কীর্তিহাটের কড়চা – ২.৭ (?)

৭ (?)

সেই কাগজের মধ্যে উপকরণ পেলাম। খানকতক মূল্যবান চিঠি। কাত্যায়নী দেবী লিখছেন স্বামীকে—শতকোটি প্রণামান্তর স্বামীচরণে নিবেদনমিদং, স্বামীন, তদীয় পত্র প্রাপ্ত হইয়া অধিনী দুশ্চিন্তায় আশঙ্কায় জীবনমৃতা হইয়া কালযাপন করিতেছে। আপনি কি এমন দুঃস্বপ্ন সন্দর্শন করিয়াছেন যে, নিশাকালে ভয় প্রাপ্ত হইয়া বু-বু করিয়া উঠিয়াছেন? কিন্তু আপনার কাছে কি রাত্রিকালে কেহ শয়ন করে না? অধিনী তো ব্যবস্থা করিয়া আসিয়াছিল, সে ব্যবস্থা কি বলবৎ নাই? যদি বলবৎ না থাকে, তবে আপনি আপনার পছন্দমতো লোক নিযুক্ত করিয়া কাছে লোক রাখিবেন। কদাচ একাকী রাত্রে শয়ন করিবেন না। তাহাতে অধিনী কোন আপত্য করিবে না। এখানে দুঃস্বপ্ন দেখিয়াছেন বলিয়া দেবতার বিশেষ পুজার ব্যবস্থা করিলাম। স্ত্রী চরণে স্বর্ণ-বিল্বপত্র, শ্রীশ্রীরাজরাজেশ্বর জিউর নিকট স্বর্ণতুলসী অর্পণের ব্যবস্থা হইল। অত্রস্থ কুশল শ্রীমতী বিমলা এবং শ্রীমান বীরেশ্বরের সর্বাঙ্গীণ কুশল। বীরেশ্বর এমন দুর্দান্ত ও বলশালী হইয়াছে যে, তাহাকে আমি ক্রোড়ে লইতে ভয় পাই। আমার প্রেমচন্দনসিক্ত প্রণাম গ্রহণ করিয়া অধিনীকে কৃতার্থ করিবেন। কারণ কম করিবেন।—ইতি তদীয় শ্রীচরণাশ্রিতা কাত্যায়নী দেবী।

মোটা হরফে লেখা কাত্যায়নী। চিঠি লিখেছে কোন পাকা হাত মুহুরি। তারপর পেলাম সোমেশ্বরের পত্ৰ।

প্রাণাধিকা প্রিয়তমাসু—

শ্রীমতী কাত্যায়নী আমার প্রেম-আশীর্বাদ জানিবা। তোমার পত্র প্রাপ্ত হইয়া সমুদয় অবগত হইলাম, কিন্তু কোন আশ্বাস বা কোন ভরসা আজও পাই নাই। প্রায় নিশাযোগে দুঃস্বপ্ন দেখিতেছি। কাছে লোক থাকে। কিন্তু সে কি করিতে পারে? সামান্য মানবকুলের কোন ক্ষমতা যে দেবরোষের প্রশমন করিবে? প্রায়শই অর্থাৎ দুই-এক দিবস অন্তর স্বপ্ন দেখিতেছি—যেন রাজরাজেশ্বর প্রভু জীউ বালকের মূর্তি ধরিয়া আমাকে শাসন করিতেছেন, আর তান্ত্রিক শ্যামাকান্ত দূরে রক্ত চক্ষুতে তাকাইয়া হি হি করিয়া হাসিতেছে।

.

রামব্রহ্ম ন্যায়রত্নের একখানা চিঠি আমি পেয়েছি সুলতা। সুন্দর চিঠি। যেমন হাতের লেখা, তেমনি সেকালের কথার গাঁথুনির নমুনা। লিখেছেন সোমেশ্বর রায়ের পত্রের উত্তরে। কারণ তার উল্লেখ রয়েছে।

লিখেছেন—অশেষ কল্যাণ ও তস্যসহ সম্মানপূর্বক নিবেদনমেতৎ। আপনার লিপিখানি পাইয়া তত্র বাটীর সমাচার অবগত হইয়া চিন্তান্বিত হইয়াছি। আমি তো অত্র ধামে থাকিয়া মহামহিমময়ী শ্রীশ্রীকালিকা দেব্যা মাতাঠাকুরাণীর এবং মহামহিম পরম দয়াল শ্রীশ্রীরাজরাজেশ্বর জিউ প্রভুঠাকুরের পুজা-অর্চনা এবং সেবাদি যথাসাধ্য করিতেছি। কোন ত্রুটি বা সেবা অপরাধ হইতে দিই নাই। নিয়মিত মাতার চরণে ১০৮ বিশ্বপত্র এবং প্রভুজিউয়ের মস্তকে ১০৮ তুলসীপত্র প্রদত্ত হইতেছে। তত্রাচ এরূপ দুঃস্বপ্ন আপনি দেখিতেছেন কি কারণ তাহা ক্ষুদ্র বুদ্ধিতে বোধগম্য করিতে পারিতেছি না। এবং সমস্ত আনুপূর্বিক বিচার করিয়া আপনার ন্যায় ধর্মপরায়ণ ভক্তিভাজনের অপরাধ খুঁজিয়া পাইতেছি না। আপনার দুঃস্বপ্ন দর্শনকেও উড়াইয়া দিতে পারিতেছি না। উপর্যুপরি দুঃস্বপ্ন দর্শন কি মতে উপেক্ষা করিতে পারা যায়। তবে এখানকার সেবা ইত্যাদিতে ত্রুটি হয় নাই এবং হইবেক না জানিবেন। তবে হিতৈষী হিসেবে যদি মদীয় চিন্তায় যাহা মনে হইতেছে তাহা নিবেদন করি, তবে আপনি দুষ্য মনে করিবেন না। আপনার অপরাধ ওই শ্যামাকান্তের অপঘাতমৃত্যুতে কিছু অর্শিয়া থাকিবেক বলিয়া মনে লইতেছে। সম্ভবত জলে ডুবিয়া আপনি নিজে বাঁচিবার জন্য ব্যস্ত হইয়াছিলেন। তাঁহাকে বাঁচাইবার চেষ্টা করিতে পারেন নাই। হইয়া থাকিলে এইখানে অপরাধ হইয়া থাকিবেক। অন্যথায় তাঁহাকেই বা স্বপ্নে দেখিবেন কেন? আমার বিবেচনায় আপনি যদি শ্যামাকান্তের বংশাবলীকে তুষ্ট করেন, তবে অবশ্যই তিনি তুষ্ট হবেন। শ্যামাকান্তের এক শ্বশুরালয় শ্যামনগর। আমার কন্যারও বিবাহ শ্যামনগরে ভট্টাচার্য বংশে দিবার স্থির করিতেছি। তাহার সপ্তবর্ষ অতিক্রান্ত হইতে চলিতেছে। সেই সূত্রে সেখানে গিয়া জানিলাম, শ্যামাকান্তের এক পুত্র আছে। পুত্রটি পিতৃমাতৃহীন। মাতামহী লালনপালন করিতেছেন। অবস্থা ভালো নহে। তাহাকে কিছু অর্থ, কিছু সম্পত্তি দান করিলে মনে হয় উহার প্রতিকার হইতে পারিবেক। অধিক কি আর, নিবেদনমিতি, পুঃ—শ্রীযুক্তা গিন্নীঠাকুরাণীর সহিত পরামর্শ করিয়াই ইহা লিখিলাম। তিনি সাতিশয় বিব্রত এবং ভীত হইয়াছেন।

সোমেশ্বর রায় এই পত্র পেয়ে পত্র উপেক্ষা করলেন না, নিজে স্বয়ং এসে হাজির হলেন কীর্তিহাট। এবং পুরোহিত রামব্রহ্মকে এবং নায়েব গিরীন্দ্র আচার্যকে সঙ্গে নিয়ে রওনা হলেন শ্যামনগর। যাতায়াতের জন্য বজরা ছিল নিজস্ব। দুখানা বজরার সঙ্গে পাহারাদারি ছিপে লাঠিয়াল সঙ্গে নিয়ে রওনা হলেন। সঙ্গে অর্থ নিয়েছিলেন। দিয়ে আশীর্বাদ নিয়ে আসবেন। কাঁসাই ধরে হলদী হয়ে গঙ্গার উজান বেয়ে এসে উঠলেন শ্যামনগরের ঘাটে। কোথায় কার বাড়ীতে আতিথ্য নেবেন? শ্যামনগর ব্রাহ্মণ সদগোপ-প্রধান গ্রাম। ব্রাহ্মণেরা ব্রহ্মত্র ভোগ করেন, যজন যাজন গুরুগিরি করেন। সদ্‌গোপেরা চাষবাস ক’রে খায়। এদের কারুর খড়ের চালের বাড়ীতে সোমেশ্বর রায় স্বচ্ছন্দবোধ করতে পারবেন না। খড়ের চাল মাটির দেওয়ালের ঘরে শুলে মনে হত ঘরে আগুন লাগবে, রাত্রে কোন না-দেখা গর্ত থেকে সাপ বেরিয়ে কামড়াবে, এমন কি ভূমিকম্প হয়ে ঘর ভেঙে পড়বার আতঙ্কও তাঁর ছিল। স্থির করলেন বজরাতেই তিনি থাকবেন। রামব্রহ্ম ন্যায়রত্ন তার ভাবী বৈবাহিককে খবর দিতেই গ্রাম ভেঙে এসে দাঁড়াল। কীর্তিহাটের রায়বাবু এসেছেন। তাঁর সাজানো বজরা, সেই বজরা দেখতেই তাদের কৌতূহলের অন্ত ছিল না।

ভট্টাচার্যেরা এসে সসম্মানে তাঁকে আহ্বান করলেন, বললেন—মহাভাগ্য আমাদের! আপনি পদার্পণ করেছেন।

সোমেশ্বর তাঁদের কাছেই খোঁজ নিলেন—শ্যামাকান্ত তান্ত্রিকের বিগত বিবরণ এবং তাঁর ছেলের বর্তমান অবস্থার সংবাদ।

রামব্রহ্ম ন্যায়রত্নের ভাবী বৈবাহিক বললেন-শ্যামাকান্ত চট্টোপাধ্যায় কাশ্যপ গোত্রীয় কুলীন সন্তান বাবু, মুলবাড়ী ওদের যশোহর জেলায়। শ্যামাকান্তের বাপ কাশীনাথ অনেক বিবাহ করেছিলেন। এই হুগলী জেলাতেই সাত আটটি বিবাহ ছিল। শুদ্ধাচারীর বংশ। সাধনাটাধনার ঝোঁক তাঁরও ছিল। শ্যামাকান্তকে নিয়ে তিনি ঘুরতেন। ওইটিই তাঁর ঘরণী স্ত্রীর সন্তান। গান তিনিও গাইতেন। শ্যামাকান্তকে বলতে গেলে তিনি মূলধন দিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর পর শ্যামাকান্তও বাপের বৃত্তি নিয়েছিলেন। সুন্দর সুপুরুষ চেহারা। গানবাজনায় যাকে বলে ওস্তাদ। ওস্তাদও বটে সাধকও বটে।

আমাদের এখানে, আমার জ্ঞাতিভাই অবশ্য, বয়সে আমার থেকে অনেক বড়, বলতে গেলে পিতৃতুল্য জ্যেষ্ঠ ছিলেন—পদ্মনাভ ভট্টাচার্য। পণ্ডিত লোক। টোল ছিল বড়। নাম ছিল! নিজে পণ্ডিতই শুধু ছিলেন না, ক্রিয়াকর্ম, বিশেষ করে তান্ত্রিক পূজা, খুব ভাল জানতেন। তন্ত্রমতে স্বস্ত্যয়নে খুব খ্যাতি ছিল। পঞ্চপর্বে জপতপ-ক্রিয়াও করতেন। শ্যামাকান্ত কোত্থেকে তাঁর খোঁজ পেয়ে তাঁর তানপুরা ঘাড়ে এসে হাজির হলেন। তখন নবীন যৌবন বলতে গেলে। আমরাও তখন নবীন। কিছু কম বয়স। পদ্মনাভ ভটচাজকে জড়িয়ে ধরলেন—আমাকে পুরশ্চরণ করাতে হবে। দীক্ষা আমার বাবার কাছে নিয়েছি। পুরশ্চরণ করা হয় নি। সেটি করিয়ে পুর্ণাভিষেকে দীক্ষিত করতে হবে। রূপবান চেহারা বাবু, তার উপর সুন্দর কণ্ঠ, তারা তারা বলে গান গাইতে গাইতে বিভোর হয়ে যেতেন; পদ্মনাভ-দাদা ফেরাতে পারলেন না। বললেন-বেশ থাকো। কিন্তু তন্ত্র-শাস্ত্র পড়েছ? সেটা কিছু প’ড়ে নাও। থাকবে আমার এখানে পুত্রের মত। এই থাকতে থাকতে মায়া জন্মাল। নিজের একটি কন্যা ছিল। বললেন—আমার মেয়েকে বিয়ে কর। তুমি শিবের মত পাত্র, আমার কন্যাও সুলক্ষণা। গৃহস্থ হয়ে ঘরে স্বামী-স্ত্রীতে সাধনা করবে। আমি বলছি, যা চাও তাই পাবে। আমার টোল আমার যজমান—ব্রহ্মত্র রয়েছে, নিশ্চিন্ত সাধনা করতে পারবে। তাই হয়ে গেল। তিনি মানে শ্যামাকান্ত একটা পুরুষ ছিলেন। গানে বাজনায় হাসিতে একেবারে আমাদিগে মাতিয়ে রাখতেন। মধ্যে মধ্যে খ্যাপার মত হাসতেন।

সোমেশ্বর বললেন—সে তো আমি জানি—দেখেছি।

—হ্যাঁ শুনেছি। কিন্তু প্রথম বয়সে দেখেন নি। মানে কুড়ি বাইশ বছরে। তখন বলতেন—জান হে শিবানন্দ, কালী এলে কি বলব জান? আমি বলতাম—কি? বলতেন—বলব—রাজা কর্ আমাকে, রাজা করে দে। হা হা করে খানিকটা হেসে আবার বলতেন—তোমাকে মন্ত্রী করব হে। আর বিয়ে করব একশো আটটা। তোমার ভাইঝির সব দাসী ক’রে দোব।

মধ্যে মধ্যে চলেও যেতেন তানপুরো ঘাড়ে করে। কোথাও ওস্তাদ এসেছে শুনলে কি কোথাও কোন সাধুটাধু এসেছে শুনলে আর তাঁকে রাখে কে?

পদ্মনাভ শেষটায় আপসোস করতেন, ওকে বাঁধতে গিয়ে ভুল করেছি। কন্যেটার কপালে কষ্ট আছে। ইতিমধ্যে তিনি হঠাৎ জ্বরবিকারে মারা গেলেন। শ্যামাকান্তকে বলে গেলেন—দেখ, ঘরে বসে সাধনা কর। এমন ক’রে ছুটো না। তখন আমার ভাইঝি মানে পদ্মনাভ দাদার কন্যা বড় হয়েছে। কিছুদিন এই সময় সুস্থ হয়ে ছিলেন তিনি। তারপর এই সন্তান হল। সন্তানটি বছরখানেকের যখন তখন একদিন উধাও হলেন। শুনেছেন এক সাধু এসেছে, খুব বড় সাধু। দেখতে গিয়ে বাস মানুষ সেই গেল আর ফিরল না। এর মধ্যে কাণ্ড হল, ওঁর স্ত্রী আমার ভাইঝি মারা গেল। তারপর থেকে আমার বউদিদি, পদ্মনাভদাদার স্ত্রী, ওই নাতিকে নিয়ে মানুষ করছেন আর কাঁদছেন। দেখবার শুনবার মানুষ নাই। জমি জেরাত, মালের জোত নিলেম করালে জমিদার, মানে সরকার বাবুরা। এখন ব্রহ্মত্রটুকু আছে। বাড়ীতে নারায়ণশিলা আছে। ওই পালেরা খুব অনুগত ওদের। ও বাড়ীর মহাভক্ত। ভাগে চাষ করে ষোল আনার উপরেও কিছু এনে দেয়। তাতেই চলে। বালকটিও সুশীল মেধাবী, নবম বৎসরে উপনয়ন হয়েছে। ভক্তিমান, সুন্দর কান্তি। আমি তাকে শালগ্রাম সেবাপূজা শিখিয়ে দিয়েছি। এখন পূজাও সেই করে। এই কোনরকমে চলছে আর কি! তা আপনি যখন এসেছেন তখন তার আর চিন্তা কি? এবার তার বৃহস্পতির দশা হল। শুধু একটা আপসোস হচ্ছে তিনি জলে ডুবলেন, সে সময় যদি একটা সংবাদ পেতাম তবে শ্রাদ্ধটা করাতাম।

সোমেশ্বর ঘাড় হেঁট করে রইলেন, তারপর বললেন—ওটা আমার অপরাধ হয়েছে। নিশ্চয় অপরাধ হয়েছে। তবে কি জানেন, আমার মনে হয়েছিল সংসারাশ্রমত্যাগী সন্ন্যাসী তো। তাঁর আবার শ্রাদ্ধ কি? তবে আমি সন্ন্যাসীর পারলৌকিক যা তা করেছিলাম।

শিবানন্দ বলেছিলেন-তা করবেন বইকি। নিশ্চয়, তাতে ত্রুটি হবে কেন? রাজাতুল্য ব্যক্তি। গৃহে দেবতা অবস্থান করছেন। না, তা আমরা বলিনি। তবে ছেলেকে দিয়ে কিছু করানো যেত এই আর কি।

—এইবার করুন। শাস্ত্রে নিশ্চয় বিধি আছে। পতিত শ্রাদ্ধ উদ্ধার তো হয়! চলুন আমি একবার ছেলেটিকে দেখে আসি।

—আপনি কেন যাবেন। সে আসবে।

—না—না। তার মাতামহীকে প্রণাম করে আসব। দেখে আসব ঘরদোর। পদব্রজে শ্যামনগরের ধুলো পায়ে মেখে সোমেশ্বর রায় এসে উঠেছিলেন পদ্মনাভ ভট্টাচার্যের ভাঙা ঘরে। ঘর তখন ভাঙাই বটে। নিদারুণ অর্থকষ্টের লক্ষণ গৃহস্থের গৃহস্থালীর সর্বাঙ্গে ভগ্নদেহ রোগীর দেহের মত ফুটে উঠেছে।

সেই ভাঙা দাওয়ায় খুঁটি ধরে একটি সুকুমার কিশোর দাঁড়িয়েছিল বিস্মিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে। পিছনে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর মাতামহী, মাথায়। দীর্ঘ অবগুণ্ঠন।

সোমেশ্বর প্রথম দৃষ্টিতেই মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন। বাঁশীর মত নাক, আয়ত টানা চোখ, গৌরবর্ণ রঙ। দেখতে শ্যামাকান্তের মতই। তাঁর দাড়ি গোঁফ চুল ছিল বলে সাদৃশ্যটা অবিকল তা বোঝা যায় না তবে বললে সঙ্গে সঙ্গে মনে হবে, হ্যাঁ, এই তো তাঁর ছেলেই বটে।

সুলতা, এই টিকলো নাক আর টানা আয়ত চোখ এটা রায়বংশের নয়। এটা শ্যামাকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের বংশের। রায়বংশও সুপুরুষ বংশ। কিন্তু ওই ছবির দিকে চেয়ে দেখ–কুড়ারাম ভট্টাচার্যের, সোমেশ্বর রায়ের, বীরেশ্বর রায়ের রঙ গৌরবর্ণ কিন্তু নাকের ডগাটা মোটা, চোখ বড় হলেও টানা নয়, তার মধ্যে উগ্রতা আছে। কিন্তু রত্নেশ্বর রায়ের চোখ, তারপর থেকে আমাদের চোখ টানা, তাতে একটা মাদকতা আছে।

আঃ, যদি তুমি আমাদের বাড়ীর কোন মেয়েকে দেখতে সুলতা তবে বুঝতে। অৰ্চনা, জগদীশ্বর কাকার মেয়ে তার দৃষ্টি যেন মদির!

ঘড়িতে ঢং শব্দে আধঘণ্টা বাজল।

সুরেশ্বর বললে–ঘড়ির দিকে তাকিয়ো না। আমাদের ঘড়ির কাঁটা একশো পনের কুড়ি বছর পিছিয়ে গেছে।

.

যা বলছিলাম।

সোমেশ্বর যা করলেন তা যে করবেন তা নিজেও বোধ হয় ভাবেন নি। ছেলেটিকে কোলে তুলে নিলেন। কষ্ট তাঁর হয়নি। বত্রিশ তেত্রিশ বছর বয়স, সবল রায়বংশের পুরুষ, অনায়াসে এগার বছরের বিমলাকান্তকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন-তোমার নাম কি বাবা

—আমার নাম শ্রীবিমলাকান্ত দেবশর্মা চট্টোপাধ্যায়।

—কি নাম? বিমলাকান্ত?

—আজ্ঞে হ্যাঁ বাবু।

ছেলেটিকে কোল থেকে নামিয়ে দিয়ে বললেন—হে ভগবান। একেই বলে প্রাক্তন ভগবদ নির্দেশ ন্যায়রত্নমশাই—

—আজ্ঞে!

—শ্যামাকান্ত যখন যাগযজ্ঞ করেন আমার সন্তানের জন্য তখন যজ্ঞশেষে বলেছিলেন—কন্যা পুত্র যাই হোক নাম রেখো র দিয়ে। আমার মেয়ের নাম বিমলা। ছেলের নাম বীরেশ্বর। তিনি থ দিয়ে নাম রাখতে বলেছিলেন। বিমলা রাখতে তো বলেননি। সেটা তো আমি রেখেছি। তা হলে?

রামব্রহ্ম বলেছিলেন- হ্যাঁ, যোগাযোগটা অদ্ভুত বটে।

—অদ্ভুত নয়, বিধিনির্দিষ্ট। বলেই হাতজোড় করে পদ্মনাভ ভট্টাচার্যের স্ত্রীকে বলেছিলেন—মা, ভিক্ষা চাইছি। আমার কন্যা বিমলার জন্য আপনার বিমলাকান্তকে যে ভিক্ষা চাইছি মা। আমার মা এক কন্যা এক পুত্র সন্তান, আর হবে না। বিমলাকান্তের সঙ্গে বিমলার বিবাহ দিয়ে আমি সম্পত্তি দু অংশে ভাগ করে দোব। ওকে কলকাতায় নিয়ে গিয়ে লেখাপড়া শেখাব। শ্যামাকান্ত আমার জন্য যজ্ঞ করে পুত্র কন্যা বাঁচিয়েছেন, আমার বাড়ীতে গুরুর মত পুরোহিতের কাজ করেছেন। মা, তাঁর আমলে আমার বৃদ্ধির সীমা নাই। একসঙ্গে নৌকোডুবিতে ডুবলাম, আমি বাঁচাতে চেষ্টাও করিনি মা, নিজে সাঁতার কেটে কূলে এসেছি। ভাবি নি তাঁকে বাঁচাতে গিয়ে মরলেও আমার অক্ষয় স্বর্গ হত। এ আমার মহাপাপ হয়েছে। সে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করব মা, আমি বিমলাকান্তকে জামাই করে।

প্রৌঢ়া মাতামহী বলেছিলেন- ঘোমটার ভিতর থেকে ফিসফিস করে-সে ঘোমটার মুখে কান না পাতলে শোনা যায় না। সোমেশ্বর বলেছিলেন—বিমলাকান্তের দিদিমা আপনি, আমি তার শ্বশুর হব সুতরাং আমি তো আপনার ছেলে মা। আমার সামনে কথা বলতে দোষ কি।

ঘোমটা-ঢাকা মাথাখানি ঘন ঘন নড়ে উঠেছিল—না। অর্থাৎ তা পারবেন না।

শিবানন্দ হেঁট হয়ে ঘোমটার গায়ে কানে পেতে বলেছিল-তবে আমাকে বল আমি বলছি। তখন শিবানন্দকে বলেছিলেন—ওরে বাপরে, এর উপর আমি কি বলব? কি আছে বলবার। আমি তো বাঁচলাম। উনি আমাকে বাঁচালেন। কত্তা স্বপনে বলেন—গিন্নী এস। তা আমি বলি এখন আমি পারব না। এইবার আমি নিশ্চিত্ত। ওকে দিলাম। তবে দুটি কথা। আমি যতদিন আছি ওকে নিয়ে যাবেন না।

সোমেশ্বর বলেছিলেন—নারায়ণ, নারায়ণ। কালী, কালী। তাই পারি? তবে আপনি চলুন-

—ছি—ছি—ছি!

—কেন তীর্থস্থানে কালীঘাটে! আলাদা থাকবেন।

—তা আমার ঠাকুরসেবার কি হবে?

—হবে। যেমন চলছে তেমনি চলবে। পুজো ভোগ সবের ব্যবস্থা বিমলাকান্তের বউ যে হবে তার কাজ, তার ব্যবস্থা করবে সে!

—ভিটেটি থাকবে তো?

—নিশ্চয়, বিমলাকান্ত আমার জামাই হবে, আমার মেয়ে এই ভিটের বউ হবে—এ ভিটে না থাকলে যে তাদের অকল্যাণ হবে।

—বেশ বেশ বাবা বেশ! যা করবে তুমি তাই হবে।

প্রণাম করে চলে এসেছিলেন সোমেশ্বর বজরায়। বাড়ী থেকে বের হতেই বৃদ্ধার কান্না শুনতে পেয়েছিলেন, ওরে মা রে-ওরে বাবা শ্যামাকান্ত রে, কোথায় তোরা গেলি রে মানিক, ওরে তোদের বিমলাকান্ত রাজা হল রে, একবার এসে দেখে যা রে!

চোখের জল মুছেছিলেন সোমেশ্বর। এবং তিনদিনে শ্যামাকান্তের শ্রাদ্ধ করিয়ে শ্রাদ্ধান্তে বিমলাকান্তকে আশীর্বাদ করেছিলেন। একজন চাকর একজন কর্মচারী রেখে বাড়ী মেরামত করবার বন্দোবস্ত করেছিলেন। চাকর মানে সর্বক্ষণস্থায়ী চাকর নয়, ভগবান পালই ওদের তিন পুরুষের জোতদার, ভাগে জমি করে, তাকে ডেকে আনিয়ে মাসে দেড় হাজার টাকা মাইনের ব্যবস্থা করেছিলেন। একজন বিধবা ব্রাহ্মণকন্যাকে বাড়ীর রান্নার জন্য দেড় টাকা বেতনে নিযুক্ত করেছিলেন।

বিষয়-সম্পত্তি কি আছে কি গেছে তাও খোঁজ নিলেন। খাজনার জোত সবই গেছে। ব্ৰহ্মত্র আছে সামান্য। সোমেশ্বর গিরীন্দ্র আচার্যকে পাঠালেন জমিদারবাড়ী। পত্তনীদার সরকারবাবুদের বাড়ী সন্নিকটেই, শ্যামনগরের একটা মাঠ পার হয়ে রাধানগর। শ্যামনগর রাধানগর দুটি মৌজা মিলিয়ে লাট যুগলপুর। এর জমিদারেরা প্রাচীন, পরগনা গোকুলশাহী, নবাবী আমলের দানেশমন্দ খেতাবধারী রাজার এলাকা! কিন্তু দশশালা বন্দোবস্তের পর ‘সানসেট ল’য়ের আমলে পরগনা রাখতে পারেন নি। কিছু কিছু মৌজা লট অষ্টম আইন আড়ি হতেই পত্তনী বন্দোবস্ত করেছেন। যুগলপুর লাট বন্দোবস্ত নিয়েছে এখানকার সরকাররা। জাতিতে কায়স্থ। পেশা পুর্বে ছিল ওই পরগনাতেই তহশীলদারী। এখন পত্তনী স্বত্বে জমিদার। পাকা হিসেব, গোমস্তা থেকে জমিদার। এবং মহাজনীও করেন।

বলতে গেলে সুলতা, আমার পূর্বপুরুষ কুড়ারামেরই জাতের লোক তবু তফাত একটু আছে। ভারতঅধীশ্বর যদি সিংহ হয় তবে ভূস্বামী বৃদ্ধ বাঘের জাত। কুড়ারাম ছিলেন চিতা। আর এঁরা নেকড়ে বলা যায়। যারা কোল থেকে ঘুমন্ত ছেলে তুলে নিয়ে গেলে জানতে পারা যায় না। আমি জমিদারবংশের ছেলে—আমার কাঁধের উপর ভারীদের মত দুদিকে মস্ত ভারী দুটো ভার। তার একটাতে ভাল কাজের বোঝা আছে, অন্যটায় হয়তো তার থেকেও ভারী মন্দ কাজের বোঝা আছে। সেই আমিই বলছি এঁদের মাথায় একটা মোট ছিল, সেটা মন্দ কাজের মোট। বগলে ভিক্ষের ঝুলির মত একটা ঝোলা আছে, তাতে ভাল কিছু নিশ্চয়ই থাকবে না থাকা হতেই পারে না।

ঝুলিটার মধ্যে যা ছিল সেটা হল দেব-দ্বিজে মৌখিক ভক্তি। ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করার পুণ্য, কপালে তিলক কাটতেন—তার পুণ্য। মধ্যে মধ্যে ব্রাহ্মণভোজন করাতেন এবং উচ্ছিষ্ট পাতাগুলি বিতরণ করতেন ব্রাত্যদের। কীর্তন গান শুনে কাঁদতেন। এগুলি কৃত্রিম ছিল না বলছি না। অকৃত্রিমই ছিল।

অন্যদিকে অর্থাৎ মোটটায় ছিল অনেক কিছু। সেগুলো মোটা ভারী কিছু ছিল না। খুন খারাবী দাঙ্গা ঘর জ্বালানো এসব ছিল না। কিন্তু হিসেব যোগটি ছিল জোঁকের মত। তাই-বা কেন, ওই নেকড়ের মত।

কোন ব্রাহ্মণ প্রজা এলে তাঁর পদধুলি নিয়ে প্রণাম করত, যত্ন করে খাওয়াতেন। তারপর সুদ মাপের সময় হাতজোড় করে বলতেন—ওইটি পারব না। টাকা ধার করতে এলে সম্পত্তির খোঁজ খবর নিয়ে ‘কটে’ টাকা দিত। কট মানে ব্যারিস্টারের বাড়ীর মেয়ে তোমার বোঝা উচিত। তবে কট আর নেই। কট ছিল মেয়াদী বন্ধকী। দশ বছর, পাঁচ বছর সময় নির্দিষ্ট থাকত, তার মধ্যে টাকা শোধ দিতে হবে। না দিলে মেয়াদ-অন্তে ওই ধারের দলিলই বিক্রী দলিল হয়ে যাবে।

এই সরকারেরাই বিচিত্র কৌশলে বিমলাকান্তের মাতামহের জোতগুলি খাস করে নিয়েছে। সরকারদের আয় বিশেষ ছিল না। হাজার চারেক টাকা জোত। তবে প্রজার বাড়ীর চালের লাউ কুমড়ো, শাক-আড়ার শাক, গরুর দুধ, পুকুরের মাছ প্রভৃতির একটা রাজভাগ বলে ভাগ নিয়ে মন্দ চলত না। ছেলেরা শুধু দুধে-ভাতেই মানুষ নয়, মাছে-ভাতেও বেশ প্রোটিন পুষ্ট দেহ। মাংসটা খেতো না কারণ বৈষ্ণব।

সোমেশ্বরের আগমনবার্তা শুনে তাঁরা নিজেরাই এলেন। সে কি কথা-ব্রাহ্মণ! রাজতুল্য ব্যক্তি! তিনি এসেছেন, পদার্পণ করেছেন আমার ভূমিতে, দেখা করতে যাব না!

যাবার সময় চাদরের খুঁটে হিসাব করে পুরাতন জমির জন্য সুদসহ পাওনা এবং নতুন একশত বিঘা জমির মূল্য বা সেলামী হিসাব করে প্রায় চার হাজার টাকা বেঁধে নিয়ে চলে গেলেন। বলে গেলেন—হরি বোল হরি বোল। গোবিন্দের মহিমা কাকে যে কখন কি করেন এক তিনি ছাড়া কেউ বলতে পারে না। জয় গোবিন্দ, জয় গোবিন্দ।

বৃদ্ধ সরকারের একটি চোখ ট্যারা ছিল। কোনটি তা খবর পাইনি। পরবর্তীকালে বীরেশ্বরের একখানি চিঠি পেয়েছিলাম। লিখেছিলেন গোমস্তাকে, ওই লোকটা যেন আমার কাছে না আইসে। তাহাকে দেখিলেই আমার ক্রোধ হয়, চোখটা গালিয়া দিতে ইচ্ছা হয়।

.

এই লাট যুগলপুর বিক্রী করেছিল সরকারেরা বীরেশ্বর রায়কে।

এই ঘটনার প্রায় একত্রিশ বছর পর। ১৮৬২ সালে। মিউটিনীর পর। তখন ইংলন্ডেশ্বরী ভারতেশ্বরী হয়েছেন।

যাক সুলতা, সে কথায় পরে আসব। সে একত্রিশ বছর পরের কথা। ১৮৩১ সালে বিমলাকান্ত চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে বিমলার বিবাহ হয়ে গেল। সে বিবাহ মহাসমারোহের বিবাহ। তার খরচের অঙ্কটাই আছে জমা-খরচের খাতায়, বিশদ বিবরণ কোন কাগজপত্রে নেই। বেঁচে আছে লোকের মুখে মুখে, আর কয়েকটি নিদর্শনে।

.

রায়বাড়ীর খিড়কীতে দুধপুকুর হয়েছিল। সোমেশ্বরের বিয়ের সময় বধু কাত্যায়নী তাতে স্নান করবেন। এবার কাটানো হয়েছিল বিমল সায়র-কন্যা বিমলার বিবাহে। বিমলা কন্যা। তার গ্রামে বের হতে লজ্জা নেই। তাই কাটানো হয়েছিল ঠাকুরবাড়ীর পিছন দিকে। ঠাকুরবাড়ীর সামনে ‘মায়ের পুকুর’ কালীমন্দির প্রতিষ্ঠার সময় কাটানো হয়েছিল। সে পুকুরে স্নান করত পুরুষে মেয়েতে সকলে। জলও খেতো। এবার কাটানো হল বিমল সায়র। এ সায়রে স্নান করবে গ্রামের মেয়েরা। তবে হাড়ি বাউড়ি ব্রাত্যদের মেয়েরা নয়। দু দিকে দুটো ঘাট বাঁধানো হয়েছিল। সে বাঁধাঘাট এখনও আছে। রানাগুলো ভেঙেছে, সিঁড়ি পায়ে পায়ে ক্ষয়ে গেছে, তবুও আছে। এখনও বিমল সায়রই গ্রামের সব থেকে ভাল পুকুর।

আর সে খাওয়া-দাওয়ার গল্প কাহিনীর মত এখনও লোকের মুখে মুখে আছে। মেয়ের বিয়েতে একটা পর্ব ছিল ক্ষীর চিঁড়ে। ক্ষীর চিঁড়ে কলা গুড় দিয়ে সধবাদের খাওয়ানো হত। সোমেশ্বর ক্ষীর চিঁড়ে করেছিলেন; তার গল্প করে লোকে বলে—ক্ষীর ছিল খুসবু ক্ষীর, গন্ধে মৌ-মৌ করেছিল নাটমন্দির। যারা খেয়েছিল তারা সারাটা দিন খুসবুভরা ঢেকুর তুলেছিল। চিঁড়ে ছিল গোবিন্দভোগ ধানের, যে ধানে যখন শীষ বের হয় তখন গোটা মাঠটা সুগন্ধে ভরে ওঠে। তাছাড়া কলকাতার সন্দেশ মিষ্টি; তখন কলকাতায় নতুন রসগোল্লা হয়েছে, পান্তুয়া হয়েছে। গ্রামের লোক খায়নি। তার সঙ্গে মর্তমান কলা। দেশের মিষ্টি ছিল মণ্ডা আর বোঁদে। মণ্ডা বলতে চিনির ঢেলা।

বহুবল্লভ পাল গ্রামের প্রবীণতম চাষী সদগোপ। সে আমার কড়চার অনেক উপকরণ জুগিয়ে দিয়েছে। সে শুনেছিল তার বাপ-মায়ের কাছে, ঠাকুমার কাছে। পাল এখন ঘোষ উপাধি নিয়েছে, সে বলেছিল, বাবু, মণ্ডা মানে চিনির ঢেলা, বাড়ীতে ভাঁড়ে থাকত। কখন আসে কুটুম-সজ্জন অতিথি-ফকীর, মাসাবধি থাকলেও গন্ধ হত না। কিন্তু যার দাঁত ভেঙেছে তাকে চুষতে হত। যার নড়া দাঁত তারও জ্বলে গুলে খেতে হত। একবার ওই ঘোষালবাড়ীতে, যিনি আপনাদের নায়েব গো, তার বাড়িতে কে রাগী বামুন এসেছিল দুপুরবেলায়। তাকে দিয়েছিল মণ্ডা। ব্রাহ্মণ কামড় মেরে বেকুব, নড়া দাঁত ছিল, মট করে গেল ভেঙে, তেষ্টা ক্ষিধের সময় দাঁত ভেঙে ব্রাহ্মণ আগুন। সেই মণ্ডা নিয়ে ছুঁড়ে মেরেছিল গেরস্ত কত্তার কপালে। কপাল কেটে রক্ত পড়ল, মণ্ডা ভাঙল না।

আর গল্প আছে অন্দরমহলের সঙ্গে জোড় লাগিয়ে আর এক মহল অন্দরের পত্তন। কন্যা জামাতার জন্যে আর এক মহলের বনেদ গড়া হয়েছিল ওই বিয়ের অষ্টমঙ্গলের মধ্যে। এ কথাটা চলিত আছে কীর্তিহাটে।

অষ্টাহব্যাপী উৎসব। বাঈ নাচ, খেমটা নাচ, তার সঙ্গে, বহুবল্লভ পাল বলে—এসেছিল বাবু তৰ্জা গান! মহাদেব মোদক আর কেষ্ট ঘোষ। বাবার কাছে শুনেছি, তিনি ত্যাখন বালক। বুয়েচেন, মহাদেব মোদক এই কালো রঙ আর শিবের মত ডাগর রাঙা রাঙা চোখ। আর ধবধবে সাদা মাথার চুল। তেমুনি এক জোড়া সাদা মোচ। নেপুর পায়ে দিয়ে কি নাচন ধুয়ো ধরেছিল।

নেচে নেচে আয় রে আমার কেষ্ট নীলমণি
যতনে তোমার পিঠে পটুপটাপট লাগাই পাঁচনী।
রাজাবাবুর মেয়ের সাদী        পাত্র ব্রাহ্মণ কুলের নিধি
নিখুঁত আচার বেদ বিধি তার সাথে নাচে যবনী
বেটা তোর তার পিছে কিসের ঘুরঘুরানি
পিঠে তোর লাগাই পাঁচনী!

তা গানে সাধারণ লোকে মেতে গিয়েছিল। এখনও লোকে ওই কয়েক ছত্র মনে করেই রাখেনি শুধু, গানে করেও গেয়ে থাকে। চাষের মাঠে গেলে চাষীর মুখে শোনা যায়, আমি শুনেছি।

***

একটা হাসির কথা এর সঙ্গে আছে। পাঁচ বছরের বীরেশ্বর খুব কেঁদেছিলেন। বলেছিলেন, দিদির বিয়েতে সব হয়ে গেল তো আমার বিয়েতে কি হবে?

.

এর পর জামাই ছেলেকে নিয়ে—ছেলে জামাইয়ের শিক্ষার জন্য বাধ্য হয়ে কাত্যায়নীকে যেতে হয়েছিল কলকাতা।

.

গ্রামের গল্প এখানেই ফুরিয়ে গেছে। কিন্তু চার বছর পর সোমেশ্বর আবার সপরিবারে এসেছিলেন কীর্তিহাটে। শুধু জামাইকে রেখে এসেছিলেন কলকাতায়, সে তখন কলকাতায় হিন্দু কলেজে পড়ছে। বয়স পনেরো বছর। মেয়ে বিমলার বয়স বারো। সে তখন অন্তঃসত্ত্বা হয়েছে। আর সঙ্গে সঙ্গে মাথার দোষ দেখা দিয়েছে। শিউরে উঠেছেন সোমেশ্বর এবং কাত্যায়নী। মা ছাড়া এ বিপদে উপায় কি? এ ছাড়াও সোমেশ্বরের আর একটা টান ছিল। নীলকর রবিনসন তখন নীলের কুঠীতে লাভ করে ব্যবসা বাড়াচ্ছে। একটা কুঠী থেকে তিনটে কুঠী করছে। নতুন কুঠীর একটা এখানেই মাইল দুয়েক দূরে। আর একটা শ্যামনগরে। শ্যামনগরের সরকারেরা তখন অবস্থায় ঘায়েল হয়েছে। তাদের সঙ্গে রবিনসনের যোগাযোগ সোমেশ্বরই করে দিয়েছিলেন। এবং অন্য দিকে তাঁর ঝোঁক পড়েছে নতুন নতুন ভূসম্পত্তি কেনার উপর। দ্বারকানাথ ঠাকুর মশায়ের মত পরগনা কেনার ঝোঁক তাঁর ছিল না। ছিল বাছাই করে লাট মৌজা খরিদের। নতুন ম্যানেজার গিরীন্দ্র আচার্য বিচক্ষণ লোক, তাঁর পরামর্শে তিনি কিনছিলেন সেই সব মৌজা যে সব মৌজায় পতিত আছে বেশী। পতিত আবাদ করিয়ে বিলি করে তা থেকে মোটা লাভ হবে।


© 2024 পুরনো বই