‘পেকারি’ কি জান? দক্ষিণ আমেরিকায় একরকম শুয়োর আছে তার নাম পেকারি। আমাদের দেশী এক-একটা বড়ো-বড়ো বরাহের কাছে পেকারি যেন কুকুরের পাশে ইঁদুরটা। বেশ বড়ো একটি পেকারি হয়তো একটি সাধারণ ছাগলের চাইতে বড় হবে না। কিন্তু পেকারিকে ভয় করে না, এমন জানোয়ার সেদেশে কম আছে। তার কারণ পেকারিরা সব সময় বড়ো-বড়ো দল বেঁধে ঘুরে বেড়ায়। এক-একটা দলে এক-এক সময় চল্লিশ-পঞ্চাশটা পর্যন্ত পেকারি থাকতে দেখা যায়।
পেকারির প্রধান শত্রু ‘জাগুয়ার’। যতরকম চিতে বাঘ আছে তার মধ্যে এই জাগুয়ারই ইতে বড়ো আর ভয়ানক। কিন্তু পেকারির দল সামনে পড়লে জাগুয়ার পর্যন্ত মানে মানে পথ ছেড়ে পালায়। একবার একদল সাহেব দক্ষিণ আমেরিকার জঙ্গলে শিকার করতে গিয়েছিলেন। হঠাৎ একটা প্রকাণ্ড ঝোপের মধ্যে থেকে এমনি ভয়ানক ফোঁস ফোঁস ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ আসতে লাগল যে, তারা ব্যস্ত হয়ে চটপট গাছে উঠে পড়লেন। উচুতে উঠে তাঁরা দেখেন, একটা ভাঙা গাছের ডালের উপর এক জাগুয়ার চড়ে বসেছে—আর তার চারিদিকে পেকারির দল ভয়ানক গোল বাধিয়ে তুলেছে। জাগুয়ারটা যেখানে বসেছে, ততদূর পর্যন্ত তাদের নাগাল পৌঁছায় না, তাই তারা কেবল রাগের মাথায় ফোঁস ফোঁস্ করছে। আর গাছের গোড়ায় ঢু মারছে। মাঝে মাঝে এক-একটা লাফ দিয়ে জাগুয়ারটাকে গুতো লাগাবার চেষ্টা করছে। কয়েকটা গাছে উঠতে গিয়ে বার বার পড়ে যাচ্ছে, তবু ছাড়ছে না। ঘণ্টার পর ঘণ্টা এইরকম থেকে জাগুয়ারটার বোধ হয় একটু পরিশ্রম হয়েছিল। সে যেই একটু নড়ে বসতে গেছে, অমনি তার একটা পা হড়কিয়ে ঝুলে পড়েছে। যেমন ঝোলা অমনি একটা পেকারি গিয়ে তার দাঁত দিয়ে এক ঘা বসিয়ে দিয়েছে। জাগুয়ারটাও একেবারে ক্ষেপে গিয়ে, এক লাফে পেকারিগুলোকে ডিঙিয়ে একটা ঝোপের মধ্যে লাফিয়ে পড়ল। কিন্তু পড়ে আর তাকে উঠতে হল না, মাটিতে ঠেকার সঙ্গে সঙ্গে পেকারির পাল তার উপর পড়ে, তাকে মাড়িয়ে খেলিয়ে গুঁতিয়ে আঁচড়িয়ে কামড়িয়ে তাকে টুকরো টুকরো করে ফেলল। জাওয়ারটা যতক্ষণ বেঁচেছিল, ততক্ষণ সে ধস্তাধস্তি করতে ছাড়ে নি। কিন্তু তার উপরে এতগুলো শুয়োর চেপেছিল যে, মাটিতে পড়বার পর আর তাকে চোখেই দেখা যায় নি। শুয়োরগুলি যদি তাকে আর কিছু নাও করত, তবু শুধু চাপের চোটেই মেরে ফেলতে পারত। জাগুয়ারটা মরে যাবার পরেও পেকারিদের রাগ থামে নি। তারা প্রায় আধঘণ্টা পর্যন্ত, থেকে থেকে পাগলের মতো তার উপর তেড়ে যাচ্ছিল। তার পর যখন পেকারির দল চলে গেল তখন দেখা গেল এগারোটা পেকারি মরে পড়ে আছে, আর জাগুয়ারের রক্ত চামড়া মাংস আর হাড় চারিদিক ছড়িয়ে পড়েছে।
পেকারিরা যখন শত্রুর সামনে পড়ে, তখন তারা ধনুকের মতো গোল হয়ে তার দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। যদি শত্রু আপনা থেকে সরে পড়ে তবে ভালোই। কিন্তু সে যদি একটুও তেজ দেখাতে চেষ্টা করে, তবে আর রক্ষা নেই। দলকে দল তার উপর পড়ে তাকে আর আস্ত রাখবে না। সেইজন্যে জাগুয়ারেরা কখনো ইচ্ছা করে পেকারির দলকে ঘাটাতে চায় না; অথচ পেকারির মাংস তার অতি প্রিয় খাদ্য। জাগুয়ার সাধারণত গাছের উপর পাতার আড়ালে চুপচাপ লুকিয়ে থাকে। যদি দৈবাৎ এক-আধটা পেকারি দল থেকে একটু এদিকে ওদিকে গিয়ে পড়ে সে এক লাফে তার ঘাড় ভেঙে আবার দৌড়ে গাছের উপর উঠে বসে, সেই সঙ্গে পেকারির দলও একেবারে চীৎকার করতে করতে সেই গাছের চারিদিকে এসে জড়ো হয়। জাগুয়ার ততক্ষণে বেশ একটি উঁচু ডালের উপর হাত পা ছড়িয়ে বিশ্রাম করতে থাকে। পেকারির দল সারাদিন কেবল চীৎকার আর দাপাদাপি করুক, তাতে তার ভ্রুক্ষেপ নেই। যখন তারা চলে যাবে, তখন সেও সুযোগ বুঝে সেই আগের মারা পেকারিটাকে খেতে নামবে।
অনেক সময়ে নদীর ধারে কাদার মধ্যে গাছের গুড়ির উপর পেকারির দল হুড়াহুড়ি করে খেলে বেড়ায়। সেইখানে কাদামাখা কাঠের চেলার মতো কুমির হাত-পা গুটিয়ে শুয়ে থাকে। সে আবার আমাদের দেশের কুমিরের চাইতেও চটপটে-এই দেখছ মড়ার মতো, এর পরেই হয়তো দেখবে পাঁচ হাত লাফ দিয়ে জলের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। পেকারির দল এদিক-ওদিক ঘুরেটুরে যখন সেইদিকে অসে, কুমিরও ল্যাজটিকে টান করে ভাবে ‘এইবার সময় এসেছে’। যদি দৈবাৎ এক-আধটা পেকারি খেলতে খেলতে সেই ল্যাজের উপর উঠে পড়ে, তবে আর রক্ষা নেই। নিশ্চয় দেখবে, তার পরের মুহর্তেই ল্যাজের এক ঝাপটায় পেকারিভায়া ডিগবাজি খেয়ে শুন্যে উঠেছেন, তার পর শুন্যে থাকতে থাকতেই ৩০৪ সেই সাংঘাতিক ল্যাজ চাবুকের মতো ছুটে এসে, আবার এক বাড়িতে তাকে কাদার মধ্যে আছাড় মেরে ফেলতে।
ব্যাপারটা কি হল, দলের সবাই সেটা ভালো করে বুঝবার আগেই, কুমির তার শিকার মুখে নিয়ে আচ্ছা করে ঝাঁকানি দিয়ে জলের মধ্যে নেমেছে। এদিকে পেকারির দল তেরে এসে দাঁত উঁচিয়ে তারের কাছে গল হয়ে দারিয়ে একটিবার কুমিরের চেহারাটি দেখেই একেবারে চার পা তুলে দে দৌড়। ঐ একমাত্র জানোয়ার যার কাছে পেকারির দল ঘেষতে সাহস পায় না।
সেদেশের লোকেরা সে পেকারিকে খুব হিসাব করে চলে, তা সহজেই বুঝতে পার। একলা পেলেও কেউ তাকে সহজে ঘাটাতে চায় না; কারণ কাছেই তার দলটি আছে কিনা জানবে কি করে? সুতরাং পেকারির সামনে যদি কখনো পড়, তবে তার কিছু করবার আগে সুবিধা মতো একটি গাছের উপর চড়ে বসাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।
সন্দেশ —শ্রাবণ, ১৩২৩