হেথা ইন্দ্রালয়ে নন্দন-ভিতর পতিসহ প্রীতিসুখে নিরন্তর, দানব-রমণী করিছে ক্রীড়া। রতি ফুলমালা হাতে দেয় তুলি, পরিছে হরিষে সুষমাতে ভুলি, বদন-মণ্ডলে ভাসিছে ব্রীড়া।। মদন-সজ্জিত কুসুম-আসন, চারিদিকে শোভা করিছে ধারণ, বিচিত্র সৌন্দর্য সুরভিময়। হাসিছে কানন ফুলশয্যা ধরি স্থানে স্থানে মৃত্তিকা-উপরি কতই কুসুম-পালঙ্ক রয়।। কত ফুল-ক্ষেত্র চারিদিকে শোভে, মুনি ভ্রান্ত হয় কান্তি হেরি লোভে, রেখেছ কন্দর্প করিতে খেলা। বসন্ত আপনি সুমোহন বেশ, ফুটাইছে পুষ্প কত সে আবেশ, হয়েছে অপূর্ব-শোভার মেলা।। দানব-রমণী ঐন্দ্রিলা সেখানে, শোভিতে মোহিত বিহ্বলিত প্রাণে ফুলে ফুলে ফুলে করিছে কেলি। করিছে শয়ন কভু পারিজাতে, মৃদুল মৃদুল সুশীল বাতে, মুদিলা নয়ন কুসুমে হেলি।। বসিছে কখন অনুরাগভরে, ইন্দ্রিরা-কমল-পর্যঙ্ক-উপরে, দৈত্যপতি হাসে পারশে বসি। হাসে মনসুখে ঐন্দ্রিলা সুন্দরী, রতিদত্ত মালা করতলে ধরি, বসনবন্ধন পড়িছে খসি।। মূর্তিমান্ ছয় রাগ করে গান, রাগিণী ছত্রিশ মিলাইছে তান, সঙ্গীত-তরঙ্গে পীযূষ ঢালি। স্বরে উদ্দীপন করে নবরস, পরশ, আঘ্রাণ, সকলি অবশ, শ্রবণ-ইন্দ্রিয়-ব্যাপৃত খালি।। ভ্রমে রতিপতি সাজাইয়া বাণ, কুসুম-ধনুতে সু-ঈষৎ টান, মুচকি মুচকি মুচকি হাসি। নাচে মনোরমা স্বর্গ বিদ্যাধরী, কন্দর্প-মোহন বেশ-ভূষা পরি, বিলাস-সরিৎ-তরঙ্গে ভাসি।। এইরূপে ক্রীড়া করে দৈত্য সনে, দৈত্যজায়া সুখে নন্দন কাননে, বৃত্রাসুর সুখে বিহ্বল-প্রায়। ধরি অনুরাগে পতি-করতল, কহে দৈত্যজায়া নয়ন চঞ্চল, হাব ভাব হাসি প্রকাশ তায়– “শুন দৈত্যেশ্বর, শুন শুন বলি, বৃথা এ বিলাস বৃথা এ সকলি, এখন(ও) আমরা বিজিত নয় বিজিত যে জন, বিজয়ী-চরণ, নাহি যদি সেবা করিল কখন, সে হেন বিজয়ে কি ফলোদয়।। “তুমি স্বর্গপতি আজি দৈত্যেশ্বর, আমি তব প্রিয়া খ্যাত চরাচর, ধিক্ লজ্জা তবু সাধ না পূরে। কটাক্ষে তোমার আশুপ্রাপ্য যাহা, তব প্রিয় নারী নাহি পায় তাহা, তবে সে কি লাভ থাকি এ পুরে? “স্বয়ংবরা হয়ে করেছি বরণ, হেরিয়া তোমাতে মহেন্দ্র-লক্ষণ, ইচ্ছাময়ী হব হৃদয়ে আশ। সে ইচ্ছা যখন ধরিবে হৃদয়, তখনি সফল হবে সমুদয়, জানিব না কারে বলে নৈরাশ।। “ত্যজি নিজকুল গন্ধর্ব ছাড়িয়া, বরিলাম তোমা যে আশা করিয়া, এবে যে বিফল হইল তাহা! নিষ্ফলা বাসনা হৃদয়ে যাহার, কিবা স্বর্গপুরী, কিবা মর্ত্য আর, যেখানে সেখানে নিয়ত হা হা!! কিবা সে ভূপতি, কিবা সে ভিখারী, কাঙ্গালী সে জন যেখানে বিহারী, প্রাণের শূন্যতা ঘুচে না কভু। পতিত্বে বরণ করিয়া তোমায় তবু সে বাসনা পূরিল না হায়, আমার(ও) এ দশা ঘটিল তবু।। ভাল ভেবে যদি বাসিতে হে ভাল, সে বাসনা পূর্ণ হ’ত কত কাল, সহিতে হ’ত না লালসা জ্বালা। ভালবাসা এবে কিসে বা জাগাই, দিয়াছি যা ছিল, সে যৌবন নাই, ভালবেসে বেসে হয়েছি আলা।। ইন্দ্রাণী যদি সে করিত বাসনা, না পূরিতে পল পূরিত কামনা, মরি সে ইন্দ্রের লয়ে বালাই। প্রণয়ী যে বলে প্রণয়ী ত’ সেই, না চাহিতে আগে হাতে তুলে দেই, সে প্রণয়ে এবে পড়েছে ছাই।।” বলিয়া নেহারে পতির বদন, আধ ছল-ছল ঢলে দু-নয়ন, অভিমানে হাসি জড়ায়ে রয়। শুনি দৈত্যেশ্বর বলে ধীরে ধীরে “কি বলিলে প্রিয়ে বল শুনি ফিরে, প্রেয়সী নারীর এ দশা নয়? কি দোষে ভর্ৎসনা করিছ আমায়, না দিয়াছি কহ কিবা সে তোমায়, অদেয় কিবা এ জগতী-মাঝ? দিয়াছি জগৎ চরণের তলে, কৌস্তভ যেমতি মাণিকমণ্ডলে, তুমিই তেমনি নারীতে আজ।। কে আছে রমণি তুলনা ধরিতে, বিভব ঐশ্বর্য গৌরব খ্যাতিতে, তোমার উপমা কাহাতে হয়? আর কি লালসা বল তা এখন আছে কিবা বাকী দিতে কোন্ ধন, কি বাসনা পুনঃ হৃদে উদয়?” কহিলা ঐন্দ্রিলা–“দিয়াছ যে সব, জানি হে সে সব বিভব-গৌরব, তবু সর্বজন-পূজিতা নই। মণিকুলে যথা কৌস্তভ মহৎ নারীকুলে আমি তেমতি মহৎ, বল দৈত্যরাজ হয়েছি কই? এখনও ইন্দ্রাণী জগতের মাঝে, গৌরবে তেমনি সুখেতে বিরাজে এখনও আয়ত্ত হ’লো না সেহ। স্বর্গের ঈশ্বরী আমি সে থাকিতে, কিবা এ স্বরগ কিবা সে মহীতে, শচীর মহত্ত্ব ভুলে না কেহ।। রতিমুখে আমি শুনিনু সেদিন, সুমেরু এখন হয়েছে শ্রীহীন, শচীর সৌন্দর্য দেহে না ধরি। ইন্দ্রাণী যখন আছিল এখানে, অমর-সুন্দরী সকলে সেখানে, থাকিত হেমাদ্রি উজ্জ্বল করি।। শুনেছি না কি পরমা রূপসী, বড় গরবিনী নারী গরীয়সী, চলনে গৌরব ঝরিয়া পড়ে। গ্রীবাতে কটিতে স্ফারিত উরসে, কিবা সে বিষাদ কিবা সে হরষে, মহত্ত্ব যেন সে বাঁধে নিগড়ে।। শচীরে দেখিব মনে বড় সাধ, ঘুচাইব চক্ষু-কর্ণের বিবাদ, আমার চিত্তের বাসনা এই। থাকিবে নিকটে শিখাবে বিলাস, ধরিব অঙ্গেতে নবীন প্রকাশ, ভুলাতে তোমার শিখাবে সেই।। আসিবে যথেক অমর-সুন্দরী, শচী সঙ্গে অঙ্গে দিব্য বেশ ধরি, অমর-কৌতুক শিখাবে ভালো। এই বাঞ্ছা চিতে শুন দৈত্যপতি, শচী দাসী হবে দেখিবে সে রতি, হয় কি না পুনঃ সুমেরু আলো।।” শুনে বৃত্রাসুর ঈষৎ হাসিয়া, কহিল ঐন্দ্রিলা-নয়নে চাহিয়া, “এই ইচ্ছা প্রিয়ে হৃদে তোমার?” বলিয়া এতেক দানব-ঈশ্বর, কন্দর্পে ডাকিয়া জিজ্ঞাসে সত্বর, “কোথা শচী এবে করে বিহার?” কহিলা কন্দর্প মুখে চির-হাসি “অমরা বিহনে এবে মর্ত্যবাসী, নৈমিষ-অরণ্যে শচী বেড়ায়। সঙ্গে প্রিয়তমা সখী অনুগত, ভ্রমে অরণ্যেতে দুঃখেতে সতত, না পেয়ে দেখিতে সুমেরু-কায়।। কষ্টে করে বাস শচী নরলোকে, ইন্দ্র, ইন্দ্রালয়, ইন্দ্রত্বের শোকে অন্তরে দারুণ দুঃখহুতাশ।” শুনি দৈত্যপতি কহিলা, “সুন্দরি, পাবে শচীসহ শচী সহচরী, অচিরে তোমার পূরিবে আশ।।” ঐন্দ্রিলা শুনিয়া সহর্ষ হইলা, অধরে মধুর হাসি প্রকাশিলা, পতিকর সুখে ধরে অমনি। হাসিতে হাসিতে কন্দর্প আবার, ধনুকে ঈষৎ করিল টঙ্কার, শিহরে দানব দৈত্যরমণী।। পুনঃ ছয় রাগ রাগিণী ছত্রিশ, গীত-বৃষ্টি করে ভুলে আশীবিষ, নব নব রস বিভাস করি। পুনঃ সে ইন্দ্রিয় অবশ সঙ্গীতে, অসুর-অসুরী শুনিতে শুনিতে, চমকে চমকে উঠে শিহরি।। কভু বীর-রসে ধরিছে সুতার, দানব উঠিছে করি মার মার, আবার সমরে পশিছে যেন। অমর নাশিতে ধরিছে ত্রিশূল, আবার যেন সে অমরের কুল, বিনাশে সংগ্রামে ভাবিছে হেন।। কখন করুণা-সারিতে ভাসিয়া চলেছে ঐন্দ্রিলা নয়ন মুছিয়া, কখন অপত্য-স্নেহেতে ভোর। যেন সে কোলেতে হেরিছে কুমার, স্তনযুগে স্বতঃ বহে ক্ষীরধার, এমনি ত্রিদিব-সঙ্গীত ঘোর।। কভু হাস্যরস করে উদ্দীপন, কোথায় বসন কোথায় ভূষণ, ঐন্দ্রিলা উল্লাসে অধীর হয়। ক্ষণে পড়ে ঢলি পতির উৎসঙ্গে ক্ষণে পড়ে ঢলি ফুলদল-অঙ্গে, উৎফুল্ল বদন লোচনদ্বয়।। অমনি অপ্সরা হইয়া বিহ্বল, চলে ধীরে ধীরে তনু ঢল-ঢল, নেত্র করতল অলকা কাঁপে। ঈষৎ হাসিতে অধর অধীর, অঙ্গুলি-অগ্রেতে অঞ্চল অস্থির, টানিয়া অধরে ঈষৎ চাপে।। চারিদিকে ছুটে মধুর সুবাস, চারিদিকে উঠে হরষ-উচ্ছ্বাস, চারিদিকে চারু কুসুম হাসে। খেলে রে দানবী দানবে মোহিয়া, বিলাস-সরিৎ-তরঙ্গে ডুবিয়া, প্রমোদ-প্লাবনে নন্দন ভাসে।।