গরিলা

গরিলা থাকে আফ্রিকার জঙ্গলে। গাছের ডালপালার ছায়ায় সে জঙ্গল দিনদুপুরেও অন্ধকার হয়ে থাকে; সেখানে ভালো করে বাতাস চলে না, জীবজন্তুর সাড়াশব্দ নাই। পাখির গান হয়তো কচিৎ কথন শোনা যায়। তারই মধ্যে গাছের ডালে বা গাছের তলায় লতাপাতার মাচা বেঁধে গরিলা ফল-মূল খেয়ে দিন কাটায়। সেদেশের লোকে পারতপক্ষে সে জঙ্গলে তোকে না—কারণ গরিলার মেজাজের তো ঠিক নেই, সে যদি একবার ক্ষেপে দাঁড়ায়, তবে বাঘ ভালুক হাতি তার কাছে কেউই লাগে না। বড়ো-বড়ো শিকারী, সিংহ বা গণ্ডার ধরা যাদের ব্যবসা, তারা পর্যন্ত গরিলার নাম শুনলে এগোতে চায় না।

পৃথিবীর প্রায় সবরকম জানোয়ারকেই মানুষে ধরে খাঁচায় পুরে চিড়িয়াখানায় আটকাতে পেরেছে—কিন্তু এ পর্যন্ত কোনো বড়ো গরিলাকে মানুষে ধরতে পারে নি। মাঝে মাঝে দুটো একটা গরিলার ছানা ধরা পড়েছে কিন্তু তার কোনোটাই বেশিদিন বাঁচে নি।

একবার এক সাহেব একটা গরিলার ছানা পুষবার চেষ্টা করেছিলেন, সেটার বয়স ছিল দু-তিন বৎসর মাত্র। তিনি বলেন, তার চাল-চলন মেজাজ দুষ্পষ্টুমি বুদ্ধি ঠিক মানুষের খোকার মতো। তাকে যখন ধরে খাচায় বন্ধ করে রাখা হত, তখন সে মুখ বেজার করে পিছন ফিরে বসে থাকত। যে জিনিস সে খেতে চায় না সেই জিনিস যদি তাকে খাওয়াতে যাও, তবে সে চীৎকার করে মাটিতে গড়াগড়ি দিয়ে হাত-পা ছড়ে অনর্থ বাধিয়ে বসবে। একদিন তাকে জোর করে ওষুধ খাওয়াবার জন্য চারজন লোকের দরকার হয়েছিল। তাকে যখন জাহাজে করে আফ্রিকা থেকে ইউরোপে আনানো হয়, তখন তাকে প্রায়ই জাহাজের উপর ছেড়ে দেওয়া হত কিন্তু সে কোনোদিন কারও অনিস্ট করে নি। তবে জাহাজের খাবার ঘরের পাশে যে একটা আলমারি ছিল, যার মধ্যে চিনি থাকত আর নানারকম মিষ্টি আচার ইত্যাদি রাখা হত সেই আলমারিটার উপর তার ভারি লোভ ছিল। কিন্তু সে জানত যে ওটাতে হাত দেওয়া তার নিষেধ, কারণ দু-একবার ধরা পড়ে সে বেশ শাস্তি পেয়েছিল। তার পর থেকে যখন তার মিস্টি খেতে ইচ্ছা হত তখন সে কখনো সোজাসুজি আলমারির দিকে যেত না, প্রথমটা যেত ঠিক তার উলেটাদিকে, যেন কেউ কোনোরকম সন্দেহ না করে। তার পর একটু আড়ালে গিয়েই এক দৌড়ে বারান্দা ঘুরে একেবারে আলমারির কাছে উপস্থিত। একবার একটা গরিলার ছানাকে চিড়িয়াখানায় রাখা হয়েছিল। চিড়িয়াখানায় নানারকম অদ্ভুত জন্তু দেখতে তার খুব মজা লাগত—কোনো কোনোটার খাঁচার কাছে দাড়িয়ে সে খুব মন দিয়ে তাদের চাল-চলন দেখত। একটা শিম্পাঞ্জির বাচ্চা ছিল, সে নানারকম কসরৎ জানত—সে যখন ডিগবাজি খেয়ে বা হটোপাটি করে নানারকম তামাশা দেখাত, গরিলাটা ডারি খুশি হয়ে তার কাছে এসে বসত।

 

গরিলার চেহারাটা মোটেও শান্তশিস্ট গোছের নয়—মানুষের মতো লম্বা, চওড়ায় তার দ্বিগুণ, গায়ের জোর তার দশটার মতো—তার উপর সে যখন রাগের চোটে চীৎকার করে নিজের বুকে কিল মারতে মারতে এগুতে থাকে তখন তার সেই শব্দ আর মুখভঙ্গি আর রকমসকম দেখে খুব সাহসী লোক পর্যন্ত ভয়ে আড়স্ট হয়ে যায়। কিন্তু মানুষ দেখলেই গরিলা তেড়ে মারতে আসে না—বরং সে অনেক সময়ে মানুষকে এড়িয়েই চলতে চায়। কিন্তু তুমি যদি একেবারে তার বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত হও তো সে কি করে বুঝতে পারে যে তোমার কোনোও দুস্ট মতলব নাই? বিশেষত লোকে যখন লাঠিসোটা নিয়ে হৈ হৈ করে জঙ্গলে হাজির হয়, তাতে যদি গরিলা খুশি না হয়, তবেই কি তাকে হিংস্র বলতে হবে?

সন্দেশ-কাতিক, ১৩২১


© 2024 পুরনো বই