জানোয়ারওয়ালা

এক সার্কাসওয়ালার ছেলে—বয়স তার ষোল বৎসর—সে স্কুলের ছুটিতে বাড়ি এসেছিল। সেখানে সে রোজ সিংহের খাঁচার কাছে দাঁড়িয়ে থাকত আর দেখত সিংহকে কেমন করে খেলা শেখায়। যে লোকটা সিংহের খেলা দেখাত, সে একটা সিংহের উপরে ভারি অত্যাচার করত—সিংহটাকে না খাইয়ে, মারধোর করে, গরম লোহার ছ্যাঁকা দিয়ে সে নানারকমে কষ্ট দিত। দেখে ছেলেটির ভয়ানক রাগ হল; সে তার বাবার কাছে গিয়ে সেই লোকটার নামে নালিশ করল। কিন্তু তার বাবা সে কথা হেসে উড়িয়ে দিলেন; বললেন, “ওরকম না করলে সিংহ কি পোষ মানে?” তারপর, অনেকদিন এই অত্যাচার সয়ে সয়ে একদিন সিংহটা সত্যি সত্যিই ক্ষেপে গিয়ে সে দুষ্টু খেলোয়াড়কে সাংঘাতিকরকম জখম করে দিল।

তখন সেই ছেলে তার বাবাকে বলল, “কাল থেকে আমি সিংহের খেলা দেখাব।” তার বাবা এ কথা শুনে তাকে দুই ধমক দিয়ে দিলেন। কিন্তু ছেলেরও জেদ কম নয়, পরদিন সকালে দেখা গেল সে বেশ নিশ্চিন্ত হয়ে সিংহের খাঁচায় ঢুকে বসে আছে! প্রথমটা সকলে খুবই ভয় পেয়েছিল কিন্তু ক্রমে দেখা গেল যে, সিংহের সঙ্গে তার এমন ভাব হয়ে গেছে যে ভয়ের কোন কারণ নেই। এই ছেলে এখন পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বড় ‘জানোয়ারওয়ালা’। এঁর নাম ফ্রাঙ্ক বোস্টক।

একটি সিংহ নিয়ে আরম্ভ করে এখন প্রায় চল্লিশটিতে দাঁড়িয়েছে। এক-এক সময়ে পঁচিশ ত্রিশ বা পঁয়ত্রিশটি সিংহকে একসঙ্গে জড়ো করে তামাসা দেখান হয়। অবশ্য সিংহগুলি সবই পোষা, কিন্তু তা হলে কি হবে—তবু ত সিংহ। সিংহ কি বাঘ হাজার পোষ মানলেও তাকে ভয় করে চলতে হয়। সামান্য একটু কারণে হঠাৎ একটু ভয় পেলে বা চমকে উঠলে তারা হাঠাৎ ক্ষেপে গিয়ে সাংঘাতিক কাণ্ড করে ফেলতে পারে। একবার একজন খেলোয়াড় একটা নতুনরকমের পোশাক পরে খাঁচায় ঢুকেছিল বলে তার সিংহটা তাকে তেড়ে কামড়াতে গিয়েছিল—খেলোয়াড় তখন পোশাক বদলিয়ে পুরান পোশাক পরে এসে তারপর খাঁচায় ঢুকতে পেল। আর একবার এক মেমসাহেব একসঙ্গে পাঁচ-সাতটা সিংহের খেলা দেখাতে গিয়ে এইরকম বিপদে পড়েছিলেন। সেদিন তাঁর হাতে একটা ফুলের তোড়া ছিল, একটা সিংহ তাই দেখে বোধহয় মাংস না কি মনে করে হঠাৎ তার উপর থাবা মেরে বসেছে। এই এইটি থাবায় মেমসাহেবের গালের আর হাতের মাংস শুদ্ধ উঠিয়ে নিয়েছে আর অমনি চক্ষের নিমেষে সবক’টা সিংহ একেবারে হাঁ হাঁ করে ফুলের তোড়াটার দিকে তেড়ে এসেছে। মেমসাহেব তখন বুদ্ধি করে তোড়াটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন তাই রক্ষা, তা নইলে অতগুলো সিংহের হুড়াহুড়ির মধ্যে পড়ে তাঁকে আর বাঁচতে হত না! যাহোক, ফুলটা মাটিতে পড়তেই সিংহগুলো তাকে নেড়ে শুঁকে নাক সিঁটকিয়ে আবার যে যার জায়গায় ফিরে গেল!

একবার বার্মিংহাম শহরে বোস্টক সাহেবের একটা সিংহ খাঁচা থেকে পালিয়ে রাস্তায় এসে হাজির হয়েছিল। শহরের মধ্যে হুলুস্থুল পড়ে গেল, রাস্তায় লোকজনের চলাফেরা বন্ধ হয়ে গেল। দোকানীরাও তাদের দোকানপাট খুলতে চায় না। সিংহটা এদিক ওদিক ঘুরে শেষটায় একটা প্রকাণ্ড ড্রেনের নর্দমায় গিয়ে ঢুকে বসল, আর সেখান থেকে সে বেরোতে চায় না। সেই নর্দমার ভিতর দিয়ে সে রাস্তার নীচে চলাফিরা করে আর মাঝে মাঝে ডাক ছাড়ে। রাত দুপুরে মাটির নীচ থেকে ঐরকম গুরুগম্ভীর আওয়াজ—অবস্থাখানা কিরকম বুঝতেই পার। শেষটা নর্দমার মুখে একটা খাঁচা বসিয়ে সিংহটাকে তাড়িয়ে সেটার মধ্যে নেবার কথা হল। কিন্তু অনেক তাড়া করেও সিংহটাকে নড়ান গেল না। সকলের চিৎকার, বড় বড় পাথরের আঘাত আর লম্বা লম্বা বাঁশের খোঁচা সেসব সহ্য করে সে চুপচাপ বসে রইল। তারপর কুকুর লিলিয়ে দেওয়া হল, বোস্টক সাহেব নিজে তার নাকের আগায় এক ঘা জুতা মেরে আসলেন কিন্তু সিংহ সেখান থেকে নড়ে না। সকলে যখন হয়রান হয়ে পড়েছে এমন সময় একজন লোকের হাত থেকে একটা বালতি কেমন করে ফস্‌কে গিয়ে গড়গড় শব্দ করে নর্দমার মধ্যে গড়িতে গিয়েছে। সেই আওয়াজ শুনে সিংহমশাই এক দৌড়ে ল্যাজ গুটিয়ে একেবারে খাঁচার মধ্যে। এর একবার একটা পলাতক সিংহকে পটকা ছুঁড়ে ভয় দেখিয়ে খাঁচার মধ্যে ঢোকান হয়েছিল। সুতরাং সিংহের যেমন একদিকে খুব সাহস, আর একদিকে তেমনি ভয়ও আছে বলতে হবে। বোস্টক সাহেব বলেন, মানুষের যেমন নানারকমের মেজাজ থাকে—কেউ ঠাণ্ডা কেউ চটা, কেউ হাবাগোছের কেউ চট্‌পটে—এইসব জানোয়ারদেরও তেমনি। এক একটা সিংহের চালচলন বুদ্ধুশুদ্ধি এক-এক রকমের।

কোনটা পোষ মানে একেবারে কুকুরের মতো—কোনটা হয়ত কোনকালেই ঠিকমত পোষ মানে না—তাকে সর্বদা চোখে চোখে রাখতে হয়। সিংহ পশুরাজ, তাই তার কথাই বেশি করে বললাম, কিন্তু জানোয়ারের মধ্যে হাতির সম্মানও বড় কম নয়। বিশেষত বিলাতে ও আমেরিকায়—যেখানে হাতি সর্বদা দেখা যায় না—সেখানে লোকে হাতিকে খুবই খাতির করে। বোস্টক সাহেবের কতগুলো হাতি আছে, তাদের তোয়াজ করবার জন্য অনেকগুলি চাকর সর্বদা লেগে আছে। আমাদের দেশে হাতিগুলো তোজ স্নান করবার সময় অনেকক্ষণ জলে কাদায় মাটিতে গড়াগড়ি করতে ভালোবাসে—তাতে নাকি তাদের গায়ের চামড়া খুব ভাল থাকে। কিন্তু ঠাণ্ডা দেশে সব সময় সেরকম স্নানের সুবিধা না থাকায় তাদের চামড়া শুকিয়ে কড়া হয়ে ফেটে যায়। সেইজন্য মাঝে মাঝে তাদের রীতিমত ভালোরকম স্নানের বন্দোবস্ত করে দিতে হয়। হাতির পক্ষে ‘রীতিমত স্নান’ কাকে বলে, তার একটু নমুনা শোন। প্রথম কোন পুকুর বা বড় চৌবাচ্চার জলে হাতিটাকে নামিয়ে দেওয়া হয়। সেখানে কয়েক ঘণ্টা থাকলে পর তাকে ডাঙায় এনে কড়া বুরুশ দিয়ে তার গায়ে কয়েক ঘণ্টা খুব করে সাবান ঘষে তাকে আবার জলে নামান হয়। তারপর আবার সাবান ঘষা, আবার জলে নামান। এইরকম তিন-চারবার করা হয়—তাতে প্রায়ই দু-চার দিন সময় লাগে, আর সাবান খরচ হয় প্রায় ২৫ সের। তারপর চামড়াটাকে আগাগোড়া একরকম ঝামা দিয়ে ঘষে কয়েকদিন ধরে তাতে বেশ করে তেল লাগান হয়—এক পিপে জলপাইয়ের তেল। এতেও তার সখ মেটে না—এর পরে তার নখগুলি একটি একটি করে উকা দিয়ে ঘষে পালিশ করে তাকে ফিটফাট করে দিতে হয়। এইরকমে একটি হাতির পিছনে এক সপ্তাহ ধরে পাঁচ-সাতটি লোককে রীতিমত পরিশ্রম করতে হয়। সৌভাগ্যের বিষয়, এরকম সাংঘাতিক স্নান সব সময় দরকার হয় না—বছরে দু-চারবার করে যথেষ্ট।

বোস্টক সাহেবের লোক পৃথিবীর চারিদিকে জানোয়ারের সন্ধানে ঘুরে বেড়ায়। একবার একটা গরিলার ছানা বিলাতে আনা হয়েছিল—বোস্টক সাহেব অনেক দরদস্তুরের পর প্রায় ষোল হাজার টাকায় সেটাকে কিনে নিয়েছিলেন, কিন্তু দুঃখের বিষয় তাকে বেশিদিন বাঁচিয়ে রাখতে পারেননি। তার চাইতে শিম্পাঞ্জির খেলা দেখিয়ে তিনি অনেক বেশি নাম করেছেন। তাঁরই পোষা শিম্পাঞ্জি ‘কন্‌সাল’ বিলাতের বড় বড় থিয়েটারে তামাসা দেখিয়ে লোকের তাক লাগিয়ে দিয়েছিল। ‘কন্‌সাল’কে বোস্টকের লোকেরা ঠিক মানুষের মতো খাতির করত। তার নিজের চাকর, নিজের থাকবার ঘর, টেবিল চেয়ার, কাপড়চোপড়, আসবাবপত্র সব ছিল। তাকে যখন তামাসা দেখাবার জন্য বড় শহরে নেওয়া হত তখন তার জন্য রীতিমত হোটেলের ঘর ভাড়া করা হত—আলাদা শোবার ঘর, বসবার ঘর, স্নানের ঘর ইত্যাদি। তার আদব-কায়দা খুব দুরস্ত। তার বাড়িতে যদি তার সঙ্গে দেখা করতে যাও, সে রীতিমত চেহার থেকে উঠে তোমার সঙ্গে ‘হ্যান্ডশেক’ করবে, তোমাকে টুপি রাখবার জায়গা দেখিয়ে দেবে— তারপর হয়ত পেয়ালা এনে তোমার জন্যে গম্ভীরভাবে চা ঢালতে বসবে। প্রথম যে শিম্পাঞ্জিকে বোস্টক সাহেব এইসব শিখিয়েছিলেন, তারই নাম ছিল কন্‌সাল, সে অনেকদিক হল মারা গিয়েছে—কিন্তু তার জায়গায় অন্য শিম্পাঞ্জিকে শিখিয়ে নেওয়া হয়েছে—তারও নাম দেওয়া হয়েছে কন্‌সাল।


© 2024 পুরনো বই