেশ্বর একটু রুক্ষভাবেই বললে—না।

নায়ের চলে গেল। সে বিবিমহলের সেই চারিপাশ খোলা ছাদওয়ালা বারান্দায় ঘুরতে লাগল। মন তিক্ত হয়ে উঠেছে। মনে হচ্ছে এসব ওই ওদের দানপত্র করে চুকিয়ে দিয়ে চলে যায় সে, তাহলে এই হরেন ঘোষ নামক সেটেলমেন্ট হাকিমের লম্বা হাতটিও আর তার নাগাল পাবে না। সে তখন ঠাকুরদাস পালকেও ভুলে গিয়েছিল। ইচ্ছে হচ্ছিল হুইস্কির বোতল সে এখনি খোলে। এবং তারপর বাজনা বাজায়। রঙ-তুলির মত বেহালাও তার সঙ্গী। সঙ্গেই এনেছে। কিন্তু এই বাজনাটা তার লোকজন থাকলে যেন নিজের কাছেই জমে না। বিশেষ করে এখানকার লোকজন।

সেই বাপের শ্রাদ্ধ থেকে এ পর্যন্ত তার তিনবার আসা হল, এখনও পর্যন্ত বলতে গেলে গ্রামের লোকের কাছে সে অপরিচিতই। এদের যা স্বভাবচরিত্র, সে তার বাবার শ্রাদ্ধের সময় এসে দেখেছিল। সেটা একান্তভাবে লোভ আর খানিকটা সেও লোভ বা আর এক ধরনের ক্ষুধা—রক্তমাংসের দেহের ক্ষুধা, সর্বস্ব। কিন্তু এবার এসে আরও গভীর এবং ভয়াবহ চেহারা দেখছে। বিষয়সম্পত্তি নিয়ে যে ক্ষুদ্রতা এদের এবং কুটিল গতিতে যে ক্ষুদ্রতা পাক খায়, তার তুলনা হয় একমাত্র সাপের সঙ্গে। প্রথমটার তুলনা শেয়ালের সঙ্গে। সত্য বলতে গেলে, এদের সে সহ্য করতে পারে না।

ডিকু বলে, বিলকুল সব হারামী আছে হুজুর।

রোজা অর্থাৎ রোজারিও বলে, বিনা মতলবে কোই বাত করে না মালেক। ঝুটা আদমী, ঝুটা বাত্!

সুরেশ্বরও তাই মনে করে, এদের মধ্যে অস্বস্তিও বোধ করে। এমন কি প্রশংসা কেউ করলেও সন্দিগ্ধ হয়ে ওঠে। বোধহয় ওরাও জানে সেটা অর্থাৎ সুরেশ্বর রায় তাদের চেনে এটা ওরা বুঝেছে। তাই কেউ এদিকে ধার ঘেঁষে না। একমাত্র ওই মেজঠাকুমা। এই রায়বাড়ী, এই কীর্তিহাট গ্রামে ওই মহিলাটিই তার পরমাত্মীয়, প্রিয়জন। তিনি তাঁর সঙ্গে আদিরস-ঘেঁষা রসিকতা করলেও মিষ্টি লাগে, তার তোষামোদ করে তাকে তাঁর অন্নদাতা বললেও সে সঙ্কোচ বোধ করে না; মনে হয় না কোন মতলবে বলছেন। তিনি দুপুরে একবার খাবার সময় আসেন, আবার সন্ধ্যার পর ঠাকুরবাড়ী ফেরত পুষ্পচরণোদক নিয়ে তাকে দেন, রাত্রে কি কি খাবার আয়োজন করেছে ঠাকুর তাঁর তদ্বির করে চলে যান। তিনি তো জানেন তার হুইস্কি খাওয়ার কথা, তাই খাওয়ার আগেই চলে যান। হুইস্কির সঙ্গে রাত্তিরের খাবার খেয়ে নিয়ে সুরেশ্বর এসে বসে ওই সামনের মনোরম খোলা বারান্দাটিতে, হাতে বেহালা থাকে। বাজায় আপনমনে। আমেজ লাগে।

আজ এই উত্তেজিত মুহূর্তটিতে সে হুইস্কির বোতলটা খুলে বসে গেল। মেজঠাকুমা এখনও আসেননি। সেজন্য সুরেশ্বর আজ বিরক্ত হয়েছিল মেজঠাকুমার উপর। মনে মনে প্রশ্ন করেছিল, কি দরকার ওঁর রাত্রে আসবার?

প্রায় সেই ক্ষণটিতেই মেজঠাকুমা এসে গিয়েছিলেন। মুখে সুরেশ্বর কিছু বলতে পারেনি। তাই বা কেন, মনটা প্রসন্নই হয়ে উঠেছিল।

মেজঠাকুমা কিন্তু সেদিন ঠিক সেই মানুষটি নন, যাঁর আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মুখের হাসি এবং সরস বাক্যে কীর্তিহাটের এই নির্বাসনবাসটি মধুর হয়ে ওঠে।

পুষ্পচরণোদক দিয়ে বললেন, আজ নদীর ওই গোয়ানপাড়ার ঘাটে বেড়াতে গিয়েছিলে?

—হ্যাঁ, ঠাকুরদাস পালকে পিদ্রু গোয়ান ওইখানটায় খুন করেছিল, বললে না তুমি? মনে হল জায়গাটা একবার দেখে আসি।

—হুঁ। তা ডিকু কি রোজারি কি রঘুকে সঙ্গে নিলেই পারতে। একলা গেলে কেন?

-–কি বিপদ, আমি কি ছেলেমানুষ, পথ হারাব?

—ওরা তো তাই রটাচ্ছে, তুমি ওদের ছুঁড়িগুলোর ইশারায় পথ হারাতেই গিয়েছিলে। চন্দ্রেশ্বর দেখেছে।

চন্দ্রেশ্বর সুখেশ্বরের ছোট ছেলে।

—ও। হ্যাঁ দেখলাম বটে। গ্রাম থেকে কেউ ওদের পিছু নিয়েছিল। আমি ঘাটে দাঁড়িয়ে ছিলাম বলে জঙ্গলের মধ্যে গাছের আড়ালে লুকিয়েছিল। মেয়েগুলো যা কুৎসিত ভাষায় ওকে গালাগাল করছিল।

—সেটা এবার তোমার নামে রটল।

—রটুক।

—না ভাই। আমার গায়ে লাগে।

একটু চুপ করে থেকে বললেন, কাল থেকে লোক সঙ্গে করে বেরুবি।

—কেন? এখানে সাক্ষী রেখে বেড়াতে হবে নাকি? না, তোমারও সন্দেহ হচ্ছে?

—তুই আচ্ছা গোঁয়ার কিন্তু। রায়বংশ তো!

—বলতে দাও। ওদের বলতে দাও। ওটা আমার প্রাপ্য রায়বংশ বলেই। কিন্তু তোমার সন্দেহ হয় কিনা বললে না তো!

—হলেই বা তোর তাতে কি যাবে আসবে বল?

বুঝলাম অভিমান।

আবার একটু চুপ করে থেকে বললেন, সায়েবের পেশকারের সঙ্গে ঝগড়া করলি!

—হ্যাঁ, তাও করেছি। দরকার হলে আবার করব।

—ওরা মানে ধনেশ্বর লাফাচ্ছে। প্রণবেশ্বর খুশী। পরামর্শ হচ্ছে—কাল প্রথমেই ওরা বাড়ীর স্বত্ত্বে আপত্তি দেবে। বলবে, বাড়ী দেবোত্তর। মানে প্রণবেশ্বরদের অংশ যা কিনেছ, এই বিবিমহল যা তোমার নিজস্ব, এর সব দেবোত্তর। মানে বিক্রী সিদ্ধ নয়। ভাগ সিদ্ধ নয়। সব তো শুনেছিস। বিরক্তিতে, ক্ষোভে ঘৃণায় সুরেশ্বরের মাথায় যেন আগুন জ্বলে উঠল। সে বললে, নিক ঠাকুমা, নিক ওরা। এতে আমার দরকার নেই—নিক

—না! কণ্ঠস্বর কঠিন হয়ে উঠল মেজঠাকুমার। বললেন, জমিদারের ছেলে হয়ে এই কথা বলছিস তুই? ছি! দিতে ইচ্ছে হয় দিতে পারিস। কিন্তু ঠকিয়ে নিতে দিবি? পরকে ঠকিয়ে নেওয়া যেমন পাপ, জেনেশুনে নিজে ঠকাও তেমনি ঘেন্নার কথা। সে যদি আবার ক্ষমতার অভাবে হয়। শোন, তোকে বলি—যে খাতাগুলো তোকে দিয়েছি, তার সবগুলো খোঁজ। এর মধ্যেই পাবি রায়বাহাদুরের দেবোত্তরের বাইরে কলকাতায় যে ব্যবসা ছিল, শেয়ার ছিল কোম্পানীতে, তার জমাখরচের খাতা। আমি দেখেছি সে খাতা। তার মধ্যে ইমারত খরচ পাবি। তোর কলকাতার বাড়ী এখানকার বাড়ী সব সেই টাকাতে।

বলে চলে গেলেন মেজঠাকুমা।

তাঁর দিকে সুরেশ্বর ‘তাকিয়ে রইল সবিস্ময়ে শুধু নয়, সসম্ভ্রম দৃষ্টিতে। আজ তার এক নতুন চেহারা দেখেছে সে! একেবারে রাজমাতার মত চেহারা। আশ্চর্য, পুজুরী বামুনের মেয়ে, এমনটা হল কি করে?

***

—সমস্ত রাত্রি আমি খাতা উল্টেছিলাম। পাতার পর পাতা। আজ আর ইতিহাস ঘাঁটতে নয়, নজীর খুঁজতে। ঠাকুমা মনের মধ্যে একটা তেজ বা আগুন জ্বেলে দিয়ে গিয়েছিলেন সুলতা। সে আগুনটা অ্যালকোহলের ছিটে পেয়ে জ্বলে উঠেছিল জোরালো হয়ে। ওদের রায়ত কেনা মেরামত করানো ভিতর-বাড়ীটা ঠকিয়ে নেবে?

এদের অর্থগৃধুতার জন্য নীচতার জন্যে ঘেন্না, ওদের জোট বেঁধে আমাকে ঠকাবার চেষ্টায় রাগ—ওদের মেজঠাকুমাকে পর্যন্ত কলঙ্কিনী অপবাদ দেওয়ার কুৎসিত প্রবৃত্তির জন্য ক্ষোভ- এগুলো মিলে আমাকে নিষ্ঠুর কঠোর করে তুলেছিল সেদিন। মদ খেয়েছিলাম মধ্যে মধ্যে, আর খাতাই উল্টেছিলাম পাতার পর পাতা, খাতার পর খাতা।


© 2024 পুরনো বই