সুরেশ্বর এসে ভালই করেছিল, নইলে হতভাগিনী বিধবার শেষকৃত্যটাও হত জীবনকালের বেঁচে থাকার লাঞ্ছনার চেয়েও কঠিনতর লাঞ্ছনার মধ্যে।
একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দল ঘোঁট পাকিয়েছে—এর প্রায়শ্চিত্ত হয় নি। একজন ম্যাট্রিক ফেল হাফ মাতব্বর ছেলে বলেছে—ডাক্তারের কাছে শুনেছে রোগটা ঢিবি ইন্টেস্টাইন।
প্রবীণদের মধ্যে কয়েকজন ধনেশ্বরের নেতৃত্বে আলোচনা করেছেন, ওর যৌবনে যে অপবাদ হয়েছিল তা অপবাদ নয় সত্য। তার জন্য ওকে কোন যজ্ঞিতে রাঁধতে পর্যন্ত কাঠি দিতে দেওয়া হত না। এ ক্ষেত্রে অন্তত প্রায়শ্চিত্ত একটা হয়ে থাকলে কথা ছিল না। কিন্তু যখন হয় নি তখন এতে কে কাঁধ দেবে!
ধনেশ্বর বলেছেন—আমাদের স্টেট থেকে পাঁচ টাকা দেবার কথা ছিল এইসব অন্যথা দরিদ্রের সৎকারের জন্যে। তাই বা কি করে দেব? এ তো একরকম ধর্মচ্যুত! রায়বাড়ীর দলিলে এ নিয়ে দুটি নির্দেশ আছে। এক, ওই পাঁচ টাকা বরাদ্দ। দুই, রায়বাড়ীর দেবোত্তরের ট্রাস্টি, যার পালা পড়বে দেবোত্তরে, তাঁর তরফ থেকে কারুকে উপস্থিত থাকতে হবে।
পালাটা এখন ধনেশ্বরদের। ধনেশ্বর এসেছেন। তা ছাড়াও যার বাড়ী কেউ মারা যায় সেখানে ধনেশ্বর পালা থাক বা না-থাক যান। এখানে তাঁর উদারতা কেউ অস্বীকার করবে না। কিন্তু অধর্মের কাজ তিনি করবেন না।
প্রতিবাদ করছে অতুলেশ্বর। শিবেশ্বরের ছোট ছেলে। যে ম্যাট্রিক ফেল করে কংগ্রেস করে বেড়ায়। ১৯৩০ সাল থেকে অগ্নিগর্ভ মেদিনীপুর কংগ্রেস। তবে ভাগ্য ওর ভাল, আর ধরা পড়েনি। গ্রামে প্রায়ই থাকে না। কংগ্রেস করে কীর্তিহাটের বাইরে। সে হঠাৎ গ্রামে এসে গেছে। আজকের দিনটিতেই।
অভুলেশ্বর দাদাকে প্রশ্ন করছে—তাহলে হবেটা কি? পচবে ঘরে? গ্রামের মধ্যে?
প্রশ্নটা মারাত্মক, এর জবাবে আমি কি জানি বলা চলে না। যাদের মড়া তারা যা হয় করবে এও বলা চলে না, কারণ মেয়েটি সামান্যমাত্র একখানা ঘর সম্বল করেই কোনক্রমে দিনপাত করে এসেছে। তার শ্বশুরবংশের অন্যদের সঙ্গে পৃথক অনেকদিন।
সুরেশ্বর এবং মেজঠাকুমা এসে উপস্থিত হলেন এই মুহূর্তটিতেই। ধনেশ্বর বলে উঠল-দুর্গা দুর্গা! শব্দটির ব্যঞ্জনা এখানে অনেক গভীর ছিল, সুলতা। ধনেশ্বরকাকার দুর্গা স্মরণে আমার শরীরে পর্যন্ত জ্বালা ধরেছিল। কিন্তু মেজঠাকুমা দেখলাম অবিচল। বললেন—হতভাগী সত্যিই মরেছে, না এখনো বেঁচে থাকতেই হচ্ছে কথাগুলো?
অতুলেশ্বর বললে–কি রে? তুই তো ভিতরেই ছিলি! বললে সে রায়দের জ্ঞাতি ভট্টচাজদের একটি ছেলেকে।
সে বললে-না মারা গেছে তা আধঘণ্টা হবে। ওই মেজমাকে খবর যখন পাঠালাম তখনও উঁ-আঁ করছিল, তারপর যখন চুপ করেছে তখনই বোধহয় হয়ে গেছে। গ্রহণীর রুগী তো! একটু দেখে—আমি ভিতরে গিয়ে দেখলাম—চোখ স্থির হয়ে গেছে নিঃশ্বেসও পড়ছে না।
মেজঠাকুমা ভিতরে গেলেন এবং ফিরে এসে বললেন—না, গেছে। খালাস পেয়েছে। তা ওর গতির কি হবে বাবা ধনেশ্বর?
—কি হবে? অনেকে বলছে এটা ওর পেটের যক্ষ্মা। ভয়ঙ্কর সর্বনেশে রোগ। তাছাড়া তোমার তো অজানা নয়, ঠাকুর-দেবতা ব্রাহ্মণভোজনে ভটচাজবাড়ীর বউ হয়েও ছুঁতে নাড়তে পেত না। এখন কাকে বলব—যাও হে গতি করে দিয়ে এস।
—কিন্তু লোকে তো ওর হাতে খেতো। তোমার বাবাও খেয়েছেন। আমার কাছে যখন যেতো ও তখনই বলতেন, নেড়ী, একটা কিছু রান্না করে দিয়ে যা। তোর হাত নয় তো, অমৃত।
ধনেশ্বর বলে উঠল—সেটা ধর্তব্যের মধ্যে নয়। ওটা মানুষের একটা ব্যাধি। তা নইলে তাঁর বৃদ্ধ বয়সে তোমার সঙ্গেই বা গিঠ বাঁধবেন কেন? আর তুমিই বা ঘাটে বসে ল্যাভেন্ডার সাবান মাখবে কেন?
মুহূর্তে সব স্তব্ধ হয়ে গেল। শুধু কুৎসিত কিছুই নয় ভয়ংকর কিছুও যেন তার সঙ্গে সেই জায়গাটায় ছড়িয়ে পড়ল। আমিও কিছু বলতে পারলাম না। কিন্তু মেজঠাকুমা সেই মুহূর্তটি বোধকরি একমুহূর্তের জন্য রায়গিন্নী হয়ে উঠলেন। বললেন-তোমার মুখ দেখলে পাপ হয় ধনেশ্বর! তুমি এখান থেকে যাও! গোপেশ্বরের বাপ তো তুমি!
আশ্চর্য শক্তি ছিল ওই কণ্ঠের মধ্যে, কথার মধ্যে। ধনেশ্বর যে ধনেশ্বর তিনিও একেবারে বোবা হয়ে গেলেন। মুখখানা হয়ে গেল ফ্যাকাসে! সমস্ত জনতাও স্তব্ধ হয়ে রইল। ফিস্-ফাস্ করেও কেউ একটি কথা বললে না।
মেজঠাকুমা বললেন—একখানা গরুর গাড়ী কেউ এনে দেবে, গাড়ীর দাম দেব আমি। আমিই ওকে গাড়ীতে চাপিয়ে নিয়ে গিয়ে কাঁসাইয়ের জলে ভাসিয়ে দিয়ে আসব।
ধনেশ্বর মাথা হেঁট করে একটি কথা না বলে ওখান থেকে চলে গেলেন।
আমি তখন কথা ফিরে পেলাম, বললাম—তুমি চুপ কর মেজঠাকুমা, আমি ব্যবস্থা করছি। না হয় ইস্কুলে যাচ্ছি, সেখান থেকে ছেলেদের ডেকে আনছি, তাদের নিয়ে আমি যাব।
অতুলেশ্বর এগিয়ে এল, বললে-রাজী তো আমরাই রয়েছি।
এর পর আর কোন বেগই পেতে হয়নি। মেজঠাকুমার বিধবা ভাজের সৎকার হয়ে গেল নির্বিবাদে। লোক অনেকগুলিই হল। তবু আমি গেলাম সঙ্গে। মেজঠাকুমা একবার বললেন—তুই যাবি? শরীরে—
হেসে বললাম—শরীরটা কি আমার ননীর পুতুলের মত মেজঠাকুমা? আমি ইচ্ছে করলে তো ওই হাড় ক’খানাকে একলাই ঘাড়ে করে দিয়ে আসতে পারি! পারি না?
—রায়বাবুরা সব পারে। তা-যা, বারণ করব না। হতভাগী চিরকাল ভাগ্যের লাথি ঝাঁটাই খেয়েছে। মরবার পর যদি এইটে ওর ভাগ্যে ছিল যে তুই ওর শ্মশানবন্ধু হবি, ঘাটের খেয়ায় তুইও থেকে ওকে তুলে দিয়ে আসবি, তাহলে সেটাতে আর আমি বাগড়া দি কেন? যা! অতুলেশ্বর এসে বললে—একটু এদিকে শোন। বয়সে ছোট অতুলেশ্বর আমার সম্বন্ধে খুড়ো। তুমি বলে ডাকলে। কথা বললে এই প্রথম। বললে—শ্মশানে যারা যায় তারা কিছু নেশাভাঙ করে। কেউ মদ কেউ গাঁজা। তা
বললাম—বেশ তো। সে এদেশে সর্বত্রই করে। শিবঠাকুরের এলাকা। বলে পকেট থেকে মানিব্যাগটা বের করে দশ টাকার নোট একখানা বের করে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল খাট চাই, জিনিসপত্র চাই। বললাম—খাট-টাটের ব্যবস্থাও তো করতে হবে!
হেসে অতুলেশ্বর বললে—এখানে খাট-খাটিয়া নেই, বাঁশের মাচান বেঁধে নিয়ে যায়। আগে রায়বাড়ীতে খাটের রেওয়াজ ছিল, এখন সেখানেও বাঁশের মাচান। সুখেশ্বরদা বাবা একদিনে গেলেন—সে তো ভয়ঙ্কর ব্যাপার। এমন ব্যাপারটা না হলে অন্তত বাবার জন্যে ঘরের খাটই একখানা দেওয়া হত। কিন্তু সে হয়নি ওই ব্যাপারটার জন্যে। সুখেশ্বরদার লাশ পুলিশ পোস্ট মর্টেমের জন্যে নিয়ে গেল গরুর গাড়ীতে চাপিয়ে মেদিনীপুর। বাবার দেহটা এইখানেই ছেড়ে দিলে বোনাফাইডি সুইসাইড বলে। বাবা গেছেন বাঁশের মাচায়। খাট বের করবার কথা কেউ মুখেও আনে নি।
চমৎকার কথা বলে অতুলেশ্বর। মেদিনীপুরী টান অবশ্যই আছে। কিন্তু বাঁধুনীতে গাঁথুনীতে শহরের বাগবিন্যাস থেকে মলিন নয়।
অতুলেশ্বরই বললে—বাঁশের ব্যবস্থা আছে। ওই কাঁসাইয়ের জঙ্গলে বাঁশ আছে, ওটা দেবোত্তরের সম্পত্তি, কিন্তু গ্রামের কারুর মৃত্যু হলে ওখান থেকে বাঁশ পায়। শুকনো গাছ দু’চারটে থাকেই। কাঠও কেটে নেয় ওখান থেকে। তবে নতুন কাপড় চাই একখানা, খানিকটা ঘি, একটুকরো সোনা, একটুকরো রুপো, বালি, কুঁচিকাঠি, তা আরও পাঁচটা টাকা দাও। ওতেই হয়ে যাবে।
নোট আর একখানা দশ টাকারই দিলাম। বললাম—বাকীটা এখন রাখ।
মেয়েটার দেহ বের করতে আমিও গিয়েছিলাম। বোধ হয় মেজঠাকুমাকে খুশী করতেই। দুর্গন্ধে আমার বমি আসছিল। বহুকষ্টেই দমন করে বের করে আনলাম। মেজঠাকুমা বোধ হয় দেখলেন না, কারণ তিনি উপু হয়ে দাওয়ার খুঁটিতে ঠেস দিয়ে বসে হাঁটুর মধ্যে মুখটি গুঁজে কাঁদছিলেন।
বাড়ী ফিরতে সন্ধ্যে উত্তরে গিয়েছিল। মেয়েটির বাড়ী হয়ে ফিরতে হয়, সেখানে তখনও মেজঠাকুমা বসে ছিলেন, বাইরে পোড়া মালসায় আগুন রেখে এবং দরজার পাশে নিম রেখে। কিছু মিষ্টিও আনিয়ে রেখেছিলেন। এ টাকাটা উনি দিয়েছিলেন। আমি বললাম—মিষ্টি আমি খাব না ঠাকুমা।
অতুল বললে-ও বমি করেছে ওখানে গিয়ে। ওকে বার বার বললাম —তুমি কাঁধ দিয়ো না। ভীষণ দুর্গন্ধ। ও শুনলে না। শ্মশানে গিয়েই হড়হড় করে বমি করে ফেললে। কি করব, ফিরে পাঠাতেও পারলাম না। ও-ও এল না। আমি ভাবলাম—ফিরে পাঠালে দুর্নাম করবে, বলবে কলকাতার বাবু!
মেজঠাকুমা বললেন—একটা কণা ভেঙে মুখে দে। তার তৃপ্তি হবে। ওর ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে একটা ন্যাকড়ায় বাঁধা গোটা আষ্টেক টাকা পেলাম—পয়সায় সিকিতে আধুলীতে টাকায়। বোধহয় শেষ কাজের জন্যেই রেখেছিল। তুই ওর ছেলের কাজ করলি, বাপের কাজ করলি, সধবা হলে বলতাম স্বামীর কাজ করলি। নে, একটু ভেঙে নে। কই তোর গা দেখি!
বুকে হাতের উল্টো পিঠটা ঠেকিয়ে বললেন—গা গরম হয়েছে সুরেশ্বর! দাঁড়া আমি সঙ্গে যাই। বলেই ডাকলে—রাধারমণ!
রাধারমণ মেজঠাকুমার আর এক ভাই। সে-ও আমাদের সঙ্গে শ্মশানে গিয়েছিল। তাকে বললেন—বউ আর তুই সব ব্যবস্থা কর এবার। বুঝলি, আমি চললাম!
আলো নিয়ে ডিকু শ্মশান পর্যন্ত গিয়েছিল। পাঠিয়েছিলেন মেজঠাকুমাই। বললেন—চল ডিকু!
নীরবে পথ হাঁটছিলেন, হঠাৎ বললেন—চল ঠাকুরবাড়ী হয়ে চল। প্রণাম করে চরণোদক নিয়ে যাবি।
ধনেশ্বর কারণ নিয়ে সন্ধ্যা করছিলেন, বার-দুই কালী কালী বলে গম্ভীরস্বরে ডেকে উঠলেন। প্রণবেশ্বর, কল্যাণেশ্বর এবং কয়েকজনই বসে ছিল কাছারীর দাওয়ায়।
প্রণবেশ্বর বললে—শ্মশানে গেছলে?
বললাম—হ্যাঁ।
—বড় বাড়াবাড়ি করছ। এত কেন?
কল্যাণেশ্বর বললে—তুমি এবার এম.এল.এ হবার জন্য দাঁড়াও সুরোদা। আমরা প্রাণপণে খাটব। টাকা আছে। তার উপর যা নাম হয়ে গেল না, ঠিক বেরিয়ে যাবে!
আমি কিছু বলবার আগেই মেজঠাকুমা বললেন—কল্যাণ, দুধপুকুরের সব থেকে বড় আম গাছটা—যেটার নাম ছিল গিন্নীর গাছ-সেটা কে কাটলে রে? তুই?
—কি?
—দুধপুকুরের গিন্নীর গাছটা! তুই কেটেছিস আমাকে বললে—
—কে বললে?
—বললে তোর যারা মজুর খাটে তারা!
—হ্যাঁ, সেটা বাবার আর দাদুর শ্রাদ্ধের সময় কাটিয়েছি।
—সে সব শ্রাদ্ধ তিন দিনে হয়েছে। বারোটি করে বামুন খেয়েছে, তুই এতবড় গাছটা কাটালি—
—কি—? হঠাৎ সন্ধ্যারত ধনেশ্বর চিৎকার করে উঠলেন—দুধপুকুরের পাড়ের গিন্নীর গাছ? তাতে যে একশোখানা তক্তা হবে! আমি পিতৃশোকে ভ্রাতৃশোকে পুত্রের লজ্জায় কাতর সেই ফাঁকে—
নাটমন্দিরটা কুৎসিত কোলাহলে ভরে উঠল।
সুরেশ্বর বললে—ঠাকুমা, আমার শরীরটা বড় ক্লান্ত—
—চল্ ভাই চল্। না, একটু দাঁড়া। ঘোষালমশাই!
ঘোষাল সুরেশ্বরের নিজস্ব কর্মচারী। ঘোষাল এসে বাইরে দাঁড়াল। মেজঠাকুমা বললেন—সুরেশ্বরের একটু জ্বর হয়েছে, ডাক্তারবাবুকে ডেকে পাঠান।
জ্বর নেহাৎ একটু নয়, টেম্পারেচার উঠল একশো চার। তার উপর সর্বাঙ্গে বেদনা, কাঁধের ব্যথাটা অসহ্য।
ডাক্তার অ্যাসপিরিনের পুরিয়া তাঁর ব্যাগ থেকেই বের করে দিয়ে গেলেন। সুলতা, আমার ভিতরটা তৃষিত হয়েছিল স্কচ হুইস্কির জন্যে। শ্মশানে আমি ভালো ছেলে সাজবার অভিপ্রায়ে ঠিক নয়, ওই ওদের সঙ্গে দেশী কারণ পান করি নি। করতে পারি নি।
এখানে মেজঠাকুমা বসে। রঘুকে বরাত করতে পারছিলাম না। বললাম—ঠাকুমা, তুমিও তো সারাদিন বসে। বোধহয় খাওনি কিছু। যাও বাড়ী গিয়ে খাও। তুমি ভেবো না, ছেলে ঘুমলো পাড়া জুড়লো বলে আমি এক্ষুনি ঘুমিয়ে যাব।
মেজঠাকুমা বললেন—না। রঘু-যে ঘরে বউমা, তোর বাবুর মা এসে থাকতেন ওইটে পরিষ্কার ক’রে দে! আমি ওখানেই কাপড় ছেড়ে সন্ধ্যে করে নেব। শোবও এই ঘরে। একবার চল্ আমার সঙ্গে ও-বাড়ী, কখানা কাপড় আর পুজোর ঝোলাটা নিয়ে আসব।
—কি দরকার ঠাকুমা। কেন এত ব্যস্ত হচ্ছ?
—ল্যাভেন্ডার সাবান মাখা নিয়ে যে কেলেঙ্কারী করছে ধনেশ্বর তারপর প্রকাশ্যে কপালে কৃষ্ণনামের ছাপ না আঁকলে তো রাধার পুজো লোকে করত না রে! আমার ষোল বছরে ছেলে হলে তার বয়স আজ একুশ বাইশ হত। তুই না হয় আমার নাতি—পৌত্র। ভাসুরপোর ছেলে। আমি ঠাকুমা। সেই ঠাকুমা হয়ে এই বাড়ীতে বাসা গাড়ব, দেখি কার সাধ্যি আমাকে কি বলে এরপর। চল রঘু। ডিকু, বাবুর কাছে বস্। রাত্রে আজ দুজনেই থাকবি। বাবুর জ্বর। ঠাকুমা নিচে নেমে দরজা খুলতেই আমি উঠে গিয়ে তৃষ্ণা নিবারণ করে ফিরে এসে শুলাম। এবং শরীরের ক্লান্তি তার সঙ্গে হুইস্কি ও অ্যাসপিরিনের যৌগিক ক্রিয়ায় ঠাকুমা ফিরবার আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
ঘুম ভেঙেছিল অনেকটা রাত্রে, তখন অ্যাসপিরিনের ক্রিয়া শেষ হয়েছে। গায়ের মাথার বেদনা ধীরে ধীরে অ্যাসপিরিনের বাঁধ ভেঙে বাঁধা জলের আস্তে আস্তে ঝ’রে ঝ’রে একসময় সশব্দে ভেঙে নামার পড়ার মত জেগে উঠল। আমি কাতরে উঠলাম- আঃ! পাশ ফিরে শুলাম।
ও-ঘর থেকে সাড়া উঠল। কেউ যেন উঠে দরজার কাছে এল। রঘুর নাক ডাকার শব্দ পাচ্ছি। সে আমার খাটের পাশেই মেঝেতে শুয়ে আছে। আর একটা পুরিয়া খেতে হবে। আকণ্ঠ তৃষ্ণা পেয়েছে। হুইস্কির রিঅ্যাকশনও বটে, তার সঙ্গে জ্বরের উত্তাপেও জলের তৃষ্ণা আছে।
দরজাটা খুলে গেল। বললাম- কে? ঠিক মনে ছিল না, মেজঠাকুমা এখানে আছেন সে কথা। মেজঠাকুমা উত্তর দিলেন—আমি।
—মেজঠাকুমা!
—হ্যাঁ। তিনি ঘরে এসে ঘরের কোণে টিপয়ের আড়াল থেকে নীল কাচ দেওয়া হ্যারিকেনটা বের করে উস্কে দিয়ে টিপয়ের উপরে রাখলেন। এবং এসে খাটের পাশে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলেন। বললেন—কাতরাচ্ছিস কেন?
বললাম—দেখ তো জল কোথায়!
জলের গ্লাসটা এগিয়ে দিলেন। আমি একটু উঠে এক নিঃশ্বাসে জলের গ্লাসটা শেষ করে বললাম—ওষুধের পুরিয়া দাও, আরও জল আন। গায়ের উত্তাপটা বেড়েছে কিনা দেখ দেখি!
গায়ে হাত দিয়ে দেখে বললেন—বেড়েছে বলেই মনে হচ্ছে। কিন্তু আবার অ্যাসপিরিন খাবি? আর এই জ্বরে ও ছাই গিলি কেন?—
—কি?
—কি আর? রায়বংশের যাতে নাড়ী কাটা!
—তুমি টের পেয়েছ?
—পাব না? ও-বাড়ি থেকে ফিরে এসে ঘরে ঢুকেই দেখি সৌরভে সুবাসে ঘর মো-মো করছে। আমি জানি তুই খাস।
বললাম—বকবে না?
—বকব? অন্নপ্রাশনের সময় সেকালে সোনার ছোট্ট গ্লাসে কালীমার প্রসাদী কারণ দিত, তাই ঠেকিয়ে দিত ছেলের মুখে।
বললাম—তাই নাকি?
বললেন—হ্যাঁ। কিন্তু এখন ঘুমো। মাথায় হাত বুলিয়ে দি।
তিনি মাথায় হাত বুলোতে লাগলেন। কিন্তু ঘুম আমার এল না। বললাম—ওই জানালাটা খুলে দাও। কাঁসাইয়ের ধার থেকে ঠান্ডা হাওয়া আসে।
—ওটা আমিই বন্ধ করে দিয়েছি। জলো বাতাস তো!
—তা হোক। ওতে ক্ষতি হবে না।
—তার থেকে আমি বাতাস করি।
—বেশ।
পাখা ঘুরতে লাগল। বললেন—টানাপাখাটা মেরামত করিয়ে নে না। টানবার লোক অনেক মিলবে।
—পাখা কোথায়?
—পাখা কোথায়? বাবা, পঞ্চাশখানা পাখা চলত সেকালে। ছোট ঘরে একটা বড় ঘরে জোড়া। যে পাখা টানত তার হাত-পা কোনখানে দড়ি দিয়ে বাঁধা থাকত আর দড়ির অপর দিকটা থাকত বিছানায়। পাখা টানতে টানতে বন্ধ হলে সেই দড়িতে হ্যাঁচকা টান পড়ত আর হাঁক উঠত, এ্যাও হারামজাদা! কাত্যায়নী ঠাকরুণের আমলে বিধি ছিল রাত্রে যে পাঙ্খাওলা যাবার থামবে, সকালে তাকে জওলাপ্রসাদের কাছে তত দু-কিল করে খেতে হবে। জওলা নাকি একবারে দেড় সের আটা খেতো, পাওভর ঘিউ খেতো। বরাদ্দ ছিল ভাণ্ডার থেকে। খোরাক আর তার ওপর মাইনে পেত তিন টাকা। সারারাত ছাদে জেগে পাহারা দিত আর হেঁকে হেঁকে ফিরত —আঃ –হ –হ! অ-হ-হ! হৈ! সারারাত। জগুলা থামলেই কাত্যায়নী হাঁকতেন—জওলাপরসাদ, থামলে কেন? জগুলা বলত—তনি তিয়াস পাইল। পানি খাইছিলাম মাঈজী!
থেমে কাত্যায়নীর কথায় ছেদ টেনে বললেন—পাখা ওই নিচের তলার একটা ঘরে ডাঁই হয়ে পড়ে আছে। সবই ভাঙা। তবু দু’চারটে কি ভাল থাকবে না! থাকবে। একটু মেরামত করিয়ে কাপড় লাগিয়ে টাঙালেই নতুন। ছাদে কড়িতে কড়া-টড়া সব লাগানো আছে।
—সে হবে। তুমি কাত্যায়নীর গল্প বল তো!
—ওরে বাবা! সে তো মহাভারতের একটা পর্ব রে! তার ভয়ে শুধু রায়বাড়ি নয় খোদ কর্তা ফোমেশ্বর রায় পর্যন্ত টটরস্ত।
***
অসুখে ভুগেছিলাম সুলতা সাতদিন। সাতদিন ধরে গল্প করেছিলেন মেজঠাকুমা কাত্যায়নী দেবীর।
সন্তান হয়ে বাঁচবার সঙ্গে সঙ্গে সুস্থ হয়ে উঠে কাত্যায়নী স্বামী থেকে আরম্ভ করে জমাদারনী পর্যন্ত এবং কলকাতা থেকে কীর্তিহাট পর্যন্ত কঠিন শাসনে নিয়ন্ত্রিত করে আশ্চর্য শৃঙ্খলায় বন্ধ করেছিলেন।
স্বামীর কলকাতা ছেড়ে আসবার সময় ছিল না। কাত্যায়নী নিয়মিত আসতেন কীর্তিহাটে। যে দেবতার দয়ায় তাঁর সন্তান বেঁচেছে, তিনি সুস্থ হয়েছেন, তাঁর প্রতি ভক্তির অন্ত ছিল না। নিজে দাঁড়িয়ে থেকে পুজো করাতেন, ভোগ শেষ হলে বাড়ী ফিরতেন। তারপর তাঁর রান্না চড়ত। সেই রান্না হ’লে খেতেন। সন্ধ্যে পর্যন্ত ঘুমোতেন। সন্ধ্যের পর উঠে গা ধোওয়া চুল বাঁধা শেষ করে আসতেন ঠাকুরবাড়ী, সেখানে আরতি, শীতলভোগ, শয়নের ব্যবস্থা ক’রে এসে বসতেন কাছারীর ঘরে। ফটক বন্ধ হত। আমলা মুহুরি ছাড়া কেউ থাকত না। তিনি বিষয়ের কথা বলতেন ম্যানেজার গিরীন্দ্র আচার্যের সঙ্গে। কোথায় কোন মামলা হচ্ছে, কোথাও কোন সম্পত্তি বিক্রী হচ্ছে, খবর নিয়ে বাড়ী ফিরে জল খেতেন। তখন খাবার করা শুরু হত। লুচি তরকারী মাছ ক্ষীর সব তৈরী হত সেই সময়। মেয়ে বিমলা ছেলে বীরেশ্বর মানুষ হত দুজন সুন্দরী সুশ্রী ভদ্রঘরের মেয়ের হাতে। তিনি শুধু খোঁজ নিতেন ঘণ্টায় ঘণ্টায়, আর কয়েকবার স্তন দিতেন কোলের সন্তান ছেলেকে। রাত্রে খেতে বসতেন ঘরে, বাইরে বারান্দায় এসে বসত ভাণ্ডারী সরকার চাকর ঝিদের প্রধানরা, আর ছিল একজন তার ভার ছিল গ্রাম-খবরদারির। ঝি চাকরের সর্দারেরা কোন্ চাকর কোন্ ঝি কি দোষ করেছে তা পেশ করত, তিনি বিচার করে দণ্ড দিতেন। ভাণ্ডারী বলত কি আছে কি নাই। সরকার লিখে নিত, কাত্যায়নী বলতেন, কত কি আসবে। গ্রাম-খবরদারির লোক গ্রামের খবর বলত। কোথায় কে রায়বাড়ীর নিন্দে করেছে, কে ভাল বলেছে, কার বাড়ীতে অসুখ, কার অভাব—নিবেদন করত। সরকারকে হুকুম দিতেন খোঁজ করতে; অভাবীর ঘরে চাল-ডাল পৌঁছে দিতে; অসুখের জন্যে বাড়ীর বাঁধা বদ্যিকে বলতে। আর নিন্দে-বান্দার কৈফিয়ৎ নিতে তাদের ডাক পড়ত খোদ তাঁর কাছে। যারা প্রশংসা করত, তাদেরও তিনি সম্মান করতেন। নোট করা থাকত; কোন উপলক্ষ্যে–বিয়ে, অন্নপ্রাশন, উপনয়ন—কিছু তাদের বাড়ী হলেই হয় দামী কাপড়, নয় সোনার কিছু, নয়তো নোকুতো বলে এক টাকা দু টাকার জায়গায় দশ টাকা দিতে হুকুম দিত।
এই সময় ভাই, দেশ থেকে ‘সতী যাওয়া’ উঠিয়ে দেবার জন্যে উঠেপড়ে লেগেছিল দেশের সব মাতব্বরেরা। কেউ রাজা, কেউ জমিদার-সব সায়েবী মতের বড়লোকরা। তার মধ্যে দ্বারকা ঠাকুর ছিলেন মাথার লোক। এই রবি ঠাকুরের ঠাকুরদাদা। তাঁর সঙ্গে ফোমেশ্বর রায়ের জানাশোনা দহরম-মহরম ছিল। ওঁরা একবয়সী ছিলেন। তাছাড়া উনি ছিলেন নুনের দেওয়ান। আর ফোমেশ্বর রায় কাঁথি তমলুকে হলদীর ধারে তখন নুন তৈরীর ‘খালারি’ বন্দোবস্ত নিয়ে নুনের কারবার করতেন। সেজন্য ঠাকুরবারুর কাছে যাওয়া-আসা করতে হত। ঠাকুরবাবু কড়া লোক ছিলেন। আর ইনি খুব হুঁশিয়ার ব্যবসাদার ছিলেন। তাঁর সায়ে সায় দিতেই হত তাঁকে
কাত্যায়নী ঠাকরুণ তখন কীর্তিহাটে এসে রয়েছেন।
হাসলেন মেজঠাকুমা। বললেন, তখন তো তাঁর স্বামীর শখ মিটেছে। মানে—মেয়ে হয়েছে একটি, ছেলে হয়েছে একটি, আর কি দরকার স্বামীতে? কিন্তু কথা শেষ না করে বেশ একটু সশব্দে হেসে উঠলেন।
অস্পষ্ট আবছায়ার মতো নীল লণ্ঠনের আলোয় সুরেশ্বর খোলা জানালার দিকে তাকিয়ে শুনছিল। বাইরে জ্যোৎস্না উঠেছে, একফালি জ্যোৎস্না তেরচা হয়ে একপাল্লা জানালার গায়ে লেগে যেন মেঝের উপর পিছলে পড়েছে। হাসির শব্দে সে মেজঠাকুমার মুখের দিকে তাকালে। বললে, হাসলে কেন?
—হাসলাম তোমাদের গুষ্টির ধারা মনে করে।
—কি সেটা?
—সেটা? সেটা হল—যেটা এখনও তোমার মধ্যে দেখছি নে সেইটে। রায়বাড়ীর বেটাছেলেরা একলা বিছানায় শুতে পারে না। কাত্যায়নী দেবীর সবসুদ্ধ সাতটা ছেলে। তার মধ্যে শেষের দুটো বেঁচেছে। কাত্যায়নীর শরীর ছিল দুর্বল। তিনি ছেলেমেয়ে নিয়ে এখানে সরে আসতেন তার ওটাও একটা কারণ। স্বামীর জন্যে দুটো সেবাদাসী নিজে দেখে পছন্দ করে বহাল করে দিয়ে এসেছেন। তার ওপর বাঈজী আছে। এখন আর সেবাদাসীদের চাকরী যেত না। মাথা গরম তো সেরে গিয়েছিল।
সুরেশ্বর অতি বিষণ্ণ হাসি হাসলে। বললে, মিথ্যে দোষ তুমি দাওনি ঠাকুমা। বাবার কথা মনে পড়ছে। বাবার মতো মানুষ তো আমি কমই দেখেছি। এত পণ্ডিত, এমন ভদ্রলোক আর মাকে আমাকে কি ভালোই বাসতেন। তিনি—।
—তুই এবার ঘুমুতে চেষ্টা কর, আমি মাথায় হাত বুলিয়ে দি। কথা থাক।
চোখই বুজে ছিল সুরেশ্বর। মাথায় লঘু চালনায় মেজঠাকুমার হাতখানি ঘুরছিল। সুরেশ্বর বললে, চুলগুলো বরং টানো ঠাকুমা, ওরকম করে দিলে সুড়সুড়ি লাগছে না, আরও জোরে টানো। টানো না যত জোর আছে তোমার। মা দুর্গার অসুরের চুল টানার মত টানো না!
মেজঠাকুমা বললেন—বোঁটায় কেন খাড়া, না বংশাবলীর ধারা। তোর মেজঠাকুরদার এই রোগ ছিল। একবার চুল টানতে টানতে আমার ভুল এসেছে, টানতে টানতে হাতেও ব্যথা ধরেছে। উনিও যেন ঘুমিয়েছেন। আমি টানা ছেড়ে এমনি আস্তে আস্তে হাত বুলিয়েছি; আর চমকে জেগে উঠে দিলেন হাত ছুঁড়ে। লাগল আমার নাকে। রক্ত পড়তে লাগল। তখন বলেন, এমনি সুড়সুড়ি দেয়! আমার মনে হল বিছেটিছে কিছু বেড়াচ্ছে চুলের মধ্যে।
হেসে সুরেশ্বর বললে, মেজঠাকুরদাকে তুমি খুবই ভালোবাসতে, না মেজদি?
অত্যন্ত প্রসন্ন ধীরকণ্ঠে বললেন মেজঠাকুমা, আমি খুব সুখী হয়েছিলাম সুরেশ্বর। মিথ্যে বলব না ভাই তোর কাছে, প্রথম যখন বিয়ে হয়, তখন বুড়ো বলে দুঃখ হয়েছিল, কেঁদেছিলাম। কিন্তু কেরমে কেরমে দুঃখ কোথায় গেল জানি নে, মনে হত আমি খুব সুখী। তবে যদি বলিস, সুখ কাকে বলে তুমি জানোই না, তবে তার জবাব আমার নেই। যা পেয়েছি, তাই অঢেল। ওঁর জন্যে লজ্জা অনেক পেতাম। উনি যেসব কাজকম্ম করেছেন, সেসব তো চোখেই দেখছিস। আমি বারণ করলেও শুনতেন না। কাত্যায়নী ঠাকরুণের মত দাপটও আমার ছিল না, তিনি ছিলেন রাজকন্যে। রাজবংশ। আমি পুজুরী বামুনের মেয়ে। সে ক্ষমতাও ছিল না। তবে বেশী লজ্জা পেতাম ওঁর মেজবউ মেজবউ রব তোলা বাতিক দেখে। চোখে আড় হয়েছি তো সঙ্গে সঙ্গে মেজবউ! মেজবউ! তারপর বাড়ির ছাদ কাঁপিয়ে মে-জ-বউ! এলেই জুড়িয়ে যেতেন, বলতেন, যাও কোথা? চটকদুলালী আমার! এই আছে এই নেই। ফুরুত আর ফুরুত। আমাকে আদর করে একলা পেলে বলতেন, চটকদুলালী। বলতাম, একটা কথাই বলতাম —বলতাম, বলতাম—বলতাম, মরতে! বলতেন, সে আমি মরার পর যেয়ো। না হয় যদি পার সেদিনই যেয়ো, চিতায় পুড়ে মরো আমার। বলে আক্ষেপ করে বলতেন, কলিতে ধর্ম একপদ। তাও এরা ঠেঙিয়ে ঠেঙিয়ে আধখানা থেকে সিকিখানায় এনেছে। নইলে সতী অধর্ম অন্যায় হয়! কাত্যায়নীদেবী যা লিখেছিলেন তা অক্ষরে অক্ষরে ফলছে। অক্ষরে-অক্ষরে!
বললাম না, কাত্যায়নীদেবী ছেলেমেয়ে নিয়ে তখন এখানে, তাঁর কানে এল, সতী ওঠাবার জন্যে দরখাস্ত করছে কলকাতার বড় বড় লোকেরা। তার মধ্যে দ্বারকা ঠাকুর একজন প্রধান। উনি জানতেন নুনের কারবার করেন স্বামী, তিনি দ্বারকানাথের কত অনুগত। তিনিও তা হলে সই দেবেন। তিনি তৎক্ষণাৎ চিঠি লেখালেন স্বামীকে। ভালো লিখতে জানতেন না নিজে, কোনমতে সই দিতে জানতেন মোটা মোটা করে, তিনি প্রেমপত্র লেখাতেন মুহুরীকে দিয়ে। তিনি বলতেন মুহুরী লিখত। তারপর পড়ে শোনাতো। তাতে তিনি সই দিতেন মোটা আঁকাবাঁকা হরফে কাত্যায়নী।
ওদিকে তখন ভোর হয়ে এসেছে। আমার জ্বরটা যেন ছেড়ে আসছে মনে হল। ঘাম হচ্ছিল। দেশে তখন ম্যালেরিয়া ছিল প্রচুর। ১৯৩৬ সাল। শীত করে জ্বর আসে, ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ে। ঠাকুমা বললেন, দেশের সম্পত্তি পেলে তো! এখন ভোগ। সকালে উঠেই ডাক্তারকে বল কুইনিন ইন্জেকশন দিয়ে দিক।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
***
ভোরে জ্বর ছাড়ল, আবার বিকেলে শীত করে জ্বর এল। কুইনিন মানলে না। সেদিন জ্বর প্রবলতর হল, একশ তিন উঠল টেম্পারেচার।
মেজঠাকুমা ডেকে পাঠালেন বুড়ো ভটচাজ মশাইকে। তিনি নাড়ী দেখে ঠিক বলে দেবেন, ক’দিন হবে জ্বরের ভোগ। নাড়ীতে সর্দি না পিত্তি না বায়ু, না সর্দি পিত্তি, না বাতপিত্তি, কি কি ঠিক বলে দেবেন। ডাক্তারেরা ওসব জানে না, ওরা নাড়ী গোনে ঘড়ি ধরে।
মেজঠাকুমাকে বাধা দেবার ক্ষমতা আমার ছিল না। উনি মেজঠাকুরদার কাছে যা হতে পারেননি, আমার কাছে তাই হয়েছিলেন, হয়েছিলেন কাত্যায়িনী দেবী।
দয়াল ভটচাজের বয়স আশী। সম্পর্কে মেজঠাকুমার শ্বশুর। লাঠি ধরে এলেন। পাকা আমের মত চেহারা, তেমনি টক্টকে রঙ। মাথার চুল-ভুরু সব পাকা। দেখে বললেন, সাদা জ্বর মেজ-মা। চিন্তা নেই। দিন পাঁচেক লাগবে। তবে বাবুর মালোয়ারী ধরলে মনে হচ্ছে গো! দুটো ঠায় উপোস দাও।
বসে রইলেন ভটচাজ কিছুক্ষণ। মেজঠাকুমা বললেন, রায়বাড়ীর গল্প শুনতে ওঁর খুব ঝোঁক। ওঁকে বলুন।
দন্তহীন মুখে হেসে দয়াল ভটচাজ বলেছিলেন, আজ নয় মা, কাল বলব। কাল এসে আবার দেখে যাব তখন।
আমি কি করব। উপোস দিয়েই পড়ে রইলাম আর ডাক্তারের মিকশ্চার খেলাম। কিন্তু কাল কাটে কি করে? পুরনো খাতা আর কাগজ নিয়ে পড়লাম। পুরনো খাতায় পেলাম কল্যাণীয়া শ্রীমতী বিমলাকুমারী দেবীর শুভ পরিণয় উপলক্ষ্যে খরচ। জামাতা আশীর্বাদী! হীরার আংটি একটি, মারফৎ হ্যামিল্টন এন্ডো কোং, মোকাম কলিকাতা, মূল্য এক হাজার টাকা! বিস্ময় লাগল। জমা-খরচের খাতাটার সাল ১২৩১ সাল, ইংরিজি ১৮২৪। বিমলাকুমারীর বয়স সাত, ১৮১৭ সালে জন্ম।
কাত্যায়নীরও বিয়ে হয়েছিল সাত বছর বয়সে।
খরচের পাতাতেই চোখ বুলাচ্ছিলাম। সে এলাহি কাণ্ড। পরিশেষে একটা খরচের ফর্দ পেলাম। একসঙ্গে সব হিসেব। খরচ যোগ করে দাঁড়িয়েছে পনের হাজার টাকায়!
তারপরের দিন মেজঠাকুমা ঠাকুরবাড়ী গিছলেন; সেখান থেকে ফিরবার পথে পুরনো বাড়ী হয়ে ফিরলেন, সঙ্গে নিয়ে এলেন রেশমী কাপড়ে বাঁধা একটা কাগজের পুলিন্দা। রেশমী কাপড় খানা এককালে সুদৃশ্য এবং বেশ মূল্যবান ছিল। বললেন, এটা তাঁর বাক্সের মধ্যে রাখা ছিল রে। দেখ এতে কি আছে।
দেখছিলাম পাল্টে পাল্টে। দেখলাম সবই প্রায় চিঠি। চিঠিগুলি রত্নেশ্বর রায়ের লেখা, লিখেছিলেন অধিকাংশই শিবেশ্বরকে। কয়েকখানা দেবেশ্বর রায়কে লেখাও আছে। তিরস্কারপূর্ণ চিঠি। তার একটাকে লেখা আছে : “প্রয়োজন হইলে তোমাকে ত্যাজ্যপুত্র করিতেও পশ্চাৎপদ হইব না। তুমি লিখিয়াছ দেবত্র টিকিবে না আইনে। দেখা যাইবে কি হয়। মোট কথা তোমার অহিন্দু আচরণ আমি সহ্য করিব না ইহা জ্ঞাত হইবে।” শেষে কতকগুলি কথা আছে, যেগুলিকে বেদবাক্যের মত বলা যায়।
আমি ভাবছিলাম। এমন সময় জ্যাঠতুতো ভাই প্রণবেশ্বর, খুড়তুতো ভাই সুখেশ্বর কাকার ছেলে কল্যাণেশ্বর এল আমাকে দেখতে। বসলে, বললে—অসুখ ধরালে তো!
বললাম, অসুখ নয়। মানে ওই মেয়েটির অসুখ আমাকে ধরেনি।
কল্যাণেশ্বর ছড়ানো কাগজগুলো দেখে বললে, ওগুলো কি?
—চিঠি। পুরনো চিঠি সব। রায়বাহাদুরের লেখা তাঁর ছেলেদেরকে।
—ও কোথায় পেলে?
—বাড়ীতেই। আবার কোথায়!
চুপ করে রইল কল্যাণেশ্বর। প্রণবেশ্বরদা বললে, দেখ, কল্যাণেশ্বর গার্লস স্কুলের ঠিকে নিয়েছে। ঘর তৈরী হয়ে গেছে, জানালা-দরজা লাগাতে বাকী আছে। এখন ওটা থাকবার জন্য দিতে হবে সেটেলমেন্ট অফিসারকে তুমি বলেছ। কল্যাণ কাজ শেষ করতে গিয়ে থমকাচ্ছে। কারণ, কাল মেজঠাকুমা সন্ধ্যের সময় বললেন, কল্যাণেশ্বর দুধপুকুরে ‘আমগাছ—কি গিন্নীগাছ না কি নাম—সেটা কাটিয়েছে। ও সেটা কাটিয়েছে ঠিক। কিন্তু সে পোড়া কাঠের জন্যে। ওদিকে ধনেশ্বর কাকা কাল রাত্রে যাচ্ছেতাই করেছেন। যত গাল তোমাকে মেজঠাকুমাকে দিয়েছেন, তত কল্যাণেশ্বরকে। সে যা হয় হবে। এখন জিজ্ঞাস্য হচ্ছে—আমতক্তার দরজা-জানালা লাগালে বিলের সময় তার টাকা দেব না-এ বলবে না তো?
কল্যাণেশ্বর বললে, আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি সুরেশ্বরদা, উনি যাই করুন তোমার বিপক্ষে, তাতে আমি আর থাকব না।
একটু বিষণ্নহাসি আমার মুখে দেখা দিয়েছিল। লজ্জা হয়েছিল। নিঃস্ব রায়সন্তানদের চেহারাটা যেন সাসপেকটেড টি বি পেশেন্টদের মত সকরুণ হয়ে উঠেছে অবিকল। স্তাবকতায় বাধে না। সামান্য স্বার্থের জন্যও স্তাবকতা করতে পারে। এরা আজ চুরি করে গাছ কাটে। আজ ঝগড়া করে কাল এসে গড়িয়ে পড়ে সামান্য স্বার্থের জন্য। নারীর কাছে এদের দাম হয়েছে বিষাক্ত পোকার মতো। তারা ঘেন্নাই করে, ভয় পর্যন্ত করে না সাপ কি বাঘ বলে। বললাম, না, ও-বিষয়ে আমি কোন আপত্তি তুলব না। তুমি ঘরখানার দরজা-জানালা লাগিয়ে দাও। মিস্টার ঘোষ প্রায় নির্বাসিত বিরহী যক্ষ হয়ে উঠেছেন—ভয় হচ্ছে সেটেলমেন্টের পরচা থেকে সেগুলো পরচা-ভূত হয়ে না দাঁড়ায়। ক্রোধবশে এর নাম কেটে ওর নাম না বসিয়ে দেন।
খুব হেসে উঠল কল্যাণেশ্বর, অযথা উচ্চহাসি। তারপর বললে, ওই চিঠিগুলো থেকে কি খুঁজছ বল দেখি?
—খুঁজছি কিছু, ঠিক বিষয় নয়।
—তবে?
—রায়বাড়ীর ইতিহাস জানতে চাচ্ছি।
—তা কি চিঠিপত্রে পাবে?
—তা পাব।
কল্যাণেশ্বর বললে, তাহলে তোমাকে সন্ধান দি সুরেশ্বরদা। দেখগে ঠাকুরের গহনা থাকত যে আয়রনচেস্টে, সেটার মধ্যে অনেক চিঠি আছে। সেসব রায়বাহাদুর রত্নেশ্বর রায় রেখে দিয়েছিলেন। মিথ্যে বলব না, দুখানা ডায়রীর মত ছিল, একখানা রায়বাহাদুরের, একখানা বীরেশ্বর রায়ের, আমার বাবা তো দাম বুঝতেন, তিনি রেখেছিলেন। কিন্তু তিনি যখন খুন হলেন, তখন যে সে কে নিলে? কে নিলে কেন, নিলে বেজোদা নিয়েছে। না হলে হারিয়েছে!
আমি তার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, খুঁজে দেখো কল্যাণ, আমাকে দিলে আমি এক হাজার টাকা পর্যন্ত দেব।
অবাক হয়ে গেল কল্যাণেশ্বর।
প্রণবেশ্বর বললে, তুমি ঠিক কি খুঁজছ বলবে?
বললাম, বিশ্বাস করবে?
—বল।
—প্রথম, নিজের বংশের কথা কে না জানতে চায় বল! দ্বিতীয়, রক্তের মধ্যে একটা কি আছে। সেটা কি জানতে চাই। বিষয় চিরকালের নয় বড়দা, সে সবাই জানে। আমি খুঁজছি আমার বাবার কেন এমন হল? আরও অনেকের ওই পাপ দেখতে পাচ্ছি। তোমাদের কথাও আমার অজানা নয়। হয়তো বলবে এটা মানুষের পাপ। হয়তো তাই। কিন্তু এ বংশের পুণ্য তো কম নয়! তবু কি করে পাপ কোথা থেকে এল? একে আমি বড় ভয় পাই বড়দা।—কেন পাই? এই আর কি পাগলামি বলতে পার।
হাতটা উল্টে দিলে প্রণবেশ্বর। অর্থাৎ কিছুই বুঝলাম না।
কল্যাণেশ্বর বললে, ঠাকুরের সিন্দুক খুলে দেখ, অনেক কাগজ-চিঠিপত্রের গাদা পাবে। মেজঠাকুমা এসে দাঁড়ালেন। চাবি তো তোকে দিয়েছি সুরেশ্বর। তুই সিন্দুকটা খুলে আজ দেখ। কল্যাণকে হাজার টাকার কথা যখন বলেছিস, তখন এখুনি নিজে গিয়ে দাঁড়িয়ে বের করে আন, নইলে আজ রাতেই কেউ সিন্দুটাকে ভেঙে ফেলবে।