নােবেলের দান

পাঁচ বৎসর আগে যখন ইউরোপ হইতে সংবাদ আসিল যে, বাংলার কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘নোবেল প্রাইজ’ পাইয়াছেন, তখন দেশময় একটা উৎসাহের ঢেউ ছুটিয়াছিল। ‘নোবেল প্রাইজ’ জিনিসটা কি তাহা অনেকেই জানি না, তাহারা সে বিষয়ে আগ্রহ করিয়া খোঁজ করিতে লাগিল।

আলফ্রেড বের্নহার্ড নোবেল সুইডেন দেশের একজন রাসায়নিক ছিলেন। তিনি মৃত্যুকালে প্রায় সওয়া তিনকোটি টাকার সম্পত্তি দান করিয়া যান। যাঁহার বিজ্ঞান- জগতে নূতন তত্ত্ব আবিষ্কার করেন, যাঁহারা সাহিত্যের উন্নতি করেন এবং বিশেষভাবে যাঁহারা জগতে শান্তি স্থাপনের সহায়তা করেন, প্রতি বৎসর তাঁহাদের সম্মানের জন্য এই সম্পত্তির অয় হইতে নোবেল প্রাইজ নামে লক্ষাধিক টাকার অর্ঘ্য দেওয়া হয়। যে-কোনো দেশের যে-কোনো লোক এই অর্ঘ্যলাভের যোগ্য হইলেই তাহা পাইতে পারেন।

এই নোবেল লোকটির জীবনের কাহিনী বড় অদ্ভুত। দুর্বল স্বাস্থ্য লইয়া রুগ্ণ ভগ্ন দেহে তিনি সারাজীবন কাটাইয়াছিলেন। একদিকে তিনি অত্যন্ত ভীরু ও নিরীহ ভালোমানুষ ছিলেন, সামান্য দুঃখ, কষ্ট বা উত্তেজনায় বিচলিত হইয়া পড়িতেন, কিন্তু অপরদিকে তাঁহার মনের এমন অসাধারণ বল হিল, ঘোর বিপদের মধ্যে ও রোগের যাতনার মধ্যে তিনি শান্তভাবে কাজ করিয়া যাইতেন। সমস্ত জীবন তিনি বোমা ও বারুদের মশলা লইয়া নানারকম পরীক্ষা করিয়াছেন। এই পরীক্ষায় যে সকল সময়ে প্রাণটি হাতে করিয়া চলিতে হয়, তাহা তিনি জানিতেন; ইহাতে যে অনেক লোকের প্রাণ গিয়াছে তাহাও তাঁহার জানা ছিল, কিন্তু সে চিন্তা তাঁহাকে নিরস্ত করিতে পারে নাই।

আলফ্রেড নোবেলের পিতা রুশিয়ার যুদ্ধ কারখানার কারিকর ছিলেন। গোলাবারুদ লইয়া তাঁহার করিবার, এবং সেই কাজে বালক নোবেলও তাঁহার সহায় ছিল। কেবল যে যুদ্ধের কাজেই বারুদের ব্যবহার হয় তা নয়। তার একটি মস্ত কাজ পাহাড় ভাঙা। রেলপথ বসাইবার জন্য এবং রাস্তাঘাট বা সুড়ঙ্গ খুঁড়িবার জন্য অনেক সময়ে পাহাড় ভাঙিয়া সমান করিতে হয়। কোদাল ঠুকিয়া এই কাজ করিতে গেলে অসম্ভবরকম পরিশ্রম ও সময় নষ্ট করিতে হয়। সাধারণ বারুদের সাহায্যে এ কাজ অনেকটা সহজ হয়, কিন্তু বারুদের তেজও সব সময়ে এ কাজের পক্ষে যথেষ্ট নয়। নোবেলের সময়েও অনেক জিনিসের কথা লোকে জানিত, যাহার তেজ বারুদের চাইতেও ভয়ানক কিন্তু এই-সমস্ত জিনিস এত সামান্য কারণে ফাটিয়া যায় যে তাহাকে কাজে লাগাইতে কেহ সাহস পাইত না। কাজ করিতে গিয়া সামান্য একটু গরম বা সামান্য একটু আঁচড় অথবা ধাক্কা লাগিলেই ঘরবাড়ি উড়িয়া এক প্রলয়কাণ্ড বাধিয়া যাইত। নোবেল ডিনামাইট আবিষ্কার করিয়া সে অসুবিধা দূর করেন। ডিনামাইটের শক্তি সাধারণ বারুদের চাইতে আটগুণ বেশি অথচ তাহাকে লইয়া সাবধানে নাড়াচাড়া করিলে কোনো ভয়ের কারণ নাই।

 

ডিনামাইট ছাড়াও তিনি আরো অনেকরকম বারুদের মশলা আবিষ্কার করেন। আজকাল কামানের গোলা ছুঁড়িবার জন্য যে-সকল প্রচণ্ড বারুদ ব্যবহার হয় তাহাও নোবেলের আবিষ্কারের ফল। এই-সমস্ত সাংঘাতিক জিনিসের কারবারের জন্য নোবেল বড়ো-বড়ো কারখানা বসাইয়া পৃথিবী জুড়িয়া প্রকাণ্ড ব্যবসা চালাইয়া, তাহাতে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করিয়াছিলেন। একবার একটি কারিকরের অসাবধানতায় সমস্ত কারখানাটি উড়িয়া যায় এবং অনেক লোক মারা পড়ে ও অনেক লক্ষ টাকা নষ্ট হয়। তাহাতেও নোবেলের উৎসাহ দমে নাই—তিনি অবাির নূতন করিয়া কারখানা করাইলেন এবং এরূপ দুর্ঘটনা যাহাতে আর না হয়, তাহার জন্য অনেক সুন্দর বন্দোবস্ত করিলেন। সে কারখানা আজও চলিতেছে।

কারখানার ভিতরে যদি ঢুকিয়া দেখ, তাহা হইলে বুঝিবে ‘সাবধান হওয়া’ কাহাকে বলে। যে-সকল স্থানে বিপদের সম্ভাবনা সেখানে প্রত্যেক ঘরের চারিদিকে মাটি উঁচু করিয়া পাহাড়ের মতো দেওয়াল দেওয়া হইয়াছে। ঘরগুলি খুব হালকা করিয়া তৈয়ারি, তাহার মেজের উপর পুরু করিয়া চট মোড়া। যাহারা কাজ করে, তাহাদের পায়ে কাপড়ের জুতা—কোথাও কোনো শব্দ করিবার নিয়ম নাই। সেখানে আগুন জ্বালানো দূরে থাকুক, কারখানার ত্রিসীমানার মধ্যে দিয়াশলাই আনিতে দেওয়া হয় না। কোনোরকম লোহার জিনিস সেখানে অনা নিষেধ, কাঁটাপেরেক গর্ষ আনিবার উপায় নাই। এইরকমের অসংখ্য নিয়ম নিষেধ মানিয়া তবে কারখানা চালাইতে হয়। ভগ্ন শরীরে এইরকম সাংঘাতিক জিনিসের কারবার করিয়া নিত্য বিপদের মধ্যে যাঁহার জীবন কাটিল, ১৮৯৬ খৃস্টাব্দে মৃত্যুকালে তাঁহার শেষ চিন্তা হইল এই যে, জগতে শান্তি স্থাপনের জন্য, এবং জ্ঞান ও আনন্দের বিস্তারের জন্য উপায় করিতে হইবে। তাহারই ফলে, এই নোবেল প্রাইজ।

কিন্তু কেবল এই দানই নোবেলের শ্রেষ্ঠ দান নয়। ডিনামাইট প্রভৃতি যে-সমস্ত রাসায়নিক অস্ত্র তিনি জগতকে দিয়া গেলেন, সেও বড়ো সামান্য দান নয়। যুদ্ধের কথা ছাড়িয়া দিলেও দেখা যায় যে, সভ্য মানুষের যে-সমস্ত বড়ো-বড়ো কীতি, তাহার অনেকগুলিই সহজ ও সম্ভব হইয়াছে কেবল নোবেলের ঐ অস্ত্রের গুণে। মাটি উড়াইয়া পাহাড় ফাটাইয়া পাথর সরাইয়া পথঘাট রেলপুল বসানো হইতেছে, খালকাটিয়া নদীর পাড় ভাঙিয়া জলের স্রোতকে নানাদিকে চালানো হইতেছে, সমুদের সঙ্গে সমুদ্র জুড়িয়া নুতন নুতন জপথের সৃষ্টি হইতেছে, খনি ব্যবসায়ী খনি খুঁড়িতে গিয়া পাঁচ মাসের কাজ পাঁচ মিনিটে সারিতেছে, সভ্য দেশের চাষা বিনা লাঙলে সামান্য পরিশ্রমে বড়ো-বড়ো জমি ফুঁড়িয়া চষিয়া ফেলিতেছে।

 

নেপোলিয়ান যখন ইটালি বিজয় করিতে চলিলেন তখন সকলে বলিয়াছিল, “কি অসম্ভব কথা! এই দুরন্ত শীতে তুমি সৈন্য লইয়া আল্পস পাহাড় পার হইবে কিরূপে?” নেপোলিয়ান বালিয়াছিলেন, “There shall be no Alps!” “অল্পস পাহাড় থাকিবে না’ —অর্থাৎ সে আমায় বাধা দিতে পারিবে না। নেপোলিয়ান আল্পস পার হইয়া চলিয়া গেলেন। তাহার পর প্রায় শতবৎসর পরে যখন ফ্রান্স, ইটালি ও সুইজারল্যাণ্ডের মধ্যে আল্পস পাহাড় ভেদ করিয়া রেলপথ বসানো হইতেছিল, তখন নোবেলও বলিতে পারিতেন, “There shall be no Alps!” লক্ষ যুগের পাহাড়ের বাঁধন একটি রুগ্নদেহ দুর্বল মানুষের বুদ্ধির কাছে পরাস্ত হইয়া ঝরিয়া পড়িল।

সন্দেশ—আশ্বিন, ১৩২৫


© 2024 পুরনো বই